স্টিফেন ম্যানসন – ৩০

(ত্রিশ)

অ্যানার বিয়ে নিয়ে মিলেনা এ ক’দিন এমন মজে ছিল, ফেসবুক খোলা বা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজগুলো দেখার সময়ই পায়নি। আজ স্কুল থেকে ফিরে লাঞ্চ সেরে ও মোবাইল সেটটা নিয়ে বসল। প্রায় একশোটার বেশি মেসেজ আর ভিডিয়ো লোড হয়ে আছে। সাধারণত, মেসেজগুলো পড়েই মিলেনা ডিলিট করে দেয়। সবগুলো পড়তেই ওর ইচ্ছে করে না। ওদের তিন-চারটে গ্রুপ আছে। সেগুলোই ক্লিক করে দেখে। তার মধ্যে একটা হল জেএনইউ কমরেডস। সেটা ওপেন করে মিলেনা দেখল, ‘অনিন্দিতা ছবি পাঠিয়েছে। সাউথ সিটি মল-এর ফুট কোর্টে বসে তোলা। তলায় লিখেছে, ‘কালই কলকাতায় এসেছি। উঠেছি পার্ক স্ট্রিটের সিলভার হোটেলে। থাকব আরও দু’দিন।’

ভাগ্যিস, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ বক্সটা খুলেছিল! জেএনইউতে অ্যান্ডি… অনিন্দিতা ব্যানার্জি ওর সবথেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। পাঁচটা বছর ওরা দিল্লি দাপিয়ে বেরিয়েছে। ও কলকাতায় চলে এল। প্রায় ওইসময়টাতেই অ্যান্ডি চলে গেল স্টেটসে। অস্টিন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো করতে। মাঝে কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে দু’জনের মধ্যে। অ্যান্ডি বলেছিল, ইউনেস্কোতে চাকরি পেয়েছে। সেই অ্যান্ডি এখন কলকাতায়! মিলেনার তর সইল না। সঙ্গে সঙ্গে ভিডিয়ো কল করল। পর্দায় দেখল, হোটেলের রেস্তোরাঁয় বসে লাঞ্চ করছে অ্যান্ডি, এক বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে। চেহারাটা কর্পোরেট টাইপের হয়ে গেছে। কাঁধ অবধি চুল ছাঁটা। পরনে কোট-প্যান্ট। তবে স্বভাবটা এখনও বদলায়নি। ওকে দেখে অ্যান্ডি খিঁচিয়ে উঠল, ‘ফোনটা যমুনার জলে ফেলে দে। কতবার ফোন করেছি তোকে, জানিস? কী এমন রাজকার্যে ব্যস্ত আছিস, রিং ব্যাক করার সময় পাসনি?’

দিল্লিতে কখনও ফোনে ওকে না পেলে অ্যান্ডি চটে গিয়ে বলত, ফোনটা যমুনায় ফেলে দে। বোধহয় ভুলে গেছে ও এখন কলকাতায়। মুচকি হেসে মিলেনা বলল, ‘ফোন করেছিলি না কি? হতে পারে। তুই তো জানিস, আনসেভড নাম্বার দেখলে আমি রিং ব্যাক করি না। কেমন আছিস, কলকাতায় কেন, বল।’

অ্যান্ডি বলল, ইউনেস্কোর কাজে। তোদের ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট গভর্নমেন্ট একটা অনুদান চাইছে। স্লাম ডেভেলপমেন্টের জন্য। সেটা স্যাংশন করা উচিত কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্যই এসেছি। তোকে না পেয়ে সুভদ্রাকে ফোন করলাম। কাল সন্ধেবেলায় আমরা সাউথসিটি মল-এর কোর্টে গিয়ে বসেছিলাম। মলটা মন্দ না। মনে হচ্ছিল, আমি অস্টিনে আছি।’

জেএনইউতে ওদের সঙ্গে পড়ত, সুভদা চাকলাদার বলে একটা মেয়ে। তার বাড়ি ছিল দিল্লির লছমীবাই নগরে। মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘সুভদ্রা এখন কলকাতায় না কি?’

‘হ্যাঁ। মাস তিনেক হল কলকাতায় পোস্টিং পেয়েছে। তুই কি জানিস, ও এখন আইএএস?’

‘না, জানতাম না। ওর সম্পর্কে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। তোর এখন প্রোগ্রাম কী?’

‘লাঞ্চের পর ঘণ্টা চারেক ফাঁকা। পাঁচটায় সেক্রেটারিয়েটে যেতে হবে বস-এর সঙ্গে। সিএম-এর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। কলকাতায় তুই কোথায় থাকিস ভোম্বলকুমারী?’

অ্যান্ডি চটে গেলে অনেকসময় ওকে ভোম্বলকুমারী বলে ডাকত। মানেটা কি, জিজ্ঞেস করেও ও কোনওদিন উত্তর পায়নি। মিলেনা বলল, ‘সিলভার হোটেলের ঠিক দুটো বাড়ি পরে। স্টিফেন ম্যানসনে।’

‘তা হলে দশ মিনিটের মধ্যে চলে আয়। না এলে কিন্তু আমি শুধু প্যান্টি পরে তোর বাড়িতে চলে যাবো।’

আঁতকে উঠে মিলেনা বলল, ‘মাই গুডনেস! কলকাতায় এসব চলে না। আমার মান সম্মান সব চলে যাবে। তোকে আসতে হবে না ভাই। আমি এখুনি তোর কাছে যাচ্ছি।’

অ্যান্ডি এমন ডেয়ারডেভিল টাইপের মেয়ে, যা বলছে, করে দেখাতেও পারে। জেএনইউতে পাঁচটা বছর স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি কলেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে। স্টুডেন্টস ইউনিয়নের নেতা ছিল। সারা বছর বিক্ষোভ, মিছিল, স্লোগান পার্টিতে ওকে সামনের সারিতে দেখা যেত। একবার এক প্রোফেসার মদ খেয়ে ক্লাস নিয়ে এসেছিলেন দেখে অ্যান্ডি জুতো ছুঁড়ে মেরেছিল। আরেকবার প্রিন্সিপালের জামায় কালি ছিটিয়ে দেয়। প্রায় রাস্টিকেট হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু লেখাপড়ায় আউটস্ট্যান্ডিং ছিল বলে, কাউন্সিল ওকে ধমক দিয়ে ছেড়ে দেয়। কাগজে একবার অ্যান্ডিকে নিয়ে লেখালেখিও হয়েছিল। কলেজের স্টাডি গ্রুপের সঙ্গে সেবার মুম্বইয়ে গিয়ে, ব্যাচমেটদের সঙ্গে ও বাজি ধরে, ভোরবেলায় জুহু বিচে নেকেড হয়ে ঘুরে আসবে। এমন বুকের পাটা, সত্যিই জুহু বিচে নেকেড অবস্থায় ও ঘুরেছিল। মিড ডে-র এক ফোটোগ্রাফার ছবিটা তুলে ছাপিয়ে দেয়। অ্যান্ডির এমন কপাল, ওই ছবিটার জন্যই ও না কি বলিউড থেকে অফার পেয়েছিল, হিন্দি ছবি করার।

চরিত্রগত দিক থেকে অ্যান্ডির সঙ্গে ওর কোনও মিলই ছিল না। তবুও, ওরা দারুণ বন্ধু ছিল। বসন্ত বিহারে যে বাড়িতে মিলেনা থাকত, সেখানে পড়াশুনোর জন্য এসে, প্রায় রাতেই অ্যান্ডি থেকে যেত। বাড়ির টান ওর ছিল না বললেই চলে। ওর ছোটবেলায় মা আর বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছিল। মা ছিলেন সেন্ট্রাল গর্ভমেন্টের অফিসার। হোস্টেলে থাকত বলে, মাকে পাত্তাই দিত না অ্যান্ডি। একবার আলুওয়ালিয়া বলে একটা ছেলে মিলেনার সঙ্গে অসভ্যতা করায়, অ্যান্ডি ছেলেটাকে এমন বেইজ্জত করেছিল, কলেজ ছেড়েই সে পালিয়ে যায়। একটা সময় সুভদ্রারা রটানোর চেষ্টা করেছিল, মিলেনার ড্যাডি মাল্টিমিলিওনিয়ার বলে, অ্যান্ডি ওর পিছনে পিছনে ঘোরে। কিন্তু আসল কারণটা জানত একমাত্র মিলেনা। পুষ্পাজিজি… ওর গর্ভনেস পুষ্পা গুরুংয়ের টানেই অ্যান্ডি ঘনঘন বসন্তবিহারে যেত। গোর্খা ওই মহিলার ভিতর ও কি দেখেছিল, কে জানে? গুরু মায়ের মতো শ্রদ্ধা করত। মিলেনার মাঝে মাঝে সন্দেহ হত, দু’জনের বন্ডিংয়ের কারণটা ব্ল্যাক ম্যাজিক কি না? পুষ্পাজিজি কিন্তু ব্ল্যাক ম্যাজিক জানত।

এ সব কথা ভাবতে ভাবতেই মিলেনা পৌঁছে গেল সিলভার হোটেলে। অ্যান্ডিকে চমকে দেওয়ার জন্য ও শাড়ি পরে গেছিল। দরজা খুলে ওকে দেখে, হাগ করে অ্যান্ডি বলে উঠল, ‘অ্যাদ্দিনে তোকে সত্যি ভোম্বলকুমারী বলে মনে হচ্ছে। আয়, আয়, কতদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা হল।’

অ্যান্ডির পরনে একটা শর্ট প্যান্ট আর ঢিলে সুতির কুর্তি। এখন ওকে আগের মতো হোস্টেলর মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। খুশিতে ওর চোখ মুখ ঝলমল করছে। মিলেনা বলল, ‘তোকে দেখে হিংসে হচ্ছে ভাই। বিদেশে গিয়ে পড়াশুনোটা কমপ্লিট করলি, বিদেশে চাকরি… লাইফটাকে এনজয় করছিস।’

‘তোকে কে বারণ করেছে রে ভোম্বলকুমারী?’ অ্যান্ডি বলল, ‘একটাই লাইফ। যা ইচ্ছে করে নাও। আমি তোর মতো না কি? সব সময় বাড়ির কথা ভেবে পা ফেলব? তোর ছাব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেল, এখনও কোনও পুরুষকে নিয়ে বিছানায় গড়াতে পারলি না। ভ্যাজাইনা যেমন ছিল, তেমন রয়ে গেল। তুই মেয়ে সমাজের কলঙ্ক।’

কলেজ লাইফেও অ্যান্ডি খুব মুখ খারাপ করত। কিন্তু কলেজের ডিবেটে যখন পার্টিসিপেট করত, বা স্টুডেন্টদের সামনে বক্তৃতা দিত, তখন মনে হত, ওর মতো গুণী-জ্ঞানী সুবক্তা হয় না। অ্যান্ডির আক্ষেপ শুনে মিলেনার হাসি পেল। ও বলল, ‘স্টেটসে গিয়ে তোর অনেক উন্নতি হয়েছে।’

‘বুঝতে পেরেছিস বলে, থ্যাঙ্কস। আসলে কি জানিস, আমেরিকানরা যে ভাষায় কথা বলে, সেটা রপ্ত করার চেষ্টা করছি। সঠিক বাংলায় অনুবাদ করলে, কানে আঙুল দিবি। ওরা প্রতিটা লাইনে একবার করে ফাকিং কথাটা উচ্চারণ করে। যদিও তোর কোনও এক্সপিরিয়েন্স নেই, তবুও ফাকিং কথাটার মানে নিশ্চয় জানিস। যাক সে কথা। সুভদার মুখে শুনলাম, তুই না কি এখন একটা মন্তেসরিতে পড়াচ্ছিস?’

‘সুভদ্রা জানল কি করে?’

‘ফেস বুকে তোদের কমন ফ্রেন্ডের কাছ থেকে। আজকাল সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিংয়ের যুগে কারও কোনও কথা চাপা থাকে না কি? সুভদ্রা কাল তোকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করছিল। বলছিল, তোদের আর্মেনিয়ান সোসাইটিতে যতক্ষণ না মেয়েরা ড্যাডির কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে, বিছানায় আর একা থাকতে পারছি না, ততক্ষণ না কি তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকে।’

কলেজে সুভদ্রার সঙ্গে ওর রাইভালরি ছিল। স্রেফ পড়াশুনো নিয়ে। অ্যান্ডি সেই স্মৃতি উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সুভদ্রার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে মিলেনা বলল, ‘ঠিকই শুনেছিস। সময় কাটানোর জন্য বাচ্চাদের স্কুলে পড়াচ্ছি। আলটিমেটলি তো আমাকে একদিন না একদিন ড্যাডির বিজনেসে ঢুকে যেতেই হবে। তার আগে নিজেই বিয়েটা সেরে নেবো।’

‘মাই গুডনেস! তুই সিওর, তুই নিজের পছন্দমতো বিয়ে করবি। তা হলে পুষ্পাজিজি তো তোর সম্পর্কে ঠিকই বলেছিল!’

শুনে মিলেনা চমকে উঠল। পুষ্পাজিজির এই একটা গুণ ছিল। যাকে যা বলত, মিলে যেত। ও জিজ্ঞেস করল, ‘বলেছিল না কি! কবে বলেছিল?’

‘সে বহুত দিন আগে। তোর সঙ্গে আলুওয়ালিয়ার সেই ঘটনাটার পর আমি একদিন কথায় কথায় পুষ্পাজিজিকে বলে ফেলেছিলাম, মিলেনাটা এত ভাল মেয়ে। নিজেকে প্রোটেক্ট করবে কী করে? হেসে পুষ্পাজিজি বলেছিল, প্রোটেক্ট করার লোক ভবিষ্যতে ও নিজেই বেছে নেবে। তুই চিন্তা করিস না। আর আমাকে কী বলেছিল জানিস? তুই এদেশে থাকবি না। তখন বিদেশে যাওয়ার কথা আমার মাথাতেও আসেনি। ভাবতাম, ভবিষ্যতে পলিটিকসে নামব। বৃন্দা কারাত হব। কিন্তু হঠাৎ পিএইচডি করার চান্স পেয়ে গেলাম অস্টিনে। পুষ্পাজিজির কথা মিলে গেছিল। যাক গে, তোর কথা বল। তুই কি কাউকে পছন্দ করে রেখেছিস?’

ঘাড় নেড়ে মিলেনা জানাল, ‘হ্যাঁ। তোর মতো বেঙ্গলি। বছর খানেক ধরে চিনতাম। কিন্তু আমাদের অ্যাফেয়ার চলছে মাস চারেক।’

‘আমার একটা অ্যাডভাইস নিবি ভোম্বলকুমারী? পুষ্পাজিজির সঙ্গে একবার কথা বলতে পারিস। ওর আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। বলে দিতে পারবে, তোর সঙ্গে ছেলেটার জেল করবে কি না।’

দিল্লি থেকে ও কলকাতায় চলে আসার পর পুষ্পাজিজি দার্জিলিংয়ে ফিরে গেছিল। মিলেনা তখন অনেক বার অনুরোধ করেছিল, যাতে কলকাতায় আসে। কিন্তু পুষ্পাজিজি কিছুতেই আসতে চায়নি। ছেলে বড় হয়ে গেছে। ওকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করতে হবে। এইসব অজুহাত দিয়েছিল। তার পর যা হয়, প্রথম কয়েকমাস ফোনে যোগাযোগ ছিল পুষ্পাজিজির সঙ্গে। এখন আর নেই। সে কথা বলতেই অ্যান্ডি চটে উঠল, ‘তুই এত হার্টলেস হতে পারলি কি করে ভোম্বলকুমারী? এতগুলো বছর যে তোকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে, সেই মানুষটার কোনও খোঁজই তুই রাখিস না? তোর মনে পড়ে না, দিল্লিতে মহাকালের পুজোর দিন বা ফুলপাতি ফেস্টিভ্যালে ও আমাদের জন্য কী করত? জানিস, পুষ্পাজিজি এখন ক্যান্সারে ভুগছে?’

উত্তর দেওয়ার মতো কথা জোগাল না মিলেনার মুখে। ও আমতা আমতা করে বলল, ‘সরি অ্যান্ডি। এই রোগটা পুষ্পাজিজির কবে হয়েছে? কই, আমায় তো কিছু জানাননি?’

‘জানতে চাইলেই জানতে পারতিস। পুষ্পাজিজি তোকে জানাতে বারণ করেছিল। কলকাতাতেও আসতে চায়নি। কী কারণে জানি না। তবে কথাবার্তায় আমার মনে হয়েছে, তোদের ফ্যামিলির কোনও রাজ ও জানে। সেই কারণ তোকে এখন অ্যাভয়েড করতে চায়।’

মিলেনা কথাটা বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, ‘তোর সঙ্গে কি যোগাযোগ আছে?’

‘আলবাত আছে। তুই তো জানিস, জীবনে প্রতিটা স্টেপে আমি কোনও প্রবলেমে পড়লেই ওর পরামর্শ চাইতাম। ও ঠিকঠাক প্রেডিকশন করে দিত। পুষ্পাজিজিকে আমি কতটা গুরুত্ব দিই তুই বুঝতেই পারছিস। কাল এসেই সল্ট লেকের টাটা ক্যান্সার হসপিটালে আমি ওকে ভর্তি করে দিয়েছি। তোর ভরসায় আমি ওকে রেখে যেতে চাই। মিলেনা, তুই দেখিস কিন্তু।’

‘সার্টেনলি। তুই এখানে আর ক’দিন আছিস অ্যান্ডি?’

‘পরশু বিকেল পর্যন্ত আছি। আমার আর একটা কাজ বাকি আছে। আমার মায়ের এক মাসতুতো বোন থাকে হুগলির চণ্ডীতলা বলে একটা জায়গায়। একটা সময় দু’জনে খুব ক্লোজ ছিল। মা বার তিন-চারেক দিল্লি থেকে সেখানে এসেওছে। মা বারবার করে বলে দিয়েছে, আমি যেন চণ্ডীতলায় যাই। সারাজীবন তো মায়ের কোনও কথা শুনিনি। কাল সেখানে যাবো ভাবছি। তুই কি জানিস, চণ্ডীতলা এখান থেকে কদ্দূর?’

চণ্ডীতলা মানে দেবদূতদের বাড়ি। মিলেনা বলল, ‘জানি, গাড়িতে গেলে ঘণ্টাখানেকেরে মতো লাগে। আমার পরিচিত একজন সেখানে থাকে।’

‘গুড। কাল সে কি আমার গাইড হতে পারবে? তুইও চল না, আমার সঙ্গে। যার কাছে যাব, তাঁর নাম নমিতা চ্যাটার্জি। ভদ্রমহিলার ছেলে নামকরা একজন বডিবিল্ডার। মি. ইন্ডিয়া হয়েছিল একবার। দেবদূত চ্যাটার্জি। তুই অবশ্য চিনতে পারবি না। কিন্তু মায়ের মুখে সেই ছেলেটার খুব প্রশংসা শুনেছি।’

মিলেনা আর চেপে রাখতে পারল না। গলগল করে বলতে লাগল দেবদূতের সঙ্গে ওর রিলেশনের কথা। ও যখন থামল, তখন লাফিয়ে উঠে অ্যান্ডি বলল, ‘ভোম্বলকুমারী, তোর পেটে পেটে এত শয়তানি। আমি তো তোর ননদ হতে যাচ্ছি তা হলে। তোকে আমি ছাড়ছি না। রাতে আজ আমার এখানে পার্টি। সেই হোস্টেল লাইফের মতো মস্তি। দেবদূতকে ধরে আন। সবাই মিলে নেকেড হয়ে নাচব।’

মিলেনা সভয়ে বলে উঠল, ‘অ্যাই না। তা হলে কিন্তু আমি আসব না।’

(একত্রিশ)

দুপুরবেলায় লাঞ্চ করতে এসে দেব দেখল, তমাল গম্ভীরমুখে টিভির চ্যানেল বদলে যাচ্ছে। সব সময় ও হাসিখুশি মেজাজে যাকে। প্রায়ই বলে, আনন্দে না থাকলে একজন শ্যেফ কিচেনে সাকসেসফুল হতে পারে না। রোজ ওকে দেখলেই হড়বড় করে কথা বলতে শুরু করে। আজ হাত-মুখ ধুয়ে, পোশাক বদলে এসেও দেব দেখল, বিছানায় উপুড় হয়ে তমাল শুয়ে আছে। পিঠে হালকা চাপড় মেরে ও জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে, তোর মুড অফ কেন?’

উঠে বসে তমাল গম্ভীর মুখে বলল, ‘এখানে আর খুব বেশিদিন চাকরি করা যাবে না ফ্রেন্ড। আজই সেটা বুঝতে পারলাম।’

ব্যাপারটা তা হলে সিরিয়াস। ডাইনিং টেবলে বসে দেব জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, খুলে বল তো?’

তমাল বলল, ‘আনন্দী ম্যাডাম আজ কোয়েলকে ডেকে যা তা বলেছেন।’

সঙ্গে সঙ্গে কোয়েলের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল দেবের। মেসে আসার আগে আট নম্বর জোনে কোয়েলকে ও দেখে এসেছে। তখন ও দু’তিনজনকে যোগা শেখাচ্ছিল। ম্যাডাম কখন ওকে ডেকে বকাবকি করলেন, দেব বুঝতে পারল না। হ্যাঁ, দু’তিনদিন আগে ম্যাডাম ওকে একবার দেখা করতে বলেছিলেন। মায়ের অসুখের জন্য মেয়েটা বেশ কয়েকদিন কামাই করেছিল বলে। তখন কি কেউ ওর নামে কমপ্লেন করেছিল? না কি ম্যাডাম ওকে দিয়ে এমন কিছু করাতে চাইছিলেন, যা করতে কোয়েল রাজি নয়। দেব অবাক হল এই ভেবে যে, ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে আসার পর কোয়েল কিন্তু ওকে কিছুই জানায়নি। অথচ সামান্য সমস্যায় পড়লেও, কোয়েল প্রথমে ওকে জানায়।

‘তুই ভাব দেব, কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের লোকেরা কতটা হার্টলেস হতে পারে।’ তমাল বলল, ‘ম্যাডাম আজ বলে দিয়েছেন, পুজোর পর থেকে জিম-এ মেয়েদের সেকশনে ইনচার্জ হবে বিদিশা। ম্যাডাম কোয়েলের ডিউটি আওয়ার্সও বদলে দিয়েছেন। ফার্স্ট সেপ্টেম্বর থেকে ওর ডিউটি সন্ধে ছ’টা থেকে। ম্যাডাম না কি বলেছেন, তোমার জন্য জিম-এর অনেক বদনাম হয়ে গেছে। তোমার প্রতি দেবের সিমপ্যাথি আছে, আমি জানি। কিন্তু আমি তোমাকে টলারেট করব না।’

শুনে ভ্রু কুচকে তাকাল দেব। বিদিশা যদি ইনচার্জ হয়, তা হলে কোয়েলকে টিকতে দেবে না। দু’নম্বর হল, সন্ধে ছ’টা থেকে জিম-এ আসতে হলে কোয়েল বাইরে যোগা শেখানোর কাজগুলো করতে পারবে না। মেয়েটাকে দেব যতদূর চেনে, জিম-এর চাকরি ও আর করবে কি না সন্দেহ। কাজটা ও ছেড়ে দিলে বেশ কয়েকজন মেম্বারও জিম-এ আসা ছেড়ে দেবে। ইস, কী দুঃসময়ের মধ্যে দিয়েই না যাচ্ছে কোয়েল। বাড়িতে অশান্তির কথা মাঝে একদিন ও বলেছিল। দিদি-জামাইবাবু সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য ওকে চাপ দিচ্ছে। একদিন জিম-এর সামনে এসেও ওরা অসভ্যতা করে গেছে। তখন লোকজন জড়ো হয়ে গেছিল। ভাগ্যিস, তখন অনিরুদ্ধ জিম-এ ছিল। ও তেড়ে না গেলে কোয়েল আরও অপদস্থ হত।

অন্য দিকে, চাকরির জায়গাটাও ওর নড়বড়ে হয়ে গেল। দেবের মনে হল, আনন্দী ম্যাডাম ঠিক করেননি। কোয়েলের এগেনস্টে কোনও স্টেপ নেওয়ার আগে, ম্যাডামের উচিত ছিল, ওর পরামর্শ নেওয়া। উনি মালিক হতে পারেন, কিন্তু জিম চালান না। কথাটা ভেবে দেব জিজ্ঞেস করল, ‘কোয়েল কী ভাবছে রে? তোকে কিছু বলল?’

তমাল বলল, ‘ওর উপর দিয়ে একটা ঝড় চলে যাচ্ছে রে। ওকে আর কিছু ভাবতে দেবো না আমি। ওকে নিয়ে যা ভাবার, এখন থেকে আমি ভাবব। ওকে আমি বলে দিয়েছি, তোমাকে আর জিম-এ চাকরি করতে হবে না। এসো, দু’জনে মিলে কিছু ভাবি।’

‘বিয়ে করার কথা ভাবছিস না কি?’

‘এখনই বিয়ের কথা ভাবছি না রে। তোর ব্যাঙ্ককের কনটেস্ট না হওয়া পর্যন্ত আমি হোটেলের চাকরিটা ছাড়ব না। আমি চলে গেলে তোর প্রিপারেশন ঠিকঠাক হবে না। আর তো মাত্তর একমাস বাকি। কোয়েলকে আমি অ্যাডভাইস করেছি, এই ক’টা দিন কোনও রকমে মুখ বুঁজে কাটিয়ে দিয়ে, তার পর বেরিয়ে যেতে। ভাবছি, আমরা দু’জন মিলে একটা এসি রেস্টুরেন্ট খুলব।’

‘রেস্টুরেন্ট খুলবি? কোথায়? ইনভেস্টই বা করবে কে?’

‘ইনভেস্ট করার মতো লোক আছে। যতদিন না তাঁর টাকা ফিরিয়ে দিতে পারি, ততদিন সে সাইলেন্ট পার্টনার হিসেবে থাকবে। সবথেকে বড় কথা, ভাল একটা জায়গা পাওয়া গেছে। মল্লিকবাজারে কোয়েলদের বাড়িতে। ওদের অংশটা রাস্তার দিকে। বাঙ্গুর সায়েন্সস অফ নিউরোলজির ঠিক পাশেই। সারাদিন রোগীদের আত্মীয়স্বজনের ভিড় থাকে হসপিটাল চত্বরে। কাছাকাছি ভাল রেস্টুরেন্ট নেই। কোয়েলদের অংশে হাজার পাঁচেক স্কোয়ার ফুটের মতো স্পেস আছে। রিনোভেশন করে, ভালভাবে ইন্টেরিয়ার ডেকোরেশন করিয়ে নিলে দারুণ হবে। রেস্টুরেন্টের নামটাও ঠিক করে ফেলেছি… কোয়েল।’

‘কোয়েলের দিদি-জামাইবাবু রাজি হবে?’

‘তাতে কিছু আসে-যায় না। কোয়েলের মা উইল করে ওঁর অংশটা পুরো দিয়ে গেছেন কোয়েলকে। আলমারিতে সেই উইল খুঁজে পেয়েছে কোয়েল। আমি অলরেডি প্রোবেট করার জন্য দিয়েছি। কোয়েলের দিদি-জামাইবাবু জানো না।’

‘তোর রেস্টুরেন্ট তৈরি হতে মাস ছয়েক তো লাগবেই। সেই সময় কোয়েল থাকবে কোথায়?’

‘দেখি, কাছাকাছি কোনও হোস্টেল পাই কি না। ওর এক মামা থাকেন সোদপুরে। কিন্তু সেখান থেকে রোজ যাতায়াত ওর পোষাবে না।’

‘এত বড় একটা ভেঞ্চারে নামবি, কবে ভাবলি তুই?’

‘কোয়েলকে দেখার পর। তখনই মনে হয়, নিজেকে বদলাতে হবে। ওর বিষণ্ণ মুখটা দেখতাম। আর তখন ভাবতাম, এই মুখে হাসি ফেরাতে হবে। একে সুখে রাখতে হবে। তুই যদি কিছু মনে না করিস, তা হলে একটা কথা বলব? ব্যাঙ্কক থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসে তুই এখানে পড়ে থাকিস না ভাই। তখন বড় কিছু ভাবিস। মি. ইন্ডিয়া হওয়ার পর থেকে তুই নিজেই একটা ব্র্যান্ড। তোর ইমেজ ভাঙিয়ে জিম চালাচ্ছে আনন্দী ম্যাডাম। মি. এশিয়া প্যাসিফিক হওয়ার পর তোর ব্র্যান্ড ভ্যালু আরও অনেক বেড়ে যাবে। এখানে পড়ে থেকে সেটা তুই নষ্ট করিস না।’

নিজেকে নিয়ে কখনও ভাবেনি দেব। কোয়েল ওর জীবনে আসার পর যদি তমাল নিজেকে বদলাতে পারে, তা হলে মিলেনা ওর জীবনে আসার পর ও বড় কিছু ভাববে না কেন? আনন্দী ম্যাডাম কোয়েলের মাইনে কেটে নিচ্ছেন, এই কথাটা শোনার পর থেকে মনটা খারাপ হয়ে গেছে দেবের। ও বলল, ‘তুই ঠিক বলেছিস। দেখি, কম্পিটিশনটা যাক। তার পর নতুন করে সব ভাবব।’

‘ইউ মাস্ট দেব।’ তমাল বলল, ‘কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডটা খুব ক্রুয়েল। কোয়েলের ঘটনাটা তুই বিচ্ছিন্ন ভাবিস না। আমি এর মধ্যে অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছি। ম্যাডাম, তোকেও একটা ওয়ার্নিং দিলেন। তুই যদি সেটা বুঝতে পারিস, তা হলে তোর কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু, জিমটা তোর নিজের ভেবে যদি কোনও ডিসিশন নিতে যাস, যা ম্যাডামের পছন্দের না, তা হলে পরের কোপটা তোর উপর পড়বে। ম্যাডামের মতো কর্পোরেটরা সবসময় সেকেন্ডম্যান বেছে রাখেন। কোয়েলের ক্ষেত্রে যেমন বিদিশা। তোর ক্ষেত্রে তেমন দুর্বার চৌধুরী। ছেলেটার চালিয়াতি সেদিনই আমি ধরে ফেলেছি। ম্যাডাম ওকে দিয়ে তোকে অপদস্থ করবেন। যাক গে, এ সব আলোচনা আর কারও সঙ্গে করিস না। তুই বরং ব্যাঙ্ককের কনটেস্টের দিকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট মন দে। আপাতত, লাঞ্চটা সেরে নে। অলরেডি আধ ঘণ্টা লেট করে ফেলেছিস।’

তমালের কথাগুলো মনে ভেতর নাড়াচাড়া করতে লাগল দেব। ছোটবেলা থেকেই ওর বন্ধুর সংখ্যা খুব কম। স্কুলে পড়ার সময় চণ্ডীতলায় যখন সহপাঠীরা ফুটবল খেলতে যেত, তখন ও ঢুকে পড়ত জগাদার জিম-এ। জগাদা বলতেন, ‘বেশি বন্ধু না থাকাই ভাল। সবসময় মনে রাখবি, তোর বন্ধু হল ডাম্বেল আর বারবেল।’ জগাদার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে দেব। হ্যাঁ, উঁচু ক্লাসে গিয়ে প্রদীপ্তর সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তার পিছনে ছিল মা। ‘ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে তোর উপকারই হবে বাবা।’ পরীক্ষার সময় নোটস দিয়ে প্রদীপ্ত তখন খুব সাহায্য করত। এখনও সেই বন্ধুত্ব অটুট আছে। কর্মজীবনে এসে তমাল ওর মনের খুব কাছাকাছি এসেছে। বিদেশ থেকে পড়াশুনো করে এসেছে, তমাল আধুনিকমনস্ক ছেলে। বাস্তবজ্ঞান ওর থেকে অনেক বেশি। যা বলে, মিলে যায়। আনন্দী ম্যাডাম সম্পর্কে তমাল যা বলল, তা অনেকটাই সত্যি।

দেব হঠাৎ আবিষ্কার করল, ম্যাডাম আগের মতো নেই। আগে যখন-তখন ডেকে পাঠাতেন। বেশ কিছুদিন হল, দু’জনের মাঝে পাণ্ডেজিকে এনে দাঁড় করিয়েছেন। জিম-এর জন্য কোনও দরকার হলে পাণ্ডেজির সঙ্গে আগে ওকে কথা বলতে বলেন। এতদিন খেয়াল হয়নি। কিন্তু তমালের সঙ্গে কথাবার্তার পর দেবের এখন মনে হচ্ছে, রুস্তমের ক্যাম্পের ছেলে ববিকে জিম-এ ঢোকানোর পিছনেও ম্যাডামের কোনও উদ্দেশ্য আছে। সম্ভবত, সেক্স শো-এর পারফর্মার করার জন্য। কী ভয়ানক একটা কুপ্রস্তাব সেদিন দুর্বার দিল, দেব এখনও তা বিশ্বাস করতে পারছে না। পেন ড্রাইভের ফুটেজ দেখে ওর বমি পেয়ে গেছিল। পারফর্মার ছেলেটা মিউজিকের তালে ধীরে ধীরে পুরো উলঙ্গ হয়ে বিচ্ছিরিভাবে সেক্স অ্যাপিল দেখাচ্ছে। সামনে বসা বয়স্ক মহিলারা ওকে ছোঁয়ার জন্য হ্যাংলামি করছেন। বাস্তবে এ সব হয় না কি? আনন্দী ম্যাডাম ভাবলেন কী করে, ওকে দিয়ে যা ইচ্ছে, তাই করাবেন? পেন ড্রাইভটা এখনও ওর কাছেই পড়ে আছে। দুর্বার সেটা নিতে আসেনি। দেবও কাউকে কিছু বলেনি। এমন কী, তমালকেও না।

ধীরে সুস্থে লাঞ্চ সেরে দেব যখন হোটেলের নীচে নেমে এল, তখন বেলা সাড়ে চারটে বাজে। লাউঞ্জেই ও দেখল, মিলেনা দাঁড়িয়ে কথা বলছে মারিয়ার সঙ্গে। ওর পরনে গাঢ় নীল রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ি। কপালে লাল টিপ। মিলেনাকে শাড়ি পরা অবস্থায় একবারই দেখেছে দেব। ওর মনে হল, ডানা কাটা পরী দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দী ম্যাডামের কথা মন থেকে উড়ে গেল দেবের। কাছাকাছি যেতেই মিলেনা হাসিমুখে বলল, ‘তোমার জন্য কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি, জানো?’

দেব বলল, ‘সরি ম্যাডাম। তুমি আসবে জানলে, বেলা বারোটা থেকে অপেক্ষা করতাম। তমালের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছিলাম। কিন্তু তুমি হোটেলে কেন?’

‘বলছি। আমেরিকা থেকে আমার এক বন্ধু এই হোটেলে এসে উঠেছে। ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। তার কথা পরে বলছি। আগে বলো, শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে?’

‘অসাম। মিস ইউনিভার্স আর মিস ওয়ার্ল্ডের কম্বিনেশন। এমন সুন্দরী আর কখনও আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু শাড়িটা তুমি পেলে কোথায়?’

‘দোকান থেকে কিনে এনেছি। আগে একদিন এই শাড়িটা পরে শ্রীকৃষ্ণাচৈতন্য টেম্পলে গেছিলাম। ওখানকার ভক্তরাও বললেন, আমি না কি শাড়ি ঠিকঠাক ক্যারি করতে পারছি।’

‘আমরা কী মনে হচ্ছে জানো। তোমাকে এখুনি আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই।’

মিলেনা ভাবল একবার বলে, কাল চণ্ডীতলায় তোমাকে যেতেও হতে পারে। কিন্তু মারিয়ার সামনে কথাটা বলা ঠিক হবে না। যা বলার ও দেবদূতকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বলবে। ও পা বাড়িয়ে বলল, ‘চলো যেতে যেতে কথা বলি।’

‘তোমার বাড়ির খবর কি মিলেনা? এভরিথিং ওকে?’

‘গ্র্যান্ডপা কাল ফ্ল্যাটে এসে ওঁর কিছু দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে গেছেন। বলে তো গেলেন, আর আসবেন না। কিন্তু আমার তা মনে হল না গ্র্যান্ডপা একজনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। মনে হয়, তাকে ফ্ল্যাটটা ঘুরিয়ে দেখালেন।’

‘ফ্ল্যাটে তোমার একা থাকাটা আমার ঠিক লাগছে না। সিসিটিভি লাগানোর লোকটা কি এসেছিল?’

‘একা আছি বলছ কেন? নাজমা আছে, ডগি ডলিও তো আছে। সিসিটিভি লাগানোর লোকটা সকালে ফোন করেছিল। বলল, বেলা চারটের সময় আসবে। তুমি সঙ্গে থাকলে ভাল হয়। সেই কারণেই তোমার জন্য আমি ওয়েট করছিলাম।’

‘চলো তা হলে।’ বলে দেব পা বাড়াল।

রাস্তা পেরিয়ে মিলেনার সঙ্গে হেঁটে দেব স্টিফেন ম্যানসনের এক নম্বর লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল। আগে কখনও এই বিল্ডিংয়ে ও ঢোকেনি। ঘিঞ্জি ড্রাইভওয়েটা দেখে ওর মোহভঙ্গ হয়ে গেল। বাইরে থেকে বিল্ডিংয়ের এত চাকচিক্য। কিন্তু ভিতরটা যেন কালোয়ারপট্টি। লোহালক্কড় পড়ে আছে। ঝালাইয়ের কাজ চলছে। দেওয়াল বরাবর সার সার গো ডাউনের মতো শেড। ভিতরে চটের বস্তায় কী যেন রাখা আছে। যে লোকগুলো গো ডাউনে বসে আছে, তারা বিল্ডিংয়ে খাপ খায় না।

লিফট নেমে আসার পর ভিতরে ঢুকে দেব তাজ্জব হয়ে গেল। এত কারুকার্য করা লিফট ও আগে কখনও দেখেনি। মাসখানেক আগে, এই লিফটটাতেই কি কোয়েল আটকা পড়েছিল? সেদিন তমাল এসে ওকে উদ্ধার করেছিল। দেব মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করল, সেদিনের মতো লিফটটা যেন বিকল হয়ে যায়। তা হলে অনেকক্ষণ ওরা দু’জনে একসঙ্গে থাকতে পারবে। লিফট ধীরে ধীরে একটার পর একটা ফ্লোর পেরচ্ছে। আয়নায় দেব দেখল, মিলেনা অদ্ভুত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে। আগে মেয়েদের চোখের ভাষা ও পড়তে পারত না। মিলেনার সঙ্গে মেলামেশা করার পর থেকে, এখন পারে। ওর আত্মসমর্পণের ভঙ্গি দেখে দেবের প্রবল ইচ্ছে হল কাছে টানার। কিন্তু নিজেকে ও দমন করল। কার চোখে পড়ে যাবে, কে জানে? এই বিল্ডিংয়েরই কোথাও মিসেস ভাল্লা থাকেন। মিলেনার সঙ্গে ওকে দেখলে পাঁচ কথা রটাতে পারেন। ভদ্রমহিলাকে অনেকটাই সুস্থ করে তুলেছে কোয়েল। ওই বিল্ডিংয়ে এসে রিহ্যাব প্রোগ্রাম করিয়ে। মিসেস ভাল্লা এখন স্টিক নিয়ে হাঁটাচলা করতে পারছেন।

পাঁচনম্বর ফ্লোরে এসে লিফট থেমে গেল। ডোর বেল টিপে মিলেনা বলল, ‘এসো দেবদূত।’

মুখোমুখি দুটো করে ফ্ল্যাট, মাঝে লম্বা করিডর। বিল্ডিংয়ের এই দিকটায় বোধহয় সূর্যের আলো কম আসে। করিডরে আবছা অন্ধকার। দিনের বেলাতেও শুনশান। লিফটের ডানদিকের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিল একটা অল্পবয়সি মেয়ে। এই মেয়েটাই তা হলে নাজমা। প্রায় একইসময়ে উল্টোদিকের দরজা খুলে যিনি বেরিয়ে এলেন, তাকে দেখে দেব চমকে উঠল। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়। দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস ভাল্লা। দু’চোখে বিস্ময়, মিসেস ভাল্লা বলে উঠলেন, ‘দেব, তুমি এখানে? কী সর্বনাশ! এই মেয়েটা অপয়া। যাও, এখখুনি চলে যাও। তুমি কিন্তু বিপদে পড়ে যাবে।’

(বত্রিশ)

মিসেস ভাল্লার ফ্ল্যাটে এসেছে কোয়েল। ডোরবেল টিপতেই দরজা খুলে দিল একটা মেয়ে। ওর দিদির বয়সি হবে। পরনে শর্টস, সামনের দিকে বোতাম লাগানো হাফ হাতা জামা। তাও ওপরের দিকে একটা বোতাম খোলা। ভারী স্তন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুখে উগ্র মেকআপ বাসি হয়ে গেছে। এই ধরনের চেহারার মেয়ে ও প্রায়ই রাতে বাড়ি ফেরার সময় পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় ঘোরাফেরা করতে দেখে। থামের আড়ালে খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলতে শোনে। ভ্রু কুঁচকে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, ‘কাকে চাই?’

কোয়েল উত্তর দেওয়ার আগেই স্টিকে ভর দিয়ে লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে এলেন মিসেস ভাল্লা। ওকে দেখে খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘তুমি! আজও প্রায় আধ ঘণ্টা দেরি করে এলে? কী ভেবেছ, তোমার সময় অনুযায়ী আমায় চলতে হবে না কি? আমার কত ক্ষতি হয়ে গেল, জানো?’

সকাল ন’টায় কোয়েলের আসার কথা ছিল। ও ঠিক সময়েই স্টিফেন ম্যানসনে এসেছে। কিন্তু লিফটের জন্য অনেকটা সময় ওকে নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। লিফটে একদিন আটকে পড়ার পর থেকে ওর ভীষণ ভয় ধরে গেছে। একা উপরে উঠতে চায় না। ততক্ষণ ও দাঁড়িয়ে থাকে, যতক্ষণ না অন্য কেউ এসে লিফটে ঢোকে। মিসেস ভাল্লার কথায় শ্লেষ লক্ষ্য করে ইচ্ছে হল বলে, লিফট সারাইয়ের ব্যবস্থা করছেন না কেন ম্যাম? লিফট ঠিক থাকলে কোনওদিন দেরি হবে না। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর, ও এখন আগের কোয়েল নেই। পাল্টা জবাব দিতে পারছে। ও বলল, ‘কত ক্ষতি হয়ে গেল ম্যাম, শুনি?’

‘হাউ ডেয়ার ইউ? আমাকে প্রশ্ন করছ? পারবে তুমি কমপেনসেট করতে?’

যে মেয়েটি দরজা খুলে দিয়েছে, সে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিল। পাল্টা প্রশ্ন শুনে সে ঘুরে দাঁড়াল। রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে আগে কখনও দেখেনি কোয়েল। ও আন্দাজ করল, মিসেস ভাল্লার মেয়ে হতে পারে… নয়না। মিলেনার মুখে এই নয়নার অনেক নিন্দে শুনেছে ও। লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়ে কোয়েল বলল, ‘বলেই দেখুন না মিসেস ভাল্লা। দেখি, কমপেনসেট করতে পারি কি না? প্রায় দিনই আপনি আমাকে আননেসেসারিলি বসিয়ে রাখেন। আপনার ট্যারো কার্ড ক্লায়েন্টদের সময় দিতে গিয়ে। আজ আমার একটু দেরি হয়েছে বলে, আপনি চেল্লাচ্ছেন? আপনার সময়ের দাম আছে, আমার থাকতে পারে না?’

‘শাট আপ। নিজেকে তুমি ভেবেছ কি?’

‘আপনার মতো মেগালোম্যানিয়াক না। কী ভাবছেন, আমরা কোনও খবর রাখি না। আপনার বুটিকে তো এখন কেউ যায় না। মিসেস শীলা মোতওয়ানি সবাইকে বলে বেরাচ্ছেন, আপনি চিটার। ওর মেয়ের বিয়েতে, পুরনো লেহেঙ্গা বিক্রি করে আপনি কীভাবে ঠকিয়েছেন, সেটা জানতে জিম-এর কারোর বাকি নেই।’

শুনে মিসেস ভাল্লা হাঁ করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। হয়তো আশাই করেননি, কেউ মুখের উপর চিটার বলবে। গলা নামিয়ে উনি বললেন, ‘শীলা এ কথা বলে বেরিয়েছে! শি ইজ আ লায়ার।’

মায়ের অপমান নয়না সহ্য করে কী করে? এতক্ষণ দাঁড়িয়ে তর্ক শুনছিল। মারমুখী হয়ে একপা এগিয়ে বলল, ‘মুখ সামলে কথা বলো ব্লাডি হোর। নয়তো…’

‘নয়তো কি?’ বলে কোয়েলও এক পা এগোল। মাত্র তিনদিন আগেই হিমাদ্রিদা জিম-এ দেবদাকে বলছিল, মিসেস ভাল্লার মেয়ে অ্যারেস্টেড হয়েছে। প্রস্টিটিউশন চার্জে এক রাত্রির পার্ক স্ট্রিট থানার লক আপে ছিল। শেষে ওর বাবা গিয়ে পরদিন শিয়ালদা কোর্ট থেকে উদ্ধার করে আনে। সে কথা মনে পড়ায় কোয়েল ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘আমার মুখ খুলিও না নয়না। ইউ… ইউ আর এ হোর। কয়েকদিন আগে তোমার কী হয়েছিল, এভরিবডি নোজ দ্যাট ইন দিস বিল্ডিং। তোমাদের পুরো ফ্যামিলিটাই জঘন্য।’

শুনে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন মিসেস ভাল্লা। চার-পাঁচ বছর ধরে মহিলাটিকে কোয়েল দেখছে। কিন্তু কোনওদিন এমন বিধ্বস্ত চেহারায় দেখেনি। মিসেস সুনীতা ভাল্লা মানেই বদমেজাজি, অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে অভ্যস্ত যৌনবুভুক্ষ এক মহিলা। যার হাসবেন্ড নাকি মেরিন অফিসার। অগাধ টাকাপয়সার মালিক। সমাজের উঁচুতলায় যিনি অবাধ বিচরণ করেন। বোধহয় কেউ কোনওদিন ওঁকে এমনভাবে সপাটে চড় মারেনি। কিন্তু কোয়েল এখন অনেক বেপরোয়া। ও ঠিক করে নিল, মহিলাটিকে এমন শিক্ষা দিয়ে যাবে, যাতে জিম-এ আর কোনওদিন কারোর সঙ্গে অসভ্যতা করতে না পারেন। কয়েক সেকেন্ড ধরে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিসেস ভাল্লা। আশ্চর্য, তার পর শান্ত গলায় মেয়েকে বললেন, ‘তু ভিত্তর যা কুড়িয়ে। মুঝকো নিপট নে দে।’

নয়না বিড়বিড় করে কী বলতে বলতে ভিতরে চলে গেল। তখনই তমালের কথা কোয়েলের মনে পড়ল। তমাল ঠিকই বলে, এলিট সমাজের লোকেরা হচ্ছে গিরগিটি টাইপের। যখন তখন রং বদলায়। এঁদের বিশ্বাস করা উচিত নয়। যতক্ষণ তোমাকে দরকার, ততক্ষণ তোমাকে এরা খাতির করবে। তার পর ছুঁড়ে ফেলে দেবে। উচিত হচ্ছে এঁদের পাল্টা প্রেসারে ফেলা। কথাগুলো মনে পড়ায় কোয়েল বলল, ‘আপনি আমার কতটা ক্ষতি করেছেন, আপনার কোনও আন্দাজ আছে ম্যাম? আপনি আনন্দী শরাফের কাছে আমার নামে কমপ্লেন করেছেন বলেই, উনি আমার এগেনস্টে কয়েকটা অ্যাকশন নিয়েচেন। হয়তো আমাকে ছাঁটাই করে দেবেন। ভেরি সুন আই মে বি জবলেস। পারবেন, আপনি কমপেনসেট করতে?’

‘মাই গুডনেস, হু সেড আই কমপ্লেনড?’ গলার সুর একেবারে খাদে মিসেস ভাল্লার, ‘তুমি যদি চাও, আনন্দীর সঙ্গে আমি ফের কথা বলতে পারি। যাতে তোমার চাকরিটা থাকে। বলো, কথা বলব?’

কোয়েল বলল, ‘কোনও দরকার নেই। শুনে রাখুন, আনন্দী শরাফের জিম যাতে উঠে যায়, তার ব্যবস্থা আমরা করব। ওঁর হোটেলেও অনেক ইল্লিগাল কাজ হয়। গেস্টদের কাছে ড্রাগ সাপ্লাই করা হয়। আমরা সব জানি। উনি পর্ন শো-এর ব্যবস্থা করছেন। আনন্দী শরাফকে ফোন করে বলে দেবেন, ওর হাতে আর মাসখানেক পরেই হাতকড়ি পড়বে। যাক সে কথা। আমি আর এখানে আসতে পারব না। আমার যা পাওনা, হিসেব করে এখনই দিয়ে দিন।’

কথাগুলো বলার পরই কোয়েলের চোখে পড়ল, লিভিং রুমের দরজার সামনে নিকি এসে দাঁড়িয়েছে। মিসেস ভাল্লার নাতনি। আট-ন’ বছরের মেয়েটা, পর্দার খুট ধরে, ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অন্যদিন ওকে দেখলেই দৌড়ে কাছে চলে আসে। ‘কোয়েল আন্টি, টিচ মি আ যোগা লেশন প্লিজ।’ খুব ফুটফুটে মেয়েটা, মাথায় এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল। ছোটবেলায় ওর মতোই কোয়েল দেখতে ছিল। নিকির মুখটা কী অদ্ভুত মায়াময়। ও কোনও আবদার করলে অ্যাদ্দিন মন গলে যেত। মিসেস ভাল্লাকে ব্যায়াম করানোর ফাঁকে কোয়েল দু’একটা আসন শিখিয়ে দিয়েছিল ওকে। স্কুলের আন্টিরা না কি তা দেখে খুব প্রশংসা করেছিল। বড়দের মধ্যে তর্কাতর্কি শুনে আজ নিকি ভয়ের চোখে ওকে দেখছে।

মিসেস ভাল্লা মুখ নীচু করে কী যেন ভাবছেন। টেবলের উপর রাখা মোবাইল সেটটা টেনে নিয়ে উনি কারও সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করতে লাগলেন। সেই সুযোগে এক পা দু’পা করে নিকি কাছে এসে দাঁড়াল। তার পর জিজ্ঞেস করল, ‘হোয়াই আর ইউ সো অ্যাঙরি কোয়েল আন্টি?’

মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কোয়েল বলল, ‘হু সেড আয়্যাম অ্যাঙরি? নো নো, আয়্যাম ওকে। আজ তুমি স্কুলে যাওনি কেন?’

নিকি বলল, ‘স্কুলে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ ছিল না। লাস্ট নাইট মাম্মি কেম ভেরি লেট। ন্যানি এখনও ভাল করে হাঁটতে পারছে না। রাস্তা ক্রস করতে পারে না।’

শুনে খুব কষ্ট হতে লাগল কোয়েলের। এত বৈভবের মধ্যে থেকেও বাচ্চারা কীভাবে অনাদরে মানুষ হয়, নিকি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। মিসেস ভাল্লার ফ্ল্যাটে আসার সময় নিকির জন্য রোজ একটা করে চকোলেট নিয়ে আসে কোয়েল। আজও এনেছে। ব্যাগ থেকে বের করে সেটা নিকির দিকে এগিয়ে দিতেই মেয়েটা বলল, ‘আন্টি আজ আমরা নিক্কো পার্কে যাবো। তুমি কখনও গেছো?’

‘না, যাইনি।’ কোয়েল বলল, ‘ওখানে অনেক রাইডস আছে। ইউ উইল লাইক ইট। এখন তুমি ভিতরে যাও নিকি। তোমার ন্যানির সঙ্গে আমার কথা আছে।’

বাধ্য মেয়ের মতো নিকি ভিতরে চলে যাওয়ার পর কোয়েল বলল, ‘আমার পাওনা টাকা মিটিয়ে দিন ম্যাম। আমাকে জিম-এ যেতে হবে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

হঠাৎ রং বদলালেন মিসেস ভাল্লা। চিৎকার করে বললেন, ‘এ ভাবে তুমি চলে যেতে পারো না কোয়েল। মোট দু’মাস তোমার ফিজিওথেরাপি করার কথা। এখনও দুটো দিন বাকি আছে। মোর ওভার, দেব তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে ছিল। ওর সঙ্গে কথা না বলে তোমাকে আমি ছাড়তে পারি না। দেবকে আমি ধরার চেষ্টা করছি। ওর লাইন পাচ্ছি না। ওর সঙ্গে কথা না বলে তোমাকে একটা পয়সাও দেবো না।’

শুনে কোয়েল মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না। ও বলে বসল, ‘টাকা না নিয়ে আমিও কিন্তু যাবো না।’

স্টিক-এ ভর দিয়ে মিসেস ভাল্লা উঠে দাঁড়ালেন। তার পর বললেন, ‘অ্যাজ ইউ উইশ। দেখি, কতক্ষণ বসে থাকতে পারো।’ বলে স্বমেজাজে উনি বেড রুমে ঢুকে গেলেন।

ফাঁকা ঘরে একা বসে কোয়েল চিন্তা করতে লাগল, দেবদাকে ফোন করবে কি না? কিন্তু দেবদা আজ খুব ব্যস্ত। নর্থ ক্যালকাটার কোনও এক জিম-এ যাবে। পোজিং পারফেকশনের জন্য। তাই হয়তো মিসেস ভাল্লার ফোন তোলেনি। অথবা এমনও হতে পারে, মিসেস ভাল্লা হয়তো আদৌও দেবদাকে ফোন করেনি। এই মহিলাকে বিশ্বাস নেই। বেলা পৌনে দশটা বাজে। তমালও হোটেলে গেস্টদের ব্রেকফাস্ট নিয়ে এই মুহূর্তে ঝামেলায় রয়েছে। বেলা সাড়ে দশটার আগে ও ফ্রি হবে না। সোফায় বসে কোয়েল মনে মনে ঠিক করে নিল, এই ফ্ল্যাটে ও আর জীবনেও পা রাখবে না। মা বলত, অন্যায় কখনও সহ্য করবি না। রামকৃষ্ণদেব বলে গেছেন, কাউকে ছোবল মারার দরকার নেই কিন্তু ফোঁস করতে ছাড়বি না। মায়ের কথাটা যে কতখানি সত্যি, সেটা ও আজ টের পেল। কার্পেটের দিকে তাকিয়ে থাকা মিসেস ভাল্লার মুখটা ওর মনে পড়ায় ওর হাসি পেল। উল্টোদিকে, নিকির মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠায় ও বিষণ্ণবোধ করল।

মিসেস ভাল্লা যেদিন ট্যারো কার্ড রিডিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, সেদিন নিকি ওর সঙ্গে অনেক গল্প করত। বলত, ওর মাম্মি ভাল না। ওর মাম্মি আর ড্যাডি প্রায়ই মারামারি করে। ওকে ন্যানির কাছে রেখে হঠাৎ হঠাৎ কোথাও চলে যায়। স্কুল যেতে না পারলে বাড়িতে বসে ও শুধু কার্টুন চ্যানেল দেখে। এই বয়সেই মেয়েটার চোখে চশমা। ওকে দেখেই বোঝা যায়, অ্যানেমিয়া আছে। তার মানে খাওয়া-দাওয়ার যত্ন পায় না। মিলেনা একদিন বলেছিল, নিকি না কি সবসময় কুকড়ে থাকে। এই বয়সে বাড়িতে এত হিংসা দেখছে, মনের বিকাশ হবে কী করে?

মিসেস ভাল্লার ফ্ল্যাটে বসে থাকাটা নিরাপদ কি না, সে সম্পর্কে কোয়েল নিশ্চিত নয়। মহিলার হাসবেন্ড সুরজিৎ ভাল্লাও জঘন্য টাইপের। লোকটাকে দেখলেই বিতৃষ্ণায় ওর মন ভরে যায়। কলম্বোতে কোন এক ব্রোথলে ধরা পড়ে উনি হাজতবাস করেছিলেন, এই খবরটা জানার পর থেকে পারতপক্ষে লোকটাকে কোয়েল এড়িয়ে চলে। কোনও কোনওদিন উনি দরজা খুলে দেওয়ার সময় খুব বিশ্রীভাবে তাকান। যেন সারা শরীর চেটে খাচ্ছেন। দু’একবার বেটি বেটি বলে আলাপ জমানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কোয়েল পাত্তাই দেয়নি। আজ সকাল বোধহয় বাড়িতে নেই। থাকলে নিশ্চয় তর্কাতর্কির সময় বেরিয়ে আসতেন। বোধহয় গলফ খেলতে গেছেন। এ ফ্ল্যাটে কোয়েল গলফস্টিক দেখেওছে।

দেবদার ভরসায় ছেড়ে দিয়ে কোয়েল উঠে আসবে কি না ভাবছে, ঠিক তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠল। অন্য প্রান্তে মিলেনার গলা, ‘তুমি কোথায়?’

‘মিসেস ভাল্লার বাড়িতে। কেন বলো তো?’

‘দারুণ। আমি এটাই এক্সপেক্ট করেছিলাম। শোনো, তোমার কাজ হয়ে গেলে প্লিজ, উল্টো দিকে আমার ফ্ল্যাটে একবার এসো। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।’

এই জেদাজেদির সময়টায় মিলেনার ডাক কোয়েল উপেক্ষা করতে পারল না। হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে ও উঠে দাঁড়াল। মিলেনার ফ্ল্যাটে কতক্ষণ থাকতে হবে, ও জানে না। কিন্তু ফেরার সময় একবার মিসেস ভাল্লার বাড়িতে ঢুঁ মেরে যাবে। সিদ্ধান্তটা নিয়ে ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় শুনতে পেল, লিফটে করে কেউ উঠে আসছেন। কয়েক সেকেন্ড পর মিলেনার ফ্ল্যাটে ডোর বেল দেওয়ার সময় ওর চোখে পড়ল, সুরজিৎ ভাল্লা লিফটের দরজা খুলছেন। সাদা টি শার্ট, সাদা ট্রাউজার্স, মাথায় গলফ ক্যাপ। চোখাচোখি হওয়ার পর উনি হেসে কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু ঠিক সেইসময় একটা মেয়ে মিলেনার ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘তুমি কোয়েল দিদি, তাই না? আমি নাজমা।’

কোয়েল হেসে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। কিন্তু মিলেনা কোথায়?’

ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে সত্যিই কোয়েল তাজ্জব হয়ে গেল। আগে কখনও আসেনি। এত বড় ফ্ল্যাট, এত বিদেশি অ্যান্টিকস… দেখে ওর মনে হল, কোনও মিউজিয়ামে এসেছে। মিলেনা এত ধনী পরিবারের মেয়ে ওর ধারণাই ছিল না। প্রাথমিক চমকটা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নাজমা বলল, ‘মিলেনাদিদি ভিতরে আছে। তোমার জন্যই ওয়েট করছে। দাঁড়াও, কোয়েলদিদি। ওরা তোমার চোখে পটি বেঁধে দিতে বলেছে।’

এ আবার কী আব্দার! মিলেনা বলেছিল, সারপ্রাইজ দেবে। দেখাই যাক না, সেটা কী? কোয়েল কিছু বলার আগেই নাজমা ওর চোখে স্কার্ফ বেঁধে দিল। তখনই কেউ এসে ওর হাত ধরল। স্পর্শেই ও বুঝতে পারল, মিলেনা। কয়েক পা হাঁটিয়ে, ওর চোখ থেকে স্কার্ফ খুলে দেওয়ার পরই কোয়েল দেখল, ও লিভিং রুমে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকে একসঙ্গে বলে উঠল ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ কোয়েল।’

টেবলের উপর একটা বার্থ ডে কেক রাখা। নীচে ফ্লুরিজ থেকে কিনে আনা। কেক-এর উপর একটা মোমবাতি জ্বালানো রয়েছে। জ্বলজ্বল করছে ওর নাম। চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে দেবদা, হিমাদ্রিদা, অনিরুদ্ধ, মিলেনা আর… মাই গুডনেস অবন্তিকা! হঠাৎই কোয়েলের মনে পড়ল, আজ পনেরোই সেপ্টেম্বর, ওর জন্মদিন। কিন্তু এরা জানল কী করে? নিশ্চয়ই দেবদার কাণ্ড। জিম-এর ডোসিয়ার থেকে জন্মদিনটা খুঁজে বের করেছে। গতবারও এই দিনটায় মা পায়েস রান্না করে ওকে খাইয়েছে। এবার নেই, ভাবতেই ওর চোখের কোণ ভিজে এল। মিলেনা একটা ছুরি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কাম অন বার্থ ডে গার্ল। কেক কাটতে শুরু করো। এর পর কিন্তু লাঞ্চেরও অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে।’

(তেত্রিশ)

ইস্ট ক্যালকাটা জোনাল পার্টি অফিসে পরেশদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে রুস্তম। ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। ট্যাংরায় তিনতলা অফিস। পরেশদা দোতলায় বসেন। পার্টিতে গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় এখন আর দরজা খুলে চট করে ওঁর ঘরে ঢুকে যাওয়া যায় না। নীচে থেকে স্লিপ পাঠাতে হয়। উনি ওঁর সময় মতো ডেকে নেন। পরেশদার ডান পা হাঁটুর পর থেকে নেই। বাস দুর্ঘটনার পর বাদ চলে গেছিল। এখন আর্টিফিসিয়াল পা নিয়ে উনি চলাফেরা করেন। থাকেনও পার্টি অফিসের তিনতলায়। সেখানে কারও ওঠার অনুমতি নেই। আবিদ ভাইজান মারা যাওয়ার পর এই পরেশদা খুব সাহায্য করেছিলেন রুস্তমকে। পার্ক সার্কাস অঞ্চলটা কবজা করার পর রুস্তমও সে কথা ভোলেনি। প্রতি মাসে তোলাবাজির টাকার একটা অংশ পরেশদার কাছে দিয়ে যায়। আজও টাকাভর্তি একটা অ্যাটাচি কেস ও নিয়ে এসেছে। যাতে ওর আনুগত্য নিয়ে কোনও সন্দেহ না করে।

পার্টি অফিসের রিসেপশনটা বেশ বড়। টাইলস বসানো মেঝে, এলইডি আলো পিছলে যাচ্ছে। হাতলওয়ালা সার সার চেয়ার। এখানে এলে অনেক চেনা মুখ চোখে পড়ে রুস্তমের। ইস্ট ক্যালকাটার ছোটবড় সব নেতা পরেশদার কাছে হাজিরা দেয়। অফিসে ঢোকার সময় ও দেখেছে, বাইরে অনেকগুলো এসইউভি দাঁড়িয়ে আছে। সব পার্টি থেকে দেওয়া গাড়ি। মনে হয়, নেতাদের কোনও মিটিং আছে। আর মাস পাঁচেক পর ইলেকশন। সিট পাওয়া নিয়ে তদবির হয়তো এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে। ক্যান্ডিডেট সিলেকশনের ব্যাপারে পরেশদার হাত থাকে। রুস্তম ঠিক করে নিল, পারলে আজ অ্যাটাচি কেসটা দেওয়ার সময় ও কথাটা তুলবে। নমিনেশন ওর চাই। এ বার না পেলে, ভবিষ্যতে আর নাও পেতে পারে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক হতে চলল, রুস্তম এসে বসে আছে। এখনও পরেশদার ডাক আসেনি। অথচ ওর পরপর কত কাজ পড়ে আছে। থানায় যেতে হবে, সেখান থেকে সিলভার হোটেল। কী একটা কারণে আনন্দী ম্যাডাম ডেকে পাঠিয়েছেন। পরেশদাকে স্লিপ পাঠিয়ে না দিলে, রুস্তম কেটে পড়তে পারত। কিন্তু এখন বেরিয়ে গেলে উনি চটে যাবেন। পরে দেখা হলে হয়তো বলবেন, ‘তুই এত বড় নেতা হয়ে গেছিস, পাঁচ মিনিট ওয়েট করতে পারলি না?’ রুস্তম নিজের মনকে সান্ত্বনা দিল এই বলে, মনে হয় পরেশদা আলাদাভাবে কিছু বলতে চান। তাই ভিড় হটাচ্ছেন। সিঁড়িতে একজন বাউন্সারকে ও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ছেলেটাকেও ও চেনে… নাম গদাই। ওর এগেনস্টে মার্ডার চার্জ আছে। একবার হকার বসানো নিয়ে গদাইয়ের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল। পরেশদা তখন ওর হয়েই কথা বলেছিল।

পার্কিং এরিয়ায় একটা এসইউভি শব্দ তুলে এসে দাঁড়াতে, জানলা দিয়ে রুস্তম দেখতে পেল, দু’জন চামচাকে নিয়ে শুভঙ্কর গাড়ি থেকে নেমে আসছে। ক্রিস্টোফার রোডের ছেলে। পার্টির স্টুডেন্টস ইউনিয়ন থেকে উঠে এসেছে। খুব ভাল বক্তৃতা দেয়। টিভিতে মাঝেমধ্যেই টক শো-তে বসে। শুভঙ্কর খুব পরিচিত মুখ। অভিজ্ঞতা থেকে রুস্তম দেখেছে, পার্টিতে এই ধরনের নেতাদের খুব কদর। এরা তোলাবাজি করতে ভয় পায়। যারা তোলাবাজি করে, তাদের সম্পর্কে খোঁজ রাখে। কিন্তু পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। কিন্তু কোনও অসম্মান করে না। মিছিলে পাঁচটা লোক আনার ক্ষমতা নেই। কিন্তু মঞ্চে এদের জন্য আলাদা চেয়ার থাকে। শুভঙ্কর হলঘরে ঢুকতেই রিসেপশনে বসে থাকা ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি ওপরে চলে যান শুভদা। আপনার কতা পরেশদা আমাকে বলে রেখেছেন।’

মৃদু হেসে শুভঙ্কর সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল। ওর চামচা দুটো রুস্তমের পাশে এসে বসল। একজনকে ও চিনতে পারল, ফিরোজ। গোবরার দিকে থাকে। বহুদিন আগে মকবুলের সঙ্গে একবার ওর কাছে এসেছিল। চোখাচোখি হতে ফিরোজ বলল, ‘কতক্ষণ?’

প্রায় একঘণ্টা অপেক্ষা করছে, তবুও রুস্তম বলল, ‘এই তো একটু আগে। তোদের খবর কি বল।’

ফিরোজ বলল, ‘দাদাকে বোধহয় এমএলএ সিটে এ বার লড়তে হবে। পরেশদা তাই ডেকে পাঠিয়েছেন। তোমার হেল্প দরকার হবে তখন রুস্তমভাই।’

‘দাদা’ বলতে ফিরোজ শুভঙ্করকে বোঝাচ্ছে। ও অ্যাসেম্বলি ইলেকশনে দাঁড়াতে পারে, শুনে একটু অবাকই হল রুস্তম। যারা ভোট দেবে, তাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগই নেই শুভঙ্করদের মতো কাগুজে নেতাদের। পাড়ার লোকেদের আপদ-বিপদেও এরা কোনওদিন পাশে গিয়ে দাঁড়ায় না। তবুও এরা চট করে নমিনেশন পেয়ে যায়। আর এদের জেতানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় ওর মতো কয়েকজনের উপর। ইলেকশনের দিন জীবনের ঝুঁকি নিয়েও যারা এভিএম মেশিন কবজা করে। আগেকার দিন হলে রুস্তম খুব তাচ্ছিল্য করে একটা উত্তর দিত। দিয়ে শত্রুতা বাড়াত। কিন্তু কালে কালে নিজেকে এখন ও বদলাচ্ছে। বোমা-পিস্তলের ইমেজ ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেকে শুধরে ফেলার কথা ভাবছে। মুখে হাসি এনে ও বলল, ‘শুভঙ্কর যদি নমিনেশন পায়, তা হলে নির্ঘাত জিতবে। ওকে বলিস, আমরা জান দিয়ে দেবো।’

‘আমরা জানি ওস্তাদ।’ ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টায় ফিরোজ বলল, ‘আবিদভাইজানকে জেতানোর জন্য তুমি যা করতে, সে তো নিজের চোখেই দেখেছি। দাদা তোমাকে খুব পছন্দ করে। মকবুল মাঝেমধ্যে তোমার গল্প করে দাদার কাছে গিয়ে।’

রেন্ডির ছেলে মকবুল! তা হলে দু’নৌকোয় পা দিয়ে চলছে। এক ক্যাম্পের খবর অন্য ক্যাম্পে দিচ্ছে! বাজিয়ে দেখার জন্য রুস্তম মুখে প্রশ্রয়ের হাসি টেনে বলল, ‘মকবুল ছেলেটা খুব ভাল রে। আমার কী গল্প করে ও তোর দাদার কাছে?’

ফিরোজ বলল, ‘এই যেমন তোমার অপারেশন পাইপ কলোনি। আমরা সব জানি। মকবুলের মুখে খবরটা শুনে মি. গুলাটির সাথে দাদা কথা বলেছিল। তুমি কত কামিয়েছ, সব খবর দাদার কাছে আছে।’

শুনে মাথা গরম হয়ে গেল রুস্তমের। একটু পরেই ওর ট্যাংরা থানায় যাওয়ার কথা। ব্লাড ডোনেশন কাম্পে ওসিকে নেমতন্ন করার জন্য। ও ঠিক করে নিলে, কায়দা করে ড্রাগসহ মকবুলকে ধরিয়ে দেবে পুলিশের কাছে। মিনিমাম বছর তিনেক শালাকে জেলে থাকতে হবে। ‘আমাকে ব্ল্যাকমেল’!! রুস্তম মুহূর্তে ঠিক করে নিল, শুভঙ্কর বানচোত যদি পেঁয়াজি মারে, তা হলে ওর এগেনস্টেও পাল্টা কিছু করতে হবে। পদ্মপুকুরে প্রায়ই ও একটা আনম্যারেড মেয়ে রিপোর্টারের বাড়িতে রাত কাটায়। মেয়েটার নাম মউ সরকার। তাকে বিয়ে করব বলেও না কি করছে না। সেই কারণে মেয়েটা চটে আছে। শুভঙ্করের মতো মুখস্ত বিদ্যের নেতাদের জব্দ করার সহজ উপায় হল, চারিত্রিক দুর্নাম রটিয়ে দেওয়া। এরা এই কলঙ্কটাকেই সবথেকে বেশি ভয় পায়। সমাধানটা চট করে খুঁজে পেতেই মুহূর্তেই ওর মাথা ঠান্ডা হয়ে গেল। ফিরোজকে বলল, ‘এ সব ফালতু কথা যেন শুভঙ্কর বিশ্বাস না করে। ওকে বলিস, যদি আমার সাহায্য চায়, পাবে।’

কথা বলতে আর আগ্রহী নয় রুস্তম। বেলা প্রায় এগারোটা বাজে। ট্যাংরা থানার ওসি পুলক দে, এরপর রাউন্ডে বেরিয়ে যাবেন। তার পর ওঁকে ধরা মুশকিল। চেয়ারে বসে ও উসখুস করতে লাগল। ভাগ্যিস আসফাককে সঙ্গে আনেনি। আনলে, এতক্ষণ বসে থাকার জন্য, ওর চোখে ছোট হয়ে যেত। রুস্তম নিজেই দোতলায় উঠে যাবে কিনা ভাবছে, এমন সময় ফিরোজ বলল, ‘দাদা নেক্সট উইকেই পদ্মপুকুরে বড় একটা প্রোগ্রাম করছে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, সিবিএসসি, আইসিএসসি আর মাদ্রাসায় আমাদের এরিয়ার সে সব ছেলে-মেয়ে র‍্যাঙ্ক করেছে, তাদের সবাইকে সংবর্ধনা দেবে। সিলভার হোটেলের মালিক পঞ্চাশটা ল্যাপটপ দিতে রাজি হয়ে গেছে। ওইদিন তুমি এসো কিন্তু রুস্তমভাই।’

এটা একটা খবর রুস্তমের কাছে। শালা শুভঙ্কর তলায় তলায় ওর এরিয়াতেও ঢুকে পড়েছে! এ তো ভদ্রভাবে একধরনের তোলাবাজি। আর দু’দিন পর ব্যাটা এমলএ হয়ে গেলে তো এই ফিরোজের মতো ছেলেগুলোই পার্ক সার্কাস অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়াবে। না, সেটা হতে দেওয়া যায় না। পদ্মপুকুরের মেয়েটার কাছে আজ-কালের মধ্যেই লোক পাঠাতে হবে। ফিরোজকে এড়ানোর জন্য মুখে অবশ্য রুস্তম বলল, ‘ডেটটা আমায় জানিয়ে দিস। নিশ্চয়ই যাবো।’

উত্তরে ফিরোজ কী একটা বলতে চাইছিল। ঠিক তখনই আসফাকের ফোন এল, ‘ওস্তাদ, তুমি কোথায়?’

চাপা গলায় রুস্তম বলল, ‘পরেশদার অফিসে। কেন রে?’

‘এতক্ষণেও কথা বলতে পারোনি?’

‘একবার কথা হয়ে গেছে। কী একটা স্পেশাল কাজ আছে। পরেশদা আমাকে তাই বসতে বলল।’

‘তোমার কাছাকাছি টিভি আছে ওস্তাদ? খুলে দেখো, আফজলমিঞা সিআইডিকে বলে দিয়েছে, ফুয়াদ সিঙ্গাপুরে চলে গেছে। এয়ারপোর্টের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সিআইডি জেনে গেছে, আমি ওকে পৌঁছে দিতে গেছিলাম। এ বার আমাকে নিয়ে টানাটানি হবে। আমি কি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবো।’

কান টানলে মাথা আসে। আসফাকের পর রুস্তম জানে, পুলিশ ওর কাছেও আসতে পারে। তখন কোনও গল্প ফেঁদে দেওয়া যাবে। রুস্তম বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি পারিস, তুই স্টিফেন ম্যানসনে চলে যা। কেউ সন্দেহ করবে না। রিয়াজকে বলিস, কোনও দরকার থাকলে ও-ই যেন আমার সঙ্গে কথা বলে। তুই আমায় আর ফোন করবি না। ভুলিস না কিন্তু।’

আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছে, সেটা রুস্তম মনে করার চেষ্টা করল। গতকাল যেচে আফজলমিঞার উপকার করতে গেছিল। পেছনে আছোলা বাঁশ ঢুকে গেল। টিভির রিপোর্টাররা সব গিধধর কা আউলাদ। একটা কিছু পেলেই হল। দল বেঁধে খবর খুঁড়তে নেমে যায়। এমনও হতে পারে, ফুয়াদের যে বন্ধুরা গাড়িতে ছিল, তাদের মধ্যেই বোধহয় ভয়ে কেউ মুখ খুলেছে পুলিশের কাছে। কেন জানে না, রুস্তমের মনে হল, আফজলমিঞার মতো পোড় খাওয়া মানুষ, পুলিশের কাছে ভুলভাল বলবে না। ছেলের ভালোর কথা আগে ভাববে। কী বলেছে, নিশ্চিত হওয়ার জন্য আগে টিভির খবর শোনা দরকার। হলঘরে একটা টিভি চালানো রয়েছে। আওয়াজটা বন্ধ বলে রুস্তম লক্ষ্যই করেনি। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে ও টিভির সাউন্ডটা বাড়িয়ে দিল।

সকালের দিকে টিভির খবরে বলছিল, পুলিশ ফুয়াদের দাদা আমজাদকে ধরে নিয়ে গেছে। কোনও সোর্স থেকে ওরা না কি খবর পেয়েছিল, অ্যাক্সিডেন্টের সময় স্টিয়ারিং আমজাদের হাতে ছিল। এখন বলছে, গাড়িতে যারা ছিল, তারাই কবুল করেছে, আমজাদ ছিলই না। তখন ড্রাইভ করছিল ফুয়াদ। ও স্পিড লিমিটের বাইরে চালাচ্ছিল। বারণ করা সত্ত্বেও শোনেনি। রাত দুটোর সময় মদ্যপান করে, সল্ট লেকের একটা বার কাম ডিস্কো থেক থেকে ওরা বেরোয়। ঘণ্টাকয়েক রাজারহাট নিউ টাউনে ঘোরাঘুরি করেছিল। ভোরের দিকে চিংড়িহাটার কাছে ফুয়াদ না কি বাজি ধরে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে রুবি হাসপাতালের মোড়ে পৌঁছে দেবে। সেই ড্রাইভিং স্কিল দেখাতে গিয়ে বিপত্তি। বন্ধুরা না কি বলেছে, ফুয়াদ এখন কোথায় তারা জানে না। কিন্তু আফজলমিঞার কাছে পুলিশ জানতে পেরেছে, ফুয়াদ সিঙ্গাপুরে চলে গেছে।

নাহ, পরেশদার জন্য আর বসে থাকলে চলবে না। একটু অধৈর্য হয়েই রুস্তম রিসেপশনের দিকে গেল। তখনই দেখতে পেল, সিঁড়ি দিয়ে কার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিজ্ঞ শুভঙ্কর নেমে আসছে। ওর দু’হাত পাঞ্জাবির পকেটে। ভাল কোনও খবর শুনে এসেছে বোধহয়। মুখে আহ্লাদের চিহ্ন। শুভঙ্কর ওর দিকে তাকিয়ে একবার মৃদু হাসল। কিন্তু সেটা পাত্তা না দেওয়ার মতো করেই। রুস্তম কিন্তু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘বাধাই হো শুভঙ্কর।’

ঠিক সেই মুহূর্তে বিরাট একটা আওয়াজ। তার পর সারা বাড়িটা কেঁপে উঠল। জানলার কাচগুলো ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। হলঘরের একাংশে ধুলোর ধোঁয়া। শুভঙ্কর আর ওর সঙ্গী লোকটা ছিটকে মেঝেতে আছড়ে পড়েছে। সিঁড়ির রেলিংয়ে হাত রেখে কথা বলছিল রুস্তম। টাল সামলে ও দেখল, শুভঙ্কর উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। ওর মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। টাইলসের মেঝের রং লাল হয়ে গেছে। হলঘরের লোকজন আতঙ্কে হুড়োহুড়ি করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ বোমাবাজি করে গেল, না কি কাছাকাছি কোথাও বিস্ফোরণ হল? ধাক্কা খেতে খেতে রিসেপশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রুস্তমের মনে হল, সাধারণ বোমাবাজি নয়। আরও বড় অন্য কিছু। হঠাৎ ও আবিষ্কার করল, অ্যটাচি কেসটা হাতে নেই। প্রায় লাখ পাঁচেক টাকা ছিল, ওই অ্যাটাচিতে। পরেশদাকে দেওয়ার জন্য এনেছিল। ফেলে রেখে চলে যাওয়া যায় না। কাশতে কাশতে ফের হলঘরে ঢুকে রুস্তম দেখল, সিঁড়ির নীচে অ্যাটাচি কেসটা পড়ে আছে। সেটা তুলে নিয়ে ও দৌড়ে বেরিয়ে এল পার্কিং এরিয়াতে।

অফিস বাড়ির দোতলার দিকে তাকাতেই রুস্তমের গা হিম হয়ে গেল। তিনতলার অংশটা কাত হয়ে ঝুলে রয়েছে দোতলার উপর। আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে দোতলার ঘরগুলো থেকে। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে আসছে তিনতলা থেকে। পরেশদার কী হল? পরেশদা বেঁচে আছেন তো? বাড়ির পিছন দিকেই একটা পানাভরা ডোবা আছে। দোতলার দেওয়ালের একটা অংশ জানলা-দরজাসহ উড়ে এসে পড়েছে সেই ডোবায়। কাছেই দুটো ছিন্ন-বিছিন্ন দুটি দেহ। একজনের পরনে ডুরে শাড়ি পরা। একটা হাত নেই। বুকের অংশে কে যেন মাংস খুবলে নিয়েছে। অন্য দেহটি পুরো সাদা হয়ে গিয়েছে। রেল লাইনের ধারে ছোটবেলাটা কাটিয়েছে রুস্তম। ক্ষতবিক্ষত অনেক দেহ দেখেছে। কিন্তু চোখের সামনে দুটি বিকৃত দেহ দেখে রুস্তমের শরীর গুলিয়ে উঠল। ওর অভিজ্ঞ চোখ বলল, পরেশদার অফিসে নির্ঘাত বিস্ফোরক বানানো হচ্ছিল। আর এই কারণেই তিনতলায় পরেশদা কাউকে উঠতে দিতেন না। আশপাশ থেকে পিলপিল করে লোক ছুটে আসছে পার্টি আপিসের দিকে। রুস্তমের মন বলল, ‘আর এক মিনিটও এখানে নয়।’ গাড়ির দিকে এগোনোর সময় ও টের পেল, পা কাঁপছে।

(চৌত্রিশ)

সল্টলেকে টাটা হসপিটালে গিয়ে পুষ্পাজিজিকে দেখে প্রথমদিন চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছিল মিলেনার। এ কী চেহারা হয়েছে? দেবদূতের সঙ্গে সেদিন যখন ও সল্ট লেকে পৌঁছয়, তখন বেলা ন’টা বাজে। নার্স বলেছিল, ‘পেসেন্ট এখন বেডে নেই। ওকে কেমো দেওয়ার জন্য তিনতলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।’

চারতলার করিডরে অন্তত ঘণ্টা দুয়েক বসে থাকার পর সেই নার্সের সঙ্গে ফের দেখা। সে বলল, ‘আপনাদের পেসেন্টকে তো আধ ঘণ্টা আগে বেডে দিয়ে এসেছি। বাইরে বসে আছেন কেন? যান, গিয়ে দেখে আসুন। ভিজিটিং আওয়ার্স কিন্তু এখনই শেষ হয়ে যাবে।’

বসে থাকার সময় দু’জনেরই চোখে পড়েছে, ট্রলি করে পেসেন্টদের নিয়ে আসা-যাওয়া হচ্ছে। হয়তো পাশ দিয়ে গেছে। তবুও মিলেনা চিনতে পারেনি ওর পুষ্পাজিজিকে। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে ওরা দেখতে পায়, চোখ বুঁজে পুষ্পাজিজি শুয়ে আছে। যেন বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। দেখেই মনে হচ্ছিল, শরীরের উপর দিয়ে মারাত্মক ধকল গেছে। ডেকে তোলা উচিত হবে কি না, ওরা বুঝতে পারছিল না। এক একটা ঘরে তিনটে করে বেড। পাশের বেডে এক ভদ্রমহিলা উঠে বসেছেন। ওদের চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে উনি জিজ্ঞেস করলেন,

‘তোমরা এনার কে হও মা?’

কান্না চেপে মিলেনা জবাব দিয়েছিল, ‘মেয়ের মতো।’

‘সেন্স ফিরে আসতে সময় নেবে মা।’ ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আজ প্রথম কেমো নিলেন। খুব পেইনফুল। এখনই কথা বলতে পারবেন বলে মনে হয় না।’

শুনে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল মিলেনা। ওকে ন্যাপি পরানো থেকে শুরু করে, একটা সময় কী না করেছে পুষ্পাজিজি। কী এনার্জিটিকই না ছিল! এখন নির্জীব হয়ে শুয়ে। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘কাল রাতে উনি ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলেন। মহাকাল, মহাকাল বলে বিড়বিড় করছিলেন। আমাকে একবার বললেনও, আপনি দেখতে পারছেন না। মহাকাল গলায় পাইথন পেঁচিয়ে আমার বেডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি আমাকে নিতে এসেছেন। আমার খুব ভয় লাগছিল তখন। মহাকাল কে মা?’

দেব বলল, ‘মহাকাল মানে মহাদেব। ইনি গোর্খা, দার্জিলিংয়ে এঁরা মহাকালের পুজো করেন।’

‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব মা? ইনি কি জ্যোতিষী টাইপের কিছু ছিলেন? কাল দুপুরে আলাপ হওয়ার পর ইনি আমাকে বললেন, আপনি খুব শিগগির বাড়ি ফিরে যাবেন। কথাটা তখন বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ সকালে ডাক্তার বললেন, আপনি সেরে উঠছেন। বাড়ি চলে যেতে পারেন।’

কথাগুলো শুনে চমকে দেবের মুখের দিকে তাকাল মিলেনা। দেব বলল, ‘হ্যাঁ, উনি যা বললেন মিলে যায়।’

আরও কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে দু’জনে যখন বেরিয়ে আসছে, তখন পিছন থেকে ক্লান্ত স্বরে পুষ্পাজিজি ডাকল, ‘মিলেনা, এদিকে আয়।’ মিলেনা বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর পর পুষ্পাজিজি ওর হাতটা দেবের হাতে তুলে দিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। তার পর আর একটা কথাও বলল না। চোখ বুঁজে নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে শুল।

দৃশ্যটা যখন মনে পড়ছে, তখনই মন ভারী হয়ে যাচ্ছে মিলেনার। আগের দিন অ্যান্ডি আমেরিকায় ফিরে গেছে। অস্টিনে পৌঁছেই রাতে ফোন করেছিল। পুষ্পাজিজি দেবের হাতে ওর হাত তুলে দিয়েছে শুনে, অ্যান্ডি লাফিয়ে উঠেছিল। ‘ব্যস, ব্যস। এনাফ ইন্ডিগেশন। তুই এগিয়ে যা। তোর ড্যাডি-মাম্মি যদি আপত্তি করেন, তুই শুনবি না। এদিকে নমিতা মাসিকে বোঝানোর দায়িত্ব আমি নেবো। ভাই, পুষ্পাজিজি যখন অ্যাপ্রুভ করেছে, তখন বুঝতে হবে, ওপরওয়ালা এটাই ঠিক করে রেখেছেন।’

প্রথম দিকে তিন-চার দিন দেবদূত ওকে বিকেলের দিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল। রোজই ওরা মন খারাপ করে ফিরে আসছিল। মিলেনা বুঝতে পারছিল, পুষ্পাজিজি আর বেশিদিন নেই। ওর ছেলে রোশনকে দার্জিলিং থেকে নিয়ে এসে মিলেনা রেখেছে হসপিটালের কাছে একটা হোটেলে। তাই দেবকে এখন হাসপাতালে যেতে হচ্ছে না। ব্যাঙ্ককের ফাইনাল প্রিপারেশনে মন দিয়েছে। বিকেলের দিকে একটা ভাল সময় ও জিম-এ দিতে পারছে। মাঝে আনন্দী ম্যাডাম না কি একদিন ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন। ভদ্রমহিলার উপর তাই প্রচণ্ড রাগ হয়েছে মিলেনার। নিজেকে উনি ভাবেনটা কি? ব্যাঙ্কক থেকে ফিরে এলে দেবদূতকে ও চাকরি করতে দেবে না ভদ্রমহিলার জিম-এ। মিলেনা ঠিকই করে রেখেছে, ড্যাডিকে বলে, ও দেবদূতকেই একটা জিম করে দেবে কাছাকাছি কোথাও।

রোজ সকালে মাকে দেখে এসে রোশন একবার ফোন করে। আজ খবর দিল, পুষ্পাজিজি না কি বেডে উঠে বসে ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছে। শুনে মনটা খুশিতে ভরে উঠল মিলেনার। শ্রীকৃষ্ণা তা হলে ওর প্রার্থনা শুনেছেন। কিন্তু রোশন আরও বলল, ‘দিদি, মা আর হাসপাতালে থাকতে চাইছে না। বলছে, দার্জিলিংয়ের জন্য মন খারাপ করছে। ডক্টরের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। উনি বললেন, পাঁচ নম্বর কেমোটা হয়ে গেলে নিয়ে যেতে পারেন। একমাস পরে আবার নিয়ে আসবেন। আজ বিকেলে এলে, মাকে কি আপনি একটু বোঝাবেন?’

‘পাঁচ নম্বর কেমো কবে হবে?’

‘বোধহয় আগামী কাল। আপনি যদি পার্মিশন দেন, তা হলে আজই ফ্লাইটের টিকিট কেটে নেবো। পরশু মাকে নিয়ে চলে যাবো দার্জিলিংয়ে। আমার মনে হয়, ওখানে মা ভাল থাকবেন।’

পুষ্পাজিজি ভাল হয়ে গেলে, মিলেনা ভেবে রেখেছিল, ওকে আর দার্জিলিং ফিরে যেতে দেবে না। তবে ফাইনাল ডিসিশন নেবে, ড্যাডির সঙ্গে কথা বলে। পুষ্পাজিজির অসুস্থতার কথা ড্যাডি জানে। স্কুল থেকে স্টিফেন ম্যানসনে ফিরে এসে মিলেনা দেখল, নাজমা ঘরে নেই। বোধহয় সবজি কিনতে বেরিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ও ভিডিয়ো কল করল ইরেভেনে। পর্দায় মাম্মির ছবি দেখে ও জিজ্ঞেস করল, ‘ড্যাডি নেই।’

‘স্নান করতে ঢুকেছে। কী দরকার, আমায় বল মা।’

পুষ্পাজিজির কথা তুলতেই মাম্মি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ওকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কি আছে মিলেনা? দার্জিলিংয়ে ফিরে যেতে চায়, যেতে দে। তোর ড্যাডি চায় না, ওর সঙ্গে তুই কোনও সম্পর্ক রাখিস।’

অবাক হয়ে মিলেনা বলল, ‘কই, ড্যাডি তো সেদিন আমাকে কিছু বলেনি!’

‘বলেনি, আমি বলছি। পুষ্পা খুব মিস্টিরিয়াস ক্যারেক্টরের মেয়ে। আমাদের ধারণা, এভারেস্ট হোটেলে আগুন লাগানো পিছনে ওর হাত ছিল। ও আগেই জানত। তোর ড্যাডিকে ও বলে দিয়েছিল। ও ব্ল্যাক ম্যাজিক জানে। তুই যখন দিল্লিতে ছিলি, তখন আমরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। তোর কোনও ক্ষতি করে না দেয়। খবর্দার, তুই ওকে স্টিফেন ম্যানসনে এনে রাখবি না। আপদ বিদেয় করে দে।’

মাম্মি আর কথা বাড়াল না। লাইনটা কেটে দিল। লিভিংরুমে বসে মিলেনা মাম্মির কথাগুলো রিওয়াইন্ড করতে লাগল। নিজেকেই ও প্রশ্ন করল, পুষ্পাজিজির উপর যাদের এত সন্দেহ, তারা কি করে ওর পুরো দায়িত্ব ওই মানুষটার কাঁধে ফেলে দিয়ে ইরেভেনে নিশ্চিন্তে বসেছিল অ্যাদ্দিন? হোটেলে আগুন লাগতে পারে, কথাটা বলে তো পুষ্পাজিজি ওঁদের উপকারই করেছিল! না, না, পুষ্পাজিজি কারও কোনও ক্ষতি করতেই পারে না। গোর্খারা খুব সহজ সরল প্রকৃতির হয়। পুষ্পাজিজি তো একেবারে মাটির মানুষ ছিল। জী জী বলে সম্মান দিয়ে কথা বলত। মজা করে মিলেনা একটা সময় পুষ্পাদিদির বদলে পুষ্পাজিজি বলে ডাকতে শুরু করে। মায়ের কথাগুলো নিয়ে ভাবার সময় অ্যান্ডির একটা কথা মিলেনার মনে পড়ল। পুষ্পাজিজি নির্ঘাত তোদের ফ্যামিলির কোনও রাজ জানে। হয়তো সেই কারণেই তোকে অ্যাভয়েডে করতে চায়। কী এমন সেই গোপন ব্যাপার? জানতেই হবে ওকে।

বাইরের দরজা লক করে, মিলেনা নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। একটু একা থাকতে ইচ্ছে করছে ওর। স্কুল লাইফে সিস্টার মার্গারেট একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ‘নেভার ইগনোর আ পার্সন, হু লাভস ইউ, কেয়ারস ফর ইউ অ্যান্ড মিসেস ইউ। বিকজ ওয়ান ডে ইউ মাইট ওয়েক আপ ফ্রম ইয়োর স্লিপ অ্যান্ড রিয়েলাইজ দ্যাট ইউ লস্ট দ্য মুন, হোয়াইল কাউন্টিং দ্য স্টারস।’ কথাটা তখন মনের মধ্যে এমন গেঁথে গেছিল, মিলেনা এখনও ভুলতে পারেনি। পুষ্পাজিজির ভালবাসার মধ্যে কোনও খাদ ছিল না। না, না, মাম্মির কথায় পুষ্পাজিজিকে মিলেনা উপেক্ষা করতে পারবে না। ড্যাডি-মাম্মি চিরটাকাল ওকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। কতদিন আর ওদের কথা শুনে চলতে হবে? ওর নিজের ইচ্ছের কি কোনও দাম নেই?

ড্যাডি মনে করলে ওকে দার্জিলিংয়ের স্কুলেই পড়াতে পারতেন। কালিম্পংয়ের থেকে অনেক ভাল স্কুল ছিল দার্জিলিংয়ের লোরেটো। কেন তা হলে ওকে কালিম্পংয়ে পাঠিয়েছিলেন? কলকাতাতে মিলেনা নিজের ইচ্ছেয় আসেনি। ওর কোনও ধারণাই ছিল না এই শহরটা সম্পর্কে। এখানে নিয়ে আসার আগে মাম্মি ওকে সাবধান করে দিয়েছিল, নোংরা শহর। যত্রতত্র আবর্জনা পড়ে থাকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকে ইউরিনেট করে। রাস্তাঘাটে খুব বেশি বেরোস না। এত ভয় দেখিয়ে তবুও, ওকে গ্র্যান্ডপার কাছে রেখে গেছিল। সত্যিকারের ভালবাসলে কি কেউ এটা করতে পারে? মাম্মি কিন্তু তখন ভাবেওনি, হোলি ন্যাজারেথ চার্চে যাওয়া-আসা, আর আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করা ছাড়া কলকাতায় মিলেনার কিছুই করার নেই। সত্যিকারের দরদ যদি থাকত, তা হলে ওঁরা ইরেভেনে নিয়ে যেত। ভাগ্যিস, ছোটবেলা থেকেই পেইন্টিং ওর প্যাশন। দিনের অনেকটা সময় ও ভাল কাটাত ছবি এঁকে।

দেবদূতই ওর জীবনটা বদলে দিয়েছে। ওকে মিলেনা প্রথম দেখে বছর খানেক আগে। জিম-এর পাশ দিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছিল। কাচের দেওয়ালের ভিতরে হঠাৎ ওর চোখে পড়ে, খালি গায়ে একটা ছেলে বারবেল নিয়ে ব্যায়াম করছে। অসাধারণ ফিজিক ছেলেটার। একেবারে রোমান গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো। কাঁধ, হাত, বুক, পেট আর উরুর পেশি যেন খোদাই করা। চলার গতি মিলেনা সেদিন শ্লথ করে দিয়েছিল, দু’চোখ ভরে আরও বেশি সময় ধরে দেখার জন্য। বারবেল নামিয়ে ছেলেটা হেসে কথা বলছিল কারও সঙ্গে। স্কুলে গিয়ে সেদিন মিলেনা মন বসাতে পারেনি। সারাক্ষণ ছেলেটার হাস্যোজ্জ্বল মুখটাই ওর চোখের সামনে ভাসছিল। মিলেনা ওর নাম দিয়েছিল আরেস। গ্রিকদের যুদ্ধদেবতা। স্টিফেন ম্যানসনে ফিরে সেদিনই ক্যানভাসের সামনে বসে গেছিল মিলেনা। রং, তুলি দিয়ে ক্রমশ ফুটিয়ে তুলেছিল ওর ভারতীয় আরেসকে।

ডেভিড সদ্য চলে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। একটু শূন্যতা তো ছিলই মনের মধ্যে। স্কুলে যাতায়াতের পথে হঠাৎ মিলেনা একদিন আবিষ্কার করে, বডি বিল্ডার ছেলেটাও ওর প্রতীক্ষা করে। চোখের ভাষা পড়ে নিতে সময় নেয়নি মিলেনা। পরিচয় জানায় খুব ইচ্ছে হয়েছিল ওর। সেই সুযোগটাও এসে গেল ক্রিসমাস ইভ-এ। নীচের তলার মারিয়ারা ওকে নেমতন্ন করেছিল ডিনারের। সেখানে মারিয়া বলেছিল, দেবদূত বলে একটা ছেলে তোমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য পাগল। একবার মিট করবে না কি? কৌতূহলে মিলেনা জানতে চেয়েছিল ছেলেটা কে? মারিয়া যা বর্ণনা দিয়েছিল, তাতে জিম-এর ছেলেটার কথাই ওর মনে হয়েছিল। মারিয়ার কাছে ও কিছু ভাঙেনি। শুধু দেবদূত সম্পর্কে যা জানার, জেনে নিয়েছিল। কিন্তু পরিচয় হওয়ার মাসকয়েকের মধ্যে দু’জনের সম্পর্কটা এত গভীরে চলে যাবে, মিলেনা কল্পনাও করেনি। ওর পছন্দে শীলমোহর দিয়ে গেছে অ্যান্ডিও। দেবদূতের সঙ্গে ও সেদিন চণ্ডীতলায় গেছিল। ফিরে এসে বলেছিল, ‘পারফেক্ট চয়েস। এ বার ভোম্বলকুমারীর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিদ্রোহ করো। আশীর্বাদ করি চিরসুখী হও।’

নাজমা যে নাজমা, সে পর্যন্ত মাঝে একদিন বলছিল, ‘তুমি কিন্তু কারও কথা শুনবে না দিদি। তোমার মন যা বলবে, তাই করবে। জানো, গদাইয়ের সঙ্গে আব্বু আমার নিকাহ চায়নি। আমি মোছলমান আর ও হিঁদু। চট করে আমি পেট বাঁধিয়ে নিলাম। ব্যস, তার পর আব্বু বাধ্য হল বিয়ে দিতে। খারাপ তো কিছু হয়নি। গদাই আমাকে সুখে রেখেছে।’ ‘পেট বাঁধিয়ে নিলাম’ শুনে মিলেনা মজা পেয়েছিল। অ্যানাও তো একই কাজ করেছে। পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ। ও অবশ্য তা করবে না। ড্যাডি আর আম্মিকে জোরগলায় জানিয়ে দেবে, রিমোট কন্ট্রোলের দিন চলে গেছে। নিজের ব্যাপারে ও-ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। দরকার হলে গ্রেগারিয়ানদের অস্বীকার করে।

বেডরুম থেকে মিলেনা হঠাৎ ফোন বাজার আওয়াজ পেল। বালিশের পাশেই নিজের সেট দেখতে পেল ও। রিং টোনটা অন্যরকম। কার ফোন বাজছে? তা হলে কি নাজমা লিভিং রুমের সোফায় ওর মোবাইল ফেলে রেখে গেছে? উঠে সেটটা নিয়ে আসতে ওর ইচ্ছে করছিল না। ওকে উঠতে বাধ্য করল ডগি… ডলি। পোষা কুকুরটার এমন বদভ্যাস, ফোন তুলতে একটু দেরি হলেই ও চেল্লাতে শুরু করে। বেডরুম থেকে উঠে গিয়ে মিলেনা ফোন ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘ম্যাডাম, ট্যাংরা থানা থেকে বলছি। আপনি কি নাজমা খাতুন?’

শুনে ভ্রু কুঁচকে উঠল মিলেনার, ‘কেন বলুন তো?’

‘ম্যাডাম, আজ বেলা এগারোটার সময় আমাদের এলাকায় পার্টি অফিসে মারাত্মক ব্লাস্ট হয়েছে। এক্সপ্লোসিভস নিয়ে কয়েকজন তখন বম্ব বানাচ্ছিল। ব্লাস্ট-এর পর তিন-চারজনের ডেডবডি পাওয়া গেছে। একজনের নাম গদাই। তার পকেটের মোবাইল থেকে আপনার এই নাম্বার পাওয়া গেছে। আপনি কে হন, গদাইয়ের?’

খবরটা শুনে মাথা টলে উঠল মিলেনার। এ কী বলছে ট্যাংরা থানার পুলিশ! গদাইয়ের ডেডবডি পাওয়া গেছে! এই তো কালই নাজমা ওর সম্পর্কে অত কথা বলছিল। মাই গুডনেস, এখন কী হবে মেয়েটার! সবজি নিয়ে যখন নাজমা ফিরে আসবে, খবরটা তখন ও কি করে দেবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *