স্টিফেন ম্যানসন – ১৫

(পনেরো)

ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে। অনেকদিন পর সকালে কোয়ার্টার্সে ব্রেক ফাস্ট বানাচ্ছিলেন শিখিন। এমন সময় ডোর বেলের শব্দ। দরজা খুলে শিখিন দেখলেন, অনিরুদ্ধ। ওর হাতে খবরের কাগজ। চোখ-মুখে উচ্ছ্বাস। বলে উঠল, ‘স্যার, আজকের কাগজটায় চোখ বুলিয়েছেন?’

ব্রেকফাস্ট-এর পর খবরের কাগজটা খুঁটিয়ে পড়েন শিখিন। আজকে ছুটি নিয়েছেন বলে, আরও তাড়া নেই। ধীরে সুস্থে কাগজটা পড়বেন, ভেবে রেখেছিলেন তিনি। কিচেন থেকে পাউরুটি পুড়ে যাওয়ার গন্ধ আসছে। টোস্ট খাবেন বলে সেঁকতে দিয়ে এসেছিলেন। দ্রুত কিচেনের দিকে পা চালিয়ে পেয়ে শিখিন বললেন, ‘না, এখনও কাগজ খুলিনি। কেন রে?’

‘স্যার আপনাকে নিয়ে বিরাট একটা খবর বেরিয়েছে।’ বলে কাগজটা এগিয়ে দিল অনিরুদ্ধ। ‘এই দেখুন, লিখেছেন, দমকল কর্মীর তৎপড়তায় কুয়ো থেকে মনোরোগী যুবক উদ্ধার।’

ওহ, গতকালের ওই বাঁশদ্রোণীর ব্যাপারটা। কী এমন খবর যে, কাগজে ফলাও করে লিখতে হবে! কাল বাঁশদ্রোণীতে তো কোনও সাংবাদিক চোখে পড়েনি। খবরটা ওরা পেল কী করে? হয়তো থানা থেকে পেয়েছে। কিংকর মনে হয়, দিয়েছে। কিচেনে পৌঁছে শিখিনের চোখে পড়ল, টোস্টার স্লাইসড পাউরুটি পুড়ে একেবারে কালো হয়ে গেছে। টুকরোটা বিন-এ ফেলে দিয়ে তিনি দেখলেন, পিছু পিছু অনিরুদ্ধও কিচেনে হাজির। ও জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনাটা কবে ঘটল স্যার? কই, আমাদের তো কিছু বলেননি?’

উত্তর না দিয়ে শিখিন জানতে চাইলেন, ‘তুই সকালের ডিউটিতে বুঝি? ব্রেকফাস্ট করেছিস?’

‘এখনও করিনি। কাগজ পড়ে ডিউটি রুমে সবাই খুব আনন্দ করছে। শিশিররা এখুনি এল বলে।’

‘তোরা আমার চাকরিটা খাবি দেখছি। শিশিরদের বারণ কর। ডিউটি রুম খালি রেখে যেন না আসে।’

‘আজ আগুন লাগবে না স্যার। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় অগ্নিদেবকে মনে মনে বলে এসেছি, আজ যেন আপনার খিদে না পায়। বলুন না স্যার, কাগজে যা লিখেছে, সত্যি? কুয়োর ভিতর থেকে রথীন বলে পাগল ছেলেটাকে তুলে আনার কায়দাটা আপনার মাথায় এল কী করে?’

‘পাগল শব্দটা বলিস না অনি। বল, মনোরোগী। ছোটবেলায় আমাদের মা দিদিমারা বলতেন, পাগলই একমাত্র পাগলের ভাল বোঝে। তখন পাগল কথাটা ব্যানড ছিল না। মা-দিদিমাদের বলা কথাটাই আমার মনে পড়েছিল। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে জেনে নিলাম, কাছাকাছি আর কোনও মেন্টাল পেসেন্ট আছে কি না। জানলাম, পাগলা পেট্রোল বলে আরও একজন আছে। ওএনজিসি-র ড্রিলিংয়ের সময় সে লেবারের কাজ করত। চাকরি চলে যাওয়ার পর ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। কে যেন বলল, ওর সঙ্গে চণ্ডীমন্দিরে রথীন রোজ গল্পগুজব করে। কমন সেন্স খাঁটিয়ে আমার মনে হল, কুয়োর রথীনের বসে থাকার কারণ, পেট্রোল হতে পারে। কুয়োর জলে সত্যিই পেট্রোল আছে কি না, ও পরীক্ষা করতে নেমেছে।’ বলে শিখিন হাসতে লাগলেন।

‘অ্যামেজিং স্যার। ঠিকঠাক গেস করেছিলেন। কিন্তু রথীনকে তুলে আনার জন্য পাগলা পেট্রলকে আপনি কুয়োর নামালেন কী বলে?’

‘বললাম, আমি ওএনজিসি-র বড়বাবু। এইমাত্তর খবর এসেছে, কুয়োর জলে পেট্রোল পাওয়া গেছে। তোমার চাকরি পাকা। রথীনের কাছে গিয়ে তুমি বলো, ওর আর রিসার্চ করার দরকার নেই। ওকেও ওএনজিসি চাকরি দেবে। পাগলা পেট্রোল কিছুতেই বিশ্বাস করে না। পকেট থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দিলাম। তার পর সুড়সুড় করে নীচে নেমে গিয়ে ছেলেটাকে ও ডেকে আনল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।’

‘কাগজে লিখেছে, ওদের দু’জনকে না কি আপনি মেন্টাল অ্যাসাইলামে পাঠিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, আমার সঙ্গে স্কটিশচার্চ কলেজে পড়ত অনাদি স্যান্নাল বলে একজন। এখন সে সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে নাম করেছে। ক্যামাক স্ট্রিটে ওর একটা মেন্টাল হেলথ ক্লিনিক আছে। রথীনদের সেখানে পাঠিয়েছি। ভাল কথা মনে করালি। আজ দুপুরে একবার ওদের খোঁজ নিতে হবে।’

শিখিন কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে শিশির ঘরে ঢুকে এসেছে। ওর পিছনে সঞ্জয়, ব্রজেন আর ফয়জানও। শিশিরের হাতে এক প্যাকেট মিষ্টির বাক্স। হাসিমুখে বলল, ‘সকালে কাগজে আপনার খবরটা পরে এত আনন্দ হল যে, মিষ্টি নিয়ে এলাম স্যার। দমকলের লোকদের তো কেউ সুখ্যাতি করে না। আমাদের ইম্পরট্যান্সটাও লোকে বুঝতে পারে না। লোকে আমাদের গালাগাল দিতে অভ্যস্ত। অন্তত একটা দিন তো কাগজ প্রশংসা করেছে। এই নিন স্যার, মিষ্টিমুখ করুন। আপনার ভাল লাগবে।’

শিশিরের প্যাকেটে ভীম নাগের নাম। ও থাকে বউবাজারের আরপুলি লেনে। ওর বাড়ির কাছেই সন্দেশের রাজা ভীম নাগের আদি দোকান। এর আগে একদিনই ও বিখ্যাত সন্দেশটা খাইয়েছিল। যেদিন ওর ছেলে হয়েছিল। উত্তর কলকাতায় জন্ম শিখিনের। ওখানে ভাল মিষ্টির দোকানের অভাব নেই। নকুড়, দ্বারিক ঘোষ, গাঙ্গুরাম, চিত্তরঞ্জন, নবীন দাস, সেন মহাশয়। কিন্তু বরাবর শিখিনের ধারণা, ভীম নাগের ক্লাসই আলাদা। হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে তিনি বললেন, ‘সন্দেশ এনে ভালই করেছিস। জমিয়ে ব্রেকফাস্ট হয়ে যাবে। সন্দেশের সঙ্গে মানাইসই কী হতে পারে, তোদের কারও আন্দাজ আছে?’

শিশির বলল, ‘স্যার, রাধাবল্লভী?’

‘গুড আইডিয়া। চট করে কেউ শ্রীলেদার্সের পাশের গলিতে চলে যায়। ওখানে দারুণ রাধাবল্লবী পাওয়া যায়। আলুর তরকারিটাও ওরা ভাল করে। গোটা পনেরো নিয়ে আয়।’

অনিরুদ্ধ বলল, ‘আমি কিন্তু খাব না স্যার। রাধাবল্লভী খেয়েছি শুনলে জিম-এর দেবদা আমাকে বকুনি দেবে। আমাকে স্টেট বডি বিল্ডিং কম্পিটিশনের জন্য প্রিপারেশন নিতে বলছে। আপনিও না খেলে ভাল হয় স্যার। শরীরচর্চা করেন, কার্বস নেওয়া ঠিক না।’

শিখিন বললেন, ‘একদিন খেলে কিছু হবে না। বিকালে একটু বেশি এক্সারসাইজ করে নেবো।’

‘ঠিক আছে স্যার। সঙ্গে বাইক আছে। আমি গিয়ে দোকান থেকে নিয়ে রাধাবল্লভী নিয়ে আসি। স্যার, আপনি ততক্ষণে এদের রথীনের গল্পটা বলুন।’

অনিরুদ্ধ বেরিয়ে যাওয়ার পর বাঁশদ্রোণীর ঘটনাটা ফের শিখিনকে বলতে হল। শুনে ফয়জান বলল, ‘ক্রাইসিসের সময় চিন্তা করে ঠিক ডিসিশনটা নেওয়াই আসল স্যার। যেটা আপনি পারেন। ফায়ার ফাইটিংয়ে আপনার সঙ্গে গিয়ে দু’একবার দেখেছি।’

ফয়জান ছেলেটা খুব কম কথা বলে। মন্ত্রীর কোটায় চাকরিটা পেয়েছিল, সবাই সেটা জানে। ওর বাড়ি পার্ক সার্কাস অঞ্চলে। খুব সাহসী ছেলে। তবুও কেমন যেন গুটিয়ে থাকে। উৎসাহ দেওয়ার জন্য শিখিন ওকে বললেন, ‘এটা কেন আমার মধ্যে রয়েছে, জানিস? ওয়াটারপোলো খেলতে গিয়ে শিখেছি। গোল করার জন্য জল থেকে লাফিয়ে উঠে যখন শট নিতাম, তখন দেখতাম, চার-পাঁচটা হাত আমাকে বাধা দেওয়ার মরীয়া চেষ্টা করছে। স্প্লিট অফ আ সেকেন্ড। ওইটুকু সময়ের মধ্যে আমাকে ডিসিশনটা নিতে হত, কোত্থেকে শটটা নিলে গোল হবে। আমাদের কোচ ছিলেন ভুবনেশ্বর পাণ্ডে। উনি সবসময় আমাকে বলতেন, মাথা থেকে নয়, হাত দিয়ে সিদ্ধান্তটা নিবি। মানেটা হল, মাথা থেকে ডিসিশনটা হাতে আসার জন্য যে সময়টুকু লাগে, সেটাও নষ্ট করবি না।’

সঞ্জয় বলল, ‘বাঃ, ভাল কথা বললেন তো স্যার। হাত দিয়ে চিন্তা করা!’

ব্রজেন খুব ভাল চা বানায়। ও কিচেনের দিকে চলে গেল। হঠাৎ শিশির জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার টেবলের উপর ফায়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এত সব বিদেশি বই দেখছি। আপনি এখনও পড়াশুনা করেন না কি?’

কথাটা বলে একটা বই তুলে নিয়ে ও পাতা ওল্টাতে লাগল। আড়চোখে তাকিয়ে শিখিন দেখলেন, বইটার নাম ‘সেফটি অ্যান্ড সার্ভাইভাল অন দ্য ফায়ারগ্রাউন্ড।’ রিসেন্টলি অ্যামাজন থেকে কিনেছেন। লেখকের নাম ভিনসেন্ট ডান। কাল রাতে ওই বইটাই তিনি পড়ছিলেন। শিখিন বললেন, ‘এই বইটা তোদেরও পড়া দরকার। নতুন অনেক কিছু জানতে পারবি। তবে, আমাকে পড়তে হচ্ছে তাগিদে।’

সঞ্জয় বলল, ‘মানেটা বুঝলাম না স্যার।’

শিখিন মৃদু হেসে বললেন, ‘তোরা কি জানিস, ফায়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল সার্টিফিকেট পাওয়া যায়? ডিভিশনাল অফিসার হওয়ার পর তৈরি হচ্ছিলাম, সেই পরীক্ষায় বসার জন্য। কিন্তু জেলার শহরগুলোতে থাকার জন্য নানা ঝামেলায় পড়াশুনোয় মন দিতে পারিনি। এই সার্টিফিকেটটা দেয় লন্ডনের এক ইউনিভার্সিটি। বছরে একবার করে পরীক্ষা হয় সারা পৃথিবী জুড়ে। সেই পরীক্ষায় বসার জন্য এ বার তৈরি হচ্ছি।’

‘সার্টিফিকেটটা নিলে আপনার কি লাভ হবে স্যার?

‘আরও উঁচু পোস্টে যেতে পারব, এই আর কী? আমার হাতে অবশ্য এখনও সময় আছে। রিটায়ার করতে বছর দশেক বাকি। যদি গ্রোবাল ডিগ্রিটা পাই, তা হলে মাইনে কড়িও বাড়বে। তবে পাশ করা সহজ নয়। ইন্ডিয়া থেকে হয়তো পরীক্ষা দেয় দশ-পনেরোজন। কিন্তু দু’একজনের বেশি পাশ করে না। বইগুলো কিনে আমার একটাই লাভ হয়েছে, ফায়ার ফাইটিংয়ে ডেভেলপড কান্ট্রিগুলো কত এগিয়ে গেছে, তা জানতে পারছি। এই যে ভদ্রলোক, ভিনসেন্ট ডান… সেফটির উপর বইটা লিখেছেন, ইনি নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার ভেঙে পড়ার পর তদন্ত কমিটিতে ছিলেন। সেলফে দ্যাখ, ভিনসেন্ট ডানের লেখা আরও দুটো বই আছে। ‘কলাপস অফ বার্নিং বিল্ডিং’ আর ‘স্ট্র্যাটেজি অফ ফায়ার ফাইটিং’। দুনিয়া কোথায় এগিয়ে গেছে, জানতে পারবি।’

শিশির বলল, ‘ইউ টিউবে সেদিন দেখলাম, ফায়ার ফাইটিংয়ের জন্য প্রচুর নতুন ইকুইপমেন্ট বেরিয়েছে। এমন একটা পাম্প বেরিয়েছি, যা থেকে জল ছুঁড়ে পাঁচশো মিটার দূরের আগুনও নেভানো যায়। স্যার, আমাদের দেশে এ গুলো কেনা হয় না কেন?’

‘প্রচুর দাম। তবে ছোট ইকুইমেন্টগুলো তো কেনাই যায়। যেমন ধর, আগুন লাগার পর হাই রাইজ বিল্ডিংয়ে যেসব জায়গায় মানুষ ঢুকতে পারে না, সেখানে রোবট ফায়ার ফাইটার পাঠানো। ড্রোন উড়িয়ে জল দেওয়া। এ সব কেনা যেতেই পারে। লোকাল ম্যানুফ্যাকচার দিয়েই তৈরি করানো যেতে পারে। আমাদের বিজ্ঞানীরা চন্দ্রযান তৈরি করে পাঠাচ্ছে। এ সব ইকুইপমেন্ট তো তাঁদের কাছে কিছুই না। একটা কথা পলিসি মেকারদের মাথায় কেন আসে না, জানি না। আগুন যখন ছোট, তখন মানুষের বন্ধু। আর আগুন বিরাট, তখন সে মানুষের চরম শত্রু। অগ্নিদেব তখন সর্বগ্রাসী। দেখছিস না, এই মুহূর্তে ব্রাজিল আর অস্ট্রেলিয়ায় কী হচ্ছে। মাইলের পর মাইল দাবানলে জ্বলে যাচ্ছে।’

সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, আপনি না কি অগ্নিদেবকে খুব মানেন? বাড়িতে না কি ছবিও টাঙিয়ে রেখেছেন। কোথায় সেটা স্যার?

‘বেডরুমের দেওয়ালে টাঙানো আছে। যা গিয়ে দেখে আয়। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি অগ্নিদেবের কাছে প্রার্থনা করি, প্রাণীজগতকে রক্ষা করুন। বৈদিক যুগে মুনি-ঋষিরা বলে গিয়েছেন, আপনিই হচ্ছেন রক্ষাকর্তা। শুনলে তোরা হয়তো হাসবি, ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি ওঁর মনের কথা বুঝতে পারি। বেশ কিছুদিন ধরে আমার কী মনে হচ্ছে জানিস, উনি খুব শিগগিরই আবির্ভূত হবেন। ওঁর উপস্থিতিটা এমনভাবে টের পাওয়াবেন, আমরা কল্পনাও করতে পারব না।’

শিশির এরই মধ্যে বেডরুমে ঢুকে দেওয়াল থেকে অগ্নিদেবের ছবিটা খুলে নিয়ে এসে টেবলের উপর রেখেছে। সবাই ঝুঁকে পড়ল ছবিটা দেখতে। কুড়ি বছর আগেকার ঘটনা। শিখিনের স্পষ্ট মনে আছে দিনটার কথা। থার্ড ফেব্রুয়ারি নাইন্টি সেভেন। তখন তিনি হাওড়ার ডুমুরজোলায় পোস্টেড। ময়দানের বইমেলায় ফায়ার ফাইটিংয়ের উপর লেখা বই কেনার আশায় এসেছিলেন। বিকেলের দিকে ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে দাঁড়ান লিটল ম্যাগিজিনের স্টলগুলোর সামনে। কাছেই গ্রামের পটুয়ারা ছবি বিক্রি করছিল। সেখানে অলস চোখ বোলানোর সময়, দুর্গা, কালী, শিব, মনসার পটচিত্রের মাঝে হঠাৎ অগ্নিদেবের ছবিটা শিখিন দেখতে পান। ক্যানভাসের উপর আঁকা। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ছাগলের উপর সওয়ারি হয়ে অগ্নিদেব বসে আছেন। তাঁর দুটো মুখ, চার হাত। মাথা থেকে আগুনের লেলিহান শিখা বেরোচ্ছে। ছবিটার দিকে কয়েক মিনিট শিখিন তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখেন, বইমেলায় আগুন লেগে গেছে। বিশাল প্যান্ডেল দাউদাউ করে জ্বলছে। ব্যাপারটা খুব সিগনিফিকেন্ট মনে হয়েছিল শিখিনের। অগ্নিদেবের ছবিটা সেদিন কিনে নেন একশো টাকা দিয়ে। কোনও দর কষাকষির মধ্যে যাননি।

‘স্যার, অগ্নিদেবের বাহন ছাগল কেন?’ প্রশ্নটা করল শিশির।

শিখিন বললেন, ‘ভাল প্রশ্ন করেছিস। বৈদিক যুগে মানুষ যজ্ঞ-হোমের সময় দেবতাদের কাছে নানা ভোগ্যবস্তু উৎসর্গ করত। বিশেষ করে, ছাগল। অগ্নিদেবের কাজটা ছিল সেগুলো দেবতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। ঠিক জানি না, তবে আমার মনে হয়, এই কারণেই ছাগল অগ্নিদেবের বাহন।’

অগ্নিদেবকে নিয়ে শিখিন অনেক চর্চা করেছেন। সোৎসাহে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কিচেন থেকে মোবাইল ফোনের রিং টোন শুনতে পেলেন তিনি। দ্রুত পায়ে কিচেনে গিয়ে সেটটা তুলেই শিখিন দেখলেন, পর্দায় ঈশিতার নাম। ও বলল, ‘আঙ্কল, বাঁশদ্রোণীর খবরটা কাগজে দেখলাম। বাড়িতে সবাই খুব এক্সাইটেড। রাখী মাসিও এসেছিল। আপনার খুব প্রশংসা করে গেল মায়ের কাছে।’

ঈশিতা রোজ একবার করে রাখীর প্রসঙ্গ তোলে। ও কি ইচ্ছে করেই পুরনো স্মৃতি উসকে দেয়। কথাটায় পাত্তা না দিয়ে শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্টিফেন ম্যানসনের খবরটা কি বেরিয়েছে তোমাদের কাগজে?’

‘না, এখনও বেরোয়নি। আমি এখনও স্টিফেন ম্যানসনে যাওয়ার সময় পাইনি। আশ্চর্যের কথা কি জানেন আঙ্কল, রাখী মাসি কিন্তু স্টিফেন ম্যানসনেই একটা কল সেন্টারে চাকরি করে। বলেছে, আমাকে একদিন নিয়ে যাবে। যাক সে কথা। আমাকে এখন অফিসে বেরোতে হবে। ছাড়ি তা হলে?’

আবার রাখী মাসি! ‘আচ্ছা’। বলে বিরক্তির সঙ্গে লাইনটা কেটে দিলেন শিখিন।

(ষোলো)

বেলা দশটার সময় পার্টি অফিসে এসে রুস্তম জানতে পারল, আবিদ ভাইজান নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছেন। বিজন খাল্লাস… ভালো এই খবরটা দেওয়ার জন্য কাল রাতে ও ভাইজানের কাছে বার তিনেক ফোন করেছিল। কিন্তু রিং হয়েই গেছে কেউ তোলেনি। তখন রুস্তম ভেবেছিল, ভাইজান হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। আজ ববির মুখে আচমকা এই দুঃসংবাদ শুনে ও হতভম্ব হয়ে গেল। পার্টি অফিস একেবারে ফাঁকা। শুধু কম্পিউটারের সামনে ববি বসে। কী হয়েছে জানতে চাওয়ায়, ও বলল, ‘শুনেছি, হার্ট অ্যাটাক।’

কাল বিকেলেও আবিদ ভাইজানের মধ্যে অসুস্থতার কোনও লক্ষণ দেখেনি রুস্তম। ষাটের উপর বয়স। বরাবর হাই ব্লাড প্রেসার, হাই সুগারের রোগী। দিনে আট-দশটা করে ক্যাপসুল খেতেন। দু’বার করে ইনসুলিন নিতেন। কিন্তু কোনও ডাক্তারি বাধানিষেধ মানতেন না। রোজ বিরিয়ানি, তেল মশলার মাটন, নানারকম ভাজাভুজি খেয়েই যেতেন। দিনে দু’প্যাকেট করে সিগারেট। তার উপর ফালতু টেনশন। তোলাবাজি নিয়ে ঝামেলা, এরিয়া দখল নিয়ে মারামারি, পুলিশকে হাতে রাখা, পার্টির উপরের তলার লিডারদের মন জুগিয়ে চলা। হার্ট অ্যাটাক হওয়া স্বাভাবিক। সেটা কতখানি গুরুতর, সেটা আগে জানা দরকার। ভাইজানের খারাপ কিছু হয়ে গেলে, একটা শূন্যতা দেখা দেবে। ভাইজানের জায়গাটা নেওয়ার জন্য অনেকেই মুখিয়ে আছে। অন্য কেউ দায়িত্ব পেলে, রুস্তমের গুরুত্ব কমে যাবে। ববিকে ও জিজ্ঞেস করল, ‘কোন নার্সিং গেছে জানিস?’

‘ইলিয়ট নার্সিং হোমে। পরেশ লস্কর একটু আগে এখানে ফোন করেছিল। আপনাকে চাইছিল। বলল, সিভিয়ার অ্যাটাক। ভাইজানের অবস্থা না কি ভালো না।’

পরেশ লস্কর এই অঞ্চলে পার্টির বড় নেতা। ট্যাংরায় থাকেন। উনি খোঁজ করছিলেন শুনে রুস্তমের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলল, অবস্থা খুবই গুরুতর। এখখুনি ওর নার্সিং হোমে চলে যাওয়া উচিত। হয়তো ভোরবেলা থেকেই ওর মতো পার্টির কর্মীরা নার্সিং হোমে গিয়ে হাজির হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে পরে হিসেবনিকেশ হয়, কে কত আগে নার্সিং হোমে গিয়ে হাজির হয়েছিল। কে ভাইজানের কত বড় অনুগামী। ওর অনুপস্থিতি হয়তো পরেশ লস্করের চোখে পড়ে গিয়েছে। ববিকে ও বলল, ‘খবরটা তুই কখন পেয়েছিস?’

ববি বলল, ‘এই মিনিট পাঁচেক আগে আঙ্কল। আপনাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আসফাকভাই বলল, ডিসটার্ব না করতে। কাল রাতে না কি আপনারা দু’জন অনেক দেরিতে বাড়ি ফিরেছেন।’

শুনেই আসফাকের উপর রাগ হল রুস্তমের। শালা বেওকুফ। কোনও বুদ্ধি নেই। অনেক দূর পর্যন্ত ভাবতে পারে না। ভাইজানের ইন্তেকাল হলে, ওদের কী হতে পারে, সে সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। মাথার উপর থেকে ছাতাটা সরে গেলে, হয়তো বিজনের মার্ডার কেসেই পুলিশ ওদের ভিতর ঢুকিয়ে দেবে। ওরা যে কাল করিম বক্স লেনে গেছিল, তার উইটনেস হল নন্দু। শুয়ারের বাচ্চাটা বোমা ছুঁড়েছিল। আল্লার দোয়ায় বোমাটা ডাইভ মেরে লুফে নিয়েছিল ও। একটা ভল্ট খেয়ে, উঠে দাঁড়িয়েই রুস্তম বোমাটা পাল্টা ছুঁড়ে মেরেছিল একতলার ছাদে। তার পর নন্দুর কী হয়েছে, সে খবরটা এখনও পায়নি। নার্গিসের কাছে পেয়ে যাবে। এখন যেটা দরকার, পার্টিতে ওর অবস্থান মজবুত করার। আসফাককে সঙ্গে নিয়ে সেজন্য ওকে যেতে হবে নার্সিং হোমে। আসফাককে কাল রাতে ও এই পার্টি অফিসেই নামিয়ে দিয়ে গেছিল। রুস্তম তাই জিজ্ঞেস করল, ‘আসফাক এখন কোথায়?’

বলতে না বলতেই আসফাক এসে হাজির। এক গাল হেসে ও বলল, ‘সালাম ওস্তাদ। কাল রাতে তোমার যা ফরমা দেখলাম, লা জবাব।’

ঠাস করে একটা চড় মারতে ইচ্ছে হল রুস্তমের। রাগটা দমন করে কঠিন গলায় ও বলল, ‘নার্গিসের সঙ্গে পরে তোর কথা হয়েছে?’

মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে, গেল আসফাকের। বলল, ‘একটু আগে আমাকে ও ফোন করেছিল। বলল, বিজনের বাড়িতে না কি ডাইরেক্ট লালবাজার থেকে পুলিশ গেছে। বাড়িত যারা ছিল, প্রত্যেকের সঙ্গে পুলিশ কথা বলেছে। পুলিশের ধারণা, ডাকাতি করতে এসেই বিজনকে কেউ খুন করে গেছে। আলমারিতে না কি দশ লাখ টাকা ছিল।’

‘পুলিশকে নার্গিস কী বলেছে?’

‘তাজ্জব কী বাত, নার্গিস যে রাতে বিজনের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল, তা কেউ লক্ষই করেনি। ফলে পুলিশ দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করে ওকে ছেড়ে দিয়েছে।’

‘নন্দুর কী হয়েছে, শুনলি কিছু?’

‘খাল্লাস। পেটের নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে… ছাদে পড়েছিল। আমাদের ভয়ের কিছু নেই। চলো ওস্তাদ, এ বার নার্সিং হোমে যাই।’

শুনে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করল রুস্তম। ববিকে বলল, ‘পার্টি অফিসে তালা লাগিয়ে তুই স্কুলে চলে যা। কেউ চাইলে, সে যে-ই হোক, বলবি, চাবি রুস্তম ভাইয়ের কাছে আছে। মনে থাকবে?’

‘ইয়েস আঙ্কল।’

…মিনিট দশেক পর ইলিয়ট নার্সিং হোমে ঢুকেই রুস্তম বুঝতে পারল, আবিদ ভাইজান আর নেই। গেট থেকে রিসেপশন পর্যন্ত লোক গিজগিজ করছে। সবার মাথায় ফেজ। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে রুমাল বের করে ও মাথায় জড়িয়ে নিল। এই নার্সিং হোমের অনেকেই ওকে চেনে। আগে এখানে একটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাহেবের বাড়ি ছিল। সেটা কিনে মিসেস বিলমোরিয়া যখন নার্সিং হোম বানান, তখন রুস্তম অনেক হেল্প করেছিল। কোনও দরকার পড়লে এখনও উনি ডেকে পাঠান। মাসখানেক আগে এক পেসেন্ট পার্টির আত্মীয়রা ডাক্তারবাবুর গায়ে হাত তুলেছিল। মিসেস বিলমোরিয়া খবর দিতেই, রুস্তম সেই পেসেন্ট পার্টির বাড়িতে গিয়ে এমন হামলা করে যে, ক্ষতিপূরণ দিয়ে ওরা ডেডবডি ছাড়িয়ে নিয়ে যায়।

রিসেপশনের দিকে এগোনোর সময় রুস্তম দেখতে পেল, দূরে লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবু কথা বলছেন আবিদ ভাইজানের আব্বু আর পরেশ লস্করের সঙ্গে। ভাইজানের আব্বু কেঁদে কী যেন বলছেন। আর তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন পরেশদা। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ওকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে পরেশদা বললেন, ‘কালকের ঘটনা সব আমার কানে এসেছে। ওয়েলডান রুস্তম। তোর মতো সাহসী ছেলেই এখন পার্টিতে দরকার।’

কালকের ঘটনা, মানে বিজনের মার্ডার না কি! পরেশদা জানলেন কী করে? ও কৌতূহলী চোখে তাকাতেই পরেশদা বললেন, ‘কাল সন্ধেবেলায় আবিদের কাছে সব শুনেছি। ওকে চমকাতেই তোদের পার্টি অফিসে গেছিলাম। অনেকদিন ধরেই তোলার টাকার পার্সেন্টেজ ও পার্টির ফান্ডে দিচ্ছিল না। সেই টাকায় উলুবেড়িয়ায় ও বিঘের পর বিঘে জমি কিনছিল। বিজনের বাড়ির কাছে একটা পাঁচতলা বাড়ি প্রোমোট করছিল। হাই কমান্ডের সঙ্গে কথা বলে আবিদটাকে এমন ভয় দেখিয়ে এসেছি, নিতে পারেনি। হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।’

ভাবলেশহীন মুখে পরেশদা কথা বলে যাচ্ছেন। আর মনে মনে জট ছড়াচ্ছে রুস্তম। তা হলে বিজনকে মার্ডার করতে বলার পিছনে, বদলা নেওয়া ছাড়া আরও একটা উদ্দেশ্যও ভাইজানের ছিল। ওই পাঁচতলা বাড়িটাতে নিরাপদে যাতায়াত করা! যত বড় নেতা, তত বড় মতলববাজ। পরেশদার মনে কী আছে, কে জানে? প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে রুস্তম বলল, ‘ভাইজান কখন মারা গেছে?’

পরেশদা বললেন, ‘ভোর পাঁচটার সময়। ডাক্তারবাবু এই ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিল। শোন ভাই, বেলা একটার সময় আবিদের ডেড বডি নিয়ে বেরোব। দাফনের সময় হাজার দুয়েক লোক যেন থাকে। রুটটা তুই চট করে ভেবে নে। সূরজ তেওয়ারি মাতব্বরি করতে এসেছে। তুই ওকে পাত্তা দিবি না। দরকার হলে তোর ছেলেপেলেদের দিয়ে ওকে বের করে দে। পুরো দায়িত্বটা আমি তোকে দিলাম। আমি এখন ট্যাংরার পার্টি অফিসে যাচ্ছি। তোর ফোন পেলে গোবরার কবরখানায় চলে যাবো।’

পরেশদার কথাগুলো শুনে মনের জোর অসম্ভব বেড়ে গেল রুস্তমের। হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ও বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না পরেশদা। দাফনের সব ব্যবস্থা আমি করে ফেলছি।’

ইচ্ছে করেই পরেশদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে রুস্তম গেট দিয়ে বেরিয়ে এল। তার পর পার্কিং স্পেস পর্যন্ত এগিয়ে, হাসিমুখে পরেশদাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ফেরার সময় ও দেখল, পরিচিত অনেকগুলো মুখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও দেখাতে চাইছিল, পরেশদার হাত ওর মাথার উপর আছে। সেই উদ্দেশ্যে আপাতত ও সফল। পার্কিং স্পেসে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশে রুস্তম বলল, ‘বেলা একটায় আমরা ডেডবডি নিয়ে বেরোব। যে যার পাড়ায় খবর দিয়ে দে। জানাজার নমাজ পড়ার সময় যেন লোক থাকে।’

কথাগুলো বলে ও ফের নার্সিং হোমের লাউঞ্জে ফিরে এল। ভাইজানের আব্বু একটা চেয়ারে বসে নিঃশব্দে কাঁদছেন। বয়স আশির কাছাকাছি। শক্তসমর্থ শরীর। শুধু চোখে পুরু কাচের চশমা। সেই চশমার ফাঁক দিয়ে অনবরত জলের ধারা নেমে আসছে। আশপাশে তাঁর নিকট আত্মীয় দাঁড়িয়ে। আব্বুজান এখনও উলুবেড়িয়ায় পৈতৃক ভিটেতে থাকেন। গোঁড়া মুসলমান বলতে যা বোঝায়, উনি তাই। উলুবেড়িয়ায় ওঁর বিশাল বাড়ির পাশেই মসজিদ। একটা সময় তিনি সেখানকার ইমাম ছিলেন। আব্বুজান এখনও লাঠি হাতে টুকটুক করে হেঁটে গিয়ে সেখানে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়ে আসেন। আবিদ ভাইজানের সঙ্গে রুস্তম বেশ কয়েকবার উলুবেড়িয়ায় গেছে। ওঁদের ক্রমবর্ধমান রমরমা নিজের চোখে দেখে এসেছে। একটু আগে পরেশদা ঠিকই বলে গেলেন। দু’নম্বরি না করলে একজন ইমামের ছেলের এত বিশাল সম্পত্তি হয় না।

হঠাৎ রুস্তমের মনে পড়ল, মাসছয়েক আগে উলুবেড়িয়ায় একদিন বিকেলে নদীর ধারে হাঁটার সময় আবিদ ভাইজান বলেছিলেন, ‘পলিটিকস আর ভাল লাগছে না রে রুস্তম। ভাবছি, কলকাতার পাট সব তুলে দিয়ে পাকাপাকি গাঁয়ে এসে থাকব। রোজ খুনখারাপি, লাল পার্টির সঙ্গে ঝামেলা… আর পারছি না।’

রুস্তম বলেছিল, ‘তা’লে আমাদের কি হবে ভাইজান?’

‘তোরাই পার্টির দায়িত্ব নিবি। জীবনে যা কিছু পাওয়ার আমি পেয়ে গেছি। আর টাকা পয়সার লোভ আমার নেই। পরেশ লস্কর আমার পিছনে লেগে রয়েছে। আমার নাম বিষিয়ে দিচ্ছে হাই কমান্ডের কাছে। আমার সব কিছু যদি চলে যায়, তা হলেও আক্ষেপ থাকবে না। কবর দেওয়ার জমিটাও আমি কিনে রেখেছি।’ কথাগুলো বলার পর সেদিনই আবিদ ভাইজান বাড়ির কাছে এক টুকরো জমি দেখিয়ে ছিলেন। ঠিক তার পাশেই না কি তাঁর আম্মিকে কবর দেওয়া হয়েছে।

কথাটা মনে পড়ায় রুস্তম দ্রুত পায়ে হেঁটে আব্বুজানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইজানকে কোথায় দাফন করবেন আব্বুজান? উলুবেড়িয়ায়?’

শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন আব্বুজান। কয়েক সেকেন্ড পর শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন।

রুস্তম বলল, ‘আমি ম্যাটাডরের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমার কয়েকটা ছেলেও আপনাদের সঙ্গে যাবে। উলুবেড়িয়ায় রওনা হওয়ার আগে বডিটা আমাদের দুটো পার্টি অফিসে নিয়ে যাবো।’

বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। আর সময় নষ্ট করার দরকার নেই। নার্সিং হোমের মুর্দাঘরে যে ছেলেটা কাজ করে, সেই রহমত রুস্তমের পরিচিত। সে এসে বলল, ‘রুস্তমভাই, আপনারা যত তাড়াতাড়ি পারেন ডেডবডিটা নিয়ে যান। সূরজ তেওয়ারি একটু আগে ডাক্তারবাবুকে ভয় দেখাল, ডেডবডি ওদের হাতে তুলে না দিলে নার্সিং হোম ভাঙচুর করবে। ডাক্তারবাবু আমাকে আপনার কাছে পাঠালেন।’

তিওয়ারির এত বড় দুঃসাহস! ও আবিদ ভাইজানের জায়গাটা নেওয়ার কথা ভাবছে না কি? না, সেটা হতে দেওয়া যায় না। দ্রুত চিন্তা করে রুস্তম বলল, ‘তুই একটা কাজ করতে পারবি রহমত? ডাক্তারবাবু আর তিওয়ারি দু’জনকেই মুর্দাঘরে নিয়ে আয়। কথা বলে দেখি। তার পর নার্সিং হোমের পিছনের গলি দিয়ে আমরা আবিদ ভাইজানকে নিয়ে বেরিয়ে যাবো।’

রহমত বেরিয়ে যাওয়ার পর কয়েকটা ফোন সেরে নিল রুস্তম। আজকের লড়াইয়ে ওকে জিততেই হবে। এমন নিষ্ঠুর ওকে হতে হবে, যাতে ওর বিরুদ্ধে কেউ আর মাথা তুলতে না পারে। ইলিয়ট নার্সিং হোমের প্রতিটি কোণ ওর চেনা। বেশ কয়েকবার ডেডবডি নিয়ে গেছে এখান থেকে। ও জানে, মুর্দাঘরটা বেসমেন্টে। লিফটে করে তাড়াতাড়ি নেমে যাওয়া যায়। তবুও, ধীরেসুস্থে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রুস্তম মুর্দাঘরে পৌঁছল। ঘরে ঢুকে ও দেখল, সূরজ তিওয়ারি খুব তড়পাচ্ছে। ডাক্তারবাবু চুপ করে ওর মাস্তানি সহ্য করে যাচ্ছেন। ওকে দেখেই তিওয়ারি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল, ‘তুই… তুই এখানে কেন?’

রুস্তম ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘তোকেও তো আমি এই প্রশ্নটা করতে পারি।’

‘আবিদ ভাইয়ের দাফন আমরা করব।’

‘পারলে ডেডবডি নিয়ে যা। আমি তো বারণ করিনি। এই রহমত, কোন ড্রয়ারে ডেডবডিটা রাখা আছে, গান্ডুটাকে দেখিয়ে দে। ভাল করে বডিটা দেখিয়ে দিস কিন্তু।’

মারাত্মক ঠান্ডা মুর্দাঘরে। হঠাৎ রুস্তমের মনে হল, গলায় দু’তিন পেগ ঢেলে এলে ভাল করত। কোমরে মাকারভ পিস্তলটা গোঁজাই আছে। ওটা আজ সকালে ফেরত দিতেই ও পার্টি অফিসে গিয়েছিল। কিন্তু তিওয়ারির মতো খুচরো মাস্তানের জন্য একটা বুলেট খরচা করবে কি না, ও বুঝে উঠতে পারল না। ড্রয়ার টেনে বের করছে রহমত। সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলি ওদের সামনে। ঝুঁকে ডেডবডি দেখছে তিওয়ারি। সেই সুযোগে ডাক্তারের গলায় ঝোলানো স্টেথিসকোপটা টেনে নিয়ে তিওয়ারির গলায় পেঁচিয়ে ধরল রুস্তম। পিছন থেকে এমন একটা ঝটকা দিল যে, তিওয়ারি ব্যালান্স হারিয়ে ছিটকে পড়ল মেঝেতে। ওকে উঠে দাঁড়ানোর সময়ই দিল না রুস্তম। ওর বুকের উপর চেপে বসে দু’হাতে দমাদম ঘুষি মারতে লাগল। তিওয়ারির মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। দেখে, মাথায় খুন চেপে গেল রুস্তমের। ও দু’হাতে গলা টিপে চাপ বাড়াতে থাকল। মিনিট কয়েক নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে তিওয়ারি শেষ পর্যন্ত আর যুঝতে পারল না। ওর শরীরটা নিথর হয়ে গেল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে রুস্তম হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘ভাইজানের ড্রয়ারে তিওয়ারির বডিটা আপাতত রেখে দে রহমত। রাতে এসে নিয়ে যাবো। আমি নার্সিং হোমের পিছনের গেটে ওয়েট করছি। ফোন করলে ভাইজানের বডিটা পৌঁছে দিবি।’

মুর্দাঘর থেকে বেরনোর সময় রুস্তমের চোখ গেল ডাক্তারবাবুর দিকে। মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। চোখের সামনে হয়তো অনেক মৃত্যু দেখেছেন উনি। কিন্তু এ রকম মৃত্যু কখনও দেখেননি। ভুল করে স্টেথিসকোপটা হাতে নিয়ে রুস্তম বেরিয়ে যাচ্ছিল। সেটা এগিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি।’

(সতেরো)

জানলার পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই মিলেনা দেখল, আকাশে ঘন কালো মেঘ। অন্যদিন জানলাগুলো খুলে দেয়। বাতাস যাতায়াত করার জন্য। কিন্তু আজ খুলে রাখতে ও ভয় পেল। হঠাৎ বৃষ্টি এলে জল ঢুকে সব ভিজিয়ে দেবে। টাইগ্রান গ্র্যান্ডপার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। চুপ করে ইজিচেয়ারে বসে থাকবেন। তবুও উঠে জানলা বন্ধ করবেন না। যেন এটা ওর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। বেলা ন’টা বাজে। একটু আগে গ্র্যান্ডপার ঘরে উঁকি মেরে মিলেনা দেখে এসেছে, উনি বিছানায় বসে একটা ফাইলের পাতা ওল্টাচ্ছেন। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। ফাইলটা একেবারে চোখের সামনে ধরে আছেন। তার মানে পাওয়ার বেড়েছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু কে বলতে যাবে? ও যদি বলতে যায়, গ্র্যান্ডপা মুখ খিঁচিয়ে উঠতে পারেন। হয়তো বিড়বিড় করে স্ল্যাং ইউজ করবেন।

সানডে… ছুটির দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মিলেনা স্নান করে নিয়েছে। ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছে। ওকে রেসিডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মিটিংয়ে যেতে হবে। নিয়োগী আন্টি বারবার বলে গিয়েছেন। হাঁটুর ব্যথা সত্ত্বেও, কাল সন্ধেবেলায় নীচের তলা থেকে উনি উঠে এসেছিলেন। অনুরোধ করে গেছেন, ‘আর চুপ করে বসে থাকলে চলবে না মিলেনা। এ বাড়িতে যা হচ্ছে, এ বার তা বন্ধ হওয়া দরকার। আজ লিফট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কাল ফ্লোরে আলো থাকছে না। নীচের তিনটে তলায় অচেনা লোকদের ভিড়। আর সার্ভেন্টস কোয়ার্টারগুলো তো এখন অ্যান্টিসোশ্যালদের ডেন। সবাই মিলে একটা কিছু করা দরকার।’

মিলেনাও তাই মনে করে। দিন কয়েক আগে নাজমা লিফটে আটকা পড়েছিল, সেই ঘটনার কথা জানিয়ে ও নিয়োগী আন্টিকে বলেছিল, ‘মিঃ কাজারিয়াকে আমরা সব জানাচ্ছি না কেন?’

স্টিফেন ম্যানসন যে কোম্পানি দেখাশুনো করে, মিঃ কাজারিয়া হলেন তার মালিক। ওঁর কোম্পানির লোকজনই কেয়ারটেকার, লিফটম্যান, আর সিকিউরিটি গার্ড। মিঃ কাজারিয়া অনেকগুলো জুটমিল আর টি গার্ডেনের মালিক। বছরে এক দু’বারের বেশি তাঁর দেখা পাওয়া যায় না। এই বাড়ি নিয়ে ওঁনার কোনও ইন্টারেস্ট আছে বলে মনে হয় না। অন্তত যে ক’বছর মিলেনা এখানে আছে, তাতে ওর তাই মনে হয়েছে। মিঃ কাজারিয়ার প্রসঙ্গটা ও তুলতেই নিয়োগী আন্টি বললেন, ‘ওঁকে জানিয়ে লাভ নেই। আমাদের এখানে একটা শক্ত লোকের দরকার। আমার হাসবেন্ড যখন বেঁচে ছিলেন, তখন একটা ধমকেই কাজ আদায় করে নিতেন। কেয়ারটেকাররা সব ভয়ে কুঁকড়ে থাকত। এভরিথিং ওয়াজ ইন অর্ডার। এখন তো ধমকানোর কোনও লোক নেই এ বাড়িতে।’

নিয়োগী আন্টির হাসবেন্ড কলকাতা পুলিশের বড় অফিসার ছিলেন। মিলেনা তাঁকে দেখেনি। ও কলকাতায় আসার বছর দুয়েক আগে তিনি মারা যান। ওঁদের মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। একটাই ছেলে, তিনি থাকেন ক্যামাক স্ট্রিটে নিজের ফ্ল্যাটে। তাই নিয়োগী আন্টি স্টিফেন ম্যানসনে একাই থাকেন। মাঝে মাঝে উনি উপরে উঠে আসেন। ইন্ডিয়ান কোনও স্পেশাল ডিশ রান্না করলে নীচে ডেকে পাঠান। কাল কথায় কথায় আন্টি বললেন, ‘আমার ছেলে রেসিডেন্টদের একটা মিটিং ডেকেছে। তুমি প্লিজ এসো। যেসব অসুবিধে তুমি ফেস করো, মিটিংয়ে বোলো।’

আগে কখনও এই ধরনের মিটিংয়ে যায়নি মিলেনা। গ্র্যান্ডপাই হাজির থাকতেন। মিটিংয়ে কী হত, তা জানার আগ্রহ বোধ করত না ও। মিটিংয়ের পর এ ব্যাপারে কেউ ফোন করলে, গ্র্যান্ডপার কথা শুনে মনে হত, ঝগড়া করে এসেছেন। ম্যানসনের চারটে ব্লকের সবাইকে মিলেনা ভাল করে চেনে না। বিশেষ করে, তিন আর চার নম্বর ব্লকের রেসিডেন্টদের। উত্তরদিকে ওঁদের জন্য আলাদা গেট পার্ক স্ট্রিটে। মিলেনাদের গেট পূর্বদিকে, মিডলটন রো-তে। দুটো গেটের মাঝে ড্রাইভ ওয়ে আছে। তার ধার দিয়ে গায়ে গায়ে লাগানো পাম গাছ আর নারকেল গাছ। বাড়ির আকারটা ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো। দু’নম্বর আর চার নম্বর ব্লকের মাঝে ফাঁকা। জায়গায় দোতলায় সার্ভেন্টস কোয়ার্টার, একতলায় গ্যারাজ।

পশ্চিম আর দক্ষিণদিকের জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই মিলেনা কলকাতার স্কাইলাইন দেখতে পায়। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ। এত বছর কলকাতায় আছে, অথচ কোনওদিন ওর যাওয়া হয়নি ওই ব্রিজটার উপর দিয়ে। মাঝে মাঝে নীল-সাদা আলো দিয়ে সাজানো হয় ব্রিজটাকে। রাতে তখন খুব ভাল লাগে দেখতে। দিনের বেলায় ওকে টানে পাশের কুইন্স ম্যানসন। বাড়িটা স্টিফেন ম্যানসনের মতোই বিশাল জায়গা জুড়ে। তফাত হচ্ছে, কুইন্স ম্যানসন ওদের বাড়ির মতো উঁচু নয়, মাত্র পাঁচতলার। আর মাঝে এখনও বিরাট সবুজ জমি আছে। সেখানে প্যান্ডেল বেঁধে মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান হয়। পার্ক স্ট্রিটের মতো অত ব্যস্ত রাস্তা নয়, মিডলটন রো-র অত আভিজাত্যও নেই। তাই কখনও সখনও মনে মনে মিলেনা আক্ষেপ করে, ইসস, ওদের ফ্ল্যাটটা যদি পার্ক স্ট্রিটের দিকে হত, তা হলে খুব ভাল হত।

…চার নম্বর ব্লকের ফিফথ ফ্লোরে মিটিং রুমে এসে ফের সেই কথাটাই মনে হল মিলেনার। করিডর দিয়ে হেঁটে আসার সময় পার্ক স্ট্রিটের দিকে ওর একবার চোখ পড়েছিল। ছুটির দিনেও অনবরত গাড়ি যাতায়াত করছে। উপর থেকে দেবদূতদের জিমটাকে দেখা যাচ্ছে। গতকাল দেবদূত ওকে বলেছিল, আজ ওদের দেশের বাড়িতে ও মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। জায়গাটা না কি বাই রোড কলকাতা থেকে এক-দেড় ঘণ্টা দূরে। দেবদূতের সঙ্গ আজকাল মিলেনার খুব ভাল লাগে। মাঝেমধ্যেই কাছাকাছি কোনও কফিশপে ওরা আধঘণ্টার জন্য দেখা করে। দেবদূত একবার রিকোয়েস্ট করলে মিলেনা হয়তো আজ ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ত সারাদিনের জন্য। অন্তত কয়েক ঘণ্টা তো মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারত। তার চেয়েও বড় কথা, নিজের চোখে দেখে আসতে পারত, বেঙ্গলি ফ্যামিলি কী রকম হয়। অ্যানার মুখে শুনে মিলেনার প্রচণ্ড আগ্রহ জেগেছে বেঙ্গলিদের সম্পর্কে।

মিটিং রুমে ঢুকে মিলেনা দেখল, প্রায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ জন রেসিডেন্ট এসে হাজির হয়েছেন। দূর থেকে হাত নেড়ে নিয়োগী আন্টি ওকে ইশারা করলেন, পাশের চেয়ারে ওর জায়গা রেখে দিয়েছেন। পাশে গিয়ে বসতেই আন্টি বললেন, ‘আজ মিঃ কাজারিয়া এসেছেন। ওই দেখো, পোডিয়ামে আমার ছেলের পাশে বসে আছেন। মাই সন ইজ কন্ডাক্টিং দ্য মিটিং। সামথিং উইল হ্যাপেন টুডে।’ মিলেনা এই প্রথম দেখল আন্টির ছেলেকে। বয়স চল্লিশ বিয়াল্লিশ হবে। লম্বা চওড়া চেহারা, গমগমে গলা। পুলিশ অফিসার বলে মনে হয়। বাস্তবে অবশ্য উনি তা নন। আন্টির মুখে মিলেনা শুনেছে, উনি একটা সিকিউরিটি এজেন্সির মালিক। ওর এমপ্লয়িরা নামকরা হাউসিং কমপ্লেক্সের সিকিউরিটি গার্ড।

মিটিংয়ে শেষপর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন জন এসে হাজির হয়েছেন। শুরু হতেই মিলেনা বুঝতে পারল, স্টিফেন ম্যানসনের রেসিডেন্টদের মধ্যে পরিষ্কার দুটো গ্রুপ আছে। বাড়িটার দুরবস্থার কথা বলতে শুরু করলেন আন্টির ছেলে। একটা রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সে কী করে একটা ওয়েল্ডিং কারখানা থাকতে পারে, কীভাবে একটা মেজেনাইন ফ্লোর গজিয়ে উঠল, সার্ভেন্টস কোয়ার্টারগুলো যারা থাকে, তাদের কোনও লিস্ট নেই কেন, দিনের পর দিন কেন জেনারেটর খারাপ হয়ে থাকে, রেসিডেন্টার কোনও অসুবিধের মধ্যে পড়লে কেন কেয়ারটেকাররা সঙ্গে সঙ্গে হাজির হন না… আন্টির ছেলে এই সব প্রশ্ন তুলে ধরতে লাগলেন। তাঁকে বাধা দিয়ে একজন বলে উঠলেন, ‘আপনারা কি জানেন, রাতে বিরাট ছাদটায় কারা এসে শুয়ে থাকেন? সারাদিন ফুটপাতে কাটানো সব লোকজন। আমরা কেউ জানতেও পারি না। ইমিডিয়েটলি ছাদের প্রত্যেকটা দরজায় তালা লাগানো উচিত।’

শুনে মিলেনার ভয় করতে লাগল। এমন একটা আনসেফ বাড়িতে ওরা থাকে, অথচ কারও কোনও হেলদোল নেই! একেকজন একেকটা অভিযোগ করছেন। খানিকক্ষণ পরে আন্টির ছেলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমাদের কাছে টপ প্রায়োরিটি হল লিফট। ওগুলো ইমিডিয়েটলি সারাই বা বদল করার জন্য একটা ফান্ড তৈরি করতে হবে।’

তখনই গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেল। মিঃ ধিংড়া বলে একজন চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘অ্যাবসার্ড প্রোপোজাল। ইউ নিড মোর দ্যান ওয়ান ক্রোর রুপিস টু চেঞ্জ ফোর লিফটস। দিস ইজ আ বিগ অ্যামাউন্ট অফ মানি। হু ইজ গোয়িং টু পে।’

কে একজন বলে উঠলেন, ‘অফ কোর্স মিঃ কাজারিয়া। হিজ কোম্পানি ইজ লুকিং আফটার দিস বিল্ডিং।’

‘সার্টেনলি আই ওন্ট।’ এতক্ষণে মুখ খুললেন মিঃ কাজারিয়া। ‘পার্ক স্ট্রিটের মতো জায়গায় আপনারা থাকেন। অথচ ভাড়া দেন সত্তর বছর আগেকার রেট-এ। কেউ পঞ্চাশ টাকা, কেউ চারশো টাকা। আপনারা ইচ্ছেমতো সাবলেট করে কামাচ্ছেন। আপনারা যা ভাড়া দেন, তাতে আমার কোম্পানি লস-এ রান করছে। নতুন করে ইনভেস্ট যদি করতেই হয়, তা হলে এখনকার রেটে আপনাদের ভাড়া দিতে হবে।’

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদের ঢেউ উঠল। মিঃ ধিংড়ার কাছাকাছি বসে থাকা বেশ কয়েকেজন বলতে থাকলেন, তাঁরা লিফট বদলানোর জন্য কন্ট্রিবিউট করবেন না। যত শুনছিল, মিলেনা অবাক হয়ে যাচ্ছিল। বাড়িটা বসবাসযোগ্য করে তোলার কথা কেউ তুলছেনই না। তার বদলে রেসিডেন্টরা ব্যক্তিগত কুৎসার দিকে চলে যাচ্ছেন। কেউ একজন বললেন, ‘মিঃ ধিংড়া, দু’নম্বর ব্লকের অর্ধেকটা তো আপনি দখল করেই ফেলেছেন। শোনা যাচ্ছে, আপনি না কি একটা গেস্ট হাউস করতে চান। এটা কি সত্যি?’

মিঃ ধিংড়া অভদ্রভাবে বললেন, ‘আপনি কে? আপনাকে উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।’

‘দু’নম্বর লিফটের পাশে যে ওয়েল্ডিং কারখানাটা আছে, সেটা না কি আপনার এক রিলেটিভের? আপনি কি জানেন, এটা রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স? এখানে ওসব চলতে পারে না।’

ধিংড়া বললেন, ‘কে বলছে, এটা রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্স? যান, আগে কর্পোরেশনে গিয়ে জেনে আসুন। আমাকে আইন দেখাবেন না।’

মিটিংয়ে কেউ কারও কথা শুনছেন না। তর্কাতর্কিতে কারও কথা ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না। মিলেনা অর্ধেক কথা বুঝতেই পারছিল না। তবুও, মিঃ ধিংড়ার উপর ওর রাগ হতে লাগল। ভদ্রলোক ওর ড্যাডির বয়সি। ওকে দেখেই মনে হচ্ছে, স্রেফ ঝগড়া করার জন্য এসেছেন। বাড়িতে ওঁর বেশ কিছু সমর্থক আছেন। তাঁরা ওঁকে সায় দিয়ে যাচ্ছেন। পাশ থেকে নিয়োগী আন্টি একবার বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললেন, ‘এই লোকটা সব ভালো কাজে বাধা দেয়। ভয়ানক মামলাবাজ। রেসিডেন্টাররা কোনও সিদ্ধান্ত নিলেই উনি কোর্ট থেকে ইনজাংকশন নিয়ে আসেন।’

এইসময় আন্টির ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দয়া করে আপনারা চেঁচামেচি থামান। বিল্ডিংয়ের সেফটির কথা ভাবুন প্লিজ। ডেঞ্জারাস ব্যাপার হল, এই বাড়ির ইলেকট্রিকাল ওয়ারিং পঞ্চাশ বছর আগেকার পুরনো। প্রতি ফ্লোরে গোছা গোছা ইলেকট্রিকের তার ঝুলে রয়েছে। বাড়িতে এর মধ্যে ইলেকট্রিক কনজাম্পশন অনেক বেড়ে গেছে। যে যেখানে পেরেছে, এসি মেশিন বসিয়েছে। যে কোনওদিন শর্ট সার্কিট হলে, রেসিডেন্টরা খুব বিপদের মধ্যে পড়বেন। মিঃ কাজারিয়া আপনাকে জানাচ্ছি, কয়েকদিন আগে কিন্তু দু’নম্বর লিফটে একবার আগুন লেগেছিল।’

মিঃ কাজারিয়া বললেন, ‘ইজ ইট? বাট নো বডি ইনফর্মড মি!’

‘আপনার কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করুন। সেদিন আমাদের ভাগ্য ভাল, আগুন ছড়ানোর আগেই দমকল এসে নিভিয়ে দেয়। ইমিডিয়েটলি আমাদের ইলেকট্রিকাল ওয়ারিং ঠিক করা দরকার। মিঃ কাজারিয়া, যদি খারাপ কিছু হয়, ইউ উইল বি হেল্ড রেসপন্সিবল। বুঝতেই পারছেন, হোয়াট আই মিন।’

মিঃ কাজারিয়া খুব শান্ত গলায় উত্তর দিলেন, ‘আমিও মনে করি, কনসিল্ড ওয়ারিং দরকার। নতুন মিটারও বসাতে হবে। পনেরো-ষোলো লাখ টাকার ধাক্কা। আমি খরচ করতে পারব না। তবে আমি পার্মিশন দিলাম, রেসিডেন্টরা সবাই মিলে যদি খরচ করতে চান, আমার কোনও আপত্তি নেই।’

আন্টির ছেলে ফের প্রশ্ন করলেন, ‘মিঃ কাজারিয়া, আজকেই একটা বেঙ্গলি নিউজপেপারে খবর বেরিয়েছে, স্টিফেন ম্যানসনের উপরের দিকের তিনটে তলা আনঅথরাইজড। কর্পোরেশনের অনুমতি নিয়ে না কি বানানো হয়নি। এটা কি সত্যি? কর্পোরেশন বলছে, ওই তলাগুলো ভেঙে দেবে।’

সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ের আওয়াজ উঠল হলঘর থেকে। মিঃ কাজারিয়া হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি জানি না। আমার কোম্পানি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনও নতুন ফ্লোর তৈরি হয়নি।’ যেন পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচেন, এমন ভঙ্গিতে ফের উনি বললেন, ‘এনি ওয়ে জেন্টেলমেন, আমাকে এখুনি উঠতে হবে। শিলিগুড়ি যাওয়ার প্লেন ধরতে হবে। আপনারা কী ডিসিশন নিলেন, আমাকে মেল করে জানিয়ে দেবেন।’

মিঃ কাজারিয়া বেরিয়ে যাওয়ার অল্পক্ষণের মধ্যে মিটিং ভেঙে গেল। একটাই মাত্র সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, রোজ রাতেরবেলায় ছাদের গেটগুলোতে তালা দিয়ে রাখা হবে। যাতে অবাঞ্ছিত কেউ শুয়ে থাকতে না পারে। বাড়ির ফেসলিফট করার জন্য একটা টাকাও দেবেন না, বলে মিঃ ধিংড়া দলবল নিয়ে চলে গেলেন। এতক্ষণ মোবাইল সুইচ অফ করে রেখেছিল মিলেনা। লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে সুইচ অন করে ও দেখল, শান্তা আন্টির তিনটে মিসড কল রয়েছে। আজ স্কুল নেই, তবুও আন্টি ফোন করলেন কেন মিলেনা বুঝতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে ও রিটার্ন কল করল। ও প্রান্ত থেকে আন্টি বললেন, ‘আজ সন্ধেবেলায় তুমি আসছ তো মিলেনা? তোমার কি মনে আছে, না ভুলে গেছো?’

সত্যিই মিলেনার মনে নেই। ও জিজ্ঞেস করল, ‘কেন আন্টি?’

‘তোমাকে তো বলেছিলাম, আজ আমার বাড়িতে ছোট একটা পার্টি আছে। খুবই লিমিটেড গেস্টস। তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে। যদি পারো, তা হলে দেবদূতকেও সঙ্গে নিয়ে এসো।

‘কোনও অকেশন আছে আন্টি?’

‘হ্যাঁ, আজ তোমার বার্থ ডে ডিয়ার। আমরা স্কুলের কয়েকজন মিলে সেলিব্রেট করব।’

শুনে মিলেনা অবাক হয়ে গেল। আজ যে ওর জন্মদিন, সেটা ঠিক। ছোটবেলায় ওর জন্মদিন পালন করা হত কি না, মিলেনার অত মনে পড়ে না। দিল্লিতে বন্ধুরা মিলে ওইদিন পার্টি করত। কিন্তু ওর জন্মদিনে পার্টি দেওয়ার কথা মাথায় এল কী করে শান্তা আন্টির! হয়তো স্কুলে ওর ডোসিয়ার থেকে ডেটটা উনি জানতে পেরেছেন। কারণটা খতিয়ে ভাবার কথা ওর মাথাতেই এল না। কৃতজ্ঞতায় ওর মন ভরে গেল। পার্টি হলে মন্দ না। কিন্তু দেবদূত আসবে কী করে? ও চণ্ডীতলায় গেছে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সন্ধের আগে ও কি ফিরতে পারবে? দেবদূতকে ফোনে ধরার চেষ্টা করতে লাগল মিলেনা।

(আঠারো)

চণ্ডীতলায় থাকার ইচ্ছে দেবের ছিল না। কিন্তু বিকেলে রয়াল এনফিল্ড বাইকটা নিয়ে যখন ও বেরিয়ে আসার কথা ভাবছে, তখন মা প্রচণ্ড বাধা দিল। মায়ের আপত্তি, সন্ধেবেলায় হাইওয়েতে বাইক চালাতে হবে না। ‘না, না, তোকে ছাড়ব না। এই তো কয়েক ঘণ্টা হল এলি। এর মধ্যে চলে যেতে চাইছিস? কী এমন কাজ আছে তোর কলকেতায়? আজ রাতটা অন্তত থেকে যা। কাল দিনের দিনে চলে যাস।’

রয়াল এনফিল্ড বাইকটা কেনার পরদিন থেকেই মায়ের আশঙ্কা, ‘অ্যাক্সিডেন্ট করে হাত-পা ভাঙবি।’ গাঁয়ের কার একবার হাইওয়েতে বাইক উল্টে গেছিল, তার পর থেকে মা চায়, ও ট্রেনে করে চণ্ডীতলায় যাতায়াত করুক। ভিড়ের মাঝে গলদঘর্ম হতে ভাল লাগে না দেবের। তার চাইতে সাবধানে বাইক চালিয়ে চণ্ডীতলায় আসা অনেক ভাল। কলকাতার রাস্তাঘাটের কথা তো মা জানে না। জানলে, বাইকে আগুন লাগিয়ে দিত। দেব মনে করে কলকাতার রাস্তায়… বিশেষ করে ট্রাম লাইন আছে যে রাস্তায়… যারা বাইক চালাতে পারে, তারা পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় চালাতে পারবে। এমনিতে, খুব স্পিডে বাইক চালায় না দেব। এখন তো আরও চালাবে না। কম্পিটিশনের আগে বডির কোনও জায়গায় সামান্য চোট বা ক্ষতের চিহ্ন থাকলে ওর চ্যাম্পিয়ন হওয়া অসম্ভব।

সত্যিই, কলকাতায় তেমন কোনও কাজ নেই দেবের। জিম-এর দায়িত্ব পাণ্ডেজির হাতে দিয়ে এসেছে। ঠিক টাইমে জিম খোলার কাজটা উনি করে দেবেন। ট্রেনাররা যদি কেউ কামাই না করে, তা হলে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এক, কামাই করার সম্ভাবনা আছে কোয়েলের। ওর মায়ের অবস্থা ভাল না। পেসমেকার না কি ঠিকঠাক কাজ করছে না। আজ সকালে চণ্ডীতলায় পৌঁছে দেব অবশ্য একবার জিম-এ ফোন করেছিল। পাণ্ডেজির মুখে তখন শুনেছে, কোয়েল এসেছে। কিন্তু বলে গেছে, কাল নাও আসতে পারে। শুনে পাণ্ডেজিকে দেব বলে দিয়েছে, ‘বিদিশাকে বলে রাখবেন। কোয়েল যদি অ্যাবসেন্ট হয়, তা হলে আট নম্বর জোন যেন বিদিশা সামলায়।’

কিন্তু বিদিশাকে বিশ্বাস নেই। কোয়েলের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা একেবারেই ভাল না। কোয়েলকে বিপদে ফেলার জন্য ও কোনও অজুহাত দিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে পারে। জোনে যদি কোনও ট্রেনার না থাকে, আর সেটা যদি আনন্দী ম্যাডামের কানে কেউ তুলে দেয়, তা হলে উনি মারাত্মক চটে যাবেন। ভদ্রমহিলা খুব কান পাতলা। আগে যেটা শোনেন, সেটাই বিশ্বাস করে নেন। সবার সামনে যা তা বলে দেন। ওঁকে বোঝাতে গিয়ে তখন দেবকে অসুবিধের মধ্যে পড়তে হয়। গত তিন বছরে তুচ্ছ কারণে ম্যাডাম দু’জন ট্রেনারের চাকরি খেয়েছেন। সেটা দেবের একদম ভাল লাগেনি। ও চায় না, এই দুরবস্থায় কোয়েল আনন্দী ম্যাডামের রোষের মুখে পড়ুক।

মাকে কষ্ট দিতে দেবের মন চায়নি। তাই চণ্ডীতলায় ও থেকে গেছে। একটা দিনের ট্রেনিং বরবাদ। সেইসঙ্গে ডেইলি ফুড চার্টও মানতে পারল না। কম্পিটিশনের আগে এইসময়টায় সিডিউল ঠিক রাখাটা উচিত একদিকে আবেগ, অন্যদিকে যুক্তি। মাঝামাঝি কোনও পথ নেই। তবুও, দেব ঠিক করে রেখেছে, চণ্ডীতলায় যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ আবেগকেই অগ্রাধিকার দেবে। মুখে হাসি যাতে না মিলোয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখবে। বাইক থেকে নেমে এসে যখন ও ড্রয়িং রুমে বসল, তখন মায়ের মুখটা আনন্দে চকচক করছিল। পাশের ঘরে গিয়ে মাকে বলতে শুনেছিল, ‘দেখলি তো রন্তি, খোকা এখন আমার কথা কতটা শোনে?’

কলকাতা থেকে মায়ের জন্য একটা গরদের শাড়ি আর রন্তিমাসির জন্য তাঁতের শাড়ি নিয়ে এসেছিল দেব। দিনের বেলায় সেসব দিতেই ভুলে গেছিল। ড্রয়িংরুমে বসে হঠাৎ সে কথা মনে হওয়ায় উঠে গিয়ে কিট ব্যাগটা ও কাছে নিয়ে এল। শাড়ি দুটো বের করে দিতেই মা বলল, ‘তুই কেমন ছেলে রে খোকা? এতক্ষণে তোর মনে পড়ল? বাইক নিয়ে যদি বেরিয়ে পড়তসি, তা হলে কী হত?’

লজ্জিত গলায় দেব বলল, ‘শাড়ির কথা মনে করার তুমি সময় দিলে কোথায় মা? বাড়িতে ঢোকার পর থেকে তো তুমি নানারকম হিসেব দিয়ে যাচ্ছ। এত ধান উঠেছে। এত আম-জাম-নারকোল বিক্রি হয়েছে। শাড়ির কথা আমার মনে থাকবে কী করে?’

মা বলল, ‘ও মা, তোকে জানিয়ে রাখব না! ওরে… আমি চলে গেলে তো বারো-ভূতে সব লুটে খাবে। এখন থেকে সব হিসেব রাখতে শুরু কর বাবা।’

‘চলে যাওয়ার কথা তুমি এখন মাথায় এনো না মা। যমরাজদার সঙ্গে আমার তা হলে মারপিট হয়ে যাবে। আপাতত, তুমি একটা কাজ করো তো মা। গোয়ালঘরটার যাচ্ছেতাই অবস্থা। ঘরামিকে ডেকে ঘরটা আগে ঠিক করো। আমি টাকা দিয়ে যাচ্ছি। দেখো, কমলার বাচ্চাটার যেন কোনও অসুবিধে না হয়।’

‘ঠিক বলেছিস, রাতের দিকে ইদিকে শেয়ালের খুব উপদ্রব। কাল কমলা বিয়োনোর পর থেকে কথাটা আমার মাথায় ঘুরছে। তোর সুকুমারদাকে বলব, মনিরুল ঘরামিকে যেন একবার খবর দেয়। কাল রাতে কমলা খুব ডাকছিল। বোধহয় শেয়াল ঘোরাঘুরি করছিল।’

গরদের শাড়ি হাতে নিয়ে মা খুব উচ্ছ্বসিত। শাড়ির গায়ে একবার হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে, কোত্থেকে কিনেছিস? পাড় আর আঁচলটা দারুণ। তোর বাবা একবার কলেজ স্ট্রিট থেকে আমায় গরদের শাড়ি এনে দিয়েছিল। সেটা অনেকদিন পরেছি। এখন ফেঁসে গেছে। ভাল করেছিস, এ বার অস্টুমির দিন এই শাড়িটাই পরব।’

সত্যি কথা বলতে, মায়ের শাড়িটা কিনে এনে দিয়েছে কোয়েল। এন্টালির কোনও শপিং মল থেকে। কিন্তু ওর নাম করলে মা ফের পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে শুরু করবে। তবুও দেব বলল, ‘শপিং মল থেকে কেনা মা। ওরা অর্ডিনারি শাড়ি রাখে না। এই শাড়িটার দাম চার হাজার টাকা। তোমার জন্য পছন্দ করে কিনে এনেছে কোয়েল।’

‘বলিস কী! এত দা-ম! তোর বাবা যখন কিনে দিয়েছিল, তকন সাড়ে তিনশো টাকা দাম নিয়েছিল। তবে এই শাড়িটা আরও সুন্দর। কোয়েলকে বলিস, আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’

‘তুমি নিজের মুখেই বলো না মা। ফোনে ওকে ধরে দেবো?’

‘দে। অনেকদিন ওর সঙ্গে কতা বলিনি।’

কোয়েলকে ফোনে ধরার চেষ্টা করতে লাগল দেব। রিং হচ্ছে, কিন্তু কেউ তুলছে না। বারতিনেক ব্যর্থ চেষ্টা করে দেব ফোনের সুইচ অফ করে দিল। মিসড কল দেখে কোয়েল নিশ্চয়ই রিং ব্যাক করবে। সন্ধের এই সময়টায় হপ্তায় তিনদিন ও ক্রিস্টোফার রোডে একজনের বাড়িতে যোগা শেখাতে যায়। সেই মহিলা না কি ট্রেনিংয়য়ের সময় কোয়েলকে কেউ ফোন করলে অসন্তুষ্ট হন। মাকে তাই ও বলল, ‘কোয়েলকে এখন পাচ্ছি না। ও রিং ব্যাক করলে তোমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবো।’

দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রন্তিমাসি হাসি হাসি মুখে বলল, ‘দিদি, এ কি সেই মেয়েটা, যে গেলবার পিকনিকের সময় কলকেতা থেকে এয়েছিল? যাকে তুমি দেবের বউ করে আনবে ভেবেছিলে?’

মা বলল, ‘হ্যাঁ, কিন্তু দেবের সে ইচ্ছে নেই।’

রন্তিমাসি বলল, ‘কেন রে খোকা? তোর মনে কি অন্য কেউ আছে। থাকলে বল, ধরে আনি।’

মা বলল, ‘ও তো তাকে নিয়ে আসবে বলেছিল। আমি ডাব পাড়িয়ে রাখলাম। কেন আনল না, কে জানে?’

কোয়েলের প্রসঙ্গটা যাতে আর কোনওদিন না ওঠে, সেজন্য দেব কথাটা বলেই ফেলল, ‘কোয়েলের জন্য একটা ছেলেকে আমি বেছে রেখেছি মা। আমার থেকেও ভাল পাত্তর সে। বড় চাকরি করে। আমাদের কাছাকাছি থাকে।’

‘তমালের কথা বলছিস না কি?’

‘হ্যাঁ মা। তমালের খুব পছন্দ কোয়েলকে। আমাকে বোধহয় ঘটকালি করতে হবে।’

‘রন্তির প্রশ্নটার কিন্তু উত্তর দিসনি তুই।’

দেব পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তোমার কেমন বউমা চাই, বলো তো মা। দেখি, মাথায় কেউ আছে কি না?’

‘ক্যামন ধারা আবার। গায়ের রঙ যেন ফরসা হয়। দেখতে শুনতে ভাল। এখানে মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে পারবে… এমন মেয়ে।’

‘সে যদি বিদেশের মেয়ে হয়?’

শুনে মা কয়েক সেকেন্ড হাঁ করে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। তারপর বলল, ‘তোর যদি পছন্দ হয়, তা হলে আমি আপত্তি করব কেন খোকা? মেয়েটাকে আমাকে একবার দেখাতে পারিস?’

‘আরে না না, তেমন কেউ নেই। আমি তোমায় জিজ্ঞেস করলাম মাত্র। আগে ব্যাঙ্কক থেকে ফিরে আসি। তার পর তোমার পছন্দের মেয়ে এনে দেবো।’

‘তার আগে দোতলায় একটা ঘর তোলা দরকার।’ মা বলল, ‘কথাটা অনেকদিন ধরে তোকে বলব ভাবছিলাম খোকা। আমি তা হলে আর ওয়েট করব না। ভটচাযমশাই বলছিলেন, ডিসেম্বর মাসে ভাল একটা দিন বেছে রাখবেন। চার-পাঁচমাস বাকি আছে। বিয়ে করে বউকে তুই নতুন ঘরে তুলবি। ঠিক আছে?’

একটু পরে মা বুকে কাপড়টা জড়িয়ে রেখে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলল, ‘রাতে তুই কী খাবি? রুটি, না ভাত? কী করে দেবে রন্তিমাসি?’

ভাত খাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। একটা রুটি ট্রাই করা যেতে পারে। সঙ্গে মুরগির মাংস আর স্যালাড। কথাটা ভেবে দেব বলল, ‘রন্তিমাসি, খেতের টাটকা টোমাটো, উচ্ছে, ক্যাপসিকাম, কামরাঙা, গাজর, পেঁয়াজ শশা দিয়ে স্যালাড বাড়িয়ে দাও। পাঁঠার মাংস থাকলে খেতে পারি। কিন্তু তেল-মশলার রান্না নয়। মাংস সেদ্ধ করে, তার উপর একটু নুন ছড়িয়ে দিও। সেইসঙ্গে গোটা চারেক সেদ্ধ ডিম। কুসুম ছাড়া। ব্যস, তাতেই আমার হয়ে যাবে।’

মা বলল, ‘খাওয়ার এ কী তোর ছিরি রে খোকা। কলকেতায় তুই এইসব খাস না কি? এখানে থাকতে তো তোকে টেংরির জুস করে দিতুম। দু’থালা ভাত খেতিস। আর জলের মতো পাতলা ডাল…।’

মা কথাটা শেষ করার আগে দেব বলল, ‘এখন কম্পিটিশনের জন্য তৈরি হচ্ছি মা। ডায়েট্রিশিয়ান আর নিউট্রেশনিস্ট যা বলবে, সেইমতো চলতে হবে। জিতলে কত টাকা পাব, জানো? ভাবতেও পারবে না।’

‘কাদের কথা তুই বলিস, আমি বুঝি না বাবা। এই গরমকালে গাজর আর ক্যাপসিকাম রন্তি কোথায় পাবে? ও যা দেবে, একবেলার জন্য খেয়ে নিস। আমি ততক্ষণে তুলসীতলায় সন্ধে প্রদীপটা জ্বালিয়ে আসি।’

মা বেরিয়ে যাওয়ার পর দেব ছাদে উঠে এল। আগেকার দিনের তৈরি বিরাট বাড়ি। একটা সময় ছাদ দিয়ে অনেকটা চলে যাওয়া যেত। এখন জ্ঞাতিদের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ ছাদে পাঁচিল তোলেনি। ছাদ থেকে দেব লক্ষ্য করল, জেঠা-কাকাদের ঘরে আলো জ্বলে উঠছে। বারান্দায় বসে আনাজ কুটছে রাঙা কাকিমা। কাকা একবেলার রান্না অন্য বেলায় খায় না। কাকিমাকে তাই দু’বেলাই রান্না করতে হয়। রাঙাকাকার অত্যাচার সারাটা জীবন মুখ বুঁজে সহ্য করে গেছে কাকিমা। ছোটবেলায় চোখের সামনে অনেক নমুনা দেখেছে ও। তখন ওদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। দেব একবার দেখেছিল, বারান্দায় আসন পেতে বাবা আর রাঙা কাকা খেতে বসেছে। হঠাৎ মেজাজ গরম করে কাকা ডালের বাটি ছুড়ে মারল কাকিমার দিকে। কপালে পেতলের বাটি লেগে রক্তাকার কাণ্ড। কাকিমার অপরাধ, তরকারিতে কেন নুন বেশি হয়েছিল। বাবা সেদিন কড়া ধমক দিয়েছিল কাকাকে। দেবের যতদূর মনে পড়ে, খড়ম তুলে মারতেও গেছিল। কিন্তু কাকিমাই বাবার পায়ে ধরে আটকায়।

কাকিমা খাঁটি শহরের মেয়ে। বাপের বাড়ি কলকাতার বাগবাজারে। অনেক গুণ ছিল রাঙা কাকিমার। ভাল সূচের কাজ করতে পারত। নতুন ধরনের রান্না করে খাওয়াত। সুন্দর গান গাইত। মায়ের মুখে দেব শুনেছে, বউ হয়ে আসার পর এ বাড়িতে ভাম দেখে রাঙা কাকিমা একদিন মারাত্মক ভয় পেয়ে গেছিল। সাপের ভয়ে প্রথম দিকে সন্ধের পর উঠোন পেরোতে চাইত না। শহুরে মেয়ে হয়েও কাকিমাকে মানিয়ে নিতে হয়েছিল চণ্ডীতলার পরিবেশ। তখন অবশ্য মেয়েদের কোনও উপায়ও ছিল না। বাগবাজারে বাপের বাড়িতেও বোধহয় শেখানো হয়েছিল, ‘পতি পরম গুরু।’ সূচের কাজে বাঁধানো এই লেখাটা মনে হয়, এখনও কাকিমার ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আছে। কাকিমার মতো মিলেনাও কি চণ্ডীতলার পরিবেশ মানিয়ে নিতে পারবে? দেব নিশ্চিত হতে পারল না।

ছাদ থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ই দেব অবাক হয়ে গেল। আরে, এই তো একটু আগে কাকিমা বসে সজনে ডাঁটার ছাল ছাড়াচ্ছিল। হঠাৎ উবে গেল কোথায়? অদ্ভুত, সে জায়গায় মিলেনা বসে আছে! ওর পরনে সুতোর ডুরে শাড়ি। বটির সামনে ঝুঁকে ও একমনে কুচিকুচি করে মুলো কাটছে। মিলেনার ফরসা মুখখানা কেমন যেন মলিন হয়ে গ্যাছে। পরনের ব্লাউজটা ঢিলে হয়ে রয়েছে। গরমে ওর কপাল থেকে বোধহয় ঘাম নেমে আসছে। মুলো কাটতে কাটতে মিলেনা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মাঝেমধ্যে ঘাম মুছছে। এমন সময় কোত্থেকে মা এসে ওর উপর চোটপাট শুরু করল। ‘কী হচ্ছে বউমা? সেই বিকেল থেকে বসে মুলো কেটেই যাচ্ছ? বাপের বাড়িতে মা বুঝি তোমায় কিছু শেখায়নি! ছি ছি, ছেলেটা মুলোর চচ্চড়ি খাবে বলে গেল। কখন রান্না করে দেবো ওকে?’

মুলো কাটা বন্ধ করে মিলেনা করুণ চোখে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। ছাদ থেকে দৃশ্যটা দেখে রাগ হয়ে গেল দেবের। মায়ের কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। ও তো প্রথম দিনই বলে দিয়েছিল, মিলেনা বাঙালিদের রান্নাবান্না কিছু জানে না। মনে মনে মায়ের সঙ্গে তর্ক লড়তে থাকল দেব, ‘কাকে কি বলছ তুমি মা? মিলেনা এত বড়লোক বাড়ির মেয়ে, ওর রান্না করার দরকার হয় না। ওদের বাড়িতে রান্নার লোকই আছে পাঁচ-ছয়জন। ভবিষ্যতে তুমি ওকে বকাবকি করবে না। তা হলে আমি ওকে এখেনে রাখবই না।’

মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কথাগুলো শুনে। কয়েক সেকেন্ড পর বিড়বিড় করে বলল, ‘তুই আমাকে এত বড় কথা বললি খোকা!’

ঠিক এইসময় ফোন বেজে ওঠায় চটক ভাঙল দেবের। জেগে স্বপ্ন দেখছিল না কি ও? মিলেনাকে বিয়ে করে আনলে, সত্যি সত্যিই মাকে ও কোনওদিন এত কড়া কথা বলে ফেলবে না কি? মিলেনা কি পারবে না, কাকিমার মতো মানিয়ে নিতে? ভাবনাটা আর এগোতে না দিয়ে পকেট থেকে দেব মোবাইল সেটটা বের করে আনল। পর্দায় দেখল, তমালের নাম। সুইচ অন করতেই ও প্রান্ত থেকে তমাল জিজ্ঞেস করল, ‘তুই এখন কোথায় ফ্রেন্ড, ফিরেছিস?’

দেব বলল, ‘না, এখনও চণ্ডীতলায়। মা আজ কিছুতেই যেতে দিল না রে।’

‘একটা খারাপ খবর আছে। কোয়েলের মা আজ এক্সপায়ার করে গেছেন।’

(উনিশ)

এনায়েত খান রোডে ওদের পার্টি অফিস দখল করে নিয়েছে রুস্তম। পরেশদা ওকে হেল্প না করলে এত সহজে আবিদ ভাইজানের চেয়ারে ও বসতেই পারত না। ভাইজানের ইন্তেকালের পর দিনতিনেক ও ঘাপটি মেরে সার্কাস অ্যাভেনিউর বাড়িতেই বসে ছিল। তখন অনেকেই এসে পার্টি খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু আসফাক ছাড়া আর কেউ জানত না, শেষবার পার্টি অফিস কে বন্ধ করেছে? আবিদ ভাইজানই বা কার কাছে চাবি দিয়ে গেছেন? ববি ছেলেটা এমন নিরীহ টাইপের, ওকে কেউ সন্দেহই করেনি। সেইসময় ববি চুপিসাড়ে চাবির গোছা ওর কাছে দিয়ে যায়। তালা খোলার আগে পর্যন্ত রুস্তম ভাবতে পারেনি, কতটা চমক ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে! লোকে বলে, আল্লাহ যখন দেন, তখন ছপ্পড় ফোরকে দেন। কথাটা যে কতখানি সত্যি, রুস্তম টের পেয়ে গেছে। ও যেদিন পার্টি অফিস খুলে বসে, সেদিন দু’একজন ঝামেলা পাকাতে এসেছিল। কিন্তু পরেশদা ধমক দিয়ে তাদের চুপ করিয়ে দেন।

অফিস খোলার দিন ববি পার্টি অফিসে আসেনি। আজ রুস্তম দেখতে পেল, ফুটপাত ঘেঁষে মোটর বাইক রেখে, নেমে এল ববি। ছেলেটা এই ক’দিন আগেও মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াত। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়ে তখন বছর খানেক চুপচাপ বসেছিল। মার্থা আন্টিই একদিন ওকে সঙ্গে নিয়ে পার্টি অফিসে এসে বলে, ‘সন, তোর সঙ্গে তো অনেকের জানা শোনা। আমার ছেলেটাকে একটা চাকরি জুটিয়ে দে না। জব না পেলে ও কানাডায় চলে যাবে বলছে। বুড়ো বয়সে না খেয়ে মরব না কি?’

মাইনরিটি কমিউনিটির ছেলে-মেয়েদের এখন চাকরি পাওয়া কঠিন। ববির কপাল ভাল, চাকরিটা ও পেয়ে যায়। ডন বস্কো স্কুলের ফাদার পপলুহা রুস্তমকে খুব খাতির করেন। স্কুলে গার্জেনদের ঝামেলা মেটানোর জন্য প্রায়ই ডাক পড়ত ওর। ফাদারকে বলে স্কুলে ববিকে একটা ক্লারিকাল জব পাইয়ে দিয়েছিল রুস্তম। সেই থেকে ছেলেটা এত কৃতজ্ঞ যে, রোজ স্কুলের ছুটির পর একবার করে পার্টি অফিসে ঘুরে যায়। ওকে কাজেও লাগাতে বলেছিলেন ভাইজান। একটা শিক্ষিত ছেলের দরকার ছিল ওঁর। পার্টির তরফ থেকে ইংরেজিতে নানা জায়গায়, বিশেষ করে সরকারি দফতরে চিঠি পাঠাতে হয়। সেই চিঠিগুলো গুছিয়ে লিখে দেয় ববি। রুস্তম ঠিক করে রেখেছে, কোনওদিন কাউন্সিলার হলে তখন ববিকে পিএ করবে।

বাইকের চাবিটা পকেটে রেখে ববি অফিসে ঢুকে বলল, ‘গুড ইভনিং আঙ্কল। আজ কি আমাকে কোনও দরকার আছে?’

ভাইজানের কয়েকটা কাজ অসমাপ্ত আছে। চট করে মনে পড়ে গেল রুস্তমের। ও বলল, ‘হ্যাঁ। একজনের মোটর ড্রাইভিং লাইসেন্স করে দিতে হবে। আরেকজন আসবে, ভোটার কার্ড কারেকশনের জন্য। তুই ফর্মগুলো ফিল আপ করে দিবি। ওরা যে টাকাটা দেবে, সেটা মার্থা আন্টিকে দিয়ে দিবি।’

ঘাড় নেড়ে ববি বলল, ‘এনিথিং এলস?’

কথাটা বলে সোফায় বসে পড়ল ববি। কত বয়স হবে ছেলেটার? বাইশ-তেইশের বেশি নয়। একেবারে হিরোর মতো চেহারা। ওর বয়স যখন মাত্র পাঁচ-ছয় বছর, তখন থেকে রুস্তম ওকে চেনে। সেদিন ওকে সঙ্গে নিয়ে আবিদভাইজানের কাছে জাস্টিস চাইতে এসেছিল মার্থা আন্টি। অভিযোগ শুনে হাসি পেয়েছিল রুস্তমের। স্টিফেন ম্যানসনে কোন এক বুড়োর সঙ্গে না কি থাকত আন্টি। ববিকে পয়দা করার পর সেই বুড়ো, মার্থা আন্টিকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের দেয়। আন্টি কী যাদু করেছিল, কে জানে? পার্ক সার্কাসের এক ক্রিশ্চান পাড়ায় মার্থা আন্টির থাকার ব্যবস্থা করে দেন ভাইজান। পুলিশে কমপ্লেন করে সেই বুড়োকে জেল পর্যন্ত পাঠান। ভাইজান তখন ওর মাধ্যমেই মাঝে মাঝে টাকাপয়সা পাঠাতে আন্টির কাছে তাই রুস্তমের চোখের সামনে ববি বড় হয়েছে। ইচ্ছে করলে ও ববির হাতে পিস্তল-পেটো তুলে দিতে পারত। কিন্তু আন্টির মুখ চেয়ে দেয়নি। ছেলেটা যে ওকে ইংরেজিতে কথা বলতে শেখায়!

‘এনিথিং এলস,’ ববির এই প্রশ্নটা শুনে রুস্তমের মনে পড়ল, আবিদ ভাইজান জনসংযোগ রাখার জন্য যা যা করতেন, ও সেই কাজগুলো করে যাবে। ভাইজান প্রতিমদের দান-ধ্যান করতেন। বিরাট ইফতার পার্টি দিতেন। ক্রিসমাস ইভ-এ আলো দিয়ে ক্রিশ্চান পাড়া সাজাতেন। সারা বছর পার্ক সার্কাস ময়দানে নানা ধরনের উৎসব করতেন। হস্তশিল্প মেলা, খাদি মেলা, খাদ্য মেলা, ঈদ মিলন, উর্দু কবি সম্মেলন থেকে শুরু করে ফুটবল টুর্নামেন্টও। গরমকালে এই সময়টায় হাসপাতালগুলোতে ব্লাড-এর আকাল হয়। ওদের এরিয়ায় দু’দুটো বড় হাসপাতাল… নীলরতন সরকার আর ন্যাশনাল মেডিকেল। ওখানকার সুপারিটেনডেন্টরা ভাইজানের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। প্রতিবছর ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প করে ভাইজান প্রায় হাজার দুয়েক বোতল রক্ত জোগাড় করে দিতেন।

ভাইজানের চেয়ারে বসে রুস্তম ঠিকই করে নিয়েছে, পার্ক সার্কাস ময়দানে ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প এ বার অনেক বড় করে করবে। লোকের চোখ পড়ার এই প্রথম সুযোগ। ক্যাম্পের আর মাসখানেকও বাকি নেই। ববিকে তাই রুস্তম বলল, ‘শোন, একটা ইম্পরট্যান্ট কাজ আজই করে দিবি। সাতাশে আগস্ট ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প করব। তুই ইনভিটেশন কার্ডটা আজই লিখে ফ্যাল। আর ফ্লেক্সে কী লেখা যাবে, সেটা আমাকে দেখিয়ে নিস। ইংরেজি, বাংলা আর উর্দু তিনটে ভাষাতেই ফ্লেক্স হবে।’

ববি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। তার পর মোবাইল সেট বের করে সঙ্গে সঙ্গে কী যেন খুঁজতে শুরু করে দিল। এই কারণেই ছেলেটাকে খুব পছন্দ করে রুস্তম। কথা কম বলে। সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে পড়ে। মোবাইলে গত বছরের ইনভিটেশন কার্ডের লেখাটা বের করে ববি বলল, ‘আঙ্কল, এ বার কি নতুন কোনও গেস্ট ডাকবেন? লাস্ট ইয়ার ভাইজান কিন্তু দশজন গেস্টকে ইনভাইট করেছিলেন।’

রুস্তম বলল, ‘এ বার আরও একটা নাম যাবে। সিলভার হোটেল মালিকের বিবি আনন্দী শরাফ। তুই চিনিস। তোকে যিনি জিম-এ ভর্তি করে নিয়েছিলেন।’

‘ফ্লেক্সে কি ওই ম্যাডামেরও ছবি থাকবে?’

‘হ্যাঁ থাকবে। ভাইজান সেটাই চেয়েছিলেন। ম্যাডামের ছবিটা যেন ঠিক এমপি-র ছবির পাশে যায়। ভাইজানের সঙ্গে যা কথা হয়েছিল, তাতে ফ্লেক্সের সব খরচ ম্যাডাম দেবেন। পরে ডিটেলে তোকে বলে দেবো। শোন, শ’পাঁচেক ফ্লেক্স-এর অর্ডার দিবি। যাতে আমাদের এরিয়াটা পুরো ব্লাড ডোনেশনের ফ্লেক্স দিয়ে মুড়ে দেওয়া যায়।’

ঘাড় নেড়ে ববি পাশের ঘরে ঢুকে গেল। পার্টি অফিসে ওই ঘরে একটা কম্পিউটর বসিয়েছে ছেলেটা। প্রিন্টিং মেশিনও এনেছে। চিঠিপত্রের দরকার হলে পটাপট টাইপ করে ও প্রিন্ট বের করে দেয়। রুস্তম জানে, আজ রাতের মধ্যেই ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের সব চিঠি টাইপ হয়ে যাবে। পার্টির ছেলেরা তা পৌঁছেও দেবে ঠিকানা মতো। ও লক্ষ্য করল, হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে আসফাক ঘরে ঢুকে এসেছে। সেটা টেবলের উপর রেখে ও বলল, ‘মল্লিকবাজারের ব্যবসায়ী সমিতি পাঠিয়ে দিয়েছে। দু’লাখ টাকা আছে এতে। আলমারিতে রেখে দাও ওস্তাদ।’

ভাইজানের সময় তোলার টাকা রুস্তমই এনে দিত। ও জানে, কোত্থেকে কত টাকা আসত। ব্যাগটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে ও জিজ্ঞেস করল, ‘লেডিস পার্কের কোনও খবর আছে?’

সূরজ তেওয়ারি থাকত এন্টালির লেডিস পার্কের দিকে। ইলিয়ট নার্সিং হোমে ওকে শেষবার দেখা গেছিল। দু’দিন পর ওর ডেডবডি পাওয়া যায় নিউ টাউনের একটা অর্ধসমাপ্ত বাড়িতে। ওকে নিয়ে কী রটেছে, রুস্তম সে সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছিল আসফাককে। ও নিশ্চিত, নার্সিং হোম থেকে কোনও খবর লিক হয়নি। আগ্রহ নিয়ে ও তাকিয়ে আছে দেখে, আসফাক বলল, ‘নিউ টাউনের প্রোমোটাররাই ওকে টপকে দিয়েছে ওস্তাদ। তিওয়ারি রোজ ঝাউতলায় জলসা বলে একটা বার-এ যেত। সেখানে রাজারহাট-নিউটাউনের সব প্রোমোটারদের আড্ডা। ভাইজান যেদিন মারা যান, সেদিনই সন্ধেবেলায় কে যেন তিওয়ারিকে জলসাতে মাল খেতে দেখেছিল। সেখানে কোনও এক প্রোমেটারের সঙ্গে ওর কথা কাটাকাটিও হয়। তার পর থেকে ওকে আর কেউ দেখেনি। সত্যি ওস্তাদ, কে ওকে খাল্লাস করল, তুমি জানো?’

শুনে মনে মনে হাসল রুস্তম। যাক, ওর উদ্দেশ্যটা তা হলে সফল। মনে প্রাণে ও চাইছিল, তিওয়ারি সম্পর্কে এই কথাগুলোই রটুক। ইলিয়ট নার্সিং হোম থেকে যেদিন তিওয়ারির ডেডবডিটা ও আনতে যায়, সেদিনই আইডিয়াটা দিয়েছিল, মুর্দাঘরের রহমত। লেডিস পার্কেরই ছেলে। ওর কাছেই রুস্তম শোনে, তিওয়ারি নিউ টাউনে প্রোমোটারি করত। আবিদ ভাইজানকে না কি সেটা জানায়নি। রহমতকে সঙ্গে নিয়েই গভীর রাতে রুস্তম ডেডবডিটা নিউটাউনে ফেলে এসেছিল। একজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে ওর হাত এতটুকুও কাঁপেনি। ও সত্যি কথাটা শুধু বলেছিল পরেশ লস্করকে। প্রশ্নটা করে আসফাক ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে, রুস্তম বলল, ‘ঠিক জানি না। পরেশদা হতে পারে। একদম চুপ করে থাকিস। তিওয়ারিকে নিয়ে কোথাও কোনও আলোচনা হলে, সরে যাবি।’

নীচু হয়ে ঝুঁকে পলিথিনের প্যাকেট তেকে দুটো বান্ডিল বের করে আনল রুস্তম। তার পর বলল, ‘এর মধ্যে নার্গিসের সঙ্গে তোর আর কথা হয়েছে?’

নার্গিসের কথা ওঠায় লজ্জা পেয়ে আসফাক বলল, ‘তোমায় মিথ্যে বলব না ওস্তাদ। কাল রাতে ওকে নিয়ে আফজলমিঞার রেস্টুরেন্টে খেতে গেছিলাম। কথায় কথায় ও বলল, বিজনের বাড়িতে কড়েয়া থানার পুলিশ মাঝে মাঝে যাচ্ছে। তবে এখনও কেউ ওকে সন্দেহ করেনি।’

টেবলের উপর নোটের বান্ডিল দুটো রেখে রুস্তম বলল, ‘এগুলো রাখ। একটা তুই নিবি, অন্যটা নার্গিসকে দিবি। বলবি, রুস্তমভাই পাঠিয়েছে।’

ইতিমধ্যে কম্পিউটরের ঘর থেকে ববি বেরিয়ে এসেছে। ওর হাতে ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পের চিঠিপত্রের প্রিন্ট। ওকে দেখে আসফাক বলল, ‘আমি তা’হলে উঠি ওস্তাদ। রাতে কোথাও বসবে না কি? ওল্ড মঙ্ক-এর একটা বোতল আমার কাছে আছে।’

সিবাস রিগালের একটা বোতল ওর কাছেই আছে। কিন্তু সেটা খুলতে ইচ্ছে করল না রুস্তমের। ওর মাথায় এখন অন্য চিন্তা। ও চায় না, পার্টি অফিসে আসফাক এখন থাকুক। তাই বলল, ‘আজ না। কাল সকালে আসিস। স্টিফেন ম্যানসনের ব্যাপারে কথা আছে।’

আসফাক বেরিয়ে যাওয়ার পর চিঠির প্রিন্টগুলো টেবলের উপর রেখে ববি জিজ্ঞেস করল, ‘এনিথিং এলস আঙ্কল?’

শুনে হাসি পেল রুস্তমের। একটা কাজ শেষ করার পর প্রতিদিন ছেলেটা এই প্রশ্নটা করে। তবে, পরে কোনও কাজ দিলে সেটাও করে দিয়ে যায়। মজা করে ও বলল, ‘কেন, তোর কি কোথাও যাওয়ার আছে?’

‘ইয়েস আঙ্কল, আই হ্যাভ টু অ্যাটেন আ বার্থ ডে পার্টি।’

ববি সবসময় চায়, ও ইংলিশে কথা বলুক। প্রায় সময় গুছিয়ে বলতে পারে না রুস্তম। কিন্তু এখন আবিদ ভাইজানের চেয়ারে বসেছে। গুন্ডার তকমাটা গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। না হলে ওর ওজন বাড়বে না। ববিকে খুশি করার জন্যই ও বলল, ‘হু’জ পার্টি ইজ দিস?’

‘মাই গার্লফ্রেন্ড মারিয়া। শি লিভস ইন স্টিফেন ম্যানসন আঙ্কল।’

‘ওকে ইউ ক্যান গো নাউ। ক্যান ইউ কাম ব্যাক ইন দ্য নাইট?’

একটু অবাক হয়েই ববি বলল, ‘ইফ ইউ সে আঙ্কল, অফ কোর্স আই ক্যান কামব্যাক। সে অ্যাট টেন ও’ক্লক। উইল দ্যাট বি অল রাইট ফর ইউ?’

পলিথিনের প্যাকেট থেকে ফের নোটের একটা বান্ডিল বের করল রুস্তম। তারপর টেবলের উপর রেখে বলল, ‘বাই সাম গুড গিফটস ফর মারিয়া। ওয়ান ফ্রম মাই সাইড। আই উইল বি ওয়েটিং হিয়ার ফর ইউ।’ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল ছেলেটার। বলল, ‘ডেফিনিটলি আই উইল ডু দ্যাট আঙ্কল। থ্যাঙ্কস।’

একটু পরে বাইরে মোটর বাইকের ভটভট শব্দ। ববি বাইকে স্টার্ট দেওয়া মাত্র রুস্তম ভাইজানের ঘর থেকে বেরিয়ে পার্টি অফিসের দরজা লক করে দিল। দু’দিন ধরে ও মনে মনে ঠিক করেই রেখেছে, ভাইজান অফিসের কোথায় ‘তোলার’ টাকা রাখতেন, খুঁজে দেখবে। ঝাউতলার ফ্ল্যাটে অবশ্যই রাখতেন না। ওই ফ্ল্যাটের কথা রুস্তম ছাড়া আর কেউ জানে না। বছর দুয়েক আগে, বসিরহাট থেকে লিলি বলে একটা হিঁদু মেয়েকে তুলে এনেছিলেন ভাইজান। বয়সে সে প্রায় তিরিশ বছরের ছোট। জোর করে কলমা পড়িয়ে ভাইজান না কি তাকে নিকাহ করেন। কিন্তু পরে বুঝতে পারেন, মেয়েটার ভীষণ টাকার খাঁই। তাই পরের দিকে টাকার থলে কখনই ঝাউতলায় নিয়ে যেতেন না। প্রায় কুড়ি বছর ছায়ার মতো ভাইজানকে অনুসরণ করেছে রুস্তম। ওর মন বলল, টাকা এই অফিস ঘরেরই কোথাও লুকোনো আছে। চার নম্বর পুলের কাছে যে বাড়িতে ভাইজান তাঁর আসল বিবিকে নিয়ে থাকতেন, অবশ্যই সেখানে না।

ঘরের মাঝে একা দাঁড়িয়ে ও চারদিকে চোখ বোলাল। দুটো আলমারি, তিনটে সোফা, একটা বড় সেন্টার টেবল, দেওয়ালে সাঁটা কাচের কয়েকটা শো কেস, তাতে প্রচুর ফাইল রাখা। না, ভাইজানের মতো লোক এইসব জায়গায় কোথাও টাকা রাখবেন না। তন্নতন্ন করে আলমারি, টেবলের ড্রয়ার, কাচের শো কেসগুলো ও দেখতে লাগল। ঘরে এসি চলছে। তা সত্ত্বেও দরদর করে ও ঘামতে লাগল। কম্পিউটার রুমে ঢুকেও কোথাও এমন জায়গা ও খুঁজে পেল না, যেখানে ভাইজান টাকা রাখতে পারেন। তার পাশে একটা বেড রুম আছে। মাঝে মাঝে ঘনিষ্ঠ লোকদের নিয়ে বসে ভাইজান মাল খেতেন। গোপন শলাপরামর্শ করতেন। সেখানে একটা ডিভান, ড্রেসিং টেবল, ফ্রিজ আর টিভি। লাগোয়া বাথরুম খুলেও একবার দেখে নিল। নাহ, রুস্তম কোথাও কিছু পেল না। ড্রেসিংটেবলের ড্রয়ারে কয়েকটা ব্লু ফিল্মের সিডি ছাড়া।

ফের ভাইজানের ঘরে ফিরে এসে রুস্তম সিবাস রিগালের বোতল খুলে বসল। জীবনে কখনও ও একা মাল খায়নি। ওর ধারণা, যারা একা মদ খায়, মনের দিক থেকে তারা সুস্থ নয়। কিন্তু ও আজ মরীয়া। যা করার ওকে আজ রাতের মধ্যেই করতে হবে। কাল থেকে পার্টির কর্মীরা একে একে আসতে শুরু করবে। পার্টি অফিস এখনকার মতো আর ফাঁকা থাকবে না। এক ঘণ্টার মধ্যে টিভি দেখতে দেখতে তিন পেগ খেয়ে রুস্তম ক্লান্তিটা কাটিয়ে উঠল। তার পর উল্টো দিক থেকে খোঁজটা শুরু করল। ভারী আলমারি সরিয়ে দেওয়ালগুলো ঠুকে দেখল, কোথাও লুকনো দরজা আছে কি না। মেঝের কার্পেট সরিয়েও কোনও গোপন কুঠুরির সন্ধান পেল না। ফের হতাশ হয়ে রুস্তম সোফায় বসে পড়ল। ওর মন বলল, টাকা আছে। এই অফিস ঘরেই কোথাও লুকোনো আছে। তোলার টাকা এনে দেওয়ার পর কোনওদিন ভাইজানকে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতে ও দেখেনি।

ভাইজান যে চেয়ারে বসতেন, তার ঠিক মাথার উপর একটা ছবি টাঙানো আছে। মক্কার কাবা মসজিদের ছবি। ভাইজান যেবার হজ করতে গেছিলেন, সেবার দুবাই থেকে ছবিটা নিয়ে এসেছিলেন। এখানে সুন্দর ফ্রেমে কাজ দিয়ে বাঁধিয়ে নিয়েছিলেন। হঠাৎই রুস্তমের সেই ছবিটার দিকে চোখ গেল। ওর মনে পড়ল, দুপুরবেলায় নমাজ পড়ার সময় ভাইজান ওর ঘরের দরজা অনেকক্ষণ ধরে বন্ধ রাখতেন। ওকেও কোনওদিন ঢুকতে দেননি। কেন জানে, না, দেওয়ালের অনেকটা জুড়ে থাকা কাবা মসজিদের রঙিন ছবিটা রুস্তমকে টানতে লাগল। টেবলে উপর উঠে দাঁড়ালেই হাত পেয়ে যাবে। বেশ ভারী, কষ্ট করে ছবিটাকে ও নামিয়ে আনল। তখনই ছবির পিছনে গোপন দরজাটা ও দেখতে পেল। টান মেরে দরজাটা খুলতেই, রুস্তমের মুখে হাসি, পরিশ্রম সার্থক। ভিতরে সারি সারি সাজানো নোট!

ওর মতো কয়েকজনের গুন্ডামির কামাই। একা ভোগ করছিলেন ভাইজান। এই টাকায় রাখেইল পুষছিলেন অ্যাদ্দিন। চোরা কুঠুরিতে উঁকি মেরে রুস্তম দেখল, অনেকটা লম্বা। দেওয়ালের ঠিক পিছনেই ভাইজানের বেডরুম। তার মানে… বেডরুমের দিক থেকেও চোরা কুঠুরি খোলার ব্যবস্থা আছে। টেবল থেকে নেমে ও বেডরুমে গিয়ে ঢুকল। হ্যাঁ ওর আন্দাজই ঠিক। এ দিকের দরজাও একটা ছবি দিয়ে ঢাকা আছে। ইফতারের অনুষ্ঠানে ভাইজান চিফ মিনিস্টারের আশীর্বাদ নিচ্ছেন। হাতের নাগালে থাকা টাকার বান্ডিলগুলো রুস্তম বের করে এনে বিছানার উপর ফেলতে লাগল। একটা সময় ও লক্ষ্য করল, তার মধ্যে দু’চারটে ফাইল আর ডলারের বান্ডিলও আছে। ফাইলগুলো সরিয়ে রেখে রুস্তম ঠিক করে নিল, আজ রাতের মধ্যেই ও বেওয়ারিশ বান্ডিলগুলো সরিয়ে ফেলবে। একটা নোটও কারোর সঙ্গে ভাগ করবে না।

দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বাজল। টাকার বান্ডিলে বিছানা ভর্তি হয়ে গেছে। ঘরে এসি চলছে, তবুও পাখাটা ফুল স্পিডে চালিয়ে দিয়ে, রুস্তম টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। টাকার গদিতে শুয়ে থাকবে, এই স্বপ্নটাই তো ও দেখে এসেছে সারা জীবন। সেই ইচ্ছেটা আজ পূরণ হল বটে, কিন্তু এই সম্পদ ও রাখবে কোথায়? সেটা ভেবে নিতে ওর মিনিট পাঁচেকও লাগল না। পার্টি থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে ববির। সেটা মনে পড়ায় বেডরুমে ও তালা লাগিয়ে দিল। তার পর অফিস ঘরে ঢুকে, খুব যত্ন করে কাবা মসজিদের ছবিটা ও টাঙিয়ে রাখল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *