স্টিফেন ম্যানসন – ৩৫

(পঁয়ত্রিশ)

মোকাম্বো রেস্টুরেন্টের ফুটপাতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে অনি বলল, ‘স্যার, উল্টো দিকে তাকিয়ে দেখুন, একটা লোক আমাদের ওয়াচ করছে।’

সিলভার জিম থেকে অফিসের দিকে ফিরছেন শিখিন আর অনিরুদ্ধ। জিম-এ কমই দেখা হয় দু’জনের মধ্যে। আজ হঠাৎ একই সময়ে হাজির হয়েছিল। সন্ধে ছ’টা, উল্টোদিকের ফুটপাত দিয়ে অনবারত লোক হাঁটছে। কার কথা অনি বলল, শিখিন বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, কোন লোকটা রে?’

হাঁটতে হাঁটতেই অনি বলল, ‘লাল হাফ হাতা শার্ট, লাল পায়জামা পরা একটা লোক। মাথায় হলুদ ফেজ আছে। ফর্সা, ইরানিদের মতো দেখতে। একটু ভারিক্কি চেহারার।’

ফের উল্টোদিকের ফুটপাতে তাকিয়ে লাল শার্ট-পায়জামা পরা কাউকে দেখতে পেলেন না শিখিন। লোকটা ওদের ওয়াচ করবেই বা কেন? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকটাকে চিনিস না কি? আগে কোথাও দেখেছিস বলে মনে হয়?’

‘স্যার আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। যেদিন এই লোকটাকে দেখি, সেদিনই কোথাও না কোথাও আগুন লাগে। লোকটার মুখোমুখি হয়ে গেলে এটা হয়। আমার দিকে তাকিয়ে একবার শুধু হাসে।’

‘কতবার তোর এই অভিজ্ঞতাটা হয়েছে রে?’

‘বারপাঁচেক হবে। প্রথম দেখি, যেদিন হেস্টিংসে আগুন নেভাতে গেছিলাম। মোবাইলে ছবিও তুলে রেখেছিলাম। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে দেখি, ছবিটা ওঠেইনি। পাঁচবারই এই এক্সপিরিয়েন্স হল। ছবি তুলে রেখেছি, অথচ ওঠেনি।’

‘স্ট্রেঞ্জ। আগে আমাকে বলিসনি তো?’

‘আগে লক্ষ্যই করিনি। তাই বলার মতো মনে করিনি। কিন্তু যেদিন আপনার কোয়ার্টারে অগ্নিদেবের ছবিটা দেখলাম, সেদিনই খেয়াল হল। ছবিটার সঙ্গে এই লোকটার মিল আছে। আরও অদ্ভুত কী জানেন, একেক দিন একেক চেহারায় দেখি। একদিন দেখলাম, লোকটা একটা কালো ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অফিসের ঠিক বাইরে। আরেকদিন দেখি, লোকটার দুটো মাথা। আজ দেখলাম, লোকটা হেঁটে যাচ্ছে আর ওর মাথা দিয়ে আগুনের শিখা বেরুচ্ছে।’

শুনে চমকে উঠে ফের একবার উল্টোদিকের ফুটপাতের দিকে তাকালেন। দোকানের রঙীন আলোগুলো একটা একটা করে জ্বলে উঠছে। পাশ দিয়ে জ্বলন্ত মাথা নিয়ে একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে, অথচ কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না, তা হয় না কি? দোকানের নিওন আলোয় অনির দৃষ্টিভ্রম হয়নি তো? ছেলেটা এত সিরিয়াস, হয়তো তাঁর মুখে অগ্নিদেবের কাহিনি শুনে খুব ভাবনাচিন্তা করেছে। সেই কারণে হ্যালুসিনিয়েশনও হতে পারে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘অগ্নিদেবকে নিয়ে বোধহয় খুব চর্চা করেছিস আজকাল, তাই না?’

‘হ্যাঁ স্যার। শুধু তাই নয়, কাল বইমেলায় গিয়ে অগ্নিদেবের একটা ছবিও কিনে এনেছি।’

‘বইমেলায় গেলি, অথচ আমাকে জানালি না কেন?’

‘অফিসে এসে শুনলাম, আপনি ডিজি-র কথায় বইমেলায় গেছেন। শুনে আমিও ডিউটি বদলে দৌড়লাম সল্ট লেকে। ওখানে আপনাকে আমি দেখেছি। আপনি তখন এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে গল্প করছিলেন ফুড স্টলের সামনে। ভদ্রমহিলাকে আমি প্রায়ই স্টিফেন ম্যানসনে দেখি। উনি ওখানে কল সেন্টারে কাজ করেন। তাই আপনাকে ডিসটার্ব করতে চাইনি।’

‘খুব অন্যায় করেছিস। কাছে গিয়ে কথা বললি না কেন? ভদ্রমহিলা আমার ছোটবেলার বান্ধবী।’

‘সরি স্যার, যেতাম। কিন্তু হঠাৎ ইচ্ছে হল, লিটল ম্যাগাজিনের স্টলগুলোর কাছাকাছি একবার ঘুরে আসি। যদি পটুয়াদের কাছে অগ্নিদেবের কোনও ছবি পাই। কী লাক ভাবুন, অদ্ভুত একটা ছবি পেয়েছি। আপনার ছবিটার থেকে আলাদা। তাই কিনে ফেললাম।’

শুনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পড়লেন শিখিন। অনির কাছ থেকে ভাল করে শোনা দরকার। বললেন, ‘চল, কোথাও বসে একটু কথা বলি।’

কাছেই একটা জুস-এর দোকান দেখে দু’জনে ঢুকে পড়লেন। ম্যাংগো জুস-এর অর্ডার দিয়ে শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘দুটো ছবির মধ্যে তফাতটা কী দেখলি রে?’

‘স্যার, আপনার কাছে যে ছবিটা আছে, তাতে অগ্নিদেবের গায়ের রং হলুদ। কিন্তু আমার ছবিতে টকটকে লাল। চুল, গোঁফ, দাঁড়ি গোল্ডেন ব্রাউন। বিগ্রহের চারদিকে সাত রংয়ের আভা। ছাগল নয়, একটা গণ্ডারের উপর তিনি বসে আছেন। ছবিটা আমার মোবাইলে আছে স্যার। দেখবেন?’

পকেট থেকে সেট বের করে অনি ছবিটা খুঁজতে লাগল। শিখিন মনে মনে রঙের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে বসলেন। অগ্নিদেব রক্তিম বর্ণ হতেই পারেন। আগুনের রং যে লাল। অগ্নিদেবের আইকোনোগ্রাফি নিয়ে চর্চা করেননি শিখিন। বেদে উল্লেখ আছে, অগ্নির স্থান দক্ষিণপূর্ব দিকে। ভারতের বেশিরভাগ হিন্দু মন্দিরে অগ্নি মূর্তি রাখা থাকে দক্ষিণপূর্বে। একেক অঞ্চলে মূর্তির রকমফের হতেই পারে। মোবাইলে তোলা ছবিটা বের করে এগিয়ে দিল অনি। আঙুরের ছোঁয়ায় এনলার্জ করে শিখিন দেখলেন, খুঁটিনাটি কয়েকটা ব্যাপার অনির চোখ এড়িয়ে গেছে। ছবিতে অগ্নির তিনটি মুখ। মাথা থেকে আগুনের শিখা বেরনোয় তৃতীয় মুখটা আড়ালে রয়ে গেছে।

‘কিছু বুঝলেন স্যার?’ অনি প্রশ্ন করল।

‘তৃতীয় মুখটা কিন্তু তোর চোখে পড়েনি।’ শিখিন বললেন, ‘অগ্নির বিচরণক্ষেত্র সর্বত্র। স্থলে, শূন্যে আর আকাশে, স্থলে তিনি আগুন, শূন্যে বজ্র, আর আকাশে তিনি সূর্য। এই তিনটে স্তরে তাঁর অস্তিত্বকে বেদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এমনভাবে যে, তিনিই ছিলেন দেবদেবী আর মানুষের মধ্যে বার্তাবাহক। তাই অগ্নিদেবের তিনটে মুখ থাকতেই পারে। তুই কি পটুয়ার কাছে খোঁজ করেছিলি, এই মূর্তিটা কোন মন্দিরের?’

‘জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, ভুবনেশ্বরের কোনও এক মন্দিরের।’

‘লোয়ার পোর্সনটা লক্ষ্য করেছিস অনি। অগ্নিদেবের প্রকাণ্ড ভূঁড়িটা? আমার কিন্তু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। দেবতাদের উৎসর্গ করা ভোগ্যবস্তু আর ঘি উদরস্থ করতে করতে ওঁর ভূঁড়ি হয়ে গেছে। শুনলে তুই অবাক হয়ে যাবি। এই বাহকের কাজটা করতে একটা সময় কিন্তু অগ্নি রাজি হননি। উনি পালিয়ে সমুদ্রগর্ভে চলে যান। দেবতারা ওঁকে যখন খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তখন মাছেরা ওঁর হদিশ দিয়ে দেয়। রেগে গিয়ে অগ্নি মাছদের অভিশাপ দেন, এরপর থেকে তোরা মানুষের খাদ্য হয়ে বিলুপ্ত হবি। সত্যিই এর পর মানুষ মাছ খেতে শুরু করে।’

বেয়ারা এসে ম্যাংগো জুস দিয়ে গেল। গ্লাসে চুমুক দিয়ে অনি জিজ্ঞেস করল, ‘ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। কিন্তু অগ্নি বেঁকে বসেছিলেন কেন স্যার?’

‘আমার খুব বেশি পড়াশুনো নেই। মাঝে একদিন এপিক বলে একটা চ্যানেলে দেখলাম, অগ্নিদেবের পালিয়ে যাওয়ার কারণ ছিল। বৈদিক যুগের শুরুতে অগ্নির অসম্ভব গুরুত্ব ছিল। মনে করা হত, তিনিই সৃষ্টি, রক্ষা আর বিনাশ কর্তা। তাঁর দুই যমজভাইয়ের একজন হলেন ইন্দ্র, অন্য জন সূর্য। কিন্তু বেদের পরবর্তী পৌরাণিক যুগে এঁরা পিছনের সারিতে চলে যান। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বররা প্রাধান্য পেতে শুরু করেন। সেই কারণেই অগ্নি রুষ্ট হতে থাকেন। তিনি অভিমান করেন, হোম যজ্ঞে দেবতাদের উৎসর্গ করা ভোগ্যবস্তু অর্থাৎ দেবতাদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির কারণে তাঁকে ব্যবহার করা হবে কেন?’

‘অগ্নির জন্ম কীভাবে হয়েছিল স্যার?’

‘প্রজাপতি ব্রহ্মার কপাল থেকে। ব্রহ্মাণ্ডের শুরুতে কিছুই ছিল না। না দিন, না রাত্রি। ব্রহ্মা অগ্নিকে নিয়ে এলেন। সেইসঙ্গে এল আলো এবং দিন। এর পরেই এল রাত্রি। অগ্নির জন্ম নিয়ে অন্য মতও আছে। বেদ, পুরাণ, উপনিষদে একেকটা সময়ে অগ্নির ভূমিকা নিয়ে অনেক জটিলতাও লক্ষ্য করা যায়। তুই যদি এপিক চ্যানেলটা নিয়মিত দেখিস, তা হলে হিন্দু মাইথোলজি নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারবি। ওই চ্যানেলে দেবদত্ত পট্টনায়ক বলে একজন বিশেষজ্ঞ আসেন। তিনি জলের মতো বুঝিয়ে দেন।’

‘বইমেলা থেকে স্যার এবার একটা বই কিনে এনেছি। অগ্নিপুরাণ। আপনি পড়েছেন?’

‘আগ্নেয়পুরাণ। বইটা আমার কাছেও আছে। অগ্নিদেব বলে যাচ্ছেন আর তা লিখে রাখছেন বশিষ্ঠ মুনি। বইটা পড়লে হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কে তোর অনেক কিছু জানা হয়ে যাবে। বুঝতে পারবি, বৈদিক যুগে হিন্দুরা কত উন্নতমানের ছিলেন। অগ্নিদেবকে তাঁরা মাথায় করে রেখেছিলেন। উপনিষদে অগ্নিদেবের প্রচুর প্রশস্তি আছে। আমাদের আলো দেখান, জ্ঞানের পথে নিয়ে চলুন। দেখবি, হিন্দুধর্মে কোনও আচারবিধিই অগ্নি ছাড়া সম্পন্ন হয় না। বিয়ের সময় আগুনকে মাঝে রেখে সাত পাক দিতে হয়। নশ্বর দেহ দাহ করার জন্য চিতার আগুন প্রয়োজন। পুজো আচ্চাতে তো বটেই, উৎসবের সময়ও প্রদীপ জ্বালিয়ে অগ্নিদেবকে সন্তুষ্ট করতে হয়। ফায়ার সার্ভিসে আসার আগে আমরা পড়ে এসেছি, ফায়ার ইজ দ্য র‍্যাপিড অক্সিডেশন অফ আ মেটিরিয়াল ইন দ্য এক্সোথেরমিক কেমিক্যাল প্রোসেস অফ কমবাসন, রিলিজিং হিট, লাইট অ্যান্ড ভেরিয়াস রিঅ্যাকশন প্রোডাক্টস। হিন্দু মাইথোলজি কিন্তু আরও গভীর কথা বলে।’

‘স্যার, অগ্নিপুরাণের প্রথম কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করা। কিন্তু এমন কঠিন মনে হচ্ছে যে, মাথায় ঢুকছে না।

‘একটু ধৈর্য্য ধরে পড়িস, সব বুঝতে পারবি। দুঃখের কথা কী জানিস, হাজার হাজার বছর আগে আমাদের মুনি-ঋষিরা যা ডিসকভার করে গেছেন, এখন তাতে আমরা বিজ্ঞানের শীলমোহর লাগাচ্ছি। ভাবছি, বিজ্ঞানীরা যেন নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেললেন। তা কিন্তু নয়। হওয়া উচিত উল্টোটা। জোরের সঙ্গে আমাদের বলা প্রয়োজন ছিল, আমাদের শাস্ত্রে ছিলই, তোমরা রিডিসকভার করেছ। অগ্নির কথাই ধর। অগ্নি যে বেসিক পাঁচটা এলিমেন্ট-এর অন্তর্গত, তা কিন্তু বৈদিক যুগের মুনি-ঋষিরাই প্রথম বলে গেছেন।’

‘জানি স্যার, আপনি কি পঞ্চভূতের কথা বলছেন? অগ্নি, বায়ু, জল, আকাশ ও পৃথিবী।’

‘কারেক্ট। আগুন কি, তা আদিমানবরা প্রথম চাক্ষুষ করেন, প্রাকৃতিক কারণে। বাজ পড়ার পর দাবানল দেখে। মস্তিষ্ক খাটিয়ে সেই আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনার, নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করার কাজটা প্রথম করেছিলেন ওঁরাই। ক্রমে ক্রমে ওঁরা বুঝেছিলেন, আগুন জ্বালালে বন্যপশুদের থাবা থেকে নিজেদের বাঁচানো যায়। আগুনের ধোঁয়া কীটপতঙ্গকে দূরে সরিয়ে রাখে। চরম ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচায়। আগুনে ঝলসে নেওয়া মাংস খেতে খুব সুস্বাদু লাগে। আগুনই এই পৃথিবীতে মানুষকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছিল বন্যপশুদের থেকে। অগ্নির গুরুত্বটা এমনি এমনি বাড়েনি। তাই আদি যুগে মানুষ অগ্নিকে দেবতার জায়গায় বসিয়েছিল। বৈদিক যুগে সেই অভিজ্ঞতাই মুনি-ঋষিরা শাস্ত্রে লিখে গেছেন। বেদ, পুরাণ, উপনিষদে আমরা তারই প্রতিফলন দেখতে পাই। মানুষ তখন মানত, অগ্নি হচ্ছেন শুদ্ধতা, পবিত্রতার প্রতীক। যে কোনও বস্তু আগুনে ছুঁইয়ে নিলে তা শুদ্ধ হতে বাধ্য।’

‘স্যার, এই কারণেই কি রামায়ণে সীতাকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল?’

‘ঠিক তাই। চারিত্রিক দুর্নাম কাটানোর জন্য সীতা অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করলেন। নিজেকে শুদ্ধ প্রমাণ করে ফের বেরিয়েও এলেন। পরবর্তীকালে অনেকেই শ্রীরামের এই বর্বরতার নিন্দা করেছেন। কিন্তু সেইসময় এটাই রেওয়াজ ছিল। আর সীতাও পরীক্ষা দিতে আপত্তি করেননি। এই যে, আগেকার দিনে মুনি ঋষিরা আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারতেন। তাদের কোনও শারীরিক ক্ষতি হত না। ওঁরা পারতেন কী করে? এখানকার বিজ্ঞান কি তার ব্যাখ্যা দিতে পারবে? আমার তো মনে হয়, না। এখনকার বিজ্ঞান বলে, তিন সেকেন্ডের বেশি সময় আগুনের সংস্পর্শে থাকা ক্ষতিকারক।’

অনি জুস-এর গ্লাস খালি করে ফেলেছে। দেখে শিখিন স্ট্র ফেলে দিয়ে জুস-এ চুমুক দিতে লাগলেন। হঠাৎ মনে পড়ল, অফিসে ঈশিতার আসার কথা সন্ধে সাড়ে ছ’টার সময়। ফোন করে ও বলেছিল, ‘আঙ্কল, জরুরি দরকার ছিল।’ অথচ তিনি আটকে গেছেন অগ্নিতত্ত্বের আলোচনাতে। এক চুমুকে গ্লাস ফাঁকা করে দিয়ে শিখিন উঠে দাঁড়ালেন। দেখলেন, অনি আগেই কাউন্টারে গিয়ে জুস-এর দাম মিটিয়ে দিয়েছে। পকেটে পার্সটা ঢুকিয়ে অনি বলল, ‘স্যার, অদ্ভুত লোকটাকে নিয়ে কী করা যায় বলুন তো?’

লোকটা মানে অগ্নিদেবের মতো দেখতে অদ্ভুত মানুষটা। অনির মাথায় একবার ঢুকে গেছে। ওকে ভোলানো কঠিন। শিখিন বললেন, ‘এখনই চেজ করতে যাস না। আরও দু’একবার ওয়াচ কর। তারপর না হয়, পুলিশের সাহায্য নেওয়া যাবে।’

জুস-এর দোকান থেকে বেরিয়ে অনি বলল, ‘না স্যার, এবার মুখোমুখি হলে ছাড়ব না। লোকটার পিছু নেবো। দেখব, আমাকে দেখা দিয়ে শেষপর্যন্ত কোথায় যায়?’

… কয়েক মিনিট পর দমকলের অফিসের সামনে পৌঁছে শিখিন দেখলেন, ঈশিতা দাঁড়িয়ে রয়েছে। উদ্বেগভরা মুখ, রেখা বা বাণীর কিছু হল না কি? গলার স্বরেও ভয়ের চিহ্ন। ঈশিতা বলল, ‘আঙ্কল, একটা বাজে ব্যাপার ঘটে গেছে।’

শিখিন বললেন, ‘কী হয়েছে রে?’

‘স্টিফেন ম্যানসনের লিজ হোল্ডার মি. কাজোরিয়া একটা উকিলের নোটিশ পাঠিয়েছেন আমার বিরুদ্ধে।’

এই ব্যাপার! স্টিফেন ম্যানসন নিয়ে ঈশিতার রিপোর্ট ঠিক জায়গায় ঘা দিয়েছে তা হলে। বাড়িটার ওপরের দিকে তিনটে তলা কর্পোরেশনের অনুমতি নিয়ে করা হয়নি। সেই কথাটাই ওর রিপোর্টে লিখেছিল ঈশিতা। অন্যায় কিছু লেখেনি। এত ভয় পাওয়ার কী আছে? শিখিন তাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘উকিলের নোটিশে ঠিক কী লেখা আছে?’

‘বাড়ির ওপরের দিকে তিনটে তলার অনুমতি কর্পোরেশন দিয়েছে। আমাদের কাছে ডকুমেন্টস আছে। চিঠিতে আরও লিখেছে, তিনদিনের মধ্যে রিজয়েন্ডার না ছাপলে আমার বিরুদ্ধে ওরা এক কোটি টাকার মানহানির মামলা করবেন। কী হবে আঙ্কল? আমরা চাকরি চলে যেতে পারে।’

শুনে শিখিন মুচকি হাসলেন। ভিমরুলের চাকে ঘা দিয়েছে মেয়েটা। ওর পাশে দাঁড়াতেই হবে। কর্পোরেশনের অনুমতি ছাড়া বাড়ির ওপরের তিনটে তলা তোলা হয়েছে, এটা সত্যি। আবার এটাও সত্যি, দশ বছর পর মি. কাজোরিয়ারা কর্পোরেশনে টাকাপয়সা খাইয়ে রেগুলারাইজড করে নিয়েছেন। শিখিনের কাছে সব নথিপত্র আছে। সরকারী ডকুমেন্ট কাউকে দেওয়া উচিত না। তবুও, শান্তগলায় শিখিন বললেন, ‘আমার সঙ্গে আয়। তোকে আমি ডকুমেন্টস দিয়ে দিচ্ছি। তোর চাকরি যাবে না।’

(ছত্রিশ)

মল্লিকবাজারে কোয়েলের বাড়ি থেকে জিমের দিকে ফিরছে দেব। রয়াল এনফিল্ড বাইকে ওর পিছনে বসে তমাল। রেস্টুরেন্টটা কীভাবে করবে, সেটা দেখাতে নিয়ে গেছিল তমাল। টুকটুক করে ও লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একজন ফাইনান্সার জোগাড় করে ফেলেছে। চাকরি করার মাঝে আলিপুর কোর্টে দৌড়োদৌড়ি করে মাসিমার উইল প্রোবেট করিয়ে নিয়েছে। বাড়ির একটা অংশের মালিক এখন কোয়েল। তমাল রেস্টুরেন্টের ব্লু প্রিন্ট বানিয়েছে, সিডনির এক কনসালট্যান্টকে দিয়ে। নামকরা একজন ইন্টেরিয়র ডেকর কোম্পানীকে কন্ট্রাক্ট দিয়েছে, যাতে রেস্টুরেন্টটা দেখতে সুন্দর হয়। সব দেখে দেবেরও মনে হচ্ছে, জায়গা নির্বাচনে তমাল ভুল করেনি। উল্টোদিকেই নিউরো সায়েন্সেস হসপিটাল। সারাদিন রোগীদের আত্মীয়স্বজনে ভিড় থাকে। কাস্টমারের অভাব হবে না তমালের।

কে বলে, বাঙালিদের নিয়ে বিজনেস হয় না? দেবের মাঝে মাঝে মনে হয়, বাঙালিরা ব্যবসায় নামলে গুজরাতি, মারোয়াড়িরা বাজার থেকে উড়ে যাবে। এত ইনোভেটিভ আইডিয়া কাদের আছে? একটু আগে তমাল বলছিল, ‘আমার রেস্টুরেন্টে একটা ইউনিক জিনিস চালু করব। ভাবছি, কেউ যদি বাবা-মাকে নিয়ে খেতে আসে, তাকে টোয়েন্টি পার্সেন্ট ছাড় দেবো। বাবা-মায়েরা বাড়ির কোণে পড়ে থাকেন। হয়তো তাদের রেস্টুরেন্টে খাবার সঙ্গতি নেই। আমি তাঁদের মুখে হাসি ফোটাব। এতে ফ্যামিলি বন্ডেজ বাড়বে। দেখবি, খুব পাবলিসিটিও পাবো।’

শুনে মনে মনে তারিফ করেছে দেব। তখনই মায়ের কথা ওর মনে পড়েছিল। একবার পুজোর সময় বাবার সঙ্গে কলকাতায় ঠাকুর দেখতে এসে মা বউবাজারের বঙ্গলক্ষ্মী রেস্টুরেন্টে খেয়েছিল। তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার কথা। মা কিন্তু আজও ভোলেনি সুক্তোর স্বাদ। দেব ঠিক করে নিয়েছে, তমাল যেদিন রেস্টুরেন্ট ওপেন করবে, সেদিনই মা আর রন্তিমাসিকে চণ্ডীতলা থেকে নিয়ে এসে খাওয়াবে। মা অবশ্য মাছ-মাংস খায় না। তাতে কী, সেদিন না হয় তমাল নিরামিষের ব্যবস্থা করবে। ওর রান্নায় যাদু আছে। সিলভার হোটেলের কিচেনটা ও-ই সামলায়। হোটেলে খাবার নিয়ে কারও কোনও কমপ্লেন নেই। হাজার প্লেটের রান্না তমাল অনায়াসে করে দিতে পারে। তবে, ওপেনিংয়ের দিনটা ও ঠিক করেছে, পয়লা বোশেখ। ওই দিন মা বাড়ি থেকে বেরতে পারবে কি না সন্দেহ।

বাইক চালানোর সময়ই দেব জিজ্ঞেস করল, ‘ফ্রেন্ড, তুই যে রেস্টুরেন্ট খুলছিস, আনন্দী ম্যাডাম জানে?’

তমাল বলল, ‘নিশ্চয়ই জানে। ওঁদের মতো কর্পোরেট খচ্চররা কাউকে বিশ্বাস করে না। সবার পিছনে লোক লাগিয়ে রাখে। আমার পিছনেও চ্যান বলে একটা ছেলেকে লাগিয়েছে। ছেলেটাকে দুবাই থেকে রিসেন্টলি নিয়ে এসেছে। আমার দিক থেকেও পিছুটান নেই, বুঝলি। আনন্দী ম্যাডাম কোয়েলের সঙ্গে যে দুর্ব্যবহারটা করেছে, ওঁকে কোনওদিন ক্ষমা করব না। এদিকে একটু গুছিয়ে নিয়ে, চাকরিটা ছেড়ে দেবো।’

‘কোয়েলকে তুই খুব ভালবাসিস, তাই না?’

‘এটা একটা প্রশ্ন হল ফ্রেন্ড? তোকে আগেও একবার বলেছি, রেস্টুরেন্ট খোলার আইডিয়াটা স্রেফ কোয়েলের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।’ কী একটা দেখে তমাল এর পরই বলে উঠল, ‘এই এই… বাইকটা একবার নার্সিং হোমের মধ্যে ঢুকিয়ে দে তো। একটা কাজ আছে, এদিকে এসেছি যখন, সেরে যাই।’

দেব তাকিয়ে দেখল, মিসেস বিলমোরিয়ার সেই নার্সিং হোম, যেখানে কোয়েলের মা ভর্তি ছিলেন। বাইকটা পার্কিং স্পেসের কাছে নিয়ে গিয়ে ও বলল, ‘আমি ওয়েট করব, না কি তোর সঙ্গে যেতে হবে?’

তমাল বলল, ‘তুই আয়। সামনে এই যে তুই কাফেটেরিয়াটা দেখছিস, সেটা আমার বন্ধু মনসুরের। সিডনিতে আমরা একসঙ্গে থাকতাম। ওর সঙ্গে আমার দরকার আছে।’

মাঝ দুপুর, নার্সিং হোমে লোকজন কম। তমালের সঙ্গে কাফেটেরিয়ায় ঢুকতেই সমবয়সি একটা ছেলে কাউন্টার ছেড়ে উঠে এসে বলল, ‘আসসালাম আলেইকুম তমালভাই, এইসময় তুই! কী মনে করে?’

এই ছেলেটাই তা হলে মনসুর।’ ‘ওয়ালেকুম আসসালাম।’ তমাল হাগ করে ছেলেটাকে বলল, ‘মিনিট পাঁচেক ফাঁকা আছিস? তোর সঙ্গে কথা বলা যাবে?’

‘ডোন্ট বি ফর্মাল তমালভাই। আগে বোস, কী খাবি বল।’

‘তার আগে তোর সঙ্গে আমার এই বন্ধুটার আলাপ করিয়ে দিই। এ হল দেবদূত। আমাদের জিম-এর চিফ ট্রেনার। মি. ইন্ডিয়া হয়েছিল। এ বার মি. এশিয়া হতে যাচ্ছে।’

মনসুর বলল, ‘জী জী, দেখেই বুঝতে পেরেছি। বডি বিল্ডিং না করলে এই শরীর হয় না। তোর কি মনে আছে, সিডনি অপেরাতে আমরা একবার ফিল হীথের শো দেখতে গেছিলাম? মি. ইউনিভার্স রে। দেবদূতের বডি তো আমার সেই ফিল হীথের মতোই মনে হচ্ছে।’

এটা বাড়াবাড়ি। তবুও তমাল হেসে বলল, ‘তোর কাছে একটা রিকোয়েস্ট নিয়ে এলাম ভাই। আমার ফিয়াসেঁকে তো তুই এখনে দেখেছিস। মনে আছে?’

‘জী জী, কেন মনে থাকবে না? নাম কোয়েল… ভেরি কিউট। কেমন আছে সে? তুই বলেছিলি, ওর মায়ের না কি ইন্তেকাল হয়েছে?’

‘রাইট ইউ আর। যাক সে কথা। তোকে বলা হয়নি, আমি রেস্টুরেন্ট বিজনেসে নামছি। পার্টনার হিসেবে নিচ্ছি কোয়েলকে। কিন্তু ওর তো কোনও এক্সপেরিয়েন্স নেই। তুই যদি সুযোগ দিস, সেটাও পেতে পারে।’

মনসুর বলল, ‘কোনও অসুবিধে নেই। মোস্ট ওয়েলকাম। আমার বিজনেসটা বড় নয়। তবুও ম্যানেজারিয়াল কাজটা ও শিখে নিতে পারবে। তার আগে আমায় বল, রেস্টুরেন্টটা খুলছিস কোথায়?’

তমাল জায়গাটার কথা বলতেই মনসুর ফের বলল, ‘ওটা তো রুস্তমের এরিয়া। ওর সঙ্গে কথা বলে নিয়েছিস? বাই দ্য ওয়ে, ওর নাম কি তুই কখনও শুনেছিস?’

প্রশ্নটা শুনে তমাল একবার তাকাল দেবের দিকে। তারপর বলল, ‘রুস্তমের সঙ্গে কথা বলতে হবে কেন?’

‘ওর সঙ্গে কম্প্রোমাইস না করলে বিজনেস চালানো তো দূরের কথা, তুই একটা ইটও গাঁথতে পারবি না। ওকে হপ্তা দিতে হবে।’

দেব জিজ্ঞেস করল, ‘রুস্তমের এত ক্ষমতা না কি?’

‘জী জী, প্রচুর। ওর লোকবল আছে, প্লাস পলিটিক্যাল ব্যাকিং। রিসেন্টলি ওর ক্ষমতা আরও বেড়ে গেল, ট্যাংরায় বোম্ব ব্লাস্টে পরেশ লস্কর মরে যাওয়ায়। লোকটা জোনাল পার্টির সেক্রেটারি ছিল। বোধহয় রুস্তম ওই পোস্টটা পাবে। তবে, তুই চিন্তা করিস না তমালভাই। আমাদের কমিউনিটির ছেলে তো, রুস্তম আমাকে খুব সম্মান করে। তেমন হলে আমি তোকে ওর কাছে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেবো।’

তমাল বলল, ‘দরকার হবে না। মাসদুয়েক আগে দেব ওকে শায়েস্তা করে দিয়েছিল। প্রোজেক্টটা আমাদের জানতে পারলে রুস্তম ধারে-কাছে ঘেঁষবে না।’

মনসুর চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, ‘মাশাআল্লা, কী হয়েছিল, বল তো?’

মিডলটন রো-তে রুস্তমের হাত মুচড়ে দেওয়ার ঘটনাটা শুনে মনসুর গুম হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পর দেবকে ও বলল, ‘রুস্তমের সঙ্গে পাঙ্গা নিয়ে তুমি ভাল করোনি ভাই। নিজেকে অনেক ও বদলে ফেলেছে। কোনখান দিয়ে রুস্তম বদলা নেবে, তুমি টেরও পাবে না। ও যেন জানতে না পারে, তুমি তমালভাইয়ের বন্ধু। শুনলে ও কিছুতেই তামলভাইকে রেস্টুরেন্ট খুলতে দেবে না।’

তমাল আর কথা বাড়াতে চাইল না। মনসুরকে বলল, ‘দরকার হলে তোর কাছে আসব। এখন চলি রে। কোয়েলের কথাটা তোকে আার ভাবতে হবে না। আল্লা হাফিজ।’

শুনে মনসুরের মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। সেদিকে আর তাকাল না দেব। জিম থেকে অনেকক্ষণ আগে ও বেরিয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার। বাইকে চেপে ফেরার পথে ও টের পেল, রুস্তম সম্পর্কে মনসুর বাড়িয়ে কিছু বলেনি। পার্ক সার্কাস ময়দানে রুস্তম বিরাট রক্তদান শিবির করছে। মোড়ের মাথায় সে সম্পর্কে বড় বড় হোর্ডিং। যাঁরা হাজির থাকবেন তাঁদের প্রত্যেকের ছবি ফ্লেক্সে। এমপি মহম্মদ আলমগীরের পাশে একটা ছবি দেখে দেব চমকে উঠল। আনন্দী ম্যাডাম! রুস্তমের অনুষ্ঠানে আনন্দী ম্যাডাম! বাইকটা দাঁড় করিয়ে দেব বলল, ‘হোর্ডিংটা দেখেছিস তমাল?’

মুখ তুলে ম্যাডামের ছবিটা দেখে তমাল বলল, ‘এতে অবাক হওয়ার কী আছে ফ্রেন্ড? একই ফর্মুলা, বিজনেস চালাতে গেলে গুণ্ডা-মাস্তানদের হাতে রাখতে হবে। তোকে না রাখলেও ম্যাডামের চলবে। কিন্তু রুস্তমকে ছাড়া ওঁর চলবে না। ছাড়, ওর কথা। মাথা থেকে সরিয়ে দে। ব্যাঙ্ককের কনটেস্ট পর্যন্ত দাঁত কামড়ে জিম-এ পড়ে থাকে। কনটেস্ট জিতে এসে, ম্যাডামকে পাত্তা না দিলেও তোর চলবে।’

ফেরার সময় আর একটা কথাও বলল না তমাল। হোটেলের সামনে নেমে যাওয়ার পর শুধু বলল, ‘রুস্তমের কথাটা কোয়েলকে তুই বলিস না। শুনলে ও ঘাবড়ে যাবে।’

মিনিট কয়েক পর জিম-এ নিজের চেম্বারে ফিরে দেব দেখল, মিসেস ভাল্লা ওর জন্য বসে আছেন। পায়ে চোট পাওয়ার পর উনি বেশ কয়েকবার ফোনে কথা বলেছেন। প্রতিবারই কোয়েল সম্পর্কে অভিযোগ করতেন। অনেকদিন পর এই প্রথম উনি জিম-এ এলেন। ভদ্রমহিলাকে দেখেই দেবের মনে পড়ল, মিলেনার ফ্ল্যাটে যেদিন ও গিয়েছিল, সেদিন উনি ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এই মেয়েটা অপয়া। যাও, এখখুনি চলে যাও। তুমি কিন্তু বিপদে পড়ে যাবে।’ দেব ঠিক করে নিল, কেন সেদিন উনি ওই কথাটা বলেছিলেন, কায়দা করে আজ নেনে নেবে। মুখোমুখি হতেই ও বলল, ‘হোয়াট আ সারপ্রাইজ! কখন এলেন মিসেস ভাল্লা?’

‘ঘণ্টাখানেক আগে তো হবেই।’

‘আপনার পা কি ঠিক হয়ে গেছে?’

‘পুরো সারেনি। কষ্ট করে এলাম। কিন্তু এসেই দেখি, পুরো জিম অন্ধকার। মেম্বাররা সব বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তোমাকে না পেয়ে আমি মিসেস শরাফের কাছে গেছিলাম। এতক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলছিলাম।’

মিসেস ভাল্লা আনন্দী ম্যাডামের কাছে গেছিলেন মানে… নানা অভিযোগ করে এসেছেন। ম্যাডামও জেনে গেছেন, প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ও জিম-এর বাইরে ছিল। এমনিতেই উনি চটে আছেন, ওকে সরাতে চাইছেন। তার পর আলো নিভে যাওয়ায় গরমে মেম্বাররা বাইরে গিয়ে গজল্লা করছিল, এই ব্যাপারটা উনি আরও ভালভাবে নেবেন না। কী হয়েছিল, জানার জন্য দেব পাণ্ডেজিকে ফোন করল, ‘লাইট চলে গেছিল কেন পাণ্ডেজি?’

পাণ্ডেজি বললেন, ‘আপনি কোথায় ছিলেন দেবজি? খুব খারাপ ব্যাপার হয়ে গেছে।’

‘সেটাই তো জানতে চাইছি।’

‘আপনি বেরিয়ে যাওয়ার পরই ইলেকট্রিক্যাল ফল্ট। ইলেকট্রিশিয়ান এসে বলল, কেউ মেন সুইচের ফিউজ খুলে নিয়েছিল। দেবজি, মিটার রুমে তালা লাগানো ছিল না। কেউ সাবোতেজ করেছে।’

কিন্তু কে সাবোতেজ করতে পারে? দুর্বার না কি? ‘আনন্দী ম্যাডামকে কী বলেছেন, কেন লাইট চলে গেছিল?’

‘আমি বলার আগেই তো মিসেস ভাল্লা ওর কাছে গিয়ে… ডিসগাস্টিং লেডি। সাবোতেজের কথা বলেছিলাম। কিন্তু আনন্দী ম্যাডাম শুনতেই চাইলেন না। আমাকে সামনে পেয়ে যা তা বলে দিলেন।’

মহিলা সামনেই বসে আছেন আহ্লাদি মুখ করে। দেব চট করে কারও উপর রাগে না। কিন্তু আজ মিসেস ভাল্লার দিকে তাকিয়ে ওর রাগ হতে লাগল। ভদ্রমহিলা কি এতটাই নির্বোধ যে, বোঝেন না, কোথায় কী বললে কার কী ক্ষতি হতে পারে? কোয়েলের চাকরিটা প্রায় খেয়েছেন। এরপর হয়তো ওর পালা। দেবের ইচ্ছে করল, ভদ্রমহিলাকে উপেক্ষা করে চেম্বার থেকে বেরিয়ে যায়। চেয়ার থেকে ওঠার মুখে বাধা দিলেন মিসেস ভাল্লা, ‘যাচ্ছ কোথায় দেব? যে কথাটা বলার জন্য এলাম, সেটাই তো বলা হল না।’

কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও, ধৈর্য না হারিয়ে দেব বলল, ‘কথাটা কি কোয়েল সম্পর্কে ম্যাডাম?’

‘একজ্যাক্টলি। মেয়েটার ক্যারেক্টার ভাল না। আমার হাসবেন্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে। একদিন বুটিক থেকে ফিরতে আমার দেরি হয়েছিল। দেখি, মেয়েটা লিভিংরুমে বসে আমার হাসবেন্ডের সঙ্গে গল্প করছে। পরে শুনলাম, সুরজিতকে না কি যোগা শেখানোর চেষ্টা করছিল। সেদিন আমার সঙ্গেও যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছে বকেয়া টাকা নিয়ে।’

মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে উঠল দেবের। কোয়েলের মতো একটা ভাল মেয়ের নামে কলঙ্ক রটাচ্ছেন মিসেস ভাল্লা। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ও কঠিন গলায় বলল, ‘ঠিক আছে ম্যাম, কোয়েলকে ডেকে আমি বলে দিচ্ছি, যাতে আপনার বাড়িতে আর না যায়।’

শুনে আঁতকে উঠলেন মিসেস ভাল্লা, ‘না, না। মানা করার দরকার নেই। ওকে তুমি বলে দিও, আমার অ্যাবসেন্সে যেন ফ্ল্যাটে না যায়। উঠতি বয়সের মেয়ে। বোঝোই তো, এই সময়টায় কী মারাত্মক সেক্স হাঙ্গার হয়। আমি ওর ট্যারো কার্ড পড়েছি। ওর খুব খারাপ দিন আসছে। তুমি ওকে সাবধান করে দিও।’

দেব মনে মনে বলল, সাবধান করার দরকার হবে না। মাসটা শেষ হলেই কোয়েল জিম ছেড়ে চলে যাবে। ভগবানের ইচ্ছেয় যদি ওদের রেস্টুরেন্টটা চালু হয়ে যায়, তা হলে লোকের বাড়ি গিয়ে ওকে আর যোগা শেখাতে হবে না। রেস্টুরেন্ট তৈরি হওয়ার সময় ও কোথায় থাকবে, তা নিয়ে একটা সমস্যা ছিল। তার সমাধান করে দিয়েছেন অবন্তিকার মা। যদুবাবু বাজারে কাছে অবন্তিকাদের বাড়ি। ওর মা বলেছেন, বাড়ির তলার ফ্লোরে দুটো ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। ইচ্ছে করলে মাস ছয়েক কোয়েল সেখানে গিয়ে থাকতে পারে। ভবানীপুরেই যোগা শেখানোর ক্লাস খুলতে পারে ও।

মিসেস ভাল্লার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল দেব। কতটা ভণ্ড তা মাপার চেষ্টা করতে লাগল। তখনই ওর মনে পড়ল মিলেনার কথা। তমাল ওকে প্র্যাক্টিকাল হতে বলেছে। রাগ হজম করে নিল দেব। জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে ও বলল, ‘ম্যাম, শুনেছি আপনার ট্যারো কার্ড প্রেডিকশন মিলে যায়। সত্যি?’

‘হ্যান্ড্রেড পার্সেন্ট।’ উৎসাহের সঙ্গে মিসেস ভাল্লা বললেন, ‘আমার দু’শোর উপর ক্লায়েন্ট। সবাই এলিট সোসাইটির মানুষ। ওঁরা আমার কথা না শুনে এক পাও এগোন না।’

‘আপনি মিলেনা সম্পর্কে সেদিন অপয়া কথাটা কেন বলছিলেন ম্যাডাম? আমি কিন্তু বুঝতে পারিনি।’

‘ওহ, ওই আর্মেনিয়ান মেয়েটা? সি ইজ আ উইচ। ওর ফ্ল্যাটে আর যেও না দেব। মেয়েটা যেদিন প্রথম এল, সেদিন কলকাতায় বিরাট আর্থকোয়েক হয়েছিল। পরে স্টিফেন ম্যানসনে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। প্রথম দিকে মেয়েটা আমার কাছে খুব যাওয়া-আসা করত। তখন আমি ওর ট্যারো কার্ড পড়েছি। তুমি ওর কাছাকাছি থেকো না দেব। তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে। আমার কাছে তুমি একদিন এসো। তোমার ভাগ্যে কী আছে, আমি বলে দেবো।’

আর সহ্য হল না দেবের। পাছে মুখ দিয়ে কোনও কটু কথা বেরিয়ে যায়, সেই ভয়ে ও উঠে পড়ল। মিসেস ভাল্লাকে উপেক্ষা করেই চেম্বার থেকে ও বেরিয়ে এল।

(সাঁইত্রিশ)

পাইপ কলোনিতে আগুন লাগার ঘটনাটা নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। ট্যাংরা থানার বড়বাবু পুলক দে-কে নেমন্তন্ন করতে গিয়ে রুস্তম জানতে পারল। ব্লাড ডোনেশনের কার্ড এগিয়ে দেওয়ার সময় ও লক্ষ করল, বড়বাবু তাতে চোখ বোলানোর প্রয়োজনও মনে করলেন না। কার্ড টেবলের উপর রেখে দিয়ে বললেন, ‘আমি জানি, কাজটা মকবুলরা করেছে। ও এখন আপনার শেল্টারে আছে। আজ বিকেলের মধ্যেই ওকে সারেন্ডার করতে বলবেন। না হলে ওর কপালে দুঃখ আছে।’

গলার স্বর গমগম করছে। বড়বাবুর চোখমুখ দেখেই মনে হচ্ছে, মারাত্মক খচে আছেন মকবুলের উপর। ওকে কাস্টোডিতে পেলে নির্ঘাত থার্ড ডিগ্রি। পুলিশের কাছে কোনও খবরই লুকোচাপা থাকে না। তবুও রুস্তম বলল, ‘স্যার, আমার শেল্টারে ও নেই। বিশ্বাস করুন। ওকে পেলে আমি নিজেই প্যাদাব ঠিক করেছি।’

‘শুনুন রুস্তম, মকবুল কোথায় আছে, জানি। নিজেকে বাঁচাতে চান তো, এখুনি ফোন করে ওকে ডেকে আনান। গোবরা থেকে যে ছেলেগুলোকে তুলে এনেছি, ওরাই সব বলে দিয়েছে। ফালতু আপনি কেন জড়িয়ে পড়বেন? ফরেন্সিকের লোকেরা অ্যান্টিরিপোর্ট দিয়েছে। দমকলের লোকেরাও বলছে, ম্যান মেড ফায়ার। মিনিস্টার মাঝে একবার ফোন করেছিলেন, মকবুল ধরা পড়েছে কি না জানতে চেয়ে। আমার কিছু করার নেই। যে কেস দেবো, তাতে দশ বছর ও আর বাইরে বেরোতে পারবে না।’

আগুন লাগার দিন পাইপ কলোনির একজন মারা গেছে। ফলে কেসটা জটিল। রুস্তম আমতা আমতা করে বলল, ‘আমাকে জড়াচ্ছেন কেন স্যার? ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প নিয়ে আমি খুব বিজি। এমপি আসছেন, এমএলএ থাকছেন, বেশ কয়েকজন ফ্লিম আর সিরিয়াল আর্টিস্টকেও নিয়ে আসছি। পাইপ কলোনির ব্যাপারে মাথা দেওয়ার সময় আছে না কি আমার?’

টেবলের উপর কাচের পেপার ওয়েট ঘোরাচ্ছেন বড়বাবু। খর দৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন, ‘পরেশ লস্করের বাড়িতে কারা এক্সপ্লোসিভস বানাচ্ছিল, আপনি জানেন? আপনি তো সেদিন ওখানে ছিলেন। সিসিটিভিতে দেখলাম, এক্সপ্লোরেশনের ঠিক পরই আপনি পালাচ্ছেন।’

শুনে ঘাবড়ে গেল রুস্তম। পার্টি অফিসে সিসিটিভি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। পুলিশ আবার এই কেসে জড়িয়ে দেবে না তো ওকে? সঙ্গে সঙ্গে ও বলে উঠল, ‘স্যার, আমি পরেশদাকে কার্ড দিতে গেছিলাম। ব্লাস্টের পর ভয়ে ওখান থেকে পালিয়েছিলাম।’

‘আপনি কি জানেন, দিল্লি থেকে এনএসএ-র অফিসাররা এসেছেন? ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি। নামটা শুনেছেন কখনও? ওদের একজন হাই প্রোফাইল অফিসার এসে লোকাল মিসক্রিয়েন্টদের নাম নিয়ে গেছে। ওঁর মুখেই শুনলাম, বাংলাদেশের দু’জন জঙ্গী পরেশ লস্করের বাড়িতে এসে এক্সপ্লোসিভস বানাচ্ছিল। ওদের টুকরো টুকরো বডি পাওয়া গেছে। ওদের সঙ্গে ঢাকা থেকে এসেছিল আরও দু’জন। তাদের না কি আপনার লোকেরা শেল্টার দিয়েছে। এনএসএ-র অফিসাররা সেন্ট্রাল গর্ভমেন্টের। ওঁরা কিন্তু ছাড়বে না।’

‘স্যার, সব বাজে কথা। কেউ আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। গুন্ডাগর্দি থেকে অনেকদিন আগেই আমি সরে এসেছি।’

‘গুলাটি আপনাকে কত টাকা দিয়েছে রুস্তম?’

আই বাপ! বড়বাবু তো তা হলে সবই জানেন। ওর দলে নিশ্চয়ই এমন কেউ আছে, যে পুলিশকে সব খবর দিচ্ছে। কে হতে পারে সেই গদ্দার? পরিচিত কয়েকজনের মুখ এক এক করে রুস্তমের চোখের সামনে ভেসে উঠল। আসফাক, ববি, রিয়াজ, হালিম। এদের মধ্যে কেউ হবে না। ওর ভাবনাচিন্তার মাঝেই বড়বাবু ধমকে উঠলেন, ‘কী ভেবেছেন আপনি? একাই সব টাকা গাপ করে দেবেন? হপ্তা বন্ধ করে দিলে, পুলিশ আপনার কী হাল করতে পারে, কোনও আন্দাজ আছে? পার্টি অফিস থেকে আপনাকে কলার ধরে এই ট্যাংরা থানা নিয়ে আসব। আপনার লিডাররাও কিছু করতে পারবে না।’

কী উত্তর দেবে রুস্তম ঠিক করতে পারল না। রাগের আসল কারণ, তা হলে হপ্তার টাকা না দেওয়া। মাস দুই ধরে ইচ্ছে করেই চারটে থানায় হপ্তা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল রুস্তম। পুলিশের উপর ওর একটু রাগই হয়েছিল। পার্ক স্ট্রিটে ছোট দোকানগুলোতে তোলা তুলতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ওর দলের চারজন। সাউথ ক্যালকাটায় কে একজন ডেপুটি কমিশনার এসেছেন, তিনি না কি ঘুষ খান না। তাই পুলিশ কেস দিয়েছিল। চারটে ছেলেই এখন জেল খাটছে। তা হলে পুলিশকে হপ্তা দিয়ে লাভ কি? আসলে রুস্তম বাজাতে চেয়েছিল পুলিশকে। টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলে, পুলিশ কী করে, সেটা দেখার ইচ্ছে হয়েছিল ওর। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, হিতে বিপরীত হয়ে গেল!

রুস্তম ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার, কোনও কারণে হয়তো টাকাটা আপনাদের কাছে পৌঁছয়নি। পুলিশকে টাকা পাঠায় আসফাক। হয়তো ভুলে গেছে।’

‘ঠিক আছে, আসফাককে তুলে আনছি। আফজলের ছেলেটাকে ও-ই যে এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়ে সিঙ্গাপুর পালাতে হেল্প করেছিল, সেই এভিডেন্স আমাদের কাছে আছে।’ কথাটা বলেই বড়বাবু ফোনের রিসিভার তুলে কাকে যেন বললেন, ‘পার্ক স্ট্রিট থানায় খবর দাও। যেখান থেকে পারো, রুস্তমের স্যাঙাৎ আসফাক শূয়ারটাকে তুলে আনো। রাউন্ড দিয়ে ফিরে যেন আমি ওকে দেখতে পাই।’

ইয়া আল্লা! বড়বাবু বলছেনটা কী? এটা সত্যি যে, দু’জন বাংলাদেশি জঙ্গীকে ওরা আশ্রয় দিয়েছে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই জামায়েতের লোক। বাংলাদেশের পুলিশ ওদের খুঁজছে বলে, ওরা পালিয়ে এসে কয়েকমাস বর্ধমানের কোনও এক গ্রামের মসজিদে লুকিয়েছিল। মুশকিল হল, বাঙাল ভাষা ছাড়া গান্ডু দুটো আর কিছু জানে না। কথার টোন-এ বোঝা যায়, এ দেশের নয়। বর্ধমানের পুলিশ ওদের খোঁজ নেওয়া শুরু করে। সেটা জানতে পেরে দু’জন কলকাতায় চলে আসে। মসজিদের মারফত কোনও অনুরোধ এলে রুস্তম না করতে পারে না। তাই স্টিফেন ম্যানসনে রিয়াজের ঘরে ওদের রেখে, আধার কার্ড জোগাড় করে দিচ্ছিল রুস্তম। কিন্তু পরেশদার বাড়িতে বিস্ফোরণের পর মিডিয়ায় এই দু’জনের নাম উঠে এসেছে।

কাল রাতেই রুস্তম ঠিক করেছিল, বাংলাদেশিদের মেটিয়াবরুজের কোথাও পাচার করবে। সেই কাজটা করতেই আসফাককে ও স্টিফেন ম্যানসনে পাঠিয়েছে। এখন ওখানে যদি পার্ক স্ট্রিট থানার লোক যায়, আসফাকসহ ওই দু’জনকে ধরে ফেলে, তা হলে পুলিশ জিনা হারাম করে দেবে। স্টিফেন ম্যানসন থেকে পাততাড়ি গোটাতে হলে পর পর অনেকগুলো কাজও আটকে যাবে। শরাফদের কাছ থেকে অনেক টাকা নেওয়া হয়ে গেছে। এই ক’দিন আগে সুনীল ধিংড়া নামে একজনের কাছে টাকা নিয়েছে, ফার্স্ট ফ্লোরে পাঁচটা অফিস তুলে দেওয়ার প্রমিস করে। ওঁদের কাছে রুস্তম মুখ দেখাতে পারবে না। না, না, এটা হতে দেওয়া যায় না। বড়বাবুকে ও বলল, ‘এত রেগে রয়েছেন কেন স্যার? আপনাদের চার হপ্তার টাকা আমি এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

বড়বাবু ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘সেই তো লাইনে এলেন, তা’লে কেন পাছা দেখালেন? শুনুন, ডেপুটি কমিশনার সাহেবের মেয়ের বিয়ে দিনদশেক পর। উনি সাত-আটশো লোককে নেমতন্ন করেছেন। বিয়ের দিন খাওয়ার পুরো খরচটা আপনি দেবেন। বাদশাহি ফুড-এর আফজলমিঞার সঙ্গে কথা বলে রাখুন। বিয়ের খাবারটা দিলে, ওর ছেলের কেসটা হালকা করে দেবো। কিন্তু একটু এদিক ওদিক হলে আপনাদের দু’জনের গাঢ়েই রুল ঢোকাব।’

শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না রুস্তম। ডেপুটি কমিশনারও তা হলে ঘুষ খান। আসফাক কোত্থেকে খবর নিয়ে এসেছিল, লোকটা না কি খুব সৎ? আসফাকের উপর রাগ দমন করে রুস্তম বলল, ‘আফজলমিঞার সঙ্গে এখুনি কথা বলে নিচ্ছি স্যার। আপনি যদি চান, তা হলে সিলভার হোটেলের মালকিনকেও রিকোয়েস্ট করতে পারি। ওদের চাইনিজ খানাটা দারুণ। স্যার, দারুর অ্যারেঞ্জমেন্টটাও করে দিতে পারি, যদি ডিসি সাহেব চান।’

বড়বাবু বললেন, ‘এটা আবার বলে দিতে হবে না কি? আপনি এখন যান। বিকেলের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে আমাদের জানাবেন।’

রুস্তম একবার শেষ চেষ্টা করল, ‘ব্লাড ডোনেশনের দিন তা হলে আসছেন তো?’

‘বলতে পারছি না। ওই একই দিনে শুভঙ্করবাবু ক্রিস্টোফার রোডে একটা অনুষ্ঠান করছেন। কৃতী ছাত্রছাত্রীদের সংবর্ধনা। এমপি, এমএলএ সবাই ওখানেই যাবেন। মনে হচ্ছে, আপনার ওখানে যাওয়া হবে না।’ কথাগুলো বলে পুলক দে উঠে দাঁড়ালেন।

আর বসে থাকার কোনও মানে হয় না। শালা শুভঙ্কর ইচ্ছে করে একই দিনে ওর অনুষ্ঠান করছে। রোয়াব দেখাতে চায়। ট্যাংরা থানা থেকে বেরিয়ে আসার সময় রুস্তম সিদ্ধান্ত নিল, শুভঙ্করকে অনুষ্ঠানটা করতে দেবে না। তখনই ওর মউ সরকারের কথা মনে পড়ল। পদ্মপুকুরের ওই রিপোর্টার মেয়েটাকে বিয়ে করবে বলেও শুভঙ্কর করছে না। এই মেয়েটাকে কাজে লাগাতে হবে। মউকে রুস্তম প্রায়ই টিভিতে দেখে। কিন্তু পদ্মপুকুরের ঠিক কোথায় ও থাকে, জানে না। কার কাছ থেকে খোঁজ পাওয়া যায়, ভাবতে ভাবতে ওর দিলুর কথা মনে পড়ল। ছেলেটা পদ্মপুকুর অঞ্চলে খুব পপুলার। ও নিশ্চয়ই মউকে চিনবে।

থানা থেকে ফেরার সময় গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে রুস্তম ফোনে দিলুকে ধরার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে লাইন পেয়েও গেল। ভণিতা না করে রুস্তম জিজ্ঞেস করল, ‘এই, তুই মউ সরকার বলে রিপোর্টার মেয়েটাকে চিনিস? তোদের ওখানে থাকে।’

দিলু বলল, ‘কেন চিনব না। ও তো আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে। কেন বস, ওকে তোমার দরকার না কি? মেয়েটা ভাল অ্যাঙ্কারিং করে। ওকে তোমার ব্লাড ডোনেশন অনুষ্ঠানে কাজে লাগাতে পারো।’

রুস্তম বলল, ‘তা হলে তো ভাল হয়। অ্যাঙ্কারিং করার জন্য কত নেয় রে?’

‘জিজ্ঞেস করতে হবে। মেয়েটা খুব অসুবিধের মধ্যে আছে। যে টিভি চ্যানেলে চাকরি করে, তারা মাস পাঁচেক মাইনে দিতে পারেনি। ওর বাবা-মা দু’জনে গতবছর সাতদিনের ব্যবধানে মারা গেছে। এখন মউ ফ্ল্যাটে একাই থাকে।’

খবরগুলো মনোমতো মনে হচ্ছে রুস্তমের। বড় কথা, মেয়েটা একা থাকে। ওকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করিয়ে নেওয়া যায়। রুস্তম টোপ দিল, ‘তুই এখনই একবার মেয়েটার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে পারবি? আমার ব্লাড ডোনেশন অনুষ্ঠানে অ্যাঙ্কারিং করার জন্য ওকে আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবো।’

শুনে লাফিয়ে উঠল দিলু, ‘তা হলে তো মেয়েটা বেঁচে যাবে রুস্তমদা। শালা শুভঙ্কর ওর জীবনটা শেষ করে দিল। প্রেম প্রেম খেলে এখন কেটে পড়তে চাইছে। বড় নেতা হয়ে গেছে। শুভঙ্করকে আমরা কিছু বলতে পারি না। আবার সহ্যও করতে পারছি না।’

‘শুভঙ্কর কি এখনও মউয়ের কাছে যায়?’

‘কাল রাতেও এসেছিল। মউ চেঁচামেচি করে ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। পাঁচকান কোরো না বস, তোমাকেই বলছি। মাসছয়েক আগে মউ প্রেগনেন্ট হয়ে গেছিল। বারাসতের এক নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়ে শুভঙ্কর চুপি চুপি অ্যাবরশন করিয়ে এনেছে। মউ খুব খেপে আছে ওর উপর। তোমার পার্টি অফিসে কি ওকে নিয়ে যাবো? তা হলে বলো, কখন যেতে হবে।’

রুস্তম বলল, ‘না, না। আমার পার্টি অফিসে না। শোন, আমি তোর বাড়ির খুব কাছাকাছি আছি। আনন্দ পালিত রোডে একটা রেস্টুরেন্ট আছে হাফিজ বলে। সেখানে ওকে আধ ঘণ্টার মধ্যে আসতে বল। আমি ওর জন্য ওয়েট করব তা হলে।’

‘এখুনি বলে দিচ্ছি বস।’

‘আরেকটা কথা, শুভঙ্কর কি এমএলএ সিট-এ নমিনেশন পাচ্ছে? তুই কি কিছু শুনেছিস?’

‘লোককে ও বলে বেরাচ্ছে বটে। কিন্তু লোকাল লোকদের সাপোর্ট পাবে না। মউয়ের কেসটা এখানকার সবাই জানে। শুভঙ্করের অ্যান্টিপাবলিসিটি হয়ে গেছে। তুমি চেষ্টা করছ না কেন, বস? তুমি দাঁড়ালে মুসলিম কমিউনিটির পুরো ভোটটা পাবে।’

রুস্তম মনে মনে খুশি হল শুনে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কিছু বলা মানে, নিজের সর্বনাশ করা। ও যা করব, পার্টির ওপর তলা থেকে করবে। তাই বলল, ‘এ সব নিয়ে ভাবার অনেক টাইম আছে দিলু। আমার মাথায় এখন শুধু ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প। আমি হাফিজ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি। তুই মউকে ওখানে পাঠিয়ে দে। ওর নামটা বলে তুই ভালই করলি ভাই। আমি একজন অ্যাঙ্কার খুঁজছিলাম। ওকে আজই আমি পঁচিশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে দেবো। ছাড়ি তা হলে? খোদা হাফিজ।’ বলে লাইনটা কেটে দিল রুস্তম।

গাড়ি স্টার্ট করার পর রুস্তম দেখল, সামনেই সিগন্যালের লাল আলো জ্বলছে। হাফিজ রেস্টুরেন্ট খুব বেশি দূরে নয়। ধীরে সুস্থে গেলেই চলবে। পাড়াটা শুভঙ্করের, ওর কোনও ছেলের যেন চোখে পড়ে না যায়। পদ্মপুকুরের সব ইয়াং ছেলেই ওকে চেনে। কেউ দেখে ফেললে, আলোচনা হবেই, কেন ও এ পাড়ায় এসেছিল। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়। ডান পাশে ভটভট করে একটা বাইক এসে দাঁড়াল। শুভঙ্করের চ্যালা ফিরোজ জানলার কাচে টোকা মারল। এসি চালানোর জন্য রুস্তম জানলার কাচ তুলে রেখেছিল। ফিরোজকে দেখে কাচটা ও নামিয়ে দিল।

ফিরোজ হেসে বলল, ‘আসসালাম আলেইকুম ওস্তাদ। কী ব্যাপার তুমি এ পাড়ায়? শুভঙ্করদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে না কি? উনি তো নেই। নার্সিং হোম থেকে ফেরার পর, পরশু দিন তিনেকের জন্য দীঘায় বেড়াতে গেছে।’

শালা শুভঙ্কর কাল রাতেও মউয়ের বাড়ি গেছিল। অথচ ফিরোজ বলছে, ও দিন তিনেকের জন্য বেড়াতে গেছে। কার কাছে খাপ খুলছে? রুস্তম বলল, ‘ওআলেইকুম সালাম। আমি জানি, শুভঙ্কর নেই। আনন্দ পালিত রোডে আমার এক খালা থাকেন। আমি তার কাছেই যাচ্ছিলাম। তুই কোথায় যাচ্ছিস?’

‘হাফিজ রেস্টুরেন্টে। এক পার্টি মাল দিতে আসবে। শুভঙ্করদা বলে গেছে, টাকাটা নিয়ে রাখতে।’ বলেই সিগন্যালের দিকে তাকিয়ে ফিরোজ বাইকে স্টার্ট দিয়ে বলল, ‘দেরি হয়ে গেছে। আমি চলি ওস্তাদ। খোদা হাফিজ।’

সিগন্যাল পেরিয়ে ফের রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করাল রুস্তম। বাল বাল বেঁচে গেছে। কী হত, যদি রেস্টুরেন্টে মউয়ের সঙ্গে ওকে দেখে ফেলত ফিরোজ? দিলুকে ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ও। মউকে অন্য কোথাও দেখা করতে বলবে।

(আটত্রিশ)

দিগন্তব্যাপী সবুজ ধানের খেত। সরু আলের উপর দাঁড়িয়ে দেবদূত হাসছে। ওর ছবি তোলার ফাঁকে মিলেনা বলল, ‘দার্জিলিংয়ে আমাদের বাড়ির কাছেও ঠিক এইরকম একটা জায়গা ছিল। চারদিকে শুধু গ্রিন। বাড়ির পাশে একটা নদীও ছিল। তার নাম ডুংরি। জানো, আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেত। নীল আকাশ, তুলোর মতো সাদা মেঘ। একেবারে ছবির মতো মনে হত। ছোটবেলায় পেইন্টিংয়ে আমার ইন্টারেস্ট জাগে, দার্জিলিংয়ের অসাধারণ সিনিক বিউটি দেখে।’

দেবদূত জানত না ও পেন্টার। জিজ্ঞেস করল, ‘এখনও তোমার পেন্টিংয়ে ইন্টারেস্ট আছে না কি?’

‘থাকবে না কেন? এখানে আসার পর তো পেন্টিং করেই আমি সময় কাটাতাম। এর পর তুমি যেদিন স্টিফেন ম্যানসনে যাবে, সেদিন তোমাকে আমার পেন্টিং দেখাব। ইস, তুমি যদি আগে আমাকে বলতে, এখানে এত গ্রিন, তা হলে আমি ক্যানভাস, প্যালেট সব নিয়ে আসতাম।’

‘তুমি কি সিনারি আঁকতে পছন্দ করো, না কি পোট্রেটও?’

‘পোট্রেট আমার ফেভারিট। শুনলে তুমি মজা পাবে। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখি, সেদিন তোমার পোট্রেট আঁকতে শুরু করেছিলাম। সেটা সদ্য শেষ করেছি। প্রপার টাইমে তোমাকে আমি গিফট করব।’

‘কোথায় রেখেছ সেই ছবিটা?’

‘আমার স্টাডি রুমে সেটা ঢাকা দেওয়া আছে। অ্যানা ছাড়া আর কেউ সেটা দেখেনি। তখন আমাদের রিলেশনের কথা ওকে বলতে হল। শুনলে তুমি খুশি হবে, কলকাতায় আমাদের হোলি ন্যাজারাথ চার্চে একবার আমার পেন্টিংয়ের একজিবিশন হয়েছিল। আমার আঁকা প্রভু যীশুর ছবি এখনও চার্চে প্রিজার্ভ করা আছে।’

কথা বলতে বলতে দেবদূতের কাছে পৌঁছে গেল মিলেনা। তারপর বলল, ‘এসো, একটা সেলফি তুলি। আর কখনও তোলার সুযোগ পাবো কি না, জানি না।’

দেবদূত ওর কোমর জড়িয়ে ধরেছে। ওর বুকে হেলান দিয়ে মিলেনা সেলফি তুলতে শুরু করল। কয়েকটা স্ন্যাপ নেওয়ার পর ও টের পেল পায়ের উপর দিয়ে কী যেন চলে গেল। সাপ না কি? কথাটা মনে হতেই মিলেনা লাফিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরল দেবদূতকে। নীচের দিকে তাকিয়ে ও দেখল, ধেঁড়ে ইঁদুর। একটা নয়, তিন চারটে। ওকে ভয় পেতে দেখে দেবদূত হেসে বলল, ‘দিনের বেলায় ইঁদুর, লক্ষণ ভালো না। সাপ বোধহয় গর্তে ঢুকে ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে। চলো, পিকনিক স্পটে ফিরে যাই।’

দেবদূত ওর কোমর ছাড়েনি। ঝুঁকে ওর শরীর থেকে সুঘ্রাণ নিচ্ছে। ঘাড়ের কাছ থেকে সুখ তিরতির করে নেমে গেল মিলেনার। দু’হাতে দেবদূতের মুখটা টেনে এনে ও চুমু খেল। কাল বিকেলে দেবদূত যখন ওকে চণ্ডীতলায় পিকনিকের কথা বলে… তমাল আর কোয়েলও সঙ্গে থাকবে জানায়, তখন মিলেনা চট করে রাজি হয়ে গেছিল। স্টিফেন ম্যানসনে ওর দম আটকে আসছিল। অন্তত একটা দিন তো খোলা হাওয়ায় কাটাতে পারবে? এই চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে সেই মনোবাসনা ওর পূরণ হচ্ছে। এখানে আসার সময় আরেকটা ইচ্ছেও ওর মিটেছে। ফ্ল্যাটের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের জানলা থেকে যে ঝুলন্ত ব্রিজটা রোজ ওকে হাতছানি দিত, তার উপর দিয়ে আজ এসেছে। ব্রিজটা এত বড়, ও ভাবতেও পারেনি। তমাল বলছিল, নীচের নদীটার নাম গ্যাঞ্জেস। তখনই ওর দার্জিলিংয়ের ডুংরি নদীটার কথা মনে পড়েছিল।

চুম্বন পর্ব মিটে যাওয়ার পর দেবদূত বলল, ‘চলো, আর দেরি করা ঠিক হবে না। পিকনিক স্পটে মা আর রন্তিমাসি মনে হয় এসে গেছে।’

ধানখেতের মাঝখান দিয়ে দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে পিকনিক স্পটের দিকে এগোল। আজ সকাল ন’টায় ওরা চণ্ডীতলায় পৌঁছেছে। কাল রাতে অ্যানা সব শিখিয়ে দিয়েছিল ওকে। ‘শাড়ি পরে যাবি। বয়সে যারা সিনিয়ার, তাদের পা ছুয়ে প্রণাম করবি। দু’হাত জোড় করে বলবি, নমস্তে। খবরদার কাউকে বলে ফেলিস না, কখনও বিফ বা হ্যাম খেয়েছিস। যারা বিফ খায়, বাঙালি-হিন্দুরা তাদের পছন্দ করে না। জানতে পারলে ওরা তোকে ড্রয়িং রুম থেকেই বিদেয় করে দেবে। আর একটা কথা, ওদের অনেক কিছুই তোর হয়তো পছন্দ হবে না। কিন্তু সেটা তুই প্রকাশ করবি না।’

অ্যানা যা করতে বলেছিল, দেবদূতের বাড়িতে পৌঁছে মিলেনা সব করে গেছে। কিন্তু ওকে দেখে শুরুতে দেবদূতের মায়ের মুখে যে উচ্ছ্বাসটা লক্ষ করেছিল, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সেটা উধাও হতেও দেখেছে। ওদের পরিবারে লোকজন কম নয়। তাঁরা সবাই এসে ভিড় করেছিলেন ওকে দেখতে। মিলেনা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে বুঝতে পারছিল না, রিলেটিভরা ওকে পছন্দ করছেন কি না? বোধহয় স্বস্তি দেওয়ার জন্যই দেবদূত বাড়ির পাশে বড় একটা পুকুরের ধারে ওকে নিয়ে গেছিল। পিকনিকের জন্য মাছ ধরতে। পুকুরে না কি চার-পাঁচ কেজি সাইজের মাছ আছে। বাঁধানো ঘাটে বসে মিলেনা যখন মাছ ধরা দেখছিল, তখন হঠাৎ ওর চোখে পড়ে, পুকুরের চারপাশে গ্রামের লোক জড়ো হয়ে গেছে। কোয়েল তখন বলেছিল, ‘তোমাকে দেখার জন্য লোকের কত কিউরিওসিটি দেখো মিলেনা।’

আজই আসার সময় কোয়েলের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছে মিলেনা। মেয়েটা খুব কম কথা বলে। দেবদূতের মুখে ওর প্রচুর প্রশংসা শুনেছে। কোয়েলের মতো যোগা ট্রেনার না কি কলকাতায় খুব কম আছে। যোগা জিনিসটা কী, কলকাতায় আসার আগে কোনও ধারণাই ছিল না মিলেনার। গুগল সার্চ করে ও জানতে পেরেছে, নিয়মিত যোগাভ্যাস করলে শরীর সুস্থ থাকে। অনেক রোগ সেরে যায়। অতীতে ভারতের মুনি-ঋষিরা সুস্থ ও নীরোগ দীর্ঘ জীবনের উপায় বের করেছিলেন এই যোগা পদ্ধতি আবিষ্কার করে। দেবদূত বলেছিল, লোকাল একটা চ্যানেলে বাবা রামদেব বলে একজন সাধু যোগা শেখান। বেশ কয়েকদিন ওই চ্যানেলে রামদেবের প্রোগ্রাম দেখেছে মিলেনা। ওর একবার মনেও হয়েছিল, মাম্মি আর ড্যাডি কলকাতা এলে কোয়েলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। মাম্মির হাঁটুতে ব্যথা, ড্যাডির বাওলসের প্রবলেম। যোগা করিয়ে কোয়েল নিশ্চয়ই সারিয়ে তুলতে পারত দু’জনকে।

খেতের আল ধরে হাঁটার সময় দূর থেকে মিলেনা লক্ষ করল, পিকনিক স্পটে বারো-চোদ্দোজনের ভিড়। কথা ছিল, ওরা চারজনে মিলে বারবিকিউ করবে। কিন্তু এত লোক এল কোত্থেকে? প্রশ্নটা করতেই দেবদূত বলল, ‘আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছে গ্রামে। প্রদীপ্ত… সে তার ওয়াইফকে নিয়ে এসেছে। বাকি যাদের দেখছ, তারা সবাই আমার আন্টি বা কাজিন। আমার মনে ছিল না, আজ সান ডে।’

পিকনিক স্পটটা বেছেছিল তমাল। বিরাট একটা বেনিয়ান ট্রি-র তলায়। আসার সময় হোটেল থেকে বারবিকিউ আভেন নিয়ে এসেছে ও। তন্দুরী বানানোর সব সামগ্রীও। নিজের হাতে মুরগির মাংস ছাড়িয়ে তমাল ম্যারিনেট করে রেখেছে। ওদের চারজনের জন্য তন্দুরী চিকেন, রায়তা আর স্যালাড। বাকিদের জন্য বেঙ্গলি কুইজিন। ছবি তুলতে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মিলেনা দেখে গেছিল, তমাল ভেজ আইটেম রাঁধতে ব্যস্ত। ফেরার সময় ও দেখল, বেনিয়ান ট্রি-র তলায় কেউ চাঁদোয়া টাঙিয়ে দিয়েছে। যাতে গাছের উপর থেকে ময়লা না পেড়ে রান্না করার সময়। প্লাস্টিকের রঙীন তিন-চারটে টেবল আর গোটা পনেরো চেয়ারের ব্যবস্থাও হয়েছে। চাঁদোয়ার তলায় বসে কোয়েল কোকোম্বার, টোমাটো আর অনিয়ন কেটে স্যালাডের কাজ এগিয়ে রাখছে। বারবিকিউ আভেনে মাংস ঝলসানোর ফাঁকে ওর সঙ্গে কথা বলে তমাল হাসছে। দেবদূতের মুখে মিলেনা আজই শুনেছে, ওরা কাপল।

ওকে দেখে তমাল বলল, ‘মিলেনা, প্লিজ গিভ মি অ্যানাদার হাফ অ্যান আওয়ার। লাঞ্চ উইল বি রেডি বাই দ্যাট টাইম। মেন কোর্স তন্দুরী চিকেন। আই থিঙ্ক ইউ উইল লাইক ইট।’

শুনে মিলেনা ম্লান হাসল। তমাল তো জানে না, হাজবেন্ড মারা যাওয়ার পর, নাজমা দশ-বারো দিন ধরে আসছে না। ফলে ওর বাড়িতে রান্নার পাট উঠে গেছে। দিনের বেলায় বাইরে থেকে ও খাবার কিনে আনে। রাতে যা হোক, ফ্রাই করে নেয়। নাজমার জায়গায় নতুন কাউকে রাখতেও ও ভরসা পাচ্ছে না। মাঝে নাজমাকে একবার ফোন করেছিল মিলেনা। ও কাঁদতে কাঁদতে বলল, ব্লাস্টের পর পুলিশ ওদের পুরো ফ্যামিলিকে রোজ থানায় ডাকছে। নানারকম ভয় দেখাচ্ছে। জিজ্ঞেস করছে, গদাইয়ের কাছে আর কে আসা-যাওয়া করত? গদাইয়ের ড্যাডি না কি মারাত্মক চটে আছে নাজমার উপর। বস্তি থেকে তাড়িয়ে দেবে বলেছে। ‘সব দোষ না কি আমার। দেখবে দিদি, কোনও একদিন গায়ে আগুন লাগিয়ে মরব। গদাই নেই, আমি বেঁচে থেকে করবটা কী?’ শুনে চোখের কোণ ভিজে উঠেছিল মিলেনার। হাসবেন্ডকে এত ভালবাসত নাজমা? এত অল্প বয়স মেয়েটার! ভবিষ্যতে কী করে ফেলবে, কে জানে?

চেয়ারে বসে ও নাজমার কথা ভাবছে। এমন সময় কোয়েল এসে বলল, ‘মিলেনা চলো। আমরা একটা টেম্পল থেকে ঘুরে আসি। গডেস কালী টেম্পল। তুমি যা উইশ করবে, পেয়ে যাবে।’

‘ইজ ইট?’ বলে মিলেনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘লেট আস গো। হাউ ফার ইজ ইট?’

‘নট ভেরি ফার। ইট ইজ টু হান্ড্রেড ইয়ার্স ওল্ড টেম্পল।’

ছোটবেলা থেকে মিলেনা জানে, বাঙালিদের অনেক গড আর গডেস। তবে, এরা গডেস কালীকে খুব মানে। টেম্পল-এ গেলে সবাই জুতো খুলে ঢোকে। প্রায় তিন বছর হল মিলেনা কলকাতায় আছে। গডেস দুর্গার ফেস্টিভ্যালের সময় জাঁকজমকও দেখেছে। সিংহের উপর বসা গডেস দুর্গা। তার পায়ের তলায় হাতজোড় করে একজন পুরুষ বসে। কলকাতায় এই গডেস দুর্গার দশটা হাত। কিন্তু দার্জিলিংয়ে আঠারো হাতের দুর্গা ওর চোখে পড়েছে। কলকাতায় দুর্গা ফেস্টিভ্যালের পর বহু প্যান্ডেলে গডেস কালীর পুজো হয়। গলায় নরমুণ্ডুর মালা। গায়ের রং কালো, কোথাও নীল। গডেস কালী একজন পুরুষের বুকের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর মুখ থেকে জিভ বেরিয়ে এসেছে। নিয়োগী আন্টি একবার বলেছিলেন, পুরুষটি হলেন লর্ড শিবা। গডেস কালীর হাসবেন্ড। শুনে মিলেনা তখন অবাকই হয়েছে। বুঝতে পারেনি, তা হলে লর্ড শিবা কেন ওয়াইফের পায়ের নীচে শুয়ে আছেন?

ওদের হোলি নাজারেথ চার্চে যাতায়াতের পথে কোথাও কালী টেম্পল পড়ে না। তাই কোনওদিন কোনও টেম্পল-এ যাওয়া হয়ে ওঠেনি মিলেনার। মিনিট পাঁচেক কোয়েলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ও কালী টেম্পল-এ গিয়ে দেখল, প্রায় ভগ্নদশা। টেম্পল-র গায়ে বেনিয়ান ট্রি বেড়ে উঠেছে। সিমেন্টে পলেস্তরা খসে গিয়ে বিবর্ণ চেহারা। যে কোনওদিন ভেঙে পড়তে পারে। বিশ্বের কোথাও কোনওদিন কোনও চার্চ-এর এই অবস্থা হবে না। ও শুনেছে, আর্মেনিয়াতেও দেড়শো দু’শো বছরের পুরনো চার্চ আছে। সেই জার-এর আমলের। যখন আর্মেনিয়া রাশিয়ায় অর্ন্তগত ছিল। কিন্তু সেই সব চার্চ এখনও ঝকঝকে, তকতকে। কিন্তু এই টেম্পল-এর ভিতরটা দিনের বেলাতেও ঘুটঘুটে অন্ধকার এবং নির্জন। জুতো খুলে মিলেনা টেম্পল-এর ভিতরে ঢুকল। গডেস কালীর মূর্তিটা দেখে ওর গা ছমছম করতে লাগল। কোয়েল হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। সম্ভবত কোনও উইশ করছে। দেখাদেখি মিলেনাও চোখ বুঁজে প্রার্থনা করল, ‘গডেস কালী, দেবদূত যেন ব্যাঙ্ককে গিয়ে মি. এশিয়া হতে পারে।’

কিছুক্ষণ পর টেম্পল থেকে বেরিয়ে এসে কোয়েল জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি চাইলে গডেস কালীর কাছে?’

মিলেনা হেসে বলল, ‘নিজের জন্য কিছু চাইনি।’

কোয়েল বলল, ‘আমিও আমার জন্য কিছু চাইনি। শুধু বললাম, আমাদের রেস্টুরেন্টটা চালু হলে, ফের এসে তোমায় পুজো দিয়ে যাবো।’

‘তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব কোয়েল?’

‘কী জানতে চাও বলো।’

‘দেবদূতের রিলেটিভরা কি আমাকে পছন্দ করেননি?’

‘কী করে তুমি বুঝলে? কেউ কি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন?’

‘না, করেননি। কিন্তু ওদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে, কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে।’

‘আসলে কি জানো, তোমাকে প্রথম দেখলেন, সেই কারণেই হয়তো অনেকে তোমার কাছে সহজ হতে পারছেন না। কিন্তু এরা সবাই খুব সহজ-সরল মানুষ। বিশেষ করে, দেবদার মাম্মি। এ নিয়ে তুমি অহেতুক চিন্তা কোরো না। মাঝে মাঝে তুমি যদি আসো, তা হলে সম্পর্কটা সহজ হয়ে যাবে। যদি কিছু মনে না করো, তোমাকে একটা প্রশ্ন করব? তোমার বাড়ির লোকজন কি দেবদাকে অ্যাকসেপ্ট করবেন?’

শুনে মিলেনা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘না, করবেন না। ওঁরা আমার জন্য একজনকে পছন্দ করে রেখেছেন। ড্যাডি মাসখানেকের মধ্যে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চান। দেখি, দেবদূত ব্যাঙ্কক থেকে ফিরে আসুক। তারপর আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

পিকনিক স্পটে পৌঁছনো পর্যন্ত মিলেনা কোনও কথা বলল না। দূর থেকে ও শুনতে পেল, রেকর্ডারে মিউজিক বাজছে। চেয়ারগুলো গোল করে সাজানো রয়েছে। ওদের দু’জনকে দেখে বাকিরা হইহই করে উঠল, ‘এতক্ষণ তোমাদের জন্যই ওয়েট করছিলাম। এসো, মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা যাক।’ মিলেনা লক্ষ্য করল, ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন মহিলা পিকনিক স্পটে জড়ো হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন দেবদূতের এক মাঝবয়সি আন্টিও। সবাই কোমরে আঁচল বেঁধে তৈরি হচ্ছেন খেলার জন্য। ছোটবেলা থেকে মিউজিক্যাল চেয়ার মিলেনার প্রিয় খেলা। ওর এমন আশ্চর্য কপাল, স্কুল, কলেজ, পিকনিক… কোনও জায়গাতেই ও এই খেলায় হারেনি। মিউজিক চালানো এবং থামানোর দায়িত্বে রয়েছে দেবদূত। খেলা শুরু করার সময় ও হাসিমুখে থামস আপ করে দেখাল।

বিভিন্ন বয়সি বারোজন খেলতে নেমেছে চেয়ার দখল করার জন্য। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সবার মুখে চাপা উত্তেজনা। সবথেকে উৎসাহ বেশি, মাঝবয়সি আন্টির। দেবদূত পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, রাঙা আন্টি বলে। মিলেনা তাঁকে প্রণাম করতে যেতেই সভয়ে আন্টি সরে গেছিলেন। ‘থাক থাক, তোমাকে পা ছুঁতে হবে না।’ কাল রাতে অ্যানা একবার বলেছিল, ‘ওদের অনেক কিছুই তোর হয়তো পছন্দ হবে না। কিন্তু সেটা তুই প্রকাশ করবি না।’ কথাটা মনে পড়ায় মিলেনা চুপ করে গেছিল। ও বুঝতে পারেনি, প্রণাম করাটা বয়স্কদের কেউ পছন্দ করেন, কেউ করেন না কেন? একটু পরে দেবদূত অ্যানাউন্স করল, ‘মিউজিক্যাল চেয়ারে যারা পার্টিসিপেট করছে, তাদের জন্য একটা প্রাইজ আছে। ধনেখালির তাঁতের শাড়ি।’ শুনে মেয়েরা সবাই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। কোয়েলকে মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়াট ইজ ধনেখালি শাড়ি?’ কোয়েল বুঝিয়ে দিল, ধনেখালি জায়গার নাম, খুব বেশি দূরে নয়। সেখানে ভাল হ্যান্ডলুমের শাড়ি তৈরি হয়।

দেবদূত বলিউডি মিউজিক চালিয়ে দেওয়ার পর প্রথম রাউন্ডেই মিলেনা লক্ষ করল, ওর ধারে কাছে কেউ আসছে না। ওর সামনে পিছনে কয়েকটা স্টেপ ফাঁকা। ফলে সহজেই ও খালি চেয়ার পেয়ে যেতে লাগল। পাঁচ-ছয় রাউন্ড হয়ে যাওয়ার পর ও ইচ্ছে করেই একটা চেয়ারের খানিকটা দূরে গতি শ্লথ করে দিল। কিন্তু কেউ ওকে টপকে সেই চেয়ারে বসার চেষ্টা করল না। কারণটা মিলেনা বুঝতে পারল, চেয়ারের বৃত্তটা যখন ছোট হয়ে দুটিতে দাঁড়াল। প্রতিযোগী মাত্র তিনে এসে দাঁড়িয়েছে। কোয়েল, ও আর চোদ্দো পনেরো বছরের একটা মেয়ে। পার্টিতে আসা পুরুষদের দল কেউ কোয়েলকে উৎসাহ দিচ্ছে, কেউ ওকে। দেবদূত মিউজিক শুরু করার পর গোল হয়ে ওরা তিনজন চেয়ারের চারপাশে ঘোরার সময় মেয়েটার সঙ্গে ধাক্কা লাগল মিলেনার। সঙ্গে সঙ্গে খেলা থেকে বেরিয়ে মেয়েটা বলে উঠল, ‘মা দেখো, মেম আন্টিটা আমাকে ছুঁয়ে দিল। আমাকে আবার চান করতে হবে।’

কথাটা শুনে মিলেনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। পিকনিকে এসে দ্বিতীয়বার ওর অ্যানার সাবধানবাণী মনে পড়ল, ‘যারা বিফ খায়, বাঙালি হিন্দুরা তাদের পছন্দ করে না।’ বিফ খায় বলে, ও এতটাই অস্পৃশ্য না কি? খেলার ইচ্ছেটাই ওর চলে গেল। মনে হল দেবদূতের কাছে গিয়ে বলে, কেন আমায় নিয়ে এলে?

(উনচল্লিশ)

দুপুরবেলায় এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। মেঘলা আকাশ, ঠান্ডা বাতাস বইছে। লাঞ্চের পর হোটেলের ছাদে এসে দেব দেখল, পূর্বদিকের আকাশে বিচিত্র ধরনের ঘুড়ি উড়ছে। ট্যাংরার দিকটায় অনেক চিনা পরিবার থাকে। ওদের বোধহয় কোনও পরব আছে। হাঁ করে দেব ঘুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। কোনটা মাছ, কোনওটা ড্রাগন, কোনওটা আবার সাপের মতো দেখতে। ও শুনেছে, চিনারা এত শৌখিন যে, এইসব ঘুড়ি না কি সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক, হংকং, এমন কী ক্যান্টন থেকেও আনায়। ছোটবেলায় দেব ঘুড়ি ওড়াতে ভালবাসত। বিশ্বকর্মা পুজোর আগে কাচের গুঁড়ো দিয়ে মাঞ্জা বানাত। একবার আঙুল কেটে গেছিল বলে মায়ের কাছে ও খুব বকুনি খেয়েছিল। সেই দিনগুলোয় ফিরে যাওয়ার মাঝেই ঘরের ভিতর থেকে তমাল ওকে ডাকল, ‘দেব, একবার ভিতরে আয়। ব্যাঙ্কক থেকে সব ইনফো পেয়ে গেছি।’

তমাল সকালে মি. এশিয়া প্যাসফিক কনটেস্টের চিফ অর্গানাইজার দুশিত চাইম্যানের কাছে কয়েকটা মেল পাঠিয়েছিল। কনটেস্টের মাত্র আর দশদিন বাকি। কিন্তু ওকে কতদিন আগে পৌঁছতে হবে, কোথায় গিয়ে উঠতে হবে, কোন জিম-এ ওয়ার্ক আউট করার সুযোগ পাবে, এই রকম অনেক তথ্য জানা বাকি ছিল দেবের। সাধারণত, এই তথ্যগুলো পাওয়া যায় দেশের ফেডারেশন কর্তাদের কাছে। তাঁরাই বডিবিল্ডারদের জানিয়ে দেন কী করতে হবে। কিন্তু কমলদারা ওকে কোনও খবরই দেননি। পোজিং শেখানোর জন্য কমলদাকে আর না ডাকায়, উনি চটে আছেন। ইন্টারনেটের যুগে অবশ্য কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা, এমন কিছু কঠিন না। তমাল চেষ্টা করে যাচ্ছিল সরাসরি চাইম্যানকে ধরার। তাই দ্রুত পায়ে দেব ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ইনফো পেলি?’

তমাল বলল, ‘আমি আজ মেল না করলে তুই কনটেস্ট থেকে ছাঁটাই হয়ে যেতি দেব।’

‘কী বলছিস তুই!! আমি তো ছ’মাস আগে নাম এন্ট্রি করেছিলাম।’

‘করেছিলি। কিন্তু তুই যে পার্টিসিপেট করবিই, সেটা কনফার্ম করার ডেটলাইন তুই ফেল করেছিস। গতকাল সেই ডেট পার হয়ে গেছে। ওরা অনেকদিন আগেই কমলদাদের কাছে জানতে চেয়েছিল। ওরা ইন্ডিয়া থেকে শুধু সুবোধ মহাপাত্রের নামটা কনফার্ম করেছেন।’

ওড়িশার এই ছেলেটাকে কমলদা ট্রেনিং দিচ্ছেন। সোজা হিসেব, কমলদা তাই চাননি, ও ব্যাঙ্ককে যাক। রেগে গেলেও দেব কখনও কাউকে গালি দেয় না। তবুও ও বলে ফেলল, ‘কমলদা কী হারামির গাছ দেখেছিস তমাল। ফেডারেশন থেকে এ বার এদের ছেঁটে ফেলার সময় এসেছে।’

‘কুল ডাউন মাই ফ্রেন্ড। ওপরে ভগবান আছেন। কন্সপিরেসি করে কাউকে আটকানো যায় না। তোর কপাল ভাল, ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল থাকায় কাল ব্যাঙ্ককে ছুটি ছিল। তাই কনফার্মেশনের জন্য বাড়তি একটা দিন তুই পেয়ে গেছিস। মি. চাইম্যান তো এন্ট্রি অ্যাকসেপ্ট করেছেন।’

শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল দেব। এমনিতেই সকাল থেকে নানা কারণে ওর মন খারাপ। কিন্তু তমালের কাছে এলে সবসময় ও পজিটিভ ভাইভস পায়। ল্যাপটপে চোখ রেখে তমাল কথা বলে যাচ্ছে। ওর চোখমুখ থেকে আত্মবিশ্বাস ফুটে বেরচ্ছে। দেখে দেব জিজ্ঞেস করল, ‘আর কী খবর পেলি?’

‘কনটেস্টের মিনিমাম এক সপ্তাহ আগে তোকে ব্যাঙ্ককে পৌঁছতে হবে। যে হোটেলে তোদের রাখা হবে, তার নাম সানগ্রিলা। সেখানেই বিরাট ফিটনেস সেন্টার আছে। তুই নিখরচায় ওয়ার্ক আউট করার সুযোগও পাবি। সানগ্রিলার অডিটোরিয়ামেই কনটেস্ট হবে। ফলে তোকে বাইরে বেরতেই হবে না। মি. চাইম্যান লিখেছেন, তোর ফুডচার্ট আগেই পাঠিয়ে দিতে।’

সে কি! এক সপ্তাহ আগে ব্যাঙ্ককে যেতে হবে! তার মানে তো আর তিনদিন বাকি। প্রিপারেশন নিয়ে দেবের কোনও সমস্যা নেই। নিষ্ঠাভরে গত ছয়মাস শরীর তৈরি করার কাজটা করে গেছে। বাকি শুধু জিম থেকে পনেরো দিন ছুটি নেওয়ার কথাটা আনন্দী ম্যাডামকে বলা। নতুন করে প্লেনের টিকিট কাটা। বালিগঞ্জে থাইল্যান্ড এমব্যাসিতে গিয়ে ভিসা নেওয়া। টেনশন অনুভব করে দেব বলল, ‘তা হলে তো আর সময় নেই। টিকিটের অ্যারেঞ্জমেন্টটা তুই করে ফ্যাল। কালই ভিসা করে ফেলতে হবে।’

তমাল বলল, ‘টিকিট নিয়ে তুই চিন্তা করিস না ভাই। হোটেলের ট্রাভেল ডেস্ক আজ বিকেলের মধ্যে করে দেবে। আগাম ভিসা নেওয়ারও কোনও দরকার নেই। চাইম্যান লিখেছেন, ব্যাঙ্কক এয়ারপোর্টে অন অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়া যাবে। কনটেস্টের কাগজপত্র দেখালে তোকে লাইনেও দাঁড়াতে হবে না। কোন ফ্লাইটে যাচ্ছিস, সেটা অর্গানাইজারদের জানিয়ে দিলে, ওরাই হোটেলের জন্য পিক আপ করে নেবে তোকে এয়ারপোর্ট থেকে!’

‘তা হলে তো কোনও প্রবলেম নেই।’

‘আছে, ফ্রেন্ড আছে। প্রত্যেক পার্টিসিপেন্টকে একজন করে ম্যানেজার নিয়ে যেতে হবে। যেমন, সুবোধ মহাপাত্রের সঙ্গে যাচ্ছেন তোদের কমলদা। চাইম্যান জানতে চেয়েছেন, তোর ম্যানেজার হিসেবে কে যাবেন? তার ডিটেলসও আগে পাঠিয়ে দিতে হবে।’

‘ম্যানেজার নিয়ে যেতে হবে কেন?’

‘ইন্টারন্যাশনাল রুল। ওরা চান না, কোনও কারণে তোদের কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হোক। ম্যানেজার তোর হয়ে সব কাজ করে দেবে। অর্গানাইজারদের সঙ্গে সে যোগাযোগ রাখবে, তোর দেখভাল করবে। কাকে তুই নিয়ে যেতে চাস বল। কনটেস্ট সম্পর্কে খানিকটা আইডিয়া আছে, এ রকম লোক হলে ভাল হয়।’

জগাদা বেঁচে থাকলে কোনও সমস্যাই হত না। দেব চিন্তা করতে লাগল, ফেডারেশনের আর কাকে অ্যাপ্রোচ করা যায়। কিন্তু চোখের সামনে কারও মুখ ভেসে উঠল না। বাধ্য হয়ে ও বলল, ‘তুই চল না। তুই ছাড়া আর কে এই দায়িত্বটা সামলাতে পারবে?’

‘আনন্দী ম্যাডাম আমাকে ছুটি দেবেন না। বিয়ের সিজন চলছে। তুই অন্য কারোর কথা ভাব। জিম-এ কি কেউ আছে, যার ধারণা আছে বডিবিল্ডিং কনটেস্ট সম্পর্কে?’

তমাল মন্দ সাজেশন দেয়নি। প্রথমেই শিখিনদার কথা মনে হল দেবের। হিমাদ্রিও হতে পারে। বিকেলের দিকে ওরা দু’জন জিম-এ আসবে। ওদের অনুরোধ করা যেতে পারে। শুনে তমালও বলল, ‘তা হলে তো খুব ভাল হয়। কিন্তু ওরা দু’জনই সরকারী কর্মচারী। এত তাড়াতাড়ি ছুটি পাবেন কি না, সন্দেহ। শোন কাউকে যদি না পাস, তা হলে মিলেনাকে নিয়ে যেতে পারিস। ওর হয়তো কনটেস্ট সম্পর্কে কোনও আইডিয়া নেই। কিন্তু শিক্ষিত মেয়ে। চট করে সব বুঝে নিতে পারবে।’

শুনে বুকের ভিতরটা গুরগুর করে উঠল দেবের। এর থেকে ভাল আর কিছু হয় না। মিলেনা যদি সঙ্গে থাকে, তা হলে তার চেয়ে বড় ইন্সপিরেশন আর কী হতে পারে? চণ্ডীতলায় পিকনিক করে ফিরে আসার পর মাঝে দু’দিন মিলেনার সঙ্গে দেবের দেখা হয়নি। ওদের শ্রীকৃষ্ণাচৈতন্য টেম্পলে কী একটা পরব আছে। সেজন্য না কি খুব ব্যস্ত। মিলেনা বলেছিল, অনেকটা সময় ওকে টেম্পলে কাটাতে হবে। পিকনিক থেকে ফিরে আসার সময় ও খুব গম্ভীর মুখ করে বসেছিল। তমাল ওকে হাসানোর অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও, হাসেনি। কাল রাতে অল্প সময়ের জন্য ও ফোন করেছিল। বলেছে, নাজমা মেয়েটা সারাক্ষণের জন্য এখন থেকে স্টিফেন ম্যানসনেই থাকবে। ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। শুনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে দেব। মিলেনাকে আর একা থাকতে হবে না। ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্য।

তমাল ল্যাপটপ বন্ধ করে বলল, ‘আমি কিচেনে চলে যাচ্ছি। তুই পারলে মিলেনাকে ফোন করে জেনে নিস, ও ব্যাঙ্ককে যেতে পারবে কি না? বিকেলে সব ফাইনাল করে, মেল পাঠিয়ে দেবো মি. চাইম্যানকে।’

খানিক পরে লিফটে করে নীচে নেমে আসার সময় ফের জগাদার কথা মনে হল দেবের। জগাদা খুব বেশিদূর লেখাপড়া করেননি। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে এমন সব কথা বলতেন, মনের জোর বেড়ে যেত। জীবনে প্রথমবার বাগবাজার ব্যায়াম সমিতির বঙ্গকুমার কনটেস্টে ও নামবে। গ্রামের ছেলে, কোনও বডিবিল্ডারকে ও তখন চেনে না। সেইসময় কলকাতার আখড়াগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এমন অনেকে বলেছিলেন, ‘যাচ্ছিস যা। ওখানে তুই পাত্তা পাবি না। তোর লোয়ার পোর্সন-এর মাসল ভলিউম কম।’ জগাদা কিন্তু উল্টো কথা শুনিয়ে ছিলেন। ‘এতদিন ধরে খাটছিস। নিরাশ হোস না। মনে কর, সাকসেস-এর দরজাটা বন্ধ আছে। তোর হাতে একগোছা চাবি। একটার পর একটা চাবি দিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করিস। দেখবি, কোনও একটা চাবি দিয়ে দরজাটা ঠিক খুলে যাবে।’ বাগবাজারে ঠিক তাই হয়েছিল। কাফ আর থাই মাসল-এ ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও দেব বঙ্গকুমার হয়ে গেছিল।

রাস্তায় নেমে দেব ঠিক করে নিল, এই ক’টা দিন ব্যাঙ্ককের কনটেস্ট ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ও ভাববেই না। আনন্দী ম্যাডামকে বলে আসবে, আগামী কয়েকটা দিন আমি ফ্রি থাকতে চাই। জিম-এর দায়িত্ব আপনি এই ক’দিন অন্য কারও হাতে দিন। আমি শুধু দু’বেলা প্র্যাকটিস করার জন্য জিম-এ আসব। ম্যাডাম যদি জিজ্ঞেস করেন, দায়িত্ব নেওয়ার মতো কে আছে, তা হলে দেব পাণ্ডেজির কথা বলবে। ভদ্রলোক বয়স্ক, মেম্বারদের সবাইকে চেনেন। প্রত্যেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেন। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজকর্মগুলো দেখাশোনা করেন। মাত্র দু’ সপ্তাহের ব্যাপার, উনি ঠিক চালিয়ে নিতে পারবেন। রাস্তায় কয়েকটা পা হাঁটার পরই দেবের মনে হল, পাণ্ডেজির বদলে যদি ম্যাডাম তিন নম্বর জোনের ট্রেনার দুর্বার চৌধুরীর নাম করেন, তা হলে কি হবে? এতটা কঠোর কি উনি হতে পারবেন?

মনে অশান্তি নিয়েই রাস্তা পেরোল দেব। তখনই পিছনই থেকে শুনতে পেল, ‘দেবদা, একটু দাঁড়ান।’

পিছন ঘুরে দেব দেখল নাড়ুগোপাল। চণ্ডীতলার রন্তিমাসির ছেলে। ওর কাঁধে একটা ছোট কিট ব্যাগ। তার মানে আজই চণ্ডীতলা থেকে কলকাতায় এল। বিএ পাস করে ছেলেটা প্রায় বছর দেড়েক বাড়িতে বসে ছিল। এদিকে, প্রেম করে বিয়ে সেরে ফেলেছে। রন্তিমাসি প্রায়ই বলত, ‘কলকাতায় তো তোর এত জানাশোনা। আমার ছেলেটাকে একটা চাকরিবাকরি জোগাড় করে দে না বাবা।’ মাসছয়েক আগে মোকাম্বো রেস্টুরেন্টে হেড বারটেন্ডার গোমসকে রিকোয়েস্ট করে নাড়ুগোপালের একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে দেব। বেয়ারার চাকরি, মাসমাইনের সঙ্গে টিপস… ছেলেটা মন্দ কামায় না।

পিকনিকের দিন চণ্ডীতলায় ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মাঝের তিনটে দিন ওখানেই ছিল না কি? ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পড়ে দেব বলল, ‘এখন চণ্ডীতলা থেকে এলি না কি?’

‘হ্যাঁ দেবদা। গোমসদা মাত্তর দু’দিনের ছুটি দিয়েছিল। কিন্তু ফিরতে চারদিন হয়ে গেল। তুমি একবার ফোন করে গোমসদাকে বলে দেবে, যাতে রাগারাগি না করে?’

ওহ, এই কারণে নাড়ু ওর জন্য অপেক্ষা করছিল? দেব মনে মনে অসন্তুষ্ট হল শুনে। এই ছেলেগুলোর কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। গোমস তো চটে থাকবেই। সারাদিন মোকাম্বোতে কোনও সিট খালি থাকে না, এত ভিড় হয়। বেয়ারাদের একজন কামাই করলে সত্যিই অসুবিধে। কামাইয়ের কী অজুহাত দেয়, তা শোনার জন্য দেব জিজ্ঞেস করল, ‘বউ আসতে দেয়নি বুঝি?’

‘না গো। কারণটা তোমাকে বলা যাবে না।’

এমনিতেই মাথায় ব্যাঙ্ককের চিন্তা। তার উপর এই খুচরো ঝামেলা। দেব বলল, ‘তা হলে তুই বাড়ি ফিরে যা। গোমসকে আমি বলে দিচ্ছি, তোকে যেন আর না রাখে।’

‘আমাকে মাফ করে দাও দেবদা। কারণটা কত্তামা তোমাকে বলতে মানা করে দিয়েছিল।’

মাকে নাড়ুগোপাল কত্তামা বলে ডাকে। মা বারণ করে দিয়েছে, শুনে দেব বলল, ‘কেন রে?’

‘পিকনিকের দিন সন্ধেবেলায় তোমরা চলে আসার পর কত্তামা গায়ে আগুন লাগাতে গেছিল। ভাগ্যিস, আমি ছিলাম সেইসময়। আমি আর সুকুমারদা মিলে কত্তামাকে আটকাই।’

মা সুইসাইড করতে চেয়েছিল! কেন? নাড়ু ছলছল চোখে বলল, ‘ছোটমুখে বড় কথা। কিছু মনে কোরো না দেবদা। মিলেনাদিদিকে কত্তামার পছন্দ হয়নি। জেঠিমা, খুড়িমাও যা তা বলছিল মিলেনাদিদির সম্পর্কে। কত্তামাকে বলছিল, ঘরে রাধামাধবের বিগ্রহ আছে, শেষপর্যন্ত কেরেস্তান বউ নিয়ে আসবি? ছি ছি, কেরেস্তানরা তো গরুর মাংস খায়। ওদের ছোঁয়া পর্যন্ত বারণ আমাদের সমাজে। এ সব শুনে ঘরের দোর দিয়েছিল কত্তামা। সুইসাইড করেই ফেলত আমরা না থাকলে।’

এ সব কী বলছে নাড়ু! পিকনিকের দিনের কথা মনে পড়তে লাগল দেবের। মিউজিক্যাল চেয়ারের সময় মিলেনার সঙ্গে ধাক্কা লাগার পর, ছোট খুকি ‘চান করতে হবে’ বলে, খেলা ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল। সন্ধেবেলায় ওরা যখন চলে আসছে, তখন জেঠিমা-খুড়িমারা কেউ ঘর থেকে বেরয়নি। মা সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু মিলেনা প্রণাম করতে গেলে, সভয়ে সরে গেছিল। দেবের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল এই ভেবে যে, এখনও এই কুসংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারল না সমাজ! ইস, মিলেনা কি বাড়ির লোকেদের আচরণে কিছু বুঝতে পেরেছিল? সেই কারণেই কি ফেরার সময় পুরো রাস্তা গম্ভীর হয়ে বসেছিল? দেব জিজ্ঞেস করল, ‘মা এখন কেমন আছে রে?’

নাড়ু বলল, ‘এখন বেডরিডেন। প্রদীপ্ত ডাক্তারকে সুকুমারদা ডেকে এনেছিল। কত্তামা তাকে বলছিল, আমার আর বাঁচার ইচ্ছে নেই। তুই এমন ওষুধ দে, যাতে ঘুমের মধ্যেই আমি চলে যেতে পারি। তার পর তোর বন্ধুকে খবর দিস। জানো, এই ক’দিন কত্তামা মুখে কুটোটিও তোলেনি। শুয়ে শুয়ে শুধু চোখের জল ফেলছে। মা আমাকে আটকে দিল। দুটো দিন থেকে যা বাবা। এই অবস্থায় তোর কত্তামাকে ফেলে চলে যাস না। মায়ের আদেশ অমান্য করতে পারলাম না দেবদা। কত্তামা দিব্যি না দিলে সেদিনই তোমাকে ফোন করে সব জানিয়ে দিতাম।’

‘মায়ের আদেশ’ কথাটা শুনে দেব চমকে উঠল। ও নিজেও তো মায়ের আদেশ সবসময় পালন করে এসেছে। সেই মা… ওকে ভুল বুঝল? ভাবতেই দেবের মাথার ভিতরটা শূন্য হয়ে গেল। ও বলে বসল, ‘কী করা যায়, বল তো নাড়ু?’

‘একবার ফোন করো কত্তামাকে। আগে রিঅ্যাকশনটা দেখো। তারপর চণ্ডীতলায় যাবে কি না, ভেবো।’

উত্তরের অপেক্ষায় নাড়ু মুখের দিকে তাকিয়ে। সেই সময় দেবের নজরে পড়ল, জিম-এর গেটের সামনে তিন-চারটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। রুস্তমের দল না কি? কোনও ঝামেলা করতে আসেনি তো? ছেলেগুলোকে দেখে দেবের মনে কুডাক দিল। তাড়াতাড়ি ও বলল, ‘ঠিক আছে নাড়ু। তুই এখন যা। গোমসকে আমি যা বলার, বলে দেবো।’ বলে আর দাঁড়াল না ও।

কয়েক পা হেঁটে দেব জিম-এর গেটের কাছে পৌঁছতেই ছেলেগুলোর একজন চিৎকার করে উঠল, ‘মাদারচোত এসে গেছে। রিয়াজ চল। একে তুলে নিয়ে যাই ওস্তাদের কাছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *