বারো
মন এতটাই খারাপ, আবছাভাবে পুলিশের সাইরেন শুনল রানা, কিন্তু আশপাশে কী ঘটছে কিছু যেন বুঝতে পারছে না। একটু পর এই বাড়ির সামনে থামল একটা ল্যাওয়ার। রানার পিঠ দরজার দিকে, তাই চোখে পড়ল না ছাতের নীল আলো। অবশ্য এটা বুঝল, প্রতিবেশীদের কেউ খবর দিয়েছে পুলিশে। নইলে ওকেই যোগাযোগ করতে হতো।
নিথর হাতটা লিষের বুকে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল রানা। নিজের দিকে চেয়ে দেখল, করুণ হাল ওর। জায়গায় জায়গায় ছিড়ে গেছে পোশাক। সারাশরীরে ধুলোবালি। গায়ে রক্ত। যে-কেউ ভাববে, বুনো কোনও জন্তুর কবলে পড়ে আহত হয়েছে ও। অসুস্থ বোধ করছে রানা। ছুটন্ত গাড়ি থেকে পড়ে শরীরের নানান জায়গায় ব্যথা পেয়েছে। তবে নিজের পরিচর্যার চেয়েও জরুরি এখন নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করা।
দরজার দিকে ঘুরতেই মেইন গেট দিয়ে এক পুলিশকে ঢুকতে দেখল রানা। তার মাথায় হ্যাট নেই। পরনে ইউনিফর্ম শার্ট ও কালো প্যান্ট। হাতে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র।
মাত্র একজন ডেপুটি দেখে বিস্মিত হলেও রানা ভাবল, খুনের এলাকায় এত দ্রুত পৌঁছে যাওয়া কম কথা নয়। দক্ষিণের প্রত্যন্ত এলাকাতেও আইনের শাসন বজায় রেখেছে স্যাম শেরিড্যান। ভারতের রাজধানী দিল্লির পুলিশের কথা মনে পড়ল ওর। কিছু দিন আগে একদল ধর্মান্ধ জানোয়ারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরীহ মুসলিমদেরকে খুন করেছে পুলিশ ফোর্সের একদল অফিসার ও কন্সটেবল। দিল্লি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের চেয়ে ঢের দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে ক্লোভিস প্যারিশের শেরিফ অফিস।
বারান্দায় উঠতেই লোকটাকে চিনল রানা। গাল ফোলা সেই ডেপুটি। রোদে পুড়ে পাকা টমেটোর মত লাল চেহারা। মাথায় পেরেকের মত চোখা বাদামি চুল। মেরিন সৈনিকের মত খুলির দু’পাশে চেঁছে নিয়েছে চুল।
রানার ভুল না হলে তার নাম কনরাড। মদের দোকানে ডাকাতির পর শেরিফের সঙ্গে যে দুই ডেপুটি গিয়েছিল, এ তাদেরই একজন। শেরিফ বলেছিল, এর মাথা ক্রিকেট বলের মতই নিরেট। তাতে সমস্যা নেই রানার। আইনের কেউ এসেছে, সেটাই এখন বড় কথা। এবার তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, কী ঘটেছে এখানে।
কিন্তু মুখ খোলার সুযোগ পেল না রানা। হলওয়েতে পা রেখেই ওকে দেখেছে লোকটা। সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র তাক করেছে ওর বুক বরাবর। ট্রিগারে চেপে বসছে তর্জনী।
প্রথমেই নিরীহ মানুষের দিকে অস্ত্র তাক না করতে শেখানো হয় যে-কোনও দেশের পুলিশ অ্যাকাডেমিতে। রানা দেখল, ডেপুটির হাতের অস্ত্র ফোর্স থেকে ইণ্ড্য করা নয়। কোমরে কাফ পাউচ, ব্যাটন হোল্ডার, টেইয়ার ও সিএস ক্যানিস্টারের পাশে ডিউটি হোলস্টার। এখনও ওটার ভেতর রয়ে গেছে গ্লক পিস্তলটা।
ওর মাথার দিকে অস্ত্রের নল তাক করল ডেপুটি।
তাকে অতিরিক্ত আগ্রাসী বলে মনে হলো রানার।
অস্ত্রটা কালো রঙের বড় একটা রিভলভার।
সিলিণ্ডারের দিকে চেয়ে রানা বুঝল, ওই অস্ত্রটা কমপক্ষে ফোর্টি-ফোর ক্যালিবারের।
সাবধানে হাতদুটো কাঁধের কাছে তুলল রানা।
ফাঁকা, অনুভূতিহীন চোখে ওকে দেখছে ডেপুটি।
‘সাবধান, অফিসার, আমি কিন্তু খুনের সাক্ষী,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘আগেই বিদায় নিয়েছে খুনিরা।’
কথা শুনেও অস্ত্র সরাল না কনরাড। কয়েক পা এগোল
রানার দিকে। ভয় পেয়েছে, তা বোঝাতে নিজেও দুই পা পিছিয়ে লিযের লাশের অন্য পাশে সরল রানা।
আরও এক পা এগোল ডেপুটি কনরাড। রিভলভার তাক করে রেখেছে রানার কপালে। লোকটার পুলিশী কালো বুটের চাপে ভেজা কার্পেট থেকে উঠছে রক্তের বুদ্বুদ।
লিযের লাশের দু’পাশে তিন ফুট ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। লাশের পেটে গাঁথা সেইবারটা যেন পতাকাহীন দণ্ড।
ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না রানার। লাশ চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়, অথচ একবারের জন্যেও ওদিকে তাকায়নি ডেপুটি। নিষ্পলক চোখে দেখছে রানাকে।
আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু’কাঁধের কাছে হাতের তালু উঁচু করেছে রানা। তর্জনী তাক করে মেঝের লাশ দেখাল। ‘হোঁচট খেয়ো না, ডেপুটি। সামনেই কিন্তু লাশ।’ রানা ভাবছে, সত্যিই হয়তো ক্রিকেট বলের মতই কঠিন মগজের লোক কনরাড।
নাক দিয়ে ঘোঁৎ শব্দ করে মাথা নাড়ল ডেপুটি। রানার দিকে রিভলভার তাক করেই রেখেছে। অনেকটা আপন মনে বলল, ‘তুমি দেখছি ভালই জানো কীভাবে ঝামেলায় জড়াতে হয়। তবে এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবে, বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছ।’
কথা শুনে বিস্মিত হলো রানা। মেঝেতে লাশ দেখেছে, কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই লোকটার, ভাবছে অন্য কথা!
‘অস্ত্রটা নামাও, ডেপুটি। খুলে বলছি কী ঘটেছে।’ অস্ত্র সরাল না কনরাড। ট্রিগারের ওপর তার তর্জনীর নখ সাদা হতে দেখছে রানা।
ওই অস্ত্র .৪৪ বলা হলেও আসলে ৪৩। বুলেটের ব্যাস এক ইঞ্চির .৪২৯ ভাগ। বুকে গুলি ঢুকলে মুঠোর সমান গর্ত তৈরি করে বেরোবে পিঠ দিয়ে। তেড়ে আসা সাত ফুট উঁচু গ্রিজলি ভালুককেও শুইয়ে দেয়া যায় এর এক গুলিতে।
এসব রিভলভার সে-কাজেই ব্যবহার করে শিকারীরা। যেভাবে অস্ত্র তাক করেছে ডেপুটি, কেন যেন রানার মনে হচ্ছে, ভালুক শিকার নয়, ওকেই খুন করতে চাইছে সে। নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে, বুঝতে পারছে রানা। সারা গায়ে রক্ত, ধুলোবালি। নির্ঘাত ডাকাত! একটু আগে বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকেছে। মহিলা বাধা দিতেই সেইবার দিয়ে খুন করেছে তাকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে হলওয়ে। ওকেই খুনি ধরে নিয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছে না কনরাড।
কিন্তু পরক্ষণে যা ঘটল, তার উপযুক্ত কোনও কারণ খুঁজে পেল না রানা। গুলি করল ডেপুটি কনরাড।
রিভলভারের বুলেটের শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠল বদ্ধ হলওয়ে। অস্ত্রের নল থেকে বেরোল পুরো একফুট লম্বা কমলা রঙের আগুনের হলকা।
রানা একটু অসতর্ক হলেই হলওয়েতে এখন থাকত দুটো লাশ। মেঝের কার্পেটে ঝরত আরও প্রচুর রক্ত। তবে, কনরাড ট্রিগার টিপে দেয়ার আগেই লাফিয়ে সরে গেছে রানা। ওর বামহাতের ধাক্কায় ওপরে উঠেছে অস্ত্রের নল। ঝুরঝুর করে রঙ ও কাঠের কুচি পড়ছে ছাত থেকে।
রিভলভারের গুলির শব্দ ও শকওয়েভ দুটোই প্রচণ্ড। আগামী ক’দিন কানের ভেতর সোঁ-সোঁ আওয়াজ শুনবে রানা। তবুও খুশি, ঘণ্টায় হাজার মাইল বেগে পনেরো গ্রামের সীসার বুলেট ছিন্নভিন্ন করেনি ওর মগজ!
কনরাডের চেয়ে অনেক উঁচু মানের ট্রেইনিং পেয়েছে মাসুদ রানা। অস্ত্রের নল সরিয়ে দিয়েই হাত মুচড়ে রিভলভারটা কেড়ে নিল ও। একইসঙ্গে ল্যাং মেরে তাকে ফেলল শক্ত মেঝেতে।
চাইলে লাথি মেরে ভাঙতে পারত ঘাড়টা। আরও সহজ ছিল হাত ভেঙে দেয়া; অথবা, কিছু বুঝে ওঠার আগে তারই ব্যাটন দিয়ে পিটিয়ে মগজ বের করে দেয়া।
আসলে ডেপুটিকে ব্যথা দিতে চায়নি রানা।
ঝুঁকে তার ব্যাজ ওয়ালেট কেড়ে নিল ও। টান দিয়ে খুলল ডিউটি বেল্ট। ওটা ছুঁড়ে ফেলল ঘরের অন্যদিকে।
গ্লক, কাফ, টিয়ার গ্যাস ও ব্যাটন হারিয়ে ভয়ের ছাপ পড়ল কনরাডের চোখে। কুঁকড়ে গেল মার খাওয়া কুকুরের মত। রক্তে সপসপ করছে ইউনিফর্ম।
রিভলভারটা একবার দেখে নিয়ে নিজের বেল্টে গুঁজল রানা। মৃতদেহটা দেখাল ডেপুটি কনরাডকে। ‘ইনি খুন হয়েছেন। আর আমি ওই খুনের সাক্ষী। তুমি তো অফিসার, নিশ্চয়ই জানো কী হওয়া উচিত সাক্ষীর প্রতি পুলিশের আচরণ?’
‘বিরাট বিপদে পড়েছ, রানা, চাপা স্বরে বলল কনরাড, ‘এইমাত্র এক পুলিশ অফিসারের ওপর হামলা করেছ।’
‘তা না করে নির্বিবাদে খুন হয়ে যাওয়াই উচিত ছিল আমার। তাই না?’ ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল রানার।
ব্যাজ ওয়ালেট খুলে প্যারিশের ছয় কোনা সোনালি স্টার দেখল রানা। পাশের পাতায় পুলিশ আইডি কার্ড। ডেপুটির পুরো নাম বিলি এস. কনরাড।
ওয়ালেট ফেলে মাথা নাড়ল রানা। ‘ভুল ভাবছ, ডেপুটি কনরাড। মামলা হলে তুমিই ফেঁসে যাবে। নিরীহ মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে বসেছ। কোর্টে আমি বলব, নিজেকে বাঁচাতে তোমাকে নিরস্ত্র করেছি। সেটাও যাবে তোমার বিপক্ষে। অসৎ আচরণের জন্যে কঠোর শাস্তি দেবে তদন্তকারী কমিটি। সেসময়ে তোমার কাছ থেকে জরুরি কিছু তথ্য চাইবে তারা। যেমন: তুমি কোথায় পেলে এই রিভলভার? কেন ঘষে তোলা হয়েছে এর সিরিয়াল নম্বর। আরও বড় কথা, ওটা দিয়ে কেন আমাকে খুন করতে চাইলে? আমি নিজেও জানতে চাই সঠিক উত্তর। কাজেই এবার প্রশ্নগুলোর জবাব দেবে, নইলে পিটিয়ে একটা একটা করে হাড় ভাঙব।’
বিড়বিড় করে কী যেন বলল ডেপুটি কনরাড
তার বক্তব্য বুঝল না রানা। ঝুঁকল লোকটার দিকে। ‘জবাব দাও, কনরাড। জোরে কথা বলবে, তোমার গুলির কারণে ভোঁ ভোঁ করছে আমার কান। তবে ঝুঁকে দাঁড়াতে গিয়ে মস্তবড় ভুল করেছে রানা।
রক্তাক্ত মেঝেতে শুয়ে আছে কনরাড। নিতম্বের কাছে ভাঁজ করে রেখেছে দুই পা। শ্বাস ফেলছে ফোঁস ফোঁস করে। রানাকে দেখছে তীব্র ঘৃণাভরা চোখে। পরক্ষণে ডানহাতটা নিল ডান গোড়ালির ওপর। বুটে বাঁধা খাপ থেকে টান দিয়ে চকচকে কী যেন নিয়েই গেঁথে দিতে চাইল রানার পেটে!
ছোরা এড়াতে গিয়ে শরীর মুচড়ে সরল রানা, তবে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। দেরি হয়ে গেছে আধ সেকেণ্ড! টের পেল, খচ্ করে ডানদিকের পাঁজরের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত ওর পেট চিরে দিল ক্ষুরধার ছোরার ফলা। জোয়ারের মত এসে ওর মগজটাকে দখল করে নিল তীব্র ব্যথা।
আবারও ওর পেট লক্ষ্য করে ছোরা চালাল কনরাড। তবে এবার তৈরি রানা। বামহাতে ছোরাটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়েই ডানহাতের তালু দিয়ে মেরে বসল ওর ফিট্রামে।
মানুষের দেহের সবচেয়ে নাজুক অংশ ঠোঁটের ওপর নাকের ওই জায়গাটা। খুব জোরে লাগলে নাকের হাড় সোজা গিয়ে ঢোকে মগজে। ফলাফল তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। অবশ্য ডেপুটিকে খুন করতে চায় না বলেই গায়ের জোরে মারেনি রানা।
টু শব্দ না করে তারা মাছের মত হাত-পা ছড়িয়ে লিযের মৃতদেহের পাশে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকল লোকটা।
টলতে টলতে দু’পা পিছিয়ে গেল রানা। দুই হাতে চেপে ধরেছে পেট। দশ আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলগল করে বেরোচ্ছে তাজা রক্ত।
তখনই রানা শুনল, বাড়ির সামনে থামছে আরও দুটো পুলিশের ক্রুযার। বুটের ধুপ-ধাপ আওয়াজে গেস্টহাউসের দিকে ছুটে আসছে কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ।