স্টিফেন ম্যানসন – ২০

(কুড়ি)

বিপদ কখনও একা আসে না। কথাটা প্রায়ই মা মনে করিয়ে দিত। কোয়েল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, সেটা কতটা সত্যি। গৌড়ীয় মঠে মায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তি করে বাড়িতে ফিরে আসার পর মায়ের খাটের দিকে তাকিয়ে ওর বুকটা হু হু করে উঠল। মাকে যেদিন নার্সিং হোমে নিয়ে গেল সেদিন কি ও ভাবতে পেরেছিল, মা আর কোনওদিন ফিরে আসবে না? ভাগ্যিস তমাল পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেই কারণে দাহ কাজটা করতে পেরেছে। তিনদিনের মাথায় গৌড়ীয় মঠে শ্রাদ্ধের ব্যবস্থাটাও দেবদা করে দিল। কোয়েল ভাবতেই পারছে না, এই বয়সে একা কী করে জীবন কাটাবে?

মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে দিদি-জামাইবাবু কেউ আসেনি। পাছে খরচা করতে হয়, সেই কথা ভেবে। তবুও, শ্রাদ্ধের আগে কোয়েল দিদিকে একবার ফোন করেছিল, একসঙ্গে অনুষ্ঠানটা করতে রাজি কি না? দিদিকে ফোনে পায়নি। জামাইবাবু ফোন ধরে বলেছে, ‘আমরা রামঠাকুরের আশ্রমে শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করেছি। তুমি আলাদাভাবে করো।’

ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে জামাইবাবু আরও বলল, ‘কথাটা এখন বলছি বলে, কিছু মনে কোরো না কোয়েল। মায়ের বাড়ির একটা ভাগ তোমার দিদির প্রাপ্য। কবে ভাগাভাগি করতে চাও আমাকে বোলো। জানোই তো আমার ভাড়া বাড়িতে থাকি। ভাগের টাকাটা পেলে আমাদের খুব সুবিধে হয়।’

পৈতৃক বাড়ির মায়ের অংশটা বিক্রি করার কথা কোয়েল ভাবতেও পারছে না। মল্লিকবাজারের একেবারে রাস্তার উপর ওদের ঘর। প্রায় তিনহাজার স্কোয়ার ফুটের তো হবেই। তবে জিনিসপত্রে এমন ঠাসা যে, বোঝা যায় না। মা-বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ভিটেতে। ছোটবেলা থেকে এই বাড়িতে ও মানুষ হয়েছে। বাবার ডেডবডিটা যখন ঘর থেকে বেরোয়, তখন ও সবে কলেজে ঢুকেছে। তার পর অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা সামলেছে মা। আত্মীয়স্বজনরা কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। কোয়েলের পড়াশুনোও আর এগোয়নি। মাসকয়েক পর থেকেই ওকে রোজগারের জন্য পথে নামতে হয়েছিল। দেবদাই নিজে উদ্যোগ নিয়ে যোগা শেখানোর চাকরিটা ওকে পাইয়ে দিয়েছিল। পেট চালানোর অসুবিধে হয়তো এখন ওর হবে না। কিন্তু আগামী জীবনের কথা ও ভাবতে পারছে না। সামনে সব অন্ধকার।

মায়ের একটা ছবি বাঁধিয়ে এনে দিয়েছে তমাল। শ্রাদ্ধের সময় ফুলের মালা দিয়ে সাজিয়ে রেখেছিল। সেটা দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতে হবে। কোন দেওয়ালে রাখবে, ছবি হাতে নিয়ে সেটা ভাবার সময় দেবদার ফোন এল। ও প্রান্ত থেকে দেবদা প্রশ্ন করল, ‘তমাল তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ। একটু আগে হোটেলে ফিরে গেল।’

‘সঙ্গে টাকাকড়ি কিছু আছে?’

‘আপাতত দরকার নেই দেবদা।’

‘মিসেস ভাল্লার বাড়িতে কবে থেকে যেতে পারবি?’

‘ভাবছি, কাল থেকে যাবো। কেন দেবদা?’

‘উনি জিম-এ ফোন করেছিলেন। আমাকে বলে গেলেন, যে ক’দিন তুই অ্যাবসেন্ট হয়েছিস, সেই ক’দিনের মাইনে কেটে নেবেন।’

শুনে একটু রাগই হল কোয়েলের। ভদ্রমহিলার অগাধ টাকা। ওঁর ফ্ল্যাটে ঢুকলেই সেটা বোঝা যায়। কিন্তু মানুষকে মানুষ বলেই মনে করেন না। ফিজিওথেরাপি করাতে গিয়ে কোয়েল দেখেছে, বুটিকের কর্মীদের সঙ্গে উনি কী রকম দুর্ব্যবহার করেন। বিরক্তির সঙ্গেই কোয়েল বলল, ‘দেবদা, ওঁর বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আপনি বিদিশাকে ফিট করে দিন।’

‘কেন? মিসেস ভাল্লা কি তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন? জানিসই তো, মহিলা কেমন?’

‘না, সেজন্য নয়।’ কোয়েল খোলাখুলি বলে দিল, ‘মিসেস ভাল্লার হাজবেন্ড ভালো লোক নন।’

ও প্রান্তে কয়েক সেকেন্ড দেবদা চুপ করে থেকে বলল, ‘দেখি, কী করা যায়। আপাতত, এই মাসটা তুই চালিয়ে দে। মাইনে কেটে নিলেও, তুই কিছু বলবি না। পরে কোনও একটা অজুহাত দিয়ে কেটে পড়িস। আর শোন, আনন্দী ম্যাডাম তোর খোঁজ করছিলেন। কাল কি তুই আসতে পারবি?’

মাঝে চারদিন কামাই হয়ে গেছে। কামাই করা ম্যাডাম একদম পছন্দ করেন না। উনি ডাকা মানে, অশনি সংকেত। কোয়েল বলল, ‘কাল সকালের ডিউটিতে যাব। জিম-এ গেলে ভালো থাকব। ফাঁকা ঘরে মায়ের কথা যখন মনে পড়ছে, তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।’

‘প্রথম প্রথম এ রকম মনে হবে। পরে দেখবি, মাসিমা না থাকলেও, ওঁর আশীর্বাদ সব সময় তোর সঙ্গে থাকবে। তুই সেল্ফ মেড মেয়ে। তোর কনফিডেন্স লেভেল অনেক মেয়ের তুলনায় বেশি। অন্তত আমার চোখে পড়েনি বললেই চলে। তা ছাড়া, নিজেকে কখনও একা ভাববি না। আমি, তমাল, আমাদের জিম-এর সবাই তোর সঙ্গে আছি। ভগবানের উপর আস্থা রাখ কোয়েল। দেখবি, উনি যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন। যাক গে, আমি এখন ছাড়ছি। কাল জিম-এ এসে প্রথমে সিলভার হোটেলে গিয়ে ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করিস, কেমন?’

মাও ঠিক একই কথা বলত। ঈশ্বর যা করেন, তা মানুষের ভালোর জন্যই। কিন্তু ওর কী ভালো হবে, ভেবে উঠতে পারছে না কোয়েল। ‘ঠিক আছে।’ বলে ও ফোনের লাইন কেটে দিল।

সারাটা দিন ওর শরীরের উপর দিয়ে মারাত্মক ধকল গেছে। সেই দুপুরে শ্রাদ্ধের পর তমাল ওর দিকে একগ্লাস ঠান্ডা সরবত এগিয়ে দিয়েছিল। তার পর কয়েকটা ফলের টুকরো আর সন্দেশ ছাড়া ওর পেটে আর কিছু পড়েনি। সন্দেশের বাক্সটা নিয়ে এসেছিল জিম-এর অবন্তিকা। ও গৌড়ীয় মঠে যাবে, কোয়েল ভাবতেও পারেনি। শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের পর ফিরে যাওয়ার সময় মেয়েটা বলে গেল, ‘কোয়েলদি, আমার মা তোমাকে একবার ডেকেছে। পারলে এসো।’ সন্দেশের সেই বাক্সটা এখন টেবলের উপর পড়ে রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে কোয়েল ঠিক করে নিল, দুধ-পাউরুটি আর সন্দেশ খেয়ে রাতটা কাটিয়ে দেবে। কাল থেকে ওর জীবনে অন্য রুটিন শুরু। জিম-এর চাকরি, আর যোগার টিউশনির মাঝে কী করে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করবে, সেটা ওকে ভাবতে হবে।

চোখ-মুখে জলের ঝাপটা দেওয়ার জন্য ঘরের বাইরে বেরিয়ে কোয়েল জেঠিমার মুখোমুখি হয়ে গেল। একবাড়ি ভর্তি ওদের জ্ঞাতি। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ। সেই কারণে কথা বলাবলিও নেই। একমাত্র এই জেঠিমা উপযাচক হয়ে কখনও কখনও কথা বলে ওর সঙ্গে। মাকে দাহ করে ফেরার পর জেঠিমা ঘরে এসে একবার বলেছিল, ‘ডেডবডি বাড়িতে নিয়ে এলি না কেন মা? একবার শেষ দেখা দেখতে পেতুম।’ কোয়েল বলেছিল, ‘মা বারণ করে গেছিল।’ শুনে জেঠিমা আর দাঁড়ায়নি। গত তিনদিন বাড়ির কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। আশাও করেনি কোয়েল।

বারান্দায় দেখা হওয়ার পর জেঠিমা জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে, যে ছেলেটা কয়েকদিন ধরে তোর ঘরে আসা-যাওয়া করছে, সে কে রে?’

জেঠিমা তমালের কথা জিজ্ঞেস করছে। এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে কোয়েল বলল, ‘ওর নাম তমাল। আমাদের সঙ্গে জিম-এ চাকরি করে। কেন বলো তো?’

‘না, ইয়ং ছেলে তো, তাই বলছি। তুই একা থাকবি। তোর বাড়িতে জোয়ান ছেলেরা যাতায়াত করলে পাঁচজনে পাঁচ রকম কথা বলবে। বাড়িতে আরও দু’তিনটে ইয়ং মেয়ে আছে কিন্তু।’

কথাগুলো শুনে সতর্ক হয়ে গেল কোয়েল। মেয়েদের একা থাকার অনেক যন্ত্রণা। বদনাম রটিয়ে দেওয়া হবে। ও স্পষ্ট বুঝতে পারল, নতুন একটা যুদ্ধে ওকে নামতে হবে। শুরুতেই জেঠিমাদের থামিয়ে দেওয়া দরকার। গলায় ঝাঁঝ এনে ও বলল, ‘ভয় নেই জেঠিমা। তমাল রাত্তিরে থাকবে না।’ কথাটা বলেই উত্তরে অপেক্ষায় না থেকে ও কলঘরে গিয়ে ঢুকল।

এ বাড়িতে বারোয়ারি কলঘরে ওদের ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। ঝগড়াঝাঁটির পর মা উঠোনের এক পাশে একটা জায়গা ঘিরে, জলের লাইন টেনে নিয়েছিল। পরে রহমত চাচা লোকাল কাউন্সিলার আবিদভাইকে বলে একটা পাকা পায়খানা তৈরি করে দেয়। কলঘরে একটাই অসুবিধে, টাকার অভাবের জন্য মা তখন ছাদটা করে যেতে পারেনি। পাশের বাড়ির ছাদে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে ওদের কলঘর দেখতে পায়। মা কম দামের একটা প্লাস্টিকের চাদর টাঙিয়ে দিয়েছিল। ঝড়-জলে সেটার অবস্থা সঙ্গীন। প্লাস্টিকের চাদর আর রিপ্লেস করা হয়নি। অন্যদিন স্নান করতে ঢুকে কোয়েল আগে ছাদের দিকে তাকিয়ে নেয়। জরিপ করে নেয়, কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না। কিন্তু আজ বাড়িতে ফেরার পর থেকেই শরীরের ভেতরটা অস্থির অস্থির করছে। জেঠিমার কথাগুলো শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিল। চৌবাচ্চা থেকে মাথায় জল দেওয়ার ফাঁকে ও বিড়বিড় করে বলল, ‘মাকে তোমরা অনেক কষ্ট দিয়েছ জেঠিমা। আমি কিন্তু সহ্য করব না।’

মগ দিয়ে জল ঢেলে যাওয়ার সময় হঠাৎ ওর চোখ পড়ল ছাদের দিকে। কার্নিসের ফাঁকে একটা আবছা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। কোয়েল জানে, সে কে? পাশের বাড়ির মিত্তির জেঠু। কী করে টের পায়, কোয়েলের ধারণা নেই। ওরা কেউ কলঘরের আলো জ্বালালেই বয়স্ক মানুষটা ছাদে উঠে আসে। রাস্তাঘাটে কোথাও দেখা হলে মানুষটা এমনভাবে তাকায়, যেন ওর শরীরটা গিলে খাচ্ছে। মা দু’একবার জেঠুকে ধমকে ছিল। পরে হাল ছেড়ে দেয়। মা এখন নেই, কামুক জেঠুর অত্যাচার নিশ্চয়ই বাড়বে। কলঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে কোয়েল ভেবে নিল, বেশি বাড়াবাড়ি করলে ও রহমত চাচার কাছে গিয়ে কমপ্লেন করবে। চাচা খুব ভাল লোক। এ পাড়ার গার্জেনের মতো।

স্নান সেরে ঘরে ফিরে নাইটি পরার সময় কোয়েল আবার ফোনের রিং টোন শুনল। রাত আটটায়… এই সময় তমাল ছাড়া আর কেউ ফোন করবে না। চট করে ফোনটা ধরল না ও। মায়ের অসুস্থতার সময় রোজই ও নার্সিং হোমে এসেছে। মাকে সাহস দিয়ে গেছে। ওর চোখের ভাষা পড়তে কোয়েলের অসুবিধে হয়নি। মা কী বুঝেছিল কে জানে? ওর সামনেই একদিন তমালকে বলে ফেলেছিল, ‘আমি না থাকলে, মেয়েটাকে তুমি দেখো বাবা।’ তমালটাও একনম্বর ফাজিল। মাকে উত্তর দিয়েছিল, ‘আপনি আশীর্বাদ করুন, কোয়েল যেন সারাজীবন আমাকে দেখে।’

হোটেলের কাজে ফাঁকি দিয়ে তমাল নার্সিং হোমে আসত। ভিজিটিং আওয়ার্স-এর পর খানিকটা সময় ওর সঙ্গে কাটানোর জন্য। একদিন বলেই ফেলল, ‘চাকরিটা যদি আমার চলে যায়, পরোয়া করব না। ইন ফিউচার, একটা ইউনিক রেস্টুরেন্ট খুলব। একদিকে হজমশক্তি বাড়ানোর জন্য তুমি যোগা শেখাবে, অন্য দিকে মানুষকে চর্বচোষ্য খাওয়ানোর ব্যবস্থা আমি করব। কী ইনোভেটিভ আইডিয়া বলো তো? পৃথিবীর কোথাও এই রকম রেস্টুরেন্ট নেই।’ সত্যি কথা বলতে কী, তমালের সঙ্গ ইদানীং ওরও ভাল লাগতে শুরু করেছে।

দেবদা একদিন নিজে থেকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হ্যাঁরে, আমার রুমমেটকে তোর কেমন লাগে রে কোয়েল?’ ও এককথায় উত্তর দিয়েছিল, ‘ভাল মানুষ’।

ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে কোয়েল পর্দার দিকে তাকিয়ে দেখল, তমাল নয়, দিদি। সঙ্গে সঙ্গে ওর ভ্রু কুঁচকে উঠল। মতলব ছাড়া দিদি কখনও ফোন করে না। ও প্রান্ত থেকে দিদি খিঁচিয়ে উঠল, ‘এতবার ফোন করে যাচ্ছি, তুই কি ঠিক করেছিলি তুলবি না?’

ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই কোয়েলের। মাথা ঠান্ডা রেখে ও বলল, ‘আমি খুব ব্যস্ত। তোমার ফালতু কথা শোনার মতো সময় আমার নেই। যা বলার, তাড়াতাড়ি বলো।’

দিদি গলা চড়িয়ে বলল, ‘তোর জামাইবাবু সম্পত্তি ভাগাভাগির কথা বলেছিল। তোর কি মনে আছে? কবে করতে চাস, বল। সুশান্ত একটা পার্টি পেয়ে গেছে। ঘর দুটোর জন্য পঞ্চাশ লাখ টাকা দেবে বলছে। তুই আর আমি পঁচিশ-পঁচিশ করে পেয়ে যাবো। রাজি আছিস?’

জামাইবাবুর নাম সুশান্ত। অত টাকা হাতে পেলে মদ খেয়ে আর জুয়ো খেলে উড়িয়ে দেবে। কোয়েল সেটা হতে দেবে না। ওর মনে যা এল, বলে গেল, ‘মাত্তর পঞ্চাশ লাখ! রহমতচাচা বলছিল, ওনার হতে একটা পার্টি আছে। পঁচাত্তর লাখ টাকা দেবে। পাঁচ লাখ টাকা রহমত চাচা নেবে। ভেবে রেখেছি, তিরিশ লাখ তুই, বাকি চল্লিশ লাখ আমি। রাজি থাকলে আমায় বলিস।’ কথাগুলো বলার সময় তমালের নামটা প্রথমে ওর মনে এসেছিল। কিন্তু মুখ দিয়ে রহমতচাচার নামটা বেরিয়ে গেল। ও জানে, সুশান্ত জামাইবাবু কোনওদিনই সাহস পাবে না রহমতচাচার কাছে গিয়ে ভেরিফাই করতে। কেননা, দিদিকে বিয়ে করার কিছুদিন পর, মাল খেয়ে জামাইবাবু একদিন মায়ের কাছে টাকা চাইতে এসেছিল। খুব চেল্লামেল্লি করেছিল। তখন রহমতচাচা এসে ঘাড় ধরে বের করে দেয়। চাচা এমনও হুমকি দিয়েছিল, এরপর কোনওদিন বাওয়াল করতে এলে পুঁতে দেবে।

ও প্রান্তে দিদি চিৎকার করে বলল, ‘আমি তিরিশ লাখ কেন?

শুনে মনে মনে হাসল কোয়েল। মুখ দিয়ে যা বেরিয়ে আসছে, বলে যাচ্ছে, ‘মায়ের ট্রিটমেন্ট করতে গিয়ে আমার বিশ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। পুরো টাকাটা আমি দেবো কেন? তোকেও দশ লাখ দিতে হবে। সেই কারণে তুই ঘর বিক্রির টাকা থেকে দশ লাখ কম পাবি।’

ওষুধটা কাজে লেগে গেছে। ও প্রান্ত থেকে দিদি আমতা আমতা করে বলল, ‘আমার সঙ্গে মাজাগি করিস না কোয়েল। ধর, সুশান্ত তোর সঙ্গে কথা বলবে।’

‘তুই ছাড়া আমি আর কারও সঙ্গে কথা বলব না দিদি প্লিজ। একটা মাতালের সঙ্গে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধবে। তোর আর কিছু বলার থাকলে, বলতে পারিস।’

‘মায়ের গয়না-গাঁটি আর যা কিছু আছে, আধাআধি হবে।’

‘ভেরি গুড। গয়না বন্ধক আছে জজসাহেবের বউয়ের কাছে। সুদে আসলে উনি প্রায় লাখ টাকার মতো পাবেন। তুই যদি ছাড়িয়ে আনতে চাস, তা হলে পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্যাশ নিয়ে চলে আসিস। না হলে বাড়ি বিক্রি পর্যন্ত তোকে ওয়েট করতে হবে। আলমারিতে মায়ের যা শাড়ি-টাড়ি আছে, তুই এসে নিয়ে যেতে পারিস। ওগুলো আধাআধি করে নেবো।’

জজসাহেব মানে রমেশ মিত্র। পাড়াই পুরনো বাসিন্দা। একসময় আলিপুরে কোর্টের জজ ছিলেন। দিদিরা তাঁর বাড়িতে ঢোকার সাহসই পাবে না। ফোনটা ছেড়ে দেওয়ার তাগিদে কোয়েল বানিয়ে বলল, ‘শোন দিদি, তোর বোধহয় জানা নেই, আমাদের অংশটা বিক্রি করতে গেলে আগে আমাদের জ্ঞাতিদের পার্মিশন নিতে হবে। ওদেরই আগে অফার দিতে হবে। যদি কেউ নিতে না চায়, তা হলে বাইরের লোকের কাছে বিক্রি করা যাবে। দেখি, জেঠিমাদের সঙ্গে কথা বলে। জেঠিমারা তো এখন প্রায়ই আসছে আমাদের ঘরে।’

দিদি বলল, ‘মায়ের আলমারি আমি না যাওয়া পর্যন্ত তুই খুলবি না। কোনও কিছু যেন সরিয়ে ফেলিস না। জানতে পারলে তোকে আমি ছিড়ে খাবো।’

কথাটা দিদি বলল বটে, কিন্তু কোয়েল বুঝতে পারল, গলার স্বরে তেমন জোর নেই। দিদি কেমন যেন ভড়কে গেছে। মনে মনে তমালকে ধন্যবাদ জানাল ও। কথা বলার টেকনিক ও শিখেছে, তমালের কাছে। ঝগড়া না করেও মানুষকে কীভাবে দমিয়ে দেওয়া যায়। ও বলল, ‘আলমারির চাবি মা কোথায় রেখে গেছে খুঁজে পাচ্ছি না রে। গোদরেজ কোম্পানির কোনও লোককে তুই সঙ্গে নিয়ে আসিস। তার সামনেই না হয়, আলমারিটা খুলব। লোকটাকে আনার জন্য যা খরচ হবে, আধাআধি করে নেবো। আর শোন, যবে তুই আসবি, তার অন্তত একদিন আগে জানিয়ে দিস দিদি।’ কথাগুলো বলেই কোয়েল লাইনটা কেটে দিল।

খানিকক্ষণ পরে ফোনটা ফেরে বেজে উঠল। মোবাইলের পর্দায় ও তমালের নাম দেখল। সোয়াইপ করতেই ও দিক থেকে তমাল বলল, ‘কী করছিলে?’

কোয়েল সত্যি কথাটা বলল, ‘বসে তোমার কথাই ভাবছিলাম।’

(একুশ)

অ্যানার আমন্ত্রণে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য টেম্পলে এসেছে মিলেনা। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার। বেঙ্গলিদের মধ্যে না কি রেওয়াজ আছে, হিন্দু ম্যারেজের পর হাসবেন্ড-ওয়াইফকে টেম্পলে আসতে হয়। সেখানে কিছু রিচুয়ালস থাকে। সেটা দেখানোর জন্যই অ্যানা ফোনে বলেছিল, ‘প্লিজ মিলেনা। ইউ মাস্ট কাম। নিজের চোখে দেখে নাও। ভবিষ্যতে তোমাকেও হয়তো একই রিচুয়ালস ফলো করতে হবে।’

দার্জিলিংয়ে থাকার সময় ড্যাডির সঙ্গে মিলেনা দু’চারবার বেঙ্গলি ফ্যামিলির বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে গেছে। তখন ওইসব রিচুয়ালস খুঁটিয়ে দেখা বা বোঝার মতো বয়স ওর হয়নি। গিফট নিয়ে গেছে, ডিনার করেছে। ড্যাডির সঙ্গে চলে এসেছে। মিলেনা হালকাভাবেই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘দেবদূতকেও সঙ্গে নেবো না কি?’

‘অফকোর্স, তা হলে তো খুব ভাল হয়। অনিলকে ওর কথা বলেছিলাম। ওর সঙ্গে অনিল আলাপ করতে চায়। প্লিজ, আমার হয়ে তুমি দেবদূতকে রিকোয়েস্ট কোরো। না হলে আমাকে ওর ফোন নাম্বারটা দাও। আমি ওকে ইনভাইট করব।’

মিলেনা বলেছিল, ‘দরকার হবে না। দেখি, দেবদূত সময় করে উঠতে পারে কি না। ও এখন কম্পিটিশনের জন্য সিরিয়াসলি তৈরি হচ্ছে। ওর শিডিউল আমার জানা নেই।’ শান্তা আন্টির পার্টিতে দেবদূত সেদিন আসতে পারেনি। আজ টেম্পলে এলে খানিকক্ষণ ওর সান্নিধ্য পাওয়া যাবে।

অ্যানা বেলা ন’টার সময় টেম্পলে আসতে বলেছিল। কিন্তু দেবদূত বলেছে, অত সকালে জিম থেকে বেরোতে পারবে না। দশটা-সাড়ে দশটার সময় আসার চেষ্টা করবে। তাতে অবশ্য কোনও অসুবিধে নেই। টেম্পলে রিচুয়ালস শেষ হতে বেলা বারোটার মতো হয়ে যাবে। তাই মিলেনা ড্রাইভারকে নিয়ে একাই চলে এসেছে। নিয়োগী আন্টি ওকে রানি কালার শিফনের শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। নিজের হাতে হেয়ার স্টাইল করে দিয়েছেন। ওকে না কি দেখতে এলিট সোসাইটির বেঙ্গলি মেয়েদের মতো লাগছে। লিফট দিয়ে নীচে নামার সময় ও লক্ষ্য করেছে, বিল্ডিংয়ের প্রতিবেশীরাই ওকে অবাক চোখে দেখছে। পোশাক একটা মানুষের পার্সোনালিটি কতটা বদলে দেয়। এখন দেবদূত কী বলবে, কে জানে?

অ্যানা যেদিন ওর বিয়ের কথা বলতে স্টিফেন ম্যানসনে যায়, সেদিনই দেবদূতের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা খুলে বলেছিল মিলেনা। শুনে লাফিয়ে উঠেছিল অ্যানা। বলেছিল, ‘ডোন্ট হেজিটেট মিলেনা। আজকের পৃথিবীটা একেবারে অন্যরকম। রিলিজিয়ন ইজ ইম্মেটিরিয়াল। তুমি শুধু জাজ করার চেষ্টা করো, তোমার সঙ্গে এই ছেলেটা জেল করবে কি না।’

মিলেনা বলেছিল, ‘আমার সঙ্গে দেবদূতের আলাপ মাত্র কয়েক মাসের। এই অল্প সময়ের মধ্যে কি বোঝা সম্ভব, জেল করবে কি না? ডিফারেন্ট কালচার…’

‘কাম অন মিলেনা।’ অ্যানা বাধা দিয়ে বলেছিল, ‘একটা এডুকেটেড মেয়ে হয়ে এসব তুমি কী বলছ? হ্যাঁ, অনিলকে বিয়ে করার ডিসিশনটা নেওয়ার আগে আমার মনেও খানিকটা দ্বিধা ছিল। পরে ভাবলাম, আমিই বা কতটা খাঁটি আর্মেনিয়ান? সেন্ট্রাল ক্যালকাটার তালতলায় বেঙ্গলি এনভায়রনমেন্টে আমি বড় হয়েছি। স্কুল, কলেজেও মিশেছি বেঙ্গলিদের সঙ্গে। ওদের কালচার সম্পর্কে আমার খানিকটা আইডিয়া হয়েই আছে। তুমিও ভেবে দেখো না, তুমি কতটা আর্মেনিয়ান। তোমার জন্মও দার্জিলিংয়ে। জীবনে কখনও তুমি আর্মেনিয়ায় যাওনি। আমার সঙ্গে তোমার কোনও তফাত নেই। এনিওয়ে, সিলেকশনে কিন্তু আমার ভুল হয়নি। ডার্লিং। অনিল খুব ভাল ছেলে। হি উড মেক মি হ্যাপি।’

সেদিন মিলেনা খোলাখুলিই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘অনিলের মধ্যে তুমি কী এমন দেখলে অ্যানা?’

‘ও খুব লিবারাল। মেয়েদের ভীষণ সম্মান দেয়। যেটা আর্মেনিয়ান সোসাইটিতে দুর্লভ। আর্মেনিয়ান ফ্যামিলি সম্পর্কে মাম্মিদের মুখে যা শুনেছি, তাতে মেয়েদের মানুষ বলেই মনে করা হয় না। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলেও তোমাকে মুখ বুঁজে থাকতে হবে। তুমি ডিভোর্স পাবে না। দেশের আইন পার্মিশন দেয় না। বিয়ের পর পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। তোমার স্বামী অক্ষম হলেও তুমি কারও সঙ্গে ফিজিক্যাল রিলেশন করতে পারবে না। একে কি বেঁচে থাকা বলে? যাক গে, তুমি দেবদূতের সঙ্গে আমার একদিন পরিচয় করিয়ে দিও। কথা বললে, ওর সম্পর্কে একটা ফ্রাঙ্ক ওপিনিয়ন দিতে পারব।’

অ্যানার হিন্দু ম্যারেজ ডে-তে মিলেনা প্রথমবার শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য টেম্পলে এসেছিল। বিয়ের আয়োজন দেখে ওর চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল। ক্রিশ্চান ম্যারেজে সবকিছু হোয়াইট। অনুষ্ঠানটাও মাত্র কয়েক মিনিটের। কিন্তু হিন্দু ম্যারেজ-এর গ্ল্যামারই আলাদা। মাই গুডনেস, ব্রাইডাল ড্রেসে ও প্রথমে অ্যানাকে চিনতেই পারেনি। পরনে রয়্যাল রেড কালারের লেহেঙ্গা। সর্বাঙ্গে গোল্ড অর্নামেন্টস। অসাধারণ হেয়ারস্টাইল। কপালে বিন্দি, পুরো মুখ সাদা ডট দিয়ে সাজানো। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী লাগছিল ওকে। কী অদ্ভুত সব রিচুয়ালস। একটা কাঠের পাটাতনে বসে থাকা অবস্থায় অ্যানাকে দু’জন নিয়ে এসেছিল ওয়েডিং পোডিয়ামে। পান পাতা দিয়ে ও তখন মুখ ঢেকে রেখেছিল। পোডিয়ামের মাঝে আগুন জ্বলছিল। তার চারপাশে অ্যানা আর অনিল দু’জনে সাত পাক দিল। হিন্দু ম্যারেজটা না কি হয় ফায়ার গডকে উইটনেস রেখে।

বিয়ের প্রচুর ছবি তুলে রেখেছিল মিলেনা। এ ক’দিন সময় পেলেই সেইসব ছবি মনোযোগ দিয়ে ও দেখেছে। অ্যানার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে কখনও কখনও রোমাঞ্চিত হয়েছে। ও ভেবেই রেখেছে, ব্রাইডের বেশে অ্যানার একটা ছবি এঁকে দেবে। ছবিটা বিয়ের পরদিনই আঁকতে বসেছিল। কিন্তু তখন দেখে, কয়েকটা রং ফুরিয়ে গেছে। বিশেষ করে, রেড কালারটা। রেড ইউজ না করলে ব্রাইডের মুখটাই ফোটানো যাবে না। ওরই গাফিলতি বলা যায়। ওদের বিল্ডিংয়ের নীচেই একটা ছোট আর্ট গ্যালারি আছে, খোলে সন্ধেবেলায়। সেখানে পেইন্টিংয়ের সব সরঞ্জাম পাওয়া যায়। প্রায় প্রতিদিনই এই গ্যালারিতে নতুন শিল্পীদের আঁকা ছবির একজিবিশন থাকে। এমন ভিড় হয় যে, একদিন রং কিনতে গিয়েও মিলেনা খালি হাতে ফিরে এসেছে। স্কুল থেকে একবার ঘরে ঢুকে গেলে মিলেনার আর ইচ্ছে করে না নীচে নামতে।

শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য টেম্পলের পার্কিং স্পেসে নেমে মিলেনা দেখল, অনিলের বিএমডবলিউটা দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে ওরা এসে গেছে। মূল টেম্পলটা প্রায় কয়েকশো গজ দূরে। বাউন্ডারির মধ্যে একটা ওয়াটার বডি আছে। সেখানে লোটাস ফুটে আছে। পুকুরের চারপাশে সুন্দর সাজানো বাগান। বিদেশি ভক্তদের একজন সেখান থেকে পুজোর ফুল তুলছেন। পরনে হোয়াইট ধুতি আর স্যাফরুন কালারের নামাবলী। গাছের নীচে বসে দু’তিনজন জপ করছেন। টেম্পলের সিঁড়ি পর্যন্ত রাস্তাটায় দামি টাইলস বসানো। তার উপর দিয়ে হাঁটার সময় ওর কানে এল, ‘ইউ আর লুকিং গ্রেট মিলেনা।’

পাশ ফিরে ও দেখল, ডিম্পল। অ্যানার সিস্টার ইন ল’। মেয়েটা গুজরাতি। ক্যামাক স্ট্রিটে ওর বাবার বিরাট শাড়ির দোকান আছে। ইন ফ্যাক্ট, সেই দোকানেই কাল নিয়োগী আন্টি মিলেনাকে নিয়ে গেছিলেন। শিফন ছাড়া, একটা বাদনি শাড়িও ওকে পছন্দ করে দিয়েছেন। ডিম্পলকে দেখেই মিলেনা বুঝতে পারল, প্রেগনেন্ট। বছর দেড়েক আগে বিয়ে হয়েছে ওর। একটু তাড়াতাড়িই বোধহয় মা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। পিছন ঘুরে মিলেনা পাল্টা বলল, ‘তোমাকেও খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।’

‘তোমার বডিবিল্ডার বয়ফ্রেন্ড আসেনি?’

বডিবিল্ডার কথাটা ডিম্পল এমনভাবে বলল, কানে খট করে এসে বাজল মিলেনার। অ্যানাটা কী! দেবদূতের কথা সবাইকে বলার কি কোনও দরকার ছিল? বিশেষ করে ডিম্পলের মতো মেয়েকে? ইন ল’জদের বাড়ি কেমন লাগছে, মাঝে একদিন অ্যানাকে জিজ্ঞেস করেছিল মিলেনা। ফোনে অ্যানা বলেছিল, ‘সব্বাই খুব ভালো। ডিম্পল ছাড়া। মিলেনিয়ারের মেয়ে তো। ওর কাছে টাকাটাই সব। মানুষকে ও বিচার করে, টাকার নিরিখে। ডিসেম্বরেই আমি আর অনিল চলে যাবো স্টেটসে। তাই আমি ওর কথা গায়ে মাখি না।’ কথাগুলো মনে পড়ায় মিলেনাও কটাক্ষটা সিরিয়াসলি নিল না। ও সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, ‘পরে আসবে।’

ডিম্পল সহজে ছাড়বে বলে মনে হল না। বলল, ‘আই নো হিম মিলেনা। হি ইজ দ্য কেয়ারটেকার অফ সিলভার জিম। ভেরি অর্ডিনারি গাই। ওর থেকে যোগ্য ছেলে আর তুমি খুঁজে পেলে না?’

ডিম্পল হেসে স্বচ্ছন্দে অপ্রিয় কথাগুলো বলে যাচ্ছে। মিলেনা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। ডিম্পলের সঙ্গে হেঁটে আসছে একটা আট-ন’বছরের ছেলে। সে আবদার করছে, পরে মন্দিরের ভিতরে ঢুকবে। আপাতত অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে লনে খেলতে চায়। ডিম্পলকে আন্টি বলে সম্বোধন করছে ছেলেটা। ও খানিকটা বিরক্ত হয়েই সম্মতি দিল। সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটা দৌড়ে গেল লনের দিকে।

মূল মন্দিরের সভাঘরে পৌঁছে মিলেনার মন ভরে গেল। রাধা আর কৃষ্ণার লাইফ সাইজ আইডল, ফুল দিয়ে সাজানো। ভাস্কর্যের এত সুন্দর নিদর্শন, ওর মনে হল, পাথরে খোদাই করার সময় শিল্পী প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। বাঁশি বাজানোর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণা রাধার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কৃষ্ণা রাধার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কৃষ্ণার কোমর ছুঁয়ে আছেন রাধা। মুখটা এত পবিত্র, চাউনিটা এত প্রেমময় যে, মিলেনা মুগ্ধ হয়ে কয়েক মিনিট চোখের পলক ফেলতে পারল না। টেম্পলের কথা শুনে নিয়োগী আন্টি কাল বিকেলেই বলছিলেন, প্রেমিকা হিসেবে রাধা হলেন ক্লাসিক একজাম্পল। রাধার মুখের দিকে তাকিয়ে মিলেনার মনে হতে লাগল, ও কি পারবে দেবদূতকে এমনভাবে ভালবাসতে?

পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে প্রিস্ট পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে আরতি করছেন। দু’পাশ থেকে তাঁকে সাহায্য করছে দু’টো বিদেশি মেয়ে ভক্ত। শেভ করা মাথা, পরনে সাদা শাড়ি। সুদূর কোনও দেশে, স্বজনদের ছেড়ে শ্রীকৃষ্ণর টানে কলকাতায় চলে এসেছে। এরা টেম্পল এরিয়াতেই গেস্ট হাউসে থাকে। সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত রাধা-কৃষ্ণকে মানুষ ভেবেই সেবা করে। অ্যানার মুখে মিলেনা শুনেছে, বেঙ্গলিরা এই মূর্তিগুলোকেই গড বলে ভাবে। তাদের ঘুম থেকে জাগায়, স্নান করিয়ে নতুন পোশাক পরায়। তাদের জন্য রান্না করে, খেতে দেয়। পোডিয়ামে সারি সারি থালায় ফ্রুটস, সুইটস আর কুকড ফুড সাজানো রয়েছে। পুজো করার সময় সেই ফুড রাধা-কৃষ্ণার উদ্দেশে নিবেদন করলেন প্রিস্ট। পুরো সভাঘর জুঁই ফুলের গন্ধে ম ম করছে। লো টোনে মিউজিক বাজছে। অনিলের প্রচুর আত্মীয়স্বজন এসেছেন। তাঁরা হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে পুজো দেখছেন। ভিড়ের মাঝে অ্যানার মাম্মি আর ড্যাডিকে দেখতে পেল মিলেনা। কিন্তু কোথাও অ্যানাকে ওর চোখে পড়ল না। আরতি হয়ে যাওয়ার পর পোডিয়াম সাদা পর্দায় ঢেকে দেওয়া হল। এ বার রাধা-কৃষ্ণার খাবারের সময় হয়েছে। সেটা যেন কারোর চোখে না পড়ে।

সভাঘর থেকে বেরিয়ে এল মিলেনা। আকাশে মেঘ সূর্যকে আড়াল করে দিয়েছে। জোরে বাতাস বইছে। মিলেনার চোখে পড়ল, পুকুরের জল তিরতির করছে। গাছের পাতাগুলো নড়ছে। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। লনে দু’তিনটে বাচ্চা দৌড়োদৌড়ি করছে। এই মেঘলা দিনগুলো খুব ভাল লাগে মিলেনার। টেম্পলের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ও একবার পার্কিং স্পেসের দিকে তাকাল। প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেছে। এখনও দেবদূত এল না। তা হলে কি জিম-এ আটকে গেল? দেবদূতকে ফোন করার কথা ভাবছে, তখনই কোত্থেকে উদয় হয়ে অ্যানা বলল, ‘কখন এসেছ মিলেনা? দেবদূতকে সঙ্গে আনোনি?’

ডিম্পলকে ও যে উত্তরটা দিয়েছিল, সেটাই দিয়ে মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে, সেটা তো বললে না।’

‘অসাম। কিন্তু তোমাকে বেঙ্গলি স্টাইলে শাড়িটা পরিয়ে দিল কে? নিশ্চয় তোমার নিয়োগী আন্টি? তুমি কিন্তু এখানে অলরেডি অনেকের চোখে পড়ে গেছো। আমার এক ইন ল’ তোমরা কথা জানতে চাইছিলেন।’

শুনে প্রসঙ্গ ঘোরাল মিলেনা, ‘তোমার দাম্পত্যজীবন কেমন কাটছে অ্যানা।’

‘সেটা জানার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। টেম্পলে এসে তোমার কেমন লাগল?’

মিলেনা সত্যিকথাটাই বলল, ‘আমার তো বাইরে বোরোতেই ইচ্ছে করছিল না। আর চার্চে না গেলে কী ক্ষতি হতে পারে, এখানে দাঁড়িয়ে সেটাই ভাবছিলাম।’

‘আমারও প্রথম দিন টেম্পলে এসে একই কথা মনে হয়েছিল। কী জানো, বেঙ্গলিরা পুতুল পুজোয় বিশ্বাস করে। কিন্তু সেই বিশ্বাস কারও উপর চাপিয়ে দিয়ে না। আমার ইন ল’জরা বলেন, তোমার যদি ইচ্ছে হয়, চার্চে যেতে পারো। ওরা এমন লিবারাল। আমি কিন্তু চার্চে আর যাচ্ছি না।’

দেবদূতের মাও কি একই কথা বলবেন? প্রশ্নটা এক সেকেন্ডের জন্য ওর মনে পাক খেয়েই মিলিয়ে গেল। মিলেনা বলল, ‘বিয়ের পর তুমি কি চার্চে গেছিলে?’

‘গেছিলাম। ভালো অভিজ্ঞতা হয়নি। যাক গে, ভোগ হয়ে যাওয়ার পর সভাঘরের দরজা খুলে যাবে। তখন তুমি ওখানে থেকো। এর পর খোল করতাল নিয়ে ভক্তরা কিছুক্ষণ হরিনাম চ্যান্টিং করবেন। হরেকৃষ্ণা, হরেকৃষ্ণা, কৃষ্ণা কৃষ্ণা হরে হরে। হরে রামা, হরে রামা, রামা রামা হরে হরে। শব্দগুলোর যে কী মাহাত্ম্য তখন তুমি বুঝতে পারবে।’

‘তোমাকে বলতে হবে না অ্যানা। চ্যান্টিংয়ের সিডি আমি বাড়িতে বসে শুনেছি।’

‘তুমি কি এখানে দেবদূতের জন্য ওয়েট করছ?’

‘হ্যাঁ,’ উত্তরটা দেওয়ার পরই পুকুরের দিকে চোখ গেল মিলেনার। তিন চারজন ভক্ত আর দুটো বাচ্চা ছেলে পারে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করছেন। টেম্পলের সিকিউরিটি গার্ডদের ডাকছেন আতঙ্কিত হয়ে। জলে কেউ ডুবে গেল না কি? হ্যাঁ, একটা বাচ্চা ছেলের হাত দেখা যাচ্ছে জলের উপর। প্রাণপণ সে চেষ্টা করছে ভেসে থাকার। সেদিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড পরে মিলেনা বলল, ‘মাই গুডনেস অ্যানা, পুকুরে কেউ বোধহয় ডুবে যাচ্ছে।’

‘আমাদের কেউ নয়তো? কথাটা বলেই সিঁডি দিয়ে দ্রুত নামতে শুরু করল অ্যানা, ‘চলো, একবার গিয়ে দেখে আসি।’

ঠিক সেইসময় জলে ঝপাং করে একটা শব্দ হল। দূর থেকে মিলেনা দেখল, বাচ্চাটার হাত লক্ষ্য করে কেউ একজন সাঁতরে যাচ্ছে। চিতাবাঘের গতিতে লোকটা এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চুলের মুঠি ধরে ছেলেটাকে একবার টেনে তুলল। তার মুখ দেখে মিলেনা চমকে উঠল। এই সেই বাচ্চা ছেলেটা, টেম্পলে ঢোকার আগে ডিম্পলের কাছে যে আবদার করছিল, লনে অন্যদের সঙ্গে খেলবে। তাকে কাঁধে চাপিয়ে, সাঁতরে লোকটা পারের দিকে এগিয়ে আসছে। জল থেকে উঠে আসার পর তাকে দেখে আরেকবার চমকে উঠল মিলেনা। দেবদূত! কখন এল?

পারে তুলে ছেলেটাকে লনে শুইয়ে দিল দেবদূত। চোখ বুঁজে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে। মারা গেছে না কি? বিস্ফারিত চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল মিলেনা। ডুকরে কেঁদে উঠল অ্যানা। ওর দিকে তাকিয়ে দেবদূত বলল, ‘লেট মি ট্রাই অ্যানা। ডোন্ট ক্রাই।’ হাঁটু গেড়ে বসে ও ছেলেটার পেটে চাপ দিতে লাগল। মুখে মুখ দিয়ে রেসপিরেশন চালু করার চেষ্টা করল। তার পর দু’ পা ধরে তুলে বাচ্চাটাকে উল্টোভাবে ঝুলিয়ে কয়েকবার ঝাঁকুনি দিল। সঙ্গে সঙ্গে নাক-মুখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। ফের লনে ওকে শুইয়ে দিতেই ছেলেটা কাশতে শুরু করল। কয়েকবার ওয়াক শব্দ করে বমি করে ফেলল। তার কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে কাঁদতে লাগল, ‘মাম্মি’ বলে। এতক্ষণে দেবদূতের মুখে হাসি ফুটল। পরনের ভিজে টি শার্টটা খুলে ও নিঙড়োতে লাগল।

জলে ডোবার খবর ইতিমধ্যে টেম্পলের ভিতর পৌঁছে গিয়েছে। অনিলের আত্মীয়রা সবাই দৌড়ে এসেছেন পুকুরের পারে। ছেলেটাকে ওর মা কোলে তুলে নিয়েছেন। দেবদূতকে দেখে তিনি বলে উঠলেন, ‘দেব, তুমি এখানে? আমার মেয়ে তো তোমার জিম-এ ট্রেনিং নিতে যেত।’

দেবদূত বলল, ‘আমি আপনাকে চিনি মিসেস মোতওয়ানি! থ্যাঙ্ক গড, আর কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে আপনার ছেলেকে বাঁচাতে পারতাম না।’

দেবদূতের পেশিবহুল শরীরটার দিকে সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ডিম্পলের দিকে চোখ পড়ায় মিলেনা দেখল, মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে করুণা হল মিলেনার। ওর খুব ইচ্ছে হল, ডিম্পলের সামনেই দেবদূতের বুকে মাথা গোঁজার।

(বাইশ)

পার্টি অফিসে ঢোকার সময় লিলিকে দেখতে পেল রুস্তম। কালো বোরখা পরে রিসেপশনে বসে রয়েছে। নকাবটা মাথার উপর তোলা। ওকে দেখেই ভ্রু কুচকে উঠল রুস্তমের। কাল বিকেলে লিলি ওকে ফোন করে ঝাউতলার ফ্ল্যাটে ডেকেছিল। ভাইজান বেঁচে থাকলে হয়তো ওকে যেতে হত। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি আলাদা। উল্টে লিলিকেই ও বলেছিল, আজ বেলা দশটায় পার্টি অফিসে আসতে। দেখেও ওকে পাত্তা না দিয়ে রুস্তম ভাইজানের ঘরে ঢুকে গেল। এখন অবশ্য ভাইজানের ঘর বলা উচিত না। ঘরের আসবাবপত্তরও বদলে ফেলা হয়েছে। চেয়ারে বসে রুস্তম ঠিক করে নিল, লিলির সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে, যাতে ভবিষ্যতে আর পার্টি অফিসে না আসে। ভাইজান যেদিন মারা যান, সেদিন রেন্ডিটাকে ও নার্সিং হোমের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। ওর সঙ্গে আরও দু’একজন ছিল। কিন্তু ভাইজানের আত্মীয়দের দেখে বোধহয় রেন্ডিটা সেদিন সামনে এগিয়ে আসার সাহস পায়নি।

আসফাক ঘরে ঢুকে বলল, ‘মমতাজ বেগম বলে একজন দেখা করতে এসেছে। কী বলব ওস্তাদ?’

কলমা পড়ার পর লিলির নাম যে মমতাজ হয়েছে, সেটা রুস্তম জানে। ও বলল, ‘একটু বসতে বল। হাতের কাজ সেরে আমি ডেকে নিচ্ছি।’

সত্যিই সকালের দিকে ওর অনেক কাজ আছে। ভাইজানের সময়কার অসমাপ্ত কাজ। স্টিফেন ম্যানসন থেকে একটা ফ্যামিলিকে উচ্ছেদের সুপারি নিয়েছিল ভাইজান। টাইগ্রান বলে একটা বুড়ো আর তাঁর পোতি থাকে, সেই ফ্ল্যাটে। মুশকিল হচ্ছে, বুড়োটা কী ভাষায় কথা বলে, রুস্তম বোঝে না। তাই চমকাতে গেলেও পারে না। তাই আসফাকের পরামর্শে পোতিটাকে রাস্তায় ধরে ভয় দেখাতে গেছিল। আচমকা লোকজন জড়ো হয়ে যায়। দেব এসে ওকে বেইজ্জত করে। রুস্তম এখনও আফসোস করে, মালপত্তর সঙ্গে নিয়ে গেলে সেদিন ভাল করত। ও ঠিকই করে রেখেছে, এমন বদলা নেবে, যাতে বাপের নাম ভুলে যায়। ফ্ল্যাটের জন্য ভাইজান যার কাছ থেকে টাকাপয়সা নিয়েছিল, সিলভার হোটেলের সেই মালিকের ম্যানেজার একটু পরেই ওর কাছে আসবে। হোটেলের মালকিন আনন্দী শরাফকে দিয়ে দেবকে ও টাইট দেবে। কেননা, দেব যে জিম-এ কাজ করে, তারও মালকিন আনন্দী শরাফ।

আসফাককে কথাটা বলেই রুস্তম টিভি চালিয়ে দিল। চল্লিশ ইঞ্চির বড় একটা টিভি সদ্য লাগিয়েছে। সময় পেলে কখনও খবর দেখে, কখনও মুভি। আজকাল প্রাইম ভিডিয়ো আর নেটফ্লিক্স-এর কল্যাণে নতুন সিনেমাগুলো দু’মাসের মধ্যে বাড়িতে বসে দেখা যায়। হল-এ গিয়ে সিনেমা দেখার ইচ্ছে রুস্তমের হয় না। কেন জানে না, ওর মনে হয় হল-এর দরজাগুলো হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাবে। ওর বিরোধী পার্টির ভাড়াটে খুনিরা অন্ধকারের মধ্যে খুঁজে ওকে মার্ডার করে যাবে। নেটফ্লিক্স খুলে রুস্তম দেখল, ‘ভাইজান’ বলে সিনেমাটা দেখা যাবে। বলিউডের হিরোদের মধ্যে ওর সবথেকে প্রিয় সলমন খান। ছোটবেলায় ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ দেখার পর থেকেই ও সল্লুভাইয়ের ফ্যান। ফ্লাক্স খুলে কাপে চা ঢেলে, চুমুক দিতে দিতে রুস্তম ‘ভাইজান’ দেখতে লাগল। একটা পাকিস্তানি বাচ্চা মেয়েকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য সল্লুভাই, উফফ… কী রিক্স নিচ্ছে, একমাত্র ওঁর পক্ষেই সম্ভব! আর কোনও হিরো পারবে না।

সিনেমাটা কতক্ষণ ধরে দেখছে, রুস্তমের খেয়াল নেই। আসফাক ফের দরজা ফাঁক করে বলল, ‘ওস্তাদ, মমতাজ বেগম বাওয়াল করছে। ভাগিয়ে দেবো, না কি তুমি কথা বলবে?’

‘ভেতরে পাঠিয়ে দে।’ বলে রিমোটের প’জ বাটনটা টিপে দিল রুস্তম। ঝাউতলায় ভাইজানের ফ্ল্যাটে ঢুকে মান্টিকে যে কাজটা ও করতে বলেছিল, বোধহয় সেটা এতক্ষণে হয়ে গেছে। নিশ্চিত হয়ে ও একটা ফাইল খুলে নিয়ে চোখ বোলাতে লাগল। কয়েক সেকেন্ড পরেই ঘরে ঢুকে লিলি চ্যালেঞ্জ করার ভঙ্গিতে বলল, ‘রুস্তম, আমার কী করলে?’

শুনে মাথায় রাগ চেপে গেল রুস্তমের। মনে মনে ও খিস্তি দিল। রেন্ডি মাগী, তোর শরীরটা নিয়ে মজা লুটে গেল একজন, আর তার দায় নিতে হবে আমাকে? শেষের দিকটায় ভাইজানেরও সেক্স বেড়ে গেছিল বোধহয়। এই অফিস ঘরেই রুস্তম অনেক কীর্তি দেখেছে। লিলি কী চায়, সেটা জানার জন্য রাগটা চেপে ও বলল, ‘আমার কাছ থেকে তুমি কী আশা করে এসেছ লিলি?’

‘তোমার ভাইজান তো আমাকে পথে বসিয়ে গেলেন। এখন আমার চলবে কী করে?’

‘তুমি উলুবেড়িয়ায় চলে যাও। গিয়ে আব্বুজানকে জানাও, ভাইজান তোমাকে নিকাহ করেছিল।’

‘তুমি যদি আমাকে নিয়ে যাও, তা হলে যেতেই পারি। কেননা, তুমি ছাড়া আর কেউ জানে না, আমি তোমার ভাইজানের সেকেন্ড বিবি।’

রুস্তম বলল, ‘একটা কথা সোজাসুজি তোমাকে বলে দিচ্ছি লিলি, আমাকে এর মধ্যে জড়িও না। ভাইজান তোমাকে রাখেইল করে রেখেছিল, না কি তোমাকে নিকাহ করেছিল, আমি সত্যিই জানি না। ঝাউতলার ফ্ল্যাটে তোমাকে কয়েকদিন দেখেছি মাত্র। তবে তুমি যদি চাও, উলুবেড়িয়ার ঠিকানা তোমাকে দিয়ে দিতে পারি। ওখানে থেকে ফিরে আসতে পারবে কি না, তার গ্যারান্টি দিতে পারছি না।’

‘আমার এখন কী করার আছে, তুমি বলো।’

‘ভাইজান কিছু তোমাকে বলে যায়নি?’

‘বলেছিল। ঝাউতলার ফ্ল্যাটটা না কি আমার নামে লিখে দিয়েছে। মাসোহারারও ব্যবস্থা করে দেবে। বাড়িতে সেই ফ্ল্যাটের দলিল খুঁজে দেখেছি। কিন্তু পাইনি। আমার মনে হয়, দলিল এই পার্টি অফিসে আছে।’

‘তা হলে খুঁজে দেখতে হবে। এই ঘরটা রিনোভেট করার সময় কিছু ফাইল আর কাগজপত্র আমি ফেলে দিয়েছি। তার মধ্যে যদি তোমার ফ্ল্যাটের দলিল থেকে থাকে, তা হলে তোমার কপাল খারাপ। তবে, আপাতত তুমি ঝাউতলায় থাকতে পারো। যতক্ষণ না, উলুবেড়িয়া থেকে আব্বুজান বা ভাবীজান এসে ক্লেইম করেন। তখন তোমাকে হয়তো বসিরহাটে ফিরে যেতে হবে।’

‘বসিরহাটে ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই রুস্তম। তুমি আমাকে মাসোহারার ব্যবস্থা করে দাও। না হলে, না খেতে পেয়ে আমাকে মরতে হবে। তুমি যদি কিছু না করো, তা হলে বাধ্য হয়ে আমাকে পরেশদার কাছে যেতে হবে।’

রাগটা আবার ফিরে এল। লিলি ভয় দেখাচ্ছে। এই মেয়েটা সবকিছু পারে। নিজের দরকারে পরেশদার সঙ্গে শুয়েও পড়তে পারে। ট্যাংরার পার্টি অফিসে পরেশদা একা থাকেন। দুঃখের কাঁদুনি গেয়ে লিলি যদি একবার পরেশদার মন ভিজিয়ে দেয়, তা হলে মুশকিল। আপাতত ওকে কাটিয়ে দেওয়া দরকার। রাগ চেপে রুস্তম তাই বলল, ‘অত দূর যাওয়ার তোমার দরকার নেই। তুমি যাও, আমার কাছে এখন একজনের আসার কথা আছে। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। কারোর হাত দিয়ে কিছু টাকা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

কথাটা মনঃপূত হল না লিলির। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বিজনকে যে তুমি মার্ডার করেছ, সেটা আমি জানি। তোমার আবিদ ভাইজানের সঙ্গে টেলিফোনে তোমার কথাবার্তা আমি সেদিন শুনে ফেলেছি। পিস্তলটা এখনও তোমার কাছে আছে বলে জানি। আমি অবশ্য পুলিশের কাছে যাবো না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’

লিলি ব্ল্যাকমেল করছে। রুস্তমের মনে পড়ল, বিজনকে মার্ডার করার দিন অ্যাকশনে বেরোনোর আগে ভাইজানের সঙ্গে ফোনে ওর কথা হয়েছিল। তা হলে সেদিন বিকেলে ভাইজান ঝাউতলার ফ্ল্যাটে ছিলেন! রেন্ডি মাগী বোধহয় ওদের কথাবার্তা শুনে ফেলেছিল। তাই পাল্টা চাপ দিচ্ছে। নাহ, ওকে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। পরেশদার খপ্পরে পড়ার আগে ওর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আজ সকালেই মান্টিকে রুস্তম কাজে নামিয়ে দিয়েছে। ঝাউতলার ফ্ল্যাটবাড়ির কেয়ারটেকার মান্টি ভাইজানের খুব কাছের লোক ছিল। লিলি সম্পর্কে ও অনেক কিছু জানে। একবার ও বলেছিল, বসিরহাটের এক নার্সিং হোমে লিলি না কি নার্সের কাজ করত। এমনও হতে পারে, ব্ল্যাকমেল করে ভাইজানকে ও ফাঁসিয়েছিল।

কলকাতায় আসার পর ওর লাইফ স্টাইলই না কি পাল্টে গেছে। প্রায়দিনই রেন্ডিটা কোয়েস্ট মল-এ যায়। দামি ড্রেস আর কসমেটিক্স কিনে আনে ব্যাগে করে। ফুড জয়েন্টে একটা লোকের সঙ্গে বসে থাকে। লিলির সম্পর্কে আরও খবর একটু পরে মান্টি দেবে। রুস্তম ওকে বলে দিয়েছে, আজ যখন লিলি পার্টি অফিসে থাকবে, তখন মাস্টার কী দিয়ে ও যেন ফ্ল্যাট খুলে, পুরো সার্চ করে। লিলিকে যতক্ষণ পারবে, রুস্তম পার্টি অফিসে আটকে রাখবে।

রুস্তম নিজে কখনও কাউকে ব্ল্যাকমেল করেনি। ভাইজান ছিল বলে, সে সাহসও কখনও ওর হয়নি। লিলির চোখে চোখ রেখে রুস্তম বলল। ‘আমি জানি, তুমি পুলিশের কাছে যাবে না। তোমাকে একটা অ্যাডভাইস দিচ্ছি লিলি। ভুল করেও ভাইজানের নামে স্ক্যান্ডাল রটাতে যেও না। পার্টির কেউ সহ্য করবে না। আর মমতাজ নামটাও কোথাও ব্যবহার কোরো না। তোমার ভালর জন্য বলছি।’

জবাবটা খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দিল লিলি, ‘তোমার অ্যাডভাইস আমার তদ্দিন মনে থাকবে, যদ্দিন তুমি টাকা পাঠাবে।’ বলে নকাব ঢেকে ঘর থেকে ও বেরিয়ে গেল।

ওর হুমকিতে পাত্তা না দিয়ে রুস্তম বেল বাজাল। ঘর সাজিয়ে নেওয়ার সময় ও নতুন এই বেলের ব্যবস্থা করেছে। বেল বাজলেই আসফাক বা ববি ভিতরে চলে আসে। ভিতরে ঢুকে আসফাক বলল, ‘কে এসেছিল ওস্তাদ?’

রুস্তম বলল, ‘ভাইজানের চেনা। ভাইজান না কি টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করত। যাক গে, খালপাড়ের পাইপ কলোনির কেসটা কদ্দূর?’

‘আজ রাতেই হয়ে যাবে, ওস্তাদ।’

‘দেখিস, একটা ঝুপড়িও যেন দাঁড়িয়ে না থাকে। মি. গুলাটিকে আমি কথা দিয়েছি, পাইপ কলোনি একেবারে সাফ করে দেবো। শোন, আমার মনে হয়, অপারেশনটা বিকেলের দিকে করাই ভাল হবে। এইসময় বস্তির ব্যাটাছেলেরা ঘরে থাকে না।’

কথাটা বলার সময় পাইপ কলোনির এলাকাটা রুস্তমের চোখের সামনে ভেসে উঠল। বাইপাসের ধারে যখন সোনালি অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছিল, তখন বিল্ডাররা খাল বুঁজিয়ে দেওয়ার জন্য কর্পোরেশনে অনেক টাকাপয়সা খরচ করেছিল। আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন তৈরি করার জন্য কর্পোরেশন কংক্রিটের কয়েকটা বিরাট পাইপ এনে খালপাড়ে রেখেছিল সেইসময়। বিল্ডারদের সঙ্গে আবিদভাইজানের কোনও একটা কারণে ঝামেলা হয়। ফলে ড্রেন তৈরির কাজ আর এগোয়নি। তার পর থেকে বেশ কিছুদিন পাইপগুলো এমনিই পড়েছিল। এদিকে সোনালি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লিট হয়ে যাওয়ার পর লোকজন এসে যায়। বিল্ডাররা তখন অ্যাপার্টমেন্টের চারদিকে উঁচু পাঁচিল তুলে দেয়। খালপাড় কিন্তু খালি পড়ে থাকেনি।

একজন দু’জন করে লোক সেখানে সংসার গুছিয়ে বসেছিল। ভাইজানও ভোটের কথা ভেবে ওদের মদত দেয় তখন। আলো, জলের লাইন আর পাকা পায়খানার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কলোনির লোক অ্যাদ্দিন ভালই ছিল। কিন্তু দিল্লির একটা কোম্পানি ওখানে একটা বড় হোটেল তৈরি করতে চাইছে। হোটেলে হলে জায়গাটার ভোলই পাল্টে যাবে। কোম্পানির মালিক উত্তম গুলাটির সঙ্গে রুস্তমের কথাবার্তা হয়ে গেছে। পাইপ কলোনির লোকজনকে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে রুস্তম। প্রচুর টাকার ডিল, প্লাস একটা এসইউভি গাড়ি। শুনে মাথা ঘুরে গেছিল ওর। কলোনির ব্যাটাছেলেরা সকালবেলায় রাজারহাট, নিউ টাউনের দিকে চলে যায় মজদুরি করার জন্য। ওদের বাড়ি-ঘরে একবার আগুন লাগিয়ে দিতে পারলে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সব শেষ হয়ে যাবে।

আসফাক জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক বলেছ ওস্তাদ। কাজটা বিকেলের দিকে করা ঠিক হবে।’

‘ক’টা ছেলেকে কাজে লাগাচ্ছিস?’

‘দশ-বারোজন। গোবরা বস্তিতে যে ছেলেগুলো অপারেশন করেছিল, তাদের ডেকেছি। ওরাই হাতের সামনে যা পাবে, সরিয়ে ফেলবে। নিজেরা আগুন নেভানোর বাহানা করে দমকলের লোকজনকে দেরিতে খবর দেবে। ঝামেলা পাকিয়ে দমকলের লোকজনকে কাজ করতে দেবে না। সব ফিট করা আছে। ছেলেগুলোকে বলে দিয়েছি, তোদের আলাদা করে টাকা দিতে পারব না। লুটপাট করে যা পাবি, সেটাই তোদের লাভ। তাতেই ওরা রাজি হয়ে গেল।’

রাজি না হয়ে উপায় নেই। আজকাল বস্তির ঘরে ঘরেও মোবাইল ফোন, টিভি, ফ্রিজ। নিশ্চিন্ত হয়ে রুস্তম বলল, ‘ভেরি গুড। পুড়ে-টুড়ে যাওয়ার পর আমাকে খবর দিস। আমি গিয়ে কলোনির লোকজনকে সান্ত্বনা দিয়ে আসব। দেখিস, পরেশ লস্করের লোকজন যেন আমার আগে না পৌঁছয়। পুরো ডিলটা তখন আমার হাতের বাইরে চলে যাবে।’

ফের সিনেমা দেখার জন্য রুস্তম পজ বাটনটা টিপতে যাবে, এমন সময় ঝাউতলা থেকে মান্টির ফোন। পর্দায় নামটা দেখে ও সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘কিছু পেলি?’

চাপা গলায় মান্টি বলল, ‘অনেক খবর রুস্তমদা। লিলিটা একেবারে রামখানকি। লেখাপড়া জানা মেয়ে। বি এসসি পাস। ভাইজানের অ্যাবসেন্সে ওর কাছে প্রায়ই একটা ডাক্তার আসত। আমার কাছে সিসিটিভির সব ফুটেজ আছে। ভাইজান ওর ফ্ল্যাটের ভিতরেও একটা ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছিলেন। খানকিটা সেটা জানত না। আজ সকালে আপনার ফোন পেয়ে ঘরের ফুটেজগুলো দেখছিলাম। মোস্ট ইম্পরট্যান্ট, ভাইজানের হার্ট অ্যাটাকের পিছনে খানকিটার হাত আছে। কফির সঙ্গে মিশিয়ে ভাইজানকে ও এমন একটা ওষুধ খাইয়েছিল, যা পেটে গেলে আধ ঘণ্টা মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হতে বাধ্য। ওষুধটা ওকে এনে দিয়েছিল ডাক্তার।’

শুনে মারাত্মক চমকে উঠল রুস্তম। মান্টি বলছেটা কী! এ রকম ওষুধ আছে না কি? সত্যিই তো ভাইজান হার্ট অ্যাটাকের দিন ঝাউতলায় ছিল। একটু আগে লিলি নিজের মুখেই তা বলে গেল। তার মানে ওষুধটা খাইয়েই ও ভাইজানকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। মান্টিকে ও বলল, ‘সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে তুই আমার কাছে চলে আয়। আর কেউ যেন এ কথা না জানে।’

‘শুধু ফুটেজ না, খানকির ল্যাপটপটাও সঙ্গে নিয়ে যাবো রুস্তমভাই। ল্যাপটপে দেখলাম, ভাইজানের সঙ্গে ইন্টারকোর্সের শুট করে রেখেছে খানকিটা। দরকার হলে ভাইজানকে ব্ল্যাকমেল করবে বলে। কী ডেঞ্জারাস টাইপের মেয়ে ভাবো।’

ফোনে আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করল না রুস্তমের। বলল, ‘সব নিয়ে তুই এখুনি পার্টি অফিসে চলে আয়।’

(তেইশ)

বাইপাসে সোনালি অ্যাপার্টমেন্টের কাছে পাইপ কলোনিতে আগুন লেগেছে। বিকেলে অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে খবরটা পেয়ে গেছিলেন শিখিন। ঘণ্টাখানেক পর শিশির উত্তেজিত গলায় খবর দিল, ‘স্যার, পাবলিক আমাদের স্পটে যেতে দিচ্ছে না। কী করা যায় বলুন?’

শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘যেতে দিচ্ছে না কেন?’

‘ওই একই কমপ্লেন। এত দেরিতে কেন এলেন? দুটো পাম্প নিয়ে এসেছিলাম। ইট মেরে একটার কাচ ভেঙে দিয়েছে। আমরা কি ফিরে যাব?’

ফিরে আসার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘জায়গাটা কোন থানার আন্ডারে?’

‘স্যার, ট্যাংরা থানার। পুলিশ কিন্তু এখনও আসেনি।’

‘এরিয়াটা কন্ট্রোল করে কে?’

‘আগে আবিদ ভাইজানের এরিয়া ছিল। এখন কন্ট্রোল করে রুস্তম বলে এক মাস্তান। ওর ছেলে-পেলেরাই গণ্ডগোল পাকাচ্ছে। স্যার, আমার মনে হচ্ছে, এর ভিতর ঘাপলা আছে। রুস্তমের লোকরা চায় না, আমরা আগুন তাড়াতাড়ি নিভিয়ে ফেলি।’

‘স্পটে যাওয়ার অন্য কোনও রাস্তা নেই?’

‘আছে। সোনালি অ্যাপার্টমেন্টস-এর ভেতর থেকে অপারেশন করা যায়। মাঝে একটা খাল আছে।’

‘তা হলে ওই কমপ্লেক্স-এর ভিতরে ঢুকে পড়ছিস না কেন?’

‘একটা পাম্প নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সিকিউরিটি গার্ডরা কিছুতেই ঢুকতে দিল না। বলল, রেসিডেন্টদের পার্মিশন নিতে হবে। মনে হয়, রেসিডেন্টরাও চায় না, কলোনিটা অক্ষত থাকুক। এ দিকে আগুন হু হু করে বাড়ছে। আর দেরি কললে একটা ঝুপড়িও টিকে থাকবে না। বাতাস দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে বইছে। সোনালি অ্যাপার্টমেন্টের রেসিডেন্টরা বুঝতে পারছেন না, ওঁদের ফ্ল্যাটগুলোতেও আগুন পৌঁছে যেতে পারে।’

‘আগুন লাগল কী করে, শুনতে পেলি?’

‘লাগল কী করে, না বলে জিজ্ঞেস করুন, লাগানো হয়েছে কী করে? স্যার, একেবারে প্ল্যান করে। ইস্ট সাইডের ঝুপড়িতে না কি প্রথম আগুন লাগে। কলোনিটা এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে, ইস্ট সাইডে পাম্প নিয়ে ঢোকার কোনও সুযোগই নেই। ঝুপড়িগুলো ক্রমশ ছড়িয়ে গেছে ওয়েস্ট সাইডে। যারা আগুন লাগিয়েছে, তারা ইস্ট সাইডটা ইচ্ছে বেছে নিয়েছে। যাতে দমকল চট করে অ্যাকশন নিয়ে আগুন কন্ট্রোল করতে পারে। কলোনিতে শ’চারেক লোক বাস করে। মাঝে একতলা কিছু পাকা বাড়িও চোখে পড়ল। এইরকম একটা কস্টলি এরিয়ায় দিব্যি ঘর সংসার গুছিয়ে বসে আছে। স্যার, সেদিন হেস্টিংস থেকে ফিরে এসে অনিরুদ্ধ আমাদের যা বলেছিল, এখন দেখছি, সেটাই হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক। বস্তিগুলোতে ফায়ার সেফটির জন্য চাপ দেওয়া উচিত।’

‘তোর কি মনে হয়, আরও পাম্প পাঠানো দরকার?’

‘বাইপাসে জ্যাম হয়ে গেছে স্যার। পাম্প পৌঁছতে পারবে কী না, জানি না। তবুও, আপনি পাঁটুলি, প্রগতি ময়দান আর সল্ট লেক স্টেশনে বলে রাখুন। নিজেকে হেল্পলেস বলে মনে হচ্ছে। চোখের সামনে একের পর এক ঝুপড়ি ছাই হয়ে যাচ্ছে, অথচ কিছু করতে পারছি না। অপারেশন শুরু করতে পারলে, হয়তো এখনও কয়েক ঘর বাঁচানো যেত। ইসস, আগুনের তেজ বেড়েই যাচ্ছে। ঝুপড়ির গ্যাস সিলিণ্ডারগুলো বার্স্ট করছে বলে।’

‘তোদের এই টিমের লিডার কে?’

‘অনিমেষদা। বয়স্ক মানুষ, ওর কথা পাবলিক শোনেনি। ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাবলিক একটা ক্লাব ঘরে আটকে রেখেছে। স্যার, পারলে শিগগির পুলিশ ফোর্সকে আসতে বলুন।’

শিখিন চট করে পরিস্থিতিটা বুঝে নিলেন। ডিভিশনাল অফিসাররা যে কোনও জায়গায় যেতেই পারেন। শিশিরের মুখে সব শুনে কন্ট্রোল রুমে ফোন করে, তার পর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। শিখিন নিশ্চিত, এই আগুন লাগার পিছনে প্রোমোটার-মাস্তান নেক্সাস আছে। বাইপাসের ধারে, ওই জায়গায় আগে মাছের ভেড়ি ছিল। হাজার হাজার একর ভেড়ির জমি একটা সময় লুট হয়ে গেছিল। জমির মালিকরা তখন কিছুই করতে পারেননি। পার্টির নেতারা দাঁড়িয়ে থেকে সেই জমি কমরেডদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত কমরেডরা যে যেমনভাবে পেরেছেন, বাড়ি তুলে নিয়েছেন। শহর বেড়ে গেছে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, মুকুন্দপুর হয়ে কামাল গাজি পর্যন্ত।

কিন্তু বালিগঞ্জ, পার্ক সার্কাসের পূর্বদিকে লোকবসতি হয়েছে অনেকদিন পর। হোটেল, কর্পোরেট অফিস, হাসপাতাল, হাউজিং কমপ্লেক্স হওয়ার জন্য অঞ্চলটার গুরুত্ব এখন অপরিসীম। অমন একটা সুন্দর জায়গায় ভবিষ্যতে যদি আরও একটা হাউসিং কমপ্লেক্স গড়ে ওঠে, তা হলে এয়ারপোর্ট থেকে শহরে ঢোকার পথে সৌন্দর্য নিশ্চয়ই বৃদ্ধি পাবে। ফায়ার ফাইটার হিসেবে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে শিখিনের। এই পাইপ কলোনির মতো বস্তিগুলো হল শহরের ফোঁড়া। অসামাজিক কাজের আখড়া। মাথা গোঁজার জন্য গ্রাম অথবা ভিন রাজ্য থেকে লোক এসে জমি জবরদখল করে রেখেছে। এদের সমূলে উৎখাত করা উচিত। কিন্তু সেটা করতে গেলে মিডিয়া আহা উহু করে উঠবে। সেন্টিমেন্টের বন্যা বয়ে যাবে সমাজে। পার্টিও সো কলড বিপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে। কেননা, বস্তিগুলো হচ্ছে একেকটা পার্টির ভোট ব্যাঙ্ক। সঞ্জয় গান্ধীর মতো লোক এখন কোথায়, যিনি দায়িত্ব নিয়ে জঞ্জাল পরিষ্কার করবেন?

যানজট পেরিয়ে শিখিন যখন স্পটে পৌঁছলেন, তখন সন্ধে হয়ে গেছে। মাইলখানেক দূর থেকে তিনি কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতে পেয়েছেন। বাতাসে কটু গন্ধ। কাছে গিয়ে তিনি দেখলেন, ট্যাংরা থানার পুলিশ এসে গেছে। বাইপাসে তিনটে পাম্প দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে পাঁটুলি অথবা প্রগতি ময়দান থেকে একটা বাড়তি পাম্প এসেছে। রাস্তায় দুটো অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। লোকজন ধরাধরি করে আহতদের তুলে দিচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সে। বাইপাসের আলোয় শিখিনের আরও চোখে পড়ল, কয়েকটা ঝুপড়ি থেকে তখনও কালো ধোঁয়াসহ আগুনের শিখা বেরোচ্ছে। লালচে রঙের শিখা। বস্তিতে নিশ্চয় কারও ঘরে কেমিকেল মজুত ছিল। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা হোস পাইপ দিয়ে জল ছেটানোর কাজ চালাচ্ছে। আগুন পুরোপুরি না-নেভা পর্যন্ত জল ছেটানোর কাজটা করেই যাবে। কাছে যেতে ফয়জানকে দেখতে পেলেন শিখিন। পুরো ইউনিফর্ম ভিজে গিয়েছে। হয়তো অনেকক্ষণ হোস পাইপ ধরে ছিল। ওর মুখ-চোখে কালি।

‘শিশিররা কোথায়?’ শিখিন জিজ্ঞেস করলেন।

‘ইস্ট সাইডে আছে। কী সব লোকজন কলোনিতে থাকে স্যার, শুনুন। এরা এত মূর্খ, একটা কথা শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। কয়েকটা ঘরে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছিল। অথচ সেগুলো এরা খুলে নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে ডাম্প করে রেখেছিল। আমরা গিয়ে ডিসকভার করলাম।’

শিখিন বললেন, ‘কি বলছিস, আমি বুঝতে পারছি না।’

‘কেমিকেল ভর্তি ড্রাম বস্তির কয়েকটা ঘরে লুকানো ছিল। ট্যাংরায় চামড়ার কারখানায় লাগে এমন কেমিকেল। মালিকরা বোধহয় ফায়ার এক্সটিংগুইশারও এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু কলোনির লোক ব্যবহার করতে জানে না। ভেবেছে, এক্সটিংগুইশারগুলো কেমিকেলের থেকেও মূল্যবান। সেগুলো যাতে নষ্ট না হয়, তাই আলাদা ঘরে সরিয়ে রেখেছে। কেমিকেলের জন্যই আগুন আরও ছড়িয়ে পড়ল স্যার। আমাদের ফোম ইউজ করতে হল। না হলে আমরা আরও আগে কন্ট্রোলে আনতে পারতাম।’

‘তা হলে তো ফোরেন্সিক লোকজনকে ডাকতে হয়।’

‘খবর দিন স্যার। পরে ফায়ার রিপোর্টে লাগতে পারে।’

‘কোনও ক্যাজুয়ালটি আছে?’ অভ্যাসমতো প্রশ্নটা করেই শিখিন থমকে গেলেন। ক্যাজুয়ালটি তো হয়েছেই। তাদের অ্যাম্বুলেন্সেও তুলতে দেখেছেন তিনি।

ফয়জান বলল, ‘এদিকে কেউ নেই। ইস্ট সাইডে হয়েছে কি না জানি না। শিশিরদারা বলতে পারবে।’

শিখিন বললেন, ‘ঠিক আছে। ধোঁয়া একদম বন্ধ না হওয়া তোরা পর্যন্ত জল দিয়ে যা। আমি শিশিরের সঙ্গে কথা বলে আসি।’

কথাগুলো বলে শিখিন আর দাঁড়ালেন না। পূর্বদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। পাইপ কলোনির নানা জায়গায় জটলা। মহিলাদের ভিড়ই বেশি। কেউ কান্নাকাটি করছেন। কেউ কেউ তাকে ঘিরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বিলাপের মধ্যে থেকে টুকরো কথা ভেসে আসছে। আগুন না কি এত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে গেছিল, জিনিসপত্তর বের করে আনারও সময় অনেকে পাননি। আশপাশের লোকজন কী বলছে, তা শোনার জন্য দু’তিনটে জায়গায় শিখিন দাঁড়িয়ে গেলেন। আগুন লাগার আসল কারণটা এইভাবে ভিড়ের মাঝে অনেক সময় জানা হয়ে যায়। একটা জটলায় একজন কখনও উত্তেজনা ছড়াচ্ছে দমকলের বিরুদ্ধে। কখনও আশ্বাস দিচ্ছে, এত ভেঙে পড়ার কিছু নেই। আধো অন্ধকারেও লোকটাকে চিনতে পারলেন শিখিন। রুলিং পার্টির কর্মী, মিছিলে প্রায়ই ওকে দেখতে পান। সামনের দিকে স্লোগান দিতে দিতে দিতে যায়। তবে ওর নামটা তিনি মনে করতে পারলেন না।

ইউনিফর্ম পরে আসেননি। তাঁকে দেখে কলোনির লোকদের বোঝা সম্ভব নয়, তিনি দমকলের অফিসার। ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে শিখিন শুনতে পেলেন, লোকটা বলছে, ‘তোরা এখন কিছুতেই কলোনি ছেড়ে যাবি না। রুস্তমভাই এল বলে। তোদের জন্য ফের ঘর তৈরি করে দেবে।’

কেউ একজন বলল, ‘কিন্তু এই জঞ্জালের মধ্যে আমরা থাকব কী করে আসফাকভাই?’

এই লোকটার নাম তা হলে আসফাক। মন্টু ওকে নিশ্চয়ই চিনতে পারবে। পূর্বদিকে আরও কয়েক পা হেঁটে যাওয়ার পর বাঁ দিকে একটা ক্লাবঘর দেখতে পেলেন শিখিন। ইটের পাকা গাঁথনির একতলা বাড়ি। বড় বড় করে লেখা ‘আজাদ সংঘ।’ বাতাসের গতি উল্টোদিকে বলে আগুনের আঁচ ক্লাবঘরে লাগেনি। বস্তিতে প্রায়ই যেতে হয় শিখিনকে। তিনি লক্ষ করেছেন, প্রতিটা বস্তিতে ঝুপড়ির অবস্থা যতই দীর্ণ হোক না কেন, একটা পাকা ক্লাবঘর থাকবেই। কারা টাকা জোগায়, কে জানে? বোধহয় কিছুদিন আগেই পাইপ কলোনিতে তারা মায়ের পুজো হয়ে গেছে। ক্লাবের দেওয়ালে, তারই ফ্লেক্স। সেদিকে তাকিয়ে তখনই শিখিনের মনে পড়ল, অনিমেষদার কথা। পাম্প নিয়ে প্রথম যে দলটা এখানে এসেছিল, তার লিডার। একটু আগে শিশির বলেছিল, লোকাল ছেলেরা না কি ওঁকে ক্লাবঘরে আটকে রেখেছে।

ক্লাবের উঠোনে বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন ট্যাংরা থানার ওসি পুলক দে। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ‘সরকারী কর্মীদের কাজে বাধা দেওয়া বেআইনি। জোর করে কাউকে তোরা আটকে রাখতে পারিস না। পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি, এর মধ্যে দমকলের লোকদের যদি তোরা ছেড়ে না দিস, তা হলে বাধ্য হয়ে আমাকে অ্যাকশন নিতে হবে।’

একজন অল্পবয়সি ছেলে চিৎকার করে বলল, ‘লাঠি চার্জ করবেন? করুন তা হলে।’

ধৈর্য হারিয়ে পুলক দে তাকে বললেন, ‘মকবুল, তোকে আমি চিনি। তুই গোবরায় থাকিস। এখানে কী করছিস? শূয়ারের বাচ্চা, তোর এগেনস্টে ড্রাগ কেস আছে। দাঁড়া, আজই তোকে তুলে নেবো।’

শুনে মকবুল বলে ছেলেটার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। ওকে বাঁচাতে এগিয়ে এল আসফাক। নিঃশব্দে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, শিখিন লক্ষ্যই করেননি। ও বলল, ‘স্যার, আমরা কাউকে আটকে রাখিনি। আগুন নেভাতে গিয়ে দমকলের অফিসার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ওকে আমরা ক্লাবঘরে বসিয়ে রেখেছি।’

পুলক দে বললেন, ‘যা, এখুনি বাইরে নিয়ে আয়।’

সেই মুহূর্তে শিখিনের সঙ্গে চোখাচোখি হল ওসি-র। চোখের ইশারায় তিনি বোঝালেন, এ বার ব্যাটনটা আমাকে হাতে নিতে দিন। আসফাকের সঙ্গে অনিমেষদা বাইরে বেরিয়ে আসার পর ভিড়ের দিকে তাকিয়ে শিখিন বললেন, ‘আপনারা কী চান, আমাকে বলুন।’

‘দমকল মন্ত্রীকে এখানে আসতে হবে।’

‘সে গ্যারান্টি আমরা দিতে পারব না। আপনাদের যদি কোনও অভিযোগ থাকে আমাকে বলুন। আমি দমকলের ডিভিশনাল অফিসার।’

উত্তেজিত গলায় একজন বলল, ‘দমকল এত দেরিতে এল কেন? জবাব দিন।’

শিখিন বললেন, ‘আপনাদের মধ্যে প্রথম যিনি দমকলকে খবর দিয়েছিলেন, তিনি সামনে আসুন।’

ভিড়ের মাঝখান থেকে কেউই এগিয়ে এলেন না। কেউ আসবে না, শিখিন জানতেন। সেইজন্যই প্রশ্নটা তিনি করেছেন। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন, আগুন লাগলে কোন নাম্বারে ফোন করতে হয়, নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট সাধারণ মানুষ তার খবর রাখে না। বহু বছর আগে পাড়ায় পাড়ায় দমকলের একটা বক্স দাঁড় করানো থাকত। লোকে বক্সের কাচ ভেঙে কাটা ঘোরালেই দমকল খবর পেয়ে যেত। এখন আর সেই বক্স নেই। ফোনেই সেই কাজটা হয়ে যায়। শিখিন অনেকবার ডিরেক্টর জেনারেলকে বলেছেন, একটা প্রচার অভিযান করা দরকার। যাতে লোকে অন্তত নিয়ারেস্ট ফায়ার স্টেশনের ফোন নাম্বারটা জানতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে কারও হেলদোল নেই।

জনতা চুপ করে আছে দেখে, শিখিন ফের বললেন, ‘আগুন কখন লেগেছিল, কেউ নোট করেছেন?’

একসঙ্গে কয়েকজন কথা বলে উঠলেন। কেউ বললেন, বিকেল চারটে, কেউ সাড়ে চারটে। হাত তুলে তাঁদের থামিয়ে শিখিন বললেন, ‘দমকলের কোন ফোন নাম্বারে আপনারা খবরটা দিয়েছিলেন?’

সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। কেউ কোনও কথা বলছেন না। দেখে শিখিন বললেন, ‘আমি বলে দিচ্ছি। আমাদের কন্ট্রোল রুমে প্রথম কার ফোন গেছিল।’ কথাটা বলেই তিনি ওয়াকিটকিতে ধরলেন কন্ট্রোল রুমের অফিসারকে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘পাইপ কলোনিতে আগুন লাগার খবরটা যিনি দিয়েছিলেন, তার ফোন নাম্বারটা আমাকে এখুনি জানান।’

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কন্ট্রোল রুমের অফিসার উত্তর দিলেন, ‘স্যার, সোনালি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে এক বয়স্কা মহিলা প্রথম খবরটা দেন। তার নাম সুনন্দা চ্যাটার্জি। কলোনির ধোঁয়া দেখে উনি প্যানিকড হয়ে গেছিলেন। ওঁনার মোবাইল নাম্বার নাইন এইটি থ্রি ওয়ান ওয়ান ফোর জিরো ওয়ান থ্রি টু। স্যার উনি ঠিক পাঁচটা পঁয়তাল্লিশে আমাদের ফোন করেন। পাঁচটা ছেচল্লিশে আমাদের প্রথম পাম্পটা বেরিয়ে যায়।’

আশপাশে যারা আছেন, তারা প্রত্যেকেই ওয়াকিটকির কথা শুনতে পাচ্ছেন। শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘পাইপ কলোনি থেকে কি কেউ ফোন করেছিল? ভাল করে দেখে বলুন।’

‘না স্যার, আর কোনও ফোন আসেনি। কেন স্যার, কোনও কমপ্লিকেশন হয়েছে? ওখানে কি আরও পাম্প পাঠাতে হবে?’

‘না, না। কিছু হয়নি। আগুন কন্ট্রোলে। আমরা আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে যাচ্ছি।’ কথাটা বলেই শিখিন ঘুরে তাকালেন ভিড়ের দিকে। ‘শুনলেন তো আপনারা? কোয়ার্টার মাইল দূর থেকে সুনন্দা চ্যাটার্জি বলে এক ভদ্রমহিলা ফোন করে প্রথম আমাদের জানান, এখানে আগুন লেগেছে। আপনারা যদি বলেন, সুনন্দা চ্যাটার্জিকে আমি ফোনে কনফার্ম করতে পারি। আপনারা কেউ দায়িত্ব পালন করেননি, অথচ আমাদের বিরুদ্ধে কমপ্লেন করছেন। আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত।’

পুলক দের মুখটা রাগে থমথম করছে। তিনি বললেন, ‘শূয়ারের বাচ্চা মকবুলটা কোথায় রে? ওর পাছায় আজ আমি রুল ঢোকাব। আমার সঙ্গে যেন ও থানায় গিয়ে দেখা করে।’

ভিড়ে চোখ বুলিয়ে শিখিন কোথাও মকবুলকে দেখতে পেলেন না। নিঃশব্দে ছেলেটা সরে পড়েছে।

(চব্বিশ)

ব্যাঙ্ককের কম্পিটিশনে দেবকে আটটা পোজ দিতে হবে। যাতে মাসলগুলো ঠিকঠাক দেখাতে পারে। যে কোনও কম্পিটিশনে এটা বাধ্যতামূলক। পোজ দেখে বিচারকরা নাম্বার দেন। আগে থেকে প্র্যাকটিস করে না রাখলে স্টেজে সমস্যা হয়। দেব বহুবার দেখেছে, মাসল ভলিউম ভাল থাকা সত্ত্বেও, অনেকে ঠিক দেখাতে না পারার জন্য হেরে যায়। সেই কারণে, চণ্ডীতলা থেকে ফিরেই দেব ফোন করেছিল কমলদাকে। ‘দাদা, একটু সময় করে যদি একবার আমার জিম-এ আসেন, তা হলে খুব ভাল হয়। পোজগুলো ঠিকঠাক দিচ্ছি কি না, কোনও ভুলভাল হচ্ছে কি না, দেখে একটু বলে দেবেন?’ কমল চৌধুরী নিজে মি. ইন্ডিয়া। বহুবার ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশনে জাজ হয়েছেন। দেব জানে, কম্পালসারি পোজগুলো তো বটেই, এক্সট্রা পোজ-এর আইডিয়া দেওয়ার মতো লোকও কলকাতায় খুব কম আছেন।

কমলদা বলেছিলেন, ‘হারামজাদা, অ্যাদ্দিনে তোর ঘুম ভাঙল? লোকে কম্পিটিশনের আট-ন’মাস আগে থেকে পোজ পারফেকশনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তোর হাতে তো মাস দুয়েকও বাকি নেই রে গাধা?’

কমলদার কথা বলার ধরনই এই রকম। তেল মারার মতো করে দেব বলেছিল, ‘আপনি ছাড়া আর কার উপরই বা ভরসা করা যায়, বলুন কমলদা? ভুলভাল শিখিয়ে যাবে। শুনেছিলাম, আপনি কলকাতায় নেই। তাই ডাকতে পারিনি।’

‘ঠিকই শুনেছিলি। রিটায়ার করার পর মেয়ের কাছে গেছিলাম। মাস দুয়েক আমেরিকায় কাটিয়ে এলাম। সে যাক, তোর জিম-এর খুব নাম শুনেছি। নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল। ডেকেছিস যখন, ঠিক আছে, নিশ্চয়ই যাবো। তবে যাতায়াতের গাড়িভাড়াটা দিয়ে দিস ব্যাটা।’

খুশি হয়ে দেব বলেছিল, ‘অনিরুদ্ধ বলে একজনকে আপনার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবো দাদা। সে গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবে।’

আজ বেলা দশটার সময় অনিরুদ্ধ যখন কমলদাকে নিয়ে সিলভার জিম-এ ঢুকল, তখন দেব ওয়ার্ক আউট সেরে ফেলেছে। ফ্লোরে অনিরুদ্ধই বোধহয় রটিয়ে দিয়েছিল, কমলদা আসছেন। কুড়ি-বাইশজন মেম্বার রয়ে গেছে ওঁকে দেখার জন্য। বহুদিন পর দেব সামনাসামনি দেখছে কমলদাকে। বয়স আশির কাছাকাছি। এখনও কী মজবুত বডিটা! ব্র্যান্ডেড টি শার্ট পরে এসেছেন, গায়ের সঙ্গে এঁটে বসে আছে। ওঁর বাইসেপস আর ফোর আর্মস দেখে দেবের হিংসে হল। জিম-এর দিকে নজর বুলিয়ে কমলদা বললেন, ‘দারুণ। এ তো দেখছি, আমেরিকার গোল্ড জিম-এর মতোই ইকুইপমেন্ট আছে রে। ইস, এই রকম একটা জিম আমাদের আমলে নর্থ ক্যালকাটায় থাকলে, আমার, মি. ইউনিভার্স হওয়াটা কেউ আটকাতে পারত না।’

দেব মৃদু হেসে বলল। ‘ঠিক ধরেছেন। গোল্ড-এর লোকেরাই ডিজাইন করে দিয়ে গেছে।’

‘এত টাকা ইনভেস্ট করল কে রে?’

‘আছেন একজন। পরে আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো।’

‘তুই যদি চাস, তাঁকে ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট করে দিতে পারি। আমরা আর টানতে পারছি না রে।’

কথাটা শুনে দেব সতর্ক হয়ে গেল। একবার মি. শরাফের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে কমলদারা ওঁকে চুষে খাবেন। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য ও বলল, ‘তা হলে শুরু করি?’

‘তার আগে আমার জন্য একটা টুল এনে দে। আজকাল হাঁটুতে ব্যথা হয়। খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না, ‘কমলদা বললেন।

কম্পিটিশনে কম্পালসারি পোজগুলোর মধ্যে প্রথমটা হল ফ্রন্ট ল্যাটারাল স্প্রেড। বিচারকরা সামনের দিক থেকে অনেকগুলো মাসল দেখেন। এটা এমন একটা পোজ, একনজ বডিবিল্ডার সম্পর্কে প্রথম ইম্প্রেশনটা পেয়ে যান বিচারকরা। শরীরের ভর দু’পায়ের উপর সমানভাবে দিয়ে ঘাড় সিধে করে দাঁড়াতে হয়। দু’হাত রিল্যাক্সড অবস্থায় কোমরে। কাঁধ আর ল্যাট মাসল কতটা চওড়া, সামনে থেকে তা দেখতে চান বিচারকরা। চেস্ট থিকনেস, ফোরআর্ম সাইজ, কোয়াড্রিসেপস ভলিউম আর তার সেপারেশন, সেইসঙ্গে কাফ মাসলও বিচার করেন। সাধারণত, স্টার বডি বিল্ডারদের মাসল ভলিউম প্রায় সমান সমান থাকে। তখন ব্যাকস্টেজে নিয়ে গিয়ে বিচারকরা খুঁটিয়ে প্রতিটা মাসল মাপেন। সেইসময় কোনও কম্পিটিটর যদি পেশি প্রদর্শনে সমান্য ভুলচুক করে, তা হলে আউট।

প্রথম পোজটা দেখে নাক সিঁটকোলেন কমলদা, ‘কিৎস্যু হচ্ছে না উল্লুক কোথাকার। তুই কি করে মি. ইন্ডিয়া হয়েছিলি রে? কে তোকে পোজিং শিখিয়েছিল? চণ্ডীতলার জগা বোধহয়। শূয়ারটা নিজে কিছু জানে না। তোকে শেখাবে কী?’

আশপাশে জিম-এর ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। কী ভাবছে কে জানে? কমলদার আমলের সব গুরুই বেআক্কেলে ছিলেন। নিজেরা একেকজন গ্রেট বডিবিল্ডার, কিন্তু কেউ কাইকে সহ্য করতে পারতেন না। কমলদার কথা আমল না দিয়ে দেব বলল, ‘কোথায় খামতি হচ্ছে, বলুন।’

‘তুই যখন ল্যাট মাসল বের করছিস, তখন বাইসেপস ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। তোর কাঁধে অত সুন্দর ডাবল মাসল, অথচ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আপার আর লোয়ার বডির কম্বিনেশন হচ্ছে না। জাজরা তোকে অত সময় দেবে না রে পাঁঠা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওপিনিয়ন ফর্ম করে ফেলবে। ব্যাঙ্ককে মেনলি তোকে যাদের সঙ্গে লড়তে হবে, তাদের প্লাস পয়েন্ট সম্পর্কে তোর কোনও আইডিয়া আছে?’

কয়েকদিন আগে হিমাদ্রি কথায় কথায় বলেছিল, আপনাকে লড়তে হবে ফিলিপিন্স আর ইন্দোনেশিয়ার দু’জন বডিবিল্ডারের সঙ্গে। পরে নেট খুঁজে তমাল ওই দু’জনের ছবি বের করেছিল। মনে পড়ায় দেব বিনীতভাবে বলল, ‘খুব সামান্য জানি। ফিলিপিন্সের ছেলেটার নাম রবার্ট ডি ভেগা। আর ইন্দোনেশিয়ার ছেলেটার নাম আসগর আলি। ওরাই আমার কম্পিটিটর হতে পারে।’

‘না না হতভাগা, আরও একজন আছে।’ বাধা দিয়ে কমলদা বললেন, ‘ওড়িশার একটা ছেলে। তার নাম সুবোধ সৎপথী। ওড়িশা গরমেন্ট ওকে স্পনসর করছে। ছেলেটা মাসখানেক আগে আমার জিম-এ এসে ভর্তি হয়েছে। আমি ওকে তৈরি করে দিচ্ছি। শোন, তিনজনের ওয়ার্ক আউটের ভিডিয়ো ক্লিপিংস আমার কাছে আছে। তুই চাইলে পাঠিয়ে দিতে পারি।’

শুনে সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে গেল দেব। এখনও পর্যন্ত ও জানে না, মি. এশিয়া প্যাসিফিক কম্পিটিশনে কারা বিচারক হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে যদি কমলদা থাকেন, তা হলে ওর কোনও চান্স নেই। বডিবিল্ডিং জগতে অনেক ধরনের পলিটিক্স হয়। নিজের জিম-এর ছেলেকে খেতাব জেতানোর জন্য কমলদার মতো কর্তারা অনেক দূর যেতে পারেন। তোর এটা নেই, সেটা নেই… বলে ওর মনোবল ভেঙে দিতে পারেন। ইস, আগে কমলদা সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। জগাদা বেঁচে থাকলে অবশ্য কমলদাকে ডাকার ওর কোনও দরকার হত না। মুহূর্তে দেব ঠিক করে নিল, ভুল শুধরে নেবে। কমলদাকে বিদায় জানানোর জন্য একটা অজুহাত খুঁজতে লাগল ও।

কম্পিটিশনে বাকি পোজগুলো হল, ফ্রন্ট ডাবল বাইসেপস, সাইড চেস্ট, রিয়ার ল্যাটারাল স্প্রেড, রিয়ার ডাবল বাইসেপস, সাইড ট্রাইসেপস, অ্যাবডোমিনাল অ্যান্ড থাই এবং একেবারে শেষে মোস্ট মাসকিউলার পোজ। কয়েক সেকেন্ড করে সময়। বছরের পর বছর ধরে একজন বডিবিল্ডারের সাধনার ফল ওই অল্প সময়ের মধ্যে নির্ধারিত হয়ে যায়। দেব একেকটা পোজ দিতে লাগল। আর দেখে নস্যাৎ করে দিতে থাকলেন কমলদা। শেষে বললেন, ‘এই বডি নিয়ে ব্যাঙ্ককে গিয়ে তুই কিছু করতে পারবি না দেব। তার চে’ আমাকে তিনমাসের জন্য ফি দিয়ে রাখ। হপ্তায় দু’দিন করে এসে তোকে পোজ শিখিয়ে যাবো।’

শুনে দেব মনে মনে বলল, ‘ফি’জ দিতে হলে আপনার মতো পুরনো আমলের ট্রেনার রাখব কেন? ওয়ার্ল্ডের বেস্ট লোকটার কাছে শিখব। শুনেছি, ভিডিয়ো কনফারেন্স মারফৎ ফিল হীথ বিভিন্ন দেশের বডিবিল্ডারদের ট্রেনিং দেন। সেই রকম একটা কোর্সে ভর্তি হয়ে যাবো। থ্যাঙ্ক ইউ কমলদা। আপনি এখন আসতে পারেন।’ মুখে অবশ্য কথাগুলো ও বলল না। উল্টে বলল, ‘আপনি যদি প্রোফেশনালি শেখান, তা হলে তো খুব ভাল হয়। পরে আপনাকে খবর দেবো।’

ঘণ্টাখানেক ধরে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কমলদা জিম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দেব মন খারাপ করে বসে রইল। ব্যাঙ্ককের কম্পিটিশনে ভাল রেজাল্ট করার আশায় ও বুঁদ হয়ে ছিল। রোজই ওয়ার্ক আউটের শেষে একবার করে ও পোজিং প্র্যাকটিস করত। এতটা খারাপ বলে কখনও ওর মনে হয়নি। কিন্তু ওর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে গেলেন কমলদা। কোনও ব্যাপারে দ্বিধায় পড়লে জগাদা বলতেন, ‘পাঁচজনের কাছে অ্যাডভাইস নিতে যাস না দেব। বরং নিজে ভাবার চেষ্টা করবি, হোয়াট ইজ রাইট। হু ইজ রাইট। দেখবি, তা হলেই একটা সমাধান খুঁজে পাবি।’ বডি বিল্ডিং নিয়ে কখনও মতলববাজি করতেন না জগাদা। সাফ কথা বলতেন বলে কমলদাদের সঙ্গে প্রায়ই ওঁর মতবিরোধ হত। বহুদিন পর কথাটা মনে পড়ায়, দেব ভাবতে লাগল, হু ইজ রাইট। কমলদা যদি সুবোধ সৎপথীর কথা উল্লেখ না করতেন, তা হলে ও ধরেই নিত, পোজিং নিয়ে যা বলছেন, উনি ঠিক।

গত এক ঘণ্টা ধরে ওকে নিয়ে কমলদার তামাশা যারা দেখেছে, তাদের কাউকে ডেকে মতামত নিলে কেমন হয়? তখনই ফ্লোরে ওর চোখে পড়ল শিখিনদাকে। দমকলের এই অফিসারকে ও তিন বছর ধরে দেখছে। উনি একটা সময় নামকরা ওয়াটারপোলো প্লেয়ার ছিলেন। খেলার জগৎ সম্পর্কে মানুষটার প্রচুর জ্ঞান। কথাবার্তা শুনে দেবের মনে হয়েছে, আলাদা চরিত্রের মানুষ। রুস্তমের সঙ্গে ঝামেলার দিন শিখিনদা বলেছিলেন, ‘বি স্ট্রং, বাট নট রুড।’ ‘বি প্রাউড, বাট নট অ্যারোগেন্ট।’ এই ধরনের সৎশিক্ষা দেওয়ার লোক এখন আর নেই বললেই চলে। ওঁদের মতো লোকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই পজিটিভ একটা ভাইভস পাওয়া যায়। কথাগুলো ভাবার সঙ্গে সঙ্গে দেব চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল। দু’ হাতে পাঁচ পাউন্ডের দুটো ডাম্বেল নিয়ে শিখিনদা হাতের ব্যায়াম করছেন। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি বললেন, ‘গেমসম্যানশিপ শব্দটা কখনও শুনেছ দেবদূত? স্পোর্টস ওয়ার্ল্ডে ইদানীং শব্দটা খুব চাল হয়েছে।’

গেমসম্যানশিপ কথাটা কখনও শোনেনি দেব। তবে স্পোর্টসম্যানশিপ কথাটা জানে। খেলোয়াড়সুলভ আচরণ করা। ও ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না শুনিনি। মানেটা কি শিখিনদা?’

‘তোমার কমলদা একটু আগে যা করে গেলেন, সেটাই গেমসম্যানশিপ। নিজের ছাত্রকে জেতানোর জন্য, তোমার মনোবল ভেঙে দেওয়ার কাজটা উনি করে দিয়ে গেলেন। টপ লেভেলের কম্পিটিশনে প্রায়ই দেখবে, একজন আরেকজনকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য এই রাস্তাটা বেছে নেয়। একটা একজাম্পল দিচ্ছি। ধরো, একটা ক্রিকেট ম্যাচে কোনও বোলার দুরন্ত ফর্মে টপাটপ উইকেট নিচ্ছে। সে রান আপ শুরু করার পর কোনও কোনও সময় দেখবে, ব্যাটসম্যান তাকে থামিয়ে দিয়ে, পিচ ঠুকে দিয়ে আসে অথবা আম্পায়ায়কে জানায় স্ক্রিনের পাশ দিয়ে লোক হেঁটে যাচ্ছে। আসলে সে বোলারের ছন্দ নষ্ট করার জন্যই কাজটা করছে। এটাকেই বলে গেমসম্যানশিপ। কিছু বুঝলে?’

শিখিনদার কথা শোনার জন্য পাশে দাঁড়িয়ে গেছে অনিরুদ্ধ আর হিমাদ্রি। অনিরুদ্ধ থাকতে না পেরে বলল, ‘কমলদার উপর আমার রাগ হচ্ছিল দেবদা। লোকটাকে আপনি আর ডাকবেন না।’

হিমাদ্রি বলল, ‘প্রায়ই আপনি আমায় বলেন, মি. ইন্ডিয়া কনটেস্টে কেন নামছি না। আসল কারণটা, কমলদার মতো মানুষগুলোর জন্য। নোংরামি করে এঁরাই বাংলার বডি বিল্ডিংয়ের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। অনেক আগেই আপনার উচিত ছিল, লোকটাকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া।’

শিখিনদা হেসে বললেন, ‘না হিমাদ্রি। আমাদের স্কুলের প্রণব স্যার বলতেন, বি হাম্বল বাট নট টিমিড। দেবদূতভাই তুমি যা করেছ, ঠিক করেছ। আমাদের সবার শুভেচ্ছা তোমার উপর রইল। মনে জোর আনো। ডেফিনিটলি তুমি ব্যাঙ্কক থেকে জিতে আসবে।’

শিখিনদাকে ঘিরে থাকা ভিড়টা হালকা হয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ করে দেব নিজের চেম্বারে এসে বসল। মি. ইন্ডিয়া খেতাব জেতার পর ও মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিল, সিলভার জিম-এর জন্য। তখন ওর আর ইচ্ছেই হয়নি, মি. এশিয়া প্যাসিফিক বা মি. অলিম্পিয়ার মতো কম্পিটিশনে নামার। প্রতি বছর মি. এশিয়া কনটেস্টে গেছে। তবে নতুন ইকুয়েপয়েন্ট কেনার তাগিদে। ওখানে বিশ্বের সেরা কোম্পানিগুলো আসে তাদের তৈরি বডি বিল্ডিং ইকুয়েমেন্ট বিক্রি করার জন্য। গত বছর বেঙ্গুলুরুতে মি. এশিয়া কনটেস্ট হয়েছিল। ওখানে একদিন জিম-এ ওয়ার্ক আউট করার সময় অনেকেই ওকে বলেছিল, ‘তুমি পার্টিসিপেট করছ না কেন? তোমার যা বডি, স্বচ্ছন্দে টাইটেলটা পেয়ে যাবে।’ তখনই দেবের মনে হয়। একটা বছর ধরে নিজেকে তৈরি করে, পরের বছর একবার চেষ্টা করে দেখবে। সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু কমলদা এসে ওর উচ্চাশায় জল ঢেলে দিয়ে গেলেন।

চেম্বারে বসে থাকার সময়ই মিলেনার ফোন পেল দেব। ওর গলায় উৎকণ্ঠা, ‘কাল রাতে গ্র্যান্ডপা বাড়ি ফেরেননি। আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে দেব।’

টেনশনে পড়ার মতোই ঘটনা। ওইরকম বয়স্ক একটা মানুষ, গেলেন কোথায়? মিলেনার মুখ দেব যা শুনেছে, তাতে ও জানে, কারোর সঙ্গে টাইগ্রান গ্রেগারিয়ানের সদ্ভাব নেই। মিলেনাকে ও জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যেতে পারেন বলে তোমার মনে হয়?’

‘বুঝতে পারছি না। কয়েক দিন ধরেই দেখছি, উনি খুব ডেসটার্বড। কাল সন্ধেবেলায় উনি বেরিয়ে গেলেন। ভাবলাম, মোকাম্বোতে ড্রিঙ্ক করতে গেছেন। আর ফেরেননি। কী করা যায় বলো তো?’

সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য দেব বলল, ‘তুমি চিন্তা কোরো না। মোকাম্বোর বারটেন্ডার গোমসকে আমি চিনি। ওকে একবার ফোন করে দেখছি। রোজ যায় যখন, তোমার গ্র্যান্ডপাকে তখন নিশ্চয়ই ও চিনবে।’

‘তুমি একটু খোঁজ করবে প্লিজ। কাল লাঞ্চের পর একবার গ্র্যান্ডপাকে শুধু বলেছিলাম, আপনাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তখন উনি রাগী মুখে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। আমার উপর রাগ করেই কি উনি চলে গেলেন?’

হতেও পারে। চট করে কেউ সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে চান না। টাইগ্রান চটে যেতেই পারেন। তবুও, দেব বলল, ‘আমার তা মনে হয় না। অন্য কারণ থাকতে পারে।’

‘পুলিশে কি একটা ডায়েরি করা উচিত?’

‘করতে তো হবেই। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা না কাটলে ওরা নিখোঁজ মানুষের কমপ্লেন নেয় না। আগে গোমসের সঙ্গে কথা বলে দেখি। তার পর তোমাকে ফোন করছি।’

মিলেনা লাইন ছেড়ে দেওয়ার পর দেব ফোন করল গোমসকে। বেলা প্রায় বারোটা বাজে। এই সময়টায় গোমস একটু ফাঁকা থাকে। প্রথম চান্সেই লাইনটা পেয়ে গেল দেব। ও প্রান্ত থেকে গোমস বলল, ‘গুড আফটারনুন দেবদা। হঠাৎ মাতালদের রাজ্যে ফোন। কী ব্যাপার?’

দেব হেসে বলল, ‘এক মাতালের খোঁজ নেওয়ার জন্য। হ্যারে, তুই টাইগ্রান গ্রেগারিয়ান বলে কাউকে চিনিস? স্টিফেন ম্যানসনে থাকে?’

‘চিনব না কেন? উনি তো আমাদের বার-এর শেষ সম্রাট। ভাল করে চিনি। কাল সন্ধেবেলায় একগোছা গোলাপ নিয়ে উনি আমাদের এখানে এসেছিলেন। খানিকক্ষণ পর সম্রাট সেলিমের কাছে আনারকলি এলেন। দু’জনে মিলে পানাহার সেরে রাত দশটার সময় চলে গেলেন। হঠাৎ ওঁর কথা জিজ্ঞেস করছেন?’

শুনে দেবের প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে। ও বলল, ‘কী যা তা বলছিস। আনারকলিটা কে?’

‘বলতে পারব না দেবদা। শুধু এটুকু বলতে পারি, কাল সাত-আট হাজার টাকার বিল করেছিলেন সম্রাট সেলিম। টাকাটা অন্য একজন স্পনসর করেছেন। তার নাম শুনলে আপনি চমকে উঠবেন। রুস্তম এ হিন্দ। তিনি বলে দিয়েছেন, একটা পয়সাও যেন টাইগ্রানের কাছ থেকে না নেওয়া না হয়। যত পেগই খান।’

রুস্তম! মানে মাস্তান রুস্তম!! মিলেনাদের ফ্ল্যাট হাতানোর জন্য শেষপর্যন্ত রুস্তম এই লেভেলে নেমে গেছে না কি? কমলদার গালিগালাজ ভুলে গেল দেব। ওর মনে হল, গ্র্যান্ডপা উধাও হওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই রুস্তমের হাত আছে। কিডন্যাপ করল না কি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *