স্কুটার আরোহী

স্কুটার আরোহী

এ বছর বর্ষা একটু দেরিতে নেমেছে, কিন্তু এখন তা সুদে-আসলে পুষিয়ে দিচ্ছে। অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি। গত কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণে চারদিক থেকে বন্যার উদবেগজনক খবর আসছে। আসাম, উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ আকার নিয়েছে বন্যা। দক্ষিণবঙ্গও পিছিয়ে নেই। উত্তাল ভাগীরথী গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। এদিকে মেদিনীপুর জেলার অবস্থাও ভালো নয়, থই থই করছে জল।

এই বৃষ্টি মাথায় করেই শঙ্করকে মেদিনীপুরের দিকে যেতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন্যাত্রাণ বিভাগে ও কাজ করে। সেই সুবাদেই নিজের চোখে বন্যা ও মানুষের দুর্দশার অবস্থা দেখে আসার জন্য নির্দেশ হয়েছে ওর ওপর।

ঘাটাল মহকুমায় বন্যার প্রকোপটা বেশি, প্রচুর মানুষ জলবন্দি হয়ে আছে, নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছে। খাবার নেই, পানীয় জল নেই। ভয়াবহ অবস্থা। তাদের অবিলম্বে ত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে, তাই শঙ্করের বসে থাকার উপায় নেই।

ঘাটালে রাতটা কাটিয়ে পরদিন আরও ভেতরে যাবার জন্য ও বাসস্ট্যান্ডে এল। ভোররাত থেকেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, বেরুবার উপায় ছিল না। তাই বিকেলের দিকে বৃষ্টি একটু ধরে আসার পরই ও বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘাটাল থেকে চার পাঁচ কিলোমিটার গিয়ে একটা দ্বিমুখী রাস্তার মোড়ে ওকে নামতে হবে। সেখান থেকে হেঁটে যেতে হবে ওর গন্তব্যস্থলে, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অবিশ্যি ওখানে খবর দেওয়া আছে, রাত্রিবাসের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

বাসস্ট্যান্ডে এসে শঙ্করকে হতাশ হতে হল। স্ট্যান্ডের গায়ে কয়েকটা চায়ের দোকান। তাদের মুখেই শুনল সকাল থেকে বাস আসছে না, বৃষ্টির জলে ওদিকের রাস্তা ভেসে গেছে। এখন উপায়! ওকে তো যেতেই হবে।

ঠিক তখুনি একটা স্কুটার ওখানে এসে দাঁড়াল। স্কুটার আরোহীর গায়ে বর্ষাতি, মাথায় বর্ষাতি টুপি, মুখ ঢাকা পড়েছে সেই টুপির আড়ালে।

শঙ্কর যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। আরোহীকে লক্ষ করে বলল, ‘আপনি কতদূর যাবেন?’

আরোহী কোনো কথা বলল না, শুধু আঙুল দিয়ে সামনের রাস্তাটা দেখাল। শঙ্করও সেই পথের যাত্রী। বেশ কিছুটা যাবার পর একটা দু-মুখো রাস্তার মোড়। ওকে সোজা রাস্তা ছেড়ে বাঁ-দিকেরটা ধরতে হবে। ওই মোড় পর্যন্ত পৌঁছোতে পারলেই যথেষ্ট, বাকি পথটা ও হেঁটেই যেতে পারবে।

শঙ্কর আরোহীকে অনুরোধ করল তিনি যদি ওকে ওই মোড় পর্যন্ত পৌঁছে দেন।

এবারও লোকটি কোনো কথা বলল না, শুধু ঘাড় কাত করে জানিয়ে দিল তার আপত্তি নেই।

শঙ্কর একটু অবাকই হল। লোকটি বোবা নাকি! তবে ও আর দ্বিরুক্তি না করে পেছনে চেপে বসল, আর কোনো উপায়ও ছিল না ওর। একটা অস্বস্তি কিন্তু ওর মনকে পীড়া দিচ্ছিল।

স্কুটার বেশ জোরে চলেছে। রাস্তার এখানে ওখানে জল জমে আছে, অনেক জায়গায় রাস্তা জলের তলায়, তার ওপর দিয়েই স্কুটার আরোহী তার দু-চাকার গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছে। শঙ্করের ভয় হচ্ছিল, এমন পিছল রাস্তায় স্কুটার যেকোনো মুহূর্তে পিছলে বড়োরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ও দু-হাত দিয়ে আরোহীকে জড়িয়ে ধরল। ওর মনে হল আরোহীর শরীরটা যেন লোহার মতো শক্ত।

মেঘভরা আকাশ, তাই দিনের আলো তাড়াতাড়ি নিভে এসেছে। ওরা যখন দু-মুখো রাস্তার মোড়ে পৌঁছাল তখন প্রায় অন্ধকার। স্কুটার থেকে ও নেমে পড়ল। এবার ওকে বাঁ-হাতি রাস্তা ধরতে হবে। সেটা আবার কাঁচা রাস্তা, একটু নীচু, আর জলে ডুবে আছে। এই পথ পেরিয়ে আর কিছুটা গেলেই ও পৌঁছে যাবে ওর ডেরায়। বড়ো টর্চটাই এখন ওর একমাত্র ভরসা।

প্যান্ট গুটিয়ে আর হাতে জুতো জোড়া নিয়ে ও হাঁটা শুরু করল। তার আগে স্কুটার আরোহীকে ধন্যবাদ দিতে ও ভোলেনি। তার সাহায্য না পেলে আজ আর ওর এদিকে আসা হত না।

স্কুটার আরোহী কিন্তু তখনও গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, যেন কিছুর একটা অপেক্ষা করছিল। শঙ্কর বাঁ-দিকের পথে কিছুটা এগুতেই ঘটল বিপর্যয়। একটা গাড্ডায় ও পড়ে গেল। জলের জন্য বোঝা যায় না, চোরা সব গর্ত।

আর ঠিক তখুনি ঘটল এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড। ও যেখানে পড়ে গিয়েছিল সেখান থেকে স্কুটার আরোহীর দূরত্ব হাত পনেরোর কম নয়। ও স্পষ্ট দেখল সেই আরোহী বাঁ-হাতটা বাড়িয়ে দিল। সেটা লম্বা হতে হতে ওর কাছে পৌঁছে ওকে তুলে ধরল তারপর অনায়াসে টেনে আনল পাকা সড়কের ওপর। তারপরই ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল স্কুটার আরোহী।

শঙ্কর ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হয়তো সারারাত ওকে ওখানেই পড়ে থাকতে হত কিন্তু ওর ভাগ্য ভালো, কয়েকজন গ্রামের লোক ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তারাই ওকে ধরাধরি করে কাছে একটা বাড়িতে নিয়ে গেল।

জ্ঞান হবার পর উদ্ধারকারীদের মুখে ও শুনল ওর পাশেই পড়ে ছিল একটা স্কুটার, আশেপাশে আর কেউ ছিল না।

তবে ওটাকে স্কুটার না বলে স্কুটারের কঙ্কাল বলাই ভালো। শুধু লোহার কাঠামোটাই আছে, আর কিছু নয়।

গ্রামবাসীদের কাছ থেকে আরও একটা খবর জানতে পারল শঙ্কর। গত বছর এমন এক বর্ষার দিনে একটা স্কুটার পিছলে বড়ো একটা গাছে জোরে ধাক্কা মেরেছিল। স্কুটার আরোহী প্রাণে বাঁচেনি, সঙ্গেসঙ্গেই মারা গিয়েছিল। স্কুটারটা তার পর থেকেই পড়ে ছিল ওখানকার থানায়। দুর্ঘটনায় ওটা তো দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল, তার ওপর এই এক বছরে ওটার গায়ে আর কিছু ছিল না, শুধু লোহার কঙ্কালটা পড়ে ছিল। কিন্তু ওটা ওখানে এল কী করে সেটাই কেউ বুঝতে পারছিল না।

শঙ্করের মনে পড়ল ও যখন স্কুটার আরোহীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিল, ওর মনে হয়েছিল যেন একটা লোহাকে জড়িয়ে আছে। তবে কি…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *