স্টপওভার : করাচি

স্টপওভার : করাচি

ভারতীয় সাংবাদিকদের তখন পাকিস্তান যাবার ভিসা দেওয়া হত না। তাই চাণক্যপুরীর পাকিস্তান হাইকমিশনের দরজায় কোনো আবেদনপত্র নিয়ে হাজির হইনি কিন্তু সব সময়ই পাকিস্তান যাবার একটা অদম্য ইচ্ছা মনের মধ্যে জমা ছিল। মনে হত অমৃতসর থেকে মাত্র আধ ঘণ্টার পথ যে হোর তাকেও কী দেখতে পাব না? করাচিকে পাশে রেখে মধ্যপ্রাচ্যের কত দেশ ঘুরে চলে যাচ্ছি ইউরোপ। দেশে ফেরার পথেও করাচির সঙ্গে লুকোচুরি খেলছি। তখনও সে বোরখা পরে নিজেকে ঢেকে রেখেছে।

সেবার কমনওয়েলথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স কভার করতে লন্ডন গেছি। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট বোধহয় ইচ্ছা করেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী আর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে ক্লারিজেসএ রেখেছেন। তাই আমাকেও বার বার যেতে হয় ব্রুক স্ট্রিটের এই বিখ্যাত হোটেলে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর নানা কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য আমাদের হাই কমিশনের বেশ কয়েকজন কর্মী ও অফিসারকে দিনরাত ওখানে থাকতে হয়। পাকিস্তান প্রেসিডেন্টকে সাহায্য করার জন্য পাকিস্তান হাইকমিশনের অনেকে ওখানে। ভাগ্যক্রমে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসএর কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সঙ্গে ক্লারিজেসএ আমার বেশ আলাপ হল। প্রথমে নেহাতই সৌজন্যমূলক কথাবার্তা; হয়তো সামান্য হাসিঠাট্টা। তারপর একটু ঘনিষ্ঠতা। সপ্তাহের শেষে প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স শেষ হতে না হতেই ওঁরা আমার বন্ধুস্থানীয় হয়ে গেলেন। আয়ুব খান লণ্ডন ত্যাগ করার পরের দিনই নটিংহিল এ হক সায়েবের বাড়িতে আমার নৈশভোজন।

ঐ নৈশভোজনে পাকিস্তান হাইকমিশনের চারপাঁচজন কূটনীতিবিদ সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও বি বি সি র দুচারজন বাঙালিও সস্ত্রীক আমন্ত্রিত ছিলেন। এক রাউণ্ড শেরি-শ্যাম্পেন-কনিয়াক-ভডকার পর শুরু হল গান। সবার আগে মাহমুদা বেগম গাইলেন অতুলপ্রসাদের মিছে তুই ভাবিস মন। তাই গান গেয়ে যা, গান গেয়ে যা আজীবন! তারপর আরো কতজনের কত গান। ঐ গান বাজনার মাঝে মাঝেই হাসিঠাট্টা-গল্পগুজব। হঠাৎ কি প্রসঙ্গে যেন করাচির কথা উঠতেই আমি বললাম, দিল্লি ফেরার পথে কটা দিন করাচিতে কাটাতে পারি না?

আমিন সায়েব বললেন, আপনাকে ভিসা দেওয়া যাবে না কিন্তু ভিসা ছাড়াও তো আটচল্লিশ ঘণ্টা আপনি থাকতে পারেন।

তা তো জানি কিন্তু….

হকসায়েব বললেন, ওসব কিন্তুটিন্তু ছাড়ুন; আপনি যান। আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব।

আমি সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলাম, কোনো বিপদে পড়ব না তো?

ওরাও সোজাসুজি উত্তর দিলেন, না, বিপদে কিছু পড়বেন না, তবে টিকটিকি লেগে থাকবে।

আমি হেসে বললাম, পাকিস্তানে গেলে যে টিকটিকি পিছনে লেগে থাকবে, তা তো খুবই স্বাভাবিক।

পরের দিনই আমি রিটার্ন জার্নির প্ল্যান ঠিক করে ফেললাম। লন্ডন, প্যারিস, ফ্রাঙ্কফার্ট মিউনিক, ভিয়েনা, রোম, বেইরুট, কায়রো, করাচি, দিল্লি। হকসায়েবকে জানিয়েছিলাম, চার তারিখে লন্ডন ছাড়ছি; একুশে ভোর চারটে ত্রিশে বি ও এ সি ফ্লাইট ফাইভ জিরো ওয়ান এ করাচি পৌঁছব। থাকব কেএলএম হোটেলে। হসায়েব বললেন, সব ঠিক হোগা কোই চিন্তা নেই করনা।

আমি লন্ডন ছাড়ার আগে হকসায়েবকে আমার রোম আর কায়রোর হোটেলের নাম ঠিকানাও জানিয়ে দিলাম।

ঘুরে ফিরে এলাম রোম কিন্তু না, হকসায়েব কোনো কিছু খবর দিলেন না। কায়রোতেও তিনদিন কাটালাম। না, ওখানেও কোনো চিঠিপত্র পেলাম না। উনি প্রতিশ্রুতি না দিলেও বলেছিলেন, দরকার হলে যোগাযোগ করবেন। আমি আশা করেছিলাম, রোম বা কায়রোতে ওর কাছ থেকে একটা চিঠি বা টেলিগ্রাম পাব। তাই বেশ দুশ্চিন্তা নিয়েই কুড়ি তারিখ রাত্রে কায়রো থেকে করাচি রওনা হলাম।

প্লেন ঠিক সময়ই করাচি পৌঁছল। অবিভক্ত ভারতের বৃহত্তম এয়ারপোর্ট আমাকে মুগ্ধ করল না, বরং সূর্যোদয়ের প্রাক্কালেও এর বাতাসে প্রাণহীন রুক্ষতার স্পর্শে চমকে উঠলাম। করাচি এয়ারপোর্টে নামলেই বোঝা যায়, বেলুচিস্তানের মরুপ্রান্তর দূরে নয়।

এলাম টার্মিনাল বিল্ডিং। ইমিগ্রেশন কাউন্টারের পুলিশ কর্মচারী আমার পাশপোর্ট একটু বেশি যত্ন নিয়ে দেখে একবার ভালো করে আমার মুখখানা দেখলেন, এ্যারাইভালোও করাচি ইন্টারন্যাশনাল। ঐ স্ট্যাম্পের উপরেই সই করে তারিখ দিলেন।

একটু পরে কাস্টমস। একজন অফিসার আমার সুটকেসের উপরেই কমনওয়েলথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্সের ফোলিও ব্যাগটি দেখে প্রশ্ন করলেন, আর ইউ এ ডিপ্লোম্যাট?

না, আমি সাংবাদিক।

পাশপোর্ট দেখান।

ওঁকে পাশপোর্ট দেবার পর উনি আমার পরিচয়পত্রের পাতাটি ভালো করে দেখে নিয়েই একবার আমাকে দেখলেন। তারপর হঠাৎ বাঘের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, এনি ক্যামেরা? ওয়াচ? ইলেকট্রনিক…

না, ওসব কিছুই নেই।

অসভ্যর মতো চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলেন, সোনার গহনা? ফরেন কারেন্সি?

না, তাও নেই; তবে ট্রাভেলার্স চেক আছে।

আবার সেই অসভ্য চিৎকার, তবে কী আছে আপনার সুটকেশে?

জামাকাপড় আর কাগজপত্র।

যে ভদ্রলোক এতক্ষণ অসভ্যর মতো চিৎকার করছিলেন, তিনিই হঠাৎ অত্যন্ত চাপ গলায় আমার দিকে না তাকিয়েই বাংলায় প্রশ্ন করলেন, আপনি হকসায়েবের বন্ধু?

সতর্কভাবে এদিকওদিক দেখে নিয়ে বললাম, হ্যাঁ।

উনিও অত্যন্ত সতর্কভাবে একবার চারপাশে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিয়ে প্রায় আপনমনে বললেন, কে এল এমএর হোটেলেই থাকবেন তো?

মুখে না, মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।

চলে যান। কোনো চিন্তা নেই।

মনে মনে হকসায়েবকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলাম না।

এরপর পাশপোর্ট জমা রেখে রসিদ নিয়ে বি ও এ সির গাড়িতে চলে এলাম কে এল এমএর ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে। তখন ছটা বাজে। রাত্রে বিশেষ ঘুম হয়নি। তাই জামা কাপড় বদলে একটু শুয়ে পড়লাম।

দরজায় নক্ করার আওয়াজ হতেই ঘুম ভাঙল। ঘড়িতে দেখলাম, প্রায় সাড়ে ৯টা বাজে। দরজা খুলতেই এক বৃদ্ধ রুম বেয়ারা আমার ঘরের ভিতর ঢুকেই ডান হাত কপালের কাছে তুলে বলল, আদাব।

সেলাম আলেকুম না বলে আদাব বলতেই বুঝলাম উনি বাঙালি। একটু হেসে বললাম, আপনি বাঙালি?

হা কর্তা, আমি বাঙালি। প্যাটের দায়ে এই বিদেশে পইড়া আছি।

করাচি বিদেশ হবে কেন?

বৃদ্ধ রুম বেয়ারা একটু ম্লান হেসে বললেন, যে দেশের ভাষা, খাবার দাবার, পোশাক পরিচ্ছদ, আবহাওয়া আলাদা সে বিদেশ ছাড়া আবার কী?

বৃদ্ধের কথা শুনে আমি বিস্মিত হই না; বরং খুশি হই।

আমি কিছু বলার আগেই উনি বললেন, আপনার ঘরে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না। আমি সবষের তেল এনে দিচ্ছি, ভালোভাবে স্নান করুন। এ শালাদের এক গাদা মশলা দেওয়া খাবারদাবার খাওয়ার দরকার নেই। আমি মাছের ঝোল ভাত এনে দেব। তাই খেয়ে বেরিয়ে পড়ুন।

বুঝলাম, পরিকল্পনা মতোই কাজ এগুচ্ছে। বৃদ্ধের কথা উপেক্ষা করলাম না, সরষের তেল মেখেই স্নান করলাম। বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গেই মাছের ঝোল ভাত খেলাম।

তারপর?

ঐ বৃদ্ধের নির্দেশমতো প্রিডি স্ট্রিটের কটেজ ইন্ডাস্ট্রীজ সেলস অ্যান্ড ডিসপ্লে সেন্টারের সামনে গিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিলাম। দশপনের মিনিট এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পর ডানদিকে কিছুদুর যেতেই বৃদ্ধের দেওয়া নম্বরের অষ্টিন দেখতে পেলাম। গাড়িতে কেউ ছিলেন না কিন্তু দরজা খোলা ছিল। আমি গাড়িতে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক ভদ্রলোক হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, আমি সিরাজুল ইসলাম। গাড়ি খুঁজতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?

না।

উনি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট করলেন। একটু ফাঁকা রাস্তায় পৌঁছেই উনি বললেন, আপনি খুব ভালো দিনে এসেছেন।

কেন?

আজ আমাদের চিত্রাঙ্গদার ফাইনাল রিহার্সাল।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। একসঙ্গে অনেক বাঙালির সঙ্গে আপনার আলাপ হবে।

তাহলে তো সত্যিই ভালো দিনে এসেছি।

গাড়িতে যেতে যেতেই অনেক গল্প হল। সিরাজুল ইসলাম জন্মেছেন কলকাতাষ পড়াশুনা কলকাতারই রিপন কলেজে; তবে এম এ পড়েছেন ঢাকায়। চাকরি কবে পাকিস্তান রেডিওর বাংলা বিভাগে। আমার কথাও উনি শুনলেন।

দুপাঁচ মিনিট পর সিরাজুল ইসলাম লুকিয়ে একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, কলকাতার কথা মনে পড়লে আর কিছু ভালো লাগে না।

আমি বললাম, যেখানে জন্মেছেন, যেখানে লেখাপড়া শিখেছেন, সেখানকার স্মৃতি কখনই ভোলা যায় না।

সিরাজুল হঠাৎ ডানদিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নতুন রাস্তায় পড়েই বলেন, কাজকর্মে ঝামেলায় দিনগুলো কেটে যায় ঠিকই কিন্তু কদাচিৎ কখনও কলকাতার লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে শুধু কলকাতার কথাই মনে হয়। উনি আপন মনে একটু ম্লান হেসে বললেন কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি, আমি করাচিতে এসে রেডিও পাকিস্তানের সেবা করব।

কেন? পূর্ব পাকিস্তানের লোক হয়ে করাচিতে এসে চাকরি করা কী স্বাভাবিক ব্যাপার নয়?

সিরাজুল আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, আমাদের দেশ বসিরহাট; পূর্ব পাকিস্তান না।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

তাহলে কী দাঙ্গার পরই বসিরহাট ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান?

উনি আবার একটু হাসেন। বলেন, দাঙ্গা হয়েছিল কলকাতায়, ঢাকায়, নোয়াখালিতে বসিরহাটে না।

তাহলে বসিরহাট ছাড়লেন কেন?

উনি একটা আঙুল দিয়ে কপাল দেখিয়ে বললেন, সবই কিসমতের খেল। ঢাকায় ব্যবসাঁ করতে গিয়ে বাবা মারা গেলেন; আর সেই ব্যবসা সামলাতে আমি গেলাম ঢাকায়। ব্যস এমন জড়িয়ে পড়লাম যে আর ফিরতে পারলাম না।

রহমান সায়েবের বাড়িতে ঢুকেই আমি স্তম্ভিত। চিত্রাঙ্গদা নাচছে আর গান হচ্ছে–আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি। আমি ঘরে পা দিতেই মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার নাচ থেমে গেল, গান বন্ধ হল। চিত্রাঙ্গদা মুহূর্তের জন্য একটু হেসে আমার দিকে তাকালেন। আমাকে অভ্যর্থনা করলেন ঘরের সবাই। আমি হাসতে হাসতে বললাম, আপনারা এমন করে অভ্যর্থনা করছে যেন ঘরে অর্জুন ঢুকলেন।

আমার কথায় ঘরের মেয়েপুরুষ সবাই হাসেন। চিত্রাঙ্গদা বললেন, কোনো দ্বিধা সঙ্কোচ না করে প্রায় অর্জুনের মতোই তো এলেন।

আমি হাসতে হাসতে বলি, তাহলে কী বলব–কাহারে হেরিলাম! আহা!

সে কি সত্য, সে কি মায়া।

ঘর ভর্তি; সবাই হাসিতে লুটিয়ে পড়লেন। হাসি থামতেই সিরাজুল ইসলাম একটি মেয়েকে বললেন, লায়লা, তুই সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দে। লায়লা আমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর আমাকে পাশে নিয়েই বসলেন। তারপর একটু চাপা গলায় বললেন, আমি লায়লা ইসলাম, সিরাজুল ইসলামের বোন।

এ ঘরের অর্ধেকের বেশিই তো রেডিও টিভিতে আছেন। আপনিও কী রেডিও বা টিভিতে আছেন?

না, না, আমি পড়াশুনা করছি।

কী পড়ছেন? এম এ।

লায়লা একটু হেসে জবাব দিলেন, বছর দুই আগে এম এ পাশ করেছি।

তাহলে রিসার্চ করছে?

হ্যাঁ, তা বলতে পারেন।

ঐ সামান্য বিরতির মধ্যেই চা আর চিড়ের পোলাও এলো। মিসেস রহমান নিজে আমাকে চা দিলেন। লায়লা এগিয়ে দিলো এক প্লেট চিড়ের পোলাও। একটু হাসিঠাট্টা গল্পগুজবের পর আবার রিহার্সাল শুরু হল।

নাচগানের মধ্যে যেন নিমেষেই সময়টা কেটে গেল। রিহার্সাল শেষ হবার পর আবার চাকফি আর হিংয়ের কচুরি। নানাজনের সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব। এবার আস্তে আস্তে সবাই বিদায় নিতে শুরু করলেন। হঠাৎহুদাসায়েব আমার কাছে এসে বললেন, হাজার হোক আপনি ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট। পুলিশ নিশ্চয়ই একটু খেয়াল রাখছে কিন্তু যদি কোথাও কোনো অসুবিধা হয় তাহলে আমাকে ফোন করবেন।

আমি মিঃ হুদার টেলিফোন নম্বরের কাগজটা হাতে নিয়ে বললাম, কোনো অঘটন ঘটার সম্ভাবনা আছে নাকি?

উনি হেসে বললেন, না, না, কিছু ঘটবে না। আমি ঘন্টাখানেক আগেই টেলিফোন করেছি।

সিরাজুল ইসলাম পাশেই ছিলেন। উনি আমাকে বললেন, হুদা সায়েব আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর। তার চাইতে বড়ো কথা উনি কলকাতায় থাকার সময় পঙ্কজ মল্লিকের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন।

আমি হুদা সায়েবকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই। তারপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি সিরাজুল আর লায়লার সঙ্গে ওঁদের বাড়ি রওনা হলাম।

বাড়ি ফেরার পথে সিরাজুল আমাকে প্রায় সারা শহরটা ঘুরিয়ে দেখাবার পর বললেন, আপনার মতো লোকের কাছে এ শহরে দেখার কিছু নেই; তবে কাল যদি আপনাকে ক্লিফটন বীচ দেখাতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে।

হ্যাঁ, ক্লিফটন বীচের কথা অনেকের কাছেই শুনেছি।

কাল যদি ছুটি নিতে পারি তাহলে আমিই নিয়ে যাব; নয়তো লায়লা আপনাকে ঘুরিয়ে আনবে।

আমি বললাম, কাজকর্মের ক্ষতি করে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবার দরকার নেই।

লায়লা বললেন, আপনাকে একটু ঘুরিয়ে আনলে আমাদের কারুরই কোনো কাজের ক্ষতি হবে না। দাদা ছুটি না পেলে আমিই আপনাকে ঘুরিয়ে আনব।

ঘুরেফিরে সিরাজুলের বাড়িতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ওদের মা দরজা খুলে দিয়েই বললেন, একটু আগেই রহমান সায়েবের কুঠী থেকে ফোন এসেছিল। তার আগে তোর অফিস থেকে দুবার ফোন এসেছে।

সিরাজুল প্রথমেই ওঁর অফিসে ফোন করলেন। সহকর্মী নরুল হাসানের খুব জ্বর। সুতরাং একটু পরেই ওঁকে রেডিওতে ছুটতে হবে।

এরপর রহমান সাহেবের বাড়িতে ফোন করে জানালেন, আমার আপত্তি না থাকলে আগামীকাল দুপুরে আমাকে ওরা খাওয়াতে চান। মিসেস রহমান আমার সঙ্গেও কথা বললেন, আজ তো আপনার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলতে পারলুম না। তাই কাল দুপুরে আসুন। সবাই মিলে একটু গল্প করা যাবে।

আমি সানন্দে স্বীকৃতি জানালাম।

সিরাজুল একটু পরেই রেডিও স্টেশনে চলে গেলেন। যাবার সময় বললেন, আপনি আম্মা আর লায়লার সঙ্গে গল্প করুন। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসছি।

সিরাজুলের মার সঙ্গেও অনেক গল্প হল। উনি কাটোয়ার মেয়ে। ম্যাট্রিক পাশ করেছেন কলকাতার শাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল থেকে। ভিক্টোরিয়াতে আইএ ক্লাসএ ভর্তি হবার পরই বিয়ে হয়। উনি বললেন, আমাদের সব আত্মীয়স্বজনই পশ্চিমবাংলায়। শুধু বড়ো মেয়ে আর জামাই ছাড়া ঢাকায় আমাদের আর কোনো আত্মীয় নেই। আত্মীয়স্বজন ছেড়ে এত দূর দেশে পড়ে থাকতে একটুও ভালো লাগে না। সব শেষে উনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কোথা দিয়ে যে কি ঘটে গেল, তা ভাবতেও অবাক লাগে।

আমি চুপ করে ওঁর কথা শুনি। লায়লা স্নান করতে গেছেন। ঘরে শুধু আমরা দুজন। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর হঠাৎ উনি প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বাবা, শনিবারের চিঠি এখন বেরোয়?

না।

তাই নাকি? অত সুন্দর কাগজটা বন্ধ হয়ে গেল?

হ্যাঁ।

ভারতবর্ষপ্রবাসী তো চলছে?

না, ওগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে।

কী আশ্চর্য! তাহলে লোকে পড়ে কী?

এখন নতুন নতুন অনেক কাগজ বেরিয়েছে।

কিন্তু বাবা, সেগুলোতো ভারতবর্ষপ্রবাসী হতে পারে না।

না, তা কী সম্ভব?

বৃদ্ধা আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সব কিছুই এমনভাবে বদলে যাচ্ছে যে আমাদের সব কিছুই বেসুরো মনে হয়।

লায়লা স্নান করে আসতেই উনি বললেন, তোরা গল্প কর। আমি শুতে যাই। পায়ে বড় ব্যথা করছে।

লায়লা আমাকে বললেন, আম্মা বাতের ব্যথায় বড়ো কষ্ট পাচ্ছেন। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না।

আমি বললাম, আমি তো অনেকক্ষণ আপনাকে আটকে রেখেছি। আপনি এবারে বিশ্রাম করুন।

বৃদ্ধা চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে লায়লাকে বললেন, একে দেখেশুনে খেতে দিস। লায়লা হাসতে হাসতে বললেন, কেন, তোমার কলকাতার লোক বলে?

তাই তো!

ওঁর মা ভিতরে চলে যেতেই লায়লা জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের রিহার্সাল কেমন লাগল?

খুব ভালো।

কী ভালো লাগল?

নাচগান, আপনাকে, আপনার দাদাকে, রহমান সাহেবকে..

আমি আপনার সামনে বসে আছি বলে আমাকে খুশি করার কোনো দরকার নেই।

ঠিক তো?

অবশ্যই।

তাহলে বলি, আপনি ছাড়া আর সবাইকে ভালো লেগেছে।

আর আমাকে?

একটুও ভালো লাগেনি

কেন?

আপনার রূপ নেই, গুণ নেই, আপনাকে ভালো লাগবে কেন?

ঠিক বলেছেন।

দুজনেই হাসি।

এবার আমি প্রশ্ন করি, আচ্ছা মেয়েরা কি সব সময়ই নিজেদের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে?

মেয়েদের দোষ দিচ্ছেন কেন? প্রশংসা শুনতে আপনারা ভালোবাসেন না?

অন্যের কথা বলতে পারি না। তবে আমার প্রশংসা করলে নিশ্চয়ই আমার ভালো লাগবে কিন্তু দুঃখের কথা, কেউ আমার প্রশংসা করে না।

কেউ না?

একজন করে তবে সাক্ষাতে না।

তিনি কে?

এক কথায় জবাব দিতে পারব না।

ঠিক আছে, সবিস্তারেই বলুন।

তার কথা শুরু করলে আরো দুচারদিন আমাকে করাচি থাকতে হবে।

তাই থাকুন। কে আপনাকে চলে যেতে বলছে?

দুচারদিন থাকার পর যদি যেতে হচ্ছে না করে?

ইচ্ছে না করে থেকে যাবেন।

যদি সিরাজসায়েব আপত্তি করেন?

সে দায়িত্ব আমার।

আপনি আমার দায়িত্ব নেবেন কেন?

আমার ইচ্ছা।

আমি আর কথা বলি না। লায়লার দিকে তাকিয়ে একটু হাসি! লায়লাও হাসেন। দু জনেই দুজনকে দেখি আর হাসি।

তারপর লায়লা বললেন, আপনি ভারি মজার লোক।

কেন?

বেশ কথা বলেন।

তাই নাকি?

আপনি আমাদের রিহার্সালের ওখানে ঢুকতেই বুঝলাম, আপনি বেশ ইন্টারেস্টিং লোক।

আমি হাসি।

হঠাৎ লায়লা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, একটু বসুন। চা করে আনি।

কোনো দরকার নেই।

কেন? চা খেতে ইচ্ছে করছে না?

ইচ্ছে তো করছে কিন্তু আপনি চলে গেলে একলা একলা ঝগড়া করব কেমন করে?

লায়লা হাসতে হাসতে বললেন, আমার সঙ্গে কিচেনে চলুন।

না থাক; তাহলে আপনার সঙ্গে আরো অনেক জায়গায় যেতে ইচ্ছে করবে।

লায়লা হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন।

আমরা চা খেতে খেতেই সিরাজুল সায়েব ফিরে এলেন। অনেক গল্প হল; তবে শুধুই কলকাতার কথা। ভিক্টোরিয়া, চৌরঙ্গী, কলেজ স্কোয়ার, কফি হাউস, বসন্ত কেবিন। পুরনো বইয়ের দোকান, গানের জলসা ময়দানের ফুটবলআরো কত কি! সব কিছুর মধ্যেই কেমন একটা আবেগ, মমত্ববোধ। কী যেন হারাবার বেদনা!

কথা বলতে বলতে সিরাজুল সায়েব হঠাৎ চুপ করেন। কী যেন আপনমনে ভাবেন। নাকি মনে মনে কিছু আবৃত্তি করছেন?

আচ্ছা অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, বিষ্ণু দে কলকাতাতেই আছেন তো? সুভাষ মুখোপাধ্যায় খুব জনপ্রিয়, তাই না?

আমাদের কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ লায়লা বললেন, দাদাও খুব ভালো কবি।

তাই নাকি?

সিরাজুল একটু হাসেন। লায়লা বলেন, দাদার তিনটে কবিতার বইও বেরিয়েছে।

আমি সিরাজুল সায়েবকে বলি, আপনি তো আচ্ছা লোক! এসব খবর আগে বলেন নি?

উনি সলজ্জভাবে বললেন, পাঁচজনকে জানানোর মতো কবিতা আমি লিখতে পারি না। তবে মাঝে মাঝে যখন মানসিক যন্ত্রণাটা অসহ্য হয়, তখন কবিতা না লিখে পারি না।

কথায় কথায় অনেক রাত হয়েছিল। তাই খেয়েদেয়েই হোটেলে ফিরে এলাম। হোটেলে পৌঁছে দেবার সময় সিরাজুল সায়েব জানালেন, উনি ছুটি পাননি। রহমান সায়েবের বাড়িতে খেতে যেতে পারবেন কিনা তারও ঠিক নেই; তবে খুব চেষ্টা করবেন। আর জানালেন, লায়লা ১২টা নাগাদ আমার হোটেলে এসে আমাকে রহমান সায়েবের বাড়ি নিয়ে যাবেন। তারপর খাওয়াদাওয়ার পর লায়লাই আমাকে ক্লিফটন বীচ ঘুরিয়ে আনবেন। মনে মনে খুশি হলেও ভদ্রতার খাতিরে আপত্তি জানালাম কিন্তু সিরাজ সায়েব বললেন, না, না, আপনার দ্বিধা করার কোনো কারণ নেই। ওর একটুও কষ্ট হবে না; বরং খুশি হবে।

মনে মনে ঠিক করেছিলাম, ১০টা পর্যন্ত ঘুমব কিন্তু সাড়ে ৯টা বাজতে বাজতেই দরজায় খট খট আওয়াজ। রাত্রে তিনটে নাগাদ এয়ারপোর্ট যেতে হবে; সুতরাং রাত্রে ঘুম হবার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। তাই একটু বিরক্ত হয়েই বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দরজা খুলে আমি হতবাক।

লায়লা!

আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি! এখন?

লায়লা দরজার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে। হাসতে হাসতে বললেন, আগে বলুন, আপনার ঘরে ঢোকার অনুমতি পাব কিনা।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

ঘরে ঢুকে আমার বিছানার দিকে একবার তাকিয়েই লায়লা প্রশ্ন করলেন, শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন?

আমি হেসে বলি, আপনাকে।

তাহলে আপনার ঘরে আমার বসার অধিকার আছে, তাই না?

একশবার।

আমি টেলিফোন করে রুম সার্ভিসকে চা পাঠাতে বলেই ওঁকে প্রশ্ন করি, হঠাৎ এখন আপনার আবির্ভাব?

অকারণেই।

সিরাজ সায়েব কী বাড়িতে?

ওকে আমি অফিসে নামিয়ে দিয়েই এখানে এসেছি।

উনি এত সকালেই অফিসে গেলেন?

হা; আজ ওর অনেকগুলো রেকর্ডিং আছে।

সেই বৃদ্ধ রুম বেয়ারা চা নিয়ে এলো। টুকটাক কথা বলে ও চলে গেল। লায়লা আমাকে চা করতে দিলেন না। বললেন, থাক। আমার সামনে আর আপনাকে চা করতে হবে না।

চা খেতে খেতে আমি আবার জানতে চাই, সত্যি বলুন তো আপনি এখন এলেন কেন? কোনো প্রোগ্রাম চেঞ্জ হয়েছে?

না, কোনো প্রোগ্রাম চেঞ্জ হয়নি।

তাহলে এখন এলেন কেন?

ইচ্ছে হলো, তাই চলে এলাম।

সত্যি?

আমি মিথ্যে কথা বলি না।

না, না, তা বলছি না। তবে ভাবছিলাম হয়তো……

কাল আপনার সঙ্গে কথা বলতে বেশ লাগছিল। তাই মনে হল, যাই আপনাকে একটু বিরক্ত করে আসি।

খবু ভালো করেছেন।

সত্যি বলছেন?

হ্যাঁ, সত্যি বলছি! কৰাচিতে আসার আগে মনে মনে অনেক ভয় ছিল কিন্তু কাল এত আনন্দে কাটিয়েছি যে আপনাদের কথা কোনোদিন ভুলতে পারব না।

আমাদেরও খুব ভালো লেগেছে। কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমি আর দাদা আপনার কথা আলোচনা করেছি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

আমি সত্যি ভাগ্যবান।

সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। লায়লা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, আপনি বেশ চট করে সবাইকে আপন করে নিতে পারেন।

আমি তো বুঝতে পারিনি, কাকে আপন করে নিলাম।

আচ্ছা ওসব কথা থাক। আপনি কিন্তু রহমান সায়েবের বাড়িতে জমে যাবেন না।

আমি হেসে বলি, সেটা কী আমার হাতে?

হ্যাঁ, আপনার হাতে।

আমি হাসি চেপে বললাম, ঠিক আছে। ওরা কেউ থাকতে বললে বলব, আপনি বেশিক্ষণ থাকতে বারণ করেছেন।

কোনো আপত্তি নেই।

না, রহমান সায়েবের বাড়িতে সত্যি বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। ওঁদের আন্তরিকতার জন্য বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, বেশ কয়েক জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে হবে বলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও এখন আড্ডা ছেড়ে উঠছি।

লায়লা আয়েসার সঙ্গে গল্প করছিলেন। আমি ওকে বললাম উঠুন আর গল্প করলে আমাদের সব জায়গা যাওয়া হবে না।

লায়লা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি তো আপনার ড্রাইভার। হুকুম করলেই উঠব।

রহমান সায়েবের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানদিকে ঘুরেই লায়লা হাসতে হাসতে বললেন ওয়েল ডান।

কৃতিত্ব অভিনেতার নয়, পরিচালিকার

লায়লা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, আপনার সঙ্গে দিনের পর দিন কাটালেও কেউ ক্লান্ত হবে না।

গাড়ি চলছে সোজা পশ্চিমে। আরব সাগরের ঝড়ো হাওয়া উইন্ড স্ক্রীনের উপর আছডে পড়ে গাড়ির ভিতরে আশ্রয় নিচ্ছে। লায়লার চুল উড়ছে, শাড়ির আঁচল উড়ছে। আমি দেখছি। না দেখে পারছি না। হঠাৎ দেখি, আরব সাগর আমার সামনে দাঁড়িয়ে মাতলামি করছে। লায়লা অষ্টিনের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েই বললেন, এই আমাদের ক্লিফটন বীচ।

শহরের এত কাছে?

হ্যাঁ, শহর থেকে মাত্র তিন মাইল

দুএক পা এগিয়ে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই বললাম, সত্যি অপূর্ব।

আপনি আরো দুএকদিন থাকলে মনোরা আইল্যান্ড ঘুরিয়ে আনতাম। ওটাও খুব সুন্দর জায়গা।

পরের বার যাওয়া যাবে।

আপনি কী আবার করাচি আসবেন?

আশা তো করি!

আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগুতে এগুতে লায়লা বললেন, এলে খুশি হবো কিন্তু আশা করি না

কেন?

এ সংসারে বেশি আশা করলেই বেশি দুঃখ পেতে হয়।

তা ঠিক কিন্তু আমি না এলে আপনি দুঃখ পাবেন কেন?

দুঃখ না পেলেও আশাভঙ্গ তো হবে।

ক্লিফটন বীচে আলোছায়ায় ঘোরাঘুরি করতে করতে আমরা কত কথা বলি। এলোমেলো। কখনও হাসি, কখনও গম্ভীর হয়ে ভাবি। আবার আনমনাও হই মাঝে মাঝে। তারপর অস্তগামী সূর্যের মুখোমুখি হয়ে সমুদ্রের ধারে বসি। কখনও নীরব, কখনও সরব। আবার কখনও দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকি অপলক দৃষ্টিতে; দুজনের চোখেই কত অনুক্ত প্রশ্ন।

ফেরার পথে গাড়িতে কেউই বিশেষ কথা বলি না। বলতে পারি না; বলতে মন চায় না। আনমনা হয়ে কত কী ভাবি। বোধহয় লায়লাও ভাবেন। ফিরে আসি করাচি শহরে। রেডিও স্টেশন থেকে সিরাজুল সায়েবকে তুলে নিয়ে সোজা ওঁদের বাড়ি। আম্মার সঙ্গে আবার সেই কলকাতার গল্প। সিরাজুল সায়েব আমায় তাঁর কবিতার বই ‘সাধনা, আমার সাধনা’ উপহার দেন। আমার আটচল্লিশ ঘণ্টা করাচি বাসের মেয়াদ যত কমে আসছে, ঘড়ির কাটা তত বেশি জোরে দৌড়চ্ছে। হোটেলে জিনিসপত্র গোছগাছ করার ছিল। তাই দশটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া শেষ করার পর আর বসলাম না। ওঁরা দুভাইবোনেই আমাকে হোটেলে ছাড়তে এলেন। রাত তখন এগারোটা

আমি আর সিরাজুল সায়েব ঘরে ঢুকলেও লায়লা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ভিতরে আসতে বললাম কিন্তু উনি এলেন না।

ঘরে ঢুকেই সিরাজুল সাহেব বললেন, দাদা আমার একটা উপকার করবেন?

নিশ্চয়ই করব।

আপনি নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে কলকাতা যান?

হ্যা যাই।

আমার দুখানা বই আর একটা ফাউন্টেনপেন একজনকে পৌঁছে দেবেন?

আমি হেসে বললাম, সানন্দে।

উনি ব্যাগ থেকে দুকপি ‘সাধনা, আমার সাধনা’ আর একটা নতুন লেডিজ পার্কার কলম বের করে আমার হাতে দেবার পর এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিলেন। বললেন, এই কাগজে ঠিকানা লেখা আছে।

ঠিকানা পড়তে গিয়েই চমকে উঠলাম। শ্রীমতী সাধনা রায়!

আমি ওঁর দিকে তাকাতেই উনি একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ দাদা, এই সাধনাই আমার সাধনা।

আমি বিমুগ্ধ হয়ে ওঁকে একবার ভালো করে দেখেই বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম।

আমার বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়েই উনি বললেন, দাদা, কফি খাওয়াবেন না?

নিশ্চয়ই।

আপনি কফির অর্ডার দিন। আমি গাড়িটা পার্কিংএ রেখে আসি।

সিরাজসায়েব বেরিয়ে যেতেই আমি কফির অর্ডার দিলাম। আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখতেই লায়লা ধীর পদক্ষেপে ঘরে ঢুকলেন।

দাদা কোথায় গেল?

গাড়িটা পার্কিং এ রাখতে গেলেন।

লায়লা দুএক পা এগিয়ে একেবারে আমার সামনে মুখ নিচু করে দাঁড়ালেন।

জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বললেন?

লায়লা একটা ছোট্ট প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বললেন, কাফ লিংকটা ব্যবহার করলে খুশি হব। যদি কাফ লিংক দেখে আমার কথা মনে পড়ে তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করব।

আমি সকৃতজ্ঞ চিত্তে ওঁর উপহার গ্রহণ করে বললাম, নিশ্চয়ই করব।

এবার লায়লা কোন কথা না বলে একটা খোলা খাম আমার হাতে দিলেন। দেখি, ভিতরে রয়েছে ওঁর সুন্দর ছোট্ট একটা ছবি। ঠিক পার্সে রাখার মতো। আমি কিছুতেই বলতে পারলাম না, লায়লা, আমার পার্সে একটাই ছবি রাখা যায়। সেখানে যার স্থান আছে সেই আমার চিরদিনের, চিরকালের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *