স্ক্রিপ্ট রাইটার : প্রথম পর্ব

স্ক্রিপ্ট রাইটার : প্রথম পর্ব

আশিকের প্রধান সমস্যা, সে সবকিছু ভুলে যায়। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা তাকে খুব চিন্তা করে মনে করতে হয়। চিন্তার মাঝখানে কোনো অপ্রত্যাশিত শব্দ কিংবা ঘটনার মুখোমুখি হতে হলে সেই চিন্তা আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয়।

কোনো একটা জায়গায় খেতে গিয়েছে, কিংবা কোনো কাজে। ফেরার সময় রিকশা করে ফিরে আসে। সে যে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে, এই ব্যাপারটা তার মনে পড়ে পরদিন। কিংবা কখনো দুদিন পর।

তারপর মনে করার চেষ্টা, শেষবার কোথায় গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল। নিউমার্কেট নাকি আসাদ গেট? একটা রিকশা নিয়ে বের হয়ে পড়া। সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে দেখার ফাঁকে ফাঁকে চোখ বন্ধ করে চিন্তা করা, শেষ কোথায় বের হয়েছে গাড়ি নিয়ে?

আশিক মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই মনে আসছে না। একেক বার চোখে একেকটা ছবি ভেসে আসে। কোনো একটা নির্দিষ্ট ছবিতে স্থির হতে পারছে না।

বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা ভাড়া করে। গাড়ি খোঁজার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো, গতকাল যেখানে যেখানে সে গিয়েছে সবগুলো জায়গায় যাওয়া।

কিন্তু কোথায় কোথায় গিয়েছে সেটা নিয়ে নিজের ভেতরে অল্প একটু বিতর্ক আছে। একবার মনে হচ্ছে অফিস শেষে স্টার কাবাবে যাবার আগে কবিরের চায়ের দোকানে থেমেছিল। আবার মনে হচ্ছে কবিরের চা- দোকানের যে ছবি ভেসে আসছে, সেটা তারও একদিন আগের।

দুপাশের ড্রেন, ঠেলাগাড়ি, শাকসবজির বাজার অতিক্রম করে রিকশা এগিয়ে চলছে। অফিসের পার্কিং স্পেসে গাড়ির সন্ধান মেলেনি। কবিরের চা দোকানের সামনেও নেই। রিকশা থেকে নেমে কবিরকে জিজ্ঞাসা করে ‘তোমার এখানে গত পরশু এসেছিলাম?’

‘জি ভাই। সাথে ম্যাডামও আছিল।’

‘আমি কি গাড়ি নিয়ে এসেছিলাম?’

‘আবার হারাইছেন?’

‘কোথায় রেখেছি মনে করতে পারছি না।‘

‘এখান থেকে কোথায় গেছিলেন?’

‘স্টার কাবাব।’

শেষমেশ স্টার কাবাবের গ্রাউন্ড ফ্লোরে গাড়ির সন্ধান মেলে। আশিক উপরে উঠে বসে। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে দেখে, তার টেবিলে অন্য একজন বসে আছে। লোকটির সারা মুখে বসন্তের দাগ।

মিনিট দশেক পর হোটেল বয় এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানি নিয়ে এলে, আশিক খেতে শুরু করে। সারা দিনের ধকলে বেশ ক্লান্ত। মিলিকে একটা ফোন দিয়ে জানায়, সে আসছে। শহর থেকে দূরে এক বাংলোয়, মিলি অপেক্ষা করছে।

ঠিক এমন সময় একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। টেবিলের অন্য পাশে বসা লোকটি একটা চামচ দিয়ে তার প্লেট থেকে খাবার খেতে শুরু করে।

আশিক জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার জন্য এক প্লেট অর্ডার করব?’

লোকটি না সূচক মাথা নাড়ে।

‘আমরা কি পূর্বপরিচিত?’

‘জি না।’

‘তাহলে?’

‘কী?’

‘আমাকে জিজ্ঞাসা না করে, আমার খাবার খাচ্ছেন।’

‘আপনি কি অসুস্থ?’

‘আমি অসুস্থ হব কেন?’

লোকটির গলার স্বর বেশ কর্কশ। আশিক কথা না বাড়িয়ে খাবার শেষ করে।

হঠাৎ খেয়াল হয়, সে আসলে লোকটির খাবার খেয়ে ফেলেছে। চিকেন বিরিয়ানির কথা সে ভাবলেও অর্ডার করতে ভুলে গেছে।

আশিক বেশ বিব্রত বোধ করে। তার এই সমস্যার কথা সে জানে। মস্তিষ্কের যে অংশ শর্ট টার্ম মেমরির তথ্যগুলো একসাথে করে লং টার্ম মেমরিতে পৌঁছে দেয় সেই অংশের প্রবেশমুখে একটা জটলা লেগে আছে। সে বলল, ‘যেখানে জটলা লেগেছে জায়গাটার নাম, হিপোক্যাম্পাস।’

লোকটি রাগান্বিত চোখে তাকায়। আশিক হতাশ হয়। সে ভেবেছিল লোকটি জিজ্ঞাসা করবে, হিপোক্যাম্পাস কী!

অন্ধকার রাস্তা। হিম শীতল বাতাস। রাস্তার এক ধারে গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর ভেতরে বৃষ্টি, ঝির ঝির

‘এদিক দিয়ে যাবার সময় একটা কুকুর অ্যাকসিডেন্ট হয়। তাকে খুঁজে পাবার কোনো উপায় আছে?’

যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তাকে দেখে মনে হয়েছে স্থানীয় কেউ হবেন। লোকটি কথার জবাব না দিয়ে ভ্যানগাড়ির উপর বসে সিগারেট টানছেন।

‘গত এক সপ্তাহে বেশ কয়েকবার এসেছি, কিন্তু তাকে খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘খুঁজে পেলে কী করবেন?

‘চিকিৎসা করাব।’

‘যখন অ্যাকসিডেন্ট করেছেন তখন এলেই হতো।’

‘ভয় পেয়েছিলাম।’

লোকটি শব্দ করে হাসে।

সুনসান নীরব ভুতুড়ে রাস্তা। গাড়ির মাইলেজ ছিল আশি। এমন সময় একটা কুকুর সামনে এসে ধাক্কা খায়। বন্ধ জানালায় ভেতর থেকে শব্দ আসছিল, বাঁচার আকুতি কিংবা ব্যথার যন্ত্রণায় সেই শব্দ কান থেকে সরে যায় মাত্র

কয়েক সেকেন্ডে।

স্থানীয় লোকটি তাকে একটি ডাস্টবিনের কাছে নিয়ে যায়। বলল, ‘কয়েকদিন ধরে এখানে একটা কুকুরের লাশ পড়ে ছিল।’

আশিক উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘গায়ের রং কী ছিল।’

লোকটি জবাব দেয়, ‘কালো।’

সারা শরীরে হিম বাতাস বয়ে গেল।

‘কুকুরটি কোথায়?’

‘কে জানে? হয়তো সিটি করপোরেশনের লোকজন নিয়ে গেছে।’

শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল?’

‘এত কিছু খেয়াল করিনি।’

‘সিটি করপোরেশন সব ময়লা কোথায় গিয়ে ফেলে, আপনি জানেন?’

লোকটি চলে যেতে উদ্যত হলেন। ঠিক এমন সময় মিলি ফোন করে।

‘কোথায়?’

‘এই তো আসছি।’

‘এখানে অনেক মশা। আসার সময় কয়েল নিয়ে আসবে।

‘আচ্ছা।’

‘তোমাকে এ রকম অন্যমনস্ক লাগছে কেন?’

‘আমি একটা খুন করেছি।’

‘কী আবোলতাবোল বলছ?’

‘সত্যি বলছি।’

‘আচ্ছা শোন, এ রকম হেঁয়ালি করবে না। তাড়াতাড়ি এসো।’

গাড়ি ছুটে চলেছে বড় রাস্তা ধরে। শহর থেকে বের হতেই এক টুকরো পাহাড়। পাহাড়ের ওপর নির্জন এক বাংলো। রাস্তার ধারে ভেজা গাছ, ঘরে ফেরা মানুষ আর বন্ধ দোকানপাট।

মিলির সাথে দেখা হবার আগে, বেশ কয়েকবার রাস্তা ভুলে গিয়ে আবার ফিরে আসা একই স্থানে। একই মানুষকে বারবার জিজ্ঞাসা করা, বাংলো কোনদিকে; শেষবার ফিরে এসে সেই স্থানে মানুষটিকে না দেখে নানান চিন্তায় সময় ক্ষেপণ করা।

মিলি দাঁড়িয়েছিল উঠানে, গায়ে শীতের হুডি। আশিককে দেখে বলল, ‘এত দেরি কেন?’

‘অনেক কিছু ঘটে গেছে।’

‘কী?’

‘আমি একটা খুন করেছি।’

‘মানে?’

‘অ্যাকসিডেন্ট। আমার গাড়ির সামনে ধাক্কা খায়।’

‘মারা গেছে তুমি নিশ্চিত?’

‘প্ৰায়।’

‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।’

‘আমি তাকে দেখিনি। তবে অনুমান করতে পারছি।’

অন্ধকার জঙ্গলে ক্যাম্পফায়ার। আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করে। চারপাশের সবকিছু এবস্ট্রাক্ট ছবির মতো,অর্ধেক বস্তু অর্ধেক কল্পনা। আরও কিছু সময় ক্ষেপণ, উৎকণ্ঠা আর নীরবতা শেষে, আশিক বলল ‘চলো আমরা একটা খেলা খেলি।’

‘কী?’

‘আমরা নিজেদের যা বলতে পারি না, পাহাড়কে বলে দিই।’

‘পাহাড়ের সাথে কথা বলা যায়?’

‘কেন যাবে না? গাছের ইন্দ্রিয় আছে। কেউ কেউ দাবি করে, দৃষ্টিশক্তিও আছে।’

‘কে দাবি করে?’

চার্লস ডারউইনের ছেলে ফ্রান্সিস ডারউইন।’ খানিকটা বিরতি নিয়ে বলল, ‘দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও সমস্যা নেই।’

মিলি তাকিয়ে থাকে অপলক।

‘তুমি কি সেই অন্ধ জ্যোতিষীর গল্প শুনেছ?’

‘কোন গল্প?’

‘যে তার বুকের ভেতরে দেখতে পেত, পুঞ্জীভূত গ্রহ নক্ষত্র।’

রাত তিনটায় বাংলোয় প্রবেশ করে একটি পুলিশের গাড়ি। তারা আশিককে গ্রেফতার করতে চায়। আশিক জানতে চায় ‘কেন?’

‘আপনি একটা খুনের সাথে সম্পৃক্ত।’

‘আপনারা জানলেন কী করে?’ আশিক ভেবে পায় না।

ভয়ে কাঁপছে মিলি। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে গিয়েও কেমন করে যেন ধরে রাখছে নিজেকে। বলল, ‘কী হচ্ছে এসব?’

আশিক আমতা গলায় বলল, ‘তোমাকে বলেছিলাম, অ্যাকসিডেন্ট। আমার গাড়ির সামনে ধাক্কা খায়।’

পুলিশের এক কর্মকর্তা আশিকের কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিল। বেকডালা খুলে বলল, ‘পাওয়া গেছে।

‘কী পাওয়া গেছে?’ জানতে চায় আশিক।

সঙ্গে সঙ্গে দুপাশ থেকে দুজন পুলিশ তাকে শক্ত করে ধরে, এক প্রকার বেঁধে ফেলল। মিলি চিৎকার করছে। গাড়ির বেকডালায় একটি ডেডবডি। কোনো একটি মেয়ে। একুশ-বাইশ বয়সের হবে।

পুলিশ অফিসার বললেন, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

আশিক বলল, ‘আমি কোথাও যাচ্ছি না। আগামী দুদিন এখানেই থাকার প্ল্যান।’

‘খুন করেছেন কোথায়?

মিলির কান্না পায়। সে আশিককে বলল, ‘তুমি তখন সত্য বলেছিলে?’

সবকিছু এত দ্রুত ঘটতে শুরু করে, আশিক নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে সময়ের চেয়ে সে অনেক বেশি ধীর হয়ে গেছে। তার সামনে একটি কাগজ ঘুরছে। এত দ্রুত ঘুরছে যে কাগজে কী লেখা সে পড়তে পারছে না।

‘তুমি লাশটা বেগডালায় করে নিয়ে এসেছ?’ জিজ্ঞাসা করে মিলি।

পুলিশ অফিসার সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় মিলির দিকে। তাকে আলাদা একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।

‘আপনি জানতেন সবকিছু?’

‘কী সব বলছিল, ভাবছিলাম রসিকতা করছে।’

‘কী বলেছিল?’

‘একটা অ্যাকসিডেন্ট, আর কী যেন।’

‘সে লাশ নিয়ে আপনার কাছে এসেছে কেন?’

‘আমি জানি না।’

ঝির ঝির বৃষ্টি নামে। প্রচণ্ড ভয়ে মিলি এতটুকু হয়ে দাঁড়িয়ে। তার ইচ্ছে করছে মেয়েটার কাছে যেতে। আশিক কেন তাকে হসপিটালে কিংবা থানায় না নিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে? মেয়েটা কে ছিল?

গাড়ির কাগজপত্র চেক করতে গিয়ে সবার চোখ কপালে। পুলিশের এক কর্মকর্তা পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার নাম?’

‘আশিক।’

‘পুরো নাম বলেন।’

‘আশিকুর রহমান।’

‘এখানে লেখা আছে, ফজলে করিম। ‘

‘এমন হবার কথা না।’

‘গাড়িটা কার?’

আশিক ভীত গলায় বলল ‘আমার।’ বলেই সে মিলির দিকে তাকায়। নেতিবাচক চিন্তা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

‘এই গাড়ি ফজলে করিমের নামে। আপনি তাকে চেনেন?’

‘জি না।’

আশিকের মাথা কাজ করছে না। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে মাথা ঠিক রাখতে। মস্তিষ্ক সচল রাখার জন্য সে বড় করে শ্বাস ফেলছে।

পুলিশ কর্মকর্তা ড্রাইভিং লাইসেন্স বের করে বলল, ‘আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স কোথায়?’

‘বুঝতে পারছি না।’

‘ফজলে করিম আপনার কে হয়?’

‘কেউ না।’

তারপর একসময় ফজলে করিমের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখে আশিক বলল, ‘আজ সন্ধায় তার সাথে দেখা হয়েছিল।’

‘সে এখন কোথায়?’

‘জানি না।’

‘তার সাথে পরিচয় কবে থেকে?

‘আজ সন্ধ্যায়।’

‘আজ সন্ধ্যায় পরিচয় আর তার গাড়ি নিয়ে এখানে চলে এসেছেন?’ আশিক বাকরুদ্ধ।

সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেছে, মনে হচ্ছে সময় চলছে আর সে থেমে আছে। ক্যাম্পফায়ারের আগুন নিভে গেছে কখন? খেয়াল হয়নি কারো। ঘটনার আকস্মিকতায় ভুলে গেছে তারা, একটা খেলায় মেতে ছিল, পাহাড়ের

সঙ্গে কথা বলার।

পুলিশ কর্মকর্তা ওয়াকিটকিতে কথা বলছেন। আসামির সহযোগীকে পাওয়া গেছে। গাড়ি উদ্ধার। লাশ উদ্ধার। সাথে একটি মেয়েও জড়িত। সে আগে থেকে জানত।

ফজলে করিমের গাড়ি চলে গেছে পুলিশের তত্ত্বাবধানে। আলো ফুটলে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় স্টার কাবাবের পার্কিং গ্রাউন্ডে। সেখানে গিয়ে আশিকের গাড়ি পাওয়া গেছে। কিন্তু আশিক মনে করতে পারছে না, তার গাড়ির চাবি কোথায়।

পুলিশের লোক রাগান্বিত গলায় বললেন, ‘আমাদের বিভ্রান্ত করবেন না। দয়া করে চাবি দিন।

আশিক অসহায় দৃষ্টি নিয়ে মিলির দিকে তাকায়। সে কাউকে বিভ্রান্ত করছে না। সবাই তাকে বিভ্রান্ত করছে।

হোটেল কর্তৃপক্ষ থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নেয়া হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে আশিকের গাড়ি তাদের পার্কিং স্পেসে প্রবেশ করে ঘটনার চব্বিশ ঘণ্টা আগে। অর্থাৎ তাদের দুজনের দেখা হবার আগেই, পূর্ব কোনো পরিকল্পনা ছিল।

পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, ‘সর্বনিম্ন শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।’

আশিক বলল, ‘আমার একজন ভালো লইয়ার দরকার।’

‘আপনি চব্বিশ ঘণ্টা আগে গাড়ি রেখে চলে গেলেন। পরদিন একটা রিকশায় করে এলেন। যাবার সময় অন্য আরেকটি গাড়ি নিয়ে চলে গেছেন। যেখানে একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে। আপনার প্রেমিকা সব আগে থেকে জানত। অর্থাৎ এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’

‘মিলি আমার প্রেমিকা না।’

‘বাংলোয় গিয়ে ফষ্টিনষ্টি? আরও একটি মামলা হবে।’

‘আপনারা এত কিছু জানেন, এটা জানেন না, সে আমার স্ত্রী।‘

ঘণ্টাখানেক পর সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আরও দেখা গেল, আশিক এবং ফজলে করিম দুজন একই টেবিলে খেতে বসেন। দুজন একই খাবার অর্ডার করে একসাথে খেলেন। এ থেকে বোঝা যায়, তারা পূর্বপরিচিত। তাছাড়া ভিডিওতে তাদের একে অন্যের সাথে কথা বলতে দেখা গেছে।

আশিক বুঝতে পারে সবকিছু তার বিপক্ষে চলে গেছে। কাউকে তার কথা বোঝাতে হলে তার মূল সমস্যার কথা বলতে হবে।

আশিক বলল, ‘আমি প্রায় সময় সবকিছু ভুলে যাই। এই নিয়ে ডাক্তারের সাথে বহুবার কলসাল্ট করেছি। আপনারা চাইলে কথা বলতে পারেন।’

‘এসব কথা কোর্টে গিয়ে বলবেন।’

‘ঘটনার দিন সকালে, আমি আমার গাড়ি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’

পুলিশ কর্মকর্তা ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘গাড়ি নাকি গাড়ির চাবি?’

আশিক নির্বিকার গলায় বলল, ‘গাড়ি। এই ঘটনা আমার সাথে প্রায় সময় হয়। কোনো একটা জায়গায় গিয়েছি, ফেরার সময় গাড়ি রেখে চলে আসি।’

‘আপনি কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন?

‘ইয়ার্কি কেন করব? আমার কাছে প্রমাণ আছে।’

‘কী প্রমাণ?’

‘ঘটনার দিন বিকেলে আমি কবিরের চায়ের দোকানে গিয়েছিলাম গাড়ি খুঁজতে।’

‘কবিরের চায়ের দোকানে কেন?’

আগের দিন যেসব জায়গায় গিয়েছি, সেই লিস্টে কবিরের চায়ের দোকানও ছিল।’

জেরা পর্বের এক পর্যায় পুলিশের গাড়ি কবিরের চা দোকানের সামনে এসে থামে।

কবিরকে জিজ্ঞাসা করে, ‘গতকাল এই ছেলেটি আপনার দোকানে এসেছিল?’

কবির আশিকের দিকে তাকায়। ‘জি. আসছিল।’

‘কেন এসেছিল? চা খেতে? নাকি অন্য কোনো কারণে?’

‘আসছিল গাড়ি খুঁজতে। পায় নাই এখনো?

আশিক দীর্ঘ দম ফেলে। একটু একটু করে জট খুলতে শুরু করে। যেখানে জটলা লেগেছে জায়গাটার নাম, হিপোক্যাম্পাস।

‘সেখানে গাড়ি না পেয়ে গেলাম স্টার কাবাবের গ্রাউন্ড ফ্লোরে। কারণ পরশুদিন সেখানে ডিনার করেছিলাম।’ বলল আশিক।

‘তারপর ফজলে করিমের সাথে আলাপ করছিলেন, কীভাবে ডেডবডি সরানো যায়?’

‘কিসের ডেডবডি? লোকটির নাম আমি জেনেছি আপনাদের কাছ থেকে।’

পুলিশ কর্মকর্তা বিদ্রূপের সহিত বললেন ‘দুজন এক প্লেটে বিরিয়ানি খেলেন। তার গাড়ি নিয়ে বাংলোয় এলেন, তাকে চিনেন না?’

‘আমি তো বলেছি, আমার একটা সমস্যা আছে। অনেক সময় শর্ট টার্ম মেমোরিও মনে রাখতে পারি না। ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসার মিনিট দশেক পর টেবিলে এক প্লেট চিকেন বিরিয়ানি দেখি। কিন্তু আমি অর্ডার করার কথা চিন্তা করেছিলাম, অর্ডার করিনি, এটা ভুলে গেছি।’

পুলিশ কর্মকর্তা সিগারেট জ্বালিয়ে চিন্তিত মুখে পায়চারি করলেন। আশিকের কথা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য না। তবুও নাড়াচাড়া করে দেখা।

বললেন, ‘আপনারা দুজন কী কথা বলছিলেন?’

‘আমাকে না জিজ্ঞাসা করে আমার খাবার খাচ্ছে কেন, সেটাই জানতে চাইলাম।’

‘তিনি কী বললেন?’

‘তিনি বলেছিলেন, আমি অসুস্থ।’

‘অসুস্থ বলার পর আপনাকে তার গাড়ির চাবি দিয়ে দিল?’

‘তিনি আমাকে চাবি দেননি।’

‘যথেষ্ট হয়েছে আপনার ফাজলামো।’

আশিক শান্ত গলায় বলল, ‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ভালো করে দেখুন। দুটা গাড়ির চাবি দেখতে একই। টেবিলের ওপর রাখা। যাবার সময় আমার চাবি মনে করে তার চাবি নিয়ে গেছি।’

‘গাড়ির সামনে গিয়েও টের পাননি?’

‘দুটা গাড়ির মডেলও একই। চাবির রিমোটে…‘

‘নিজের মতো করে গল্প বানালে হবে?’ খানিকটা বিরতি নিয়ে বললেন তাছাড়া আপনার খুনের কথা আপনার স্ত্রী আগে থেকে জানতেন।’

‘সেটা একটা কুকুর ছিল। রাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট করেছিলাম গত সপ্তাহে।’

‘কী সব ফালতু কথা বলছেন।’

‘আমার কাছে প্রমাণ আছে।’

‘কী প্রমাণ?’

‘কুকুরটা যেখানে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, গতকাল রাতে খুঁজতে গিয়েছিলাম। স্থানীয় একজন লোকের সাথে এই নিয়ে আলাপ হয়েছে। আপনারা তার সাথে কথা বলতে পারেন।’

‘লোকটির বাসা কোথায় জানেন?’

‘সেটা জানি না। তবে খুঁজে বের করতে পারব।’

রনক হাসান শান্ত গলায় বললেন, ‘আমার কাছে আরও একটা স্ক্রিপ্ট আছে।’

ডিরেক্টর বললেন, ‘কী রকম?’

‘আমরা দেখাতে পারি, সেদিন বাংলোয় কোনো পুলিশ আসেনি। অন্ধকার ক্যাম্পফায়ারে তারা দুজন কথা বলছে, পাহাড়ের সঙ্গে।’

‘কী কথা?’

‘সেটা নিয়ে চিন্তা করা হয়নি। তবে এমন কিছু কথা থাকবে যা শোনার পর দর্শকের হৃদয় নিংড়ে যাবে।’

‘তারপর?’

‘গাড়ির ভেতর থেকে শব্দ আসতে শুরু করে। আশিক আর মিলি দুজন উঠে গিয়ে গাড়ির কাছে যায়। শব্দ আসছে বেগডালার ভেতর থেকে।’

‘বেগডালার ভেতর থেকে শব্দ আসবে কী করে?’

শব্দটা এমন যে ভেতর থেকে নাড়াচাড়া হচ্ছে। যেন একসাথে অনেকগুলো বিড়াল বের হবার চেষ্টা করছে।’

ডিরেক্টর চিন্তিত হয়ে রনকের কথা শুনছে।

‘আশিক অস্থির চিত্তে গাড়ির বেগডালা খোলে। বেগডালায় একটি মেয়ে। হাত-পা বাঁধা। মুখে টেপ মোড়ানো। তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। মিলি জিজ্ঞাসা করে, ‘মেয়েটি কে?’

‘মেয়েটি হঠাৎ করে কেন শব্দ করার চেষ্টা করে? ডিরেক্টর জানতে চায়।’

‘কারণ তাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল।’

‘কিন্তু এই মেয়েটি আসলে কে?’

‘সেটা আশিকের জানার কথা না। সে ভুল করে ফজলে করিমের গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে।’

‘তারপর?’

‘আগের স্ক্রিপ্টে যে রহস্যের জাল খুলে দিয়েছে পুলিশ, এই স্ক্রিপ্টে জাল খুলতে শুরু করবে মেয়েটি।’

‘কীভাবে?’

‘মিলি সন্দেহ করে। এই মেয়ে এখানে কেন? আশিক অন্য আরেকটি সেম মডেলের গাড়ি নিয়ে বাংলোয় এসেছে, এই ব্যাপারটা ততক্ষণে আবিষ্কার করে মিলি। তারপর সব আগের মতো। গাড়ির কাগজপত্র, লাইসেন্সের ছবি… আশিকের চিৎকার করে বলা, এই লোকটিকে আমি চিনি। আজ সন্ধ্যায় তার সাথে বিরিয়ানি খেয়েছিলাম।’

ডিরেক্টরের মাথা কাজ করছে না। বেশ কিছু সময় চিন্তা করার জন্য নিলেন। তারপর মাথা দুলিয়ে বললেন ‘কিন্তু আমার কাছে আগের স্ক্রিপটাই ভালো লেগেছে। পুলিশ এসে দেখবে, গাড়িতে লাশ পাওয়া গেছে।’

রনক মাথা নাড়ে, ‘আচ্ছা।’

‘কিন্তু আগের স্ক্রিপ্টে একটা জায়গায় সংশোধনের দরকার আছে।‘

রনক ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

‘আশিক আর মিলি এরা দুজন স্বামী-স্ত্রী। এই ব্যাপারটা পুলিশ জানতে পারে সকালে একটা কথা চালাচালির সময়।’

‘জি।’

‘কিন্তু এই তথ্য জানতে তারা এত সময় নেবে কেন? রাতে যখন গাড়িতে লাশ পাওয়া যায়, তখনই জিজ্ঞাসা করার কথা।’

‘এটা কারেকশন করে নেব।’ রনক সম্মতি দেয়।

ডিরেক্টর বেশ কিছু সময় চিন্তা করার জন্য নিলেন। তারপর বললেন, ‘কিন্তু এই গল্পে মিলির চরিত্র খুব বেশি সাদামাটা হয়ে গেছে।’

‘এতে সমস্যা কোথায়?’

‘সিনিয়র নায়িকারা থাকতে চায় না।’

সপ্তাহ খানেক পর রনক ডিরেক্টরের কাছে যায়।

নানান কথাবার্তার এক পর্যায়ে বলল, ‘এই গল্পের দ্বিতীয় একটা পর্ব

নিয়ে ভাবছি।’

‘কী রকম?’

‘দ্বিতীয় পর্বে মূল চরিত্র থাকবে ফজলে করিম।’

‘ফজলে করিম?’

‘এখানে আমরা ফজলে করিমের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে গল্প বলার চেষ্টা করব। কেন তিনি খুন করেছেন, এই অংশ পরে বলা হবে। শুরু করব এভাবে, কেন তিনি একটি ডেডবডি গাড়িতে রেখে এরকম শান্তভাবে বিরিয়ানি অর্ডার করলেন?

তার বিরিয়ানি অন্য একজন খেতে শুরু করলেও তাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে এ রকম নির্লিপ্ত থাকার কারণ কী! এটুকুই শেষ না, যাবার সময় তার গাড়ির চাবি নিয়ে চলে গেল। যেখানে সযত্নে রাখা ডেডবডি।

রেস্তোরাঁ থেকে নামার পর ভাবছেন, কোথায় খুঁজবেন আশিককে? তিনি নিজেই তো পলাতক!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *