(চল্লিশ)
বাকরাহাটের কাছে সামালি বলে একটা জায়গায় এসেছেন শিখিন। বছর পনেরো আগে পাঁচ বিঘে জমি তিনি কিনে রেখেছিলেন এখানে। বিডন স্ট্রিটের ফ্ল্যাট বিক্রির টাকায়। খুব অল্প দামে তখন পেয়ে যান। সেই জমিতে তিনি একটা এনজিও খোলার কথা ভেবে রেখেছিলেন আগুনে সর্বহারা মানুষদের জন্য। জমিতে গোটা কুড়ি নারকেল, গোটা দশেক করে আম, জাম আর খেজুর গাছ আছে। প্লাস প্রচুর কলাগাছ। ভাগ্যিস, তখন ইটের পাঁচিল তুলে দিয়েছিলেন শিখিন। তাই গাছগুলো এখনও অক্ষত। জমিটার দেখাশুনা করে ইদ্রিস আলি বলে একজন। শামালির কাছেই রসপুঞ্জে এক কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে একবার আগুন নেভাতে এসেছিলেন শিখিন। সেইসময় ইদ্রিসের সঙ্গে আলাপ। বেচারির বাড়ি-ঘর সব পুড়ে যাওয়ায় রাস্তা এসে দাঁড়িয়েছিল। শিখিন তখন ওকে সামালির জমিতে থাকার জায়গা দেন। জমির কেয়ারটেকার হিসেবে রেখেছেন।
সিদ্ধান্তটা নিয়ে তখন শিখিন ভুল করেননি। মুসলমান প্রধান এলাকা। ইদ্রিসকে গ্রামের মানুষ খুব মানে। তাই গাছের ফল লুঠ হয়ে যায় না। তা’ছাড়া দমকলের খাকি পোশাকে বেশ কয়েকবার দেখেছে বলে, গ্রামের লোক মনে করে, তিনি পুলিশ। এতদিন কেউ উপদ্রব করেনি। জোকায় মেট্রো রেলের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে ইদ্রিসের কাছে প্রোমোটারদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। এই অঞ্চলে জমির দাম ইদানীং হু হু করে বাড়ছে। শিখিনের জমি মেট্রো রেলের স্টেশন থেকে দশ মিনিটের পথ। ইদ্রিস প্রায়ই ফোন করছিল, ‘ছ্যার, হপ্তায় একবার করে আবনি আসেন। না হলি জমি রাখা মুশকিল হইয়ে যাবে।’
রবিবার ছুটির দিন। সেই কারণেই শিখিন সামালিতে এসেছেন ইদ্রিসের কাছে সব শুনতে। বছর দুয়েক আগে জমির দক্ষিণদিকে পুকুরের পাশে দু’কামরার একটা গেস্ট হাউসের মতো করেছেন। সেখানে সারাদিনটা কাটিয়ে সন্ধেবেলায় কোয়ার্টার্সে ফিরে যান। বেশি দূর তো নয়, ঘণ্টা দেড়েকের রাস্তা। সামালিতে আসার আরও একটা আকর্ষণ, ইদ্রিসের বউয়ের হাতে তৈরি বিরিয়ানি। আসার আগের দিন ফরিদা জেনে নেয়, কী রান্না করতে হবে। ইদ্রিস পুকুর থেকে মাছ তুলে রাখে। গাছ থেকে ডাব পেড়ে খাওয়ায়। ফলের সিজনে ফেরার সময় গাড়ির ডিকিতে ফলের ঝুড়ি তুলে দেয়। সেই আম-জাম পরদিন শিখিন খাওয়ান অনিরুদ্ধ আর শিশিরদের। ওদের নিয়ে একবার তিনি পিকনিকও করতে এসেছিলেন।
আজ সকাল ন’টা শিখিন যখন সামালিতে আসেন, তখন ঝকঝকে রোদ। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আকাশ একেবারে কালো। যে কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে। বইমেলা থেকে এবার রাজশেখর বসুর ‘মহাভারত’ কিনেছিলেন শিখিন। ফের নতুন করে পড়বেন বলে। কাল রাতে সুভদ্রহরণ পর্ব শেষ করেছেন। বইটা তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন সামালিতে। যাতে সারাদিনে আরও কয়েকটা অধ্যায় এগিয়ে যেতে পারেন। ঘরের ভিতর আলো জ্বালিয়ে, ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে শিখিন পরের পর্বটা পড়তে শুরু করেছেন। এমন সময় ইদ্রিস ঘরে ঢুকে বলল, ‘রস এহনও মুখে দ্যান নাই ছ্যার। গেইজে গেছে না কি?’
আসার পরই কাচের গ্লাসে খেজুর রস দিয়ে গেছিল ইদ্রিস। শিখিন ভুলেই গেছিলেন খেতে। যেমনকার তেমন পড়েই আছে। সকালের দিকে রসের যে স্বাদ পাওয়া যায়, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা পাওয়া যায় না। তাই শিখিন বললেন, ‘রসের গ্লাসটা তুমি নিয়ে যাও ইদ্রিস। ছেলে-মেয়েদের দিয়ে দিও।’
গ্লাসটা হাতে নিয়ে ইদ্রিস বলল, ‘ফরিদা জিজ্ঞেস করছেল, কিছু ন্যাকস কইরে দিবে? খেতি খেতি তো আবনের বেলা দেড়ডা হইয়ে যাবে।’
ন্যাকস মানে স্ন্যাকস। মনে মনে হেসে শিখিন বললেন, ‘না কিচ্ছু করতে হবে না। ঠাকুরপুকুরের মোড়ে একটা দোকানে পুরী-ভাজি খেয়ে এসেছি। এখন খিদে নেই। লাঞ্চের জন্য ফরিদা কী রান্না করছে?’
‘সরু চালের ভাত, মুগের ডাইল আর কচি পাঁঠার ঝোল।’
‘ব্যস, ব্যস, ওতেই হবে।’ বলে শিখিন মহাভারতের পৃষ্ঠায় চোখ দিলেন। দিন দুই আগে ফোনে একবার ইদ্রিস বলেছিল, কালু মিঞা বলে এক দালাল সামালিতে খুব ঘোরাঘুরি করছে। কলকাতার কোনও এক প্রোমোটার এই অঞ্চলে বড় হাউসিং কমপ্লেক্স বানাতে চায়। কালু তার হয়ে খুব অ্যাকটিভ। শিখিন জানেন, কলকাতার আশপাশে জমি মাফিয়ারা এখন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আগুন নেভাতে গিয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন। কোনটা মাফিয়াদের কাজ, কোনটা নিছক দুর্ঘটনা। জমি ফাঁকা করে নেওয়ার চক্রান্ত। লাঞ্চের মেন্যু জানিয়ে দেওয়ার পরও ইদ্রিস কিছু বলবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। মহাভারতে মন পড়ে আছে। শিখিনের ইচ্ছে করছে না, দালালদের সম্পর্কে অভিযোগ শোনার। তবুও তিনি বললেন, ‘কিছু বলবে ইদ্রিস?’
‘ছ্যার, দুকান থেইকে কিছু আনতি হলি এখনই কয়ে দ্যান। ঝড় উঠবি বলে মনে হচ্ছে।’
একটা শ্যাম্পুর প্যাকেট কিনে আনালে ভাল হত। তবুও, কী ভেবে শিখিনের মনে হল, থাক দরকার নেই। ঘাড় নেড়ে সে কথা জানিয়ে দেওয়ার পরই ফের বাধা। মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। সেট তুলে নিয়ে তিনি দেখলেন পর্দায় রাখীর নাম। সোয়াইপ করতেইও প্রান্ত থেকে রাখী বলল, ‘তুমি এখন কোথায় শিখিন?’
রাখীর গলায় উদ্বেগের ছাপ। সেটা লক্ষ্য করে শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি সামালি বলে একটা জায়গায়। কলকাতার বাইরে।’
‘আগুন নেভাতে গেছ না কি? পারলে একবার আসবে স্টিফেন ম্যানসনে?’
‘কেন, স্টিফেন ম্যানসনে কী হয়েছে?’
‘মিস্টার ধিংড়ার লোকজন আমাদের আফিস ভাঙচুর করেছে কাল রাতে।’
দিন কয়েক আগে সিলভার জিম-এ এসে রাখী দেখা করেছিল। তখন বলেছিল, ধিংড়া বলে একজন রেসিডেন্ট স্টিফেন ম্যানসন থেকে ওদের কল সেন্টারটা তুলে দিতে চান। ভদ্রলোক না কি খুব ইনফ্লুয়েসিয়াল। ফার্স্ট ফ্লোর থেকে রাখীদের অফিস তুলে দিতে পারলে, পুরো তলাটা উনি কবজা করে নিতে পারবেন। তা হলে একটা গেস্ট হাউস চালু করতে ওঁর সুবিধে হবে। কল সেন্টারের মালিক থাকেন দুবাইয়ে। বিরাট ব্যবসা করেন সেখানে। কলকাতায় কল সেন্টার উঠে গেলেও তাঁর কিছু আসে যায় না। মুশকিলে পড়েছে, রাখীর মতো তিরিশ-পঁয়ত্রিশ জন কর্মী। তাদের পেটে হাত পড়ে যাবে। সব শুনে শিখিন পরামর্শ দিয়েছিলেন, পার্ক স্ট্রিট থানায় গিয়ে কমপ্লেন করতে। কেননা, এ ক্ষেত্রে দমকলের কিছু করার নেই। শিখিন ভেবে রেখেছেন, ধিংড়া যখন গেস্ট হাউসের জন্য ফায়ার লাইসেন্স নিতে আসবেন, তখন ওঁকে টাইট দেবেন।
কল সেন্টার ভাঙচুর করেছে। তার মানে ধিংড়া ডেসপারেট হয়ে গেছে। কাজটা আঁটঘাট বেঁধেই করেছে। শিখিন করলেন, ‘ধিংড়ার লোকজনই যে দুষ্কর্মটা করেছে, তার কোনও আই উইটনেস আছে?’
রাখী বলল, ‘কাকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে, জানি। রুস্তম বলে এক মাস্তান আছে এর পিছনে। তুমি থানায় যেতে বলেছিলে। ওরা এফআইআর নিতে চায়নি। কার কাছে যাবো আমরা বুঝতে পারছি না। তুমি একটু হেল্প করবে, প্লিজ?’
ধিংড়ার মতো বদমাস লোকদের শায়েস্তা করার ওষুধ মিডিয়া। চট করে যা মাথায় এল, বলে ফেললেন শিখিন, ‘ঈশিতাকে বলো, ওদের কাগজে কালই যেন এই ঘটনাটা নিয়ে একটা রিপোর্ট বের করে। রিপোর্টে যেন ধিংড়াকে জড়ায়। আমি শুনেছি, স্টিফেন ম্যানসনের অন্য রেসিডেন্টরা ওঁকে পছন্দ করেন না। ঈশিতাকে বোলো, ওই বাড়িতে মিস্টার নিয়োগী বলে একজন আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বললে, তিনি সব উগড়ে দেবেন। আমি যতদূর জানি, ধিংড়ার দুটো ফ্ল্যাট আছে ফিফথ ফ্লোরে। স্টিফেন ম্যানসনের ফিফথ থেকে সেভেন্থ ফ্লোর বেআইনিভাবে তোলা। ঈশিতা জানে। কাগজে খবরটা বেরোলে দেখবে, থানা এফআইআর নিতে বাধ্য হবে।’
‘ঠিক আছে, ঈশিতাকে বলে দেখি। আমরা এমপ্লয়িরা মিলে ঠিক করেছি, ধিংড়াকে অফিস দখল করতে দেবো না। আজ থেকেই পালা করে আমরা পাহারা দেবো। ধিংড়া যতই গুন্ডা লেলিয়ে দিক, আমরা শেষ দেখে ছাড়ব। কলকাতায় ফিরে এলে তুমি স্টিফেন ম্যানসনে এসো। রাতে আমি এখানে থেকে যাবো।’
কড়াৎ করে বাজ পড়ার শব্দ হল। জানলা দিয়ে শিখিন দেখলেন, দক্ষিণে একটা নারকেল গাছের মাথায় আগুন ধরে গেছে। তার মানে বাজটা গাছেই পড়েছে। এলোমেলো বাতাস বইছে। নারকেল গাছটা এমন দুলছে যেন মনে হচ্ছে, জ্বলুনি সহ্য করতে পারছে না। আকাশে গাঢ় কালো রঙের মেঘের মাঝে ক্রমাগত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাজ পড়ার শব্দ বোধহয় ফোনে শুনতে পেয়েছে রাখী। ও প্রান্ত থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে না কি?’
ওর কথা ভাল শোনা যাচ্ছে না। শিখিন বললেন, ‘মনে হচ্ছে শুরু হবে। তোমাকে যা বললাম, করো। দুপুরের দিকে আমি ফোন করে জেনে নেবো, কী হল?’
ফোনের লাইন কেটে দিয়ে শিখিন বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। বাতাসে গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। আক্রোশ দেখানোর মতো শোনাচ্ছে। গ্রামের ভিতরের দিক থেকে হাহাকারের আওয়াজ শুনতে পেলেন শিখিন। খড়, টালি দিয়ে ছাওয়া সব বাড়ি। বোধহয় ঝড়ের মাতলামিতে ছাদ উড়ে যাচ্ছে। ইদ্রিস বলত বটে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় মারাত্মক ঝড়বৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রকৃতির এই রোষ আগে কখনও দেখেননি শিখিন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় তিনি দেখতে পেলেন, আকাশ ফালাফালা করে দেওয়া বিদ্যুতের অসংখ্যা হিজিবিজি। পাঁচিলের ও পাশে বিস্তীর্ণ খেতি জমি ঝাপসা হয়ে গেছে। ঠাকুরপুকুরের দিক থেকে বৃষ্টি সামালিকে গ্রাস করতে আসছে। উঠোনে তাঁর গাড়ির ছাদে বরফের টুকরো এসে পড়ল। তার মানে শিলাবৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। এই সময়টায় রাখী যদি এখানে থাকত, তা হলে নির্ঘাত ওকে টেনে নামাতেন উঠোনে। ভাল করে বৃষ্টি দেখার জন্য ইজিচেয়ারটা দরজার কাছে সরিয়ে আনলেন শিখিন।
বিডন স্ট্রিটে রেখাদের তিনমহলা বাড়ির ছাদে একবার এই রকম বৃষ্টির সময় রাখীকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। মনে আছে, সেটা তাঁর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর আগের দিন বিকেলে। একমাস আগে থেকে মা খবরদারি শুরু করেছিল। অমুকের পক্স হয়েছে, ওই বাড়ির ছায়া মাড়াবি না। বেশি রোদ্দুরে ঘুরবি না। হেদুয়ায় যেতে হবে না। জলে নামলে যদি জ্বর হয়, তা হলে পরীক্ষাটাই বরবাদ হয়ে যাবে। মাকে অনেক বলে ক’য়ে সেদিন শিখিন রেখাদের বাড়ি গেছিলেন ক্যারাম খেলতে। বাণীব্রত আর রাখীও হাজির সেখানে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হল। রেখা বলল, ‘বাড়িতে বড়রা কেউ নেই। হাতিবাগানে অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা দেখতে গেছে। চল, আমরা বৃষ্টিতে ভিজি।’ মায়ের ভয়ে শিখিন কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বাকি তিনজন কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে নাচানাচি শুরু করেছিল।
রাখী তখন ক্লাস নাইনে। শরীরে সদ্য যৌবন। ভিজে ফ্রকের মধ্যে থেকে ওর স্তন দুটো চোখ টানছিল শিখিনের। রাখী এসে হাত ধরে টানায় নিজেকে সামলাতে পারেননি তিনি। মায়ের নিষেধবাণীও মনে পড়েনি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তিনি রাখীর বুকের মাঝে মুখ গুঁজে দিয়েছিলেন। তখনই রাখীর মুখে শিৎকার ধ্বনি শুনতে পান, ‘আহহ।’ সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল ওর। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল। বৃষ্টির মধ্যেই রাখীর মুখটা দু’হাতে ধরে চুমু খেয়েছিলেন শিখিন। বাধা তো দেয়ইনি, উল্টে চোখ বুঁজে ঠোঁট দুটো আরও ফাঁক করে দিয়েছিল ও। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, কয়েক সেকেন্ড পর ধাক্কা মেরে রাখী বলেছিল, ‘এ কী করলে বাচ্চুদা? আমাকে এঁটো করে দিলে?’ ওই ঘটনার একমাত্র সাক্ষী ছিল বাণীব্রত।
রাগ করে রাখী তখন ভিজে অবস্থাতেই নিজেদের বাড়িতে চলে গেছিল। চুমুর কথা বাণীব্রত বলে দিয়েছিল রেখাকে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিনটা ভাল কাটেনি। বাংলা পরীক্ষা দিতে বসেও শিখিনের বারবার মনে পড়েছিল রাখীর ক্রুদ্ধ মুখটা। ওর প্রশ্নটাও, ‘আমাকে এঁটো করে দিলে?’ কী ছেলেমানুষই না ছিলেন ওঁরা তখন! পরীক্ষার বাকি দিনগুলোতে লজ্জায় রেখা বা রাখীর সামনেই যেতে পারেননি তিনি। একদিন পরীক্ষার হল থেকে ফেরার পথে বোকার মতো তিনি বাণীব্রতকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এঁটো করে দেওয়া মানে কী রে?’ বাণীব্রত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিল, ‘ওই কথাটা নিয়ে এখনও ভাবছিস না কি? কী গাধা রে তুই? বেশ করেছিস রাখীকে চুমু খেয়েছিস। আমি তো সুযোগ পেলেই রেখাকে চুমু খাই। মেয়েরা প্রথম প্রথম এঁটো হওয়ার কথা বলে। তারপর দেখবি, নিজেরাই চুমু দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে।’
সেই বছরই গরমের ছুটিতে দু’সপ্তাহের জন্য রাখীরা দার্জিলিংয়ে বেড়াতে যাচ্ছিল। শুনে বুকের ভিতরটা শূন্য শূন্য লাগছিল শিখিনের। তখনও ওয়াটারপোলো সিজন শুরু হয়নি। পড়াশুনোর পাট নেই। রেখার হাত দিয়ে তিনটে চিঠি পাঠিয়েছিলেন রাখীর কাছে। তাতে তলার দিকে বড় বড় লেখা ‘সরি’। একটারও উত্তর তিনি পাননি। একেবারে পাগল পাগল অবস্থা। হেদুয়ায় কামিনী গাছের নীচে গিয়ে বসে থাকতেন। একদিন রেখাদের বাড়িতে গেছেন। সেখানে রাখীর সঙ্গে দেখা। মধ্যস্ততা করেছিল রেখাই। মান-অভিমানের পালা শেষ। রেখা বলেছিল, ‘বাচ্চুদা, তুমি দিব্যি দাও, বিয়ে করলে রাখীকেই করবে। অন্য কাউকে না। ওর যা ক্ষতি হয়ে গেছে, এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।’ মনে পড়লে এখনও হাসি পায় শিখিনের। রেখা যা বলেছিল, তিনি করেছিলেন। দিব্যি দিয়েছিলেন।
রাখীকে নিয়ে ভাবনার আর সুযোগই পেলেন না শিখিন। ওই ঝড়জলের মাঝেই তিনি লক্ষ্য করলেন, গেটের দক্ষিণপূর্ব দিক থেকে মোষের পিঠে সওয়ার হয়ে কেউ আসছে। শুধু বিদ্যুতের আলোয় তাকে দেখা যাচ্ছে। মানুষটার গায়ের রং উজ্জ্বল হলুদ। একবারে আগুনের মতো। পরনে টকটকে লাল রঙিন ধুতি। শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গে শুধু লাল উত্তরীয়। সর্বাঙ্গে সোনার অলঙ্কার। শুশ্রমণ্ডিত মুখ, মাথায় বাদামি রঙের বিশাল জটা। মাথার পিছনে আগুনের লেলিহান শিখা। তাঁর চারটে হাত। এক হাতে কুঠার, অন্য হাতে জপমালা। তৃতীয় হাতে কী বুরুশ জাতীয় কিছু। বারান্দার কাছে আসতেই শিখিন বুঝতে পারলেন, মোষ নয়, মানুষটা বিরাট একটা ছাগলের পিঠ থেকে নেমে আসছেন। অবাক কাণ্ড, ঝোড়ো বাতাস আর প্রবল বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে আসা সত্ত্বেও মানুষটার শরীরে এক ফোঁটা জলের চিহ্ন নেই।
বাজ পড়ার শব্দকে ছাপিয়ে, গ্রামের কোথাও থেকে কাসর ঘণ্টার আওয়াজ ভেসে এল। উচ্চস্বরে কেউ মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। যজ্ঞস্থলে চন্দন কাঠে কেউ ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন বোধহয়। তারই সুগন্ধ পেলেন শিখিন। ওই দুর্যোগের মাঝে এমন একজন অদ্ভুতদর্শন মানুষ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে! তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না। অলৌকিক গল্পে এমনটা হয়। রোমাঞ্চিত হয়ে ইজিচেয়ার থেকে শিখিন উঠে দাঁড়ালেন। হাতজোড় বললেন, ‘কে আপনি?’
স্মিত হেসে মানুষটা মেঘ ডাকা গলায় বললেন, ‘আমাকে চিনতে পারছিস না? রোজ কিন্তু তুই আমার পুজো করিস। তোর ভাবশিষ্য অনিরুদ্ধ যে আমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে রে। আমি অগ্নিদেব।’
(একচল্লিশ)
লকার খুলে নিজের জিনিসপত্তর কিট ব্যাগের মধ্যে ভরে নিল কোয়েল। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা ও নিয়েই ফেলেছে। আর কখনও সিলভার জিম-এ ঢুকবে না। দ্রুত লকার রুমের বাইরে বেরিয়ে এসে কোয়েল একবার ফ্লোরের দিকে তাকাল। মিসেস শীলা মোতওয়ানিকে শলভাসন শেখাচ্ছে বিদিশা। দেখেই চোখের কোণ ভিজে উঠল ওর। গত তিনটে বছর প্রায় সারাটা দিন ও কাটিয়েছে এই জিম-এ। কত আশা আর উৎসাহ নিয়ে ট্রেনারের কাজটা শুরু করেছিল সেদিন। আজ মুখ নীচু করে ওকে চলে যেতে হচ্ছে। ও ঠিক করেছে, লকারের চাবিটা দেবদার হাতে দিয়ে ও চলে যাবে। আর কাউকে কিছু বলবে না।
দেবদার চেম্বারের দিকে তাকিয়ে কোয়েল দেখল, ফাঁকা। পরশু রাতেই দেবদার ব্যাঙ্কক যাওয়ার কথা। হয়তো কোথাও ব্যস্ত আছে। কী করবে যখন দাঁড়িয়ে ভাবছে, তখন ও দেখল, গেট দিয়ে মিসেস ভাল্লার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পাণ্ডেজি জিম-এর ভিতরে ঢুকে আসছেন। মিসেস ভাল্লাকে দেখেই ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কিট ব্যাগটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে ও বলল, ‘পাণ্ডেজি, এই নিন লকারের চাবি। কাল থেকে আমি আর আসছি না।’
চাবিটা হাতে নিয়ে পাণ্ডেজি অবাক হয়ে বললেন, ‘আসছেন না মানে! চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন না কি?’
‘হ্যাঁ। ভবানীপুরে যোগা সেন্টার খুলছি। এখানে আর সময় দিতে পারব না।’
‘রেজিগনেশন লেটার কাকে দিয়েছেন?
‘আনন্দী শরাফকে মেল করে দিয়েছি।’ ইচ্ছে করেই কোয়েল ম্যাম কথাটা ব্যবহার করল না।
মিসেস ভাল্লা ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘বাঃ বাঃ যোগা সেন্টার খুলছ? ইনভেস্টার কে? আনন্দী শরাফ জানে?’
পাত্তা না দিয়ে কোয়েল কিট ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। তারপর এক পা এগোতেই শুনল, মিসেস ভাল্লা পাণ্ডেজিকে ধমকাচ্ছেন, ‘ওকে এমনি চলে যেতে দিচ্ছেন কেন পাণ্ডেজি? ব্যাগটা একবার চেক করে দেখুন। জিম-এর কিছু নিয়ে যাচ্ছে কি না? এই সব থার্ড ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েদের বিশ্বাস নেই। আপনাদের বলিনি, আমার বাড়ি থেকেও এই মেয়েটা মোবাইল ফোন সরিয়েছে।’
ব্যায়াম করার ফাঁকে ফ্লোরের অনেকেই এ দিকে তাকিয়ে। কোয়েলের ইচ্ছে হল, ঠাস করে একটা চড় মারে। তবুও, নিজেকে ও সামলে নিল। এতদিন সুনামের সঙ্গে ট্রেনিং দিয়েছে। জিম-এর মেল-ফিমেল সব মেম্বারই ওকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে। ছেড়ে যাওয়ার দিন ও এমন কিছু করবে না, যাতে পারে কেউ নিন্দে করতে পারে। কিট ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে কোয়েল বলল, ‘খুলে দেখে নিন পাণ্ডেজি। কিছু নিয়ে যাচ্ছি কি না?’
পিছন থেকে কে যেন ব্যাগটা টেনে ধরে চিৎকার করে বলল, ‘না ম্যাডামদি, ব্যাগ চেক করতে আমরা দেবো না। আমাদের সামনে কেউ তোমাকে ইনসাল্ট করবে, সেটা হতে দেওয়া যায় না।’
জিম-এ একমাত্র অনিরুদ্ধই ওকে ম্যাডামদি বলে ডাকে। ব্যাগটা অনিরুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে। এইমাত্র বোধহয় ছেলেটা জিম-এ ঢুকল। ওর চিৎকার শুনে ধীরে ধীরে অনেক মেম্বারই পাণ্ডেজি আর মিসেস ভাল্লার চারপাশে জড়ো হয়েছেন। মিসেস মোতওয়ানিও জোন এইট থেকে চলে এসেছেন। উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে মিস কোয়েল, আপনি চলে যাচ্ছেন কেন?’
মিসেস মোতয়ানিকে আসরে নামতে দেখে পাণ্ডেজি ঘাবড়ে গেলেন। একটু পিছিয়ে গিয়ে উনি কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলতে লাগলেন। কোয়েল বুঝতে পারল, ফোনটা কাকে করছেন। নিশ্চয়ই আনন্দী ম্যাডাম। ঝামেলা আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। অনিরুদ্ধকে ও বলল, ‘ছেড়ে দাও ভাই।’
অনিরুদ্ধ জেদ দেখিয়ে বলল, ‘ছেড়ে দেবো মানে? আনন্দী ম্যাডাম ভেবেছেনটা কী? যা ইচ্ছে তাই করবেন? তুমি কি ভাবছ, জিম-এ কী চলছে, আমরা কেউ জানি না? তুমি আমার সঙ্গে চলো। দেখি কোন বাস্টার্ড তোমাকে আটকায়?’
মিসেস ভাল্লাকে দেখিয়ে মিসেস মোতওয়ানি বললেন, ‘দিস উওম্যান ইজ দ্য অফ অল ইভিলস। আনন্দীর কাছে গিয়ে সবার সম্পর্কে কমপ্লেন করে। আমি নিজের কানে শুনেছি। হাসবেন্ডটা একটা রেপিস্ট, মেয়েটা হোর। আর ও নিজে একজন ব্লাডি চিটার। আমাদের সোসাইটির সবাই ওকে চেনে। চলো, আমরা সবাই মিলে আনন্দীর কাছে গিয়ে বলি, কোয়েল চলে গেলে আমরা কেউ জিম-এ আসব না।’
রমেন বলে একজন ট্রেনার বলল, ‘ইউ আর রাইট মিসেস মোতওয়ানি। আনন্দী শরাফকে এখানে আসতে বলুন। এখনই একটা ফয়সালা হয়ে যাক।’
অনিরুদ্ধ বলল, ‘সুনীতা ভাল্লাকে ক্ষমা চাইতে হবে।’
অসন্তোষ অন্য মেম্বারদেরও চোখ-মুখে। ফোন ছেড়ে দিয়ে পাণ্ডেজি ভিড়ের ভিতর ঢুকে এলেন। খুব বিনীতভাবে বললেন, ‘সরি কোয়েলজি। আপনি যেতে পারেন। মিসেস ভাল্লার কথায় প্লিজ মাইন্ড করবেন না। ওঁর হয়ে আমি আপনার কাছে মাফি চাইছি। ম্যাডাম এখন দিল্লিতে আছেন। ওঁর সঙ্গে পরে একটা মিটিং ফিক্স করে দেবো। যা বলার, আপনারা তখন বলবেন।’
কিট ব্যাগটা অনিরুদ্ধর হাত থেকে নিয়ে কোয়েল গেটের বাইরে বেরিয়ে এল। যাদবের সরবতের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিল। মিসেস ভাল্লার কথাগুলো যখনই ওর মনে পড়ছে, তখনই সারা শরীর জ্বলছে। ‘থার্ড ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে।’ জিম চালু হওয়ার পর থেকেই কোয়েল লক্ষ্য করত, ওকে মিসেস ভাল্লা পছন্দ করেন না। কথায় কথায় তখন খাটো করতেন। কারণটা কী, কোয়েল বুঝতে পারত না। পরে ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। মিসেস ভাল্লার টার্গেট দেবদা। কী কারণে, সেটা ও জেনে গেছে বলে মিসেস ভাল্লার এত রাগ ওর উপরে। দিনের পর দিন মায়ের বয়সি এক মহিলার নির্লজ্জ আচরণ ও দেখেছে। ওর গা ঘিনঘিন করত। দেবদাকে ও দু’একবার বোঝানোর চেষ্টাও করেছিল, মহিলার ফাঁদে যেন না পড়ে। পরে কোয়েল বুঝতে পারে, দেবদা কঠিন চরিত্রের মানুষ। নোংরামির মধ্যে যাবে না।
জিম-এর ঘটনাটার কথা তমালকে জানানো দরকার। যাদবের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ফোন করে কোয়েল সব গুছিয়ে বলল। উল্টো প্রান্তে কয়েক সেকেন্ড গুম হয়ে থেকে, তমাল জিজ্ঞেস করল, ‘আনন্দী ম্যাডাম কোথাও যাননি। একটু আগেই ওঁকে হোটেলে দেখেছি। সে যাক, তুমি এখন কোথায় যাবে কোয়েল, মল্লিকবাজারের বাড়িতে?’
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে কোয়েল দেখল, বেলা চারটে বাজে। বাড়িতে ফিরেই বা কী করবে? ও বলল, ‘ভাবছি, অবন্তিকাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসব কি না। তোমার প্রোগ্রাম কী?’
‘যাও। কিন্তু ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে ফিরে এসো। তার মধ্যে আমি ফ্রি হয়ে যাবো। ফ্লুরিজে দেখা হবে।’
ফোনটা হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে কোয়েল মেট্রো রেলের দিকে হাঁটতে লাগল। অবন্তিকাদের বাড়ি নেতাজি ভবনের কাছেই। মেট্রো করে গেলে মিনিট কয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাবে। কয়েক পা এগিয়েছে, এমন সময় পিছন থেকে কেউ ডাকল, ‘কোয়েল, একটু দাঁড়াবে?’
ঘুরে তাকিয়ে কোয়েল দেখল, ওরই বয়সি একটা মেয়ে। পরনে জিনসের প্যান্ট, কুর্তি। দেখতে খুবই সুন্দর। যেন ওর সঙ্গে অনেকদিনের চেনা, এমনভাবে হেসে মেয়েটা বলল, ‘আমি মউ সরকার। মিডিয়াতে আছি। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
কোয়েল অবাক হয়ে বলল, ‘আমার সঙ্গে! তোমার সঙ্গে কি আমার আগে কোথাও দেখা হয়েছে?’
মেয়েটা বলল, ‘না। তবুও, আমি কিন্তু তোমাকে চিনি। তোমার কথা শুনেছি দেবদূত মুখার্জির মুখে। সিলভার জিম-এর চিফ ট্রেনার। গতকাল ওর একটা ইন্টারভিউ আমাদের চ্যানেলে দেখিয়েছি।’
দেবদার ইন্টারভিউ টিভিতে দেখিয়েছে, কোয়েলকে কেউ বলেনি। কিন্তু মেয়েটা দেবদাকে চেনে। শুনে কোয়েল বলল, ‘আমার সঙ্গে কী দরকার?’
‘কোথাও কয়েক মিনিট বসতে পারলে ভাল হতো। চলো, ফ্লুরিজে গিয়ে বসি। তোমার সময় আছে?’
অবন্তিকাদের বাড়ি পরে গেলেও চলবে। কী ভেবে কোয়েল রাজি হয়ে গেল। দু’জনে কয়েক পা হেঁটে ফ্লুরিজে গিয়ে ঢুকল। খানিকক্ষণ পরেই অফিস থেকে বেরিয়ে লোকে ফ্লুরিজে ঢুকবে। তখন আর জায়গা পাওয়া যাবে না। কোণের টেবলে দুটো চেয়ার খালি আছে দেখে দু’জনে সেখানে গিয়ে বসল। মউ কেকের অর্ডার দেওয়ার পর জিজ্ঞেস করল, ‘দুর্বার চৌধুরীকে তুমি চেনো কোয়েল?’
সিলভার জিম-এ ট্রেনার হিসেবে কয়েকদিন আগে জয়েন করেছে ছেলেটা। আনন্দী ম্যাডামই একদিন ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। হোটেলের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য দুর্বার না কি ইনোভেটিভ শো-য়ের ব্যবস্থা করছে। সেই শো নিয়ে কথা বলার সময় কোয়েল মিটিং থেকে মাঝপথে উঠে আসে। আনন্দী ম্যাডামের দুর্ব্যবহার তো বটেই, শো নিয়ে দুর্বারের কথাবার্তা ওর ভাল লাগেনি। জিম ছেড়ে আসার এটাও বড় একটা কারণ। সত্যিকারের কারণটা ও দেবদা আর তমালকেও বলতে পারেনি। কোয়েল বুঝতে পারল না, মউ আসলে কী জানতে চায়? যাচাই করার জন্য ও পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘দুর্বারকে চিনি। কিন্তু তুমি হঠাৎ ওর সম্পর্কে এত ইন্টারেস্টেড কেন মউ?’
হ্যান্ডব্যাগ খুলে মউ খবরের কাগজের একটা কাটিং বের করে বলল, ‘এটা আগে পড়ে নাও। তা হলেই তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।’
পেপার কাটিংটা দেখে কোয়েলের মনে হল, কোনও ম্যাগাজিনের। বড় বড় করে হেডিং, ‘হোটেলে অশ্লীল শো, গ্রেফতার জিম-এর ট্রেনার।’ আর্টিকেলের মাঝে দুর্বারের ছবি। পুলিশ ভ্যানে তুলছে। এক নজর দেখেই কোয়েল চমকে তাকাল মউয়ের দিকে। জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কোথাকার ম্যাগাজিন?’
‘চেন্নাইয়ের। মাসছয়েক আগেকার কাটিং। ডেটটা দেখো, তা হলেই বুঝতে পারবে। দুর্বার মাস তিনেক জেলে ছিল। তার পর জামিন পেয়ে কলকাতায় চলে আসে। এখনও ওর এগেনস্টে কেস চলছে।’
কোয়েল জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এই খবরটা পেলে কী করে?’
‘আজকাল ইন্টারনেটের যুগে কি কোনওকিছু চাপা থাকে কোয়েল? আমরা ইনভেস্টিগেটিং জার্নালিজম করি। দুর্বার সম্পর্কে খবরটা লালবাজারের এক টপ অফিসারের কাছ থেকে পেয়েছি। ওর উপর কলকাতা পুলিশ নজর রাখছে । এই ছেলেটি আসলে কে জানো?’
শুনে কোয়েল ঘাড় নাড়ল। সত্যিই ও কিছু জানে না। জানার ইচ্ছেও হয়নি কোনওদিন। দেবদাও বোধহয় জানে না। জানলে নিশ্চয় ওকে বলত। বেয়ারা কেকের দুটো প্লেট নিয়ে এসেছে। দু’দিকে সাজিয়ে দিচ্ছে। সেটা দেখে কৌতূহলবশত কোয়েল জানতে চাইল, ‘কে এই ছেলেটা?’
‘আমাদের রাজ্যের বডিবিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি কমল চৌধুরীর ছেলে। উনি নিজে একটা সময় নামকরা বডিবিল্ডার ছিলেন। কিন্তু দুর্বার ছোটবেলা থেকেই বখে যাওয়া ছেলে। নিজে কোনওদিন বডিবিল্ডিং করেনি। বাবার নাম ভাঙিয়ে এতদিন চালিয়ে গেছে। এবার আমাদের র্যাডারে ধরা পড়েছে। আর কেউ ওকে বাঁচাতে পারবে বলে মনে হয় না।’
বাধা দিয়ে কোয়েল বলল, ‘আমরা কিন্তু শুনেছি, দুর্বার লন্ডন থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে।’
‘বুলশিট। হান্ড্রেড পার্সেন্ট লাই। ভুলটা আসলে করেছে দেবদূত। কমল চৌধুরীকে একদিন তোমাদের জিম-এ নিয়ে গেছিল। পোজিং পারফেকশনের জন্য। ছুঁচ হয়ে ঢুকে উনি ফাল হয়ে বেরিয়েছেন। লোক মারফত আনন্দী শরাফের কাছে উনি পৌঁছে গেছেন। নিজের ছেলেকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন জিম-এ। মাইনে মাসে এক লাখ টাকা। প্লাস প্রতি শো-এর পর টেন পার্সেন্ট বোনাস।’
এ-ক লা-খ টা-কা! দুর্বারের মাইনে শুনে কোয়েলের রাগ হতে লাগল। দেবদা তার অর্ধেকও পায় না। অথচ সারাটা দিন সময় দেয় জিম-এর পিছনে। ইসস, দেবদার মতো ভালমানুষরা চিরটাদিন এক্সপ্লয়েটেড হয়ে যায়। কোয়েল জিজ্ঞেস করল, ‘দুর্বারের সম্পর্কে তুমি আমার কাছ থেকে কী জানতে চাও মউ?’
‘একটাই কথা। ওর শো-তে পার্টিসিপেট করার জন্য দুর্বার তোমাকে একজ্যাক্টলি কী প্রোপোজাল দিয়েছিল। তুমি সেদিন মিটিংয়ের মাঝপথে উঠে এসেছিলে কেন? তুমি উঠে আসার সময় আনন্দী শরাফ তোমাকে ঠিক কী হুমকি দিয়েছিলেন? আমাকে বলো কোয়েল। মল্লিকবাজারে তুমি আর তমাল যাতে নির্বিঘ্নে রেস্টুরেন্ট চালু করতে পারো, সেটা আমি দেখব। ওই অঞ্চলের বস, রুস্তম আমার কথায় ওঠে-বসে।’
কোয়েল উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছে। যে মেয়েটাকে ও আধ ঘণ্টা আগেও চিনত না, সেই মউ ওর সম্পর্কে এত খবর জানল কী করে? ওকে বিশ্বাস করে কথাগুলো বলাটা কি ঠিক হবে? একটু আগে অপমানের কথা ওর মনে পড়ল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে কোয়েল বলল, ‘আনন্দী শরাফ প্রথমে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তোমার এত সেক্সি বডি, সুযোগটা নষ্ট কোরো না। যা পারো, কামিয়ে নাও। কিন্তু আমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে পরে উনি বুঝতে পারেন, আমার সম্মতি নেই। তখন উনি হুমকি দেন, রাজি না হলে আমার জিম-এ আসার দরকার নেই। শো-তে আমার বদলে বিদিশাকে নেবেন।’
কথাগুলো বলে কোয়েল চুপ করে রইল। গলগল করে ওর মুখ থেকে কথা বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু রাগ আর দুঃখ মিশিয়ে ওর গলায় এক তাল বাষ্প আটকে গেছে। চেষ্টা করেও কথাগুলো ও উগড়ে দিতে পারল না। তখনই মউ বলল, ‘চুপ করে থেকো না কোয়েল। আনন্দী শরাফকে আমি পরে টাইট দেবো। আপাতত দুর্বারকে ফ্রেম করা দরকার। তোমাকে একটা খবর দিই। দেবদূতকেও শো-তে নামানোর টার্গেট করেছিল দুর্বার। কিন্তু তোমার মতো দেবদূতও ফ্ল্যাটলি না করে দিয়েছে।’
কোয়েল জিজ্ঞেস করল, ‘মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে, ভার্বালি। তুমি দুর্বারের এগেনস্টে চার্জ ফ্রেম করবে কি করে?
‘ওসব নিয়ে তুমি ভেবো না। মিটিংয়ের ফুটেজ আমার কাছে আছে। সেখানে তখন এমন একজন বসেছিল, যে গোপন ক্যামেরায় শ্যুট করে গেছে। সেই ফুটেজ আমি দেখেছি। সবই শুনেছি। তবুও, তোমার কাছ থেকে কনফার্ম হয়ে নিলাম।’
মউ ব্যাগ থেকে কার্ড বের করে পেমেন্ট করছে। সেইসময় কোয়েল জিজ্ঞেস করল, ‘দুর্বারকে ফ্রেম করে তোমার কি লাভ মউ।’
মউ হেসে বলল, ‘জাস্টিস দেওয়া। দেবদূত, তুমি, তোমার মতো আরও কয়েকজনকে। শুনতে চাইছই যখন, তখন বলি। শুভঙ্কর বলে এক উঠতি নেতার সঙ্গে আমার রিলেশন ছিল। ও আমাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়মিত রেপ করত। ফলে আমাকে একবার অ্যাবারসনও করতে হয়। শুভঙ্করের মাসতুতো ভাই হল এই দুর্বার। শুভঙ্করের সঙ্গে ও প্রায়ই আমার বাড়িতে মদ খেতে আসত। শুভঙ্করের এগেনস্টে আমি পুলিশে কমপ্লেন করার পর, একদিন দুর্বার কয়েকজন বডিবিল্ডার সঙ্গে নিয়ে এসে আমাকে ভয় দেখায়। ওর উপর কেন আমার এত রাগ, এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?’
বেয়ারা ডেবিট কার্ড ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়ার পর মউ উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, ‘ভয় পেও না কোয়েল। আমি তোমার প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করব। এই নাও, আমার নেমকার্ড। দরকার হলে ফোন কোরো। দেবদূত ব্যাঙ্কক থেকে জিতে ফিরে এলে আমি একটা পার্টি থ্রো করব। তখন কিন্তু তোমার আসা চাই।’
(বিয়াল্লিশ)
ডিনার করার পর হোটেলের ছাদে খানিকক্ষণ হাঁটা অভ্যাস দেবের। অন্ধকারে এত উঁচু থেকে কলকাতাকে মায়ানগরী বলে মনে হয় ওর। বাঁ দিকে বিদ্যাসাগর সেতু, ডানদিকে শহীদ মিনার আলোয় ঝলমল করে। ইডেন গার্ডেন্সে কোনও খেলা থাকলে, রাত বারোটা পর্যন্ত চারটে টাওয়ারে আলো জ্বলে। দেবকে সবথেকে বেশি টানে ‘দ্য ফর্টি টু’ বিল্ডিং। কলকাতার সবথেকে বড়, পঁয়ষট্টি তলা বাড়িটা যেন আকাশ ছুঁয়ে রয়েছে। হোটেলের ছাদ থেকে ও যখন চৌরঙ্গীর দিকে তাকায়, তখন ওর অদ্ভুত লাগে। কখনও মনে হয়, সাত-আটশো ফুট উঁচুতলায় যাঁরা থাকেন, ঝড়বৃষ্টির সময় তাঁদের ভয় করে না? নীচের দিকে তাকালে তাঁদের মাথা ঘোরে না? কয়েক কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনে, কোন সুখে তাঁরা ওখানে বাস করেন? কখনও কি তাঁরা ভাবেন, বাড়িটা যদি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে, তা হলে কী হবে? মাঝে মাঝে দেবের খুব ইচ্ছে হয়, দ্য ফর্টি টু-র ছাদে গিয়ে খানিকটা সময় কাটিয়ে আসতে। কলকাতার কতদূর পর্যন্ত দেখা যায়, অন্তত সেই অভিজ্ঞতা তো হবে?
আজ ছাদে পায়চারী করার সময় কিন্তু দেবের মনে এই ধরনের রোমান্টিক চিন্তা আসছে না। উল্টে, ও ভাবছে ছাদ থেকে যদি ঝাঁপ দেয়, তা হলে কী হবে? নাড়ুগোপালের মুখ থেকে শোনা মায়ের কথাগুলোই ওর বারবার মনে পড়ছে। ‘ওকে ছেলে বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে। ওর জন্য আমাকে এত অপমান সহ্য করতে হবে, কখনও ভাবিনি। আমাকে যেন আর কোনওদিন ও মুখ না দেখায়।’ দুপুরে জিম-এর গেটের সামনে রুস্তমের যে ছেলেটা ওকে ‘মাদারচোত’ বলে গালি দিয়েছিল, তার চোয়াল দেব ভেঙে দিতে পারেনি। কথাটা যখন মনে পড়ছে, তখনই ওর সারা শরীর জ্বলছে। ব্যাঙ্ককের কম্পিটিশনে যাওয়ার ইচ্ছেটাই ওর চলে যাচ্ছে। আপন লোকেরাই কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। গুন্ডা-মাস্তানরা মুখের সামনে গালি দিয়ে যাচ্ছে। বেঁচে থেকে লাভ কী?
রাত প্রায় দশটা, তমাল এখনও ডিউটি থেকে ফেরেনি। হোটেলের দুটো ব্যাঙ্কয়েট হল-এ পার্টি আছে। সেই কারণে ফিরতে ওর দেরি হবে। দেব প্রায় ঠিক করেই ফেলল, তমাল এলে ও জানিয়ে দেবে, ব্যাঙ্ককে যাবে না। ছাদে হোটেলের পরিত্যক্ত কিছু আসবাব পড়ে আছে। তারই মধ্যে থেকে একটা চেয়ার বের করে দেব বসে পড়ল। দু’হাতে মুখ ঢেকে ও রিওয়াইন্ড করতে লাগল, চণ্ডীতলায় ফোন করার পর কী কী ঘটেছে। মাকে প্রথম ফোনটা ও করেছিল, বিকেল চারটেয়। বেজেই গেছিল, কেউ তোলেনি। তার পর থেকে আধ ঘণ্টা অন্তর ও ফোন করে গেছে। চণ্ডীতলায় আত্মীয়, পরিচিত ছয়-সাতজনকে। একমাত্র জেঠু ফোন তুলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, ‘তোদের বাড়ির কোনও খবর রাখি না।’ প্রদীপ্তর কম্পাউন্ডার বলেছিল, ‘ডাক্তারবাবু রুগী দেখতে গেছেন বাদিনানে। কখন ফিরবেন জানি না।’
ছাদে বসে হঠাৎ দেবের মনে পড়ল সুকুমারদার কথা। পিসতুতো দাদা, ওর রাঙাদা। ওকে কোনওদিন ফোন করার দরকার হয়নি। নাম্বার খুঁজে বের করে দেব এক চান্সেই লাইনটা পেয়ে গেল। বুকের ভিতর উথাল পাতাল করছে মায়ের খবর জানার জন্য। কোথায় জিজ্ঞেস করবে, মা কেমন আছে, জানো? তার জায়গায় দেব বলে বসল ‘পিসিমা কেমন আছে রাঙাদা?’
ও প্রান্ত থেকে রাঙাদা অবাক গলায় বলল, ‘আমার মা তো অনেকদিন হল, মারা গেছে। তোর মনে নেই?’
‘সরি সরি রাঙাদা। আমার মাথার ঠিক নেই। আমার মা এখন কেমন আছে?’
কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে রাঙাদা বলল, ‘তোকে খবরটা কে দিল খোকা?’
‘যে-ই দিক, মায়ের কী হয়েছে, আগে বলো।’
রাঙাদা এমনিতে ভালমানুষ। কোনওদিন একটা কড়া কথাও ওকে বলেনি। আজও শান্ত গলায় বলল, ‘তোর মা ভাল নেই।’
‘তুমি এখন কোথায় রাঙাদা?’
‘তোদের বাড়িতে। তোর মা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমি গত তিনদিন ধরে তোদের বাড়িতে এসে পড়ে আছি। দোকানটাও খুলতে পারিনি।’
‘ফোনটা মাকে দাও। আমি কথা বলতে চাই।’
‘দেওয়া যাবে না রে। প্রদীপ্ত ডাক্তার এসে সিডেটিভ দিয়ে গেছে। মামি এখন ঘুমোচ্ছে। প্রদীপ্ত বলে গেছে, ঘুম থেকে কেউ যেন ওঁকে না তোলে। মামির কী হয়েছে, যদি জানতে চাস, তা হলে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস কর। ও ভাল বলতে পারবে।’
‘নাড়ুর মুখে শুনলাম, মা না কি গায়ে আগুন দিতে গেছিল? কেন, রাঙাদা?’ প্রশ্নটা করার সময় গলায় কান্না আটকে গেল দেবের।
‘নাড়ু বলেছে!! মিথ্যে কথা। ও কী করে জানল, মামি গায়ে আগুন দিতে চেয়েছিল? কই, আমি তো কারও মুখে শুনিনি? হ্যাঁ, তোদের বাড়িতে একটু অশান্তি হয়েছিল, এটা ঠিক। তার জন্য তুই দায়ী। তোর বাপু কী দরকার ছিল, কেরেস্তান মেয়েটাকে চণ্ডীতলায় নিয়ে এসে দেখানোর?’
‘আমি বুঝতে পারিনি রাঙাদা।’
‘মামি খুব আঘাত পেয়েছে রে। তোর জেঠিমা-খুড়িমাদের তো চিনিস। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর ওঁরা মামিকে যা-তা বলেছেন। সেই কারণেই মামি মাথা ঠিক রাখতে পারেনি।’
‘রাঙাদা, মা না কি বলেছে, আমার মুখ আর কোনওদিন দেখবে না?’
‘নাড়ু শুয়ারটা বলেছে বুঝি? শয়তানের হাড়। তোর মাকে ও একবারও দেখতে আসেনি। ডাক্তার ডেকে আনার জন্য খুঁজেও ওকে পাওয়া যায়নি। রন্তিমাসি বলছিল, বটতলায় বসে এই ক’দিন জুয়ো খেলে টাকা উড়িয়ে গেছে। তোর কাছে গিয়ে ও যা বলেছে, একদম বিশ্বাস করবি না।’
‘মাকে নিয়ে এত বড় মিথ্যে কথা বলল নাড়ু?’
‘তুই কী রে খোকা? বুঝতে পারছিস না, এতে তোর জেঠিমা-খুড়িমাদের ষাড় আছে? তোর আর মামির মধ্যে এত সুন্দর সম্পর্ক। তোকে কত লোক চেনে। মামির কত গর্ব তোকে নিয়ে। সেটা কি সহ্যি হয় তোর জেঠিমা খুড়িমাদের? মা-ছেলের সম্পর্কটা নষ্ট করে দিতে চান ওঁরা। দ্যাখ গে, ওঁরাই হয়তো গল্প বানিয়ে নাড়ুকে তোর কাছে পাঠিয়েছেন। ওঁদের ফাঁদে তুই কিন্তু পা দিবি না।’
‘কাকে বিশ্বেস করব তা’লে রাঙাদা?’
‘যা যুগ পড়েছে, কাউকে বিশ্বেস করা উচিত না। শোন তা’লে, বছর তিনেক আগে চাষ করার জন্য তোর জেঠুর কাছ থেকে নাড়ু দশ হাজার টাকা লোন নিয়েছিল। সে বছর ভাল ফসল হয়নি। তাই টাকাটা এখনও নাড়ু শোধ করতে পারেনি। জেঠিমা এখনও ওকে যা করতে বলবে, ও করতে বাধ্য। গ্রামের সবাই আমরা জানি, ওকে তুই চাকরি করে দিয়েছিস। তার কী প্রতিদান দিচ্ছে, এখন দ্যাখ।’
এত সাংসারিক কূটকাচালির মধ্যে দেব কোনওদিন ঢোকেনি। চণ্ডীতলায় গেলে ও জ্ঞাতিদের সবার সঙ্গে কথা বলে। হ্যাঁ, মায়ের মুখ দেখে অবশ্য ও বুঝতে পারে, জেঠিমা-খুড়িমাদের মা পছন্দ করে না। একদিন বলেও ফেলেছিল, ওদের ঘরে যাস না। ওরা তুকতাক করে। কিন্তু দেব হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। রাঙাদার কথা শুনে ওর মনে হতে লাগল, মায়ের ডিপ্রেশনের পিছনে ডেফিনিটলি জ্ঞাতিদের হাত আছে। ইস, প্রদীপ্ত অনেকদিন আগেই সাবধান করে দিয়েছিল। ‘মাসিমা যাতে একা না থাকে, তার ব্যবস্থা কর।’ ও যা ভয় পাচ্ছিল, সেটাই ঘটে গেল। নাড়ুর উপর এখন মারাত্মক রাগ হচ্ছে। কী করবে, দেব ভেবে উঠতে পারল না। কাল সকালেই কি ও চণ্ডীতলায় চলে যাবে? কিন্তু মা যদি দেখা না করে? তার চেয়ে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। দেব এ সব ভাবছে, তখনই রাঙাদা জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ রে, ব্যাঙ্ককে তোর কম্পিটিশনটা করে রে?’
‘পরশু যাওয়ার কথা আমার। কিন্তু এখন ভাবছি, যাব কি না।’
‘এই ভুলটা কখনও করিস না। শোন খোকা, তোকে এখন মামির কাছে আসতে হবে না। আমি এখেনে সব সামলে নেবো। দ্যাখ ভাই, আমি ছোট্ট একটা মুদির দোকান চালাই। খুব সাধারণ লোক। একমাত্র তুই-ই আছিস, যাকে নিয়ে গ্রামের মানুষকে দুটো কথা কইতে পারি। মামির একটু অভিমান হয়েছে তোর উপর এটা ঠিক। কিন্তু পেটের সন্তানকে কি কেউ পর করে দিতে পারে? সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার উপর তোর যদি বিশ্বেস থাকে, তা হলে তুই নিশ্চিন্তে ব্যাঙ্ককে চলে যা। গিয়ে কম্পিটিশন জিতে আয় ভাই।’
‘মাকে তুমি একটা কথা বলতে পারবে রাঙাদা?’
‘কী বলতে হবে, বল না ভাই।’
‘বলবে, মায়ের অমতে আমি কিছু করব না।’
‘কী বলছিস তুই! যে মেয়েটাকে তুই ভালবাসিস, তাকে ত্যাগ দিবি? না ভাই, আমি মানতে পারলুম না। সেদিন পিকনিকের সময় যতটুকু দেখেছি, কেরেস্তান মেয়েটাকে আমার খুব ভালো মনে হয়েছে রে। মনটা খুব পরিষ্কার। পরিচয় হতেই সেদিন হাতজোড় করে আমায় বলল, জয় শ্রীকৃষ্ণা। কোত্থেকে শিখল রে ভাই?
তোর বউদিরও খুব পছন্দ হয়েছে ওকে। তোদের বাড়ি আলো করে রাখবে। তুই যদি ওকে কথা দিয়ে থাকিস, বিয়ে করবি, তা’লে পিছিয়ে আছিস না।’
‘কিন্তু মা তো ওকে মানবে না রাঙাদা?’
‘যদ্দূর জানি, মামির আপত্তি ওর ধম্ম নিয়ে। তুই এক কাজ কর ভাই। মেয়েটার যদি আপত্তি না থাকে, তা’লে ব্যাঙ্কক থেকে ফিরে আসার পর, ওকে নিয়ে তুই কাশীতে চলে যা। ওখেনে ধম্ম বদল করার ব্যবস্থা আছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের লোকেরা ওকে হিদুঁ করে দেবে। তখন মামি আর আপত্তি করতে পারবে না। এখন আকচার এ সব হচ্ছে। গোলোকদাদু কয়েকদিন আগে কাশী গেছিল। ফিরে এসে আমার দোকানে আড্ডা মারার সময় গপ্প করেছে।’
কথা বলার আর কিছু নেই। ফোন ছেড়ে দেওয়ার জন্যই দেব বলল, ‘কাল দুপুর ফের তোমায় ফোন করব রাঙাদা। আমার মাকে তুমি দেখো।’
এতক্ষণে অভিমান ফুটে বেরোল রাঙাদার মুখ থেকে, ‘দেখব রে ভাই, দেখব। আমার মা মারা যাওয়ার খবর পেয়েও তুই চণ্ডীতলায় আসিসনি। সে কথা আমি মনে রাখিনি। যা ভাই, ব্যাঙ্ককে গিয়ে জিতে আয়। হাইওয়ে থেকে ব্যান্ড বাজিয়ে তোকে আমরা চণ্ডীতলায় নিয়ে আসব।’
রাঙাদার শেষ কথাটা শুনে দেবের চোখে জল এসে গেল। অন্ধকার আকাশ, অসংখ্য চুমকি ঝিকমিক করছে। ক’টা বাজে এখন দেবের খেয়াল নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেবের হঠাৎ মনে হল, এই রাঙাদাকে এতদিন ও চিনতে পারেনি। রাঙাদার মতো শুদ্ধ আত্মার লোক পৃথিবীতে বিরল। সাংসারিক আবর্তে বাস করেও এই মানুষগুলো নিজেদের কলুসিত করে না। এদের কথাগুলো যেন অন্ধকারে একটা আলোর রেখা দেখিয়ে দেয়।
নীচ থেকে লিফট উঠে আসার ঘড়ঘড় শব্দ পাচ্ছে দেব। ডিউটি শেষ করে তমাল বোধহয় ছাদে উঠে আসছে। চেয়ার ছেড়ে ঘরের দিকে এগোনোর সময়ই দেবের চোখে পড়ল, দক্ষিণ আকাশ থেকে একটা তারা খসে পড়ল। আরেকটা পশ্চিম প্রান্তের দিকে ছুটে যাচ্ছে। বিদ্যাসাগর সেতুর কাছাকাছি সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তমাল একদিন বলেছিল, তারা খসে পড়ার সময় কোনও ইচ্ছে প্রকাশ করলে, সেটা না কি পূরণ হয়। দ্বিতীয় তারাটা হারিয়ে যাওয়ার আগে দেব উইশ করল, ‘ভগবান, আমার মাকে ভালো রেখো।’
আর তখনই তমাল সামনে এসে বলল, ‘কি রে, তুই এখনও জেগে?’
ওর মুখে দেখে কী আন্দাজ করল, কে জানে? একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসে তমাল ফের বলল, ‘তোর ব্যাঙ্ককের টিকিট কনফার্ম করে ফেললাম দেব। পরশু রাতেই তুই রওনা হয়ে যাবি। রাত দেড়টায় তোর ফ্লাইট, থাই এয়ারওয়েজে। মি চাইম্যানকে সব ইনফর্মেশন দিয়ে রেখেছি।
দেব জিজ্ঞেস করল, ‘একদিন আগে যেতে হচ্ছে কেন?’
‘আমি কোনও রিস্ক নিতে চাই না ফ্রেন্ড। আজ দুপুরে তুই বেঁচে গেছিস। কী হত, রুস্তমের ছেলেগুলোর সঙ্গে যদি তোর হাতাহাতি হত? তোর বডিতে কোনও ইনজুরি হলে, তুই তো কম্পিটিশনেই নামতে পারতি না। ভাগ্যিস, সেইসময় হিমাদ্রি জিম-এ ছিল। ও বেরিয়ে না এলে ছেলেগুলো তোর ক্ষতি করে দিত।’
তমাল ঠিকই বলছে। পার্ক স্ট্রিট থানার এএসআই হিমাদ্রি সেইসময় বেরিয়ে এসেছিল বলেই, ছেলে তিনটে পালিয়ে গেছিল। হিমাদ্রি অবশ্য ছেলেগুলোকে চিনতে পেরেছে। মকবুল, রিয়াজ আর সাদেক। তিনজনই স্টিফেন ম্যানসনে ড্রাইভারদের কোয়ার্টার্সে থাকে। হিমাদ্রি এত রেগেছিল, পোশাক বদলে সঙ্গে সঙ্গে থানায় চলে যায়। বিকেলে ও খবর দেয়, রিয়াজ আর সাদেককে তুলে নিয়েছে। মকবুল পালিয়ে গেছে। রিয়াজরা স্বীকার করেছে, দেবকে পেটানোর জন্যই ওরা ওয়েট করছিল। ওদের উপর নির্দেশ ছিল, এমনভাবে পেটাতে যাতে কয়েকটা দিন নার্সিং হোমে কাটাতে হয়। শুনে দেব চমকে উঠেছিল। বিকেলে হিমাদ্রি বলেছিল, ‘কে এই সুপারি দিয়েছে, তার নামটা রিয়াজরা ডাইভালজ করেনি। রাতে মাথা ঠান্ডা করে ওদের থার্ড ডিগ্রি দেবো। তখন সুড়সুড় করে উগড়ে দেবে।’
‘শোন, এই দু’দিন একবার বুড়ি ছোঁয়ার মতো করে জিম থেকে ঘুরে আসবি। ওখানে বেশিক্ষণ থাকার দরকার নেই।’ তমাল বোঝাতে লাগল, ‘পরশু দুপুরের মধ্যে তুই সব গোছগাছ করে নিবি। তোর ম্যানেজার হয়ে হিমাদ্রি যেতে রাজি হয়ে গেছে। তোর কী কপাল দ্যাখ, সিকিমে ট্রেকিং করতে যাবে বলে দু’সপ্তাহ ও ছুটি নিয়েছিল। সেই ট্রিপ ও ক্যানসেল করে দিয়েছে। হ্যাঁরে, হিমাদ্রি কি রাতে তোকে ফোন করেছিল?’
ঘরে ঢুকে দেব বলল, ‘করেছিল। এখনই দুটো মিসড কল দেখলাম। সেটটা আমার কাছে ছিল না।’
‘কী খবর দেওয়ার জন্য ও তোকে ফোন করেছিল, শুনবি না কি?’
‘কী খবর রে?’
‘তোকে নার্সিং হোম পাঠানোর সুপারিটা কে দিয়েছিল, জানিস? নামটা শুনে তুই চমকে উঠিস না। আনন্দী ম্যাডাম। হিমাদ্রির কাছে রিয়াজ ম্যাডামের নামটা বলে ফেলেছে। মিলেনাদের ফ্ল্যাটটার দিকে ম্যাডামের নজর পড়েছে। মাল্টি মিলিওয়ারদের কত কী চাই। ওঁরা ধরেই নিয়েছেন, টাকা দিয়ে সব কেনা যায়। রুস্তমকে দিয়ে ফ্ল্যাট দখলের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ম্যাডামের কাছে খবর গেছে, পথের কাঁটা হলি তুই। তোকে কিছুদিনের জন্য সরাতে পারলে কাজটা সহজ হয়ে যাবে।’
শুনে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দেব, ‘আমি ব্যাঙ্কক গেলে… ম্যাডাম এই কাজটা তখনও তো করতে পারতেন।’
তমাল বলল, ‘হয়তো পারতেন। কিন্তু তা’লে দুর্বার চৌধুরীকে তোর জায়গায় বসাতে পারতেন না। তুই মি. এশিয়া হয়ে ফিরে আয় ফ্রেন্ড। তারপর সিলভার জিমকে লাথি মেরে চলে যাবি। কম্পিটিশনে নেমে আনন্দী শরাফের মুখটা একবার মনে করিস। তোকে কেউ আটকাতে পারবে না।’
(তেতাল্লিশ)
ক্রিস্টোফার রোডের বাড়ি থেকে মউকে তুলে এনেছে রুস্তম। পরিচিত দু’একজন ছাড়া কেউ জানে না, দ্য ফর্টি টু বিল্ডিংয়ের পঁয়তাল্লিশ তলায় ও সুন্দর সাজানো গোছানো একটা ফ্ল্যাট হাতে পেয়ে গেছে। আসলে ফ্ল্যাটটা গুলাটির। পাইপ কলোনির কমপ্লেক্স তৈরি না হওয়া পর্যন্ত চাবি রুস্তমের কাছে থাকবে। বড় কোনও দাঁও মারার সময় ইমপ্রেস করার জন্য লোকজনকে ওই ফ্ল্যাটে রুস্তম নিয়ে যায়। মউ যেদিন এন্টালি থানায় শুভঙ্করের বিরুদ্ধে রেপ চার্জ আনে, সেদিনই রুস্তম ঠিক করে নিয়েছিল, মেয়েটাকে কিছুদিনের জন্য দ্য ফর্টি টু-তে নিয়ে গিয়ে রাখবে। বিল্ডিংয়ে সিকিউরিটির এত কড়াকড়ি, কাকপক্ষীতেও টের পাবে না, মউয়ের সঙ্গে ওর কোনওরকম যোগাযোগ আছে। গোপনীয়তার দরকার ছিল। শুভঙ্করের এগেনস্টে মউ এফআইআর করার পর, মিডিয়া দু’দিন ধরে খবরটা লাগাতার করে গেছে। পুলিশ শুভঙ্করকে অ্যারেস্ট করে কোর্টে তুলছে, সেই ছবিও টিভি চ্যানেলে দেখিয়েছে।
পার্ক সার্কাসের অফিসে বসে রুস্তম যা খবর পাচ্ছে, তাতে শুভঙ্করের পলিটিক্যাল কেরিয়ার শেষ। পার্টির হাই কম্যান্ড হাত ধুয়ে ফেলার জন্য যা বলার দরকার, সেটাই বলে দিয়েছে। আইন আইনের পথে চলবে। এই কথা চাউর হওয়ার পর পার্টি লেভেলে প্রত্যেকের মুখে একই প্রশ্ন, কে শুভঙ্করের এত বড় সর্বনাশটা করল? মউকে কে এই সাহসটা জোগাল? এসবি-র লোকেরাও না কি সেটা জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই কারণেই রুস্তম খুব বেশি করে সতর্ক। দু’দিন আগে ও এন্টালি থানায় গেছিল। ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের অনুষ্ঠানে ওসি নির্মল সাহাকে ইনভাইট করার জন্য। ওসি একটু বাড়তি খাতির করেই ওকে চা খাওয়ালেন। শুভঙ্করের প্রসঙ্গ ওসি তোলেন কি না, তার জন্য রুস্তম অপেক্ষা করছিল। হঠাৎই নির্মল সাহা বললেন, ‘এখানে শুভঙ্করবাবুর প্রোগ্রামটা তো হচ্ছে না। মনে হয়, আপনার ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে আমি যেতে পারব।’
সুযোগ পেয়ে রুস্তম বলেছিল, ‘হ্যাঁ, বিশ্রী একটা স্ক্যান্ডাল রটল শুভঙ্করের নামে। শুনে খারাপ লেগেছে।’
‘ভিক্টম মেয়েটা…মানে মউ সরকারকে আপনি চেনেন না কি?’
রুস্তম বলতে যাচ্ছিল ‘না।’ কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামনে নিয়েছিল। ক’দিন পরেই ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে অ্যাঙ্কারিং করবে মউ। অস্বীকার করে গেলে, পরে ওসি-র সন্দেহ হতে পারে। রুস্তম বলেছিল, ‘চিনি। ইন ফ্যাক্ট, আমার অনুষ্ঠানে ওর অ্যাঙ্কারিং করার কথা। কিন্তু তার আগে এমন একটা স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়ল, এখন কী করব তাই ভাবছি।’
‘মেয়েটার দম আছে রুস্তমবাবু। এফআইআর নেওয়ার আগে আমি ইতস্তত করছিলাম। কিন্তু ওপরওয়ালাদের ফোন টোন করে আমার উপর এমন প্রেসার দিল, আমি রিফিউজ করতে পারলাম না। জানেন, ইন্টারকোর্সের ভিডিয়ো পর্যন্ত তুলে রেখেছে মেয়েটা। শুভঙ্করবাবুর বেরিয়ে আসা মুশকিল। একটা মেয়ের কতটা গাটস থাকলে, এটা করতে পারে, ভাবুন। ওপরওয়ালারা আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মেয়েটার পিছনে কে আছে, খোঁজ নিন। আমি বলেছি, কারও মদত নিয়েছে বলে মনে হয় না। এ মেয়ে একাই যথেষ্ট।’ পাছে মুখ ফস্কে কিছু বলে ফেলে, সেই কারণে রুস্তম তাড়াতাড়ি থানা থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
মউ যে কতটা বেপরোয়া, দিলুদের বাড়িতে ওর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে রুস্তম সেটা টের পায়। প্রথম দিনই মেয়েটা সওদা করে নিয়েছিল, ‘রুস্তমদা, আপনি যে একজন অসহায় নারীকে উদ্ধার করতে এসেছেন, আমি তা মনে করি না। ডেফিনিটলি আপনি সমাজসেবা করতে নামেননি। প্রশ্ন হচ্ছে, শুভঙ্করকে ফাঁসিয়ে আপনার কি ফয়দা হবে বলুন। আমিই বা এতবড় একটা দুর্নাম নিজের ঘাড়ে নিয়ে কী পাবো?’ দিলু মাঝখান থেকে কী যেন বোঝাতে গেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ওকে থামিয়ে দিয়ে মউ আরও বলেছিল, ‘প্লিজ, তুমি এর মাঝে এসো না দিলুদা। উত্তরটা রুস্তমদাকে দিতে দাও।’
সরাসরি প্রশ্নটার মুখোমুখি হবে রুস্তম ভাবতে পারেনি। তবুও, মন খুলেই ও উত্তরটা দিয়েছিল, ‘পথের কাঁটাকে রাস্তা থেকে হটানো। তার পর পলিটিক্যাল ফায়দা তোলা। আমার দিক থেকে আমি এটাই চাই। এ বার তুমি কি চাও শুনি?’
‘থানায় কমপ্লেন করার জন্য ক্যাশ পাঁচ লাখ টাকা। প্লাস থাকার একটা জায়গা। এর পরের শর্তটা কী হবে, সেটা নির্ভর করবে, আপনি আমার কতটা সাহায্য চান, তার উপর। রিপোর্টার হিসেবে আমি আপনার অনেক কাজে লাগতে পারি।’
রুস্তম আগুপিছু ভাবেইনি। বলে দিয়েছিল, ‘ডান। মনে হচ্ছে, আমার কপাল এ বার খুলে যাবে।’
উত্তরে মউ যা বলেছিল, তাতে চমকে উঠেছিল রুস্তম। ‘আপনার কপাল তখনই খুলবে, যখন নিজের ইমেজ আপনি বদলাবেন। গুন্ডাগর্দি করে আপনি খুব বেশিদূর এগোতে পারবেন না রুস্তমদা। এই জায়গাটাতেই আপনার থেকে শুভঙ্কর কয়েক কদম এগিয়ে ছিল। ওর ইমেজ বিল্ডিংয়ের জন্য আমায় অনেক খাটতে হয়েছে। আমাকে ডিচ না করলে, কয়েকমাস পর ও কিন্তু অ্যাসেম্বলিতে গিয়ে বসত। থাক, সে কথা।’
সাফ সাফ কথা হয়ে গেছে। দেনা-পাওনার কথা। মউয়ের সব শর্ত পূরণ করেছে রুস্তম। প্রথম তিনদিন দ্য ফর্টি টু-তে মউয়ের সঙ্গে ও দেখাই করতে যায়নি। মেয়েটাও এমন বুদ্ধিমতী, ফোন করে ওকে বিরক্ত করেনি। উল্টে, ওর একটা প্রাইভেট ফোন নাম্বার দিলুর মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছিল। নম্বরটা দিতে এসে দিলু বলে গেছে, মাঝে একদিন ফিরোজরা পাড়ায় হুজ্জোত করতে গেছিল। লোকজন বাড়ি থেকে নেমে আসায় ওরা পালিয়ে যায়। সহানুভূতির ঢেউটা না কি পুরোপুরি মউয়ের দিকে। দ্য ফর্টি টু বিল্ডিংয়ে প্রথম যেদিন রুস্তম ওর সঙ্গে কথা বলতে যায়, সেদিন দরজা খুলেই মউ বলেছিল, ‘এসো রুস্তমদা, আমার মন বলছিল, তুমি আজ আসবে। সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।’
তুমি সম্বোধনটা করায় রুস্তম একটু অবাকই হয়েছিল। কী ব্যবস্থা করে রেখেছে, সেটা অল্প সময় পরেই ও বুঝতে পারে। সিবাস রিগালের বড় বোতল যখন মউ নিয়ে আসে। মেয়েটা কী করে জানল, ওর প্রিয় ব্র্যান্ডের কথা? তার পরে ফের চমক, ‘তুমি তো সোডা দিয়ে খেতে ভালবাসো না। নিট খাও, তাই সোডা এনে রাখিনি।’
রোজ সন্ধে হলেই মউ এখন চুম্বকের মতো টানে। ওর মতো চৌখস মেয়ে আগে কখনও চোখে পড়েনি রুস্তমের। যেমন পটাকা টাইপের দেখতে, তেমনই লেখাপড়া জানা। পটাপট ইংরেজি বলে। চট করে চার পাতা লিখে দিতে পারে। ভয়ডর বলে ওর মধ্যে কিছু নেই। আর ওর কন্টাক্টও আছে প্রচুর। পুলিশ কমিশনার থেকে হোম সেক্রেটারি, লোকাল কাউন্সিলার থেকে এমপি পর্যন্ত সবাই ওকে চেনে। সিনেমা আর্টিস্টদের অনেকের ফোন নাম্বার মউয়ের মুখস্থ। ফোন করলে কেউ ওকে অ্যাভয়েড করে না। সবাই ওকে বাই নেম চেনে। ওর একটা ফোনে সেলিব্রিটিদের অনেকের ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে আসতে রাজি হয়ে গেছে। রিপোর্টারদের যে এত পাওয়ার, আগে রুস্তমের ধারণা ছিল না।
আজ বিকেলের পর থেকে রুস্তমের মনটা খিঁচড়ে আছে। পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ রিয়াজ আর সাদেককে ধরে নিয়ে গেছে স্টিফেন ম্যানসন থেকে। গান্ডুগুলোকে সিলভার জিম-এ ও পাঠিয়েছিল, দেবকে শুধু চমকানোর জন্য। হয়তো বাড়াবাড়ি কিছু করে ফেলেছে। তার পরিণতি, এখন থানার লক আপে। সারাদিনে ওসি ওর ফোনই ধরেননি। পুলিশের কাছে রিয়াজরা কী উগড়ে দেবে, কে জানে? মনে দুঃশ্চিন্তা নিয়ে রুস্তম দ্য ফর্টি টু-র ফ্ল্যাটে এসেছে। ঘরে ঢুকেই ওর চোখে পড়ল, সমবয়সি একটা মেয়ের সঙ্গে বসে মউ মাল খাচ্ছে। দু’জনের হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট। ধোঁয়ায় ঘর ভরে আছে। মেয়েটাকে দেখে রুস্তম একটু বিরক্তই হল। মউ যে ওর আশ্রয়ে আছে, সেটা কেউ জানুক, ও চায়নি। ওরই দোষ, কথাটা মউকে বলে দেওয়া হয়নি। জানলাগুলো সব খুলে দিয়ে রুস্তম বলল, ‘অফিস থেকে কখন ফিরলে মউ?’
‘বলছি, তার আগে রুস্তমদা তোমার সঙ্গে আমার এই বন্ধুটার আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম মারিয়া গোমেজ। লেডি ব্র্যাবোর্নে আমার সঙ্গে পড়ত। এখন সিলভার হোটেলের ফ্লোর ম্যানেজার। থাকে স্টিফেন ম্যানসনে। ওকে দরকার বলে আজ ডেকে এনেছি।’ বলে মউ চোখ টিপে হাসল।
সোফায় বসার আগে মারিয়ার দিকে তাকাল রুস্তম। এই মেয়েটাই ববির প্রেমিকা নাকি? মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। হয়তো সিলভার হোটেলে ওকে দেখেছে। মারিয়া উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আপনার কথা ববির মুখে অনেক শুনেছি। আপনি তো ওর গডফাদার।’ কোনও রকমে হ্যান্ডশেক করে মেয়েটা মউকে বলল, ‘আজ আমাকে উঠতে হবে মউ। রাত আটটা থেকে আমার ডিউটি। আর মিনিট পনেরো বাকি। ফরগিভ মি রুস্তম। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আই গট টু গো নাউ।’
মউ দু’একবার রিকোয়েস্ট করল বটে, মারিয়া কিন্তু এক মিনিটও বসল না। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল। ও চলে যাওয়ার পর মউ হেসে বলল, ‘তোমার কী ইমেজ দেখলে রুস্তমদা? ভয় পেয়ে মেয়েটা পালিয়ে গেল। অথচ ঘণ্টাখানেক ধরে দিব্যি আমার সঙ্গে গল্প করছিল।’
‘তুমি সিওর, আমাকে চেনে?’
‘আরে বাবা, তোমার নামটা তো জানে। তোমাকে না কি সিলভার হোটেলে বার তিনেক দেখেওছে। তুমি কি সব ভুলভাল করেছ, সেই কথাগুলোই তো ওর পেট থেকে বের করছিলাম।’ কথাগুলো বলতে বলতে গ্লাসে স্কচ ঢালতে শুরু করল মউ।
রুস্তম বলল, ‘কী ভুল করেছি আমি?’
একসঙ্গে দু’পেগ ঢেলে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে মউ বলল, ‘একটা নয়, বেশ কয়েকটা। এই যেমন, রিয়াজ আর মকবুলকে আজ পাঠিয়েছিলে দেবদূতকে পেটানোর জন্য? দেবদূতকে তুমি কতটুকু জানো?’
‘তুমি চেনো না কি?’
গ্লাসে চুমুক দিয়ে মউ বলল, ‘সেটা বড় কথা নয়। আমি এমন একটা পেশায় আছি, সব খবর হাতের মুঠোয় চলে আসে। কাজটা করতে পাঠানোর আগে তোমার উচিত ছিল আমার হেল্প নেওয়া। তুমি কি জানো, দেবদূত কাল রাতেই ব্যাঙ্কক চলে যাচ্ছে, মি. এশিয়া কনটেস্টে পার্টিসিপেট করতে? দিন পনেরো এমনিতেই ও কলকাতায় থাকবে না। ওর অ্যাবসেন্সে তুমি তো স্বচ্ছন্দে তোমার কাজটা করাতে পারতে। এখন ঠেলা সামলাও। শোনো, ব্যাঙ্কক থেকে দেবদূত যদি চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরে আসে, তা হলে কলকাতা পুলিশে বিরাট চাকরি পেয়ে যাবে। আর তোমার চিরশত্রু হয়ে থাকবে। সেটা কি তোমার পক্ষে ভাল হবে?’
‘তুমি এত খবর পেলে কোত্থেকে? মারিয়া বলল বুঝি?’
‘তোমার কাছে লুকোব না। ইয়েস, মারিয়ার কাছেই শুনলাম। কিন্তু তার আগে আমি আমার এক কলিগকে দেবদূতের কাছে পাঠিয়েছিলাম ইন্টারভিউ নিতে। গতকাল আমাদের চ্যানেলে সেটা দেখানোও হয়েছে আধঘণ্টা ধরে। ছেলেটার ইমেজ এত ভাল যে, অন্তত একশো ফোন কল এসেছে ওকে গুডউইশ জানিয়ে।
যাতে ব্যাঙ্ককে ও চ্যাম্পিয়ন হতে পারে। তুমি কিন্তু গাড্ডায় পড়ে গেলে রুস্তমদা।’
‘কেন, দেব কিছু অ্যান্টি বলেছে না কি আমার সম্পর্কে?’
‘বলেনি। কিন্তু আমার আন্দাজ বলছে, রিয়াজরা পুলিশের কাছে ডেফিনিটলি বলে দিয়েছে, তোমাকে সুপারিটা কে দিয়েছিল? আমার কথা শোনো, আজকের ফয়দার কথা ভেবে কোনও কাজ করতে নেমো না রুস্তমদা। কালকের কথা ভেবো।’
শুনে গুম হয়ে খানিকক্ষণ বসে রইল রুস্তম। আজ পর্যন্ত কেউ ওকে জ্ঞান দেওয়ার সাহস পায়নি। মউ অবলীলায় দিয়ে যাচ্ছে। এক চুমুকে গ্লাস খালি করে দিয়ে ও বলল, ‘আমার আর কী ভুল হয়েছে, শুনি।’
‘ধিংড়া লোকটাকেই বা তুমি কতখানি চেনো রুস্তমদা? কেন কাল রাতে ওর কথায় কল সেন্টারটা ভাঙচুর করতে গেলে? স্টিফেন ম্যানসনে কেউ লোকটাকে পছন্দ করে না। অনেকেই জেনে গেছে, ও তোমার মদত নিচ্ছে। একটা কথা তোমাকে বলে রাখি। গায়ের জোরে সবকিছু হয় না। স্টিফেন ম্যানসনের ইতিহাসটা তুমি জানো না। তাই আগুনে হাত দিয়ে ফেলেছ। যে ফ্ল্যাটটা দখল করে তুমি আনন্দী শরাফকে দিতে চাইছ, সেটা কার জানো?’
প্রশ্নটা করে গ্লাসে ফের চুমুক দিল মউ। উত্তরের জন্য সরাসরি মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রুস্তম উত্তরোত্তর অবাক হচ্ছে। মেয়েটা এত খবর জানল কী করে? ও পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কার?’
‘একশো বছর আগে যারা লিজ নিয়ে বিল্ডিং বানিয়েছিলেন, সেই গ্রেগরিয়ান ফ্যামিলির। এখন বিল্ডিংয়ের মালিক অবশ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেণ্ট, যেটা চালায় তোমাদের পার্টি। কিন্তু গ্রেগরিয়ান ফ্যামিলির সঙ্গে গভর্নমেণ্টের চুক্তি আছে, কোনও পরিস্থিতিতেই ওদের ফ্ল্যাট থেকে উৎখাত করা যাবে না। ওই ফ্ল্যাট কেনা-বেচার পার্মিশনও গভর্নমেণ্ট দেবে না। এই গ্রেগরিয়ান ফ্যামিলি এখন থাকে আর্মেনিয়া বলে একটা দেশে। এত পাওয়ারফুল ওরা, ওদের সঙ্গে এত রাশিয়ান কানেকশন, তোমাকে পুঁতে দিতে ওদের একটা দিনও লাগবে না। না জেনে কেন তুমি ওই ফ্যামিলির মেয়েটাকে চমকাতে গেলে? বুড়োটা ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েটা যাতে থাকতে না পারে, তার ব্যবস্থা আমিই করতে পারি। কত দেবে বলো? আনন্দী ম্যাডাম তোমাকে যা দিচ্ছে, তার টেন পার্সেন্ট আমায় দিলে দু’দিনের মধ্যেই মেয়েটাকে…’ কথা শেষ না করে মউ তুড়ি মেরে দেখাল।
মউ কি সত্যি কথা বলছে? না কি ভয় দেখাচ্ছে? এই সামান্য ব্যাপারে রাশিয়া কেন মাথা ঘামাতে যাবে? মিলেনাকেই বা ফ্ল্যাট থেকে ও তাড়াবে কি করে? সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে রুস্তম ভাল করে তাকাল মউয়ের দিকে। ওর খালি গ্লাসটা টেনে নিয়ে মউ স্কচ ঢালছে। ওর পরনে ব্রা-হীন একটা পাতলা টপ। ঝুঁকে আছে বলে ওর ক্লিভেজ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ইচ্ছে করে দেখাচ্ছে, না কি কেউ দেখলেও ওর কিছু যায় আসে না… রুস্তম বুঝতে পারল না। তবে আন্দাজ করতে পারল, শুভঙ্কর কেন মেয়েটার ফাঁদে পড়েছিল? অসম্ভব সেক্স অ্যাপিল মেয়েটার মধ্যে। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে রুস্তম বলল, ‘আমি রাজি। পাঁচ লাখ?’
গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে মউ বলল, ‘ডান। শোনো রুস্তমদা, বিজন মার্ডার, পাইপ কলোনির আগুন আর আফজলমিঞার ছেলের অ্যাক্সিডেন্টের কেসে তুমি অলরেডি পুলিশের র্যাডারে আছ। আপাতত স্টিফেন ম্যানসন থেকে তুমি হাত তুলে নাও। দেখবে, তোমার লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না।’
এখনও এক সপ্তাহও হয়নি মউয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ও এত সব জানল কী করে? প্রশ্নটা রুস্তমের মনের মধ্যে উঠেই মিলিয়ে গেল। বরাবর ও মিডিয়া থেকে দূরে থেকেছে। ওর কোনও অনুষ্ঠানে কালেভেদ্রে কোনও রিপোর্টার এলে, তাদের খাতিরদারিতে রুস্তম কোনও ত্রুটি রাখেনি। কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনওদিন কোনও কিছু প্রত্যাশা করেনি। মউকে ক’দিন ধরে কাছ থেকে দেখে রুস্তমের মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছে ডানা মেলছে। ওর মনে হচ্ছে, পলিটিক্যাল ফিল্ডে ও যে উচ্চতায় পৌঁছতে চাইছে, তার সিঁড়িটা পেয়ে গেছে। আরও ঘণ্টাখানেক কথা বলে, আরও তিন পেগ উদরস্থ করে রুস্তম যখন উঠে দাঁড়াল, তখন মউ জিজ্ঞেস করল, ‘শুভঙ্কর আপাতত দমদম সেন্ট্রাল জেলে আছে। জেলের ভিতর তোমার চেনাজানা কেউ আছে রুস্তমদা?’
একটু মনে করে রুস্তম বলল, ‘কয়েদিদের কথা বলছ? না কি জেলের কর্তা?’
‘সাজাওয়ালাদের কথা বলছি।’
শাস্তি পেয়ে যারা জেল খাটছে, তাদের সাজাওয়ালা বলে। এই শব্দটা মউ জানল কী করে? মেয়েটা সব জানে, ধরে নিয়েই রুস্তম বলল, ‘বেশ কয়েকজন আছে। তাদের মধ্যে একজন লাইফার। রেপ অ্যান্ড মার্ডার চার্জের জন্য। খুব ডেঞ্জারাস টাইপের ছেলে… নীলু। কেন বলো তো?’
‘তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে?’
‘হ্যাঁ, কিছু বলতে হবে? তোমার সামনে এখনই বলে দিতে পারি।’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে, তার পর মউ হিসহিস করে বলল, ‘নীলুকে বলো, জেলের ভিতর শুভঙ্করকে যেন শান্তিতে থাকতে না দেয়। এমন অত্যাচার করতে বলো, ভবিষ্যতে নেকেড মেয়েদের দেখলেও যেন ওর পেনিস…’ বাকিটা মুখে আর বলল না মউ। আঙুল তুলে বলল, ‘আর না দাঁড়ায়।’
(চুয়াল্লিশ)
দূরে কোথাও কড়াৎ করে বাজ পড়ল। অগ্নিদেব পিছন ঘুরে আকাশের দিকে হাত দেখালেন। যেন বাজ পড়া বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। ঝড় ওঠার পর থেকে সামালিতে অবাস্তব সব ঘটনা ঘটছে। শিখিনের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, স্বয়ং অগ্নিদেব… তাঁর সামনে এসে হাজির হয়েছেন। বইমেলায় কেনা পটুয়ার আঁকা ছবির মতো, কয়েক হাজার আগেকার এক পৌরাণিক চরিত্র দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এটা কী ভাবে সম্ভব? ঘরের ভিতর টেবলের উপর মোবাইল ফোনটা পড়ে আছে। থ্রি পিক্সেল ক্যামেরার। অগ্নিদেবকে ক্যামেরা বন্দী করে রাখার ইচ্ছে হল শিখিনের। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল, অনিরুদ্ধ চেষ্টা করেও ছবি তুলতে পারেনি। তিনি পারবেন কী করে?
রোজ যে স্ত্রোত্র পাঠ করে তিনি অগ্নিদেবকে ফুল দেন, সেটা ভুলে গেলেন শিখিন। হাতজোড় করে শুধু তিনি বলতে পারলেন, ‘আমার প্রণাম গ্রহণ করুন দেব।’
চতুর্থ হাত তুলে আশীর্বাদ করে অগ্নিদেব বললেন, ‘ভাল থাকিস। আমাকেও ভাল রাখিস।’
‘আমি ক্ষুদ্র মানুষ। আমার কী-ই বা ক্ষমতা। কী করে আপনাকে আমি ভাল রাখব মহাত্মন?’
‘কোথাও আগুন নেভাতে যাস না। তা হলেই আমাকে ভাল রাখতে পারবি। ইদানীং অনেক শাস্ত্রবিরোধী কাজ করেছিস তোরা। তার শাস্তি কিন্তু খুব শিগগির পাবি।’
‘আমরা শাস্ত্রবিরোধী কী কাজ করেছি মহাত্মন?’
ঘরের ভিতর ঢুকে এলেন অগ্নিদেব। তার পর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন ‘করিসনি? শহরের চারটে প্রান্তে টানা একশো আট দিন ধরে মহাযজ্ঞ হওয়ার কথা ছিল, সেটা বন্ধ করে দিসনি? অগ্নিপুরাণে তো আমি স্পষ্ট করে বলেই রেখেছি, জগতের হিতের জন্য কেন যজ্ঞ করা উচিত?’
মহাযজ্ঞের কথা মনে পড়ে গেল শিখিনের। কলকাতার কিছু ধনী মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী ওই মহাযজ্ঞ করতে চেয়ে দমকলের কাছে পার্মিশন চেয়েছিলেন। কোন এক জ্যোতিষী না কি বলেছেন, অল্পদিনের মধ্যে চিন থেকে এক ধরনের ভাইরাস ছড়াবে এদেশে। প্রচুর লোক মারা যাবে। সেটা যাতে না হয়, সেই কারণেই একশো আটদিন ধরে এই মহাযজ্ঞ। কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। শিখিনরা যজ্ঞের অনুমতি দেননি পরিবেশ দূষণের কথা ভেবে। প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে হাজার হাজার টন কাঠ-ঘি পোড়ালে কলকাতার অবস্থা দিল্লির মতো হয়ে যাবে। বড় কথা, মারোয়াড়ি সমিতি ডোমেস্টিক এরিয়ায় যজ্ঞ করতে চেয়েছিল। সেই অনুমতি দেওয়া সম্ভব ছিল না।
একটা উত্তর দিতেই হবে অগ্নিদেবকে। তাই বিনম্রতার সঙ্গে শিখিন বললেন, ‘অগ্নিপুরাণ আমি পড়েছি মহাত্মন। নিজের মুখে বশিষ্ঠ মুনিকে আপনি সব বিধান দিয়ে গেছেন। কিন্তু পুরাণ আমলে পরিবেশ দূষণ সম্বর্কে লোকের আইডিয়া ছিল না। আইন বলেও কিছু ছিল না। মহাযজ্ঞ করলে এখন সাধারণ মানুষের খুব অসুবিধে হবে। স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমরা আটকে দিয়েছি।’
‘ভাল করিসনি শিখিন। কয়েক হাজার বছর পর ফের আমার অগ্নিমান্দ্য হয়েছে। জঠরজ্বালায় আমি সারা পৃথিবী ঘুরে বেরাচ্ছি। পাতালের দাবানলও আমার ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতে পারল না। তোদের এই জনপদ আমি নিশ্চিহ্ন করে দেবো ভাবছি।’
পুরাণের আমলে পাতাল বলতে লোকে দক্ষিণ গোলার্ধকে বোঝাত। অর্থাৎ কী না নর্থ আর সাউথ আমেরিকা। অগ্নিদেব ব্রাজিলের দাবানলের কথা বলছেন। তাঁর মুখে রোষের চিহ্ন দেখে শিখিন বললেন, ‘দয়া করুন দেব। আপনি রুদ্রমূর্তি ধরলে লক্ষ লক্ষ প্রাণীর জীবনহানি হবে।’
‘আমি তো সেটাই চাই। না হলে আমার উদরপূর্তি হবে না।’ বলে ঘরের ভিতর আরও দু’পা এগিয়ে এলেন অগ্নিদেব। টেবলের উপর রাখা মহাভারত বইটা হাতে তুলে নিয়ে উনি বললেন, ‘এটা পড়ছিলি বুঝি? তা হলে তো আমার খাণ্ডবদাহের কথাও পড়ে ফেলেছিস।’
চট করে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল শিখিনের। বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে রোজ সন্ধেবেলায় গা ধুয়ে এসে মা চৌকির উপর বসে মহাভারত পড়তেন। সহজ কথায় পাণ্ডব-কৌরবদের গল্প বলে যেতেন। তখন শিখিনের বয়স দশ-এগারো। ওয়াটারপোলো খেলাটা নিয়ে মাতেননি। ওই বয়সে মনের মধ্যে একবার কিছু ঢুকে গেলে সেই স্মৃতি সারাজীবন থেকে যায়। শিখিন বললেন, ‘ছোটবেলায় মা পড়ে শোনাতেন। কিন্তু আমার অত মনে নেই। আপনিই বলুন না, কেন খাণ্ডবদাহ করেছিলেন?’
আগ্রহ দেখে রোষ সংবরণ করলেন অগ্নিদেব। বললেন, ‘শোন তা হলে। প্রাচীনকালে শ্বেতকি বলে এক রাজা ছিলেন। তিনি নিরন্তর যজ্ঞ করতেন। পুরোহিতরা একটা সময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। সর্বদা যজ্ঞের ধোঁয়ার মধ্যে থাকার জন্য তাঁদের চক্ষুপীড়া দেখা দিচ্ছিল। একটা সময় পুরোহিতরা আর যজ্ঞ করতে চাইলেন না। তখন রাজা শ্বেতকি আর কী করেন। মহাদেবের তপস্যা করতে লাগলেন। কঠিন সেই তপস্যা। শেষে মহাদিদেব তুষ্ট হয়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। শ্বেতকিকে বললেন, তোর কী বর চাই বল। রাজা তখন বললেন, আমার পুরোহিতরা আর যজ্ঞ করতে চাইছেন না। আমি চাই, আপনি নিজে আমার যজ্ঞের পুরোহিত হোন।’
অগ্নিদেব এই পর্যন্ত বলার পর শিখিনের মনে পড়ল, হ্যাঁ, রাজা শ্বেতকির কথা মায়ের মুখে শুনেছেন। এই সেই রাজা, যাঁর জন্য অগ্নিদেবের অগ্নিমান্দ্য হয়েছিল। মা বলেছিল, রাজার প্রস্তাবে মহাদেব পুরোহিত হতে রাজি হননি। সম্ভবত, দুর্বাসা মুনির উপর মহাদেব এই দায়িত্বটা দিয়েছিলেন। বারো বছর লেগেছিল যজ্ঞ সম্পন্ন হতে। এত বছর ধরে যজ্ঞের ঘি পান করে অগ্নিদেব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর অরুচি রোগ হয়েছিল। কথাগুলো মনে পড়ায় শিখিন সোৎসাহে বললেন, ‘মহাত্মন, পরের কিছু ঘটনা আমার মনে পড়ছে। অরুচি রোগের প্রতিকার জানতে চেয়ে আপনি ব্রহ্মার দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তাই না?’
‘ঠিক তাই। ব্রহ্মা আমাকে বললেন, তুমি খাণ্ডবপ্রস্থে চলে যাও। সেখানে বিশাল বনে অসংখ্য প্রাণী বাস করে। তুমি খাণ্ডববন দাহ করে সেখানকার প্রাণীদের মেদ ভক্ষণ করো। তা হলে তোমার অরুচি রোগ সেরে যাবে। ব্রহ্মার কথা শুনে আমি খাণ্ডববনে গেলাম। দাহ করতে গিয়ে দেখি, শতসহস্র হস্তী এসে হাজির। শুড় দিয়ে জলসেচন করে তারা আগুন নিভিয়ে ফেলছে। তাদের সাহায্য করছে, বিশাল সব পঞ্চমুখী নাগ আর অনেক প্রাণী। সাত-সাতবার চেষ্টা করেও আমি সফল হতে পারিনি। তার পর কী হয়েছিল, জানিস?’
জানেন, শিখিনের মনে পড়ছে। তিনি বললেন, ‘জানি মহাত্মন, ফের আপনি ব্রহ্মার কাছে যান। তখন উনিই আপনাকে পরামর্শ দেন, শ্রীকৃষ্ণ আর অর্জুনের কাছে যেতে। সুভদ্রাহরণের পর সেইসময় ওঁরা দু’জন খাণ্ডববনেই বিহার করছিলেন। আমি কি ঠিক বলছি মহাত্মন?’
‘হ্যাঁ, একদম ঠিক। ব্রহ্মা আরও বলেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ আর অর্জুন যদি তোমার সহায় হন, তা হলে কেউ তোমাকে রুখতে পারবে না। দেবরাজ ইন্দ্রও না। ব্রহ্মার কথা শুনে আমি খাণ্ডববনের কাছেই যমুনা নদীর ধারে এক প্রমোদ আবাসে গেলাম। এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধরে বললাম, আমি বহুদিন অভুক্ত। তোমরা আমার ভোজনের ব্যবস্থা করো। ওঁরা জিজ্ঞেস করলেন, কোন ধরনের খাদ্য আপনার পছন্দ? তখন আমি নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি অন্ন চাই না। আমি এই খাণ্ডববন ভক্ষণ করতে চাই। কিন্তু এই বনে নাগরাজ তক্ষক বাস করেন। তাঁর পরম মিত্র হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। আমি যখনই খাণ্ডববন দগ্ধ করতে আসি, তখনই ইন্দ্র এসে বাধা দেন। আর আমাকে পালিয়ে যেতে হয়। তোমরা দু’জন উত্তম অস্ত্রবিদ। তোমরা সহায় হলে আমি খাণ্ডববন দাহ করতে পারব। অন্য কিছু নয়, আমার এই ভোজনই চাই।’
একটা আস্ত বন খেয়ে ফেলার ঘটনা বাস্তবে কতটা সম্ভব, তা নিয়ে মাকে প্রশ্ন করার মতো বয়স তখন শিখিনের হয়নি। কিন্তু তাঁর পড়ে গেল, অগ্নিদেবকে তখন অর্জুন বলেছিলেন, ‘আমরা এখানে প্রমোদবিহারে এসেছি। ইন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো ধনুক এখন আমার কাছে নেই। তবে, আমার কাছে অনেক দিব্যবাণ আছে। এখানে শ্রীকৃষ্ণও নিরস্ত্র। তিনিও জানতেন না, যুদ্ধে নামতে হবে। আপনি যদি অস্ত্র জোগাড় করে দেন, আমরা তা হলে ইন্দ্রের মোকাবিলা করতে পারি।’ খাণ্ডবদাহ পর্ব শোনানোর সময় মা সেদিন গাণ্ডীব ধনুকের কথা বলেছিল। গাণ্ডীবের কথা শিখিনের মনে আছে এই কারণে যে, ধনুকটা গণ্ডারের মেরুদণ্ড দিয়ে তৈরি। যা অর্জুনকে পরবর্তীকালে অজেয় করে তুলেছিল।
শিখিন বললেন, ‘অর্জুন আর শ্রীকৃষ্ণকে আপনি অস্ত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু কার কাছ থেকে চেয়ে মহাত্মন, মনে করতে পারছি না।’
অগ্নিদেব বললেন, ‘লোকপাল বরুণের কাছ থেকে চেয়ে। অর্জুনকে গাণ্ডীব ধনু, কয়েক অক্ষয় তূণীর আর কপিধ্বজ রথ দিয়েছিলাম। আর কৃষ্ণকে একটা চক্র আর কৌমদকী নামে একটা গদা। কৃষ্ণার্জুনের রথে চেপে তার পর আমি খাণ্ডববন ভক্ষণ করতে লাগলাম। বনের পশু-পক্ষী চিৎকার করে পালাতে গেল। কিন্তু অর্জুনের বাণে বিদ্ধ হয়ে আগুনে পড়তে লাগল। বনে বসবাসকারী কোনও প্রাণী রক্ষা পেল না। আগুনের শিখা আকাশ স্পর্শ করছে দেখে দেবতারা ভয় পেয়ে গেলেন। তক্ষককে বাঁচানোর তাগিদে ইন্দ্র তখন যুদ্ধে নামলেন। ইন্দ্রের আদেশে মেঘ সহস্রধারায় জল বর্ষণ করতে লাগল। কিন্তু আমার তেজে সেই জল ধরিত্রী পর্যন্ত পৌঁছল না। আকাশেই শুকিয়ে যেতে থাকল। ইন্দ্রের সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল অর্জুন আর শ্রীকৃষ্ণের। অসুর, রাক্ষস, যক্ষ, গন্ধর্বরাও ইন্দ্রের পাশে এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু গাণ্ডীবের বিক্রমের কাছে মাথা নত করে সবাই পালিয়ে যেতে থাকলেন।’
অগ্নিদেব এত সুন্দর যুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছেন, শিখিনের মনে হতে লাগল, যেন তাঁর চোখের সামনেই তা ঘটছে। সত্যিই আকাশে বৃষ্টি আর ঝোড়ো বাতাসের তাণ্ডব চলছে। অন্তরীক্ষ থেকে ইন্দ্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন কি না, তা বোঝার উপায় শিখিনের নেই। মায়ের মুখে তিনি শুনেছেন, যুদ্ধের শেষদিকে ইন্দ্র মন্দর পর্বতের একটা শৃঙ্গ ছুঁড়ে মেরেছিলেন অর্জুনের দিকে। কিন্তু অর্জুনের বাণে সেই শৃঙ্গ সহস্রখণ্ড হয়ে পড়েছিল খাণ্ডববণে। বহু প্রাণী তাতে নিহত হয়েছিল। যুদ্ধ থেমে গেছিল এক অশরীরিণী দৈববাণীর পর। ‘ইন্দ্র, তোমার সখা তক্ষক এখন খাণ্ডববনে নেই। তিনি আছেন কুরুক্ষেত্রে। যুদ্ধ থেকে তুমি বিরত হও। অর্জুন আর শ্রীকৃষ্ণকে তুমি হারাতে পারবে না।’ দৈববাণী শুনে ইন্দ্র আর যুদ্ধে অংশ নেননি। এর পর টানা পনেরো দিন ধরে অগ্নিদেব খাণ্ডববন ভক্ষণ করেন। তাঁর অরুচি রোগ সেরে গেছিল।
কোথাও থেকে পোড়া গন্ধ ঘরের ভিতর ভেসে আসছে। আবার কোনও গাছে বাজ পড়ল না কি? জানলার দিকে তাকাতেই শিখিন অবাক হয়ে দেখলেন, বাইরে পুরো বাগান জুড়ে কালো ধোঁয়া। আম, জাম, কলা, নারকেল কোনও গাছ দেখা যাচ্ছে না। অদ্ভুত, ধোঁয়াটা ক্রমশ সাদা হয়ে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে সাধারণত কোনও কেমিক্যাল পুড়লে কালো ধোঁয়া হয়। একে তো এখানে কোথাও কেমিক্যাল নেই, তার উপর ধোঁয়ার রংই বা বদলে যাচ্ছে কী করে, শিখিন তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেন না। কালো ধোঁয়া ধীরে ধীরে ঘরটাকেও গ্রাস করে ফেলছে। অগ্নিদেবকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। ক্যানিং স্ট্রিট চত্বরে নন্দরাম মার্কেটে একবার আগুন নেভাতে গিয়ে শিখিন কালো ধোঁয়ার ট্র্যাপে পড়ে গিয়েছিলেন। মাস্ক পরা ছিল, তবুও বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন সেদিন। সেই ভয়ঙ্কর দিনটার স্মৃতি ফিরে আসায় কোনও রকমে তিনি বললেন, ‘অগ্নিদেব, আপনি কোথায়?’
ধোঁয়ার মধ্যে থেকে অগ্নিদেবের গলা ভেসে গেল, ‘জিজ্ঞেস করে লাভ কী? তোকে সাবধান করে দিতে এসেছিলাম। বুঝলাম, তুই গুরুত্ব দিচ্ছিস না। শুনে রাখ, শিগগির তোর খুব বদনাম হয়ে যাবে। অনিরুদ্ধকে বলিস, আর যেন আমার পিছু না নেয়। আচ্ছা, চলি তা হলে।’
চোখের সামনে শুধু অন্ধকার। ধোঁয়ার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সামালিতে মাস্ক কোথায় পাবেন? ভেজা গামছা পেলেই আপাতত কাজ চলে যেত। শিখিনের মনে পড়ল, সামালিতে আসার পর হাত-পা ধুয়ে, বারান্দার দড়িতে তিনি ভিজে গামছাটা মেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু অন্ধকারে হেঁটে বারান্দায় তিনি যাবেন কী করে? বাধ্য হয়ে তিনি চিৎকার করে ডাকতে গেলেন, ‘ইদ্রিস, একবার আমার ঘরে এসো।’ কিন্তু অবাক কাণ্ড, গলা দিয়ে স্বর বেরল না। ঘর থেকে তিনি একবার বেরোনোর চেষ্টাও করলেন। কিন্তু টের পেলেন, দু’পা কেউ যেন স্ক্রু দিয়ে আটকে দিয়েছে। এগোনোর চেষ্টা করলেই ধপ করে পড়ে যাবেন। অগ্নিদেব কি তাঁর সারা শরীর অবশ করে দিয়ে গেলেন? ভাবতেই শিখিন ভয় পেয়ে গেলেন।
কতক্ষণ ওইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, শিখিন জানেন না। তাঁর চটক ভাঙল, ইদ্রিসের ডাকে, ‘ছ্যার উঠেন। এই তো আবনারে দেখখে গেলাম। কহন ঘুমায়ে পড়লেন?’
চোখ মেলে ইদ্রিসকে দেখে ধড়ে প্রাণ ফিরে গেলেন শিখিন। ইজিচেয়ারেই আধশোয়া হয়ে রয়েছেন তিনি। বাইরে ঝকঝকে রোদ্দুর। কোথাও বৃষ্টির চিহ্নমাত্র নেই। মহাভারতের পৃষ্ঠা ওল্টানোর ফাঁকে তা হলে কি তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? অগ্নিদেবকে স্বপ্নে দেখেছেন? বিমূঢ় অবস্থায় শিখিন তাকিয়ে রইলেন ইদ্রিসের দিকে। ওর হাতে ট্রে, ডিশে কিছু ভাজাভুজি। ও বলল, ‘ছ্যার, কয়েগডা কুমড়ো ফুল পেইড়ে রেখেছিলাম। ফরিদা ব্যাসন দিয়ে ভেইজে দিয়েছে। টেস করে দ্যাখেন, ভাল লাইগবে।’
শিখিন জিজ্ঞেস করতে যাবেন, ‘ক’টা বাজে রে?’
তখনই মাইকে আজান শুনতে পেলেন তিনি। গ্রামে ঢোকার মুখে একটা মসজিদ আছে। দিনে পাঁচওয়াক্ত আজান দেওয়া হয় সেখান থেকে। শুনে ইদ্রিস বলল, ‘ছ্যার, জহুরের নামাজ পড়ার সময় হইয়ে গেছে। বেলা সাড়ে বারোডা বাজে বলি মনে হয়। আমি বাড়িতে যাই, নামাজ পড়তি হবে।’ কথাগুলো বলে দরজার দিকে কয়েক পা এগিয়েও ফিরে এল ইদ্রিস। বলল, ‘হায় হাইরে… ওই দ্যাখেন ছ্যার। কত্ত বড় এগডা খাসি ঘুইরে বেরাচ্ছে বাগানে। গায়ের রং মিশকালা। মুইষের মতোন গাট্টাগোট্টা। আইল কোতথনে? গাঁয়ে এত্ত বড় খাসি তো কুনও বাড়িতে দেখি নাই!’
ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন শিখিন। দেখলেন, বড়সড় শরীরের একটা ছাগল বেড়ার গায়ে দাঁড়িয়ে গাছের পাতা চিবুচ্ছে। দেখেই চমকে উঠলেন তিনি। আরে, এর পিঠে সওয়ার হয়েই তো অগ্নিদেব খানিক আগে তাঁর কাছে এসেছিলেন। তা হলে, স্বপ্নে নয়, যা দেখেছিলেন, তা সত্যি!!