স্টিফেন ম্যানসন – ১

(এক)

হোটেল থেকে বেরিয়ে জিম-এর দিকে হাঁটার সময়ই দেবের চোখে পড়ল, আকাশে ঘন কালো মেঘ। দেখে ওর মনটা খুশিতে ভরে উঠল। যাক, আজ তা হলে বৃষ্টি হতে পারে। জুলাইয়ের ফার্স্ট উইক হয়ে গেল। এখনও বর্ষা নামেনি। গরমে হাঁসফাঁস করছে কলকাতার মানুষ। কয়েকদিন আগে কাগজে লিখেছিল, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়েছে। দু’তিন তারিখের মধ্যেই এদিকে এসে পড়বে। কিন্তু কোথায় কী! উল্টে, টেম্পারেচার লাফিয়ে বেড়েছে। গতকাল আটত্রিশ ডিগ্রির কাছাকাছি ছিল।

ভোর ঠিক সাড়ে ছ’টায় দেবের জিম খোলার কথা। আজ মিনিট পাঁচেক আগেই চলে এসেছে। কোড নাম্বারে বোতাম টিপে শাটার তোলার সময়ই ও লক্ষ্য করল, রাস্তার উল্টোদিকে স্কুল গেটের সামনে বেশ ভিড়। একের পর এক গাড়ি আসছে আর গার্জেনরা বাচ্চাদের নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। দেবের চোখে পড়ল, মিসেস সুনীতা ভাল্লা ছোট্ট নাতনিটাকে নিয়ে হেঁটে স্কুলের দিকে যাচ্ছেন। ভদ্রমহিলা থাকেন কাছেই, স্টিফেন ম্যানসনে। জিম-এর পুরনো মেম্বার। যোগ ব্যায়াম শিখতে আসেন কোয়েলের কাছে। বাচ্চাটাকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে মিসেস ভাল্লা জিম-এ আসেন। তার আগে পরিচিত গার্জেনদের সঙ্গে কিছুক্ষণ ধরে হাই-হ্যালো করেন। অন্তত মিনিট দশেক সময় পাওয়া যাবে। ভদ্রমহিলাকে দেখেই দেবের মনে অস্বস্তি শুরু হল। ও মনে মনে চাইল, মিসেস ভাল্লা জিম-এ ঢোকার আগে যেন দু’একজন মেম্বার চলে আসেন।

পার্ক স্ট্রিট পাড়ায় দেবদের এই জিমন্যাসিয়ামের নাম ‘সিলভার জিম’। হাই-ফাই লোকদের জন্য। কর্পোরেট জগতের মানুষ, যাঁদের শরীরচর্চার ইচ্ছে আছে, অথচ কাজের চাপে সময় পান না, তাদের জন্য সিলভার জিম। সারা দিনে যে কোনও সময় এসে তাঁরা ব্যায়াম করতে পারেন। শরাফ স্যারের মাথা থেকে আইডিয়াটা ভাল বেরিয়েছিল। স্যারের পুরো নাম বিনোদ শরাফ। জিম-এর বিজনেস করার মতো মানুষ নন উনি। বিজনেস কনসালটেন্ট হিসেবে ওঁর খুব নাম। জিম-এর উপরে ওঁর নিজেরই একটা ছয়তলা হোটেল আছে। সেটা চালান স্যারের স্ত্রী আনন্দী ম্যাডাম। হোটেল গেস্টদের জন্য রাত বারোটা অবধি খোলা থাকে সিলভার জিম। সামনে পিছনে তিনটে স্কুল। পড়ুয়াদের গার্জেনরাও এখানে শরীরচর্চা করতে আসেন। মোট মেম্বার এখন প্রায় তিনশোর মতো। দেব এই সিলভার জিমের চিফ ট্রেনার। ওর আন্ডারে আরও আটজন আছে, যার মধ্যে তিনজন মেয়ে।

সকালের দিকে মহিলাদের ভিড় বেশি থাকে। জিম-এ আলোগুলো জ্বালিয়ে দেব এয়ার কন্ডিশনড মেশিন চালিয়ে দিল। পনেরো হাজার স্কোয়ার ফুট এরিয়া। নানা ধরনের ইকুইপমেন্ট বসানো আছে। একসঙ্গে পঞ্চাশ-ষাটজন ব্যায়াম করতে পারেন। পাশেই দুটো আলাদা হলঘরে যোগ ব্যায়াম আর ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা। নিজের চেম্বারে ঢুকে দেব হালকা মিউজিক চালিয়ে দিল। সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত অন্তত চারজন ট্রেনারের থাকা কথা। একজনও এখনও আসেনি। যোগা টিচার কোয়েল থাকে মল্লিক বাজারের কাছে। জিম থেকে হাঁটা পথ। রোজ ঠিক সময় এসে যায়। আজ আসেনি কেন ভেবে, দেব চিন্তায় পড়ল। ওকে একবার ফোন করবে কী না ভাবছে, তখনই ম্যাগনেটিক কার্ড পাঞ্চ করে, কাচের সুইং ডোর ঠেলে ভিতরে ঢুকে এলেন মিসেস ভাল্লা। ওঁর একহাতে একটা প্যাকেট। দূর থেকে অন্য হাত তুলে উনি বললেন, ‘গুড মর্নিং ডার্লিং। হাউ আর ইউ?’

মিসেস ভাল্লার পরনে নতুন মাল্টিকালার ট্র্যাকশ্যুট। পুমা কোম্পানির। গরমের ছুটিতে উনি আমেরিকায় গেছিলেন। বোধহয় সেখান থেকে কিনে এনেছেন। ট্র্যাকশ্যুটের প্রশংসা করলে খুশি হবেন। চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে দেব বলল, ‘আয়াম ফাইন ম্যাডাম। পুমার ট্র্যাকশ্যুটে আপনাকে দারুণ দেখাচ্ছে।’

মিসেস ভাল্লা বললেন, ‘জানতাম, তুমি এ কথা বলবে। তোমার জন্যও একটা নিয়ে এসেছি ডার্লিং। ট্রাই করে দেখো তো, তোমার সাইজের কি না?’

কাছে এসে মিসেস ভাল্লা, হাগ করলেন ওকে। বুকে ওঁর ভারী স্তনের স্পর্শ পেল দেব। এ সব বিলিত কায়দায় ও অভ্যস্ত নয়। ভদ্রমহিলা ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুখটা তুলে ধরে আছেন। চোখে যৌন আর্তি দেখে প্রমাদ গুণল দেব। মাসছয়েক ধরে ভদ্রমহিলার অদ্ভুত বিহেভিয়ার ওর পছন্দ হচ্ছে না। কোয়েল না থাকলে কারণে-অকারণে মিসেস ভাল্লা আজকাল যোগা রুমে ওকে ডেকে পাঠান। নানা ধরনের আসন করার সময় মাঝে মধ্যে ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেন। ভদ্রমহিলার বয়স বাহান্ন পেরিয়ে গেছে। মেম্বারশিপ কার্ডে দেখেছে বলে দেব ওঁর বয়সটা জানে। দেখে অবশ্য এত বয়স বলে মনে হয় না। সব সময় সেজে গুজে থাকেন। এই সকালবেলাতেও ভদ্রমহিলার ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। কোয়েলের মুখে দেব শুনেছে, ভদ্রমহিলার স্বামী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। বছরে আটমাস বাড়িতেই থাকেন না। মিসেস ভাল্লা কিন্তু এখানে বিন্দাস আছেন। ট্র্যাকশ্যুট না নিলে মিসেস ভাল্লা মনঃক্ষুণ্ণ হবেন। ওঁর সঙ্গে আনন্দী ম্যাডামের ভাল জানাশোনা। একবার নালিশ করে দিলে মুশকিল। প্যাকেট হাতে নিয়ে দেব বলল, ‘এর কি কোনও দরকার ছিল?’

মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে মিসেস ভাল্লা বললেন, ‘ডার্লিং, ভালবেসে কেউ কিছু দিলে, সেটা নিতে হয়। আমেরিকায় রোজ তোমার কথা মনে হত। তাই কিনে ফেললাম।’

ভদ্রমহিলার মুখ দিয়ে রসুনের গন্ধ বেরচ্ছে। খালি পেটে রোজ এক কোয়া রসুন চিবিয়ে খেলে শরীর ভাল থাকে। দেব সেটা জানে। কিন্তু নিজে কখনও খায় না, মুখ দিয়ে দুর্গন্ধ বেরয় বলে। দম বন্ধ করে, গেটের দিকে চট করে একবার তাকিয়ে ও দেখল, হন্তদন্ত হয়ে কোয়েল ঢুকছে। এক পা পিছিয়ে গিয়ে দেব বলল, ‘থ্যাঙ্কস ম্যাডাম। আমেরিকায় যাওয়ার সৌভাগ্য তো আমাদের কোনওদিন হবে না। যেতে পারলে ওখানে গোল্ড জিমন্যাসিয়ামে একবার ঢুঁ মারতাম। শুনেছি, গোল্ড চেন-এর জিমগুলো না কি ওয়ার্ল্ডের বেস্ট।’

মিসেস ভাল্লা সোৎসাহে বললেন, ‘ডালাসে আমি কিন্তু এ বার দেখে এলাম। গোল্ড জিম-এর ওটাই এখন মেন সেন্টার। কত রকমের ইকুইপমেন্ট! পার ডে ওরা আড়াইশো ডলার করে নেয়। উইকে তিনদিন করে যেতাম। দেখবে, আমার ওয়েস্ট কত কমে গেছে?’

কথা বলতে বলতেই কোমর দেখানোর জন্য মিসেস ভাল্লা ট্র্যাকশ্যুটের আপার টেনে তুললেন। ফর্সা তলপেটে নাভি দেখা যাচ্ছে। দেখেই চোখ সরিয়ে নিল দেব। ওর সারা গা একবার শিরশির করে উঠল। মিসেস ভাল্লা হাসিমুখে বললেন, ‘হিপ মাসল অনেক টাইট করে ফেলেছি। ওয়েটও কমিয়েছি। আমার কী মনে হচ্ছে জানো ডার্লিং, আই ক্যান ফ্লাই। প্লিজ, একদিন আমার ফ্ল্যাটে এসো। তোমাকে আমি গোল্ড জিমন্যাসিয়ামের ভিডিয়ো ক্লিপিংস দেখাব।’

সত্যিই, ভদ্রমহিলার লোয়ার পোর্সন এখন অনেকটা ট্রিমড বলে মনে হচ্ছে। ফ্যাট নেই বললেই চলে। ফ্যাট কমানো বা মাসল-এর ভলিউম বাড়ানোর জন্য আমেরিকানরা নিত্যিনতুন ইকুইপমেন্ট বের করে। ওখানকার স্পোর্টস গুডস ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলো এ নিয়ে প্রচুর রিসার্চও করে। এতদিন দেবের কোনও ধারণাই ছিল না। গতবছর ম্যানিলায় মি. এশিয়া কম্পিটিশনে গিয়ে ও জানতে পারে। কম্পিটিশনের স্পনসর ছিল আমেরিকার গোল্ড জিমন্যাসিয়াম। ম্যানিলায় ওদের ম্যাগাজিনগুলো বিক্রি হচ্ছিল। প্রতি পৃষ্ঠায় দেব এমন সব বডিবিল্ডিং ইকুইপমেন্ট দেখেছে যায়, ওর মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। প্রচুর দাম। কেনার কথা শরাফ স্যারকে বলার সাহসই হয়নি দেবের। হ্যাঁ, ওই ইকুইপমেন্টগুলো কিনতে পারলে হয়তো ওর নিজের সুবিধে হত। মি. ইউনিভার্স না হোক, অন্তত মি. এশিয়া প্যাসিফিক হওয়ার স্বপ্নটা ও দেখতে পারত। এই স্বপ্নটা পূরণ করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। এই কলকাতা শহর থেকেই তো দু’জন বডিবিল্ডার বিশ্বশ্রী হয়েছিলেন। প্রায় সত্তর বছর আগে। মনোতোষ রায় ও মনোহর আইচ। এই দু’জনের ফুল বডির ছবিও দেব জিমের দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছে আরনল্ড সোয়েৎজানেগার, ফিল রোডেনদের পাশে।

মিসেস ভাল্লার কাছ থেকে গোল্ড জিম সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যাবে। ভেবে নিয়ে দেব মন থেকে বলল, ‘সিওর ম্যাডাম। একদিন আপনার ফ্ল্যাটে যাব। কখন গেলে আপনি ফ্রি থাকবেন?’

‘মে বি স্যাটারডে ইভনিং। হ্যাভ ডিনার উইথ মি। স্যাটারডে-সানডে আমার নাতনি ওর বাবা-মায়ের কাছে গিয়ে থাকে। আমি তখন খুব লোনলি ফিল করি।’ মিসেস ভাল্লা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। পিছনে কোয়েল এসে দাঁড়িয়েছে দেখে চুপ করে গেলেন।

বাড়ি থেকে এলে কোয়েল জিম-এর দেওয়া সাদা ট্র্যাকশ্যুট পরে আসে। সামনের দিকে লেখা সিলভার জিম। পিঠের দিকে ট্রেনার কথাটা। এটাই নিয়ম। আনন্দী ম্যাডাম মাঝে মাঝে সারপ্রাইজ ভিজিটে আসেন। ট্রেনারদের অন্য পোশাকে দেখলে উনি চটে যান। আজ কোয়েলের পরনে সালোয়ার-কামিজ। চোখ-মুখ শুকনো। রাত জাগার চিহ্ন। তা হলে কি ও অন্য কোথাও থেকে এল? যোগা টিচার হিসেবে কোয়েলের খুব সুনাম। একটা সময় টানা পাঁচবার বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কঠিন আসনগুলোও ও সহজভাবে করাতে পারে। আজ পর্যন্ত কেউ ওর নামে কমপ্লেন করেনি। দেরি হওয়ার জন্য ওকে বকাঝকা করা উচিত নয়। তবুও, গম্ভীর গলায় দেব বলল, ‘কী ব্যাপার? তুই এত লেট? মিসেস ভাল্লা কতক্ষণ ওয়েট করছেন, জানিস?’

কোয়েল বলল, ‘সরি ম্যাম। ফরগিভ মি ফর মাই ডিলে। কাল মাঝরাতে মাকে হসপিটালে ভর্তি করতে হল। এতক্ষণ ওখানেই ছিলাম।’

মিসেস ভাল্লা জিজ্ঞেস করলেন। ‘কী হয়েছে তোমার মাম্মির?’

‘সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক ম্যাম।’

‘হাউ ওল্ড ইজ সি?’

‘ফর্টি ফাইভ ইয়ার্স ওল্ড।’

‘মাই গুডনেস। আমার থেকে উনি তা হলে ওনলি পাঁচবছরের বড়। এর মধ্যেই হার্টের প্রবলেম বাধিয়ে বসলেন!’ মিসেস ভাল্লার গলা থেকে মধু ঝরতে শুরু করল, ‘তুমি এলে কেন সুইটি? দেবকে ফোন করে দিলেই পারতে। ওর কাছেই আমি এক্সারসাইজ করে নিতাম।’

কোয়েলের ঠোঁট পাতলা হাসি। দেবের দৃষ্টি এড়াল না। নিজের বয়সটা এক ঝটকায় দু’বছর কমিয়ে দিলেন মিসেস ভাল্লা। কোয়েলের হাসিটা অবশ্য সে কারণে নয়। ও জানে, ভদ্রমহিলার গোপন ইচ্ছেটা কী। মাঝে মাঝে উনি এমন বাড়াবাড়ি করে ফেলেন যে, সেটা কোয়েলেরও চোখে পড়েছে। মেয়েরাই মেয়েদের সবথেকে আগে চেনে। চোখ সরিয়ে দেব দেখল, দেওয়াল ঘড়িতে ছ’টা চল্লিশ। গেটে কার্ড পাঞ্চ করে, সাত-আটজন মেম্বার একে একে ভিতরে ঢুকে আসছেন। বেলা আটটার পর পুরো ফ্লোর ভর্তি হয়ে যাবে। একটা ইকুইপমেন্টাও খালি পড়ে থাকবে না। তখন যান্ত্রিক শব্দ ছাপিয়ে যাবে মিউজিককে। মিসেস ভাল্লাকে দেব বলল, ‘ম্যাম, আপনি লকার রুমে চলে যান। এর মধ্যে কোয়েল রেডি হয়ে যাবে।’

যাঁরা গোল্ড কার্ড মেম্বার, তাঁদের প্রত্যেকের জন্য জিম-এ লকার আছে। অফিসের পোশাক লকারে রেখে তাঁরা ফ্লোরে চলে আসেন। ইচ্ছে করলে কর্পোরেট মেম্বাররা সাওনা বাথও সেরে নিতে পারেন। মিসেস ভাল্লা অবশ্য কর্পোরেট নন। ওঁর নিজের বুটিকে আছে মির্জা গালিব স্ট্রিটে। উনি আবার ট্যারো কার্ড রিডার। লোকের ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন। সত্যি কী মিথ্যে, দেব জানে না। ভদ্রমহিলা না কি গুপ্তবিদ্যারও চর্চা করেন। জিম চালু হওয়ার পরই মিসেস ভাল্লা একদিন ট্যারো কার্ড ফেলে দেবের ভবিষ্যৎবাণী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেব উৎসাহ দেখায়নি।

যোগা ক্লাস করেই রোজ মিসেস ভাল্লা বুটিকে চলে যান। কোয়েলের সঙ্গে উনি চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর, নিজের চেয়ারে বসে দেব সিসিটিভি-র সুইচ অন করল। পুরো ফ্লোর আটটা জোনে ভাগ করা আছে। পর্দায় একবার চোখ বুলিয়ে ও দেখতে পেল, মেম্বারদের অনেকেই ইকুইপমেন্টে বসে গেছে। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ একঘণ্টা। সবাইকে শিডিউল দেওয়া আছে। দরকার হলে দেব কিছুদিন অন্তর তা বদলে দেয়। বছর তিনেক জিম-এর দায়িত্বে রয়েছে বলে, দেব সব মেম্বারকে চেনে। শুধু ফ্লাইং মেম্বারদের ছাড়া। অর্থাৎ কি না, যারা অল্প কয়েকদিনের জন্য আসে। দেব লক্ষ্য করেছে, জুন-জুলাই মাসে বেশ কিছু অল্পবয়সি ছেলে-মেয়ে জিম-এ এসে ভর্তি হয়। কালীপুজোর পর আর তাদের দেখা যায় না। স্রেফ একটাই কারণ, পুজোর মরশুমের পর ওদের রোমিও অথবা হিরোইন হওয়ার ইচ্ছে মিটে যায়।

জিম-এর পশ্চিম আর উত্তর দিকে কাচের দেওয়াল। রাফ আন্ড টাফ ব্ল্যাক গ্লাসের। রাস্তা থেকে ভিতরের কিছু দেখা যায় না। কিন্তু জিম-এর ভিতর থেকে বাইরের সবকিছু দেখা যায়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেব দেখল, বৃষ্টি নেমে গেছে। লোকজন দৌড়ে শেড-এর তলায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। পার্ক স্ট্রিটে এই সময়টায় খুব একটা ট্রাফিক থাকে না। অফিস পাড়ায় ব্যস্ততা শুরু হয় বেলা আটটার পর থেকে। উত্তরে মির্জা গালিব স্ট্রিটের দিকটা এখন একদম ফাঁকা। কাচের দেওয়ালের ঠিক ওপাশে লোকজন আশ্রয় নিয়েছে বলে পূর্বদিকের রাস্তাটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। দেব একটু বিরক্তই হল। এই সময়টায় পূর্বদিক থেকে রোজ ওর বয়সি একটা মেয়ে হেঁটে আসে। একেবারে বার্বি ডল-এর মতো দেখতে। খুব সম্ভ্রান্ত ঘরের বলেই ওর মনে হয়। কসমোপলিটান এরিয়া। চেহারা বা পোশাক দেখে মেয়েটাকে বাঙালি বলে মনে হয় না। জিম-এর পাশ দিয়ে হেঁটে ও ক্যামাক স্ট্রিটের দিকে বাঁক নেয়। দিনের কোন সময়ে ফেরে, দেব জানে না।

বৃষ্টির তেজ ক্রমশ বাড়ছে। উল্টোদিকের ফুটপাতটা ঝাপসা হয়ে গেছে। আজ বোধহয় মেয়েটা বাড়ি থেকে বেরয়নি। ভেবে দেবের মন খারাপ হতে লাগল। মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করার খুব ইচ্ছে ওর। ফুরসত পেলেই মেয়েটাকে নিয়ে ও ভাবে। ওর মনে অনেক প্রশ্ন কুরে কুরে খায়। নাম কী, বাড়ি কোথায়, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কী? রোজ সকালে যায়ই বা কোথায়? চাকরি করে? না কি পড়াশুনো এখনও শেষ করেনি? বয়ফ্রেন্ড আছে? না কি এখনও এনগেজড হয়নি। প্রায় এক বছর ধরে দেখছে, অথচ এখনও কোনও ছেলেকে দেব মেয়েটার সঙ্গে দেখেনি। হাঁটার সময় ও আশপাশের কারোর দিকে তাকায় না। প্রথম প্রথম ওকে উন্নাসিক বলে মনে হত। এখন অবশ্য চলার ছন্দে এক ধরনের উদাসীনতা লক্ষ্য করে।

রাতে প্রাইম ভিডিয়োর সিনেমাতে নায়ক-নায়িকার প্রথম সাক্ষাতের যেসব ঘটনা দেব দেখে, বাস্তব জীবনে তা সম্ভব বলে ওর মনে হয় না। কাচের দেওয়ালটাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটা যখন হেঁটে যায়, ও তখন জিম চালু করা নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকে। আজ পর্যন্ত এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি, যার জন্য জিম থেকে বেরিয়ে মেয়েটার সঙ্গে ও পরিচিত হতে পারে। এমন কোনও বন্ধুও নেই, যে দু’জনের মধ্যে সেতু হয়ে দাঁড়াবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেব ফের সিসিটিভির দিকে মন দিল। তখনই ওর চোখে পড়ল, আট নম্বর জোনে ট্রেড মিল মেশিনটার পাশে মিসেস ভাল্লা কাত হয়ে পড়ে আছেন। ডান হাঁটু ধরে উনি কাতরাচ্ছেন। কোয়েল হতভম্ব হয়ে কাকে যেন ফোন করতে ব্যস্ত। পরক্ষণেই টেবলের উপর রাখা ওর মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সেটটা তুলে কানে দিতেই ও কোয়েলের উৎকণ্ঠাভরা গলা শুনতে পেল, ‘দেবদা, শিগগির আট নম্বরে চলে আসুন। ভাল্লা ম্যাম চোট পেয়েছেন। মনে হয়, অ্যাম্বুল্যান্স ডাকতে হবে।’

এই রে! শেষপর্যন্ত অঘটনটা ঘটেই গেল। আগুপিছু না ভেবে চেম্বার থেকে দেব ছিটকে বেরল।

(দুই)

জিম-এ ছোটখাটো দুর্ঘটনা যে আগে হয়নি, তা নয়। বেশি ওজনের বারবেল তুলতে গিয়ে অনেকে সামলাতে পারেন না। ক্রস টোস্টারে তলপটের ব্যায়াম করতে গিয়েও অনেকে কোমরে চোট পান। সবথেকে রিস্কি হচ্ছে ট্রেডমিল। ঠিকঠাক স্পিডে না চালালে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকী, হার্ট অ্যাটাকেরও। সেই কারণেই কাছাকাছি ট্রেনারদের রাখা। মেয়েরা ধরাধরি করে মিসেস ভাল্লাকে রেস্ট রুমে নিয়ে যাওয়ার পর দেব ডাক্তার সুজয় মিত্রকে ফোন করল। মুখ চোখ দেখে ওর মনে হয়নি, মারাত্মক কিছু। ডিসলোকেশন তো নয়ই। তবুও, সাবধানের মার নেই। কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে পর আনন্দী ম্যাডামের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে। রেস্ট রুমে ঢুকে দেব দেখল, ট্র্যাকশ্যুটের লোয়ার খুলে মিসেস ভাল্লা বেডে টানটান শুয়ে আছেন। যাতে ব্যথা কমে, সেজন্য কোয়েল ওঁর ডান হাঁটুতে ভোলিনি স্প্রে করছে। ভদ্রমহিলার নিম্নাঙ্গে শুধু প্যান্টি। ফর্সা উরুর দিকে এক পলক তাকিয়েই দেব বাইরে বেরিয়ে এল।

ডাক্তার মিত্রের চেম্বার ক্যামাক স্ট্রিটে। রোজ সকাল আটটা থেকে সেখানে বসেন। কলকাতার খুব নামী অর্থোপেডিক সার্জেন। হোটেল সিলভারের এনলিস্টেড ছ’জন ডাক্তারের একজন। হোটেলের কোনও গেস্ট অথবা জিম-এর কোনও মেম্বার চোট পেলে শরাফস্যার ডাক্তার মিত্রকেই ডাকতে বলেন। প্রথম চেষ্টায় দেব ডাক্তার মিত্রের লাইনটা পেয়ে গেল। সমস্যার কথা বলতেই ও প্রান্ত থেকে ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আমি এখন রাস্তায়, কাছাকাছি আছি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তোমাদের জিম-এ পৌঁছে যাচ্ছি।’

করিডরে কোয়েল কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। দেব জিজ্ঞেস করল, ‘কী করে হল রে?’

নীচু গলায় কোয়েল বলল, ‘ট্রেড মিল চালিয়ে উনি মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। প্রথম দু’তিনবার ফোন বেজে গেল। তার পর ফোন ধরে উনি কারও সঙ্গে কথা কাটাকাটি করছিলেন। সেই সময় মনে হয় কনসেনট্রেশন লুজ করেন। আমি তখন মৌমিতাদিকে যোগা করাছিলাম। হঠাৎ দেখি, ম্যাডাম ব্যালান্স হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন।’

জিম-এ যাঁরা যোগা করতে আসেন। তাঁদের অনেকে মেদ ঝরানোর জন্য ট্রেডমিলও করতে চান। ট্রেডমিলে দাঁড়ানোর পর সঙ্গে মোবাইল ফোন রাখা বারণ। বারবার বলা সত্ত্বেও, মেম্বাররা সে কথা ভুলে যান। অনেকে পাকামি করে নিজেরাই ট্রেড মিলের স্পিড বাড়িয়ে দেন। তখন কার্ডিও ভাসকুলার ক্ষমতার কথা মাথায় থাকে না। এর আগে দু’তিনজনের ব্লাড প্রেসার হাই হয়ে গেছিল। মাথা ঘুরে ওঁরা পড়ে গেছিলেন। আমেরিকা থেকে ফিরে মিসেস ভাল্লা সে রকম কোনও পাকামি করতে যাননি তো? প্রশ্নটা মনে এসে মিলিয়ে গেল দেবের। কোয়েল খুব দায়িত্ববান মেয়ে। ওর কথা অবিশ্বাস করা ঠিক না। ও জিজ্ঞেস করল, ‘ম্যাডাম কার সঙ্গে তর্কাতর্কি করছিলেন রে?’

কোয়েল বলল, ‘মনে হল, হাসবেন্ডের সঙ্গে। ভদ্রলোক বোধহয় কোনও একটা সমস্যায় পড়েছেন। সে কারণে ম্যাডামকে টাকা পাঠাতে বলছিলেন। ম্যাডাম রাজি হচ্ছিলেন না।’

‘আজ কী হত বল তো, মিসেস ভাল্লা যদি কোনও ইকুইপমেন্টে ঠোক্কর খেতেন? তা হলে তো রক্তারক্তি হয়ে যেত। ফ্যাটল ইনজুরিও হতে পারত।’

‘ঠিক। মেঝেটা রাবারের বলে উনি আরও বেঁচে গেলেন।’

‘ট্রেড মিলে স্পিড তখন কত ছিল, দেখেছিস?’

‘খুব বেশি না। মাত্র ফোর পয়েন্ট। ওহ হ্যাঁ, ম্যাডামের মোবাইল সেটটা আমার কাছে আছে দেবদা। মেঝে থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি। এই নিন। আপনি ওঁকে দিয়ে দেবেন।’

হাত বাড়িয়ে মোবাইল সেটটা হাতে নিয়ে দেব দেখল, অ্যাপল-এর লেটেস্ট মডেল। আই ফোন ইলেভেন প্রো ম্যাক্স। অ্যাপল কোম্পানির প্রথম ফোন, যার তিনটে ক্যামেরা আছে। ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলা যায়। সাউন্ড সাপোর্ট সিস্টেমটাও ডলবি অ্যাটমস। দাম সত্তর-আশি হাজার টাকা তো হবেই। হাতে পয়সা থাকলে, কত ধরনের শখই না পূরণ করা যায়! সত্যি, কপাল নিয়ে জন্মেছেন মিসেস ভাল্লা। সেটটা পকেটে রেখে দেওয়ার আগে দেব ভাবল, মিসেস ভাল্লার মেয়ে বা জামাইকে ফোন করে খবরটা দেবে কি না? তখনই ওর মনে পড়ল, বিজ্ঞাপনে দেখেছে, এই ধরনের সেট মালিকের মুখে সামনে না রাখলে খোলা যায় না। ফেস রেকগনিশন মারফত আনলক করতে হয়। তবে, ইচ্ছে করলে কেউ পাসওয়ার্ড দিয়েও রাখতে পারেন। ভদ্রমহিলা কী করে রেখেছেন, দেবের জানা নেই। ভেবে মোবাইল ফোনটা ও পকেটে রেখে দিল।

ডাঃ মিত্র এসে গেছেন। ওঁকে সঙ্গে নিয়ে দেব ফের রেস্ট রুমে ঢুকল। চোখ বন্ধ করে মিসেস ভাল্লা শুয়ে আছেন। চোখ খুলে ডা. মিত্রকে দেখে উনি বলে উঠলেন, ‘সঞ্জয়, তুমি?’

ডাঃ মিত্র বললেন, ‘আবার তুমি কী বাঁধিয়ে বসলে?’

দু’জন পরস্পরকে চেনেন দেখে দেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কীভাবে দুর্ঘটনাটা ঘটল, বিশদভাবে শোনার পর, হাঁটু পরীক্ষা করে ডা. মিত্র বললেন, ‘কার্টেলেজ গেছে বলে মনে হচ্ছে। আপাতত, চোটের জায়গাটায় বরফ বেঁধে রাখো। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তো আছি।’

মিসেস ভাল্লা উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তার মানে, আমার হাঁটুতে কিছু হয়নি?’

‘এমআরআই রিপোর্ট না পেলে সিওর হতে পারব না। একটা কাজ করো। পাশেই কুইন্স কোর্ট বিল্ডিংয়ে রিসেন্টলি নতুন একটা ল্যাবরেটরি চালু হয়েছে। ওখানে সব লেটেস্ট মেশিন। ওখানে এখন আরআই করে, আমার চেম্বারে চলে এসো।’

‘কত লাগতে পারে?’

‘একটু এক্সপেন্সিভ। হাজার দশেক তো লাগবেই। তা, সুরজিত এখন কোথায়? তোমার বর ফিরেছে, না কি এখনও জাহাজে?’

প্রশ্নটা শুনে মুহূর্তের মধ্যে মিসেস ভাল্লার মুখের রং বদলে গেল। কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে, রাগী গলায় উনি বললেন, ‘ডোন্ট আস্ক মি এনিথিং অ্যাবাউট দ্যাট বাস্টার্ড। আমি খবর রাখতে চাই না। ওকে হাসবেন্ড বলে স্বীকার করতেও আমার লজ্জা হয়।’

‘আবার কী হল, তোমাদের মধ্যে?’

‘শুনবে, তোমার স্কাউন্ড্রেল বন্ধুটা এখন কোথায়? কলম্বোর কোনও এক ব্রথেল থেকে ওকে না কি পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। এখন জেলে আছে। একটু আগে ফোন করে বলল, টাকা পাঠাও। ল’ইয়ার অ্যাপোয়েন্ট করতে হবে। মাই ফুট।’

‘কোম্পানি ওর জন্য কিছু করেনি?’

‘কোম্পানির নাম ডুবিয়েছে। কেন করবে, বলো তো? ওকে ফেলে রেখেই ভেসেল পৌঁছে গেছে চেন্নাইতে। ওর কীর্তির কথা ক্যাপ্টেন দু’দিন আগেই আমায় জানিয়ে ছিলেন।’

ডা. মিত্রের বোধহয় খেয়াল হল, জিম-এর একজন সামনে দাঁড়িয়ে। পারিবারিক সমস্যা নিয়ে কথা বলার জায়গা এটা নয়। নিজেকে সামলে নিয়ে উনি বললেন, ‘কুল ডাউন সুনীতা। আমার চেম্বারে এসো। এ নিয়ে তোমার সঙ্গে তখন কথা বলব।’

ডা. মিত্র রেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরই, দু’হাতে মুখ ঢেকে মিসেস ভাল্লা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। হাঁটু দুটো বিশ্রীভাবে ছড়িয়ে রেখেছেন। প্যান্টির দিকে চোখ যেতেই দেবের শরীর দ্বিতীয়বার শিরশির করে উঠল। ওর মন বলল, এখুনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু হৃদয় বলল, ভদ্রমহিলাকে সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে, এক পা এগিয়ে দেব বলল, ‘ম্যাম, একবার চেষ্টা করে দেখবেন, দাঁড়াতে পারছেন কি না?’

মিসেস ভাল্লা বোধহয় শুনতে পাননি। দেব বারদুয়েক কথাটা রিপিট করার পর মিসেস ভাল্লা কান্না থামিয়ে বললেন, ‘নো, আই কান্ট। একবার চেষ্টা করেছিলাম। খুব পেইন হচ্ছে। ডান হাঁটুটা স্টিফ হয়ে গেছে। ভাঁজ করতে পারছি না।’

‘তা হলে আপনি শুয়ে থাকুন। কোয়েলকে আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। ও ততক্ষণ চোটের জায়গায় বরফ ঘষুক।’

কথাটা শুনে মিসেস ভাল্লা বোধহয় হতাশ হলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘গড নোজ, হোয়াই দিস হ্যাজ হ্যাপেনড টু মি। বাড়িতে ফিরে আমাকে ট্যারো কার্ড নিয়ে বসতে হবে। কিন্তু ইমিডিয়েট প্রবলেমটা হচ্ছে, নাতনিকে স্কুল থেকে কে বাড়ি নিয়ে যাবে?’

‘কেন, আপনার বাড়িতে আর কেউ নেই?’

‘আছে, একজন মেড। গড়িয়ার দিকে থাকে। সন্ধের পর চলে যায়।’

‘ম্যাম, আপনার মেয়েকে কি খবর দিতে হবে?’

‘সে কলকাতায় নেই। বাবা বিদেশে জেলে, এই খবরটা জেনেও সে অফিসের বস-এর সঙ্গে পাটায়ায় গেছে। আর এই কারণে মেয়েটাকে আমার কাছে রেখে গেছে। দিনতিনেক পরে তার ফেরার কথা।’

‘আপনার সান ইন ল?’

‘ওর অফিস সল্ট লেকের সেক্টর ফাইভে। ও একটা কোম্পানির সিইও। এত ব্যস্ত, আমার কী হল না হল, তাতে ওর কিছু আসে-যায় না।’

শুনে মনটা ভারী হয়ে গেল দেবের। হাই সোসাইটির লোকজনের মানবিকতা বলে কি কিছু নেই? বাইরে থেকে দেখে বোঝাই যায় না, মিসেস ভাল্লা কতটা দুঃখী। সত্যিই ভভ্রমহিলাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছে। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় মিসেস ভাল্লা বললেন, ‘তুমি একটা কাজ করতে পারবে? ডালিয়া বলে একটা মেয়ে আমার বুটিক সামলায়। তাকে একটা খবর দিতে পারো? আমার ফোনটা পাচ্ছি না।’

পকেট থেকে আই ফোন ইলেভেন সেটটা বের করে দেব এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যাম, আপনার সেট আমার কাছে আছে। এই নিন।’

বারকয়েক লাইন ধরার চেষ্টা করে মিসেস ভাল্লা বললেন, ‘স্ট্রেঞ্জ। বেলা আটটা হয়ে গেল। ডালিয়া এখনও বুটিক খুলল না কেন? আজই একটা লেহেঙ্গা ডেলিভারি দেওয়ার কথা। মিসেস মোতওয়ানি এসে নিয়ে যাবেন। কাল ওঁর মেয়ের বিয়ে। ডেলিভারি দিতে না পারলে আমার বুটিকের খুব বদনাম হয়ে যাবে।’

মিসেস শীলা মোতওয়ানিকে দেব চেনে। ওঁর মেয়ে দিব্যাকেও। দু’জনেই সিলভার জিমের মেম্বার। সাধারণত ওঁরা আসেন সন্ধের দিকে। থাকেন রয়েড স্ট্রিটের কোনও অ্যাপার্টমেন্টে। মিসেস মোতওয়ানির হাসবেন্ডের শাড়ির বিজনেস। বিরাট শোরুম ক্যামাক স্ট্রিটে। গত বছর দেওয়ালির সময় জিম-এর ট্রেনারদের উনি বকশিস দিতে চেয়েছিলেন। দেব তাতে আপত্তি জানিয়েছিল। তার পর থেকে উনি মনঃক্ষুণ্ণ। তবে সামনাসামনি কোনও অভদ্রতা করেন না। দিব্যা মেয়েটা মডেলিং করে বলে দেব শুনেছে। জিম-এ ওদের চার-পাঁচজনের একটা গ্রুপ আছে, যারা ফ্যাশন শো-তে অংশ নেয়। কত বয়স হবে? কোয়েলেরই বয়সি। সাততাড়াতাড়ি মেয়েটার বিয়ে দিচ্ছেন কেন মিসেস মোতওয়ানি?

আইফোনটা ট্র্যাকশ্যুটের পকেটে ঢুকিয়ে মিসেস ভাল্লা এইসময় বলে উঠলেন, ‘নাহ, যে কোরেই হোক আমাকে একবার বুটিকে যেতে হবে। কাউকে আর ট্রাস্ট করতে পারছি না। লেহেঙ্গাটার যা প্রাইস দিয়েছিলাম, মিসেস মোতওয়ানি তাতেই রাজি হয়ে গেছিলেন। দু’লাখ টাকা, বুঝলে? ঠিক সময়ে ডেলিভারি না পেলে, উনি মারাত্মক চটে যাবেন।’

কথাগুলো বলতে বলতে বেড থেকে প্রথমে বাঁ পা-টা নামিয়ে মিসেস ভাল্লা দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। তার পর অতি কষ্টে ডান পা-টাকে নামিয়ে আনলেন। ব্যথায় ভদ্রমহিলার চোখ-মুখ কুঁচকে গিয়েছে। ডান পায়ের পাতা ফেলতে পারছেন না। কয়েক সেকেন্ড এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মিসেস ভাল্লা বললেন, ‘যার মুখ দেখে আজ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম, জানতাম একটা কোনও অঘটন ঘটবে। একটা অপয়া মেয়ে। ইচ্ছে করছে, ফিরে গিয়ে গালে ঠাসঠাস করে চড় মারি।’

দেব জিজ্ঞেস করল, ‘কার কথা বলছেন ম্যাম?’

‘কে আবার? আমার উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে যে মেয়েটা থাকে।’ বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে মিসেস ভাল্লা বললেন, ‘তুমি আমাকে একটা সাপোর্ট দেবে ডার্লিং? এখানে বসে থাকলে চলবে না। অনেক টাকার ব্যাপার।’

কাছে গিয়ে হাতটা ধরে দেব বলল, ‘বৃষ্টি হচ্ছে। যাবেন কী ভাবে? রিক্সা নেওয়াটা কি ঠিক হবে ম্যাম?’

মিসেস ভাল্লা কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ওঁর ফোন বেজে উঠল। সেট কানে দিয়েই উনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হাউ ইরেসপন্সিবল ইউ আর। এতক্ষণ ধরে ট্রাই করছি। তোমায় পাচ্ছি না কেন?’

নিশ্চয়ই ওর বুটিকের ডালিয়া বলে মেয়েটা। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে দেব। ও প্রান্ত থেকে মেয়েটা কী বলল, পরিষ্কার শুনতে পারছে। ‘ম্যাম, আপনি যখন ফোন করছিলেন, তখন মিসেস মোতওয়ানি এখানে দাঁড়িয়ে। লেহেঙ্গাটা নিতে এসেছিলেন। উনি কতগুলো অদ্ভুত কথা শুনিয়ে গেলেন।’

‘কী বললেন উনি?’

‘বললেন আমাদের চালাকি উনি ধরে ফেলেছেন। যে লেহেঙ্গাটা আপনি ওঁর জন্য রেখে গেছেন, সেটা না কি সেকেন্ড হ্যান্ড। অন্য কারও বিয়েতে ইউজড হয়েছিল। কম দামে কিনে, আপনি সেটাকেই গছাচ্ছেন।’

‘হাউ ডেয়ার শী ইজ! তুমি প্রোটেস্ট করোনি?’

‘করেছি ম্যাম। বললাম, একটা মেয়ে হয়তো সারা জীবনে মাত্র একবারই লেহেঙ্গা পরে। অনেকেই হয়তো বিয়ে অথবা রিসেপশনের রাতে লেহেঙ্গাটা পরে ফের শোরুমে বিক্রি করে দিয়ে যায়। কিন্তু ভাল্লা’জ বুটিকের একটা রেপুটেশন আছে। এখানে এ সব দু’নম্বরি হয় না। আমি আরও বললাম, আপনার যখন এতই সন্দেহ, তখন একবার ভাল্লা ম্যামের সঙ্গে কথা বলুন। কিন্তু উনি শুনলেনই না।’

‘চেকটা কি দিয়ে গেছেন?’

‘হ্যাঁ। দেড়লাখ টাকার। বাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা উনি পরে দেবেন আপনার সঙ্গে কথা বলে।’

শুনে মিসেস ভাল্লা গুম হয়ে গেলেন। বোধহয় উনি ভুলে গেছিলেন হাঁটুর চোটের কথা। আনমনা হয়ে হাঁটতে গিয়ে আছাড় খেলেন মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল দেব। আর দেরি করা উচিত হবে না। ওকে অখুনি একবার ডাঃ মিত্রের চেম্বারে নিয়ে যাওয়া দরকার। গেটের দিকে এগোনোর সময় দেব অবাক হয়ে গেল। যন্ত্রণায় ছটফট করছেন মিসেস ভাল্লা। তবুও, বলেই যাচ্ছেন, ‘আমার বুটিকের বদনাম করা? আমি কিন্তু শীলাকে ছাড়ব না। পুরো টাকাটাই উশুল করব।’

(তিন)

কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে শিখিন চ্যাটার্জি ফায়ার ফাইটারদের রুমে এলেন। চোখ বুলিয়ে দেখলেন, ঘরে শিশির, সঞ্জয়, ব্রজেন আর ফয়জান বসে ব্রেকফাস্টের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু অনিরুদ্ধ নেই। তার মানে এখনও অপারেশন শেষ করে ও ফেরেনি। রাত চারটে-সাড়ে চারটের সময় একবার অ্যালার্ম বেজেছিল। সেই আওয়াজে শিখিনের ঘুম ভেঙে যায়। অ্যালার্ম বাজার অর্থ, কলকাতার কোথাও আগুন লেগেছে। ডিউটিতে যারা থাকে, ফায়ার ইঞ্জিন নিয়ে তখন তারা অকুস্থলে ছুটে যায়। অনিরুদ্ধ… অনি কাল নাইট ডিউটিতে ছিল। আগুন নেভানোর জন্য নিশ্চয়ই ওকে দৌড়তে হয়েছে।

দমকলের সদর দফতরের ডিভিশনাল অফিসার শিখিন। থাকেন অফিসের লাগোয়া কোয়ার্টারে। চব্বিশ ঘণ্টাই তাঁর ডিউটি। তবে, খুব বড় ধরনের আগুন না লাগলে তাঁকে স্পটে যেতে হয় না। সেই কারণে অ্যালার্মের আওয়াজ শুনেও তিনি ভোর রাতে নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে শুয়েছিলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে, স্নান সেরে প্রথমে অগ্নিদেবের পুজো সেরে নিয়েছেন। কেননা, তিনি বিশ্বাস করেন, এই দেবতার ইচ্ছে ছাড়া কোথাও আগুন লাগা সম্ভব না। আজ অগ্নিদেবকে সন্তুষ্ট করে নীচে নামার সময় শিখিন দেখেন, অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। নিজের চেম্বারে যাওয়ার আগে রোজ একবার করে তিনি ফায়ার ফাইটারদের রুমে আসেন। ক্যান্টিন থেকে খাবার আনিয়ে ওদের সঙ্গে বসেই ব্রেকফাস্ট সেরে নেন। ফায়ার সার্ভিসে সদ্য জয়েন করেছে, এমন ছেলেদের উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করেন। নাইট ডিউটিতে থাকলে, কর্মীদের সকাল আটটায় ছুটি। তার পর অনিরুদ্ধ কোনওদিন মেসে ফিরে যায় না। এইসময় ব্রেকফাস্ট টেবলে হাজির থাকে। ফায়ার ফাইটিং নিয়ে নানা কথা জানতে চায়। ছেলেটাকে শিখিন খুব পছন্দ করেন। গ্রাজুয়েট বলে শুধু নয়, ছেলেটা লিডার এবং ডেয়ার ডেভিল টাইপেরও। ফায়ার সার্ভিসে এই রকম ছেলেই দরকার। যদি টিকে থাকে, তা হলে অনেক উঁচুতে উঠবে।

সমস্বরে ‘গুড মর্নিং স্যার’ শুনে, শিখিন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লেন। তার পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁরে, অনি এখনও ফেরেনি কেন রে?’

শিশির বলল, ‘বস্তির লোকজন ওদের আসতে দিচ্ছে না। ঘেরাও করে রেখেছে।’

‘কাল রাতে আগুনটা বস্তিতে লেগেছিল বুঝি?’

‘হ্যাঁ স্যার। হেস্টিংসের এক বস্তিতে। অনিকে একটু আগে ফোন করেছিলাম। ও বলল, আগুন নিভে গেছে। ক্যাজুয়ালটি বলতে একটা বাচ্চা মেয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গেছে। গোটা কুড়ি ঝুপড়ি পুড়ে ছাই। তাই বস্তির লোকজন বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। বলছে, দমকল কেন এত দেরিতে এল? অনি বলল, পুলিশ ওখানে রয়েছে। ওরা শিগগির এসে যাবে। যাক সে কথা, আপনি কী খাবেন স্যার?’

‘ব্রেক ফাস্টে কী পাওয়া যাবে আজ?’

‘পুরি-ভাজি, ধোসা বঢ়া, টোস্ট-অমলেট। আপনি চাইলে স্যার, মিন্টু চাওমিনও করে দিতে পারে।’

ফায়ার সার্ভিস বিল্ডিংয়ের গ্যারাজ স্পেসে ছোট্ট একটা ক্যান্টিনের মতো আছে। সেটা চালায় মিন্টু বলে একটা ছেলে। পাঁচ-ছ’বছর আগে জানবাজারের বস্তিতে একবার আগুন লেগেছিল। বস্তিরই ছেলে মিন্টু রেসকিউ অপারেশনের সময় প্রচুর সাহায্য করেছিল ফায়ার ফাইটারদের। ও নিজেও ভালরকম চোট পেয়েছিল। সেদিন অপারেশনের লিডার ছিলেন শিখিন। মিন্টুকে তাঁর এত ভাল লেগেছিল যে, পরে ওকে অফিসে ডেকে পাঠান। হাজার টাকা পুরস্কারও দিয়েছিলেন। জানবাজারে ছেলেটা রোডসাইড ফুড স্টল চালাত। শুনে ডিরেক্টরকে বলে শিখিন অফিসের এক কোণে ওকে ক্যান্টিন চালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

সেই মিন্টু হাসিমুখে অর্ডার নেওয়ার জন্য সামনে দাঁড়িয়ে। শিখিন বরাবর স্বাস্থ্য সচেতন। ভাজাভুজি খেতে পছন্দ করেন না। মিন্টু রোজ তাঁর জন্য বাটার-টোস্ট, ডিমসেদ্ধ, কলা বা আপেল এনে রাখে। কোনও কোনওদিন ডিমের পোচ বা ওমলেটও করে দেয়। চাওমিনের কথা শুনে শিখিন বললেন, ‘সবার জন্য ভেজ চাওমিন করে আন। আমি সবার পয়সা দেবো।’

মাথা গুণে মিন্টু বেরিয়ে যাওয়ার পর শিশির বলল, ‘স্যার, একটা বেশি প্লেট বলে দিলে ভাল হত। অনি যে কোনও সময় চলে আসতে পারে।’

সঞ্জয় বলল, ‘কোনও দরকার নেই। অনি এলে ভাগাভাগি করে খাওয়া যাবে।’ কথাটা শুনে শিখিনের খুব ভাল লাগল। এই স্পিরিটটাই তো চাই। সবে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। ফায়ার ফাইটিং ইউনিফর্ম সার্ভিস। পুলিশ, মিলিটারির মতো উর্দি পরে করতে হয়। এই কাজে সবথেকে বেশি দরকার একতা। দমকলে যোগ দেওয়ার পর থেকে সিনিয়রদের কাছ থেকে সর্বদা শিখিন এই কথাটাই শিখে এসেছেন। এখন সেই স্পিরিটটাই ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি, জুনিয়রদের মনে। সঞ্জয় ছেলেটা বহরমপুরের। জেলা ফুটবলে খুব নাম করেছিল। ফায়ার সার্ভিসে চাকরি পেতে ওর খেলার সার্টিফিকেট বাড়তি নম্বর জুগিয়েছে। মোহনবাগান ক্লাবের সাপোর্টার। সময় পেলে এখনও ময়দানে খেলা দেখতে যায়। ওকে খোঁচা দেওয়ার জন্য শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘সঞ্জয় এ বার তোর টিমের অবস্থা এত খারাপ কেন রে? আজকাল পিয়ারলেসের মতো টিমের কাছে হেরে যাচ্ছে!’

মুষড়ে পড়া মুখে সঞ্জয় বলল, ‘আর ময়দানে যাবো না ভাবছি স্যার।’

শুনে শিশির হেসে বলল, ‘ওকে রোজ বলছি, রঙ বদলে লাল-হলুদে চলে আয়। কথাটা কানেই তুলছে না।’

লাল-হলুদ মানে ইস্টবেঙ্গল। শিখিন নিজেও ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার। একটা সময় পিন্টু চৌধুরীর খুব ফ্যান ছিলেন। দু’তিন বছর আগে ময়দানে যখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাব নতুন টেন্ট বানাচ্ছিল, তখন ফায়ার ডিপার্টমেন্টের লাইসেন্স নেওয়ার জন্য একজন কর্তার সঙ্গে পিন্টু চৌধুরী এই মির্জা গালিব স্ট্রিটের দফতরে এসেছিলেন। শিখিন তখন খুব সাহায্য করেন ওঁদের। তারপর থেকে প্রতিবছর একটা করে কমপ্লিমেন্টারি কার্ড পাঠান ক্লাব কর্তারা। খেলা দেখতে যাওয়ার সুযোগ অবশ্য শিখিন পান না। কলিগদের মধ্যে কেউ ময়দানে যেতে চাইলে কার্ডটা তাঁকে দিয়ে দেন।

‘স্যার, ফুটবলে আপনার বোধহয় ইন্টারেস্ট নেই, তাই না?’

‘আছে, তবে কম। ছোটবেলায় আমি থাকতাম নর্থ ক্যালকাটায় হেদুয়ার কাছে। সাঁতার শিখতে গিয়ে ওয়াটারপোলো খেলাটাকে ভালবেসে ফেলি। হেদুয়ার ন্যাশনাল সুইমিং ক্লাবের হয়ে লিগে কয়েক বছর খেলেওছি। তখন এই খেলাটা কত জনপ্রিয় ছিল, তোরা ভাবতে পারবি না। লিগের খেলা দেখতে কয়েক হাজার লোক তখন হেদুয়ার রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে থাকত। আমাদের রাইভাল ছিল কলেজ স্কোয়ার সুইমিং ক্লাব। একেবারে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো রেষারেষি। আমি বেঙ্গলের হয়েও খেলেছি। ওই সার্টিফিকেটটার জন্যই ফায়ার সার্ভিসে আমার চাকরিটা চট করে হয়ে যায়। ইস্টার্ন রেলও আমায় চেয়েছিল। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসে চ্যালেঞ্জ আছে বলে, এটাই শেষপর্যন্ত অ্যাকসেপ্ট করলাম। কী অদ্ভুত, তাই না? আমার নেশা ছিল জলে লড়াইতে, পেশা হয়ে গেল আগুনে লড়াইতে।’

‘স্যার, ওয়াটারপোলোতে তো সারাক্ষণ সাঁতার কাটতে হয়। টায়ার্ড হয়ে যেতেন না?’

সঞ্জয়ের প্রশ্নটা শুনে শিখিন হেসে ফেললেন। ‘প্র্যাকটিস, ভাই স্রেফ প্র্যাকটিস। তখন ক’ঘণ্টা জলে পড়ে থাকতাম জানিস? সকাল-বিকাল মিলিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা।’

সমস্বরে গলা দিয়ে বিষ্ময় ফুটে বেরল, ‘সিক্স আওয়ারস! বলছেন কী স্যার?’

‘বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি।’ শিখিন বললেন, ‘সেই সময় আমাদের কোচ ছিলেন ভুবনেশ্বর পাণ্ডে… গগাদা। কখনও কখনও উনি বেত মেরে আমাদের জল থেকে ডাঙায় ওঠাতেন। দমকলে চাকরি না পেলে হয়তো কোনওদিন আমি ইন্ডিয়া টিমে খেলে ফেলতাম।’ গুরু গগাদার আরও গুণগান করতে যাচ্ছিলেন শিখিন, এমন সময় দেখলেন অনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে তিনি বললেন, ‘কী হয়েছিল রে? কী ঝামেলায় পড়েছিলি?’

‘আর বলবেন না স্যার।’ অনিরুদ্ধ বলল, ‘আর একটু হলে মারধর খেয়ে ফিরতাম। লোকাল এক ভদ্রলোক আমাদের পাশে এসে না দাঁড়ালে হয়তো আজ হাসপাতাল ঘুরে আসতে হত। ভদ্রলোক বললেন, ওঁর বাবা না কি খুব নামকরা ফুটবলার ছিলেন। মেওয়ালাল… আপনি নাম শুনেছেন?’

সঞ্জয় বলল, ‘তুই কি রে অনি। মেওয়ালালের নাম শুনিসনি? উনিই একমাত্র ইন্ডিয়ান ফুটবলার, যিনি ফার্স্ট ক্লাস ফুটবলে হাজার গোল করেন। একান্নর এশিয়ান গেমসে আমাদের চ্যাম্পিয়ন টিমেও খেলেছেন। ওঁর ছেলে বস্তিতে থাকেন না কি?’

‘না না, বস্তির কাছে একটা পাকা বাড়িতে থাকেন। উনিই পরে বললেন, খিদিরপুর আর হেস্টিংসে যখন ফ্লাইওভারগুলো তৈরি হচ্ছিল, তখন ওখানকার ঝুপড়িবাসীরা হেস্টিংসের ভিতরের দিকে সরে যায়। সরকারী জমি দখল করে বস্তি বসিয়ে দেয়। সেই বস্তিতে এখন সরকার কয়েকটা অফিস বানাবে বলে ঠিক করেছে। আগুনটা প্ল্যান করেই লাগানো হয়েছে। আর এর পিছনে আছেন এক প্রোমোটার। তিনি আবার রুলিং পার্টির এক দাদার স্নেহধন্য। পুলিশ সব জানে।’

‘বস্তির ইনহ্যাবিট্যান্টরা জানে না?’

‘জানে। কিন্তু মুখ খুললেই তো প্রবলেম। তাই রাগটা ওরা আমাদের উপর ফলাল। ফালতু চোটপাট করল।

ওরা হেস্টিংসের মোড়ে পথ অবরোধও করেছিল।’

‘কী কারণে আগুন লেগেছিল রে?’

‘বস্তির একটা ঘরে কেমিক্যাল ভরা কিছু ড্রাম ডাম্প করা ছিল স্যার। কালো ধোঁয়া আর লালচে ফ্লেম দেখে আমার তো তাই মনে হল। কোনও কারণে ড্রামে আগুন লাগে। স্যার, স্যাড ব্যাপার হল, পাশের ঘরেই দু’তিন বছরের একটা মেয়ে ঘুমিয়ে ছিল। বাবা-মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ভুলে গেছিল, মেয়েটা ঘরে রয়ে গেছে। রেসকিউ করার সময় দেখি, বাচ্চাটা পুড়ে কাঠ হয়ে রয়েছে। দেখে আমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। রাতে ঘুমোনোর সময় বাবা-মা হয়তো ভাবতেও পারিনি, বাচ্চাটার এই পরিণতি হবে।’

এইসব করুণ অভিজ্ঞতা ফায়ার ফাইটারদের কাছে নতুন নয়। শিখিন নিজেও বহুবার প্রত্যক্ষ করেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কোনও ক্যাজুয়ালটি?’

‘বারো-তেরো বছরের একটা মেয়েকে দেখে আরও খারাপ লাগছিল স্যার। স্কুলে মেয়েটার পরীক্ষা দু’তিনদিনের মধ্যেই। বইপত্তর পুড়ে খাক। পরীক্ষা দিতে পারবে না বলে ফুটপাত বসে মেয়েটা খুব কাঁদছিল। বাবা খিদিরপুর বাজারে বসে লেবু, লঙ্কা, ধনেপাতা বেচে। মা লোকের বাড়িতে মেড-এর কাজ করে। বাবা বলছিল, মেয়েটা না কি প্রতিবার স্কুলে ফার্স্ট হয়। ভাবছি, দুপুরবেলায় গিয়ে যদি দেখা পাই, তা হলে বই কেনার জন্য মেয়েটার হাতে কিছু টাকা দিয়ে আসব।’

মনে মনে অনির তারিফ করলেন শিখিন। ছেলেটা সদ্য ফায়ার সার্ভিসে জয়েন করেছে। খুব বেশি টাকা মাইনে পায় না। কিন্তু ও যে মেয়েটার পাশে দাঁড়ানোর কথা ভেবেছে, এটাই প্রশংসা করার মতো। তেমন হলে তিনি নিজেও কিছু টাকা দিয়ে মেয়েটাকে সাহায্য করতে পারেন। অতীতে করেওছেন অনেককে। শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘হ্যাঁ রে, রেসকিউ অপারেশনের কি সত্যিই তোদের দেরি হয়েছিল?’

‘একদম না সার। কাল রাতে অ্যালার্ম বাজার ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে আমরা সাতজন ফার্স্ট পাম্পটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। রাস্তা ফাঁকা ছিল, সাত মিনিটের মধ্যে আমরা হেস্টিংস পৌঁছে যাই। তার দশ মিনিট পর আমরা সেকেন্ড পাম্প ডেকে পাঠাই। ভোর পাঁচটার মধ্যে আমরা আগুন নিভিয়ে ফেলি। তবুও, কে যেন রটিয়ে দিয়েছিল, আমরা পৌঁছতে দেরি না করলে বস্তির অনেকটাই বেঁচে যেত।। আমার মনে হয়, ঘেরাও করেছিল রুলিং পার্টিরই লোকজন। দোষটা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য।’

পাম্প কথাটার মানে ইঞ্জিনসহ দমকলের গাড়ি। কথাটা ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা বলে। শিখিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কি তোর প্রথম অপারেশন ছিল?’

অনি বলল, ‘বলতে পারেন স্যার। জয়েন করার পর দোকান-টোকানে আগুন নেভাতে গেছি। কিন্তু বড় ধরনের আগুন এই প্রথম দেখলাম।’

‘তোর আর কী এক্সপিরিয়েন্স হল রে?’

‘সত্যি কথা বলব? রাগ করবেন না বলুন।’

‘রাগ করব কেন? মন খুলে বল।’

‘আমরা উঁচুতলা বাড়িগুলোর সেফটির কথা যত ভাবি, সেই তুলনায় বস্তির ব্যাপারে কিছুই না। এই প্রথম আমি কলকাতার কোনও বস্তিতে ঢুকলাম। লিভিং কন্ডিশন এত খারাপ, নরক বললেও কম বলা হয়। ঝুপড়িগুলো এত ঘেষাঘেষি, এত ডেঞ্জারাস মেটিরিয়ালে বানানো, আগুন একটা দিকে লাগলে, হু হু করে তা ছড়িয়ে পড়ে। আরও প্রবলেমের হল, ঘরে ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার। সরকার ফ্রি-তে দিচ্ছে। স্যার, বস্তিতে একেকটা ঘরে সিলিন্ডার বার্স্ট করছে দেখে আমরা তো টেনশনে পড়ে গেছিলাম। আমার তো মনে হয়, প্রত্যেকটা বস্তিতে আমাদের রেগুলার ভিজিট করা দরকার। আলাদাভাবে রিসার্চ করা উচিত, সেফটির জন্য কোন বস্তিতে কী দরকার?’

এ সব রিসার্চ কর্পোরেশনের সিটি প্ল্যানারদের করার কথা। তবুও, উৎসাহ দেওয়ার জন্য শিখিন বললেন, ‘কথাটা তুই মন্দ বলিসনি।’

‘হেস্টিংস থেকে ফেরার সময় গুগল সার্চ করে দেখলাম, স্যার কলকাতায় বস্তির সংখ্যা কিন্তু কম না। সরকারীভাবে বাইশশো। বেসরকারী হিসেব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার। যে কোনেও বড় রাস্তার এক-দেশশো মিটার ভিতরে ঢুকলে দেখবেন, পাকা বাড়িগুলোর পিছনে একটা করে বস্তি আছে। সব বিলো পোভার্টি লাইনের লোকজন সেখানে থাকে। গুগল বলছে, প্রায় পনেরো থেকে ষোলো লাখ লোক বস্তিতে বাস করে। কলকাতার ইনহ্যাবিট্যান্টদের দশভাগের একভাগ। সাহস করে আরেকটা কথা বলব স্যার?’

অনি কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই চাওমিনের ডেকচি নিয়ে ভেতরে ঢুকে এল। ছয়টা কাগজের প্লেটে ও চাওমিন ভাগ করে দিচ্ছে। গরম ধোঁয়া উঠছে প্লেট থেকে। চোখে পড়ায় অনি বলল, ‘মন্টু, আমাকে দিস না ভাই। ফেরার সময় খিদিরপুরের মোড়ে একটা দোকান থেকে এক গ্লাস গরম দুধ আর বিস্কিট খেয়ে এসেছি। এখুনি আমি সিলভার জিম-এ যাব। ব্রেকফাস্ট করে গেলে, ব্যায়াম করতে পারব না।’

শিখিন নিজেও সিলভার জিম-এর মেম্বার। অনি ঠিকই বলেছে, ভরা পেটে ব্যায়াম করা ঠিক না। টেবলে রাখা হেলমেটটা তুলে অনি উঠে দাঁড়াল। তখনই শিখিন বললেন, ‘কী বলতে চাইছিলি, বলে যা।’

অনি বলল, ‘স্যার, ফায়ার সার্ভিসে রিক্রুট করার সময় আপনারা ছেলেদের এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেন। ফিজিক্যাল এবিলিটি টেস্ট করেন। মেন্টালি সে কতটা ফিট, সেটাও জাজ করতে ছাড়েন না। আমার মনে হয়, মরালি কে কতটা সাউন্ড, সেটাও আপনাদের দেখা উচিত।’

কথাগুলো শুনে শিখিন চমকে উঠলেন। সবার সামনে এ কী বলছে অনিরুদ্ধ? কিসের ইঙ্গিত করছে? দমকলের কর্তাদের কারও কারও সম্পর্কে বদনাম তাঁরও কানে আসে। টাকাপয়সা খেয়ে অনেকে গুরুতর অপরাধ, লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করেন। আজ অপারেশনের সময় অনি কি সে রকম কিছু লক্ষ্য করেছে? ঘরে শিশির-সঞ্জয়রা আছে দেখে শিখিন কথা বাড়ালেন না। অনির কাছে পরে জানতে চাইবেন, নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্নটা ও কেন তুলল? চাওমিনের প্লেটটা হাতে তুলে নিয়ে তিনি বললেন, ‘বস্তিতে আগুন নেভানো নিয়ে তুই যে এত ভেবেছিস, তার জন্য ধন্যবাদ। একটা কাজ কর, তোর এই এক্সপিরিয়েন্সের কথা লিখে ডিরেক্টরকে একটা চিঠি দে। পরে রিসার্চের জন্য আমি � চাপ দেবো।’

মোটরবাইক নিয়ে অনি পার্ক স্ট্রিটের দিকে বেরিয়ে যাওয়ার পর শিখিন চাওমিনের প্রথম গ্রাসটা মুখে দিলেন। আর ঠিক সেইসময় অ্যালার্ম বেজে উঠল। কোথাও আগুন লেগেছে বোধহয়। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে রওনা হতে হবে শিশির-সঞ্জয়দের নিয়ে। মুখের গ্রাস ফেলে দিয়ে শিখিন দৌড়লেন গেটের দিকে। দেখলেন, প্রথম পাম্পটা ইঞ্জিন চালু করে দিয়েছে। ড্রাইভার বনোয়ারি বলল, ‘বেশিদূর যেতে হবে না স্যার। কাছেই আগুন লেগেছে। এই স্টিফেন ম্যানসন বিল্ডিংয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে।’

(চার)

বেলা দশটার সময় মোবাইলে গ্যাঁ গ্যাঁ শব্দ শুনে কোয়েল সেটটা পকেট থেকে বের করে এনেছিল। সুইচ অন করে কানে দিতেই শুনল, ‘কোয়েল সাহা বলছেন?’

কর্তৃত্ব ফলানো গলা, পিছনে আরও কয়েকজনের কথা শোনা যাচ্ছে। শুনেই বুকটা কেঁপে উঠেছিল কোয়েলের। নিশ্চয় নার্সিং হোম থেকে। মায়ের খারাপ কিছু হয়ে গেল না কি? নিঃশ্বাস বন্ধ করে ও দুঃসংবাদটা শোনার অপেক্ষায় বলেছিল, ‘স্পিকিং।’

‘মমতা সাহা আপনাদের পেসেন্ট?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। কেমন আছেন উনি?’

‘আইসিইউ-তে আছেন। শুনুন, আপনাদের কিছু পেমেন্ট বাকি আছে। টোয়েন্টি ফাইভ থাউজেন্ড। বেলা বারোটার আগে জমা দিয়ে যাবেন। বেলা একটার সময় কিন্তু ডক্টর ভিজিটে আসবেন।’

শুনে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল কোয়েলের। পঁচিশ হাজার টাকা!! এই ঘণ্টা কয়েক আগে মাকে ও ভর্তি করে এল। এর মধ্যে এত টাকার বিল উঠল কী করে? রিসেপশনিস্ট মেয়েটার কথার অন্তর্নিহিত মানে খুঁজতে লাগল ও। প্রচ্ছন্ন একটা হুমকি আছে। ডাক্তারবাবু বেলা একটার সময় রাউন্ডে আসবেন, তার আগে টাকা জমা করে দেওয়া চাই। না দেওয়া হলে উনি পেসেন্টকে দেখবেন না। কিন্তু ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে এত টাকা কোয়েল পাবে কোথায়? মেরে-কেটে ওর এটিএমে হাজার দশেক টাকা আছে কি না সন্দেহ। ফোনে কোনও উত্তর দেওয়ার আগেই কোয়েল বুঝতে পেরেছিল, ও প্রান্ত থেকে লাইনটা কেটে দিয়েছে।

ওকে সাহায্য করার মতো এক আছে দিদি। মল্লিকবাজারের বাড়ি থেকে পরশু রাতে মাকে নিয়ে বেরনোর সময় কোয়েল ফোন করেছিল। দিদি ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ‘ফোন করার আর সময় পেলি না। বাচ্চাটার ঘুম ভেঙে গেল।’ দিদির উপর এমন রাগ হয়েছিল, কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে লাইনটা তখন কেটে দেয়। অনেক কষ্টে নিজের গয়না বিক্রি করে দু’বছর আগে মা কোনও রকমে এই দিদির বিয়ে দিয়েছিল। জামাইবাবু কোনও এক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। কম আয় করে বলে মনে হয় না। বিয়ের পর দিদি হঠাৎ যাতায়াত কমিয়ে দিল। এর পিছনে জামাইবাবুর কোনও ইন্ধন ছিল কি না, সে সম্পর্কে কোয়েলের কোনও ধারণা নেই। মোদ্দা কথা, তার পর থেকে সংসার চালানোর পুরো দায়িত্ব এখন ওর উপর। ভাগ্যিস, দেবদা ওকে চিনত। সিলভার জিম-এ যোগা শেখানোর চাকরিটা তখন জোগাড় করে দিয়েছিল। এটাই এখন কোয়েলের প্রধান রোজগার। এ ছাড়া, হপ্তায় তিনদিন করে চারটে বাড়িতে গিয়ে ও বয়স্ক মহিলাদের যোগা শেখায়। তাই কোনও রকমে ও মায়ের মুখে দুটো ভাত তুলে দিতে পারছে।

জিম-এ সঙ্গে ফোন রাখা বারণ। ট্রেনাররা মোবাইল সেট দেবদার কাছে জমা দিয়ে রাখে। কিন্তু আজ নার্সিং হোম থেকে কল আসতে পারে ভেবে, কোয়েল সেট নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। তবে সাইলেন্ট মোড-এ। এখনও পর্যন্ত দিদি বা জামাইবাবু কেউ ওকে ফোন করে মায়ের খবর জানতে চায়নি। বোঝাই যাচ্ছে, মা মরুক-বাচুক ওদের কোনও মাথা ব্যথা নেই। সুতরাং ওদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য আশা করাই বোকামি। যোগা শেখানোর মাঝে কোয়েল দ্রুত চিন্তা করতে লাগল, কার কাছে হাত পাতা যায়। ওর কোনও বন্ধু নেই। জিম-এ ও যাদের যোগা শেখায়, তাদের মধ্যে ওর বয়সিরা কেউ পাত্তাও দেয় না। সব বড়লোক বাড়ির মেয়ে। রাতারাতি জিরো ফিগার করার আশায় জিম-এ আসে। ওরা মুড়ি মুড়কির মতো টাকা ওড়ায়। পুরুষ মেম্বারদের সঙ্গে গোপনে ডেট-এ যায়।

বৃষ্টি নেমেছে বলে আজও জিম-এ মেম্বারদের হাজিরা কম। অবন্তিকা বলে একটা মেয়ে ভুজঙ্গাসন করছে। সতেরো আঠারো বছর বয়স হবে। একবছর আগে মায়ের সঙ্গে প্রথম যেদিন মেয়েটা জিম-এ ভর্তি হতে এসেছিল, সেদিন ওকে একটু কোল-কুঁজো বলে মনে হয়েছিল। গাবলা গুবলো চেহারার। টেবলে বসে সারা দিন যারা মুখ গুঁজে পড়াশুনো করে, সেই মেয়েদের মতো। পরনে জিনস ছিল বলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, ওর তলপেট আর পাছার দিকটা বেশ ভারী। মেয়েটা এত লাজুক, শারীরীক সমস্যাগুলো সেদিন বলতে চায়নি। ওর মা বলেছিল, অবন্তিকার হজম হয় না। মেনস্ট্রুয়েশনের প্রবলেম আছে। সাদা স্রাব হয়। বুকের গড়নটাও ভাল না। অভিজ্ঞ চোখে, তখনই কোয়েল ঠিক করে নিয়েছিল, মেয়েটাকে ভুজঙ্গাসন, শলভাসন আর হলাসন করালে ঠিক হয়ে যাবে। গত ছয় মাসে ওর অনেক উন্নতি হয়েছে।

অবন্তিকার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কোয়েল দেখল, মেয়েটা ভুজঙ্গাসন ঠিকঠাক করছে। ভুজঙ্গ মানে সাপ। এই আসনটা করার সময় শরীরের উপরের ভাগ এমন অবস্থায় থাকে, যেন সাপ ফণা তুলে রয়েছে। দু’হাতে ভর দিয়ে অবন্তিকা, চিবুক উপরের দিকে তুলে ঠিকঠাক ঘাড় পিছন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পা থেকে নাভি পর্যন্ত, বডির লোয়ার পোর্সন গদির সঙ্গে ঠেসে রেখেছে। তিরিশ সেকেন্ড এইভাবে থেকে পুরো শরীর ধীরে ধীরে গ্রাউন্ড লেবেলে নিয়ে এসে, অবন্তিকা উপুড় হয়ে শুয়ে, পনেরো-কুড়ি সেকেন্ডের জন্য শবাসনে থাকছে। আবার ভুজঙ্গাসনে ফিরে যাচ্ছে। এটা বারপাঁচেক ওকে করতে হবে। এই আসনে মেরুদণ্ডের ব্যায়াম হয় বলে, ওর কোল-কুঁজো ভাব অনেকটাই কেটে গেছে। বুকের গড়নও ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। স্তন দুটো ফুটে বেরচ্ছে। কৈশোরে পা দেওয়া মেয়ে বলে মনে হচ্ছে।

অবন্তিকার দিক থেকে মনোযোগ সরাতেই, ফের একবার মায়ের রুগ্ন মুখটা কোয়েলের চোখের সামনে ভেসে উঠল। দু’তিনদিন ধরে মা বলছিল, বুকের বাঁ দিকে ব্যথা হচ্ছে। গ্যাস-অম্বলের কথা ভেবে কোয়েল অতটা গা করেনি। সমস্যা হচ্ছে, মা ঠিক সময়ে খাওয়া-দাওয়া করে না। বারবার বলা সত্ত্বেও নিজেকে শোধরায়নি। যোগা নিয়ে পড়াশুনো করার জন্যই কোয়েল জানে, শরীরের ভিতর একটা ঘড়ি থাকে। ঠিকমতো চলার জন্য, তার কিছু চাহিদা আছে। সেটা না মেটালেই ঘড়ি বিগড়ে বসে। আসলে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা কেমন যেন হয়ে গেছে। দুই মেয়েকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েছিল। জ্ঞাতিরাও যে যেমনভাবে পারে, ঠকিয়েছে। এখন ওদের সম্বল বলতে মল্লিকবাজারে পৈতৃক বাড়িতে দুটো ঘর। এমন ভাঙাচোরা অবস্থায় সেই দুটো ঘর, যে কোনওসময় ছাদ ধসে পড়তে পারে।

কোয়েলের মনে পড়ল, পরশু রাতে মা যন্ত্রণায় ছটফট করছে দেখে ও আর ভোর হওয়ার অপেক্ষায় থাকেনি। বাড়িতে থাকেন ওর দুই বয়স্ক জেঠা আর কাকা। তাঁদের ডাকাডাকি করা সত্ত্বেও কেউ দরজা খোলেননি। মায়ের পরামর্শে বাধ্য হয়ে কোয়েল রহমতচাচাকে ডেকে এনেছিল পাশের বাড়ি থেকে। চাচার নিজের ট্যাক্সি আছে। সেই ট্যাক্সিতে করে ওরা ইলিয়ট রোডের একটা নার্সিং হোমে যায়। প্রিয়জন অসুস্থ হয়ে পড়লে মানুষ যে কতটা অসহায় হয়ে পড়ে, সেটা কোয়েল টের পাচ্ছিল। নার্সিং হোমে ঢুকেই ও বুঝতে পারে, এটা ওদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য নয়। মাকে ওরা ভর্তি করে নিয়েছিল বটে, কিন্তু এমন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাকাচ্ছিল বা কথা বলছিল, কোয়েলের মনে হচ্ছিল, যেন জানতে চাইছে, এখানে ট্রিটমেন্ট করানোর মতো সামর্থ্য আছে তো? ওয়ার্ডে ঢোকার ঠিক আগে হাতটা ধরে মা কাতর স্বরে বলেছিল, ‘এখানে কেন নিয়ে এলি খুকি? সামলাতে পারবি?’ শুনে চোখে জল এসে গেছিল কোয়েলের।

এই মানুষটা অযাচিতভাবে কত লোকের জন্য প্রাণপাত করেছে। দেখে তখন কোয়েল রাগ করে বলত, ‘দেখব, তোমার বিপদে ক’টা লোক আসে? কেউ তখন ফিরে তাকাবে না মা।’ মা হেসে বলত, ‘যার কেউ নেই, তার ভগবান আছে। দেখবি, ঠিক কেউ না কেউ পাশে দাঁড়াবে। ঠাকুরই তাকে পাঠিয়ে দেবে।’

মা-ই ঠিক। রহমতচাচাকে পরশু রাতে ঠাকুরই পাঠিয়েছিল। ভোরবেলায় চাচা বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় বলেছে, ‘বেটি, তুই চিন্তা করিস না। আমার ফ্যামিলি তোর সাথে আছে।’ কী আশ্চর্য, মাও প্রায়দিন এই কথা বলত। ‘আমাদের ফ্যামিলিটা মাত্তর দু’জনের বলিস কেন তুই খুকি। ভাবতে দোষ কী, এ পাড়ায় যারা থাকে, তারা সবাই মিলে আমরা একটা ফ্যামিলি।’

‘ম্যাডাম, আমার ভুজঙ্গাসনটা করা হয়ে গেছে।’ অবন্তিকার কথা শুনে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হল কোয়েলের। ‘এ বার কি শলভাসনটা করে ফেলব? আমার কিন্তু আর মিনিট দশেক সময় বাকি আছে।’

অবন্তিকা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর গা দিয়ে মিষ্টি একটা গন্ধ বেরচ্ছে। আজকাল ছেলে-মেয়েরা পারফিউম মেখে জিম করতে আসে। ঘামের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য। ওদের আমলে ঘাম নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। উল্টে ভাবত, ঘাম হয়নি। তার মানে ব্যায়াম ঠিকঠাক হয়নি। কথাটা ভেবে কোয়েল মনে মনে হাসল। ভুজঙ্গাসন করার পরই শলভাসন করার নিয়ম। শলভ কথাটার মানে হচ্ছে পতঙ্গ। ঘেরন্ড সংহিতায় লেখা আছে, এই আসন করার সময় শরীর পতঙ্গের আকার ধারণ করে। প্রথম দিকে অবন্তিকা শলভাসন ঠিকমতো করতে পারত না। তাই ওকে অর্ধশলভাসন শিখিয়েছে কোয়েল। ওর তলপেট আর পাছার মাসলগুলো ক্রমে ক্রমে টাইট হয়ে আসছে। অবন্তিকার মা একদিন বলছিলেন, ‘তোমার কাছে ট্রেনিং নেওয়ার পর থেকে, মেয়ের খিদে অনেকটা বেড়ে গেছে। মেনস্ট্রুয়েশনের সময় আর ব্যথায় ছটফট করছে না। এখন ওর কনফিডেন্সও অনেক বেড়েছে।’ ভদ্রমহিলা এত ইম্পেসড যে, নিজেও এখন যোগ ক্লাসে ভর্তি হতে চাইছেন।

অবন্তিকা অর্ধশলভাসন শুরু করার পর গেটের দিকে তাকাতেই কোয়েল দেখল, অনিরুদ্ধ ভিতরে ঢুকে আসছে। ভিজে রেনকোটটা বাফার জোনে ঝুলিয়ে দিয়ে ও কার্ড পাঞ্চ করল। সদ্য চাকরি পেয়েছে দমকলে। জয়েন করার দিন সবাইকে আপেল আর কলা খাইয়েছিল। খুব মিশুকে টাইপের ছেলে। লকার রুমে যাওয়ার পথে দূর থেকে ও হাত নাড়ল। কয়েক মিনিট পর পোশাক বদলে, কাছে এসে অনিরুদ্ধ বলল, ‘গুড মর্নিং ম্যাডামদি।’

বেশিরভাগ মেল মেম্বার কোয়েলকে সম্বোধন করে, মিস মিত্র অথবা ম্যাডাম বলে। জিম-এ একমাত্র এই ছেলেটাই ম্যাডামদি বলে ডাকে। দিদি বলে ডাকার মধ্যবিত্ত সংস্কার এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বোধাহয়। কোয়েল পাল্টা বলল, ‘গুড মর্নিং।’

কানের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে, শুনতে পায়নি এমন ভঙ্গিতে অনিরুদ্ধ ঠাট্টা করল, ‘কী বললে? স্যাড মর্নিং? বলেছি না, গুড মর্নিংটা রোজ হাসিমুখে বলবে? তোমার মুখে আজ হাসি নেই কেন?’

‘হাসি বেরচ্ছে না ভাই। মা নার্সিং হোমে। খুব দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে।’

‘দুঃশ্চিন্তাটা ভাগ করে নিচ্ছ না কেন ম্যাডামদি? তোমার ফ্যামিলিতে আর কেউ নেই?’

‘থেকেও নেই বলতে পারো।’

‘তা হলে ফ্যামিলিটা বাড়িয়ে নাও। আমাকেও তোমার ফ্যামিলিতে অ্যাড করে ফেলো। বলো, কী কাজে লাগতে পারি। এখান থেকে বেরোনোর পর রাত আটটা পর্যন্ত আমার ডিউটি নেই, আমি ফ্রি।’

কথাটা বলে অনিরুদ্ধ উত্তরে আশায় তাকিয়ে রয়েছে। কোয়েলের চোখে পড়ল, বিদিশা ওদের কথাবার্তা শুনছে। জিম-এ মেম্বারদের সঙ্গে সবসময় পেশাদারি সম্পর্ক রাখতে বলেন আনন্দী ম্যাডাম। কোনও মেল মেম্বারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা পছন্দ করেন না। ভদ্রমহিলার কাছে রিপোর্ট হয়ে গেলে মুশকিলে পড়তে হবে কোয়েলকে। ওর মতো বিদিশাও ট্রেনার, তবে সাত নম্বর জোনের। খুব কুচুটে টাইপের। মেয়েটা থাকে পার্ক সার্কাস অঞ্চলে অ্যাংলো পাড়ায়। সেই কারণে খুব দেমাক। অনিরুদ্ধর সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে কোয়েল বলল, ‘দরকার হলে বলব ভাই। তুমি যাও, সময় নষ্ট কোরো না। ওয়ার্ক আউট শুরু করো।’

‘সে আমি যাচ্ছি। কিন্তু মাসিমা কোন নার্সিং হোমে ভর্তি আছে, সেটা তো বলবে?’

নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য কোয়েল নার্সিং হোমের নামটা বলে দিল। তার পর মন দিল অবন্তিকার দিকে এর মধ্যেই ও অর্ধশলভাসনটা বার পাঁচেক করে ফেলেছে। এ বার হলাসন করবে। এই আসনে তলপেটে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। হলাসন করার জন্য অবন্তিকা উঠে দাঁড়াতেই সাদা গদীর দিকে তাকিয়ে কোয়েল চমকে উঠল। একটা জায়গায় হালকা লাল ছোপ। দাগটা এল কোত্থেকে? উজ্জ্বল আলোয় বেশি করে চোখে পড়ছে। একটু ভাবতেই কোয়েল ধরে ফেলল। অবন্তিকার লোয়ার ট্র্যাকশ্যুটে, উরু সন্ধিক্ষণেও দাগটা দেখা যাচ্ছে। মাই গুডনেস, মাসিক শুরু হয়ে গিয়েছে, অথচ মেয়েটা টেরই পায়নি!! চোখের ইশারায় ও দাগটা দেখাতেই অবন্তিকার মুখ ফ্যাকাশে। গালে হাত দিয়ে ও বলে উঠল, ‘ইসস ম্যাডাম, কী হবে?’

‘আজই কি হওয়ার কথা ছিল?’

‘না ম্যাডাম। দিনতিনেক পর ডেট ছিল।’

‘তোমার কি ঠিকঠাক ডেট-এ হয়?’

‘আগে ইরেগুলার হত। কিন্তু যোগা শুরু করার পর থেকে, লাস্ট সিক্সথ মান্থ ডেট ফেল করেনি।’

‘ভুজঙ্গাসনটা করার সময় কি অ্যাবডোমেন্টে পেন ফিল করেছিলে?’

‘খুব সামান্য। অন্যবার দু’একদিন আগে থেকে পেন শুরু হয়। তখন বুঝতে পারি। এ বার কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। আই অ্যাম সরি… ভেরি ভেরি সরি ম্যাডাম।’ লজ্জায় গলা বুঁজে এলে অবন্তিকার।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে কোয়েল বলল, ‘তুমি শিগগির লেডিস টয়লেটে যাও। উপরের দিকের লকার খুললেই দেখতে পাবে, প্যাড সাজানো আছে। আমি দেখছি, গদিটা তাড়াতাড়ি পাল্টানো যায় কি না?’

ভাগ্যিস এইসময়টায় আট নম্বর জোনে অন্য কোনও মেম্বার নেই। রক্তের দাগটার উপর একটা তোয়ালে ফেলে ঢেকে দিয়ে, কোয়েল দ্রুত স্টোর রুমে গেল। অন্যদিন এই সময়টায় যোগা করতে হাজির থাকেন মিসেস বাগচী। ভীষণ খুঁতখুতে টাইপের মহিলা। গদিতে সামান্য ময়লা দেখলেই চেঁচামেচি শুরু করে দেন। সম্ভবত, বৃষ্টির জন্য আজ তিনি আসতে পারেননি। স্টোরকিপার পাণ্ডেজিকে গদি বদলানোর কথা বলে জোনে ফিরে আসার সময় কোয়েল দেখল, দেবদার চেম্বার থেকে অনিরুদ্ধ বেরুচ্ছে। ওয়ার্ক আউট শুরু না করে এতক্ষণ তা হলে দেবদার সঙ্গে আড্ডা মারছিল! পারেও বটে ছেলেটা। ফ্লোরে এতক্ষণ ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক বাজছিল। হঠাৎ বলিউডি ফিল্মের গান বাজতে শুরু করল। ফাস্ট বিট-এর দমাদম গান। অনিরুদ্ধ পুরোনো দিনের বলিউডি গান খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে, কিশোর কুমারের গান। মনে হয়, দেবদাকে নিশ্চয় ও বলতে গেছিল, ‘ঠুং ঠাং বাজনটা প্লিজ বন্ধ করো। ব্যায়াম করতে উৎসাহ দেবে, এমন গান চালাও।’ আশ্চর্য, দেবদা মেনেও নেয় ওর আব্দার।

হাত নেড়ে দেবদা ওকে ডাকছে। কাছে যেতেই বলল, ‘কোয়েল, তুই এখানে? এখুনি নার্সিং হোমে চলে যা। সময় নষ্ট করিস না। বিদিশাকে আমি বলে দিচ্ছি, তোর অ্যাবসেন্সে ও তোর জোন সামলাবে।’

শুনে কোয়েলের বুকটা কেঁপে উঠল। তা হলে কি মায়ের খারাপ কিছু হল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *