(পঁয়তাল্লিশ)
নিয়োগী আন্টি ওকে দেখেই বললেন, ‘তোমাকে তো রাধারানির মতো দেখাচ্ছে মিলেনা।’
সদ্য স্নান সেরে এসেছে। মিলেনার পরনে গরদের শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। হাতে জুঁই ফুলের ডালা। নিয়োগী আন্টি রাধার সঙ্গে তুলনা করায় মিলেনা লজ্জা পেয়ে গেল। পিটার স্ট্রিটে শ্রীকৃষ্ণাচৈতন্য টেম্পলের রাধা মূর্তিটার কথা ওর মনে পড়ে গেল। পুষ্পাজিজি দার্জিলিংয়ে চলে যাওয়ার পর, সপ্তাহখানেক ধরে ও রোজই টেম্পলে যাচ্ছে। সন্ধেবেলায় আচার্যদের ফুল দিয়ে রাধাকৃষ্ণাকে সাজান, আরতি করেন। মিলেনা বসে তা মন দিয়ে দেখে। এর পর খোল করতাল নিয়ে ভক্তরা কিছুক্ষণ হরিনাম করেন। হরে কৃষ্ণা, হরে কৃষ্ণা, কৃষ্ণা কৃষ্ণা হরে হরে। হরে রামা, হরে রামা, রামা রামা হরে হরে। সভাঘর ছেড়ে ওর উঠে আসতেই ইচ্ছে করে না। উচ্চস্বরে ও গলা মেলায়।
চণ্ডীতলা থেকে ফেরার পর তখন ওর মন খারাপ। দেবদূতদের পরিবার সম্পর্কে জানার জন্য অ্যানা মাঝে ফোন করেছিল। মিলেনা বলে ফেলেছিল, ও ক্রিশ্চান বলে অনেকেই ওকে পছন্দ করেননি। খুঁটিয়ে দেবদূতদের বাড়ির কথা জেনে নেওয়ার পর অ্যানা পরামর্শ দিয়েছিল, ‘তুমি বললে ওদের বাড়িতে রাধামাধবের পুজো হয়। তার মানে ওরা বৈষ্ণব। কৃষ্ণার ভক্ত। তুমি এক কাজ করো। টেম্পল থেকে কৃষ্ণা কনসাসনেস সম্পর্কে কয়েকটা বই কিনে নিয়ে এনো। পড়লেই বুঝতে পারবে, হিন্দু রিলিজিয়ান নিয়ে হোল ওয়ার্ল্ড কেন ধীরে ধীরে অ্যাট্রাক্টেড হচ্ছে।’
পরের দিনই টেম্পলে গিয়ে দুটো বই কিনে এসেছিল মিলেনা। বইগুলো পড়ার পর আগ্রহ আরও বেড়েছে। মাঝে নিয়োগী আন্টি ওদের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন একদিন। বইয়ের কভারে শ্রীকৃষ্ণা আর অর্জুনের ছবি দেখে ওকে জিজ্ঞেস করেন, ‘হিন্দু রিলিজিয়ন নিয়ে তোমার হঠাৎ কৌতূহল হল কেন মিলেনা?’ ও তখন শ্রীকৃষ্ণাচৈতন্য টেম্পলের কথা বলেছিল।
মিলেনা সেদিনই প্রথম জানতে পারে, আন্টি একটা সময় কলেজে ফিলজফি পড়াতেন। হিন্দু রিলিজিয়ন নিয়ে ওঁর প্রচুর পড়াশুনো আছে। কৃষ্ণা কনসেপ্ট খুব সহজ ভাষায় উনি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ‘কৃষ্ণ হচ্ছেন ঈশ্বরের অবতার। এই পৃথিবী যখন পাপে ভরে যায়, তখন ঈশ্বর তাঁর একজন প্রতিনিধিকে পাঠান। মানুষের মাঝে থেকে তিনি পৃথিবীকে পাপমুক্ত করেন। ভগবান বুদ্ধ এমন একজন অবতার। তোমাদের ক্রাইস্ট আর আমাদের কৃষ্ণা তেমনই একজন।’ নিয়োগী আন্টি আরও বলেছিলেন, হিন্দুরা ঘরে বসেই একান্তে ঈশ্বরের আরাধনা করতে পারেন। মন্দিরে যে যেতেই হবে, তার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
গত তিন বছরে মিলেনা বহুবার আন্টির ফ্লাটে গেছে। কখনও চোখে পড়েনি, কোথায় বসে নিভৃতে উনি ঈশ্বরকে ডাকেন। দু’তিনদিন আগে আন্টির ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে ও প্রথম ঠাকুরঘর দেখে। বেশ কয়েকটা মূর্তির মাঝে রাধাকৃষ্ণ। পিটার স্ট্রিটের টেম্পলে আচার্যদেবের কাছে মিলেনা যে প্রশ্নটা করতে পারেনি, সেটা নিয়োগী আন্টির কাছে করতে ওর বাধেনি। ও জানতে চেয়েছিল, কৃষ্ণা না হয় গড-এর রিপ্রেজেন্টেটিভ। কিন্তু তা হলে রাধা কে? উনি কি কৃষ্ণার ওয়াইফ? ওঁদের দু’জনকে একসঙ্গে পুজো করা হয় কেন?
নিয়োগী আন্টি খুব খুশি হয়েছিলেন প্রশ্নগুলো শুনে। বলেছিলেন, ‘রাধা হলেন শ্রীকৃষ্ণের প্রেমিকা। দু’জনের ইন্টার্নাল লাভ অন্য একটা থিয়োরি দাঁড় করিয়েছে। কৃষ্ণভক্তরা মনে করেন, রাধা প্রেমরসে নিমজ্জিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ ঈশ্বরকে পেয়েছিলেন। তাই রাধার আরাধনা করলেও ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে। এই মতের প্রবক্তা হলেন শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি আমাদের এই বাংলারই মানুষ। এই যে রাধাকৃষ্ণের মূর্তির নীচে দু’হাত তুলে নাচের ভঙ্গিতে একজনকে তুমি দেখতে পাচ্ছ, উনিই শ্রীচৈতন্যদেব।’
চৈতন্যদেবের ছবি মিলেনার চোখে পড়েছিল, চণ্ডীতলায় দেবদূতদের বাড়িতেও। ওখানে ঠাকুরঘরে ওকে অবশ্য ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এই একটা আক্ষেপ ওর থেকেই গেছে। দেবদূতকে ও কিছুই জানায়নি। কিন্তু চণ্ডীতলা থেকে ফেরার পর ওর জেদ চেপে গেছে, দেবদূতকে পাওয়ার জন্য নিজেকে বদলে ফেলবে। দরকার হলে ও চার্চে যাওয়া বন্ধ করে দেবে। মুশকিল হচ্ছে, আর্মেনিয়ান চার্চে নিয়মিত যাওয়ার মতো লোক এত কম, কেউ একজন গরহাজির হলেই খোঁজ শুরু হয়ে যায়। মাঝে মাত্র একটা রোববার ও চার্চে যায়নি। ফাদার ফোন করে খবর নিয়েছেন, ও সুস্থ আছে কি না? সেই রবিবার টেম্পলে যেতে বলেছিলেন আচার্যদেব। উনি নগর সংকীর্তনে পাঠিয়েছিলেন ভক্তদের। ওরা কুড়ি পঁচিশজন মৃদঙ্গ আর করতাল বাজিয়ে কৃষ্ণানাম করতে করতে মধ্য কলকাতায় প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা হেঁটেছিল। ভক্তদের উদ্বাহু নৃত্য আর আত্মনিবেদনের ভঙ্গি দেখে মিলেনার মনে হয়েছিল, কৃষ্ণা নামটার মধ্যে এত মাদকতা কেন, জানতেই হবে।
নিয়োগী আন্টি ওকে বলেছিলেন, ‘তোমার যখন এত আগ্রহ, রাধাকৃষ্ণের আইডল কিনে এনে বাড়িতেই পুজো করতে পারো। আমার সঙ্গে হগ মার্কেটে চলো। ওখানে একটা রাজস্থানী দোকান আছে। সেখানে সুন্দর মূর্তি পাওয়া যায়।’ শুনে মিলেনা দেরি করেনি। গতকাল বিকেলেই আন্টির সঙ্গে সেই দোকানে গিয়ে পছন্দমতো একটা যুগলমূর্তি কিনে এনেছে। আগামীকাল নিয়োগী আন্টি শিলিগুড়িতে বোনের বাড়িতে চলে যাবেন কয়েকদিনের জন্য। তাই আজ সাতসকালেই উনি এসে হাজির হয়েছেন, কীভাবে পুজো করতে হয় তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। টেম্পল থেকে কৃষ্ণা চ্যান্টিংয়ের অডিয়ো ক্যাসেট কিনে এনেছে মিলেনা। লো ভলিউমে চালিয়ে দিয়েছে। ফুল আর ধূপের গন্ধে ম ম করছে লিভিং রুম। নিয়োগী আন্টি শিখিয়ে দিচ্ছেন, কীভাবে চন্দন বাটতে হয়, দুর্বা বাছতে হয়, কখন তুলসী পাতা দিতে হয়।
পুজোর ফাঁকে হঠাৎ নিয়োগী আন্টি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কৃষ্ণকে আজ আসতে বলোনি?’
মিলেনা চমকে উঠে বলল, ‘তাকে আপনি চিনলেন কী করে?’
‘সেদিন দুপুরে যখন তোমার ফ্ল্যাটে এসেছিল, তখন দেখেছি। ভেরি হ্যান্ডসাম। তোমার সঙ্গে পরিচয় হল কী করে?’
বাধ্য হয়ে সব কথা খুলে বলল মিলেনা। আন্টি সেই একই প্রশ্ন করলেন, যা অ্যানা, অ্যান্ডি আর নাজমাও করেছিল। ‘তোমার পেরেন্টরা কি ওকে মেনে নেবেন?’
মাথা নীচু করে মিলেনা ঘাড় নাড়ল। দেখে আন্টি বললেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে, তিন বিধাতা নিয়ে। অর্থাৎ বিধাতাই ঠিক করে দেন, কে কখন জন্মাবে, কার কখন মৃত্যু হবে, কার সঙ্গে কার বিয়ে হবে। কোনটাই মানুষের হাতে নেই। বিধাতা কথাটার মানে হল ঈশ্বর… গড। তোমার সঙ্গে যদি দেবদূতের বিয়ে উনি স্থির করে দিয়ে থাকেন, তা হলে হবেই। ঈশ্বরের উপর ভরসা রাখো।’
‘ড্যাডি ক্যাথলিক। উনি কিছুতেই মানবেন না।’
‘এরিককে জানি। আগে প্রতি বছর উনি একবার করে আসতেন অ্যানুয়াল মিটিংয়ের সময়। তখন দেখেছি, উনি কতটা গোঁড়া। কথায় কথায় একবার এরিক আমার হাসবেন্ডকে বলেছিলেন, কলকাতায় হোলি ন্যাজারেথ চার্চ ওর এক ফোরফাদারই বানিয়ে দিয়েছিলেন। শুনেছি কলকাতায় এলে এরিক অনেক টাকা ডোনেশনও দিতেন চার্চে। সেই ফ্যামিলির মেয়ে হয়ে তুমি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য টেম্পলে যাওয়া-আসা করছ। জানতে পারলে, তোমাদের ফ্যামিলি তো বটেই, চার্চও ভালভাবে নেবে না। একটু যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও মিলেনা।’
‘জানি আন্টি।’ মিলেনা বলল, ‘আমাকে লড়াইটা দু’দিক থেকে করতে হবে। দেবদূতের বাড়িতেও অনেকের আপত্তি আছে। আমি শুধু দেবদূতের জন্য ওয়েট করছি। ব্যাঙ্ককের কম্পিটিশন থেকে ও ফিরে এলেই একটা ডিসিশন নেবো।’
নিয়োগী আন্টি নীচে নেমে যাওয়ার পর হোয়াটসঅ্যাপে আনা আর অ্যান্ডিকে কয়েকটা ছবি পাঠাল মিলেনা। ওর বাড়ির রাধাকৃষ্ণের ছবি। সঙ্গে সঙ্গে অ্যানার ফোন চলে এল, ‘মাই গুডনেস, আগে যদি বলতে তা হলে তোমার বাড়িতে যেতাম। আজ আমি ফাঁকাই ছিলাম। অনিল দিল্লিতে গেছে। এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স মিনিস্ট্রি থেকে ওকে ডেকে পাঠিয়েছে। মনে হয়, পোস্টিং পেয়ে যাবে।’
এ কথা সে কথার পর হঠাৎ অ্যানা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি মউ সরকার বলে কোনও রিপোর্টারকে চেনো?’
মিলেনা বলল, ‘না, নামও কখনও শুনিনি। কেন বলো তো?’
‘মেয়েটা কাল চার্চে গিয়ে ফাদারের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। পরে মেম্বারদের দু’একজনের কাছে শুনলাম, তোমার সম্পর্কে জানতেই চার্চে গেছিল। ফাদারকে না কি জিজ্ঞেস করেছে, একটা ক্রিশ্চান মেয়ে কেন হিন্দু টেম্পলে যাচ্ছে, কেন কনভার্ট হওয়ার কথা ভাবছে, খোঁজ নিয়েছেন? শুনে ফাদার না কি তোমার উপর খুব অসন্তুষ্ট।’
শুনে মিলেনার বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করতে লাগল। কে এই মেয়েটা? ওর সম্পর্কে তার এত আগ্রহই বা কেন? ফাদার চটে গেছেন মানে… দু’একদিনের মধ্যেই হয়তো ড্যাডির কাছে খবর পৌঁছে যাবে। ফোন ধরে থাকা অবস্থাতে ও রাধা-কৃষ্ণার মূর্তিটার দিকে তাকাল। মনে মনে বলল, এই রকম একটা দিন আসবে, প্রভু জানতাম। তবে এত তাড়াতাড়ি মুখোমুখি হতে হবে, ভাবিনি। তারপর চোখ সারিয়ে নিয়ে অ্যানাকে ও বলল, ‘দেবদূতের কথা এ বার ড্যাডি-মাম্মিকে জানিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে।’
‘ফেস ইট বোল্ডলি মিলেনা।’ অ্যানা বলল, ‘যদি দেখো, ওরা বাই ফোর্স কিছু করার চেষ্টা করছেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন করে জানাবে। জেনে রাখো, আমার আর ডিম্পলের পুরো ফ্যামিলি কিন্তু সবসময় তোমাদের পাশে থাকবে।’
…সারাটা দিন ইরেভেন থেকে ফোনের প্রত্যাশায় রইল মিলেনা। কিন্তু এল না। ফোনটা এল ডিনার করার পর ও যখন সব শুয়েছে। ভিডিয়ো কল করে মাম্মি প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে মিলেনা? তোমার সম্পর্কে এ সব কী শুনছি?’
মাম্মি বা ড্যাডি কী জিজ্ঞেস করলে, কী উত্তর দেবে, সারাটা দিন মনে মনে তার রিহার্সাল দিয়েছে মিলেনা। ও বলল, ‘কী শুনেছ মাম্মি?’
‘তুমি না কি কনভার্ট হচ্ছো। চার্চের ফাদার একটু আগে ফোন করে তোমার সম্পর্কে অনেক কমপ্লেন করলেন।
উনি বললেন, তুমি না কি নিয়মিত হিন্দু টেম্পলে যাচ্ছ?’
‘ভাল লাগে তাই যাচ্ছি। এতে কমপ্লেন করার কী আছে?’
‘চমৎকার! এই কথাটা যদি এখানে ছড়ায়, তা হলে কী দুর্নাম হবে ভাবতে পারছ? হোল ক্রিশ্চান কমিউনিটি আমাদের থুতু দেবে।’
মিলেনা উড়িয়ে দিল কথাটা, ‘তোমার ওখানে কারা কী ভাবল, আয়্যাম লিস্ট বদারড মাম্মি।’
ও প্রান্তে মাম্মি উত্তেজিত, ‘তুমি তো এ ভাবে কথা বলতে না! কে এই ছেলেটা? যার জন্য তুমি এতটা বদলে গেছো? আমি জানতে চাই, সে কী করে? তোমার ড্যাডি মিসেস ভাল্লাকে ফোন করেছিলেন। উনি বললেন, ছেলেটা না কি প্রায়ই রাতে তোমার কাছে থাকে।’
মিলেনা প্রতিবাদ করল, ‘উনি ঠিক বলেননি। খুব অবাক লাগছে ভেবে, তোমরা এখন মিসেস ভাল্লার কাছ থেকে আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছ। অথচ তোমরাই এতদিন বলতে, মহিলার ছায়া মাড়িও না।’
‘চুপ করো। শুধু উনি নন, চার্চের ফাদারও কয়েকটা ছবি আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। ছেলেটার সঙ্গে তোমার ছবি। ওর মধ্যে তুমি কী এমন দেখলে মিলেনা? যে মাম্মি-ড্যাডি এত তুচ্ছ হয়ে গেল? জানো, তোমার দাদা কতটা রেগে গেছেন? না, না তোমাকে আর ইন্ডিয়ায় থাকতে হবে না। বিয়ে দিয়ে তোমাকে আমরা সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।’
‘ডোন্ট এভার ট্রাই মাম্মি। আয়্যাম নট গোয়িং এনিহোয়ার। আয়্যাম অ্যাডাল্ট, অ্যান্ড বাই বার্থ অ্যান ইন্ডিয়ান। আমি কাকে বিয়ে করব, সেটা আমার ইচ্ছের উপর নির্ভর করবে। আর আমার ইচ্ছে, দেবদূতকে বিয়ে করে এখানে সেটল হওয়া। তোমার আর কিছু বলার আছে?’
‘তুমি ভুল করছ ডার্লিং। এখন বুঝতে পারছ না। এই দেবদূত ছেলেটা তোমার যোগ্য না। চার্চের ফাদার ওর সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন। লো মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ছেলে। তোমার যা লাইফ স্টাইল, ওকে বিয়ে করলে, বাকি জীবনটায় প্রতি পদে পদে তুমি হোঁচট খাবে। ড্যাডি সাফ বলে দিয়েছেন, তোমার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখবেন না। আমি জানি, ছেলেটা তোমার ড্যাডির বিশাল সম্পত্তি আর বিজনেসের কথা জেনে তোমাকে ফাঁসিয়েছে। তুমি কিন্তু সুখী হবে না।’
এ সব মাম্মি কী বলছে, কার কাছে কী শুনেছে? সত্যি কথা হল, দেবদূত কোনওদিন ওর পরিবারের কথা খুঁটিয়ে জানতেই চায়নি। ও জানেও না, ড্যাডি কত ধনী। মিলেনাও আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। ফ্যাক্ট রিমেন্স, ওর মধ্যে টাকা-পয়সার লোভ, বিত্তবান হওয়ার ইচ্ছে, কোনটাই লক্ষ্য করেনি মিলেনা। ও সুখী হবে কি না, মাম্মি জানল কী করে? দুম করে ও বলে বসল, ‘অর্থ মানুষকে সুখ দেয় বলে আমার মনে হয় না মাম্মি। আমায় বলো তো, তুমি সুখী?’
ও প্রান্তে মাম্মি ধৈর্য হারাল, ‘তোমার সাহস তো কম নয়। কাকে কী বলছ, খেয়াল আছে?’
‘আছে। তবে আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে, তুমি আমার নিজের মাম্মি কি না।’
দু’তিন সেকেন্ড অপেক্ষা করে মাম্মি কথাটা বলেই ফেলল, ‘তোমার সন্দেহটাই ঠিক মিলেনা। জানতে যখন চাইছ, তখন বলি। তোমাকে কিন্তু আমি পেটে ধরিনি। বাধ্য হয়ে তোমাকে মানুষ করতে হয়েছিল। মায়ের দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়েছিল। তবে হ্যাঁ, এরিক গ্রেগারিয়ান কিন্তু তোমার ড্যাডি। আমি তোমার আসল মা নই।’
শুনে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল মিলেনার। এ কী ও শুনছে? কথাটা হজম করার সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখের কোণ ভিজে উঠল। নিজেকে দ্রুত সামলে ও জিজ্ঞেস করল, ‘তা হলে আমার আসল মা কে?’
মাম্মির হিসহিস করা গলা ভেসে আসছে, ‘তিনি একজন বেঙ্গলি। দার্জিলিংয়ে আমাদের এভারেস্ট হোটেলের এমপ্লয়ি ছিলেন। তাঁর সঙ্গে তোমার ড্যাডির ঘনিষ্ঠতার কথা আমি জানতাম না। একবার ছুটি কাটাতে দার্জিলিং গিয়ে জানতে পারি। তোমার বয়স তখন তিন বছর হয়ে গেছে। সবাই তোমাকে এরিকের মেয়ে বলে জানে। তোমার ব্যাড লাক, সে বছরই দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়িতে নামার পথে, ঘন কুয়াশায় তোমার মাম্মি মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। তোমাকে আমি ফেলে দিতে পারিনি। তোমার ড্যাডি আমাকে দিয়ে প্রমিস করিয়ে নেন, কোনওদিন যেন সত্যি কথাটা তোমাকে না বলি। কিন্তু আজ তুমি বাধ্য করলে।’
চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে আসছে। এত বড় একটা ধাক্কা কি করে মিলেনা সামলাবে, বুঝে উঠতে পারল না। মাথাটা পরিষ্কার হতে শুরু করল ওর। অবৈধ সন্তান বলেই সম্ভবত মাম্মি বা ড্যাডি ওকে কোনওদিন ইরেভেনে নিয়ে যাননি। সারা জীবন দূরে দূরে রেখেছেন। কখনও কালিম্পং, কখনও দিল্লি বা কলকাতায়। ওর বিয়ের ব্যবস্থাটাও করছিলেন কলকাতা থেকে। এর পর কেন প্রশ্নটা করল, মিলেনা নিজেও জানে না। ‘আমার আসল মায়ের অ্যাক্সিডেন্টের কথা কতটা সত্যি?’
‘আমি জানি না। আমাকে তাই বলা হয়েছিল। তুমি এরিককে জিজ্ঞেস কোরো। ও ভাল বলতে পারবে।’ মিলেনা বলল, ‘তার দরকার নেই। ড্যাডিকে ফোন করতে বারণ কোরো। আমারও কথা বলার ইচ্ছে নেই। তোমাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ। গুডবাই।’
(ছেচল্লিশ)
নার্গিসের সঙ্গে আসফাকের আজ নিকাহ। শীল লেনের একটা ভাড়া বাড়িতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। বেলা দশটার সময় সেখানে যেতে হবে রুস্তমকে। দিন চারেক আগে আসফাক এসে বলল, নার্গিসের বাড়ি থেকে খুব চাপ দিচ্ছে। আর দেরি করা যাবে না। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তোমাকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে। তখন না করতে পারেনি রুস্তম। এখন ওর একটা ফোনেই সবকিছু হয়ে যায়। বিয়ে বাড়ি ভাড়া করা, ক্যাটারার ঠিক করা, মৌলভীকে নিয়ে আসা, পার্টির লোকজনকে নেমতন্ন করা… সব ফোনে ফোনে হয়ে গেছে। মায়, নিকাহর পর নার্গিসকে নিয়ে কোন বাড়িতে উঠবে, সেটাও রুস্তম ঠিক করে দিয়েছে।
নার্গিস মেয়েটা হায়ার সেকেন্ডারি পাশ। ওকে একটা চাকরিরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে রুস্তম। এন্টালিতে কর্পোরেশনের বার্থ রেজিস্ট্রেশন অপিসে। এর জন্য লাখ তিনেক টাকা খরচা করতে হয়েছে ওকে। চাপের কাজ না। বার্থ রেজিস্ট্রেশন-এর ফরম নেওয়ার কাজ। সকাল ন’টা থেকে বেলা দুটো অবধি। বিজনের বাড়িতে ঝিগিরি করার থেকে তো অন্তত ভাল। পার্টির জন্য আসফাক যে ধরনের ঝুঁকি নেয়, তাতে যে কোনওদিন গুলি খেয়ে মরতে পারে। জেলে যেতে পারে। তখন নার্গিস যাতে পথে না বসে, সেই কারণে নেতাদের ধরাধরি করে, সরকারি চাকরিটা নার্গিসকে ও পাইয়ে দিয়েছে। আসফাক ওর অনেক দিনের সঙ্গী। ভাইজানের জমানায় অনেকবার দু’জনে অ্যাকশনে গেছে। লাল পার্টির আমলে দু’একবার তো মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছে। ওর জন্য এটুকু না করলে বিবেকের দংশনে ভুগত রুস্তম।
কাল পার্টি অফিসে আসফাক বলেছিল, ‘ওস্তাদ, একটু তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি না আসা পর্যন্ত কিন্তু নিকাহ আটকে থাকবে।’ কিন্তু শীল লেনের দিকে বেরনোর সময় রুস্তম একের পর এক ফোন পেতে থাকল। প্রথমে মান্টির ফোন। প্রায় চিৎকার করেই ও বলল, ‘ঘর ফাঁকা হয়ে গেছে রুস্তমদা। চুলের মুঠি ধরে লালিকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে আবিদ ভাইজানের মেয়ে।’
শুনে একটু অবাকই হয়েছিল রুস্তম। গতকাল সকালেই ওর কাছে খবর আসে, উলুবেড়িয়া থেকে ভাবীজানকে নিয়ে রাবেয়া কলকাতায় এসেছে। চার নম্বর পুলে ভাইজানের বাড়িতে আছে। ঝাউতলার ফ্ল্যাটের দলিলটা সঙ্গে দিয়ে ববিকে ও পাঠিয়েছিল রাবেয়ার কাছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই ঘর ফাঁকা! মান্টিকে ও জিজ্ঞেস করল, ‘চেঁচাস না। কী করে হল, বল।’
‘রাত তিনটের সময় ঘুম ভেঙে গেল। শুনি উপরতলায় চেঁচামেচি হচ্ছে। দরজা খুলে বেরতেই দেখি, দশ বারোজন লোক সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। সবার কোমরে চেম্বার। ভাইজানের মেয়েকে এই প্রথম দেখলাম রুস্তমদা। কী রোয়াব। লিলির জিনিসপত্তর লোকজন দিয়ে নামিয়ে একটা ম্যাটাডরে তুলে দিল। কপালে চেম্বার ধরে রেন্ডিটাকে বলল, আর কখনও যেন ঝাউতলায় তোকে না দেখি। যা, বসিরহাটে ফিরে যা। আব্বুজানকে নিয়ে যদি আর একটা কথাও কাউকে বলিস, জিভ কেটে নেবো। রেন্ডিটাকে বসিরহাট পৌঁছে দেওয়ার জন্য চারটে লোকও সঙ্গে গেছে। ভোর হতে না হতেই অপারেশন খতম।’
এ রকমই একটা কিছু হবে, রুস্তম আশা করেছিল। ও জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইজানের মেয়ে তোকে কিছু বলল না? অন্য ফ্ল্যাটের লোকেরা তখন কী করছিল?’
‘আমাকে বলল, এক সপ্তাহের মধ্যে আমার ফ্ল্যাট নতুন রং করিয়ে রাখবি। আর রেন্ডিটা যদি অন্য কারোর ফ্ল্যাটে আসে, তা হলে আমাকে খবর দিস। তাকে পুঁতে দিয়ে যাবো। কথাটা শুনে অন্য ফ্ল্যাটের লোকেরা গুটিয়ে গেছে। ভাইজানের মেয়ের যা ফরমা দেখলাম, রুস্তমদা আপনাকেও না ট্রাবল দেয়।’
উত্তর না দিয়ে রুস্তম ফোনের লাইনটা কেটে দিল। মান্টিকে মাথায় তোলার দরকার নেই। রাবেয়াকে ও প্রায় কুড়ি বছর ধরে চেনে। ও যতটা চেনে, রাবেয়াও ওকে ততটাই চেনে। অতীতে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। একটা নিকাহর অনুষ্ঠানে যাচ্ছে, মেজাজ খারাপ করে লাভ নেই। আলমারি থেকে বের করে নতুন শেরওয়ানিটা পরার সময় ফোনটা ফের বেজে উঠল। এ বার ট্রাভেল এজেন্ট রঘুবীরের ফোন, ‘রুস্তমভাই, সিআইডি-র একজন অফিসার আমার কাছে এসেছিল। জানতে চাইছিল, ফুয়াদের জন্য সিঙ্গাপুরের টিকিট কে কাটার অর্ডার দিয়েছিল? আপনার নামটা আমি করিনি। আফজলমিঞার নাম বলেছি।’
‘ঠিক করেছিস।’ রুস্তম খানিকটা নিশ্চিন্ত। কালই মউয়ের মুখে ও শুনেছে, ফুয়াদের কেসটা এখন আর কলকাতার পুলিশের হাতে নেই। মিডিয়ার চাপে গভর্নমেণ্ট কেসটা সিআইডির হাতে তুলে দিয়েছে। তার মানে বিশ বাঁও জলে। সিআইডি লোকদেখানি তদন্ত করবে। ফুয়াদকে সিঙ্গাপুর থেকে নিয়ে এসে বাহবা কুড়োবে। দু’দিন পর কেউ খোঁজ রাখবে না, ফুয়াদ কবে বেল পেয়ে গেছে। রঘুবীর লাইনটা ধরে আছে। হঠাৎ মউয়ের একটা কথা মনে পড়ল রুস্তমের। রঘুবীরকে ও বলল, ‘শোনো, কাল বা পরশুর মধ্যে গোয়ার ফ্লাইটের দুটো টিকিট পাওয়া যাবে? ওখানে একটা হোটেলে থাকার ব্যবস্থাও তোমাকে করে দিতে হবে।’
‘টিকিট দুটো কার নামে হবে রুস্তমভাই?’
‘আসফাক আহমেদ আর নার্গিস বেগম। সন্ধেবেলায় কেউ এসে যেন টিকিট আর হোটেলের ডিটেলস দিয়ে, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। ছ’টা-সাড়ে ছ’টা নাগাদ আমি পার্টি অফিসে থাকব।’
‘ঠিক আছে রুস্তমভাই। পরশু কলকাতা থেকে একটা ডাইরেক্ট ফ্লাইট আছে। যে কাপল যাচ্ছে, তাদের আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে বলবেন। না হলে কিন্তু এয়ারপোর্টে ঝামেলায় পড়বে।’
ফোনটা শেরওয়ানির পকেটে রেখে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল রুস্তম। ফোনের পর ফোন। আবিদ ভাইজানকেও একই সমস্যায় পড়তে দেখেছে ও। রাজ্যের লোকের তুচ্ছ সমস্যা। নিজেরাই মিটিয়ে নিতে পারে। তবুও, মাথা ঠান্ডা রেখে ভাইজান সবার সঙ্গে কথা বলতেন। ভাইজানের জায়গাটা নিতে হলে ওকেও ভাইজানের মতো হতে হবে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে রুস্তম দেখল, প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। ওর বাড়ি থেকে শীল লেন খুব বেশি দূরে না। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। গুলাটির দেওয়া এসইউভি গাড়িতে উঠে বসতে না বসতেই ও রাবেয়ার ফোন পেল। ‘জনাব রুস্তম। ব্যস্ত না কি?’
গলায় ব্যঙ্গের সুর লক্ষ করে রুস্তম সতর্ক হয়ে গেল। রাবেয়া কী মতলবে ফোন করেছে, কে জানে? তবুও সৌজন্য দেখিয়ে বলল, ‘তেমন ব্যস্ত না। একজনের নিকাহ অ্যাটেন্ড করতে যাচ্ছি। কী বলবে বলো।’
‘কথাটা ফোনে বলা ঠিক হচ্ছে কি না জানি না, থ্যাঙ্কু। আব্বুজান আমার জন্য আর কী রেখে গেছে, জানতে পারলে ভাল লাগত।’
‘খুঁজে পেলে নিশ্চয়ই জানাব। কাজের কথা বলো।’
‘শুনলাম, কর্পোরেশন ইলেকশন আসছে। সাতান্ন নম্বর ওয়ার্ড থেকে আমি এ বার দাঁড়াতে চাই। তুমি সেই ব্যবস্থা করো।’
ভাইজান সাতান্ন নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার ছিলেন। বলতে দ্বিধা নেই, খুব পপুলারও ছিলেন। তাঁর মেয়ে যদি ক্যান্ডিডেট হয়, অনেক সিমপ্যাথি ভোট টানবে। কেউ বোধহয় ওর মাথায় কথাটা ঢুকিয়েছে। কিন্তু রুস্তম জানে, রাবেয়া কী চিজ। তাই, ও প্রশ্ন তুলল, ‘তুমি ক্যান্ডিডেট হলে তো ভালই হয়। কিন্তু মালদহে থাকলে তুমি কী করে ওয়ার্ড সামলাবে রাবেয়া? জানোই তো, কাউন্সিলারকে রোজকার প্রবলেম সামলাতে হয়।’
‘কে বলেছে, আমি মালদায় থাকব? তেমন হলে আমি আম্মুর কাছে এসে থাকতে পারি।’
‘ঠিক জানো, তোমার ডাক্তার হাসবেন্ডের আপত্তি নেই?’
‘ওই বাস্টার্ডটার কথা আমায় জিজ্ঞেস কোরো না রুস্তম। নিকাহর বারো বছর হয়ে গেল। এখনও একটা বাচ্চা পয়দা করতে পারল না। ওর সঙ্গে থেকে আমার লাভ কী? এখন এক বিছানাতে শুইও না। যাক গে, তোমাকে আমার মনের ইচ্ছেটা জানিয়ে রাখলাম। আব্বুজানের সব কিছুই তো তুমি দখল করে নিয়েছ। এটুকু অন্তত আমার জন্য রেখো।’
রাবেয়া ফের ছলাকলা শুরু করেছে। ওকে বাড়তে দেওয়া চলবে না। রুস্তম বলল, ‘পার্টির অনেকেই বলছিল, ভাইজানের জায়গায় এ বার ভাবীজানকে ক্যান্ডিডেট করার জন্য। কিন্তু তোমার রিকোয়েস্ট আমার মনে থাকবে। ভাবীজানকে বোলো, পরে গিয়ে আমি একদিন দেখা করে আসব। আচ্ছা এখন ছাড়ি।’
রাবেয়াকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনের লাইন কেটে দিল রুস্তম। তারপর শীল লেনের দিকে রওনা হল। হরগিজ ভাইজানের পরিবারের কাউকে ও সিট পেতে দেবে না। পার্ক সার্কাস অঞ্চলে অনেক দিন ধরে ওরা রাজ করেছেন, আর নয়। একটা সময় রাবেয়ার কম অত্যাচার ওকে সহ্য করতে হয়নি। ভাইজানের ছত্রছায়ায় ছিল বলে রাবেয়া ওর সঙ্গে চাকরবাকরের মতো ব্যবহার করত। একবার শাহরুখ খানের কোনও একটা সিনেমার টিকিট এনে দিতে বলেছিল। নূরমহল হল-এ ঘণ্টাখানেক লাইন দিয়েও রুস্তম টিকিট পায়নি। রাগে রাবেয়া ওকে চড় মেরেছিল। মনে আছে, সব রুস্তমের মনে আছে। সেইসময় অ্যাকশনে গিয়ে প্রথম মার্ডারটা করার পর ওর ভাঁও অনেক বেড়ে যায়। তার পর থেকে রাবেয়া টিটকিরি মেরে ওকে জনাব বলে সম্বোধন করত। বহুদিন পর মেয়েটা মনে করিয়ে দিল।
মিনিট দশেক পর শীল লেনের নিকাহ বাড়িতে গিয়ে রুস্তম দেখল, অ্যারেঞ্জমেন্ট মনের মতো হয়েছে। এন্টালির মার্কেট থেকে কিনে আনা ফুল দিয়ে পুরো বাড়িটা সাজানো হয়েছে। সামনে বিরাট প্যান্ডেল। সেখানে কলেজ স্ট্রিটের মেহবুব কোম্পানির ব্যান্ড বাজছে। প্রচুর নিমন্ত্রিতের ভিড়। তিন-চার রকমের সরবত নিয়ে ঘুরছে ক্যাটারারের লোক। কোনওদিক থেকে কম নেই। আসফাকের নিকাহটা বড় করে করার পরামর্শটা অবশ্য মউয়ের। ড্রিঙ্ক করার ফাঁকে ও বলেছিল, ‘ভবিষ্যতে তোমার যাদের দরকার হবে, চেনা হোক বা অচেনা, তাদের তুমি অনুষ্ঠানে ডাকবে। পাবলিক রিলেশন বাড়ানোর এটাই তোমার প্রথম সুযোগ। ওখানে এমন কিছু কোরো, যাতে তোমার ইমেজ বাড়ে।’ শুনে পরদিনই আসফাক আর নার্গিসের সঙ্গে বসে রুস্তম লিস্ট বানিয়েছিল। এদিকে এন্টালি থেকে গোবরা, ওদিকে তপসিয়া, ট্যাংরা থেকে শুরু করে পঞ্চান্ন গ্রাম। ওদের যত পার্টি অফিস আছে, তার প্রত্যেকটার দু’তিনজন করে নেতাকে ও ইনভাইট করেছে।
আগে ভাইজানের সঙ্গে কোনও অনুষ্ঠানে গেলে খাতিরদারি লক্ষ করত রুস্তম। চেনা-পরিচিতরা ভাইজানকে ঘিরে থাকতেন। উনিও সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। রুস্তমকে অন্যরকম কিছু করতে হবে। সানগ্লাসটা চোখে লাগিয়ে নিয়ে নিকাহর আসরে ঢুকে ও খুব গম্ভীর হয়ে সামনে গিয়ে বসল। অ্যাকশনে পাঠানোর আগে ভাইজান বলত, ‘রুস্তম বেটা, তোর পিছনের চোখটা ঠিক আছে তো?’ উনি বিশ্বাস করতেন, সত্যিকারের রুস্তম যারা হয়, তাদের মাথার পিছন দিকেও একটা করে চোখ থাকে। অ্যাটাকটা কোনদিক থেকে আসছে, তারা দেখতে পায়। নিকাহ অনুষ্ঠান চলার সময় সেই তৃতীয় চোখ দিয়ে রুস্তম বুঝতে পারল, পার্টির তলার স্তরের কর্মীরা সম্ভ্রমের চোখে ওকে দেখছে। এই রহস্যময়তাই ও চাইছিল।
নিকাহর আসরে শেরওয়ানিতে আসফাককে চেনাই যাচ্ছে না। বিউটি পার্লার থেকে সেজে আসা নার্গিসকেও মনে হচ্ছে অনুষ্কা চোপড়া। মৌলভী সাহেব নিকাহর নিয়মগুলো পালন করছেন। এমন সময় ছন্দপতন! হঠাৎ খাকি উর্দিপরা দু’জন পুলিশ অফিসার এসে হাজির। আসফাককে ওঁরা তুলে নিয়ে যেতে চান। হলঘরে শ’দুয়েক নিমন্ত্রিত বসে। তাদের মধ্যে গুঞ্জন হয়ে গেল। একটু পরেই রুস্তম মৌলভী সাহেবের চড়া গলা শুনতে পেল, ‘আপনি যে-ই হোন, বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। আমার কাজটা শেষ হতে দিন।’
আসফাক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নার্গিসের চোখ ছলছল করছে। কেউ একজন পিছন থেকে বলল, ‘রুস্তমভাই, আপনি কিছু করুন।’ রুস্তম পিছন দিকে তাকিয়ে দেখল, নার্গিসের আব্বুজান। হাতজোড় করে রয়েছে। নার্গিস ওর পায়ের সামনে বসে পড়ে বলতে লাগল, ‘রুস্তমভাই, আসফাককে বাঁচান।’
মৌলভী সাহেবের সঙ্গে পুলিশ অফিসারদের তর্কাতর্কি হচ্ছে। একজন হ্যান্ডকাফ বের করে ধমকাচ্ছেন। তা শুনে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়ে গেল। মৌলভী সাহেবকে অপমান বরদাস্ত করা হবে না। আর সময় দেওয়া উচিত না। দিলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রুস্তম জোর গলায় অফিসারদের উদ্দেশে বলল, ‘মৌলভী সাহেবকে ডিসটার্ব করবেন না। আপনারা এসে আমার সঙ্গে কথা বলুন। আমি রুস্তম, পুরো ইস্ট ক্যালকাটা আমার কন্ট্রোলে।’
অফিসারদের একজন কাছে এসে বললেন, ‘আসফাককে আমরা অ্যারেস্ট করতে এসেছি।’
দাবিয়ে দিয়ে রুস্তম জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কারা? কোন থানা থেকে এসেছেন? ওয়ারেন্ট আছে?’
‘আছে। আমরা সিআইডি অফিসার। ভবানীভবন থেকে এসেছি। কিন্তু আপনি কে যে, আপনাকে ওয়ারেন্ট দেখাতে হবে?’
‘শূয়ারের বাচ্চা, আমি তোদের বাপ।’ শেরওয়ানির পকেট থেকে এম নাইন পিস্তল বের করে রুস্তম হুমকি দিল, ‘তোদের এত বড় সাহস। আমার সামনে আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে যাবি? আসফাক কী এমন করেছে যে ওকে তোরা অ্যারেস্ট করবি?’
পিস্তল দেখে অফিসার দু’জন ঘাবড়ে গেছেন। একজন বললেন, ‘পিস্তল নামান। আপনি কিন্তু ঠিক করছেন না রুস্তম। সরকারী কাজে বাধা দিচ্ছেন। আফজলমিঞার ছেলের কেসটা এখন আমাদের হাতে। আসফাক ওই ছেলেটাকে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। একজন মার্ডারারকে আড়াল করতে যাওয়াও অপরাধ। আপনি যদি আমাদের বাধা দেন, তাহলে আপনাকেও তুলে নিতে হবে।’
নিমন্ত্রিত কর্মীরা গোল হয়ে সিআইডি অফিসারদের ঘিরে ধরেছে। মেজাজ হারিয়ে রুস্তম একজনকে ঠাস করে এক চড় মেরে বসল। তারপর বলল, ‘ভাগ চুতিয়ার বাচ্চা, তোদের ডিজিকে গিয়ে বলিস, আমি আসফাককে কাজটা করতে বলেছিলাম। মুসলমানকে মুসলমান না দেখলে, কে দেখবে? যা, তোদের পুরো ফোর্স এখানে নিয়ে আয়। দেখি, কোন বানচোত আমাকে অ্যারেস্ট করে।’
পার্টি কর্মীরা হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, ওরা আশাই করেনি, সিআইডি অফিসারের গায়ে ও হাত তুলবে। সবার উদ্দেশে রুস্তম বলল, ‘এ দুটোকে তোরা বাইরে বের করে দে। তার আগে পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে আমাকে দিয়ে যাবি। তোদের ভয় নেই। নিকাহ আর খাওয়া দাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি এখানে আছি।’ কথাগুলো বলে রুস্তম ফের মুখ গম্ভীর করে সোফায় গিয়ে বসল।
নির্বিঘ্নে নিকাহর কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল। পরোঠা, কাবাব, গোস্ত মাটন বিরিয়ানি আর ফিরনি খেয়ে একে একে নিমন্ত্রিত পার্টি কর্মীরা বেরিয়ে যেতে শুরু করল। যাওয়ার আগে সবাই ওর সঙ্গে দেখা করে যাচ্ছে। কে যেন বলল, ‘রুস্তমভাই, শুনেছিলাম, করিম বক্স লেনে আপনি না কি ডাইভ মেরে বোমা লুফে নিয়েছিলেন। কথাটা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ নিজের চোখে আপনার যা সাহস দেখলাম, আবিদ ভাইজানের মধ্যেও তা দেখিনি।’ কেউ একজন ফিসফিস করে বলে গেলেন, ‘পরেশদার জায়গায় আপনি ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারছি না রুস্তমভাই। আপনি পারবেন, আমাদের ইন্টারেস্ট দেখতে।’ মুখে স্মিত হেসে রুস্তম অবশ্য সবাইকে বলতে লাগল, ‘আমার ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে কিন্তু আসা চাই। এ বার অনেক বড় করে অনুষ্ঠান করছি পার্ক সার্কাস ময়দানে।’
বিকেল চারটের সময় শীল লেন থেকে বেরিয়ে পার্টি অফিসে আসার সময় ট্যাংরার এক চাইনিজ রেস্তোরাঁয় ঢুকল রুস্তম। যাদের সঙ্গে ও দেখা করতে এসেছে, তারা কোণের একটা টেবলে বসে আছে। একজনের কপালে ছোট্ট লিউকোপ্লাস্ট। ওকে দেখে লোক দুটো উঠে দাঁড়াল। ওদের বসতে বলে, পকেট থেকে নোটের বাণ্ডিল বের করে, রুস্তম বলল, ‘বেশি লাগেনি তো? চড়টা কিন্তু জোরেই মেরেছিলাম।’
একজন হেসে বলল, ‘মউদি কোনও রিকোয়েস্ট করলে আমরা না করতে পারি না স্যার। উনি প্রায়ই আমাদের নাটক দেখতে আসেন। পুলিশ অফিসারের রোলে আমাদের কেমন লাগল, বললেন না তো?’
টাকার বান্ডিল দুটো রুস্তম এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমরা একটাই ভুল করছিলে। সিআইডি অফিসারদের কোনও ইউনিফর্ম নেই। তোমরা খাঁকি ড্রেস পরে গেছিলে কেন?’
(সাতচল্লিশ)
সকালে নাজমা ফোন করে বলল, ‘মিঠুনদা, দিদি খুব কান্নাকাটি করছে কাল রাত থেকে। তুমি শিগগির একবার আমাদের ফ্ল্যাটে এসো।’
নাজমা ওকে মিঠুনদা বলে ডাকে। ওর হাসিটা না কি সিনেমার হিরো মিঠুন চক্রবর্তীর মতো। ফোন পেয়ে মিলেনার কান্নাকাটির কারণটাই খুঁজে পেল না দেব। আজ মাঝ রাতেই ওর ব্যাঙ্কক যাওয়ার কথা। ঠিক আছে, সকালে একবার আনন্দী ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে আসবে। তারপর দুপুরবেলায় ও যাবে মিলেনার সঙ্গে দেখা করতে। তারও পর মেসে ফিরে রেস্ট। রাত এগারোটার সময় তমাল ওকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আসবে। মিলেনা যদি সি অফ করতে যেতে চায়, তা হলে যেতে পারে। হিমাদ্রি বলেছে, বাড়ি থেকে ও সোজা এয়ারপোর্ট চলে যাবে। এরই মাঝে সকালে নাজমার ফোন। ও জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, তুমি কি কিছু জানো?’
মেয়েটা বলল, ‘কাল রাতে দেশ থেকে দিদির মাম্মি ফোন করেছিল। তারপর থেকে দিদি কাঁদছে।’
শুনে দেবের মনে কুডাক দিল। হয় মিলেনার গ্র্যান্ডপা ফিরে এসে কোনও ঝামেলা করেছেন, নয়তো ওর সঙ্গে মিলেনার রিলেশনের কথা ইরেভেনে জানাজানি হয়ে গেছে। সমস্যাটা যদি গ্র্যান্ডপাকে নিয়ে হত, তা হলে নাজমা বলে দিত। তার মানে দ্বিতীয় ধারণাটাই ঠিক। ইরেভানে একদিন না একদিন খবরটা পৌঁছতই। সেটা এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে, দেব ভাবতেও পারেনি। আর এমন একটা ক্রুশিয়াল সময়, যখন ওকে একশো পার্সেন্ট ফোকাসড থাকতে হবে। মিলেনার বাবা-মা নির্ঘাত ওকে ভয় দেখিয়েছেন। না হলে ও কাঁদার মেয়ে নয়। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে নাজমা বলল, ‘দিদি সুটকেস গোছগাছ করছে। এ বাড়িতে আর নাকি থাকবে না। মিঠুনদা, তুমি শিগগির এসো।’
‘ফোনটা কি তোমার দিদিকে দেওয়া যাবে?’
‘না গো। দিদি দোর ভেজিয়ে রেখেছে।’
‘ঠিক আছে, আমি আসছি। একবার জিম ঘুরে স্টিফেন ম্যানসনে যাচ্ছি।’
তমাল ভোর ছ’টায় কিচেনে নেমে গেছে। মায়ানমার থেকে প্রায় একশো জন তীর্থযাত্রী হোটেলে এসে উঠেছেন। আজ বেলা দশটায় তাঁরা না কি বাসে করে সারনাথ রওনা হবেন। তাঁদের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সেই কারণে তমাল সকালের দিকটায় খুব ব্যস্ত থাকবে বলেছিল। পোশাক পরে নীচে নেমে এসে দেখল, লাউঞ্জে বার্মিজ তীর্থযাত্রীদের ভিড়। তারা একে একে লাক্সারি বাসে উঠে যাচ্ছেন। তদারকি করছে ফ্লোর ম্যানেজার মারিয়া গোমস। ওকে দেখেই মারিয়া এসে বলল, ‘গুড মর্নিং দেবদা। আপনার তো আজই ব্যাঙ্কক যাওয়ার কথা, তাই না? উইশ ইউ গুড লাক।’
দেব বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ মারিয়া। প্রে টু গড, সো দ্যাট আই ক্যান কামব্যাক অ্যাজ চ্যাম্পিয়ন।’
‘সিওর দেবদা। বাই দ্য বাই, আপনি কি মউ সরকার বলে কাউকে চেনেন?’
‘হ্যাঁ, তুমি কি টিভি রিপোর্টার মউ সরকারের কথা বলছ? কেন বলো তো?’
‘ও আমার সঙ্গে লেডি ব্র্যাবোর্নে পড়ত। সেদিন দেখা হয়েছিল। ও মিলেনার সম্পর্কে অনেক কথা জানতে চাইছিল। পরে দেখলাম, রুস্তম ওর কাছে এল। ওকে দেখে আমি উঠে এলাম।’
মউ সরকারের সঙ্গে মাত্র একটা দিনের আলাপ। টিভিতে ইন্টারভিউ নিয়েছিল। মেয়েটাকে খারাপ মনে হয়নি দেবের। কিন্তু রুস্তমের সঙ্গে ওর যোগাযোগ আছে শুনে দেব থমকে গেল। রুস্তমের একটাই অ্যাজেন্ডা, মিলেনাদের ফ্ল্যাটটা কবজা করতে হবে। ও গিয়ে ভয় দেখায়নি তো? সেই কারণেই কি মিলেনা কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভাবছে? দেব জিজ্ঞেস করল, ‘মউ সরকারের সঙ্গে তোমার কোথায় দেখা হয়েছিল মারিয়া?’
‘ইন দ্য ফার্টি টু বিল্ডিং। মউ আমাকে ওখানে নিয়ে গেছিল। বলল, ওখানে থাকে। আমি বুঝতে পারলাম না, ওইরকম একটা লাকজুরিয়াস ফ্ল্যাট ওর হল কী করে? আমি জিজ্ঞেস করিনি, কিন্তু আমার মনে হল, রুস্তমের সঙ্গে ওর রিলেশনটা খুব ক্লোজ। আপনি থাকছেন না। এই ক’টা দিন মিলেনাকে একটু সাবধানে থাকতে বলবেন।’
‘বলব মারিয়া।’ কথাটা বলে দেব আর দাঁড়াল না।
কয়েক মিনিট পর হেঁটে জিম-এর কাছে এসে দেব দেখল, গেট বন্ধ। শাটার পর্যন্ত তোলা হয়নি। বেলা সাড়ে আটটা বাজে, এখনও জিম খোলা হয়নি কেন, দেব বুঝতে পারল না। গতকাল সকালে পাণ্ডেজিকে ও বলে দিয়েছিল দিন পনেরো ছুটি নিচ্ছে। মেল পাঠিয়ে দিয়েছে আনন্দী ম্যাডামের কাছে। পাণ্ডেজি তখন বলেন, ‘ঠিক আছে, আপনি নিশ্চিন্তে চলে যান। জিম-এর দেখাশুনো আমি করব।’ পাণ্ডেজির হলটা কী? উনি তো এতটা ইরেসপন্সিবল নন! দেব অবাক হয়েই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। মেম্বাররা দু’একজন করে হাজির হচ্ছেন এবং ফিরে যাচ্ছেন। জিম বন্ধ কেন, প্রশ্নটার উত্তর দেব দিতে পারছে না। মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থাকার পর ও ফোন করল পাণ্ডেজিকে, ‘জিম খোলেননি কেন?’
পাণ্ডেজি বললেন, ‘ম্যাডাম কয়েকটা দিন বন্ধ রাখতে বলেছেন দেবজি। উনি পেস্টিসাইডিস কোম্পানিকে খবর দিয়েছেন। পুরো জিম সাফা করার পর খুলবেন।’
শুনে মাথা গরম হয়ে গেল দেবের। ও বলল, ‘সত্যি কথাটা বলুন।’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর পাণ্ডেজি বললেন, ‘কাল বিকেলে যা হয়েছে, ম্যাডাম তাতে খুব অসন্তুষ্ট। কয়েকজন মেম্বার খুবই অসভ্যতা করেছিল। নিশ্চয়ই আপনার কানে গেছে। দেবজি, আপনি এসব নিয়ে এখন মাথা ঘামাবেন না। একটা বড় কম্পিটিশনে যাচ্ছে। স্টে ফোকাসড। আপনি ফিরে এলে ম্যাডাম ডেফিনিটলি জিম খোলার পার্মিশন দেবেন।’ আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ পাণ্ডেজি লাইনটা কেটে দিলেন।
যাদবের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দেবের চোখ জ্বালা করতে লাগল। কাল বিকেলে যা হয়েছে, রাতে তা সবই শুনেছে ও। প্রথমে অনিরুদ্ধ ফোন করেছিল। তারপর কোয়েল। কিন্তু ও তখন কালীঘাটের মায়ের মন্দিরের লাইনে দাঁড়িয়ে। পুজো দেওয়ার জন্য গেছে। মেসে ফিরে আসার পর তমালের সঙ্গেও ওর আলোচনা হয়েছিল। তমাল ঠিকই বলেছিল, ‘জিম-এর কথা তুই মনে থেকে মুছে ফ্যাল দেব। ফোকাস ঠিক রাখ। তোকে আগেও বলেছি, কর্পোরেট জগতটা খুব নিষ্ঠুর। যে সম্মানটা তুই অ্যাদ্দিন পেতিস, জিম-এ কাল থেকে তুই আর পাবি না। দেখবি, যে লোকগুলো তোর খুব কাছের মনে হত, রাতারাতি তারা সবাই বদলে গেছে।’ সত্যি, দেব ভাবতেই পারেনি, পাণ্ডেজির মতো একটা নিপাট ভদ্রলোক এভাবে আচমকা লাইনটা কেটে দিতে পারেন।
মাথা ঠান্ডা করার জন্য দেব ফ্লুরিজে গিয়ে ঢুকল। দিনের এই সময়টায় ভিড় থাকে না। কোণের একটা টেবল ফাঁকা দেখে, ও সেখানে গিয়ে বসল। কোনও সমস্যায় পড়লে প্রায়ই ও ফ্লুরিজে ঢুকে পড়ে। খানিকক্ষণ একা বসে চিন্তাভাবনা করে তারপর বেরিয়ে যায়। দোকানের ম্যানেজার থেকে বেয়ারা… সবাই ওকে চেনে। এও জানে, বডিবিল্ডার বলে কেক-পেস্ট্রি ও কিছুই খায় না। তবুও, যতক্ষণ ও বসে থাকে, ততক্ষণ কেউ ওকে বিরক্ত করে না। শুধু টেবলের উপর এক গ্লাস জল ঢাকা দিয়ে রেখে যায়। আজ চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গে একজন বেয়ারা জলের গ্লাস নিয়ে এসে বলল, ‘নমস্কার দেবদূত স্যার। দু’তিনদিন আগে আপনার ইন্টারভিউ টিভিতে দেখলাম। আপনি আমাদের হুগলির ছেলে জেনে খুব ভাল লাগল।’
কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও দেব বলল, ‘তোমার বাড়ি হুগলির কোথায়?’
‘ধনেখালিতে স্যার। বাড়িতে বউকে বললাম, দেখো একজন বাঙালি, কত বড় কম্পিটিশনে লড়তে যাচ্ছেন। আমাদেরই জেলার ছেলে। প্রায়ই ইনি আমাদের দোকানে এসে বসেন। আপনার জন্য খুব গর্ব হচ্ছে স্যার। ম্যানেজারবাবুকে বলেওছি। জিতে আসুন, আপনার ট্রোফিটা একদিনের জন্য আমাদের দোকানে রেখে দেবো।’
এমন আন্তরিকভাবে কথাগুলো ছেলেটা বলল যে, মনটা ভাল হয়ে গেল দেবের। চোখ বুঁজে বাড়ির রাধামাধবকে স্মরণ করে ও বলল, ‘ঠাকুর দেখো, এদের মুখে যেন হাসি ফোটাতে পারি।’ আর ঠিক তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠল। পর্দায় সুকুমারদার নাম। সোয়াইপ করতেই ও প্রান্তে সুকুমারদার গলা, ‘এই নে। মামি তোর সঙ্গে কথা বলবে। মাথা খারাপ করে দিচ্ছে সকাল থেকে। মামির সঙ্গে কথা বলার পর লাইনটা যেন ছেড়ে দিস না। আমি কথা বলব।’
মা কথা বলবে! শুনে বিশ্বাসই করতে পারল না দেব। চণ্ডীতলায় পিকনিক করে আসার পর থেকে ও অনেকবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। আজ মা যেচে কথা বলতে চাইছে, আনন্দে দেবের চোখে জল চলে এল। ও প্রান্তে মায়ের গলা, ‘কেমন আছিস খোকা?’
‘আমি ঠিক আছি মা। তুমি?’
‘কেন, আমার তো কিছু হয়নি? আমি শুনলুম, নাড়ুটা না কি তোর কাছে গিয়ে আলতু ফালতু কথা বলে এসেছিল। হারামজাদাটাকে একদম বিশ্বাস করিস না।’
‘রাঙাদার কাছে সব শুনেছি মা। পাপের শাস্তি ও পেয়েছে। এখানে ওর চাকরি চলে গেছে।’
‘তাই দেখছি, কিছুদিন ধরে ঘরে বসে আছে। মাঝে একদিন আমার পায়ে এসে পড়েছিল। সুকুমার ঘাড় ধরে ওকে বিদেয় করে দিয়েছে। যাক সে কথা। তোর কম্পিটিশন কবে রে? কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে গেছিলি?
‘হ্যাঁ মা। পুজো দিয়ে এসেছি। তুমি আমায় আশীর্বাদ করো, যেন ব্যাঙ্কক থেকে জিতে আসতে পারি।’
‘আমার খুব ইচ্ছে ছিল, কলকাতায় যাই। কিন্তু পায়ের ব্যথার জন্য প্রদীপ্ত আমাকে যেতে দিল না। হ্যাঁ রে খোকা, তুই কবে যাবি?’
‘আজ রাতে মা। তুমি দেখো, আমি জিতে ফিরবই। তুমি সঙ্গে থাকলে কেউ আমাকে হারাতে পারবে না।’
‘শোন বাবা, যেজন্য তোকে ফোনটা করলুম, সেটা বলি। কাল চণ্ডীতলার কালী মন্দিরে তোর জন্য পুজো দিতে গেসলুম। ওখানে ভটচার্যি মশাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। তোর ছক দেখে উনি বললেন, খুব শিগগির তোর একটা বিরাট ফাঁড়া আছে। খোকা, আগুন থেকে দূরে থাকিস। বারবার উনি এ কথা বললেন। ভটচার্যি মশাইয়ের কথা শুনে আমার ভালো লাগল না বাবা। উনি যা বলেন তা মিলে যায়। উনি সাবধান করে দিলেন, তোর জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে। তোকে একটা তাবিজ দেবেন বলছিলেন। কিন্তু কে নিয়ে যাবে?’
দেব জোর দিয়ে বলল, ‘ও সব বুজরুকিতে বিশ্বাস কোরো না মা। কপালের লিখন কেউ বদলাতে পারে না। শোনো মা, ভটচার্যি মশাই বলেছিলেন, আমার বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। আজ পর্যন্ত হয়েছে, বলো? সব কথা মেলে না কি গণৎকারদের? মনটাকে দুর্বল কোরো না।’
‘ব্যাঙ্কক থেকে কবে ফিরবি তুই?’
‘দিনসাতেক পর। ভাবছি, ব্যাঙ্কক থেকে ফিরে আর চাকরিবাকরি কিছু করব না। চণ্ডীতলায় গিয়ে থাকব। বাবা যা রেখে গেছে, আমাদের মায়ে-পোয়ের তাতে চলে যাবে। তেমন হলে চণ্ডীতলায় একটা জিম খুলে বসব। তুমি খুশি তো মা?’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেমে মা জিজ্ঞেস করল, ‘মিলি কেমন আছে রে?’
মিলি মানে মিলেনা। মা প্রতিবার কোয়েলের কথা জানতে চায়। কিন্তু এবার মিলেনার কথা কেন জানতে চাইল, দেবের বোধগম্য হল না। বোধহয় রাঙাদা মাকে বুঝিয়েছে। ও বলল, ‘ভাল আছে। কেন মা?’
‘ওকে আর একবার আমার কাছে নিয়ে আসিস বাবা। মেয়েটা বোধহয় আমাকে ভুল বুঝেছে। আসলে সেদিন তোর জেঠিমা-খুড়িমা মিলে আমাকে ঠুসছিল যে, আমি মাথা ঠান্ডা রাখতে পারিনি।’
‘মিলেনা তোমাকে ভুল বোঝেনি মা। ব্যাঙ্কক থেকে ফিরে আমি ওকে চণ্ডীতলায় নিয়ে যাবো। এ বার ফোনটা তুমি রাঙাদাদাকে দাও। আমাকে কী যেন বলতে চায়।’
মা ওদিকে ফোনটা বোধহয় সুকুমারদাকে দিচ্ছে। মুখ তুলে তাকাতেই দেব দেখল, ওর সামনে দুর্বার চৌধুরী দাঁড়িয়ে। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে এমন ব্যস্ত ছিল যে, দুর্বার কখন ফ্লুরিজে ঢুকেছে, ও টেরও পায়নি। ওর সঙ্গে আরও দু’তিনজন রয়েছে। তারা কাছেই একটা টেবলে বসে। দুর্বারের দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা দেখে দেবের ভাল লাগল না। লোকজন নিয়ে এসে ঝামেলা পাকাতে এসেছে না কি? সুকুমারদাকে ফিসফিস করে ও বলল, ‘তোমাকে একটু পরে ফোন করছি রাঙাদা। ফাঁকা থেকো।’
লাইন কেটে দিয়ে ও জিজ্ঞেস করল, ‘দুর্বার, তুমি কি কিছু বলবে?’
তমাল বলল, ‘ব্যাঙ্ককে যাচ্ছ, যাও। তুমি কিন্তু জিততে পারবে না।’
দেব বলল, ‘জানি। তোমার বাবা তো কালই পৌঁছে গেছেন ব্যাঙ্ককে।’
এই উত্তরটা বোধহয় আশা করেনি। শুনে রক্ত চলকে উঠল দুর্বারের মুখে। তবুও বলল, ‘তোমাকে বাঁশ দেওয়ার কাজটাও সম্ভবত উনি করে রেখেছেন। কেন শুধু শুধু মুখ পোড়াতে যাচ্ছ? ফিরে এসে তুমি সিলভার জিম-এও কিন্তু আর ঢুকতে পারবে না।’
‘বোসো দুর্বার, খবরটা তুমি তা হলে পাওনি। তোমার বাবা… মানে যাকে আমরা চোর কমলদা, বলি, তিনি কিন্তু এবার মি. এশিয়া কম্পিটিশনের জাজ হতে পারছেন না। এশিয়ার আটটা দেশের কর্তা ওর এগেনস্টে চিঠি দিয়েছেন। কম্পিটিশনে ওড়িশার সুবোধ মহাপাত্র বলে ওর একজন ট্রেনি পার্টিসিপেট করছে। কমলদা পার্সিয়ালটি করতে পারেন, এই আশঙ্কায় জাজেস প্যানেল থেকে ওঁর নাম শেষ মুহূর্তে বাদ চলে গেছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে, তুমি এখান থেকেই ওঁকে ফোন করতে পারো।’
‘চোর কমলদা’ কথাটা শুনে দুর্বার হঠাৎ কেমন যেন দমে গেল বলে মনে হল দেবের। সুযোগটা ও ছাড়ল না। দেব আরও বলল, ‘দুঃখের কথা কি জানো, অর্গানাইজাররা ওকে হোটেলে থেকেও বের করে দিয়েছেন। খবরটা পেয়ে সুবোধ মহাপাত্রের বাবা ভুবনেশ্বর পুলিশের কাছে এফআইআর করেছেন। কমলদা না কি তাঁর কাছ থেকে দু’লাখ টাকা নিয়েছিলেন, সুবোধকে মি. এশিয়া করে দেবেন বলে। ফিরে আসার পর তোমার বাবার কী হবে, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।’
‘তুমি… তুমি মিথ্যে কথা বলছ।’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল দুর্বার।
দেবও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ? দাঁড়াও, বাকি কথাগুলোও তা হলে শুনে যাও। চেন্নাই পুলিশ তোমাকে কেন অ্যারেস্ট করেছিল, সিলভার জিম-এর অনেকেই সেটা জেনে গেছে। কাচের ঘরে বসে অন্যকে ঢিল মারার ইচ্ছেটা তোমার হল কেন দুর্বার? লালবাজার কিন্তু নজর রাখছে তোমার উপর। এমন একটা দিন যেন না আসে কমলদা আর তুমি একই সঙ্গে জেলের ঘানি টানছ।’
দুর্বারের ফর্সা মুখটা একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে দিকে তাকিয়ে আর অপেক্ষা করল না দেব। ফ্লুরিজ থেকেও বেরিয়ে এল।
(আটচল্লিশ)
বেলা ন’টার সময় অবন্তিকাদের বাড়িতে যাবে বলে বেরচ্ছে কোয়েল। এমন সময় কেউ একজন দরজায় কড়া নাড়ল। রাস্তার দিকে দরজা অল্প ফাঁক করে ও দেখল, বেশ লম্বাচওড়া এক সাধু দাঁড়িয়ে আছেন। মুখ দাঁড়ি-গোঁফে ভর্তি। মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা। গলায় দু’তিনটে রুদ্রাক্ষের মালা। গায়ের রং ফেটে পড়ছে। পরনে লাল রঙের হাফহাতা শার্ট ও ধুতি। হাতে কমণ্ডলু। বছর তিনেক আগে মাকে নিয়ে কোয়েল একবার হরিদ্বারে বেড়াতে গেছিল। তখন গঙ্গার ধারে এই ধরনের সাধুদের ও দেখেছে।
মায়ের কাছে বছরে একবার করে এই ধরনের সাধু আসতেন। কিন্তু সেটা গঙ্গাসাগর মেলার সময়। তাঁর নামটাও কোয়েলের মনে আছে, হাওয়া মহারাজ। হাওয়া অর্থাৎ বাতাস ছাড়া না কি তিনি কিছুই খেতেন না। মাকে আশীর্বাদ করে উনি চলে যেতেন। সেই হাওয়া মহারাজই এলেন না কি? পরক্ষণেই কোয়েলের মনে হল, গঙ্গাসাগর মেলার তো এখনও পাঁচ মাস বাকি। উনি হতে পারেন না। তা হলে ইনি কে? সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে, হাতজোড় করে ও জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কাকে চান, বাবাজি?’
কোয়েল বলতে যাচ্ছিল, ‘যাকে চান, তিনি মাসখানেক হল মারা গেছেন।’ কিন্তু মুখ ফুটে বলার আগেই বাবাজি বললেন, ‘জানি বেটি। কিন্তু আমি তোর কাছেই এসেছি। তোকে একটা সন্দেশ দেওয়ার আছে।’
কোয়েল বলল, ‘দয়া করে ভিতরে আসুন।’
‘আমার হাতে সময় নেই রে বেটি। আমাকে আরও কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে। শোন, আজ বেলা বারোটার সময় তুই স্টিফেন ম্যানসনে যাবি। তোকে আমার খুব দরকার।’
স্টিফেন ম্যানসন! তা হলে কি মিসেস ভাল্লার সুবুদ্ধি হল? টাকা দেওয়ার জন্য খবর পাঠিয়েছেন? কিন্তু উনি ফোন করলেও তো পারতেন। বাড়িতে লোক পাঠানোর কোনও দরকার ছিল না। হয়তো লজ্জায় ফোনটা করতে পারেননি। মিসেস ভাল্লা পাঠিয়েছেন ধরে নিয়েই কোয়েল বলল, ‘নিশ্চয়ই যাবো। কিন্তু আমাকে আপনার কী দরকার? মিসেস ভাল্লার ওখানে তো আপনাকে কোনওদিন দেখিনি।’
সন্ন্যাসী হেসে বললেন, ‘বেটি দেখবি কী করে? আমি দেখা দিলে তো দেখবি। আমি অনেক অনেক দূরে থাকি। তুই খুব কষ্টের মধ্যে আছিস। সেটা জানি বলেই তোর কাছে এলাম। তোর সব দুঃখ-কষ্ট আজ দূর হয়ে যাবে।’
কোয়েল বলল, ‘আশীর্বাদ করুন বাবাজি, তাই যেন হয়।’
আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে বাবাজি আর দাঁড়ালেন না। দক্ষিণ দিকে হেঁটে গেলেন। জানালা-দরজা বন্ধ করার আগে রান্নাঘর থেকে ধারালো বড় ছুরিটা হ্যান্ডব্যাগে ভরে নিল কোয়েল। মিসেস ভাল্লাকে বিশ্বাস নেই। কী মতলবে, খবর পাঠিয়েছেন, কে জানে? মিসেস ভাল্লার কাছ থেকে ও প্রায় দশ হাজার টাকার মতো পাবে। কাল তমাল অবশ্য বলেছিল, ‘টাকাটার কথা ভুলে যাও। জেদাজেদি কোরো না। ওই বিল্ডিংয়ে তোমার যাওয়ার দরকার নেই। কপালে থাকলে জীবনে অনেক টাকা রোজগার করতে পারবে।’ তমালের কথায়, পাওনা আদায়ের কথা মন থেকে মুছে ফেলেছিল কোয়েল। কিন্তু মিসেস ভাল্লা নিজে লোক পাঠিয়ে ডাকছেন। এই সুযোগটা ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়। তমালকে পরে জানালেও চলবে।
দরজা বন্ধ করে ঠিক বেরনোর মুখে কোয়েল টের পেল, ওর ফোনটা বাজছে। ইসস, ফোনটা ঘরের ভিতর রেখেই ও বেরিয়ে যাচ্ছিল। ফের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে, সেট হাতে নিয়ে ও দেখল, অনিরুদ্ধর ফোন। সোয়াইপ করতেই ও প্রান্ত থেকে অনি জিজ্ঞেস করল, ‘ম্যাডামদি আপনি কোথায়? বাড়িতে?’
অন্যদিন গুড মর্নিং বলে ও কথা শুরু করে না। আজ বোধহয় ভুলে গেছে। কোয়েল বলল, ‘এই বাড়ি থেকে বেরচ্ছিলাম। তুমি?’
‘জিম-এ এসেছিলাম। দেখি বন্ধ। সবরতওয়ালাটা বিচ্ছিরি খবর দিল। জিম না কি বন্ধ হয়ে গেল।’
শুনে কোয়েল চুপ করে রইল। কাল বিকেলের ওই ঘটনাটার পর আনন্দী শরাফ জিম বন্ধ করে দেবেন, ও ভাবতেই পারেনি। সমস্ত দোষ এখন ওর উপরে চাপানোর চেষ্টা করবেন। মরুক গে যাক। জিম নিয়ে ওর আর কোনও ইন্টাররেস্ট নেই। কোয়েল জিজ্ঞেস করল, ‘দেবদার সঙ্গে কি তোমার দেখা হয়েছে ভাই?’
অনি বলল, ‘না। সরবতওয়ালাটা বলল, দেবদাও না কি জানত না, জিম-এ তালা পড়ে গেছে। ফোনে দেবদাকে ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বারবারই এনগেজড পাচ্ছি। আমরা কয়েকজন এখন জিম-এর সামনে দাঁড়িয়ে। এখুনি দুর্বারকে দেখলাম। ফ্লুরিজ থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে ও কারোর বাইকে উঠে বসল।’
‘তুমি কি অফিসে ফিরে যাচ্ছ ভাই?’
‘আমার ডিউটি ছিল রাত আটটা থেকে। কিন্তু রাতে দেবদাকে সী অফ করতে এয়ারপোর্ট যাবো বলে ডিউটি বদলে বেলা একটায় করে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, জিম থেকে সোজা চলে যাবো দমকল অফিসে। কিন্তু তা আর হল না। ভাবছি, পাণ্ডেজির সঙ্গে আমরা দেখা করে যাবো কি না? তোমার প্রোগ্রাম কী, ম্যাডামদি?’
‘এখন অবন্তিকাদের বাড়িতে যাবো। তারপর বেলা বারোটা সময় স্টিফেন ম্যানসনে।’
‘মিসেস ভাল্লার বাড়িতে না কি? একা যেও না ম্যাডামদি। খতরনাক মহিলা।’
‘ভয় দেখিও না ভাই। আমি ভয়ে ভয়ে আর বাঁচতে চাই না। দেখি, নিজেকে প্রোটেক্ট করতে পারি কি না?’
ফোনের লাইন কেটে দিয়ে ফের দরজার দিকে পা বাড়ানোর সময় কোয়েলের চোখে পড়ল, বারান্দা দিয়ে জেঠিমা দ্রুত পায়ে এদিকে আসছেন। দূর থেকে জেঠিমা বললেন, ‘কোয়েল, একটু দাঁড়া।’
এ দিয়ে তিনবার বাড়ি থেকে বেরনোর মুখে বাধা পড়ল। জেঠিমার হাতে কাচের প্লেট। তাতে কয়েকটা মিষ্টি। কাছে এসে জেঠিমা বললেন, ‘তোকে তো বাড়িতে পাওয়া যায় না। কখন বেরোস, কখন ঢুকিস জানতেও পারি না। তুইও বাড়ির কোনও খোঁজ রাখিস না। শোন মা, তিতলি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কাল ওর শউরবাড়ির লোকেরা এসে ওকে আশীর্বাদ করে গেল। তোর জন্য মিষ্টি রেখে দিয়েছি।’
জেঠতুতো বোন তিতলি ওর থেকে চার বছরের ছোট। তার বিয়ে শুনে খুব খুশি হল কোয়েল। মুশকিল হল, মিষ্টি ও খায় না। কিন্তু এক টুকরো না খেলে মানেটা অন্যরকম হয়ে দাঁড়াবে। হিংসে করছে। প্লেট থেকে সন্দেশ তুলে নিয়ে ও মুখে দিল। সঙ্গে সঙ্গে জেঠিমা বলল, ‘কই, জিজ্ঞেস করলি না তো, বর কী করে?’
কোয়েল বলল, ‘জিজ্ঞেস করে কী হবে জেঠিমা। তোমরা দেখেশুনে দিচ্ছ। নিশ্চয়ই ভাল হবে।’
‘বর আমেরিকায় চাগরি করে। বিয়ের পর তিতলিকেও নিয়ে যাবে। শউরবাড়ি অবশ্য রানাঘাটে।’
জেঠিমার আহ্লাদি মুখটা দেখে কোয়েলের একবার মনে হল, জিজ্ঞেস করে, এ কি সেই ছেলেটা, পার্ক সার্কাস ময়দানে সন্ধেবেলায়, যার সঙ্গে প্রায়ই তিতলিকে বসে থাকতে দেখত? না, সে হবে না। রানাঘাট থেকে কেউ তিতলির সঙ্গে প্রেম করতে আসবে না। অপ্রিয় কথাটা ওর মুখ দিয়ে বেরল না। ও চুপ করে দরজায় তালা লাগাতে লাগল। সেটা দেখে জেঠিমা অন্য প্রসঙ্গ তুললেন, ‘হ্যাঁরে, তোর কাছে যে ছোঁড়াটা আসে, সেদিন লোকজন নিযে এসে কী মাপজোক করছিল রে?’
‘বাড়ির আমার এই অংশটায় একটা রেস্টুরেন্ট করব জেঠিমা। সেজন্য মিস্তিরি লাগাব খুব শিগগির। তিতলির বিয়েটা কোনও বাড়ি ভাড়া করে দিও।’
‘সে কি কথা? না, না, এখানে রেস্টুরেন্ট করতে দেবো না। গেরস্থ বাড়ির ভিতরে রেস্টুরেন্ট! হতে পারে না কি? বাড়ির সবাই মিলে আমরা কিন্তু অবজেকশন দেবো।’
‘পারলে আটকিও।’ কথাটা বলে কোয়েল আর দাঁড়াল না। রাস্তায় নেমে এল।
অবন্তিকাদের বাড়িতে পৌঁছতে ওর বেলা দশটা বেজে গেল। রমেশ মিত্র রোডে তিনতলা বাড়ি। দেখেই মনে হয়, খুব বনেদি পরিবার। এই প্রথম পরিচয় হল অবন্তিকার বাবার সঙ্গে। ভদ্রলোক একটা সময় হাইকোর্টের নামকরা অ্যাডভোকেট ছিলেন। বয়স হয়ে গেছে বলে এখন আর প্র্যাকটিস করেন না। উনি বারবার বলতে লাগলেন, বাড়ির নীচের তলায় যোগা সেন্টার হলে, যতটা সম্ভব হেল্প করবেন। অবন্তিকার মা এত ভাল মনের মানুষ, জোর করে কোয়েলকে লাঞ্চ খাইয়ে দিলেন। ভবানীপুর থেকে কোয়েল যখন স্টিফেন ম্যানসনে পৌঁছল, তখন প্রায় বারোটা বাজে।
দু’নম্বর লিফটে করে ও পাঁচতলায় উঠে এল। এই সময়ে ও কোনওদিন স্টিফেন ম্যানসনে আসেনি। দোতলার পর থেকে একেবারে নিঝুম। কোনও মানুষের চিহ্ন নেই। লিফটে ওঠার সময়ই কোয়েল পোড়া পোড়া গন্ধ পেল। প্রথম দিন এ বাড়িতে আসার সময় এই কটু গন্ধটাই পেয়েছিল। লিফট থেকে বেরিয়ে মিসেস ভাল্লার ফ্ল্যাটের ডোর বেল বাজানোর আগে হ্যান্ডব্যাগে ছুরিটা ও দেখে দিল। বলা যায় না, দরকারও হতে পারে। কোয়েল ঠিকই করে নিল, খুব বেশিক্ষণ ও বসবে না। কোনও বাকবিতণ্ডায় যাবে না। টাকাটা নিয়েই ও বেরিয়ে আসবে। তারপর উল্টো দিকে মিলেনাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে ঢুকবে।
দরজাটা যিনি খুলে দিলেন, তাকে দেখে কোয়েল একটু চমকে উঠল। সুরজিত ভাল্লা! পরনে স্লিপিং শ্যুট। বোধহয় দুপুরে রেস্ট নিচ্ছিলেন। হাসিমুখে উনি বললেন, ‘আও আও বেটি। এই সময়ে?’
দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই কোয়েল জিজ্ঞেস করল, ‘মিসেস ভাল্লা নেই?’
‘আছেন। ওর একজন ক্লায়েন্ট এসেছেন। ভিতরে বসে তার সঙ্গে কথা বলছেন।’
সুরজিত ভাল্লার চাউনিটা দেখে কোয়েলের ভাল লাগল না। কিন্তু কথাটা ও পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারল না। এর আগেও ট্যারো কার্ড ক্লায়েন্টদের জন্য কোয়েলকে কোনও কোনওদিন ওয়েট করতে হয়েছে।
ও বলল, ‘ঠিক আছে। আমি তা হলে আধ ঘণ্টা পর ঘুরে আসছি।’
সুরজিৎ ভাল্লা বললেন, ‘না দাঁড়াও, তা হলে আমি ওকে জিজ্ঞেস করে আসি।’
কথাটা বলে ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকে গেলেন। তখনই কোয়েলের চোখে পড়ল, ড্রয়িং রুমের দরজার সামনে নিকি ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ও হাত নাড়তেই পর্দার আড়ালে মেয়েটা অদৃশ্য হয়ে গেল। কোনওদিন এ রকমটা হয় না। ও এ ফ্ল্যাটে এলে নিকি দৌড়ে চলে আসে চকোলেট নেওয়ার জন্য। হঠাৎ কোয়েলের মনে হল, তাড়াহুড়োয় আজ নিকির জন্য চকোলেট আনা হয়নি। ইসস, আর কোনওদিন এই ফ্ল্যাটে ও আসবে না। মেয়েটার সঙ্গেও আর কোনওদিন দেখা হবে না। চকোলেটটা আজ আনা উচিত ছিল। নীচে গিয়ে কিনে আনবে কি না যখন কোয়েল ভাবছে, তখনই ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সুরজিত ভাল্লা বললেন, ‘তুমি কত টাকা পাবে বেটি। উনি আমাকে দিয়ে দিতে বললেন। আসলে মিসেস ভাল্লা তোমার উপর একটু রেগে রয়েছেন।’
মনে মনে কোয়েল বলল, বয়ে গেল। কিন্তু মুখে বলল, ‘দশ হাজার টাকা।’
ব্যস, এই ক’টাকা?’ গলায় মধু ঢেলে সুরজিত ভাল্লা বললেন, ‘তুমি ভিতরে এসে বোসো বেটি। আমি টাকাটা নিয়ে আসছি। কিন্তু উনি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না কেন? তুমি ওর পা ঠিক করে দিলে। ওর তো গ্রেটফুল থাকার কথা।’
শুনে কোয়েল ঘরের ভিতর ঢুকে সোফায় বসল। ভদ্রলোক যেচে কথা বাড়াচ্ছেন। মিসেস ভাল্লাকে নিয়ে আলোচনা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর নেই। এমন একজন মহিলা, যিনি কারোর ভাল দেখতে পারেন না।
কোয়েল বলল, ‘জানি না। উনি আমায় আসতে বলেছিলেন। তাই এলাম।’
‘মিসেস ভাল্লার উপর রাগ কোরো না বেটি। উনি বরাবরই একটু মেন্টাল। এই মহিলাকে নিয়ে আমি সারাটা জীবন ভুগেছি। ভাবো, আমাকে কত নুইসেন্স ফেস করতে হয়েছে। সি ইজ আ বিচ। ওর জন্য আমার খুব বদনাম হয়ে গেছে। তুমিও খারাপ ইম্প্রেশন নিয়ে যাও, আমি সেটা চাই না। প্লিজ, দু’তিন মিনিট বোসো। আমি এখুনি আসছি।’ কথাগুলো বলে উনি ফের ভিতরে ঢুকে গেলেন।
ফের দরজায় পর্দার আড়ালে নিকিকে কোয়েল দেখতে পেল। ও কি কিছু বলার চেষ্টা করছে? হঠাৎ নিকি একটা কাগজের পুঁটলি ছুড়ে মারল। মেঝে থেকে পুঁটলিটা দ্রুত তুলে নিয়ে কোয়েল দেখল, তাতে লেখা, ‘গো অ্যাওয়ে আন্টি। ডোন্ট স্টে আ সেকেন্ড।’ চমকে উঠে কোয়েল দরজার দিকে তাকাতেই দেখল, নিকি সরে গেছে।
হাসিমুখে পের লিভিংরুমে উদয় হলেন সুরজিত ভাল্লা। হাতে ট্রে, তার উপর একটা গ্লাসে কোল্ড ড্রিঙ্কস। ট্রে সেন্টার টেবিলে নামিয়ে, পকেট থেকে কয়েকটা নোট বের করে উনি বললেন, ‘গুনে নাও বেটি। কোনও ইল ফিলিং রেখো না। পারলে মিসেস ভাল্লাকে ক্ষমা করে দিও।’
পাঁচটা দু’হাজার টাকার গোলাপি নোট। হ্যান্ড ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে কোয়েল বলল, ‘থ্যাঙ্কস’।
ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ও উঠে দাঁড়াতেই সুরজিত ভাল্লা অনুরোধের সুরে বললেন, ‘যাচ্ছ কোথায়? কোল্ড ড্রিঙ্কসটা তো খেয়ে যাও। আরে, আমার সঙ্গে তো তোমার কিছু হয়নি। ঠিক আছে, মিসেস ভাল্লার হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গ্লাস খালি করে কোয়েল উঠে দাঁড়াল। তখনই ওর মাথাটা টলে উঠল। ধপ করে ও সোফায় বসে পড়ল। কোল্ড ড্রিঙ্কসের সঙ্গে সুরজিত ভাল্লা কিছু মিশিয়ে দিয়েছেন না কি? সিনেমায় প্রায়ই এই ধরনের প্লট দেখা যায়। নায়িকাদের রেপ করার আগে ভিলেন চা, কফি বা সরবতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিচ্ছে। সুরজিত ভাল্লাও সেই চেষ্টা করলেন না কি? সেটা কী করে সম্ভব? ভিতরের ঘরে মিসেস ভাল্লা ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁর উপস্থিতিতেই একজন হাসবেন্ড কী করে একটা মেয়েকে ধর্ষণ করতে পারেন? চোখ বুজে আসছে। তবুও কোয়েল আবছা দেখতে পেল, সুরজিত ভাল্লা সদর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন। হঠাৎ ও টের পেল, ওর জিনসের প্যান্ট নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। একটা জানোয়ার যেন ওর শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
… জ্ঞান ফিরে আসতেই কোয়েল শুনতে পেল, নিকি ওকে ডাকছে, ‘গেট আপ আন্টি, গেট আপ।’ বাচ্চা মেয়েটা সোফায় বসে ওর চোখ-মুখে জল ছেটাচ্ছে। চোখ খুলে ও দেখতে পেল, সোফায় শুয়ে আছে। শরীরের নীচের দিকটায় মারাত্মক ব্যথা। চট করে ওর মনে পড়ল, ও স্টিফেন ম্যানসনে মিসেস ভাল্লার ফ্ল্যাটে এসেছিল। উঠে বসার চেষ্টা করতেই কোয়েল যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল। তলপেটে ব্যথার জায়গায় চটচটে পদার্থ। হাত দিতেও ও বুঝতে পারল, গোপনাঙ্গ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সুরজিত ভাল্লা তা হলে ওর যা সর্বনাশ করার, করে দিয়েছেন। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে প্রথমেই ওর তমালের কথা মনে পড়ল। এই মুখ তমালকে ও দেখাবে কী করে?
(উনপঞ্চাশ)
স্টিফেন ম্যানসন ছেড়ে কোথাও চলে যেতে হবে। কিন্তু কোথায় গিয়ে উঠবে, সারারাত ভেবেও মিলেনা ঠিক করতে পারল না। এই শহরে ওর ঘনিষ্ঠ লোকের সংখ্যা খুব কম। চোখের সামনে একেকটা চেহারা ভেসে উঠেছে। ডরোথি আন্টি, স্কুলের টিচার শান্তা আন্টি, অ্যানা-অনিল, ডিম্পল-অমল, দেবদূত, তমাল, কোয়েল। এমনকী, শ্রীকৃষ্ণাচৈতন্য টেম্পলের আচার্য্যদেবও। নানাদিক ভেবে ও প্রত্যেককে বাতিল করে দিয়েছে। বড় প্রশ্ন, স্টিফেন ম্যানসন ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণটা কী বলবে? ও যে গ্রেগারিয়ান পরিবারের কেউ না এবং সেটা এতদিন পরে জানতে পেরেছে, সেই কথাটা মিলেনা বলবে কি করে?
সারারাত ও দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। নিয়োগী আন্টি বলেছিলেন, কোনও সমস্যায় পড়লে ঠাকুরের সামনে বসে প্রার্থনা কোরো। আন্টির কথামতো, মিলেনা লিভিং রুমে গিয়ে একটা সময় রাধা-কৃষ্ণার আইডলের সামনে বসেছিল। মনে মনে বলেছিল, পথ দেখাও। কিন্তু পথ খুঁজে পায়নি। রাতে ও ভেবেছিল, ড্যাডি অন্তত ফোনে একবার ওর সঙ্গে কথা বলবেন। উনি ফোন করেননি। তার মানে প্রচণ্ড রেগে রয়েছেন। এমনও হতে পারে, আচমকা চলে এসে জোর করে ওকে ইরেভেনে নিয়ে যেতে পারেন। ইভেতাও যে কেন ফোন করল না, ভেবে মিলেনা অবাক। মেয়েটা মন খুলে কথা বলে। গোঁড়ামির অনেক ঊর্ধ্বে। দাদা যে ওর জন্য কাউকে পছন্দ করে রেখেছে, সেটা ইভেতা অনেক আগেই জানত। তবুও, কেন বলেনি?
এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই মিলেনা ভোরের দিকে কার্পেটের উপর গা ছেড়ে দিয়েছিল। চোখ খুলে শুনতে পেল নাজমা প্রশ্ন করছে, ‘এ কী দিদি, তুমি সারারাত এখানেই শুনে ছিলে না কি? তোমার কী হয়েছে?
মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘ক’টা বাজে এখন?’
‘প্রায় সাড়ে ন’টা। শোনো, নীচের তলার লম্বু লোকটা এসেছে। তোমার সাথে কথা বলবে।’
লম্বু লোকটা মানে… নিয়োগী আন্টির ছেলে দেবাশিস। শুনে একটু অবাকই হল মিলেনা। অ্যানুয়াল মিটিংয়ের দিনই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ। ডেফিনিটলি বিল্ডিংয়ের কোনও ব্যাপার উনি দেখা করতে চান। কিন্তু চোখ-মুখের যা অবস্থা, তাতে ওঁর সামনে যাওয়া যাবে না। মিলেনা বলল, ‘আঙ্কলটাকে বসতে বল। ওঁর জন্য কফি করে দে। আমি চট করে চোখ-মুখে জল দিয়ে যাচ্ছি।’
মিনিট পাঁচেক পরে ড্রয়িং রুমে ঢুকে মিলেনা বলল, ‘আয়্যাম সরি মি. নিয়োগী। দেরি হয়ে গেল।’
দেবাশিস উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ডাজন্ট ম্যাটার, আমিই হঠাৎ চলে এসেছি। টাইগ্রান নেই?’
আচমকা প্রশ্নটার জন্য মিলেনা প্রস্তুত ছিল না। ও বলল, ‘না। উনি কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গেছেন।’
‘আসলে মা আজ দুপুরেই নর্থ বেঙ্গলে চলে যাচ্ছেন। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে ভাবলাম, স্টিফেন ম্যানসন নিয়ে দু’একটা কথা আপনাদের জানিয়ে যাই।’
নাজমা কফির কাপ নিয়ে এল। কফিতে চুমুক দিয়ে মিলেনা বলল, ‘কী ডিসিশন নিলেন আপনারা?’
কফিতে চুমুক দিয়ে দেবাশিস বললেন, ‘বিল্ডিংয়ে অনেক প্রবলেম, মিটিংয়ে সেদিন সব শুনেছেন নিশ্চয়ই। টপ প্রায়োরিটি হল, বিল্ডিংটাকে সেফ রাখা। রোজ রাতে যে সব আনওয়ান্টেড লোক ঢুকে ছাদে শুয়ে থাকে, তাদের আটকানো। সেজন্য ছাদের বারোটা দরজায় আমরা তালা লাগিয়ে দিলাম। চাবি কেয়ারটেকার সিংজির কাছে থাকবে। কারোর দরকার হলে, সে ফোন করে চাবি চেয়ে নেবে সিংজির কাছ থেকে।’
কাজটা ভাল হয়েছে না মন্দ, সে সম্পর্কে আন্দাজ পাওয়ার জন্য দেবাশিস ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। বিল্ডিংয়ের ভাল-মন্দ নিয়ে এখন আর মিলেনার কিছু যায়-আসে না। তবুও ও বলল, ‘ঠিকই করেছেন। রেসিডেন্টদের তো ছাদে ওঠার দরকার হয় না। জলের ট্যাঙ্কে কোনও প্রবলেম হলে প্লাম্বাররাই উঠে সারিয়ে দেয়। আমি মাত্র একবারই ছাদে গেছিলাম।’
দেবাশিস বললেন, ‘আগে কিন্তু এমন ছিল না মিস মিলেনা। ছাদে প্রায়ই রাতে পার্টি হত। দশ-বারো বছর আগেও আমরা ওয়েট করে থাকতাম কে কবে পার্টি দেবে। ক্রিসমাস ইভ, নিউ ইয়ার্স ইভ, রিপাবলিক ডে, হোলি, কারও বার্থ ডে বা ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি… সব অনুষ্ঠানে আমরা ছাদে গিয়ে হইহুল্লোড় করতাম। যাক গে, আরও যে ইমপরট্যান্ট কথাটা বলার জন্য এলাম, সেটা হল লিফটগুলোর মেরামতির ব্যবস্থা। ইমিডিয়েলি না করলে কিন্তু কোনওদিন একটা বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।’
দেবাশিস ঠিকই বলছেন, কিন্তু ওর মনের যা অবস্থা, তাতে বিল্ডিং নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছে নেই। মিলেনা বলল, ‘গ্র্যান্ডপা ফিরে আসুন। ওর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।’
‘না মিস মিলেনা, এরিকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আপনাদের এই ফ্ল্যাটটা ওঁর নামে। আপনি এরিকের কন্টাক্ট নাম্বার বা মেল অ্যাড্রেসটা দিন। ওঁর সঙ্গে আমি কথা বলব।’
ড্যাডির ফোন নাম্বার আর মেল অ্যাড্রেস নিয়ে দেবাশিস উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন ‘মায়ের ফ্লাইট বিকেল চারটেয়। বেলা দেড়টার সময় উনি বেরিয়ে যাবেন। আপনাকে বলে গেলাম। লিফটে করে ওঠা-নামার সময় আমাদের ফ্ল্যাটটার দিকে একটু নজর রাখবেন।’
দেবাশিস বেরিয়ে যাওয়ার পর সোফায় গিয়ে বসতেই, মিলেনার মনে ফিরে এল মাম্মির বলা কথাগুলো।
‘আমি তোমাকে পেটে ধরিনি’। আমি তোমার আসল মা নই।’ কথাটা কি গ্র্যান্ডপাও তা হলে জানতেন? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মিলেনা তিন বছর পিছিয়ে গেল। বরাবর মাম্মির মুখে গ্র্যান্ডপার নিন্দে ও শুনে এসেছে। লোকটা অমানুষ। কাজের মেয়েদেরও ছাড়ত না। নিজের বউকে মেরে ফেলেছিল। তাই কলকাতায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। এখানেও লিভ ইন করত এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলার সঙ্গে। মাম্মির কথাবার্তায় তখন ঘৃণা ফুটে বেরত। কলকাতায় এসে তাই কোনওদিন গ্র্যান্ডপার কাছে স্বচ্ছন্দ হতে পারেনি মিলেনা। এখন তো দেখছে, মানুষটা সম্পর্কে ওকে বোঝানো হয়েছিল। আর যাই করুক, গ্র্যান্ডপা শেষপর্যন্ত মার্থাকে স্ত্রী মর্যাদা দিয়েছেন। নিজের সন্তানকে পিতৃপরিচয়। এর থেকে বড় কথা আার কী হতে নারে?
মিলেনার মনে পড়ল, কলকাতায় এসে প্রথমদিকে গ্র্যান্ডপার ঘরে একটা ফ্যামিলি অ্যালবাম দেখেছিল। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে তোলা গোটা পঞ্চাশ ছবি ছিল তাতে। সম্ভবত কোনও একদিন আলমারি থেকে বের করে গ্র্যান্ডপা তা দেখছিলেন। আলমারিতে তুলে রাখতে ভুলে গেছিলেন। কৌতূহলে সেই অ্যালবাম যখন মিলেনা দেখছিল, তখন গ্র্যান্ডপা এসে সেটা কেড়ে নেন। খুব রেগে গেছিলেন সেদিন। এমনও বলেছিলেন, ‘আর কোনওদিন যেন না দেখি, এই অ্যালবামে তুমি হাত দিয়েছ।’ মিলেনা সত্যিই সেদিন অবাক হয়ে গেছিল, অ্যালবামটা তো ওদের পরিবারের। আত্মীয়স্বজনের ছবি দেখতে চেয়ে ও কী এমন অন্যায় করেছে? গ্র্যান্ডপা কি সেদিন কিছু লুকোতে চেয়েছিলেন ওর কাছে? হয়তো জানতে দিতে চাননি, ও গ্রেগারিয়ান পরিবারের কেউ না। জানতে পারলে ও দুঃখ পাবে বলে। অশীতিপর মানুষটার জন্য এই প্রথম মন খারাপ হল মিলেনার। এই প্রথম মনে হল, মানুষটা খিটখিটে ছিল বটে, কিন্তু ওর খারাপ চায়নি কোনওদিন। দ্রুত উঠে ও গ্র্যান্ডপার ঘরে গিয়ে ঢুকল। আলমারিটা খুলল অ্যালবাম খোঁজার জন্য। ছবিগুলোর মাঝে যদি ওর আসল মায়ের কোনও হদিশ পায়। কিন্তু গ্র্যান্ডপার ঘরে কোত্থাও খুঁজে পেল না অ্যালবামটা। ওর স্পষ্ট মনে আছে, অ্যালবামের উপরে এক কোণে লেখা ছিল, বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ড। ছবি তোলার কোম্পানির নাম। অদ্ভুত সেই লেটারিং। প্রথম ছবিটাই ছিল জোনাথন গ্রেগারিয়ানের। আর্মেনিয়ান বেশে। যতদূর মনে পড়ে, অ্যালবামের শেষের দিকে ড্যাডি আর মাম্মির প্রচুর ছবি ও দেখেছে। প্রায় সবগুলোই দার্জিলিংয়ে তোলা।
ওদের ফ্ল্যাটে পাঁচটা বিরাট ঘর। তার মধ্যে সবথেকে সাজানো গোছানো আর বড় ঘরটা ড্যাডির। সারা বছর তালা দেওয়া থাকে। ড্যাডি কলকাতায় এলে তখন খোলা হয়। সেই ঘরে কি কোনও অ্যালবাম রাখা আছে? ঘরটা শেষ খোলা হয়েছিল বছর দেড়েক আগে। সেই ঘরের আলমারি খুলে মিলেনা যখন খোঁজাখুজি করছে, সেই সময় নাজমা এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি খুঁজছ গো দিদি? আমি তো আছি। আমায় বলো না, তোমার কী চাই?’
মিলেনা বলল, ‘একটা অ্যালবাম। তোর কি মনে আছে, গ্র্যান্ডপা মাঝে মাঝে দেখত?’
‘জানি তো কোথায় আছে। এই ঘরের তক্তপোশের নীচে, সুটকেশের ভেতর। তোমার বাবা রেখেছিল।’
‘শিগগির বের কর তো।’
উবু হয়ে খাটের তলা থেকে সুটকেশটা বের করে আনল নাজমা। তার ভিতর থেকে দু’টো অ্যালবাম। তখনই ডোর বেলের পাখির ডাকটা ভেসে এল। শুনে নাজমা বলল, ‘ওই বোধহয় তোমার বর এল।’ বলেই ও দৌড়ে গেল সদর দরজার দিকে। কিন্তু একটু পরে ফিরে এসে বলল, ‘না গো দিদি। ড্রাইভার সমীর। ফোন করে তুমি না কি আসতে বলেছ? কোথায় যাবে তুমি?’
কোথায় যাবে, মিলেনা নিজেও জানে না। একটা রাত্তিরের ব্যবধানেই ও বুঝে গেছে, এই ফ্ল্যাটে থাকার অধিকার ওর নেই। কাল রাতে রাধা-কৃষ্ণার আইডলের সামনে বসে থাকার সময় ও দুটো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এক, দেবদূতকে সব বলে ওর পরামর্শ নিতে হবে। দুই, সম্ভব হলে ওর আসল মাকে খুঁজে বের করতে হবে। জানতে হবে, সত্যিই মোটর দুর্ঘটনায় ওর মা মারা গেছিলেন কি না? মাম্মির কথা শুনে কেন জানে না, মিলেনার মনে হয়েছে, ওর আসল মাকে ড্যাডি কোথাও সরিয়ে দিয়েছিলেন। দাম্পত্য সম্পর্কটা অটুট রাখার জন্য। এই ফ্ল্যাট থেকে একবার বেরিয়ে গেলে মিলেনা জানতেও পারবে না, ওর আসল মা বেঁচে আছেন কি না। ড্যাডির ঘরে পাওয়া অ্যালবাম দুটো সেই রহস্যের পর্দা খুলতেও পারে। শ্রীকৃষ্ণার কাছে ও প্রার্থনা করল, আসল মায়ের একটা ছবি অন্তত যেন পায়।
নিজের ঘরে এসে অ্যালবাম খোলার সময়ই ফোন বাজতে শুরু করল। পর্দায় ড্যাডির ছবি। দেখেই মনটাকে মিলেনা শক্ত করে নিল। সোয়াইপ করতেই ও প্রান্ত থেকে ড্যাডি শুরু করলেন, ‘তুমি আমাকে এতটা কষ্ট দেবে, আমি ভাবতেও পারিনি ডিয়ার।’
মিলেনা বলল, ‘তুমি যদি মাম্মির মতো কোনও রিকোয়েস্ট করো, তা হলে আমি লাইন কেটে দেবো।’
‘আমার উপর এত রেগে রয়েছ কেন মিলেনা? শান্তভাবে আমরা তো কথা বলতেই পারি। তাই না?’
‘যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। এই ফ্ল্যাট ছেড়ে আমি আর একটু পরেই চলে যাবো।’
‘দেবাশিস একটু আগে আমাকে ফোন করেছিলেন। উনি বলছিলেন, বিল্ডিংটা না কি খুব আনসেফ হয়ে গেছে? আমিই তোমাকে ওই ফ্ল্যাটে থাকতে বারণ করছি মা। স্টিফেন ম্যানসনের ফ্ল্যাট আমি টাইগ্রান আঙ্কলের নামে লিখে দিচ্ছি। আশা করি, তোমার কোনও আপত্তি নেই।’
এমন নরম গলায় ড্যাডি কথাগুলো বললেন, মিলেনার চোখে হঠাৎ জল চলে এল। সেই আগের ড্যাডির মতো। তবুও জিদ ধরে ও বলল, ‘আপনার প্রোপার্টি আপনি যাকে ইচ্ছে দেবেন। আমার আপত্তিতে কী আসে যায় ড্যাডি?’
‘এই যে ড্যাডি নামে ডাকলে, শুনে আমার মনটা আনন্দে ভরে গেল। কথাটা মনে হচ্ছে, প্রত্যেক ড্যাডিরই একটা কর্তব্য থাকে, তার সন্তানের প্রতি। প্রত্যেক ড্যাডি বা মাম্মি চায়, তার সন্তান ভালো থাকুক। আমার রক্ত তোমার শরীরে বইছে ডিয়ার। ড্যাডি হিসেবে আমাকেও কিছু কর্তব্য পালন করতে হবে। আমাকে বলো, তুমি কোথায় গিয়ে থাকবে? যে বেঙ্গলি ছেলেটাকে তুমি ভালবাসো, তুমি কি সেই দেবদূতের বাড়িতে গিয়ে উঠবে? তোমার সঙ্গে কি তার বিয়ে হয়ে গেছে? মন খুলে আমার সঙ্গে কথা বলো ডিয়ার, তোমার তাতে ভালই হবে।’
‘না, বিয়ে হয়নি। দেবদূত বডিবিল্ডিং কম্পিটিশনের জন্য ব্যাঙ্কক যাচ্ছে। ও ফিরে এলে আমরা ডিসিশন নেবো। আপনি কি আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন?’
‘না মিলেনা, দেবদূত সম্পর্কে যা খবর নেওয়ার, আমি তোমার ডরোথি আর শান্তা আন্টির কাছে নিয়ে ফেলেছি। এও শুনেছি, দেবদূত একদিন রাস্তায় তোমাকে হেনস্থার হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিল। ওকে না কি তুমি ভরসা করতে পারো। এমনিতেই বেঙ্গলিদের সম্পর্কে আমার প্রচুর শ্রদ্ধা। আমার গ্রেট গ্র্যান্ডপার সঙ্গে এমন এক বেঙ্গলির পরিচয় ছিল, যিনি ইন্ডিয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্স মুভমেন্টের সময় বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলেন। তুমি কি তাঁর নাম শুনছ? নেতাজি বোস। তাঁর নাম দেবদূতের কাছে কোরো। সে চিনতে পারবে। উনি অনেকবার স্টিফেন ম্যানসনে গেছেন।’
কালিম্পংয়ের স্কুলে তেইশে জানুয়ারি নেতাজি বোসের জন্মদিন পালন করত ওরা। তাঁর সঙ্গে গ্রেগারিয়ান পরিবারের সম্পর্ক ছিল! মিলেনার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘আপনি তো কখনও আমাকে বলেননি?’
‘আমার গ্রেড গ্র্যান্ডপার সঙ্গে নেতাজি বোসের ছবিও আছে দুটো। আমার বেডরুমের তলায় একটা পুরনো সুটকেশের ভিতর কয়েকটা অ্যালবাম আছে। তার ভিতর তুমি সেই ছবি পাবে। যাক সে কথা। তুমি আমাকে খুব মুশকিলে ফেলে দিয়েছ ডিয়ার। দেবদূত সম্পর্কে যা শুনলাম, তাতে আমার মনে হয়েছে, আর্থিক দিক থেকে খুব স্ট্রং নয়। খুব সামান্য চাকরি করে। শুনলাম, ছেলেটি খুব অনেস্ট, হিউম্যান বিয়িং হিসেবে চমৎকার।’
ড্যাডির কথাগুলো মাম্মির মতো কড়া শোনাচ্ছে না। উনি ডরোথি আন্টির সঙ্গে কথা বলেছেন, চার্চের সূত্রে ওকে জানেন বলে। কিন্তু মিলেনা বুঝতে পারল না, শান্তা আন্টিকে ড্যাডি চিনলেন কি করে? হয়তো ডরোথি আন্টির জন্য কোথাও আলাপ হয়েছিল। ড্যাডি দেবদূতের প্রসঙ্গ তোলায় মিলেনা সুযোগটা ছাড়ল না। বলল, ‘দেবদূত ছাড়া আমি আর কাউকে লাইফ পার্টনার হিসেবে ভাবতে পারছি না। আপনি যদি মাম্মির মতো কোনও রিকোয়েস্ট করেন, তা হলে জেনে রাখুন, আমার উত্তর হবে, না।’
শুনে ও প্রান্তে ড্যাডি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘দার্জিলিংয়ে প্রচুর বেঙ্গলি ফ্যামিলির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। তখন দেখেছি, ওদের হাসবেন্ড-ওয়াইফের মধ্যে বন্ডিংটা খুব মজবুত হয়। আমারও মনে হয়, দেবদূতের সঙ্গে তুমি সুখে থাকবে। ফাইনাল কিছু বলার আগে, তোমার কাছে একটা জিনিস জানতে চাই। আমাদের পরিবার সম্পর্কে ওর কি কোনও ধারণা আছে?’
মিলেনা বলল, ‘ও কিছুই জানে না। কোনওদিন জানতেও চায়নি। আপনি যদি আপনার ধনসম্পত্তির কথা ভেবে প্রশ্নটা করে থাকেন, তা হলে বলব, দেবদূতের কোনও ইন্টারেস্ট নেই। আমিও আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি, আপনার কাছ থেকে আমি কিছু প্রত্যাশা করি না। ফোনটা রাখি তা হলে?’
‘ওয়েট, ওয়েট ডিয়ার। আমার কাছ থেকে তুমি কিছু না চাইলেও ড্যাডি হিসেবে, আমি তোমাকে কিছু দায়িত্ব দিতে চাই। স্টিফেন ম্যানসনের পাশেই যে হোটেলটা আাছে… সিলভার হোটেল, তার খানিকটা মালিকানা আমার। দার্জিলিংয়ে আমার এভারেস্ট হোটেল পুড়ে যাওয়ার পর আমার মন চায়নি হোটেল বিজনেস থেকে সরে আসতে। তাই সিলভার হোটেলের থার্টি পার্সেন্ট শেয়ার আমি কিনে রেখেছিলাম। কাউকে তা বলিওনি। রিসেন্টলি কয়েকজন শেয়ার হোল্ডার আমার কাছে কমপ্লেন করেছেন, ম্যানেজিং ডিরেক্টর আনন্দী শরাফ না কি হোটেলের বদনাম করে দিচ্ছেন?
বাধা দিয়ে মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে এ সব বলার অর্থ কী ড্যাডি?’
‘পুরোটা শোনো, তা হলেই বুঝতে পারবে। আনন্দী শরাফের হাসবেন্ড বিরাট শরাফের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। দেখলাম, স্ত্রীর উপর উনিও খুব বিরক্ত। উনি বলে দিয়েছেন, ওঁর পঁচিশ পার্সেন্ট শেয়ার আমার কাছে বিক্রি করে দেবেন। সেই ব্যাপারেই কথা বলার জন্য আমার কলকাতায় যাওয়ার কথা ছিল। হোটেল আর জিমন্যাসিয়ামটা তা হলে আমার দখলে চলে আসবে। এত কথা তোমাকে জানানোর পিছনে আমার একটাই উদ্দেশ্য, তুমি সিলভার হোটেলের দায়িত্ব নেবে। দিল্লিতে তোমাকে ম্যানেজমেন্ট পড়তে আমি পাঠিয়েছিলাম এই একটাই কারণে। বলো, তুমি রাজি কি না? সিলভার হোটেলেই তুমি থাকবে। স্টিফেন ম্যানসনের ফ্ল্যাট তুমি গ্র্যান্ডপাকে ছেড়ে দিও।’
প্রস্তাবটা শুনে মিলেনা হতভম্ব হয়ে গেল। ড্যাডি ওকে এত ভালবাসেন? কী উত্তর দেবে, ও বুঝতে পারল না।