স্টিফেন ম্যানসন – ৫

(পাঁচ)

মেসে লাঞ্চ করতে বসবে, এমন সময় কোয়েলের ফোন, ‘দেবদা, তুমি কি নার্সিং হোমে ফোন করে দিয়েছিলে?’

সরাসরি উত্তর না দিয়ে দেব জিজ্ঞেস করল, ‘আগে বল, মাসিমা কেমন আছেন?’

‘ঠিক আছে। ডাক্তারের সঙ্গে এইমাত্র কথা বললাম। উনি বললেন, পেসমেকার বসাতে হবে। আমাকে খুব বকাঝকাও করলেন। বললেন, আপনার মা মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, কোনওদিন খেয়াল করেননি?’

দেব বলল, ‘তুই খেয়াল করবি কী করে? সারাদিন তো বাড়িতেই থাকিস না।’

‘মা-টাও কেমন দেখো, অজ্ঞান হয়ে যেত। কিন্তু আমাকে কিচ্ছুটি জানায়নি।’

‘মায়েদের ওই এক দোষ। অসুস্থ হলেও কাউকে কিছু জানাতে চায় না। পাছে ফ্যামিলির অন্যরা বিব্রত হয়ে পড়ে। আমার মায়েরও এই দোষটা আছে। যাক গে, মাসিমার সঙ্গে কথা বলেছিস?’

‘হ্যাঁ দেবদা। এখানে ভিজিটিং আওয়ার্সের বাইরে কাউকে ওয়ার্ডে যেতে দেয় না। আশ্চর্য, আমি একবার রিকোয়েস্ট করতেই আমাকে অ্যালাউ করল।’

‘এতে অবাক হওয়ার কী আছে রে কোয়েল।’

‘তুমি জানো না দেবদা, কাল রাতে ভর্তি করার সময় এরা কিন্তু ডিফারেন্ট বিহেভ করেছিল। সত্যি কথাটা বলো তো। কাউকে দিয়ে তুমি কি এখানে ফোন করিয়েছিলে? চেনা-জানা না থাকলে তো এত খাতির পাওয়া যায় না।’

‘আমি? দাঁড়া, মনে করে দেখি। তার আগে বল, মাসিমাকে ওরা কবে ছাড়বে, কিছু বলল?’

‘ডাক্তারবাবু বললেন, পেসমেকার যত তাড়াতাড়ি পারেন, বসিয়ে নিন। হার্ট রেট কখনও কখনও প্রায় চল্লিশে নেমে যাচ্ছে। বেশিদিন ফেলে রাখবেন না।’

‘কত খরচ পড়বে, কিছু বললেন?’

‘সব মিলিয়ে লাখখানেকের মতো। কী করে জোগাড় করব, দেবদা?’

‘এত ভাবিস না। ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। আমরা তো তোর পাশে আছি।’

‘তুমি কিন্তু আমার কোয়েশ্চেনের জবাবটা দিলে না।’

‘কোন কোয়েশ্চেনটার রে?’

‘কাউকে দিয়ে নার্সিং হোমে ফোন করিয়েছিলে? পেমেন্টের জন্য এরা সকালে একবার তাগাদা দিয়েছিল।

এখন কিন্তু আমার কাছ থেকে টাকা-পয়সা কিছু চাইল না।’

‘বাঃ এ তো দারুণ খবর। তোর মতো বিউটিফুল একটা মেয়ে নার্সিং হোমে গেছে, এতেই বোধহয় ওরা মোহিত হয়ে গেছে।’

‘দেবদা, এটা কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করার সময়?’

‘তোর ঠাট্টা মনে হল? এই তো সকালে মিসেস বিলমোরিয়া তোর সম্পর্কে কথাটা বলে গেলেন।’

‘মিসেস বিলমোরিয়া আবার কে?’

‘তুই চিনিস না, তাই না? আমাদের গোল্ড কার্ড মেম্বার। ওহ হো, এ বার সব মনে পড়েছে। কী কো-ইনসিডেন্স ভাব, অনিরুদ্ধ যখন এসে আমায় বলল, মাসিমা ইলিয়ট নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছে, তখন আমার মনে পড়ল, ওটা তো মিসেস বিলমোরিয়াদের নার্সিং হোম। তোর কী কপাল দ্যাখ, ঠিক তখনই মিসেস বিলমোরিয়া সাবস্ক্রিপসন দিতে এসেছিলেন। ওঁকে বলতেই, উনি প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, জিম-এর কোন মেয়েটার মা ভর্তি হয়েছে বলছেন? এইটথ জোনের বিউটিফুল মেয়েটা? কী আশ্চর্য, দেখলাম, উনি তোকে ভালমতো চেনেন। তোর খুব গুণগান করছিলেন বিলমোরিয়া ম্যাম। শেষে বললেন, ঠিক আছে, আমি নার্সিং হোমের সিইওকে বলে দিচ্ছি। তার পর উনি কী করেছেন, আমি জানি না রে।’

‘কেন মিথ্যে কথা বলছ দেবদা? তুমি আমার জন্য আর কত করবে?’

কোয়েলের গলা ধরে এসেছে। কথা বাড়ালেই কেঁদে ফেলবে। কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে দেব বলল, ‘এই আবার তুই প্যানপ্যানানি শুরু করলি? ফোনটা ছাড়। তোর জন্য আমার লাঞ্চে দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ কথাগুলো বলে দেব লাইনটা কেটে দিল।

সেই সাতসকালে ট্র্যাকশ্যুটটা গায়ে চাপিয়ে ছিল। এক পশলা বৃষ্টির পর তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। গরম লাগছে দেখে দেব আপার আর ইনার… দুটো খুলে ফেলল। ঘণ্টাখানেক ধরে আজ কার্ডিও এক্সারসাইজগুলো করে এসেছে। বুকের মাসলগুলো পাম্প হয়ে রয়েছে। দেওয়ালের আয়নায় চোখ যেতেই ও দেখল, বাইসেপস আর ট্রাইসেপসও মানানসই বলে মনে হচ্ছে। সন্ধের দিকে অ্যাবস-এর ব্যায়ামগুলো করবে। সকাল-বিকেল দেড় ঘণ্টা করে ওর শিডিউল। জিম-এ খালি গায়ে ও যখন ইকুইপমেন্টে বসে, তখন অনেকগুলো মুগ্ধ চোখ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ভগবান ওর শরীরে এমন সব মাসল দিয়েছেন, যা সবাইকে দেন না। সেই মাসলগুলো দেব যত্ন করে দৃশ্যমান করে তুলছে। খালি গায়ে থাকলেই ও আয়নার দিকে তাকায়।

চণ্ডীতলায় জগাদা কথাটা সবাইকে বলতেন। দেবের মাসল ভগবান দিয়েছে রে। বাড়ির কাছাকাছি নেতাজি ব্যায়াম সমিতিতে তখন ও ব্যায়াম করতে যেত। মাটির মেঝে, চারদিকে দরমার দেওয়াল, অ্যাসবেস্টারের ছাদ। জগাদার জিম-এ ইকুইপমেন্ট বলতে বিভিন্ন ওজনের সস্তার ডাম্বেল, বারবেল। আর ডন দেওয়ার জন্য হাতল দেওয়া দুটো কাঠ, ও ল্যাটারাল মাসল বাড়ানোর জন্য রিং। ওখানে ট্রেনিং নিয়েই দেব মি. বেঙ্গল হয়ে যায়। খেতাব জেতার পর জগাদা বলেছিলেন, ‘আর এখানে থাকিস না ভাই। তুই অনেক দূর যাবি। কলকাতার কোনও জিম-এ চলে যা। মনোতোষদা বেঁচে থাকলে তোকে ওঁর কাছে পাঠাতাম। তুই গোয়াবাগানে বিষ্টুদার জিম-এ চলে যা। শুনেছি, ওঁর ছেলে না কি জাপান থেকে মডার্ন ইকুইপমেন্ট আনিয়েছে।’ দেবের কাছে তখন জগাদার আদেশই শেষ কথা। ও তখন কলকাতায় চলে আসে।

জগাদাকে সিলভার জিম-এ নিয়ে আসার খুব ইচ্ছে ছিল দেবের। দেখাতে চেয়েছিল, কোন জিম-এর ও চিফ ট্রেনার। কিন্তু জগাদা মারা গেছেন বছর দুয়েক আগে। এই একটা আফসোস দেবের রয়ে গেছে। আয়নার সামনে থেকে সরে এসে চেয়ারে বসতেই ওর চোখে পড়ল, উল্টোদিকের ডিভানে তমাল আধশোয়া হয়ে আছে। নিজের শরীরটাকে এতক্ষণ এমন মন দিয়ে দেখছিল যে, তমাল কখন ঘরে ঢুকে এসেছে, দেব খেয়ালও করেনি। সমবয়সি তমাল সিলভার হোটেলের শ্যেফ। কন্টিনেন্টাল ফুড এক্সপার্ট। সিডনির কোনও এক হোটেল ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে জিম ওপেন করার আগে শরাফ স্যার যখন দেবকে রিক্রুট করেন, তখনই বলে দিয়েছিলেন, হোটেলের ছাদে স্টাফ কোয়ার্টার্সে ওকে থাকতে হবে। তবে রুম শেয়ার করে। তার পর থেকে তমাল ওর রুম পার্টনার। আলাপ পরিচয় পর্বের পর, জেনে দেবের ভাল লেগেছিল, তমাল হুগলির জনাইয়ের ছেলে। ওদের চণ্ডীতলার বাড়ি পেরিয়ে জনাইয়ে যেতে হয়।

তমাল মিটিমিটি হাসছে। চোখাচোখি হতে জিজ্ঞেস করল, ‘যোগাকন্যা ফোন করেছিল, তাই না?’

তমাল কোয়েলের নাম দিয়েছে যোগাকন্যা। দেব বলল, ‘হ্যাঁ। ওর মা নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছেন।’

‘সে তো কথাবার্তাতেই বুঝতে পারলাম। তোর কত গচ্চা গেল দেব?’

প্রশ্নটা শুনে রাগ হয়ে গেল দেবের। অন্য কেউ হলে বলে দিত, ‘দ্যাটস নান অফ ইয়োর বিজনেস।’ কিন্তু নিজেকে ও সংবরণ করল। তমাল খুব ভাল মনের ছেলে। এমন একজন, যার সঙ্গে সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ও শেয়ার করে। উত্তর না দিয়ে দেব লাঞ্চ সাজানোয় মন দিল। আর সাড়ে তিনমাস পর ব্যাঙ্ককে মি. এশিয়া প্যাসিফিক কনটেস্ট। ও ঠিক করেছে, সেখানে অংশ নেবে। তিনমাস আগে ও ফাইনাল প্রিপারেশন শুরু করবে। তাই এখন ফুড ইনটেক বাড়াচ্ছে। গতবছর ঠাকুর আনন্দ সিং বলে একজন মি. ওয়ার্ল্ড খেতাব জিতেছিল। আজমগড়ের ছেলে। ওর কাছ থেকে ফুড আর সাপ্লিমেন্ট চার্ট আনিয়েছে দেব। দিনে ছয়বার করে এখন খাচ্ছে। সকাল ছ’টায় সাপ্লিমেন্ট, বেলা ন’টায় ব্রেক ফাস্ট, দুপুর একটায় লাঞ্চ, বিকেল চারটে আর সন্ধে সাতটায় সাপ্লিমেন্ট, আর রাত দশটায় ডিনার। চার্ট অনুযায়ী, কখন কোন মিল পাঠাবে, তার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়েছে তমাল। নিজে তদারকি করে খাবারটা তৈরি করে ও হয় জিম-এ পাঠায়, নয়তো রুমে রেখে দেয়। তমালকে এখন ওর খুব দরকার।

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে তমাল উঠে বসে বলল, ‘গোঁসা করলি না কি ভাই?’

দেব বলল, ‘মাথা খারাপ। গোঁসা তো মেয়েরা করে। তা ছাড়া, নিজের পায়ে কি কেউ কুড়ুল মারে? তুই বিগড়ে গেলে আমার মি. এশিয়া প্যাসিফিক হওয়া হবে না। আগামী তিন মাস তোর সাত খুন মাফ।’

হো হো করে হাসতে শুরু করল তমাল। বলল, ‘বর দানের কথাটা তোর মনে আছে তো?’

‘আছে। আমি খেতাব পেলে, তোর সঙ্গে যোগাকন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করে দেবো। ঘটকালি করার দায়িত্ব আমার। কিন্তু তোর যোগাকন্যা জনাইতে গিয়ে থাকবে কি না, সে গ্যারান্টি দিতে পারছি না।’

‘থাঙ্কয়ু ভাই। সেটাই অনেক। একটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। লাঞ্চের প্যাকেটটা কি তুই নিজে খুলবি, না কি সার্ভ করে দিতে হবে?’

‘থাক, এত উপকার করতে হবে না।’ খাবারের প্যাকেট খোলার ফাঁকে দেব বলল, ‘বিকেলের দিকে যদি পারিস, ইলিয়ট নার্সিং হোমে গিয়ে একবার মাসিমাকে দেখে আসিস।’

লাঞ্চের মেন্যুতে একবার চোখ বুলিয়ে দেব সন্তুষ্ট। খাওয়া শুরু করার আগে ও বলল, ‘তুই লাঞ্চ করবি না?’

তমাল বলল, ‘বেলা পাঁচটা থেকে আমার ডিউটি। তুই বরং খেয়ে নে। আমি স্নান-টান সেরে ঘণ্টাখানেক পর লাঞ্চ করে নেবো।’

‘ওপরে আসার সময় দেখলাম, বড় ব্যাঙ্কোয়েট হলটা খুব সাজিয়েছে। কোনও অনুষ্ঠান আছে?’

‘হ্যাঁ। বিরাট পার্টি আছে। মিসেস মোতওয়ানির মেয়ের বিয়ের সঙ্গীত অনুষ্ঠান। তাতেই প্রায় হাজার খানেক লোক নিমন্ত্রিত। কাল বিয়ের পার্টি। জয়পুর আর দিল্লি থেকে ওদের প্রায় তিনশো গেস্ট এসেছে।’

হোটেলে কোনও পার্টি থাকলে তমাল সাধারণত রাত একটার আগে ঘরে ফিরতে পারে না। আজ কত রাত হবে, কে জানে? টেবলে সাজিয়ে রাখা খাবারের প্যাকেটের অ্যালুমনিয়াম ফয়েলটা দেব খুলে ফেলল। মি. বেঙ্গল হওয়ার পর থেকে খাওয়ার ব্যাপারে ও খুব সতর্ক। তেল-ঝাল-মশলার রান্না খায় না। কোনও অনুষ্ঠান বাড়িতে যায় না। জাঙ্ক ফুড কোনওদিন ছোঁয়নি। গত দশ বছর ও সেদ্ধ-র উপর আছে। লাঞ্চে ওর মেন্যু দু’শো গ্রাম চিকেন, দেড়শো গ্রাম ওটমিল, চারটে ডিম আর একটু বেশি পরিমাণে গ্রিন ভেজিটেবলস। হোটেলে রোজ টাটকা সবজি আসে শেয়ালদার কোলে মার্কেট থেকে। দেব দেখল, লাঞ্চ প্যাকেটে আজ টোমাটো, উচ্ছে, পালং শাক, ব্রোকোলি, ক্যাপসিকাম, কামরাঙা দিয়েছে তমাল। সাধারণত বডি বিল্ডারদের শরীরের ওজন অনুযায়ী খাবারের পরিমাণ বেঁধে দেন এক্সপার্টরা। প্রতি কেজি ওজন পিছু ১.২ থেকে ১.৭ গ্রাম খাবার। দেবের ওজন প্রায় অষ্টাশি কেজি। মাপমতো খাবার জোগান দেয় তমাল। হোটেলের শ্যেফ বলে এই সুবিধেটা ওর আছে।

ভাগাড়ে মরা পশুর মাংস বিক্রি নিয়ে মিডিয়ায় যখন খুব হই চই হচ্ছিল, তখন ঘেন্নায় বিফ খাওয়া ছেড়ে দেয় দেব। তার বদলে এখন চিকেন খাচ্ছে। ওটমিলের বদলে কোনও কোনওদিন ফ্যানসহ দু’কাপ গলানো ভাত অথবা দু’পিস ব্রাউন ব্রেড। সেইসঙ্গে দিনে অন্তত দশটা ডিমের সাদা অংশ। বডিবিল্ডারদের প্রচুর পরিমাণে সাপ্লিমেন্ট খেতে হয়। ওয়ার্ক আউট করার আগে এবং পরে। অ্যামিনো অ্যাসিডের গুঁড়ো মেশানো সরবত দিনে দু’বার। এতে প্রচুর প্রোটিন ইনটেক হয়। সাপ্লিমেন্টের দাম ইদানীং অনেক বেড়ে গেছে। কিনতেই মাইনের অর্ধেক টাকা খরচ হয়ে যায় দেবের। ও বুঝতে পারছে, চাকরি করে স্টার বডিবিল্ডার হওয়া যাবে না। ঠাকুর আনন্দ সিংও একটা সময় ওর মতো সমস্যায় পড়েছিল। কিন্তু তখন বলিউডের সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে যায়। সেখান থেকে যা রোজগার হয়েছিল, তা ও খরচ করেছিল মি. ইউনিভার্স হওয়ার প্রস্তুতিতে। কিন্তু দেবের কপালে কি সেই সুযোগ আসবে?

টিভি চালিয়ে দিয়ে খবর শুনছে তমাল। ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে। স্টিফেন ম্যানসনে আগুন। একতলায় শর্ট সার্কিট। আগুন খুব বেশি ছড়ানোর আগেই দমকলের একটা ইঞ্জিন গিয়ে নিভিয়ে ফেলে। কেউ আহত হননি। চ্যানেল বদলানোর ফাঁকে তমাল বলল, ‘অল্পের উপর দিয়ে গেছে। একদিন দেখবি ওই বাড়িটায় বিশাল আগুন লাগবে।’

হোটেল সিলভারের দুটো বাড়ির পরেই স্টিফেন ম্যানসন। রোজ যাতায়াতের পথে চোখে পড়ে। মিসেস ভাল্লা ওই বিশাল বাড়িটাতেই থাকেন। উনি অনেকবার ইনভাইট করেছেন। কিন্তু দেব কোনওদিন স্টিফেন ম্যানসনের ভিতর ঢোকেনি। খাওয়ার ফাঁকে ও জিজ্ঞেস করল, ‘তুই জানলি কী করে?’

তমাল বলল, ‘আমাদের একজন ফ্লোর ম্যানেজার মিস মারিয়া গোমেজ স্টিফেন ম্যানসনে থাকে। আগুন লাগার খবর শুনে ওর সঙ্গে আমিও স্টিফেন ম্যানসনে গেছিলাম। তখন দেখলাম, বাড়িটায় মেনটেনেন্স বলে কিছু হয় না। পুরনো আমলের ইলেকট্রিক্যাল ওয়ারিং। গাদা গাদা তার জড়িয়ে মড়িয়ে রয়েছে। ওখানেই শর্ট সার্কিট হয়েছিল। কী দেখলাম জানিস? দোতলা-তিনতলায় প্রচুর অফিস, গো ডাউন। সারাদিনই না কি উটকো লোকের ভিড়।’

‘কী বলছিস তুই! ফ্ল্যাট ওনাররা কিছু বলেন না?’

‘মারিয়া বলছিল, কার কাছে কমপ্লেন করবে? প্রায় একশো বছরের পুরনো বাড়ি। এখন যিনি মালিক, তাঁকে অনেকে চোখে দেখেননি।’ হঠাৎ কী মনে পড়ায় তমাল উঠে বসে বলল, ‘আরে, একটা ইম্পরট্যান্ট কথা তো তোকে বলতেই ভুলে গেছি।’

‘কী কথা রে?’ খাওয়া থামিয়ে দেব জিজ্ঞেস করল।

‘তোর সেই ড্রিম গার্ল, যাকে তুই রোজ জিম-এর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখিস, সে কোথায় থাকে জানিস? স্টিফেন ম্যানসনে। আজ নিজের চোখে ওকে ওখানে দেখলাম। নামটা কী শুনবি? মিলেনা।’

‘নামটা খুব অদ্ভুত তো। বাঙালি বলে মনে হয় না।’

‘সেটা জানি না। মোস্ট ইম্পরট্যান্ট হল, আমাদের মারিয়া ওকে খুব ভাল করে চেনে। তুই যদি মারিয়ার সঙ্গে কথা বলিস, তা হলে সব ইনফো পেয়ে যাবি।’

এত বড় একটা খবর ব্যাটাচ্ছেলে এত পরে জানাচ্ছে! তমালের উপর রাগ হতে লাগল দেবের।

(ছয়)

মিডলটন রো-র মোড়ে বাঁক নেওয়ার সময় জিম-এর দিকে আড়চোখে একবার তাকাল মিলেনা। দেবদূতকে আজ ওর চোখে পড়ল না। রোজ কখনও কাচের দেওয়ালের ওপাশে, কখনও গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। মিলেনার মনে হয়, যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য কোনও কোনওদিন ও দশ মিনিট আগে-পরে জিম-এর পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে। তখনও দেখেছে, দেবদূত দাঁড়িয়ে। ওর চোখ অনুসরণ করে বটে, কিন্তু কখনও পিছু নেয় না।

মিডলটন রো-তে একটা ক্রেশ কাম মন্তেসরি স্কুলে পড়ায় মিলেনা। সকাল সাড়ে ছ’টায় ও স্কুলে যায়। একই রাস্তা দিয়ে ফেরে বেলা সাড়ে বারোটার সময়। কাচের দেওয়ালের ওপাশে তখন দেখতে পায়, ভারী ভারী ইকুইপমেন্টে বসে দেবদূত ব্যায়াম করছে। খালি গায়ে ওকে গ্রিক দেবতাদের মতো দেখায়। গা দিয়ে ঘাম ঝরে, ফ্লুরোসেন্ট আলোয় চকচক করে। ওরে মাসলগুলো আরও খাঁজ কেটে বেরোয়। ছেলেটার নাম যে দেবদূত, এই ক’দিন আগেও তা জানত না মিলেনা। নামটা ওকে বলে, স্টিফেন ম্যানসনে ওর প্রতিবেশী মারিয়া। মাঝে একদিন ম্যানসনের একতলায় শর্ট সার্কিট হয়েছিল। দমকল এসে চট করে আগুন নিভিয়ে ফেলে। তার কয়েক দিন পরে ওদের ফ্ল্যাটে আড্ডা মারতে এসেছিল মারিয়া। তখনই কথায় কথায় ও জানতে চায়, ‘হ্যাঁ রে, ডেভিডের সঙ্গে তোর সম্পর্কটা একনও আছে?’

ডেভিড ছিল মিলেনার বয়ফ্রেন্ড। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কমিউনিটির ছেলে, আইরিশ অরিজিন। ওদের পরিবার মাইগ্রেট করে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। তাই মিলেনা বলেছিল, ‘না, নেই। হঠাৎ ওর প্রসঙ্গ তুলছিস?’

‘তোর সঙ্গে আলাপ করার জন্য একটা ছেলে পাগল। একবার মিট করবি না কি?’

এর পর যা হয়, কৌতূহলে মিলেনা জানতে চেয়েছিল, ছেলেটা কে? মারিয়া যা বর্ণনা দিয়েছিল, তাতে জিম-এর ছেলেটার কথাই ওর মনে হয়েছিল। মারিয়ার কাছে ও কিছু ভাঙেনি। শুধু দেবদূত সম্পর্কে যা জানার জেনে নিয়েছিল। সবশেষে বলেছিল, ‘ভেবে দেখি।’ নতুন করে কারও সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছে মিলেনার হচ্ছে না। কলকাতায় ও কতদিন আর থাকবে, সেটাই ওর জানা নেই। আসলে ওরা আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের। ওর ড্যাডি এরিক গ্রিগোরিয়ানের বিশাল ব্যবসা তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। মিলেনার জন্ম অবশ্য দার্জিলিংয়ে। ওর গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডপার হোটেল ছিল সেখানে। দ্য এভারেস্ট হোটেল। একটা সময় যে হোটেলকে তুলনা করা হত কলকাতার গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড-এর সঙ্গে। এরিক ইস্তাম্বুল থেকে বছরে একবার করে আসতেন হোটেল ব্যবসা দেখতে। মিলেনা তখন পড়াশুনো করত দার্জিলিংয়ের লোরেটো স্কুলে।

বছর দশেক আগে এভারেস্ট হোটেলে মারাত্মক আগুন লাগে। অর্ধেকটাই পুড়ে যায়। ইস্তাম্বুল থেকে এসে এরিক এভারেস্ট হোটেল বিক্রি করে দেন। ড্যাডির সঙ্গে মিলেনারও ইস্তাম্বুলে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার বদলে ড্যাডি ওকে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন জেএনইউতে পড়ার জন্য। এমবিএ করার পর মিলেনা কলকাতায় চলে এসেছে। এরিকের এক পূর্বপুরুষ জোনাথন কলকাতায় একটা বিশাল বাড়ি বানিয়ে গেছিলেন। বাড়িটার নাম স্টিফেন ম্যানসন। দু’পুরুষ আগে এরিকদের পরিবারের সবাই কলকাতা ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু চার কামরার একটা ফ্ল্যাট এখনও রয়েছে গ্রিগোরিয়ানদের নামে। সেই ফ্ল্যাটে থাকেন এরিকের এক দূর সম্পর্কের আঙ্কল টাইগ্রান গ্রেগারিয়ান। বয়স আশির উপর, খিটখিটে টাইপের মানুষ। তাঁকে দেখাশুনো করার দায়িত্ব এখন মিলেনার উপর।

কলকাতায় এখন আর্মেনিয়ানরা আর নেই বললেই চলে। সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র দেড়শোর কাছাকাছি। ওদের হোলি ন্যাজারেথ চার্চে গেলে রবিবার সবার সঙ্গে মিলেনার দেখা হয়। ডেভিডের সঙ্গে ব্রেক আপ হয়ে যাওয়ার পর ফেস বুক আর হোয়াটসঅ্যাপ করে ওর সময় আর কাটত না। তখন চার্চে ডরোথি আন্টিই ওকে একদিন বলেছিল, ‘ক্যামাক স্ট্রিটে আমি আর শান্তা চ্যাটার্জি মিলে বাচ্চাদের ক্রেশ আর স্কুল খুলেছি। এসো না, স্কুলটাকে দাঁড় করাই।’ বাচ্চাদের ভালবাসে বলে সঙ্গে সঙ্গে মিলেনা রাজি হয়ে গেছিল। তিনটে বাচ্চাকে নিয়ে স্কুল শুরু হয়েছিল। এখন সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় একশোতে। ক্রেশ-এ ব্যস্ততা বাড়ে বেলা আটটার পর থেকে। বাচ্চাদের ক্রেশ-এ দিয়ে মা-বাবারা অফিসে ঢুকে যায়। ঘণ্টা চারেক বাচ্চাদের মাঝে খুব আনন্দে কাটায় মিলেনা। ভাইস প্রিন্সিপাল শান্তা আন্টিকেও ওর খুব ভাল লাগে।

মিডলটন রো ধরে হেঁটে মিলেনা স্কুলের দিকে যাচ্ছে। এমন সময় ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল নাজমার। মেয়েটা ওদের বাড়িতে রাঁধুনির কাজ করে। থাকে ভবানীপুরের দিকে। সকালবেলায় আসে, সন্ধেবেলায় ডিনার সাজিয়ে দিয়ে ফিরে যায়। সারাদিন ধরে টাইগ্রান গ্র্যান্ডপার কাছে বকুনি খায়। স্কুল থেকে মিলেনা বাড়ি ফিরলেই রোজ মেয়েটা কমপ্লেন করে। তবুও, কাজ ছেড়ে যায়নি। গতকাল বাড়ি ফিরে ওকে দেখতে পায়নি, মনে পড়ায় মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘কাল তোর কি হয়েছিল রে? তুই চলে গেলি কেন?’

‘বুড়োর ভীমরতি হয়েছে দিদি। ডাগতার দেখাও। কাল রেগে গিয়ে আমায় চড় মেরেছিল।’

নাজমার অনেক কথা মিলেনা বুঝতে পারে না। যেমন ভীমরতি কথাটা এখন বুঝতে পারল না। কথা না বাড়িয়ে ও বলল, ‘তোর গায়ে গ্র্যান্ডপা হাত তুলেছিল! কেন?’

‘হঠাৎ বুড়োর ইচ্ছে হল, ডোলমা খাবে। ল্যাম্ব আর রাইস দিয়ে তৈরি করে দিলাম। মুখে দিয়ে বুড়ো খেপে লাল। বলে না কি ভাল হয়নি। তার পরই ঠাস করে আমাকে চড়। ইংজিরিতে কী বলে আমি বুঝতে পারি না। আমাকে ধাক্কা মেরে বাইরে বের করে দিল।’

ডোলমা হল একধরনের আর্মেনিয়ান খাবার। ইস, ওকে চড় মারা গ্র্যান্ডপার ঠিক হয়নি। বোঝানোর ভঙ্গিতে মিলেনা বলল, ‘কিছু মনে করিস না। গ্র্যান্ডপার বয়স হয়ে গেছে তো। কখন কাকে কী বলে, ঠিক নেই। আমাকেও তো কত কথা শোনায়।’

‘আমার বর যদি চড় মারার কথা শুনত, তা’লে আমাকে আসতেই দিত না। কিন্তু তোমার কথা ভেবেই আজ আমি এলাম। তুমি যাও দিদি, স্কুল যেতে তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিলেনা দেখল, সত্যিই পাঁচ-সাত মিনিট দেরি হয়ে গেছে। স্কুলটা অবশ্য খুব দূরে নয়। সোজা চার্চের একেবারে পাশেই। তাড়াতাড়ি ও পা চালাল। ঠিক সেইসময় একটা মোটর বাইক এসে দাঁড়াল ফুটপাত ঘেঁষে। পিছনের সিট থেকে লাফিয়ে নামল সানগ্লাস পরা একটা ছেলে। সমবয়সি, গাট্টাগোট্টা চেহারা। সাদা প্যান্ট-শার্ট পরা। গলায় সোনার মোটা চেন। গায়ের রং বেশ কালো। পথ আটকেই হিন্দিতে ছেলেটা বলল, ‘আপনি স্টিফেন ম্যানসনে থাকেন, না?’

ভ্রু কুঁচকে তাকাল মিলেনা। বলল, ‘ইয়েস।’

‘টাইগ্রান গাগরিয়ান আপনার কে হয়?’

মুখ দিয়ে মদের গন্ধ বেরচ্ছে। বোধহয় রাতে আকণ্ঠ পান করেছিল। এখনও হজম হয়নি। ছেলেটার আক্রমণাত্মক ভঙ্গি দেখে এক পা পিছিয়ে গেল মিলেনা। গ্র্যান্ডপা-র নাম শুনেই ও সতর্ক হয়ে গেল। ও হিন্দি আর বাংলা দুটোই ভাল বলতে পারে। তবুও ইংরেজিতে বলল, ‘মাই গ্র্যান্ডপা। বাট হু আর ইউ?’

বাইক চালাচ্ছিল যে ছেলেটাকে, তাকে সানগ্লাস বলল, ‘ঠিক মেয়েটাকেই ধরেছি।’

‘রেন্ডিটাকে এত ভালভাবে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। চমকাও ওস্তাদ।’

সানগ্লাস বলল, ‘আই অ্যাম রুস্তম। আই কন্ট্রোল পার্ক স্ট্রিট।’ হাত ঘুরিয়ে পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলটা দেখিয়ে ছেলেটা কী একটা বলার জন্য কথা হাতড়াতে লাগল। তার পর বলল, ‘ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড বেঙ্গলি?’

‘ইয়েস অফকোর্স। আমি বাংলা বলতে পারি।’

বাইকার ছেলেটা অধৈর্য হয়ে বলল, ‘এত ইংজিরি বলার দরকার নেই ওস্তাদ। হিন্দিতে গালি দাও। গালি বুঝতে পারবে।’

ছেলে দু’টোর হাবভাব মিলেনার ভাল লাগল না। সকালের দিকে এই সময়টায় ফুটপাথ দিয়ে লোক চলাচলও কম। আশপাশ তাকিয়ে ও দেখল, নামী শো রুমগুলো এখনও শাটার তোলেনি। শুধু রাস্তার ধারে একটা টি স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে দু’তিনজন চা খাচ্ছে। রোজ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় বলে চা-ওয়ালাটা ওর মুখ চেনে। সম্ভবত, ছেলে দু’টোকেও জানে। চা-ওয়ালা অবাক চোখে এ দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছেলেটাই তা হলে রুস্তম। নামটা আগে শুনেছে মিলেনা। ছেলেটা না কি দু’তিনদিন আগে গ্র্যান্ডপার সঙ্গে কথা বলতে গেছিল। মাস কয়েক ধরে এই নতুন এক অশান্তি শুরু হয়েছে ওদের জীবনে। পার্ক স্ট্রিটের অ্যান্টিসোশ্যাল… রুস্তমের নজর পড়েছে স্টিফেন ম্যানসনে ওদের ফ্ল্যাটের উপর। লোক মারফৎ সে চাপ দিচ্ছে ফ্ল্যাটটা বিক্রি করার জন্য। গ্র্যান্ডপার কাছে প্রায়ই দালাল পাঠাচ্ছে। নানারকম ভয় দেখাচ্ছে।

রুস্তমকে পাত্তা না দিয়ে মিলেনা এক পা এগিয়ে, বলল, ‘রাস্তা ছাড়ুন। আমাকে স্কুলে যেতে হবে।’

গলার স্বরটা একটু উচ্চগ্রামেই হয়ে গেছিল। পথচলতি দু’একজন থমকে দাঁড়াল। সেটা দেখে রুস্তমের সঙ্গী ছেলেটা কড়া চোখে তাকিয়ে, তার পর হঠাৎই মুখ খিঁচিয়ে মিলেনাকে বলল, ‘এই, তোকে স্কুলে যেতে হবে না। ওস্তাদ যা বলছে, ভাল করে শোন।’

দাঁড়িয়ে পড়া একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, ভাই।’

‘যা-ই হোক না কেন, তোর কী বে শালা? যা, পাতলা হ।’

মাঝবয়সি লোকটা ভয় পেল বলে মনে হল না। পাল্টা বলল, ‘একা একটা মেয়েকে পেয়ে মাস্তানি করছ? এখান থেকে যাও ভাই। জিম-এর ছেলেরা বেরিয়ে পড়লে মুশকিলে পড়বে।’

‘আঈ বাপ। বলে কী!’ বলতে বলতে রুস্তমের সঙ্গী ছেলেটা ভদ্রলোককে ধাক্কা মারল। ‘যা ডেকে লিয়ে আয়, তোর জিম-এর ছেলেদের। চুতিয়াগুলোকে দেখি।’

স্কুলে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। মিলেনা ভয় পেয়ে গেল, ঝামেলাটা হাতাহাতির পর্যায়ে যাচ্ছে দেখে। ও একবার ভাবল, ফোন করে স্কুলে খবর দেবে কি না। কিন্তু সেই সুযোগ দেবে কি রুস্তমরা? ও জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, ‘হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?’ কিন্তু তখনই মিলেনার চোখে পড়ল, স্কুলের দিক থেকে শান্তা আন্টি দ্রুত পায়ে এদিকে আসছেন। সঙ্গে দু’জন সিকিউরিটি গার্ড। খবরটা স্কুলে দিল কে? হাঁফাতে হাঁফাতে কাছে এসে শান্তা আন্টি বললেন, ‘কী হয়েছে মিলেনা? চায়ের দোকানের ছেলেটা গিয়ে এইমাত্তর খবর দিল, কারা যেন স্কুলের টিচারকে হেকল করছে। এরা কারা?’

মিলেনা বলল, ‘জানি না আন্টি। এরা কী চায়, সেটাও বুঝতে পারছি না।’

আশপাশে আরও লোক জড়ো হয়ে গেছে। মিলেনা শুনল, পিছন থেকে কে যেন বললেন, ‘এই ভাই, একজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছ। একটু অন্তত সম্মান দিয়ে বলো।’

লোকটাকে দেখার জন্য ঘাড় ঘোরাতেই মিলেনা চমকে উঠল। আরে, এ তো জিম-এর সেই ছেলেটা… দেবদূত! রোজ ওকে দেখার জন্য যে দাঁড়িয়ে থাকে। যার কথা ভাবতে ভাবতে আজ ও স্কুলে যাচ্ছিল। দেবদূতের সঙ্গে আরও দু’তিনজন রয়েছে। মাই গুডনেস, দু’দলের মধ্যে মারপিট লাগবে না কি? কথাটা মনে হওয়া মাত্র, মিলেনা দেখল, রুস্তম চোখ পাকিয়ে তেড়ে যাচ্ছে দেবদূতের দিকে। ‘তুই আবার আমার সঙ্গে পাঙ্গা নিতে এসেছিস?’ শুনে ভয়ে মিলেনা খানিকটা সরে গেল। রুস্তম চেনে না কি দেবদূতকে? এইসব অ্যান্টি সোশ্যাল ছেলেদের বিশ্বাস নেই। মাথা গরম করলে রক্তারক্তি করে দিতে পারে।

রুস্তম কথা কাটাকাটি করছে দেবদূতের সঙ্গে। ওদের কথাবার্তায় মিলেনা বুঝতে পারল, পুরনো ঝগড়া। আগেও এক দু’বার ওদের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। দেবদূতের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে ভয়ের কোনও চিহ্ন নেই। ও বলল, ‘তোর আবিদ ভাইজান না মানা করে দিয়েছিল, জিম-এর ধারে-কাছে আসবি না। ফের মাস্তানি করতে এসেছিস? মেয়েটাকে একা পেয়ে চমকাচ্ছিস? ছিঃ রুস্তম।’

সঙ্গী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রুস্তম বলল, ‘রেন্ডি মাগীটার সামনে হিরো হতে চাইছে?’ কথাটা বলেই আমচকা ও ঘুসি চালাল। চট করে ডান দিকে সরে গিয়ে দেব ওর মুষ্টিবদ্ধ হাতটা ধরে ফেলল। হাতটা মুচড়ে ধরে দেবদূত সঙ্গী ছেলেটাকে বলল, ‘আসফাক, পিস্তল-টিস্তল সঙ্গে এনেছিস, না কি খালি হাতে মাস্তানি করতে এসেছিস।’

বজ্র আঁটুনিতে রুস্তমের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। কিছুতেই ও হাত ছাড়াতে পারছে না। কয়েক সেকেন্ড পর হাতটা ছেড়ে দিয়ে দেবদূত বলল, ‘ডেরায় গিয়ে হাতে স্প্রে লাগাস। এটা স্রেফ ট্রেলার দেখালাম। আসল হিরোর ম্যাজিক দেখতে হলে তোকে পুরো পিকচার দেখতে হবে।’

ঝুলে যাওয়া হাত ধরে রুস্তম হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে। চোখ-মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন স্পষ্ট। ভিড়ের মাঝখান থেকে কে যেন বলল, ‘দাদা, ছাড়বেন না। ওর চামচাটাকেও শিক্ষা দিন।’

অবস্থা সুবিধের নয় বুঝে, ততক্ষণে রুস্তমের সঙ্গী আসফাক চট করে বাইকে চেপে বসেছে। কিন্তু তড়পানি কমেনি। দেবদূতের দিকে তাকিয়ে ও বলল, ‘তুই কিন্তু ভাল করলি না। পরে দলবল নিয়ে আসছি। তোর হিরোইনের মুখে অ্যাসিড তো মারবই, তোকেও পিস করে কাটব।’

শুনে দেবদূত হেসে ফেলল। তার পর ঝুঁকে রুস্তমকে বলল, ‘কী রে, বাইকে বসতে পারবি? না কি তোকে আমার ছেলেরা পৌঁছে দেবে? এখন কোথায় যাবি, বল?’

রুস্তম কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে বাইকে চেপে বসল। যাওয়ার আগে জ্বলন্ত চোখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে গেল। দেখে এই প্রথম বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল মিলেনার। কৃতজ্ঞ চোখে দেবদূতের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল, ছেলেটাকে অহেতুক ও বিপদে ফেলে দিল। মারিয়া বলেছিল, দেবদূত এই অঞ্চলেই সারাটা দিন কাটায়। অসম্ভব কিছু নয়, যে কোনও সময় রুস্তমরা ওকে অ্যাটাক করতে পারে। কিন্তু ছেলেটা হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে, মিলেনা বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ দেবদূত।’

হাসিটা মুখে ধরে রেখেই দেবদূত বলল, ‘হাউ ডু ইউ নো মাই নেম মিলেনা?’

‘আই ক্যান আস্ক ইউ দ্য সেম কোয়েশ্চেন টু ইউ।’

এমন সময় শান্তা আন্টি বললেন, ‘থ্যাঙ্কস ইয়ংম্যান। তুমি কি চেনো এই রাস্কেল দু’টোকে?’

দেবদূত বলল, ‘এই অঞ্চলে আগে গুণ্ডামি করতে দেখেছি। একজনের নাম রুস্তম, অন্যজনের আসফাক। এদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই ম্যাডাম। যদি তেমন কিছু হয়, তা হলে জিম-এ একটা খবর দেবেন। আমি সিলভার জিম-এ সারাদিনই থাকি।’

শান্তা আন্টির সঙ্গে স্কুলের দিকে হাঁটার সময় হঠাৎই ডেভিডকে মনে পড়ল মিলেনার। বাইকে করে একদিন অনেক রাতে ওরা দু’জন ফিরছিল সল্ট লেকের এক ডিস্কোথেক থেকে। মা ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় তিনজন বাইকারের সঙ্গে ঝামেলায় ওরা জড়িয়ে পড়ে। ডেভিড সেদিন ছেলেগুলোকে ফেস করেনি। বলতে গেলে পালিয়ে এসেছিল। কত তফাৎ ডেভিডের সঙ্গে দেবদূতের!

(সাত)

অফিসে বসে স্টিফেন ম্যানসন সম্পর্কে রিপোর্ট লিখছিলেন শিখিন। সেন্ট্রাল ক্যালকাটায় রাজপথের ধারে অত বড় একটা বাড়ির ফায়ার ক্লিয়ারেন্স নেই জেনে তিনি অবাক। সেদিন আগুন নিভিয়ে ফেরার পর কথায় কথায় ডিরেক্টর জেনারেল প্রেমকুমার তিওয়ারি কাছে তিনি অভিযোগ করেছিলেন। তিওয়ারি বলেছেন, একটা রিপোর্ট লিখে আমাকে দিন। আমি অ্যাকশন নেবো।’

স্টিফেন ম্যানসনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে রাস্তার ধারে যেসব রেস্তোরাঁ বা শো রুম আছে, তাদের দু’তিনজন ম্যানেজার সেদিন শিখিনের কাছে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন। একজন বলেছিলেন, ‘স্যার, দেখবেন, একদিন এই বাড়িটায় বিরাট অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাবে। সবথেকে ডেঞ্জারাস হল মেজেনাইন ফ্লোর। আগে ছিল না। ফার্স্ট ফ্লোরের লোকেরা সুবিধেমতো বানিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ এই তলাটায় প্রচুর অফিস আর গুদাম গজিয়ে উঠেছে। সেখানে সব মিস্টিরিয়াস লোকের আনাগোনা। পার্ক স্ট্রিট থানায় আমরা একবার কমপ্লেন করেছিলাম। কোনও লাভ হয়নি।’

গত কয়েকদিন ধরে স্টিফেন ম্যানসন বিল্ডিং সম্পর্কে নানা তথ্য বের করেছেন শিখিন। পুরসভার রেকর্ডে বাড়িটার লিজ-হোল্ডার হিসেবে নাম আছে জোরাথন গ্রেগোরিয়ান নামে একজনের। তিনি ছিলেন একজন আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কলকাতার শ্রীবৃদ্ধির জন্য উনি অনেক অর্থব্যয় করেন। শিখিন জানতে পেরেছেন, যে জমির উপর স্টিফেন ম্যানসন তৈরি হয়েছিল, তার মালিক ছিলেন চার্লস ডগলাস। জমিটা প্রায় সাড়ে তিন বিঘের উপর। একেবারে গোড়ার দিকে, ১৯১৭ সালে ওখানে ছোট একটা দোকানসহ একতলা বাড়ি ছিল। ১৯২০ সালে জোরাথন লিজ নিয়ে সেখানে চারতলা বাড়ি করেন। সেই বাড়ি এখন সাততলা। কোনও পার্মিশন না নিয়েই মালিকরা বাকি তিনতলা তুলেছিলেন।

কী করে এটা সম্ভব হল, কৌতূহল মেটানোর জন্য কর্পোরেশনের রেকর্ড সেকশনে গেছিলেন শিখিন। বাড়িটা রেসিডেন্সিয়াল, না কমার্শিয়াল পারপাসে তৈরি হয়েছিল, তা নিয়েও ধন্ধ ছিল। আইন অনুযায়ী, রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিংয়ের ট্যাক্স এক রকম। কমার্শিয়াল বিল্ডিংয়ের অনেক বেশি। শিখিন জানতে পেরেছেন, স্টিফেন ম্যানসনের মালিকরা কর্পোরেশনকে কিছুই জানাননি। আরও বিরাট একটা অপরাধ ধরা পড়েছে খোঁজ করতে গিয়ে। সাধারণত, কোনও বাড়ি আঠারো মিটারের বেশি উঁচু হলে ফায়ার ডিপার্টমেন্টের ক্লিয়ারেন্স নেওয়া আবশ্যিক। না নিলে ফ্লোর তোলার অনুমতিই দেওয়া হয় না। স্টিফেন ম্যানসনে তলার পর তলা বাড়ানো হয়েছে, অথচ দমকলের কোনও পার্মিশন নেওয়া হয়নি। আশ্চর্য, বাড়িটার বয়স একশো বছর হয়ে গেল, তবুও ফায়ার ডিপার্টমেন্টের দৃষ্টি এড়াল কী করে? তা হলে, এর মধ্যে কি অন্য কোনও খেলা আছে? টাকা-পয়সার লেনদেন? নাহ, বাড়ির মালিকদের ছাড়া যাবে না। যাতে বিরাট জরিমানা হয়, সেই সুপারিশ করে রিপোর্টটা লিখছেন শিখিন।

‘আঙ্কল, ভেতরে আসতে পারি?’

ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে শিখিন দেখলেন, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঈশিতা। প্রাত্যহিক দর্পণ কাগজের রিপোর্টার। বয়স তেইশ-চব্বিশ বছর হবে। ধর্মতলায় কর্পোরেশন বিট-এর খবর করতে আসে। বিকেলের দিকে অফিসে ফেরার আগে প্রায়ই মেয়েটা দমকল অফিস ঘুরে যায়। যদি কোনও খবর পাওয়া যায়, এই আশায়। ও যে বাণীব্রতর মেয়ে, আগে শিখিন তা জানতেন না। বাণীব্রত মিত্তির একটা সময় ন্যাশনাল সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের ওয়াটারপোলো টিমের গোলকিপার ছিল। এখন ক্লাবের সেক্রেটারি। মাঝে কী কেনাকেটার কারণে বাণীব্রত মেয়েকে নিয়ে লিন্ডসে স্ট্রিটে এসেছিল। তখন দমকল অফিসে এসে দেখা করে যায়। মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বাণীব্রত বলেছিল, ‘রিসেন্টলি খবরের কাগজের অফিসে চাকরি পেয়েছে। ও বলছিল, তোদের দমকলে নাকি অনেক রকমের খবর হয়। পারলে আমার মেয়েটাকে খবর-টবর দিস।’

অন্য দিন ঈশিতা বিকেল পাঁচটার পর আসে। আজ বেলা দুটোয় এসে হাজির। ল্যাপটপ বন্ধ করে শিখিন বললেন, ‘এসো এসো। অনেকদিন পরে এলে।’

ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসে মেয়েটা বলল, ‘অফিসে চাপ বেড়ে গেছে আঙ্কল। মাঝে মাঝে ডেস্ক ডিউটিও করতে হচ্ছে। হপ্তায় তিনদিনের বেশি বাইরে বেরতে পারছি না।’

‘আগে বলো, বাণী কেমন আছে।’

‘বাবা ঠিকঠাক। মা সুগারের ফ্যাক্টরি খুলেছে শরীরে।’

মানে সুগারের পেসেন্ট। ঈশিতার মা রেখা সুইমিং করত। যদ্দূর মনে পড়ে, ব্রেস্ট স্ট্রোকে একবার স্টেট চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল। বাণীব্রত রেলে চাকরি পাওয়ার পর ওরা বিয়ে করে। কত বয়স হবে রেখার? পঁয়তাল্লিশও পেরোয়নি। এর মধ্যেই ডায়বেটিক হয়ে গেল? শিখিন বললেন, ‘মাকে যোগা করতে বলো। আমাদের জিম-এ ভাল ট্রেনার আছে। বললে পাঠিয়ে দেবো। বাড়ি গিয়ে শিখিয়ে আসবে।’

‘বলে দেখি।’ কাজের কথায় ঢুকল ঈশিতা, ‘আঙ্কল, কোনও খবর আছে?’

‘কেন, তোমার ঝুলিতে আজ কর্পোরেশনের কোনও নিউজ নেই?’

‘আছে একটা। ভেঙে পড়া পোস্তা ব্রিজ নিয়ে একটা খবর। কাগজ সেটা ক্যারি করবে কি না জানি না।’

‘আমার কাছে কর্পোরেশন রিলেটেড একটা খবর আছে। তবে সেটা তোমার বন্ধুর পেট ডগ রেসকিউর মতো ইন্টারেস্টিং হবে কি না জানি না।’

শুনে ঈশিতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ওর এক বন্ধু থাকে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে আশিয়ানা বিল্ডিংয়ের ছ’তলায়। ওদের পোষা ল্যাপডগটা কী করে যেন বারান্দা থেকে লাফিয়ে প্যারাপেট-এ চলে গেছিল। কিছুতেই সেখান থেকে নামতে পারছিল না। কুঁই কুঁই করে সারাক্ষণ কাঁদছিল। নীচে পড়ে গেলে অবধারিত মারা যেত। ঈশিতার ফোন পেয়ে শিখিন ল্যাডার নিয়ে আশিয়ানায় চলে যান। গিয়ে দেখেন শ’দুয়েক লোক হা হুতাশ করছে। শিখিন ল্যাপডগটাকে উদ্ধার করে আনেন। সেই খবর ঈশিতা কাগজে লিখেছিল। না কি দারুণ রেসপন্স পেয়েছিল পশুপ্রেমীদের কাছ থেকে।

‘কর্পোরেশন রিলেটেড খবরটা কি আঙ্কল?’

‘দিনতিনেক আগে পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন ম্যানসন বাড়িটায় আগুন নেভাতে গেছিলাম। গিয়ে দেখি, বাড়িটার ওপরের তিনটে তলার পার্মিশন নেই। শুধু তাই নয়, নিয়ম অনুযায়ী ফায়ার ক্লিয়ারেন্সও ওরা নেয়নি। কর্পোরেশনের রেকর্ড সেকশনে গিয়ে তুমি খোঁজ নাও। ভাল খবর হয়ে যাবে।’

উত্তেজনায় ঈশিতা উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘দারুণ খবর। কী আশ্চর্য দেখুন আঙ্কল। অন্যদিন আমি আগে কর্পোরেশনে যাই। কিন্তু আজ কী মনে হল, বাস থেকে এক স্টপেজ আগে নেমে পড়লাম। মনে হল, আপনার এখানে এলে খবর পাওয়া যাবে। আমার আন্দাজ খেটে গেল।’

‘শোনো, আমি কিন্তু খবরটা তোমাকে দিইনি। আমার নামটা কোথাও লিক কোরো না। তুমি যদি দমকলকে ক্রিটিসাইজ করে লেখো, তা হলে আমার সুবিধে হবে।’

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আঙ্কল। আমার ডান হাত কী করে, বাঁ হাতও তা জানতে পারে না। আমাকে শুধু বলে দিন, স্টিফেন ম্যানসন বিল্ডিংটা ঠিক কোথায়? নামটা কার কাছে যেন শুনলাম সেদিন। আমাদেরই পরিচিত কারোর অফিস ওই বাড়িতে। ইস, এখন মনে পড়ছে না।’

‘বাড়ির ঠিকানা নাইন্টি ওয়ান পার্ক স্ট্রিট। মিডলটন রো-র ক্রসিংয়ে। জিজ্ঞেস করলে যে কেউ বলে দেবে।’

‘আমাকে একবার ওই বাড়িটায় ঢুঁ মেরে আসতে হবে।’

কথাটা বলে ঈশিতা উঠে দাঁড়াল। আজকালকার ছেলে-মেয়েরা এমন পেশাদার, কাজের বাইরে সময় নষ্ট করতে চায় না। এই যেমন খবর পেয়েই ঈশিতা চলে যেতে চাইছে। চায়ের ট্রে হাতে মন্টু ঘরে ঢুকে এসেছে। দেখে হাতের ইশারায় শিখিন ঈশিতাকে বসতে বললেন। মেয়েটা এলে প্রায়ই হেদুয়ার কথা বলে। ছেলেবেলাটা উত্তর কলকাতার ওই অঞ্চলে তিনি কাটিয়েছেন। কত স্মৃতি জড়িয়ে। ঈশিতা সেগুলো উস্কে দেয়। চেনা প্রতিবেশীদের নিয়ে গল্প করে। কিন্তু যাঁর কথা তিনি সবথেকে বেশি জানতে চান, তার সম্পর্কে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে ভয় পান। রেখার বন্ধু রাখী। একটা সময়ে যার জন্য শিখিন পাগল ছিলেন।

চায়ে চুমুক দিয়ে ঈশিতা হেসে বলল, ‘আঙ্কল, আপনাকে নিয়ে দিনে একবার না একবার কথা ওঠেই আমাদের বাড়িতে। কেন বলুন তো?’

কৌতূহলী হয়ে শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’

‘ভাইয়ার জন্য। ভাইয়া ন্যাশনাল সুইমিং ক্লাবের হয়ে ওয়াটারপোলো লিগে খেলে। আপনার পজিশনে। রোজ বাবা ওকে বলে, আমাদের সময়ে শিখিন এই করত, ওই করত। তুই পারিস না কেন? আঙ্কল, আপনি না কি একেকটা ম্যাচে পনেরো-কুড়িটা করে গোল করতেন? আপনার খেলা দেখার জন্য না কি বেথুন কলেজের মেয়েরাও হেদুয়ার ভিড় করত। অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য?’

খেলোয়াড় জীবনের এইসব প্রশংসা শুনতে পছন্দ করেন শিখিন। তবুও, উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোমাকে এই বাজে গল্পটা কে করেছে ঈশিতা?’

‘রাখী মাসি। উনি নিজেই না কি কলেজ ছুটি হয়ে যাওয়ার পর প্রায়ই হেদুয়ায় যেতেন? আপনি তো রাখী মাসিকে ভালমতো চিনতেন।’

রাখী নিজে বলেছে!! চমকে একবার ঈশিতার দিকে তাকালেন শিখিন। রেখা সব বলে দিয়েছে না কি? বলা যায় না, এখনকার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বাবা-মায়েরা খুল্লামখুল্লা কথা বলে। ঠিক বয়সে বিয়ে হলে, এতদিন তিনি নিজেও ঈশিতার বয়সি মেয়ের বাবা হয়ে যেতেন। প্রশ্নটার সরাসরি উত্তর না দিয়ে শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের বাড়িতে আর কী গল্প হয় আমাকে নিয়ে?’

‘আপনি সাহায্য না করলে বাবার সঙ্গে মায়ের বিয়েটাই না কি হত না? সত্যি?’

‘খানিকটা সত্যি। তোমার দাদু মনোময়দা কিছুতেই চাননি। তখনও বাণী চাকরি পায়নি বলে। ও চট করে রেলে চাকরিটা পেয়ে গেল। তার পর মনোময়দা আর আপত্তি করেননি।’

‘আঙ্কল এটা কি সত্যি, রেলের চাকরিটা আপনি নেননি বলেই বাবা পেয়ে গেছিলেন। আপনিই না কি রেল কর্তাদের সাজেস্ট করেছিলেন, আপনার বদলে বাবাকে নেওয়া হোক।’

‘এ সব আজগুবি কথা কার মুখে শুনেছ?’

‘রাখী মাসি বলেছে। শুনে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। একজন টিমমেটের জন্য কেউ এতটা স্যাক্রিফাইস করতে পারে না কি? কিন্তু পরে বাবা আর মাও আমার কাছে স্বীকার করেছে।’

না, না, প্রসঙ্গটা আর বাড়তে দেওয়া ঠিক না। বুকের ভিতরটা টনটন করছে। তার মানে, তাঁকে নিয়ে বাণীর বাড়িতে ভাল আলোচনাই হয়। কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে শিখিন বললেন, ‘তখন প্লেয়ারদের চাকরি পাওয়াটা, এখনকার মতো কঠিন ছিল না। বাণী নিজের যোগ্যতাতেই চাকরিটা পেয়েছিল। যাক সে কথা। তুমি কিন্তু একটু সাবধানে স্টিফেন ম্যানসনের রিপোর্টটা লিখো। জেনে রাখো, মৌচাকে ঢিল মারতে যাচ্ছ।’

‘এ কথা বলছেন কেন আঙ্কল?’

‘আসলে কী জানো, পার্ক স্ট্রিটের মতো জায়গায় কর্পোরেশনের পার্মিশন না নিয়ে যারা তিনটে তলা তুলে নিতে পারেন, তাঁরা এলেবেলে মানুষ নন। ওই বাড়ির রেসিডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বারদের লিস্ট আনিয়েছি। দেখলাম, দু’টো ব্লকে অনেক ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোক থাকেন। তাঁদের কিন্তু পা মাটিতে পড়ে না। কার সঙ্গে কী নেক্সাস, জানা সম্ভব না।’

‘লেখাটা কি ছাপার আগে আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেবো?’

‘দরকার নেই ঈশিতা। জলে যখন নেমেছ, নিজেকেই সাঁতার কাটতে হবে। আর হ্যাঁ, তোমার ভাইয়াকে বোলো, সামনের রোববার যেন আমার কোয়ার্টারে আসে। আমার কাছ থেকে ও যদি টিপস নিতে চায়, তা হলে দিতে পারি।’

‘ভাইয়া খুব খুশি হবে শুনলে।’ কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিয়ে ঈশিতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ফাঁকা ঘরে বসে শিখিনের মনে হল, মেয়েটা যেন এক টুকরো হেদুয়াকে রেখে দিয়ে গেল। গত প্রায় পঁচিশ বছর তিনি গোলদীঘিতে পা দেননি। কিন্তু ছবির মতো সব মনে আছে। পশ্চিমদিকে একটা কামিনী ফুলের গাছ ছিল। মিষ্টি গন্ধে আশপাশ ম ম করত। গাছের পাশেই ছিল কয়েকটা লোহার বেঞ্চ। সন্ধেবেলায় ক্লাবের সমবয়সি প্লেয়াররা সেই বেঞ্চে বসে খানিকক্ষণ আড্ডা মারতেন। ওই আড্ডাতেই আলাপ রাখীর সঙ্গে।

কালীপুজোর রাতে পাড়ায় একটা আগুন লাগার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই আড্ডাতেই রাখীর সঙ্গে বিচ্ছেদ। ভাগ্যিস, কিছুদিনের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের চাকরিটা পেয়ে গেছিলেন শিখিন। নিজে যেতে প্রথম পোস্টিংটা নেন মালদহে। সেখান থেকে রামপুরহাট, তার পর বহরমপুর, বর্ধমান, কাঁচড়াপাড়া, ব্যারাকপুর। কলকাতায় ফেরার ইচ্ছেটাই শিখিনের চলে গেছিল। বিডন স্ট্রিটে তাঁর পৈতৃক বাড়িটা এখন আর নেই। সেখানে প্রোমোটার চারতলা বাড়ি তুলে দিয়েছে। শরিকদের ভাগাভাগির পর একটা ফ্ল্যাট তিনি পেয়েছিলেন। সেটা বিক্রি করে দেন। ফলে হেদুয়ার যাওয়ার আর প্রয়োজন পড়ে না শিখিনের।

ল্যান্ডলাইন থেকে হঠাৎ কর্কশ শব্দ বেরিয়ে এল। রিসিভার তুলে ডিরেক্টর সাহেবের গলা পেলেন শিখিন, ‘মিঃ চ্যাটার্জি, স্টিফেন ম্যানসনের রিপোর্টটা কি তৈরি করে ফেলেছেন?’

শিখিন বললেন, ‘হ্যাঁ স্যার। রিপোর্টটা কি এখুনি পাঠিয়ে দেবো?’

‘না। একটু হোল্ড করুন। আমি একবার মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলি। তার পর ওদের নোটিশ পাঠাব।’

ঠিকই বলছেন ডিরেক্টর সাহেব। উঁচুতলায় অনেক নাক শোঁকাশুকি হয়ে যায়। সরকারী চাকরি করতে গিয়ে শিখিনের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই বয়সে আগ বাড়িয়ে গালে থাপ্পড় খাওয়ার কোনও দরকার নেই। টেবলের তলা দিয়ে আদানপ্রদান করে যে অনেক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানো যায়, সেটা শিখিন চাকরি জীবনের সাত-আট বছর পর বুঝতে পেরেছিলেন। অনিরুদ্ধরা তা সাত-আট মাসের মধ্যেই বুঝে গেছে। এই ডিরেক্টর সাহেব মাত্র একবছর হল দায়িত্ব নিয়েছেন। এখনও পর্যন্ত তাঁকে অত্যন্ত সৎ লোক বলে শিখিনের মনে হয়েছে। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে স্যার। রিপোর্টটা যখন চাইবেন, পাঠিয়ে দেবো।’

রিপোর্টটা ফাইলবন্দি করে শিখিন উঠে দাঁড়ালেন। কলকাতায় মনে হয়, আজ কোনও ফায়ার ইন্সিডেন্ট নেই। একেকদিন এমনটা হয়। তবে, গরমকালে কোনও বিশ্বাস নেই। এই সিজনে আগুন লাগে বেশি। কোনও কোনওদিন চার-পাঁচটা ঘটনাও ঘটে যায়। মোবাইলে শিখিন দেখলেন, বেলা চারটে বাজে। তাঁর মনে হল, জিম থেকে ঘুরে আসা যায়। চট করে সিদ্ধান্তটা নিয়ে, কন্ট্রোল রুমে ফোন করে তিনি বললেন, ‘আমি এখন সিলভার জিম-এ যাচ্ছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসব। দরকার হলে আমাকে খবর দেবেন।’

(আট)

আসফাকের স্কুটারের পিছনের সিটে বসে করিম বক্স লেনের দিকে যাচ্ছে রুস্তম। ওর ডান হাত প্যান্টের পকেট ছুয়ে আছে। মুঙ্গের থেকে পাচার হয়ে আসা একটা মাকারভ পিস্তল ওই পকেটে আছে। তাতে পাঁচটা গুলি লোড করা। পিস্তলটা ওকে দিয়েছেন আবিদ ভাইজান। পার্ক সার্কাস অঞ্চলে ওদের লিডার। হাতে তুলে দেওয়ার সময় উনি বলেছেন, ‘বিজনটাকে খাল্লাস করে আসবি। আমাদের ছেলেরা প্রায় এক বছর হল, করিম বক্স লেনে ঢুকতে পারছে না। আজই পুরো এলাকাটা আমার চাই। আর শোন, ফিরে এসে পিস্তলটা কিন্তু ফেরত দিবি। ওটার অনেক দাম।’

আসফাককে সঙ্গে নিয়ে অ্যাকশনে এসেছে রুস্তম। ডেঞ্জারাস টাইপের ছেলে। স্কুটার, বাইক ভাল চালাতে পারে। যে এলাকাটা ওরা দখল নিতে যাচ্ছে, তার গলিঘুঁজি ওদের নখদর্পণে। বিকেল বেলায় একবার করিম বক্স লেনে আসফাক চক্কর মেরে গেছে। রাস্তাটা পার্ক সার্কাস স্টেশনের খুব কাছে। মুসলমান অধুষ্যিত পাড়া। ট্রেন থেকে যারা নামে, তাদের ওই গলি দিয়েই অটো রিক্সা স্ট্যান্ডে যেতে হয়। সেই কারণে সারা দিন লোক চলাচল করে। বিকেলে আসফাক ফিরে গিয়ে বলেছে, পুরো অঞ্চলটা থম মেরে আছে। দোকানপাট সব প্রায় বন্ধ। শুধু দু’একটা খাবারের দোকান খোলা। স্থানীয় লোকেরাও ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে।

বনধ চেহারা নেওয়ার পিছনে কারণও আছে। কাল সন্ধেবেলায় রুস্তমদের পার্টিরই ছেলে ইমতিয়াজ করিম বক্স লেনে এসেছিল ওর কোনও এক আত্মীয়ের নিকাহ উপলক্ষে। ওকে চিনতে পেরে বিজনরা তুলে নিয়ে যায়। তার পর কয়েক টুকরো করে রাতে ওকে রেল লাইনের ধারে ফেলে দেয়। ইমতিয়াজের মা আজ সকালে না কি পার্টি অফিসে এসে আবিদ ভাইজানের কাছে খুব কান্নাকাটি করেছিল। সাধারণত ভাইজান চট করে উত্তেজিত হন না। কিন্তু সকালেই না কি পার্টি অফিসে এসে ইমতিয়াজ মুড়ি-তেলেভাজা খেয়ে গেছে। ভাইজান এমনিতেই লাল পার্টির লোকদের দেখতে পারেন না। এখন এত রেগে আছেন যে, রুস্তমকে বলেই দিয়েছেন, ‘আজই তুই রাস্তা সাফ করে আসবি। রেল লাইনের ওপারটাও যাতে আমাদের হাতে চলে আসে, সেটা আমি দেখতে চাই।’

যথেষ্ট তৈরি হয়েই রুস্তম অ্যাকশনে যাচ্ছে। নিজের সঙ্গে পিস্তল তো আছেই, আসফাকের দু’পায়ের ফাঁকে আছে একটা কিট ব্যাগ। তাতে রয়েছে গোটা দশেক বোমা, আর একটা গোস্ত কাটার চপার। চলন্ত অবস্থায় কোনও কারণে বোমা ফেটে গেলে দু’জনেই উড়ে যাবে। সেটা জানে বলেই আসফাক খানাখন্দ বাঁচিয়ে খুব সতর্ক হয়েই স্কুটার চালাচ্ছে। ভাইজানের সুপারি পাওয়ার পর দু’জনে কয়েক পেগ লোড করে নিয়েছে। মাল না খেয়ে যারা অ্যাকশনে যায়, তারা ধুর টাইপের। বহুদিন আগে কথাটা ওকে বলেছিল ওমরভাই। সেদিন স্কুটার চালাচ্ছিল ও। আর পিছনে বসে ছিল ওমরভাই। পরে অন্য একটা অ্যাকশনের জন্য বোমা বাঁধতে গিয়ে ওমরভাইয়ের হাত উড়ে যায়। মানুষটা এখন ফুরফুরা শরিফে ভিক্ষে করে।

সন্ধেবেলায় মাল খাওয়ার সময় ভালো করে প্ল্যান ছকে নিয়েছে রুস্তম। শালা বিজন আগে একটা টালির বাড়িতে থাকত। এখন সামনের জমিতে তিনতলা তুলে নিয়েছে। টালির বাড়িটা আড়ালে চলে গেছে। ওকে খতম করার কাজটা নিঃশব্দে করতে হলে, জানার দরকার ছিল, ওর বেডরুমটা ঠিক কোথায়? বাড়িতে মোট ক’জন লোক? ওকে গার্ড দেওয়ার জন্য রাতে ক’জন থাকে? প্লাস বাড়িতে সিসিটিভি আছে কি না? সব ইনফর্মেশন জোগাড় করেই রুস্তম অ্যাকশনে এসেছে। কাছাকাছি বস্তি থেকে আসফাক তুলে নিয়ে এসেছিল নার্গিস বলে একটা মেয়েকে। বিজনের বাড়িতে কাজ করে মেয়েটা। হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে একটু চমকাতেই নার্গিস সব উগড়ে দিয়েছিল। রাতে না কি বিজন তিনতলার বিল্ডিংয়ে থাকে না। শত্রুদের চোখে ধুলো দিতে ও টালির ঘরে গিয়ে ঘুমোয়। ওর বাড়িতে সিসিটিভি নেই। গার্ড বলতে মাত্র একজনই… আসগর বলে একটা ছেলে, যাকে সবসময় বিজনের পাশে দেখা যায়।

কাজটা আজ ওকে করে আসতেই হবে। না হলে আবিদ ভাইজানের নজর থেকে দূরে চলে যাবে। কয়েকদিন আগে স্টিফেন ম্যানসনের মেয়েটাকে চমকাতে গিয়ে হেনস্তা হয়েছিল রুস্তম। শালা, বডিবিল্ডারটা কোত্থেকে এসে ওর হাত মুচড়ে ধরেছিল। রুস্তমের হাতের ব্যথা সেরে গেছে। কিন্তু দেবের উপর ওর রাগ কমেনি। এখনও ওর আফসোস যায়নি, কেন সেদিন খালি হাতে গেছিল? রুস্তম ঠিক করে নিয়েছে, দেবকে এমন শিক্ষা দেবে, যাতে আর কোনওদিন হিরোগিরি করতে না আসে। আবিদ ভাইজান অবশ্য ওর হেনস্তা হওয়ার কথাটা জানে না। জানলে চড় থাপ্পড় মারত।

রাত প্রায় একটা বাজে। বিজনের এরিয়ায় ঢুকে পড়ছে ওরা দু’জন। হঠাৎ আসফাক বলল, ‘বিজনের বাড়িতে এখনও আলো জ্বলছে ওস্তাদ। কী করবে?’

বিজন কি তা হলে আন্দাজ করেছে ওদের কেউ রিভেঞ্জ নিতে আসবে? হয়তো তৈরি হয়ে রয়েছে। রুস্তম ঠিক করে নিল, যত রাতই হোক না কেন, ওরা ওয়েট করবে। করিম বক্স লেনে মোড়ের মাথায় একটা পাঁচতলা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। কংক্রিটের পিলারের উপর বাড়ির খাঁচাটা সবে দাঁড়িয়েছে। এই অঞ্চলে মুসলমানদের হাতে প্রচুর পয়সা এসে গেছে। বস্তি দখল করে, অনেকেই দুমদাম বাড়ি তুলছে। হাউসিং কমপ্লেক্স করছে, অথবা হোটেল খুলছে। পাঁচতলা এই অসম্পূর্ণ বাড়িতে রাতে কেউ থাকে না। নার্গিসের সঙ্গে কথা হয়ে আছে। ও আজ কোনও অজুহাতে বিজনের বাড়িতে থেকে যাবে। তার পর সুবিধে মতো সময়ে তিনতলার ছাদে উঠে লাল টর্চ দেখাবে। সেইসময় পাঁচতলার বাড়ির কোনও একটা তলায় রুস্তমরা লুকিয়ে থাকবে। টর্চের লাল আলো দেখার পর ওরা বিজনের বাড়ির দিকে এগোবে। সেই ফাঁকে নার্গিস নীচে নেমে এসে বিজনের বাড়ির সদর দরজা খুলে দেবে। তার পর পিছনের দিকে টালির ঘরে ঢুকে বিজনকে ওরা খাল্লাস করবে।

করিম বক্স লেনে ঢোকার আগে খাবারের দোকানে দাঁড়িয়ে রুস্তম দু’প্যাকেট কাবাব কিনে নিল। নার্গিসের মুখে ওরা শুনেছে, রাতে বিজনের বাড়ির সামনে পাঁচ-সাতটা লেড়ি কুত্তা না কি পাহারা দেয়। বিজন ইচ্ছে করেই কুত্তাগুলো পোষে। রাতে রাস্তায় অবাঞ্চিত কাউকে দেখলেই না কি কুত্তাগুলো ঘেউ ঘেউ করে। ওদের মুখ বন্ধ করার জন্যই কাবাব। বিষ মিশিয়ে মুখ একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার কথা তুলেছিল আসফাক। কিন্তু সেটা রুস্তমের পছন্দ হয়নি। পাঁচতলা নতুন বাড়ির কমপাউন্ডে ঢুকে টিনের আড়ালে আসফাক স্কুটারটা এমন একটা জায়গায় রাখল, যাতে হঠাৎ কারোর চোখে না পড়ে। রাস্তায় বাঁক নিয়ে একশোগজ দূরেই বিজনের বাড়ি। তৈরি হতে থাকা বাড়িটার তিনতলায় উঠে ওরা দেখতে পেল, বিজনের বাড়ির দরজার সামনে একটা পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলে রাস্তায় রাস্তায় কর্পোরেশন সাদা এলইডি আলো লাগিয়েছে। বিজনের লালরংয়ের বাড়িটা ঝকঝক করছে।

জিপ দেখে রুস্তম আর আসফাক মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। বিজন পুলিশ প্রোটেকশন চাইতে পারে, এ কথাটা ওদের মাথায় আসেনি। তা হলে কি নার্গিস বেইমানি করল? ও কি বিজন মাদারচোতকে সব বলে দিয়েছে? প্রশ্নটা ফিসফিস করে আসফাককে করে বসল রুস্তম। কিন্তু আসফাক কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘না ওস্তাদ। নার্গিস আমার সঙ্গে দু’নম্বরি করবে না। ও আমার সঙ্গে শোয়। দেখো গে, হয়তো পুলিশ তোলার টাকা নিতে এসেছে। লুলিশের নোলা তো কম না।’

অত রাতেও বিজনের বাড়ির ভিতর থেকে দু’তিনটে ছেলে বাইরে এসে দাঁড়াল। সিগারেট খেতে খেতে ওরা কী যেন আলোচনা করছে। তাদের একজনকে না কি চেনে আসফাক। অটো ইউনিয়নের ছেলেটার নাম নন্দু। আগে আবিদ ভাইজানের শেল্টারে ছিল। এখন বিজনের দলে গিয়ে ভিড়েছে। এ রকম দলবদল পার্টিতে আকচারই হয়। যে যেখানে থেকে যত বেশি মাল খিঁচতে পারে, সেখানে গিয়ে ভেড়ে। উপর থেকে রুস্তম দেখল, বিজনের বাড়ির আশপাশটা একেবারে শুনশান। দূরে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে পার্ক সার্কাস স্টেশনের লাল সিগন্যাল দেখা যাচ্ছে। সেটা দেখে হঠাৎ রুস্তমের ছেলেবেলাকার কথা মনে পড়ল। ওই রেললাইনের ধারে একটা ঝুপড়িতে ওর ছোটবেলাটা কেটেছে।

কী দুর্দশার মধ্যেই না কেটেছে রুস্তমের জীবন সেইসময়। আম্মি কয়েক বাড়িতে ঝিগিরি করত। সেই রোজগারের টাকায় ওদের দু’বেলা ভাল করে খাবার জুটত না। স্কুলে ভর্তি হয়েছিল বটে, কিন্তু পড়াশুনো খুব বেশিদূর এগোয়নি। সেইসময় ফুটবল খেলায় রুস্তমের মারাত্মক ঝোঁক। ভাল ট্রেনিং পেলে হয়তো ময়দানের কোনও ক্লাবের গোলকিপার হতে পারত। কিন্তু, ওর যখন বারো-তেরো বছর বয়স, আম্মি তখন ওকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। স্টেশনের কাছে খান মহম্মদের মাংসের দোকানে। এমনি সময় রেওয়াজি খাসি, মুরগি আর ঈদের সময় উট আর গরুর মাংস বিক্রি হত সেই দোকান থেকে। ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে রুস্তমকে যেতে হত রেললাইনের ধারেই পরিত্যক্ত এক ট্যানারির গো ডাউনে। খান সাহেব দু’তিনটে করে খাসি জবাই করত রোজ। হালালের সময় পরিত্রাহি ডাক শুনতে শুনতে একটা সময় ভয় পালিয়ে যায় রুস্তমের মন থেকে। ছাল ছাড়ানোর সময় ও সাহায্য করত খান সাহেবকে। এক দেড় বছরের মধ্যেই দোকানে খাসি আর মুরগির মাংস বিক্রি করায় পটু হয়ে উঠেছিল রুস্তম।

সেইসময় একবার ভোররাতে রেল লাইন দিয়ে হেঁটে ট্যানারির দিকে যাওয়ার সময় এমন একটা ঘটনা ঘটে, রুস্তমের জীবনটাই তাতে বদলে যায়। ও দেখে, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে একটা লোক দৌড়তে দৌড়তে আসছে। খুট করে একটা শব্দ হল। লোকটা হুমড়ি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল রেল লাইনে। বেশ খানিকটা দূরে দুটো লোক দৌড়ে এদিকে আসছে। রুস্তমের কী মনে হয়েছিল কে জানে, হুমড়ি খেয়ে পড়া লোকটাকে টেনে রেল লাইনের ঢাল দিয়ে সাঁ করে নীচের দিকে গড়িয়ে যায়। শেষে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। দু’তিন মিনিট পড়েই রুস্তম বুঝতে পারে, যে দু’জন তাড়া করছিল, তারা রেল পুলিশ। যাকে ও আড়াল করেছে, সে ওয়াগন ব্রেকার। তার পায়ে গুলি লেগেছে। ওই বয়সেই রুস্তম বুঝে গেছিল, কারা ওয়াগন ব্রেকার। প্রায় রাতেই ওদের ঝুপড়ির কাছে রেলের মালগাড়ি যান্ত্রব শব্দ তুলে দাঁড়িয়ে পড়ত। ওয়াগন ব্রেকাররা অবাধে লুটপাট করত। আম্মি ভয় দেখাত, ‘জানলা দিয়ে উঁকি মারিস না বাবা। দেখলে পুলিশ গুলি করে দেবে।’

পুলিশের হাত থেকে রুস্তম সেদিন যাকে বাঁচিয়েছিল সে আবিদ ভাইজান। মানুষটার সংস্পর্শে এসে, বলা ভাল, তাঁর ছত্রছায়ায় ঢুকে ভয়ডর বলে এখন রুস্তমের কিছু নেই। ও-ই এখন পার্ক সার্কাস অঞ্চলের আতঙ্ক।

অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসতেই ওর চোখে পড়ল, সিগন্যালের লাল আলোটা সবুজ হয়ে গেছে। একটু পরেই জিপ আর মোটর বাইক চলে যাওয়ার শব্দ ওর কানে এল। তার পরেই ট্রেন যাওয়ার কর্কশ খটাখট আওয়াজ আর টানা হরন। তখনই পাশ থেকে আসফাক ওকে বলল, ‘ওস্তাদ, রেডি হও। লাস্ট ট্রেন বেরিয়ে গেল শেয়ালদার দিকে।’

পা টিপে রুস্তম সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল। পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে ওকে কাজটা সারতে হবে। পিস্তলের চেম্বার খুলে ও একবার দেখে নিল, সব গুলি আছে কি না? পিস্তলটা পকেটে গুঁজে রাখার পরই ও কালো বোরখা পরে নিল। তখনই আসফাক বলল, ‘নার্গিস টর্চ মারছে ওস্তাদ। যাও, এ বার তুমি রাস্তায় নামো। স্কুটারটা হাঁটিয়ে আমি বাড়ির কাছে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি বেরিয়ে এলেই স্টার্ট দেবো।’

খান সাহেবের মাংসের দোকানে তোলা তুলতে এসে বিজন ওকে একবার পিটিয়েছিল। সে অবশ্য অনেকদিন আগের কথা। সেই অপমানের বদলা নেওয়ার সুযোগটা আজ ও পেয়েছে। রাস্তার বাঁক পেরিয়ে বিজনের বাড়িতে যখন রুস্তম পৌঁছল, ততক্ষণে নার্গিস দরজা খুলে দিয়েছে। করিডর দিয়ে খানিকটা হেঁটে, টালির ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে, ফিসফিস করে মেয়েটা বলল, ‘দরজা খোলাই আছে। তুমি ঢুকে যাও রুস্তমভাই। আমি তিনতলায় উঠে যাচ্ছি।’

ঘরে ঢুকে যতটা অন্ধকার রুস্তম আশা করেছিল, ততটা নেই। রাস্তার এলইডি আলোর খানিকটা এসে ঢুকেছে ঘরে। ও দেখতে পেল, খালি গায়ে বিজন শুয়ে আছে। ওর পরনে শুধু একটা লুঙ্গি। ওর বিশাল ভুঁড়ি কাত হয়ে বিছানায় মিসেছে। সময় নষ্ট না করে রুস্তম পিস্তলটা মাথায় লাগিয়ে ট্রিগার টিপে দিল। সাইলেন্সার লাগানো আছে। খুট করে একটা শব্দ হল। তার পর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরতে লাগল বিজনের মাথা থেকে। জীবনের প্রথম মার্ডার। তবুও ওর হাত একটুও কাঁপল না। ভাল করে বিজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রুস্তমের মনে হল, সেকেন্ড বুলেটটা খরচ করার আর দরকার নেই। পা টিপে বাইরে বেরিয়ে আসার সময় ওর মনে পড়ল, বিকেলে প্ল্যান করার সময় নার্গিস বলেছিল, ‘দাদার বিছানার পাশে আলমারিতে প্রচুর টাকা থাকে। ফি শুক্কুরবার ইউনিয়নের চাঁদা জমা পড়ে। দাদা শনিবার ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে আসে। ইচ্ছে করলে তোমরা লুঠও করতে পারো।’ কথাটা মনে পড়ায় লোভ সামলাতে পারল না রুস্তম।

রুস্তম জানে, বিজন অনেকগুলো শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। আলমারি খুলে ও দেখল, সত্যিই দুটো ব্যাগে প্রচুর টাকা রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বোরখাটা রুস্তম খুলে ফেলল। দুটো ব্যাগ তার মধ্যে পেঁচিয়ে ও বাইরে বেরিয়ে এল। রাস্তায় নেমে ও দেখল, কয়েকটা কুকুর আসফাককে ঘিরে ঘেউঘেউ করছে। কাবারের প্যাকেটটা রাস্তা ছড়িয়ে, স্কুটারের স্টার্ট দিয়ে আসফাক বলে উঠল, ‘পাশের একতলার ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখো ওস্তাদ। কুকুরের চিৎকারে আসগরের ঘুম ভেঙে গেছে। আর এক সেকেন্ড দেরি করা চলবে না।’

রুস্তমের চোখে পড়ল, ছাদ থেকে একটা ছেলে হুইসল দিচ্ছে। আশপাশের বাড়ির জানলা খুলে যাচ্ছে। বোরখাটা আসফাকের স্কুটারের কেরিয়ারে রেখে রুস্তম বলল, ‘তুই এগো। আমি তোকে ধরে নিচ্ছি।’

কথাটা বলেই আসগরের দিকে তাক করে রুস্তম গুলি চালিয়ে দিল। ছাদ থেকে ধপ করে ছেলেটা রাস্তায় এসে পড়ল। একতলার ছাদে আরেকটা ছেলে উঠে দাঁড়িয়েছে। তা হলে কি ওরা ছাদে শুয়ে বিজনকে গার্ড দিচ্ছিল? এলইডির আলোয় রুস্তম পরিষ্কার দেখতে পেল, ছেলেটার হাতে বোমা। সর্বনাশ, এত কাছ থেকে কোনও বোমা যদি এসে পায়ের সামনে পড়ে, তা হলে আর ওকে উঠে দাঁড়াতে হবে না। ছেলেটা ওকে তাক করে বোমাটা ছুঁড়ে দিয়েছে। আর কোনও উপায় নেই। দু’হাতের তালু বাড়িয়ে, ডাইভ দিয়ে রুস্তম বোমাটা লুফে নেওয়ার চেষ্টা করল। ছোটবেলায় গোলকিপার খেলার সময় যেমন করে ও গোল বাঁচাত।

(নয়)

ছ’টায় ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হতে আর মিনিট দশেক বাকি। জেনারেল ওয়ার্ডে মায়ের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে কোয়েল কথা বলছে। এমন সময় কাছেই মিষ্টি একটা গন্ধ পেয়ে ও পাশ ফিরে তাকাল। তমালকে দেখে ও একটু অবাকই হল। সুগন্ধটা তমালের গা থেকেই আসছে। ও বোকার মতো বলে ফেলল, ‘তুমি?’

প্রশ্নটা যেন শুনতেই পেল না তমাল। মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন বোধ করছেন মাসিমা?’

মা ম্লান হেসে বলল, ‘আগের থেকে ভাল।’

‘কিন্তু আমার তো আপনাকে আগের থেকে অনেক ভাল বলে মনে হচ্ছে মাসিমা। এই মাত্তর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম। উনি বললেন, আপনি নাইন্টি পার্সেন্ট ফিট হয়ে গেছেন। দু’একদিনের মধ্যেই না কি আপনাকে ছেড়ে দেবে।’

কথাগুলো শুনে কোয়েল চমকে তাকাল। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা হয়েছে না কি তমালের? ডাক্তারবাবুকে ও পেল কোথায়? এই নার্সিং হোমে ডাক্তারবাবু আসেন ঠিক সাড়ে সাতটার সময়। একবার রাউন্ড মেরে চলে যান। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলার জন্য কোয়েলকে গত পাঁচদিন রাত আটটা অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে। এখন তো আসার কথা নয়! প্রশ্নটা ও করতে যাচ্ছিল। কিন্তু মায়ের দিকে চোখ পড়ায় চুপ করে গেল। মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মা উৎসাহ পেয়ে বলল, ‘ডাক্তারবাবু ঠিক বলেছেন। আজ নার্স আমাকে ধরে ধরে টয়লেটে নিয়ে গেছিল। আমার কোনও অসুবিধে হয়নি। খুব ভাল লাগল বাবা, তুমি এসেছ দেখে।’

‘ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলার পরই আমি প্ল্যানটা ঠিক করে ফেললাম মাসিমা। ফিফটিন্থ আগস্ট ফের আমাদের চণ্ডীতলায় পিকনিক। আপনার মনে আছে, গেলবারের পিকনিকের কথা?’

‘মনে আবার থাকবে না? দেব গাড়ি করে আমাকে আর কোয়েলকে নিয়ে গেছিল। তুমি নিজে রান্না করে আমাদের খাইয়েছিলে। পাবদা মাছটা এত সুন্দর রান্না করেছিলে, ভুলিনি।’

‘এ বার আপনাকে ট্যাংরা মাছ খাওয়াব। বাবা বলছিল, মাসখানেকের মধ্যে আমাদের পুকুরের ট্যাংরা মাছ এক বিঘত লম্বা হয়ে যাবে। পেঁয়াজকলি দিয়ে সেই মাছের এমন একটা আইটেম করে দেবো, আপনি তার স্বাদ ভুলতে পারবেন না। জানেন মাসিমা, মা প্রায়ই বলে, আমার বউমা হয়ে যে আসবে, সে রান্না না জানলেও ক্ষতি নেই।’

‘তাই না কি? কেমন মেয়ে ওনার পছন্দ?’

‘টিচার হলে সবথেকে ভাল। তবে তাকে কলকাতার মেয়ে হতে হবে।’

কোয়েল বুঝতে পারল না, অগাস্ট মাসে তমাল পেঁয়াজকলি পাবে কোথায়? বউমা হিসেবে ওর মায়ের কাকে পছন্দ, তা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ওর নেই। ও চুপ করে রইল। তখনই মা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছেন তমাল?’

‘বিন্দাস মাসিমা। ইন ফ্যাক্ট, বাড়িতে গেলে মা প্রায়ই আপনাদের কথা জিজ্ঞেস করে। আপনি নার্সিং হোমে শোনার পর মা-ই আমায় বলল, একবার গিয়ে দিদিকে দেখে আসিস বাবা। কিন্তু আসব কী করে? গত তিনদিন ধরে হোটেলে ম্যারেজ পার্টি ছিল। তাই বেরোতে পারিনি। আজ ফাঁকা ছিলাম, তাই চলে এলাম।’

‘দেবকেও সঙ্গে নিয়ে এলে না কেন বাবা?’

‘ও খুব ব্যস্ত মাসিমা। সকাল ছ’টা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত ওকে জিম-এ থাকতে হয়। মাঝে লাঞ্চ টাইমে একবার রুমে যায়। আমার সঙ্গেও ওর কথাবার্তা হয় না বললেই চলে। সে যাক, মা আপনার জন্য একটা জিনিস পাঠিয়েছে। দাঁড়ান, সেটা আগে ছুঁইয়ে দিই।’

পকেট থেকে তমাল কী একটা বের করতে লাগল। সমবয়সি ছেলেটাকে কোয়েল অনেকদিন ধরে চেনে। দেবদার খুব বন্ধু। বারতিনেক তমাল ওদের মল্লিক বাজারের বাড়িতেও গেছিল। খুব হাসিখুশি টাইপের, তবে মাঝে মাঝে হেঁয়ালি করে কথা বলে। কোয়েল শুনেছে, তমাল না কি তিন-চার বছর সিডনিতে ছিল। ওখানে শ্যেফ-এর চাকরিও করেছে। মায়ের কথায় একবাক্যে চাকরি ছেড়ে ইন্ডিয়ায় ফিরে এসেছে। গেলবার তমাল জনাইতে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেছিল। বেশ সম্পন্ন পরিবারের ছেলে। বাবার প্রচুর খেতি জমি আছে। ধান বিক্রি করে ভাল রোজগার করেন। মাও একেবারে মাটির মানুষ। তমালের তিন দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে বলে ওকে সবাই ভালবাসেন। এমনিতে তমলাকে খারাপ লাগে না কোয়েলের। দোষের মধ্যে একটাই মাঝেমধ্যে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কী যেন বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারে না।

পকেট থেকে পুজোর ফুল আর বেলপাতা বের করে তমাল মায়ের কপালে ছুঁইয়ে দিয়ে বলল, ‘মা আপনার নাম করে আমাদের ওখানকার চণ্ডী মন্দিরে পুজো দিয়ে এসেছিল। খুব জাগ্রত দেবী মাসিমা। সাত-আটশো বছর পুরনো। সরস্বতী নদীর ধারে চাঁদ সওদাগর নিজে ওই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওখানে কেউ যদি কোনও মানত করে, ফলে যেতে বাধ্য। ব্যস, আর কোনও ভয় নেই। এ বার হেঁটে হেঁটে আপনি বাড়ি ফিরে যাবেন।’

‘আমার মেয়েটার মাথাও ফুলটা ছুঁইয়ে দাও না বাবা। সংসার চালাতে গিয়ে মেয়েটা জেরবার হয়ে গেল। এই বয়সে সোয়ামী-সন্তান নিয়ে ওর ঘর করার কথা। অথচ দেখো, আমার জন্য মেয়েটা…।’

মাকে থামিয়ে দিতে কোয়েল বলল, ‘আবার তুমি শুরু করলে মা?’

তমাল বলল, ‘চণ্ডীমায়ের আশীর্বাদি ফুল ছুঁইয়ে দিচ্ছি মাসিমা। দেখবেন, খুব শিগগির আপনার ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে।’ বলতে বলতে ওর কাছে চলে এল তমাল। মাথায় ফুল ছুঁইয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘বিয়েতে তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাও যোগাকন্যা। না হলে শান্তি পাবো না।’

কোয়েল চমকে উঠে তমালের দিকে তাকাল। ফের হেঁয়ালি। কথাটা তমাল এমনভাবে বলল যেন, ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। অথচ ও রাজি হচ্ছে না। তা ছাড়া, যোগকন্যাটাই বা কে? তমাল কেনই বা বলল, ‘না হলে শান্তি পাবো না?’ না, না, ওকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হবে না। দেবদার কানে গেলে, কী মনে করবে কে জানে? হয়তো বলবে, তমাল তোকে বিয়ে করতে চায়, কথাটা তোর মাথায় এল কী করে? ও কোন ফ্যামিলির ছেলে, সেটা তুই নিজের চোখেই দেখে এসেছিস। ছিঃ কোয়েল, তোর কাছে এটা আমি আশা করিনি। কথাগুলো মনে হতেই কোয়েল চোয়াল শক্ত করে ফেলল। আর তখনই ঘণ্টা বেজে উঠল, ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ। এখুনি বেরিয়ে যেতে হবে। মাকে ও বলল, ‘আমি যাই মা। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে আমাকে একবার স্টিফেন ম্যানসনে যেতে হবে। তার পর বাড়ি ফিরব।’

মা জিজ্ঞেস করল, ‘সেটা আবার কোথায়?’

‘আমাদের জিম-এর কাছেই। তোমাকে আগে বলেছি। ওই বাড়িতে মিসেস ভাল্লা বলে একজনকে রিহ্যাব এক্সারসাইজ করাতে যেতে হবে। কাজটা আজ থেকে ধরলাম।’

‘তুই আর আমার জন্য কত করবি মা।’

প্রতিদিন নার্সিং হোম থেকে বেরনোর সময় কোয়েলের মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। আশঙ্কা নিয়ে বাড়ি ফেরে, পরদিন মাকে ও জীবন্ত দেখতে পাবে কি না। জেনারেল ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে লিফটের জন্য অপেক্ষা করার সময় ও দেখল, তমাল পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘কোয়েল, তোমাকে একটা গোপন খবর দিই। এখানকার ক্যাফেটোরিয়াটা দারুণ। আমার এক ক্লাসমেট মনসুর এটা চালায়। আগে একবার এসেছিলাম। ওর হাতের স্যান্টউইচ আর ক্যাপিচিনো কফি খেতে খুব ইচ্ছে করছে। চলো না, যাই। আমাদের দেখলে ও স্পেশাল বানিয়ে দেবে।’

আজ সারাটা দিনে খুব ধকল গেছে। সিলভার জিম-এ মর্নিং ডিউটি সেরে কোয়েল ভবানীপুরে যোগা সেন্টারে গেছিল। সেখানে বিকেল পাঁচটা অবধি থেকে, প্রায় ছুটে নার্সিং হোমে এসেছে। অন্যদিন, বিকেলে যোগা সেন্টারে বসে ও টিফিন করে নেয়। বাড়ি থেকে আনা রুটি আর আলুভাজা। আজ সময়ই পায়নি। এমন মার্জিত ভঙ্গিতে তমাল ক্যাফেটোরিয়ায় যাওয়ার প্রস্তাবটা দিল, কোয়েল না করতে পারল না। তা ছাড়া, ডাক্তারবাবুর আসতেও ঘণ্টাখানেক দেরি আছে। মাঝের সময়টুকু লাউঞ্জেই বসে থাকতে হবে। তার চেয়ে তমালের সঙ্গে খানিকক্ষণ আড্ডা মারলে ক্ষতি কী? টিফিন কৌটোটা ওর ব্যাগেই রয়ে গেছে। রাতের খাওয়াটা হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে ওকে কিছু বানিয়ে নিতে হবে না।

লিফট থেকে বেরিয়েই কোয়েল দেখল, ডাক্তারবাবু করিডর দিয়ে হেঁটে আসছেন। আজ এত তাড়াতাড়ি! এই রে, উনি একবার তিনতলায় উঠে গেলে, ঘণ্টাখানেকের আগে ধরা যাবে না। কোয়েল পা চালিয়ে, কাছে গিয়ে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, মা কেমন আছেন?’

ডাক্তারবাবু বললেন, ‘কোন বেডের পেসেন্ট, বলুন তো?’

‘জি-টুর। নাম মমতা সাহা।’

‘ইয়েস মনে পড়েছে। মিসেস বিলমোরিয়ার কেয়ার অফে আছেন যিনি। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল হল। শুনুন, কালই আমি পেসমেকার বসিয়ে দিচ্ছি। আপনারা এক্সট্রিমলি লাকি ম্যাডাম। তিনটে পেসমেকার ডোনেশন হিসেবে এসেছে। একটা আপনাদের পেসেন্টকে দেওয়া হচ্ছে নার্সিং হোম থেকে।’

শুনে আনন্দে চোখে জল এসে গেল কোয়েলের। জিম-এ মিসেস বিলমোরিয়াকে দূর থেকে ও দেখেছে। উঁচুতলার মানুষ, কোনওদিন আলাপ হয়নি। প্রায় লাখখানেক টাকার ধাক্কা উনি সামলে দিলেন। ও বলল, ‘অপারেশনটা কখন করবেন ডাক্তারবাবু?’

‘সকাল সাতটায়। তার আগে এসে বন্ড-এ সাইন করে দেবেন। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন, যাতে কোনও কমপ্লিকেশন না হয়। পেসমেকার যদি ঠিকঠাক ফাংশন করে, তা হলে পরশু বিকেলের দিকে পেসেন্টেকে নিয়ে যেতে পারেন।’ কথাগুলো বলেই ডাক্তারবাবু লিফটের দিকে পা বাড়ালেন।

খানিকক্ষণ পর ক্যাফেটোরিয়ায় ঢুকে ওরা দেখল, কোণের দিকে দু’চেয়ারের একটা টেবল খালি আছে। তমাল কাউন্টারের দিকে চলে গেল। কোয়েল ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়ল। রোজই ক্যাফেটোরিয়ার পাশ দিয়ে ও লিফটে উঠে যায়। কোনও দিন ঢোকার সাহস হয়নি। মেন্যুর দিকে তাকিয়ে ওর চক্ষু চড়কগাছ। ওর আন্দাজই ঠিক। খাবারের দাম অত্যাধিক বেশি। একটা চিকেন স্যান্ডউইচ দেড়শো টাকা, ভেজ স্যান্ডউইচের দাম একশো। এক প্লেট ভেজ পকোরা আশি টাকা। চা তিরিশ, কফি পঞ্চাশ। লোকের কিনে খাচ্ছেও। কুপন কেটে এসে তমাল উল্টোদিকের চেয়ারে বসে বলল, ‘আমার বন্ধু মনসুর এখন নেই। ধর্মতলার দিকে গেছে। ফিরতে অনেক দেরি হবে। ইস, ও থাকলে খাবার কিনে খেতে হত না। আমি কিন্তু ভেজ স্যান্ডউইচ আর কফির অর্ডার দিয়ে দিলাম। আর কিছু বলব?’

‘না।’ ঘাড় নেড়ে কোয়েল জানিয়ে দিল। কিছু বলতে হয়, তাই ফের বলল, ‘মনসুরের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্বটা হল কী করে?’

তমাল বলল, ‘সিডনিতে আমরা একই হোটেল ম্যানেজমেন্ট কলেজে পড়তাম। আমরা রুম শেয়ার করেছি। মনসুর ছেলেটা কলকাতারই ছেলে। নিউ মার্কেটে ওর বাবার বিরাট ফলের দোকান। জানো, একটা অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে ওর গার্লফ্রেন্ড ছিল। দু’জনে দারুণ মস্তি করত।’

‘তোমার কোনও গার্লফ্রেন্ড ছিল না?’

‘সাহস পাইনি গো। মা-বাবার কথা যখন মনে পড়ত, তখন মস্তি করার কথা মন থেকে উবে যেত। বাবা জমি বিক্রির টাকায় আমাকে সিডনি পাঠিয়েছিল। ওখানে দু’বছর চাকরি করে সেই টাকা আমি বাবাকে ফেরত দিয়েছি। ওদেশেই থেকে যেতে পারতাম। কিন্তু মায়ের টানে ফিরে আসতে হল। ছেলে হিসেবে মা-বাবাকে দেখা আমার কর্তব্য।’

‘তোমার আর কোনও বন্ধু নেই?’

‘কেন থাকবে না? যেমন এখানে দেব। ওর সঙ্গে আমার ওয়েভ লেংথে মিল খায়। জানো, এমন পরোপকারী ছেলে আমি খুব কম দেখেছি। তুমি তো আমার থেকেও ওকে বেশি দিন চেনো। তুমি নিশ্চয়ই জানো।’

‘হ্যাঁ, দেবদার মনটা খুব ভাল।’

‘ভাল মানে! ও রকম হয় না। অন্যের জন্য ও জান পর্যন্ত দিতে পারে। ও যেদিন মি. এশিয়া হবে, সেদিন আমি আনন্দে হাওড়া ব্রিজ থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দেবো। আমি ঠিকই করে রেখেছি।’

শুনে খুব মজা পেল কোয়েল। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি সাঁতার জানো?’

‘আনফরচুনেটলি, গ্রামের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও, না। জলে ফাঁড়া আছে, সেই ভয়ে মা আমাকে বাড়ির পুকুরেও কোনওদিন নামতে দেয়নি।’

‘তা হলে যে বললে, গঙ্গায় ঝাঁপ দেবে?’

‘মি. এশিয়া কনটেস্ট হবে মাস তিনেক পরে। এর মধ্যে হোটেলের সুইমিং পুলে সাঁতারটা শিখে নেবো। কী এমন কঠিন?’

‘কবে ঝাঁপ দেবে, আমায় বোলো। ব্রিজ থেকে ধাক্কা মারার কাজটা আমি করে দেবো।’ বলে কোয়েল হাসতে লাগল।

তখনই খাবারের প্লেট নিয়ে বেয়ারা হাজির। টেবলে প্লেট সাজিয়ে দেওয়ার সময় তমাল বলল, ‘জানো কোয়েল, সিডনি থেকে ফেরার পর আমার খুব ইচ্ছে ছিল একটা বড় রেস্তোরাঁ চালু করব। কিন্তু একে অনেক পুঁজি দরকার, তার পর হেন লাইসেন্স, তেন লাইসেন্স… নানা ঝক্কি। সেইজন্য আপাতত, চাকরিতে ঢুকে গেলাম। আমি সুযোগের অপেক্ষায় আছি। রেডি হয়েই ব্যবসায় নামব।’

‘তুমি রেস্তোরাঁ খুললে দেবদাকে পার্টনার করে নিও।’

‘বাহ, তুমি তো আমার মনের কথাটা বললে। জানো, মি. এশিয়া টাইটেলটা পেলে, কত স্পনসর পাবে দেব? দেড়-দু’কোটি টাকার। প্লাস প্রাইজ মানি। তখন আমার পুঁজির অভাব হবে না।’

‘এ সব নিয়ে দেবদার সঙ্গে তোমার কথা হয় না কি?’

‘সময় পেলে হয়। সিলভার জিম-এ চিফ ট্রেনারের চাকরিটা দেব বাধ্য হয়ে এখন করে। নির্বিঘ্নে ও ব্যায়ামটা করতে পারবে বলে। কলকাতা পুলিশে ওর জন্য অফিসার র‍্যাঙ্কের চাকরি ওয়েট করছে। জানি না, মি. এশিয়া হয়ে গেলে, ও সিলভার জিম-এ থাকবে কি না? এখনও পর্যন্ত তো দেব আমার কথা শুনে চলে। মিলেনা ওর জীবনে এসে গেলে, কী করবে বলতে পারব না।’

‘মিলেনা আবার কে?’

‘তুমি জানো না? দেব তো মেয়েটার জন্য পাগল বললেও কম বলা হয়। স্টিফেন ম্যানসনে থাকে। প্যারাগন অফ বিউটি। মেয়েটার সঙ্গে প্রথম কালই বেলা বারোটার সময় দেব ডেট-এ গেছিল।’

শুনে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল কোয়েলের। দেবদা সিলভার জিম ছেড়ে দিতে পারে! তা হলে ওর কি হবে? ভেজ স্যান্ডউইচ ওর তেতো বলে মনে হতে লাগল। তমাল কি ফাজলামো মারছে? কাল বেলা বারোটার সময় তো দেবদা জিম-এ ছিল। মিলেনা না কে, তার সঙ্গে ডেট-এ গেল কী করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *