স্ট্রেঞ্জার – ৫৭

সাতান্ন

পথ দেখাল উডো রবার্টস। কুঁজো হয়েছে কাটা পড়া আঙুলের তীব্র ব্যথায়। মাটিতে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। চাঁদের আলোয় ফোঁটাগুলো দেখাচ্ছে কালচে। পিছু নিয়ে হাঁটছে রানা আর জেনি।

পুলিশ রেইড টিমের সঙ্গে চরম বেইমানি করেছে রবার্টস, এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না জেনি। বিড়বিড় করছে, ‘নিজেদের লোক কী করে এ কাজ করে!’ লোকটার পিঠে তাক করে রেখেছে কিমবার পিস্তল।

উডো রবার্টসকে খুন করতে চাইলেও বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে মেয়েটা, টের পেল রানা।

বেশিদূর হাঁটতে হলো না। উঠান থেকে নানাদিকে গেছে সরু গলি। বছরের পর বছর উঠানের জঙ্গল পরিষ্কার করে এখানে-ওখানে গড়ে তোলা হয়েছে দালান বা ছাউনি। এদিকটা ভাল মতই চেনে রবার্টস। আইনের উল্টো পথের মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে নিয়মিতই আসতে হয়েছে এ দ্বীপে। হয়তো একইসঙ্গে মদ্যপান করত বিলি এস. কনরাড, উডো রবার্টস আর নোভাকরা।

দীর্ঘ, একটা নিচু দালান পাশ কাটিয়ে গেল রবার্টস বামে বাঁক নিয়ে চলল আরেক গলি ধরে। তবে দশ গজ যাওয়ার পর থেমে গেল সে।

‘ব্যস্, এইখানেই পুঁতে রাখা হয়েছে সেই কনটেইনার। জায়গাটা কারাগারের মত। এখানে আটকে রাখে বন্দিদের… তারপর…’ মিলিয়ে গেল তার কথার রেশ।

‘তারপর মেরে ফেলা হয়,’ বলল রানা।

‘বা অন্য কিছু,’ বলল উডো। ‘আসলে হয়েছে কী…..’

‘চোপ!’ ধমক দিল রানা।

নীরব হয়ে গেল লোকটা।

মাটিতে ম্যানহোলের মত গর্ত চোখে পড়েছে রানার। অন্ধকারের ভেতর ওটা আরও কালো। মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি ওপরে ধাতব ঢাকনি, যাতে ধুলোবালি আর বৃষ্টির পানি ভেতরে না যায়। রানা বুঝল, কী ধরনের বন্দিশালা মাটির নিচে। নোভাকরা তৈরি করেছে নিজেদের পছন্দের ডানজন।

কয়েক পা বেড়ে ডানজনের ঢাকনিটা দেখল রানা। ওটা ভারী লোহার তৈরি। হ্যান্ডেল ধরে টান দিয়ে তুলে ধুপ করে গর্তের পাশে ঢাকনি ফেলল ও। কালো গর্তের ভেতর উঁকি দিল। ভক্ করে ওর নাকে ধাক্কা মারল মানুষের প্রস্রাব ও বিষ্ঠার বদ গন্ধ। ওর জানা আছে এর চেয়েও অনেক খারাপ জায়গায় রাখা হয় যুদ্ধবন্দি মানুষকে।

নিচের হাল বুঝতে হলে আলো চাই রানার। ব্যাগ হাতড়ে মিনি টর্চ বের করে বাতি জ্বালল। বিদায় নিয়েছে যুদ্ধের উত্তেজনা, এখন বুক ধুকপুক করছে রানার। স্পষ্ট শুনল নিজের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ।

টর্চের আলোয় পরিষ্কার দেখল, গর্তের পাশ দিয়ে নিচে নেমেছে অ্যালিউমিনিয়ামের মই। কিন্তু নিচে কোথাও রক্ত বা ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। লাশ নেই নিচে। ডানজন সম্পূর্ণ ফাঁকা।

‘এখানে নেই,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে জানাল রানা, ‘ওদেরকে মেরে ফেলতে চায় রিচি আর হ্যাঙ্ক, তো কোথায় নেবে?’

‘ওরা যদি মরেই গিয়ে থাকে, আমার মনে হয় না তুমি ওদের লাশ দেখতে চাইবে,’ বলল জেনি।

‘ওরা মারা যায়নি,’ বলল উডো রবার্টস।

একইসময়ে তার দিকে তাকাল রানা ও জেনি। লোকটার মুখে টর্চের আলো ফেলল রানা। ফুলে গেছে ফেটে যাওয়া রক্তাক্ত নাক। জোরালো আলো পড়ে ছোট হয়েছে চোে তারা। ‘কী বললে?’ জানতে চাইল রানা।

‘খুন হয়নি,’ আবারও বলল রবার্টস। ‘মনে করেছিলাম এখানে থাকবে। তবে আমরা বোধহয় একটু দেরি করে ফেলেছি।’

ঘুষি খেয়ে চিত হয়ে মাটিতে পড়ল লোকটা। অক্ষত হাত দিয়ে চেপে ধরেছে ভাঙা নাক। রবার্টসসের থুতনিতে বন্দুকের মাল চেপে ধরল রানা। ‘জলদি! কথা বলতে তিন সেকেণ্ড সময় পাবে, তারপর মগজটা উড়ে যাবে বাইয়ুর ওদিকে।’

‘আ…. আমি বলতে চেয়েছি,’ কাঁদতে লাগল উড়ো রবার্টস। রক্তে নাক বুজে গেছে বলে নাকি শোনাল কথা, ‘ওরা সবসময় খুন করে না। বিক্রি করে দেয়।’

কথা শুনে চমকে গেল রানা। ‘কাদের কাছে বিক্রি করে?

‘কালো মেয়েমানুষদেরকে।’

‘কাদের কাছে?’ কড়া স্বরে আবারও জানতে চাইল রানা।

‘ওদের পরিচিত লোক আছে। টেক্সাসে। টেনেসিতে মিসিসিপিতে। ওদের সবাইকে চিনি না। ওই এলাকার পাকা বদমাশ তারা। কালো মেয়েমানুষ কেনে, অনেক টাকায়।’

‘হায়, যিশু, বিড়বিড় করল জেনি। সরে যাও, রানা! আমি খুন করব এই শুয়োরের বাচ্চাটাকে!’

রক্তাক্ত দুই হাত ওপরে তুলল উডো রবার্টস। এখন ডান হাতের কাটা পড়া তিনটে আঙুলের ব্যথা ভুলে গেছে সে। মৃত্যুভয় কাঁপিয়ে দিয়েছে তাকে।

‘না! আমি এসবে ছিলাম না! তবে জানি, ওরা এখনও বেঁচে আছে! অন্তত বেঁচে আছে ওই কালো মহিলা আর ছোট মেয়েটা! বর্ণসংকর ছেলেটা আর ওর সৎভাইকে হয়তো মেরে ফেলেছে। তবে অন্য কারণেও তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে রিচি। আমি জানি না! আমি কোনও মিথ্যা বলিনি! প্লিয! তোমরা এভাবে আমাকে মেরে ফেলতে পারো না! এটা তো ঠাণ্ডা মাথায় খুন!’

‘আমরা মানুষ খুন করব না, রবার্টস,’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল জেনি লরেন্স। থরথর করে কাঁপছে দু’হাতে ধরা কিমবার পিস্তল। ‘কীভাবে মরলে খুশি হবে, জানোয়ারের বাচ্চা?’

‘ওরা এখন কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।

‘সত্যিই জানি না,’ ফুঁপিয়ে উঠল রবার্টস। ‘শপথ করে বলছি!’

‘তোমার কথা বিশ্বাস করেছি,’ বলেই ট্রিগার টিপে দিল রানা।

বাইয়ুর ওদিকে গেল না লোকটার মগজ। কয়েক টুকরো হয়ে বড়জোর ছিটকে গেল বারো ফুট দূরে। দালানের মাঝে বিকট আওয়াজ তুলেছে দশ গেজের বন্দুক।

রবার্টসসের লাশের কাছ থেকে কয়েক পা সরে জেনি লরেন্সের দিকে তাকাল রানা।

‘তুমি একটা অমানুষ!’ বলল মেয়েটা।

‘কেন? ঠাণ্ডা মাথায় নিরস্ত্র কাউকে খুন করেছি বলে?’

‘না। ওই শুয়োরের বাচ্চাটাকে আরও কষ্ট দিয়ে শেষ করা উচিত ছিল।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল জেনি। মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল, ‘সর্বনাশ হয়েছে অনেক পরিবারের। এদিকে আমরা ধরতে পারিনি নোভাকদেরকে। এটাও জানি না এখন গুডরিচদেরকে কোথায় নিয়ে গেছে।’

‘এখানেই আছি আমরা, কুত্তী মাগী, ́ ছায়ার ভেতর থেকে বলল কেউ।

ঘুরেই কাঁধে বন্দুকের কুঁদো তুলল রানা। একটু কুঁজো হয়ে পিস্তল হাতে লড়াইয়ের জন্যে তৈরি জেনি। একটু দূরের অন্ধকার থেকেই এসেছে কণ্ঠস্বর। রানা বা জেনি গুলি করার আগেই ছিটকে উঠল সাদা-কমলা ফুলকি। ক’পা পিছিয়ে গেল জেনি। হাত থেকে পড়ে গেছে পিস্তল। চিত হয়ে মাটিতে পড়ল মেয়েটা।

উইনচেস্টার দিয়ে গুলি করতে গিয়েও বরফের মূর্তির মত জমে গেল রানা।

‘আমি হলে গুলি করতাম না,’ ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছে রিচি নোভাক।

একা নয় সে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *