(দশ)
জিম-এ ওয়ার্ক আউট সেরে দেব সবে চেঞ্জিং রুমের দিকে যাচ্ছিল। পিছন থেকে কে যেন বলল, ‘দেবদা, আপনার ডেলটয়েড আর বাইসেপস মার্ভেলাস শেপ-এ এসেছে।’
ঘাড় ঘুরিয়ে দেব দেখল, অনিরুদ্ধ। কেউ ওর মাসল-এর প্রশংসা করলে ওর ভাল লাগে। নতুন করে ও উৎসাহ পায়। আজ তিন সেট কালিং করেছে। একেকটা পনেরো মিনিট করে। ফলে হাতের মাসল পাম্প হয়ে রয়েছে। অনিরুদ্ধর কথাটা শুনে দেব আয়নার দিকে তাকাল। নাহ, ঠিকঠাক সিডিউলেই এগোচ্ছে। মাস দুয়েক পরে যখন মি. এশিয়া কনটেস্ট হবে, তখন আরও গ্রোথ হবে। কোমরে জড়ানো তোয়ালেটা খুলে ও গায়ের ঘাম মুছতে শুরু করল। তখনই ওর চোখে পড়ল, জিম-এর দরজার সামনে মিলেনা দাঁড়িয়ে। অবাক হয়ে ওর শরীরের দিকে তাকিয়ে। কয়েকদিন আগে শিখিনদা জিম-এ এসে খবর না দিলে, রুস্তম রাস্তায় মেয়েটাকে আরও ভয় দেখাত। তখনই দেব ছুটে গেছিল অকুস্থলে।
দেব বুঝতে পারল না, ও এগিয়ে গিয়ে মিলেনাকে ভিতরে আসতে বলবে, না কি চেঞ্জিং রুমে গিয়ে গায়ে কিছু চাপিয়ে, তার পর ওর মুখোমুখি হবে। শরীরের মাসলগুলো সবসময় দেব ঢেকে রাখার চেষ্টা করে। বিশেষ করে, মেয়েদের সামনে। এ ব্যাপারে ওর তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। একবার চণ্ডীতলায় মেয়েদের কলেজ থেকে পিসতুতো বোন দীপাকে ও আনতে গিয়েছিল। কলেজের বাইরে বাইক নিয়ে ও দাঁড়িয়ে ছিল। ওর খেয়াল ছিল না, হাফহাতা টি শার্ট পরে গেছে। এক ঝাঁক মেয়ের সঙ্গে দীপা হাসতে হাসতে বেরিয়েছিল। দেব স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, হাসাহাসিটা ওকে নিয়েই হচ্ছে। বোনকে চেপে ধরতেই ও বলেছিল, ‘আমার বন্ধুরা তোর সম্পর্কে কী বলল, জানিস? তোর দাদা তো দুর্গা ঠাকুরের অসুর রে।’ শুনে বাড়িতে মা বলেছিল, ‘অসভ্য মেয়ে সব। তুই বাবা, ঢেকে ঢুকে রাখিস। নজর লাগবে।’ তার পর থেকে বাইরে বেরোলে দেব হাই কলার ফুল হাতা শার্ট বা গেঞ্জি পরে বেরোয়।
দেব কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই মিলেনা হাত নেড়ে ইঙ্গিত করল, ‘ভিতরে আসতে পারি?’
দেবও ইশারায় ওকে সোফায় বসতে বলল। তার পর দ্রুত পায়ে চেঞ্জিং রুমে ঢুকে গেল। অন্যদিন নিজের চেম্বারে বসে এইসময়টায় ও আয়েশ করে এক গ্লাস সাপ্লিমেন্ট খায়। আজ বোধহয় সম্ভব হবে না। মিলেনা নিশ্চয়ই কোনও দরকারে এসেছে। কিন্তু কী কারণে, সেটা দেব বুঝতে পারল না। রুস্তম কি আবার ওকে ভয় দেখাল? এত সাহস হবে না কি ছেলেটার? স্কুলের শান্তা ম্যাডাম ওর সম্পর্কে থানায় কমপ্লেন করেছেন। খবরটা ও পেয়েছে তমালের কাছ থেকে। থানার বড়বাবুকে প্রায়ই হোটেল থেকে ও খাবার পাঠায়। শরাফ স্যারের নির্দেশ আছে, বড়বাবু যখন যা ইচ্ছে, খেতে চাইলে সঙ্গে সঙ্গে থানায় বা কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিতে হবে। সেই সূত্রে তমালের সঙ্গে বড়বাবুর খুব জানাশোনা।
তা সত্ত্বেও, সেদিন ঘটনাটা শুনে রাতে তমাল ওকে বলেছিল, ‘রুস্তমের সঙ্গে পাঙ্গা না দিলেই ভাল করতি দেব। এরা হচ্ছে সমাজের কীট। তুই কোনও অ্যাকশন নিলে, ওর কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু ও যদি রিভেঞ্জ নেয়, তা হলে তোর ক্ষতি হয়ে যাবে। কত কষ্ট করে বডিটা বানাচ্ছিস, মনে রাখিস।’
পোশাক বদলে দেব বাইরে এসে দেখল, মিলেনার সঙ্গে নীচু গলায় কথা বলছে অনিরুদ্ধ। হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে আইডিয়া দিচ্ছে জিম সম্পর্কে। হালকা মিউজিক বাজছে। ফ্লোর প্রায় ভর্তি। যে যার মতো মেশিনে বসে ব্যায়াম করে যাচ্ছে। মিলেনার দিকে তাকিয়ে দেব হঠাৎ নার্ভাস বোধ করল। অ্যাদ্দিন দূর থেকে দেখেছে। কাছে থেকে এখন মনে হচ্ছে, এত সুন্দরী মেয়ে ও আগে কখনও ও দেখেনি। বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার চেষ্টাটা কি ওর ঠিক হচ্ছে? চোখাচোখি হতেই মিলেনা বলল, ‘গুড আফটারনুন দেব। এক্সট্রিমলি সরি টু ডিসটার্ব ইউ।’
দেব বলল, ‘গুড আফটারনুন। টেল মি, হোয়াট প্রম্পট ইউ টু কাম হিয়ার।’
এদিক ওদিক তাকিয়ে মিলেনা বলল, ‘ক্যান উই সিট সামহোয়ার?’
‘ডেফিনিটলি। প্লিজ কাম।’ বলে দেব ওর চেম্বারের দিকে এগোল।’
ঘরে ঢোকার আগে ও দেখতে পেল, টেবলের উপর কাচের গ্লাসে সাপ্লিমেন্ট ঢাকা দেওয়া আছে। নিশ্চয়ই হোটেল থেকে তমাল কারও হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। ও এখন ইভিনিং ডিউটিতে। কিচেনে ভয়ানক ব্যস্ত। তবুও সাপ্লিমেন্ট পাঠানোর কথা ভোলেনি। কিন্তু, মিলেনার সামনে ও একা খাবে কী করে? ভেবে চেয়ারে বসে দেব জিজ্ঞেস করল, ‘ইউ লাইক টু হ্যাভ কফি?’
‘নো থ্যাঙ্কস।’ মিলেনা বাংলায় বলল, ‘দেব, তোমার কাছে এসেছি অ্যাডভাইস নিতে। তোমার সঙ্গে কি ভাল কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের চেনা আছে?’
আচমকা প্রশ্নটা শুনে দেব বলল, ‘কার জন্য দরকার?’
‘আমার গ্র্যান্ডপা টাইগ্রানের জন্য। বয়স প্রায় এইট্টির কাছাকাছি। রিসেন্টলি আমার মনে হচ্ছে, ওঁর মেন্টাল ডিসঅর্ডার হয়েছে।’
‘হোয়াই ডু ইউ থিঙ্ক সো?’
‘বিক’জ অফ হিজ বিহেভিয়ার। উনি এমন সব কাজ করছেন, যা স্কেয়ারিং। লাস্ট মানডে হি সেট ফায়ার ইনসাইড দ্য ফ্ল্যাট। লাকিলি, আই ওয়াজ দেয়ার। না থাকলে, গড নো’জ হোয়াট উড হ্যাভ হ্যাপেনড।’
‘কারণটা কি, ক্যান ইউগেস মিলেনা?’
‘রিয়েলি, আই ডোন্ট নো। সারাদিন কারও সঙ্গে কথা বলেন না। কোনও খাবার পছন্দ হয় না। ওয়ান্স হি বিট আওয়ার মেড নাজমা। রিডিকুলাস।’
‘হোল ডে উনি কী করেন?’
‘আগে রেগুলার ভিক্টোরিয়ায় মর্নিং ওয়াকে যেতেন। চার্চে সানডে মাস-এ অ্যাবসেন্ট হতেন না। হি হ্যাড ফ্রেন্ড সার্কেল। বাট রিসেন্টলি উনি বাড়ি থেকে বেরোন না। পুটিং অফ লাইটস, সামটাইমস হি উড ওয়াচ বিবিসি নিউজ, অর আল জাজিরা চ্যানেল। এলস, ভিডিয়ো ক্লিপিংস সেন্ট বাই মাই ফাদার ফ্রম আওয়ার কান্ট্রি। ক্লিপিংস দেখে মাঝে মধ্যেই উনি কাঁদেন।’
‘তোমার বাবা কোথায় থাকেন মিলেনা?’
‘মাই ফ্যামিলি রিসাইডস ইন আর্মেনিয়া। বিউটিফুল কান্ট্রি। আমার ড্যাডি এরিক গ্রোগোরিয়ানের হিউজ প্রোপার্টি আছে ওখানে। বাট আই ওয়াজ বরন ইন দার্জিলিং।’
‘আই সী।’ বলে দেব চুপ করে রইল। আর্মেনিয়া দেশটা কোথায়, সে সম্পর্কে ওর কোনও ধারণা নেই। তবে বড়বাজারের কাছে চিনে পট্টিতে একটা চার্চ আছে, হাওড়া স্টেশনে যাতায়াতের পথে বাসের কনডাক্টরদের ও হাঁক পাড়তে শুনেছে, আর্মেনি চার্চ। লোকজনকে ঢুকতে বা বেরতেও দেখেছে ওই চার্চ থেকে। মেয়েরা দেখতে খুব সুন্দর, ঝলমলে পোশাক পড়ে। একদম মিলেনার মতো। যাই হোক, মেয়েটা যা বলছে, চিন্তা করার মতো। ঠাকুর্দাকে নিয়ে ওর যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ আছে। ফ্ল্যাটে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন, কাজের মেয়েকে মারধর করছেন, এটা সুস্থ মানসিকতার লক্ষণ নয়। এ সব কি একাকিত্বের কারণে? দেব জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে তোমাদের কোনও রিলেটিভ নেই? এমন কেউ, যাঁর অ্যাডভাইস তুমি নিতে পারো?’
মিলেনা বলল, ‘দেয়ার আর মেনি। বাট নোবডি লাইকস গ্র্যান্ডপা টাইগ্রান। আসলে উনি জেল থেকে ফেরার পর কেউ আর যোগাযোগ রাখে না। নোবডি উইল কাম ফরোয়ার্ড টু হেল্প মি।’
‘তোমার গ্র্যান্ডপা জেলে গেছিলেন কেন?’
‘অ্যাটেম্পট টু মার্ডার। আমি দার্জিলিং থেকে এখানে আসার আগে গ্র্যান্ডপা লিভ ইন করতেন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ডিভোর্সির সাথে। তার নাম মার্থা। দে হ্যাড আ চাইল্ড… আ বয়। আমাদের চার্চ ওদের রিলেশন অ্যাপ্রুভ করেনি। বাচ্চাটাকে ব্যাপটাইজ করতে চায়নি। বিক’জ অফ দ্যাট, গ্র্যান্ডপা ওই লেডিকে চলে যেতে বলেন। বাট সি উড নট লিভ। যেতে চাননি। রোজ ওদের মধ্যে ঝগড়া, মারপিট হত। ওয়ান্স দ্যাট লেডি ওয়েন্ট টু পোলিশ উইথ ইনজুরিস অ্যান্ড কমপ্লেনড কী… গ্র্যান্ডপা ওকে মার্ডার করতে চেয়েছিলেন। লেটার হি ওয়াজ সেনটেন্সড ফর টু ইয়ারস।’
‘হোয়ার ইজ দ্যাট লেডি রাইট নাউ?’
‘নো আইডিয়া। বাট, মাঝে মাঝে উনি আসেন আমাদের রাইট অপোজিট ফ্ল্যাটে। নেবারের সঙ্গে কন্সপিরেসি করে চলে যান। আই হ্যাভ সিন হার মেনি টাইমস।’
‘এখনকার সিচুয়েশনটা কি তোমার ড্যাডিকে সব জানিয়েছ?’
‘প্রায়ই ভিডিয়ো কল-এ কথা হয়। আসলে এই গ্র্যান্ডপা আমার ড্যাডির আঙ্কল। ড্যাডি কান্ট ফোর্স হিম টু গো ব্যাক আর্মেনিয়া। দেয়ার আর লট অফ ফ্যামিলি প্রবলেমস। কান্ট্রির পলিটিক্যাল সিচুয়েশনও ভাল না। পারহ্যাপস ইউ আর অ্যাওয়ার, ওখানে কুর্দরা সেপারেশন চাইছে। এভরি নাউ অ্যান্ড দেন, অ্যাজিটেশন। ড্যাডি আমাকে ওখানে কোনওদিন নিয়ে যাননি। মোরওভার, ড্যাডির কাছে খবর যাচ্ছিল, গ্র্যান্ডপা না কি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়ে গোয়ায় চলে যেতে চাইছেন। সেটা আটকানোও একটা কারণ ছিল।’
‘তোমার কলকাতায় আসাটা তা হলে গ্র্যান্ডপা পছন্দ করেননি?’
‘এতদিন আমার তা মনে হয়নি। সাডেনলি গ্র্যান্ডপা বদলে গেলেন।’
দেব জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার স্কুলের আন্টিরা কী বলছেন?’
‘শান্তা আন্টি টোল্ড মি টু টক টু ইউ। অনেক ভেবে ঠিক করলাম, ফার্স্ট অফ অল, আই মাস্ট কনসাল্ট আ ডক্টর। তার পর উনি যে রকম অ্যাডভাইস করবেন, আই উইল এক্সাক্টলি ডু দ্যাট।’
চুপ করে কয়েক সেকেন্ড ভাবল দেব। সমস্যার কারণ মনে হয় একটাই, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ। মিলেনাদের ওই ফ্ল্যাট। যার দাম এখন দশ বারো কোটি টাকা তো হবেই। গ্র্যান্ডপা এতদিন একাই ভোগ করছিলেন। মাঝখান থেকে কোনও দাবিদার এসে গেলে তিনি পছন্দ করবেন কেন? ও জিজ্ঞেস করল, ‘টেল মি, হু ইজ দ্য ওনার অফ দ্যাট ফ্ল্যাট। মালিকটা কে?’
‘মাই ড্যাডি। এনিওয়ে, আমি এসেছি, তুমি যদি একজন ভাল সাইকিয়াট্রিস্টের খোঁজ দাও, তা হলে আই উইল বি গ্রেটফুল। আই ডোন্ট নো এনি ডক্টর হিয়ার।’
জিজ্ঞেস করবে না, করবে না ভেবেও দেব প্রশ্নটা করে ফেলল, ‘তোমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই।’
মিলেনা বলল, ‘টু টেল ইউ ফ্রাঙ্কলি, বয়ফ্রেন্ড ছিল… ডেভিড। সে মাইগ্রেট করে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে ফ্যামিলির সাথে। নাউ আই রিয়েলাইজ, ভাল হয়েছে। ডেভিড ওয়াজ নট ব্রেভ এনাফ লাইক ইউ। তোমাকে ফ্রেন্ড বলে মনে হয়েছে বলেই, তোমার সাহায্য নিতে এসেছি দেবদূত। উইল ইউ বি মাই ফ্রেন্ড?’
এমন আন্তরিকতার সঙ্গে কথাগুলো মিলেনা বলল যে, দেব একটু অবাকই হল। মিলেনার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, কথা দিচ্ছি, তোমার বন্ধুত্বটা সারা জীবন রাখব। হাত বাড়িয়ে দিয়ে ও বলল, ‘সিওর’। তখনই ওর মনে পড়ল, ক্যামাক স্ট্রিটের যে ক্লিনিকে ডাঃ সুজয় মিত্র বসেন, সেখানে একবার কথা বলা যেতে পারে। সাইনবোর্ডে বারো-তেরো জন ডাক্তারের নাম দেখেছে ও। তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই একজন সাইকিয়াট্রিস্ট থাকবেন। তাই বলল, ‘গিভ মি ওয়ান ডে টাইম। আমি দেখছি, কাছাকাছি কোথায় ভাল সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বার আছে।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে মিলেনা উঠে দাঁড়াল। তার পর বলল, ‘কাল স্কুল থেকে ফেরার সময় এখানে আসব। তুমি প্লিজ খোঁজ নিয়ে রেখো।’
ভদ্রতা করে মিলেনাকে দেব গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এল। চেম্বারে ফেরার সময় ওর মনে হল, আকাশে পা দিয়ে হাঁটছে। ওর হাতে পূর্ণিমার চাঁদ। এক আঙুলের ডগায় রেখে ও লাট্টুর মতো ঘোরাচ্ছে চাঁদটাকে। এই পৃথিবীতে কত আশ্চর্য ঘটনাই না ঘটে! যার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ও এতদিন মুখিয়ে ছিল, সে আজ নিজে থেকে এসে বন্ধুত্ব পাতাল। কথাটা ভাবতে ভাবতে মোহগ্রস্তের মতো দেব চেয়ারে এসে বসল। চন্দনের গন্ধ ঘরের মধ্যে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। গন্ধটা ও মিলেনা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছিল। এক লম্বা নিঃশ্বাস টেনে ও মনে মনে বলল, ‘আজ থেকে তুমি আমার প্রতিটা শ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে। আই প্রমিস ইউ মিলেনা, তোমার জন্য আমি জান দিতেও রাজি।’
টেবলে রাখা সাপ্লিমেন্টের গ্লাসটা টেনে নিতে যাবে, তখনই দেব দেখল, শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে অনিরুদ্ধ এদিকে আসছে। কাচের দরজা খুলে ও বলল, ‘কী সাপ্লিমেন্ট নিচ্ছেন দেবদা?’
দেব বলল, ‘বিসিএএ সাপ্লিমেন্ট। ব্রাঞ্চ চেন অ্যামিনো অ্যাসিড এনার্জি পাউডার। দিনে আমি দু’বার করে নিই। এতে প্রোটিন ইনটেক হয়। ওয়ার্ক আউটের পর মাসল রিকভারিতে সাহায্য করে।’
‘খুব দাম, তাই না?’
‘হ্যাঁ। একটা বোতল পাউডার আঠারোশো টাকার মতো পড়ে। শুধু একটা সাপ্লিমেন্ট খেলেই তো হবে না। ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছতে গেলে আরও পাঁচ ধরনের সাপ্লিমেন্ট নিতে হয়। ফিল হীথের মতো ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নরা অনেক ধরনের সাপ্লিমেন্ট খায়। স্টেরয়েড পুশ করে। আমারই তো মাসে পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায় এই কারণে।’
অনিরুদ্ধ হতাশ হয়ে বলল, ‘থাক বাবা, আমার ফিল হীথ হয়ে দরকার নেই। আগুন নেভানোর সময় হোস পাইপ ধরার জন্য হাতের জোরটা থাকলেই হল।’
দমকলে চাকরি করে অনিরুদ্ধ। এত খরচ করার ক্ষমতা ওর নেই, দেব জানে। সাপ্লিমেন্টের গ্লাসটা তুলে ধরে ও হেসে বলল, ‘একবার টেস্ট করবি না কি?’
‘না থাক।’ বলেই প্রসঙ্গ পাল্টে অনিরুদ্ধ বলল, ‘দেবদা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবেন না তো?’
‘কী কথা বল। এত হেজিটেট করছিস কেন?’
‘একটু আগে যে ভদ্রমহিলা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তিনি কিন্তু খুব বিপদের মধ্যে আছেন। ওনার বাড়িতে যে বুড়োটা থাকে, সে খুব খতরনাক লোক।’
‘বুড়োটা ওর ঠাকুর্দা। তুই তাকে চিনলি কী করে?’
‘স্টিফেন ম্যানসনের ভিতর একটা কল সেন্টারে আমার এক বন্ধু তুহিন চাকরি করে। বারাসতে থাকে বলে মাঝে মধ্যে ওর কাছে যাই। ওখানে অনেককেই আমি চিনি। দু’তিনদিন আগে, কল সেন্টারের উপরে একটা ফ্লোরে হঠাৎ ফায়ার ফায়ার চিৎকার শুনে আমরা ছুটে যাই। দেখি, একটা বিরাট ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুমে আগুন জ্বলছে। আপনার কাছে আসা এই ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছেন। আর ওই বুড়োটা তড়পাচ্ছে, সব ভাঙচুর করছে। ভাগ্যিস, ওই ফ্লোরের করিডরে একটা ফায়ার এক্সটিংগুইশার ছিল। আমি চট করে আগুন নিভিয়ে ফেলি। খবরটা পুলিশে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভদ্রমহিলা আমাকে আটকে দিলেন। আজ ওকে এখানে দেখে কথা বলতে গেলাম, কিন্তু উনি আমাকে চিনতে পারলেন না।’
‘তোর কেন মনে হল, মেয়েটা বিপদের মধ্যে রয়েছে।’
‘তড়পানোর সময় বুড়োটা কী বলছিল, কোন ভাষায় বলছিল, বুঝতে পারিনি। কিন্তু লোকটার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে আমার মনে হল, ভদ্রমহিলার গায়ে হাতও তুলতে পারেন।’
দেব বলল, ‘ঠিক বলেছিস। মেয়েটা আমার কাছে হেল্প চাইতে এসেছিল।’
‘করুন। কিন্তু আমার অন্য একটা কথা মনে হচ্ছে দেবদা। গত কয়েকদিনের মধ্যে স্টিফেন ম্যানসনে এ নিয়ে দু’বার আগুন ধরল। ক্ষয়ক্ষতি অল্পের উপর দিয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস, অগ্নিদেব তৃতীয়বার ফিরে আসবেন। এ বার কিন্তু গ্রাস করে ফেলবেন পুরো বাড়িটাকে। শিখিনদাকে আমি অলরেডি অ্যালার্ট করে দিয়েছি।’
কথাটা শুনে দেব হাঁ করে তাকিয়ে রইল অনিরুদ্ধর দিকে। ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট থেকে সামান্য আগুন লাগার ঘটনা। তার সঙ্গে পুরাণ যুগের অগ্নিদেবতার কী সম্পর্কে!
(এগারো)
স্কুলে প্রণব স্যার বলতেন, ‘মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা আর সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যে অনেক দূরত্ব রে। মাঝের রাস্তাটা অনেক লম্বা। প্রত্যেকের উচিত, প্রতিদিন ব্যবধান কমিয়ে আনা।’
মানুষ হওয়ার… মানেটা প্রণব স্যার অবশ্য একদিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন টিফিন পিরিয়ডে শিখিনরা কয়েকজন মিলে স্কুলের বাইরে মিষ্টির দোকানে টিফিন খেতে বেরিয়েছিলেন। স্কুলের পাশেই ট্রাম লাইন। টিফিনের সময় ট্রাম থেকে নামতে গিয়ে পড়ে যান বয়স্ক এক ভদ্রলোক। শিখিনরা দৌড়ে গেছিলেন তাঁর শুশ্রুষার জন্য। স্কুলের বারান্দা থেকে সেটা বোধহয় চোখে পড়েছিল প্রণব স্যারের। ক্লাসে গিয়ে বসার পর স্যার বলেছিলেন, ‘আজ তোরা যা করলি, সেটাই মানবিক। আমরা মানুষ হয়ে জন্মেছি, এটা আমাদের সৌভাগ্য। কিন্তু ক’জন সত্যিকারের মানুষ হতে পারে? মানুষ হওয়ার জন্য মানবিক হওয়া দরকার। এটা একটা লম্বা জার্নি। যে যত দ্রুত দূরত্বটা কমিয়ে আনতে পারবে, সে তত তাড়াতাড়ি মানুষ হয়ে উঠবে।’
প্রণব স্যার অদ্ভুত পোশাকে স্কুলে আসতেন। হলুদ হাফ হাতা শার্ট, হলুদ ধুতি আর মাথায় হলুদ গান্ধী টুপি। সম্ভবত, কোনও ধর্মীয় সংস্থার সঙ্গে উনি জড়িয়ে ছিলেন। উনি ঢুকলেই সারা স্কুল চুপ হয়ে যেত। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর মার্কশিট নিয়ে যেদিন শিখিন স্কুল থেকে বেরিয়ে আসেন, সেদিন প্রণব স্যারকে প্রণাম করে বলে এসেছিলেন, ‘আপনাকে খুব মিস করব স্যার। আশীর্বাদ করুন, যেন মানুষ হতে পারি।’ স্যারের চোখের কোণ ভিজে উঠেছিল। বলেছিলেন, ‘তোর মতো স্টুডেন্টও আর পাবো না রে শিখিন। এই স্কুল থেকে যারা বেরোয়, লাস্ট দিন কেউ বলে যায় ডাক্তার হবে বা ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু কেউ কখনও বলে যায়নি মানুষ হবো। তুই-ই প্রথম বললি। স্কুলে আর না পড়ালেও আমার চলবে।’
প্রণব স্যারের কথাটা আজ খুব বেশি করে মনে পড়ছে। অনিরুদ্ধ এসে খবরটা দেওয়ার পর। আগুনে হেস্টিংস বস্তির যে মেয়েটার বইপত্তর পুড়ে গিয়েছিল, তাকে খুঁজে পেতে অনি বই-খাতা কেনার টাকা দিয়ে এসেছে। ওর বাবাকেও বলে এসেছে, মেয়েটা যতদিন স্কুলে পড়বে, ততদিন পড়াশুনোর খরচ ও দিয়ে যাবে। অনির ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কি, শিখিন জানতেন না। একটু আগে খুঁটিয়ে সব জেনেছেন। ওর বাবা বারাসতে কোনওরকমে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছেন। এখন রিটায়ার্ড। ওরা দুই ভাই-বোন। মাকে নিয়ে চারজনের সংসার অনির মুখের দিকেই তাকিয়ে। শুনে ওকে একটু বকাবকিই করেছেন শিখিন। ‘শোন, ফাইনান্সিয়াল বার্ডেন তোকে নিতে হবে না। আমার তিন কুলে কেউ নেই। মেয়েটার ভার আমি নিলাম। ওর বাবাকে এর মধ্যে একদিন আমার কাছে নিয়ে আসবি।’
অনি প্রথমদিকে গাঁইগুই করেছিল। পরে বলে গেল, ‘স্যার, আপনার মুখের উপর কথা বলার সাহস আমার নেই। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আপনি যা ভাল বোঝেন, তাই করুন।
ডিউটি শেষ হওয়ার পর প্রতিদিন একবার করে ছেলেটা চেম্বারে এসে দেখা করে যায়। ফায়ার সার্ভিস আর বডি বিল্ডিং নিয়ে অসীম আগ্রহ। তাই ওর সঙ্গে ওয়েভ লেংথে মেলে শিখিনের। আজ শহরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেনি। অগ্নিদেব রুষ্ট হননি। অফিসে সকাল আটটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত স্রেফ আড্ডা মেরে কাটাতে অনির ভাল লাগেনি। এমন ছটফটে, তাঁর বাড়িতে ছুটে এসেছে ফায়ার ফাইটিংয়ের গল্প শুনতে। শেষে এমন একটা প্রশ্ন করল, যার উত্তর শিখিনের জানা ছিল না। দমকলের লোকেরা কেন ঝোলানো ঘণ্টা বাজিয়ে আগুন নেভাতে যায়? কেন ইলেকট্রিক বেল-এর ব্যবস্থা করা হয় না? শিখিন ভেবেই রেখেছেন, বরেনদার কাছে উত্তরটা জানতে চাইবেন। বরেনদা একটা সময় দমকলের ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন। ফায়ার সার্ভিসের উপর বেশ কয়েকটা বইও লিখেছেন। সেই বই ফায়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে পড়ানোও হয়। বাংলার ফায়ার সার্ভিসে যে ক’জন কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গেছেন, বরেনদা তাঁদের মধ্যে একজন।
অনি যেমন এখন তাঁর কাছে আসে, শিখিনও তেমন চাকরি জীবনের গোড়ায় বরেনদার কাছে ঘুরঘুর করতেন। তাঁর কাছে শিখিন শুনেছেন, বেশ কয়েক বছর হল, ক্যালকাটা ইউনির্ভাসিটি ফায়ার সার্ভিসের উপর একটা কোর্স চালু করেছে। সায়েন্স গ্রাজুয়েটরাই সেখানে ভর্তি হতে পারে। যারা পাশ করে বেরোচ্ছে, তাদের জন্য চাকরি বাঁধা। ইদানীং মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং, শপিং মল, অফিস বা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সে ফায়ার এক্সপার্টদের চাকরি দেওয়ার রেওয়াজ উঠেছে। বেতন খারাপ না। এটা যদি শিখিন আগে জানতেন, অনিকে তা হলে পরামর্শ দিতেন, ইউনিভার্সিটির কোর্সটা পড়ে আসতে। এখন চাকরি করে ওর পক্ষে কোর্স কমপ্লিট করা সম্ভব না।
টেবলের উপর রাখা মোবাইল ফোনটা বাজছে। সেট তুলে শিখিন পর্দায় দেখলেন কিংকরের নাম। পাশে লেখা আছে বাঙাল। ফোনে দু’জন কিংকরের নাম সেভ করা আছে। একজন বাঙাল কিংকর, অন্যজন টিভি সারানোর মেকানিক। বাঙাল কিংকর তাঁর সঙ্গে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ত। কার মুখে যেন শিখিন শুনেছিলেন, ও কলকাতা পুলিশে ঢুকেছে। কিছুদিন আগে আইনক্সে সিনেমা দেখতে গিয়ে বাঙালটার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সঙ্গে ওর বউ আর মেয়ে। ব্যাটাচ্ছেলে খুব মুটিয়ে গেছে। অথচ কলেজ লাইফে ও জোড়াবাগান পার্কে পঞ্চানন ব্যায়াম সমিতির আখড়ায় গিয়ে হিন্দুস্তানিদের সঙ্গে রীতিমতো কুস্তি লড়ত। আইনক্সে শিখিন জানতে পারেন, কিংকর রিসেন্টলি বাঁশদ্রোণী থানার অফিসার ইনচার্জ হয়েছে। ‘একদিন আসিস আমার কোয়ার্টারে। জমাইয়া আড্ডা মারুম।’ কথাটা বলে বউ আর মেয়েকে নিয়ে কিংকর সিনেমা হলে ঢুকে গেছিল। হঠাৎ কী দরকারের ব্যাটা ফোন করল?
তিনি সুইচ অন করতেই, কিংকর বলল, ‘হালায় অফিসে বইস্যা কি মাড়াইতাসো ফেরেন্ড? আইজ তো তোমাগো কোনও কাম নাই। বইস্যা গরমেন্টের অন্ন ধ্বংস করত্যাস।’
কলকাতার কোথাও দমকলের ডাক পড়েনি। তাই কিংকরের এই টিপ্পনি। শিখিন পাল্টা বললেন, ‘তুই যে কত কাজ করছিস, সে তো বোঝাই যাচ্ছে।’
‘এহানে আইস্যা দেইখ্যা যা। হালায় থানার সামনে অহন একশো লোক জড়ো হইয়া আসে। কী করুম ঠাওর করতে পারতাসি না।’
‘কেন, কোনও পলিটিক্যাল ক্ল্যাশ হয়েছে না কি?’
‘আরে না ফেরেন্ড। আগে ক’ তো, পাতকুঁয়া থেইক্যা মানুষ তোলার কাজটা কি দমকলে করে?’
‘হ্যাঁ রেসকিউর কাজ আমরা করে থাকি। তবে তোদের পুলিশেও একটা ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট উইং আছে। কী হয়েছে বল তো?’
‘আমার এরিয়ার একটা ফাগল পাইতকুয়ার নাইম্যা গ্যাসে। কিছুতেই উইঠ্ঠা আসতাসে না। কী করুম ক’।’
কলকাতার মধ্যে এখনও কোথাও পাতকুয়া আছে বলে শিখিনের জানা নেই। ছোটবেলায় বিডন স্ট্রিটে তিনি পাতকুয়ো মিস্ত্রিদের দেখেছেন। ‘ঘটি-বাটি তুলবে না কি গো’ বলে হাঁক দিয়ে যারা রোজ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত। জল তোলার সময় কোনও গেরস্থের ঘটি-বাটি পাতকুয়োয় পড়ে গেলে, মিস্ত্রিরা তুলে দিত। কিন্তু সে তো চল্লিশ বছর আগেকার কথা। তখন নর্থ ক্যালকাটার অনেক বাড়িতে পাতকুয়ো ছিল। এই কয়েকবছর আগে লিলুয়ায় পাতকুয়োয় পড়ে গিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে মারা যায়। তার পর থেকে কর্পোরেশন পাতকুয়ো ব্যানড করে দিয়েছে কলকাতায়? তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘পাতকুয়োটা কোথায়?’
কিংকর বলল, ‘আর কইস না। আমার এরিয়ায় সোনামণি পার্কে। বাইশ-তেইশ বসরের একডা পোলা কুয়ার নীচে নাইম্যা বইস্যা আসে। হালায় কয়, রিসার্চ করত্যাসে। হোন ভাই, দমকলের টিম লইয়্যা তুই আয়। ল্যাডার দিয়া নাইম্যা হ্যারে তোল। তার পর আচ্ছা কইর্যা হ্যারে পিটামু।’
কথাটা শুনে হাসি পেল শিখিনের। কুয়োর ভিতর ল্যাডার নামানো যায় না। পুলিশ বোধহয় অনেকক্ষণ অনুরোধ করেও ছেলেটাকে তুলতে পারেনি। তাই বাঙালটা চটে গেছে। ও বলল, ‘কিংকর, তুই আগে ওয়ান জিরো ওয়ানে কাউকে একটা ফোন করতে বল। অথবা বাঁশদ্রোণীতে আমাদের ছোট একটা ফায়ার স্টেশন আছে। সেখানে খবর দে। দেখছি, কী করতে পারি।’
এই ধরনের রেসকিউ করার কাজ দমকলের লোকেদের মাঝেমধ্যেই করতে হয়। সোনামণি পার্ক জায়গাটা বাঁশদ্রোণীর ঠিক কোথায়, সেটা ভাল করে জেনে নিয়ে তিনি কন্ট্রোল রুমে ফোন করলেন। নিজেই ঘটনাটা জানিয়ে বললেন, ‘ফায়ার ইঞ্জিন পাঠানোর কোনও দরকার নেই। আমি নিজেই একবার বাঁশদ্রোণী থেকে ঘুরে আসছি। তেমন প্রয়োজন পড়লে বাঁশদ্রোণী অথবা পাঁটুলি স্টেশন থেকে পাম্প ডেকে নেবো।’
গাড়িতে উঠে হাতঘড়িতে চোখ রাখলেন শিখিন। রোববারের বেলা আড়াইটে। রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। দক্ষিণমুখী রাস্তা ধরে এগোনোর সময় মালদহের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল শিখিনের। তখন তিনি ইংলিশবাজারে পোস্টেড। সেখানে এক শীতের দিনে মাঝবয়সি এক মেন্টাল পেসেন্ট পাতকুয়োয় নেমে বসে ছিল। ডাকাডাকির পরও উঠে আসে না। দমকল কর্মীরা নামার চেষ্টা করলেই সে হুমকি দিচ্ছিল, জলে ঝাঁপ দেবে। বুদ্ধি করে শিখিন ওর ফ্যামিলির লোকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। জানতে পারেন, লোকটাকে একবার বাঁদরে কামড়ে দিয়েছিল। তার পর থেকে বাঁদর দেখলেই ভয় পায়। তখন তিনি স্থানীয় লোকদের বলেন, কোথাও থেকে বাঁদর ধরে আনতে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে, মাদারির খেলা দেখায়, এমন একজন লোককে ধরে আনা হল। কুয়োর উপর থেকে তখন শিখিন বাঁদরটাকে দেখিয়ে পাল্টা হুমকি দেন, উঠে না এলে, বাঁদরটাকে নীচে পাঠিয়ে দেবেন। ব্যস, তাতেই কাজ হয়ে যায়। সুড়সুড় করে লোকটা শেষপর্যন্ত উঠে আসে।
আধঘণ্টা পর সোনামণি পার্কে পৌঁছে শিখিন বুঝতে পারলেন, কর্পোরেশনের অ্যাডেড এরিয়া। মেট্রো রেলের দক্ষিণ দিকে, বেশ খানিকটা ভিতরে। বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের। পূর্ববাংলা থেকে আসা। টালির চাল, টিন বা দরমার বেড়া দেওয়া বাড়ি-ঘর দেখে মনে হয়, দিন আনি, দিন খাই টাইপের মানুষের বসবাস। খুঁজে বাড়িটায় গিয়ে শিখিন দেখলেন, প্রায় দু’শো লোকের ভিড় কুয়ো ঘিরে। জল অনেক গড়িয়েছে। স্থানীয় বিধায়ক এসেছিলেন, তাঁকে ধাক্কাধাক্কি করে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির উঠোনে একটা চেয়ারে কিংকর বসে আছে। ওকে ঘিরে পাড়ার ছেলেরা যা তা বলে যাচ্ছে। মুখ কালো করে কিংকর বলল, ‘দেখছস তো কী অবস্থা। শুয়ারটারে তুইল্যা আন ভাই।’
মেন্টাল পেসেন্ট ছেলেটির মা লক্ষ্মী বাগুই বারান্দায় বসে কেঁদে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিলাপ করছে, ‘আমার রথীন এমনডা ছেল না গো। ইস্কুলে ফার্স্ট হত। কে যে ওকে কী খাওয়াল, তার পর থেকে মাথা খারাপ হয়ে গ্যাছে।’
উঠোনের একধারে কুয়ো। যতটা চওড়া হওয়া উচিত, ততটা নয়। উঁকি মেরে শিখিন দেখলেন, বেশ গভীর। অন্তত কুড়ি ফুট তো হবেই। নীচের নামার জন্য একহাত অন্তর লোহার কাঁটা দেওয়া আছে। কিন্তু এত অপ্রশস্ত যে, দু’তিন জন একসঙ্গে নামতে বা উঠতে পারবে না। রথীন বলে ছেলেটা কুয়োর ভিতর জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে একটা কাচের নল। মিনিট তিন-চারেক মন দিয়ে ছেলেটাকে লক্ষ্য করে, শিখিন দেখলেন, নলে জল ভরে, নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে ও কী যেন পরীক্ষা করছে। তার পর বিড়বিড় করে সেই জল ফের কুয়োয় ফেলে দিচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ছেলেটা প্রকৃতিস্থ নয়।
পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন শিখিন। একেকজন একেক রকম কথা বলছে। ঘটনাগুলো তিনি পরপর সাজিয়ে নিলেন। লক্ষ্মী বাগুই এ বাড়ির ভাড়াটে। পরিচারিকার কাজ করে ও সংসার চালায়। বাড়িতে থাকে ওর বৃদ্ধা মা আর ছেলে রথীন। রোজ এইসময়টায় রথীন দিদিমাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তার পর নিজে স্নান সেরে মায়ের জন্য অপেক্ষা করে। আজ কাজ থেকে ফিরে রথীনকে ঘরে দেখতে পায়নি লক্ষ্মী। তখন ভেবেছিল, ছেলে চণ্ডী মন্দিরে আড্ডা মারতে গেছে। কিন্তু স্নান করার জন্য কুয়োতলায় গিয়ে ও দেখতে পায়, রথীন নীচে বসে আছে। বারবার উঠে আসতে বলায় ছেলে না কি বলে, ‘মা, আমি এখন রিসার্চ করছি। আমাকে ডিসটার্ব কোরো না।’ উপায় না দেখে লক্ষ্মী তখন হাঁক-ডাক করে লোকজন জড়ো করে।
রথীনকে কীভাবে তুলে আনা যায়, তা নিয়ে মাথা ঘামাতে লাগলেন শিখিন। তিনি নিশ্চিত, সমস্যাটা ওর রিসার্চ করা নিয়ে। কী নিয়ে ও রিসার্চ করতে নেমেছে, সেটা জানতে পারলেই ওকে তুলে আনা যাবে। বাড়িওয়ালাকে ডেকে প্রথমে একচোট ধমকালেন তিনি। ‘কর্পোরেশন কতদিন আগে কুয়ো খোঁড়া বন্ধ করে দিয়েছে, জানেন? বছর দশেক আগে। জানেন কী, ছেলেটার যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়, তা হলে পুলিশ আপনাকে অ্যারেস্ট করতে পারে?’
শুনে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল বাড়িওয়ালার। বলল, ‘আমার কোনও দোষ নেই স্যার। এই কুয়োটা আগে থেকেই ছিল। এখানে কর্পোরেশনের জল আসে না। এই কুয়ো থেকে আমরা জল পাই, তাই খাই।’
বয়স্ক এক প্রতিবেশী এগিয়ে এসে বললেন, ‘স্যার আমি রিটায়ার্ড স্কুল টিচার। অনেকদিন এই অঞ্চলে আছি। এ ঠিক বলছে স্যার। কুয়োটা অনেক পুরনো।’
‘তা হলে কুয়োটা খুঁড়েছিল কে?’
‘স্যার, তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে ওএনজিসি থেকে লোকজন এসে এই অঞ্চলে খোঁড়াখুড়ি করেছিল। তখন কাগজে দেখেছিলাম, কলকাতার এই এরিয়াটা না কি তেলের উপর ভাসছে। মানে পেট্রোলিয়াম অয়েল। খালের এ পাশে গড়িয়া পর্যন্ত অনেকগুলো জায়গায় ওঁরা ড্রিল করেন। আমি তখন কাছেই বিভাবতী স্কুলে পড়াতাম। হঠাৎ একদিন দেখলাম, ড্রিলিং বন্ধ করে ওঁদের লোকজন চলে গেলেন। গর্তগুলো ওঁরা ভরাট করে যাননি। এই অঞ্চলটা তখন ফাঁকাই পড়ে ছিল। দেখে আমরা রিফিউজিরা জবরদখল করে নিই। স্যার, গিয়ে দেখবেন চলুন, এখানে অনেকের বাড়িতেই এ রকম কুয়ো আছে।’
চট করে একটা কথা মাথায় এল শিখিনের। মুচকি হেসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘রথীন যাদের সঙ্গে চণ্ডী মন্দিরে আড্ডা মারে, তাদের মধ্যে কেউ এখানে আছে? আমি কথা বলতে চাই।’
একজন বলল, ‘আছে স্যার। পাগলা পেট্রল। ড্রিলিংয়ের সময় এখানে লেবারের কাজ করত। কাজ চলে যাওয়ার পর থেকে ওর মাথায় গুন্ডগোল দেখা দেয়। বেশিরভাগ সময় ও এখন চণ্ডী মন্দিরেই পড়ে থাকে। আর রথীনের সঙ্গে গুজগুজ করে।’
শুনে মুচকি হাসলেন শিখিন। তার পর বললেন, ‘কেউ যাও। এখুনি পাগলা পেট্রোলকে ধরে নিয়ে এসো।’
(বারো)
একটু ভয়ে ভয়েই দু’নম্বর গেট দিয়ে স্টিফেন ম্যানসনে ঢুকল কোয়েল। বিশাল বাড়িটার পাশ দিয়ে রোজ ও হেঁটে যায়। কোনওদিন ভিতরে ঢোকার প্রয়োজন হয়নি। আজ সন্ধে সাতটার মধ্যে ওকে মিসেস ভাল্লার ফ্ল্যাটে যেতে হবে। ফোনে উনি বলে দিয়েছিলেন, কোন গেট দিয়ে কোন ব্লকে যেতে হবে। কত নম্বর লিফট দিয়ে উঠে কোন ফ্ল্যাটে যাবে। মিডলটন রো-র গায়ে দু’ নম্বর গেটের সামনে কোয়েল দাঁড়িয়ে দেখল, একটা ঘরের সামনে সাইনবোর্ডে লেখা আছে, স্টিফেন ম্যানসন ফ্ল্যাট ওনার’স অ্যাসোসিয়েশন অফিস। সেখানে একজন সিকিউরিটি গার্ড বসে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। পরনে সবুজ ড্রেস। সে জিজ্ঞেস করল, ‘ম্যাডাম, কার কাছে যাবেন?’
কোয়েল বলল, ‘মিসেস সুনীতা ভাল্লা। ফাইভ বাই থ্রিতে।’
‘ওহ, বুটিক ম্যাডাম? ওঁর সঙ্গে কি অ্যাপোয়েন্টমেন্ট আছে?’
‘হ্যাঁ। ফোনে একটু আগেই ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে।’
গার্ড একটা রেজিস্টার খাতা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনার ডিটেলস এখানে লিখে দিন।’
চট করে কোয়েল নাম, ঠিকানা আর ওর ফোন নাম্বারটা লিখে দিল। খাতায় চোখ বুলিয়ে গার্ড জিজ্ঞেস করল, ‘কী দরকারে যাচ্ছেন, ম্যাডাম সেটা কিন্তু আপনি লেখেননি।’
শুনে কোয়েল একটু বিরক্তই হল। ফ্ল্যাটবাড়িতে এই একটা প্রবলেম। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে একটা হাউসিং কমপ্লেক্সে ও রুক্মিণী ম্যাডামকে যোগা শেখাতে যায়। ওখানেও প্রতিবার রেজিস্টারে নাম লিখতে হত। কিন্তু একদিন ম্যাডাম ওখানকার গার্ডকে বলে দেওয়ার পর, এখন ওকে আর লিখতে হয় না। সোজা লিফটে করে উঠে যায়। এখানে গার্ডের প্রশ্নটা শুনে খাতায় কোয়েল লিখল, অফিসিয়াল। ফের প্রশ্ন, ‘ম্যাডাম, আপনি কি বুটিকের কোনও কাজে এসেছেন?’
‘কেন বলুন তো?’
‘না, মানে… কারণ আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি। জানেনই তো, বুটিক ম্যাডাম এখন পায়ে প্লাস্টার বেঁধে শুয়ে আছেন। বুটিকের কাজ এখন উনি নিচ্ছেন না। ম্যাডাম স্ট্রিক্টলি বলে দিয়েছেন, বুটিক নিয়ে কথা বলতে আসা, কেউ যেন ফ্ল্যাটে না যেতে পারেন। তবে ট্যারো কার্ড সংক্রান্ত কেউ এলে আটাকাতে বারণ করে দিয়েছেন।’
কোয়েলের মনে পড়ল, বুটিকের ব্যবসা ছাড়াও মিসেস ভাল্লা জ্যোতিষ চর্চা করেন। ট্যারো কার্ড না কী একটা আছে, সেসব দেখে লোকের ভবিষ্যৎবাণী করেন। এবং তাতে না কি ভাল রোজগার করেন। জ্যোতিষে কোয়েল বিশ্বাস করে না। নিজের ভবিষ্যৎ জানার আগ্রহ ও বোধ করে না। কী হবে জেনে? মা বলে, ওপরওয়ালা যা লিখে রেখেছে, সেটা কেউ খণ্ডাতে পারবে না। আগেভাগে সেটা জেনে লাভ কী? মাথা ঠান্ডা রেখে ও বলল, ‘আমি যোগা টিচার। ভাল্লা ম্যাডামকে ফিজিওথেরাপি করাতে এসেছি।’
‘আপনার নামটা খুব সুন্দর ম্যাডাম।’ বলে বোকার মতো হাসল গার্ড। তার পর বলল, ‘যান, আপনি লিফট দিয়ে ফিফথ ফ্লোরে চলে যান। লিফট থেকে বেরিয়ে ডানদিকে থার্ড ফ্ল্যাটটাই বুটিক ম্যাডামের।’
গায়ে পড়ে ঘনিষ্ঠতা করার চেষ্টা একেবারে পছন্দ করে না কোয়েল। উপেক্ষার চোখে তাকিয়ে ও লিফটের দিকে হাঁটা দিল। নার্সিং হোম থেকে বেরনোর সময় তমাল একবার বলেছিল, ‘স্টিফেন ম্যানসনে সন্ধেবেলার দিকে তোমার একা না যাওয়াই ভাল। ওখানে উল্টোপাল্টা লোকের ভিড়।’ প্রথম দিন বলে তমাল ওর সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু কোয়েলই না করে দেয়। করিডর ধরে লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো পর্যন্ত ওর চোখে পড়ল, সত্যিই অনেক অবাঞ্ছিত লোকের ভিড়। ড্রাইভওয়ের ধারে গোডাউন আছে। একপাশে চটের বস্তায় মাল ডাঁই করা। কাঁধে করে পেটি নিয়ে এসে দু’তিনজন ঘরে ঢোকাচ্ছে। করিডরে চৌকিতে বসে চার-পাঁচজন তাস খেলায় ব্যস্ত। অচেনা মুখ দেখে দু’একজন ওর দিকে তাকাল।
পুরনো আমলের কোলাপসিবল গেট দেওয়া লিফট। সুইচ টেপা মাত্রই ঘড়ঘড় আওয়াজ করতে করতে গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে দাঁড়াল। ভিতরে কেউ নেই। কোলাপসিবল গেটটা টেনে কোয়েল খুলতে পারল না। লিফটের পাশেই সাধারণত সিঁড়ি থাকে। ডানদিকে তাকিয়ে ও দেখল, কাঠের সিঁড়ি উপর দিকে উঠে গেছে। কিন্তু একতলার ল্যান্ডিংয়ের দিকটায় আবছা অন্ধকার। তার মানে কোনও কারণে আলো জ্বলছে না। এমনিতে লিফটে উঠতে ভয় করে কোয়েলের। কোনও কারণে মাঝপথে যদি আটকে যায়, তা হলে? ও ঠিক করতে পারল না, সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে ছয়তলায় উঠে যাবে, না কি লিফটে উঠতে চাওয়া কারও জন্য অপেক্ষা করবে। ওর মন বলল, অচেনা বাড়িতে একা সিঁড়ি দিয়ে ওঠা ঠিক হবে না। কোত্থেকে যেন কটু একটা গন্ধ ভেসে আসছে। গাঁজা? হতে পারে। অন্ধকার সিঁড়িতে বসে বোধহয় কেউ গাঁজা টানছে।
কোয়েলকে অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওরই বয়সি একটা মেয়ে লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে একটা অ্যালসেশিয়ান। লম্বা জিভ বের করে হাঁফাচ্ছে। মেয়েটা বোধহয় ম্যানসনেই থাকে। সন্ধেবেলায় পোষা ডগিকে পটি করাতে গেছিল। মেয়েটা জোর হ্যাঁচকায় লিফটের দরজা খুলে ডগিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল। এমনিতেই, কুকুর দেখলে ভীষণ ভয় পায় কোয়েল। লিফটে ঢুকতে ও ইতস্তত করছে দেখে, মেয়েটা বলল, ‘ভয় পেও না দিদি। ডলি খুব বাধ্য। কাউকে কামড়ায় না।’ কথাগুলো বলেই মেয়েটা ধমকাল, ‘ডলি, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।’
লিফট বন্ধ করার আগে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ক’তলায় যাবে গো?’
কুকুরটাকে এড়িয়ে চট করে লিফটের ভিতর ঢুকে কোয়েল বলল, ‘ফিফথ ফ্লোর।’ বলেই বোর্ডের পাঁচ নম্বর সুইচটা ও টিপে দিল।
লিফটের ভিতর চারদিকে তাকিয়ে কোয়েল অবাক হয়ে গেল। এমন ভিনটেজ লিফট আগে মাত্র একবার ওর চোখে পড়েছে। বছর দুয়েক আগে ইন্ডিয়ান টিমের হয়ে ও থাইল্যান্ডে এশিয়ান যোগ কম্পিটিশনে গেছিল। ওদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল, পাটায়ায় এক হেরিটেজ বিল্ডিংয়ে। সেখানকার লিফটটাও ছিল এই রকম। তিনটে দেওয়ালই বার্মিজ টিক-এর দু’পাশে বেলজিয়াম কাচের আয়না। সিলিংয়ের দিকটায় রংবেরং কাচের কারুকার্য। সুইচ বোর্ড আর ঘণ্টি পেতলের। মেঝেটা সাদা পাথরের। দেখেই কোয়েলের মনে হল, এ সাহেবদের আমলের তৈরি। সুইচের পাশে লেখাও আছে কোম্পানির নাম, বার্ন অ্যান্ড মার্টিন, লন্ডন। ১৯৫০ সাল। তার মানে প্রায় সত্তর বছর আগেকার লিফট। তবে, এক নজরেই বোঝা যায়, এত সুন্দর ভিনটেজ লিফটটার কোনও যত্ন নেওয়া হয় না। কোলাপসিবল গেটের দু’একটা ডাঁটির স্ক্রু খুলে গেছে। কাত হয়ে আছে। মেঝেটা ধুলোয় মলিন। সুইচের জায়গাটাতেও ময়লা।
রুক্মিণী ম্যাডামদের বাড়ির লিফটটা সাঁ করে উপরে উঠে যায়। আপনা আপনি দরজা খোলে। কিন্তু এই লিফটটাকে প্রচণ্ড একটা শব্দ তুলে উপরের দিকে উঠতে শুরু করল। কেউ যেন হ্যাঁচকা মেরে তুলছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কোয়েল দেখল, সাতটা বেজে পাঁচ। অলরেডি পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেছে। তার মানে এর মধ্যে একটা ব্যায়াম করানো হয়ে যেত। মিসেস ভাল্লাকে ওর টাইম দেওয়ার কথা এক ঘণ্টা। অভিজ্ঞতা থেকে কোয়েল জানে, ক্লায়েন্টরা একটা মিনিটও নষ্ট করতে চায় না। দেরি হলে তাঁদের মুখ তেতো হয়ে যায় মিসেস ভাল্লাও আজ খ্যাঁচখ্যাঁচ করবেন। কী আর করা যাবে? এখন লিফটটা ঠিকঠাক ফিফথ ফ্লোরে পৌঁছতে পারলে হয়।
যা আশঙ্কা করছিল, ঠিক তাই হল। তিন-চার সেকেন্ডের মধ্যে ঘটাং ঘটাং আওয়াজ করে হঠাৎ লিফটটা আটকে গেল। কোয়েল চমকে উঠে দেখল, দুটো ফ্লোরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে গেছে। ওর বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। পাশ ফিরে ও সঙ্গী মেয়েটার দিকে তাকাল। নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে। তার মানে, লিফটে আটকে পড়ার অভিজ্ঞতা ওর আছে। ময়লা সালোয়ার-কামিজে ওকে কাজের মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। ডান হাতে ডগিটাকে সামলানোর ফাঁকে, বাঁ হাতে মোবাইল বের করে ও কাকে যেন ফোন করতে লাগল। দু’তিনবার চেষ্টা করার পর লাইন পেয়ে বলল, ‘দিদি, নাজমা বলছি। লিফট আটকে গেছে। তুমি কেয়ারটেকারকে ফোন করো।’
‘কোন ফ্লোরে আটকেছে?’
‘ফার্স্ট ফ্লোরে।’ নাজমা বলে মেয়েটা কথা শেষ করার আগে আরও বড় বিপদ। হঠাৎ লিফটের আলো নিভে গেল। তার পোড়া একটা গন্ধ ওদের নাকে এল। সঙ্গে সঙ্গে নাজমা বলে উঠল, ‘এই যাঃ, দিদি লাইট চলে গেল। এখন কি হবে?’ প্রশ্নটা করার সময় ওর গলা কেঁপে গেল।
কোয়েল সব কথাবার্তাই শুনতে পাচ্ছে। সেইসঙ্গে নিজের বুকের ধড়াস ধড়াস শব্দ। আশপাশ কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে অন্ধকার কোনও গুহার মধ্যে ও দাঁড়িয়ে আছে। ভাগ্যিস, নাজমা আর ওর ডগি সঙ্গে আছে। একা লিফটে উঠলে এতক্ষণে ভয়ে ও অজ্ঞানই হয়ে যেত। কাঠের হ্যান্ডেলটা কোয়েল শক্ত করে ধরে থাকল। তখনই ফোনে শুনতে পেল, ‘তোর কাছে টর্চ আছে?’
নাজমা বলল, ‘হ্যাঁ দিদি। তাড়াতাড়ি করো। ভয় লাগছে।’
এমন পরিস্থিতিতে কোয়েল কখনও পড়েনি। মা বলে, বিপদে পড়লে লোকনাথবাবার নাম স্মরণ করবি। দেখবি, উনি এসে ঠিক তোকে উদ্ধার করবেন। এর আগে কোনওদিন ওর লোকনাথবাবাকে ডাকার প্রয়োজন হয়নি। এমন কী, মাকে নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়ার সময়ও নয়। আজ চোখ বন্ধ করে ও লোকনাথবাবাকে মনে মনে বলল, ‘বাঁচাও বাবা। আমার কোনও বিপদ হলে মায়ের কী হবে?’ কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে ও দেখল নাজমা হ্যান্ডব্যাগ থেকে টর্চ বের করে জ্বালিয়েছে। কোলাপসিবল গেটের দিকে আলো ফেলে ও বোঝার চেষ্টা করছে, কারও নজরে পড়েছে কি না। অন্ধকারে অশান্ত হয়ে হঠাৎ ডগিটা চেল্লাতে শুরু করেছে। ঠিক তখনই কোয়েলের মনে হল, দেবদা আর তমালের কথা। ওদের কাউকে ফোন করা উচিত। সিলভার জিম বা হোটেল খুব বেশি দূরে নয়। পা চালিয়ে এলে, স্টিফেন ম্যানসনে পৌঁছতে তিন-চার মিনিটের বেশি সময় লাগবে না।
ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল ফোনটা বের করে কোয়েল দ্বিধায় পড়ল, আগে কাকে ফোন করবে? এই সময়টায় দেবদা জিম-এ ওয়ার্ক আউট করে। যদি ব্যায়াম শুরু করে দিয়ে থাকে, তা হলে আসবে বটে, কিন্তু ওকে ডিসটার্ব করা হবে। কথাটা ভেবে কোয়েল তমালকে ধরার চেষ্টা করল। প্রথম চেষ্টাতে ওকে পেয়েও গেল। ও প্রান্ত থেকে তমাল বলল, ‘কী ব্যাপার কোয়েল? এখন ফোন করলে?’
দু’চার কথায় পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিয়ে কোয়েল বলল, ‘তোমাকে সঙ্গে না নিয়ে এসে আমি ভুল করেছি। প্লিজ, তুমি শিগগির এসো।’
তমাল বলল, ‘আসছি।’
টর্চ জ্বালিয়ে রেখেই নাজমা এতক্ষণে মুখ খুলল, ‘কার ফ্ল্যাটে যাচ্ছিলে দিদি?’
কোয়েল বলল, ‘মিসেস সুনীতা ভাল্লা।’
‘ওরে বাবা, সে তো খোচো টাইপের আন্টি। এ বাড়ির কারও সাথে তার ভাব নেই।’
কাজের মেয়ের মুখ থেকে এ রকম একটা মন্তব্য শুনবে, কোয়েল আশা করেনি। মিসেস ভাল্লা কী টাইপের, সে ও ভালমতো জানে। তাই প্রসঙ্গ ঘোরাল, ‘এই লিফটটা কি প্রায়ই এ রকম ট্রাবল দেয়?’
‘দিনে পাঁচবার করে আটকে যায়। কারও কোনও হুঁশ নেই। এই দু’নম্বর লিফটটা মিলেনা দিদিদের ফ্ল্যাটের সবথেকে কাছে। দিদি এতবার লিফট সারানোর কথা বলেছে, কেউ কানেই দেয় না। বলে কি না, এ সাহেবদের লিফট, এখন সারানো যাবে না। সারাতে গেলে যা খরচা হবে, তার থেকে কম টাকায় নতুন লিফট লাগানো হয়ে যাবে।’
‘লিফটে কি তুমি এর আগেও আটকা পড়েছ?’
‘দু’একবার পড়েছি। তবে দিনের বেলায়। রাতের বেলায় এই বাড়িটা ডেঞ্জার। বিশেষ করে, দোতলা অবধি। যে সব লোক ঘুরে বেড়ায়, তারা কেউ ভদ্দরলোক নয়। অনেককেই চিনি। মাতাল, নেশার ট্যাবলেট খায়। রাস্তা থেকে রেন্ডিদের তুলে আনে। সন্ধের পর আমরা কেউ সিঁড়ি দিয়ে নামি না দিদি। মেজেনাইন আর ফার্স্ট ফ্লোরে প্রায় রাতেই খারাপ কাজ হয়। কিছুদিন আগে একটা মেয়ে মার্ডার পর্যন্ত হয়ে গেছে।’
শুনে বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করে উঠল কোয়েলের। ও জিজ্ঞেস করল, ‘ফ্ল্যাটের মালিকরা কিচ্ছু স্টেপ নেয় না? সিকিউরিটি গার্ডগুলোই বা কী করে?’
‘তোমার মাতা খারাপ দিদি? এ বাড়িতে চারটে লিফট আছে। তিনতলা থেকে সাততলা অবধি যারা থাকে, তারা অন্য লিফটগুলো দিয়ে ওঠা-নামা করে। ও তিনটে লিফট এখনও বিগড়োয়নি। আমাদের মতো কাজের লোকেদের জন্য এই দু’নম্বর লিফট। তাই সারানোর জন্য কেউ উদ্যোগ নেয় না। আর গার্ডদের কথা কইছ। ওগুলো হারামি। গুণ্ডা-মাস্তানদের সঙ্গে ওদের ষড় আছে। কেউ কাউকে ঘাঁটায় না।’
লিফটের নীচের দিক থেকে কারও কথা শোনা যাচ্ছে। কোয়েল তাকিয়ে দেখল, দু’তিনজনের মাথা দেখা যাচ্ছে। নাজমা নীচের দিকে ঝুঁকে ওদের দেখে বলল, ‘সর্বনাশ দিদি। খতরনাক দু’তিনজন হাজির হয়ে গেছে। এরা যদি লিফটের দরজা খুলে ফেলে, তা হলে আমাদের কপালে দুঃখ আছে। মন্দের ভাল, ডলি আমাদের সঙ্গে আছে!’
ঢোঁক গিলে কোয়েল জানতে চাইল, ‘এরা দরজা খুলবে কী করে?’
‘প্রত্যেক ফ্লোরে লিফটের বাইরে দেওয়ালে একটা করে ফুটো আছে। তার ভিতরে রড ঢুকিয়ে চাপ দিলেই লিফটের দরজাটা আলগা হয়ে যায়। তখন ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া যায়। কয়েকদিন আগে এই ফ্লোরেই লিফটে আটকে গেছিলাম। এই পাতাখোরগুলো আমাকে বের করেছিল। কী বলব, নীচে নামানোর পর একজন আমাকে জাপটে ধরে। অন্য একজন বেলাউজের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল। দিনের বেলায় বলে আর এগোতে সাহস পায়নি।’
ডগিটা ক্রমাগত ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে। মা বলে, জন্তুরা না কি আগে বিপদের গন্ধ পায়। নাজমার কথাগুলো সত্যিই ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো। কলকাতায় আজকাল কত কী-ই না ঘটে যাচ্ছে! এত বড় একটা বাড়িতে কোনও অচেনা মেয়ে গুম হয়ে গেলে কাকপক্ষীও টের পাবে না। ভাবতেই কোয়েলের শরীরের ভিতর একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তখনই ও শুনতে পেল নীচের তলা থেকে কেউ বলছে, ‘নাজমা সোনা, দাঁড়া আমরা লিফটের দরজা খুলে দিচ্ছি। নীচ দিয়ে তোরা নেমে আয়।’
নাজমা সোনা… কথাটা শুনে কোয়েল চমকে উঠল।
(তেরো)
মাম্মি দেশের বাড়ি ইরেভেনে গেছে প্রায় হপ্তাখানেক আগে। মাম্মির সঙ্গে কথা বলার সময়ই পাচ্ছিল না মিলেনা। খবর নেওয়ার জন্য ও ভিডিয়ো কল করল। ফোনটা এসে ধরল ওর দাদার বউ ইভেতা। ইস্তাম্বুল থেকে ইভেতা এইসময় ইরেভেনে গিয়ে থাকবে, মিলেনা আশাই করেনি। ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘তুমি?’
ইভেতা হেসে বলল, ‘অবাক হচ্ছ কেন? কাল থেকে ডিলিয়ানে কার্পেট ফেস্টিভ্যাল শুরু। তোমার দাদা বিজনেসের কাজে এসেছে। আমিও ইস্তাম্বুলে গণ্ডগোলের মধ্যে না থেকে ওর সঙ্গে চলে এলাম। এখানে অন্তত মন খুলে দু’জনে কথা বলতে পারব।’
বছর দুয়েক আগে ইরেভেনে দাদার বিয়ে হয়েছে। আর্মেনিয়ানদের মধ্যে একটা প্রথা চালু আছে, নতুন বিয়ে হওয়া বউ প্রথম এক বছর স্বামী ছাড়া পরিবারের আর কোনও পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। একটু রক্ষণশীল পরিবারে এই নিষেধাজ্ঞাটা পাঁচ-সাত বছরও চলতে পারে। স্বামীর সঙ্গে অন্য কারোর সামনে কথা বলা বারণ। ইভেতা পড়াশুনো করেছে আমেরিকার নিউ জার্সিতে। আধুনিক মেয়ে। তাই প্রথম প্রথম ওর খুব অসুবিধে হত। তখন ফোনে ক্ষোভ জানাত। মিলেনার সঙ্গে এখনও ইভেতার সামনাসামনি দেখা হয়নি। কেননা, ড্যাডি কখনও ওকে ইরেভানে নিয়ে যায়নি। যতটকু চেনা, সবই ফোন মারফত। ইভেতা মেয়েটার মধ্যে এক ধরনের সারল্য লক্ষ্য করেছে ও। তাই ওর সঙ্গে কথা বলতে মিলেনার ভাল লাগে।
আর্মেনিয়ার রাজধানী হল ইরেভেন। মিলেনা শুনেছে, ইরেভেন থেকে ডিলিয়ান প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে। দাদার কার্পেটের ব্যবসা। ডিলিয়ানে ওর কার্পেট কারখানায় প্রায় শ’পাঁচেক লোক কাজ করে। দাদার বানানো কার্পেটের বিরাট চাহিদা আমেরিকা আর ইউরোপের বাজারে। অগাস্ট মাসের প্রথম শনিবারে ডিলিয়ানে কার্পেট ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়। সারা পৃথিবী থেকে ব্যবসায়ীরা এসে হাজির হন সেখানে। পনেরো দিন ধরে ফেস্টিভ্যাল চলে।
দাদা একটু অন্য প্রকৃতির মানুষ। খুব প্রোগেসিভ মাইন্ডের। চায় না, মাম্মি-ন্যানিদের মতো এখনকার মেয়েরা ঘরের কোণে বসে থাকুক। তাই বোধহয় বউকে ডিলিয়ানে নিয়ে গেছে। যাতে ব্যবসার কাজে লাগাতে পারে। বিশেষ করে, আমেরিকানদের সঙ্গে বিজনেস ডিল করার সময়। দেশের বাড়িতে গেছে যখন, ওরা তখন চট করে ফিরে আসবে না। দু’জনে মিলে নিশ্চয়ই বরফে মোড়া আরারত পর্বতে ঘুরতে যাবে। যদিও আরারত তুরস্কে, তবুও ওদের ওই অঞ্চলের সেরা ট্যুরিস্ট স্পট। এই সময়টয়ে আবহাওয়াও খুব ভাল থাকে ওখানে।
মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘মাম্মি কোথায় ইভেতা?’
‘কিচেনে। আজ এখানে লুসকার আতমহাতিক। মাম্মি রিলেটিভদের ইনভাইট করেছে। প্রায় শ’তিনেক লোক ইনভাইটেড। মাম্মি তাদের জন্য ডোলমা আর খোরোভাটস প্রিপেয়ার করছে।’
প্রিপেয়ার করছে, মানে মাম্মি রান্নার তদারকি করছে। শুনে ভাল লাগল মিলেনার। ইদানীং হাঁটুর ব্যথা নিয়ে খুব ভুগছিল। যাক, তা হলে এখন হাঁটাচলা করতে পারছে। আর্মেনিয়ান কুইজিনের মধ্যে ডোলমা আর খোরোভাটস… এই দুটো খাবার খুব নামকরা। বিশেষ করে, খোরাভাটস। শুয়োর বা ভেড়ার মাংসের ঝলসানো টুকরো, নানারকম মশলা দেওয়া। আর্মেনিয়ান মেয়েরা খুব অল্প বয়স থেকে এইসব রান্না মাম্মিদের কাছে শিখে যায়। মাম্মি কিচেনে ব্যস্ত শুনে মিলেনা মনে মনে হিসেব করতে লাগল। কলকাতা থেকে ইরেভেন দেড় ঘণ্টা পিছনে। কলকাতায় এখন রাত আট টা। তার মানে ইরেভেনে সন্ধে সাড়ে ছ’টা। ঘণ্টাখানেক পরে ফোন করলে মাম্মিকে ফ্রি পাওয়া যাবে।
লুসকার আজ আতমহাতিক। আতম নানে দাঁত। আর হাতিক হল, গম দিয়ে তৈরি একরকমের খাবার। বাচ্চার নতুন দাঁত উঠলে প্রথম সলিড ফুট খাওয়ানোর দিন। বাচ্চাকে চার্চে নিয়ে যেতে হয়। তার পর ওর মাথায় স্কার্ফ জড়িয়ে হাতিক ছিটিয়ে দিতে হয়। এরপর খাওয়ানোর জন্য ধস্তাধস্তি। ইভেতার মেয়ে লুসকার বয়স মাত্র পাঁচ মাস। এরই মধ্যে ওর দাঁত উঠে গেছে না কি! মেয়েটা এত সুন্দর দেখতে যে, ফ্যামিলির লোকেরা এখন থেকেই ওকে মিস আর্মেনিয়া বলতে শুরু করেছে। ইভেতা মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপে মেয়েটার ছবি আর ভিডিয়ো পাঠায়। ক্যাপশনে লেখে, ‘বয়স হলে আমার মেয়ে কিন্তু তোমাকে ছাপিয়ে যাবে।’
ভাইঝির কথা মনে পড়তেই মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘মিস আর্মেনিয়ার আতমহাতিক কি হয়ে গেছে?’
ইভেতা বলল, ‘হ্যাঁ, বেলা বারোটার সময়। চার্চে নিয়ে গেছিলাম। কান্নাকাটি করেনি।’
চার্চের ফাদাররা বলেন, আতমহাতিকের সময়ই বাচ্চার ভবিষ্যত জেনে যাওয়া যায়। ওর সামনে কয়েকটা জিনিস রেখে দিতে হয়। যেমন, আর্মেনিয়ান মুদ্রা এএমডির নোট, একটা বাইবেল, একটা হাতুড়ি। বাচ্চা যে জিনিসটা ছোঁবে, ভবিষ্যতে সেই পেশায় যাবে। যদি নোট ছোঁয়, তা হলে ব্যবসায়ী বা ব্যাঙ্কার, বাইবেল ছুঁলে ধর্মপ্রাণ হবে অথবা এমন কোনও পেশায় যাবে, যেখানে পড়াশুনো করতে হয়। আর হাতুড়ি স্পর্শ করলে কায়িক পরিশ্রমের কাজ করবে। কৌতূহলে মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘লুসকা কোনটা ছুঁয়েছে গো?’
হেসে ইভেতা বলল, ‘নিজের চোখে দেখো। আমি ভিডিয়ো ক্লিপিস পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘ঠিক আছে, মাম্মিকে বোলো আমি পরে ফোন করছি।’
বলে লাইনটা কেটে দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় ইভেতা বলল, ‘তোমার দাদার মুখে শুনলাম, টাইগান গ্র্যান্ডপা না কি তোমার সঙ্গে আজকাল খুব ইলবিহেভ করছে!’
চেপে রেখে লাভ নেই। তাই মিলেনা বলল, ‘ঠিক শুনেছ। আমার খুব ভয় লাগছে জানো।’
‘উনি এখন বাড়িতে নেই?’
‘না। সন্ধেবেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। এখানে বাড়ির কাছেই একটা রেস্তোরাঁ কাম বার আছে মোকাম্বো। হয়তো ওখানে ড্রিঙ্ক করতে গেছেন। আগে রেগুলার যেতেন। এখন মাঝে মধ্যে যান। আমার সন্দেহ, কেউ ওখানে ওকে ওস্কায়। ফিরে এসে উনি মাতলামি করেন। দিন দিন গ্র্যান্ডপা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
সেটা তোয়াক্কা করছেন না।’
‘কী চান উনি?’
‘এখানকার ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে উনি অন্য কোথাও শিফট করতে চান।’
‘কিন্তু তোমার দাদার মুখে তো শুনেছি, ফ্ল্যাটটা তো ওনার নামে নয়।’
‘সেটা জেনেও উনি জেদ ধরে আছেন। গত চল্লিশ বছর ধরে এই ফ্ল্যাটে আছেন। ওর না কি রাইটস জন্মে গেছে। এখান থেকে ওকে চলে যেতে বললে, উনি যাবেন তো না-ই, উল্টে অ্যান্টিসোশ্যালদের হেল্প নিয়ে আমাকে বিপদে ফেলে দেবেন। অলরেডি লোকাল এক রাফিয়ানকে দিয়ে আমাকে ভয় দেখিয়েছেন।’
‘মাই গুডনেস। ড্যাডি সব জানেন?’
‘ড্যাডিকে সব বলেছি। উনি বললেন, সেপ্টেম্বরে এখানে এসে সেটল করে দিয়ে যাবেন।’
‘খুব ভাল। আর তো মাত্র মাস দেড়েক বাকি। ড্যাডি যখন কলকাতায় যাচ্ছেনই, তখন তুমি ওঁর সঙ্গে চলে এসো না। তুমি তো কখনও এখানে আসোনি।’
ইরেভেনে যেতে পারলে ভালই হত। কিন্তু কলকাতা থেকে চলে যাওয়ার ইচ্ছে এখন ওর নেই। কেন, তা ইভেতাকে বলা যাবে না। ইরেভেনে জানাজানি হলে, বিরাট রিঅ্যাকশন হবে। উত্তরটা দেওয়ার আগে মিলেনা পাখির ডাক শুনতে পেল। তার মানে, কেউ ওদের ডোর বেল টিপছে। তা হলে কি গ্র্যান্ডপা আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন! মিলেনা বলল, ‘আমি রাখছি ইভেতা। মনে হচ্ছে গ্র্যান্ডপা এলেন।’
লাইন কেটে দিয়ে মিলেনা ড্রায়ার থেকে সরু ছুরি বের করে হাতের তালুর মধ্যে লুকিয়ে রাখল। সেল্ফ ডিফেন্সের জন্য ছুরিটা নাগালের মধ্যে রাখতে বলেছে দেবদূত। শিখিয়েও দিয়েছে, কেমন করে ব্যবহার করতে হয়। বলা যায় না, গ্র্যান্ডপা কোনওদিন গায়ের জোর খাটাতে পারেন। তখন ছুরিটা কাজে লাগবে। মিলেনা দ্রুত পায়ে দরজার সামনে গিয়ে আই হোল দিয়ে দেখল, গ্র্যান্ডপা নন, অ্যানা। ওদের হোলি নাজারেথ চার্চের মেম্বার। ওরই বয়সি আর্মেনিয়ান পরিবারের মেয়ে। কলকাতায় ওর প্রথম ইস্টার-এর সময় মেয়েটাকে নজরে পড়ে মিলেনার। চার্চের হলঘরে দারুণ নেচেছিল। তার পর থেকে ওর সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। অ্যানাকে খুব পছন্দ করে মিলেনা। ওর পাশে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে।
নির্ভয়ে দরজা খুলে দিয়ে মিলেনা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল, ‘হোয়াট আ সারপ্রাইজ।’
ফ্ল্যাটে ঢুকে হাগ করে অ্যানা বলল, ‘আগে তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হচ্ছেন অনিল বাসু। আমার উড বি হাসবেন্ড। ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে আছেন। আর অনিল… এ হচ্ছে মিলেনা, যার কথা বলতে বলতে আমি আসছিলাম।’
বছর খানেক আগে অ্যানা একদিন কথায় কথায় বলেছিল, ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ডেট-এ যাবে। সে নাকি আর্মেনিয়ান নয়, বেঙ্গলি। কথাটা ও পাত্তা দেয়নি বলে, পরে অ্যানা কখনও ওর বয়ফ্রেন্ডের কথা বলেনি। আসলে একটা আর্মেনিয়ান মেয়ে অন্য কোনও সম্প্রদায়ের ছেলেকে বয়ফ্রেন্ডের মর্যাদা দেবে, মিলেনা ভাবতেও পারেনি। মাম্মিদের কাছ থেকে এমন শিক্ষাই ও পেয়ে এসেছে। কিন্তু দু’তিনটে রোববার আগে চার্চে দাঁড়িয়ে অ্যানার মা কাকে যেন বলছিলেন, ‘আমার মেয়েটা একটা বেঙ্গলি ছেলেকে বিয়ে করবে বলছে। কী করব, ভেবে পাচ্ছি না।’ তখনই মিলেনা ঠিক করেছিল, অ্যানাকে জিজ্ঞেস করবে, সত্যি কি না? কিন্তু মাথা থেকে হারিয়ে গেছিল সে কথা। তা হলে এই সেই ছেলেটা? বাহ, বেশ হ্যান্ডসাম তো। দু’জনকে সোফায় বসতে বলে মিলেনা বলল, ‘কনগ্রাটস। বিয়েটা কবে?’
‘কবে বোলো না। বলো কতদিন ধরে? পাঁচদিন ধরে চলবে।’
অনিল বলল, ‘ইন্ডিয়ান রিচুয়ালস প্রথম তিনদিন। বাকি দুটো দিন অ্যানার উপর ছেড়ে দিয়েছি।’
অ্যানা হেসে বলল, ‘ডিফারেন্ট কালচার, ডিফারেন্ট রিচুয়ালস। বুঝতেই পারছ। ওদের বাড়িতে হিন্দুমতে বিয়ে, আমাদের বাড়িতে ক্রিশ্চিয়ান মতে। আমরা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির উপর ছেড়ে দিয়েছি। ওরাই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।’
কৌতূহল মেটাতে মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের মধ্যে সম্পর্কটা হল কী করে?’
উত্তরটা অনিল দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু অ্যানা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগল, ‘অনিলের ভাই অমলের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য টেম্পলে। ওখানে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ডিম্পল বলে আমার এক কলেজের বন্ধু।’
‘ওয়েট ওয়েট। চার্চের অ্যাকটিভ মেম্বার হয়ে তুমি টেম্পলে কী করতে গেছিলে?’
‘শান্তি পেতে। জর্জের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর সেইসময় ভীষণ মানসিক অশান্তির মধ্যে ছিলাম। ডিম্বল আমায় বলল, চলো তোমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাবো, কিছুক্ষণের জন্য জর্জকে তুমি ভুলে থাকবে। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য টেম্পলে গিয়ে আমি সেদিন সত্যিই কিছুক্ষণের জন্য খুব আনন্দে ছিলাম। ওখানে চান্টিংয়ের সময় ডিম্বল ওর উড বি হাজবেন্ড অমলের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। অমল পেশায় ড্রেস ডিজাইনার। তুমি তো জানো, আমারও ওই বিষয়ে আগ্রহ আছে। এর পর মাঝে মাঝেই আমি টেম্পলে যেতে লাগলাম। শ্রীকৃষণার নাম চ্যান্টিং করার সময়টায় আমি সব ভুলে থাকতাম।’
‘শ্রীকৃষণার নাম চ্যান্টিং? তার মানে?’
‘পরে বলব। টু কাট ইট শর্ট, ডিম্বল আর অমলের বিয়ের রিসেপশনে গিয়ে আমার সঙ্গে পরিচয় হয় অনিলের। তখনই ওর মুখে শুনি, ও কিছুদিন আর্মেনিয়ায় ছিল। ইন্ডিয়ান এমব্যাসিতে ডিপ্লোম্যাট হয়ে। পরিচয়ের পর ঘনিষ্ঠতা, তার পর প্রেম। প্রায় এক বছর কোর্টশিপের পর আমরা বিয়ের ডিসিশন নিয়েছি। আমার মাম্মি প্রথমদিকে একটু আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু অনিলের ফ্যামিলিকে দেখে রাজি হয়ে গেছে।’
মিলেনা বলল, ‘তুমি ননআর্মেনিয়ানকে বিয়ে করছ, আর্মেনিয়ান গভর্মেন্টের পার্মিশন নিয়েছ? আমি যদদূর জানি, এ রকম একটা নিয়ম আছে।’
‘আমার ক্ষেত্রে লাগবে না। বাই বার্থ আমি ইন্ডিয়ান। এই কলকাতাতেই আমার জন্ম। তবে ইরেভেনে আমাদের প্রচুর আত্মীয়স্বজন আছেন। ওঁরা অনেকেই আসবেন। দু’দিন ধরে মিউজিক, ডান্স… সব অ্যারেঞ্জমেন্ট করা হয়েছে। অনিলদের রিসেপশনে বলিউডি ডান্স। আর আমাদের ওখানে আর্মেনিয়ান স্টাইলের। তোমারও একটা সোলো পারফরম্যান্স রেখেছি।’
অ্যানার চোখমুখ থেকে আনন্দ ছিটকে বেরোচ্ছে। বিয়ের আগে সব মেয়েই বোধহয় সুখস্বপ্নে বিভোর থাকে। মিলেনা বলল, ‘তোমরা একটু বোসো। অনিলের জন্য আমি কফি বাড়িয়ে আনছি।’
সন্ধেবেলায় বাড়িতে কেউ এলে তাকে হুইস্কি অফার করাই রীতি। কিন্তু মিলেনা সাহস পেল না। গ্র্যান্ডপা এসে যদি দেখে তাঁর অচেনা কেউ বসে হুইস্কি খাচ্ছে, তা হলে পছন্দ নাও করতে পারেন। সোফা থেকে উঠে মিলেনা কিচেনের দিকে যেতেই অ্যানাও ড্রয়িং রুম থেকে ওর পিছু পিছু উঠে এল। কিচেনে ঢুকে মিলেনা জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যানা যা করছ, ভেবে-চিন্তে করছ তো?’
‘আমার আর কোনও উপায় নেই। আমি টেন উইকস প্রেগনেন্ট মিলেনা। গত একবছর আমরা খুব এনজয় করেছি। ঠিক করেছি, আমাদের প্রথম সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাব। আর কয়েকদিনের মধ্যে অনিল স্টেটস-এ পোস্টিং পাচ্ছে। তাই এখানে কেউ জানতে পারবে না। তুমিও কথাটা কাউকে বোলো না প্লিজ। তোমাকে বলে আমি হালকা হলাম।’ বলতে বলতে অ্যানার গলা ভারী হয়ে এল।
বিয়ের আগেই অ্যানা প্রেগনেন্ট! শুনে মিলেনা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। অ্যানা পারল কী করে? চার্চের কাছে এটা মারাত্মক অপরাধ। আর্মেনিয়াম সমাজের কাছে অত্যন্ত নিন্দনীয়। আর্মেনিয়ানরা গর্ব করেন, সারা পৃথিবীতে তাঁরাই খ্রীস্ট ধর্মকে প্রথম গ্রহণ করেছিলেন। সেই কারণে ধর্মীয় অনুশাসনগুলো তাঁদের কঠোরভাবে পালন করা উচিত। তবুও, অ্যানার চোখের কোণে জল দেখে মিলেনা ওকে আশ্বস্ত করল, ‘তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। কেউ জানতে পারবে না।’
(চোদ্দো)
অনেকদিন পর ফোনে মায়ের গলা শুনে চোখের কোণ ভিজে উঠল দেবের। ও প্রান্ত থেকে মা বলছে, ‘কোনওদিন এই চণ্ডীতলার বাড়িতে মরে পড়ে থাকব, তুই জানতেও পারবি না রে খোকা। খবর পেয়ে যখন ছুটে আসবি, তখন হয়তো আমার মরা মুখ দেখবি।’
নিজেকে সামলে দেব বলল, ‘এমন কথা বোলো না মা, তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে। বলো?’
মা বলল, ‘ভবিতব্য কে খণ্ডাতে পারে বল। এই যে ক’দিন আগে তোর রমাপিসি চলে গেল, কেউ ভাবতে পেরেছিল? দুকুরে খাওয়াদাওয়া করে সুকুমারের সাথে কথা টথা বলে সবে শুয়ে ছিল, আর ওটেনি। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। রাতে সুকুমার দোকান থেকে ফিরে এসে দ্যাখে, মা নেই। ঈশ্বর কাকে কখন টেনে নেবেন, আগে থেকে তা কি বলা যায় রে খোকা?’
রমাপিসির প্রসঙ্গটা ফের ওঠায় দেবের মন বিষণ্ণ হয়ে গেল। সম্পত্তি নিয়ে ওদের পারিবারিক বিরোধ যখন তুঙ্গে, তখন এই রমাপিসিই একমাত্র মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। না দাঁড়ালে মাকে ভিটে ছাড়তে হত। তখন পিসতুতোদাদা সুকুমারদাই জেঠামশাইকে চাপ দিয়ে সম্পত্তি ভাগাভাগি করে দিয়েছিল। এই রমাপিসির মৃত্যুর খবর পেয়েও দেব সেদিন চণ্ডীতলায় যেতে পারেনি। জিম নিয়ে সেদিন আনন্দী ম্যাডামের সঙ্গে ওর একটা মিটিং ছিল। মা মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে সেই নিয়ে। শুনে দেব বলল, ‘একটু সাবধানে থেকো মা।’
‘এদানী প্রেসারটা খুব ওঠানামা করছে রে খোকা। গেল পরশু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার সময় মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠেছিল। রেলিং ধরে না ফেললে গড়িয়ে পড়ে যেতাম।’
‘তুমি দোতলায় উঠেছিলে কেন মা?’
‘ও মা! সন্ধে প্রদীপ জ্বালব না? সংসারের অকল্যাণ হবে যে।’
চণ্ডীতলার বাড়িতে ঠাকুরঘরটা দোতলার ছাদে। মাকে ও অনেকবার বলেছে, খুব বেশিবার উপর নীচ না করতে। তেমন হলে ঠাকুরঘরটা একতলায় নামিয়ে আনতে। কিন্তু মায়ের আশ্চর্য জেদ, আসন থেকে ঠাকুরকে নড়ানো যাবে না। দু’পুরুষ আগে প্রতিষ্ঠা করা রাধামাধবের বিগ্রহ। কী করে সরাবে? বাধ্য হয়ে দেব রন্তিমাসিকে বলে এসেছে, মা যখন পুজো করতে উঠবে, তখন যেন আশপাশে থাকে। রন্তিমাসি হল ওদের কাজের লোক। গ্রামেই থাকে, মায়ের বয়সি। ওকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে। সত্যি বলতে কী, রন্তিমাসির ভরসাতেই দেব মাকে দেশের বাড়িতে রেখে এসেছে।
বছর পাঁচেক আগে, এই রন্তিমাসিই মৃত্যুর মুখ থেকে একবার ফিরিয়ে এনেছিল মাকে। ঠাকুরঘরে প্রদীপ থেকে মায়ের শাড়িতে আগুন লেগে গিয়েছিল। মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শরীরের নীচের দিকটা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রন্তিমাসি কম্বল চাপা না দিলে, মাকে হয়তো বাঁচানো যেত না। আগুন লাগার পর মায়ের সেই আর্তনাদ, ‘খোকা আমায় বাঁচা’, এখনও দেবের কানে বাজে। রন্তিমাসির চিৎকার শুনে নিজের ঘর থেকে দেব ছুটে বেরিয়ে এসেছিল সেদিন। পায়ে ক্ষত নিয়ে মা প্রায় মাস তিনেক হাসপাতালে ছিল। এখনও পা টেনে হাঁটে। তার পর থেকে মা আগুন দেখলে ভয় পায়। রন্তিমাসি মাকে তাই রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় না। ঠাকুরঘরে এখন প্রদীপের বদলে জ্বলে টুনি বাল্ব।
মায়ের প্রেসার ওঠা-নামা করছে শুনে, প্রদীপ্তর কথা মনে পড়ল দেবের। কেন এটা হচ্ছে, ওকে একবার ফোন করে জেনে নেওয়া দরকার। প্রদীপ্ত ছোটবেলার বন্ধু, ওরা একই স্কুলে পড়ত। পড়াশুনোয় বরাবর ভাল ছিল ছেলেটা। ডাক্তারি পাশ করে প্রদীপ্ত এখন গ্রামেই চেম্বার খুলে বসেছে। বন্ধুত্বটা এখনও এমন অটুট যে, মাঝে মধ্যে নিজে থেকে বাড়িতে গিয়ে ও মায়ের প্রেসার মেপে আসে। এই ক’দিন আগেই প্রদীপ্তর সঙ্গে কথা হয়েছে দেবের। ও তখন বলেছিল, ‘তোর মায়ের প্রবলেমটা হচ্ছে লোনলিনেস। আর তোকে নিয়ে অযথা টেনশন। এ বার বিয়ে করে ফ্যাল দেব। তোর মা যাতে সঙ্গ পায়, এমন কাউকে এনে দে।’
দেব যে সেটা বোঝে না, তা নয়। প্রায়ই মা ওর বিয়ের কথা তোলে। হয়তো এখন ফের সেই একই কথা তুলবে। সেটা যাতে মা করতে না পারে, সেই কারণে ও প্রসঙ্গ ঘোরাল। বাড়ির গোয়াল ঘরে কমলা আর বিমলা বলে দুটো গাই আছে। রোজ দু’আড়াই সের করে দুধ দেয়। কমলা বাচ্চা বিয়োবে। দেব জিজ্ঞেস করল, ‘কমলার কোনও খবর আছে মা?’
‘গুরুপদ এসে রোজ ওকে দেখে যাচ্ছে। দু’একদিনের মধ্যে বিয়োবে, বলছে। তোর খবর কি বল।’
‘ভাল মা। মাস আড়াই পরেই কম্পিটিশন। এখন রেডি হচ্ছি।’
‘হ্যাঁরে, কোয়েলের কি খবর রে? বহুদিন ও ফোন করে না। ও কি এখনও তোদের সঙ্গে আছে?’
‘থাকবে না তো কোথায় যাবে? আসলে ওর মা নার্সিং হোমে। মাসিমাকে নিয়েও ও খুব ব্যস্ত। কেন মা, কোনও দরকার আছে কোয়েলকে? ওকে কি ফোন করতে বলব?’
‘কী হয়েছে ওর মায়ের? আগে তো আমায় বলিসনি?’
‘পেস মেকার বসেছে মা।’
‘ওরে বাবা, সে তো অনেক টাকার ধাক্কা। মেয়েটা জোগাড় করল কোত্থেকে?’
‘জোগাড় হয়ে গেছে। জিম-এর সবাই মিলে হেল্প করেছে। আসলে সবাই তো ওকে ভালবাসে।’
‘ভালবাসার মতনই মেয়ে।’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মা। তার পর বলল, ‘মেয়ে থাকাই ভাল রে খোকা। মেয়েরা বাপ-মাকে দেখে। দেখছিস না, মেয়েটা একা কীভাবে সংসার টেনে যাচ্ছে। তুই এক কাজ কর বাবা, ওর মাকে এখানে এসে কিছুদিন থাকতে বল। আমি খাইয়ে দাইয়ে সুস্থ করে তুলব। প্লাস আমারও একজন কথা বলার লোক থাকবে।’
কথাটা মন্দ বলেনি মা। ও যদি মাসিমার কাছে গিয়ে প্রস্তাবটা দেয়, তা হলে উনি না বলতে পারবেন না। কিন্তু কোয়েল রাজি হবে কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত নয় দেব। ওর আত্মসম্মানটা বেশি। ‘খাইয়ে-দাইয়ে সুস্থ’ করে তোলার কথাটা শুনলে কোয়েল নির্ঘাত বেঁকে বসবে। মুখ তুলে একবার ফ্লোরের দিকে তাকাল ও। আট নম্বর জোনে ও কোয়েলকে দেখতে পেল না। অবন্তিকা বলে মেয়েটা একা একা যোগাসন করে যাচ্ছে। প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। এখনও কোয়েল আসেনি কেন? না কি এসেছে, কোথাও বেরিয়েছে? সকালে ওকে দেখেছে কি না, দেব খেয়াল করতে পারল না। ওদিকে মা ফোন ধরে আছে। তাই ও বলল, ‘তোমার কথা একবার মাসিমাকে বলব মা। পারলে বিকেলের দিকে একবার নিজেই নার্সিং হোমে যাব। দেখি, তোমার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারি কি না।’ বলে দেব হাসল।
ওদিক থেকে মা বলল, ‘ইচ্ছে তো আমার অনেকই ছিল রে খোকা, তুই পূরণ করলি কই? আমার তো ইচ্ছে, কোয়েলকে পাকাপাকি এনে চণ্ডীতলায় রাখি। অনেক বছর ধরে মেয়েটাকে দেখছি। ওর উপর মায়া পড়ে গেছে রে। তোর সঙ্গে মানাবেও। আমার কপালে কে আছে, কে জানে? হয়তো ধরে আনবি, শহুরে কোনও মেয়ে। আমার দিকে সে ফিরেও তাকাবে না।’
সর্বনাশ, মা বলছেটা কী? কোয়েলকে বিয়ে করার কথা! স্বপ্নেও কোনওদিন দেব ভাবেনি। কোয়েলকে নিয়ে কথা আর বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না। দেব বলল, ‘কী সব উল্টোপাল্টা ভাবছ তুমি মা? শহুরে মেয়েরা কি সবাই খারাপ?’ বলার সময় মিলেনার মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। দেশের বাড়িতে ওকে নিয়ে গেলে কেমন হয়? সকালে বেরিয়ে সন্ধেবেলায় ফিরে আসবে। মনে হয়, মিলেনা যেতে রাজি হয়ে যাবে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ও বলল, ‘দাঁড়াও, এই রোববারই চণ্ডীতলায় যাচ্ছি। গিয়ে তোমার ভুল ভেঙে দেবো।’
‘সত্যি আসবি?’ মা খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠল।
‘বললাম তো, যাব। আমার সঙ্গে আরও একজন থাকতে পারে। গুরুপদকে দিয়ে তুমি নারকেল গাছ থেকে কয়েকটা ডাব পাড়িয়ে রেখো। এখন ছাড়ছি, কেমন?’
‘ঠিক আছে বাবা।’ বলে মা লাইনটা কেটে দিল।
মোবাইল ফোন টেবলের উপর রেখে দেব কয়েক সেকেন্ড চোখ বুঁজে রইল। রবিবারের এখনও দু’দিন বাকি। দেব জানে, এই আটচল্লিশটা ঘণ্টা মা নানা খাবার তৈরি করে রাখবে রন্তিমাসিকে দিয়ে। মোয়া, মুড়কি, বাদামের চাট, নিমকি, গুজিয়া, সন্দেশ। ছোটবেলায় এ সব খুব প্রিয় খাবার ছিল দেবের। বডি বিল্ডিং শুরু করার পর থেকে এখন ছোঁয় পর্যন্ত না। কিন্তু মা মনে করে, ও এখনও ছোটটাই রয়ে গেছে। মাকে দুঃখ দিতে দেবের মন চায় না। খাবার প্যাক করে নিয়ে এসে ও তমালকে দিয়ে দেয়। নিজে অত বড় শ্যেফ। তবুও তমালের খুব পছন্দ মায়ের তদারকিকে তৈরি এইসব জলখাবার।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেব দেখল, প্রায় দশটা বাজে। ও চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এল। কোয়েলের খবর নিতে হবে। ট্রেনার আর মেম্বারদের মধ্যে যারা প্রেজেন্ট, ইলেকট্রনিক চার্টে তাদের নামের পাশে সবুজ আলো জ্বলে রয়েছে। টোটাল নাম্বার পঁয়ত্রিশ। কোয়েলের নামের পাশে এখন লাল আলো জ্বলছে। তার মানে এই মুহূর্তে ও জিম-এ নেই। ফ্লোরে একটা ইকুইপমেন্টও ফাঁকা নেই। যে যাঁর মতো ব্যায়াম করে যাচ্ছে। জিম একটা অদ্ভুত জায়গা। সমাজের সর্বস্তরের, সব পেশার লোকজনকে পাওয়া যায়। ডাক্তার, উকিল ইঞ্জিনিয়ার, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, মডেল, চিত্রতারকা, পুলিশ অফিসার… ওদের জিম-এ কে নেই! গুড মর্নিং বলতে বলতে বলতে দেব আট নম্বর জোনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। তখনই ওর চোখে পড়ল হিমাদ্রিকে। কাঁধের ব্যায়াম করছে। বডি বিল্ডিংয়ে একবার স্টেট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেইসূত্রে কলকাতা পুলিশে চাকরি পায়। ছেলেটার মাসল ভলিউম খুব সুন্দর। চেষ্টা করলে মি. ইন্ডিয়া হতে পারে। কিন্তু সে রকম ইচ্ছের কথা কোনওদিন জানায়নি।
চোখাচোখি হতে হিমাদ্রি হেসে বলল, ‘আপনার প্রিপারেশন কেমন চলছে দেবদা?’
দাঁড়িয়ে পড়ে দেব জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি জানলে কী করে?’
‘কমলদা দিন কয়েক আগে একটা ব্যাপারে আমাদের থানায় এসেছিল। ওঁর মুখেই শুনলাম, আপনি ব্যাঙ্ককে মি. এশিয়া প্যাসিফিক কনটেস্টে যাচ্ছেন। উনি আপনার এন্ট্রি আর সিডি পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
কমলদা… কমল চৌধুরী হলেন ইন্ডিয়ান বডি বিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি। বহুবছর আগে একবার মি. ইন্ডিয়া হয়েছিলেন। ওঁর সঙ্গে সামনাসামনি বহুদিন দেখা হয়নি। কিন্তু, মেল মারফত এখনও কমলদার সঙ্গে যোগাযোগ আছে দেবের। ও জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছেন কমলদা?’
‘ঠিক আছেন। বললেন, এখনও রোজ ঘণ্টা দুয়েক শরীরচর্চা করেন।’
শুনে অবাক হল দেব। কমলদা বয়স এখন প্রায় আশি ছুঁইছুঁই। এখনও বডি ঠিক রাখার নেশা ছাড়তে পারেননি। এই মানুষগুলোর তুলনা নেই। এঁদের জন্যই একটা সময় বডি বিল্ডিংয়ে বাঙালিরা দেশের সেরা ছিল। আর এঁদের পলিটিকসের জন্যই এখন বাংলা পিছিয়ে পড়েছে। দেব জিজ্ঞেস করল, ‘কমলদা আর কী বললেন?’
‘বললেন, ব্যাঙ্ককে আপনার চান্স আছে। আপনাকে লড়তে হবে তিনজনের সঙ্গে। একজন ফিলিপিনো, একজন মালয়েশিয়ান… থার্ড লোকটার নাম কমলদা বললেন না। আপনাদের নিয়ে না কি হিউজ বেটিং শুরু হয়ে গেছে ওখেনে। গুগল-এ দেখলাম, এ বার প্রাইজ মানি প্রচুর। আমাদের কারেন্সিতে প্রায় এক কোটি টাকার কাছাকাছি। শুনে আপনার ভাল লাগবে, স্যাস পরাতে আমেরিকা থেকে ব্যাঙ্কক আসছেন ফিল হীথ। উনি না কি নিজে এক ঘণ্টার শো দেখাবেন।’
তমাল গুগল সার্চ করে মাঝেমধ্যে এ সব খবর দেয়। ওর মুখে ফিল হীথের শো-এর কথা দেব শুনেছে। কিন্তু প্রাইজ মানির খবরটা আগে পায়নি। ও হেসে বলল, ‘এক কোটি টাকা! পেলে কী করব, আমাকে অ্যাডভাইস কোরো তো হিমাদ্রি। তুমি এখন কোন থানায় আছ?’
‘পার্ক স্ট্রিট থানায়। মাসখানেক হল পোস্টিংয়ের। আমার সুবিধেই হয়েছে। বাড়ি আর জিম খুব বেশি দূরে নয়। তাই এখন রেগুলার আসতে পারব জিম-এ। আপনার ওয়ার্ক সিডিউলটা কখন দেবদা? ভাবছি, একদিন তখন আসব। এসে দেখব, আপনি কী করেন?’
দেব হেসে বলল, ‘আমার ভিডিয়ো করা আছে। বাড়িতে বসেই তুমি দেখতে পারবে। ইচ্ছে হলে আজ আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারো। কেন, ফলো করবে না কি?’
‘না দেবদা। দিনে তেরো-চোদ্দো ঘণ্টা পুলিশের ডিউটি করে শরীরচর্চা সম্ভব না।’
হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে হিমাদ্রি জিজ্ঞেস করল, ‘রুস্তম বলে কাউকে আপনি চেনেন দেবদা?’
আট নম্বর জোনের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও দেব থকে গেল। ও বলল, ‘চিনব না কেন? এই অঞ্চলে ওকে কে না চেনে? আমি অনেকদিন ধরে চিনি।’
‘ওর সঙ্গে কি রিসেন্টলি আপনার কোনওদিন ঝামেলা হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ হয়েছিল। কিন্তু তুমি জানলে কী করে?’
‘ওর লোকজন কিন্তু প্রায়ই বদ মতলবে আপনার জিম-এর আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দু’নম্বর জোনে একটা ছেলে দেখুন এখন বেঞ্চ প্রেস করছে। ওই যে… হ্যান্ডসাম দেখতে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলে। নাম ববি… রুস্তমের লোক। প্রতিদিন ও রুস্তমদের পার্টি অফিসে যায়। ওদের সঙ্গে আপনার কী হয়েছিল, প্লিজ আমাকে বলুন তো?’
ঘাড় ঘুরিয়ে ববিকে দেখল দেব। দিন-পনেরো হল জিম-এ ভর্তি হয়েছে। নিরীহ টাইপের দেখতে। দেখলে কেউ সন্দেহই করবে না, ছেলেটা ক্রিমিনালদের সঙ্গে যুক্ত। হিমাদ্রি যখন বলছে, তখন সাবধান থাকা উচিত। ববির ডোসিয়ারটাও একবার নিজের চোখে দেখতে হবে। কার রেকমেন্ডশনে ও জিম-এ ভর্তি হয়েছে। মিলেনার উপর রুস্তমের চড়াও হওয়ার ঘটনাটা সংক্ষেপে জানিয়ে দেব বলল, ‘ওরা আমার জিম-এর কী ক্ষতি করতে পারে, আমার মাথায় ঢুকছে না।’
‘অনেক কিছু করতে পারে দেবদা। ফর একজাম্পল, রুস্তমের লোকেরা ড্রাগ সাপ্লাই করে। দুটো বাড়ির পরেই স্টিফেন ম্যানসন। ওখানকার সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে রুস্তমের একটা ডেন আছে। সেখান থেকে লুকিয়ে ড্রাগ এই জিম-এ রেখে চলে যেতে পারে। কোনও কমপ্লেন এলে থানা স্টেপ নিতে বাধ্য। দায় কিন্তু মি. শরাফ নেবেন না। আপনার ঘাড়ে এসে পড়বে।’
‘মাই গুডনেস, এ কী বলছ তুমি?’
‘আমাদের কাছে যা খবর আছে, তা হল, ড্রাগ সাপ্লাইয়ের থেকেও ওদের বড় একটা অ্যাজেন্ডা, স্টিফেন ম্যানসন বাড়িটা কবজা করা। নিশ্চয়ই কোনও পাওয়ারফুল লোক ওদের হাতিয়ার করে কাজটা সারতে চায়। ব্যাপারটা হালকাভাবে নেবেন না দেবদা। রুস্তমকে অ্যাভয়েড করুন। কোনও প্ররোচনায় পা দেবেন না। ব্যাঙ্ককে আপনার সামনে একটা বিরাট কম্পিটিশন। মনে রাখবেন।’
চিন্তিত মুখে দেব বলল, ‘ভাল করেছ হিমাদ্রি আমাকে অ্যালার্ট করে দিয়ে। মাঝেমধ্যে ফিড ব্যাক দিও।’
কথাটা বলেই দেব আর দাঁড়াল না। ওর মাথার ভিতরটা হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল। অদ্ভুত, কী কারণে চেম্বার থেকে বেরিয়েছিল, ও তা মনে করতে পারল না।