স্টিফেন ম্যানসন – ৬৫

(পঁয়ষট্টি)

সিলভার হোটেলের এমডি-র ঘরে শান্তা মায়ের সঙ্গে কথা বলছে মিলেনা। শান্তা মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই এত নার্ভাস হয়ে পড়েছিস কেন মা? ঈশিতার সঙ্গে একটু আগেই ফোনে আমার কথা হয়েছে। দেবকে সঙ্গে নিয়ে বিডন স্ট্রিট থেকে ওরা বেরিয়ে পড়েছে। তুই বরং নীচে নেমে দ্যাখ, জিম ইনোগোরেশনের কাজ ঠিকঠাক চলছে কি না?’

সকাল থেকে মিলেনা টেনশনে। সময় যত গড়িয়েছে, ততই ওর টেনশন বেড়েছে। কাল কথা প্রসঙ্গে ঈশিতা বলেছিল, ‘তোমার দেবদূত এখন পুরনো অনেক কথা মনে করতে পারে না। কাছের মানুষকেও কখনও কখনও চিনতে পারে না। মাথায় চোট লাগার জন্যই ওর এই হাল।’ কথাগুলো শোনার পর থেকে নতুন একটা আশঙ্কা মিলেনাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সকালে ব্লাড প্রেসার চেক করেছিল। উপরের দিকে একশো ষাট। একটা কথাই ওর মাথায় ঘুরছে, সত্যিই যদি দেবদূত ওকে চিনতে না পারে? কাল অনেক রাত পর্যন্ত মিলেনা কম্পিউটারে গুগল সার্চ করে গেছে। বিশ্বের কোথায় এই স্মৃতিলোপের সবথেকে ভাল চিকিৎসা হয়, সেটা জানার জন্য। শেষে ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, দরকার হলে দেবদূতকে ভিয়েনায় নিয়ে যাবে। ওকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে ফিরবে।

সত্যি বলতে কি, ঈশিতার সঙ্গে আচমকা টাইগ্রান ব্যাঙ্কোয়েট হলে ওর দেখা হয়ে না গেলে দেবদূতের খোঁজই পেত না মিলেনা। কালই ও শিখিন চ্যাটার্জির বাড়ি যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ঈশিতা ঠিক পরামর্শ দিয়েছিল, ‘তুমি হুট করে দেবদার সামনে যেও না। বুঝতেই পারছ, ওর মেন্টাল কন্ডিশন ঠিক নেই।’ ওদের মধ্যে যখন এইসব কথা হচ্ছে, তখনই প্রান্তিক ফোন করে খবর দেয়, সিলভার জিম-এর কাছে এমন একজনকে দেখা গেছে, যাকে দেবদূতের মতো দেখতে। কিন্তু ওরা স্পটে যাওয়ার পর শোনে পাখি উড়ে গেছে। প্রান্তিককে যখন মিলেনা খুব বকাবকি করছিল, তখনই ঈশিতা বলে, ‘তোমরা চিন্তা কোরো না। দেবদাকে আমি এখানে নিয়ে আসব। দেখো, জিম-এর টানেই ও আসবে।’

সাংবাদিকদের মাথা খুব শার্প হয়। ঈশিতার সঙ্গে অল্প সময়ের আলাপেই, মিলেনা সেটা বুঝে যায়। ঈশিতার কথাগুলো ওর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছিল। তিনমাস আগে সিলভার হোটেলের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম বোর্ড মিটিংয়ের শেষে ড্যাডি বলে দিয়েছিল, ‘রুথলেস না হলে তুমি বিজনেস চালাতে পারবে না। আবেগের থেকে বেশি গুরুত্ব দিও যুক্তিকে।’ ড্যাডির কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে মিলেনা। ও প্রথমেই জিম-এর নামটা বদলে দেয়। ‘দেব’স জিম’ নামটা রেখেছে, আনন্দী শরাফের গালে থাপ্পড় মারার জন্য। পাণ্ডেজিকে সরিয়ে সেই জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে ববিকে। স্টিফেন ম্যানসনে আগুন লাগার আগে জিম নিয়ে নানা স্বপ্নের কথা বলত দেবদূত। সব মনে আছে মিলেনার। দেবদূতের সব ইচ্ছে ও পূরণ করবে।

ঈশিতার সামনেই শান্তা মা বলেছিলেন, ‘তা হলে কালই জিম-এর অফিসিয়াল ইনোগোরেশন করে দাও মিলেনা। সেই ছুঁতোয় দেবদূতকে নিয়ে আসুক ঈশিতা।’

কথাটা মনে ধরে যায় মিলেনার। মাত্র দু’ঘণ্টার মধ্যে লোকজন ইনভাইট করা, অনুষ্ঠানটা কী হবে, তার প্ল্যানিং… ও করে ফেলেছে ববি, মারিয়া আর শান্তা মায়ের সঙ্গে বসে। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এত বড় একটা অনুষ্ঠান করা যাবে কি না, তা নিয়ে মিলেনার সন্দেহ ছিল। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করেছে ববি আর মারিয়া। মেল আর ফোন করে ওরা দু’জন সেলেব্রিটিদেরও ইনভাইট করেছে। বিশেষ করে, টিভি আর্টিস্ট আর মডেলদের। গতকাল রাতে ঈশিতা নিশ্চিন্ত করেছিল, ‘জিম-এর ইনগোরেশনের অ্যারেঞ্জমেন্টটা করে ফেলো। তোমার দেবদূত সিলভার হোটেলে যেতে রাজি হয়ে গেছে। অ্যাজ ইফ, আমি পার্টি দিচ্ছি, অফিসে আমার প্রোমোশনের জন্য। তোমার কথা ওকে কিছু বলিনি। ও জানে, নতুন জিম-এর ওপেনিং হচ্ছে। আর ও চিফ গেস্ট।’ আজ বিকেল পর্যন্ত মিলেনা অন্তত বারদশেক ফোনে কথা বলেছে ঈশিতার সঙ্গে। বার পাঁচেক নীচে নেমে দেখেছে, জিম সাজানোর কাজ ঠিকঠাক চলছে কি না। ঈশিতার পাঠানো একটা ভিডিয়ো ক্লিপিংস দেখে মিলেনার উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। ঈশিতার ভাইয়ার সঙ্গে দেবদূত পাঞ্জা লড়ছে। প্রাইজ হিসেবে মাটন রোল পেয়ে ও কী খুশি!

ওর এই হাসিমুখটাই মিলেনা সারাজীবন দেখতে চায়। নাজমা বলত, ‘দিদি তোমার বরের বডিটা না ঠিক সলমন খানের মতো। কিন্তু হাসিটা মিঠুন চক্কোত্তির।’ তখন ওকে ধমক দিত মিলেনা। কিন্তু গত কুড়িটা মাস ওই হাসি দেখার জন্য কী উদ্বেগের মধ্যেই না কেটেছে ওর। লন্ডন থেকে প্রায়ই ও ফোন করত চেনা-পরিচিতদের। কেউ দেবদূতকে দেখেছে কি না, জানার জন্য। কলকাতায় এসে মিলেনা আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। তমালের মুখে যখন ও শুনেছিল, চণ্ডীতলাতেও কেউ জানে না, দেবদূত কোথায়? নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেয়ে ও কোথায় গেছে? তমালের মুখে দেবদূতের মায়ের মৃত্যুর খবরটা অবশ্য মিলেনা পেয়েছিল। ওইরকম হতাশাজনক পরিস্থিতিতে শান্তা মা তখন শুধু বলত, ‘আমার মন বলছে, দেবদূতের সঙ্গে তোর দেখা হবেই মা। ও বেঁচে আছে।’ আজ দেবদূতের মুখোমুখি হলে ও কী করবে, মিলেনা ভেবে উঠতে পারছে না।

জিম-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানটা যাতে ও ঘরে বসে দেখতে পায় সেজন্য স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে ববিরা। বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময়ই এমডি-র ঘরে বসে টিভিতে মিলেনা দেখতে পেল, ইনভাইটিরা একে একে সবাই আসছেন। জিম-এর গেটে তাঁদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন শান্তা মা। যোগা শেখানোর জোনে কোনও ইকুইপমেন্ট নেই। সেখানে শ’খানেক চেয়ার পাতা রয়েছে। তার উল্টো দিকে একটা পোডিয়াম। মিলেনা দেখল, শ্রীকৃষ্ণাচৈতন্য টেম্পলের আচার্যদেবকে নিয়ে গিয়ে শান্তা মা বসালেন পোডিয়ামে। বিশুদ্ধানন্দজির সঙ্গে এসেছে অ্যানা, ডিম্পল আর ওদের বরেরা। জিম-এর মেম্বারদের মধ্যে শীলা মোতওয়ানিকে দেখতে পেল মিলেনা। কাঁটায় কাঁটায় ছ’টায় ঈশিতার সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে এল দেবদূত। জিম-এ ঢোকার মুখে দরজা ছুঁয়ে একবার প্রণাম করে নিল। ও প্রায়ই বলত, ‘জিম হল আমার কাছে মন্দিরের মতো।’

দেবদূতের পরনে নীল থ্রি পিস স্যুট। ওকে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে অবাকই হল মিলেনা। গেটের বাইরে ওকে জড়িয়ে ধরেছে তমাল। ফিতে কেটে দেবদূত ভিতরে ঢুকে আসতেই হাততালির বন্যা বয়ে গেল। এ কী, দু’নম্বর জোনে ঢুকে ও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল কেন? নিজের চেম্বারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শান্তা মা ওকে কিছু বললেন। সঙ্গে সঙ্গে দেবদূত পোডিয়ামের দিকে হাঁটতে লাগল। দেখে মিলেনা খুশি হল। নির্ঘাত ওর আঁকা ছবিটা দেবদূতের চোখে পড়েছে। আগুন লাগার দিন যে ছবিটা ও গিফট করেছিল দেবদূতকে। ছবিটা ইচ্ছে করেই মিলেনা চেম্বারে ঝুলিয়ে রেখেছে, দেখে যাতে ওর কথা মনে পড়ে।

একতলায় এমডি-র ঘরে একা বসে মিলেনা টিভির পর্দায় সব লক্ষ্য করে যাচ্ছে। পোডিয়ামে পাশাপাশি তিনজন বসে বিশুদ্ধানন্দজি, গ্র্যান্ডপা আর দেবদূত। গতকালই স্টিফেন ম্যানসনের ফ্ল্যাটে ফিরে এসেছেন গ্র্যান্ডপা। ওঁকে আমন্ত্রণ জানানোর পরামর্শটা দিয়েছিলেন শান্তা মা। গ্র্যান্ডপা হেসে কথা বলছেন দেবদূতের সঙ্গে। নিশ্চয়ই বডিবিল্ডিং নিয়ে। কেননা উনি একবার দেবদূতের হাতের মাসল টিপে দেখলেন। সন্ধের এই সময়টায় গ্র্যান্ডপা রোজ মোকাম্বোতে যান। কিন্তু ববি যখন অনুষ্ঠানে আসার কথা বলে, তখন না কি শুধু দেবদূতকে দেখার জন্যই উনি রাজি হয়ে গেছিলেন। গ্র্যান্ডপার সেই খিটখিটে মেজাজটা আর নেই। মার্থা আর ববি ওঁকে একেবারে বদলে দিয়েছে। পরিবর্তন দেবদূতেরও কম হয়েছে না কি? আগে সবসময় ক্লিন শেভড থাকত। এখন একগাল দাঁড়ি-গোঁফ। ওর ব্যক্তিত্ব অনেকটাই বদলে গিয়েছে। কিন্তু চোখের কোণে ক্লান্তিটা ঢেকে রাখতে পারেনি।

অ্যাঙ্কর মারিয়া অনুষ্ঠান শুরু করে দিয়েছে। পোডিয়ামে বসা গেস্টদের ফুলের স্তবক তুলে দিচ্ছেন মার্থা। কাল রাতেই পুরো প্রোগ্রামটা ছকে দিয়েছিল মিলেনা। মারিয়াকে ও বলেই দিয়েছিল, পুরো অনুষ্ঠানে একবারও যেন আনন্দী শরাফের নাম না ওঠে। ও যেন বারবার বলে, জিম-এর এত সাফল্যের পিছনে মাত্র একজনই। সে হল চিফ ট্রেনার দেবদূত। তমালের কাছ থেকে ববি আধ ঘণ্টার ভিডিয়ো ক্লিপিংস জোগাড় করেছে। বেঙ্গালুরুতে যেবার দেবদূত মি. ইন্ডিয়া টাইটেল জেতে, সেই কনটেস্টের ক্লিপিংস। অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে পর্দায় সেইসময়কার ছবিও ববি দেখিয়ে যাচ্ছে। খেতাব জিতেছে জানার পরই দেবদূত দু’হাত তুলে পোজ দিল। ওর পুরো শরীরে সাজানো মাসল। সেই দৃশ্য দেখে হাততালির ঝড় উঠল। গেস্টদের উচ্ছ্বাস দেখে দেবদূত কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ও পর্দার দিকে তাকিয়ে রইল।

মারিয়াকে বলাই ছিল, অনুষ্ঠানে প্রথমে বলবেন আচার্য বিশুদ্ধানন্দজি। তারপর শুধু শান্তা মা। দেবদূত যদি কিছু বলতে রাজি হয়, বলতে পারে। ববি বডিবিল্ডিং শো-এর কথা বলেছিল। কিন্তু অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেটা করা সম্ভব হয়নি। বিশুদ্ধানন্দজি সবে সংস্কৃত মন্ত্র বলতে শুরু করেছেন, এমন সময় মিলেনা লক্ষ করল, এসি চালানো সত্ত্বেও ওর ভীষণ গরম লাগছে। তখনই ওর চোখে পড়ল ঘরের দক্ষিণ পূর্ব দিকে একজন দাঁড়িয়ে আছেন। মানুষটার মাথায় বাদামি জটা, মুখ সোনালি দাঁড়ি-গোঁফে ঢাকা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। সর্বাঙ্গে সোনার অলঙ্কার। পরনে লাল পোশাক। এই অদ্ভুত দর্শন মানুষটা হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলেন? সিকিউরিটির চোখ এড়িয়ে উনি এমডি-র ঘরে ঢুকলেনই বা কী করে? শ্রীকৃষ্ণাচৈতন্য টেম্পলে মাঝেমধ্যে উত্তর ভারত থেকে আসা কিছু সাঁধুকে মিলেনা দেখেছে। ইনি কি তাঁদের মতোই কেউ? কী চান?

মিলেনা বিস্ময় কাটিয়ে ওঠার আগেই মানুষটি বললেন, ‘সিকিউরিটির লোকদের ডাকার কোনও দরকার নেই মা। ভয় পাস না। তোকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি।’

মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘কে আপনি?’

‘শুনেছি, হিন্দু মাইথোলজি নিয়ে তোর ইদানীং আগ্রহ হয়েছে। সেই কারণেই জিজ্ঞেস করছি, তুই কি অগ্নিদেবের নাম শুনেছিস? গড অফ ফাদার। হিন্দুদের সবথেকে প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। যাঁর ছোঁয়ায় সবকিছু পবিত্র হয়ে যায়। আমি হচ্ছি সেই অগ্নিদেব।’

পর্দায় বিশুদ্ধানন্দজি সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। গমগম করছে জিম-এর হলঘর। কী আশ্চর্য, মিলেনা দেখতে পেল, অগ্নিদেবের জটা থেকে আগুনের শিখা বেরিয়ে আসছে। চেহারাটাও ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। একটা মাথার বদলে দুটো মাথা। দুটো হাতের বদলে চারটে হাত। দেখে ওর বুকের ভিতরটা ধড়াস ধড়াস করতে শুরু করল। আগুনের বিধ্বংসী রূপ ও একবার দেখেছে স্টিফেন ম্যানসনে। সিলভার হোটেলেও সে রকম কিছু ঘটাতে এসেছেন না কি উনি? ঘরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। চন্দন কাঠ পোড়ার হালকা ধোঁয়ায় ঘর ভরে যাচ্ছে। দরদর করে মিলেনা ঘামতে শুরু করল। ভয়ে ও বলে উঠল, ‘আপনি এখুনি হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। না হলে অ্যালার্ম বাজাব।’

অগ্নিদেব মিটিমিটি হেসে বললেন ‘দরকার নেই মা। আমি জানি, আমার জন্য তোর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তোদের স্টিফেন ম্যানসন অগ্নিকাণ্ডের পিছনে ছিলাম আমিই। চলে যাচ্ছি মা। তার আগে, আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দে। তোর কি মহাভারত পড়া আছে? মহাভারতের খাণ্ডবদহন পর্ব?’

পুষ্পাজিজির মুখে মিলেনা মহাভারত আর রামায়ণের কথা শুনেছে। দুটোই ইন্ডিয়ান এপিক। টেম্পল থেকে কিনে আনা কৃষ্ণা কনসাসনেস বইতেও মহাভারতের উল্লেখ ও পেয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণা অর্জুনকে বোঝাচ্ছেন, কেন যুদ্ধ করা জরুরি। কিন্তু খাণ্ডবদহন পর্ব ওর পড়া হয়নি। সে কথা জানাতেই অগ্নিদেব বললেন, ‘শোন মা, খাদ্যে অরুচি হওয়ার কারণে আমাকে খাণ্ডব নামে একটা বন উদরস্থ করতে হয়েছিল। সেই বনে থাকত তক্ষকরাজের মতো এক দুষ্কৃতী এবং অসংখ্য ভয়ানক জন্তু-জানোয়ার। তাদের নির্মূল করাও আমার লক্ষ্য ছিল। সেইসময় আমাকে সাহায্য করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুন। খাণ্ডববন ভষ্মীভূত হয়ে যাওয়ার পর সেখানেই ইন্দ্রপ্রস্থ গড়ে তুলে ছিলেন অর্জুনরা…।’

অগ্নিদেবের কথাবার্তা শুনে মিলেনার মনে হল, ও কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছে। জোর করে ও ফের টিভির পর্দায় চোখ দিল। জিম-এর হলঘরে বিশুদ্ধানন্দজি চেয়ারে বসে পড়ছেন। ইস, উনি কী বললেন, অগ্নিদেবের জন্য সেটা শোনা হল না। মারিয়া এ বার শান্তা মাকে কিছু বলার অনুরোধ করছে। মা কি বলবে, সেটা মিলেনার জানা। মূল চারটে পয়েন্ট। এক, জিম-এর মালিকানা এখন থেকে দেবদূতের। লক্ষ্য, ইন্ডিয়ার এক নম্বর জিম-এর শিরোপা। দুই, আমেরিকার গোল্ড কোম্পানি থেকে অনেকগুলো নতুন ইকুইপমেন্ট আগামী একমাসের মধ্যে এসে যাবে। তিন, দেব’স জিম এখন থেকে টাইটেল পাওয়ার লক্ষ্যে বডিবিল্ডার তৈরি করবে। মি. বেঙ্গল থেকে শুরু করে মি. অলিম্পিয়া টাইটেল। চার, এখন থেকে প্রতি বছর দেব’স জিম একটা অল ইন্ডিয়া কনটেস্ট অর্গানাইজ করবে। যার পুরস্কার মূল্য হবে দশ লক্ষ টাকা।

শান্তা মা বলতে শুরু করেছেন। ঘরে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও, মিলেনার চোখ তখনও পর্দার দিকে। সেটা লক্ষ্য করে অগ্নিদেব বিরক্ত গলায় বললেন, ‘যা বলে যাচ্ছি, মন দিয়ে শোন মা। তোদের স্টিফেন ম্যানসনের অবস্থা ইদানীং খাণ্ডববনের মতো হয়ে গেছিল। ধিংড়ার মতো তক্ষক আর রুস্তমদের মতো মনুষ্যরূপী জানোয়ারে স্টিফেন ম্যানসন ভর্তি হয়ে গেছিল। সেই কারণেই আমাকে ধ্বংস করতে হল। শ্রীকৃষ্ণ এবারও আমাকে সাহায্য করেছেন। যেদিন তুই ওই বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলি, সেদিনই ইঙ্গিতটা পেয়ে গেছিলাম। মনে করে দ্যাখ, তারপরই আমি স্টিফেন ম্যানসন গ্রাস করে ফেলি। জানিসই তো, ধ্বংসের পর সৃষ্টির নিয়ম। এ বার থেকে সুখ-শান্তিতে তোরা ওখানে থাকতে পারবি।’

অগ্নিদেব আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে এলেন। এক মাথা, দুই হাত। দরজার দিকে পা বাড়ানোর আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে উনি বললেন, ‘আরেকটা কথা, আজকের অনুষ্ঠানে, তোরা পঞ্চপ্রদীপ জ্বালাসনি কেন মা? আমাকে ছাড়া কোনও শুভ কাজ কখনও সম্পন্ন হতে পারে না কি? মারিয়াকে বল, শিগগির পঞ্চপ্রদীপ জোগাড় করতে। না হলে তোদের কপালে ফের দুঃখ আছে।’

জ্বলন্ত চোখে একবার তাকিয়েই অগ্নিদেব অদৃশ্য হয়ে গেলেন। যেন একটা আগুনের গোলা ছুঁড়ে দিয়ে গেলেন। ঘরের ভিতর আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। কাচের দেওয়ালের ওপাশে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না মিলেনা। অ্যালার্ম বেলটা কোথায়, খুঁজে পেল না ও। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঘরের তাপ সহ্য করতে না পেরে মিলেনা চেতনা হারাল।

…চোখ খোলার পরই ও দেখতে পেল দেবদূতকে। আশপাশে তাকিয়ে মিলেনা বুঝতে পারল, ও হোটেলে নিজের সুইটেই শুয়ে আছে। ধড়মড় করে উঠে বসে ও জিজ্ঞেস করল, ‘প্রোগ্রাম কি শেষ হয়ে গেছে?’

দেবদূত বলল, ‘অনেকক্ষণ। গেস্টরা এখন ব্যাঙ্কয়েট হলে। ডিনারে ব্যস্ত।’

‘আমার কী হয়েছিল দেবদূত?’

‘প্রেসার বেড়ে গেছিল। তুমি সেন্সলেস হয়ে গেছিলে। ডাক্তার বললেন, রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।’

‘জানো, আজ যখন ইনোগোরেশন চলছিল, তখন অগ্নিদেব এসেছিলেন। স্টিফেন ম্যানসনের…’

কথাটা শেষ করতে দিল না দেবদূত। হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘শিখিনদার মতো তোমাকেও এই রোগে ধরেছে না কি? উনিও মাঝে মাঝে অগ্নিদেবকে দেখেন। অনাদি ডাক্তার ওঁকে কী বলেছেন, জানো? অবচেতন মন থেকে এই লোকটাকে বের করে দিন। তুমিও পাত্তা দিও না।’

দেবদূত হাসছে, সত্যিই ওকে মিঠুন চক্রবর্তীর মতো লাগছে। ওর ঠোঁটে চুমু খাওয়ার তীব্র ইচ্ছেটা দমন করল মিলেনা। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার অনারে ডিনার। তুমি এখানে বসে আছ কেন দেবদূত?’

‘অ্যানা-ডিম্পলরা যে আমাকে যেতে মানা করল। বলল, রাধা ছাড়া কৃষ্ণকে মানায় না। তোমার রাধাকে সঙ্গে নিয়ে নীচে নেমো। এ বার চলো, একসঙ্গে যাওয়া যাক।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *