স্ত্রী
সংস্কৃত প্রবচনে আছে, স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী। এই প্রবচনটি একটি শ্লোকের শেষাংশ। সম্পূর্ণ সংস্কৃত শ্লোকটি হল;
আত্মবুদ্ধি শুভকরী
গুরুবুদ্ধি বিশেষতঃ।
পরবুদ্ধি বিনাশায়
স্ত্রীবুদ্ধিঃ প্রলয়ঙ্করী ॥
এই শ্লোকের মানে হল, নিজের বুদ্ধি শুভকারী, বিশেষত গুরুর বুদ্ধি কিন্তু পরের বুদ্ধিতে বিনাশ হয় আর স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী।
এই স্ত্রীবুদ্ধির স্ত্রী সম্ভবত স্ত্রীজাতির স্ত্রী নয়, স্বামী-স্ত্রীর স্ত্রী। এই স্ত্রী ঠাকরুন এবার আমাদের এই রম্য নিবন্ধের বিষয়। বিষয়টি পুরননা, ইতিপূর্বে একাধিকবার এই বিপজ্জনক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছি, আবার সাহসে ভর করে স্ত্রীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি।।
প্রথমে সুশিক্ষিতা স্ত্রীকে ধরে শুরু করি।
লাখকথার এককথা বলেছিলেন সেই খরবুদ্ধি ইংরেজ মহামতি স্যামুয়েল জনসন। জনসনের বক্তব্য ছিল, একজন মানুষ তৃপ্ত হয় যদি তার নৈশভোজ উত্তম হয়। তার স্ত্রীর গ্রিকভাষায় ভাল কথা বলতে পারার চেয়ে উত্তম নৈশভোজ তার পক্ষে অনেক বেশি তৃপ্তিকর।
সংস্কৃত শ্লোক থেকে স্যামুয়েল জনসন পর্যন্ত দ্রুত পর্যটন করে আসা গেল। এবার চিরাচরিত হালকা গল্পে ফিরে যাই।
প্রথমেই সেই পুরনো গল্পটি স্মরণীয়। ঠিক গল্প নয়, এক নির্বোধ স্বামীর উক্তি, বহুকথিত, বহুলিখিত (আমি নিজেই অন্তত এর আগে তিনবার লিখেছি)।
ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। এক ভদ্রলোকের স্ত্রী একদিন খুব সাজগোজ করেছে, খুব প্রসাধন করেছে, ভদ্রলোক স্ত্রীর এই রূপ দেখে মুগ্ধ। যাকে বল একেবারে গদগদ।
এবং অবশেষে কথাটি বলেই ফেললেন নিজের স্ত্রীকে। ‘ওগো আজকে যে তোমাকে একেবারে পরস্ত্রীর মতো দেখাচ্ছে।’
স্ত্রীঘটিত বিলিতি গল্পেই মজা বেশি।
এক মেমসাহেব তাঁর প্রতিবেশিনীর কাছে নালিশ করেছিলেন যে তাঁর পতিদেবতা প্রত্যেকদিন বহু রাত করে বাড়ি ফেরেন। হাজার রকম চেষ্টা করেও তিনি স্বামীর এই রাত করে বাড়ি ফেরা বন্ধ করতে পারেননি।
প্রতিবেশিনী বললেন, “শোনো তুমি আমার পরামর্শ নও। আমার বরও এক সময়ে খুব দেরি করে রাতে ফিরত, প্রায় রাত কাবার করে। অনেক চেষ্টা করেও, অনেক অনুনয় বিনয়, রাগারাগি, চোখের জল, কথা বন্ধ—কিছুতেই কোনও কাজ হল না। তখন বাধ্য হয়ে একটা বুদ্ধি বার করলাম।’
বলা বাহুল্য, এরপর ওই মেমসাহেব তাঁর প্রতিবেশিনীর কাছে বুদ্ধিটা কী জানতে চাইলেন।
প্রতিবেশিনী যা বললেন তা চমৎকার, একদিন রাতে তাঁর স্বামী যথারীতি প্রায় রাত কাবার করে বাড়ি ফিরেছেন, তিনি তখন বিছানায় শুয়ে, স্বামীর পায়ের শব্দ শুনে বন্ধ চোখের পাতা না খুলেই তিনি বললেন, ‘কে? স্যামুয়েল এতক্ষণে এলে?’
একথা শুনে মেমসাহেব বললেন, কিন্তু তাতে কী হল? এই এক জিজ্ঞাসাতেই আপনার স্বামী ভাল হয়ে গেল?
‘হ্যাঁ, তাই হল। প্রতিবেশিনী মৃদু হেসে বললেন, ‘আসলে আমার বরের নাম তো স্যামুয়েল নয়, ওর নাম জন। ও ভাবল কে না কে স্যামুয়েল নামে একটা লোক—ও যখন রাতের বেলায় থাকে না তখন আমার কাছে আসে। তারপর আর কেউ রাতে বাইরে থাকে?
এ গল্পটা কিঞ্চিৎ গোলমেলে। এর পরের গল্পটা কিঞ্চিদধিক গোলমেলে।
দুই বন্ধু পার্কে বসে গল্প করছিল। বিকেল হয়েছে। গাছের ছায়া পড়েছে মাঠে। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে কিন্তু এক বন্ধু, তার নাম সুরনাথ, তার কিছুই ভাল লাগছে না। আসলে তার ভয়ংকর মাথা ধরেছে, যন্ত্রণায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছে।
সুরনাথ তার দু’হাত দিয়ে কপালের দু’দিকের দুটো শিরা চেপে ধরে গুম মেরে বসে আছে, গল্প-টল্প কিছুই তার বিশেষ ভাল লাগছে না।
সুরনাথের বন্ধু দিবানাথ সুরনাথের এই অবস্থা দেখে বলল, “আমারও কয়েকদিন আগে খুবই মাথা ধরেছিল। অনেক বেদনাহর ট্যাবলেট, মলম, মাথাবধায়া, স্নান অডিকোলন—কিছুতেই কোনওরকম উপশম হয়নি।’
তারপর দিবানাথ একটু লজ্জিতভাবে বলল, ‘অবশেষে বউয়ের কোলে মাথা দিয়ে আধঘণ্টা শুয়ে রইলাম, বউ শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় একটু হাওয়া করল। আর, কী আশ্চর্য! মাথাধরাটা একদম ছেড়ে গেল। তারপর থেকে মাথা পরিষ্কার, একেবারে হালকা হয়ে গেছে।’
এই কথা শুনে সুরনাথ উঠে দাঁড়াল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর বউ এখন বাসায় আছে, এখন গেলে পাওয়া যাবে?’
বিস্মিত হয়ে দিবানাথ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন? আমার বউকে দিয়ে কী হবে?’
সুরনাথ বলল, “দ্যাখ, আমিও তো মাথাধরার বড়ি, অডিকোলনের প্রলেপ, আশ্চর্য মলম— সবরকম চেষ্টা করে দেখেছি। কিন্তু কিছুতেই তো কিছু হল না। এখন তুই যা বললি, শেষ চেষ্টাটুকু করে দেখি। তোর বউয়ের কোলে আধঘণ্টা মাথা রেখে শুয়ে থাকি, তোর বউ একটু শাড়ির আঁচল দিয়ে হাওয়া করুক, দেখি মাথাধরাটা যায় কিনা?’
পুনশ্চ :
সংস্কৃত শ্লোক দিয়ে এই নিবন্ধ শুরু করেছিলাম, সংস্কৃত শ্লোক দিয়েই শেষ করি।
স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করীর মতোই এই শ্লোকটিও বহু বিখ্যাত, স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি শ্লোকটি স্মরণীয়,
শ্রদ্ধধানঃ শুভাং বিদ্যাম
আদদীপ্রাবরাদপি
অন্ত্যাদপি পরং ধর্মং
স্ত্রী রত্নং দুষ্কুলাদপি
অর্থটা পরিষ্কার, তবু সোজা করে বলি, ‘নিজের থেকেও নিকৃষ্ট লোকের কাছ থেকে শুভ বিদ্যা গ্রহণ করা যায়, অন্ত্যজ জাতির কাছে থেকেও ধর্মশিক্ষা নেওয়া যায় এবং খারাপ বংশ থেকেও স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করা যায়।’