স্টেশনে আসেন রজত সেন

স্টেশনে আসেন রজত সেন

রজত সেন প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটছেন।

শেষ শীতের হাওয়া বইছে। শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া। শীত চলে যাবার আগে একধরনের ঝটকা মারে। তাতে ঠান্ডা বেশি লাগে। রজত সেনের গায়ে গলাবন্ধ কর্ডসুলের জামা, ফুলহাতা সোয়েটার। তার ওপর নস্যি রঙের চাদর, কালো রঙের মাফলার। পায়ে লম্বা মোজা, পুরোনো কায়দার পাম্প সু। হাতে একটা লম্বা টর্চও আছে। তিন ব্যাটারির এই টর্চ রজতবাবু বহু বছর আগে কিনেছিলেন। এখনও দিব্যি সার্ভিস দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ঝাঁকানি দিয়ে জ্বালাতে হয়, এইটুকুই যা ঝামেলা।

মাফলার দিয়ে গলা, কান, মাথা ভালো করে জড়িয়ে নিয়েছেন রজতবাবু। বয়স কম হল না। এখন অল্প ঠান্ডা লাগলেই কাবু। সেই কারণেই এই সতর্কতা। তবে রজতবাবু চিরকালই নিজের ব্যাপারে সাবধানী। একটু বেশিই সাবধানী। এই নিয়ে একসময় তাকে হাসি-ঠাট্টা কম শুনতে হয়নি। অফিসে সহকর্মী, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সুযোগ পেলেই কথা শোনাত। রজতবাবু গায়ে মাখতেন না। তিনি জানেন, সাবধানী মানুষদের চিরকালই হাসি-ঠাট্টা সহ্য করতে হয়। লোকে তাদের হয় বোকা বলে, নয় নার্ভাস। সাবধানী মানুষরা নাকি এমন ভয় ভয় থাকে যে জীবনটা ঠিক মতো উপভোগই করতে পারে না। রজতবাবু এসব কখনও মানেননি। তাড়াহুড়ো, ঝুঁকি আর বেপরোয়া থাকার মধ্যে জীবন উপভোগ করবার কী আছে তিনি বুঝতে পারতেন না। চিরকাল নিজের বিশ্বাসেই অটল থেকেছেন। আজও তাই।

একসময়ে সহকর্মীরা অফিসে ঠাট্টা করে বলত, ‘সেনদা, আপনার অবস্থা তো দেখছি খুবই খারাপ। মনে হচ্ছে, এরপর থেকে আপনি দিনেরবেলাতেও টর্চ জ্বেলে পথ হাঁটবেন। পাছে ঠোক্কর খেতে হয়।’

রাগ করবার মতো কথা। দিনেরবেলায় টর্চ নিয়ে রাস্তায় বেরোবেন কেন? তার কি মাথার গোলমাল? রজতবাবু রাগ করতেন না। বরং সিরিয়াস মুখ করে বলতেন, ‘ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। এবার থেকে অফিসে ছাতা, টিফিনের সঙ্গে একটা টর্চও আনব। মেঘলা বিকেলে অফিসের সিঁড়িটা কেমন অন্ধকার থাকে। বালবগুলো সেই যে কেটেছে, নতুন করে আর লাগায়নি। অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় একবার পা ফসকালে আর রক্ষে নেই। পা ভেঙে তিন মাস বিছানায়। টর্চের কথাটা ভাগ্যিস মনে করিয়ে দিলে। এবার থেকে টর্চ জ্বালিয়ে নামব।’

প্রতিবেশীরা বলত, ‘রজতবাবু আপনি যেভাবে সাইকেল চালান তাতে শ্লো মোশান ক্যাটাগরিতে গিনেসবুকে নাম তুলতে পারেন। যদি রাজি থাকেন, আপনার একটা পাসপোর্ট ফটো পাঠিয়ে দেখতে পারি।’

রজতবাবু হেসে বলতেন, ‘তাড়াহুড়ো করে সাইকেল চালিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করার থেকে গিনেস বুকে নাম তোলা ভালো। আর সাইকেলে কতটুকুই বা পথ যাই? স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে তো সাইকেল জমা রেখে ট্রেন ধরি। হাতে একটু সময় নিয়ে বেরোলেই হয়ে যায়।’

আত্মীয়স্বজনের বিয়েবাড়িতে গেলে খাবার সময় ভাবনাচিন্তা করেন রজতবাবু। কোন খাবারটা নিরাপদ? কোনটায় অম্বল হবে না? পেট কনকন করবে কোন খাবারে? ভাগ্নে-ভাগ্নিরা ঠাট্টা করে বলে, ‘অত ভেব না ছোটমামা। তোমার জন্য কাঁচাকলার ঝোল করতে বলা হয়েছে। বিয়েবাড়ির মেনুতে এই প্রথম কাঁচাকলার ঝোল। খবরের কাগজের নিউজ হয়ে যাবে।’

হাসিঠাট্টা এখন অবশ্য বন্ধ হয়ে গেছে। তবে সাবধানে থাকা বন্ধ হয়নি রজতবাবুর। পা ভাঙা, ঠান্ডা লাগা, পেটের অসুখ সব কিছু নিয়ে তিনি আজও সতর্ক। ধীরে সুস্থে পথ চলেন। বাইরের খাবার মুখে তোলেন না। সারা বছর গরম জলে স্নান করেন। বেরোবার আগে আকাশে মেঘের টুকরো দেখলে বগলে ছাতা নেন। একবার ভিড় ট্রেনে পাবলিকের কনুইয়ের গুঁতো পেটে লেগেছিল। তারপর থেকে ভিড় ট্রেনে পারতপক্ষে ওঠেন না। সাবধানে থাকা একটা সময় পর্যন্ত যথেষ্ট কাজে দিয়েছে। অসুখ বিসুখে কম পড়েছেন। অফিসে সুনাম ছিল। বস পছন্দ করত। তার থেকেও দশ-বারো বছরের ছোট সহকর্মীরা রাস্তায় হাবিজাবি খেয়ে পেট ব্যথা নিয়ে বাড়িতে কঁকিয়েছে, বৃষ্টিতে ভিজে ধুম জ্বরে সাত দিন অফিস কামাই করেছে। রজতবাবু কিন্তু অফিসে হাজির থেকেছেন। টিফিনে মুড়ি শশা খেতে খেতে মিটিমিটি হেসে বলেছেন, ‘সাবধানী হওয়ার ডবল সুবিধে। অফিস কামাই হয় না, আবার ওষুধের জন্য পয়সাও নষ্ট হয় না।’

সহকর্মীরা রেগে যেত। বলত, ‘জীবনটা সবসময় সাবধানে কাটলে মজাই থাকে না।’

রজতবাবু বলতেন, ‘মজা করতে গিয়ে আমি বাপু কুপোকাৎ হয়ে থাকতে রাজি নই। মজা করে বিছানায় পড়ে থাকার থেকে, সুস্থ হয়ে ঘুরে বেড়ানোই আমার কাছে সুবিধের।’

এখন আর এসব শুনতে হয় না। রজতবাবুও জানতেন, একদিন সবই থেমে যাবে। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়।

রজতবাবু স্টেশনের পূর্ব দিকে যাচ্ছেন। ওদিকটায় ওভারব্রিজ। ব্রিজ টপকে বাঁ-দিকে খানিকটা গেলে ডাউন প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় পৌঁছোনো যায়। সেখানে মাথার ওপর প্ল্যাটফর্মের ছাউনি নেই। খোলা আকাশের নীচে একটা বকুল গাছ। গাছটাকে গোল করে ঘিরে বসার জন্য বাঁধানো জায়গা। রেল কোম্পানি ভারী সুন্দর ব্যবস্থা করেছে। অনেক সময় ট্রেনে চেপে যাওয়ার সময় জানলা দিয়ে এই ধরনের ছোটখাটো স্টেশন চোখে পড়ে। গাছের তলায় বাঁধানো জায়গা দেখে মনে হয় ইস, একবার যদি ওখানে খানিকক্ষণ বসা যেত! কিন্তু তা তো সম্ভব হয় না। ট্রেন হুড়মুড়িয়ে ছুটে স্টেশন পার হয়ে যায়। বকুল গাছের তলার এই বাঁধানো জায়গাটা ঠিক সেরকম। দেখলেই মনে হবে, একটু বসি। বসা যায় আবার শোওয়াও যায়। দূরের মাঠ, খেত থেকে আসা হাওয়ায় গাছের পাতায় ঝিরঝির আওয়াজ হয়। তবে এদিকটায় লোকজন প্রায় আসে না বললেই চলে। লোকাল ট্রেন তো আর প্ল্যাটফর্মের অতদূর পর্যন্ত পৌঁছোয় না। অত লম্বা নয়। বড় মেল বা এক্সপ্রেস গাড়ি হলে আলাদা কথা। তখন পিছনের একটা-দুটো কামরা প্ল্যাটফর্মের বাইরেই থেকে যায়। অবশ্য এই স্টেশনে বড় ট্রেন আর ক’টা দাঁড়ায়? দিনে মেরে কেটে একটা বা দুটো। বুকল গাছের তলাটা সারাদিনই ফাঁকাই পড়ে থাকে। দু-একজন ভবঘুরে দুপুরে এসে মাঝে মাঝে ঘুম দেয়। রাতে প্রশ্নই ওঠে না।

হাওয়ার কনকনানিটা বাড়ল। রজতবাবু থমকে দাঁড়ালেন। মাফলারটাকে ভালো করে পেঁচিয়ে নিলেন। মাঙ্কি ক্যাপটা থাকলে ভালো হত। শীতের জন্য জুতসৎ জিনিস। মাথার চারপাশটা এমন ঢেকেঢুকে থাকে যে হাওয়া ঢোকবার পথ পায় না। রজতবাবুর একটা নয়, দুটো মাঙ্কি ক্যাপ আছে। আজ বেরোবার সময় একটাও খুঁজে পেলেন না। একা মানুষের এই এক ঝামেলা। ঠিক সময় কাজের জিনিস খুঁজে পাওয়া যায় না। মাফলার ঠিক করে রজতবাবু আবার হাঁটতে শুরু করলেন।

রেল স্টেশন একেক সময় একেরকম। কখনও খুব ব্যস্ত, কখনও বিরাট অলস। দুটোই চরম। ব্যস্ততার সময় হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি, চেঁচামেচির শেষ নেই। আর যখন অলস তখন একেবারে কোনও নড়াচড়া নেই। অজগর সাপের মতো ঝিম মেরে পড়ে থাকে। ট্রেন আসা যাওয়ার খবর হলে আড়মোড়া ভেঙে ওঠে।

এখন রাত ক’টা? এগারোটা হয়ে গেছে। শীতের রাত। মনে হচ্ছে, আরও বেশি। আচ্ছা, রজত সেন এত রাতে স্টেশনে কী করতে এসেছেন? তিনি কি ট্রেন ধরবেন? কোথাও যাবেন? তাকে দেখে কিন্তু সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না। হাতে ব্যাগ-ট্যাগ কিছু নেই। শীতের রাতে ট্রেন জার্নি করতে হলে সঙ্গে একটা ব্যাগ অন্তত থাকা উচিত। তাতে মোটা চাদর থাকবে। জলের বোতল থাকবে। তেমন হলে একটা গল্পের বইও থাকবে। সেসব কিছু তো নেই! তাছাড়া, এই সময় ট্রেন কোথায়? আপ ডাউন দুদিকের লাস্ট ট্রেনই চলে গেছে। গাড়ি আবার সেই ভোর রাতে। কলকাতা যাবার প্রথম ট্রেন তিনটে বেজে বাইশ মিনিটে। মাঝখানে দুটো এক্সপ্রেস আর একটা মেল স্টেশন টপকাবে। এই যেমন খানিকটা পরেই যাবে মাঝেরহাট এক্সপ্রেস। তবে সেসব গাড়ি এখানে থামবে না। কান ফাটানো হুইশল বাজিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটবে। তারমধ্যে কারও কারও ইচ্ছে হলে স্টেশনের কাছে গতি কমায়। একটা সময় মাঝেরহাট এক্সপ্রেসের এই কাণ্ড ছিল। সিগন্যাল না পেলে দাঁড়িয়ে পড়ত স্টেশনের বাইরে। দু-একজন ওঠানামাও করত। তবে সে একেবারেই হঠাৎ। ‘যদি ট্রেন দাঁড়ায় তাহলে ছুটে গিয়ে ওঠা যাবে’—এমন ভেবে নিশ্চয় কেউ এত রাতে স্টেশনে আসে না।

তাহলে; তাহলে রজত সেন এত রাতে কী করতে এসেছেন? মাঝরাতে স্টেশনে বেড়াতে এসেছেন নাকি?

না, বেড়াতে নয়। রজতবাবু এসেছেন দরকারে।

বছরের এই একটা রাতে রজতবাবু স্টেশনে আসবেনই। গত তিন বছর ধরে এই কাণ্ড চলছে। সে যতই শীত পড়ুক আর অসুবিধে হোক। গতবার তো খুব বৃষ্টি হয়েছিল। অসময়ের ঝড়-বৃষ্টি। রজতবাবু রেনকোট পড়ে, ছাতা মাথায় এসেছিলেন। ভিজে একসা। রজতবাবু আসেন সাইকেল চালিয়ে। বাড়ি থেকে স্টেশন পর্যন্ত সাইকেলে আসতে আধঘণ্টার কাছাকাছি সময় লাগবার কথা। একটা গ্রাম পেরিয়ে, খালের সেতু টপকে, বাজারের কোল ঘেঁষে আসতে হয়। রজতবাবুর আরও দশ-বারো মিনিট বেশিই লাগে। তিনি ধীরে ধীরে সাইকেল চালান। শীতের রাতে পথঘাট শুনশান থাকে। অন্য কেউ হলে বনবন করে ছুটত। আধঘণ্টার পথ, পনেরো মিনিটে ফুরিয়ে দিত। সাবধানী রজতবাবু তা করেন না। তিনি এক হাতে টর্চ জ্বেলে দেখেশুনে সাইকেল চালান। এলাকার কেউ কেউ রজতবাবুর এই নৈশ সফরের খবর জানে। সবাই জানে না। যারা জানে না তারা অবাক হয়। এই তো আজই হয়েছে।

শশধর আর ছিদাম দোকানের জিনিসপত্র গুছিয়ে বাজার থেকে ফিরছিল। আজ তাদের রাত হয়ে গেছে। দুজনেই হন হন করে হাঁটছিল। খিদে পেয়েছে খুব। খালের কাছাকাছি আসবার সময় হঠাৎই একটা আলো চোখে পড়ল। আলোটা যেন লাফাচ্ছে। ছিদামের বয়স কম। তার আবার ভয়ও বেশি। সে থমকে দাঁড়াল। শশধরের হাত চেপে ধরল।

‘শশধরদা, ওটা কীসের আলো।’

শশধর ভুরু কুঁচকে বলল, ‘টর্চের আলো।’

ছিদাম কাঁপা গলায় বলল, ‘আলোটা লাফাচ্ছে কেন?’

শশধর একটু খেয়াল করে বলল, ‘মনে হচ্ছে সাইকেলে থেকে কেউ আলো ফেলছে।’

ছিদাম শশধরের গা ঘেঁষে এসে বলল, ‘এই শীতের রাতে সাইকেলে করে কে যায়! চোর-ডাকাত নয় তো?’

শশধর চাপা গলায় ধমক দিয়ে বলল, ‘চোর-ডাকাত হতে যাবে কেন? চোর-ডাকাত সাইকেল চেপে টর্চ জ্বেলে কখনও যায়?’

ছিদামের ভয় কাটল না। সে ফিসফিস করে বলল, ‘কী হবে শশধরদা, আমাদের কাছে তো বাজারের টাকাপয়সা আছে। লোকটার কাছে ছুরি, বন্দুক থাকে যদি? টাকাপয়সা কেড়ে নেবে না তো?’

এবার শশধরও চিন্তিত হল। ছিদাম ভীতু হলেও কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সঙ্গে টাকাপয়সা আছে। আজকাল ডাকাতি, ছিনতাইয়ের নানারকম কায়দা বেরিয়েছে। গোবেচারা লোকও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।

আলোটা এগিয়ে আসছে। সাইকেলের চাকা, চেইনের ঝনাৎ ঝনাৎ আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে। শশধর দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। কী করবে? রাস্তা থেকে মাঠের মধ্যে চলে যাবে? তাতে লাভ নেই। লোকটা যদি সত্যি চোর-ডাকাত হয় আর হাতে অস্ত্র-টস্ত্র থাকে সে-ও তাড়া করবে। না, এরপর থেকে আর টাকাপয়সা নিয়ে এত রাতে বাড়ি ফেরা যাবে না। ফিরলেও দলবেঁধে ফিরতে হবে। ইস, আজই কানাই, রতন, নিখিল একসঙ্গে ফেরবার জন্য ডাকাডাকি করছিল। ওদের সঙ্গে বেরোতে পারলে আর চিন্তা ছিল না। গোছাতে গোছাতে দেরি হয়ে গেল।

সাইকেল এগিয়ে আসছে। চালককে দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারে মিশে আছে যেন।

ছিদাম শশধরের কাঁধের কাছটা খিমচে ধরল। শশধর চাপা গলায় বলল, ‘ভয় পাস না। আমরা তো দুজন আছি। একটা লোক আমাদের কী ক্ষতি করবে?’

ছিদাম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘কী হবে দাদা!’

শশধর বলল, ‘রাস্তা ছেড়ে নেমে আয়।’

কথাটা বলে একরকম টান মেরেই ছিদামকে নামিয়ে নিল শশধর। মেঠো রাস্তা ঢালু হয়। এদিকটায় খাল থাকায় এই ঢাল বেশি। সেই ঢালের কারণে দুজনে খানিকটা আড়ালে চলে গেল। শশধর ফিসফিস করে বলল, ‘লোকটার দিকে তাকাবি না। উলটো দিকে মুখ করে থাক। আমাদের যেন ঠাওর করতে না পারে।’

আজ কি আমাবস্যা? তাই মনে হয়। চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। তারওপর কুয়াশার চাদর। সবকিছুই আবছা। আঁকাবাঁকা সরু মেঠো রাস্তার ওপর দিয়ে ঝনঝন করে রজতবাবুর সাইকেল চলে গেলে আরও খানিকটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল শশধর আর ছিদাম।

ছিদাম নিশ্চিন্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘চল শশধর। লোকটা দেখতে পায়নি।’

রাস্তায় ওপর ফিরে আসতে আসতে এবার শশধরের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। আরে! আজ কত তারিখ? এই দিনটায় পালপাড়ার রজত সেন স্টেশনে যায় না? কিন্তু লোকটা কি রজত সেনই ছিল? নাকি অন্য কেউ?

শশধর বাকি পথ থম মেরে রইল। ছিদাম হেসে বলল, ‘কী হয়েছে শশধর! হঠাৎ থম মেরে গেলে যে? আর তো ভয় নেই।’

শশধর চাপা গলায় বলল, ‘কিছু হয়নি। লোকটাকে খেয়াল করলি?’

ছিদাম দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘খেপেছ? ডাকাতকে খেয়াল করে মরি আর কী? কেন বল তো?’

শশধর বলল, ‘কিছু না। তাড়াতাড়ি চল।’

রাতে রজতবাবুর স্টেশনের যাওয়ার ঘটনা শশধরের মতো অল্প কয়েকজনই জানে। তবে আলোচনা করে না। স্টেশনেও তাই। স্টেশন মাস্টার কার্তিকবাবু, চায়ের দোকানদার গগন, বলাই ভিখিরি আর ভবঘুরে পটাস জানে, এই দিনটায় রজত সেন আসবেন। নিজের মতো হাঁটতে হাঁটতে প্ল্যাটফর্মের মাথা পর্যন্ত যাবেন। বকুল গাছের তলায় বসবেন। যতক্ষণ না মাঝেরহাট এক্সপ্রেস হুশহুশ করে সামনে দিয়ে চলে না যায় বসে থাকবেন চুপটি করে। কাউকে বিরক্ত করেন না। নিজের মতো আসেন, নিজের মতো চলে যান। মুখোমুখি হলে হয় অন্যমনস্ক থাকেন, নয় মুচকি হাসেন। প্রথম বছর কার্তিকবাবু সামনে পড়েছিলেন। থতমত খেয়ে যান। রজতবাবু হেসে জিগ্যেস করেছিলেন, ‘শরীর ভালো তো? সময়টা ভালো নয়। আপনার আবার বাইরে কাজ। গরম পোশাক পরবেন।’

গতবার বৃষ্টিতে ভিজে গগনের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। গগন তখন দোকান গুটিয়ে ফেলেছে। শীতের রাত, তার ওপর ঝড়-বাদলা। কে চা খাবে? ট্রেনও আর নেই। রজতবাবুকে দেখে আঁতকে উঠেছিলেন।

‘এক কাপ চা হবে নাকি ভাই? খুব ভেজান ভিজেছি। শুধু আমাকে না, বেচারি বলাইটাকেও দিও। ছেলেটা শীতে কাঁপছে। ঠান্ডায় নিমোনিয়া না হয়ে যায়।’

শুধু কি তাই? মোটেও নয়। ভবঘুরের পটাশের জন্যও চিন্তা করেন। একবার ওভারব্রিজে ওঠবার সময় দেখা হয়ে গেল। পটাশ অন্ধকারে কুঁকড়ে মুঁকড়ে শুয়ে ছিল। রজতবাবু কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই হাউমাউ করে ধড়ফড় করে উঠে বসে। ভয় পেয়ে গিয়েছিল বেচারি। স্বাভাবিক। অত রাতে মাফলার জড়ানো কাউকে দেখলে ভয় তো হবেই। রজতবাবু নরম গলায় বললেন, ‘তোর বলিহারি বুদ্ধি বটে পটাশ। স্টেশনে এত জায়গা থাকতে ওভারব্রিজে শুয়ে আছিস? মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হলে কে দেখবে রে বেটা?’

এই লোককে বিরক্ত করবার প্রশ্ন ওঠে? একেবারেই না। তা ছাড়া স্টেশন তো কারও একার নয়। যার দরকার আসাযাওয়া করতে পারে। রজত সেনেরও নিশ্চয়ই দরকার আছে। নইলে এত রাতে আসবে কেন? গগন একবার ভেবেছিল জিগ্যেস করবে। বলাই আর পটাশই বারণ করেছে।

বলাই বলেছিল, ‘দরকার কী বাপু? উনি যদি রেগে যান।’

পটাশ বলেছিল, ‘যান কী? যাবেনই। এই যে স্টেশনে এত লোক আসে যায় আমরা কি তাদের কারণ জিগ্যেস করি।’

কার্তিকবাবু অবশ্য বদলির অ্যাপ্লিকেশন করে চলে গেছেন। আর নতুন স্টেশন মাস্টারমশাই বছরে এই দিনটায় অবধারিত অসুখে পড়েন। ভোরের আলো ফোটবার আগে ঘর থেকে বেরোতেই চান না। ট্রেন এলে কোনওরকম ফ্ল্যাগ দেখিয়ে ঘরে সেঁধিয়ে যান।

রাতের রেলস্টেশন ভালো লাগে রজতবাবুর। শুনশান, ছমছমে। মনে হয়, সারাদিনের হইচই-তে স্টেশন ছিল বিরক্ত। এবার নিজের মতো একা হয়েছে। শান্ত হয়েছে। প্ল্যাটফর্ম, ওভারব্রিজ, রেললাইন, টিকিটঘর, লোহার বেঞ্চ, চায়ের গুমটি সবকিছু নিয়ে গুড়িসুড়ি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে। দূরে সিগন্যালের আলোরাও থাকে ঝিম মেরে। কুয়াশা মেখে ধোঁয়া ধোঁয়া।

রজন সেন বকুলতলায় বসে আছেন। শীত করছে আবার ভালোও লাগছে। পরের বছর সঙ্গে একটা ফ্লাস্ক আনলে কেমন হয়। গরম চা ভর্তি থাকবে। যতক্ষণ না মাঝেরহাট এক্সপ্রেস আসে ততক্ষণ একটু একটু খাওয়া যাবে। বেশ হবে না? নিজের মনেই হাসলেন রজত সেন।

হ্যাঁ, মাঝেরহাট এক্সপ্রেসের জন্যই তিন বছর ধরে এই দিনটায় রাতে স্টেশনে আসেন রজনবাবু। না এসে উপায় কী?

চার বছর আগের ঘটনা। সহকর্মীর মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলেন রজতবাবু। বেরোতে দেরি হয়ে গেল। হাওড়া স্টেশনে এসে দেখলেন লাস্ট ট্রেন বাতিল। কেউ বলল, কলকাতায় থেকে গেলেই ভালো। সাবধানী রজতবাবু পছন্দ হল না। তিনি মোটে বাইরে রাত কাটাতে পারেন না। নিজের বিছানা ছাড়া ঘুম হয় না। তাছাড়া, কলকাতায় থাকবার মতো তেমন চেনাজানাও নেই। স্টেশনে খোঁজ নিয়ে জানলেন, একটু পরেই মাঝেরহাট এক্সপ্রেস ছাড়বে। ওই পথেই যাবে। প্রায় রোজই গাড়িটা রজতবাবুর স্টেশনের কাছে মুহূর্তখানেকের জন্য থমকে যায়। কখনও কখনও লোকজন ওঠানামাও করে। ঝুঁকি নিয়ে চলে গেলে বাড়ি। রজতবাবু ভাবলেন। ট্রেন যদি না থামে? কী আর হবে? পরের জংশনে গিয়ে নামলেই হবে। ঘণ্টা দু-তিন স্টেশনে কাটিয়ে ফার্স্ট ট্রেন ধরে ফেরা যাবে। জংশন থেকে ফিরতে আধঘণ্টা তো মোটে লাগবে। কলকাতায় থাকার থেকে সে অনেক ভালো। বাড়ির কাছে তো চলে যাওয়া যাচ্ছে।

রজত সেন ট্রেনে উঠে বসলেন। মাঝেরহাট এক্সপ্রেস। সাবধানী রজতবাবুর সেটাই সবথেকে বড় ভুল। শেষ ভুল।

নিজের স্টেশনের কাছে আসার আগেই রজতবাবু গেটের কাছে চলে এসেছিলেন। হু-হু করে বাতাস বইছিল। ট্রেন ছুটছিল অন্ধকার কেটে। গায়ের কোটটা ভালো করে চেপে ধরেছিলেন রজতবাবু। ট্রেন কি থামবে?

হ্যাঁ থামল। প্ল্যাটফর্ম যেখানে শেষ হব হব সেখানে থামল। ওই তো বুকলগাছ আর নীচের বাঁধানো বসার জায়গাটা দেখা যাচ্ছে। কুয়াশা মাখা। রজতবাবু কাঁধের ব্যাগ সামলে দ্রুত ট্রেনের উঁচু সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। অতি সাবধানে একটা পা মাটিতে রাখলেন। মুহূর্তে ট্রেন ঝাঁকুনি দিল। ছিটকে পড়লেন রজতবাবু। ব্যালান্স হারিয়ে গড়িয়ে গেলেন পাথর আর লোহার লাইনের ওপর দিয়ে। কিছু বোঝবার আগেই শরীরের অনেকটা চলে গেল ট্রেনের নীচে।

মাঝেরহাট এক্সপ্রেস সিগন্যাল পেয়ে হইশল বাজাল তারস্বরে। ছুটতে শুরু করল মহানন্দে।

মৃত্যুর আগে রজত সেন কষ্ট পেয়েছিলেন খুব। অন্ধকার লাইন থেকে আহত মানুষটাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাবার মতো কেউ ছিল না। শীতের ওই রাতে কে থাকবে? আর ওটা তো স্টেশনও নয়। স্টেশনের শেষ। যেখানে মানুষজন থাকে না।

বছরের এই দিনটায় রাতের স্টেশনে রজতবাবু আসবেনই। ফের যদি মাঝেরহাট এক্সপ্রেস থামে। ফের যদি তিনি নামতে যান? বারণ করতে হবে। সাবধান করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *