1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৭

সাত

এই সম্বোধনে বিস্মিত হলো না রানা। এ দেশে এভাবে কথা বলে লোকে। তবে কৃষ্ণাঙ্গিনীর আন্তরিক হাসি যে একেবারেই খাঁটি, তাতে একবিন্দু সন্দেহ থাকল না ওর মনে। ওর নিজের ঠোঁটেও এসে গেল হাসির সংক্রমণ।

রানা গেস্টহাউস খুঁজছে শুনেই হাতের ইশারায় ওকে বাড়ির ভেতর ডেকে নিল লিয বাউয়ার। এন্ট্রান্স হলে পা রেখেই রানার মনে হলো, বহু দিন পর বেড়াতে এসেছে আপন বোনের বাড়িতে। ফুলদানীতে রঙিন, চমৎকার সব ফুল। ঘরে হালকা সুবাস।

‘শুগাহ্, তুমি কোথা থেকে এসেছ? কথার উচ্চারণে তো মনে হচ্ছে লেখাপড়া করেছ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। আমি কি ঠিক বললাম, ডিয়ারি?’

‘ওই ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন পড়েছি,’ বলল- রানা। *তবে মানুষটা আমি বাংলাদেশি।’

‘আচ্ছা? দক্ষিণ এশিয়ায় না? আমি ওই সুন্দর দেশটার কথা শুনেছি।’ রহস্যময় হাসল লিয বাউয়ার। এ বিষয়ে আর কিছু না বলে জানাল, ‘এসো, আগে তোমার ঘর দেখিয়ে দিই।’

পুরু কার্পেট ছাওয়া এন্ট্রান্স পেরিয়ে মহিলার পিছু নিল রানা। চকচকে মেহগনি কাঠের তৈরি খাড়া সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল দু’জন। রেলিঙে হাত রেখে একটু দূরে সাদা এক দরজা দেখাল লিয বাউয়ার। ‘ওই যে, আমাকে পাবে ওই ঘরে। বেলও বাজাতে পারো।’

লিয বাউয়ারের ঘর ছাড়া এ তলায় রয়েছে আরও তিনটে ঘর। দরজার চৌকাঠে তামার প্লেটে নম্বর লেখা।

‘আপাতত অন্য গেস্ট নেই। তিন ঘরের যে-কোনটা নিতে পারো।’ নিজের ঘরের পাশের দরজাটা দেখাল সে। ‘ওটা নেবে?’

‘তেতলায় কিছু আছে?’ ল্যাণ্ডিঙের আরেকদিকে কা সরু সিঁড়ি দেখে জানতে চাইল রানা। সিঁড়ির ওপরের ধাপ গিয়ে মিশেছে গোল করে কাটা সিলিঙে।

‘ওটা চিলেকোঠা। ছাত একটু বেশি নিচু।’

‘চিলেকোঠা আমার সবসময় ভাল লাগে,’ বলল রানা।

‘তা হলে চলো, ঘরটা দেখিয়ে আনি।’

চিলেকোঠা তৈরি করা হয়েছে দক্ষতার সঙ্গে। সব কিছুতেই নিজের সুন্দর রুচির ছাপ রেখেছে লিয় বাউয়ার। ওপরতলায় উঠে যাওয়ার পর পুলিতে বাঁধা দড়ি টেনে তুলে নেয়া যায় কাঠের ভাঁজ করা সিঁড়ি। এ ছাড়া, দ্বিতীয়তলার প্রথম, তৃতীয় এবং চতুর্থ ঘরও চমৎকার করে সাজানো। দেয়ালে ও সিলিঙে চকচকে কাঠের প্যানেল। মেঝেতে সুন্দর ডিযাইনের কার্পেট। তবুও সব ঘর ঘুরে তৃতীয়তলার ওই চিলেকোঠারই প্রেমে পড়ল রানা। ওটা যেন কাঠের তৈরি প্রাচীন কোনও জাহাজের কেবিন। ঘরের মাঝে পুরু তোষক বিছানো মাঝারি সাইজের লোহার খাট। একটু দূরে ছোট্ট টেবিলের ওপর রিডিং ল্যাম্প, সামনে আরাম কেদারা। একপাশে চওড়া জানালার ওদিকে দু’দিকে ঢালু ছাত। বাম দিকের ঢালের শেষে কয়েক ফুট দূরে আরেকটা ঢালু ছাতের শুরু। ওটা প্রতিবেশীর বাড়ির। আর ডান দিকে তাকালে পাশের বাড়ির ঢালু ছাতের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে কাদাপানি বুকে নিয়ে মন্থরগতিতে বাদামি সাপের মত এঁকেবেঁকে বহু দূরে গেছে বাইয়ু। জানালার দিকে পিঠ রেখে বলল রানা, ‘ব্যস, এই রুমই নেব।’

‘সমস্যা নেই। এখন থেকে এটা তোমার, শুগাহ্!’

রানাকে নিয়ে নিচতলায় স্যালোনে ফিরল লিয। নানান কায়দা করে রানার জন্যে লম্বা একটা গ্লাসে তৈরি করল ভাসা লেবু চা। ওটার স্বাদ মিষ্টি নয়, তবে এই গরমে তরলে চুমুক দিয়ে ভাল লাগল রানার। সামনের বড় এক আর্মচেয়ারে কীভাবে যেন বিশাল শরীরটা আঁটিয়ে ফেলল মহিলা। শুরু হলো গল্প।

একটু পর রানা বুঝে গেল, কথা বলতে ভালবাসে লিয বাউয়ার। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তার গলার আওয়াজ ও মজার মজার কথা শুনতে ভাল লাগছে ওরও। প্রতিটা কথা, প্রতিটা হাসি যেন আসছে মহিলার অন্তর থেকে।

মনে মনে বলল রানা, বড়বোন থাকলে বোধহয় এভাবেই কাটত সুন্দর সময়। এ-ও বুঝল, সারাদিন মানুষটার গল্প শুনতেও খারাপ লাগবে না ওর।

জীবনের বেশিরভাগ সময় চিটিমাচায় কাটিয়ে দিয়েছে লিয বাউয়ার। বারো বছর বয়সে ভিলেনিউভ শহর থেকে এখানে এসেছিল বাবা-মার সঙ্গে। তারপর যৌবনে প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছিল ভুল এক লোককে। বহু বছর তাকে শুধরে নেয়ার চেষ্টা করে একদিন বুঝল, জীবনটা চালিয়ে নেয়ার জন্যে নিজের কিছু করতে হবে ওকে। তখন চল্লিশ বছর বয়সে বেইমান স্বামীকে ত্যাগ করে শপথ নিল, আর একমিনিটও সময় নষ্ট করবে না। গত তিনবছর লেখাপড়া ও কাজ শেখার জন্যে ইউরোপের নানান দেশে ঘুরেছে। মাত্র কয়েক মাস আগে ফিরেছে লুইযিয়ানা স্টেটে।

‘গেস্টহাউস চালাবার ওপরে লেখাপড়া?’ জানতে চাইল রানা।

মৃদু হেসে জবাব দিল লিয বাউয়ার, ‘না তো, ডিয়ারি। আমি রান্না শিখছিলাম। গেস্টহাউস দিয়েছি কিছু দিনের জন্যে। আসলে ঠিক করেছি, কিছু টাকা জমাতে পারলেই রেস্টুরেন্ট খুলব। এমন একটা রেস্টুরেন্ট, যেখানে শত শত মাইল দূর থেকে খেতে আসবে মানুষ। আর ওই রেস্টুরেন্টের খাবারের কারণে একদিন ছোট্ট এই শহরের নাম উঠবে মানচিত্রে।’

ইউরোপে চরকির মত ঘুরেছে লিয। লণ্ডন, প্যারিস, রোমের মত বড় সব শহরের নামকরা রেস্টুরেন্টে হাঁড়ি পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে ওয়েট্রেসের কাজ করেছে। বেতনের টাকা ব্যয় করেছে রান্না শেখায়। গত তিনটে বছর কঠোর পরিশ্রম করে দক্ষতা অর্জন করেছে। তারপর পেয়েছে শেফের ডিপ্লোমা। এবার সময় হয়েছে নিজে কিছু করার। স্থানীয় ক্যাজুন খাবারের সঙ্গে ক্লাসিকাল পদ মিশিয়ে তৈরি হবে ওর মজাদার সব খাবার।

‘সে খাবার হবে দুনিয়ার যে-কোনও পদের থেকে আলাদা,’ জোর দিয়ে জানাল লিয।

‘এ দেশে এসে দেখছি শুধু খাবার নিয়ে হুলুস্থুল!’ হেসে ফেলল রানা। ‘চারপাশে ডিকি’স ক্রফিশ বা জনির তাজা কুনের মাংস! জাম্বালায়া, বাউডিন, গাম্বো বা গার বলের ছড়াছড়ি। তবে তোমার এখানে এসে এখনও শক্ত কিছু পেটে পড়েনি।’

‘আমরা সবাই পেটপূজা করতে ভালবাসি,’ হাসল লিয, ‘আমেরিকার সবচেয়ে পেট মোটাদের স্টেট এটা। আর আমরা তো এখনও ভাল করে খেতেই শুরু করিনি। আগে চালু করি আমার রেস্টুরেন্ট, তারপর দেখবে!’

‘গার বল আসলে কী?’ জানতে চাইল রানা।

‘একধরনের চপ, তৈরি করা হয় অ্যালিগেটর গার মাছের ফুসফুস ভেজে। খুব কুৎসিত মাছ। নদী থেকে ধরে আনে জেলেরা। জীবন্ত দুঃস্বপ্নের মত দেখতে। কিন্তু খেলে মনে হবে পৌঁছে গেছ স্বর্গে।’

শহরে আসার সময় দাঁতাল ভয়ঙ্কর এক দানব দেখেছে, মনে পড়ল রানার। মনে মনে বলল, জীবনেও ওই জিনিস খাব না! প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইল, ‘আর ওই গাম্বো জিনিসটা কী? এ ধরনের নাম এসেছে কোথা থেকে?’

বিস্ফারিত হলো লিযের দুই চোখ। আফসোস করে মাথা নাড়ল সে। ‘কী সর্বনাশের কথা, তুমি তো দেখি একেবারে অবোধ শিশু, রানা! বলতে চাইছ, আগে কখনও লুইযিয়ানার গাম্বো খেয়ে দেখোনি?’

মাথা নাড়ল রানা। ‘মনে তো পড়ে না।’

‘এক্কেবারে ঠিক জায়গায় এসেছ, হাঁড়িভরা মিষ্টি মধু, লক্ষ্মী ছেলে! এখন আমি জানি, আজ ডিনারে কী রাঁধব!’ খাঁকারি দিয়ে কণ্ঠ নিচু করল লিয, ‘ভাবতেও পারবে না ওটা কোন স্বৰ্গীয় জিনিস!’

কিন্তু রান্নার কাজ শুরুর আগে চাই জরুরি প্রস্তুতি।

লিয স্বীকার করল, গেস্টহাউস চালু করতে এত ব্যস্ত ছিল, খাবার-দাবার কিনতে পারেনি। কিচেন প্রায় ফাঁকা। লজ্জায় আরও কালো হয়ে গেল বেচারি 1

রাতে থাকার মত ঘর পেয়েই খুশি হয়ে গেছে রানা, এখানে খাবার পাবে ভাবেনি। সেটাই বলল, ‘চিন্তা কোরো না, লিয। কষ্ট করে রাঁধতে হবে না। এখানে আসার সময় একটা ক্যাফে দেখেছি। ওখান থেকে কিছু খেয়ে নেব।’

‘ভুলেও না,’ আঁৎকে উঠল লিয, ‘পেট খারাপ করবে!’

‘এতই খারাপ ওদের খাবার?’ বলল রানা। ও-ই জানে, জীবনে কত ধরনের বাজে জিনিস খেয়েছে বিপদে পড়ে।

বড়বোনের মত ঘন ঘন আমি চাই না আমার হোক।’ এবার জানাল, ‘খবরদার, বাইরে খাবে না, মাথা নেড়ে নিষেধ করল লিয। জীবনের প্রথম গেস্টের মহাবিপদ ডিনারের জন্যে চট করে বাজার থেকে তরকারী ও দরকারি অন্যান্য জিনিস কিনে আনবে। তাতে লাগবে দেড় ঘণ্টা। এরপর রান্না করতে বড়জোর আর একঘণ্টা। ‘আমি চট করে বাজার থেকে ঘুরে আসছি!’

‘আমার তো এখন কোনও কাজ নেই, তোমার সঙ্গে বাজার থেকে ঘুরে আসতে পারি,’ বলল রানা।

‘তা হলে একা সবকিছু বইতে হবে না। গুড! রাজি হয়ে গেল লিয়।

একটু পর গেস্টহাউস থেকে বেরোল ওরা।

ম্যাচবাক্সের সমান লিযের গাড়িটা। রানা প্রস্তাব দিতেই ওর গাড়িতে বাজারে যেতে রাজি হলো লিয। মার্সিডিয সেডানে চেপে রওনা হলো ওরা। পাশের বাড়ির বয়স্ক এক ভদ্রলোক হাত নাড়লেন লিষের দিকে। জবাবে মিষ্টি হাসি উপহার দিল লিয। মুখে বলল, ‘উনি মিস্টার রবিনসন। খুব ভাল মানুষ।

রানা বুঝে গেল, লিযের পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষই খুব ভাল। বাজার পার হয়ে যাচ্ছে দেখে তার দিকে তাকাল। উত্তরে আঙুল তুলে পশ্চিমের রাস্তা দেখাল লিয।

চিটিমাচা পেছনে ফেলে এগিয়ে চলল মার্সিডিয।

ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে চোখ টিপল লিয। নিচু গলায় জানাল, রেস্টুরেন্ট সফল হওয়ার জন্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে দূরের ওই পয়েন্ট ব্লাঞ্চের বাজার। ওখানে আছে দুর্দান্ত সব কাঁচা রসদ।

‘বুঝলে, রানা, ক্লোভিস প্যারিশের সবচেয়ে ভাল বাজার ওটা। ক্যাজুন রান্নার সব পদ পাওয়া যায় পানির দামে।’

মৃদু হেসে মাথা দোলাল রানা। মনে মনে ভাবল, ক্যাজুন স্টেকহাউসের খাবার মোটেও খারাপ ছিল না। তবে কে জানে, খেতে কেমন লাগবে ভয়ঙ্কর চেহারার ওই মাছটাকে!

একটু পর গাড়ি পৌছল চিটিমাচার চেয়েও ছোট এক বসতিতে। তবে এদিকটায় লোকজনের ভিড়ভাট্টা আছে।

‘রেস্টুরেন্ট তো এখানেই চালু করতে পারো,’ পার্কিং-এর জন্যে জায়গা খুঁজছে রানা। ‘মার্কেট কাছে। খদ্দেরও বেশি পাবে।’

কঠিন মুখ করে মাথা নাড়ল লিয। ‘না, বড় হয়েছি চিটিমাচায়। আমি মরতেও চাই ওখানে।’

পছন্দমত জায়গায় গাড়ি রাখল রানা। এখান থেকে তিন মিনিটের পথ বাজার। চট্ করে গাড়িতে তুলতে পারবে মালপত্র। গাড়ি থেকে নেমে লিযের গল্প শুনতে শুনতে বাজারের দিকে চলল রানা।

বাজারের আগে পড়ল একটা গাড়ি মেরামতের গ্যারাজ। সাইনবোর্ডে লেখা: হাম্পি ডাম্পি’য গ্যারাজ। ওখানে কাউকে দেখল না রানা। চেইন লিঙ্কের গেটে তালা মারা। ভেতরে এখানে-ওখানে নানান জাতের গাড়ির ইঞ্জিন নামিয়ে রাখা হয়েছে। গ্যারাজের পাশে আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান পেরোতেই সামনে বাজার। ওটা যেন আলাদিনের চেরাগের সেই গুহার মত।

একটা দোকানের সাইনবোর্ড পড়ল রানা। ওখানে বিক্রি হচ্ছে বাইয়ুর অ্যালিগেটরের বার্গার, কালো ক্যাট ফিশ ও ‘আবর্জনা’ দিয়ে মাখানো রোস্ট করা গরুর মাংস। ‘

আবর্জনা খাওয়াতে চায় কেউ, ভাবতে ভাল লাগল না রানার।

পুতুলের দোকানে ঢুকলে নয় বছরের বাচ্চা মেয়ের যে অবস্থা হয়, বাজারে ঢুকে সেই একই হাল হলো লিয়ের। একরাতের জন্যে যে টাকা লিযকে দেবে রানা, তার তিন গুণ খরচ করে ফেলল সে এক বেলার বাজারেই।

‘আমাকে ডিনার খাওয়াবার জন্যে এত কিছু কিনতে হবে কেন?’ আপত্তি তুলল রানা।

‘শ্‌শ্‌শ্! কথা বলে না, লক্ষ্মী ছেলে,’ বড়বোনের চোখে রানাকে দেখল লিয। চোখে হাসি।

আড়াই ঘণ্টা পর ক্যাজুনদের প্রিয় মাছ-মাংস ও তরকারীর ব্যাগ বয়ে গাড়ির দিকে চলল ওরা। আবারও পাশ কাটাল গাড়ি মেরামতের গ্যারাজ। এখন ওটার গেট খোলা। উঠানে জড় হয়েছে পাঁচ-ছয়জন যুবক। সোনার মত চকচকে একটা গাড়ি দেখছে তারা। ওটার তলি এতই নিচু, সামান্য উঁচু স্পিড ব্রেকার সামনে পড়লেই ফেঁসে যাবে।

যুবকদের একজনের চোখদুটো খুব কাছাকাছি। চেহারায় নীচতা। বিদঘুটে গাড়ির ওপর থেকে চোখ সরিয়ে লিযের দিকে তাকাল সে। মুখে ফুটল টিটকারির হাসি। রানা দেখল, তার দাঁত মারাত্মকভাবে পোকা খাওয়া। পাশের যুবকের পাঁজরে কনুইয়ের খোঁচা মেরে জোর গলায় বলে উঠল সে, ‘দেখেছিস? দেখ! বছরের সবচেয়ে মোটা, কালো শুয়োরাণী!’

কোমর ছুঁই-ছুঁই করছে তার সঙ্গীর মাথার চুল। হাত দিয়ে মাইক তৈরি করে রানার উদ্দেশে বলল সে, ‘অ্যাই, বাদামি মিস্টার, কালো গরিলাটাকে বেশি খাইয়ো না আবার!’

হাতের শপিং ব্যাগদুটো রাস্তায় নামিয়ে রাখল রানা। ঠিক করে ফেলেছে, কথাটা ফেরত না নিলে পিটিয়ে শুইয়ে দেবে সবক’টাকে। এমনভাবেই কাজটা সারবে, যাতে আগামী দুটো মাস হাসপাতাল ছাড়তে না পারে।

রানার কনুই চেপে ধরল লিয। চাপা স্বরে বলল, ‘চলো, যাই, রানা। পয়েন্ট ব্লাঞ্চে না থাকার এটা একটা কারণ। এদের মত একদঙ্গল শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী থাকে এখানে।’

‘হাড়গোড় ভাঙলে মানুষ হওয়ার সুযোগ পাবে,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল রানা।

‘বাদ দাও, বিড়বিড় করল লিয, ‘ওই লোক মণ্টি ডয়েল। অনেক লোককে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে।’

‘তা হলে চেনো ওকে?’ জানতে চাইল রানা।

‘এদিকের সবাই চেনে। খারাপ লোক। ওর সঙ্গে লাগতে গেলে ক্ষতিই হবে।’

‘ওর কথা পছন্দ হয়নি আমার,’ বলল রানা।

‘রাগ কোরো না, রানা,’ বলল লিখ। ‘দুনিয়ার সবার সঙ্গে তো লড়তে পারবে না। চলো, আমরা চলে যাই।’

মুখ টিপে হাসছে পাঁচ যুবক। শীতল চোখে দেখছে রানাকে। লম্বা চুলওয়ালা মণ্টি ডয়েল চিৎকার করল, ‘তুমি ভেবেছ ঝামেলা করবে, নাকি, হাঁদারাম?’

লড়তে হলে পাঁচজনের বিরুদ্ধে নামতে হবে। তাতে আপত্তি নেই রানার। পরস্পরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে তারা। প্রত্যেকের আলাদা বৈশিষ্ট্য খেয়াল করছে ও। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, লড়াই শেষ হবে পনেরো থেকে আঠারো সেকেণ্ডে।

‘চলো, সোনা ভাই, চলে এসো!’ আবারও রানার কনুই ধরল লিয। কণ্ঠে অনুরোধ, ‘বিপদে জড়িয়ে লাভ কী? চলো, যাই।’

‘ফিরতে আমার বেশিক্ষণ লাগবে না,’ বলল রানা।

ধীরপায়ে ওদের দিকে আসছে পাঁচ যুবক। কঠিন হয়ে উঠেছে চেহারা। মুঠো হয়েছে সবার দুই হাত। কুঁচকে গেছে ভুরু। আত্মবিশ্বাস ভরা সরু চোখে দেখছে রানাকে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, পাঁচ মিনিটে পিটিয়ে শুইয়ে দেবে বাদামি যুবককে। ভাল করেই জানে, আজও মারপিটে জিতবে তারা।

মৃদু হাসি ফুটল রানার মুখে।

ওই হাসি বেশিক্ষণ থাকবে না, স্ট্রেঞ্জার!’ বলল মণ্টি ডয়েল। ‘নিজের পায়ে হেঁটে যেতে পারবে না হাসপাতালে। আজকে তোমার কপাল মন্দ!’

‘কখনও হুইল চেয়ার ব্যবহার করেছ?’ তার কাছে জানতে চাইল রানা। ‘কাজটা কিন্তু বেশ কঠিন। তবে হাসপাতালে দুই মাস প্র্যাকটিসের সুযোগ পাবে।’

আরও কালো হয়েছে লিযের মুখ। ‘রানা, ভাই আমার, প্লিয,’ প্রায় ফিসফিস করল সে।

পকেট থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে লিয়ের হাতে দিল রানা। ‘তুমি গিয়ে গাড়িতে বসো তো, ঠিক একমিনিট পর ফিরছি।’

প্রথমে ডয়েলকে ধরবে, ঠিক করেছে রানা। তারপর শায়েস্তা করবে লিযকে গরিলা বলা বেয়াড়া যুবককে। এই দু’জনই চালিয়ে যাচ্ছে বাক্যবাণ। তার মানে, দলনেতা তারা। লিডার হচ্ছে ডয়েল। তার ডানহাত হচ্ছে নীচ চেহারার যুবক। কুকুরের মতই নিয়ম মেনে চলে এ ধরনের লোক। আলফা মেইল-এর পর হামলার দায়িত্ব নেবে বিটা কুকুর। নিচের সারির অন্যরা শুধু অনুসরণ করবে। হাত-পা চালাবে।

এসব নিয়ম ভাল করেই জানে রানা। যুদ্ধে প্রথমে শেষ করতে হয় ওপরের অফিসারদেরকে। আলফা ও বিটা হেরে গেলে পালিয়ে যাবে অন্যরা।

এখনও তা-ই হবে। মন্টি ডয়েল আর তার স্যাঙাৎ পিট্টি খেলে লেজ তুলে ভাগবে বাকিরা।

আবারও অনুরোধের সুরে বলল লিয, ‘প্লিয, লক্ষ্মী আমার, রানা…’

ধীর পায়ে এগোল রানা ওদের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *