স্টিফেন ম্যানসন – ২৫

(পঁচিশ)

সকালবেলাতেই আফজলমিঞার ফোনে ঘুম ভাঙল রুস্তমের। বাদশাহি ফুড চেন-এর মালিক। বাইপাসে উনি রেস্টুরেন্ট খোলার সময় ভাইজানের হেল্প চাইতে এসেছিলেন উনি। অনেকদিনের চেনা। রুস্তমও পার্টির কোনও অনুষ্ঠানে দরকার হলে বাদশাহি ফুড থেকে খাবার আনায়। আফজলমিঞার গলায় উদ্বেগ, ‘রুস্তমভাই, একবার আমার বাড়িতে আসবেন প্লিজ? জরুরি দরকার আছে।’

রুস্তম বলল, ‘ফোনে বলা যাবে?’

‘না। আপনি মার্কোস স্ট্রিটে আমার বাড়িতে চলে আসুন। খুব বিপদে পড়েছি। আপনার কাছে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

একটা মুসলিম পরিবার বিপদের মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে, ওর এলাকায়। তাদের সাহায্য করা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। রুস্তম বলল, ‘ঠিক আছে, আমি দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হচ্ছি। গাড়ি পাঠান।’

চট করে ও চোখ-মুখ ধুয়ে পোশাক পরে নিল। ভাইজানের সঙ্গে মাত্র একবারই রুস্তম আফজলমিঞার বাড়িতে গেছিল। ওর বড় ছেলে আমজাদের নিকাহ উপলক্ষে। মার্কোস স্ট্রিট অবশ্য খুব বেশি দূরে না। কলকাতার অনেক আশরফি মুসলমানের বাস ওখানে। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকে রুস্তম ওর বাকি কাজগুলোর কথা ভেবে রাখল। মান্টির দিয়ে যাওয়া সিসিটিভি ফুটেজ ও কাল অনেক রাত্তির অবধি দেখেছে। লিলির ল্যাপটপটা নিয়ে আজ বসার কথা ববির সঙ্গে। রুস্তম ঠিকই করে রেখেছে, ডাক্তারের কাছে গিয়ে একবার জিজ্ঞেস করে নেবে, কোনও ওষুধ খাইয়ে কারও হার্ট অ্যাটাক করানো যায় কি না? লিলির কাছে আজই ওর টাকা পাঠানোর কথা। কিন্তু রুস্তম পাঠাবে না। লিলির রিঅ্যাকশন দেখবে।

মিনিট পনেরোর মধ্যে আফজলমিঞার বাড়িতে পৌঁছে রুস্তম বুঝল, বিপদটা ছোটখাটো নয়। আফজলমিঞার ছোটছেলে ফুয়াদ মোটর অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। নতুন কেনা বিএমডবলিউ নিয়ে রাতে বন্ধুদের সঙ্গে স্ফূর্তি করতে বেরিয়েছিল। স্পিড কন্ট্রোল করতে পারেনি। বাইপাসে একজন বয়স্ক মানুষকে এমন ধাক্কা মেরেছে, সঙ্গে সঙ্গে স্পটডেড। শালা, মিডিয়ার লোকগুলো কোত্থেকে খবর পায় কে জানে? অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার ঘণ্টাখানেক পর থেকেই টিভিতে ফলাও করে খবর দেখাচ্ছে। পুরো কেস শুনেই রুস্তম বুঝতে পারল, মিডিয়া খবরটা নিয়ে চাপ বাড়াবে। বড়লোকের ছেলে কাণ্ডটা করে ফেলেছে, নানাভাবে মুখরোচক করে তুলবে খবরটা। ফলে এখন পুলিশকে ম্যানেজ করা যাবে না। তার থেকে ফুয়াদকেই কলকাতা থেকে হ্যাপিশ করে দেওয়া ভাল।

আফজলমিঞাকে অভয় দিয়ে রুস্তম বলল, ‘আমার উপর ছেড়ে দিন।’ ওর মনে পড়ল, ভাইজানের মুখে একবার শুনেছিল, দুবাই আর সিঙ্গাপুরেও বাদশাহি ফুড-এর বিরাট রেস্টুরেন্ট আছে। সঙ্গে সঙ্গে ও ছকে নিল, যত শিগগির সম্ভব, ফুয়াদকে সিঙ্গাপুরে পাচার করতে হবে। দুবাইতে নয়। তার কারণ, কোনও মুসলমান অপরাধ করলে এখানকার পুলিশ প্রথমেই দুবাই কানেকশন খোঁজে। ফলে ফুয়াদ চট করে ধরা পড়ে যাবে। আফজলমিঞার বাড়িতে বসেই আসফাককে ফোন করে রুস্তম বলল, ‘আধঘণ্টার মধ্যে তুই মার্কোস স্ট্রিটে চলে আয়। একজনকে সিঙ্গাপুরের ফ্লাইটে তুলে দিতে হবে। যেন কাকপক্ষীও টের না পায়।’ তার পরই আফজলমিঞাকেও জিজ্ঞেস করল, ‘ফুয়াদ এখন কোথায়’

আফজলমিঞা বললেন, ‘বাইপাসে আমাদের রেস্টুরেন্টে ওকে লুকিয়ে রেখেছি।’

‘গুড। ওকে ওখানেই থাকতে বলুন। আমার লোক ওখান থেকে ওকে গাড়িতে তুলে নেবে। আর ফুয়াদের পাসপোর্ট আমাকে দিন। এখানে থাকলে পুলিশ ঠিক ওর খোঁজ পেয়ে যাবে। একবার অ্যারেস্ট করলে ওর বেল পাওয়া কঠিন। ওকে আজই বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনার কোনও আপত্তি নেই তো?’

অসহায়ের মতো আফজলমিঞা বললেন ‘আপনি যা ভাল বোঝেন করুন। যত টাকাই লাগুক, আমি খরচ করব। আমার ছেলেটাকে বাঁচান রুস্তমভাই। ওর আম্মি বারবার ফেন্ট হয়ে যাচ্ছেন।’

থিয়েটার রোডের পরিচিত এক ট্র্যাভেল এজেন্টকে ফোন করল রুস্তম। হজের সময় ভাইজান প্রতি বছর অন্তত দশ বারোজন গরিব হজযাত্রীর টিকিট কাটতেন ওঁর কাছ থেকে। ভাইজান এই একটা পুণ্যের কাজ করতেন। ট্র্যাভেল এজেন্ট ভদ্রলোক আসফাককেও চেনেন। উনি বললেন, বেলা বারোটায় জেট এয়ারওয়েজের একটা ফ্লাইট আছে, যেটা সিঙ্গাপুরে যায়। বিজনেস ক্লাসের টিকিট পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রচুর দাম পড়ে যাবে। শুনে রুস্তম বলল, ‘অসুবিধে নেই। আমি পার্টি অফিসে গিয়েই ক্যাশ পাঠিয়ে দেবো। আপনার কোনও লোককে এয়ারপোর্ট পাঠিয়ে দিন। আমাদের আসফাকের হাতে যেন ই-টিকিট পৌঁছে দেয়। আর প্লিজ, এই খবরটা যেন লিক না হয়। হলে থিয়েটার রোডে কোনওদিন আপনাকে ঢুকতে দেবো না। মনে থাকে যেন।’

আধঘণ্টার মধ্যে আসফাককে এয়ারপোর্টে রওনা করিয়ে দিয়ে রুস্তম একটু নিশ্চিন্ত হল। প্ল্যান আরও ফুলপ্রুফ করার জন্য, দুর্ঘটনার সময় গাড়িতে ফুয়াদের সঙ্গে যে দু’জন বন্ধু ছিল, তাদেরও ডেকে পাঠাল। তারা আশপাশের বাড়িরই ছেলে। ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে। কী হয়েছিল, জানতে চাওয়ায় একজন বলল, ‘চিংড়িহাটার কাছে ফুয়াদ একশো দশ-পনেরোতে ড্রাইভ করছিল। বারবার বারণ করা সত্ত্বেও শোনেনি। মাইকেল নগরের কাছে স্টিয়ারিং কন্ট্রোল করতে না পেরে বুড়ো লোকটাকে ফুয়াদ ধাক্কা মারে। গাড়িটা উল্টে যেত। কিন্তু মেট্রো রেলের পিলারে ধাক্কা মেরে দাঁড়িয়ে যায়। সব শুনে রুস্তম শিখিয়ে দিল, কেউ যেন পুলিশের কাছে কবুল না করে, ফুয়াদ তখন গাড়ি চালাচ্ছিল। তার বদলে যেন বলে, স্টিয়ারিং ড্রাইভারের হাতে ছিল। অ্যাক্সিডেন্ট করার পর সেই ভাড়া করা ড্রাইভার পালিয়ে যায়। রুস্তম জানে, আফজলমিঞার এত টাকা আছে যে, একজন গরীব ড্রাইভারকে জোগাড় করতে ওঁর অসুবিধে হবে না। দরকার হলে সে জেল খেটে আসবে। আর তার ফ্যামিলিকে চালাবে আফজলমিঞা।

পার্টি অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে। ওর জন্য অনেকেই বসে থাকবে। তা ছাড়া ওকে একবার ইলিয়ট নার্সিং হোমে যেতে হবে, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার জন্য। রুস্তম উসখুস করতে লাগল। কিন্তু আফজলমিঞা এমন ভেঙে পড়েছেন, দু’বার চেষ্টা করেও ও উঠে আসতে পারল না। খড়কুটোর মতো ওকে আঁকড়ে ধরেছেন আফজলমিঞা। বারবারই বলছেন, ফুয়াদ প্লেনে উঠল কি না, সেই খবরটা নিয়ে তারপর আপনাকে ছাড়ব। ভিতর থেকে মেয়েদের কান্নাকাটির আওয়াজ আসছে। ড্রয়িং রুমে আফজলমিঞার বড় ছেলে আমজাদ এবং আরও দু’জন মাঝবয়সি হাজি মুখ নীচু করে সোফায় বসে। একেবারে শোকের আবহাওয়া। একজন উঠে গিয়ে টিভি চালিয়ে দিলেন। রুস্তম টিভির দিকে মন দিল। পর্দায় ফুয়াদের অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা দেখাচ্ছে। ইসস, আশি নব্বুই লাখ টাকার গাড়িটার কী অবস্থা! সামনের দিকটা একেবারে তুবড়ে গেছে।

নিউজ রিডার বলছে, দুর্ঘটনায় যে বয়স্ক ভদ্রলোক মারা গেছেন, তাঁর নাম বিশ্বজিৎ লাহিড়ি। তিনি মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছিলেন। বিএমডবলিউর ধাক্কায় তিনি দশ-বারো গজ দূরে ছিটকে পড়েন। রাস্তায় লাগানো সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে, যে গাড়ি চালাচ্ছিল, তার বয়স খুবই অল্প। বাইশ-তেইশের বেশি হবে না। তাকে শনাক্তকরণের চেষ্টা চলছে। বিশ্বজিৎবাবু টিভি সিরিয়ালে অ্যাক্টিং করতেন। দর্শকদের কাছে তিনি খুবই পরিচিত। তাঁর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর পেয়ে টালিগঞ্জের শিল্পীরা মর্মাহত। টিভির সাংবাদিকরা একেকজনকে ইন্টারভিউ নিচ্ছেন, আর তাঁরা যা তা বলে যাচ্ছেন র‍্যাশ ড্রাইভিং সম্পর্কে। একজন তো এমনও বললেন, ‘সরকার প্রচার চালাচ্ছে, সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ। অথচ এই ধরনের ড্রাইভাররা সেটা কানেই তুলছে না। এদের ফাঁসি হওয়া উচিত।’

টিভির খবর দেখে মনে মনে রুস্তম খানিকটা বিরক্ত হল ফুয়াদের উপর। কী ননসেন্স ছেলে! ভাই, আব্বুর পয়সা আছে, তুই যত ইচ্ছে ওড়া। ডিস্কোতে গিয়ে মাগিবাজি কর, মদ খাওয়ার ইচ্ছে হলে, খা। বন্ধুদের নিয়ে লং ড্রাইভে যা। বাকি সময়টায় আব্বুর ব্যবসায় মন দে। আরও টাকা রোজগার কর। তা না করে, এইসব ঝামেলায় পড়তে যাস কেন? পুলিশ যদি ধরে, তা হলে কত বছর জেলের ঘাণি টানতে হবে, জানিস? একেবারে পরিষ্কার মার্ডার চার্জ। গাড়ির ডিলারের কাছ থেকে পুলিশ আজকের মধ্যেই জেনে যাবে, কার নামে কেনা হয়েছিল। সেই সূত্র ধরে চলে আসবে এই বাড়িতে। ফোরেন্সিকের লোকজন খুঁটিয়ে বের করে ফেলবে, কার দোষে এই অ্যাক্সিডেন্ট। মদ খেয়ে কে চালাচ্ছিল গাড়িটা?

সোফায় বসে থাকা একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমাকে আগেই বারণ করেছিলাম আফজল, ফুয়াদকে বিএমডবলিউ কিনে দিও না। তোমার দুসরা বিবি আদর দিয়ে ছেলেটার মাথা খেয়েছে। পুলিশের চোখে পর্দা দিয়ে কতদিন ও সিঙ্গাপুরে থাকতে পারবে? মাঝখান থেকে তোমার বিজনেস মার খাবে।’

এইসময় আমজাদ বলে উঠল, ‘আব্বুজান, পুলিশ যদি ফুয়াদকে ধরতে আসে, তা হলে আমি বলব, গাড়িটা আমি ড্রাইভ করছিলাম। একবার জেলে গেলে ভাইজান আরও খারাপ হয়ে যাবে।’

রুস্তম চমকে উঠল কথাটা শুনে। পরিবারের লোকজনের মধ্যে কথা হচ্ছে। ওদের খেয়ালই নেই, ও বসে আছে। অতিরিক্ত স্নেহ কতটা ক্ষতিকারক। ওঁদের কথাবার্তাতেই রুস্তম জানতে পারল, আফজলমিঞার দুই বিয়ে। প্রথম পক্ষের ছেলে আমজাদ দিল্লি থেকে এমবিএ করে এসে আব্বুজানের পাশে দাঁড়িয়েছে, ব্যবসাটা দেখে। দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে ফুয়াদ। মায়ের আদরে একেবারে উচ্ছন্নে গেছে। পড়াশুনো কমপ্লিট করেনি। ওর আব্দার মেটাতে গিয়ে আফজলমিঞার জান জেরবার। মাঝে একবার কোন ডিস্কো থেক-এ গিয়ে মারপিট করেছিল। ওকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে প্রচুর টাকা বেরিয়ে গেছিল আফজলমিঞার। পরিবারের সবাই আমজাদকে ভাল বলে। এটাও পছন্দ নয় ফুয়াদের। মাঝবয়সি ভদ্রলোক কে হন, রুস্তম জানে না। কিন্তু উনি ঠিকই বলেছেন, বাদশাহি ফুড ব্যবসায় ক্ষতি হয়ে যাবে। টিভিতে এখনও ফুয়াদের নামটা আসেনি। কিন্তু পুলিশ নিশ্চয় আজ-কালের মধ্যে জেনে যাবে। নাহ, ছেলেটার জন্য এখন চিন্তা হচ্ছে।

দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রুস্তম দেখল, প্রায় বারোটা বাজে। এতক্ষণে ফুয়াদের প্লেনে উঠে যাওয়ার কথা। অথচ আসফাক মাদারচোত এখনও কোনও খবর দিল না। রাগের পারদ চড়তে থাকল রুস্তমের। আসফাকের ফোন নাম্বারটা দিয়ে ও উঠে পড়ল। এখনই ওকে একবার ইলিয়ট নার্সিং হোমে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ভাইজানের হার্ট অ্যাটাক নিয়ে মান্টি যা বলেছে, তা মিলিয়ে নেওয়া দরকার। সত্যিসত্যি এমন কি কোনও ওষুধ আছে, যা খাইয়ে দিলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে? নার্সিং হোমের পার্কিং স্পেসে পৌঁছে রুস্তম ফোন করল রহমতকে, ‘ডাক্তার সাহেব আছেন? ওঁকে বল, এখুনি আমি একবার দেখা করব। আমি লাউঞ্জে ওয়েট করছি।’

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই রহমত হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আপনি চলুন রুস্তমভাই। সব পেসেন্টকে বের করে দিয়েছি।’

ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে চোখের ইশারায় রহমতকে বেরিয়ে যেতে বলল রুস্তম। তার পর জিজ্ঞেস করল, ‘আবিদ ভাইজানের ইন্তেকাল কী কারণে হয়েছিল স্যার?’

ওকে দেখেই ডাক্তারের ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। কাচের গ্লাসে রাখা জল এক চুমুক খেয়ে ডাক্তার বললেন, ‘ডেথ সার্টিফিকেটে তো সেটা লিখে দিয়েছিলাম। সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক। কেন, কোনও প্রবলেম হয়েছে না কি?’

‘ভাইজানের কি পোস্ট মর্টেম করা হয়েছিল?’

‘দরকার মনে করিনি। ওনার ইস্কেমিয়া ছিল। সেই কারণে সন্দেহ হয়নি।’

‘আমার কাছে খবর আছে, ওকে মার্ডার করা হয়েছে। আপনি আমাকে বলুন, কোনও ওষুধ খাইয়ে কি হার্ট ফেল করানো সম্ভব? যতদূর শুনেছি, ভাইজানের ক্লোজ একজন ওকে একটা ওষুধ খাইয়ে দেন। গোপনে কফির সঙ্গে মিশিয়ে। সিসিটিভিতে সেই ছবি আমরা দেখেছি।’

উত্তর দিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন ডাক্তার। তার পর বললেন, ‘হতেই পারে। ওনার হাই ব্লাডপ্রেসার ছিল। ভেসো কন্সিট্রাকচার ড্রাগ দিলে হার্ট অ্যাটাক হতেই পারে। ওই ধরনের ড্রাগ ব্লাড সার্কুলেশন কমিয়ে দেয়। হার্টে অক্সিজেন পরিমাণমতো পৌঁছয় না। কিছুক্ষণ পর হার্ট অ্যাটাক আর ডেথ হতে পারে। কফির সঙ্গে কখন ওকে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল বলতে পারেন?’

‘ফুটেজে দেখেছি, সন্ধে সাতটার সময়।’

‘বাড়ির লোকেরা নার্সিং হোমে ওঁনাকে নিয়ে আসেন রাত্রি দশটার সময়। পসিবল…মাঝের তিন ঘণ্টায় পসিবল।’

ব্যস, এটুকু জানাই দরকার ছিল। শুনে উঠে দাঁড়াল রুস্তম। তা দেখে ডাক্তার বললেন, ‘আপনারা কি পোস্ট মর্টেম করাতে চান? তা হলে কিন্তু বডিটা তুলে আনতে হবে।’

কটনি গলায় রুস্তম বলল, ‘সেটা সম্ভব না। তবে যে এই কাজটা করেছে তাকে তো শাস্তি দিতেই পারি। আপনার কাছে কনফার্ম করতে এসেছিলাম।’

(ছাব্বিশ)

দেবের ফোনের প্রতীক্ষায় ছটফট করছে মিলেনা। দেব বলেছিল, টাইগ্রান গ্র্যান্ডপার খোঁজ নিয়ে ও রিং ব্যাক করবে। কিন্তু এখনও করেনি। মিলেনার মন বলছে, ইরেভেনে এখুনি ফোন করে ড্যাডিকে সব জানানো উচিত। বাটন টিপতে গিয়েও ও আঙুল সরিয়ে নিয়েছে। ওঁরা অতদূরে আছেন, ওদের টেনশনে ফেলার কোনও মানেই হয় না। ড্যাডি বাড়তি কি আর বলবেন? বড়জোর পুলিশের কাছে যেতে বলবেন। আগে দেখাই যাক না, দেব খোঁজ পায় কি না?

সারাটা রাত খুব উদ্বেগের মধ্যে কেটেছে মিলেনার। প্রতি মুহূর্তে ও ভেবেছে, এই বুঝি টাইগ্রান গ্র্যান্ডপা ফিরে এলেন। ভোর রাতে চোখ বুঁজে এসেছিল। পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর দ্রুত পায়ে ও গ্র্যান্ডপার ঘরে ঢুকে দেখেছিল, বিছানা যেমনকার, তেমনই আছে। গেল কোথায় মানুষটা? আগে কখনও এ রকম করেননি। সন্ধেবেলায় বেরিয়ে রোজ মোকাম্বো বার-এ যান। তিন-চার পেগ মদ খেয়ে ন’টার মধ্যে ঠিক ফিরে আসেন। ডিনার করে, অল্প সময় টিভির সামনে বসে বিবিসি বা আল জাজিরা জ্যানেল দেখেন। তার পর ঘুমিয়ে পড়েন। সেই মানুষটা কোনও বিপদে পড়লেন না তো? মোকাম্বো অবশ্য খুব বেশি দূরে নয়। রাস্তা ক্রশ করে একটু হেঁটে গেলেই ওই রেস্টুরেন্ট। পার্ক স্ট্রিটে কোনও গাড়ি গ্র্যান্ডপাকে ধাক্কা মেরে চলে গেল না তো? ইদানীং গ্র্যান্ডপা চোখেও কম দেখছেন।

কথাগুলো ভাবতেই নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে মিলেনা। থানা-পুলিশ করে দিনটা আজ কেমন যাবে, ভাবতেই ওর বুকটা গুরুগুর করে উঠল। গ্র্যান্ডপার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ভাল ছিল না। তবুও রক্তের সম্পর্ক তো। অস্বীকার করে কী করে? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ও দেখল, বেলা প্রায় একটা বাজে। রোজ এই সময়টায় ও স্কুল থেকে ফিরে আসে। নাজমা লাঞ্চ রেডি করে রাখে। আজ লাঞ্চ টেবলে বসতেই ওর ইচ্ছে করছে না। সোফায় বসে ও একবার মনে করার চেষ্টা করল, শেষ কখন দেখেছিল গ্র্যান্ডপাকে? কাল স্কুল থেকে ফিরে ওর চোখে পড়েছিল, নিজের ঘরে টেবলে বসে গ্র্যান্ডপা কী যেন লিখছেন। নাজমা তখন টিভির সামনে মেঝেতে বসে সিরিয়াল দেখছিল। দু’জনের মধ্যে একবার চোখাচোখি হতেই, নাজমা ইশারায় বলেছিল, ‘লাঞ্চ করার সময় বুড়ো কোনও ঝামেলা করেনি।’ পোশাক বদলে লিভিং রুমে ফিরে আসার পর মিলেনা আর গ্র্যান্ডপাকে দেখতে পায়নি। তা, প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা হতে চলল।

বাইরে ডোর বেল বাছছে। ওয়াশরুমে থাকার সময়ই মিলেনা পাখির ডাকের মিষ্টি আওয়াজটা শুনতে পেল। গ্র্যান্ডপা ফিরে এলেন না কি? পরক্ষণেই ওর মনে পড়ল, গ্র্যান্ডপার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে। ফিরে এলে অন্তত বেল বাজাবেন না। দরজা খুলে ও দেখতে পেল নাজমা দাঁড়িয়ে আছে। কোমরে হাত দিয়ে হাঁপাচ্ছে। ওর পরনে জিনসের প্যান্ট আর হলুদ কুর্তি। শরীরের তুলনায় বড় স্তন দুটো হাঁপরের মতো ওঠা-নামা করছে। মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘রান্না করতে করতে তুই কোথায় গেছিলে?’

নাজমা দম নিয়ে বলল, ‘তোমাদের কাজটা ছেড়ে দিতে হবে দিদি। আজকেও লিফট খারাপ। হেঁটে ছ’তলায় উঠে আসতে হল।’

মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘নীচে নেমেছিলি কেন?’

‘ফোনে গদাই ডেকেছিল যে। বাড়িতে আজ একচোট ঝামেলা হয়ে গ্যাচে। ভাইয়ে ভাইয়ে হাতাহাতি। কাকে নিয়ে যে আমাকে সংসার করতে হয়, তুমি তো জানো না। গদাইকে সামলাতে আমার জান বেরিয়ে যায়।’

নাজমার হাসবেন্ড গদাইকে কোনওদিন সামনাসামনি দেখেনি মিলেনা। তবে নাজমার মুখে প্রায়ই ওর কথা শোনে। ওর ভয়ে না কি পুরো টার্ফ রোড কাঁপে। কথাবার্তা শুনে মিলেনার মনে হয়, নাজমা ছেলেটাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। আর সে সম্পর্কে গর্ব করতেও ভালোবাসে। সুযোগ দিলে কাজ শুরু না করে নাজমা গদাইয়ের কথা বলে যাবে। সেই কারণে মিলেনা বলল, ‘হাতের কাজগুলো চটপট সেরে নে।’

লিভিং রুমে ঢুকে নাজমা বলল, ‘তোমার শরীর খারাপ, দিদি? রাতে ঘুম হয়নি বুঝি? বুড়ো কোনও হুজ্জোত করেছে না কি?’

একসঙ্গে তিন-তিনটে প্রশ্ন। একমাত্র নাজমাই করতে পারে। এর একটাই উত্তর হতে পারে, ‘না’। কিন্তু মিলেনা কিছু বলার আগে খর পায়ে নাজমা একবার ফ্ল্যাটে চক্কর মেরে এসে বলল, ‘বুড়োকে দেখছি না। সক্কালেই বেরিয়ে গ্যাছে না কি?’

‘কাল রাতে ফেরেইনি।’

‘তাই সক্কালে দেখিনি। তোমাকে একটা কথা বলব দিদি?’ বলে হি হি করে হেসে নাজমা বলল, ‘বুড়োর মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গ্যাছে। মারথা কে গো? এদানী বুড়ো মাঝেমধ্যেই একা একা একটা ছবির সঙ্গে কথা কয়। ফরগিভ মি, ফরগিভ মি বলে। আই মিস ইউ মারথা ডার্লিং বলে। কে হয় গো সে, বুড়োর বউ?’

শুনে অবাক হল মিলেনা। ও জানে, মার্থা বলে এক মিস্ট্রেসের সঙ্গে গ্র্যান্ডপা লিভ ইন করতেন। সে অবশ্য বহুবছর আগেকার কথা। তাঁকে আবার মনে করার কারণটা কি? পুরনো প্রেম ফিরে এল না কি? মার্থার ছবি এখনও গ্র্যান্ডপা সযত্নে রেখে দিয়েছেন জেনে, মিলেনার কৌতূহল হল। ও জিজ্ঞেস করল, ‘তুই পিকচারটা নিজের চোখে দেখেছিস?’

‘হ্যাঁ গো দিদি। মাঝে মাঝে কিস করতেও দেখেছি। আই লাভ ইউ বলতে শুনেছি। ছবিটা বোধহয় বুড়োর ড্রয়ারে আছে। দাঁড়াও, আমি নিয়ে আসছি।’

লাফাতে লাফাতে নাজমা গ্র্যান্ডপার ঘরে গিয়ে ঢুকল। কিন্তু ফিরে এল একরাশ হতাশা নিয়ে। বলল, ‘না গো দিদি। ছবিটা ড্রয়ারে নেই। তার বদলে আসার সময় বুড়োর টেবলের উপর এই চিঠিটা পেলাম। পড়ে দেখো তো, বুড়ো কিছু জানিয়ে গ্যাছে কি না?’

ভাঁজ করা কাগজটা খুলে মিলেনা দেখল, ড্যাডির উদ্দেশে ইংরেজিতে লেখা একটা চিঠি। গ্র্যান্ডপা কী লিখে গেছেন, সেটা জানার জন্য ও দ্রুত চোখ বোলাল। ‘প্রিয় এরিক, অনেক ভেবে ঠিক করলাম, আমি মার্থার কাছেই ফিরে যাবো। ওর প্রতি আমি চরম অন্যায় করেছি। চার্চে গিয়ে কনফেস করেছিলাম। ফাদার বললেন, একটা উপায়েই তোমার পাপস্খলন হতে পারে। বিয়ে করে যদি মার্থা আর তোমার সন্তানকে স্বীকৃতি দাও। মার্থা যদি আমাকে ক্ষমা করে, তা হলে খুব শিগগির ওকে বিয়ে করব। পৈতৃক সূত্রে সম্পত্তি থেকে আমরা যা পাওনা, তুমি আমাকে বুঝিয়ে দেবে। আমি এ দেশেই থেকে যাবো। বাকি জীবনটা আমি শান্তিতে কাটাতে চাই। ইতি, তোমার আঙ্কল।’

বুক থেকে একটা বিরাট ভার নেমে গেল মিলেনার। যাক, গ্র্যান্ডপা তা হলে সুস্থই আছেন। ওঁর গৃহত্যাগের কথা এখনই ড্যাডিকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। দেশের বাড়ি ইরেভেনে এখন দুপুর। ড্যাডি নিশ্চয়ই অফিসে চলে গেছেন। মাম্মি বা ইভেতা লাঞ্চ রেডি করছে। আর্মেনিয়ান পরিবারে মেয়েদের বেশিরভাগ সময়টাই কাটে কিচেনে। ফোনে মাম্মিকে পাওয়া যেতে পারে ভেবে মিলেনা ভিডিয়ো কল করল। ও প্রান্ত থেকে মাম্মি জিজ্ঞেস করল, ‘মাঝ দুপুরে ফোন করলি, সব ঠিক আছে তো?’

মাম্মি বোধহয় কোনও খারাপ খবর আন্দাজ করেছে গ্র্যান্ডপা সম্পর্কে। উদ্বেগে জল ঢেলে দেওয়ার জন্য মিলেনা বলল, ‘সব ঠিক আছে। একটা খবর জানানোর জন্য তোমাদের ফোন করলাম। টাইগ্রান গ্র্যান্ডপা ডিসিশন নিয়েছেন, বিয়ে করবেন।’

মাম্মি বলল, ‘মাথা খারাপ হল না কি লোকটার? বিয়ে করছে মানে? তুই জানলি কী করে?’

অল্প কথায় মাম্মিকে চিঠির কথা গুছিয়ে বলার পর মিলেনা বলল, ‘হোয়াটসঅ্যাপে আমি চিঠিটা ড্যাডিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

মাম্মি বলল, ‘লোকটা সারাজীবন তোর ড্যাডিকে জ্বালিয়ে গেল। নিজের বউটাকে ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছিল। এখানে কাজের মেয়েদের নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারি করে গেছে। একবার তো জেল হয়ে যায়, এমন অবস্থা। তোর ড্যাডি লুকিয়ে ওঁকে পাঠিয়ে দিলেন ইন্ডিয়াতে। সে যাক, আমায় বল তো, বউ নিয়ে তোর গ্র্যান্ডপা স্টিফেন ম্যানসনে উঠবে না কি? তুই কিন্তু অ্যালাউ করবি না।’

কথাটা আগে ভাবেনি মিলেনা। চিঠিতে কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই, বিয়ে করার পর মার্থাকে নিয়ে গ্র্যান্ডপা কোথায় থাকবেন? নিয়োগী আন্টি একবার বলেছিলেন, মার্থা না কি দজ্জাল মহিলা। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের মিসেস ভাল্লা ছাড়া বাড়ির আর কারোর সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল না। মার্থা এই শহরের কোথায় থাকেন, মিলেনা জানে না। ও বলল, ‘আমার কথা উনি শুনবেন না কি? ড্যাডিকে একবার এখানে আসতে বলো।’

মাম্মি বলল, ‘তোর ড্যাডি বিজনেসের কাজে দু’তিন মাসের মধ্যে সিঙ্গাপুরে যাবে। ফেরার পথে কলকাতায় দু’চারদিন থাকবে বলছিল। শোন একটা ভাল খবর আছে। তোর জন্য একটা ভাল ছেলের সন্ধান পেয়েছি। সিঙ্গাপুরে থাকে। তোর দাদার বিজনেস পার্টনার। ছেলেটা এখানে কার্পেট ফেস্টিভ্যালে এসেছিল। তোর ড্যাডির খুব পছন্দ হয়েছে তাকে। কেন, ইভেতা তোকে কিছু বলেনি?’

মিলেনা কথাগুলো শুনে হতভম্ভ হয়ে গেল। আমতা আমতা করে ও বলল, ‘না তো?’

‘তোর ছবি দেখেই ছেলেটার পছন্দ হয়ে গেছে। ইভেতাকে বলব, ছেলেটার ছবি তোকে পাঠাতে। ড্যাডি বলছিল, তোর বিয়েটা কলকাতা থেকেই দেবে। তাতে ছেলে পক্ষেরও সুবিধে।’

মিলেনা আহত গলায় বলল, ‘তোমরা এতটা এগিয়েছ, অথচ আমাকে কিছু জানালে না মাম্মি?’

‘তোকে জানানোর কী আছে? আমাদের সমাজে কোন মাম্মি-ড্যাডি মেয়ের বিয়ে ঠিক করার সময় তার মতামত নিয়েছে শুনি?’

মাম্মির কথাগুলো শুনে দেবদূতের চেহারাটা মিলেনার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সর্বনাশ, মাম্মিরা ওর বিয়ের ব্যাপারে এতটা এগিয়ে গেছেন না কি? সবে ছাব্বিশে পা দিয়েছে মিলেনা। এই বয়েসে কোনও আর্মেনিয়ান মেয়ে আনম্যারেড থাকে না। মাম্মি যা বলছে, আদতে সেটা ড্যাডিরই কথা। আর্মেনিয়ান সমাজে মেয়েদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনও মূল্য নেই। পুরুষরা যা বলবে, সেটাই মুখ বুঁজে করে মেনে নিতে হবে। মেয়ে যতই এনলাইটেন্ড হোক না কেন? বিয়ের ব্যাপারে অদ্ভুত গোঁড়ামি ওদের সমাজে। কিছুতেই ভিনধর্মী বা ভিনদেশিকে আর্মেনিয়ান মেয়েরা বিয়ে করতে পারবে না। পুরুষদের অবশ্য কোনও বাধা নেই। ওর এক পিসি অস্টিন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে এক আমেরিকানের প্রেমে পড়েছিলেন। দেশে ফেয়ার পর তাঁর উপর মারাত্মক টর্চার করা হয়েছিল। মিলেনা ছোটবেলায় শুনেছে, সেই পিসি সুইসাইড করেন।

মায়ের ফোনটা ছেড়ে মিলেনা ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। ওর কপালটাই খারাপ। গ্র্যান্ডপাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা দূর হল, তো দেবদূতকে হারানোর চিন্তা মাথায় ঢুকল। দেবদূত ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের কথা ও ভাবতেই পারে না। রোজ একবার ওর সঙ্গে দেখা না হলে প্রাণ ছটফট করে। ভিনধর্মের একটা ছেলেকে এত দ্রুত মন দিয়ে ফেলবে, মিলেনা কল্পনাও করেনি। দেবদূতের সঙ্গে মিশে বাঙালিদের সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে মিলেনার। অত্যন্ত সংবেদনশীল। মেয়েদের খুব সম্মান করে। সেটা আরও বুঝতে পারে, ইদানীং অ্যানার মুখে অনিলদের প্রশংসা শুনে। না, না, মাম্মি-ড্যাডির কথা ও কিছুতেই শুনবে না। তেমন হলে বিদ্রোহ করবে। এটা আর্মেনিয়া নয়, ইন্ডিয়া। আর ও ইন্ডিয়ান সিটিজেন। এখানে মেয়েদের সমান অধিকার কেউ জোর করে মেয়েদের উপর মতামত চাপিয়ে দিতে পারে না।

মাম্মি বলল, ড্যাডির কলকাতায় আসার কথা মাস দু’তিন পরে। হাতে অনেকটা সময় আছে। এর মধ্যে দেবদূতের কম্পিটিশনটা হয়ে যাবে। তার পর ভেবেচিন্তে একটা ডিসিশন নেবে। এর মাঝে ইরেভেনের কাউকে জানতে দেবে না দেবদূতের কথা। শুধু ওখানকার কথা শুনে যাবে। এখন দেবদূতকেও কিছু জানাবে না। সোফায় বসে মনে মনে ও বলল, ফার্স্ট থিং ফার্স্ট। আগে গ্র্যান্ডপার লিখে যাওয়া চিঠিটা ড্যাডিকে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। চিঠিটার ছবি তুলে ও ড্যাডির হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে পাঠিয়ে দিল। চিঠিটায় দ্বিতীয়বার চোখ বোলানোর সময় এই প্রথম গ্র্যান্ডপাকে ওর শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে হল। অন্তত উনি মার্থার প্রেমের মর্যাদা দিয়েছেন।

সোফার উপর রাখা মোবাইল ফোনটা বাজছে। সেট তুলে তাকিয়ে মিলেনা দেখল, ডিম্পল। হঠাৎ ও ফোন করেছে? সোয়াইপ করতেই ও প্রান্ত থেকে ডিম্পল বলল, ‘মিলেনা তোমাকে বিরক্ত করলাম না তো? তুমি কি স্কুলে, না বাড়িতে?’

এই সেই মেয়েটা, অ্যানার সিস্টার ইন ল।’ টেম্পলে দেবদূতকে বডিবিল্ডার বলে তাচ্ছিল্য করেছিল। মিলেনা বলল, ‘আজ স্কুলে যাইনি। বলো, ফোন করলে কেন?’

‘কী বলব, কীভাবে বলব, জানি না মিলেনা। সেদিন টেম্পলে আমি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে একটা বাজে কথা বলেছিলাম। তার জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। দেবদূত সেদিন আমার ভাইকে না বাঁচালে, কী হত, ভাবতেই ভয় পাচ্ছি। আমার জন্মের পনেরো বছর পর ওই ভাইয়ের জন্ম। আমাদের ফ্যামিলির চিরাগ বলতে পারো। বংশের একটাই ছেলে। ওর কিছু হলে আমাদের ফ্যামিলিটাই রুইনড হয়ে যেতো। ড্যাডি দেবদূতের জন্য কিছু করতে চান। প্লিজ, তোমরা দু’জন একদিন আসবে আমার ড্যাডির বাড়িতে?’

মিলেনা বলল, ‘ওই একটা সামান্য কথা নিয়ে তুমি লজ্জা পাচ্ছ কেন ডিম্পল? আমি তো তখনই ভুলে গেছিলাম। তুমি দেবদূতের সঙ্গে সরাসরি কথা বলো। ও টাইম করতে পারবে কি না, আমি জানি না। ব্যাঙ্ককের কম্পিটিশন নিয়ে ও এখন খুব ব্যস্ত।’

‘তা হলে মাকেই সিলভার জিম-এ পাঠিয়ে দেবো। ওয়ান্স এগেন, প্লিজ ফরগিভ মি।’

ফোনটা রেখে মিলেনা লাফিয়ে উঠল। দু’হাত তুলে ও নাচতে শুরু করল ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণা’ বলে। হঠাৎ দরজার দিকে ওর চোখ গেল। নাজমা কিচেন থেকে বেরিয়ে এসেছে। অবাক চোখে তাকিয়ে ও বলল, ‘কি হল তোমার দিদি? বুড়োর মতো তোমারও ভীমরতি হল না কি?’

(সাতাশ)

সিলভার হোটেলের একতলায় এমডি-র ঘরের রিসেপশনে বসে রয়েছে দেব। আনন্দী ম্যাডাম ওকে দেখা করতে বলেছেন। ম্যাডাম মাঝে ইউরোপ ট্যুরে গেছিলেন বিজনেস ট্রিপে। প্রায় মাসখানেক ছিলেন। পান্ডেজির মুখে দেব শুনেছে, হোটেলের অ্যাট্রাকশন বাড়ানোর জন্য ম্যাডাম না কি অনেক প্ল্যান নিয়ে এসেছেন। তার মধ্যে একটা রেন ডান্স। হোটেলের পিছন দিকে কুইন্স ম্যানসনের গায়ে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে নাকি কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা করা হবে। গেস্টরা ইচ্ছে করলে পার্টনার নিয়ে সেখানে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ডান্স করতে পারেন। পাণ্ডেজি বলছিলেন, হোটেলের দোতলায় সুইমিং পুলটাতে গেস্টরা যেতে চান না। সেখানে স্নান করার মধ্যে না কি কোনও উত্তেজনা নেই।

হোটেলের ছাদে পায়চারি করার সময় নীচের দিকে তাকিয়ে ইদানীং দেবের চোখে পড়েছে, ফাঁকা জায়গাটায় পনেরো-কুড়ি ফুট উপরে পাইপ লাগানোর কাজ চলছে। সেখান থেকে জল পড়বে রেন ডান্সের সময়। বড়লোকদের কত রকম খেয়াল! কতরকমভাবেই না ওরা পয়সা ওড়াতে পারেন। হয়তো রেন ডান্সের জন্য এন্ট্রি ফি-ই হবে হাজার টাকা। গরমকালে, ফেস্টিভ্যাল সিজনে লোক উপচে পড়বে ওখানে। একটা সেক্সচুয়াল প্লেজারের জায়গা হয়ে দাঁড়বে। আনন্দী ম্যাডামের প্রশংসা করে পান্ডেজি বলছিলেন, ‘ভদ্রমহিলার বিজনেস ব্রেন অসাধারণ। বিজনেসটা দান খয়রাতের জায়গা নয়। এমনভাবে করতে হবে যাতে দুটো পয়সা রিটার্ন আসে।’ পান্ডেজির কথাবার্তায় কোনও খোঁচা আছে কি না দেব মাঝেমধ্যে বোঝার চেষ্টা করে। উনি কি এটা বোঝাতে চান, জিম-ফিম লাভজনক নয়? আনন্দী ম্যাডামের হাসবেন্ড বিরাট শরাফ কিন্তু তখন জিমটা বানিয়ে ছিলেন, স্রেফ হোটেলের গ্ল্যামার বাড়ানোর জন্য নয়, অফিস পাড়ার কর্পোরেটদের স্বাস্থ্যচর্চার কথা মাথায় রেখে।

জিম-এর জন্য কয়েকটা ইকুইপমেন্ট কেনা দরকার। ম্যাডামকে সেকথা বলবে বলে দেব তৈরি হয়ে এসেছে। ম্যাডামের পিএ রত্নাবলী মেয়েটা ওকে ভালমতো চেনে। মাঝে মাঝে সে ম্যাডামের ঘরে ঢুকছে এবং বেরিয়ে আসছে। একবার বলল, ‘ম্যাডামের ঘরে দু’তিনজন বসে আছেন। ওরা বেরিয়ে গেলেই আপনাকে ঢুকিয়ে দেবো দেবদা।’ প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে ও বসে আছে, অথচ ম্যাডাম ওকে ডেকে নেননি, এমনটা আগে কখনও হয়নি। হঠাৎই ম্যাডামের ঘর থেকে ও এমন একজনকে বেরিয়ে আসতে দেখল, যাকে আশা করেনি। মাস্তান রুস্তম! দেব ভেবেই পেল না, ওর মতো একটা রাফিয়ান ম্যাডামের ঘরে এতক্ষণ কী করছিল? ম্যাডামের সঙ্গে ওর যোগাযোগই বা হল কী করে? বেরিয়ে যাওয়ার সময় রুস্তম একবার ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। দেব মুখটা কঠিন করে রইল।

রুস্তমকে দেব প্রথম দেখে বছর তিনেক আগে। ওদের জিম-এর ডান পাশে দেওয়ালের ফাঁকে একটা শরবতের দোকান আছে। খুবই ছোট্ট একটা জায়গায়, রাস্তার খানিকটা উপরে যাদবের সেই দোকান। লোকটা বয়স্ক, ফিজিক্যালি হ্যান্ডিক্যাপড। পায়ে প্রবলেম আছে। তখনও সাপ্লিমেন্ট খাওয়া শুরু করেনি দেব। রোজই একবার করে বেরিয়ে ও যাদবের দোকানে মৌসম্বীর রস খেত। একদিন দেখে, ওরই বয়সি একটা ছেলে যাদবকে দোকান থেকে টেনে নামিয়ে মারধর করছে। আর ফুটপাতের ধারে মোটর বাইকে বসে ওকে উৎসাহ দিচ্ছে আরেকটা ছেলে। আশপাশের দোকানদাররা দাঁড়িয়ে দেখছে, কিন্তু ছেলে দুটোকে কিছু বলছে না। চলে যাওয়ার সময় ছেলে দুটো শাসিয়ে গেল, ফের পরের দিন আসবে। টাকা রেডি করে না রাখলে, দোকানটাই তুলে দেবে।

দেব ভেবেছিল, যাদব হয়তো টাকাপয়সা ধার নিয়েছিল। শোধ করতে পারেনি। কিন্তু পরে শুনেছিল, বাইকে বসে থাকা ছেলেটার নাম রুস্তম। তাকে প্রতি হপ্তায় টাকা দিতে হয় পার্ক স্ট্রিটের ছোট বড় সব দোকানের মালিককে। শুনে দেবের রক্ত গরম হয়ে গেছিল। কিন্তু যাদব পরে ওকে বলেছিল, ‘সাব, রুস্তম আগে পার ডে পঞ্চাশ রুপিয়া নিত। এখন বাড়াতে বলছে। কোত্থেকে দেবো? আপ যাইয়ে। আপনি ভদ্দর ঘরের ছেলে। আমি চাই না, আমার জন্য আপনি কোনও ঝামেলায় পড়ুন। আমার বিরাদরির লোকজন আছে নিউ মার্কেটে। উন লোগ নিপট লেঙ্গে।’ যাদব চায়নি বলে, সেইসময় দেব আর মাথা ঘামায়নি। কিন্তু পরে জিম-এ যাতায়াত করার সময় এমন অনেক ইন্সিডেন্ট ওর চোখে পড়েছে, যা দেখে ওর গা চিড়বিড় করেছে। মাঝে একবারই মাত্র ওকে পেটানোর সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু মিলেনার সামনে ও নিষ্ঠুর হতে পারেনি সেদিন।

হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন আনন্দী ম্যাডাম। ওঁর পিছনে হ্যান্ডসাম একটা ছেলে। রিসেপশনে ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখে ম্যাডাম বললেন, ‘দেবদূত, তোমার সঙ্গে এই ছেলেটির আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম দুর্বার চৌধুরী। লন্ডন থেকে ইনটিগ্রেটেড ফিটনেস ডিগ্রি নিয়ে এসেছে। একে ট্রেনার হিসেবে নিলাম।’

জিম-এ একজন ট্রেনার কম ছিল। ভালই হল ছেলেটা আসায়। হ্যান্ডশেক করার জন্য দুর্বারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে দেব বলল, ‘ওয়েলকাম।’

ম্যাডাম বোধহয় খুব ব্যস্ততার মধ্যে আছেন। বললেন, ‘তুমি একে জিম-এ নিয়ে যাও দেবদূত। এ কিছু ইনোভেটিভ আইডিয়া দেবে। জিম-এর ইনকাম বাড়ানোর জন্য। তোমাকে কী করতে হবে, এর কাছ থেকে জেনে নিও।’ কথাগুলো বলে ম্যাডাম আর দাঁড়ালেন না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

ইকুইপমেন্ট কেনার কথা বলাই হল না। দেব বলল, ‘চলো দুর্বার, জিম-এ যাওয়া যাক।’

বেলা এগারোটা বাজে। ফ্লোর প্রায় ভর্তি। বেলা সাড়ে দশটা থেকে দেবের কার্লিং করার সিডিউল ছিল। সেটা মিস হয়ে গেল ম্যাডামের জন্য। দুর্বারকে নিয়ে জিম-এ ঢুকে দেব দেখল, তমাল ওর চেম্বারে বসে আছে। দু’জনের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘বোসো দুর্বার, তোমার সঙ্গে ভাল করে আলাপ করা যাক। ম্যাডাম বলছিলেন, তুমি না কি ফিটনেসের উপর ডিগ্রি নিয়ে এসেছ। কোত্থেকে?’

দুর্বারের মুখে বিদ্রুপের হাসি। বলল, ‘লন্ডনের আথেনা ইউনিভার্সিটি থেকে। ওখানে চান্স পাওয়া খুব কঠিন। দুটো বছর ওখানে থেকে আমি কোর্সটা করে এসেছি।’

‘কী শেখায় ওখানে?’

‘সবকিছু ফিটনেস থেকে শুরু করে, বডি বিল্ডিংয়ের খুঁটিনাটি সব। মাসল বিল্ডিং নিয়েও আলাদা কোর্স করেছি। প্লাস জিম ম্যানেজমেন্ট, ইকুইপমেন্ট কন্ট্রাক্টর, জিম ইনস্ট্রাক্টর, ডায়টেশিয়ান, নিউট্রেশন কোর্স। চেন্নাইয়ের একটা জিম চালাতাম। দিল্লি, মুম্বাই আর বেঙ্গালুরুর কয়েকটা জিম থেকেও অফার পেয়েছিলাম। কিন্তু আনন্দী ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগল। তাই চলে এলাম।’

‘নিজে কখনও বডিবিল্ডিং করেছ?’

‘একটা সময় করেছি। কিন্তু বডি বিল্ডিংকে প্রোফেশন হিসেবে নেওয়ার কথা যখন মাথায় এল, তখনই লন্ডনে চলে গেলাম। তুমি কখনও গেছ?’

‘না ভাই। এখনও যাওয়ার সুযোগ পাইনি।’

‘তা হলে তো দেখছি, টপ লেভেলের বডি বিল্ডিং সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণাই নেই। পিটার চ্যান্ডলার বা রুবি ফাউলারের নাম শুনেছ কখনও। ওঁরা দু’জন হলেন আথেনা ইউনিভার্সিটির ফিটনেস অকাদেমির ডিরেক্টর। ওয়ার্ল্ডের টপ দু’জন ফিটনেস এক্সপার্ট। রকি সিরিজের যে সব মুভিগুলো তোমরা দেখো, তার অ্যাক্টররা সবাই ওঁদের হাতে তৈরি।’

তমাল মোবাইলে কী যেন দেখে যাচ্ছে। দেব লক্ষ্য করল, ও ভালভাবে শুনছেও না দুর্বারের কথা। অথচ ওর মতো মিশুকে ছেলে খুব কম আছে। অন্য কেউ হলে তমাল গলগল করে কথা বলে যেত। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ও বলল, ‘দেব, চলি রে। বারোটা থেকে আমার ডিউটি। পরে কথা হবে।’

তমাল বেরিয়ে যাওয়ার পর দেব বলল, ‘খুব ভাল হল দুর্বার, তোমার এক্সপিরিয়েন্স মেম্বারদের কাজে লাগবে। আমি কয়েকটা দিনের জন্য ব্যাঙ্ককে যাচ্ছি। মি. এশিয়া প্যাসিফিক কম্পিটিশনে। ততদিনে তুমি জিম-এর সবার সঙ্গে আলাপ- পরিচয়টা ভালোভাবে সেরে রেখো।’

কথাটা শুনে দুর্বার অবাক হওয়ার ভঙ্গি করল, ‘জিম-এর ডে টু ডে দেখাশুনো করার জন্য ম্যাডাম কিন্তু আমাকে আনেননি। মেক নো মিসটেক দেবদূত। আমি এসেছি, বডিবিল্ডিংয়ের সঙ্গে বিনোদন মিশিয়ে জিম ব্যবসাটাকে লাভের মুখ দেখাতে।’

তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না দুর্বার।’

‘স্বাভাবিক। এই হাই লেভেলের আইডিয়া তোমার মাথায় আসবেই বা কী করে? একবারে বটম লেভেল থেকে বোঝানোর চেষ্টা করি। তুমি স্ট্রিপটিজ কথাটা শুনেছ?’

‘মানে, মেয়েদের নেকেড হওয়ার কথা বলছ?’

‘একজাক্টলি তাই। পুরুষদের টানতে বহু নামী হোটেল মেয়েদের স্ট্রিপটিজের শো রাখে। সেখানে কোন বয়সি পুরুষরা বেশি যায় জানো? পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর উপর যাদের বয়স। যাদের সেক্স আর্জ বউদের দিয়ে মেটে না। আমরা এর উল্টোটা সিলভার হোটেলে চালু করব। পুরুষদের স্ট্রিপটিজ। চেন্নাইয়ের হোটেলে একটা শো দেখেছিলাম। একদিনে প্রায় পঁচিশ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছিল।’

‘এখানে স্ট্রিপটিজ করবেটা কে?’

‘শুরুতে বাইরে থেকে লোক ভাড়া করে আনতে হবে। মুম্বইয়ে এ রকম দু’তিনজন আছে, যারা সেলেব্রিটি হয়ে গেছে। একজনের নাম আনোয়ার। প্রতি শো-তে সে পাঁচ লাখ টাকা করে নেয়। পরে আমাদের জিম থেকেই পারফর্মার তুলে আনতে হবে।’

শুনে মাথা ঘুলিয়ে যাচ্ছে দেবের। কী বলছে দুর্বার? ও বলল, ‘ছেলেদের নেকেড দেখার জন্য কারা আসবে ভাই। তা ছাড়া এটা তো হাইলি ইমমরাল। পুলিশ জানতে পারলে সব বন্ধ করে দেবে।’

‘সেসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। ম্যাডামের ঘরে রুস্তম বলে একটা ছেলের সঙ্গে আজই আমার আলাপ হল। সে কথা দিয়েছে, পুলিশকে সামলে নেবে। আর তুমি এই শো-কে ইমমরাল ভাবছ কেন দেব? তোমাদের এই মিডল ক্লাস মেন্টালিটি আর সহ্য করা যায় না। ভাবো না, ইট’স ফান। কারা দেখতে আসবে, জিজ্ঞেস করছ? পঁয়তাল্লিশের বেশি বয়স, এমন সব মহিলা। ওদের সেক্স হাঙ্গার অনেক বেশি। হাসবেন্ডের কাছ থেকে ওরা ফিজিক্যাল প্লেজার পায় না। ওদের হাসবেন্ডরাও বিছানায় উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে অন্য মহিলার কথা ভাবে। আমার তো মনে হয়, হাই সোসাইটির মহিলারা ঝাঁপিয়ে পড়বে ছেলেদের স্ট্রিপটিজ দেখতে। অবশ্য যদি পুরো শো-টাই বিহাইন্ড দ্য কার্টেন করা যায়।’

‘সেটা কি করে সম্ভব?’

‘নিশ্চয়ই সম্ভব।’ দুর্বার আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ‘হোটেলের কোনও একটা ডিলাক্স সুইটে দশজনের জন্য শো। প্রতিদিন দুটো করে এক ঘণ্টার শো। অন লাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থা থাকবে। টিকিটের দামটা ঠিক করবেন আনন্দী ম্যাডাম। শো-এর পর পারফর্মার-এর বডি যদি কোনও মহিলার পছন্দ হয়, তা হলে নিলাম করা হবে। যে যত বেশি টাকা দেবে, সে পারফর্মারকে দিয়ে সেক্স হাঙ্গার মেটাতে পারে। তবে সেটাও এক ঘণ্টা মেয়াদের।’

দেবের গা গুলিয়ে উঠল কথাগুলো শুনে। এ তো এক ধরনের বেশ্যাবৃত্তি। ও পাল্টা যুক্তি দেওয়ার চেষ্ট করল, ‘কলকাতা কিন্তু চেন্নাই বা মুম্বইয়ের মতো নয়। কলকাতা ভীষণ কনজারভেটিভ। তোমার কি মনে হয়, এখানে এই সব শো চলবে?’

‘আলবাত চলবে। একেকটা শো থেকে কত ইনকাম ভাবো? তার একটা পার্সেন্টেজ পাবে পারফর্মার। সে, পার শো দু থেকে আড়াই লাখ টাকা তো বটেই।’

‘আমাকে এ সবে জড়াচ্ছ কেন দুর্বার?’

‘জড়াতে হচ্ছে দু’টি কারণে। এক, তিন বছর আগে শুরু করার পর থেকে আজ পর্যন্ত তোমার জিম লাভের মুখ দেখেনি। প্রতি বছর দশ থেকে বারো লাখ টাকা আনন্দী ম্যাডামের গচ্চা যাচ্ছে। এই শো-টা চালু করলে জিম লাভের মুখ দেখবে। দুই, যেসব ছেলে তোমার জিম-এ বডি বানাতে আসছে। তাদের কাছে একটা রোজগারের পথ খুলে যাবে।’

দেব যুক্তি খাঁড়া করল, ‘তোমার শো-টা তো শেষপর্যন্ত স্ট্রিপটিজে সীমাবদ্ধ থাকছে না দুর্বার। শেষপর্যন্ত গিয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রস্টিটিউশনে।’

‘তাতে তোমার কী এসে গেল?’ দুর্বারের গলায় অসন্তোষের সুর, ‘দ্যাখো ভাই, টু মেক ইট ক্লিয়ার, সেক্স শো চালানোর জন্য আমার চার-পাঁচটা ছেলে দরকার। যাদের মাসল ভলিউম দেখার মতো। খালি গায়ে যাদের দেখলে বয়স্কা মহিলারা পাগলা হয়ে যাবে। ববি বলে একটা ছেলের নাম রুস্তম দিয়েছে। কিন্তু ও-ই ম্যাডামকে সাজেস্ট করল, তোমাকে দিয়ে শো-টা শুরু করাতে। কেননা, তোমার মতো বডি না কি জিম-এ কারোর নেই। শোনো দেবদূত, তোমাকে একটা পেন ড্রাইভ দিয়ে যাচ্ছি। প্রথমে স্ট্রিপটিজ তার পর সেক্স শো কীভাবে হয়, তা দেখানোর জন্য আমি ফুটেজ আনিয়েছি আমস্টারডাম থেকে। তুমি ফ্রি টাইমে ফুটেজটা দেখে রেখো। ম্যাডাম বললেন, জিম-এ কোয়েল বলে একজন যোগা টিচার আছে। সে না কি মারাত্মক সেক্সি। সেক্স শো-তে তোমার পার্টনার হিসেবে না কি তাকে খুব মানাবে।’

পেন ড্রাইভটা টেবলে রেখে দুর্বার উঠে দাঁড়াল। ওর মুখে কোয়েলের নামটা শুনে মাথায় রাগ চড়ে গেল দেবের। ওর ইচ্ছে হল, দুর্বারকে দু’হাতে তুলে ধরে ফ্লোরে আছড়ে ফেলে। ঠিক তখনই ওর মোবাইলে পিং শব্দ। মেসেজ বক্সটা খুলে ও দেখল, তমাল পাঠিয়েছে। ‘দুর্বারের সঙ্গে ঘনাদা বা টেনিদার কোনও পার্থক্য নেই। গুগল সার্চ করে দেখলাম, লন্ডনে আথেনা ইউনিভার্সিটি বলে কিছু নেই। পিটার চ্যান্ডলার বা রুবি ফাউলার তার ডিরেক্টর হতে পারেন না। ছেলেটাকে পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই।’

মেসেজটা পড়ে মুখ তুলে দেব দেখল, দুর্বার জিম থেকে বেরিয়ে গেছে।

(আঠাশ)

ক্যালকাটা বুক ফেয়ারে দমকলের একটা স্টল নেওয়া হয়েছে। বইমেলায় প্রচুর লোকজন হয়। ফায়ার সেফটি নিয়ে তাদের সচেতন করার জন্য এই উদ্যোগ। মাস তিনেক আগে বরেনদা সদর দফতরে এসেছিলেন, ফায়ার ফাইটিংয়ের উপর সদ্য ওঁর লেখা একটা বই উপহার দিতে। তখনই আইডিয়াটা মাথায় খেলে যায় শিখিনের। এমনিতে এপ্রিল মাসে দমকল থেকে একটা অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম নেওয়া হয়। তবুও, বইমেলায় স্টল দেওয়ার আইডিয়াটা লুফে নেন এখনকার ডিরেক্টর প্রেমচাঁদ তিওয়ারি। বইমেলা এখন হয় সল্ট লেকের সেন্ট্রাল পার্কে। গিল্ডের সঙ্গে কথা বলে পুরো ব্যবস্থাটা করেছেন অনিমেষদা। জায়গার অভাব নেই। দুটো ইঞ্জিন সেখানে রাখা আছে দু’প্রান্তে।

অনিমেষদা রোজই বইমেলার স্টলে যেতে বলছিলেন। সেই কারণে তো বটেই, মেলায় বিদেশি বইয়ের স্টল থেকে ফায়ার ফাইটিংয়ের উপর লেখা নতুন বই কিনতেও শিখিন আগ্রহী। খুব বেশি খুঁজতে হল না। আট নম্বর গেটের গায়েই দমকলের স্টল। ঢুকে তিনি দেখলেন, বিধাননগর ডিভিশনের অসীম কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। দু’জনের একই সময়ে কর্মজীবন শুরু। রামপুরহাটে বছর দুয়েক একই সঙ্গে চাকরি করেছেন। তাই একটা সময় খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। দেখা হতেই অসীম বলল, ‘কী রে, রোজই অনিমেষদার মুখে শুনি তুই না কি আসবি। মেলা শেষ হতে চলল, এতদিনে আসার সময় পেলি?’

শিখিন বললেন, ‘এতদূরে আসা পোষায় না কি। ডিজি কাল বললেন, তাই এলাম।’

কথা বলার সময়ই শিখিনের চোখে পড়ল লাল চকচকে বুলেট গাড়িগুলোর দিকে। স্টলের ঠিক বাইরে পাঁচটা মোটর বাইক পরপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। বইমেলায় বুলেট রাখার আইডিয়াটাও তাঁর। মেলায় বিভিন্ন স্টলগুলোর মধ্যে দূরত্ব খুব কম। কোনও স্টলে ছোটখাটো আগুন লাগলে, বড় ইঞ্জিন নিয়ে তাড়াতাড়ি সেখানে পৌঁছনো যাবে না। তাই প্ল্যান করার সময় শিখিন বলেছিলেন, বুলেটের ক্যারিয়ারে বড় এক্সটিংগুইশার রাখতে। বাইক নিয়ে অলিগলি দিয়ে চট করে স্টলে চলে যাওয়া যাবে। তেইশ বছর আগে এই আইডিয়াটা কারও মাথায় খেললে, সম্ভবত বইমেলায় বিধ্বংসী আগুন লাগত না। সেবার মেলায় আগুন লেগেছিল, স্টলের মধ্যে চা বানানোর সময় জ্বলন্ত স্টোভ থেকে।

ডেকোরেটরের কাপড় দিয়ে ঘেরা ঘরে বসে খানিকক্ষণ আড্ডা দিলেন শিখিন। টের পেলেন, অসীম তাঁর সম্পর্কে সব খবরই রাখে। কথায় কথায় ও জিজ্ঞেস করল, ‘তোকে কাগজে একটা রিপোর্ট দেখলাম। কী ব্যাপার রে?’

বুঝতে না পেরে শিখিন বললেন, ‘কোন রিপোর্টটা? বাঁশদ্রোণীর পাতকুয়া থেকে যুবক উদ্ধার?’

‘আরে না। স্টিফেন ম্যানসনের আগুন লাগা নিয়ে। তোর সম্পর্কে তো যা তা লিখেছে।’

তার মানে ঈশিতার রিপোর্ট। সেটা বেরিয়েছে না কি? আশ্চর্য, মেয়েটা জানায়নি! শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী লিখেছে, বল তো?’

‘বাড়িটা ডেঞ্জারাস অবস্থায় রয়েছে। অথচ দমকলের কোনও হুঁশ নেই। স্টিফেন ম্যানসনের ওপরের দিকে তিনটে তলা নাকি বেআইনিভাবে বানানো। কর্পোরেশনের স্যাংশন নেওয়া হয়নি। বাড়িটা নিয়ে তোকে ডিজি একটা রিপোর্ট দিতে বলেছিলেন। তুই না কি গড়িমসি করছিস!’

যেমনভাবে ঈশিতাকে তিনি লিখতে বলেছিলেন, ও সেইভাবেই লিখেছে। তাঁকে খানিকটা দোষারোপ করে। শিখিন কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে বললেন, ‘ভুলভাল লিখেছে। ডিজি নিজেই আমাকে রিপোর্ট দিতে মানা করেছিলেন। কেঁচো খুঁড়তে না সাপ বেরিয়ে পড়ে।’

‘আই সি।’ দাঁত চিপে অসীম বলল, ‘তিওয়ারি তা’লে মাল খেঁচার কথা ভাবছে। শালা, শান্তিনিকেতনে একটা বাড়ি কিনে রেখেছে। সল্ট লেকে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট। দেদার মাল কামাচ্ছে। কলকাতা শহরে গত পাঁচ বছরে যতগুলো শপিং মল হয়েছে, প্রত্যেক ক’টা থেকে কামাই। মাল না দিলে লাইসেন্স পেতে দেরি হবে।’

শিখিন বাধা দিয়ে বললেন, ‘কার সম্পর্কে কী বলছিস অসীম। এখনকার ডিজি সে রকম মানুষ না।’

অসীম হঠাৎ চটে গিয়ে বলল, ‘শিখিন অনেক হয়েছে। এ বার চোখ কান খুলে চলার চেষ্টা কর তো ভাই। এত ভাল খেলতিস, অথচ এশিয়ান গেমসে যেতে পারিসনি। বসতবাড়ি ছিল, সেটাও হাতছাড়া করে ফেলেছিস। রাখীর সঙ্গে প্রেম করেছিলি, সে সম্পর্কটাও টিকিয়ে রাখতে পারলি না। টাকা-পয়সাও কিছু জমিয়েছিস বলে মনে হয় না। জীবনে কী করলি, সে হিসেবনিকেশ কি কখনও করেছিস? থাকিস সরকারী কোয়ার্টারে। আর ক’বছর পর রিটায়ার করলে, তুই কোথায় যাবি, কখনও ভেবেছিস?’

শিখিন বললেন, ‘নিজের কথা আমি অত ভাবি না ভাই। জীবন কখনও থেমে থাকে না। আমারও কেটে যাবে। রিটায়ার করার পর যে টাকা হাতে পাবো, তা দিয়ে একটা এনজিও খুলতে চাই। ফায়র ভিক্টিমদের জন্য। আগুন যাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে, তাদের কথা কেউ ভাবে না রে। জোকার কাছে একটা জমি কিনে রেখেছি অনেকদিন আগে। সেটাই তখন কাজে লাগাব।’

‘শালা, তোর যা ইচ্ছে কর। তোকে তো কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। আমাদের সংসার আছে। বউ ছেলে-মেয়ে আছে। ওদের ভবিষ্যতের কথা আমায় মাথায় রাখতে হয়। তোকে বলতে কোনও অসুবিধে নেই। বিধাননগর ডিভিশনের চার্জ নেওয়ার পর থেকে আমার ভাল কামাই হচ্ছে ভাই। ছেলেকে বেঙ্গালুরুতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠিয়েছি। মেয়েকে ভুবনেশ্বরে এমবিএ করতে। এখন ইচ্ছে হলে, ভাল রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে বউকে ব্যুফে খাওয়াতে পারি। তোর কথা মনে হলে, আমার গা রাগে চিড়বিড় করে। আমাদের র‍্যাঙ্কের সবার গায়ে কালো স্ট্যাম্প পড়ে গেছে, তুই সফেদ থাকবি কেন?’

অসীমের আত্মগ্লানির কথা শুনে হাসি পাচ্ছে শিখিনের। বঙ্কিমচন্দ্রের লাইনটাই ওঁর মনে পড়ল। ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ চেয়ার ছেড়ে উঠে, একমুখ হেসে তিনি বললেন, ‘তোর চিড়বিড়ানি কমুক। আমি ততক্ষণে বইয়ের স্টলগুলোতে চক্কর মেরে আসি।’ অসীম অবাক চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে। বিশ্বাসই করতে পারছে না, কী করে তিনি কথাগুলো এত হালকাভাবে নিলেন।

মনে মনে শিখিন বললেন, ‘এত বিষয়ী হয়ে কি লাভ ভাই? রাতে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি। অবসর পেলে ইন্টারন্যাশনাল সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য পড়াশুনো করতে পারি। মান্না দের গান শুনে চোখের জল ফেলতে পারি। অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করতে পারি। শোন ভাই, পৃথিবীর সবথেকে বড় আদালত হল বিবেক। সেখানে যখন সওয়াল করা হবে, তোরা তখন কি জবাব দিবি? বিষয়-আশয় নিয়ে তোরা ভাব ভাই। আমি ততক্ষণে কিছুটা সময় ছোটবেলায় ঘুরে আসি।’

দমকল অফিস থেকে বেরিয়েই শিখিন দেব সাহিত্য কুটিরের স্টলটা দেখতে পেলেন। বিরাট স্টল, প্রচুর ভিড়। শিখিনের মনে পড়ল, ছোটবেলায় প্রথম বইমেলায় এসেছিলেন বাবা-মার হাত ধরে। তখন ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়েন। বাবা সেবার দুটো বই কিনে দিয়েছিল এই দেব সাহিত্য কুটির থেকে। একটা ঠাকুরমার ঝুলি, অন্যটা রাক্ষস-খোক্কসের গল্প। বই দুটো যে কতবার তিনি পড়েছিলেন, ইয়ত্তা নেই। মা বাড়ি থেকে পরোটা আর আলুর দম করে নিয়ে এসেছিল। তিনজনে মিলে ময়দানের কোনও একটা গাছতলায় বসে তৃপ্তি করে টিফিন সেরেছিলেন। সন্ধেবেলায় ট্রাম ধরে ওঁরা হেদুয়ার বাড়িতে ফেরেন। বইমেলায় তখন এত খাবার বা অন্য জিনিস বিক্রি করার স্টল থাকত না। এত ধুলো, আর তার মাঝে হ্যান্ডবিল, লিফলেট গড়াগড়ি খেতেও দেখা যেত না। এখনকার মতো এত অপরিচ্ছন্ন বইমেলা আগে কখনও তাঁর চোখে পড়েনি।

গেট দিয়ে ঢোকার পর কেউ একজন বইমেলার ম্যাপ হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। ভিড়ের মাঝে ঠোক্কর খেতে খেতে শিখিন ভাবলেন, উদ্দেশ্যহীন না ঘুরে, বিদেশি বইয়ের স্টল ঠিক কোথায়, একবার দেখে নেওয়া যাক। বাউলদের স্টলের পাশে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে ম্যাপটা তিনি খুলে ধরলেন চোখের সামনে। বাহ, দারুণ আইডিয়া তো! একেকটা অডিটোরিয়াম আর রাস্তার নাম একেক জন লেখকের নামে। একেকটা জোন একেকটা রঙের। বিদেশি বইয়ের স্টল এফ ব্লকে ব্লু জোনে, ম্যাক্সিম গোর্কি সরণিতে। যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তার দিক উল্টোদিকে। দুপুরে চড়া রোদ্দুর। শিখিন হঠাৎ তেষ্টা অনুভব করলেন। ছোটবেলায় যখন আসতেন, তখন বাবা শান্তিনিকেতনি ঝোলা থেকে জলের বোতল বের করে দিয়ে বলতেন, ‘বাচ্চু, পুরোটা খেয়ে ফেলিস না যেন।’ এখন রাস্তার ধারে বিনে পয়সায় জলের পাউচ পাওয়া যাচ্ছে। একটা পাউচ চেয়ে নিয়ে পুরো জলটা গলাধঃকরণ করে শিখিন এগোলেন এফ ব্লকের দিকে।

কোথাও বাউল গান, কোথাও রবীন্দ্র সংগীত অথবা হেমন্ত মুখার্জির ‘রানার ছুটেছে’। ছোটবেলার বইমেলায় এত শব্দদূষণ ছিল না। কেউ হারিয়ে গেলে অ্যানাউন্সমেন্ট হত, ‘কাঁচরাপাড়া থেকে এসেছেন বিমলেন্দু চ্যাটার্জি। আপনার ছেলে আমাদের প্যাভিলিয়নে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’ অথবা সন্ধেবেলায় কোনও অনুষ্ঠান থাকলে বক্তা বা গায়ক-গায়িকার নাম ঘোষণা করা হত। শিখিনের মনে পড়ল, একবার বইমেলায় বদমাইসি করে বন্ধুরা তাঁর নামটা বারবার অ্যানাউন্স করিয়েছিল। স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়েন তখন। ‘স্কটিশ চার্চ স্কুলের ছাত্র শিখিন তুমি শিগগির বাড়ি ফিরে যাও। তোমার ঠাকুরমা বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’ ঠাকুরমা তখন অবশ্য বেঁচে ছিলেন না। কিন্তু আনাউন্সমেন্ট শুনে শিখিনরা খুব হাসাহাসি করেছিলেন। পরদিন অফিস থেকে ফিরে বাবা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হাঁরে, কাল স্কুলে না গিয়ে তুই কি বইমেলায় গেছিলি? তোর পিসে মেলায় গেছিল। আজ এসে আমায় বলল, মেলায় তোর নামে অ্যানাউন্সমেন্ট শুনেছে। শুনে আমি বললাম, শিখিনের ঠাকুরমা কোত্থেক আসবে? নিশ্চয়ই, তোদের স্কুলে শিখিন বলে অন্য কেউ আছে।’

এখন এইসব মজা পাওয়া সম্ভব না। মেলায় যারা আসে, তাদের প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোন। এখন মেলায় কেউ হারিয়ে যায় না। এফ ব্লকের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শিখিনের মনে পড়ল, রাখীর সঙ্গে লুকিয়ে মেলায় এসে একবার তিনি কী বিপদেই না পড়েছিলেন। রাখী তখন বেথুন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে। হেদুয়া থেকে ট্রামের দুটো আলাদা কামরায় উঠে ওরা এসপ্ল্যানেডে নামেন। রাখীর তখন প্রচণ্ড ভয়, পাড়ার কারোর যেন চোখে না পড়ে। বইমেলার ভিড়ে ঢুকে ওরা দু’জনে খানিকটা স্বস্তি পেয়েছিলেন। হঠাৎ অ্যানাউন্সমেন্ট, ‘বিডন স্ট্রিট থেকে এসেছেন রাখী সরকার। রিসেপশনে আপনার বয়ফ্রেন্ড শিখিন আপনার জন্য বসে আছেন।’ শুনে দু’জনে চমকে উঠেছিলেন সেদিন। বয়ফ্রেন্ড শব্দটা তখন নিষিদ্ধ। হাত ছাড়িয়ে রাখী বলেছিল, ‘নিশ্চয়ই চেনা-জানা কেউ আমাদের দেখে ফেলেছে। চলো, ফিরে যাই।’ কিন্তু কে এই খচরামিটা করেছিল, সেটা খানিক পরেই শিখিন বুঝতে পারেন। রিসেপশনে দাঁড়িয়ে বাণীব্রত আর রেখা। ওরাও দু’জনে লুকিয়ে মেলায় গেছিল। সেদিন চারজনে মিলে খুব আনন্দ করেছিলেন।

এখন বয়ফ্রেন্ড শব্দটা শুনে কোনও মেয়ে লজ্জা পায় না। প্রকাশ্যে প্রেম করতেও আপত্তি নেই বললেই চলে। ভিড়ের মধ্যে চোখ বুলিয়ে শিখিন দেখলেন, ইয়াং ছেলে-মেয়েরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে সেলফি তুলছে। বইমেলায় বাণীব্রত সে বার আগফা ক্লিক ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিল। রেখা আর ওর প্রচুর ছবি তুলে দিয়েছিলেন শিখিন। কিন্তু রাখী কিছুতেই রাজি হয়নি একসঙ্গে ছবি তুলতে। ওর একটা পোট্রেট পরে বাণীব্রত দিয়েছিল। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট সেই ছবিটা বহুদিন পার্সের ভিতর রেখে দিয়েছিলেন শিখিন। চাকরি পাওয়ার পর যখন কলকাতা ছেড়ে মালদায় চলে যাচ্ছেন, তখন ছবিটা তিনি ডাস্টবিনে ফেলে দেন। রাখীর স্মৃতি আর বহন করতে চাননি।

একটা সময় রাখীর প্রতি তাঁর ভালোবাসায় কোনও খাদ ছিল না। গোলদীঘির এক কোণে কামিনী ফুল গাছের তলাটা ওর সান্নিধ্যে স্বর্গ বলে মনে হত। কালীপুজোর রাতে ওই অঘটনটা না ঘটলে, হয়তো রাখীকে নিয়ে এই মেলায় তিনি সানন্দে ঘুরে বেড়াতে পারতেন। তখন আতসবাজি নিয়ে এত কড়াকড়ি ছিল না। বৈঠকখানার বাজার থেকে বাবা সেবার তুবড়ি, রং মশাল, উড়ন চরকি, রকেট বাজি কিনে এনেছিল। সেই রকেট বাজি থেকে মারাত্মক কাণ্ড। রকেট আকাশের দিকে না উড়ে, দিকভ্রষ্ট হয়ে ঢুকে গেছিল রাখীদের দোতলার ঘরে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠতে দেখে শিখিন ভয়ে পাড়া ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে জানতে পারেন, রাখীর অসুস্থ ঠাকুরমা তখন শুয়ে ছিলেন দোতলার সেই ঘরে। পাড়ার লোকজন তাঁকে উদ্ধার করার আগে ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। রাস্তায় তখন অনেকেই বাজি পোড়াচ্ছিল। ফলে পুলিশ আসল দোষীকে খুঁজে পায়নি। কিন্তু শিখিন ধরা পড়ে গেছিলেন রাখীর কাছে। তিনি ভাবতেই পারেননি, রেখাদের বাড়ির দোতলা থেকে রাখী তাঁর বাজি পোড়ানো দেখছিল।

কালীপুজোর সপ্তাহ দুয়েক পর রাখীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল শিখিনের। রেখাই বুদ্ধি করে ওকে ডেকে এনেছিল। কিন্তু রাখী সেদিন খুব বিশ্রী ব্যবহার করে এমনও বলেছিল, ‘তুমি একটা মার্ডারার। আমার ঠাকুরমাকে মেরে ফেলেছ। তোমার সঙ্গে আমি আর কোনও সম্পর্ক রাখতে চাই না।’ শেষ কথাটা বলে দিয়েছিল রাখী। তার পর শিখিন আর যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেননি। হ্যাঁ, বাজি পোড়ানোর সময় তিনি খানিকটা কেয়ারলেস হয়ে গেছিলেন, সেটা ঠিক। কিন্তু মার্ডারার দোষারোপটা খুব কঠিনভাবে বুকে এসে বেঁধেছিল। কোথাও রাখীর মুখোমুখি হলে ‘মার্ডারার’ কথাটা মনে পড়ে যেত। বাবা তখন বেঁচে নেই। মা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হ্যা রে বাচ্চু, রাখী আর আমাদের বাড়িতে আসে না কেন রে?’ সেদিন নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি শিখিন। খুলে সব বলেছিলেন। মা বলেছিল, ‘মন খারাপ করিস না বাবা। যা ঘটে গেছে, সেটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। দেখিস, রাখী নিজের ভুল বুঝতে পারবে। ঠিক তোর কাছে ফিরে আসবে।’

দমকলে চাকরি পাওয়ার আগে রকে আড্ডা মারতেও বেরতেন না শিখিন। হেদুয়ায় যাওয়াও কমিয়ে দেন। ফলে প্র্যাকটিসের অভাবে এশিয়ান গেমসের ট্রায়াল থেকে বাদ পড়ে যান। সেই কয়েকটা বছর খুব মনোকষ্টে ভুগেছেন। ফায়ার সার্ভিসে চাকরি নেওয়ার পিছনেও ছিল রাখীর কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়ার তাগিদ। ওকে একটা জবাব দেওয়ারও ছিল। এমন একটা চাকরি নিলাম, সারা জীবন আগুনের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাব। যাক, সে সব কথা। এখন মনে করার কোনও কারণ নেই।

এফ ব্লকে ঢুকে বিদেশি বইয়ের স্টলগুলো চোখে পড়ল শিখিনের। বিরাট স্টল, কত ধরনের বই র‍্যাকে। পাঠকদের সুবিধার জন্য এমনভাবে সাজিয়ে রাখা, যাতে সবাই মনোমতো বই চট করে হাতের নাগালে পেয়ে যেতে পারেন। ভিড় এড়িয়ে একটা স্টলে ঢোকার মুখে কে যেন পিছন থেকে বলল, ‘কেমন আছ, বাচ্চু? আমাকে চিনতে পারছ না?’

গলাটা অতি পরিচিত। শুনলে একটা সময় বুকের ভিতর ঢেউ খেলে যেত। ছোটবেলার নাম ধরে কে ডাকছে? ঘাড় ঘুরিয়ে রাখীকে দেখে শিখিন চমকে উঠলেন। এই তো ওকে নিয়ে তিনি এতক্ষণ ভাবছিলেন। একেই কি টেলিপ্যাথি বলে? ঈশ্বরের কী ইচ্ছে তা হলে? এই মুহূর্তে তাঁর চোখের সামনে রাখী। পরনে কমলা রঙের তাঁতের শাড়ি, লাল ব্লাউজ। ঈষৎ ঘাড় হেলিয়ে তাকিয়ে। কালো ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে ওর চোখ দুটোকে অসম্ভব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মৃদু হাসির ফাঁকে গজদাঁত। মাই গুডনেস, রাখী একটুও বদলায়নি। কমলা রঙে ওকে একটুকরো আগুনের শিখা বলে মনে হচ্ছে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে তাঁকে গ্রাস করে ফেলতে পারে।

হঠাৎ ওর পাশে উদয় হল ঈশিতা। ও বলে উঠল, ‘কী কোইন্সিডেন্স আঙ্কল! একটু আগেই রাখী মাসি আপনার গল্প করছিল। ময়দানের বইমেলায় গিয়ে আপনারা কী মজা করতেন, সেই গল্প। উফ, আমি ভাবতেও পারিনি, আপনার সঙ্গে এখানে দেখা হয়ে যাবে।’

প্রশ্নটা করে রাখী মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কামনার আগুনটা চট করে নিভিয়ে ফেললেন শিখিন। তার পর খানিকটা শ্লেষ মিশিয়ে উত্তর দিলেন, ‘যাক, মার্ডারারকে তুমি চিনতে পেরেছ তা হলে।’

(উনত্রিশ)

পার্টি অফিসে ঢুকেই রুস্তম দেখল, রিয়াজ, মান্টির সঙ্গে রিসেপশনে বেশ কয়েকটা ছেলে-মেয়ে বসে আছে। অন্যদিন বেলা ন’টার মধ্যে ও চলে আসে। আজ বেলা একটা বাজে। হয়তো এরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে। ওকে দেখেই মান্টি উঠে দাঁড়াল। তখনই রুস্তমের চোখে পড়ল, এককোণে মকবুল বসে। অপরাধী চোখে তাকিয়ে। আসফাক এই মকবুলের উপরই সব দোষ চাপিয়ে ছিল। পাইপ কলোনির কেসটা ও-ই না কি সেদিন ঠিকঠাক হ্যান্ডেল করতে পারেনি। দমকলের লোকের সঙ্গে অহেতুক পাঙ্গা নিতে গিয়ে মকবুল ট্যাংরা থানার ওসিকে চটিয়েছিল। তার পর থেকে ও পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

মান্টিকে ডেকে নিয়ে ও ঘরে ঢুকে গেল। চেয়ারে বসে রুস্তম বলল, ‘তোর সন্দেহই ঠিক। রেন্ডি মাগীটাকে নিয়ে কী করা যায় বল তো?’

মান্টি বলল, ‘উপড়ে ফেলুন রুস্তমদা। শুনলাম, কর্পোরেশনে ইলেকশনে ভাইজানের জায়গায় ক্যান্ডিডেট হওয়ার কথা ভাবছে।’

ঠান্ডা গলায় রুস্তম জিজ্ঞেস করল, ‘কার কাছে শুনলি?’

‘পরেশ লস্করের ছেলেদের মুখে। ভাইজান না কি ওকে কথা দিয়েছিলেন। শুনলাম, ওঁর ওয়ার্ডটা এ বার মেয়েদের জন্য রিজার্ভ থাকবে।’

‘তুই যে সেদিন ওর ঘরে ঢুকেছিলি, টের পায়নি?’

‘সন্ধেবেলায় আমাকে চার্জ করেছিল, ল্যাপটপ চুরি হল কী করে? আমি বললাম, পুলিশের কাছে গিয়ে কমপ্লেন করতে। করেছিল, কি না জানি না।’

‘ডাক্তারটা এখনও আসে? লোকটার সম্পর্কে খোঁজ পেলি কিছু?’

‘লোকটার নাম তুষার দাস। বসিরহাট হসপিটালের ডাক্তার। প্রতি শনিবার রাতে আসে, সোমবার সকালে চলে যায়। রেন্ডিটা বলে অবশ্য ওর দাদা। কিন্তু শনি-রবিবারের সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই বুঝতে পারবেন, কী রকম দাদা। যা করার, তাড়াতাড়ি করুন রুস্তমভাই। মেয়েটাকে বাড়তে দেবেন না।’

শুনে রুস্তম চুপ করে রইল। ঝাউতলার ফ্ল্যাটের দলিলটা ও খুঁজে পেয়েছে। ফ্ল্যাট ভাইজানের মেয়ে রাবেয়ার নামে কেনা। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি মালদহে, হাসবেন্ড ডাক্তার। কিন্তু এখন রাবেয়া উলুবেড়িয়ায় আছে। ওকে দলিলের কথা বললেই কাজ হয়ে যাবে। লোকজন নিয়ে গিয়ে ঘাড় ধরে বের করে দেবে লিলিকে। এ সব কথা মান্টিকে বলার দরকার নেই। লিলির কথা দু’দিন পরে ভাবলেও চলবে। আপাতত, ওর মাথায় ঘুরছে আফজলমিঞার ছেলে ফুয়াদ। বেলা দেড়টা বাজতে চলল, এয়ারপোর্ট থেকে এখনও আসফাক ফেরেনি। শালা বুরবাক, ফুয়াদ প্লেনে উঠতে পারল কি না, সেটা তো অন্তত ফোন করে জানাবে! কোনও গণ্ডগোল করেনি তো? আসফাক আজকাল বড্ড বেশি নার্গিসের পিছনে সময় দিচ্ছে। হয়তো এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ওদের বস্তিতে গেছে। ড্রয়ার থেকে নোটের একটা বান্ডিল বের করে, মান্টির দিকে এগিয়ে দিয়ে রুস্তম বলল, ‘রেন্ডিটাকে চোখে চোখে রাখিস। রোজ ফোনে আমায় জানাবি। এখন তুই আয় তা হলে।’

নোটের বান্ডিলটা পকেটে গুঁজে, সেলাম ঠুকে মান্টি বেরিয়ে গেল। পাশের ঘরে উঁকি মেরে রুস্তম দেখল, ল্যাপটপের সামনে বসে ববি নিজের মনে কাজ করে যাচ্ছে। পার্টি অফিসে এলে ওর উপস্থিতি টেরই পাওয়া যায় না। কম্পিউটারের কী বোর্ডের মৃদু আওয়াজ ছাড়া বোঝা যায় না, ও আছে। লিলি যে কফির কাপে ওষুধ মেশাচ্ছে, এই ফুটেজ মান্টি আর ববি ছাড়া আর কেউ দেখেনি। সম্ভবত, লিলির ল্যাপটপটা নিয়েই এখন বসেছে ববি। একটু পরে ফিরিস্তি দিয়ে যাবে, কী পেয়েছে। আপাতত পাইপ কলোনির কেসটার কী হল জানা দরকার। বেল বাজিয়ে ববিকে ডেকে রুস্তম বলল, ‘বাইরে মকবুল বলে একটা ছেলে বসে আছে, ওকে ভিতর আসতে বল।’

একটু পরে ঢুকে মকবুল বলল, ‘সেলাম আলেইকুম রুস্তমভাই।’

‘আলেইকুম আসসেলাম।’ মনে মনে খচে থাকা সত্ত্বেও রুস্তম ভালোভাবেই জিজ্ঞেস করল, ‘পাইপ কলোনির কন্ডিশন এখন কেমন রে? কর্পোরেশনের লোকজন আবর্জনা সরিয়েছে?’

মকবুল সাহস পেয়ে বলল, ‘কর্পোরেশনের লোকজনকে আমরা ঢুকতেই দিইনি। ওরা আসার আগে দশটা লরি আমরাই ঠিক করে, সব আবর্জনা ধাপায় ফেলে এসেছি। এক রাতেই পুরো জায়গাটা সাফ।’

শুনে প্রসন্ন হল রুস্তম। তবুও প্রশ্ন করল, ‘আগ বাড়িয়ে তোরা এটা করতে গেলি কেন?’

‘ওস্তাদ, এটা না করে আমাদের উপায় ছিল না। ফোরেন্সিকের লোকজন খুব খতরনাক। ঠিক বুঝতে পেরে যেত, কী কারণে আগুনটা লেগেছিল। গতবার গোবরার বস্তিতে আমরা আগুন লাগিয়েছিলাম, মনে আছে। ফোরেন্সিকের লোকজন আমাদের কিন্তু ধরে ফেলেছিল। আমাদের দু’জন এখনও জেল খাটছে। তার পর থেকে আমরা সাবধান হয়ে গেছি।’

‘ফোরেন্সিক’ কথাটা শুনে রুস্তম কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। মকবুল ছেলেটা আসফাকের মতো গাঁড়ল নয়। ওর পেটে মোটামুটি বিদ্যে আছে। আগে বিজনদের পার্টি করত। মাস ছয়েক আগে রুলিং পার্টিতে এসে ভিড়েছে। ওকে এখনও ইনার সার্কেলে ঢোকায়নি রুস্তম। বাজিয়ে নিতে চায়। আগুন লাগানোর পরে রুস্তম পাইপ কলোনিতে গেছিল। লোকজনকে হোটেল তৈরির কথা বলেনি। বুঝিয়েছে, কলোনির জায়গাটা সরকার নিয়ে নিচ্ছে। ওখানে সোয়ারেজ পাম্পিং স্টেশন হবে। এবং সেটা খুব দরকারি। ওর মুখে কথাগুলো শুনে কান্নাকাটি পড়ে গেছিল।

তখন রুস্তম বোঝায়, সরকার প্রত্যেক ফ্যামিলিকে টাকা দেবে। একলাখ থেকে দু’লাখের মধ্যে। তবুও লোকজন মানতে চাইছিল না। শেষে রুস্তম প্রতিশ্রুতি দেয়, ঠিক আছে, কর্পোরেশনের সঙ্গে কথা বলে একেকজনকে তিনলাখ পাইয়ে দেবে। তাতে যদি কেউ রাজি না হয়, তা হলে একটা পয়সাও পাবে না। বাধ্য হয়ে কলোনির লোকরা রাজি হয়ে যায়। বিল্ডার উত্তম গুলাটির লোক টাকার বস্তা নামিয়ে দিয়ে গেছে। সেই টাকা নিয়েও গেছে কলোনির লোকজন। রুস্তম জিজ্ঞেস করল, ‘কলোনির সব লোক বিদেয় হয়েছে? না কি এখনও আছে?’

‘চার-পাঁচজন এখনও ক্লাবঘরে রয়ে গেছে। ওরা আরও বেশি টাকা চাইছে।’

‘হারামিগুলোকে নিয়ে কী করা যায় বল তো?’

‘আমার উপর ছেড়ে দাও ওস্তাদ। আমি ওদের চিনি। আমার পুরনো পার্টির স্যাঙাৎ… নীতিন, রজ্জাক। সব করিমপুর বর্ডারের মাল। বাংলাদেশ থেকে ইয়াবা আনত। আর কলোনিতে বসে সেই ড্রাগ বেচত সোনালি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে আশপাশের সব কমপ্লেক্সের ইয়াং ছেলে-মেয়েদের কাছে। আগুন লাগার রাতে আমার কাছে ওরা মাথা চাপড়াচ্ছিল। প্রায় সাত-আট লাখ টাকার মাল স্টোর করা ছিল একটা ঝুপড়িতে। সব না কি পুড়ে গেছে। বাংলাদেশের এজেন্টরা তো আর ছাড়বে না। ওদের টাকা ফেরত দিতে হবে। সেই টাকাটাই ওরা চাইছে, তোমার কাছে।’

শুনে মনে মনে হাসল রুস্তম। খানকির ছেলে, কার কাছে এসে ঢপ মারছিস? কোন ঝুপড়িতে কত মাল, এই খবরটা আগেই তোর কাছে ছিল। আগুন লাগার পর ড্রাগের পেটিটা তোরাই সরিয়ে দিয়েছিস। মনের কথা অবশ্য মুখে প্রকাশ করল না রুস্তম। সরলভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কী বলিস, টাকাটা দিয়ে দেবো?’

‘প্রশ্নই ওঠে না ওস্তাদ। আজ রাতের মধ্যে বাংলাদেশি এজেন্টদের টাকা দেওয়ার কথা। দিতে না পারলে নীতিনদের কপালে দুঃখ আছে। একটু ওয়েট করো। দেখো, তিন লাখ টাকা নিতে ওরাই এসে তোমার পায়ে পড়ল বলে।’

রুস্তম খুব খুশি হল মকবুলের উত্তরটা শুনে। জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কপালে কী আছে, ভেবেছিস?’

‘ওস্তাদ, সেই কারণেই তো তোমার এখানে বসে আছি। ট্যাংরা থানায় তুমি একবার কথা বলো। পুলিশ দু’বার খুঁজে গেছে গোবরায়। ধরলে ওসি আমায় পেটাবে।’

কী ভেবে রুস্তম বলল, ‘একটা রাত তুই লুকিয়ে থাক। কাল ট্যাংরা থানায় যাবো আমি। ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের জন্য ওসিকে নেমতন্ন করতে। তখন তোর কথা বলে আসব। রিয়াজকে আমি বলে দিচ্ছি। ও থাকে স্টিফেন ম্যানসনের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে। তুই ওর শেল্টারে চলে যা। ওখানে ঢুকে গেলে পুলিশের বাপের সাধ্যি নেই, তোকে খুঁজে বের করে।’

‘আদাব ওস্তাদ।’ বলে মাথা নীচু করে মকবুল বেরিয়ে গেল। এই মুহূর্তে ওকে দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না, ছেলেটা পাক্কা ক্রিমিনাল। তিনটে মার্ডার চার্জ আছে ওর বিরুদ্ধে। আসফাক অনেক কমপ্লেন করছিল মকবুলের বিরুদ্ধে। ও যা-ই বলুক না কেন, এইসব ছেলে পার্টির অ্যাসেট। যেমন খুশি, তেমন ইউজ করা যায়। আল্লাহর কী ইচ্ছে, আগে থেকে জানা যায় না। মকবুলকে স্টিফেন ম্যানসনে পাঠানোর পিছনে উপরওয়ালার অন্য কোনও ইচ্ছে আছে বোধহয়। না হলে এত গোপন ডেরা থাকতে আধচেনা ছেলেটাকে ও স্টিফেন ম্যানসনে পাঠাবে কেন?

রুস্তম যেদিন প্রথম স্টিফেন ম্যানসনে যায়, সেদিন বিরাট ছাদে উঠে ওর একটা আশ্চর্য অনুভূতি হয়েছিল। যেন একটা অভিশপ্ত বাড়ি। ফুটবল খেলা যায়, এমন একটা এল টাইপের ছাদ। খানিকটা তফাতে অনেকগুলো জলের ট্যাঙ্ক। দিনের বেলাতেও রুস্তমের মনে হয়েছিল, ট্যাঙ্কগুলোর ফাঁকে পরতে পরতে বিপদ লুকিয়ে আছে। আসফাকের মুখেই ও শুনেছিল, রাতে না কি অচেনা, অজানা মানুষ ছাদে এসে শুয়ে থাকে! বোমা, পেটো, পিস্তল নিয়ে তখন লড়াইয়ে রুস্তম অভ্যস্ত। ইচ্ছে করলে স্টিফেন ম্যানসনে এমন ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে পারত, লোকজন ওই বাড়িটার ছায়া পর্যন্ত মাড়াত না। কিন্তু ভাইজানের ইন্তেকালের পর পলিটিক্সে ঢুকে নিজেকে ও অনেক বদলাচ্ছে।

ওর মতে, সমাজের সবথেকে বিপদজনক লোকগুলো হল, যারা লেখাপড়া জানে। সামনে এদের সঙ্গে দাঁত কেলিয়ে কথা বলতে হবে। পিছনে আছোলা বাঁশ দেওয়ার কথা ভাবতে হবে। কাউকে বিশ্বাস করার দরকার নেই। এই যেমন, স্টিফেন ম্যানসনের টাইগ্রান বলে বুড়ো সাহেবটা। ওর ফ্ল্যাটটা ফাঁকা করে দিতে হবে। ফ্ল্যাটটা সিলভার হোটেলের মালকিন আনন্দী শরাফের দরকার। ভাইজান দায়িত্বটা ওর উপর দিয়েছিল। আসফাকের বুদ্ধিতে বুড়োর নাতনির সঙ্গে রাস্তায় একদিন খুব খারাপ ব্যবহার করেছিল রুস্তম। পরে বুঝতে পারে, ভুল রাস্তায় গেছিল। তাই বুড়োর সঙ্গে ও ভাল সম্পর্ক রেখে যাচ্ছে। টাইগ্রান রোজ মোকাম্বোতে মাল খেতে যায়। মোকাম্বোর বার-এ ছেলেপেলেদের রুস্তম বলে রেখেছে, বুড়োকে খাতির করবি। যেন রেস্টুরেন্টে এসে বুড়ো তোদের ধন্য করে দিয়েছে। নিজেও রুস্তম মাঝে মধ্যে সাহেবের টেবলে বসে। পটানোর চেষ্টা করে। মাদারচোত সাহেবটা এক নম্বরের তিড়কমবাজ। একবার বলে, ফ্ল্যাটটা ওর নামে। অন্যবার বলে, কে মালিক, নিজেই জানে না।

মুশকিল হচ্ছে, আনন্দী ম্যাডাম পিছু ছাড়ছেন না। দু’একদিন অন্তর তাগাদা মারেন, কতদূর এগলো? রুস্তম আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। ফ্ল্যাটের আসল মালিক কে, তা জেনে আসার জন্য ও একবার ববিকে কর্পোরেশনে পাঠিয়েছিল। ফিরে এসে ববি যা বলল, তার অনেকটাই রুস্তমের মাথায় ঢোকেনি। ফ্ল্যাটের মালিক বলে কারও নাম রেকর্ড করা নেই। একজন বিদেশি শেয়ার হোল্ডারের নাম এরিক গ্রেগারিয়ান। আর্মেনিয়া থেকে সে ট্যাক্সের টাকা পাঠিয়ে দেয়। তার মানে, টাইগ্রান বলে বুড়োটার আত্মীয় হবে। রণজিত বলে একজন উকিল আছে ওদের পার্টিতে। রুস্তম তাকে জিজ্ঞেস করেছিল। সে বলেছে, লিগ্যাল ব্যাপার জেনে তোর লাভ নেই। তুই আকাট মূর্খ, বুঝবিও না। বাড়িটার মালিক এখন গভর্নমেন্ট। একটা কোম্পানিকে লিজ দেওয়া আছে। ওই বাড়িটা থেকে কাউকে উচ্ছেদ করতে গেলে, তোর মতো করে তুই এগো।’ মানে সেই বোমা-পেটো-পিস্তল। কোথায় যেন খটকা লাগছে রুস্তমের। ওর মন বলছে, একটু ওয়েট করা যাক।

ঘরে বসানো সিসিটিভির মনিটরে রুস্তম মাঝে মাঝে চোখ রাখে। হঠাৎ দেখল, একটা অটো এসে দাঁড়াল গেটের সামনে। সেখান থেকে নেমে আসছে মার্থা অ্যান্টি। দিনের বেলায় আন্টি কখনও পার্টি অফিসে আসে না। আন্টির পোশাক দেখে মনে হচ্ছে, হয়তো কাছাকাছি কারও বাড়িতে কোনও পার্টিতে গেছিল। মনে হয়, ববি এখানে আসতে বলে দিয়েছে। একসঙ্গে বাড়ি ফিরবে। ঘরে পা দেওয়ার পর আন্টির মুখ খুশিতে উজ্জ্বল। মনোযোগ দিয়ে আন্টিকে কখনও লক্ষ করেনি রুস্তম। হঠাৎই ওর মনে হল, একটা সময় আন্টি সত্যিই সুন্দরী ছিল।

চেয়ারে বসে আন্টি বলল, ‘মিরাক্যাল হ্যাপেনড বয়। স্টিফেন ম্যানসন ছেড়ে দিয়ে টাইগ্রান আমার কাছে ফিরে এসেছে!’

শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না রুস্তম। কার কথা বলছে আন্টি? স্টিফেন ম্যানসনের বুড়ো সাহেবটার কথা না কি? যাকে আন্টি জেল খাটিয়ে ছিল নির্যাতনের অভিযোগে! তাও বছর কুড়ি আগে। অ্যাদ্দিন পর হঠাৎ কী এমন ঘটল, সাহেব স্টিফেন ম্যানসনের ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এল? নাতনিটা কী এমন প্যাঁচ কষল, রুস্তম বুঝতে পারল না। প্রথম প্রেমে পড়া মেয়েদের মতো মনে হচ্ছে মার্থা আন্টিকে। গলগল করে বলেই যাচ্ছে, ‘কাল রাতে দেখি, টাইগ্রান আমার ফ্ল্যাটে এসে হাজির। হাঁটু গেড়ে বসে বলল, উইল ইউ ফরগিভ মি মার্থা? উইল ইউ ম্যারি মি? হি ইজ সাচ আ গাই, আই ফরগট এভরিথিং। টাইগ্রানকে ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। নাউ আই অ্যাম টেরিবলি হ্যাপি রুস্টম। গড ইজ দেয়ার। লাস্ট অফ অল, ববি গট হিজ ওন ড্যাড। কেন, এমন একটা গুড নিউজ ববি তোমাকে দেয়নি?’

বলছে কী আন্টি? বুড়ো সাহেবটা ববির বাবা! এত বড় খবর অ্যাদ্দিন ওকে কেউ দেয়নি? রুস্তম হাঁ করে আন্টির দিকে তাকিয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *