স্টিফেন ম্যানসন – ৫৫

(পঞ্চান্ন)

নীচ থেকে পুলিশের গাড়ির হুটারের শব্দ ভেসে আসছে। দমকলের গাড়ির ঢং ঢং শব্দও। অন্যদিন, এই শব্দগুলো বুক কাঁপিয়ে দিত না। কিন্তু আজ বুকের ভিতরটা ধড়াস ধড়াস করছে মিলেনার। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসার সময় কী ভেবে ও রাধা-কৃষ্ণের মূর্তিটা হাতে তুলে নিল। মন্দিরের আচার্যদেব একদিন বলেছিলেন, ‘এক হাতে কর্ম কোরো, অন্য হাতে ঈশ্বরকে আঁকড়ে ধোরো। কর্ম হয়ে গেলে দু’হাতে ঈশ্বরকে চেপে ধরবে।’ শ্রীকৃষ্ণাই তো ওর কাছে ঈশ্বর। দেব ওর অন্য হাত ধরে টানল সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নীচে নেমে যাবে বলে। এমন সময় নিয়োগী আন্টির ছেলের ফোন পেল মিলেনা। করিডরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ও জিজ্ঞেস করল, ‘বলুন।’

এ প্রান্ত থেকে উৎকণ্ঠাভরা গলা, ‘মিলেনা, আপনারা কি বেরিয়ে এসেছেন?’

মিলেনা বলল, ‘এই নীচে নামছি। ফ্ল্যাটের দরজা জানলা বন্ধ ছিল। আগুন লেগেছে, আমরা টের পাইনি। ফোন করলেন কেন, বলুন?’

মি. নিয়োগী বললেন, ‘প্লিজ, নীচে নামার সময় আমাদের ফ্ল্যাটে কি একটা উঁকি মারবেন? মায়ের কোনও খোঁজ পাচ্ছি না। বেলা একটার সময় মায়ের বেরিয়ে আসার কথা ছিল। ওঁর বাগডোগরার ফ্লাইট ধরার কথা। এয়ারপোর্টে জেট অফিসে ফোন করে জানলাম, মা প্লেনে ওঠেননি। বার দশেক ফোন করেছি, অথচ ওকে পাচ্ছি না। ভয় লাগছে, উনি ফ্ল্যাটে আটকা পড়লেন কি না?’

পাশ ফিরে তাকিয়ে মিলেনা দেখল, দেবদূতও দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওকেও কেউ ফোন করেছে। পোষা অ্যালসেশিয়ান ডলি সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নেমে যাচ্ছে, আবার ডাকতে ডাকতে উঠে আসছে। বিপদ সবথেকে আগে টের পায় জন্তুরা। ডলি ওর শাড়ির আঁচল কামড়ে ধরে টানছে। নীচের দিকে যেতে ইঙ্গিত করছে। ওকে সামলানোর ফাঁকে মিলেনা বলল, ‘মি. নিয়োগী, আমি দেখছি, আন্টি ফ্ল্যাটে আছেন কি না। আমাদের ব্লকে কিন্তু আগুন পৌঁছয়নি। তবে স্মোক আছে।’

‘জানি। আমি এখন মিডলটন রো-তে দাঁড়িয়ে। পুলিশ ব্যারিকেড করে আছে। আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। আপনি নীচে নামার সময় যতজনকে পারুন, ডেকে নামান। আমাদের ফ্লোরে একজন ক্যান্সার পেসেন্ট আছেন। একাই থাকেন। মিসেস বাসন্তী সেন। ফাইভ জিরো থ্রি-তে। ভদ্রমহিলা একটা সময় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের পাইলট ছিলেন। পারলে ওর ফ্ল্যাটে একবার নক করবেন।’

ফোনে কথা শেষ করে দেব ফের হাত ধরে টান দিল। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ও বলল, ‘অনিরুদ্ধ ফোন করেছিল। তোমাদের এই ব্লকের মেজেনাইন ফ্লোর না কি পুরো ছাই হয়ে গেছে। ও বলল, বাতাসের ডিরেকশন বদলে গেছে। খুব শিগগির আগুন এই ব্লকের উপরের দিকে উঠবে। আমরা যেন সময় নষ্ট না করে, নীচে নেমে যাই।’

পাঁচতলায় নেমে মিলেনা বলল, ‘এক সেকেন্ড দাঁড়াও দেবদূত। দুটো ফ্ল্যাটে নক করতে হবে। বয়স্ক মানুষ, একবার দেখে যাই, ওরা আছেন কি না?’

করিডর দিয়ে খানিকটা হেঁটে নিয়োগী আন্টির ফ্ল্যাটের সামনে মিলেনা দেখল, দরজা খোলা। একটা ইয়াং ছেলে ঘরের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে। আগে কখনও তাকে দেখেনি। মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘আন্টি কোথায়?’

ছেলেটা বলল, ‘নীচে চলে গেছেন।’

‘তুমি কে, এখানে কী করছ? আগে তো কখনও তোমাকে দেখিনি?’

‘আমরা আন্টির ফ্ল্যাট পাহারা দিচ্ছি।’

শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মিলেনা। এ বার ফাইভ জিরো থ্রি-তে একবার খোঁজ করেই ওরা দু’জন নীচে নেমে যাবে। ধোঁয়ার কটু গন্ধ নাকে এসে ঢুকছে। করিডরের শেষ প্রান্তে দু’নম্বর ব্লকের দিকটায় কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। ফ্ল্যাটের নম্বরগুলো পিতলের চাকতির উপর লেখা। হালকা ধোঁয়াচ্ছন্ন বলে নম্বর বোঝা যাচ্ছে না। দেব দু’পাশের দরজাগুলোতে ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘ভিতরে কেউ আছেন? ইজ এনিবডি ইনসাইড। প্লিজ কাম আউট।’

একটা দুটো করে দরজা খুলে যাচ্ছে। ভীত, সন্ত্রস্ত মুখগুলো একে একে বেরিয়ে আসছে। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই কাশতে শুরু করেছেন। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে দেবদূত বলল, ‘মিসেস বাসন্তী সেন কোন ফ্ল্যাটে থাকেন, কেউ জানেন?’

একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমি জানি। এই যে উল্টোদিকের এই ফ্ল্যাটে। উনি বাড়ি থেকে বেরোন না। মায়া বলে একজন আয়া ওর দেখাশুনো করে।’

ফাইভ জিরো থ্রি-তে ধাক্কা দিতে লাগল দেবদূত। কিন্তু দরজা খুলছে না। সম্ভবত কেউ বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। ভিতর থেকে ক্ষীণ গলা ভেসে এল, ‘হু ইজ ইট?’

আর অপেক্ষা করল না দেবদূত। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে ও ধাক্কা দিতে লাগল। বার্মিজ কাঠের পাল্লা দরজার। ভাঙা খুব কঠিন। কিন্তু দেবদূতের গায়ে অসুরের শক্তি। বার পাঁচ-ছয়েক ধাক্কা মেরে দরজাটা ও ভেঙে ফেলল। ভিতরে ঢুকে ওরা দেখল, লিভিং রুমের সোফায় বসে আছেন শীর্ণকায় এক মহিলা। দেখেই মনে হয়, অসুস্থ। ওদের দেখে বললেন, ‘আমাকে একটু বেডরুমে পৌঁছে দেবে। শরীরটা ভাল লাগছে না। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।’

প্রতিবেশীদের সবাই ফাইভ জিরো থ্রি-তে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাদেরই মধ্যে কেউ একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘মায়া কোথায় মিসেস সেন? তাকে তো দেখছি না?’

‘কী জানি? ঘণ্টাখানেক আগে একটা ব্যাগ হাতে করে নীচে নেমে গেল। আমি বারণ করা সত্ত্বেও, শুনল না।’ শুনে দেবদূতের দিকে তাকাল মিলেনা। মানুষ এমন নিষ্ঠুর হতে পারে? আগুন লেগেছে জানতে পেরে, মায়া বোধহয় বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে পালিয়েছে। হয়তো যাওয়ার আগে টাকাপয়সা, অর্নামেন্টস নিয়ে গেছে। বেডরুমে ঢুকে মিলেনা দেখল, ওর আন্দাজই ঠিক। আলমারির পাল্লা খোলা, লকারও। মাই গুডনেস, ওরা খোঁজ করতে না এলে হয়তো অসহায় এই মহিলা দমবন্ধ হয়ে বা আগুনে পুড়ে মরতেন। লিভিং রুমে বেরিয়ে এসে মিলেনা বলল, ‘মিসেস সেন, মায়া হ্যাড স্টোলেন এভরিথিং। পরে ওর ব্যবস্থা করব। আপনি কি হেঁটে নীচে নামতে পারবেন?’

শুনে প্রতিবেশীদের মুখ থেকে সমস্বরে বিস্ময়সূচক আওয়াজ বেরিয়ে এল। কিন্তু মিসেস সেনের মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখতে পেল না মিলেনা। উনি কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে থেকে তার পর ধীরে ধীরে বললেন, ‘তুমি এরিকের মেয়ে না? তোমাকে আমি চিনি। আমাকে নীচে নামতে বলছ কেন মা?’

কারণটা মিলেনা বলতে চাইছিল না। মিসেস সেন অযথা আতঙ্কে ভুগবেন। কিন্তু প্রতিবেশীদের একজন বলে উঠলেন, ‘বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে বাসন্তী। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো।’

শুনেও বোধহীন চোখে তাকিয়ে রইলেন মিসেস সেন। তারপর যা বললেন, শুনে চমকে উঠল মিলেনা। ‘অ্যায়াম নট গোয়িং এনিহোয়ার ডিয়ার। এই ফ্ল্যাট ছেড়ে কোত্থাও যাবো না। এই ফ্ল্যাটে আার হাসবেন্ডের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পুড়ে মরলে, এখানেই মরব। এমনিতেই পা বাড়িয়ে আছি। পুড়তে তো একদিন হবেই। কয়েকটা দিন আগে অথবা পরে।’

দেবদূত এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘কিন্তু আমরা আপনাকে ফেলে রেখে যাবো না আন্টি।’ বলেই ও কোলে তুলে নিল মিসেস সেনকে। ‘চলো মিলেনা, আর দেরি করা ঠিক হবে না। সবাইকে নিয়ে তুমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকো। আমি দেখি লিফটে করে আন্টিকে নামাতে পারি কি না?’

সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ নেমেই মিলেনা অবাক হয়ে গেল। চারতলার কলাপসিবল গেটে কেউ তালা দিয়ে রেখেছে। লিফটের পাশেই প্রতিটা ফ্লোরের ওঠা-নামার সিঁড়ি। সেখানে যে কলাপসিবল গেট আছে, মিলেনা কোনওদিন লক্ষ্য করেনি। কেননা, সিঁড়ি দিয়ে যাতায়াত করার কোনওদিন দরকারই হয়নি। চারতলার গেট বন্ধ দেখে আতঙ্কে ওর পা কাঁপতে লাগল। ধোঁয়ার পরিমাণ বাড়ছে। খুব বেশিক্ষণ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। হঠাৎ ওর চোখে পড়ল, কলাপসিবল গেটে ও পাশে করিডর দিয়ে কেউ হেঁটে আসছে। তার মুখে মাস্ক, হাতে একটা সুটকেশ। ওকে দেখেই ডলি ঘেউঘেউ করতে লাগল। ছুটে নেমে গিয়ে মিলেনা বলল, ‘গেটে কে তালা দিয়েছে? খুলে দাও।’

অল্পবয়সি একটা ছেলে। খুব রুক্ষ গলায় বলল, ‘তালা খোলা যাবে না। পুলিশ মানা করে দিয়েছে।’

‘আমরা নামব কী করে? দেখছ না, বয়স্ক লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।’

‘তা হলে ছাদে চলে যান।’ কথাগুলো বলে ছেলেটা আর দাঁড়াল না। নীচের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘হচ্ছেটা কী? এই ছেলেগুলো কারা? আজ প্রায় তিরিশ বছর এই বিল্ডিংয়ে আছি। কলাপসিবল গেট কখনও বন্ধ হতে দেখিনি।’ অসন্তোষ আর হতাশা মেশানো গলা। এই ভদ্রলোককে মিটিংয়ের দিন মিলেনা বলতে শুনেছিল, লিফট সারাইয়ের জন্য একটা পয়সাও তিনি দেবেন না। নিয়োগী আন্টির ছেলের সঙ্গে সেদিন উনি তর্কাতর্কি করছিলেন। এখন অবশ্য কাউকে দোষারোপ করার সময় না। কয়েকজন সিঁড়ির উপরই বসে পড়েছেন। একটা বাচ্চা মেয়ে মাম্মি, মাম্মি বলে কেঁদে উঠল। তালাটা এখুনি ভেঙে ফেলতে হবে। না হলে এতগুলো লোককে বাঁচানো যাবে না। নীচ থেকে মিলেনা হাঁক পারল, ‘দেবদূত, এখানে এসো। তালা ভাঙতে হবে।’

ঠিক সেই মুহূর্তেই লিফট ওঠার ঘরঘর শব্দ শুনতে পেল মিলেনা। ওর বুকের ভিতরটা চলকে উঠল। যাক, তা হলে লিফট চালু আছে! এতক্ষণ মনেই পড়েনি লিফটের কথা। ও দেখতে পেল, চারতলা দিয়ে লিফট উপরে উঠতে গিয়ে মাঝপথে হঠাৎ থেমে গেল। সিঁড়ি থেকে লিফটের ভিতরটা দেখা যাচ্ছে। মিলেনা দেখল, দুটো বডি হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বেঁচে নেই। ভয়াবহ ওই দৃশ্য দেখে কেউ একজন ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সবাই তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাচ্ছিলেন। হতাশ হয়ে ফের সিঁড়ির উপর বসে পড়লেন।

তখনই ফের ফোন বাজার আওয়াজ শুনতে পেল মিলেনা। ও প্রান্তে শান্তা আন্টির গলা, ‘তুমি এখন কোথায় মিলেনা? তুমি কি নেমে এসেছ?’

মিলেনা বলল, ‘না আন্টি। চারতলার সিঁড়িতে আটকা পড়ে আছি। কলাপসিবল গেটে কেউ তালা লাগিয়ে দিয়েছে।’

‘হরিবল। তোমার কাজের মেয়ে নাজমা বলল, দেবদূত না কি তোমার সঙ্গে আছে? ওকে তালা ভেঙে ফেলতে বলো।’

‘নাজমার সঙ্গে আপনার কোথায় দেখা হল আন্টি?’

‘আমি এখন পার্ক স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে আছি। এখানেই ওর সঙ্গে দেখা হল। তোমার জন্য মারাত্মক টেনশন হচ্ছে মা। তোমাকে দেখে তবে আমি স্কুলে ফিরে যাব।’ নাজমার কথা এতক্ষণ মনেই ছিল না মিলেনার। নীচে কিছু একটা ঘটেছে, কথাটা ও-ই প্রথম বলেছিল। এও বলেছিল, কী হয়েছে, নীচে নেমে দেখে আসবে কি না? তার মানে এক ফাঁকে নাজমা নীচে নেমে এসেছিল। তারপর আর ফিরে যেতে পারেনি। মিলেনা বলল, ‘হ্যাঁ আন্টি, দেবদূত আমার সঙ্গে আছে। আপনি ফোনটা একবার নাজমাকে দিন। আমি কথা বলি।’

নাজমা ফোনটা ধরতেই মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘তুই যখন নীচে নেমে গেলি, তখন কি সিঁড়িতে তালা লাগানো ছিল?’

‘না দিদি। নীচের তলায় আগুন দেখে তোমাদের বলার জন্য আমি যখন উপরে উঠছিলাম, তখন রিয়াজরা আমাকে আটকে দিল। ওদের দলের ছেলেরা সবাই বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়েছে। ফাঁকা ফ্ল্যাটে ঢুকে লুঠপাট করছে। আমাকে ধাক্কা মারতে মারতে ওরা নীচে নামিয়ে দিল। মনে হয়, ওরাই তালা লাগিয়ে দিয়েছে।’

‘তখনই আমাদের ফোন করলি না কেন?’

‘ফোনটা ঘরে ফেলে এসেছিলাম।’ বলতে বলতে নাজমা কেঁদে ফেলল, ‘তোমরা এখন কী করে বেরোবে দিদি? দাদাকে বলো, গায়ের জোরে তালা ভাঙতে।’

মনের জোর হারিয়ে ফেললে চলবে না। নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ঢুকে যাচ্ছে। কাশতে কাশতে মিলেনা বলল, ‘চিন্তা করিস না। শ্রীকৃষ্ণা সঙ্গে আছেন, উনি আমাদের বাঁচাবেন। আর শোন, নিয়োগী আন্টির ছেলের সঙ্গে দেখা হলে বলবি, উনি ফ্ল্যাটে নেই।’ প্রবল কাশিতে বাকি কথা মিলেনা শেষ করতে পারল না।

‘তাড়াতাড়ি নেমে এসো দিদি। আমার খুব ভয় করছে। আগুন চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। বাইরে থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি।’

‘আমরা আসছি।’ বলে লাইন কেটে দিল মিলেনা। রাধা-কৃষ্ণের মূর্তিটা ও বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। আগুনে বাড়িতে হিট বেড়ে গেছে। গরমে দরদর করে ও ঘামছে। সবাইকে নিয়ে মিলেনা পাঁচতলায় উঠে এসে দেখল, আরও তিন-চারজন দেবদূতের পাশে জড়ো হয়েছে। ওর পরনের টি শার্ট ঘামে ভিজে গেছে। মিসেস সেনকে কোল থেকে নামিয়ে, সিঁড়িতে বসিয়ে দিয়ে দেবদূত বলল, ‘কেউ একজন হাতুড়ি বা শাবল এনে দিন। তালাটা ভাঙার জন্য দরকার।’

একটা ইয়াং মেয়ে বলল, ‘আমাদের ফ্ল্যাটে আছে। এনে দিচ্ছি।’

মেয়েটা হাতুড়ি আনতে গেছে। সেইসময় ফোনটা আবার বেজে উঠল মিলেনার। এবার ইরেভেন থেকে ড্যাডির ভিডিয়ো কল দেখে ও চমকে উঠল। অত দূরে আছেন, উনি জানলেন কী করে? বোধহয় অফিস থেকে ফোন করেছেন। উদ্বেগভরা গলায় উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়ার আর ইউ ডিয়ার?’

মিলেনা বলল, ‘স্টিফেন ম্যানসন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনি খবরটা পেলেন কী করে?’

‘একটু আগে কলকাতা থেকে তোমার শান্তা আন্টি আমাকে ফোন করেছিলেন। ওর মুখেই শুনলাম, স্টিফেন ম্যানসনে আগুন লেগেছে।’

‘শান্তা আন্টি আমাকেও বার দুয়েক ফোন করেছিলেন। আপনি ওঁকে চিনলেন কী করে?’

ও প্রান্তে চুপ করে ড্যাডি তাকিয়ে আছেন। কী উত্তর দেবেন বোধহয় ভেবে পাচ্ছেন না। মিলেনা ফের জিজ্ঞেস করল, ‘শান্তা আন্টি কি কখনও দার্জিলিংয়ে ছিলেন ড্যাডি? অ্যালবামের একটা ছবিতে আজই দেখলাম, আমাকে কোলে নিয়ে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। পাশেই শান্তা আন্টি। এখানে উনি কিন্তু কখনও বলেননি, আপনাকে চেনেন।’

ড্যাডি বললেন, ‘তুমি হয়তো কাল মাম্মির মুখে খানিকটা শুনেছ। ছবিটাও তোমার চোখে পড়েছে। তাই তোমাকে লুকিয়ে লাভ নেই। ওই শান্তা আন্টিই তোমার আসল মা। দার্জিলিংয়ে কথাটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর গোপনে ওকে আমি কলকাতায় পাঠিয়ে দিই। ওর অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা সত্যি নয়।’

শুনে শান্তা আন্টির মুখটা মিলেনার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ধপ করে ও বসে পড়ল সিঁড়িতে।

(ছাপ্পান্ন)

রেস্টুরেন্টের মধ্যে কন্ট্রোল রুমে বসে শিখিন বার দুয়েক ফোন পেয়েছেন দেবের। এক নম্বর ব্লকের চারতলায় ওরা কয়েকজন আটকা পড়েছে। কেউ না কি তালা দিয়ে রেখেছে কলাপসিবল গেটে। ওই দিককার লিফটের ভিতর দুটো ডেডবডির কথাও তখন ও বলেছিল। এই পরিস্থিতিতে কাউকে নামিয়ে আনার জন্য উঁচু ল্যাডার খুব কাজ দেয়। কলকাতায় দমকলের একটাই মাত্র সত্তর ফুট লম্বা ল্যাডার আছে। সেটা রাখা আছে বেহালার শীলপাড়ায় দমকলের ট্রেনিং সেন্টারে। প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে সেখানে শিখিন ফোন করেছিলেন। তখন জানতে পারেন, ল্যাডারটা ডায়মন্ডহারবার রোড দিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। এখনও কেন পৌঁছল না, জানার জন্য ফের কন্ট্রোল রুমে ফোন করলেন শিখিন।

ডিউটি অফিসার বললেন, ‘স্যার, ল্যাডার এখন ভবানীপুরে আটকে রয়েছে। নিউ আলিপুরেও মারাত্মক ট্রাফিক জ্যাম ছিল।’

শুনে বিরক্ত হলেন শিখিন। পরক্ষণেই তাঁর মনে পড়ল, মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়ার পর ট্রাফিক নিউ আলিপুরের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যানজট হলেও হতে পারে। পুলিশের উচিত ছিল, হুটার গাড়ি দিয়ে ল্যাডারটাকে পার্ক স্ট্রিটে নিয়ে আসা। আরেকটা সমস্যাও আছে। শহরের প্রতিটা রাস্তায় এত ধরনের ওভারহেড তার, উঁচু ল্যাডার নিয়ে আসা বেশ কঠিন। ল্যাডারটা অবশ্য ভাঁজ করা যায়। তবুও মেট্রো রেলের ব্রিজ বা রেল ব্রিজের কোথাও আটকে যেতে পারে। এর আগে মাত্র একবারই দৈত্যাকৃতির ল্যাডারটা শীলপাড়া থেকে বেরিয়েছে। সেটা আমরি হাসপাতালে আগুন লাগার পর। তাই ড্রাইভাররা জানে, কোন রাস্তা দিয়ে আসতে হবে। শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কতক্ষণ লাগতে পারে?’

অফিসার বললেন, ‘হিসেব মতো মিনিট দশেকের বেশি নয় স্যার। ওরা জানতে চাইছিল, ল্যাডারটা কোনদিকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাবে? পার্ক স্ট্রিটের দিকে, না মিডলটন রো-তে।’

দেবরা রয়েছে মিডলটন রো-র দিকে। কিন্তু বিল্ডিংয়ে ঢোকার জন্য ওই দিকে কংক্রিটের তোরণ ভাঙতে হবে। না হলে ড্রাইভ ওয়ে দিয়ে এক নম্বর ব্লকের কাছে ল্যাডার নিয়ে যাওয়া যাবে না। এই দিকটায় সারি সারি নারকেল গাছ আছে। রেসকিউর কাজে সেটাও বাধা হতে পারে। আগে ল্যাডার আসুক, তখন ভাবা যাবে। শিখিন তাই বললেন, ‘মিডলটন রো-র দিকে।’

লবি কন্ট্রোল রুম থেকে ফায়ার অ্যাটাক টিমকে ডিরেকশন দিচ্ছে অসীম। কম্পিউটারের পর্দায় ওর চোখ। কাছে গিয়ে শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘অনিমেষদা কী বলছে?’

‘ব্যাড নিউজ। জ্বলন্ত কড়িকাঠ ওঁর পিঠে পড়েছে। ওকে নিয়ে আসছে দু’জন ফায়ার অপারেটার।’

একশো সোয়াশো বছর আগেকার বিল্ডিং। তখন কড়িকাঠ ব্যবহার করা হত। তাতে যদি আগুন ধরে যায়, তা হলে উপরের ফ্লোরের মেঝে যে কোনও সময় ধসে পড়তে পারে। এমনিতে ফায়ার ফাইটাররা যথেষ্ট প্রস্তুত হয়েই আগুনের মাঝে ঢোকে। কেউ পুড়ে মারা গেছে, এমন ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। কিন্তু মিসহ্যাপ হতেই পারে। শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইনজুরি কী রকম?’

‘অনিমেষদার বয়স হয়ে গেছে। রিফ্লেকশন কমে গেছে। ওঁকে অ্যাটাক টিমে না পাঠালেই পারতি শিখিন। ড্রোন পাঠিয়েছি, এই দ্যাখ তার ছবি।’

আগুনের উৎস খোঁজার জন ড্রোন ভাল কাজ দেয়। ফায়ার অপারেটাররা যে সব জায়গায় ঢুকতে পারে না, সেখানকার ছবি ড্রোন পাঠিয়ে দিতে পারে। কম্পিউটারের পর্দায় শিখিন দেখলেন, অনিমেষদাকে ধরাধরি করে বের করে আনা হচ্ছে। কিন্তু উনি আসতে চাইছেন না। আরে, এটাই তো ফাইটিং স্পিরিট। আমার যা-ই হোক, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসব না। মিনিট পনেরো আগেই শিখিন কথা বলছেন এই জেদি মানুষটার সঙ্গে। অনিমেষদা তখন বললেন, আগুনের সোর্স না কি ওরা খুঁজে পেয়েছেন। অ্যাটাক টিমের প্রথমে ধারণা হয়েছিল, শর্ট সার্কিট থেকে আগুন। একে তো মিটার রুমগুলো একেবারে লিফটের গায়ে। তার উপর ইলেকট্রিকের তার কনসিল করা ছিল না। পুরনো আমলের বড় বাড়িতে আগুন নেভানোর অভিজ্ঞতা অনিমেষদার আছে। ডালহৌসীতে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের আগুন নিভিয়েছেন। অনেক সময় হয় কী, এই সব পুরনো বাড়িতে দিনের পর দিন অফিসের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বরাদ্দের থেকে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়। তখনই শর্ট সার্কিট হয়। এই থিয়োরিটা স্টিফেন ম্যানসনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অনিমেষদার প্রাথমিক আন্দাজটা তখন ভুল বলে মনে হয়নি।

কিন্তু অনিমেষদা খানিক আগে একটু অন্যরকম কথা বললেন। বিল্ডিংয়ের কয়েকটা জায়গায় ওঁরা পেট্রোলের গন্ধ পেয়েছেন। শুধুমাত্র একটা জায়গা থেকে আগুন ছড়ায়নি। একসঙ্গে দু’তিনটে ফ্লোরের কাছাকাছি জায়গায় আগুন লেগেছিল। না হলে এত দ্রুত এতগুলো ফ্লোর এফেক্টেড হত না। যদি অনিমেষদার ধারণাই ঠিক হয়, তা হলে সাবোতাজ ধরে এগোতে হবে। স্টিফেন ম্যানসনের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী শিখিন জানেন। কারা এই দুষ্কর্মটি করতে পারে, রাখীর মুখে অনেকটাই শুনেছেন। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করেও ওঁরা এখনও আগুন নেভাতে পারেননি। অন্তত, পঁচিশ থেকে তিরিশজন ফায়ার অপারেটর এখন বিল্ডিংয়ের ভিতর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আটটা ইঞ্জিন হাজির, গোটা ছয়েক ওয়াটার ক্যারিয়ার। কর্পোরেশনের পাম্পিং স্টেশন থেকে জল এনে দিচ্ছে। একেকটাতে হাজার গ্যালন করে জল ভরা যায়।

বাইরে থেকে ফায়ার সার্ভিসের যেসব কর্মীরা আসছে, তাদের মুখে শিখিন শুনেছেন, কয়েক হাজার মানুষ না কি জড়ো হয়ে গেছে স্টিফেন ম্যানসনের রাস্তায়। টিভিতে বলেছে, বেশ কিছু লোক পুড়ে মারা গেছে। লোকদের ক্ষোভ, দমকল কেন সঙ্গে সঙ্গে আসেনি? সেই পুরনো খেল! দমকলের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলা। শুনে রাগই হচ্ছে শিখিনের। প্রচুর লোক মারা গেছে, এই খবরটা মিডিয়া পেল কোথায়? টিভিতে না কি এমনও বলেছে, লোকাল ছেলেরা রেসকিউর কাজে নেমে না পড়লে, আরও অনেক রেসিডেন্ট মারা যেতেন। বুলশিট! এর পর অনিরুদ্ধ এসে জানাল, পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। পুরো বাড়ির কন্ট্রোল রুস্তমের ছেলেদের হাতে। আগুন দেখতে কলকাতার মেয়র, দমকল মন্ত্রী আর রুলিং পার্টির বড় নেতারা এসে হাজির হয়েছেন। মিডিয়ায় একেকজন এক এক রকম মন্তব্য করে যাচ্ছেন।

রেস্টুরেন্টের কন্ট্রোল রুম থেকেই শিখিন একজনকে বাইরে পাঠালেন। এখুনি গেটের কংক্রিটের তোরণ ভেঙে ফেলতে হবে। না হলে উঁচু ল্যাডার ঢোকানো যাবে না। পাঁচ-ছ’জন অফিসার ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়েছেন। ভিতর থেকে ড্রোন যে ছবি পাঠাচ্ছে, একেকজন সেটা মনিটর করছেন। অনিরুদ্ধ এসে খবর দিল, পাঁচতলার করিডরে দেব আর মিলেনাকে না কি এক ঝলক দেখা গেছে। দশ-বারোজনকে নিয়ে ওরা ওয়েট করছে। শিখিন বললেন, ‘দেবের সঙ্গে কথা বলেছিস?’

অনিরুদ্ধ বলল, ‘চেষ্টা করেছিলাম স্যার। কিন্তু দেবদা তখন কারও সঙ্গে কথা বলছিল।’

‘লাইনটা ধরে আমাকে দে। কথা বলব।’

অনিরুদ্ধ লাইন ধরার চেষ্টা করছে। হঠাৎ শিখিনের মনে পড়ল, আরে আজ রাতেই তো দেবের ব্যাঙ্কক রওনা হওয়ার কথা। কী কুক্ষণেই না ও স্টিফেন ম্যানসনে ঢুকেছিল। টানা ছয়মাস ধরে এত পরিশ্রম করল, বেরিয়ে আসতে না পারলে সব বৃথা হয়ে যাবে। দুর্ভাবনা তাড়া করতে লাগল শিখিনকে। আগুনে যদি কোনও ইনজুরি হয়, ছেলেটা তা হলে কম্পিটিশনে পার্টিসিপেটই করতে পারবে না। না, ল্যাডার এসে প্রথমেই ওকে রেসকিউ করতে হবে। কথাটা ভাবার মাঝেই অনিরুদ্ধ মোবাইল সেট এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার, দেবদা লাইনে রয়েছে। কথা বলুন।’

শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘একনম্বর লিফটের দিকে সিঁড়িটা এখনও সেফ। নেমে আসার চেষ্টা করো।’

দেব বলল, ‘ট্রাই করেছিলাম। কিন্তু চারতলার কলাপসিবল গেটে কেউ তালা দিয়ে রেখেছে। তালা ভাঙার সময় দু’তিনটে ছেলে পিস্তল দেখাল। বলল, তোকে বেরতে দেবো না। বাধ্য হয়ে পাঁচতলায় উঠে এসেছি।’ ‘ছেলেগুলো কারা, চেনো তাদের?’

‘অবভিয়াসলি রুস্তমের। ওদের মধ্যে একটা ছেলে থাকে এই বিল্ডিংয়েরই সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে। নাম মকবুল। কয়েকদিন আগে জিম-এর কাছে এই ছেলেটাও আমার উপর হামলা করতে গিয়েছিল। হিমাদ্রি ওকে ধরতে পারেনি সেদিন। আজ খুব তড়পাচ্ছিল।’

‘তালা ভাঙার ব্যবস্থা আমি করছি। ফায়ার ফাইটাররা কেউ একজন গিয়ে ভেঙে দেবে। তোমার সঙ্গে যাঁরা আছেন, তাঁরা কি সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারবেন?’

‘অনেকেই পারবেন না শিখিনদা। ধোঁয়ায় অনেকে কাবু হয়ে গেছেন। আমার সঙ্গে একজন বয়স্কা ক্যান্সার পেসেন্ট আছেন। রেসকিউ পার্টিকে বলুন, অন্তত তাঁর জন্য স্ট্রেচার নিয়ে আসতে।’

‘মিনিট দশেক ওদের চাঙা করে রাখো দেব। এর মধ্যে ল্যাডার এসে যাবে। তখন ওদের নামিয়ে আনব। আর তুমি যাতে ঠিক টাইমে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে পারো, তমালকে সেই ব্যবস্থা করে রাখতে বলছি।’

‘আর এয়ারপোর্ট!’ হতাশ গলায় দেব বলল, ‘আমার কপালে নেই শিখিনদা। মা কয়েকদিন আগে বলছিল, আগুনে না কি আমার ফাঁড়া আছে। দেখছি, মায়ের কথাই সত্যিই হয়ে গেল। কিন্তু তমালের সঙ্গে আপনার কোথায় দেখা হল শিখিনদা?’

‘তোমার আর কোয়েলের খোঁজে ও আমার কাছে এসেছিল। কোয়েলকে ও দুপুর থেকে খুঁজছে। অনিরুদ্ধ বলল, কোয়েল না কি বেলা এগারোটার সময় স্টিফেন ম্যানসনে এসেছিল। মিসেস ভাল্লার কাছে টাকা নিতে। তারপর থেকে ওর কোনও খোঁজ নেই। মিসেস ভাল্লার ফ্ল্যাটটা কোথায় তুমি জানো?’

‘জানি। মাত্তর একটা ফ্লোর উপরে। কিন্তু কোয়েলকে এত করে মানা করলাম, তবুও আমার কথা শুনল না!’

‘একবার উঠে গিয়ে দেখে আসবে দেব? ল্যাডার এলেই আমি তোমাকে ফোন করে দেবো। ততক্ষণ তোমরা সবাই কোনও একটা ঘরে জানলা-দরজা বন্ধ করে ওয়েট করো।’

‘তাড়াতাড়ি শিখিনদা। আমার জন্য ভাবছি না। আগে আমার সঙ্গীদের উদ্ধার করুন। বিল্ডিংয়ে সম্ভবত কারেন্ট নেই। ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে।’

পিছন থেকে কেউ একজন বললেন, ল্যাডার এসে গেছে। শিখিন আর কথা বাড়ালেন না। কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। মিডলটন রো এমনিতেই খুব চওড়া রাস্তা নয়। সার সার দমকলের লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাঝে সাদা অ্যাম্বুলেন্স। পুলিশের নীল গাড়ি। লোকজনকে পুলিশ দূরে পার্ক স্ট্রিটের দিকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। দু’পাশের দোকানগুলোর শাটার ফেলা। ঘণ্টা চারেক আগে শিখিন যখন এই বিল্ডিংয়ে ঢোকেন, তখন পরিস্থিতি ছিল একেবারে অন্যরকম। রেস্টুরেন্টের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে শিখিন দেখলেন, তোরণ ভাঙার কাজ চলছে। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের লিডার পিনাকী চট্টরাজকে চোখে পড়ল। ওরা যে এসে দাঁড়িয়ে আছেন, খবরটা কেউ দেয়নি।

সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমে শিখিন বললেন, ‘আপনারা কখন এসেছেন পিনাকীবাবু?’

‘অনেকক্ষণ। প্রায় আধঘণ্টা হবে। দাঁড়িয়ে রগড় দেখছি। পার্টির ছেলেরা ম্যানেজ করছে। নেতারা সব আসছেন। নানা উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আপনার মন্ত্রীকে তো দেখলাম, এসে পার্টির ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে চলে গেলেন। তাঁর সঙ্গে আপনার ডিজিও ছিলেন।’

শুনে মনের ভিতর কুডাক দিল শিখিনের। মন্ত্রী সুহাস চ্যাটার্জি এত কাছে এসেও একবার কন্ট্রোল রুমে এলেন না! অথচ আমরি হাসপাতালে আগুন লাগার পরে সারাটা দিন মন্ত্রী সঙ্গে থেকে দমকল কর্মীদের উৎসাহ দিয়েছিলেন। আরও অদ্ভুত ব্যাপার, ফায়ার সার্ভিসের ডিজি প্রেমচাঁদ তিওয়ারিও দেখা করে গেলেন না। উনি অবশ্য ফায়ার সার্ভিসের লোক নন। উনি আইপিএস। ওঁকে মাথার উপর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কী এমন হল, ওঁরা দু’জন বয়কট করলেন? এই নেগেটিভ চিন্তাটা মাথায় ঢুকতে দিলেন না শিখিন। কাম-হোয়াট-মে। বরেনদাদের কাছে তিনি শিখেছেন, কর্তব্য করে যেতে হবে। তখনই দেখলেন, উঁচু ল্যাডারটা সোজা পার্ক স্ট্রিটের দিকে চলে যাচ্ছে। শিখিন ড্রাইভারকে মানা করতে যাবেন, এমন সময় তাঁর হাত ধরে টানলেন পিনাকী চট্টরাজ, ‘যেতে দিন স্যার। আপনার কথা ওরা শুনবে না। একটু আগে দেখলাম, লোকাল নেতা রুস্তম আহমেদ চোটপাট করছিল ড্রাইভারের উপর। ল্যাডার আগে চার নম্বর ব্লকের লোকজন উদ্ধার করবে। তার পর এ দিকে আসবে।’

শুনে দাঁড়িয়ে পড়লেন শিখিন। মাই গুডনেস, তাই যদি হয়, দেবদের কাছে ঘণ্টা দুয়েকের আগে পৌঁছনো যাবে না। অথচ ওঁর ভরসায় ছেলেটা সবাইকে নিয়ে ওয়েট করে থাকবে। দেবকে কী বলবেন, শিখিন ভেবে পেলেন না। ওঁর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে পিনাকী চট্টরাজ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী প্রবলেম, আমায় বলুন তো স্যার। দেখি, আমি সলভ করতে পারি কি না?’

অল্প কথায় সব গুছিয়ে বললেন শিখিন। গুরুত্ব বোঝানোর জন্য শেষে বললেন, ‘ওদের মধ্যে একজন ক্যান্সার পেসেন্টও আছেন। তার জন্য একটা স্ট্রেচার নিয়ে যেতে হবে।’

‘অল রাইট। লিফট ছাড়া অন্য কোনওভাবে কি চারতলায় পৌঁছনো যাবে?’

চট করে রেস্টুরেন্টের ভিতর দিয়ে দোতলা যাওয়ার রাস্তাটা মনে পড়ল শিখিনের। তিনি বললেন, ‘যাবে। আপনাকে আমি দোতলা পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছি। তারপর করিডর ধরে সোজা পশ্চিম দিকে এগোলেই এক নম্বর লিফটের পাশে চারতলায় যাওয়ার সিঁড়ি পেয়ে যাবেন।’

‘দোতলায় চলুন তা হলে।’ চোখের ইশারায় গ্রুপের তিনটে ছেলেকে ডেকে নিলেন পিনাকী। একজনের কাঁধে একটা ভাঁজকরা স্ট্রেচার। দেবের ফোন নম্বরটা চেয়ে নিয়ে উনি বললেন, ‘আপনি কন্ট্রোল রুমে গিয়ে বসুন স্যার। আমরা মিনিট দশেকের মধ্যে নেমে আসছি।’

রেস্টুরেন্টের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে পিনাকীবাবুকে খানিকটা এগিয়ে দেওয়ার সময় শিখিন দেখলেন, ডান-বাঁ দু’পাশের সব ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। তার মানে প্রাণের মায়ায় সবাই তাড়াহুড়ো করে নীচে নেমে গেছেন। ফিরে আসছেন, এমন সময় ফোন বেজে উঠল। পর্দায় তিনি দেখলেন, রেখার নাম। তখনই রাখীর কথা মনে পড়ে গেল। অচেতন অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে ওকে তুলে দিয়েছিলেন। তারপর ফোন করে দেন বাণীব্রতকে। পরে রাখীর খোঁজ নেওয়ার সময় তিনি পাননি। ফলে জানতেও পারেননি, অ্যাম্বুলেন্স কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সোয়াইপ করে শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘রেখা তোরা কোথায়? রাখীর খোঁজ পেলি?’

উত্তরটা দিল বাণীব্রত, ‘আমরা এসএসকেএম-এ। রাখীর বেডের পাশেই দাঁড়িয়ে আছি।’

‘কেমন আছে ও এখন?’

‘চোখ খোলার পর থেকেই তোর কথা জিজ্ঞেস করছে। ওদিকের অবস্থা কী বুঝছিস?’

‘ভাল না। আগুন লাগানো হয়েছে প্ল্যান করে। মনে হয়, দুটো দিন লেগে যাবে নেভাতে। তোর মেয়েকে একবার ফোন করতে বলিস। যা ঘটছে, সব খুলে ওকে বলে দেবো। ও যেন কাগজে ফ্ল্যাশ করে।’

‘ঈশিতা তো স্টিফেন হাউসের কাছাকাছি আছে। ঠিক আছে, আমি ওকে বলে দিচ্ছি যাতে তোর সঙ্গে যোগাযোগ করে। এদিকে, টিভিতে তো সারাক্ষণ দমকলকে খাস্তা করছে।’

‘জানি। সেই কারণেই ঈশিতার সঙ্গে কথা বলা দরকার। রাখীকে বল, আমি ঠিক আছি। রাতে ফেরার সময় হাসপাতালে ওর সঙ্গে দেখা করে আসব।’

‘না, না। তোকে হাসপাতালে আসবে হবে না। রাতে রাখীকে আমি এখানে ফেলে রাখব না। ওদের ওয়ার্ডে কয়েকটা ডেডবডি পড়ে আছে। রাখীকে আমি হাতিবাগানের ড্রিমল্যান্ড নার্সিং হোমে নিয়ে যাচ্ছি। পারলে ওখানে যাস।’

লাইন কেটে দিয়ে শিখিন রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে নামতে যাবেন। তখন হঠাৎই একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। করিডরের উত্তর প্রান্তে ঘন অন্ধকারের মধ্যে কেউ একজন সিংহাসনে বসে আছেন। জ্বলজ্বল করছে হলুদ পোশাক। তাঁর মাথার জটে আগুনের শিখা। দেখেই সামালির কথা মনে পড়ে গেল শিখিনের। অগ্নিদেব না কি? করিডরের মেঝের উপর দিয়ে আগুনের পিণ্ড গড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। সেই পিণ্ড সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে!

(সাতান্ন)

কোয়েলের খোঁজে মিলেনাকে নিয়ে ছয়তলায় উঠে এসেছে দেব। মিসেস ভাল্লার ফ্ল্যাটে বার তিনেক ডোর বেল টিপল। তা সত্ত্বেও, কেউ খুলে দিলেন না। দরজায় একবার ধাক্কা মারতেই হাট করে খুলে গেল। ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে ওরা দু’জন ভিতরে ঢুকে পড়ল। লিভিং রুমে দাঁড়িয়ে দেব দু’বার চিৎকার করে বলল, ‘মিসেস ভাল্লা আপনি কি আছেন? আমি দেব।’ তাও কেউ উত্তর দিলেন না।

মিলেনা বলল, ‘আমার মনে হয়, এরা সবাই নীচে নেমে গেছেন।’

দেব বলল, ‘দাঁড়াও। এসেছি যখন বেডরুমটাও দেখে যাই।’

করিডরের উত্তর দিকের ফ্ল্যাটগুলো সব তিন কামরার। মিলেনাদের মতো চার কামরার নয়। প্রথম বেডরুমে ঢুকতেই দেবের মনে হল, ডিভানে কেউ শুয়ে আছেন। টর্চের আলো তাঁর মুখে ফেলতেই ও চমকে উঠল। কাত হয়ে পড়ে আছেন এক ভদ্রলোক। গলার কাছে চাপ চাপ রক্ত। কাছে গিয়ে ও দেখল, বিছানা ও বালিশে কেউ যেন লাল রং ঢেলে দিয়েছেন। মুখটা দেখে মিলেনা শিউরে উঠে বলল, ‘মাই গুডনেস, ইনি তো সুরজিত ভাল্লা। মিসেস ভাল্লার হাসবেন্ড। কে ওর এমন অবস্থা করল?’

তা হলে কি রুস্তমের ছেলেরা লুটপাট করার জন্য পাঁচতলাতেও উঠে এসেছিল? সুরজিত ভাল্লাকে খুন করে গেছে? নাহ, সে রকম তো কাউকে এতক্ষণ চোখে পড়েনি! দেব সিদ্ধান্ত নিল, এক মুহূর্তও আর ও এই ফ্ল্যাটে দাঁড়াবে না। একেই মিসেস ভাল্লা সুবিধের মানুষ নন। কারোর চোখে পড়ে গেলে, খুন করার দায় ওর উপর চাপিয়ে দিতে পারেন। বেডরুম থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসার সময় ও ফোন বাজার আওয়াজ পেল। মিউজিকটা সোফা সেট থেকে আসছে। ফোনটা তুলে নিয়ে পর্দায় ও দেখল, তমালের নাম। আবেগে ওর গলা বুঁজে এল। কোনওরকমে দেব বলল, ‘বল, তমাল।’

‘তোর কাছে কোয়েলের ফোন এল কি করে দেব? ও কোথায়?’

ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে দেব বলল, ‘ওর খোঁজেই মিসেস ভাল্লার ফ্ল্যাটে ঢুকেছিলাম। কিন্তু ফোন পড়ে আছে, কোয়েল নেই। তার মানে ও এখানে এসেছিল।’

‘গেল কোথায় বল তো? আমার মন বলছে, নিশ্চয়ই ওর খারাপ কিছু হয়েছে। টিভিতে দেখলাম, অনেক লোক না কি মারা গেছে স্টিফেন ম্যানসনে।’

‘হ্যাঁ, খুব বাজে ধরনের আগুন লেগেছে এখানে।’

‘এখনও ওখানে তুই কি করছিস ভাই। তোর না আজ ব্যাঙ্কক যাওয়ার কথা?’

‘দুপুরে মিলেনার সঙ্গে দেখা করতে এসে ট্র্যাপে পড়ে গেছি।’ অল্প দু’চার কথায় দেব পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে তার পর বলল, ‘তুই শিখিনদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখ। কোয়েলের খোঁজ পেয়ে যাবি।’

শিখিনদা কথা দিয়েছেন, ল্যাডার পাঠিয়ে ওদের উদ্ধার করবেন। সেই আশায় মিলেনাকে নিয়ে পাঁচতলায় নেমে এল ও। দুটো ছেলে দৌড়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই রুস্তমের দলের ছেলে। কোনও দুষ্কর্ম করে গেল বোধহয়। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও করিডরে কটু একটা গন্ধ পেল। তারপরই একটা আশ্চর্য দৃশ্য ওর চোখে পড়ল। করিডরের উপর দিয়ে আগুন ভেসে আসছে। একটু পরেই বুউম করে প্রচণ্ড এক শব্দ। পুরো তলাটা একবার কেঁপে উঠল। ছ’তলার কোনও ফ্ল্যাটের মেঝে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। তখনই মিলেনা আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘বোধহয় কোনও ফ্ল্যাটের গ্যাস সিলিন্ডার ফাটল। সিঁড়িতেও আগুন ছড়িয়েছে। নীচে নামার পথ বন্ধ হয়ে গেল দেবদূত। বাঁচার আর কোনও উপায় নেই।’

ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আগুনের তাত এসে লাগছে গায়ে। বাঁচার ইচ্ছে হারিয়ে ফেললে নেগেটিভ চিন্তা মাথায় আসবে। বাতাসে আগুন ভেসে আসার রহস্যটা দেব ধরে ফেলল। লুটপাট করার পর ছেলে দুটো সম্ভবত কিচেনে ঢুকে সিলিন্ডারের চাবিটা খুলে দিয়েছিল। ঘরের ভিতর থেকে গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে যায়। সেইসময়ই আগুনটা লাগে। তাই আগুন বাতাসে ভেসে বেরাচ্ছে। এই সংকটময় মুহূর্তে সাহস হারিয়ে ফেললে চলবে না। মিলেনাকে দেখেই মনে হচ্ছে মারাত্মক আতঙ্কে ভুগছে। ওর অত সুন্দর মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। ওর হাত ধরে দেব বলল, ‘কপালে যা আছে, হবে। চলো, আমরা ছাদে চলে যাই। ছাদে অন্তত ফ্রেশ এয়ার পাবো।’

সিঁড়িতে পুরোপুরি অন্ধকার। মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে ফের ছ’তলায় উঠে মিলেনা বলল, ‘দেবদূত, চলো একবার আমাদের ফ্ল্যাটে যাই। অনেকদিন আগে তোমাকে একটা গিফট দেবো বলেছিলাম। জানি না আর সুযোগ পাবো কি না। আজই সেটা তোমার হাতে তুলে দিই।’

ফ্ল্যাটে ঢুকে লিভিং রুমে প্রথমেই দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে তার মধ্যিখানে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তিটা রাখল মিলেনা। কয়েক সেকেন্ড হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থেকে, তারপর ঘুরে বলল, ‘এসো, আমার স্টাডি রুমে যাই। তোমার গিফট ওখানেই রাখা আছে।’

মিলেনা আগে কোনওদিন ওর স্টাডি রুম দেখায়নি। কথায় কথায় একদিন বলেছিল, ছোটবেলা থেকেই না কি ওর পেইন্টিংয়ের খুব শখ। কলকাতায় আসার পর প্রথম দিকে ও সময় কাটাত পেইন্টিং করে। স্টাডি রুমে ঢুকে দেব দেখল, ঘরে ইতিউতি অনেক ছবি দেওয়ালে টাঙানো অথবা মেঝেতে পড়ে রয়েছে। স্ট্যান্ডে রাখা একটা ক্যানভাস শুধু সিল্কের চাদরে ঢাকা। মিলেনা বোধহয় কাউকে ছবিটা দেখাতে চায়নি। চাদরটা ও সরিয়ে দিতেই দেবের মুখ দিয়ে বাহঃ শব্দটা বেরিয়ে এল। খালি গায়ে ফ্রন্টাল পোজে ওর ছবি। শরীরের প্রতিটা মাসল ফুটে বেরিয়েছে। মোমবাতির স্বল্প আলোতেও যেন জীবন্ত মনে হচ্ছে। ও বোকার মতো জিজ্ঞেস করল, ‘এই ছবিটা তুমি এঁকেছ! কবে আঁকলে?’

মিলেনা বলল, ‘রোজ একটু একটু করে এঁকেছি। তখনও আমাদের আলাপ হয়নি। জিম-এর পাশ দিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় রোজ তোমাকে ট্রেনিং করতে দেখতাম। ভেবেছিলাম, যেদিন তুমি আমাকে প্রোপোজ করবে, এই ছবিটা তোমাকে সেদিন উপহার দেবো।’

শুনে সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল দেব। পৃথিবীতে আর কেউ কখনও চরম বিপদের দিনে তার প্রেমিকাকে প্রোপোজ করেছে কি না ও জানে না। কিন্তু হাঁটু গেড়ে বসে, আঙুল থেকে আংটি খোলার ফাঁকে দেব বলল, ‘আমাকে বিয়ে করবে মিলেনা?’

ম্লান হাসি ফুটে উঠল মিলেনার মুখে। বাঁ হাতের অনামিকা বাড়িয়ে দিয়ে ও সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে ওকে বুকে টেনে নিয়ে দেব বলল, ‘ছবিটা আমার থেকেও ভাল হয়েছে। তোমাকে কথা দিচ্ছি মিলেনা, এই ছবিটার যোগ্য মর্যাদা দেবো।’

দু’জন দু’জনকে আঁকড়ে ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। দেবের বুকে মাথা রেখে হঠাৎ মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘আমার মধ্যে তুমি কী দেখেছিলে দেবদূত?’

‘প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি। জিম-এর পাশ দিয়ে রোজ তোমাকে হেঁটে যেতে দেখতাম। দেখে খুব ইন্সপায়ার্ড হতাম। মনে মনে বলতাম, এই মেয়েটার মন আমাকে জয় করতে হবে। সেজন্য জীবনে কিছু করে দেখাতে হবে। বলতে পারো, তুমি আমার ইন্সপিরেশন। কিন্তু তুমি আমার মধ্যে কী দেখেছিলে মিলেনা? তুমি ধনী পরিবারের মেয়ে, এত সুন্দরী, শিক্ষিতা। সেই তুলনায় আমি তো খুব সাধারণ ছেলে।’

‘ভরসা। রুস্তমের সঙ্গে সেই ঝামেলার দিনই স্কুলে আমাকে শান্তা আন্টি বলেছিলেন, ওই ছেলেটার উপর ভরসা রাখতে পারো মিলেনা। সারা জীবন এ তোমাকে ঝড় ঝঞ্ঝা থেকে বাঁচাবে। কোনওদিন তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে না। তখন বুঝতে পারিনি, শান্তা আন্টি প্রায়দিনই কেন তোমার কথা জানতে চাইতেন? আজ বুঝতে পারছি। আমার কি কপাল দেখো, এমন একটা দিনে জানতে পারলাম উনি আমার আসল মা, ওঁর কাছে যাওয়ার উপায় নেই।’

মিলেনার চোখের কোণে জল। সেটা মুছে দিয়ে দেব বলল, ‘ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখো মিলেনা। আমার মা প্রায়ই বলে, ঈশ্বর মাঝে মাঝে তাঁর সন্তানদের পরীক্ষায় ফেলেন। যে প্রকৃত ভক্ত, সে ঠিক রাস্তাটা বেছে নেয়। ধরে নাও, উনি সে রকমই একটা পরীক্ষা নিচ্ছেন।’

‘ঈশ্বরে তুমি বিশ্বাস করো দেবদূত?’

‘কেন করব না? আমি অনুভব করি, ঈশ্বর সবার ভিতর আছেন। কিন্তু সবাই তাঁর ভিতরে নেই। এই কারণেই মানুষের এত দুঃখ। মা বলে, পৃথিবী যখন পাপে ভরে যায়, তখনই তিনি দেখা দিয়ে উদ্ধার করেন।’

হঠাৎ দেবের ফোনটা বেজে উঠল। তা হলে কি শিখিনদার ফোন? পর্দায় চোখ রেখে দেব দেখল, মায়ের ফোন। ও প্রান্ত থেকে মা বলল, ‘সারাদিন তোর জন্য ওয়েট করতে করতে শেষে আমিই ফোনটা করলাম খোকা। এত বড় একটা কম্পিটিশনে যাচ্ছিস, অথচ মায়ের কথা তোর মনে পড়ল না?’

স্টিফেন ম্যানসনে আগুন লাগার খবরটা সম্ভবত মা শোনেনি। মা টিভি দেখে না। শহরে কী হল না হল, গাঁয়ের লোকদের অত মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আগুন লাগার কথা বললে মা টেনশনে পড়ে যাবে। বহু বছর আগে কর্ড লাইনে ডানকুনির কাছে একবার ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। কলেজে পড়ার সময় দেব তখন রোজ ট্রেনে যাতায়াত করত। অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে মা ধরে নিয়েছিল, ও ওই ট্রেনে ছিল। কোনওরকমে বাস ধরে দেব যখন অনেক রাতে বাড়িতে পৌঁছয়, তখন দেখে মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। না, মাকে কিছু জানতে দেওয়া যাবে না। তাই ও স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘তোমাকে একটু পরেই ফোন করতাম মা।’

‘হ্যাঁ রে, ব্যাঙ্কক যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে ক’টার সময় তুই বেরোবি বাবা? আজ কালীমন্দিরের ভটটাযমশাইয়ের কাছে গেছিলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, প্লেন ক’টার সময় ছাড়বে? আমি বলতে পারলুম না। তখন উনি বললেন, রাত সোয়া দশটার আগে দেব যেন বাড়ি থেকে না বেরোয়। প্লেনে ওঠার সময় বাঁ পা-টা যেন আগে বাড়ায়। হ্যাঁরে তোর প্লেন ক’টায়?’

‘রাত দু’টোয় মা। সোয়া দশটার পরে বেরোলেও আমার চলবে।’

‘ভটটাযমশাই তোর ঠিকুজি দেখে বললেন, তোর মঙ্গল গ্রহটা খুব খারাপ জায়গায় আছে। মাথায় বা পায়ে চোট লাগার খুব সম্ভাবনা। প্লেনে ওঠা-নামার সময় খুব সাবধান বাবা। তোর সঙ্গে কি আর কেউ যাবে?’

‘যাওয়ার কথা আছে জিম-এরই হিমাদ্রি বলে একজনের।’ মাকে বলছে বটে, কিন্তু ব্যাঙ্কক যাওয়ার কথা দেব এখন ভাবতে পারছে না। প্রাণ বাঁচাবে কী করে, সেটাই মাথায় ঘুরছে। মাকে তো আর সেকথা বলা যাবে না। একগাদা মিথ্যে কথা বলে যেতে হবে। তাই প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য দেব বলল, ‘চণ্ডীতলায় বাড়ির সবাই কেমন আছে মা? কমলার বাচ্চাটা কত বড় হল?’

‘বাড়ির সবাই বহাল তবিয়তে আছে। শুধু সুকুমারের টাইফয়েড, ও বাড়ি থেকে বেরুতে পারছে না। কমলার বাচ্চা অনেক বড় হয়ে গেছে বাবা। এত দুষ্টু, কালাচাঁদ দুধ দুইতে গেলে চাট মারছে। মায়ের দুধ কাউকে নিতে দেবে না। সবটা ও খাবে। তোর রাঙাদাদা ওর নাম দিয়েছে চপলা।’

কমলা ওদের দুধেল গরুর নাম। কিছুদিন আগে বাচ্চা বিইয়েছে। কালাদা রোজ দুধ দুইতে আসে। চপলাকে নিয়ে আলোচনায় উৎসাহ দেখাল না মা। বলল, ‘শোন, আমার শরীর ভালো নেই বাবা। চোখ বোঁজার আগে তোর আর মিলেনার চার হাতে এক করে দিতে চাই। আমেরিকা থেকে অনিন্দিতা রোজ আমাকে তাগাদা দিচ্ছে। তুই ব্যাঙ্কক থেকে ফিরে এলেই তোর বিয়ের কাজে নেমে পড়ব।’

‘তুমি এখনই এত ভাবছ কেন মা?’

‘হ্যাঁরে, তোদের বিয়েতে মিলেনার মা-বাবার মত আছে তো?’

‘আজ সকালেই মিলেনার বাবা রাজি হয়ে গেছেন। ওর মায়ের অবশ্য আপত্তি আছে। কিন্তু তা নিয়ে তুমি ভেবো না। মিলেনাকে ওঁরা খুব ভালবাসেন। মেয়ের মুখ চেয়ে পরে উনি রাজি হয়ে যাবেন।’

‘তা হলে ছাদের উপর ঘর তোলার ব্যবস্থাটা করে ফেলি?’

‘কয়েকটা দিন ওয়েট করো মা। এখনই কন্ট্রাক্টরকে টাকাপয়সা কিছু দিও না।’

‘গাঁয়ের লোকরা খুব আশায় আছে বাবা তোকে নিয়ে। কয়েকদিন আগে না কি তোকে টিভিতে দেখিয়েছে। তারপর থেকে দেখা হলে সবাই তোর কথা জিজ্ঞেস করছে। জিতে যদি ফিরে আসিস, তা হলে এরা না কি কী সব করবে-টরবে বলছে।’

ফোনের চার্জ তলানিতে নেমে এসেছে। আর কথা বলা যাবে না। দেব বলল, ‘আমি এখন ছাড়ছি মা। তুমি ভাল থেকো।’ কথাটা বলার সময় গলাটা ও ভারী হয়ে গেল। ফোন ছেড়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে দেব বসে রইল। মায়ের সঙ্গে আর কোনওদিন কথা বলতে পারবে কি না, কে জানে? কাল বা পরশু যখন মা আসল খবরটা পাবে, তখন কী হবে? পরক্ষণেই ও গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। একটা মেয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এত হতাশ হয়ে পড়া ওর উচিত না।

এবার মিলেনার ফোনটা বাজছে। ইরেভান থেকে ওর ড্যাডির ফোন। কী অবস্থায় আছে, মিলেনা বলে যাচ্ছে। এরিকের মুখে কিছু আশাব্যঞ্জক শুনে ওর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপরই সেটটা এগিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘ড্যাডি কী বলছেন তুমি শোনো।’

ও প্রান্ত থেকে এরিক বললেন, ‘দেবদূত, আমাদের ওয়াশরুমের সাউথ সাইডে একটা দরজা আছে। কয়েকটা কাঠের তক্তা দিয়ে সেটা সিল করা। কাঠগুলো ভেঙে, দরজা খুললে দেখতে পাবে, একটা লোহার স্পাইরাল সিঁড়ি নীচের দিকে নেমে গেছে। ল্যাডারের জন্য ওয়েট না করে তোমরা ওই স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাও।’

সাউথ সাইডে মানে কুইন্স ম্যানসনের দিকে। সিঁড়িটা বাইরে থেকে অল্পই দেখা যায়। কেননা, নীচের দিকে জেনারেটার রুম আর তার পাশে কেয়ারটেকারের অফিস। এরিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতেই দেব ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকল। এরিক বলে যাচ্ছেন, ‘আমার গ্রেট গ্র্যান্ডফাদারদের আমলে ওই স্পাইরাল সিঁড়িটা ব্যবহার করত সুইপাররা। আমার আমলে একবার আমার ফ্ল্যাটে চুরি হয়েছিল। চোররা না কি ওই স্পাইরাল সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছিল। তখন আমি দরজাটা সিল করে দিই। বহু বছর ধরে সিঁড়িটা ব্যবহার করা হয়নি। জানি না, পোক্ত অবস্থায় আছে কি না। খুব সাবধানে মিলেনাকে নিয়ে তুমি নেমে যাও। তারপর আমাকে ফোন কোরো।’

এরিকের কথা শুনে মুহূর্তে চাঙা হয়ে উঠল দেব। সময় নষ্ট না করে কাঠের তক্তাগুলো ও ভেঙে ফেলল। ওয়াশরুমের দরজাটা খুলে দিতেই তাজা বাতাস ভেসে এল। কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেব দেখল, কাছেই বাগান গিয়ে ঘেরা কুইন্স ম্যানসনটাকে অন্ধকারের মধ্যে রাজপুরীর মতো মনে হচ্ছে। নীচ থেকে জেনারেটরের আওয়াজ ভেসে আসছে। বিল্ডিংয়ে ইলেকট্রিসিটি নেই বলে বোধহয় দমকলের লোকেরা জেনারেটার চালু করে দিয়েছেন। পাশ ফিরে ও বলল, ‘হোয়াট আ রিলিফ। মিলেনা দেখো, ঈশ্বর আমাদের কথা শুনেছেন।’

কিন্তু স্পাইরাল সিঁড়িতে পা রেখে নীচের দিকে তাকাতেই দেবের মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। মিডলটন রো-র দিকে হ্যালোজেন আলো লাগানো হয়েছে। কিন্তু স্পাইরাল সিঁড়ির নীচে ঘন অন্ধকার। দোতলার কোনও একটা ফ্ল্যাট থেকে আগুনের শিখা একবার বেরিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল। দেখে দেবের পা কাঁপতে লাগল। প্রায় ঘণ্টা ছয়েক হয়ে গেল। আগুন তা হলে একনম্বর ব্লকের নীচেও ছড়িয়ে পড়েছে। আগুনের ফুলকি উড়ে আসছে। সাবধানে নেমে গেলে হয়তো আগুন ওদের স্পর্শ করতে পারবে না। এই আশা নিয়ে ও স্পাইরাল সিঁড়িতে আগে মিলেনাকে এগিয়ে দিল। ধীরে ধীরে কয়েক ধাপ আগে-পরে, ওঁরা নীচের দিকে নেমে আসছে। মনে মনে দেব প্রার্থনা করল, দোতলা থেকে আগুনের শিখা যেন আবার বেরিয়ে না আসে। কিন্তু বিস্ফারিত চোখেও দেখল, একতলায় নামার সময় মিলেনার শাড়িতে আগুন ধরে গিয়েছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই ও শাড়ি খুলে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ওকে বাঁচানোর তাগিদে দ্রুত নীচে নামতে গিয়ে দেব টের পেল, স্পাইরাল সিঁড়িটা একবার নড়ে উঠল। ওর পা পিছলে গেছে। মাথাটা ঠোক্কর খেল লোহার রেলিংয়ে। তার পর আর কিছু ওর মনে নেই।

(আটান্ন)

সল্ট লেকে টিভি চ্যানেলের অফিস থেকে ফিরছে রুস্তম। স্টিফেন ম্যানসনে আগুন লাগা নিয়ে একটা টক শো ছিল। জীবনে কখনও ক্যামেরার মুখোমুখি হয়নি ও। কী বলতে কী বলে ফেলবে, মনে একটা ভয় ছিল। কিন্তু অ্যাঙ্করের সিটে মউকে দেখে ও সাহস পেয়ে যায়। মউ যা জিজ্ঞেস করেছে, রুস্তম ঠিকঠাক উত্তর দিয়েছে। প্রতিবার বলেছে, উদ্ধার কার্যে নেমে ও যা কিছু করেছে, সবই মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায়। রুলিং পার্টির নেতাদেরও রুস্তম নৈবিদ্য দিতে ভোলেনি। বিশেষ করে কর্পোরেশনের মেয়রকে। কিন্তু একবারও উল্লেখ করেনি দমকল মন্ত্রী সুহাস চ্যাটার্জির নাম। লোকটাকে ও পছন্দ করে না। পাইপ কলোনির আগুন লাগার ব্যাপারে ওকে জড়ানোর চেষ্টা করেছিল।

মা ফ্লাইওভারে ওঠার পরই রুস্তম ফোন পেল আসফাকের, ‘ওস্তাদ, গুড নিউজ আছে।’

মনটা খুশি খুশি। টিভি অফিস থেকে বেরোনোর সময় মউ বলে দিয়েছে, দ্য ফর্টি টু বিল্ডিংয়ে যেতে। ওর কোনও এক বন্ধু না কি আমেরিকাতে গেছিল। সে এক বোতল ক্যাপ্টেন মর্গান এনে দিয়েছে। সেই বোতল খুলে আজ পার্টি করা হবে। আসফাকের সঙ্গে বেশি কথা বলবে না ভেবে রুস্তম বলল, ‘কী খবর বল।’

‘আশিক-এর বারোটা বেজে গেছে ওস্তাদ। মারাত্মক ইনজিওর্ড। পাঁচতলা থেকে লোহার সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেছিল। ভেবেছিল, আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু দোতলা থেকে পড়ে গিয়ে আশিক অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।’

‘রেসকিউ টিমের কারোর চোখে পড়েছে?’

‘না। কেউ টের পায়নি। দেবো না কি খতম করে?’

অন্য কোনওসময় হলে রুস্তম উত্তর দিত, হ্যাঁ। কিন্তু মউয়ের পরামর্শ ছাড়া আজকাল ও এক পাও নড়ে না। ও বলল, ‘বডিটা কোথাও পাচার করে দে। হ্যাঁ রে, মিলেনার কী হল?’

‘রেন্ডিটার শাড়িতে আগুন লেগেছিল। পায়ের দিকে খানিকটা পুড়েছে। কিন্তু সেই অবস্থাতেই ও দৌড়ে গেল পার্ক স্ট্রিট গেটের দিকে। চিনে ফেলবে বলে আমরা ওকে আটকাইনি। লোকজন নিয়ে রেন্ডিটা হয়তো এখুনি ফিরে আসবে। ওস্তাদ, তাড়াতাড়ি বলো, আশিককে কোথায় নিয়ে যাবো?’

‘ওর বডিটা সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে কোথাও লুকিয়ে রাখ। আমি স্পটে যাচ্ছি। গিয়ে ডিসিশন নেবো।’ বলে রুস্তম লাইনটা কেটে দিল।

মনে মনে ও আত্মপ্রসাদ অনুভব করল। রেজাল্ট তা হলে বরাব্বর হয়ে রইল। দেবের সঙ্গে ওর ঝামেলা তো আজকের নয়। ও যখন তোলাবাজি করত, তখন থেকে। রেষারেষির প্রথম দিনটার কথা এখনও রুস্তমের স্পষ্ট মনে আছে। সিলভার হোটেলের নীচে যখন জিমটা হল, তখন আবিদ ভাইজান সেটিং করে নিয়েছিল শরাফ ম্যাডামের সঙ্গে। টাকা সরাসরি চলে যেত সার্কাস অ্যাভেনিউর পার্টি অফিসে। ভাইজান তখন বলেই দিয়েছিল, জিম-টাকে তোরা ডিসটার্ব করবি না। তবে আশপাশের দোকানগুলো থেকে যা পারবি খিঁচে নিবি। রাস্তা থেকে বডিবিল্ডারদের দেখে তখন রুস্তম মনে মনে হাসত। আরে ভাই, বডির মাসল বাড়িয়ে কি লাভ? যদি না শক্তিটা কাজে লাগানো যায়? অভিজ্ঞতা থেকে ও বুঝতে পেরেছিল, বডিবিল্ডার মারপিটে ঢুকতে চায় না। তেড়ে গেলেই পালিয়ে যায়। যাতে ওদের মাসল-এর ক্ষতি না হয়। কিন্তু ওর ভুলটা প্রথম ভেঙে দিয়েছিল দেব।

সেদিন জিম-এর পাশে একটা সরবতের দোকান থেকে তোলা তুলতে গেছিল রুস্তম। বুড়ো লোকটা সবে দোকান খুলে বসেছে। কিছুতেই টাকা বের করে না। বেওকুফ আসফাকটা তখন ওর ফলের ঝুড়িটা রাস্তায় উল্টে ফেলে দেয়। বেলা দশটা সাড়ে দশটা বাজে। আশপাশে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছিল। কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি। কেউ বোধহয় জিম-এ খবর দিয়েছিল। বুরবাক দেবটাই জিম-এ থেকে বেরিয়ে আসে। আসফাককে সামনে পেয়ে এমন একটা ঘুসি মারে, ওর নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে। তার পরেই দেব ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘শোন, আমার নাম দেবদূত। আমি জিম-এর চিফ ট্রেনার। তুই এখুনি এখান থেকে চলে যাবি। না হলে এমন মার মারব, জিন্দেগিতে ভুলবি না।’

সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে চাকু বের করেছিল রুস্তম। ভেবেছিল, চাকু দেখালে দেব ভয়ে পিছিয়ে যাবে। কিন্তু তাতে উল্টো ফল হল। দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, দু’হাত দিয়ে দেব ওকে ডেকেছিল, ‘আয়, আয়। তোর কত সাহস দেখি।’ বলতে বলতেই ওর তলপেট লক্ষ্য করে লাথি মেরেছিল। হাত থেকে চাকু ছিটকে রাস্তায় চলে গেছিল। ও হুমড়ি খেয়ে ধাক্কা খায় কংক্রিটের পিলারে। রুস্তমের মনে আছে, দেব বলেছিল, ‘এই জিম-এর আশপাশে যেন তোকে আর কোনওদিন না দেখি। যা, আজ ছেড়ে দিলাম।’ মারমুখি দেবকে দেখে সেদিন প্রথম ভয় পেয়েছিল রুস্তম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ছেলেটাকে এমন শিক্ষা দেবে, যেন সারাজীবন পস্তায়।

ঘটনার রেশ গড়িয়েছিল পরের দিনও। আবিদ ভাইজানের অফিসে গিয়ে রুস্তম দেখে, দেব বসে আছে। সম্ভবত শরাফ ম্যাডামই ওকে পাঠিয়েছিলেন। কোথায় ভাইজান ওকে সাপোর্ট করবেন। তা না করে সেদিন গালি দিতে শুরু করলেন, ‘মাদারচোত, তোকে বলেছি না, জিম-এর আশপাশে যাবি না। কেন গেছিলি? এরা সব ভদ্রলোকের ছেলে। এদের ভয় দেখানোর জন্য চাকু বের করেছিলি কেন? রেন্ডির বাচ্চা, তুই আমার বদনাম করে দিচ্ছিস।’ রুস্তমের তলপেটের ব্যথাটা তখনও যায়নি। রাতে উলঙ্গ হয়ে ও দেখেছে, একটা অণ্ডকোষ ফুলে আছে। দেবের মুখের দিকে তাকালেই ওর রাগ মাথায় উঠে যাচ্ছিল। তবুও, ভাইজানের সামনে রুস্তম মুখ নীচু করে দাঁড়িয়েছিল। দেব ভদ্দরলোকের ছেলে। আর রেল লাইনের ধারে ঝুপড়িতে জন্মেছে বলে ও লাথখোর হয়ে গেল! আবিদ ভাইজান বেঁচে থাকলে আজ ও দেখাতে পারত, সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে কে লাথখোর হয়ে পড়ে আছে।

ড্যাশবোর্ডে রাখা মোবাইল ফোনটা বাজছে। উড়ালপুল থেকে নেমে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রুস্তম পর্দায় রাবেয়ার নামটা দেখতে পেল। সোয়াইপ করতেই ও প্রান্ত থেকে রায়েবা বলল, ‘তুই তো বড় নেতা হয়ে গেলি রুস্তম। সারাদিন বাড়িতে বসে তোকে কতবার টিভিতে দেখলাম। মউ বলে রিপোর্টারকে কত টাকা খাইয়েছিস? আগে থেকেই রেন্ডিটাকে চিনতিস না কি?’

সত্যিই, মউ বোধহয় আজ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এতবার বাইট নিয়েছে, এতবার ওর মুখ টিভিতে দেখিয়েছে, শুনে অনেকেই হয়তো জ্বলবে। টক শো-তেও মেয়েটা মুখে কথা জুগিয়ে দিচ্ছিল। রুস্তম বলল, ‘না, চিনতাম না। কেন, তোমার হিংসে হচ্ছে না কি?’

‘হিংসে করব কেন? মেয়েটাকে চিনি, তাই বলছি। তোর ভাইজানের কাছে গোপনে কয়েকবার এসেছিল। ডেঞ্জারাস টাইপের মেয়ে। আব্বু পার্টি ফান্ডে টাকা দিচ্ছে না, এই সন্দেহটা মউই প্রথম সুধাংশুদার মাথায় ঢুকিয়েছিল। ওর ফাঁদে পড়িস না রুস্তম। দেখবি, তোর অনেক খবর শত্রুদের কাছে পৌঁছে দেবে।’

কথাটা সত্যি হলেও হতে পারে। মউ অনেকের গোপন খবর রাখে। খবর আদান-প্রদান করে অনেক টাকা কামায়। মউ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য রুস্তম বলল, ‘তোমার ফাঁদ থেকে তো আগে বেরোই। তারপর অন্যের কথা ভাবা যাবে।’

‘তোকে দেখলেই আমার সারা শরীরে আজকাল জ্বলুনি শুরু হয় রুস্তম। তুই কোথায় ছিলি, কোথায় পৌঁছে গেলি। এমনকী, আমার ছেলেরাও তোর খুব প্রশংসা করছিল আজ। জানি, দু’চারদিন পর ওরা তোর দলে গিয়ে ভিড়বে। আমাকে একাই চলতে হবে।’

‘তুমি এক কাজ করো রাবেয়া। মালদহে হাসবেন্ডের কাছে চলে যাও। শরীরের জ্বলুনি আগে কমাও। তার পর আমার কথা ভেবো।’

‘আমার শরীর ঠান্ডা করার ক্ষমতা ওর নেই রুস্তম। পারলে তুই-ই পারবি। আয় না, একবার আমাদের বাড়িতে। আম্মি সবাইকে নিয়ে উলুবেড়িয়ায় গেছে। বাড়ি একেবারে ফাঁকা। সেই কারণে তোকে ফোনটা করলাম।’

রাবেয়ার গলায় যৌন আর্তি শুনে রুস্তম একমুহূর্ত টলে গেল। সেদিন পার্টি অফিসে রাবেয়া ওকে পা টিপে দিতে বলেছিল। কিন্তু তখনই মউয়ের সাবধানবাণী ওর মনে পড়ে। ‘হানি ট্র্যাপে পড়ার মতো ভুল কোনওদিন পড়ো না রুস্তমদা। শুভঙ্করের মতো সারাজীবন পস্তাবে।’ বেডরুম থেকে সঙ্গে সঙ্গে ও বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু আজ ওর আরও পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এই রাবেয়াই প্রথম ওকে যৌনশিক্ষা দিয়েছিল। মেয়েদের শরীরের সব রহস্য নিজেই ফাঁস করে দেখিয়েছিল। বর্তমান ভুলে গিয়ে রুস্তম বলে ফেলল, ‘এত করে যখন বলছ, আমি আসছি।’

‘ড্রিঙ্কস-এর ব্যবস্থা করে রাখব না কি?’

‘না থাক। আমার গাড়িতে সিবাস রিগালের বোতল আছে। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

মিনিট দশেকের মধ্যেই রুস্তম স্টিফেন ম্যানসনে পৌঁছে গেল। দুপুরবেলায় মিডলটন রো-তে একটা চায়ের দোকান থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে ও কন্ট্রোল রুম খুলেছিল। সেখান থেকেই অপারেশন চালিয়েছে। ও দেখল, রাত দশটা বাজে, তখনও দোকানের মালিক হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পকেট থেকে একটা নোটের বান্ডিল বের করে তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে রুস্তম বলল, ‘এই টাকাটা রাখ। তোর যা লোকসান হয়েছে, পুষিয়ে যাবে। কালও তোর এই দোকানটা আমার চাই। কালকের ভরপাই কাল পাবি।’

গদগদ হয়ে দোকানের মালিক হিন্দিতে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ রুস্তমভাই। আমার দোকান আপনাকে দিয়ে দিলাম। যতদিন ইচ্ছে আপনি রাখুন।’

আসফাক এতক্ষণে দেখতে পেয়েছে। ও দৌড়ে এসে বলল, ‘সেলাম আলেইকুম ওস্তাদ। আফজলমিঞা একটু আগে ফোন করেছিল। বলল, তোমার টিভি প্রোগ্রাম না কি দারুণ হয়েছে। তারপর থেকে অনেকেই আমাকে ফোন করছে। তোমাকে না পেয়ে।’

‘এ দিককার সব খবর কী?’

‘অপারেশন সেভেন্টি ফাইভ পার্সেন্ট সাকসেসফুল। তিন আর চার নম্বর ব্লকের ফ্ল্যাটগুলো ফাঁকা করে দিয়েছি। ল্যাডারটা আগে ও দিকে না পাঠালেই ভাল করতে ওস্তাদ। ল্যাডারটা আসার আগে ট্র্যাকে করে লুঠের মাল পাচার করে দিচ্ছিলাম। কিন্তু, পরে দমকল আর পুলিশের লোক এসে গেল। তাই মালগুলো পড়েই আছে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে। দেখি, ভোর হওয়ার আগে সব বের করে নেবো।’

‘ফ্ল্যাটের লোকজন এখন কোথায়?’

‘এখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছে। অনেকেই তোমাকে খুঁজছিল। কিন্তু ওদের সঙ্গে কথা বলতে যেও না ওস্তাদ। শিক্ষিত লোকজন, ডেঞ্জারাস।’

‘ঠিক আছে, কাউকে বলিস না, আমি এখানে আছি। আসল খবরটাই তো তুই আমাকে দিলি না। তোর আশিক-এর অবস্থা কেমন এখন?

‘বোধহয় আর নেই। ইন্তেকাল হয়ে গেছে। শরীর থেকে এত রক্ত বেরিয়ে গেছে, বাঁচার সম্ভাবনা কম। ওকে নিয়ে কি করব ওস্তাদ? থানার ওসি একটু আগে বলল, কাল ভোর থেকে বিল্ডিংয়ের পজেশন নেবে। কাউকেই ঢুকতে বা বেরোতে দেবে না।’

কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে রুস্তম বলল, ‘তা হলে দেবের বডিটা নিয়ে এখুনি কাউকে বেরিয়ে যেতে বল। মির্জা গালিব স্ট্রিটে দমকলের অফিস সামনে যেন ফেলে দিয়ে আসে। কারোর চোখে পড়লে কিন্তু মুশকিল হয়ে যাবে। ডেডবডির কাছাকাছি আমাদের লোকজন রেখে দিস। কাল সকালে ওই ডেডবডি ঘিরে তোরা বিক্ষোভ দেখাবি দমকলের বিরুদ্ধে।’

‘জী ওস্তাদ।’ বলে আসফাক বেরিয়ে যাচ্ছিল, ওকে থামিয়ে রুস্তম বলল, ‘একটা খবর তুই এখুনি এনে দিতে পারবি আসফাক? আমি কিন্তু এখুনি বেরিয়ে যাবো।’

‘গুলাম হাজির, কী খবর ওস্তাদ?’

‘আবিদ ভাইজানের বাড়ির সবাইকে তো তুই চিনিস। কারোর কাছে একটু খবর নিয়ে দ্যাখ তো, ভাইজানের বাড়িতে এই মুহূর্তে কে আছে? রাবেয়ার আম্মিজানকে কিছু টাকা দিয়ে আসতে হবে। শোন, আমি যে যাবো, সেটা যেন কেউ জানতে না পারে।’

‘জী, জী। রাবেয়ার দলের একটা ছেলে এখন আমার সঙ্গে আছে। আমি এখুনি খবর নিচ্ছি।’

আসফাক বেরিয়ে যাওয়ার পর ফোন এল মউয়ের, ‘রুস্তম, তুমি কোথায়?’

‘স্টিফেন ম্যানসনে। আরে, তোমাদের অফিস থেকে ফেরার পর এখানে একটা খুব খারাপ খবর শুনলাম। আমার যেতে একটু দেরি হবে।’

‘আর এখানে আমি বোতল খুলে বসে আছি। তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেবো বলে। আগে তুমি এসো। তার পর তোমার খবরটা শুনব। আমারটাও তুমি শুনতে পাবে।’

‘আসছি।’ বলে রুস্তম লাইন কেটে দিল।

তখনই ও দেখল, দ্রুত পায়ে আসফাক চায়ের দোকানের দিকে এগিয়ে আসছে। ফুটপাতে নেমে এসে রুস্তম জিজ্ঞেস করল, ‘জানতে পারলি?’

‘জী ওস্তাদ। ভাইজানের বাড়িতে এখন রাবেয়া আর ওর শহুর ছাড়া আর কেউ নেই। বাকিরা গাঁয়ের বাড়িতে গেছেন।’

মাই গুডনেস! রাবেয়া হাসবেন্ড এখন এখানে? তা হলে ও কিসের জন্য ডেকেছিল? হানি ট্র্যাপে ফেলার জন্য? আল্লার মেহেরবানি। ভাগ্যিস, আসফাককে দিয়ে একবার চেক করিয়েছিল! মনে মনে মউকে ও ফের একবার ধন্যবাদ জানাল। এই সাবধানতাটা শেখানোর জন্য। গাড়িতে উঠে রুস্তম সোজা রওনা দিল দ্য ফর্টি টু বিল্ডিংয়ের দিকে।

(ঊনষাট)

রাত আড়াইটার সময় অফিসে ফিরছেন শিখিন। সারা শরীর ও মন বিধ্বস্ত। টানা প্রায় বারো ঘণ্টা ধরে তিনি আগুনের সঙ্গে লড়াই করেছেন। এখনও নেভাতে পারেননি। সময়ের বিচারে এটা অবশ্য দীর্ঘমেয়াদি লড়াই নয়। এর আগে সত্যনারায়ণ পার্কের আন্ডার গ্রাউন্ড মার্কেটে ফায়ার অনেক বেশি ভুগিয়েছিল। তিনদিন ধরে টানা যুদ্ধ করতে হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার কথাই অনিরুদ্ধকে বলতে বলতে আসছেন শিখিন। ছেলেটার মধ্যে একটা অদম্য স্পিরিট লক্ষ্য করেছেন তিনি। ওর চাকরি ফায়ার ফাইটিংয়ের জন্য। কিন্তু ওকে কন্ট্রোল রুমে রেখে দিয়ে আজ অনেক কিছু শিখিয়েছেন।

সারাটা দিন পেটে সলিড ফুট কিছু পড়েনি। হয়তো বাইরে থেকে শিখিন কিছু আনিয়ে নিয়ে পারতেন। কিন্তু মন সাড়া দেয়নি। বিল্ডিংয়ের ভিতর এতগুলো লোক মৃত্যুভয়ে ভুগছে, সেখানে কন্ট্রোল রুমে বসে ওঁরা খাবার মুখে তোলেন কী করে? তাই চা-কফির উপরই ভরসা করতে হয়েছে। এখন মারাত্মক খিদে পাচ্ছে। কথা বললে খিদেটা ভুলে থাকতে পারবেন। শিখিন অনিরুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ তোর নতুন কি এক্সপিরিয়েন্স হল অনি, আমায় বল।’

অনি বলল, ‘স্যার, আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে লড়ার থেকেও, অনেক বেশি ইমপরট্যান্ট, পিছনে বসে লড়ার প্ল্যানিং করা। আপনি না থাকলে বিল্ডিংটার আর বেশি ক্ষতি হত। ক্যাজুয়ালটি বাড়ত। সরকারের উচিত আপনাকে প্রাইজ দেওয়া।’

শুনে মনে মনে হাসলেন শিখিন। সারাদিনে কত কি পলিটিক্স হয়ে গেছে, তা বোঝার সাধ্য অনির নেই। শিখিন জেনে গেছেন, তাঁকে গিলোটিনে মাথা দিতে হবে। দমকল সম্পর্কে অনেক অপপ্রচার আজ ইলেকট্রনিক মিডিয়া করেছে। ওদের সুরে যদি প্রিন্ট মিডিয়াও গলা মেলায়, তা হলে তাঁর ট্রান্সফার অনিবার্য। হয়তো কাল বা পরশু চিঠি পেয়ে যাবেন। মনকে প্রস্তুত করে নিয়েছেন শিখিন। অনিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘জব স্যাটিসফ্যাকশন বলে একটা কথা আছে। সেটা কি পেলি বলে মনে হচ্ছিল তোর?’

‘অফ কোর্স স্যার। পাঁচ তলার করিডর থেকে যখন ক্যান্সার পেসেন্ট ভদ্রমহিলাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলাম, তখন মনে হচ্ছিল, এর থেকে গোল্ডেন মোমেন্ট জীবনে আর কিছু হতে পারে না। অত স্মোকের মধ্যে উনি সার্ভাইভ করে গেলেন কী করে, সেটা ভেবেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। রেসকিউ টিমের পিনাকীদারা ওঁকে কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছেন, জানতে পারলে কাল এক ফাঁকে গিয়ে দেখে আসতাম।’

‘আমি জানি, সল্ট লেকে টাটাদের ক্যানসার হসপিটালে গেছেন। ওখানেই না কি ভদ্রমহিলার ট্রিটমেন্ট চলছিল অনেকদিন ধরে।’

‘স্যার, মিসেস বাসন্তী সেন বলছিলেন, উনি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের পাইলট ছিলেন। ওইটুকু সময়ের মধ্যে উনি এত সুন্দর কথা বলছিলেন, আমার মনে হচ্ছিল, আমি আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলছি।’

‘মাকে গিয়ে বলিস সে কথা।’

‘স্যার, আমার মা আমার ছোটবেলাতেই মারা গেছেন।’

‘বলিসনি তো কখনও। মিসেস সেন আর কী বলছিলেন তোকে?’

‘ওঁর স্বামী মারা গেছেন এক বছর আগে। ছেলে জার্মানিতে চাকরি করে। সে না কি খোঁজও নেয় না। ভদ্রমহিলার তিন নম্বর কেমোথেরাপি করার কথা কাল দুপুরে। হাসপাতাল থেকে সেটা করিয়ে ওঁর বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু, পুলিশ যদি স্টিফেন ম্যানসন সিল করে দেয়, তা হলে উনি কোথায় থাকবেন?’

‘অত ভাবিস না অনি। ঈশিতা ভদ্রমহিলার একটা ইন্টারভিউ নিয়েছে। ওর মুখেই শুনলাম, টাটা হসপিটালের কথা। কাল কাগজে খবরটা বেরলে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হবে।’

‘স্যার, আজ আপনার নতুন কি এক্সপিরিয়েন্স হল?’

‘বিরাট একটা আফসোস নিয়ে ফিরছি অনি। দেবকে কোনও সাহায্যই করতে পারলাম না। ল্যাডারটা যদি ঠিক সময়ে পাঠাতে পারতাম, তা হলে এই আফসোসটা হত না। ও আর মিলেনা গেল কোথায়, আদৌও বেরিয়ে আসতে পেরেছে কি না, কিছুই জানি না। আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে, রুস্তমের ছেলেরা প্ল্যান করে ওকে বেরোতে দেয়নি।’

‘দেবদার উপর রুস্তমের এত রাগ কিসের স্যার?’

‘ভালর উপর মন্দের রাগ। এককথায় এটাই বলতে পারি। জানিস, এই দেবকে আমি প্রথম দেখি, কলকাতা পুলিশের একটা অনুষ্ঠানে। রবীন্দ্র সদনে বডি বিল্ডিং শো-তে ও পার্টিসিপেট করেছিল। তখন পুলিশ কমিশনার ছিলেন সুজিত ভৌমিক, আমাদের নর্থ ক্যালকাটার লোক। ন্যাশনাল সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। উনিই আমার সঙ্গে দেবের আলাপ করিয়ে দেন। একটা বাঙালি ছেলের অত সুন্দর একটা বডি। সবে মি. ইন্ডিয়া হয়ে ফিরেছে। সুজিতদা ওকে পুলিশে নেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। গভর্নরের এডিসি পোস্ট দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু দেব তাতে রাজি হয়নি। মনে আছে, সেইসময় ও আমাকে বলেছিল, বাংলার বডি বিল্ডিং অনেক পিছিয়ে পড়ছে শিখিনদা। আমার পর আর কেউ নেই। ফের রিভাইভ করতে হবে। কিছু ছেলেকে তুলতে হবে। চেষ্টা করেই দেখি না। না পারলে চাকরি নিয়ে নেবো।’

‘এটা কদ্দিন আগেকার কথা স্যার?’

‘বামফ্রন্ট আমলের। তারপর ঢাক ঢোল পিটিয়ে সিলভার জিম হল। দেবের জন্য আমিও গিয়ে ভর্তি হলাম জিম-এ। পরে দেখলাম, মারোয়াড়িরা যেসব ভেঞ্চার নেয়, তাতে ফাইনান্সিয়াল বেনিফিটের কথা আগে ভাবে। দেবের মুখ দেখে আমি বুঝতে পারি, জিম-এ ও সুখে নেই।’

‘আপনি ঠিক বলেছেন স্যার। ম্যাডামদির মতো অত ভাল একজন ট্রেনারকে ছাঁটাই করে দিল। দেবদা ব্যাপারটা ভালভাবে নেননি। আশ্চর্য, ম্যাডামদিও কাল থেকে রহস্যজনকভাবে উধাও।’

‘কোয়েলের ডেডবডি পাওয়া গেছে। হিমাদ্রি যে লিস্ট দিয়েছে, তাতে ওর নাম আছে। ও চিনত বলেই কোয়েল বেওয়ারিশ লাশ হয়ে যায়নি। ওর ডেডবডি এখন এসএসকেএম-এর মর্গে।’

‘কী বলছেন স্যার!! ‘দুঃসংবাদটা শুনে কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইল অনি। তার পর বলল, ‘ভগবানের উপর বিশ্বাস চলে যাচ্ছে। ভাবতেও পারছি না, ম্যাডামদি আর নেই। ওর ক্রিমেশনের কী হবে? রিলেটিভদের সঙ্গে তো ম্যাডামদির ভাল সম্পর্ক ছিল না।’

‘তমালকে জানিয়ে দিয়েছি। বেচারা কত কী প্ল্যান করেছিল, সব চৌপাট হয়ে গেল।’

অফিসের কাছাকাছি এসে অনি হঠাৎ বলে উঠল, ‘স্যার তাকিয়ে দেখুন, ওই অদ্ভুত লোকটা ফের হাজির হয়েছে। আপনি যাঁকে অগ্নিদেব বলেন। লোকটা হেঁটে যাচ্ছে আমাদের অফিসের দিকে।’

সামনে তাকিয়ে শিখিন অবশ্য কাউকেই দেখতে পেলেন না। মির্জা গালিব স্ট্রিট একেবারে শুনশান। উল্টোদিক থেকে গাড়ি হুঁশ করে চলে যাচ্ছে। দমকল অফিসের গেটে প্রচুর আলো। রাতের ডিউটির দু’একজন কর্মী দাঁড়িয়ে কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। শিখিন বললেন, ‘কার কথা বলছিস অনি?’

‘ওই তো বাঁ দিকে। দাঁড়ান, উল্টোদিকের গাড়িটা চলে যাক, তখন দেখতে পাবেন। ওই যে… শ্রীলেদার্স দোকানের সামনে লোকটা ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। গাড়িটা থামান স্যার। লোকটাকে আজ ধরবই।’ শিখিনের চোখে পড়ল শ্রীলেদার্স দোকানের সামনে হুমড়ি খেয়ে কেউ পড়ে আছে। মাতালদের উৎপাত বোধহয়। আশপাশের লোক হতে পারে। পার্ক স্ট্রিটের বারগুলোতে মাল খেতে যায়। ফেরার সময় বেহেড হয়ে গেছে। আগেও অনেকবার রাস্তা থেকে তুলে মাতালদের একটা গতি করেছেন শিখিন। কাছাকাছি গাড়ি দাঁড় করিয়ে তিনি বললেন, ‘অনি, একবার নেমে দ্যাখ তো লোকটার জ্ঞান আছে কি না?’

এ সব কাজে সাধারণত অনি খুব উৎসাহ দেখায়। দরজা খুলে চট করে নামার সময় ও বলল, ‘আশ্চর্য, আমি স্পষ্ট লোকটাকে দেখলাম। মাথার জটা থেকে আগুন বেরুচ্ছে। ঢেকুর তুলতে তুলতে লোকটা এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ হঠাৎ উধাও হয়ে গেল কী করে?’ রাস্তায় নেমে মাতালের বডিটাকে উল্টে দেখেই অনি চিৎকার করে উঠল, ‘স্যার, শিগগির নেমে আসুন। দেবদা পড়ে আছেন!’

গাড়ি থেকে নেমে দেবের অবস্থা দেখে শিখিন চমকে উঠলেন। মাথার সামনের দিকটায় আঘাতের চিহ্ন। রক্তাক্ত মুখটা চেনাই যাচ্ছে না। ডান পা-টা দুমড়ে গেছে। হাতের নাড়ি টিপে শিখিন দেখলেন, তখনও ধীর গতিতে চলছে। ব্যায়াম করা বডি বলে এখনও ছেলেটা যুঝে যাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে কোনও নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া দরকার। সরকারী হাসপাতালে নিয়ে গেলে এমনিভাবেই পড়ে থাকবে। অনিকে কাল সকালের আগে ট্রিটমেন্ট পাবে না। তিনি বললেন, ‘দেবকে শিগগির গাড়িতে তোল।’ চট করে তাঁর মাথায় এল ড্রিমল্যান্ড নার্সিং হোমের নাম। ওখানেই রাখীকে আজ বাণীব্রত ভর্তি করেছে। রাস্তা এখন ফাঁকা। মিনিট পনেরোর মধ্যেই তিনি হাতিবাগানে পৌঁছে যাবেন। পুরনো পাড়ার নার্সিং হোম। নিশ্চয় কাউকে না কাউকে চেনা পেয়ে যাবেন।

গাড়িতে উঠে অনি জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, রুস্তমের কাজ বলে মনে হচ্ছে?’

‘জানি না। তবে নিশ্চয়ই কোনও শয়তানের হাত আছে। খালি হাতে দেবকে কবজা করা শক্ত। কেউ গুলি করতেও পারে। মার্ডার করতে চেয়েছিল বলে মনে হচ্ছে না। তা হলে স্টিফেন ম্যানসনেই কাজটা ওরা করে ফেলতে পারত। এতদূরে ফেলে দিয়ে যেত না। যে-ই করে থাকুক, তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, দেব যাতে ব্যাঙ্কক যেতে না পারে। সেই টার্গেটে সে সফল।’

‘হিমাদ্রিদাকে ফোন করব স্যার?’

‘এখন না। বেচারীকে ঘুম থেকে তোলার দরকার নেই। এখনই বেশি লোক জানাজানি করতে চাই না।’

‘দেবদার বাড়িতে তো জানাতেই হবে স্যার।’

‘ভেবে দেখি। খবরটা কীভাবে ওর মাকে দেবো। গেল বছর চণ্ডীতলায় পিকনিকের সময় তুইও তো গেছিলি। দেখেছিস, ভদ্রমহিলা কী রকম ছেলেঅন্ত প্রাণ। এ খবর কানে গেলে ওঁর হার্টফেল হয়ে যাবে।’

‘স্যার, দেবদা সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন তো?’

‘লেট আস হোপ সো। ভগবান এতটা নিষ্ঠুর হতে পারেন না। আমার চিন্তা হচ্ছে মিলেনার জন্য। দেবের খারাপ কিছু হয়ে গেলে মেয়েটা পাগল হয়ে যাবে। মেয়েটাকে একবার ফোন করবি?’

‘ঠিক বলেছেন স্যার।’ কথাটা বলে অনি মোবাইলের বাটন টিপতে লাগল। বুদ্ধি করে ও স্পিকার অন করে দিয়েছে। এক ভদ্রমহিলার রাশভারী গলা শুনতে পেলেন শিখিন, ‘হু ইজ স্পিকিং?’

‘ম্যাডাম, আমি অনিরুদ্ধ। ফায়ার সার্ভিসে আছি। ফোনটা মিলেনাদিকে দেবেন প্লিজ।’

‘মিলেনা কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। ওকে সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আপনি কি ব্যাপারে কথা বলতে চান?’

‘আমি সিলভার জিম-এর মেম্বার। দেবদূতদার সূত্রেই মিলেনাদির সঙ্গে আমার আলাপ। উনি কোথায়, সেটা জানার জন্যই ফোন করেছি।’

‘মিলেনা এখন ইলিয়ট নার্সিং হোমে। স্টিফেন ম্যানসন থেকে নীচে নেমে আসার সময় ওর শাড়িতে আগুন লেগে গেছিল। আমি ওকে নার্সিং হোমে ভর্তি করেছি।’

‘আপনি কে বলছেন ম্যাডাম?’

‘শান্তা গ্রেগারিয়ান। মিলেনার মা। আচ্ছা, দেবদূতের খবর কোথায় পাওয়া যাবে, বলতে পারেন? যখনই সেন্স আসছে, তখনই আমার মেয়েটা দেবদূতের কথা জিজ্ঞেস করছে।’

ইশারায় অনিকে কিছু বলতে মানা করলেন শিখিন। যাক, মিলেনার একটা খবর অন্তত পাওয়া গেছে। যদি থার্ড ডিগ্রি বার্ন কেস না হয়, তা হলে দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই। অনি তখনও ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। ও প্রান্ত থেকে শান্তা গ্রেগারিয়ান বলছেন, ‘আমি কিছুই জানি না। মিলেনার বাবা আগামীকাল দুপুরেই কলকাতায় আসছেন। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে ওকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন। জানি না, শেষে উনি কী ডিসিশন নেবেন।’

‘মিলেনাদি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক ভগবানের কাছে সেই প্রার্থনা করি ম্যাডাম। এদিকে দেবদূতদার কোনও খবর পেলে কী করে আপনাকে জানাব?’

‘মিলেনা যে স্কুলে পড়াত, সেখানে খবর দিলেই আমি পেয়ে যাবো। জানেন, সেই স্কুলের নাম?’

পাশ থেকে শিখিন ইঙ্গিত করলেন, হ্যাঁ বলতে। ‘গুড নাইট’ জানিয়ে অনি ফোন ছেড়ে দিল।

হাতিবাগানের গলির ভিতর ড্রিমল্যান্ড নার্সিং হোমে গাড়ি দাঁড় করিয়ে শিখিন দেখলেন, গেটের সামনে স্ট্রেচারের লোকজন নিয়ে বাণীব্রত দাঁড়িয়ে আছে। দেবকে গাড়িতে তোলার পরই বাণীব্রতকে তিনি ফোন করে দিয়েছিলেন। তখন ও বলেছিল, নার্সিং হোমেই আছে। রাখীকে ছেড়ে ও আর রেখা বাড়ি ফিরতে পারেনি। ছোটবেলার বন্ধুত্ব যে কত গভীর হয়, সেটা আরেকবার টের পেয়েছিলেন শিখিন। দেবকে স্ট্রেচারে তোলার সময় বাণীব্রত বলল, ‘তোর ভাগ্য ভাল, রাতের ডিউটিতে যে ডাক্তার আছে, সে আমাদের বিডন স্ট্রিটের ছেলে। ডাক্তার শৌভিক মিত্তির। আমাদের ক্লাবের হুলো মিত্তিরের ভাইপো। লন্ডন থেকে কী সব পাস করে এসেছে।’

হুলো মিত্তির মানে হলধর মিত্র। শিখিন খুব ভালমতন তাঁকে চেনেন। লিফটে করে দেবকে উপরে নিয়ে যাওয়ার পর শিখিন ক্লান্ত হয়ে রিসেপশনের সোফায় বসে পড়লেন। সারাদিনের ধকল তিনি আর সামলাতে পারছেন না। মাথায় অসংখ্য চিন্তা গিজগিজ করছে। চাকরির জায়গাটা আর মসৃণ থাকবে কি না, তা নিয়ে তিনি পরোয়া করেন না। সাসপেন্ড বা ট্রান্সফার করা হলে তিনি কোনও প্রতিবাদই করবেন না। চাকরিটা ছেড়ে দেবেন। দুবাইয়ের এক বিজনেসম্যান রাজারহাটে বিশাল একটা শপিং মল বানাচ্ছেন। সেখান থেকে বেশি মাইনের একটা অফার তিনি দিন দুই আগে পেয়েছেন। কাছাকাছি তিন কামরার একটা ফ্ল্যাট, চব্বিশ ঘণ্টার জন্য গাড়ি। খবরটা একমাত্র জানে রাখী। ও হ্যাঁ বললেই, শিখিন রাজি হয়ে যাবেন।

কাচের সুইংডোর ঠেলে অনি ভিতরে ঢুকে আসছে। ওর হাতে চায়ের কাপ আর মিষ্টি পাউরুটি। অত রাতেও পেসেন্ট পার্টির জন্য বোধহয় পাশেই কোনও চায়ের দোকান খোলা আছে। চায়ের কাপ হাতে তুলে দিয়ে অনি বলল, ‘এর বেশি আর কিছু জুটল না স্যার।’

ছেলেটার হাসিমুখ দেখে মনে ভরে গেল শিখিনের। মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে গেল, ‘হ্যাঁ রে অনি, চাকরিটা যদি আমি ছেড়ে দিই, তা হলে কি তুই খুব দুঃখ পাবি?’

চোখ স্থির হয়ে গেল অনির। বলল, ‘কথাটা মুখেও আনবেন না স্যার। তা হলে আমি দ্বিতীয়বার অনাথ হয়ে যাবো।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *