স্ত্রী ও পুরুষের প্রেমে বিশেষত্ব

আমার মনে হয় স্ত্রীলোকের প্রতি পুরুষের এবং পুরুষের প্রতি স্ত্রীলোকের ভালোবাসার মধ্যে মাত্রাভেদ নহে জাতিভেদ বর্তমান। পুরুষের ভালোবাসা সৌন্দর্যপ্রিয়তার সহিত সংযুক্ত, আর স্ত্রীলোকের ভালোবাসা নির্ভরপরতা সুতরাং ক্ষমতার প্রতি আসক্তি হইতে উৎপন্ন। পুরুষের যথার্থ ভালোবাসা Ideal-এর প্রতি এবং স্ত্রীলোকের যথার্থ ভালোবাসা Real-এর প্রতি। এ স্থলে Ideal এবং Real আমি হয়তো একটু বিশেষ অর্থে ব্যবহার করিতেছি। সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ Ideality-র সহিতই বিশেষরূপে সম্বন্ধ এবং ক্ষমতার প্রতি অনুরাগ Reality-র মধ্যে নিবিষ্ট। ক্ষমতার প্রতি অবলম্বন করা যায়, তাহার মধ্যে আপন দুর্বলতা বিসর্জন দিয়া বিশ্রাম লাভ করা যায়। কিন্তু সৌন্দর্যকে ধরা যায় না, তাহার প্রতি ভর দেওয়া যায় না, আমাদের পক্ষে তাহার যে কী উপযোগিতা তাহা সম্পূর্ণ জানি না, এই পর্যন্ত জানি যে, তাহার প্রতি আমাদের আত্মার একটি অনিবার্য আকর্ষণ আছে। স্পর্শনযোগ্য নির্ভরযোগ্য ছনতরভঢ়ঁ-র পক্ষে সৌন্দর্য অতি অক্ষম, তাহাকে সযত্নে সকাতরে রক্ষা করিতে হয়; তাহা আঘাতে ক্লিষ্ট হয়, উত্তাপে ম্লান হইয়া যায় কিন্তু Ideality-র পক্ষে তাহার অসীম প্রভাব, সমস্ত বলবুদ্ধি অবহেলে তাহার শরণাপন্ন হইয়া পড়ে। পুরুষ যখন রমণীকে ভালোবাসে তখন সেই ভালোবাসার মধ্যে সে সম্পূর্ণ বিরাম পায় না; যদিও তাহার ভালোবাসার মধ্যে একটি অনির্বচনীয় সুখ থাকে তথাপি কী একটা আকাঙক্ষাপূর্ণ সুগভীর বিষাদ ছায়ার ন্যায় তাহার অনুবর্তী হইয়া থাকে। কারণ সমুদয় যথার্থ সৌন্দর্যের মধ্যে একটি চিরনিলীন আকাঙক্ষা সর্বদা বিরাজ করিতে থাকে। যেমন ভালো গান শুনিলে প্রাণ উদাস হইয়া যায়, প্রকৃতির উদার সৌন্দর্য অনুভব করিলে হৃদয়ের মধ্যে ব্যাকুলতা জন্মে। বস্তুর মধ্যেই সৌন্দর্যের সমাপ্তি নহে, সে যেন আপন আশ্রয়স্থলকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করিয়া একটি অসীমতাকে ব্যাপ্ত করিয়া থাকে। আমরা বস্তুকে গ্রহণ করি, স্পর্শ করি, ঘ্রাণ করি, কিন্তু সেই অসীমতাকে আয়ত্ত করিতে পারি না। এইজন্য আমাদের কর্মের চঞ্চলতা দূর হয় না। এইজন্য আমরা ভ্রমবশত সহস্র বস্তুকে স্পর্শ করিয়া দেখিতে চাহি এবং সেই স্পর্শকেই সৌন্দর্যের ভোগ বলিয়া ভ্রম হয়, এবং এইরূপে ভ্রান্ত লোকের মন হইতে সৌন্দর্যের আধ্যাত্মিকতার প্রতি বিশ্বাস নিতান্ত শারীরিকতার মধ্যে হারাইয়া যাইতে পারে। এইজন্য পুরুষের প্রেমের চাঞ্চল্য ও ভোগপ্রিয়তা লোকবিখ্যাত। কিন্তু উচ্চশ্রেণীর পদার্থ মাত্রেরই মধ্যে পরিপূর্ণতা (Perfection) অতি বিরল। একটি গাছের মধ্যে তাহার অধিকাংশ ফুল ও পাতা তাহার আপনার মধ্যে সম্পূর্ণতা লাভ করিয়া সুন্দর হইয়া উঠে। কুশ্রী বেল জুঁই চাঁপা অতি দুর্লভ। কিন্তু মানুষের মধ্যে শারীরিক সর্বতোমুখী সম্পূর্ণতা বিরল। সেইরূপ, আমার বিশ্বাস, সৌন্দর্যপ্রিয়তা হইতে যে প্রেমের উৎপত্তি তাহা উন্নতশ্রেণীয় প্রেম। এইজন্য সাধারণত সেই প্রেমের চরম বিকাশ দেখা যায় না, এবং অধিকাংশ স্থলে তাহার বিকার লক্ষিত হয়। আমি অনুভব করি পুরুষের সম্পূর্ণ প্রেমের সহিত স্ত্রীলোকের প্রেমের তুলনা হয় না। পুরুষ যখন তাহার সমস্ত বলবুদ্ধি বৃহত্ত্ব কুসুমপেলব সৌন্দর্যের নিকট বিসর্জন দেয় তখন সেই প্রেমের মধ্যে একটি সুমহৎ রহস্য উদ্ভাবিত হইতে থাকে। প্রেম রমণীর পক্ষে বাস্তবিক আশ্রয়স্থল– এইজন্য সে তাহার মধ্যে পরিতৃপ্ত থাকে– ক্ষমতাকে সর্বতোভাবে কায়মনোবাক্যে অবলম্বন করিয়া সে পরিপূর্ণ বিশ্রাম লাভ করে। সৌন্দর্য তাহার হৃদয়কে চঞ্চল ও বিক্ষিপ্ত করে না। সে যাহা পাইয়াছে তাহার মধ্যেই তাহার আকাঙক্ষার অবসান। রমণী এই কারণে বিশেষ Practical। সে কিছু অসমাপ্ত দেখিতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত গল্পের সমস্ত হিসাব না চুকিয়া যায় ততক্ষণ সে জিজ্ঞাসা করে “তার পর’। শুদ্ধ কাল্পনিকতার প্রতি তাহার এক প্রকার বিদ্বেষ আছে। আমার সামান্য অভিজ্ঞতায় এই দেখিয়াছি রমণীরা প্রকৃত সাহিত্যের যথার্থ রসগ্রাহী ও সমালোচক হইতে পারে না।

রমণীর প্রেমের মধ্যে পরিতৃপ্তি আছে, বিশ্বাস আছে, নিষ্ঠা আছে, কিন্তু পুরুষের প্রেমের মধ্যে যে একটি চির অতৃপ্তিপূর্ণ অনির্বচনীয় সুখ আছে তাহা বোধ করি খুব অল্প রমণী উপভোগ করিয়াছে। সেই প্রেমে যেন মানবাত্মার অন্তর্নিহিত গভীর অমরতা হইতে এক অপূর্ব রাগিণীময় গান বাহিরের সৌন্দর্যময়ী অসীমতার দিকে কল্পিত হোমশিখার ন্যায় সর্বদা উত্থিত হইতে থাকে। প্রেমের অবস্থায় যত কবিতা এবং [গান তাহা] হৃদয় হইতেই বাহির হইয়াছে। সৌন্দর্যপ্রেমের মধ্যে সেই চিরচঞ্চলা শক্তি আছে যাহা হইতে কবিতা ও গান বাহির হইতে পারে– গভীর সুখ গভীর দুঃখ গভীর তৃপ্তির সহিত গভীর কামনার যোগে মানব হৃদয়ের এই-সকল কাতর গান জাগিয়া উঠে– প্রেমিক গাহিয়া উঠে–

“জনম অবধি হম রূপ নেহারনু নয়ন না তিরপিত ভেল,
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু তবু হিয়ে জুড়ন না গেল।’

কেহ কাহাকেও সত্য সত্যই লাখ যুগ হৃদয়ে হৃদয়ে রাখে নাই, কিন্তু উদ্দাম মুহূর্তের মধ্যে সেই লক্ষ যুগ রহিয়াছে। মনের মধ্যে অনুভব হয় যে, যে সৌন্দর্যের জন্যে হৃদয় কাতর লক্ষ যুগেও সে সৌন্দর্যের তৃপ্তি নাই কারণ তাহা অসীম।

পুরুষের কবিতায় স্ত্রীলোকের প্রেমের ভাব

যদিও যোগেশচন্দ্র শুনিয়া অত্যন্ত হাসিবেন তথাপি আমাকে স্বীকার করিতে হইবে যে, আমার Ideal সৌন্দর্য আমি কেবল স্ত্রীসৌন্দর্যের মধ্যেই দেখিতে পাই। যতবার আমি সুন্দরী স্ত্রী দেখি ততবারই আমার মনে এক বৃহৎ… উদয় হয়– আমি মনে মনে না বলিয়া থাকিতে পারি না “কী আশ্চর্য! কেমন করিয়া এমনটা হইল’! জগতের সমস্ত সৌন্দর্যের কেন্দ্রস্থলে আমি যেন এক লক্ষ্মীরূপিণী মানসী স্ত্রীমূর্তি দেখিতে পাই। কী পুষ্পলতার মতো লালিত্য, মাধুর্য পরিস্ফুটিত, কী গতির হিল্লোল! কী সর্বাঙ্গে হৃদয়ের বিকাশ! কী আপনার মধ্যে আপনার সামঞ্জস্য, আত্মসম্ভ্রম, ইতরসাধারণ হইতে নির্লিপ্ত অনিন্দ্য শোভন ভাব! সমস্ত সৌন্দর্যের মধ্যে কী একটি সুমধুর সংযম!

আমাদের দেশের বৈষ্ণব কবিরা অনেক স্থলে রাধিকার যে প্রেম বর্ণনা করিয়াছেন আমার বোধ হয় তাহা পুরুষের প্রেম, স্ত্রীলোকের প্রেম নহে। সৌন্দর্যের অতৃপ্তিভাব পুরুষের প্রেমেরই বিশেষ লক্ষণ– কৃষ্ণের প্রতি রাধিকার যে ব্যাকুল সৌন্দর্যমোহ তাহা পুরুষ কবির পুরুষভাব হইতে উত্থিত। উষাকে দেখিয়া ঋষিরা যেমন গান গাহিয়া উঠিতেন, কৃষ্ণের সৌন্দর্য দেখিয়া রাধা স্থানে স্থানে সেইরূপ গীতোচ্ছ্বাস প্রকাশ করিয়াছেন ইহা আমার অত্যন্ত বিপরীত বলিয়া বোধ হয়। পুরুষের মধ্যে সেই বিকশিত মঞ্জরিত পরিপূর্ণ সংহৃত হৃদয়ের ভাব দিয়া সুসংযত সৌন্দর্য মূর্তিমান হইয়া প্রকাশ পায় না, তাহাকে দেখিয়া যথার্থ সৌন্দর্যস্তব উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে পারে না। পুরুষ কবিরা এইরূপে অনেক সময়ে আত্মভাব স্ত্রীতে আরোপ করিয়া একপ্রকার অস্বাভাবিক সুখ অনুভব করে– তাহারা কল্পনা করে “আমরা উহাদিগকে যেরূপ আগ্রহের সহিত যেরূপ ভালোবাসিতেছি উহাদের কোমল হৃদয়ের মধ্য হইতে উহারাও আমাদিগকে অবিকল সেইরূপ ভালোবাসা দিতেছে।’ কিন্তু তাহা ঠিক নহে। উহারা আমাদিগকে আর-এক রকম করিয়া ভালোবাসে এবং ভালোবাসিয়া আর-এক রকম সুখ পায়। আমরা উহাদিগকে প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্যের সহিত মিলাইয়া উহাদের সীমা দূর করিয়া উহাদিগকে আয়ত্তের বাহির করিয়া সুখ পাই। আর উহারা আমাদিগকে সমস্ত হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া আমাদের সীমা নির্ধারণ করিয়া আপন আয়ত্তটুকুর মধ্যে আনিয়া সুখ পায়। আমরা আশ্রয়হীন আকাশে সুখী হই, উহারা পরিবৃত নীড়ে নির্ভর করিয়া সুখী হয়। আমাদিগকে উহারা দৃঢ়, আশ্রয়যোগ্য definite মনে করিয়াই ভালোবাসে, আমাদের মধ্যে দর্শনস্পর্শনাতীত অতিলৌকিক অসীম suggestiveness দেখিয়া যে ভালোবাসে তাহা নহে।

ধর্মে ভয়, কৃতজ্ঞতা ও প্রেম

প্রথম প্রথম প্রকৃতির মধ্যে একটা প্রবল শক্তি দেখিয়া আমরা ঈশ্বরকে অনুভব করিতাম ও সভয়ে তাঁহার নিকট নত হইতাম। তাহার পরে প্রকৃতির মধ্যে করুণার ভাব, লালন-পালনের ভাব দেখিয়া ঈশ্বরের সহিত বাধ্যবাধক সম্বন্ধে কৃতজ্ঞতা সূত্রে পিতার প্রতি পুত্রের কর্তব্যপাশে বদ্ধ হইলাম। তাহার পরে প্রকৃতিতে সৌন্দর্য দেখিয়া ঈশ্বরের সহিত প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপিত হইল। প্রেমের সম্বন্ধের মধ্যে “কেন’ “কী বৃত্তান্ত’ নাই– তুমি সুন্দর বলিয়া তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে না ভালোবাসিয়া থাকিতে পারি না বলিয়া ভালোবাসি। তুমি রাজা বলিয়া পিতা বলিয়া নহে, তুমি আত্মার আনন্দ বলিয়া।

মনে হয় ঈশ্বরের প্রতি এই সৌন্দর্যপ্রেম চরম আধ্যাত্মিকতা। কারণ, ইহাতেই আত্মার নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা। বৈষ্ণব ধর্ম এই প্রেমের ধর্ম।

১৯। ১১। ১৮৮৮, পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *