স্টিফেন ম্যানসন – ৬০

(ষাট)

(কুড়ি মাস পর)

চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেবের মাথা খারাপ হয়ে গেল। এই রে, সোয়া ছ’টা বেজে গেছে। এখুনি ওকে জিম-এ যেতে হবে। অলরেডি পনেরো মিনিট লেট। কোনও মেম্বার যদি গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে, তা হলে লজ্জার শেষ থাকবে না। আনন্দী ম্যাডামের কাছে কমপ্লেনও করে দিতে পারে। বিছানা ছেড়ে উঠে ও দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। মুখ-চোখে জল ছেটানোর সময় আয়নায় দেব লক্ষ্য করল, দাঁড়ি গোঁফের আড়ালে ওকে আজকাল চেনাই যায় না। বাইসেপস, ট্রাইসেপসের ভলিউম অনেক কমে গেছে। মাসল-এর আর দোষ কী? অনেকদিন কার্লিং সিডিউল ঠিকঠাক করতে পারেনি। করবে কী করে, ও যে একা জিম-এ যাওয়ার সাহসই পাচ্ছে না। একে রাস্তাটা ভুলে গেছে। তার উপর জিম খুলেছে কি না, সে খবরটাও পাচ্ছে না।

দীর্ঘদিনের অভ্যেস, ঘুম থেকে উঠেই সিলভার জিম-এ চলে যাওয়া। সারাটা দিন জিম নিয়েই ব্যস্ত থাকা। মাঝে কী যে হল, দেবের জীবনযাত্রার ধরনটাই কেমন যেন ওলটপালোট হয়ে গেল। সকালে জিম খোলার জন্য যখন ও বেরিয়ে আসতে চায়, তখন তমালের বদলে দেব শিখিনদার মুখ দেখে। ড্রয়িং রুমে বসে শিখিনদা তখন খবরের কাগজ পড়েন। মুখ তুলে রোজই একবার উনি বলেন, ‘গুড মর্নিং দেব। এত তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছটা কোথায়? আরে, পাণ্ডেজি জিম খুলে দিয়েছেন। আমিও জিম-এ যাবো। তুমি আমার সঙ্গে যেও।’ কথাটা শিখিনদা বলেন বটে, কিন্তু জিম-এ যাওয়ার আগ্রহ দেখান না।

রাখীদি চায়ের ট্রে নিয়ে আসেন। প্রতিবেশীদেরও দু’একজন এসে হাজির হন। আড্ডা মারতে গিয়ে আটটা-সাড়ে আটটা বেজে যায়। আগে চা খাওয়ার অভ্যেস দেবের ছিল না। আড্ডায় বসে এখন একের বেশি কাপ খেয়ে ফেলে। এখন অবশ্য ওর ব্যাঙ্ককে যাওয়ার তাড়া নেই। শিখিনদার মুখে দেব শুনেছে, মি. এশিয়া প্যাসেফিক কনটেস্ট না কি ওর জন্যই পিছিয়ে গেছে। তাই খাওয়া নিয়ে নিয়মগুলো কঠোরভাবে মানার তাগিদও ওর নেই। আড্ডায় বসে সবার কথা শুনতে ওর ভাল লাগে। এর পর স্নান করতে যাওয়ার আগে শিখিনদা আফসোস করেন, ‘ইসস, দেখলে দেব, আজও আমার জিম-এ যাওয়া হল না। তুমি যাও, জিম থেকে একবার ঘুরে এসো। খুব বেশিদূর কিন্তু যেও না।’ শিখিনদার মধ্যে এই লেথার্জি আগে কখনও দেখেনি দেব। দমকলের অফিস থেকে রোজ একবার না একবার উনি সিলভার জিম-এ যেতেনই।

আজ বেরনোর মুখে শিখিনদা বললেন, ‘একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে দেব? তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য একজন আসবেন।’

দেব জিজ্ঞেস করল, ‘কে এই ভদ্রলোক?’

‘আমার এক বন্ধু অনাদি সান্যাল। খুব পণ্ডিত মানুষ। ওর সঙ্গে কথা বললেই এ বার থেকে তুমি একা সিলভার জিম-এ চলে যেতে পারবে। উনি মনের চিকিৎসা করেন। কেউ যদি কিছু ভুলে যায়, উনি মনে করিয়ে দিতে পারেন।’

‘তা হলে তো খুব ভাল হয় শিখিনদা। খুব অবাক লাগে, জানেন। সিলভার জিম-এর রাস্তাটা আমি ভুলে গেলাম কী করে? হোটেল থেকে নেমেই মিডলটন রো পেরিয়ে, মোড়ের মাথায় চোখ বুঁজে জিম-এ চলে যেতাম। এখন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। জানেন, আপনাকে বলিনি, খুঁজতে গিয়ে মাঝে একদিন হারিয়ে গেছিলাম?’

‘সে কী! ফিরে এলে কী করে?’

‘হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছিলাম জোড়াবাগান বলে একটা জায়গায়। ভাগ্যিস, ওখানকার পঞ্চানন ব্যায়াম সমিতির একটা ছেলে আমাকে চিনতে পেরেছিল। তাকে এখানকার ঠিকানাটা বলতে পারছিলাম না। শুধু হেদুয়া কথাটা মনে ছিল। বাইকে করে সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেল। শিখিনদা জানেন, আমারও একটা রয়াল এনফিলড বাইক ছিল। কোথায় গেল সেটা, কে জানে?’

‘এখানকার ঠিকানাটা আজ মনে আছে?’

শুনে দেব হেসে ফেলল, ‘রাখীদি লিখে দিয়েছেন। অপ্সরা কমপ্লেক্স বিডন স্ট্রিট। রোজ পকেটে দুটো ফোন নাম্বার আর ঠিকানা লেখা কাগজটা নিয়ে বেরোই। ফিরে আসতে আর অসুবিধে হবে না।’

‘পকেটে টাকাপয়সা কিছু আছে?’

‘রাখীদি অ্যাজ ইয়ুজাল দিতে ভোলেননি।’

কথাগুলো বলে দেব দোতলা থেকে নামতে লাগল। আজকাল সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে বা নামতে ওর খুব অসুবিধে হয়। শিখিনদার মুখে ও শুনেছে, কুড়ি মাস আগে না কি ওর বিরাট একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। বাঁ পায়ে অপারেশন করতে হয়। সিন বোনে স্টিলের চাকতি বসানো আছে। বেশ কয়েকমাস ও হাঁটা চলাই করতে পারেনি। ফিজিও থেরাপি করার পর এখন উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুব ধীরে ধীরে হাঁটে। ওর অত ভাল থাই আর কাফ মাসল ছিল। সব শুকিয়ে গেছে। শিখিনদার মুখে দেব আরও শুনেছে, ওই অ্যাক্সিডেন্টে ওর না কি মাথাতেও মারাত্মক চোট লেগেছিল। অপারেশনের পর বাইরে থেকে সেটা এখন আর বোঝা যায় না। গালে শুধু দাগ আছে। সেটা ঢাকার জন্যই ওকে দাঁড়ি রাখতে হয়েছে। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টের পর ওর বিরাট একটা ক্ষতি হয়ে গেছে। আগেকার অনেক কিছুই ওর মনে পড়ছে না। দিন কয়েক আগে রাস্তায় খোঁজাখুঁজির সময় কেউ একজন জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার জিম-এর নামটা কী মশাই? আশ্চর্য, সিলভার জিম নামটা তখন ওর মনে পড়েনি। অথচ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ও নামটা ওর মনে ছিল।

আজ বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। হুডিটা মাথার উপর টেনে দিয়ে দেব মেন গেটের দিকে হাঁটতে লাগল। আগে শিখিনদা থাকতেন দমকলের মেন অফিসের কোয়ার্টারে। সেখানে বিরাট একটা মাঠ ছিল। ফায়ার ফাইটারদের ট্রেনিং হত। বেশ কয়েকবার দেব সেই কোয়ার্টারে গেছে। উনি কেন নর্থ ক্যালকাটায় অপ্সরা কমপ্লেক্সে চলে এলেন, দেব কেনাওদিন জানতে চায়নি। তবে এই কমপ্লেক্সটা খুব সুন্দর। গোটা দশেক চারতলা বাড়ি। ভিতরে ছোট্ট একটা পার্ক আছে। সেখানে কয়েকটা ছেলে রোজকার মতো আজও ক্রিকেট খেলছে। এই খেলাটা দেব কোনওদিনই পছন্দ করত না। চোখ সরিয়ে ও গেটের বাইরে বেরিয়ে এল। বাঁ দিকে গেলে হেদুয়া, ডান দিকে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ। মাঝে একদিন লোকাল একজন…জিম খোঁজার কথা শুনে ওকে গোয়াবাগানে গোবর গুহোর আখড়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। হেদুয়া থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে। সেই আখড়া দেখে দেব অবাক। এমন সাধারণ একটা জিম থেকে কি করে গোবর গুহোর মতো একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রেস্টলার বেরিয়ে ছিলেন ভেবে!

বিডন স্ট্রিট দিয়ে এক-দেড়শো মিটার হাঁটার পরই হিংয়ের কচুরি ভাজার গন্ধটা দেবের নাকে এল। দোকানটার নাম ও জানে। আজাদ হিন্দ সুইটস। এই দোকানের দেওয়ালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একটা ছবি টাঙানো আছে। নেতাজি না কি একবার হিংয়ের কচুরি খেয়ে খুব প্রশংসা করেছিলেন। আগে কচুরি, সিঙাড়া, জিলিপি খাওয়ার কথা ভাবতেই পারত না দেব। এখন খেতে ওর খুব ভাল লাগে। মাঝে মাঝে দোকানটায় ও আসে বলে মালিক ভদ্রলোক মুখচেনা। মাঝবয়সি, পরনে সাদা ধুতি আর হাফ হাতা ফতুয়া। দেব দোকানের ভিতর ঢুকতেই, ক্যাশ বাক্স ছেড়ে উঠে উনি বললেন, ‘স্যার দাঁড়ান, আপনি তো শিখিনবাবুর ভাই, তাই না? অপ্সরায় থাকেন। আবনার সনে একটা কতা আচে।’

দেব জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপারে বলুন?’

‘আবনার নাম কি দেবদূত?’ দেব ঘাড় নাড়তেই ভদ্রলোক বললেন, ‘স্যার, আবনি এখুনি দোকান ছেড়ে চলে যান। না হলে খুব বেপদে পড়বেন।’

বিপদের কথা শুনলে দেব আজকাল খুব ঘাবড়ে যায়। ও বলল, ‘কেন বলুন তো?’

‘সিমলার অরবিন্দ ব্যায়াম সমিতির ছেলেরা আবনাকে একবার খুঁজে গেচে। আমাকে বলেচে, আবনি এলেই আবনাকে বসিয়ে রেকে, কেলাবে খবর পাঠাতে। ছেলেগুনো খুব গরম গরম কথা বলচেল। আবনাকে পেলে না কি হাত-পা খোঁড়া করে দেবে।’

‘ছেলেগুলো কারা, কারোর নাম বলতে পারেন?’

‘একজনের নাম জানি, কেলাবের সেক্রেটারি দুর্বার চৌধুরী। সে বলচেল, আবনি না কি তেনার খুব ক্ষতি করে দিয়েচেন? স্যার, আবনি কি সিলভার জিম বলে কোনও আখড়ার চিফ ট্রেনার ছেলেন? আবনাকে কি পুলিশ মার্ডার কেস দিয়েচেল? আবনি কি কুড়ি মাস জেলে ছেলেন?’

কে দুর্বার, তার চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করল দেব। কিন্তু ওর মনে পড়ল না। দেখলে হয়তো চিনতে পারবে। ভদ্রলোকের এতগুলো প্রশ্ন ওর মাথাতেই রেজিস্টার করল না। ও বলল, ‘হ্যাঁ আমি সিলভার জিম-এর চিফ ট্রেনার ছিলাম। কিন্তু দুর্বার ছেলেটা কে, আমি মনে করতে পারছি না।’

‘সক্কাল থেকে তেনারা একেনে গজল্লা করচেল। তেনাদের কতাবার্তাতেই বুঝলুম, আখড়াটা পার্ক স্ট্রিটে। স্যার, হাতজোড় করে বলচি, আবনি সেকেনে চলে যান। এই ছেলেগুনো ভাল নয়।’

‘কিন্তু পার্ক স্ট্রিটে আমি যাবো কি করে?’

‘ডানদিক দে সোজা সেন্ট্রাল এভিনিউতে চলে যান। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই সে পাতাল রেলের টেশন দেকিয়ে দেবে। নীচে নেমে গে পার্ক স্ট্রিটের টিকিট কেটে নেবেন। পিলিজ, দোকানে বসবেন না। আমি চাই নে, বাপ-ঠাকুরদার হাতে গড়া দোকান ভাঙচুর হোগ। আমি প্যাকেট করে দিচ্চি, আবনি খাবার নিয়ে চলে যান।’

ভদ্রলোক মারাত্মক ভয় পেয়ে গেছেন বলে মনে হল দেবের। বাদামী ঠোঙার প্যাকেটে কচুরি আর হালুয়া ভরে দিয়ে উনি প্রায় ঠেলেই দোকান থেকে বের করে দিলেন। দুর্বার চৌধুরী কে, সে ওকে মারবেই বা কেন, কিছুতেই দেব মনে করতে পারল না। হুডির পকেটে ঠোঙা ঢুকিয়ে দিয়ে খুব সাবধানে ও হাঁটতে লাগল। শিখিনদা রোজ বলে, বেকায়দায় পড়ে-টড়ে গেলে কিন্তু ফের অপারেশন করাতে হবে। সেটা ওর পক্ষে একদমই ভাল হবে না। পায়ের এখন এমন অবস্থা, দৌড়নোর কথা দেব ভাবতেও পারে না। মারপিটের কথা তো দূর অস্ত। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউর দিকে হাঁটার সময় দেবের মনে পড়ল, রুস্তম বলে একটা ছেলের সঙ্গে প্রায়ই ওর ঝামেলা হত। তখন ওর খুব সাহস ছিল। হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিয়ে ও একবার রুস্তমকে প্রচণ্ড মারধর করেছিল। এইবার ওর মনে পড়ছে। তমাল ওকে নিয়ে গেছিল জলসা বলে একটা রেস্টুরেন্টে। সেদিন খাবার দিতে দেরি হয়েছিল বলে, তুচ্ছ কারণে রুস্তম রেস্টুরেন্টের মালিককে পেটাচ্ছিল। দেখে দেব চুপ করে বসে থাকতে পারেনি।

কিন্তু এখন হাতাহাতির কথা দেব ভাবতেও পারে না। ডান হাতটা লক হয়ে গেছে। কাঁধ পর্যন্ত তুলতে পারে না। হঠাৎ সেই রুস্তমের কথা অ্যাদ্দিন পর মনে পড়ায় দেব খুব খুশি হল। ওর চেহারাটাও চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সমবয়সি ছেলেটা পার্ক স্ট্রিটের এক নম্বর তোলাবাজ ছিল। দেব ভেবে রাখল, অপ্সরায় ফিরে শিখিনদাকে রুস্তমের কথা বলতে হবে। উনি তা হলে পুরনো অনেক কিছু মনে করিয়ে দেবেন। ইস, শিখিনদা আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিলেন। সেটা বোধহয় সম্ভব হবে না। সিলভার জিম-এর খোঁজ যখন ও পেয়েই গেছে, তখন সেখানে একবার যাওয়া উচিত। খানিকক্ষণ পর হয়তো মাথা থেকে হারিয়েও যেতে পারে। এসব ভাবার মাঝেই দেব গিরীশ পার্ক মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে গেল।

…পার্ক স্ট্রিট স্টেশন থেকে রাস্তায় উঠে এত লোকজন দেখে দেবের ভয় করতে লাগল। আশপাশ দিয়ে লোক উদভ্রান্তের মতো হেঁটে যাচ্ছে। দু’একবার ধাক্কা খেয়ে পড়তে গিয়েও দেব নিজেকে সামলে নিল। ট্রেনে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ই ওর পা খুব টনটন করছিল। এবড়োখেবড়ো ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় ব্যথাটা আরও বেড়ে গেল। একটা সময় চণ্ডীতলা থেকে তারকেশ্বর পর্যন্ত বাঁক নিয়ে স্বচ্ছন্দে হেঁটে যেতে পারত ও। শ্রাবণ মাসে বাবার মাথায় জল দেওয়ার জন্য। এখন আধ কিলোমিটারও হাঁটেনি। ওর ইচ্ছে করল, কোথাও বসে একটু বিশ্রাম নেয়। তেষ্টা মেটানোর জন্য একটা জলের বোতল কিনে, একটা বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে দেব বসে পড়ল। তখনই ওর মনে পড়ল পকেটে হিংয়ের কচুরির প্যাকেটটা আছে। খেয়ে নেওয়া যেতে পারে। সবে একটা গ্রাস মুখে তুলেছে, এমন সময় থেকে কে যেন বলল, ‘ওস্তাদ দেখো, মালটা এখন বেঁচে আছে। আবার আমাদের এরিয়ায় ফিরে এসেছে।’

খাওয়া বন্ধ করে ছেলেটার দিকে তাকাল দেব। চিনতে পারল না। উপেক্ষা করে ও খাওয়ায় মন দিল। পাশ থেকে আরেকটা ছেলে বলল, ‘আই বাপ, এ তো মেম রেন্ডিটার আশিক দেব।’ কাছে এসে ওর দাঁড়ি ধরে টেনে নিশ্চিত হয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, ‘মাদারচোত, তোর এই অবস্থা হল কী করে? ফুটপাতে বসে এখন ভিক্ষে করছিস তা হলে!’

ছেলে দুটোর হাবভাব দেবের ভাল লাগল না। ফালতু কথা বলছে। ওকে দেখে ভিখারি বলে মনে হচ্ছে না কি? হুডির ঢাকনাটা ও মাথায় টেনে দিল। তারপর বিরক্ত হয়ে খাবারের প্যাকেট পকেটে পুরে ও পুবদিকে হাঁটতে শুরু করল। ছেলে দুটো কিন্তু ওর পিছু ছাড়ল না। একজন ওকে ধাক্কা মারল। অন্যজন ওর হাত থেকে বোতল কেড়ে নিয়ে মাথায় জল ঢেলে দিল। তারপর বলল, ‘মকবুলভাই চলো, মাদারচোতকে পার্টি অফিসের কাছে নিয়ে গিয়ে পেটাই। সবাই দেখুক, আমাদের সঙ্গে পাঙ্গা নিতে গেলে কী অবস্থা হয়।’

‘খুব ভাল হয়। ওখানেই ভিক্ষে করতে বসিয়ে দেবো।’

ওকে ধাক্কা মারতে মারতে ছেলে দুটো সামনের দিকে এগোচ্ছে। একটা ঝুল বারান্দার নীচে দেব হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে চোট লেগেছে। ভাগ্যিস আজ স্নিকারটা পরে এসেছিল। না হলে নখটাই উঠে যেত। কোনওরকমে থামের গায়ে হেলান দিয়ে ও উঠে দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। আশপাশ দিয়ে লোকজন যাতায়াত করছে। কেউ ওকে হেল্প করার জন্য এগিয়ে আসছে না। পার্ক স্ট্রিটের চরিত্রটাই এ রকম। ছেলে দুটোর হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য দেব বলল, ‘আমাকে মারছ কেন ভাই? আমি তো তোমাদের চিনি না।’

লাথি মেরে একটা ছেলে বলল, ‘মিথ্যে কথা বলছিস, আমাদের চিনিস না? আমি রিয়াজ, আর এ মকবুল। ভোসরি কে, তোর জন্য আমাদের জেল খাটতে হয়েছে। রুস্তমভাইজানের হাত তুই মুচড়ে দিয়েছিলি। তোর হাত আজ আমরা ভেঙে দেবো।’

মকবুল বলে ছেলেটা বলে উঠল, ‘আসফাক ভাইকে খবর দে। এখন ফ্লুরিজে আছে। দৌড়ে তুই চলে যা। ততক্ষণ আমি হাতের সুখটা করে নিই।’

দুটো ছেলের মুখ দিয়েই আক্রোশ ফুটে বেরচ্ছে। রিয়াজ ফের লাথি মারার জন্য পা তুলতেই দেব দু’হাতে ধরে ফেলল। তারপর শরীরের সব শক্তি জড়ো করে শূন্যে তুলে ওকে দূরে ছুঁড়ে দিল। একটা শো রুমের কাচের দরজায় গিয়ে আছড়ে পড়ল রিয়াজ। ঝনঝন করে একটা শব্দ হল। দেব দেখল, রিয়াজের মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরচ্ছে। মকবুল বলে ছেলেটার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। সেই চোখে ভয়ের চিহ্ন। কাচের দরজা খুলে ভিতরের লোকজন সব বেরিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে দু’তিনজন খালি গায়ে। বোধহয় ব্যায়াম করছিল। এটা তা হলে শো রুম নয়, জিম। তখনই দেওয়ালের গায়ে লেখাটা দেবের চোখে পড়ল। নিওনের আলোয় লেখা, দেব’জ ড্রিম। ফ্যাল ফ্যাল করে ও সেদিকে তাকিয়ে রইল। সিলভার জিম তা হলে আনন্দী ম্যাডাম আর খোলেননি। কিন্তু জিম ওর নামে বদলে দিল কে?

(একষট্টি)

রোলস রয়েস গাড়ি থেকে নেমে এল মিলেনা। মিডলটন রো-তে পা দিয়ে স্টিফেন ম্যানসনের দিকে তাকাতেই ওর সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। পুরো বিল্ডিংটায় সাদা পেইন্ট। রাজবাড়ির মতো দেখাচ্ছে। সূর্যের আলো ঠিকরে পড়েছে। উপরের দিকটা মেঘের মতো মনে হচ্ছে। এক নম্বর ব্লকের ছয়তলার দিকে ওর চোখ চলে গেল। দক্ষিণদিকের ছয়শো পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাটে ও তিন-তিনটে বছর কাটিয়ে গেছে। কত স্মৃতি জড়িয়ে ওই ফ্ল্যাটে। বিল্ডিংয়ের গেট পেরনোর সময় ও বুকটা একবার কেঁপে উঠল।

গেটে খুব সুন্দর নতুন একটা তোরণ তৈরি করা হয়েছে। ড্রাইভওয়েতে লাল কার্পেট পাতা। ওকে স্বাগত জানানোর জন্য যাঁরা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, তাঁদের মধ্যে নিয়োগী আন্টির ছেলেকে চিনতে পারল মিলেনা। ভদ্রলোক লিজ হোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি। স্টিফেন ম্যানসনের রিনোভেশনের পিছনে প্রচুর সময় দিয়েছেন। উনি না থাকলে পার্ক স্ট্রিটের উপর এই বিল্ডিংটা এখনও প্রেতপুরী হয়ে থাকত। হাতজোড় করে দেবাশিস নিয়োগী আপ্যায়ন জানালেন, ‘আসুন ম্যাডাম। ওয়েলকাম হোম।’

মন ভারাক্রান্ত, কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ভদ্রতা করে মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘আন্টি আসেননি?’

‘মা এসেছেন। উনি ব্যাঙ্কোয়েট হল-এ আছেন। কলকাতার মেয়র, শ্রীকৃষ্ণাচৈতন্য টেম্পলের আচার্যদেব, হোলি ন্যাজারেথ চার্চের ফাদার, আরও ডিগনেটারিজরা সবাই এসে গেছেন। আমরা সবাই আপনার জন্যই ওয়েট করছিলাম।’

মিলেনা বলল, ‘ঠিক কুড়ি মাস পর স্টিফেন ম্যানসনে ঢুকলাম। অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে।’

‘হওয়াটাই স্বাভাবিক ম্যাডাম। শেষের দিকে বিল্ডিংটার যা অবস্থা হয়েছিল, এলিট ক্লাসের মানুষদের থাকার যোগ্য ছিল না। দেখবেন চলুন, অনেক বদলে ফেলেছি।’

ড্রাইভওয়ে দিয়ে সোজা পশ্চিমদিকে গিয়ে ডান দিকে টার্ন নিলেই আগে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার্স চোখে পড়ত। নীচে পরপর দশ-বারোটা গ্যারাজ, উপরে সার্ভেন্টদের থাকার ঘর। একটা সময় অ্যান্টসোশ্যালদের ডেন ছিল। এখন কোয়াটার্সটাই নেই। তার বদলে ব্যাঙ্কয়েট হল। বড় বড় করে লেখা ‘টাইগ্রান’। ওর গ্র্যান্ডপার নামে। ওর ড্যাডির এই আঙ্কল টাইগ্রান বহু বছর স্টিফেন ম্যানসনে থেকে গেছেন। এখন অবশ্য উনি ইন্ডিয়াতে নেই। ওর চোখ-মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন দেখে দেবাশিস নিয়োগী ভুল বুঝলেন। বললেন, ‘ম্যাডাম, একটু অবাক লাগছে, তাই না? এখানে এখন আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং হয়েছে। ব্যাঙ্কয়েট হলটা ঠিক তার উপরেই। আনওয়ান্টেড লোকগুলোকে বিল্ডিং থেকে আমরা বিদেয় করে দিয়েছি। পুরনো দিনগুলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। এই ব্যাঙ্কয়েট হলে আবার আমরা পার্টি করব। ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি, বার্থ ডে পার্টি, ক্রিসমাস ইভ, নিউ ইয়ার্স ইভ।’

কুড়ি মাস আগে এই স্টিফেন ম্যানসনে ভয়ঙ্কর আগুন লেগেছিল। প্রায় তিরিশ জনের মতো লোক মারা যান। মিলেনা নিজেও কোনও রকমে প্রাণে বেঁচে গেছিল। এক নম্বর ব্লকের লোহার স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসার সময় ওর শাড়িতে আগুন ধরে গেছিল। শরীরের বাঁ দিকের একটা অংশ পুড়ে যায়। ভাগ্যিস শান্তা আন্টির মতো মা আর এরিকের মতো পয়সাওয়ালা ড্যাডি ছিলেন। লন্ডনে নিয়ে গিয়ে ওঁরা ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করেন। ওয়ার্ল্ডের বেস্ট প্লাস্টিক সার্জেন ড. গুস্তাভ ক্লেমেন্তের আন্ডারে প্রায় দেড়বছর ছিল মিলেনা। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে মাসখানেক আগে কলকাতায় ফিরে এসেছে। আগুন লাগার পর স্টেট গভর্নমেণ্ট স্টিফেন ম্যানসন বন্ধ করে দিয়েছিল। রিনোভেশনের পর এতদিনে গভর্নমেণ্ট সার্টিফিকেট দিয়েছে, বিল্ডিং বাসযোগ্য হয়েছে বলে। দেবাশিস নিয়োগীরা বেআইনি ভাড়াটেদের তুলে দিয়েছেন। পুরনো আবাসিকরা আজ তাঁদের ফ্ল্যাটে ফিরে যাবেন। খুশি মনে সবাই হাজির। মিলেনা কিন্তু খুশি হতে পারছে না। দেবদূতের স্মৃতি ওকে তাড়া করে বেরোচ্ছে। আগুন লাগার দিন থেকে দেবদূতের সঙ্গে ওর আর দেখা হয়নি।

টাইগ্রানে ঢুকে মিলেনা দেখল, ফুল দিয়ে পোডিয়াম খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। পোডিয়ামের উপর একটা বিরাট আর্মেনিয়ান কার্পেট পাতা। উজ্জ্বল আলোয় তার বিচিত্র কারুকার্য হলের আভিজাত্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্ভবত এরিক ইরেভেন থেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। পোডিয়ামে পরপর কয়েকটা চেয়ারে বসে আছেন অভ্যাগতরা। তাঁদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণাচৈতন্য টেম্পলের আচার্যদেবও আছেন। শান্তা মা আর মারিয়া ওঁর সঙ্গে কথা বলছে। কালই মিলেনা শুনেছিল, ওয়েলকাম হোম পার্টিতে অ্যাঙ্কারিং করবে মারিয়া। ওর পরনে বেগুনি রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ি। বিউটি পার্লারে গিয়ে বোধহয় সাজগোজ করে এসেছে। একবার উইংসের পাশে গিয়ে মারিয়া ওর বয়ফ্রেন্ড ববির সঙ্গে কথা বলে এল। গ্র্যান্ডপার ছেলে ববি। সম্পর্কে ওর আঙ্কল। এরিক কলকাতায় এসে ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তখন স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলেন। ববি এখন স্টিফেন ম্যানসনের এস্টেট ম্যানেজার।

মারিয়া খুব সুন্দরভাবে অনুষ্ঠানটা শুরু করল। প্রথমেই মৃত মানুষদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এক মিনিট মৌন পালন। চোখ বুঁজে থাকার সময় জ্বলন্ত বিল্ডিংটার টুকরো ছবি মিলেনার মনে ভেসে উঠতে লাগল। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে লোহার স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে ও নীচের দিকে নেমে আসছে। হঠাৎ দোতলার জানলা দিয়ে উড়ে আসা আগুনের ফুলকি ওর শাড়িতে এসে লাগল। নিজেকে বাঁচানোর জন্য মিলেনা সেদিন আর উপরের দিকে তাকায়নি। শেষপর্যন্ত জানতেও পারেনি, দেবদূত নীচে নেমে এসেছিল কি না? ইলিয়ট নার্সিং হোমে শুয়ে শরীরে অসহ্য জ্বলুনির মাঝেও শান্তা মাকে মাঝে মাঝে প্রশ্নটা করেছে। কিন্তু কোনও উত্তর পায়নি।

চোখ খুলেই মিলেনা দেখতে পেল, পোডিয়ামের পিছনে পর্দা সরে গেছে। বিরাট একটা সাদা মার্বেলের ফলক। তাতে কালো অক্ষরে মৃত আবাসিকদের সবার নাম লেখা। ফলকের উপর থেকে ক্রমাগত জলের ধারা নেমে আসছে। দেখে মিলেনা চমকে উঠল। শান্তির ধারা। ইনোভেটিভ আইডিয়াটা কার, জানার খুব ইচ্ছে হল ওর। তখনই মারিয়া বলে উঠল, ‘সারা বছর ধরে এই শান্তির জল যাবে। মৃত মানুষদের আত্মার শান্তি কামনায় এই চমৎকার আইডিয়াটি দেবাশিস নিয়োগীর। আমি প্রথমে শ্রীকৃষ্ণাচৈতন্য টেম্পলের আচার্যদেব বিশুদ্ধানন্দজিকে শান্তির বাণী দেওয়ার জন্য অনুরোধ করব।’ কথাগুলো বলে মাইক আচার্যদেবের হাতে তুলে দিল মারিয়া।

ঠিক সেই মুহূর্তে শান্তা মা ওর পাশে এসে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার এত দেরি হল কেন মিলেনা?’

‘প্রান্তিকের জন্য ওয়েট করছিলাম না। কাল বিকালে প্রান্তিক খবর দিয়েছিল, নর্থ ক্যালকাটায় দেবদূতকে কেউ দেখেছে। বিডন স্ট্রিট বলে একটা জায়গায়। আজ সকালে ওখানে ওর যাওয়ার কথা ছিল। ওর জন্য অফিসে এতক্ষণ বসে রইলাম, অথচ প্রান্তিক এল না।’

কলকাতার পুলিশের উপর ভরসা রাখতে না পেরে, একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভকে অ্যাপোয়েন্ট করেছে মিলেনা। দেবদূতকে খুঁজে বের করার জন্য। সেই ছেলেটির নাম প্রান্তিক। গত একমাস ধরে সে দেবদূতকে খুঁজে বেরাচ্ছে। রোজই এসে কোনও না কোনও খবর দেয়। সে কথা শান্তা মা জানেন। শান্তা মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওকে ফোন করলে না কেন?’

‘করেছিলাম। প্রান্তিক তখন মেট্রো রেলে। এমন শব্দ হচ্ছিল, ওর কথা শুনতেই পারছিলাম না। শুধু বুঝলাম, ও জিম-এর দিকে আসছে।’

পোডিয়ামের একদিকে একটা বড় স্ক্রিন, তাতে অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে মিলেনা দেখল, আচার্যদেব ‘ওঁং শান্তি, ওঁং শান্তি’ বলে বসে পড়লেন। তার আগে উনি কী বললেন, মিলেনার শোনা হল না। গত একমাসে ওর মন যখনই দেবদূতের জন্য অশান্ত হয়েছে, তখনই ও ছুটে গেছে বিশুদ্ধানন্দজির কাছে। উনি বারবারই বলেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণার উপর ভরসা রাখো মা। আমার মন বলছে, দেবদূতের সঙ্গে তোমার শিগগির দেখা হবে।’ কিছুদিন আগে শান্তা মা ওকে নামকরা এক জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে গেছিলেন। গণনা করে তিনিও একই কথা বলেছেন। কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়ে এরিক এ বার ওর উপর বিরাট দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন। সিলভার হোটেল আর জিম চালানোর। দুটোই উনি কিনে নিয়েছেন। মুশকিল হচ্ছে, কাজের মধ্যে থাকলেও মিলেনা দেবদূতকে ভুলতে পারছে না। ইদানীং মারাত্মক অপরাধবোধে ভুগছে। ওর মনে হচ্ছে, ওকে বাঁচাতে গিয়েই দেবদূত আজ নিখোঁজ।

মাইকে দেবাশিসের গলা পেল মিলেনা। বিল্ডিংয়ে নতুন কী হয়েছে, উনি তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন। ভদ্রলোক একটু বেশি কথা বলতে ভালবাসেন। ‘আপনাদের একটা গুড নিউজ দিই। স্টিফেন হাউসের মালিকানা বদল হয়েছে। গ্রেগারিয়ানরা এই বিল্ডিংয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন। নতুন কোম্পানির চেয়ারম্যান হয়েছেন মিসেস শান্তা গ্রেগারিয়ান। শান্তা আন্টি আপনি একবার উঠে দাঁড়াবেন প্লিজ? আপনি গাইড না করলে আজ বিল্ডিং রিওপেন করা সম্ভব হত না।’

কথাটা শুনে শান্তা মা উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে হাততালির ঝড় বয়ে গেল। এর পর দেবাশিস বললেন, ‘মিসহ্যাপের দিন আবাসিকদের মধ্যে সবথেকে বয়স্ক যে মহিলা সাহসিকতা দেখিয়ে ছিলেন, ক্যামেরায় তাঁকে দেখানোর জন্য অনুরোধ করছি। তিনি মিসেস বাসন্তী সেন। আপনারা অনেকেই জানেন, উনি দুরারোগ্য অসুখে ভুগছেন। পোডিয়ামে উনি আসতে পারবেন না। আমি তাঁকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।’

সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনে মিসেস সেনের মুখটা ভেসে উঠল। অনুষ্ঠানে আসার জন্য ভদ্রমহিলা সেজে এসেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, একটা সময় তিনি খুব সুন্দরী ছিলেন। মারিয়া নীচে নেমে এসে তাঁর হাতে মাইক তুলে দিতেই মিসেস সেন বললেন, ‘ঈশ্বরের অসীম কৃপা। আমি এখনও বেঁচে আছি। দুর্ঘটনার দিন আমি জানতাম না, স্টিফেন ম্যানসনে আগুন লেগেছে। আমাকে ফ্ল্যাটের ভিতর রেখে আমার আয়া টাকা পয়সা আর অর্নামেনটস নিয়ে পালিয়ে গেছিল। কিন্তু ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একজন দেবদূতকে পাঠিয়ে ছিলেন। ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে সে আমাকে উদ্ধার করে। আমি জানতাম না, সত্যিই তার নাম দেবদূত। সে যদি আজ এখানে এসে থাকে, তা হলে আমি তাকে আশীর্বাদ করতে চাই। বাবা, তোমার মতো ছেলে ঘরে ঘরে জন্মাক। প্লিজ, দেখুন তো, সে এখানে আছে কি না?’

অনুষ্ঠানে হাজির সবাই এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। মিসেস সেনের কথা শুনে শান্তা মায়ের হাতটা চেপে ধরল মিলেনা। এইরকম মিরাকল কি ঘটতে পারে? কাচের দরজা ফাঁক করে দেবদূত এসে উপস্থিত হবে! ওর চোখের কোণ ভিজে উঠল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে মিসেস সেন আবার বললেন, ‘দেবদূতের সঙ্গে সেদিন এরিকের মেয়ে মিলেনাও আমার ফ্ল্যাটে এসেছিল। তাকে একবার পোডিয়ামে উঠতে বলবে? আমি তাকে দেখতে চাই।’

‘তিনি এখানে আছেন মিসেস সেন।’ পোডিয়াম থেকে দেবাশিস বললেন, মিস গ্রেগারিয়ান, আপনি প্লিজ উঠে আসুন।’

শান্তা মা ওকে বললেন, ‘যাও মিলেনা।’

পা থরথর করে কাঁপছে। মারিয়া কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর সঙ্গে পোডিয়ামে উঠে সামনের দিকে তাকাতেই মিলেনা দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল। ওর মুখ দিয়ে কোনও কথাই বেরল না। হল-এ পিন ড্রপ সাইলেন্স। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে সামলে মিলেনা বলল, ‘সেদিন মিসেস সেনকে রেসকিউ করার কথা আমাকে প্রথম বলেন দেবাশিস। তারপর কি হয়েছিল, মিসেস সেনের মুখে আপনারা শুনলেন। দুর্ভাগ্যের কথা, ওইদিনের পর থেকে দেবদূত নিখোঁজ। ওর কী হল, পুলিশও আমাকে জানাতে পারেনি। আরেকটা কথা বলতে চাই। জানি না, এখানে বলা উচিত কি না। ক্ষোভের কথা হল, মিসহ্যাপের পর মিডিয়ায় যাদের নিয়ে হই চই হল, পুলিশ ও সরকার যাদের পুরস্কার দিল, তারা সেদিন লুঠপাট করছিল। দেবদূতকে তারা গুলি করে মারারও হুমকি দিয়েছিল।’ আর কিছু বলতে পারল না মিলেনা। কান্নায় ওর গলা বুঁজে এল।

অনুষ্ঠানের শুরু হয়েছিল, উৎসবের মেজাজে। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ হয়ে গেল বিষাদের পরিবহে। ব্যুফে লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছেন দেবাশিস। প্রেসের লোকদের ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন খাবার টেবলে। ব্যাঙ্কয়েট হলে নানা জায়গায় জটলা। শান্তা মা, নিয়োগী আন্টি, মারিয়া আর ববিকে সঙ্গে নিয়ে এক কোণে মিলেনা খাবারের প্লেট নিয়ে বসল। কিন্তু কিছু মুখে দিতে ওর ইচ্ছে করল না। আবাসিকদের অনেকেই এসে ওকে বলে যাচ্ছেন, ‘আপনি ঠিক বলেছেন মিস গ্রেগারিয়ান। আপনার কথা শুনে মেয়র মুখ নীচু করে চলে গেলেন।’ মিলেনা সৌজন্য দেখিয়ে তাঁদের দু’একটা উত্তর দিচ্ছে। এমন সময় একটা মেয়ে এসে ওকে বলল, ‘মিলেনা, আমি প্রাত্যহিক দর্পণের রিপোর্টার। আমার নাম ঈশিতা। আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে।’

ঈশিতার সঙ্গে কথা বলার সময়ই হঠাৎ মিলেনার মোবাইল ফোনটা বাজতে শুরু করল। ব্যাগ থেকে সেট বের করে ও দেখল, প্রান্তিকের ভিডিয়ো কল। বিরক্তিতে সোয়াইপ করতে মন চাইল না ওর। হয়তো সেই একই কথা বলবে। দেবদূতের খোঁজ পাওয়া গেল না। কিন্তু কী ভেবে ও লাইনটা কানেক্ট করল। প্রান্তিকের উত্তেজিত মুখ, ‘ম্যাডাম, আপনি কোথায়?’

ভিডিয়ো কল বলে ওর মুখের পিছন দিকের ছবি মিলেনা দেখতে পাচ্ছে। পার্ক স্ট্রিটের রাস্তা বলে মনে হল। গাড়ি চলাচল করছে। দূরে মোকাম্বো বার। মিলেনা বলল, ‘কেন বলুন তো? আমি স্টিফেন ম্যানসনে।’

‘ম্যাডাম আমি একজনের ছবি দেখাচ্ছি। দেখুন তো, আপনি যাকে খুঁজছেন, এ সে কি না?’

কথাগুলো বলেই প্রান্তিক ফোনটা সামনের দিকে ঘুরিয়ে দিল। মিলেনা দেখল, জিম-এর ফুটপাতেই থামের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন। ঠোঙা থেকে বের করে কি যেন খাচ্ছে। পরনে কাদামাখা একটা হুডি। মুখ দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গলে ঢাকা। ঠোঁটে কিন্তু যুদ্ধজয়ের হাসি। ওই হাসিটা মিলেনা ভুলবে কি করে? দেবদূতকে চিনতে পেরে ওর মাথা একবার চক্কর দিয়ে উঠল। এ কি অবস্থা হয়েছে দেবদূতের! রাস্তার ভবঘুরে বলে মনে হচ্ছে ওকে। বুকের ভিতরটাও একবকার মোচড় দিয়ে উঠল মিলেনার। ও দিক থেকে প্রান্তিক বলে যাচ্ছে, ‘একমাস ধরে যাকে খুঁজে বেরাচ্ছিলাম, ম্যাডাম আজ সে আপনার জিম-এর কাছেই এসে হাজির। আপনার জন্যই তখন আমি জিম-এ ওয়েট করছিলাম। হঠাৎ বাইরে গণ্ডগোলের আওয়াজ শুনে বাইরে বেরিয়ে আসি। দেবদূতবাবু তার একটু আগেই লোকাল এক রাফিয়ানকে ধরে আছাড় মেরেছেন।’

নিশ্বাস বন্ধ করে মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘দেবদূত এখন কোথায়?’

‘উনি থাকতে চাইছেন না ম্যাডাম। দেরি হয়ে গেছে বলে মেট্রো রেলের স্টেশনের দিকে যেতে চাইছেন। আপনার নাম ওর কাছে করেছিলাম। কিন্তু মনে হল, আপনাকেও চিনতে পারলেন না। আপনি শিগগির আসুন।’

চার-পাঁচটা মুখ কৌতূহল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। শান্তা মা-ই প্রথম জিজ্ঞেস করেলন, ‘দেবদূতকে কি পাওয়া গেছে?’

টেনশনে ওর হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। মোবাইল সেট ব্যাগের মধ্যে ঢোকাতে গিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল মিলেনা। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ও বেঁচে আছে মা। ও বেঁচে আছে। এখুনি ওকে দেখলাম। শিগগির চলো, শ্রীকৃষ্ণাই ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’

(বাষট্টি)

বারান্দা থেকে একবার ঘুরে এসে রাখী বলল, ‘দেবভাই তো এখনও এল না। এত দেরি তো ও কোনওদিন করে না। তুমি একবার রাস্তায় বেরিয়ে দেখবে, শিখিন?’

সত্যিই ঘণ্টা চারেক প্রায় হয়ে গেল। সকাল সাড়ে আটটায় জিম খোঁজার নাম করে দেব বেরিয়ে গেছিল। প্রতিদিন আধ ঘণ্টা—পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে মুখ গম্ভীর করে ঘরে ঢোকে। আজ বেলা সাড়ে বারোটা বেজে গেল, এখনও ফেরেনি। কোনও বিপদ আপদের মধ্যে পড়ল না তো? বা রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ি চাপা? সবথেকে বড় কথা, শিখিন ওকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলেছিলেন। অনাদি সান্যালের সামনে ওকে বসিয়ে দেবেন বলে। অনাদি একটা সময় তাঁর সঙ্গে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়তেন। এখন নাম করেছেন সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে। ওঁর একটা ক্লিনিকও আছে ক্যামাক স্ট্রিটে।

অনাদি খুব ব্যস্ত ডাক্তার। সকাল দশটায় সেই গলফ গ্রিন থেকে উনি চলে এসেছেন। শিখিন জানেন, রোজ বেলা এগারোটায় অনাদি ক্লিনিকে গিয়ে ওঁর মেন্টাল পেসেন্টদের দেখেন। দেবকে নিয়েই ফোনে মাঝে মাঝে ওঁর সঙ্গে কথা হত। কিন্তু সামনাসামনি দেখা বহুদিন পর। দু’জনে মিলে কলেজ জীবনের গল্প করছেন। এরই মাঝে তিন-চারবার ফোন এসে গেছে অনাদির ক্লিনিক থেকে। দেব ফিরছে না দেখে, লজ্জিত গলায় একবার শিখিন বলেও ফেললেন, ‘সরি ভাই। তোমাকে এতক্ষণ আটকে রেখেছি। ছেলেটাকে আজকে বেরতে না দিলেই ভালো করতাম।’

অনাদি বললেন, ‘ডাজন্ট ম্যাটার। তোমার সঙ্গে পুরনো দিনের গল্প করছি। রাখীকেও অনেকদি পর দেখলাম। আমারই উঠতে ইচ্ছে করছে না। মনে আছে, বীণা সিনেমায় তুমি একবার রাখীকে নিয়ে জিতেন্দ্রর একটা সিনেমা দেখতে গেছিলে। সেদিন আমি না বাঁচালে, তুমি পাড়ায় ফিরতে পারতে না। কেননা, রাখীর কাকিমাও সেদিন নুন শো দেখতে গেছিলেন।’

শিখিন হেসে বললেন, ‘মনে আবার থাকবে না? সিনেমাটার নাম ছিল… ফরজ। একটা গানও মনে আছে, বার বার এ দিন আয়ে, বার বার এ দিন যায়ে/ তু জিয়ে হাজারো সাল, ইয়ে হ্যায় মেরে আরজু। বার্থ ডে পার্টিতে জিতেন্দ্র ওই গানটা যখন গাইছে, তখন তুমি মাত্র তিনটে কথা পিছন থেকে বলেছিলে, রাখীর কাকি… ভাগো।’

শুনে অনাদি হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘কী দিন ছিল, বলো তো মাইরি? গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে আমরা নিশ্চিন্তে সিনেমাও দেখতে পারতুম না। একটা সময় তোমার উপর কিন্তু আমার খুব রাগ হয়েছিল শিখিন। যখন রেখার মুখে শুনেছিলাম, তোমার আর রাখীর মধ্যে ব্রেক আপ হয়ে গেছে। তারপর কবে তোমাদের মিলন হল, কবে তোমরা বিয়ে করলে কিছুই জানতে পারলাম না।’

শিখিন বললেন, ‘দুটোর পিছনেই কারণ, আগুন। আগুনের জন্যই ব্রেক আপ, আগুনের জন্যই বিয়ে। এত চট করে হয়ে গেল, বাণীব্রত আর রেখা ছাড়া বন্ধুদের আর কাউকে জানাতে পারিনি। সে অনেক গল্প।’ রাখী ফের ঘরে ঢুকে বলল, ‘তুমি এখনও নিশ্চিন্তে গল্প করে যাচ্ছ শিখিন? আমি এত টেনশনে ভুগছি। তুমি এত উদাসীন হয়ে বসে আছ কি করে? আমি তো দেখছি, তোমাকেও ট্রিটমেন্ট করানো দরকার।’

অনাদি উসকে দেওয়ার জন্য বললেন, ‘সিমটমগুলো বলো তো রাখী। দেখি, ওষুধের দরকার আছে কি না।’ রাখীর মুখে দিকে তাকিয়ে শিখিন বললেন, ‘আমিই বলছি। শুনলে তুমি হয়তো হাসবে অনাদি। গত তিন বছর ধরে আমি প্রায়ই অগ্নিদেবকে দেখছি। কোথাও আগুন নেভাতে গেলে, ওঁকে আমি দেখতে পেতাম। আমার সঙ্গে উনি দু’তিনবার কথাও বলেছেন।’

মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল অনাদির। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘একজ্যাক্টলি কী দেখতে?’

দেওয়ালে টাঙানো অগ্নিদেবের ছবিটা দেখিয়ে শিখিন বললেন, ‘ঠিক এই চেহারায়।’

ছবিটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকে অনাদি প্রশ্ন করলেন, ‘শেষ কবে দেখেছ?’

‘চাকরি থেকে সাসপেণ্ড হওয়ার পর সামনাসামনি কখনও দেখিনি। কিন্তু মাঝে মধ্যেই স্বপ্নে দেখি।’

অনাদি কী বলেন, সেটা শোনার জন্য রাখী বসে পড়েছে। ও বলল, ‘আমি সেটা বুঝতে পারি অনাদিদা। রাতে শিখিন যখন ঘুমিয়ে অগ্নিদেবের স্তব করে।’

চোখ বুঁজে দু’এক মিনিট কি যেন ভেবে নিলেন অনাদি। তারপর বললেন, ‘তোমার পেশা আগুন নিয়ে। অগ্নিদেবকে তুমি স্বপ্নে দেখবে, খুব স্বাভাবিক। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। খুব সহজ করে তোমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছি। প্রাচীন কালে মুণি-ঋষিরা বলে গেছেন, মনের তিনটে স্তর আছে। চেতন, অবচেতন আর অতিচেতন। এই তিনটে স্তরের মধ্যেই মন যাবতীয় কাজ করে। মনটা সবসময় ওঠা-নামা করে। চেতন স্তরে মন অহংবোধের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই স্তরেই মনটাকে বশ করার প্রশ্ন আসে। যাঁরা এটা পারেন, তাঁরা অতিচেতন স্তরে পৌঁছতে পারেন। কী ভাই, কিছু বুঝতে পারছ?’

‘পারলাম না ভাই।’ শিখিন বললেন, ‘গত কুড়িমাস ধরে আমার মনটা এলোমেলো হয়ে আছে। কিছুতেই বশ করতে পারছি না।’

‘পারবে। আগে অবচেতন মনটাকে গুছিয়ে নাও। তারপরই পারবে। অবচেতন মনটা কী রকম জানো? একটা চিলে কুঠুরির মতো। রেগুলার দরকার পড়ে না, এমন জিনিসপত্তর যেখানে আমরা ফেলে রাখি। তোমার অবচেতন মনের চিলে কুঠুরিতে অদরকারী অনেক স্মৃতি জমে আছে। সেগুলো ফেলে দাও। তা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা, একটু ভেবে বলো তো, ফায়ার সার্ভিসে ঢুকে তুমি কি কোনও অ্যাম্বিশন ফুলফিল করতে চেয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ। বরেন সেনের মতো ফায়ার ফাইটার হবো।’

‘বুঝেছি। তা হলে সেটাই তোমার চেতন স্তরকে গ্রাস করে, অহংবোধের জন্ম দিয়েছিল। আচ্ছা, আগুন নিয়ে তোমার মনে কোনও অপরাধবোধ ছিল? মানে আগুন লাগিয়ে তুমি এমন কিছু করে ফেলেছিলে, যা অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল?’ রাখীর দিকে তাকিয়ে শিখিন ঘাড় নাড়লেন। দেওয়ালির বাজি পোড়াতে গিয়ে রাখীদের বাড়িতে আগুন, ওর ঠাকুরমার মৃত্যু। একটা অপরাধবোধ তো ছিলই। ওঁকে ঘাড় নাড়তে দেখে অনাদি বললেন, ‘ব্যস, ব্যস, ডিটেলে বলতে হবে না। ব্যাপারটা আমার কাছে ক্লিয়ার। তুমি অবচেতন মন থেকে এই স্মৃতিগুলো ঝেড়ে ফেলে দাও শিখিন। একটা সাজেশন দিতে পারি। প্রথমেই বলি, অগ্নিদেবের এই ছবিটাকে তুমি চোখের সামনে রেখো না। ছবিটা তুমি কবে কিনেছিলে, মনে আছে?’

শিখিন বললেন, ‘বহুবছর আগে। ময়দানের বইমেলায় যেদিন আগুন লেগেছিল।’

‘হুমম, তারপর থেকেই তোমার অবচেতন মনে অগ্নিদেব বাসা বেঁধেছেন। ছবিটাকে কোথাও ডাম্প করে দাও ভাই। মনের চিলে কুঠুরিটা তুমি ভর্তি করো, অন্য চিন্তা দিয়ে। পজিটিভ সব চিন্তা, যা তোমাদের দাম্পত্য জীবনটা সুন্দর করে তুলবে। সাসপেনশন নিয়ে তুমি আর মাথাই ঘামাবে না। ফোনে একদিন তুমি বলেছিলে, রাজারহাটের শপিং মলে চাকরির একটা অফার আছে। যত তাড়াতাড়ি পারো, সেটা অ্যাকসেপ্ট করে নাও। আর মোস্ট ইম্পরট্যান্ট, রাখী যাতে তাড়াতাড়ি মা হয়, তা নিয়ে ভাবো। ফ্যামিলি কমপ্লিট হলে দেখবে, তোমার অবচেতন মনের কুঠুরিটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।’

বলবেন না ভেবেও, শিখিন বলে ফেললেন, ‘রাখী মা হতে যাচ্ছে অনাদি।’

‘কনগ্রাটস। তা হলে আর কি চিন্তার আছে? এনজয় ইয়োর লাইফ।’ কথাগুলো বলার সময় ফের একটা ফোন এল ওঁর। উঠে দাঁড়িয়ে অনাদি বললেন, ‘আর বসা যাবে না ভাই। দেবদূতকে নিয়ে তুমি একদিন আমার ক্লিনিকে এসো। সেকেন্ড হাফে এলে ভাল হয়। তখন খানিকটা ফ্রি থাকি।’

অনাদিকে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিতে শিখিন নীচে নেমে এলেন। তখনই দোতলা থেকে রাখী বলল, ‘কমপ্লেক্সের বাইরে গিয়ে একবার দেবের খোঁজ নিয়ে এসো। আমাকে একবার বলেছিল, গোলোকবাবুর মিষ্টির দোকানে মাঝেমধ্যে ও হিংয়ের কচুরি খেতে যায়। দেখো তো, আজ ওখানে গেছিল কি না?’

শুনে ঘাড় নাড়লেন শিখিন। গেল কোথায় ছেলেটা? চেনা কারোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল না কি? হয়তো তার সঙ্গেই গল্পে মেতে গেছে। ওর সঙ্গে মোবাইল থাকলে, হয়তো জানা যেত। কিন্তু গত একমাসে দু’দুবার ও মোবাইল ফোন হারিয়ে ফেলেছে। স্টিফেন ম্যানসনের আগুনে ভিক্টিমদের মধ্যে শারীরিক আর মানসিকভাবে দেবের মতো ক্ষতিগ্রস্ত আর কেউ হয়নি। শরীরে মাল্টিপল ফ্রাকচার। ড্রিমল্যান্ডের ডাক্তার ছেলেটা… শৌভিক মিত্তিরের হাতে না পড়লে দেবকে বাঁচানো কঠিন হত। ব্রেন থেকে শুরু করে স্পাইন… কোথায় সার্জারি হয়নি ছেলেটার! প্রথম দিকে তো প্রায় মাসআটেক কোমায় পড়েছিল। চণ্ডীতলায় খবর দিয়েছিলেন শিখিন। মাসিমাকে নিয়ে এসেছিল ওর পিসতুতো দাদা সুকুমার। ছেলেকে দেখেই মাসিমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। দিন দুই পরে তিনি মারা যান। দেব কিন্তু এখনও জানে না, ওর মা নেই। মায়ের কথা মনেই নেই। রাখী বা শিখিন কেউ চণ্ডীতলার কথা ওকে মনে করিয়ে দেননি।

দেবকে সুস্থ করে তোলার জন্য হুলো মিত্তিরের ভাইপো শৌভিক যা করেছে, তার তুলনা নেই। সিনিয়র ডাক্তারদের ডেকে নিয়ে এসে কঠিন অপারেশনগুলো ও নিজের হাতে করেছে। ড্রিমল্যান্ডে বড় অপারেশনের সুবিধে নেই। শৌভিক সব ব্যবস্থা করে দেবকে নিয়ে গেছে কখনও মেডিকেল কলেজ, কখনও এসএসকেএম হাসপাতালে। ও যেন প্রতিজ্ঞা করে বসেছিল, দেবকে জিম-এ ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সাসপেনশনের চিঠি পাওয়ার পর থেকে সিলভার জিম-এর দিকে আর যাওয়া হয়নি শিখিনের। অনিরুদ্ধ একবার বলেছিল, জিম-এ না কি তালা পড়ে গেছে। ফের খুলেছে কি না, সেই খবরটা নেওয়ার কোনও প্রয়োজন মনে করেননি শিখিন। খবর এনে দিতে পারত অনিরুদ্ধ। কিন্তু স্টিফেন ম্যানসনে আগুন লাগার দিন কর্তব্যে গাফিলতির জন্য ওকেও ডিজি পানিশমেন্ট দিয়েছিলেন। ওকে ট্রান্সফার করেন কালিয়াগঞ্জে।

ড্রিমল্যান্ড নার্সিং হোমে দেবের জন্যে জলের মতো টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছিল শিখিনের। তখনই একবার তাঁর মনে পড়েছিল মিলেনার কথা। কেমন আছে, তা জানার জন্য তিনি নিজে একবার গিয়েছিলেন মেয়েটার স্কুলে। প্রিন্সিপ্যাল ডরোথি ম্যাম দেবের কথা শুনে খুব দুঃখ পেলেন। কিন্তু মিলেনা ঠিক কোথায়, তার হদিশ দিতে পারলেন না। শুধু বলেছিলেন, দুর্ঘটনার পরদিনই আর্মেনিয়া থেকে এসে ওর ড্যাডি এরিক গ্রেগারিয়ান মিলেনাকে নিয়ে লন্ডনে চলে যান। তার পর আর কোনও খবর তিনি পাননি। এদিকে, দেব কোমা থেকে বেরিয়ে এল। অপারেশনের পর ধীরে ধীরে হাঁটতে চলতে পারল। কিন্তু নতুন উপসর্গ দেখে শিখিন একেবারে ভেঙে পড়লেন। মাথায় চোট লাগার জন্য দেবের স্মৃতিশক্তি অনেকটাই লোপ পেয়েছে। ফিজিওথেরাপির সময় দেব বাইরে বেরতে চাইত না। খুব বেশি লোকজন দেখলে ভয় পেত। আগুন দেখলে চিৎকার করে উঠত। অসুস্থ ছেলেটাকে ফেলে দিতে পারেননি শিখিন। ওর উপর মায়া পড়ে গেছে রাখীরও। বিয়ের পর অপ্সরা কমপ্লেক্সে ওঁরা ফ্ল্যাট কিনেছেন। দেবকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। সেইসময় বাণীব্রতর পুরো পরিবার পাশে এসে না দাঁড়ালে শিখিন সামলে উঠতে পারতেন না।

দেবের কথা ভাবতে ভাবতেই দূর থেকে গোলোকদার মিষ্টির দোকানের সামনে জটলা দেখতে পেলেন শিখিন। আরে, বাণীব্রতর মেয়ে ঈশিতা ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? পা চালিয়ে সেখানে পৌঁছতেই শিখিন দেখলেন, ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে একটা ছেলে বাঁধা রয়েছে। ছেলেটার রক্তাক্ত মুখ একদিকে ঝুলে পড়েছে। ভাল করে তাকাতেই ছেলেটাকে চিনতে পারলেন শিখিন। এ তো সিলভার জিম-এর দুর্বার চৌধুরী! এর এই অবস্থা হল কেন? ঈশিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এখানে? কী হয়েছে?’

‘অফিস যাচ্ছিলাম আঙ্কল। গণ্ডগোল দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি। সিমলার ছেলেগুলোর কী সাহস দেখেছেন? আমাদের পাড়ায় এসে মাস্তানি করছে! গোলোকদার দোকান ভাঙচুর করছিল। এমন প্যাদানি খেয়েছে, জিন্দগিতে আর এ তল্লাটে আসবে না।’

গোলোকদা দোকান থেকে নেমে এসে বললেন, ‘শিখিনবাবু, এই ছেলেটা সকালের দিগে আবনার ভাইকে মারার জন্য দলবল নিয়ে একানে এয়েছিল। তখন আবনার ভাই আসেননি। তিনি আসার পর আমি তেনাকে তাড়াতাড়ি পার্ক স্ট্রিটে পাটিয়েদিলুম। দেখুন, পরে ফিরে এসে, তেনাকে না পেয়ে এরা আমার দোকানের কী অবস্তা করেচে।’

ঈশিতা বলল, ‘থানার ওসিকে খবর দিয়েছি। আসছেন।’

দুর্বারকে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই শিখিনের। দেবের কী হল, জানতে তিনি বেশি আগ্রহী। গোলোকদাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার ভাইকে আপনি পার্ক স্ট্রিটে পাঠিয়ে দিলেন কেন?’

‘যেতে চাইছেন যে। সিলভার জিম বলে একটা জায়গায়।’

শিখিন চট করে ঘটনাটা মনের মধ্যে সাজিয়ে নিলেন। ঈশিতাকে তিনি বললেন, ‘দেব মনে হয়, সিলভার জিম-এ গেছে। চলো, বাড়িতে গিয়ে গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।’

প্রায় দৌড়েই দু’জনে অপ্সরা কমপ্লেক্সে ফিরে এলেন। গাড়ির চাবি নেওয়ার জন্য ডোরবেল টিপতে দরজা খুলে রাখী ফিসফিস করে বলল, ‘দেবভাই ফিরে এসেছে।’

শুনে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন শিখিন। উঁকি মেরে দেখলেন, সোফার এককোণে মাথা নীচু করে দেব বসে আছে। রাখী বলল, ‘তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পরই বারান্দা থেকে দেখি, ট্যাক্সি থেকে ও নেমে আসছে। উপরের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, দিদিভাই, ট্যাক্সি ভাড়াটা তুমি দিয়ে দাও। ব্যস, আর কোনও কথা বলেনি। কোথাও কিছু একটা হয়েছে মনে হয়। আসা ইস্তক গুম হয়ে বসে। জিজ্ঞেস করছি, কোনও উত্তর দিচ্ছে না।’

শিখিন বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি।’

সোফায় দেবের পাশে গিয়ে বসলেন শিখিন। কাঁধে হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, ‘সিলভার জিম-এ কার কার সঙ্গে দেখা হল দেব?’

মুখ তুলে দেব বলল, ‘সিলভার জিম বন্ধ হয়ে গেছে শিখিনদা।’

‘ওখানে চেনা তোমার কেউ চোখে পড়ল?’

‘রুস্তমের দুটো ছেলেকে। মকবুল আর রিয়াজ। ওরা আমাকে ভিখারি করে রাখবে বলছিল।’ বলতে বলতে চোখের কোণ ভিজে উঠল দেবের। রাখীর দিকে তাকিয়ে ও বলল, ‘দিদিভাই, আমাকে কি এখন ভিখারির মতো দেখতে লাগে, তুমি বলো?’

রাখী সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসে দেবকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘না ভাই, না। ওই ছেলেগুলো খুব খারাপ।’

‘একটাকে তুলে আছাড় মেরেছি। অন্যটাকে মারতে যাবো, এমন সময় দেখি, নাড়ুগোপাল ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এল। ও আমাকে একদিকে সরিয়ে নিয়ে গেল।’

শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘নাড়ুগোপাল কে দেব? আগে তো তার কথা আমাদের বলোনি!’

‘চণ্ডীতলায় থাকে। নাড়ু… আমাদের রন্তি মাসির ছেলে। মোকাম্বো বার-এ চাকরি করে। ও আমাকে বিচ্ছিরি একটা খবর দিল। মা না কি অনেকদিন আগে মারা গেছে। কী আশ্চর্য দেখো, মায়ের কথা অ্যাদ্দিন আমার মনেই পড়েনি। তোমরা কি জানো, মা কেমন আছে?’

রাখীর দিকে তাকালেন শিখিন। সত্যি কথাটা বলার সময় এখনই এসে গেছে। কিন্তু ভাঙাগলায় দেব বলতে লাগল, ‘নাড়ুর কথা আমি বিশ্বাস করিনি দিদিভাই। ও আগেও একবার মাকে জড়িয়ে মিথ্যে কথা বলেছিল। মায়ের নাকি মিলেনাকে পছন্দ হয়নি। তাই আগুন লাগিয়ে সুইসাইড করতে গেছিল। পরে রাঙাদা বলল, ডাহা মিথ্যে কথা। তুমি একবার আমার রাঙাদাকে ফোন করবে দিদিভাই?’

কথাটা আর চেপে রাখা উচিত হবে না। রাখী বলেই ফেলল, ‘নাড়ু এ বার মিথ্যে কথা বলেনি ভাই।’

শুনে চমকে উঠে দেব বলল, ‘তোমরা তা হলে জানতে? আমাকে বলোনি কেন দিদিভাই? কোয়েল মারা গেছে, তমাল জনাইতে ফিরে গেছে। মিলেনার খোঁজ নেই। আজ শুনলাম, মাও নেই। আমার তো কেউ রইল না দিদিভাই। আমার বেঁচে থেকে কি হবে?’

কথাগুলো বলতে বলতে দু’হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল দেব। ওর মুখে মিলেনার নামটা শুনে ফের একবার স্বস্তির নিশ্বাস নিলেন শিখিন।

(তেষট্টি)

বিধানসভা থেকে মুখ চুণ করে বেরিয়ে এল রুস্তম। প্রাত্যহিক দর্পণ কাগজে আজ ওর সম্পর্কে একটা খবর বেরিয়েছে। খানিক আগে কাগজটা মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে সুধাংশুদা। আলটপকা অনেক কিছু বলেন রেগে গেলে। বিশেষ করে, কোনও মাসে টাকা পাঠাতে দেরি হলে। কিন্তু ‘বাপের ঠিক নেই’ কথাটা রুস্তম হজম করতে পারেনি। তবুও, মাথা ঠান্ডা রেখে ও বলেছিল, ‘কী লিখেছে সুধাংশুদা? আমি তো কিছুই জানি না।’

‘তোর মায়ের ইন্টারভিউ। রাসমণি চক্কোত্তির। গোসাবায় গিয়ে রিপোর্টার তোর মায়ের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। লেখার সঙ্গে ছবিও আছে। খুলে দ্যাখ, তোর মা কি না। না কি তোর মায়েরও ঠিক নেই?’

টেবলের উপর কাগজটা পড়েছিল। তাকিয়ে হেডিংটা দেখে নিয়েছিল রুস্তম। ‘আর্থিক অনটনে বিধায়কের মা মৃত্যুশয্যায়।’ সঙ্গে আম্মির ছবি। দেখে চমকে উঠেছিল ও। মেটে বাড়ির দাওয়ায় আম্মি বসে আছে। চোখ-মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। হতদরিদ্র চেহারা। রক্তের সম্পর্ক বলতে যা বোঝায়, তা ওর ছিল মা আর ভাইয়ের সঙ্গে। আবিদ ভাইজানের সঙ্গে ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর আম্মির সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। তাও বছর কুড়ি হয়ে গেছে। পুলিশ না কি ওর খোঁজে দু’তিনবার ঝুপড়িতে গেছিল। তারপর আম্মি নিজেই ওখান থেকে কোথাও চলে যায়। আসলে রুস্তম জানতই না, আম্মি কোথায় আছে। বছর দশেক আগে ভাইয়ের সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল শেয়ালদা স্টেশনে। কুলিগিরি করছে। ভাই ওকে না চেনার ভান করেছিল। রুস্তমও পাত্তা দেয়নি। এত বছর পর এই মুসিব্বত উদয় হল কোত্থেকে?’

সুধাংশুদা তড়পাচ্ছিলেন, ‘এই তো কাগজে তোর নামে যা তা লিখেছে। ভোটার আর আধার কার্ডে তোর নাম রুস্তম আহমেদ। বাবার নাম খান মহম্মদ। এদিকে, তোর মা তো বলছে, তোর জন্ম হয়েছিল গোসাবার হাসপাতালে। বার্থ সার্টিফিকেটে তোর নাম আছে রাসমোহন। কথাটা যদি সত্যি হয়, তা হলে তোর তো পোঁদ মারা যাবেই, এখন সেশন চলছে, অ্যাসেম্বলিতে পার্টিরও গাঢ় মেরে দেবে অপোজিশন।’

যে কোনও সময় সুধাংশুদার ঘরে লোক ঢুকে আসবে। রুস্তম বেশি কথা বাড়াতে চায়নি। বলেছিল, ‘কাগজে ঠিক লেখেনি সুধাংশুদা। এ আমার আম্মি না। আমার আম্মির ইন্তেকাল হয়েছে অনেকদিন আগে। নিজের হাতে আমি তাকে গোর দিয়েছি গোবরায়।’

‘আমার সঙ্গে গাঢ়পেঁয়াজি করবি না রুস্তম। তুই যে সত্যি কথা বলছিস, তার প্রমাণ দিতে পারবি? আজ বিকেলের মধ্যেই তুই গোবরার গোরস্থান থেকে সার্টিফায়েড কপি নিয়ে আসবি। আর যে মেয়েছেলেটা তোর মা বলে মিডিয়ায় ডিম্যান্ড করেছে, তাকে মার্ডার করে আসবি। এই নিউজটার ইমপ্যাক্ট কী হবে, তুই কি বুঝতে পারছিস বেওকুফ? তোর এরিয়া মুসলিম ডমিনেটেড। তুই যে মোছলমান না, সেটা জানতে পারলে কী জবাব দিবি পার্টির ছেলেদের? অ্যাদ্দিন ধরে ওদের সঙ্গে নামাজ পড়েছিস, ঈদ আর ইফতার করেছিস। এখন যদি ওরা জানতে পারে, তুই বামুনের ছেলে, তা হলে পার্ক সার্কাস, তিলজলা আর তপসিয়ায় কাল থেকে তোকে লিডার বলে কেউ মানবে? উল্টে, তোকে মার্ডার করে দেবে।’

এতটা তলিয়ে ভাবেনি তখন রুস্তম। সুধাংশুদা পোড়খাওয়া পলিটিশিয়ান। আশঙ্কার জায়গাটা ঠিক ধরতে পেরেছেন। তবুও, গলায় জোর এনে ও বলেছিল, ‘অত ভাববেন না সুধাংশুদা। আমি জানি, কে পিছনে লেগেছে। আমাকে একটু সময় দিন, সব মেরামত করে দিচ্ছি।’

তবুও, সুধাংশুদার আক্ষেপ যায়নি, ‘মেরামত-টেরামত না। আমার প্রুফ চাই। সলিড প্রুফ। তোকে এমএলএ করে আনাটাই আমার তখন ভুল হয়েছে। আবিদের মেয়েটা…কী যেন নাম… রাবেয়া তখন আমাকে অত করে ধরল। ওকে তখন পাত্তাই দিলাম না। তুই এখন যা ভাই। মনে মনে রেডি থাক। পার্টি তোর এগেনস্টে অ্যাকশন নিতেও পারে।’

সুধাংশুদার অ্যাটিটিউট ভাল লাগেনি রুস্তমের। বিরাট দুঃশ্চিন্তা নিয়ে ও বিধানসভা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কী করবে, বুঝতেই পারছে না। ভোটার কার্ডে নাম তোলার সময়কার ঘটনাটা ওর মনে আছে। খানসাহেবের মাংসের দোকানে ও তখন কাজ করত। ওর বয়স তখন চোদ্দো-পনেরো। কিন্তু ওকে দেখতে মনে হত, আঠারো-উনিশ। খানসাহেব রাসমোহন বলতে পারতেন না। একটু ডেয়ারডেভিল টাইপের ছিল বলে, ওকে ডাকতেন রুস্তম বলে। পার্টির যে ছেলেগুলো ভোটার লিস্ট বানাতে এসেছিল, তারাই জোর করে ওর নামটা তখন ঢুকিয়ে দেয়। একটা মুসলিম ভোট তো অন্তত বাড়বে। তখন ছেলেগুলো জিজ্ঞেস করেছিল, আব্বুর নাম কী লিখব? খানসাহেব তখন বলেন, ‘আমার কাছেই মানুষ হচ্ছে, আমার নামটা লিখে দে।’ সেইসময় রেললাইনের ধারে ঝুপড়ি উচ্ছেদ হয়ে গেছে। আম্মি আর ভাই কোথায় গেছে, রুস্তম সত্যিই জানত না।

রেড রোড ধরে গাড়ি চালানোর সময় রুস্তম ঠিক করতে পারল না, কোথায় যাবে। তখনই ওর ফোনটা বাজতে শুরু করল। আড়চোখে তাকিয়ে ও দেখল, আসফাকের ফোন। স্টিফেন ম্যানসনে আগুন লাগার পর থেকে আসফাক একটু নেতা হওয়ার চেষ্টা করছে। রেসকিউ কাজের জন্য কলকাতার পুলিশ ওকে মেডেল দিয়েছিল। তার পর থেকে ওর মাথাটা বিগড়ে গেছে। রুস্তম খবর পাচ্ছে, অনেক জায়গা থেকে ও তোলা তুলছে, অথচ জানাচ্ছে না। এর পিছনে নির্ঘাত নার্গিসের উস্কানি আছে। পুরুষদের সর্বনাশের পিছনে কোনও না কোনও মেয়ের হাত থাকে। এই কারণে ও নিজে নিকাহ করার কথা কখনও ভাবেনি। আসফাকের পাখনা ও খুব শিগগির ছেঁটে দেবে। তাই আজকাল পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। অভিজ্ঞতা রুস্তমকে শিখিয়েছে, মানুষ যখন উপরের দিকে ওঠে, তখন কিছু ঘনিষ্ঠ লোক পাশ থেকে ছিটকে যায়। উল্টোটাও হয়। মানুষের যখন খারাপ সময় আসে, তখনও কিছু লোক আর ধারে-কাছে থাকে না।

আসফাকের ফোন ধরবে না ভেবেও, মন বদলে রুস্তম সুইচ অন করল। ইয়ারফোনে শুনতে পেল, ‘ওস্তাদ, আশিক আবার এ পাড়ায় ফিরে এসেছে। রিয়াজকে আজ এমন মেরেছে, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল।’

আশিক মানে… একটা সময় ওর রাইভাল সিলভার জিম-এর দেব। আসফাক বেওকুফটা কীইইই! ও এখন এমএলএ… বিরাট পজিশনে আছে। দেবের মতো সামান্য একটা ছেলেকে নিয়ে ও মাথা ঘামাবে কেন? ছেলেটা বেঁচে আছে কি না, অ্যাদ্দিন কেউ খোঁজও নেয়নি। তা ছাড়া, রুস্তমের এখন জীবন-মরণ সমস্যা। হাতে মাত্তর চব্বিশ ঘণ্টা সময়। নিরাসক্ত ভাব দেখিয়ে রুস্তম বলল, ‘আমাকে বলছিস কেন আসফাক? আমি এখন অ্যাসেম্বলিতে। এসব ছোটখাটো ব্যাপারে আমাকে আর জড়াবি না।’

ও প্রান্ত থেকে আসফাক আহত গলায় বলল, ‘রেন্ডির বাচ্চাটাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবো?’

‘যা পারিস কর। আমার কথা বলার সময় নেই।’ বলে লাইনটা কেটে দিল রুস্তম।

একবার ভাবল, মোকাম্বোতে গিয়ে বসবে। দু’তিন পেগ পেটে পড়লেই মাথাটা সাফ হয়ে যাবে। পরক্ষণেই রুস্তমের মনে হল, পার্ক স্ট্রিটের দিকে ও যাবেই না। গেলে কোনও না কোনও সাঙাতের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। রাজ্যের সমস্যার কথা তুলে ওকে নিজের চিন্তা করতেই দেবে না। নিশ্চিন্তে বসার জন্য একটা বার-ই আছে। ঝাউতলায় জলসা। মিনিট দশেকের মধ্যেই রুস্তম ঝাউতলায় পৌঁছে গেল। গাড়ি পার্ক করার সময় প্রাত্যহিক দর্পণের একটা কপি হাতে তুলে নিল পিছনের সিট থেকে। মাল খেতে খেতে রিপোর্টটা ও ভাল করে পড়বে। তার পর ডিসিশন নেবে, কী করা যায়। ওকে দেখেই ম্যানেজার ছেলেটা দৌড়ে এসে বলল, ‘সালাম আলেইকম এমএলএ সাব। আপনার সাথে আর কেউ আছে?’

রুস্তম বলল, ‘আলেইকম সালাম।’ বার-এর ভিতরে একবার চোখ বুলিয়ে রুস্তম বলল, ‘না, সঙ্গে কেউ নেই। উপরের তলায় একটা ঘর খুলে দে। কেউ যেন অন্তত ঘণ্টা খানেক আমাকে ডিসটার্ব না করে।’

নীচের তলার মতো উপরে অত ভিড় নেই। রাস্তার দিকে একটা ঘরে বসে নিশ্চিন্তে রুস্তম খবরের কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরল। হেডিংটা আগেই পড়ে নিয়েছিল। লেখার ভিতরে ঢোকার পর ওর মাথায় কে যেন ঘণ্টা বাজাতে শুরু করল। ‘ছেলে বিধায়ক। থাকেন কলকাতার সবথেকে উঁচু বিল্ডিং দ্য ফর্টি টু-তে। আর মা গোসাবার গ্রামে স্বামীর ভিটেতে অনাহারে দিন গুজরান করছেন। শরীরে টিবি রোগ বাসা বেঁধেছে অনেক আগেই। চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পারেন না। রাসমণি চক্রবর্তীর হাল-হকিকত এখন এমনই। বয়স ষাটের উপর। বছর চার-পাঁচ আগেও খেতে জন মজুরির কাজ করেছেন। এখন হাঁটা-চলার সামর্থটুকুও নেই। রাসমণি মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন।’

এই পর্যন্ত পড়েই রুস্তমের মাথার ভিতরটা শূন্য হয়ে গেল। ওর নামটা কোথাও রিপোর্টার লিখেছে কি না, তা দেখার জন্য ও দ্রুত চোখ বোলাতে লাগল। ‘অসুস্থ স্বামী পাঁচকড়ি চক্রবর্তীর চিকিৎসার জন্য দুই ছেলে রাসমোহন আর কৃষ্ণমোহনকে নিয়ে রাসমণি কলকাতার মুচিপাড়ার এক বস্তিতে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু স্বামীকে তিনি বাঁচাতে পারেননি। গোসাবায় ফিরে না গিয়ে রাসমণি কলকাতাতেই থেকে যান। পরিচারিকার কাজ করতেন। অভাবের তাড়নায় ঠোক্কর খেতে খেতে শেষপর্যন্ত এক মুসলিম ভদ্রলোকের চেষ্টায় আশ্রয় পান শিয়ালদহের রেল ঝুপড়িতে। ততদিনে বড় ছেলে রাসু আন্ডারওয়ার্ল্ডে ঢুকে পড়েছে। সে যে কবে রুস্তম আহমেদ হয়ে গেছে রাসমণি তা জানতেনও না। রেল কর্তৃপক্ষ ঝুপড়ি উচ্ছেদ করার পর তিনি ফের গোসাবায় ফিরে আসেন। তারপর থেকে রাসু ওরফে রুস্তমের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই।’

মনে পড়ছে, রুস্তমের সব মনে পড়ছে সেইদিনগুলোর কথা। বেয়ারা ওল্ড মঙ্কের বোতল রেখে গেছে। নিট কয়েক ঢোঁক খেয়ে মাথাটা সাফ করার চেষ্টা করল রুস্তম। যে মাদারচোত লিখেছে, সে খুব আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছিল। গোসাবার টাইগার ঘাটের কাছে সে গিয়েছিল, গাঁয়ের লাল পার্টির কোনও কমরেডের কাছে খবর পেয়ে। রুস্তম ফের রিপোর্টে মন দিল, ‘তাঁর ছোট ছেলে কৃষ্ণমোহন যে ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন, সে কথা রাসমণি জানতে পারেন প্রায় এক বছর পর। বড় ছেলে রাসু বিধায়ক হয়েছেন, তা শোনেন এক এনজিও কর্মীর কাছ থেকে। রুস্তম আহমেদের ছবি দেখে তাঁকে চিনতে পারেন। তবে, বড় ছেলের কাছে এখন তিনি কিছু প্রত্যাশা করেন না। বিপিএল কার্ড এখনও তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি চান শুধু সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ।’

এর পরের লাইনগুলোই মারাত্মক। ‘মাসছয়েক আগে রুস্তম পার্ক সার্কাস অঞ্চল থেকে বিধায়ক হয়েছেন। মুসলিম সমাজ তাঁকে নেতা বলে মেনে নিয়েছেন। অথচ তিনি মুসলিম নন। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য রুস্তমকেই এখন এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তিনি নির্বাচন কমিশনকে ভুল তথ্য দিয়েছেন। সেই অপরাধে তাঁর বিধায়ক পদ খারিজও হতে পারে। একদিকে গর্ভধারিণী মা, অন্যদিকে রাজনৈতিক উচ্চাশা। কাকে রুস্তম গুরুত্ব দেবেন, এখন সেটা তাঁর উপরই নির্ভর করছে।’ শেষের এই লাইনগুলো পড়ে রুস্তমের মাথা গরম হয়ে গেল। বোতল থেকে সরাসরি লম্বা একটা ঢোঁক গিলে ও সিদ্ধান্ত নিল, আগে জানতে হবে, এই রিপোর্টটা কার লেখা? খোঁজ করে সেটা একমাত্র বলতে পারে মউ। কথাটা মনে উদয় হওয়া মাত্রই রুস্তম গুটিয়ে গেল। অনেকদিন মেয়েটার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের কাছে মউ একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট কিনেছে। দ্য ফর্টি টু থেকে মেয়েটা নিজেই চলে গেছিল, রুস্তম বিধায়ক হওয়ার পর।

জলসাতে বসেই রুস্তম ফোন করল মউকে, ‘তোমার সঙ্গে আজ একবার দেখা হতে পারে?

মউ বিদ্রুপের সুরে বলল, ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য বুঝি?

শুনে একটু থমকে গেল রুস্তম। জিজ্ঞেস করল, ‘প্রাত্যহিক দর্পণের রিপোর্টটা তোমার চোখে পড়েছে না কি?’

‘হ্যাঁ, দেখেছি। ওরা তো মিথ্যে লেখেনি।’

‘কে লিখেছে, সেই ছেলেটার নাম জেনে দিতে পারবে?’

‘ছেলে নয়, মেয়ে। মেয়েটার নাম ঈশিতা। স্টিফেন ম্যানসনে আগুন লাগার পরদিন তোমার এগেনস্টে লিখেছিল বলে, যাকে তুমি চড় থাপ্পড় মেরেছিলে। মনে পড়ছে? অ্যাদ্দিনে ও তার বদলা নিল। কিন্তু ওর নামটা জানতে চাইছ কেন? ওকে মার্ডার করবে না কি?’

কয়েক সেকেন্ড গুম হয়ে থেকে রুস্তম বলল, ‘মেয়েটাকে কে খবর দিয়েছে, জানো?’

‘জানব না কেন? একটা সময় তোমার শয্যাসঙ্গিনী রাবেয়া। তুমি যে মুসলিম নও, সেটা ও অনেকদিন আগেই জানত। তোমার ছুন্নত করা নেই। ইলেকশনের আগেই রাবেয়া তোমার নামে স্ক্যান্ডাল রটানোর কথা ভেবেছিল। কিন্তু আমিই ওকে মানা করেছিলাম। কেননা আঁচটা ওর গায়েও গিয়ে লাগত। প্লাস পার্টি নেতাদের কাছে চক্ষুঃশূল হয়ে যেত। রাবেয়ার হাসবেন্ড এখন ওকে তালাক দিয়েছে। এখন ওর পিছুটান বলে কিছু নেই।’

‘কী করি, তুমি একটা পরামর্শ দাও তো মউ।’

‘তোমার কিছু করার নেই। তুমি যে রাসমণি চক্রবর্তীর ছেলে, তার প্রমাণ ঈশিতার কাছে আছে। প্লাস রাসমণি বেঁচে আছেন, তিনিও অ্যালিবাই দেবেন। কোর্ট কাছারিতে গেলে তুমি ফেঁসে যাবে। খান মহম্মদ যে তোমাকে কনভার্ট করেছিলেন, তার প্রমাণও তুমি দিতে পারবে না। কোর্টে গিয়ে তুমি তখন এফিডেফিটও করোনি। তোমার পালিয়ে যাওয়ার একটাই রাস্তা আছে। আরব কান্ট্রিগুলো থেকে মসজিদ রিনোভেশনের জন্য তুমি অনেক টাকা এনেছ। আশা করি, ওখানে অনেক লোক তোমার চেনা আছে। ওদের পটিয়ে তুমি খাঁটি মুসলিম হয়ে যাও। সঙ্গে হজও করে এসো।’ কথাটা বলে মউ হাসতে শুরু করল।

কথা হাতড়ে না পেয়ে, রুস্তম বলল, ‘আমি জলসা বার-এ আছি। প্লিজ, তুমি একবার আসবে?’

মউ বলল, ‘সম্ভব না। আমি এখন মালদ্বীপে হনিমুন করতে এসেছি। ওহ, আমার বিয়েতে তোমাকে নেমতন্ন করা হয়নি বোধহয়, তাই না? গত সপ্তাহে শুভঙ্করের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। বেচারিকে আমি মাফ করে দিয়েছি রুস্তম। ইস, আমার জন্য অনেকদিন ওকে জেল খাটতে হয়েছে। পরে বুঝলাম, ও সত্যিই আমাকে খুব ভালবাসে। আমি কথা দিয়েছি, তোমার জায়গায় বাই ইলেকশনে শুভঙ্করকে… আমরা মিডিয়ার লোকেরা সবাই মিলে জেতাব। যাক সে কথা। আমরা এখন একটা জাহাজের ডেক-এ। সমুদ্রের উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছি। মালদ্বীপ যে কী চমৎকার জায়গা, না এলে জানতে পারতাম না।’

কথাগুলো শুনতে শুনতে রুস্তমের মনে হল, জাহাজ থেকে মউ ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। নীল সমুদ্রের জলে ও ডুবে যাচ্ছে। বিরাট একটা ঘূর্ণির মধ্যে ও পড়ে গেছে। জলের আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ও প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়ছে। জাহাজের ডেক-এ মউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে শুভঙ্কর। দু’জনেই হাত তুলে বিদায় জানাচ্ছে, ‘বাই।’ এক পাক করে ও ঘুরছে আর একেকজনকে দেখতে পাচ্ছে। সুধাংশুদা, রাবেয়া, আসফাক, নার্গিস, মি. ধিংড়া, গুলাটি, এমন কী দেবকেও। বৃত্তটা ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। ঘূর্ণির টানে নীচে নামছে রুস্তম। জ্ঞান হারানোর আগেও শুধু জাহাজের ভোঁ শুনতে পেল।

(চৌষট্টি)

ভাইয়ার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে দেব। বাণীব্রত আঙ্কলের ছেলে প্রায়দিনই এসে ওকে চ্যালেঞ্জ করে, ‘দেবদা, এসো তো দেখি, তোমার স্ট্রেংথ কতটা বাড়ল?’

দেব রোজই বলে, ‘ধূত, তুই আমার সঙ্গে পারবি না? আমি বাঁ হাত দিয়ে লড়লাম, তবুও লাস্ট দিন তুই হেরে গেলি। আগে নিজের স্ট্রেংথ বাড়িয়ে আয়। শুধু ওয়াটারপোলো খেললে গায়ের জোর বাড়ে না কি?’

ভাইয়া ভাল ওয়াটারপোলো খেলে। হেদুয়ায় বেশ কয়েকদিন ও লিগ ম্যাচ দেখাতে নিয়ে গেছে। ওরও লোহা তোলা বডি। বয়স একুশ-বাইশের বেশি হবে না। সবে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে। এরই মধ্যে ওয়াটারপোলো খেলার জন্য রেল না কি ওকে চাকরি দেবে বলেছে। নর্থ ক্যালকাটার ছেলেরা একটু সাদাসিধে টাইপের। প্রায়ই সন্ধেবেলায় ও আড্ডা মারতে এলে দেব খুশিই হয়।

মাসখানেক আগে কোথায় যেন আর্ম রেস্টলিং কম্পিটিশন দেখে এসেছে ভাইয়া। তারপর থেকে পাঞ্জা লড়ায় ঝোঁক বেড়েছে ওর। কেউ বোধহয় একবার ওকে ভয় দেখিয়েছিল, যার-তার সঙ্গে লড়তে যেও না। হাত ভেঙে যাওয়ার চান্স আছে। খচরামি করে কেউ যদি হাত ভেঙে দেয়, তা হলে ওয়াটারপোলো খেলা আর রেলের চাকরি খতম। তাই কার সঙ্গেই বা ও লড়তে যাবে? বেছে নিয়েছে দেবকে। কেননা, বোকার মতো দেব একদিন বলে ফেলেছিল, হাওড়ায় একবার আর্ম রেস্টলিংয়ে ও পার্টিসিপেট করেছিল। কিন্তু জগাদা প্রচণ্ড বকুনি দেওয়ায় আর্ম রেস্টলিং, পাওয়ার লিফটং… এইসব খেলার দিকে ও কখনও যায়নি।

শিখিনদার টেবলে দুটো তোয়ালে মুখোমুখি ভাঁজ করে রেখেছে ভাইয়া। নরম তোয়ালের উপর কনুই রেখে ওরা পাঞ্জা লড়বে। কম্পিটিশনে স্পঞ্জ-এর টুকরোর উপর কনুই রাখতে হয়। কিন্তু বাড়িতে সেসব পাবে কোথায়? ভাইয়াকে সিরিয়াসলি তৈরি হতে দেখে দেব বলল, ‘তোর সঙ্গে লড়ে কোনও লাভ নেই ভাইয়া। জিতে কোনও প্রাইজ পাওয়া যায় না। কেউ হাততালি দেয় না।’

ভাইয়া বলল, ‘কী প্রাইজ চাও তুমি বলো।’

আজ দর্শকের সংখ্যা কম না। ড্রয়িং রুমের ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে ছয়-সাতজন। বাণীব্রত আঙ্কল, শিখিনদা, রাখী আর রেখা দিদিভাই, কমপ্লেক্সের আরও দু’তিনজন। হঠাৎ ঘরে ঢুকে এল ঈশিতা। ওর হাতে বড় পলিথিনের প্যাকেট। ভাইয়ার প্রশ্নটা বোধহয় শুনতে পেয়েছিল ও। এক পলকেই পরিস্থিতিটা বুঝে নিয়ে ও বলল, ‘প্রাইজ আমি নিয়ে এসেছি। এগ-মাটন রোল। যে জিতবে, সে দুটো পাবে।’

দেব উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘এক্সিলেন্ট। বেশ কয়েকদিন ধরে মাটন রোল খেতে ইচ্ছে করছিল। চল ভাইয়া, খেলা যাক। রেফারি কিন্তু শিখিনদা।’

কথাগুলো বলেই দেব জামাটা খুলে ফেলল। ওয়ার্ম আপ করার জন্য হাতের মাসলগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল। পাঞ্জা লড়ার জন্য হাতের চারটে মাসল-এর খুব দরকার হয়। বাইসেপস ব্রাচি, প্রোনেটর টেরেস, পেকটোরালিস মেজর আর ফ্লেক্সর কার্পি। ডেলটয়েড, ল্যাটস আর ট্রাইসেপস স্ট্রং হলে সোনায় সোহাগা। দেব এই মাসলগুলো টোন করার সময় ঈশিতা বলে উঠল, ‘ভাইয়া দাঁড়া, তোদের লড়াইটা মোবাইলে রেকর্ড করে রাখি।’

আর্ম রেস্টলিং হল পৃথিবীর সবথেকে স্বল্পমেয়াদি খেলা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হার-জিত হয়ে যায়। তিন মিনিটের মধ্যে তিনবার ভাইয়াকে নক আউট করে দেওয়ার পর দেব হাসিমুখে বলল, ‘ভাইয়া, তুই তো আর্ম রেস্টলিংয়ের টেকনিকটাই জানিস না। অপোনেন্টের হাত ধরার একটা কায়দা আছে। সেটা রপ্ত করতে না পারলে তুই কোনওদিন জিততে পারবি না।’

ভাইয়া বলল, ‘সেটা শিখিয়ে দাও না দেবদা।’

ঈশিতা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘এখন থাক। এগ মাটন রোল ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’

পলিথিনের প্যাকেট থেকে এগ মাটন রোল বের করে ও সবাইয়ের হাতে দিতে লাগল। একবার তাতে কামড় দিয়ে দেব বলল, ‘ওঃ, দারুণ। নর্থ ক্যালকাটাটা হচ্ছে আশ্চর্য একটা জায়গা, বুঝলি ঈশিতা। এখানকার মতো ভাজাভুজির টেস্ট অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।’

শিখিন বললেন, ‘তুমি তো আগে এ সব জাঙ্ক ফুড একদমই মুখে তুলতে না দেব।’

‘তখন যে সিরিয়াসলি বডিবিল্ডিংটা করতাম।’

‘আবার শুরু করো না ভাই। নর্থ ক্যালকাটায় অনেক জিম আছে। চলো, কাল তোমাকে নিয়ে যাই।’

‘না শিখিনদা, আর পারব না। আমাকে দিয়ে আর হবে না। মন ভেঙে গেছে। আমার বডিতে এখন অনেক খুঁত। আর বোধহয় মেরামত করা যাবে না।’

দেবের গলায় বিষাদের সুর। কেউ কোনও কথা না বলে রোল খেতে লাগলেন। কিন্তু ঘরের আবহাওয়াটা ফিরিয়ে আমার জন্য মাটল রোল… মাইকের মতো মুখের সামনে ধরে, ঈশিতা বলল, ‘অ্যাটেনশন প্লিজ, আমার কয়েকটা ইম্পরট্যান্ট অ্যানাউন্সমেন্ট করার আছে। শিখিন আঙ্কলের জন্য আজ একটা সুখবর নিয়ে এসেছি।’

শিখিনদা বললেন, ‘আমার জন্য সুখবর! কী রে?’

‘আঙ্কল, স্টিফেন ম্যানসনে আগুন লাগার পর গভর্নমেণ্ট যে তদন্ত কমিশন বসিয়েছিল, তার ফাইনাল রিপোর্ট আজ বেরিয়েছে। আজ দমকল মন্ত্রী সুহাস ব্যানার্জি প্রেস কনফারেন্স ডেকে বলেছেন, স্টিফেন ম্যানসনে আগুন ইলেকট্রিক্যাল শর্ট সার্কিটের জন্য লাগেনি। আগুন লাগানো হয়েছিল। কন্সপিরেসিতে যে দু’জন ছিল, তাদের একজন মি. ধিংড়াকে পুলিশ চণ্ডীগড় থেকে পাকড়াও করেছে। অন্যজন রুস্তম আহমেদকে তুলেছে কাল রাতে ঝাউতলার জলসা বার থেকে। আঙ্কল, এই রুস্তমকে তো আপনি ভাল করে চেনেন। এখন রুলিং পার্টির এমএলএ।’

রেখা দিদিভাই জিজ্ঞেস করল, ‘এই রুস্তমের ছেলেরাই আগুনের সময় তোকে হ্যারাস করেছিল না?’

‘হ্যাঁ মামণি, দমকলের সাপোর্টে আমার রিপোর্ট বেরনোর দিনই, পার্ক স্ট্রিটে আমাকে ঘিরে ধরে চড়চাপড় মেরেছিল ওর ছেলেরা।’

ঈশিতার মুখে রুস্তমের নাম শুনেই দেবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ও বলল, ‘ঝাউতলার জলসা বার-এ আমি একবার ওকে পিটিয়ে ছিলাম। তোমাকে যে ও হ্যারাস করেছিল, তা তো জানতাম না।’

‘জানবে কি করে, তুমি তো তখন নার্সিং হোমে। যাক সে কথা, আমার কাছে আরও সুখবর আছে। নাম্বার টু, ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট স্বীকার করে নিয়েছে, শিখিন আঙ্কলকে সাসপেন্ড করা অন্যায় হয়েছিল। সেই সাসপেনশন তুলে নেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, শিখিন আঙ্কলকে প্রোমোশন দেওয়া হবে ডিরেক্টর জেনারেল র‍্যাঙ্কে তুলে দিয়ে। আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে সুহাসদা নিজের মুখে কথাটা বলেছেন। সম্ভবত, সাসপেনশন উইথড্রয়ালের সেই চিঠি এসে যাবে কাল বা পরশুর মধ্যে।’

মুহূর্তের মধ্যে খুশির রেশ ছড়িয়ে গেল ঘরে। দেবের চোখে পড়ল, রাখী দিদিভাই দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করেছেন। আনন্দের কান্না। একবার শুধু বললেন, ‘ঈশ্বর আছেন।’

শিখিনদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তদন্ত কমিশনের রিপোর্টটা কি তোমার কাছে আছে ঈশিতা?’

‘আঙ্কল, প্রেস কনফারেন্সের পরই হোয়াটসঅ্যাপে আপনার কাছে পিডিএফ করে দিয়েছি। একশো পাতার রিপোর্ট। একটা হার্ড কপিও আপনার জন্য নিয়ে এসেছি। ভালো করে পড়ে দেখবেন।’

কথাটা বলে হ্যান্ড ব্যাগ খুলে ও একটা ফাইল এগিয়ে দিল শিখিনদার দিকে। তারপর বলল, ‘ওয়েট, ওয়েট। এ বার সুখবর নাম্বার থ্রি-টা দিই। আজ সকালে ঘটা করে স্টিফেন ম্যানসন খুলে দেওয়া হয়েছে রেসিডেন্টদের জন্য। কুড়ি মাস পর যে যার ঘরে ফিরে গেছেন। রাখী মাসি, তোমাদের কল সেন্টারের মালিক ওখানে এসেছিলেন। তোমাদের পাশের অফিসের তুহিনকে ওখানে দেখলাম। তোমরা যে বাড়ি বদলেছ, তোমার অফিস তা জানত না। তোমার নতুন ফোন নাম্বারটাও ওদের কাছে নেই। তুহিন আমার কাছ থেকে নাম্বারটা চেয়ে নিল। ডেফিনিটলি ও কন্টাক্ট করবে তোমার সঙ্গে।’

একসঙ্গে তিন-তিনটে সুখবর! ঘরের ভিতর পিনড্রপ সাইলেন্স। বাণীব্রত আঙ্কল বলে উঠলেন, ‘নাউ দ্য কোয়েশ্চেন অ্যারাইজেস, শিখিন তুই দমকলের চাকরিতে ফিরে যাবি কি না?’

‘বাপী… প্লিইইজ কিপ কোয়াইট।’ ঈশিতা বলল, ‘কথার মাঝখানে নাক গলাচ্ছ কেন? আমার সুখবরের লিস্ট এখনও শেষ হয়নি।’

বাবা-আর মেয়ের এই মিষ্টি ঝগড়া দেব প্রায়ই শোনে। বড় হয়ে গেলে মেয়েরা বোধহয় বাবাদের গার্জেন হয়ে ওঠে। মায়েরও প্রশ্রয় পায়। রেখা দিদিভাই বলল, ‘বাণী একটু চুপ করো না। মেয়েটা কী বলছে, শোনো।’

ঈশিতা বলল, ‘চার নম্বর সুখবরটা আমাকে নিয়ে। অফিসে আমার প্রোমোশন হয়েছে। আমি স্পেশাল করেসপন্ডেট হয়ে গেলাম। আমি এখন নবান্ন থেকে রাজভবন, সব জায়গায় যেতে পারব খবর করার জন্য। অফিস কেন আমার উপর খুশি জানো? রুস্তম সম্পর্কে আমি রিসেন্টলি এমন একটা খবর করেছি, যা কাগজের বিক্রি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। সার্কুলেশন তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। রুস্তমের পলিটিক্যাল লাইফ শেষ করে দিয়েছি। ওকে এখন জেলের ঘানি টানতে হবে দেবদা।’

শুনে দেব আর ভাইয়া লাফিয়ে উঠল। দু’জনে হাই ফাইভ করার পর দেব বলল, ‘শুধু এগ মাটন রোলে হবে না ঈশিতা। এত বড় একটা অ্যাচিভমেন্ট। তোর উচিত বড় করে পার্টি দেওয়া।’

ভাইয়া বলল, ‘ফালতু জায়গায় নয়। ফাইভ স্টার হোটেলে।’

আশ্চর্য, ঈশিতা রাজিও হয়ে গেল। বলল, ‘ওকে, অলরাইট। লেট’স হ্যাভ আ পার্টি টুমরো। লাস্ট টোয়েন্টি মান্থস আমরা যারা স্টিফেন ম্যানসনের আগুনের জন্য সাফার করেছি, তাদের জন্য এই পার্টি। ফাইভ স্টার হোটেলে। নামটাও বলে দিচ্ছি, সিলভার হোটেল।’

বাণীব্রত আঙ্কল বললেন, ‘কী বলছিস মা তুই? কত খরচ হবে জানিস?’ কড়া চোখে ঈশিতা তাকিয়ে আছে দেখে উনি আমতা আমতা করে কথাটা শেষ করলেন, ‘যা ভাল বুঝিস, কর।’

সিলভার হোটেলে নামটা শুনে দেব একটু দমে গেল। ওখানে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আনন্দী ম্যাডামকে নিয়ে বিচ্ছিরি সব স্মৃতি। সেগুলো মনে পড়লে ওর কষ্ট কমবে না, বরং বাড়বে। তা ছাড়া, ইদানীং তমাল আর কোয়েলের কথাও ওর খুব মনে পড়ছে। দেব বলল, ‘ভেন্যুটা অন্য কোথাও করা যায় না ঈশিতা?’

ঈশিতা বলল, ‘কেন পারা যাবে না? কিন্তু সিলভার হোটেলে গেলে তুমি তোমার এক বন্ধুর দেখা পাবে। কিচেনের চিফ শ্যেফ তমাল। আমি জানি, তুমি ওর রান্না খুব পছন্দ করো।’

‘কী বলছিস তুই!! তমাল এখনও ওখানে আছে?’

‘ছিল না। এই মাসখানেক হল, ফের জয়েন করেছে। সিলভার হোটেলের কথা আরও ভাবলাম এই কারণে, কাল ওখানে তোমাকে নতুন একটা জিম অফিসিয়ালি উদ্বোধন করতে হবে। জিম-এর মালিকের সঙ্গে আজই আলাপ হল। তোমাকে চিনি জেনে, উনি চিফ গেস্ট হিসেবে তোমাকে চাইছেন। অনেক রিকোয়েস্ট করেছেন উনি দেবদা। প্লিজ, তুমি রাজি হয়ে যাও।’

শুনে শিখিন আঙ্কল বললেন, ‘এ তো দারুণ খবর। দেবভাই, তুমি না কোরো না। চলো, গিয়ে দেখে আসি, নতুন জিমটা কেমন? যদি পছন্দ হয়ে যায়, তা হলে আমরাও রেগুলার যেতে পারি।’

ঈশিতা বলল, ‘ভাইয়া এদিকে আয়। পার্টিতে কাদের ডাকব, লিস্টটা তৈরি করে ফেলি।’

দেবও গিয়ে ওদের পাশে বসে বলল, ‘মেন্যুটা তমালের উপর ছেড়ে দিও ঈশিতা।’

ওদের উৎসাহ দেখে ঘরের সবাই মজা পাচ্ছে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে লিস্ট তৈরি করে, হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঈশিতা বলল, ‘এই রে, প্রায় ন’টা বাজে। এখুনি আমাকে বাড়ি যেতে হবে। মালদ্বীপ থেকে আমাদের এক সিনিয়র রিপোর্টার মউদি আমায় ফোন করবে। এখানকার সব খবর ওকে দিতে হবে। আমি চলি গো। গুডনাইট এভরিবডি।’

…মিনিট দশেকের সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর দেব বারান্দায় গিয়ে বসল। শিখিনদা ড্রয়িংরুমে বসে কী যেন পড়ছেন। রাখীদিদিভাই ব্যস্ত কিচেনে। রাত ন’টা বাজে, ডিনারের সময় হয়ে গেছে। আজ দিনটা দেবের শুরু হয়েছিল খুব বিচ্ছিরিভাবে। কিন্তু শেষ হল অনেকগুলো সুখবর জেনে। সবথেকে ভাল লাগছে, শিখিনদার ডিজি হওয়ার কথা শুনে। দমকলের অনেক কিছু এবার বদলে দেবেন উনি। মানুষটার আত্মবিশ্বাস দেখে একেক সময় অবাক হয় দেব। ওর মনে আছে, শিখিনদা একদিন বলেছিলেন, ‘চেঞ্জ ইজ নেভার পেইনফুল দেবভাই, ওনলি দ্য রেজিস্ট্যান্স টু চেঞ্জ ইজ পেইনফুল।’ বদল আনতে গিয়েই গত কুড়ি মাস বেচারিকে এত যন্ত্রণা পোহাতে হল।

‘কী ভাবছ, ভাই।’ রাখী দিদিভাইয়ের গলা শুনে দেব পাশ ফিরে তাকাল।

‘কী ভাবব, সেটাই গুলিয়ে গেছে দিদিভাই। আমার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। একবার ভাবছি, চণ্ডীতলায় ফিরে যাই। কিন্তু মা নেই, কার কাছে যাবো? আরেকবার ভাবছি, ক’দ্দিন আর তোমাদের বোঝা হয়ে থাকব? আমার জন্য শিখিনদার কত টাকা খরচা হয়ে গেছে, বলো তো? সে সব শোধ না করে আমাকে কি চলে যাওয়া উচিত? এখন ভাবছি, দু’একদিনের মধ্যে দেশে গিয়ে আমার যা আছে, সব বিক্রি করে দিয়ে আসব। তোমাদের কিছুটা ঋণ তো অন্তত কমানো যাবে।’

‘এ সব চিন্তা কখনও মাথায় এনো না দেব।’ রাখীদিদিভাই মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাই, সিলভার হোটেলে তুমি যেতে চাইছিলে না কেন গো?’

দেব বলল, ‘মনটা খুঁতখুঁত করছে। যদি মিলেনার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তা হলে? জানো, দুপুরে তোমাদের একটা কথা বলিনি। পার্ক স্ট্রিট থেকে যখন আজ আমি ট্যাক্সিতে উঠছি, তখন প্রান্তিক বলে একটা ছেলে আমাকে মিলেনার কথা খুব বলছিল। আমাকে মিলেনার কাছে নিয়ে যেতে চাইছিল। ভয়ে আমি পালিয়ে এসেছি।’

‘তুমি কি জানো, শাড়িতে আগুন লাগার পর মিলেনার কী হয়েছিল?’

‘না, কেউ তো আমাকে বলেনি।’

‘প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। তোমার শিখিনদা ওর খোঁজ নিতে গেছিল। স্কুলের ডরোথি আন্টি তখন বলেন, মিলেনা লন্ডনের এক হাসপাতালে। প্রায় একটা বছর ওকে ট্রিটমেন্ট করাতে হয়েছিল। ওর শরীরের কয়েকটা জায়গায় প্লাস্টিক সার্জারিও হয়েছে। মাস ছয়েক আগে মিলেনা কলকাতায় ফিরে এসেছে। আজ ঈশিতার মুখে শুনলাম, তারপর থেকে ও না কি শুধু তোমাকেই খুঁজছে। ওকে ভয় পেয়ে তুমি আজ পালিয়ে এলে কেন ভাই?’

শুনে কয়েক সেকেন্ড রাখী দিদিভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল দেব। তারপর সত্যি কথাটা বলে ফেলল, ‘অ্যাদ্দিন ভাবতে ভয় পেতাম, হয়তো কেউ এসে বলবে, মিলেনা বেঁচে নেই। কিন্তু ও বেঁচে আছে শোনার পর দুপুর থেকে অন্য একটা ভয় মনের কুঠুরিতে ঢুকেছে দিদিভাই। আমি জানি, মিলেনা আমাকে খুব ভালবাসে। আমার জন্য বাবা-মা, ধনসম্পত্তি, ধর্ম সবই ও ত্যাগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তো আর তখনকার মতো নেই। আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি বুঝে গেছি, আগের মতো সুস্থ হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পুরনো একটা সম্পর্কের জের টেনে কেন আমি অত সুন্দর একটা মেয়ের জীবন বরবাদ করব, বলো তো?’ কথাগুলো বলার সময় দেবের গলা ভারী হয়ে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *