(পঞ্চাশ)
নজরুল মঞ্চের ভিআইপি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রুস্তম। পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি সুধাংশু লাহিড়ির সঙ্গে ও দেখা করতে এসেছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিয়েছে মউ। কাল রাতে ও বলেছিল, ‘সুধাংশুদার সঙ্গে আমি কথা বলে রেখেছি। কাল কর্মী সম্মেলনের জন্য উনি নজরুল মঞ্চে সারাদিন থাকবেন। তুমি বেলা এগারোটার সময় ভিআইপি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকো। সুধাংশুদার পিএ শ্যামল তোমাকে ডেকে নিয়ে আলাদা ঘরে বসিয়ে দেবে।’
কর্মী সম্মেলনে পার্টির অনেক সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন সুধাংশুদা। কাণাঘুষোয় রুস্তম শুনেছে, পরেশদার জায়গায় ইস্ট ক্যালকাটা ডিস্ট্রিক্ট কমিটির সেক্রেটারি কে হবে, সেই নামটাও না কি উনি অ্যানাউন্স করবেন। আগে কখনও এই ধরনের কর্মী সম্মেলনে আসেনি রুস্তম। আবিদ ভাইজানের সঙ্গে এলেও ওর দৌড় ছিল পার্কিং স্পেস পর্যন্ত। গাড়ির ভিতর ও বসে থাকত। হলঘরের ভিতর ভাইজান কখনও ওকে নিয়ে যাননি। আজ নজরুল মঞ্চে এসে ভিড়ভাট্টা দেখে ওর অস্বস্তি হচ্ছে। পার্টির বড় বড় নেতারা একে একে আসছেন। গাড়ি থেকে নেমে গটগট করে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছেন। রুস্তম প্রায়দিন টিভিতে তাঁদের মুখ দেখে। বাইরে দেখলে মনে হয়, কত সজ্জন। কিন্তু ভিতর ভিতর একেকটা লোভী কুত্তা। রাজ্যটাকে সবাই চুষে খাচ্ছেন। রুস্তম জানে, পার্টিতে নেতাদের ওঠা-পড়া নির্ভর করে, ফান্ড-এর জন্য কে কত মাল জোগাতে আর কামাতে পারছেন, তার উপর। ও আরও জানে, সুধাংশুদার সঙ্গে এই ডিলটাই ওকে করতে হবে।
ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থাকার সময় রুস্তমের মনে হল, শুভঙ্কর যদি আজ জেলের বাইরে থাকত, তাহলে ওই চুতিয়াটাও গাড়ি থেকে নেমে গটগট করে মঞ্চে ঢুকে যেত। কিন্তু, কিসমত কা খেল আর কাকে বলে। ওখন ও জেলের যে সেলে আছে, সেখানে পায়খানার সবথেকে কাছে ওর থাকার জায়গা হয়েছে। রোজ না কি ওকে অন্য কয়েদিদের জামা কাপড় কেচে দিতে হয়। জেলে রেপিস্টদের হাল খুব বাজে। মার্ডারাররা যে সম্মানটুকু পায়, ওরা তাও পায় না। শুভঙ্করকে না কি প্রায়ই মারধর খেতে হচ্ছে নীলুর দলের লোকদের কাছে। নীলুকে বলে, সেই ব্যবস্থাটা করে দিয়েছে রুস্তম। ও শুনেছে শুভঙ্কর না কি কাকে বলেছে, জীবনে আর কখনও হানি ট্র্যাপে পড়বে না। আর যদি পলিটিকসে ফিরে আসতে পারে, তা হলে মউ সরকারের জান কয়লা করে দেবে। হানি ট্র্যাপ কথাটার মানে রুস্তম জানত না। ববি বুঝিয়ে দিয়েছে, রেন্ডিদের ফাঁদ।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ একটা ছেলে এসে বলল, ‘আরে রুস্তমদা আপনি এখানে দাঁড়িয়ে? আপনার তো ভিভিআইপি গেটের সামনে থাকার কথা। মউদি বলেনি?’
ছেলেটাকে বিভিন্ন জায়গায় সুধাংশুদার সঙ্গে ও দেখেছে। ও বলল, ‘আমি বোধহয় বুঝতে ভুল করেছি।’
‘চলুন চলুন। এখুনি সিএম এসে পড়বেন। সুধাংশুদা এরপর কারও সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না।’ কথাগুলো বলতে বলতে ছেলেটা হাঁটতে শুরু করল। অলিগলি দিয়ে ও মঞ্চের পিছন দিকের একটা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ল। রুস্তম দেখল, সোফায় সুধাংশুদা কয়েকজনের সঙ্গে বসে আছেন। উনি বললেন, ‘আয় রুস্তম। ইস্ট ক্যালকাটায় তো আজকাল তোর নাম খুব ফেটে গেছে। ডাইভ দিয়ে বোমা লুফছিস। ডাক্তারের স্টেথিকোপ দিয়ে গলায় ফাঁস দিচ্ছিস। পরেশটাকে কি করে সরালি, শুধু এটাই জানি না।’
ঘরের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে। কী বলবে, রুস্তম বুঝতে পারল না। হাতজোড় করে ও নমস্কার জানাল। উল্টোদিকের সোফায় বসাটা ওর উচিত হবে কি না, ও বুঝতে পারল না। কেউ একজন বললেন, ‘তুই আবিদের হয়ে অ্যাকশন করতে যেতি, তাই না?’
সুধাংশুদার ইশারায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘর ফাঁকা হয়ে হয়ে গেল। সময় নষ্ট না করে সুধাংশুদা বললেন, ‘মউ তোর কথা বলছিল। তোর মতো ফাইটার না কি এই মুহূর্তে ইস্ট ক্যালকাটার পার্টিতে কেউ নেই। তা, হ্যাঁ রে, ব্রিগেড গ্রাউন্ডে সমাবেশ হলে কত লোক নিয়ে পারবি রুস্তম?’
‘হাজার কুড়ি। মোটামুটি এই দিকটায় সবাই আমায় চেনে। আমি ডাকলে ইয়াং ছেলেরা আসবে।’
‘বেশ, বেশ।’ শুনে তারিফ করলেন সুধাংশুদা। তারপর বললেন, ‘ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছিস না তো? গোবরায় যে ছেলেটা আমাদের হোল টাইমার তার নামটা কী বল তো?’
মকবুলের নামটাই মনে পড়ল রুস্তমের। কিন্তু ও কোনও উত্তর দেওয়ার আগে সুধাংশুদা ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইস্ট ক্যালকাটা থেকে পরেশ লস্কর পার্টি ফান্ডে ইয়ারলি দু’কোটি টাকা দিত। তুই কত দিতে পারবি রুস্তম?’
‘কত দিতে হবে, বলুন।’
তিন কোটি। পারবি, না কি অন্য কাউকে দায়িত্বটা দেবো। লাইনে কিন্তু আরও একজন দাঁড়িয়ে আছে।’
চোখে চোখ রেখে রুস্তম বলল, ‘ঠিক আছে দাদা, তাই দেবো। প্লাস প্রতি মাসে আপনাকে এক লাখ।’
‘কোত্থেকে দিবি? পরে ফেল করবি না তো? ঠিক করে বল। এখনই সিএমকে দিয়ে তোর নামটা আমি অ্যাপ্রুভ করিয়ে নেবো। তবে, সিএমকে তো জানিস। কোনওকিছু ওর চোখ এড়িয়ে যায় না। পার্টি ফান্ডের জন্য টাকা তুলে নিজে গাপ করলে কিন্তু, ঝুটা ইনজাম দিয়ে সিএম তোকে অন্দর করে দেবে। তোর গুরু অবশ্য ধরা পড়ে গেছিল।’
ইস্ট ক্যালকাটায় বড় বড় হোটেল, অফিস, রেস্টুরেন্ট, হাউসিং কমপ্লেক্স, বস্তি, ভেড়ি… বড় বিল্ডারদের মুখগুলো চোখের সামনে একবার পাক খেয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে মনে মনে রুস্তম অঙ্ক কষে নিল। ও পারবে টাকা তুলতে। ওর পিছনে জাতভাইরাও থাকবে। দায়িত্বটা এখন নিক, তারপর সুধাংশুদের মতো নেতাদের কীভাবে নাচাতে হয়, দেখিয়ে দেবে। খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রুস্তম বলল, ‘কমিটমেন্ট ইজ কমিটমেন্ট সুধাংশুদা। খুদা কসম, আই নেবার ফেল। পরে দেখে নেবেন। আপনার কাছে শুধু একটাই রিকোয়েস্ট, থানার ওসিগুলো যেন আমার কোনও কাজে বাগড়া না দেয়।’
‘দেবে না। গান্ডুগুলো রোজ তোর অফিসে গিয়ে মুখ দেখিয়ে আসবে। যদি কাউকে বদলি করতে হয়, এখনই আমায় জানিয়ে দিস। আর হ্যাঁ, পরেশ লস্কর যে অফিসটায় বসত, বোম্ব ব্লাস্টের পর সেটার হাল তো তুই জানিস। ইস্ট ক্যালকাটা জোনের অফিসটা কি তুই সার্কাস অ্যাভেনিউতে নিয়ে যাবি? তা হলে সেইরকম সার্কুলার দিয়ে পার্টি ওয়ার্কারদের জানিয়ে দিতে হবে।’
রুস্তম বলল, ‘আমার অফিসে শিফট করলে ভাল হয়।’
‘বেশ তা হলে ওই কথাই রইল। আমি আজই তোর নামটা অ্যানাউন্স করে দিচ্ছি। কীভাবে তুই টাকাটা পার্টি ফান্ডে দিবি আমাকে জানিয়ে দিস। অনেক সরকারী নিয়মকানুন আছে।’
রুস্তম বলল, ‘আমি দু’কিস্তিতে টাকা দেবো সুধাংশুদা। প্রথম কিস্তির টাকা কাল কোথায় পাঠাতে হবে বলে দেবেন। আমার পিএ গিয়ে দিয়ে আসবে।’
সুধাংশুদা কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ দরজা খুলে কেউ একজন খবর দিল, সিএম এসে গেছেন। শুনে সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন সুধাংশুদা। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘পার্টি একজন ল’ইয়ার তোর সঙ্গে গিয়ে দেখা করবে। কবে যাবে, তোকে পরে জানিয়ে দেবো। আমার টাকাটা তুই ক্যাশ দিয়ে দিস। কাল পাঠাতে যেন ভুলিস না।’
ঘর ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল রুস্তম। পার্টির ইস্ট ক্যালকাটা জোনের সেক্রেটারি! আবিদ ভাইজানও এই পোস্টে যাওয়ার কথা কখনও ভাবেনি। নজরুল মঞ্চের বাইরে বেরিয়ে ও দেখল, কর্মীরা সবাই ভিতরে ঢুকে গেছে। তবে এখনও মিছিল আসছে গোলপার্কের দিক থেকে। এরা গিয়ে সিএম-এর বক্তৃতা শুনবে। তারপর প্যাকেটের মাটন-বিরিয়ানি খেয়ে বাড়ি ফিরবে। হাতে এত ফালতু সময় নেই রুস্তমের। মউ মাঝে মাঝে বলে, ‘টাইম ইজ মানি। বুঝলে রুস্তমদা। এটা যে বুঝতে পারে, সুখ তার পায়ে এসে গড়াগড়ি খায়। এক মুহূর্ত বসে থেকো না। কামিয়ে নাও। কামিয়ে যাও।’ দ্য ফর্টি টু’ বিল্ডিংয়ে বসে মদ খেতে খেতে মউ কথাগুলো মন্দ বলে না। পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে ওই মেয়েটাই আজ সেক্রেটারির পোস্টটা পাইয়ে দিল। রুস্তম ওকে প্রমিস করেছে, দু’লাখ টাকা দেবে। টাকাটা আজই দিতে হবে।
ওর এসইউভি গাড়িটা গোলপার্কের কাছাকাছি পার্ক করা আছে। ওইটুকু রাস্তা হেঁটে যেতে রুস্তম ঘেমে গেল। ওর পাশ দিয়ে তিরিশ-চল্লিশ জনের একটা মিছিল যাচ্ছে। ব্যানারে লেখা চার নম্বর পুল। সিএম-এর নামে যে ছেলেটা স্লোগান দিচ্ছে, তাকে চিনতে পারল ও। চার নম্বর পুলের কাছে আবিদ ভাইজানের পাশের বাড়িটায় থাকে। তখনই ওর চোখে পড়ল, মিছিলের মাঝখানে হেঁটে যাচ্ছে রাবেয়া। বোরখা পরে আছে, কিন্তু নকাব তোলা। ঝিলিক মারা চোখ দুটোই ওকে চিনিয়ে দিল। প্রায় চার-পাঁচ বছর পর ওকে সামনাসামনি দেখল রুস্তম। ডাক্তারের সঙ্গে নিকাহর সময়ও ওর শরীরটা ছিল লিকলিকে। এখন অনেক ভরাট হয়েছে। মুখের রংটাও অনেক পরিষ্কার। এখনও এক গালে টোল পড়ে। বোরখার আড়ালে থাকা সত্ত্বেও ওর ভরাট দুটো স্তন চোখ টানল রুস্তমের। ওই স্তনে কতবার হাত বোলাতে হয়েছে রুস্তমকে, তা শুধু ও-ই জানে।
এই জগতে কেউ এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে চায় না। ভাইজানের মেয়েও তা হলে পলিটিকসে নেমে পড়ল। সেটা জানাতে ঠিক দিনই মিছিলটা নজরুল মঞ্চে নিয়ে এসেছে। রাবেয়া কি ভাবছে, ভাইজানের জায়গাটা ও নিয়ে নেবে। অত সহজ না কি? ছোটবেলা থেকে রাবেয়াকে ও চেনে। রেললাইনের ধারে বস্তি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ভাইজান যখন ওকে বাড়িতে আশ্রয় দেন, তখন থেকেই। গেটের কাছে সিঁড়ির নীচে সেইসময় রুস্তম রাতের পর রাত কাটিয়েছে। ভাইজানের ফরমাইস খাটত। এই রাবেয়া তখন ওর সঙ্গে চাকরবাকরের মতো ব্যবহার করত। ও যে ভাইজানের জান বাঁচিয়েছিল, সেই কথাটা কিন্তু কেউ মনে রাখেনি। এই রাবেয়ার শরীরে ধীরে ধীরে যৌবন আসতে দেখেছে রুস্তম। যৌন আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তির চেষ্টাও। ওর নিকাহ হয়ে যাওয়ার পর রুস্তম হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। ভাইজানের চোখে পড়ে গেলে ও যে কোনওদিন লাশ হয়ে যেত।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুস্তম এগিয়ে গেল গোলপার্কের দিকে। তখনই পিছন থেকে রাবেয়ার গলা শুনতে পেল, ‘কী রে রুস্তম, না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিস যে?’
দু’তিনদিন আগে ফোনে ‘জনাব রুস্তম’ বলে ডেকে রাবেয়া ব্যঙ্গ করেছিল। ও এখন আর সেই দশ-বারো বছর আগেকার রুস্তম নয়। ও পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘মিছিল থেকে তুমি বেরিয়ে আসবে, ভাবতে পারিনি। হাঁটার জন্য পায়ে ব্যথা করছে না কি?’
কথাটা বলেই অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে ও রাবেয়ার দিকে তাকাল। রাবেয়া বলল, ‘আব্বুজান বেঁচে থাকলে, তোকে দিয়ে পা টিপিয়ে নিতাম। আগে যেমনটা করতাম। কিন্তু এখন তো সম্ভব না। যাক সে কথা, যে কারণে তোকে দাঁড় করালাম, সেটা এখানে শুনবি? না কি অন্য কোথাও বসবি?’
‘আমি এখন সার্কাস অ্যাভেনিউর অফিসে যাচ্ছি। তোমার ইচ্ছে হলে ওখানে যেতে পারো।’
‘চল তা হলে। অনেকদিন আব্বুজানের অফিসে যাইনি।’
রাবেয়াকে সঙ্গে নিয়ে রুস্তম এসইউভিতে এসে বসল। জানলার কাচ তুলে এসি চালিয়ে দেওয়ার পর ও রাবেয়ার গা থেকে পারফিউমের গন্ধ পেল। আগে হগ মার্কেট থেকে ওর জন্য পারফিউম কিনে আনতে হত। নামটাও মনে আছে, ব্রুট। তখনই দাম ছিল সাত-আটশো টাকার মতো। জলের মতো টাকা ওড়াত রাবেয়া। গাড়ি স্টার্ট করার পর ও ব্যঙ্গ করে বলল, ‘তোর কিসমত দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি রে রুস্তম। আগে আব্বুজানের অ্যাম্বাস্যাডর ধোঁয়া পোছা করতিস। এখন আঠারো লাখ টাকার গাড়ি চালাচ্ছিস।’
রুস্তম বলল, ‘তোমার আব্বুজান ওই অ্যাম্বাস্যাডরে চড়ার সুযোগই পেত না। যদি না একদিন আরপিএফের হাত থেকে আমি ভাইজানকে বাঁচাতাম।’
গালে থাপ্পড় খেয়ে রাবেয়া চুপ করে গেল। গাড়ি সার্কাস অ্যাভেনিউতে পৌঁছনো পর্যন্ত চুপ করে রইল। রুস্তম ঠিকই করে নিল, মেয়েটাকে আপারহ্যান্ড নিতে দেবে না। ওকে আজই বুঝিয়ে দেবে, পলিটিকসে উত্তরাধিকার সূত্রে জায়গা পাওয়ার দিন চলে গেছে। অফিস আজ একেবারে ফাঁকা। রুস্তম সবাইকে নজরুল মঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছে। ফিরে এসে ওরা যে সবাই লাফালাফি করবে, সেটাও ও জানে। তার ইন্তেজামও ওকে করে রাখতে হবে। ফোন করে কয়েক বোতল হুইস্কি আনিয়ে রাখবে। তালা খুলে অফিসে ঢুকে রুস্তম লক্ষ করতে লাগল রাবেয়াকে। যা আশা করেছিল, সেটাই হল। রাবেয়া বলল, ‘ইয়াআল্লাহ, পুরো অফিসটাই যে তুই পাল্টে ফেলেছিস রুস্তম! কর্পোরেট অফিস বলে মনে হচ্ছে।’
রুস্তম বলল, ‘বড় লেভেলের পলিটিকস করার জন্য ভিশন দরকার, বুঝলে রাবেয়া। ভাইজানের সেটা ছিল না। তবে ভাইজান যে ঘরটায় বসে মজা লুটতেন, সেটা এখনও ভাঙিনি। দেখবে না কি?
কথাটা বলে রুস্তম আর দাঁড়াল না। ভিতরের বেড রুমে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে, সেইসঙ্গে এসিও চালিয়ে দিল। রাতে কোনও কারণে দেরি হলে, ও এই ঘরে শুয়ে পড়ে। অফিস পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পাশের বস্তির একটা মেয়েকে রেখেছে ও। সকালে এসে সে সব সাজিয়ে দিয়ে যায়। ডিভানে নরম গদির উপর চাদর টানটান। বেডরুমে ঢুকে রাবেয়া বলে উঠল, ‘ইনসাল্লাহ, তুই এই ঘরেই থাকিস না কি রুস্তম?’
উত্তর না দিয়ে সোফায় বসে রুস্তম বলল, ‘এবার বলো, তোমার কী বলার আছে। একটু পরেই পার্টির লোকেরা এসে পড়বে। তখন আর কথা বলার সময় পাবো না।’
বোরখা খুলে সোফায় ছুঁড়ে ফেলে দিল রাবেয়া। ওর পরনে লাল কুর্তি, আর জিনসের প্যান্ট। বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ও বলল, ‘চার নম্বর পুলের ছেলেরা আমায় বলল, আব্বুজানকে না কি মার্ডার করা হয়েছে? কথাটা কি সত্যি? আম্মিজান জানতে চেয়েছে।’
কথাটা তাহলে লিক হয়ে গিয়েছে। ববি, মান্টি ছাড়া আর জানত নার্সিং হোমের ডাক্তার ও রহমত। প্রশ্নটা শুনেই রুস্তম সতর্ক হয়ে গেল। ও বলল, ‘নার্সিং হোমে সেটা জানতে চাইছ না কেন?’
‘লোক পাঠিয়ে ছিলাম। কিন্তু তোর ভয়ে কেউ কিছু বলছে না। আমার ছেলেদের ধারণা, মার্ডার তুই করিয়েছিস। আর কারোর এই সাহস হবে না। এতদিন আব্বুজানের নিমক খেয়েছিস। তোর ভয় হল না, জাহান্নুমে যেতে হবে?’
রাবেয়ার ভারী স্তন দুটো একদিকে হেলে রয়েছে। একটা বিছানায় বিশ্রাম নিচ্ছে, অন্যটা প্রায় ছুইছুই। স্তন দুটোকে নিয়ে আগের মতো, খেলা করার ইচ্ছে দমিয়ে রাখল রুস্তম। হানি ট্র্যাপ হতে পারে। রেন্ডিটা এসেইছে ওই কারণে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ওকে অফিস থেকে বিদেয় করে দিতে হবে। ও বলল, ‘তোমাকে একটা পেনড্রাইভ দিতে পারি। দেখলেই বুঝবে, কন্সপিরেসি কার? কিন্তু কেন সে এই কাজটা করেছিল, তার উত্তর আমি দিতে পারব না।’
সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে টেবলের ড্রয়ার থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে আনল রুস্তম। তারপর সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাড়িতে গিয়ে একা একা দেখো। ফালতু আমায় জড়াবে না।’
পেনড্রাইভটা দুই স্তরের মাঝে ব্রা-তে ঢুকিয়ে দিয়ে রাবেয়া বলল, ‘বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না রে রুস্তম।
তুই আমার কাছে আয়। পা দুটো টনটন করছে। আগে মতোন খানিকক্ষণ টিপে দে।’ কথাটা বলেই রাবেয়া পা দুটো দু’পাশে ছড়িয়ে দিল।
(একান্ন)
তলপেটে মারাত্মক যন্ত্রণা হচ্ছে। সোফায় উঠে বসে কোয়েল আশপাশে চোখ বোলাল, হ্যান্ডব্যাগের জন্য। ওর ভিতর মোবাইল সেট আছে। কোয়েল দেখল, হ্যান্ডব্যাগটা উল্টো দিকের সোফায় পড়ে আছে। নিকিকে ও বলল, ‘ক্যান ইউ ব্রিং দ্যাট ব্যাগ ফর মি প্লিজ?’
নিকি চট করে ব্যাগটা এনে দিল। চেন খুলে কোয়েল দেখতে পেল, দু’হাজার টাকার নোটগুলো ব্যাগের ভিতর নেই। অথচ নোটগুলো ও ব্যাগের ভিতরই রেখেছিল। তার মানে ওকে রেপ করার পর সুরজিত ভাল্লা ব্যাগ থেকে টাকাগুলোও সরিয়ে দিয়েছেন। মোবাইল সেট খোঁজার সময় কোয়েল লক্ষ করল, ওর হাতের আঙুলগুলো কাঁপছে। হাতের তালু আর আঙুল রক্তে চটচট করছে। কামিজে রক্ত মোছার সময় কোয়েল স্থির করতে পারল না, সেট খুঁজে পেলে ফোনটা ও কাকে করবে? দেবদাকে করার কোনও প্রশ্নই নেই। বেচারি ব্যাঙ্কক যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তমাল কী করছে, সেটা আন্দাজ করতে পারে, এখন ক’টা বাজে সেটা জানতে পারলে। দেওয়াল ঘড়িতে ও দেখল, বেলা প্রায় চারটে। স্টিফেন ম্যানসনে ও যখন ঢুকেছিল, তখন বেলা বারোটা বাজতে পাঁচ। তার মানে, ঘণ্টা চারেক ও অজ্ঞান হয়ে সোফায় পড়েছিল।
হ্যান্ডব্যাগ তন্নতন্ন করে খুঁজেও মোবাইল সেট পেল না কোয়েল। তার মানে সুরজিত ভাল্লা টাকা আরা ফোন দুটোই হাপিশ করে দিয়েছেন। ফের একই প্রশ্ন ওর মাথায় ঘুরে ফিরে এল, কী বলবে ও তমালকে? মিসেস ভাল্লার হাসবেন্ড ওকে রেপ করেছে? শুনলেই তমাল হয়তো দৌড়ে আসবে স্টিফেন ম্যানসনে। ওকে যেতে বাধ্য করবে পার্ক স্ট্রিট থানায়। খবরটা পেলে মিডিয়া লুফে নেবে। লোকজন জানাজানি হয়ে যাবে। কী করে ও মুখ দেখাবে বাড়িতে জেঠিমা-খুড়িমাদের কাছে। কে আসবে ভবানীপুরে ওর যোগাসেন্টারে, বা মল্লিকবাজারে ওদের রেস্টুরেন্টে? তমালের বাড়ির লোকেরাই বা ওকে অ্যাকসেপ্ট করবেন কেন? সারাজীবন তমালের বার্ডেন হয়ে ওকে বেঁচে থাকতে হবে। এই পার্ক স্ট্রিটেই বছর দুয়েক আগে গাড়ির মধ্যে রেপড হয়েছিল একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে। লোকলজ্জার পরোয়া করেনি মেয়েটা। কিন্তু দুর্নাম নিয়ে শেষপর্যন্ত মেয়েটা মরেই গেল। ধর্ষিতা মেয়ের বেঁচে থাকাটা, মরে যাওয়ারই সমান।
নিকি ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় কাঁদছিল, চোখের জল শুকিয়ে গেছে। ওর চোখের সামনেই হয়তো জানোয়ারটা রেপ করেছে। একটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ওকে হয়তো সারাজীবন তাড়া করে বেড়াবে। কোয়েল বুঝতে পারল না, মিসেস ভাল্লা ফ্ল্যাটে থাকা সত্ত্বেও, সুরজিত ওকে রেপ করার সাহস পেলেন কী করে? তা হলে কি দু’জনে যোগসাজশ করে ওকে ডেকে এনেছিলেন? একরাশ প্রশ্ন ওর মাথায় ঘোরাফেরা করতে লাগল। কোনও রকমে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কোয়েল নিকিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হোয়ার ইজ দ্য ওয়াশ রুম?’
উল্টোদিকে একটা দরজা দেখিয়ে দিল নিকি। দরজায় কাচের উপর আঁকা স্নানরতা একটা মেয়ে। আগে এতদিন ওই লিভিং রুমে এসে কোয়েল বসেছে। কিন্তু কোনওদিন দরজাটা লক্ষ করেনি। ওয়াশরুমে যাওয়া দরকারই কোনওদিন ওর হয়নি। এমনিতে ইনফেকশনের ভয়ে পেসেন্টদের বাড়িতে ও কখনও ওয়াশরুম ব্যবহার করে না। জিম-এর ওয়াশরুম স্যানিটাইজ করা থাকে। বাড়ির বাইরে থাকলে তাই কোয়েল ইউরিন করার জন্য শুধু সেখানে যায়। সোফা থেকে ওঠার সময় তলপেটের ব্যথায় ওর চোখ মুখ কুঁচকে উঠল। যোনিমুখ মারাত্মক জ্বালা করছে। জীবনে আরও একবার ও এই জ্বলুনিটা অনুভব করেছিল। নিকির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে কোয়েল বলল, ‘উইল ইউ হেল্প মি ডিয়ার। প্লিজ টেক মি টু দ্য ওয়াশরুম।’
বাচ্চা মেয়েটা এতদিন চকোলোটের জন্য হাত বাড়িয়ে দিত। আজ ওর সাহারা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শরীর ঝুঁকিয়ে মেয়েটার হাত ধরে, কোনওরকমে পা ফেলে কোয়েল ওয়াশরুম পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তখনই নিকি ফিসফিস করে বলল, ‘আন্টি প্লিজ ডু ইট ফাস্ট। সুরজিত উড ওয়েক আপ ভেরি সুন।’
‘হোয়ার ইজ হি নাউ?’
‘স্লিপিং ইন দ্য বেডরুম। ইউ ট্রাই টু লিভ দিস প্লেস অ্যাজ সুন অ্যাস পসিবল।’
ওকে ধর্ষণ করে সুরজিত ভাল্লা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন! রাগে মাথার ভেতরটা জ্বলে উঠল কোয়েলের। ও জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়ার ইজ ইয়োর ন্যানি?’
‘উনি বুটিকে গেছেন বেলা এগারোটার সময়। সুরজিতকে বলে গেছেন, ইভনিংয়ে ফিরবেন।’
মায়ের বাবাকে নিকি নাম ধরে ডাকছে কেন, জানার খুব কৌতূহল হল কোয়েলের। প্রশ্নটা করতেই নিকি বলল, ‘হি ইজ নট মাই মম’স ফাদার। সুরজিত ইজ ন্যানি’জ ফ্রেন্ড। টু নাইট হি উড লিভ ফর দেলহি।’
ওয়াশরুমে ঢুকে কোয়েল দরজা বন্ধ করে দিল। নিকির কথাগুলো শুনে ঘেন্নায় গা রি রি করতে লাগল ওর। বন্ধুকে স্বামী বলে পরিচয় দিয়ে মিসেস ভাল্লা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন। নিকির মা-ই বা কি করে সেটা মেনে নিচ্ছে? হাই সোসাইটির ফ্যামিলিগুলো কি এ রকমই হয়? সালোয়ারকামিজ খুলে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে পড়ল কোয়েল। মাথা দিয়ে ঠান্ডা জলের ধারা নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। সাদা মার্বেল পাথরের মেঝেতে রক্ত ধুয়ে যাচ্ছে নর্দমার দিকে। কোয়েল জানে, ও যে ধর্ষিতা হয়েছে, তার সব প্রমাণ মুছে দিচ্ছে। ওর উচিত ছিল, রক্তাক্ত পোশাকেই থানায় চলে যাওয়া। কিন্তু বিচার চাইতে ও অন্য মেয়েদের মতো পুলিশ-উকিল-আদালতের কাছে যাবে না। ও আজকেই সুরজিত ভাল্লাকে শাস্তি দিয়ে যাবে। সেইসঙ্গে মুখোমুখি হলে ওই সাধুটাকেই, যিনি খবরটা দিতে গেছিলেন ওদের মল্লিকবাজারের বাড়িতে।
বাইরে কোথাও বেরলে কোয়েল হ্যান্ডব্যাগের ভিতর বাড়তি সেট ড্রেস নিয়ে আসে। ফিজিওথেরাপি বা যোগার কোনও কোনও পেসেন্ট চান না, ঘেমে যাওয়া পোশাকে ও ব্যায়ামগুলো করাক। কারোর বাড়িতে গেলে কোয়েল তাই পোশাক বদলে নেয় চেঞ্জিং রুমে গিয়ে। বাড়তি পোশাক ওকে আজ বাঁচিয়ে দিল। হ্যান্ডব্যাগ থেকে সালোয়ারকামিজ বের করার সময় ও শুনতে পেল, নীচে রাস্তা থেকে হই হল্লার আওয়াজ ভেসে আসছে। ওয়াশরুমের পূর্বদিকের জানলাটা অল্প খোলা। আওয়াজটা কিসের কোয়েল বুঝতে পারল না। মিডলটন রো রাস্তাটা দিনের সবসময় ব্যস্ত থাকে। হয়তো কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কলকাতায় হুজুগে লোকের তো অভাব নেই। লোকজন ছুটে গিয়ে চোটপাট করছে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই কোয়েল ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল। দরজার বাইরে তখনও নিকি দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে বলল, ‘আন্টি, আই ফাউন্ড ইয়োর মোবাইল সেট। ইট ওয়াজ আন্ডার দ্য পিলো।’
নিকির হাত থেকে তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে কল লিস্টে কোয়েল দেখল, তমাল আর অনিরুদ্ধর অনেকগুলো মিসড কল। তার মধ্যে তমালেরই দশটা। আশ্চর্য, এই দু’জনই মাত্র জানে, ও আজ স্টিফেন ম্যানসনে আসবে। ওকে কি এমন দরকার, দু’জন মিলে এতবার ফোন করেছে? তমালকে পাল্টা ফোন করবে বলেও কোয়েল বাটন থেকে আঙুল তুলে নিল। না, এখন দরকার নেই। এখন কথা বলতে গেলে সুরজিত ভাল্লার ঘুম ভেঙে যেতে পারে। সোফায় উপর সেটটা ফেলে রেখে কোয়েল জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়ার ইজ ইয়োর ন্যানি’জ ফ্রেন্ড? ইজ হি স্টিল স্লিপিং?’
নিকি ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ইয়েস আন্টি। প্লিজ, ডোন্ট গো দেয়ার। হি উড কিল ইউ।’
‘নিকি ডিয়ার, ডিড ইউ সি, হি ওয়াজ টর্চারিং মি?’
‘ইয়েস আন্টি। হি ইজ আ মনস্টার।’
‘ডোন্ট ইউ থিংক, আই শুড পানিশ হিম?’
শুনে নিকি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। ইশারায় চুপ করে মেয়েটাকে সোফায় বসে থাকতে বলে কোয়েল এগিয়ে গেল বেড রুমের দিকে। আগে কখনও মিসেস ভাল্লার বেডরুমে আসেনি ও। সিলভার হোটেলের রুমগুলোর মতোই সাজানো। ডিভানের উপর সুরজিত ভাল্লা চিত হয়ে শুয়ে আছেন। পাশেই ছোট্ট টেবলের উপর মদের বোতল ও গ্লাস। টেবলের উপর কোল্ড ড্রিঙ্কসের সেই গ্লাসটাও কোয়েল দেখতে পেল, যাতে উনি অজ্ঞান করার ওষুধ মিশিয়ে ছিলেন। দেখেই বুঝল, সুরজিত ভাল্লা এত মদ্যপান করেছেন, সম্ভবত হুঁশ নেই। বুকটা হাঁপরের মতো ওঠা-নামা করছে। বিছানার পশ্চিম দিকের জানালাটা খোলা। ঘরের ভিতর গোধূলির আলো। লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকার সময় তলপেটের ব্যথাটা ফের অনুভব করল কোয়েল। অন্য কোনও মেয়ে হলে উঠে দাঁড়াতে পারত না। কিন্তু ও যোগা করে। শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্য মেয়েদের থেকে বেশি। একটা নিরপরাধ মেয়েকে রেপ করে জানোয়ারটা দিল্লি পালিয়ে যাচ্ছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কোয়েল ঠিক করে নিল, সঙ্গে নিয়ে আসা ছুরিটা কাজে লাগাবে।
ডিভান ঘুরে কোয়েল মাথার দিকে চলে গেল। আস্তিন থেকে ছুরিটা বের করার সময় ওর হাত এতটুকুও কাঁপল না। সুরজিত ভাল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে ও লক্ষ্য স্থির করে নিল। দশ বছর আগেও একবার ওকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সুরজিত ভাল্লার বদলে সেদিন বিছানায় ঠিক এমনভাবেই শুয়ে ছিলেন যোগাগুরু নিত্যসুন্দর দাস। জনাইয়ে অল বেঙ্গল যোগা কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল সেদিন কোয়েল। কলকাতার পার্টিসিপেন্টরা যে যার মতো ট্রেন ধরে ফিরে এসেছিল। কিন্তু প্রাইজ নেওয়ার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় কোয়েলকে। রাত দশটার সময় স্টেশনে এসে ও জানতে পারে, লাস্ট ট্রেন বর্ধমান থেকে ছাড়েনি। বাতিল হয়ে গেছে।
কর্ড লাইনে ভোরের ট্রেন সেই সাড়ে চারটেয়। শুনশান প্ল্যাটফরম। সাররাত একা স্টেশনে কাটাবে কী করে, ভাবার সময় হঠাৎ ওর মনে পড়ে, কাছেই একটা ক্লাবঘরে রয়ে গেছেন নিত্যদা। সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে কোয়েলের। হেঁটে ক্লাবঘরে ফিরে আসার পর ওকে দেখে খুশি হয়েছিলেন নিত্যদা। ‘এখানে কোথাও শুয়ে পড়। কাল সকালে আমার সঙ্গে ফিরে যাবি।’ কিট ব্যাগটাকে বালিশ করে ঘরের এককোণে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল কোয়েল। হঠাৎ চোখ খুলে ও দেখে, নিত্যদা ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এতদিনের চেনা লোকটা অমানুষ হয়ে গেছেন। দু’চার মিনিট ধস্তাধস্তি করে কোয়েল হাল ছেড়ে দেয়। তখনই নিত্যদা বলেছিলেন, ‘তোকে বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন করে দিলাম, তার মূল্য দিবি না?’ ধর্ষিতা হওয়ার পর নিঃসাড় হয়ে শুয়ে ছিল কোয়েল। নিত্যদা হয়তো ভেবে নিয়েছিলেন, ও কাউকে কিছু বলবে না।
সেদিন নিত্যদার গলায় ছুরিটা যেভাবে চালিয়ে দিয়েছিল, আজও ঠান্ডা মাথায় সেই কাজটা করল কোয়েল। সুরজিত ভাল্লার গলা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে, মুহূর্তে চাদরের রং বদলে দিল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ খুলে জানোয়ারটা বোধহয় কাউকে খুঁজছিল। তারপরই ওর মাথাটা একদিকে কাত হয়ে গেল। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বালিশটা মুখের উপর খানিকক্ষণ চেপে রইল কোয়েল। তারপর চাদরে ছুরির রক্ত মুছে ও হ্যান্ডব্যাগের ভিতরে ঢুকিয়ে রাখল। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় ও দেখতে পেল, পর্দার খুট ধরে নিকি বিস্ফারিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা উচিত না। দ্রুত পায়ে ও মিসেস ভাল্লার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল। উল্টোদিকেই মিলেনাদের ফ্ল্যাট। কিন্তু ওর কামিজে রক্তের ছিটে লেগে আছে। এই অবস্থায় ওর কাছে যাওয়া চলবে না। লিফটের বাটন টিপে দু’এক মিনিট অপেক্ষা করে, কী মনে হওয়ায় কোয়েল সিঁড়ির দিকে দৌড়ল। স্টিফেন ম্যানসন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অগে কেউ যেন ওকে না দেখে ফেলে।
সিঁড়ি দিয়ে দুটো ফ্লোর নেমে আসার পর কোয়েলের মনে হল, নীচে গুরুতর কিছু ঘটে গেছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী উপরের দিকে উঠে আসছে। লোকজনের কথাবার্তায় আগুন শব্দটা ও শুনতে পেল। সর্বনাশ, স্টিফেন ম্যানসনের কোথাও আগুন লেগেছে না কি? হঠাৎই ওর অনিরুদ্ধর কথা মনে পড়ল। ছেলেটা বেশ কিছুদিন আগে দেবদাকে বলেছিল, স্টিফেন ম্যানসনে দু’বার আগুন লেগেছে। তৃতীয়বার লাগলে কিন্তু সব ধ্বংস করে দেবে। ওর কথাই সত্যি হয়ে গেল না কি। সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই কোয়েল ফোন করল অনিকে। ও কিছু বলার আগেই ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এখন কোথায় ম্যাডামদি? স্টিফেন ম্যানসনে না কি? থাকলে চট করে বেরিয়ে এলো। স্টিফেন ম্যানসনের একটা দিক এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে।’
ধোঁয়ায় ক্রমশ ভরে যাচ্ছে থার্ড ফ্লোর। নাক-মুখে ধোঁয়া ঢুকে যাওয়ায় কোয়েল কাশতে শুরু করল। ওর হাত থেকে ব্যাগটা নীচে পড়ে গেল। উবু হয়ে বলে সেটা খোঁজার সময় ওর নিকির কথা মনে পড়ল। ও বেরিয়ে আসর সময় দেখেছিল, মেয়েটা সদর দরজায় দাঁড়িয়ে। এখন একা রয়েছে ফ্ল্যাটে। নিকি জানতেও পারবে না, কী মারাত্মক বিপদ ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে। ওকে বের করে নিয়ে যেতেই হবে। কথাটা মনে হওয়ায় কোয়েল ফের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পর ভিজে টাওয়েল মুখে জড়িয়ে নিয়ে, নিকির হাত ধরে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসার সময় কোয়েল দেখল, এক নম্বর লিফটটা ফিফথ ফ্লোরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটু আগে ও বাটন টিপে গেছিল। যাক, কোনও রকমে গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছে গেলে প্রাণে বেঁচে যাবে। সেই আশায় লিফটের ভিতর ঢুকে পড়ল দু’জন। প্রথম যেদিন ও স্টিফেন ম্যানসনে আসে, সেদিন এই লিফটেই ও আটকে পড়েছিল কোয়েল। মনে মনে ও প্রার্থনা করল, আজ যেন কোথাও দাঁড়িয়ে না পড়ে।
(বাহান্ন)
ফ্যামিলি অ্যালবাম দেখাতে শুরু করেছে মিলেনা। লিভিং রুমের সোফায় ওরা দু’জন বসে। প্রথম পাতাটা উল্টে মিলেনা বলল, ‘এই দেখো, ইনি আমার ড্যাডি এরিক গ্রেগারিয়ান। কী হ্যান্ডসাম তাই না?’
দেব বলল, ‘রিয়েলি একেবারে মেল গিবসনের মতো দেখতে। এই অ্যালবামটা তুমি কোথায় পেলে? আগে তো কখনও বলোনি।’
‘বলব কী করে? আজই তো নাজমা খুঁজে বের করল।’ কথাটা বলেই মিলেনা পাতা ওল্টাল। ‘এই দেখো, দার্জিলিংয়ে এই হোটেলটা আগে আমারা ড্যাডির ছিল। ছোটবেলাটা আমি এই হোটেলেই কাটিয়েছি।’
ছবিতে এরিক হোটেলের লনে বসে আছেন। পরনে স্যুট-কোট-টাই। দূরে পাহাড়ের চূড়োয় বরফের উপর রোদ্দুর এসে পড়েছে। চূড়োটাকে মনে হচ্ছে, গলানো সোনায় মোড়া। দেব কোনওদিন দার্জিলিংয়ে যায়নি। তবুও, আন্দাজেই বলল, ‘পিছনের ওই পিকটা কি কাঞ্চনজঙ্ঘা?’
‘ঠিক বলেছ। আমাদের হোটেলটা এত সুন্দর জায়গায় ছিল, যে কোনও রুমের বিছানা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেত। ব্রিটিশ পিরিয়ডে সামারের সময় গভর্নমেণ্ট অফিসাররা আমাদের হোটেলে গিয়ে থাকতেন।’
‘হোটেলটা এখন তোমাদের নেই?’
‘না। হোটেলে একবার মারাত্মক আগুন লেগেছিল। তখন গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন তুঙ্গে। ড্যাডির কাছে গোর্খা নেতারা প্রায়ই জোর করে টাকাপয়সা আদায় করতেন। উনি অশান্তির ভয়ে হোটেল বিক্রি করে দেন।’
মিলেনা একের পর এক পাতা ওল্টাচ্ছে, আর ফ্যামিলি মেম্বারদের চিনিয়ে দিচ্ছে। কখনও বাচ্চা মেয়ের মতো উচ্ছ্বসিত, কখনও গম্ভীর। ‘এই ছবিটা কার বলো তো? ভাল করে দেখে বলবে কিন্তু।’ মিলেনার কথা শুনে অ্যালবামটা কেড়ে নিল দেব। ভাল করে দেখার জন্য। প্যারাম্বুলেটরে বসে এক-দেড় বছর বয়সি একটা ফুটফুটে মেয়ে। একেবারে রাজকন্যার মতো দেখতে। হোটেলের ব্যাকইয়ার্ডে ফুলের গাছগাছালির মাঝে সেই প্যারাম্বুলেটর ঠেলছেন এক ভদ্রমহিলা। মিলেনা ছাড়া বাচ্চাটা আর কেউ হতেই পারে না। তবুও দেব মজা করে বলল, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে ডল পুতুল।’
‘আরে বুদ্ধু, এটা আমি।’ কথাটা বলে মিলেনা ওর আরও কাছ ঘেঁষে বসল। নিজেই অ্যালবামের পাতা উল্টে দিল। হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলে পার্টি হচ্ছে। বিরাট কেকের উপর লেখা ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু মিলেনা।’ তার মানে মিলেনার জন্মদিনের পার্টি। ও কেকের টুকরো তুলে দিচ্ছে এরিকের মুখে। আশপাশের অনেকেই হাততালি দিচ্ছেন। ছবিটা দেখিয়ে মিলেনা বলল, ‘এটা আমার চার বছর বয়েসের বার্থ ডে পার্টি। এর পরের বছরই ড্যাডি আমাকে ভর্তি করে দিয়েছিল কালিম্পংয়ের স্কুলে।’
আজ বেলা এগারোটার সময় মনে মনে খুব দুঃশ্চিন্তা নিয়ে দেব এসে ঢুকেছিল স্টিফেন ম্যানসনে। কেননা, সকালে নাজমা ফোন করে বলেছিল, ‘দিদি রাতে ঘুমায়নি। খুব কান্নাকাটি করছে।’ কিন্তু ওর ফ্ল্যাটে এসে বিষণ্ণতার চিহ্নমাত্র দেখতে পায়নি দেব। বরং অনেকদিনের তুলনায় অনেক হাসিখুশি। নাজমা কিচেনে ঢুকে যাওয়ার পর মিলেনা ওকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ চুমু দিয়েছিল। তারপর বলেছিল, ‘একটা গুড নিউজ আছে। ড্যাডি ফোন করেছিলেন। আমাদের রিলেশনটা উনি মেনে নিয়েছেন। পরে তোমাকে সব গুছিয়ে বলছি। আগে আমি স্নান করে আসি। উফ, কাল রাত থেকে আমার উপর দিয়ে যা ঝড় গেল…।’
দেব তখন মনে মনে বলেছিল, সকাল থেকে আমার উপর দিয়েও আয়লা গেছে। মিলেনা বাথরুমে ঢুকে যাওয়ার পর ও লিভিং রুমের সোফায় বসে পড়ল। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই ব্যাঙ্ককে চলে যাবে। এতগুলো লোক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা কিছু ওকে করেই আসতে হবে। মাঝে মিলেনা ওকে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মন্দিরে আচার্য্যদেবের কাছে নিয়ে গেছিল। আশীর্বাদ করে উনি কয়েকটা ভাল কথা বললেন। ‘স্বপ্ন পূরণ করাটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় দেবদূত। লক্ষ্য পূরণ করাটাই স্বপ্ন হওয়া উচিত।’ কী চমৎকার একটা কথা। কত সহজভাবে সেদিন বললেন আচার্য্যদেব! ‘কখনো ভেঙে পড়ো না। শুধু মনে রেখো গাছেরাও প্রতিবছর তাদের সবুজ পাতা হারায়। কিন্তু কিছুদিন অপেক্ষা করার পর তারা আবার সবুজ পাতা ফিরে পায়।’ লক্ষ্য পূরণ করতেই আজ দেব যাচ্ছে ব্যাঙ্ককে। যাওয়ার আগে ওর আফসোস হচ্ছে, এত প্রিয় ওর জিম আজ বন্ধ হয়ে গেল। তবুও ও ভেঙে পড়বে না। আচার্যদেব বলেছেন, ‘ধৈর্য ধরো, সেরা সময় পাওয়ার জন্য মাঝে মধ্যে খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।’ আচার্য্যের কথা ভুল হতে পারে না।
অ্যালবাম দেখতে বসার আগে মিলেনাকে ও বলেছিল জিম বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। মিলেনা তখন রহস্য করে বলে, ‘চিন্তা কোরো না। জিম তোমার হাতেই থাকবে। শুধু মালিক বদলাবে।’
বুঝতে না পেরে দেব জিজ্ঞেস করে, ‘তার মানে?’
‘তোমাকে একটা সুখবর দিচ্ছি দেবদূত। আমার ড্যাডি সিলভার হোটেল আর জিম-এর মেজর শেয়ার কিনে নিচ্ছেন। তার মানে, আনন্দী শরাফ আর এমডি থাকছেন না। খুব শিগগির এই হাত বদলটা হয়ে যাবে। তখন কিন্তু আমার আন্ডারে কাজ করতে হবে তোমাকে।’
মিলেনা কখনো বারফাট্টাই মারে না। যা বলছে, নিশ্চয়ই সত্যি। কত টাকা আছে ওর ড্যাডির? সিলভার হোটেল কিনে নিচ্ছেন? মজা করে দেব বলল, ‘তুমি এম ডি হলে আমাকে দিয়ে কোনও কাজ করিও না প্লিজ। বিনে পয়সায় মাইনেটা দিও। আমি তা হলে মি. অলিম্পিয়ার জন্য তৈরি হতে পারব। তবে কথা দিচ্ছি, তোমার বাচ্চাদের আমি খেয়াল রাখব।’
ওর বুকে ঘুসি মেরে মিলেনা বলল, ‘হাউ ডেয়ার ইউ। এখনই বাচ্চার কথা ভাবছ!’
‘কেন ভাবব না? আমার কিন্তু মেয়ে চাই মিলেনা। তোমার মতো কিউট একটা মেয়ে।’
‘একদম না। প্রথমটা ছেলে চাই। না হলে এত বড় বিজনেস কে সামলাবে? আমাদের কমিউনিটিতে ছেলেদের খুব আদর, জানো। মেয়ে হলে সবার মুখ গোমড়া হয়ে যায়।’
‘ভেরি ব্যাড। আমাদের সমাজে কিন্তু উল্টো। প্রথমে মেয়ে হলে লোকে ঘরে লক্ষ্মী এলো। আমার মাকেই দেখো না, সারাজীবন আক্ষেপ করতে শুনলাম, একটা মেয়ে থাকলে ভালো হত। তোর মতো আমাকে জ্বালাত না।’
‘তোমার মা কি আমাকে মেনে নেবেন দেবদূত?’
‘অফকোর্স’। দেব হেসে বলল, ‘তোমার হয়ে অস্টিন থেকে এমন একজন ওকালতি করছে, মা একদম পটে ক্ষীর। আজই তো তোমার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছিল। তোমাকে আর একবার চণ্ডীতলায় নিয়ে যেতে বলল। আমার খুশির জন্য মা সবকিছু স্যাক্রিফাইস করতে পারে।’
‘ব্যাঙ্কক থেকে তুমি ফিরে এসো। তোমার মাকে আমি তখন এখানে নিয়ে আসব। তোমার মায়ের কোনও অসুবিধে হবে না। এই দেখো, আমি রাধা-কৃষ্ণার আইডল এনেছি।’
ঘরের এক কোণে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি দেখে চমকে উঠল দেব। ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ‘বাহ। রোজ তুমি পুজো করো না কি? কে শেখাল?’ উচ্ছ্বাসে মিলেনাকে জাপটে তুলে এক পাক ঘুরে নিল দেব। দ্বিতীয় পাক দেওয়ার মুখে ও দেখল, দরজার গোড়ায় নাজমা দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মিলেনাকে ও সোফার উপর শুইয়ে দিল।
নাজমা বলল, ‘দিদি, নীচে বোধহয় কোনও গণ্ডগোল হয়েছে। কিচেন থেকে শুনলাম, অনেকে চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে। গিয়ে একবার দেখে আসব?’
মিলেনা বলল, ‘তোর রান্না হয়ে গেছে?’
‘আমাদের দু’জনের রান্না হয়ে গেছে। দাদা কী খাবে, বলে দাও।’
দেব বলল, ‘শুধু ফ্রুট স্যালাড।’
নাজমা বলল, ‘করে দিচ্ছি। কিন্তু জানলাটা খুলে তোমরা একবার উঁকি মারো দিদি। আমার মনে হল নীচে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। মারপিট বেঁধেছে বোধহয়।’ বলেই নাজমা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
মিলেনা বলল, ‘বিল্ডিংটা খুব আনসেফ হয়ে গেছে দেবদূত। সারাদিন নীচে আনওয়ান্টেড লোকের ভিড়। সার্ভেন্টস কোয়াটার্স আর গ্যারাজগুলো অ্যান্টিসোশালে ভর্তি। সারাদিন ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে।’
কথাগুলো বলতে বলতে মিলেনা পশ্চিম দিকের জানলায় গিয়ে উঁকি মেরে বলল, ‘দেবদূত এসে দেখো তো কী হচ্ছে?’
ড্রাইভওয়ের একপাশে বিল্ডিংয়ের গা ঘেঁসে সারসার নারকেল গাছ আছে। দেব দেখল, একটা গাছ দিয়ে লোক নেমে যাচ্ছে। বোধহয় ডাব পাড়তে উঠেছিল। চণ্ডীতলায় আকচার ও এই দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত। একেবারে নীচে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনকে ও দেখতে পাচ্ছে না। দোতলা সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের ছাদের জন্য। কিন্তু দেবের মনে হল, ড্রাইভওয়েতে বেশ কিছু লোক চিৎকার করে কী যেন বলছে। হঠাৎই ওর চোখে পড়ল গাছ বেয়ে নামতে গিয়ে লোকটা হাত ফসকাল। দড়াম করে সে আছাড় খেল সার্ভেন্টস কোয়ার্টারের ছাদে। ছয়তলার জানলা থেকে দেব দেখল, রক্তে জায়গাটা ভেসে যাচ্ছে। ইসস লোকটার বাঁচা কঠিন। যে সে লোক দিয়ে ডাব পাড়ানো উচিত না। ওদের চণ্ডীতলায় মাত্র দু’তিনজন এক্সপার্ট লোক আছে। নারকেল ছোবড়ার দড়ি পায়ে বেঁধে তারা তরতর করে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ ফুট উপরে উঠে যায়। ডাব পেড়ে দিয়ে আবার নীচে নেমে আসে। কলকাতায় এ রকম এক্সপার্ট লোক কই!
পড়ে যাওয়া লোকটাকে বোধহয় চোখে পড়েনি মিলেনার। দেখলে বেচারি ভয় পেয়ে যাবে। জানলা থেকে ওকে সরিয়ে নিয়ে এল দেব। জানলার ঠিক পাশেই ওয়াল পেপারে মোড়া দেওয়াল। তাতে পুরনো দিনের ফ্রেমে অনেকগুলো ছবি টাঙানো রয়েছে। দেব জিজ্ঞেস করল, ‘এই ছবিগুলো কাদের মিলেনা?
‘আমাদের পূর্বপুরুষদের। মাঝের সবথেকে বড় ছবিটা জোনাথন গ্রেগারিয়ানের। যিনি এই বিল্ডিংটা তৈরি করিয়েছিলেন। বাকিদের নাম বলতে পারব না। তোমাকে এখনকার ফ্যামিলি অ্যালবাম দেখাতে পারি। ওই যে টেবলের উপর রাখা আছে। খুলে দেখব বলে সকালে বের করেছিলাম। তখন দেখা হয়নি। লাঞ্চ সেরে নিয়ে, দু’জনে মিলে দেখব, কেমন?’
বেলা সেই দুটো থেকে মিলেনা অ্যালবাম দেখাচ্ছে। স্কুল ড্রেস পরা ওর একটা ছবি। কারোর হাত থেকে ট্রোফি নিচ্ছে। পিছনে একটা ব্যানার। তাতে লেখা অ্যানুয়াল সেরেমনি, সেন্ট ফিলোমেলা গার্লস হাইস্কুল, কালিম্পং। ছবিটা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে মিলেনা বলল, ‘তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। পেইন্টিং কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছিলাম। সিস্টার মার্গারেটের কাছ থেকে প্রাইজ নিচ্ছি।’ এর পরেই পাতায় একটা গ্রুপ ছবি। প্রায় কুড়ি-বাইশজন মেয়ে রয়েছে তাতে। স্কুলের উঠোনে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে তোলা। অথচ প্রত্যেকটা মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মিলেনা একেকজনকে চেনাতে লাগল। ‘আমাদের স্কুলটা ছিল কালিম্পংয়ের খাসমহলে। এই ছবিটা হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বেরনোর পর আমরা তুলেছিলাম। ড্যাড যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। এই মেয়েগুলোর মধ্যে অনেকের সঙ্গেই ষখন আমার ফেস বুকে যোগাযোগ আছে। কিন্তু স্কুল ছাড়ার পর বন্ধুত্ব টিঁকে ছিল মাত্র একজনের সঙ্গে। এই দেখো, অনিন্দিতা। তোমার কাজিন। ওকে আমরা ডাকতাম অ্যান্ডি বলে। কালিম্পংয়ের স্কুল থেকে একমাত্র ও-ই আমার মতো জেএনইউতে পড়তে গেছিল।’
অ্যালবামের পাতা ও একের পর উল্টে যাচ্ছে। ওর সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারছে দেব। আর্মেনিয়া থেকে বছরে নাকি একবারই গ্রেগারিয়ান পরিবারের লোকেরা দার্জিলিংয়ে আসতেন। যাঁদের সঙ্গে ম্যাল-এ ঘোড়ায় চড়া, টাইগার হিলে গিয়ে সানরাইজ দেখা, তিস্তা নদীর ধারে পিকনিক করার সব ছবি। ওর গালে গাল ঠেকানো একজন নেপালি মহিলার ছবি দেখিয়ে মিলেনা বলল, ‘এর নাম পুষ্পা গুরুং। এ আমার গভর্নেস ছিল। মনে আছে এই ছবিটা ড্যাডি তুলেছিল, যেদিন দিল্লিতে পড়তে যাওয়ার জন্য যেদিন রওনা হয়েছিলাম। দিল্লিতে পুষ্পাজিজি দেখাশুনো করত।’
‘দিল্লিতে তুমি কতদিন ছিলে মিলেনা?’
‘প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর। বসন্তবিহারের একটা গেস্ট হাউসে থাকতাম। দাঁড়াও তোমাকে ছবি দেখাচ্ছি।’ বলে কয়েকটা পাতা উল্টে গেল মিলেনা। একটা ছবিতে ও টপ আর শর্টস পরা। বন্ধুদের সঙ্গে বসে ওয়াইন খাচ্ছে। ঘরের কোণে ক্রিসমাস ট্রি। ওর পাশে বসা একটা মেয়েকে দেখিয়ে মিলেনা বলল, ‘এই দেখো, অ্যান্ডি। ক্রিসমাস ইভ-এর পার্টি হচ্ছিল সেদিন আমাদের গেস্ট হাউসে। কী যে মজার দিনগুলো ছিল! জেএনইউতে এমবিএ করার পর আরও তিন, সাড়ে তিন বছর আমি পিএইডি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু সেটা কমপ্লিট করা হল না। ড্যাডি আমাকে কলকাতায় চলে আসতে বললেন।’
অ্যালবামের পাতা ওল্টানোর সময় একটা ছবি নীচে পড়ে গেল। বোধহয় আটকানো ছিল না। ছবিটা কুড়িয়ে আনল দেব। দেখল, এরিক মিলেনাকে কোলে নিয়েছেন। পাশেই শাড়িপরা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রমহিলাকে চেনা বলে মনে হল দেবের। কোথাও যেন দেখেছে। ছবিটা মিলেনার দিকে এগিয়ে দিয়ে দেব বলল, ‘এই ছবিটা কার বলো তো?’
মিলেনা অবাক হয়ে বলল, ‘মাই গুডনেস, ইনি তো শান্তা আন্টি। আমাদের এখানকার স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল। তুমি ওঁকে দু’একবার দেখেছ। কিন্তু ড্যাডির সঙ্গে শান্তা আন্টির পরিচয় ছিল না কি? ছবি দেখে তো মনে হচ্ছে, দার্জিলিংয়ের হোটেলে তোলা। আশ্চর্য, শান্তা আন্টির সঙ্গে রোজ স্কুলে দেখা হয়। অথচ কোনওদিন তো বলেননি, উনি কখনও দার্জিলিংয়ে ছিলেন?
দেব বলল, ‘এত অবাক হওয়ার কী আছে? কখনও হয়তো বেড়াতে গিয়ে তোমাদের হোটেলে গিয়ে উঠেছিলেন। তখন এরিকের সঙ্গে ছবিটা তোলেন। আমাকে একটা কথা বলো তো? তোমাকে এরিক আর্মেনিয়ায় না নিয়ে গিয়ে কলকাতায় পাঠালেন কেন?’
‘তখন উনি বলেছিলেন, গ্র্যান্ডপাকে দেখাশুনো করার জন্য। কিন্তু আসল কারণটা কাল রাতে জানতে পারলাম মাম্মি… মানে এতদিন আমি যাকে মাম্মি বলে জানতাম, তার কাছ থেকে।’
ঘুরে বসে দেব জিজ্ঞেস করল, ‘কী যা তা বলছ তুমি?’
‘ঠিকই বলছি দেবদূত। জানি না, তুমি কিভাবে নেবে। তবুও তোমার জানা দরকার। আমার ড্যাডি…।’
মিলেনা কথাটা শেষ করার আগে ওর ফোনটা বাজতে শুরু করল। সোয়াইপ করে এদিক থেকে মিলেনা বলল, ‘হ্যাঁ শান্তা আন্টি বলুন। আমি স্টিফেন ম্যানসনে।’
‘টিভি-তে দেখাচ্ছে, তোমাদের বিল্ডিংয়ে ভয়ঙ্কর আগুন লেগেছে।’ উত্তেজিত গলায় শান্তা আন্টি ওদিক থেকে যা বলছেন, দেব শুনতে পাচ্ছে। ‘টিভিতে বলল, দু’নম্বর লিফটের কাছে প্রথম আগুনটা লাগে। তার পর সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ছে। আশ্চর্য, ঘণ্টাখানেক আগে আগুন লেগেছে, অথচ তুমি টের পাওনি? যে কোরেই হোক, তুমি বেরিয়ে এসো মা।’
অ্যালবাম ফেলে দিয়ে দেব লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল। জানলার সামনে গিয়ে দেখল, বিরাট একটা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। তা হলে মিডলটন রো-র দিকে আগুনটা লেগেছে। সেই কারণেই বাঁচার আকুতিতে ওই ব্লকের কেউ কেউ নারকেল গাছ দিয়ে নীচে নামার চেষ্টা করছিলেন! আতঙ্কে গা হিম হয়ে গেল দেবের। ‘শিগগির চলো,’ বলে ও মিলেনার হাত ধরে টানল।
(তিপ্পান্ন)
বেলা দেড়টার সময় রাখীর ফোন পেলেন শিখিন। কাঁদো কাঁদো গলায় ও বলল, ‘ধিংড়ার লোক স্টিফেন ম্যানসনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ঠিক আমাদের অফিসের নীচে। শিখিনদা, তোমরা শিগগির দমকলের গাড়ি নিয়ে এসো।’
কোয়াটার্সে বসে তখন লাঞ্চ সারছিলেন শিখিন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এখন কোথায়?’
অফিসে আটকা পড়ে আছি। তোমাদের কেউ খবরটা দেয়নি? প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেল।’
‘নীচে নেমে আসোনি কেন?’
‘চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখি, কালো ধোঁয়ায় জায়গাটা ভরে গেছে। দাউদাউ করে জ্বলছে লিফট। উফ কী ভয়ঙ্কর! অফিসের কয়েকজন কলিগ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। প্লিজ, আমাদের বাঁচাও শিখিনদা।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল রাখী।
শিখিন বললেন, ‘অফিস থেকে তোমরা কেউ বেরিও না। দরজা-জানলা সব বন্ধ করে দাও। দেখো যেন ধোঁয়া ভিতরে ঢুকতে না পারে। কোথাও ফাঁক থাকলে টাওয়েল গুঁজে দিও। আমি মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আসছি। মোবাইল ফোন হাতের সামনে রেখো।’
লাঞ্চ করা চুলোয়। কন্ট্রোল রুমে ফোন করলেন শিখিন। অফিসার বললেন, ‘খবর পাওয়ার পর তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে দুটো পাম্প পাঠিয়ে দিয়েছি স্যার। অ্যাটাক টিমের লিডার হয়ে গেছেন অনিমেষদা। ওঁর কাছ থেকে রিপোর্ট পেলেই আরও পাম্প পাঠাব।’
‘ডিজি সাহেব অফিসে আছেন?’
‘না স্যার, ওঁর বাড়িতে একটা ফ্যাংশান আছে। এখনও আসেননি।’
‘এলে বলে দিও, আমি স্টিফেন ম্যানসনে গেছি।’
ফোন ছেড়ে তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নিলেন শিখিন। স্টিফেন ম্যানসনে পৌঁছতে মিনিট চারেকও লাগবে না। কী ধরনের আগুন লেগেছে, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বুঝতে পারবেন না। রাখীর শেষ কথাটা কানে বাজতে লাগল, ‘আমাদের বাঁচাও শিখিনদা।’ মারাত্মক ভয় পেয়ে গেছে ও। আগুন ছড়িয়ে পড়ার সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একেকটা মিনিট অত্যন্ত মূল্যবান। প্রায় দৌড়েই কোয়ার্টার্স থেকে নেমে শিখিন নিজের অফিসে গিয়ে থুকলেন। স্টিফেন ম্যানসন সম্পর্কে একটা রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন তিনি সপ্তাহ কয়েক আগে। তাতে বিল্ডিংয়ের নকশাটা ছিল। কলকাতা কর্পোরেশন থেকে তিনি চেয়ে এনে ছিলেন। পরে অনিরুদ্ধকে দিয়ে একটা ম্যাপ আঁকিয়ে নেন, কোন ফ্লোরে কী আছে। অনির এক বন্ধু তুহিন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। সে ওই স্টিফেন ম্যানসনেই একটা সফটওয়ার কোম্পানিতে চাকরি করে। দু’জনে মিলে পুরো বিল্ডিং ঘুরে ম্যাপ তৈরি করেছিল, কোন ফ্লোরে কোনটা রেসিডেন্সিয়াল ফ্ল্যাট, কোনটা অফিস বা গোডাউন হিসেবে রেজিস্টার্ড।
ভাগ্যিস, দুই বন্ধু মিলে ম্যাপটা করে দিয়েছিল। আজ সঙ্গে নিয়ে গেলে কাজে লাগতে পারে। স্টিফেন ম্যানসনের দিকে রওনা হওয়ার পরই অনিরুদ্ধর ফোন। উত্তেজিত গলায় ও বলল, ‘স্যার, আমার ধারাণাই শেষপর্যন্ত সত্যি হয়ে গেল। স্টিফেন ম্যানসন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।’
‘তুমি কোথায় অনি?’
‘অফিসে ঢুকতে যাচ্ছিলাম, তখন পৌনে একটা বাজে। গেটের সামনে দেখি, মিস্টিরিয়াস সেই লোকটা আমার দিকে তাকিয়েই দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুরু করল। ওর পিছন ধাওয়া করে দেখি, লোকটা স্টিফেন ম্যানসনে ঢুকছে। তখনই বুঝলাম, আজ একটা অঘটন ঘটবে। তুহিনকে সঙ্গে সঙ্গে দোতলা থেকে নেমে আসতে বললাম। মিডলটন রো-তে দাঁড়িয়ে দু’জনে কথা বলছি, এমন সময় শুনি আগুন আগুন বলতে বলতে লোকজন দৌড়ে বেরিয়ে আসছে। প্রচুর লোক আটকা পড়ে আছে পুরো বাড়িতে। আপনি আসুন স্যার। আপনার জন্য আমরা দু’নম্বর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’
শিখিন বললেন, ‘কুল ডাউন অনি। দুটো ইঞ্জিন পৌঁছে গেছে। আমিও দু’মিনিটের মধ্যে পৌঁছচ্ছি।’
‘লাইনটা কেটে দেবেন না স্যার। কোনও ইঞ্জিন আসেনি। এখানে ক্যাওস হয়ে গেছে। লোকাল ছেলেরা বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়ছে। কেন, বুঝতেই পারছেন। পুলিশের দেখা নেই।’
কথা বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। সব জায়গাতেই কিছু রাফিয়ান থাকে, যারা পরিস্থিতির ফায়দা তোলে। কয়েকদিন আগে পাইপ কলোনিতে আগুন নেভাতে গিয়ে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে শিখিনের। কিন্তু উদ্বেগের কথা হল, দুটো ইঞ্জিন এখনও পৌঁছয়নি কেন? রিপোর্ট লেখার জন্য বেশ কয়েকদিন তাঁকে স্টিফেন ম্যানসনে আসতে হয়েছে। বিল্ডিংয়ে ঢোকার দুটো গেট। একটা পার্ক স্ট্রিটের দিকে, অন্যটা মিডলটন রোতে। ইঞ্জিন দুটো সম্ভবত ভুল করে পার্ক স্ট্রিটের গেটের দিকে চলে গিয়েছে। রাস্তাটা ওয়ান ওয়ে বলে অনেকটা ঘুরে তবে এদিকে আসতে হবে। অনিমেষদার মতো মানুষ এই ভুলটা করলেন কী করে? বয়স হয়ে গেছে, ওঁকে অ্যাটাক টিমের লিডার করে না পাঠালেই পারত কন্ট্রোল রুম।
শিখিন দু’নম্বর গেটের সামনে পৌঁছতেই দৌড়ে এল অনি আর তুহিন। অনি বলল, ‘উপরের দিকে তাকিয়ে দেখুন স্যার। স্মোক আর ফ্লেম কীভাবে বাড়ছে। প্রত্যেকটা ফ্লোরের বারান্দায় কত লোক দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে।’
উপরের তলাগুলোর দিকে তাকিয়ে শিখিন দেখলেন, দোতলার দু’তিনটে ঘরের ভিতর থেকে কালো ধোঁয়া গলগল করে বেরিয়ে আসছে। কী মেটেরিয়াল পুড়ছে, ধোঁয়ার গন্ধে তা বোঝা যায়। অভিজ্ঞতা থেকে শিখিন বুঝতে পারলেন, ঘরে ব্যবহার্য জিনিসপত্র পুড়ে যাওয়ার গন্ধ। কাঠ, কাঠবোর্ড, কাগজপত্র, বিছানা, প্লাস্টিক জাতীয় কিছুর। তার মধ্যে গ্যাস সিলিন্ডারও থাকতে পারে। তাই লালচে ফ্লেম বেরিয়ে আসছে। লিফটে যদি প্রথম আগুন লেগে থাকে, তা হলে করিডর পেরিয়ে কাছাকাছি ফ্ল্যাটগুলোতে তা ঢুকে পড়েছে। এত দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ার কথা নয়। কেননা, করিডরগুলোর দু’পাশে মুখোমুখি ফ্ল্যাট। বাতাস চলাচল করতে পারে না। তা হলে ফ্ল্যাটগুলোয় ছড়িয়ে পড়ল কী করে? কেউ কি সাবোতাজ করেছে? অসম্ভব কিছু নয়। রাখীর কথা সত্যিও হতে পারে। ধিংড়া বলে লোকটা এর পিছনে নেই তো?
উপরতলার বারান্দাগুলোতে দাঁড়িয়ে যারা সাহায্য চাইছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বাচ্চা আর বয়স্ক মহিলা। দোতলা-তিনতলার লোকদের ল্যাডার দিয়ে নামিয়ে আনা যেতে পারে। কথাটা মনে হতেই রাস্তা থেকে রাখীকে ফোন করলেন শিখিন। সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরে রাখী বলল, ‘আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি শিখিনদা। দোতলার দিকে তাকিয়ে দেখো। আমার হাতে একটা লাল রুমাল আছে। আমরা আট-দশজন এখন অফিস ঘরে আছি। বাকিরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদের দিকে গেছে। আগুনের তাঁতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। প্লিজ, আমাদের বাঁচাও।
ঘণ্টা বাজিয়ে দুটো ইঞ্জিন দাঁড়াল দু’নম্বর গেটের কাছে। রাখীর কথা আর শুনতে পেলেন না শিখিন। অ্যাটাক টিমের তিনজন গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে ভিতরে ঢুকে গেল। ওরা আগুনের সোর্স খুঁজে বের করবে। ইকুইপমেন্ট দিয়ে ওদের সাহায্য করবে আরও তিনজন। আপাতত আরও লোকবল দরকার। আগুন নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে রেসকিউ অপারেশনও শুরু করে দিতে হবে। জিনিসপত্র পুড়ে গেলে অতটা কথা ওঠে না। কিন্তু একটা লোকও যদি মারা যায়, তা হলে দমকলের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আর সময় নষ্ট করলে অনেক লোক ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। অনিকে শিখিন বললেন, ‘তুই কন্ট্রোল রুমে খবর দে। আরও গোটা চারেক ইঞ্জিন যেন পাঠায়। সেইসঙ্গে পুলিশকে বল, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপকে খবর দিতে। বিল্ডিংটা এত ছড়ানো যে, ইভাকুয়েশনের জন্য অনেক লোক দরকার।’
দু’নম্বর গেটের সামনে একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ আছে। শিখিন আগে দেখে গেছেন। তুহিনকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে ঢোকার সময় তিনি দেখলেন, পার্ক স্ট্রিট থানার গাড়ি থেকে হিমাদ্রি নেমে আসছে। দেবের ম্যানেজার হয়ে আজ রাতে ওর ব্যাঙ্কক যাওয়ার কথা। সম্ভবত, কাল থেকে ছুটি নিয়েছে। যাইহোক এই সময়ে পুলিশের লোক সঙ্গে থাকা ভাল। শিখিন বললেন, ‘হিমাদ্রি, তুমিও আমার সঙ্গে এসো।’ রেস্টুরেন্ট একেবারে ফাঁকা। লাঞ্চ করতে ঢুকেছিল, এমন লোকজন সব ভয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে। রেস্তোরাঁর ম্যানেজারকে ডেকে শিখিন বললেন, ‘দু’তিনটে টেবল একসঙ্গে জুড়ে দিন। এখানে আমরা কন্ট্রোল রুম খুলব।’
ম্যানেজার হাতজোড় করে বললেন, ‘স্যার, এটা মিঃ ধিংড়ার রেস্টুরেন্ট। ওঁর পার্মিশন ছাড়া…।’
কথাটা শেষ করতে দিল না হিমাদ্রি। গালে থাপ্পড় মেরে বলল, ‘চুপ শালা। যদি থানার লক আপে যেতে না চাস, তা হলে যা বলছি তাই কর।’
তুহিন বলল, ‘শিখিনদা, রেস্টুরেন্টের ভিতর দিয়ে দোতলায় যাওয়ার একটা রাস্তা আছে। ধিংড়া গোপনে সেটা বানিয়েছেন। দোতলার করিডর দিয়ে যাতায়াত করার সময় দরজাটা আমাদের চোখে পড়ে। সন্ধেবেলার পর থেকে একজন বাউন্সার সেখানে পাহারা দেয়।’
হিমাদ্রি ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল, ‘এ যা বলছে, ঠিক? দোতলা যাওয়ার দরজাটা কেন বানিয়েছিস?’
চড় খেয়ে ম্যানেজার কেমন যেন ঘাবড়ে গেছে। ওর চুলের মুঠি ধরে হিমাদ্রি জিজ্ঞেস করল, ‘তোদের মালিক ধিংড়া কোথায়? এখুনি তাকে ফোন কর। বলবি পার্ক স্ট্রিট থানার অফিসার কথা বলবে।’
‘ধিংড়া সাহেব কলকাতায় নেই স্যার। চণ্ডীগড় গেছেন।’
‘বিল্ডিংয়ে আগুন লাগানোর সুপারি দিয়ে নিজে ভেগে গেছেন। সত্যি কথা বল, না হলে এমন কেসে তোকে ফাঁসিয়ে দেবো, দশ বছরের আগে জেল থেকে বেরতে পারবি না।’
তুহিন বলল, ‘স্যার, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। পরে একে পেটাবেন। আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি। সন্ধেবেলায় কয়েকজন প্রস্টিটিউট এই রেস্টুরেন্টে এসে বসে। ধিংড়া দোতলায় দুটো ফ্ল্যাট অলরেডি দখল করে নিয়েছে। সেখানে ব্রথেল চালায়। এখুনি ভিতর দিয়ে দোতলায় চলুন স্যার। পরপর কয়েকটা অফিসের লোক আটকা পড়ে রয়েছে। তাদের হয়তো বাঁচানো যাবে।’
রাখীর আর্ত মুখটা শিখিনের মনে ভেসে উঠল। কিচেনের পাশে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওরা চারজন দোতলায় উঠতে লাগলেন। মিনিট দশেক কেটে গেছে। রাখীরা এখনও অফিস ঘরে আসে কি না, শিখিন জানেন না। এইসময় আতঙ্কে মানুষ বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। আগুন নেভাতে গিয়ে তিনি আগে দেখেছেন, তিনতলা থেকে লোকে নীচে লাফিয়ে পড়েছে বাঁচার তাগিদে। না, না, মনে কোনও নেগেটিভ চিন্তা স্থান দেবেন না শিখিন। রাখীকে তিনি উদ্ধার করবেনই। বহু বছর আগে অজান্তে একটা অপরাধ করে ফেলেছিলেন তিনি। কালীপুজোর সময় রকেট বাজি ফাটিয়ে। সেই জ্বলন্ত রকেট রাখীদের বাড়িতে ঢুকে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। তাতে মারা যান রাখীর বৃদ্ধা ঠাকুরমা। ইন ফ্যাক্ট, দমকলে শিখিনের চাকরি নেওয়ার পিছনে একটা বড় কারণ ছিল, সেই অগ্নিকাণ্ড। তিনি শপথ নেন, মানুষকে আগুনের হাত থেকে বাঁচাবেন। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ আজ পেয়েছেন শিখিন। দরকার হলে নিজের জীবন দিয়েও রাখীকে তিনি বাঁচাবেন।
কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় লক্ষ্য করলেন, দরজার তলা দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। খুললেই রেস্টুরেন্ট গ্রাস করে ফেলবে। পিছন দিকে ঘুরে তিনি তুহিনকে বললেন, ‘শিগগির যাও। অনিকে বলো, কয়েকটা মাস্ক আর থার্মাল ইমেজিং ক্যামেরা নিয়ে আসতে। ও জানে, গাড়ির কোথায় আছে।’
মহড়া দেওয়ার সময় প্রায়ই এই ইকুইপমেন্টগুলো ব্যবহার করতে হয় দমকল কর্মীদের। ধোঁয়া হচ্ছে ফায়ার ফাইটারদের চরম শত্রু। মাস্ক পরলে ধোঁয়ার ভিতরে ঢুকে যাওয়া যায়। আর থার্মাল ইমেজিং ক্যামেরা সঙ্গে থাকলে ধোঁয়ার ভিতরও সবকিছু দেখা যায়। ইকুইপমেন্টের জন্য অপেক্ষা করার সময় শিখিন ফোন পেলেন অনিমেষদার। ‘স্যার, ফায়ার কন্ট্রোল করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। আপনি আরও তিন-চারটে ইঞ্জিন ডেকে পাঠান। দু’নম্বর ব্লকের গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফট থেকে আগুনটা লেগেছিল। কেউ বোধহয় না জেনে, উপর তলা থেকে তখন সুইচ টেপেন। জ্বলন্ত লিফট উপরে উঠে যায়। রেল গার্ডে মাখানো গ্রিজে আগুন লাগে। ফলে পুরো লিফটের কাঠামোয় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রিলিমিনারি এটাই আমার ধারণা।’
শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কজ অফ ফায়ার কি মনে হল আপনার?’
‘ইলেকট্রিক্যাল শর্ট সার্কিট। স্মোক দেখে আমার তো তাই মনে হচ্ছে।’
মাস্ক নিয়ে অনিরুদ্ধ উপরে উঠে আসছে। দেখে শিখিন বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনি ফায়ার অ্যারেস্ট করার চেষ্টা করুন। আমি দোতলায় কয়েকজনকে রেসকিউ করতে যাচ্ছি।’ বলেই লাইনটা কেটে দিলেন তিনি।
দোতলায় পা দিয়ে শিখিন বুঝতে পারলেন, মাস্ক না নিয়ে এলে খুব বিপদে পড়তেন। ঘন ধোঁয়ায় করিডর ভর্তি হয়ে গেছে। দু’পাশে সারি সারি ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ধরে ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পায়নি। বিল্ডিংয়ের নকশাটা শিখিনের মাথায় আছে। তিনি জানেন, করিডরটা লম্বা প্রায় দেড়শো গজের মতো। একেবারে শেষ প্রান্তে তিন নম্বর লিফট। সেখান দিয়ে অফিস কর্মীরা ওঠা নামা করেন। কিন্তু কোন অফিসটা রাখীদের, সেটা বুঝতে পারবেন কি করে? পিছন ফিরে তুহিনকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে যে কল সেন্টারটা আছে, সেটা কোথায়?’
তুহিন বলল, ‘স্যার, আমাদের অফিসের ঠিক পাশে। কিন্তু চিনতে পারছি না। ডান দিকে কোথাও হবে।’
হেলমেটের টর্চ জ্বালিয়ে শিখিন বললেন, ‘তোমরা এখানে দাঁড়াও। আমি খুঁজে দেখি।’
কয়েক পা এগোতেই শিখিন দেখতে পেলেন, অন্ধকারের মধ্যে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। পুরনো দিনের বার্মিজ কাঠের ভারী দরজা জ্বলছে। করিডরে হুমড়ি খেয়ে কেউ পড়ে আছেন। তার মানে ফ্ল্যাট থেকে বোধহয় বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা গেছেন। দেখে শিখিনের বুকটা ধড়াস করে উঠল। ধোঁয়া মারাত্মক টক্সিক। ফায়ার ফাইটারদেরও মাথায় রাখতে হয়, কার্বন যেন লাংসে না যায়। মনে মনে অগ্নিদেবের কাছে শিখিন প্রার্থনা করলেন, রাখী যেন সুস্থ থাকে। ঠিক তখনই পিছন থেকে তুহিন বলল, ‘স্যার, এবার চিনতে পেরেছি। ডানদিকের ঘরটাতে কল সেন্টার ছিল।’
শিখিন বললেন, ‘অনি, তুমি তুহিনদের অফিসে যাও। আমি এ দিকটা দেখছি।’
ধাক্কাধাক্কি করে শিখিন কল সেন্টারের দরজাটা খুলে ফেললেন। ঘরের ভিতর গলগল করে ধোঁয়া ঢুকতে লাগল। ভিতরে মেঝেতে শুয়ে থাকা অনেকেই কাশতে শুরু করেছেন। তার মানে কেউ কেউ বেঁচে আছেন। শিখিন চিৎকার করে বললেন, ‘রাখী, তুমি কোথায়?’
ধোঁয়ার মাঝখান থেকে কেউ একজন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কাছে আসার আগেই টলে পড়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে শিখিন দেখলেন, রাখী। পাঁজকোলা করে রাখীকে তুলে নিয়ে তিনি হাঁটতে লাগলেন রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে।
(চুয়ান্ন)
অ্যাসেম্বলিতে সুধাংশুদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে রুস্তম। আর তিনদিন পরেই ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প। কয়েকদিন আগে একবার সুধাংশুদার বাড়িতে গিয়ে ও চিঠি দিয়ে এসেছে। তবুও, অ্যাসেম্বিলিতে এসেছে রিমাইন্ডার দিতে। পার্টির সেক্রেটারি, পার্ক সার্কাস ময়দানে সুধাংশু পাঁচ মিনিটের জন্যও গেলে গ্ল্যামার অনেক বেড়ে যাবে। ভাইজান কখনও এই লেভেলের নেতাদের ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে নিয়ে যেতে পারেনি। ঘণ্টাখানেক ধরে লবিতে ঘোরাঘুরির পর রুস্তম সুধাংশুদার ঘরে ডাক পেল শেষে।
ওকে দেখেই সুধাংশুদা বললেন, ‘তুই এখানে কি করছিস রুস্তম? তোর এলাকায় অত বড় আগুন লেগেছে, তুই জানিস না?’
মনে মনে রুস্তম বলল, আগুন লাগবে কাল রাতেই আমি জানি। কিন্তু মুখে ও বলল, ‘সক্কাল থেকে ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প’ নিয়ে আমি ব্যস্ত সুধাংশুদা। আমি কিছু শুনিনি। আগুন কোথায় লেগেছে?’
‘স্টিফেন ম্যানসনে। তুই এখুনি ওখানে চলে যা। গিয়ে এমন কিছু কর, যাতে আমাদের পার্টির সুনাম হয়। টাইম টু টাইম আমাকে ফোন করবি। কোনও প্রবলেম হলে আমি ছুটে যাবো।’
ব্যস্ততার ভান করে রুস্তম ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কিন্তু ধীরে সুস্থে এগোল পার্কিং স্পেসের দিকে। পার্টি থেকে সুধাংশুদা নতুন একটা এসইউভি দিয়েছেন। সেটা চড়ে পুরো ইস্ট ক্যালকাটা ও চষে বেড়াচ্ছে। পার্টি কর্মীদের একটাই মেসেজ দেওয়ার জন্য। দেখো, পার্টিতে আমার পজিশন কতটা উঁচুতে। নিজেই ড্রাইভ করে রুস্তম অ্যাসেম্বলি থেকে বেরিয়ে এল। স্টিফেন ম্যানসনে ও এখন যাবে না। আসফাক দলবল নিয়ে সকাল ন’টার সময়ই ওখানে পৌঁছে গেছে। ইতিমধ্যে বার চারেক ফোন করে ও খবরও দিয়েছে। তার মধ্যে একটা খুব ইম্পরট্যান্ট। ‘ওস্তাদ, আশিক অনেকক্ষণ আগে স্টিফেন ম্যানসনে ঢুকেছে। ও যাতে আর বেরোতে না পারে, তার ব্যবস্থা করছি।’
দেবের উপর আসকাফের এমন রাগ নাম পর্যন্ত উল্লেখ করে না। ওকে আশিক বলে ডাকে। শুনে রুস্তম মুচকি হেসেছে। এক ঢিলে ও আজ অনেকগুলো পাখি মারবে। মিঃ ধিংড়ার কথা ওর মনে পড়ল। লোকটা ভোরের ফ্লাইটে দিল্লি উড়ে গেছে। সেখান থেকে এতক্ষণে হয়তো চণ্ডীগড়েও পৌঁছেছে। ধিংড়া মনে আশা নিয়ে গেছে, ফিরে আসার পর স্টিফেন ম্যানসন ওর বাপের সম্পত্তি হয়ে যাবে। দোতলার পুরো একটা ব্লক ওর দখলে চলে আসবে। আসলে তা হবে কি না রুস্তম জানে না। কিন্তু ও আন্দাজ করতে পারছে, প্ল্যান সাকসেসফুল হলে সবথেকে বেশি যদি কেউ লাভবান হয়, তবে ও নিজে হবে।
কাল সন্ধেবেলায় ধিংড়া ‘দ্য ফর্টি টু’-র ফ্ল্যাটে ওর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। স্টিফেন ম্যানসন নিয়ে আলোচনা করার জন্য। ফ্ল্যাটে ভেতরের ঘরে তখন মউ হাজির। ওকে বেরতে মানা করে রুস্তম সিবাস রিগালের বোতল খুলে বসে। ধিংড়ার সঙ্গে কথাবার্তায় ও বুঝতে পারে, এতদিন বিল্ডিংটার বড় মাতব্বর ছিলেন উনি। কোর্টে কেস-এর পর কেস করে সব্বাইকে চমকাতেন। কিন্তু এখন বোধহয় রেসিডেন্টরা অনেকে মিলে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ওঁর সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জন্য না কি নিয়োগী বলে কেউ একজন এসে গেছেন। পার্ক স্ট্রিট থানা তাঁর কথা খুব মানে। ধিংড়া আসলে ওকে তাতাতে এসেছিলেন। এমনকী, একবার বলেও ফেললেন, ‘তোমাকে এত টাকাপয়সা দিলাম, অথচ তুমি তো কিছু করতে পারলে না রুস্তম। কল সেন্টারটা পর্যন্ত ওদের এমপ্লয়িরা আগলে বসে আছে।’
গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে রুস্তম জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনি কী চান, সেটা আমাকে খুলে বলুন তো?’
‘এমন কিছু করো, যাতে সব তছনছ হয়ে যায়। নিয়োগীর লিডারশিপে রেসিডেন্টরা একটা অ্যাসোসিয়েশন করেছে। ওরা ঠিক করেছে, লিজ হোল্ডার ছাড়া আর কাউকে স্টিফেন ম্যানসনে থাকতে দেবে না।’
আপনি লিজ হোল্ডার নন?’
‘না, আমি হলাম লিজ হোল্ডারদের ভাড়াটে। আসল মালিকরা কেউ বেঁচে নেই। তাঁদের ওয়ারিশরাও কোথায় জানি না। চার-পাঁচটা ফ্ল্যাটের মালিক এখন আমিই। বাস্টার্ড নিয়োগীটা বলছে, পঞ্চাশ বছর আগে আপনি একশো দেড়শো টাকা ভাড়ায় এ বিল্ডিংয়ে ঢুকেছিলেন। রেন্ট কন্ট্রোলে এখনও সেটা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিল্ডিংয়ে থাকতে হলে এখনকার রেটে আপনাকে ভাড়া দিতে হবে। আর সেটা দিতে হলে একেকটা ফ্ল্যাটের ভাড়া হয়ে যাবে দুই আড়াই লাখ টাকা করে। মেইন্টেনেন্স দিতে হবে পার ফ্ল্যাট পার মান্থ কুড়ি হাজার টাকা। আমি মানব কেন? আরও শুনবে, বিল্ডিংয়ের রিনোভেশন আর লিফট সারাইয়ের জন্য ওরা আলাদা করে দশ-বারো লাখ টাকা চাইছে। না, না, নিয়োগীদের যে করেই হোক, আমাকে আটকাতে হবে।’
হুইস্কি পেটে গেলে ইদানীং রুস্তম আগের মতো উত্তেজিত হয় না। বরং ধীর-স্থির হয়ে যায়। মউয়ের সঙ্গে মাল খেতে বসলে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। কিন্তু আজ ধিংড়াকে বাজিয়ে দেখার জন্য ও জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি বলেন, নিয়োগীটাকে খতম করে দেবো? ও থাকে কোথায়?’
‘ক্যামাক স্ট্রিটে। স্টিফেন ম্যানসনে ওর ফ্ল্যাটে এখন ওর মা থাকে। নিয়োগী বাস্টার্ড ইংলিশ নিউজ পেপারের রিপোর্টার। ওকে মার্ডার করতে যেও না। তুমি ডুববে, আমাকেও ডোবাবে।’
‘তা হলে এমন একটা কিছু করি যাতে, রেসিডেন্টরা খুব অসুবিধের মধ্যে পড়েন। বিশেষ করে, যারা বয়স্ক মানুষ, আর লিজ হোল্ডার। দেখবেন, যাঁরা এখন নিয়োগীর পিছনে আছেন, তাঁরা তখন কেউ থাকবেন না।’
‘নট আ ব্যাড আইডিয়া। কবে করবে তুমি কাজটা?’
‘কালই। ফ্যামিলির লোকজনকে নিয়ে আপনি কোথাও সরে পড়ুন। বিল্ডিংয়ের হাল কী হবে, জানি না। আপনি অন্তত দিন সাতেকের আগে আসবেন না।’
টাকাপয়সার ডিল হয়ে গেছিল এর পর। আরও খানিকক্ষণ কথা বলে ধিংড়া বেরিয়ে যাওয়ার পর মউ সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। সাজগোজ করে বেরিয়েছে। কিন্তু মুখ খুব গম্ভীর। রুস্তম জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোথাও যাচ্ছ না কি মউ?’
‘হ্যাঁ, সিলভার হোটেলে একটা পার্টি আছে। একটা সিনেমার প্রিমিয়ার শো-য়ের। ফিল্মের প্রোডিউসাররা খুব রিকোয়েস্ট করলেন। তাই অ্যাটেন্ড করতে যাচ্ছি।’
‘ধিংড়ার আব্দারটা তুমি শুনলে?’
‘শুনেছি। তোমাকে একদিন বারণ করেছিলাম, স্টিফেন ম্যানসনের দিকে হাত বাড়িও না। তোমার হাত কিন্তু পুড়ে যাবে। তুমি আমার কথা শুনছ না।’
‘এই শেষবার মউ। তুমি আমার প্ল্যানটা তো শোনো।’
‘শোনার ইচ্ছে নেই। তবে একটা রিকোয়েস্ট, এমন কিছু কোরো না যাতে, আমার বন্ধু মারিয়ারা বিপদে পড়ে। ওরা কিন্তু চার নম্বর ব্লকে থাকে।’ কথাগুলো বলে মউ আর দাঁড়ায়নি।
সার্কাস অ্যাভেনিউর আপিসের দিকে গাড়ি চালানোর ফাঁকে মউয়ের অসন্তুষ্ট মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল রুস্তমের। স্টিফেন ম্যানসনে আগুন লাগার খবরটা নিশ্চয়ই ও অনেক আগে পেয়ে গেছে। একমাত্র ও-ই জানে, পিছন থেকে কলকাঠিটা কে নেড়েছে। ও যদি ভবিষ্যতে বিট্রে করে, তা হলেও অবশ্য তা প্রমাণ করতে পারবে না। কেননা, ঠিক আগুন লাগার সময়টায় ইচ্ছে করে রুস্তম অ্যাসেম্বলিতে ছিল। সুধাংশুদা তার সাক্ষী। লবিতে ঘোরাঘুরির সময় পার্টির আরও অনেক নেতার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছে। মউ হয়তো বিট্রে করবে না। তবুও, ওকে চটানো বোধহয় ঠিক হয়নি। ওর সঙ্গে মাস কয়েক আগে আলাপ। কিন্তু এর মধ্যে মউ যা হেল্প করেছে। তার তুলনা নেই। সন্ধেবেলায় দেখা হলে, ওকে ম্যানেজ করে নিতে হবে। কথাটা ভেবে রুস্তম স্বস্তিবোধ করল। কিন্তু ওর মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করতে লাগল, মউ কেন স্টিফেন ম্যানসন থেকে দূরে থাকতে বলছে? ওর কি ইন্টারেস্ট? শুধুই কি মারিয়া?
কয়েক মিনিট পর সার্কাস অ্যাভেনিউর অফিসে এসে রুস্তম দেখল, কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। দলবল নিয়ে আসফাক এখন স্টিফেন ম্যানসনের আশপাশে রয়েছে। সেক্রেটারির ঘরে ঢুকে রুস্তম টিভি চালিয়ে দিল। তখনই ব্রেকিং নিউজ ওর চোখে পড়ল, ‘পার্ক স্ট্রিটে ভয়াবহ আগুন।’ পর্দায় লেখাটা বারবার আসছে, আর অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। হেডিংয়ের পিছনে স্টিফেন ম্যানসনের পুবদিকটা দেখাচ্ছে। কালো ধোঁয়ার বিরাট কুণ্ডলী আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। দোতলা-তিনতলা-চারতলার জানলায় অনেক লোকের মুখ।’ চ্যানেল বদলে রুস্তম দেখল, মিডলটন রো-তে প্রচুর লোকের ভিড়। দমকলের কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ল্যাডার বের করে দমকল কর্মীরা লাগোয়া দোকানগুলোর ছাদে উঠে যাচ্ছে। যাতে উপরের তলার লোকদের নিরাপদে নামিয়ে আনা যায়।
পর্দায় হঠাৎ আসফাককে চোখে পড়ল রুস্তমের। ওর পিঠে বাচ্চা একটা মেয়ে গামছা দিয়ে বাঁধা। আসফাক রেন পাইপ বেয়ে দোকানগুলোর ছাদে নেমে আসছে। রাস্তায় জমে থাকা ভিড় ওর দিকে উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে আসফাককে চেনে রুস্তম। লোকের বাড়িতে পাইপ বেয়ে উঠে গিয়ে চুরি চামারিতে অভ্যস্ত ছিল। বাচ্চাটাকে ছাদে নামিয়ে দিয়ে আসফাক ফের পাইপ বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। দোতলার জানলায় পুরনো দিনের লম্বা লোহার শিক ফাঁক করে অনেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হাতজোড় করে নীচের দিকে তাকিয়ে তারা কান্নাকাটি করছে। টিভির ক্যামেরা তাদের মুখগুলো ধরে আছে। হঠাৎ জানলা দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে লাগল। ঘরে বোধহয় আগুন পৌঁছে গেছে।
চ্যানেল বদলানোর সময় ওর মোবাইল ফোনটা বাজতে শুরু করল। সোয়াইপ করার আগে রুস্তম দেখল, পর্দায় সুধাংশুদার নাম। বিরক্তিমাখানো গলায় উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘পরিস্থিতি কী বুঝছিস বানচোত? তোকে যে বলে দিলাম, টাইম টু টাইম খবর দিতে?’
আগে থেকেই স্ক্রিপ্ট বানানো আছে। গালিটা হজম করে রুস্তম বলল, ‘ভাল নয় সুধাংশুদা। চোখের সামনে দশ-বারোজন ডেড। দমকল এত দেরি করে এসেছে যে লোকাল পাবলিক মারাত্মক খেপে আছে। আগুন লেগেছে বেলা একটায়। কিন্তু আমার ছেলেরা বলল, দমকল এখানে এসেছে প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে।’
‘বলিস কী, দমকল অফিস থেকে স্টিফেন ম্যানসন পায়ে হাঁটা পথ। এতক্ষণ সময় লাগল কী করে?’
‘এই উত্তরটাই দিতে পারছি না পাবলিককে। নেহাত এখানকার লোকেরা আমাকে চেনে, তাই কিছু বলছে না। আপনি দমকল মন্ত্রীকে এখানে পাঠান। ওর কথা যদি লোকে শোনে।’
‘ওটা একনম্বরের গান্ডু। পরে ওর ব্যবস্থা করছি। ফায়ার সার্ভিস-এর যে অফিসার ওখানে আছে, তার নামটা তুই দিতে পারবি? খানকির ছেলেকে কালকেই কালিয়াগঞ্জে ট্রান্সফার করে দেবো। এতগুলো লোক মারা গেল, আমরা মিডিয়াকে কী জবাব দেবো?’
শিখিন চ্যাটার্জির নামটাই প্রথমে মনে পড়ল রুস্তমের। শূয়ারের বাচ্চাটা পাইপ কলোনির ঘটনার পর খুব রোয়াব দেখিয়েছিল। রুস্তম জানে না, লোকটা স্টিফেন ম্যানসনে গেছে কি না। কিন্তু নামটা সুধাংশুদার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়র জন্য ও বলল, ‘নাম শিখিন চ্যাটার্জি। লোকটা আমাদের পার্টির ছেলেদের রেসকিউর কাজ করতে দিচ্ছে না। আপনি এখুনি স্টেপ নিন। না হলে আরও অনেকে মারা যাবে।’
‘ঠিক আছে। তুই ওখানে থাক। পুরো রেসপন্সিবিলিটি তোর উপর দিলাম। পুলিশ তোকে হেল্প করবে।’
লাইন কেটে দিয়ে রুস্তম টিভির দিকে চোখ রাখল। কোনও একটা চ্যানেলের পর্দায় মউ সরকারের ছবি। মিডলটন রো-তে দাঁড়িয়ে ও রিপোর্ট করছে। ‘আগুন লাগার পর ঘণ্টা তিনেক হয়ে গেল। অথচ এখনও ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের কোনও দেখা নেই। আমাদের অনুমান, স্টিফেন ম্যানসনের চারটে ব্লকে এখনও প্রায় শ’চারেক মানুষ আটকা পড়ে আছেন। বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। ক্যামেরাম্যান অভিমন্যুকে আমি সেই দৃশ্য দেখানোর অনুরোধ করছি।’ জানলায় জানলায় প্রচুর ভয়ার্ত মুখ। ক্যামেরা সরে আসতে আসতে এসে দাঁড়াল আসফাকের দিকে। রেল পাইপ বেয়ে ও নেমে আসছে। ওর পিঠে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে এক বৃদ্ধা।
ফের মউয়ের গলা শুনতে পেল রুস্তম। ‘আপনারা দেখুন, প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও লোকাল ইয়াং ছেলেরা কীভাবে নামিয়ে আনছেন মানুষজনকে। এদেরই একজন মকবুল। ইতিমধ্যেই ভিতরে ঢুকে ছেলেটা একটা পুরো পরিবারকে নিরাপদে নামিয়ে এনেছে। আসুন, প্রত্যক্ষদর্শী এই ছেলেটা কী বলছে, শুনি।’ হাতের বুমটা মকবুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে মউ জিজ্ঞেস করল, ‘আগুন লাগার সময় আপনি বিল্ডিংয়ে ছিলেন?’
মকবুল বলল, ‘সার্ভেন্টস কোয়াটার্সে ছিলাম। ধোঁয়া দেখে দু’নম্বর লিফটের কাছে দৌড়ে যাই। ইলেকট্রিকের তার থেকে আগুন লেগেছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে কেয়ারটেকার বিজয় সিংকে খবর দিই। ও বলল, লাঞ্চ করছে। শেষ না করে আসতে পারবে না। তখন আমরা লোকাল ছেলেরা উদ্ধারের কাজে নেমে পড়ি।’
ক্যামেরার দিকে মুখ ঘুরিয়ে মউ এবার বলতে শুরু করল, ‘দমকল আর পুলিশ স্টিফেন ম্যানসনে আসার অনেক আগেই রুস্তম আহমেদের নেতৃত্বে স্থানীয় কিছু যুবক উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রুস্তম রুলিং পার্টির ইস্ট ক্যালকাটা জোনের সেক্রেটারি। তাঁর ছেলেরাই বিল্ডিংয়ের অন্য ব্লকগুলো থেকে আবাসিকদের নামিয়ে আনছেন। একটু আগে রেল পাইপ বেয়ে নেমে আসা যে যুবকটির ছবি আপনাদের দেখালাম, তার নাম আসফাক। নিজের জীবন তুচ্ছ করে এঁরা আজ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, তার তুলনা নেই। রুস্তম আহমেদের মতো নেতারা বাংলার গর্ব। আমরা রুস্তমকে ধরার চেষ্টা করছি।’
নিজের নামটা টিভিতে শুনে রুস্তম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মনে মনে মউকে ও অসংখ্য ধন্যবাদ দিল। প্রায়দিনই মদ্যপানের সময় মেয়েটা বলত, ‘রুস্তমদা আগে তোমাকে ইমেজ বদলাতে হবে। না হলে বড় জায়গায় যেতে পারবে না।’ আজ ওর এই রিপোর্টিং লাখ লাখ মানুষের কানে গেছে। একটা বার্তা পৌঁছে দিয়েছে, রুস্তম নিছক মাস্তান নয়। সাহসী একজন যুবক। দুর্ঘটনাস্থলে এ বার ওর খোঁজ পড়বেই। মউকে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় কী বলবে, রুস্তম ঠিক করে নিল। নাহ, আর এক মিনিটও ওর অফিসে বসে থাকা উচিত না। অফিস ছেড়ে বেরিয়ে আসার মুখে টিভির পর্দায় ও দেখল, দমকল মন্ত্রী সুহাস ব্যানার্জির গাড়ি পার্ক স্ট্রিট থেকে মিডলটন রো-র দিকে টার্ন নিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পাবলিক গাড়িটা ঘিরে ধরল।