স্ট্রেঞ্জার – ৫১

একান্ন

কোয়াড বাইকে চেপে বাড়ির উঠানের দিকে চলেছে রিচি ও হ্যাঙ্ক। অবশ্য ক্লাব হাউসের কাছে পৌঁছুবার আগেই বামে বাঁক নিল রিচি। কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে একটু যেতেই পেছনে পড়ল বন্দিদেরকে আটকে রাখার পাতাল কারাগার। আগে ওখানে থাকত নোভাকদের শত্রু, ব্যবসায়িক প্রতিযোগী ও ছ্যাচড়া চোরেরা। প্রাণ নিয়ে ফিরত না কেউ। ওই জেল শুইয়ে রাখা মস্তবড় বোতল আকৃতির একটা গর্ত। ওটার মুখে লোহার গ্রিড বসিয়ে নেয়ার পর কারও সাধ্য নেই ওখান থেকে বেরোয়। তবে বর্তমানে ওই গর্ত আরও বড় করেছে নোভাকরা। নিচে নামানো হয়েছে শিপিং কন্টেইনার। আবারও মাটি ফেলে ঢেকে দেয়া হয়েছে গর্ত। ওখান থেকে উঠতে হলে মই বেয়ে ট্র্যাপডোর পেরোতে হবে। বন্দিকে নামিয়ে দেয়ার পর তুলে নেয়া হয় মই। পাতাল কারাগারের পরিবেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন ও স্যাঁতসেঁতে। বন্দি যেন শ্বাস আটকে না মরে, তাই আছে ভেন্টিলেশন পাইপ। পাষাণ নয় নোভাকরা, দু’দিন অন্তর বন্দির জন্যে ওপর থেকে ফেলে সামান্য খাবার আর জনপ্রতি এক পাইন্ট পানির বোতল।

এগিয়ে চলেছে রিচি, পেছনে হ্যাঙ্ক। আগেই পাতাল ডানজনে এলিসা, রন, রব আর টিনাকে নামিয়ে মই তুলে ট্র্যাপডোর আটকে দিয়েছে রেলি জ্যাকব। কারাগারের দিকে চেয়েও দেখেনি রিচি বা হ্যাঙ্ক। ট্র্যাক ধরে আরও কিছুটা গিয়ে প্রিফ্যাব্রিকেটেড স্টিলের বড় এক দালানের সামনে থামল রিচি। বাড়ির পেছনে রয়েছে নানাধরনের ট্রাক, গাড়ি আর চোরাই সব মালামাল।

দালানের একপাশে শাটার দেয়া চওড়া দরজার ওপাশেই নিজের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখে রিচি। চাবি থাকে শুধু তার কাছে। মেয়েমানুষ থেকে শুরু করে প্রায় সবই ভাগ করে ব্যবহার করে নোভাকরা, তবে শাটার দেয়া ঘরে কী আছে, তা দুই ভাইকে জানতে দেয়নি রিচি। গত বছর বড় কোনও প্রজেক্ট নিয়ে ওখানে কাজ করছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছে ওই ঘরে। কখনও কখনও দেখা গেছে দু’দিন, তিন দিন বেরোয়নি ওখান থেকে। বাইরে থেকে পাওয়া গেছে লোহা পেটাবার বিকট আওয়াজ আর ড্রিলের চিঁ-চিঁ শব্দ। যে কাজই করুক রিচি, দু’ভাইকে সে বিষয়ে কিছুই জানাতে চায়নি।

হ্যাঙ্ক বুঝতে পারছে, এবার সময় হয়েছে রহস্যময় মনে পা রাখার। শাটার খুলে ওপরে ঠেলল রিচি। তাতে ব আওয়াজ হলো। ঘরের ভেতরটা লম্বাটে। গেটের সামনে সূর্যের আলো। ওখানে থমকে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল হ্যাঙ্ক। কয়েক সেকেণ্ড পর দৃষ্টি অন্ধকারে অভ্যস্ত হতেই দেখতে পেল ভেতরটা।

ঘরের একদিকের দেয়ালে সারি সারি জলপাই রঙের কাঠের বাক্স। বাক্সগুলোর উচ্চতা ছয় ফুট। বাক্সের একপাশে স্টেনসিল করা সাদা রঙে লেখা নানান কিছুর নাম। সেগুলোর ভেতর রয়েছে: গ্রেনেড্‌স্‌, রেকন এমকে১ ফ্র্যাগ ডাব্লিউ/ফিউয এম২০৪এ২ ও অ্যামিউনিশন ফর ক্যানন উইদ এক্সপ্লোসিভ প্রজেক্টাইল। এ ছাড়া, লেখা আছে প্রচুর সংখ্যা এবং ডেযিগনেশন। হ্যাঙ্ক ওগুলোর অর্থ না বুঝলেও এটুকু টের পেল, বড় কিছু করছে রিচি। ঘরে কয়েক পা এগোতেই এককান থেকে আরেক কানে গিয়ে পৌঁছুল হ্যাঙ্কের হাসি। বেরিয়ে পড়ল বত্রিশ পাটি দাঁত।

‘আরিব্বাপরে! বড়ভাই, তুমি তো কাজের কাজই করেছ! কিন্তু পেলে কোথায় এসব?’

‘টেনেসির হোয়াইট পাওয়ার বয়েজদের কাছ থেকে, বলল রিচি। ‘কিন্তু এসব দেখাতে তোমাকে এখানে আনিনি।

ভাইয়ের পিছু নিয়ে আরও কয়েক পা এগোল হ্যাঙ্ক। দেয়ালের সুইচ টিপে বাতি জ্বালল রিচি। ছাত থেকে উজ্জ্বল আলো ছড়াল ন্যাংটো শক্তিশালী বার্। দূরে গর্জন ছাড়ছে জেনারেটর। ঘরের দু’দিকের দেয়াল ঘেঁষে ওঅর্কবেঞ্চে নানান যন্ত্রপাতি। তার ভেতর রয়েছে ওয়েল্ডিং টর্চ, অক্সি-এসেটিলিন কাটার, বেঞ্চ লেইদ, অ্যাংগেল গ্রাইণ্ডার আর পিলার ড্রিলের মত হেভি ডিউটি হার্ডওয়্যার। এখানে বসে মেলা কাজ করেছে রিচি নোভাক।

দু’দিকের ওঅর্কবেঞ্চের মাঝে তার গর্বের বস্তু। ঢেকে রাখা হয়েছে তারপুলিন দিয়ে। জিনিসটা চওড়ায় দুই মিটার, দৈর্ঘ্যে পাঁচ মিটার।

‘তারপুলিনের নিচে ওটা কী?’ কৌতূহলী কণ্ঠে জানতে চাইল হ্যাঙ্ক। ‘বিরাট কোনও কামান?’

একপাশ থেকে তারপুলিন সরাতে শুরু করে বলল রিচি, ‘নিজের চোখেই দেখে নাও।’

গাড়িটার ওপর থেকে তারপুলিন সরে যেতেই পিরিচের মত বড় হয়ে উঠল হ্যাঙ্কের দুই চোখ।

অস্ত্রের অভাব নেই দ্বীপে, বলল রিচি, ‘এসবের ভারে আরেকটু হলে তলিয়েই যেত। তবে এ জিনিস অন্যকিছু। আমি নাম দিয়েছি: ডুম্‌স্‌ ডে মেশিন।’

প্রথমে ওটাকে ভারী ট্রাক মনে হলো হ্যাঙ্কের। আগে কখনও দেখেনি এমন ভয়ঙ্করদর্শন গাড়ি। ভালো করে দেখার পর বুঝল, ওটা মডিফাই করা মিলিটারি হামভি পিকআপ। উঁচু সাসপেনশন। মস্ত চাকার থ্রেডগুলো দেখার মত। ছাত ও দু’পাশের জানালা এখন নেই। বডির সঙ্গে ওয়েল্ডিং করে আটকে নেয়া হয়েছে পুরু আর্মার প্লেটিং। শুধু ওগুলোরই ওজন হবে একটনের বেশি। খোলা ক্যাবে ড্রাইভারের সিটের পাশে প্যাসেঞ্জার সিটের বদলে বিশাল এক ডিভাইস।

কয়েক মুহূর্ত পর হ্যাঙ্ক বুঝল, সে দেখছে তার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় কামান। হাঁ হয়ে গেল তার মুখ। হারিয়ে গেছে জবান। কামানের নলটা ক্যাথেড্রালের পাইপ অর্গানের চেয়েও মোটা। ওই নল গিয়ে মিশেছে মস্ত এক সিলিন্ডারের সঙ্গে। গোটা জিনিসটা আছে রিভেট করা ভারী ইস্পাতের পাতের ওপর।

‘এম৬১ ভালক্যান রোটারি ক্যানন, বলল রিচি। ‘যুদ্ধের সিনেমায় দেখেছ, হ্যাঙ্ক। তবে এটা নকল নয়। ভিয়েতনামে ব্যবহার হয়েছে এমন এক স্টারফাইটার জেট বিমান থেকে এসেছে। এখানে পৌঁছে দেয়ার জন্যে মেলা টাকা নিয়েছে টেনেসির দোস্তরা। ছয় ব্যারেলের প্রতিটা থেকে মিনিটে বেরোবে এক হাজার গোলা। তুমি এমন এক অস্ত্র দেখছ, যেটা কয়েক মিনিটে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে আস্ত পাহাড়। আমার কাছে যে বেল্ট, তাতে আছে কামানের জন্যে চার হাজার রাউণ্ড। প্রতিটা রাউণ্ড বিশ মিলিমিটার। আছে ট্রেসার, হাই এক্সপ্লোসিভ ইনসেনডিয়ারি, আর্মার ভেদ করা রাউণ্ড। আরও আছে পেনিট্রেটার অ্যামিউনিশন। ওটা ভেদ করবে যে-কোনও কিছু।’ কাঁধ ঝাঁকাল রিচি। ‘যদিও জানি না কী ওড়াতে ওটা লাগবে। আগে কখনও চালু করিনি কামান। অপেক্ষা করেছি উপযুক্ত সুযোগের জন্যে। এম৬১ ভালক্যান রোটারি ক্যানন দারুণ সুন্দরী, কী বলো, হ্যাঙ্ক?’

মাথা দোলাল হ্যাঙ্ক। সত্যিই, দুর্দান্ত সুন্দর অস্ত্র। খুশিতে চকচক করছে তার দুই চোখ। রিচিকে আগে কখনও এত খুশি দেখেনি। মাতাল বাবার কাছ থেকে উযি সাবমেশিন গান চুরি করে জঙ্গলে ব্রাশ ফায়ারের সুযোগ পেলে যতটা খুশি হয় কোনও কিশোর, তেমনই ঝলমল করছে রিচির চেহারা।

ট্রাকে উঠে চকচকে ধাতুর ওপর হাত বোলাল সে। গর্ব ও খুশিতে ভরপুর দু’চোখ। ‘গ্যাটলিং গানের নাম শুনেছ, হ্যাঙ্ক? ওটাই প্রথম সত্যিকারের মেশিন গান। হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে চালু করত। যুদ্ধের সময় আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল ইয়াঙ্কিরা। যে আবিষ্কার করেছিল, সে চেয়েছিল যাতে যুদ্ধ বাদ দিয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে আর্মি থেকে পালিয়ে যায় শত্রুসেনা। এবার তেমনই কিছু হবে নোভাক দ্বীপে। জাহাজ বা ব্যাটল ট্যাঙ্ক পর্যন্ত অনায়াসে ধ্বংস করে দেয় এই কামান।’

‘এ তো মহান শিল্প, শ্বাস টানল হ্যাঙ্ক। ‘তার মানে এজন্যেই এতদিন গোপনে এটা রেডি করেছ? আমাদেরকে বললে না কেন?’

‘চমকে দিতে চেয়েছি,’ বলল রিচি, ‘কাজ শেষ হয়েছে কয়েক সপ্তাহ আগে। নোভাক দ্বীপে লড়াইয়ের জন্যে এবার কাজে লাগবে।’

‘তা ঠিক,’ বিড়বিড় করল হ্যাঙ্ক। পরক্ষণে তার মাথায় এল অদ্ভুত চিন্তা। ভাবছে, নির্ঘাত ভাবনাটা পাঠিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর। ‘একটা কথা জানো, রিচি, আমার মনে হচ্ছে আমাদেরকে দিয়ে শত্রুদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেবেন ঈশ্বর।’

‘আমারও তা-ই ধারণা,’ সায় দিল রিচি। ‘আসুক শত শত পুলিশ। আমার পরিকল্পনা তৈরি শেষ, অস্ত্রও রেডি।’

‘কী করবে ভাবছ সেটা বলবে না?’ ভাল প্ল্যান শুনতে সবসময় ভাল লাগে হ্যাঙ্কের।

‘তিন ধাপে কাজ করব,’ বলল রিচি। ‘প্রথম কাজ, মাসুদ রানা, শেরিফ শেরিড্যান আর তার লোকজন এলেই বোক বানিয়ে দেব তাদেরকে। দ্বিতীয় কথা, কয়েক মাইল দূরের রাস্তায় গিয়ে ইউ টার্ন নিয়ে দ্বীপে ফিরবে আমাদের ছেলেরা। ফলে সেতু পেরিয়ে আর পালাতে পারবে না রানার পুলিশ বাহিনী।’

‘শুনে তো ভাল প্ল্যান মনে হচ্ছে।’

‘প্ল্যানের শেষ অংশ তো শোনোইনি,’ বলল রিচি, ‘গ্যাটলিং গানের গোলা মেরে উড়িয়ে দেব ওদেরকে। শালারা বুঝবেও না কখন পৌঁছে গেছে নরকে।’

‘গোলা, তাই না?’ মাথা দোলাল হ্যাঙ্ক। মুখে হাসি।

‘ঘাসকাটা মেশিনের মত ছিন্নভিন্ন করব ওদের, হ্যাঙ্ক। প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না কেউ।’

‘মাসুদ রানার কী করবে?’

‘ওর ব্যাপারে আলাদা প্ল্যান আছে। সবার পর মরবে ও এতই কষ্ট দেব, যতটা ব্যথা পায়নি পৃথিবীর কেউ।

উত্তেজনায় চকচক করছে হ্যাঙ্কের চোখ। হাসির কারণে কুঁচকে গেল গাল। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পর ভোঁতা হলো তার দৃষ্টি। বাজে একটা চিন্তা এসেছে মনে।

‘একমিনিট, রিচি! একটা কথা ভেবেছ? পুলিশ মেরে সাফ করলে আমাদের পেছনে লাগবে ফেডারেল এজেন্টরা।

টিটকারির হাসি নিয়ে ভাইকে দেখল রিচি। ‘ভয়ের চোটে মুরগির বাচ্চা হয়ে গেলে নাকি?’

‘গোটা আর্মি লেলিয়ে দেবে! এর চেয়েও বড় কামান আছে তাদের কাছে। তা ছাড়া, ব্যবহার করবে অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার। যেমন ব্ল্যাক হক। আকাশ থেকে ফেলবে নাপাম বোম। কোথাও পালাতে পারব না আমরা। আমাদের হাল দেখে ওয়্যাকো আর রুবি রিজের কাহিনী ভুলে যাবে সবাই।’

‘কথা ঠিক,’ বলল রিচি। ‘সুযোগ পেলে তা-ই করবে। যেভাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের বাড়িঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এ দ্বীপ বোমা মেরে তলিয়ে দিক ইয়াঙ্কি সৈনিকরা। ততক্ষণে আমরা চলে যাব অনেক দূরে।

‘কোথায় যাব?’

‘এই দেশ অনেক বড়, হ্যাঙ্ক। আর আমাদের চেয়ে বেশি কেউ চেনে না এ এলাকা। এমনিতেই এখান থেকে আমাদের চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। ইয়াঙ্কিদের এড়াতে যেভাবে সরে গিয়েছিল আমাদের পূর্বপুরুষ উইলিয়াম এফ. নোভাক, ঠিক তেমন করেই কোথাও গিয়ে নতুন বসতি গড়ব আমরা দুই ভাই। খুঁজে নেব সুন্দরী দুটো কুত্তী। ওদের পেটে ভরে দেব বংশধর। মনে রেখো, হ্যাঙ্ক, উইলিয়াম এফ. নোভাককে যেমন খুঁজে পায়নি ওরা, আমাদেরকেও পাবে না।’

‘তোমার কোনও ভুল হচ্ছে না তো, বড়ভাই?’

‘ভুলে যেয়ো না আমরা কারা,’ গর্বের সঙ্গে বলল রিচি। ‘মগজ যেমন ক্ষুরধার, তেমনি অভাব নেই টাকার। যা খুশি করব। কারও সাধ্য নেই যে বাধা দেবে!’

কথাগুলো শুনে ভাল লাগছে হ্যাঙ্কের। কিন্তু তখনই আরেকটা চিন্তা আসতেই ভুরু কুঁচকে গেল তার। আঙুল তাক করে দেখাল ডানজনের দিক। ‘গুডরিচের বউ আর তার বাচ্চাগুলোর কী হবে?’

মৃদু হাসল রিচি নোভাক। ‘মনে নেই, ওদের জন্যে অন্য প্ল্যান, ব্রো? কিছুই বাদ দিইনি হিসাব থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *