তেইশ
এত বছরে বহু হুলুস্থুল হয়েছে ক্লোভিস প্যারিশের শেরিফ ডিপার্টমেন্টে, কিন্তু লিয বাউয়ার খুন হওয়ায় ভিলেনিউভ শহরের কোর্টহাউসের সামনে অ্যাসেনশন স্কয়্যারে এ মুহূর্তে যা ঘটছে, নিজ চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না শহরবাসীরা।
সকাল হতে না হতেই লুইযিয়ানা স্টেটের নানান জায়গা থেকে কোর্টহাউসের কারপার্কে এসে জড় হয়েছে একগাদা পুলিশ পেট্রল ক্রুযার এবং চকচকে কালো সোয়্যাট ভেহিকেল। রাস্তার বেশিরভাগটাই দখল করেছে ওগুলো। কোর্ট ভবনে ঢুকছে বা বেরোচ্ছে সশস্ত্র সব পুলিশ অফিসার কেন এত আয়োজন, তা জানা না থাকলে যে-কেউ ভাববে, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎই আমেরিকার ওপর হামলা করেছে রাশা।
ভোরে কোর্টহাউসের উঠানে নিজের ট্যাঙ্ক রাখতে গিয়ে শেরিফ স্যাম শেরিড্যানের লোকজনের সঙ্গে একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে সোয়্যাট ফোর্সের কমাণ্ডারের। ভিলেনিউভ শহরের জনসংখ্যার দেড়গুণ অস্ত্র নিয়ে কোর্টহাউসে হাজির হয়েছে পুলিশ অফিসাররা। তুমুল গোলাগুলির সুযোগ পাবে সেই খুশিতে মিটিমিটি হাসছে কেউ কেউ।
ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের জন্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে কোর্টহাউসের পেছনের কয়েকটি অফিস কামরা। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে যে ছোট্ট অফিসে বেশিরভাগ সময় পার করেছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান, সেখানে বসেই দরকারি সব নির্দেশ দিচ্ছে সে। দুই পা তুলে দিয়েছে কফি- মগের দাগ ভরা টেবিলের ওপর। পেছনে ঠেলে দেয়ায় ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজে দুলছে পুরনো চেয়ার। কোঁ-কোঁ শব্দে চলছে প্রাচীন এয়ারকুলার। সামনের দেয়ালে বরাবরের মতই ভুরু কুঁচকে শেরিফের দিকে চেয়ে আছে তার বহু দিনের অসুস্থ, প্রিয়তমা স্ত্রীর ছবি। পাশেই এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে পতাকা সহ স্ট্যাণ্ড। শৌখিন লোক নয় শেরিড্যান, তাই কখনও ভাবতে যায়নি আরাম-আয়েসের কথা। চিরকাল মেতে থেকেছে নিজের কাজ নিয়ে। আশা করেছে, তার মত করেই দায়িত্ব পালন করবে অধীনস্থ অফিসাররা। অথচ, শেরিড্যানকে এখন মেনে নিতে হচ্ছে, লিয বাউয়ারের কেসে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেনি তার অনুচররা।
সকাল এখন নয়টা।
বদ্ধ ঘরের তপ্ত পরিবেশে নিজের চেয়ারে বসে বরফ দেয়া চায়ে চুমুক দিচ্ছে শেরিড্যান। বুঝতে চাইছে পরিস্থিতি। লিয বাউয়ারের নির্মম খুনের প্রতিশোধ নিতে ক্লোভিস প্যারিশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ম্যান-হান্টের আয়োজন করেছে কর্তৃপক্ষ। আর এ কাজে অফিসারদের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে সে। মাঝে মাঝে নিজেকে মনে হচ্ছে জেনারেল প্যাটন, বাউয়ার-ফাউয়ার কিচ্ছু না, সৈনিকদেরকে নিয়ে চলেছে সে সম্মুখযুদ্ধে।
এই অপারেশন শুরুর পর প্রথমবারের মত বিশ্রামের জন্যে চেয়ারে বসেছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। একটু আগেও রেডিয়ো, মোবাইল ফোন, ল্যাণ্ড ফোনে বা মুখোমুখি হয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছে সবাইকে। বাদ পড়েনি জরুরি কোনও দিক। একদল বোকা ডেপুটিকে দিয়ে করাতে চাইছে গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ। যেদিকটা ঠিক নেই ভাবছে, সেদিকেই জোর দিচ্ছে শেরিড্যান।
এরই ভেতর এসেছে এয়ার ফোর্সের হেলিকপ্টার। নানান খামারের জমি, জলাভূমি, বাইয়ুর ওপর চোখ রাখছে একদল দক্ষ পাইলট। আজ ভোর থেকে ক্লোভিস প্যারিশে ঢোকা বা বেরনোর পথ রাখা হয়নি। একটু পর পর রোডব্লক। চারপাশে চোখ রাখছে পুলিশবাহিনী। শেষরাত থেকে এখন পর্যন্ত শত শত গাড়ি থামিয়ে চিরুনি-তল্লাসী করা হয়েছে। এ ছাড়া, চিটিমাচা ও তার চারপাশের নানান জায়গায় হানা দিয়েছে শত শত ট্রুপার।
ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক ডেসপারেডো স্টিভ এভার্সের বিরুদ্ধে গোলাগুলির পর থেকে আর কখনও এতটা উত্তেজিত হয়নি শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। অথচ, এত কসরত করেও ‘ পাওয়া যাচ্ছে না ক্লোভিস প্যারিশের দুর্ধর্ষতম অপরাধী মাসুদ রানাকে। যেন স্রেফ হাওয়ায় উবে গেছে সে।
আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে অনুরোধ যাওয়ায় অতি সাধারণ একটি ডোশিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তাতে প্রায় কিছুই লেখা নেই। তবে সিআইএ থেকে মোটা এক ফাইল এসেছে শেরিড্যানের কাছে। ওটাতে রয়েছে জরুরি অনেক ধরনের তথ্য। সেসব পড়তে গিয়ে সে বুঝেছে, মাসুদ রানার তুলনায় ডেল্টা ফোর্সের সৈনিক বা অফিসাররা একেবারেই দুধের শিশু।
রানার অতীত, মিলিটারি রেকর্ড, কী ধরনের কাজে সে অভ্যস্ত- সবই এখন জানে শেরিড্যান। আর সেজন্যই চমকে গেছে। ভয় ঢুকে গেছে মনে— আমি কি যোগ্যতা রাখে এ কাজ সম্পন্ন করার?
মাসুদ রানা আগে ছিল আর্মির একজন মেজর। নানান বিপজ্জনক মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। অত্যন্ত দক্ষ একজন স্নাইপার। সার্ভেইলেন্স ও কাউন্টার সার্ভেইলেন্সে এক্সপার্ট। ব্যবহার করতে জানে নানান ধরনের অস্ত্র। ট্যাকটিকাল দক্ষতা তুলনাহীন। যে-কোনও বোমা তৈরিতে পারঙ্গম। শত্রু এলাকায় ঢুকে স্যাবোটাজ করা বা কাউন্টার টেরর রেইড এসব তার জন্যে অতি মামুলি কাজ। সামরিক বাহিনীতে ইস্তফা দিয়ে এই লোক যোগ দিয়েছিল কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে। বর্তমানে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত।
‘শালার কপাল!’ বিড়বিড় করল শেরিড্যান। ‘কেন আমার ঘাড়ে এসে চাপল লোকটা!’ বারবার মনে হচ্ছে, অনেক আগেই রিটায়ার করা উচিত ছিল তার।
হতাশা নিয়ে হোলস্টার থেকে কোল্ট রিভলভারটা নিল শেরিফ। ওটা হাফ কক করে খুলল রিলোডিং গেট। টেবিলের ওপর গড়িয়ে পড়ল .৪৫ বুলেট। একটা একটা করে টেবিলে বুলেটগুলো দাঁড় করাল শেরিড্যান। তেলমাখা কাপড় দিয়ে মুছে আবারও রিলোড করে ঠিক জায়গায় রাখল রিভলভার। এটা না করলেও চলত। তবে প্রিয় অস্ত্রের স্পর্শে নিজের অসহায়বোধ কমছে বলেই গত দু’ঘণ্টায় অন্তত পাঁচবার একই কাজ করেছে সে। ভালভাবেই বুঝতে পারছে, মাসুদ রানার তুলনায় কিছুই নয় সে। মনটা বলছে: সময় থাকতে অবসরে গেলি না কেন! তা হলে নিজের বাগানে বসে ফুলের বেড নিয়ে ভাবতে পারতি!
দরজায় টোকার আওয়াজ হওয়ার দুই সেকেণ্ড পর ঘরে ঢুকল বিলি এস. কনরাড। হাসপাতাল থেকে ডাকিয়ে এনে তাকে ডিউটিতে যোগ দিতে বলেছে শেরিফ শেরিড্যান। বিপজ্জনক এ মহাযজ্ঞে হাতের কাছে সবাইকেই চাই তার।
কনরাডকে দেখে চমকে উঠল শেরিড্যান। ‘হায়, ঈশ্বর, তোমার কী হাল? এই চেহারা দেখলে তো জান নিয়ে ভাগবে ধাড়ী শকুনীও!’
আফ্রিকান ম্যাণ্ডিল বেবুনের মতই লাল-নীল হয়েছে বিলি এস. কনরাডের জখম হওয়া নাক-মুখ। সে যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত, সেটা জাহির করছে গর্বের সঙ্গে। স্বাভাবিক। খুনের জায়গায় আগে পৌঁচেছে সে। মোকাবিলা করেছে মাসুদ রানার। হাসপাতালের বেডে শুয়ে যে বর্ণনা দিয়েছে, তাতে উল্লেখ করেছে: দু’জনের ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের এক পর্যায়ে জ্ঞান হারায় সে।
‘তা ঠিক, শেরিফ, নাকি গলায় বলল কনরাড। ‘আমরা সবাই তৈরি, স্যর।’
‘আসছি,’ বলে চা-র কাপে শেষ চুমুক দিয়ে চেয়ার ছাড়ল শেরিড্যান। ওঅর রুমে অধীনস্থদের সামনে বক্তৃতা দেবে। জরুরি পরিস্থিতির জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে ওই ঘর। অফিস থেকে বেরিয়ে টাই ও হ্যাট ঠিক করে নিয়ে করিডোর ধরে এগোল শেরিফ। পিছু নিল কনরাড। জানতে চাইল, ‘স্যর, নতুন কোনও খবর?’
‘থাকলে ভাল হতো। আমাদের জানা নেই এত দ্রুত কোথায় লুকাল লোকটা। তোমার কি মনে হয়? পালিয়ে আছে কারও বার্ন বা আউটহাউসে? অবশ্য সেক্ষেত্রে যে-কোনও সময়ে ধরা পড়বে।’
‘ওই লোক আহত, আশা নিয়ে বলল কনরাড, ‘হয়তো মরে পড়ে আছে ময়লার কোনও ড্রেনে। এটা জানি, খুনের পর পর অনেক রক্ত হারিয়েছে সে।’
মাসুদ রানা আহত, সেটা নিয়ে আলাপ করেছে সবাই। মৃত লিযের দেহ থেকে শুরু করে ওপরতলার ছাতে পাওয়া গেছে রক্তের চিহ্ন। লাল ফোঁটাগুলো গেছে প্রতিবেশীর ছাতে। এরপর একটা গাছের সাহায্য নিয়ে নেমে পড়ে সে মাটিতে। কয়েকটা বাগান পেরিয়ে একসময়ে পৌঁছে যায় দূরের রাস্তায়। সিকি মাইল হাঁটার পর মিস্টার ব্রাম স্টোকারের গাড়ি চুরি করে পালিয়ে যায়। তারপর থেকে ওই পিকআপ বা মাসুদ রানার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
একটা কথা পরিষ্কার: গুরুতরভাবে আহত ভয়ঙ্কর ওই খুনি। যদিও কারও জানা নেই কীভাবে জখম হলো সে। এ ব্যাপারে জরুরি কোনও তথ্য দিতে পারেনি ডেপুটি কনরাড। অন্যরা গেস্টহাউসে গেলেও গুলি লাগাতে পারেনি মাসুদ রানার গায়ে। অবশ্য আপাতত এই বিষয়টা নিয়ে বেশি ভাবছে না কেউ। ধরে নেয়া হয়েছে, খুন হওয়ার আগে মাসুদ রানার সঙ্গে হয়তো লড়াই করেছিল লিয বাউয়ার। আর তখনই জখম হয় লোকটা।
‘মনে হয় কোথাও লুকিয়ে পড়েছে সে, ‘ বলল শেরিড্যান, ‘তবে মারা যায়নি। সত্যিকারের নিনযা যোদ্ধাদের মতই কঠিন জান তার।’
‘অতটা কঠিন নয়,’ বিড়বিড় করতে করতে আলতো করে নাক-মুখে হাত বোলাল কনরাড।
‘সুযোগ পেয়েও তাকে ঠেকাতে পারোনি,’ ঘোঁৎ করে উঠল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান।
‘পরেরবার ভুল করব না।’
ওঅর রুমের দরজা খুলে ভেতরে পা রাখল শেরিফ। ভেতরে গিজগিজ করছে একদল অফিসার। নিজেদের ভেতর আলাপ করছে তারা। কিন্তু শেরিফ ঘরে ঢুকতেই সবার চোখ গেল তার ওপর। গটগট করে হেঁটে নিজের ডেস্কের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল শেরিড্যান। আপাতত ওটাকে ব্যবহার করা হবে পডিয়াম হিসেবে।
‘এবার দয়া করে চুপ করো,’ বলল শেরিফ। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে থামল গুঞ্জন। শেরিড্যান ব্যাখ্যা করে জানাল, ক্লোভিস প্যারিশের সঙ্গে যে চারটে প্যারিশের সীমান্ত আছে, ওই পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়েছে কর্তৃপক্ষের জাল। সবধরনের কর্তৃত্ব থাকছে শেরিড্যানের হাতে। তবে এ কাজে তাকে সহায়তা দেবে পাশের চার প্যারিশের শেরিফ জন স্টোন, শ্যন ক্লার্ক, চার্লি হোগান ও আব্রাহাম স্যাণ্ডার্স। তারা প্রত্যেকে এখন এই ঘরে উপস্থিত এবং অখুশি, দলের নেতৃত্ব দেয়া হচ্ছে না তাদেরকে।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই অপারেশনের নানান দিক ব্যাখ্যা করল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। তারপর জানতে চাইল, ‘কারও কোনও প্রশ্ন?’
নীরব থাকল সবাই।
সবার ওপর চোখ বুলিয়ে নিল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। সম্পূর্ণ মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছে। ‘ঠিক আছে। এবার সবাই মন দিয়ে শোনো, আমরা চাই ওই ভয়ঙ্কর সাইকোপ্যাথকে ধরে তার চামড়া ছিলে নিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা যদি বুঝতে পারি, কেউ না কেউ তাকে সাহায্য করছে, মারাত্মক শাস্তির মুখে পড়বে সে বা তারা।’ আঙুল তুলে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল সে, ‘এই মাসুদ রানা স্থানীয় কোনও বর্ণবাদী বা সাধারণ ডাকাত নয়। ঠাণ্ডা মাথার খুনি। খুনের ব্যাপারে তার আছে পেশাদারি দক্ষতা। যদি হামলা করে, সেটা করবে নিঃশব্দে। সুতরাং তাকে দেখলে কোনও কথা না বলে আগে গুলি করবে তার বুকে। এ কথা তোমাদের প্রত্যেকের জন্যে প্রযোজ্য।’
‘আমরা তাকে ঠিকই ধরব, শেরিড্যান,’ বলল শেরিফ চার্লি হোগান। ভাবছে, একবার আমার এলাকায় তাকে পেলে সমস্ত প্রশংসার ঝোল টেনে নেব আমার পাতে।
‘ধরা তাকে পড়তেই হবে,’ দাঁতে দাঁত পিষল শেরিড্যান। ‘কারণ আজ যে কাজে নেমেছি, যেভাবেই হোক সেটা শেষ করব। এখন থেকে আর কোনও বিশ্রাম নেব না আমরা। খাবারের কথাও মাথায় আনব না। হয় আমাদের হাতে মরবে মাসুদ রানা, নইলে থাকবে জেলখানার চোদ্দ শিকের ভেতর। ঠিক আছে, এবার কাজে নেমে পড়ো সবাই!’