স্ট্রেঞ্জার – ৫৯

ঊনষাট

মৃত্যুর মুহূর্তে সোয়া এক আউন্স শীতল চ্যাপ্টা সীসার বাকশট প্যালেট ঢুকেছে হ্যাঙ্ক নোভাকের মগজে। সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের নির্দেশ দেয়া বন্ধ করেছে মগজটা। পা-দুটো এখন নিথর। হাত থেকে খসে গেছে ছোরা। অন্যহাত সরেছে রনের ওপর থেকে। হুড়মুড় করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটা।

স্বাস্থ্যবান মানুষের ক্ষেত্রে ভিষ্যুয়াল স্টিমুলাস হচ্ছে ০.২৫ সেকেণ্ড। অডিয়ো স্টিমুলাস ০.১৭ সেকেণ্ড। ভাইয়ের মগজ ছিটকে বেরোতেই দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাল রিচি নোভাক। তার মগজটা নির্দেশ দিল ট্রিগারে আঙুলের চাপ বাড়াতে।

ভাই নেই তা বুঝতে সংক্ষিপ্ত যে কয়েক মিলিসেকেণ্ড ব্যয় হলো, সেসময়ে সে শুনল বিকট এক শব্দ। ওটা এসেছে রানার পেছনের আঁধার থেকে। রিচি নোভাকের কানের পাশ দিয়ে গিয়ে পেছনের দালানে লেগেছে ভারী অস্ত্রের বুলেট। ভীষণ চমকে গিয়ে এলিসাকে ছেড়ে দিল সে। ভারসাম্য রাখতে না পেরে পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ল এলিসা। ধরে নিয়েছে গুলি করা হয়েছে ওকে।

পরের কয়েক মিলিসেকেণ্ডে উইনচেস্টারের লিভার টান দিয়ে ধূমায়িত কার্তুজের খোসা ফেলল রানা। লিভার ঠেলতেই চেম্বারে ঢুকল পরের কার্তুজ। ও ভাবল, এবার উড়িয়ে দেবে রিচি নোভাকের মাথা। কিন্তু ইজেক্ট/রিকক শেষ হওয়ার আগেই রিভলভারের ট্রিগার টিপেছে রিচি। তার আগেই অস্ত্রের নল ঘুরিয়ে নিয়েছে রানার বুক লক্ষ্য করে। ‘বুম্!’ শব্দে গর্জে উঠেছে রিভলভার।

বুকে প্রচণ্ড ধাক্কার পর পর গুলির আওয়াজ শুনল রানা। পিছিয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। তাগড়া ঘোড়া লাথি মারলেও হয়তো এত ব্যথা লাগে না। এখনও রানার হাতে বন্দুক, ট্রিগারে চাপ পড়তেই আকাশে গেল গুলি। ভারী ক্যালিবারের বুলেট বুকে বিধলেও জ্যাকেটের নিচে রয়েছে ব্যালিস্টিক ভেস্ট। দুই সেকেণ্ড পর রানা টের পেল, ও মরে যায়নি

বুকে টের পেল তীক্ষ্ণ ব্যথা। চিড় ধরেছে পাঁজরের একটা হাড়ে। হাই পাওয়ারের প্রজেকটাইল ঠেকাবে কেভলার ভেস্ট। তাতে ভাইটাল অর্গান রক্ষা পেলেও এত শক্তিশালী বুলেটের এনার্জি উবে যাওয়ার নয়!

অন্ধকার থেকে আবারও বিকট ‘বুম্!’ আওয়াজ তুলল অস্ত্র। এবারের বুলেট লাগল রিচি নোভাকের নিতম্বের ডানদিকে। জোরালো ধাক্কা খেয়ে ঘুরে গেল লোকটা। হাত থেকে পড়ে গেছে রিভলভার। তবে নিজের ভারসাম্য ধরে রাখল রিচি। ঝুঁকে মাটি থেকে তুলে নিল অস্ত্রটা। তৃতীয় বুলেট মাটি খুঁড়ল তার পায়ের কাছে। এক পা পিছিয়ে গেল সে। ভাল করেই বুঝেছে, টার্গেট করা হচ্ছে তাকে। আধ সেকেণ্ডের জন্যে টলমল করল রিচি, তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে হারিয়ে গেল দালানের ওপাশে নিকষ কালো ছায়ায়।

ঝিমঝিম করছে মাথা, বুকে তীব্র ব্যথা, তবুও উঠে দাঁড়াল রানা। বারকয়েক চোখ পিটপিট করার পর কমল শক ও মনের দ্বিধা। বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দেখল, আগের জায়গায় নেই রিচি নোভাক। আশপাশে কোথাও নেই সে। মাটিতে চিকচিক করছে রক্ত। ভেজা দাগ গেছে দূরের অন্ধকারে।

নিথর পড়ে আছে জেনি লরেন্স। মেয়েটার দিকে তাকাল রানা। বেচারির শুশ্রূষা দরকার। তবে আগে দেখতে হবে ঠিক আছে কি না এলিসা আর বাচ্চারা। মাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে রন, রব ও টিনা। ফুঁপিয়ে কাঁদছে এলিসা। রানাকে দেখে বলল, ‘হায়, ঈশ্বর! ভেবেছিলাম মরে গেছ। মনে হয়েছিল আমরাও আর বাঁচব না।’

‘চিন্তা নেই,’ বলল রানা। ‘আর কোনও ঝামেলা হবে না।’

‘জোসেফ কোথায়?’

‘সুস্থ আছে। শেরিফের অফিসে বসে আছে তোমাদের অপেক্ষায়।’

‘অনেক ধন্যবাদ,’ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে রানাকে জড়িয়ে ধরল এলিসা। রানাকে জাপ্টে ধরল রন। ওর গলায় কয়েক ফোঁটা রক্ত। হ্যাঙ্কের ছোরা গভীরভাবে চিরে দিতে পারেনি কণ্ঠনালী। তবে আর আধ সেকেণ্ড দেরি হলে সব শেষ হতো।

এলিসা ও বাচ্চাদের কাছ থেকে সরে জেনির পাশে বসল রানা। পালস দেখবে, তার আগেই চোখ মেলে তাকাল মেয়েটা। দু’কাঁধ ধরে তাকে উঠিয়ে বসাল রানা। নরম সুরে বলল, ‘চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’

‘মনে হলো বুকে বেসবল ব্যাট দিয়ে বাড়ি দিয়েছে,’ গুঙিয়ে উঠল জেনি। বুকে ভেস্টের নিচের অংশে লেগেছে বুলেট। জায়গাটা ডলতে লাগল সে। ‘সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি।’

‘বুঝতে পেরেছি কেমন লাগছে,’ বলল রানা।

‘আমি যখন অজ্ঞান, তখন কী কী ঘটেছে?’

‘অলৌকিক কিছু,’ মন্তব্য করল রানা। ঘুরে তাকাল অন্ধকারে। ছায়া থেকে টলতে টলতে এগিয়ে আসছে কেউ। ‘না, না, অলৌকিক নয়।’,

বিধ্বস্ত শেরিফ যে-কোনও সময়ে মাটিতে পড়বে। চাঁদের আলোয় মড়ার মত ফ্যাকাসে তার চেহারা। জ্যাকেটে চটচটে রক্ত। দেহের পাশে ঝুলছে অকেজো ডানহাত।

‘সাহায্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ, শেরিফ,’ অন্তর থেকে বলল রানা।

‘তোমার কপাল ভাল, বামহাতেও এটা ব্যবহার করতে পারি, রিভলভার দেখিয়ে বিড়বিড় করল শেরিড্যান। তার চোখ স্থির হলো হ্যাঙ্ক নোভাকের লাশের ওপর। এবার তার দৃষ্টি অনুসরণ করল রক্তের মোটা দাগ। ওটা গেছে ছায়ার ভেতর। ‘ওই রক্ত কি রিচির?’

‘হ্যাঁ, আপনার দ্বিতীয় বুলেট ভেঙে দিয়েছে ওর নিতম্বের হাড়।

গুড! মরুক হারামজাদা!’ তীব্র ব্যথা সহ্য করছে শেরিফ। তবুও পলকের জন্যে চেহারায় ফুটল তৃপ্তি। উড়ো রবার্টসসের লাশের ওপর স্থির হলো চোখ। পরক্ষণে দেখল রানার হাতের দশ গেজের বন্দুক।

রানা বুঝল, শেরিফের জানা হয়ে গেছে কীভাবে মরেছে অফিসার রবার্টস।

তিক্ত হাসি ফুটল শেরিড্যানের ঠোঁটে। দুর্বল কণ্ঠে বলল, ওর বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে নোভাকরা।’

‘কনরাডের মতই নোভাকদের দলে ভিড়েছিল।’

‘তা বোধহয় আর প্রমাণ করা যাবে না।’

মৃদু মাথা দোলাল রানা।

এলিসার দিকে ফিরল শেরিফ। ‘ম্যাম, তোমরা ভাল আছ দেখে খুব স্বস্তি লাগছে।

করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়েও শেরিড্যানের আহত হাত ও রক্ত দেখে ভুরু কুঁচকে ফেলল এলিসা। ‘আপনি তো মারাত্মকভাবে আহত! আমি নার্স। আমাকে ক্ষতটা দেখতে দিন।’

মাথা নাড়ল স্যাম শেরিড্যান। ‘বললে বলে অনেক ধন্যবাদ, ম্যাম। তবে আপাতত চিকিৎসা নেয়ার উপায় নেই। সামনে মেলা কাজ। প্রথমে হেলিকপ্টার ডেকে বাচ্চাদেরকে পৌঁছে দিতে হবে ভিলেনিউভ শহরে। এ দ্বীপে ওদের থাকা উচিত নয়।’ জেনিকে দেখল শেরিফ। ‘অফিসার লরেন্স, আজ দক্ষতার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করেছ তুমি। আমি তোমার জন্যে গর্বিত।’

জেনির ফ্যাকাসে মুখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল চোখ দুটো।

‘এবার দেখবে ফেডারেল অফিসার আর স্টেট ট্রপারে ভরে যাবে এই দ্বীপ। আগে কখনও এত লোক দেখোনি। রিচি নোভাক বেঁচে থাকলে ঠিকই পাব ওকে আমরা। তবে কেউ আগেই মেরে ফেললে অন্য কথা।’ ভুরু উঁচু করে রানার দিকে তাকাল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান।

‘রিচির সঙ্গে ব্যক্তিগত কিছু লেনদেন আছে আমার,’ বলল রানা।

‘আমিও তাই ভেবেছি। তবে সেক্ষেত্রে ওকে খুঁজতে যেতে দেরি কোরো না। ভাঙা কোমর নিয়ে বেশি দূরে যেতে পারবে না। রওনা হওয়ার আগে আমার বুকপকেটে হাত ভরো। নিজে বের করে আনতে পারব না।’

দ্বিধা করে শেরিফের বুকপকেটে হাত ভরল রানা। শক্ত কী যেন লাগল আঙুলে। ওটা চিকন এবং চোখা। এইমাত্র চাঁদের ওপর থেকে সরে গেছে মেঘ। হাতে নিয়ে জিনিসটা চাঁদের আলোয় দেখল রানা। ওটা নীল ও সোনালি রঙের ধাতব একটা স্টার। রক্ত লেগে আছে।

‘পরিষ্কার করে নাও,’ বলল শেরিড্যান। ‘ওটা এখন থেকে তোমার।’

প্যান্টে মুছে নিয়ে আবছা আলোয় তারাটা দেখল রানা। ওই ব্যাজের মাঝে স্টেট অভ লুইযিয়ানার ঝকমকে ঈগলের প্রতিকৃতি। নিচে লেখা: ইউনিয়ান; জাস্টিস; কনফিডেন্স। নিচে খোদাই করা: ক্লোভিস প্যারিশ। তবে ওটার ওপরে ইটালিক ফন্টে ঝলমল করছে: অনারারি ডেপুটি শেরিফ

‘আপনি ঠাট্টা করছেন?’ বলল রানা।

‘না। ধরে নাও তুমি আইনের স্পেশাল অফিসার, মিস্টার রানা।’ মাথা দোলাল শেরিড্যান। ‘এবার যা করবে, সবই হবে আইনসঙ্গত।’

‘আমি এখনও ওকে জীবিত চাই,’ বলল রানা।

‘যা চাইবে, সবসময় তা পাবে না, বাছা। তা ছাড়া, সব ধরনের প্রমাণ আমরা পেয়েছি। কোনও দোষেই তোমাকে দায়ী করবে না কেউ।’ রানার হাতের বন্দুক দেখাল শেরিফ। ‘ওটার ভেতর কয়টা গুলি?’

‘মাত্র একটা,’ বলল রানা।

‘তো সঙ্গে নাও আমার আহ্লাদি মেয়েটাকে,’ নিজের কোল্ট .৪৫ ক্যালিবারের রিভলভারটা রানার দিকে বাড়িয়ে দিল শেরিড্যান। ‘আজ আর ওটা লাগবে না আমার।’

সিক্সগান নিয়ে সিলিণ্ডার চেক করল রানা। ভেতরে রয়েছে মাত্র দুটো গুলি। বিপদ এড়াতে ষষ্ঠ চেম্বারটা খালি রেখেছিল শেরিফ। প্যান্টের বাম পকেট থেকে তিনটা তাজা কার্তুজ বের করে রানার হাতে দিল সে। নরম সুরে বলল, ‘এবার, ডেপুটি, দেখো দেখি রিচি নোভাকের বারোটা বাজাতে পারো কি না!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *