সৌভাগ্যসন্ধানী সায়েবদের কলকাতায় আসা

সৌভাগ্যসন্ধানী সায়েবদের কলকাতায় আসা

পলাশি যুদ্ধের আগে পর্যন্ত কলকাতায় ইংরেজদের ভবিষ্যৎ ছিল ভগবানের হাতে। আশা-আশঙ্কার মাঝে দুলছিল তাদের ভাগ্য। পলাশির পর যাবতীয় শঙ্কা কেটে যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বহিরঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে থেকে গেলেও, ভেতরে ভেতরে তার চরিত্র পালটে যেতে থাকে একটু একটু করে। কোম্পানির হয়ে যারা এদেশে বাণিজ্য করতে এসেছিল, তারা হঠাৎই বসে পড়ে শাসকের আসনে। কিন্তু বণিকের মানদণ্ড রাতারাতি রাজদণ্ড হয়ে উঠলেও রাজা হওয়ার যোগ্যতা যেমন তাদের ছিল না, ইচ্ছেও তেমন ছিল না। তাদের লক্ষ্য ছিল, কত কম সময়ে কত বেশি ধনী হয়ে ফিরে যাওয়া যায় স্বদেশে। কলকাতা থেকে কোম্পানির এক একজন কর্মকর্তা ‘নবাব’ হয়ে স্বদেশে ফিরে গেলে তাদের দেখে বিলেতের মানুষের মনে এই ধারণা গড়ে ওঠে যে, একবার বাংলা মুলুকে পা রাখতে পারলে মুড়িয়ে নেওয়া যাবে প্যাগোডার গাছটা। ড্রেক, ক্লাইভ, ওয়াটস, ভ্যান্সিটার্ট, হলওয়েল, কিলপ্যাট্রিক প্রমুখ সায়েব যখনই বিলেতে ফিরেছেন, তাদের ঠাটঠমক দেখে বিলেতের মানুষ যেমন অবাক হয়েছে, তেমনি একবার ভারতে যাওয়ার মদির ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়েছে মনটা।

আঠারো শতক থেকেই ইউরোপের সৌভাগ্যসন্ধানী মানুষের এদেশে আসার বিরাম ছিল না। অনেক সায়েব মোগল এবং অন্য দেশীয় রাজ্যের অধীনে সামরিক বিভাগে নিযুক্ত ছিল। শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের আমলে মোগল বাহিনীতে ছিল একশোর ওপর ইউরোপীয় গোলন্দাজ। বাংলার নবাব মিরকাশিমের বাহিনীর একটা অংশের দায়িত্ব ছিল Walter Reinhardt-এর ওপর, সমরু নামে যিনি পরিচিত ছিলেন। আরও অনেক ফরাসি এবং আইরিশ সে সময় তাদের ভাগ্য গড়ে তোলে, যারা একসময় জীবন শুরু করেছিল নাবিক হিসেবে। এই শতকে মোগল শাসনের আসন্ন পতনের সম্ভাবনায় যে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়, তার সুযোগ নিয়েছিল ইউরোপীয়রা। তারা দেশীয় শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্লিপ্ত দর্শক হয়ে থাকেনি। যেকোনও এক প্রতিস্পর্ধীর পক্ষে যোগ দিয়ে ভাগ্য গড়ে তুলেছিল অনেক যুদ্ধবাজ সায়েব। যুদ্ধ মানেই বেপরোয়া লুঠতরাজের লোভনীয় সুযোগ। বিলেতের অনেকেই সেই আশায় প্রয়োজনে কোম্পানির কর্তাদের ঘুষে বশ করে কোম্পানির একেবারে নিচুতলায় একটা চাকরি পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে উঠত।

শুধু ভারত থেকে ফেরা সায়েব ‘নবাব’দের দেখে বিলেতের মানুষ ভারতে আসার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিল, তা নয়। ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন দারুণ সংকটে। উনিশ শতকের প্রায় গোটা প্রথমার্ধ জুড়ে ইংল্যান্ডের ঘরে-বাইরে এমন কতকগুলো আর্থ-রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটে যায়, যার পরিণামে সেখানকার সাধারণ মানুষ সীমাহীন অর্থসংকটে পড়ে। এই সর্বনাশা পরিস্থিতির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল শিল্পবিপ্লব। শিল্পবিপ্লব ইংল্যান্ডকে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশের আসনে বসিয়েছিল, কিন্তু কেড়ে নিয়েছিল সেখানকার সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার সুখ। তারা ডুবে যায় আর্থিক আঁধারে। অবস্থাটা ছিল প্রদীপের শিখার মতো। স্বাচ্ছন্দ্য দূরে থাক, উপযুক্ত আহার জুটত না তাদের। যতদিন নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধ জারি ছিল, প্রয়োজন হয়েছিল লক্ষ লক্ষ সেনার। ১৮১৫ সালে ওয়াটার লু’র যুদ্ধে নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয় সে যুদ্ধে দাঁড়ি টেনে দেয়। সেনারা দেশে ফিরে এসে বেকার হয়ে পড়ে। তার আগে ১৭৮৩-তে আমেরিকার উপনিবেশ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ডের। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বিজয় প্রলেপ দিতে পারেনি উপনিবেশে পরাজয়ের ক্ষতে। এই জোড়া সামরিক ধাক্কার মাশুল গুনতে হয়েছিল ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষকে।

দেশের এই আর্থিক সংকটের অনিবার্য প্রভাব পড়েছিল বিলেতের সমাজে। অভাবের তাড়নায় অপরাধ বৃদ্ধি একটা স্বাভাবিক পরিণাম। ভিক্ষাবৃত্তিও চরম রূপ নিল। তাতে ভয় পেল এলিট শাসক শ্রেণি। তাদের মনে হল, এই হতদরিদ্র শ্রেণি সামাজিক অপরাধের সূতিকাগৃহ। ভদ্র পরিবারের ছেলেরাও হয়ে উঠেছিল অবাধ্য, অসভ্য। এইসব বদ ছেলেদের হাত থেকে রেহাই পেতে তাদের অভিভাবকরা চাইত তাদের কোনওরকমে ভারতগামী জাহাজে তুলে দিতে। দুঃশাসন ছেলেগুলো হয়তো সমুদ্র পথে ডুবে মরবে কিংবা ভারতে পা দিয়ে হয় তারা ভাগ্য গড়বে, না হয় দুর্ভাগ্যের দণ্ড পাবে। এছাড়া অভিভাবকদের কাছে তাদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার অন্য উপায় ছিল না। ক্লাইভ ছিলেন এর উপযুক্ত দৃষ্টান্ত। বাপের বড়ো ছেলে হওয়ার সুবাদে পৈতৃক সম্পত্তির মালিকানা ছিল নিশ্চিত। পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন বলার মতো না হলেও নিতান্ত মন্দ ছিল না। তবুও ক্লাইভকে ভারতে পাঠানো হয় তাঁর বেপরোয়া স্বভাব-চরিত্রের জন্য। তিনি ছিলেন পরিবার-প্রতিবেশীর মাথাব্যথার কারণ, সমস্ত নিয়ম-শৃঙ্খলার বাইরে এক দুর্দান্ত ছোকরা। এইভাবে ইংল্যান্ডে, বিশেষ করে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেদের পাঠিয়ে দেওয়া হত ভারতে, যারা অনেকে এসে পৌঁছত কলকাতায়।

শুধু নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারই নয়, পলাশির আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ পরিবারও চাইত তাদের ছেলেরা ভারতে গিয়ে একটা বড়ো রকমের ব্যাবসা কিংবা অন্ততপক্ষে গির্জায় পাদরিগিরিটা করুক। বাংলায় ক্রমবর্ধমান পাদরির সংখ্যা থেকে বোঝা যায়, ভারতে এসে কোনও কাজে লেগে যাওয়া ছিল বিলেতের উঁচুশ্রেণির অনেক মানুষের একমাত্র লক্ষ্য। সুতরাং এ ধারণা ভ্রান্ত যে, শুধুমাত্র নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ইংরেজ পরিবারের ছেলেরা ভারতে কোম্পানির চাকরি পাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করত। থোমাস ম্যালথুস (Thomas Malthus) এবং প্যাট্রিক কোলকুহাম (Patrick Colquhaum) তাঁদের রচনায় বিলেতের মানুষকে ভারতে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন, কারণ তাঁরা মনে করতেন, ব্রিটেনের জনসংখ্যাপ্রসূত সামাজিক ও আর্থিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার এটাই একমাত্র উপায়। পলাশির বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই ভারতে আসার জন্য যেসব আর্জি জমা পড়ে, তার বেশিরভাগ ছিল বণিক পরিবারের পক্ষ থেকে। তাদের অনেকের বাংলার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল বাণিজ্যিক সূত্রে। কিন্তু এও দেখা গেছে, অন্য পেশাধারী পরিবারের ছেলেরা, যারা ভবিষ্যৎ গড়তে চায়, তারাও বাংলায় চাকরি পেতে মরিয়া। ভারতে এসে যেসব কাজে বহাল হওয়ার জন্য আর্জিতে উল্লেখ করা হত, সেগুলো হল, রাজমিস্ত্রির কাজ, স্কুলে শিক্ষকতা, ব্যারিস্টারি, ওকালতি, সওদাগর সংস্থার শরিক হওয়া, জাহাজমিস্ত্রির কাজ, ঘোড়াগাড়ি নির্মাণ, শ্রমিকের কাজ ইত্যাদি।

কিন্তু আসতে চাইলেও সব সায়েব ভারতে আসতে পারত না। সামান্য রাইটারের পদ লাভ করাও ছিল ভীষণ কঠিন। প্রথমদিকে এই পদের জন্য যোগ্যতার মাপকাঠি তেমন উঁচু পর্দায় বাঁধা ছিল না। তবে অবশ্যই প্রয়োজন হত একজন ডিরেক্টরের মনোনয়ন লাভ। সেই সঙ্গে গচ্ছিত রাখতে হত ৫০০ পাউন্ডের জমানত এবং পেশ করতে হত কর্তব্যে বিশ্বস্ত থাকার হলফনামা। ১৭৯৩-এর চার্টার আইন পাশ হওয়ার আগে পর্যন্ত মনোনয়নের অধিকার থাকায় ডিরেক্টররা জড়িয়ে পড়ত আর্থিক কেলেঙ্কারিতে। চড়া দামে বিক্রি হত রাইটারের চাকরি। এক সংবাদপত্র ১৭৭২ সালে এমন খবরও প্রকাশ করে যে, দু-তিন হাজার পাউন্ডে রাইটারের চাকরি বিক্রি হয়। ১৭৮৩ সালে তো প্রকাশ্য বিজ্ঞাপনই দেওয়া হয়, হাজার গিনি দিলে বাংলায় রাইটারের চাকরি নিশ্চিত। প্রথমদিকে কলকাতায় কোম্পানির সামরিক ও অসামরিক কাজে নিযুক্ত ইংরেজরা ছা়ড়া আর যেসব সায়েব ছিল, তাদের সংখ্যা ছিল খুব কম। কারণ ভারতে জন্ম হয়নি এমন ব্রিটিশ প্রজার কোম্পানির এলাকায় বসবাস করার অধিকার ছিল না। যাদের রাজনৈতিক আচরণ নিশ্চিতভাবে নিষ্কলুষ মনে করা হত, তারাই অনুমতি পেত বাস করার।৬ক কোম্পানি চাইত না, বিলেতের মানুষ বেশি সংখ্যায় এসে ভিড় করুক এদেশে। এই মনোভাব কোম্পানি কঠোরভাবে আঁকড়ে রেখেছিল অন্তত ১৮১৩ সাল পর্যন্ত, যে বছর ভারতে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। পরিচালক সমিতির এই নীতিতে কলকাতার কর্মকর্তাদের তেমন সায় ছিল না। আঠারো শতকে বিভিন্ন শ্রেণির ইউরোপীয় ব্যাপক সংখ্যায় বাংলায় এসেছিল কোম্পানির ছাড়পত্র বা লাইসেন্স ছাড়াই। তাদের বাধা দেওয়ার তেমন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৭২০-র দশকে শাস্তির হুমকি দেওয়া হয়েছিল ভারতে আসা লাইসেন্সহীন ইউরোপীয়দের এবং যেসব জাহাজে তারা আসত, সেইসব জাহাজের ক্যাপ্টেনদের। তাতে লাভ হয়নি তেমন। একমাত্র উপায় ছিল তাদের দ্বীপান্তরে পাঠানো। কিন্তু কোম্পানির সে ক্ষমতা আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এমনকী, ব্রিটিশ আদালতে মামলাও হয়। অবশ্য রায় যায় গভর্নরের পক্ষে। তথাপি লাইসেন্সহীন সাহেবদের বিরুদ্ধে গভর্নরই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তৎপর ছিলেন না। ওয়ারেন হেস্টিংস অকপটে তাঁর অভিমত জানান, লাইসেন্সহীন ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোম্পানির এই কড়াকড়ি আরোপ করার ইচ্ছে তাঁর নেই, তাতে তাঁর সম্মতিও নেই। কোম্পানির বিনা অনুমতিতে যারা এদেশে শান্তিতে বাস করছে, সরকারের নির্দেশ পালন করছে অক্ষরে অক্ষরে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি নারাজ।

১৭৬২-র পর কলকাতায় প্রশাসনের প্রয়োজনে কর্মচারীর চাহিদা দেখা দেয়। কিন্তু ১৭৬৬-তে কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ডেপুটি চেয়ারম্যান দু’জনেই বেশি সংখ্যক রাইটার পাঠানোয় আপত্তি তোলেন। এ আপত্তি অবশ্য শেষপর্যন্ত প্রয়োজনের চাপে টেকেনি। Calcutta Review লিখেছে, কোম্পানির শাসন ব্রিটিশরাজের হাতে চলে যাওয়ার তিরিশ বছর আগে পর্যন্ত কোনও ইংরেজকে পরিচালক সমিতির বিশেষ অনুমতি ছাড়া ভারতে পাকাপাকিভাবে বাস করতে দেওয়া হত না। কোনও কারণে কোনও ইংরেজকে অবাঞ্ছিত মনে হলে তাকে দেওয়া রাজিনামা ফিরিয়ে নিয়ে অপরাধীর তকমা দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হত দ্বীপান্তরে। এমনকী, ১৮২৯-এ বিলেত থেকে ভারতের উদ্দেশে সস্ত্রীক পাড়ি দেওয়ার আগে আলেকজান্ডার ডাফ-এর মতো সুখ্যাত এবং শ্রদ্ধেয় মিশনারিকেও কোম্পানির অনুমতি নিতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, শ্রীমতী ডাফ যে তাঁর স্ত্রী, তার সপক্ষে প্রমাণপত্র দাখিল করার পর তাঁকে সঙ্গে আনার ছাড়পত্র মেলে।

বিলেতের সায়েবদের ভারতে আসার প্রবল জোয়ারে বাধা দেওয়ার জন্য কোম্পানি লাইসেন্সে বাঁধ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। কোম্পানির চাকরিতে বহাল না হয়েও যারা ভারতে আসতে ইচ্ছুক এবং কোম্পানির এলাকায় প্রবেশে আগ্রহী, তাদের আর্জি পেশ করতে হত পরিচালক সমিতির কাছে। লাইসেন্স মঞ্জুর করার ক্ষেত্রে কোম্পানি ছিল অতি কৃপণ। করলেও তা করা হত যথেষ্ট অনিচ্ছায়। তারা ভারতে আসার প্রত্যেকটি আর্জি খুব খুঁটিয়ে যাচাই করে নিত, যাতে একজনও অপছন্দের মানুষ ভারতে কোম্পানির এলাকায় প্রবেশের সুযোগ না পায়। এভাবেই পরিচালক সমিতি চেষ্টা করত সৌভাগ্যসন্ধানীদের ভারতে আসার মোহকে মিলিয়ে দিতে। এজন্যই থোমাস উইলিয়মসন লিখেছেন, ‘The hope of obtaining an appointment in India, as a Company’s servant, should never be entertained.’৯ক

লর্ড ওয়েলেসলির আমলে (১৭৯৮-১৮০৫) লাইসেন্সহীন সায়েবদের কড়া নজরদারিতে রাখা হত। তাদের কোম্পানির এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখলেই পাকড়াও করে পাঠিয়ে দেওয়া হত দ্বীপান্তরে। সে সময় দ্বীপান্তর হত নিউ সাউথ ওয়েলস্‌-এ। বৈধ লাইসেন্স থাকলেও অনেক সময় রেহাই মিলত না। কোনো লাইসেন্সধারীকে অবাঞ্ছিত মনে করলে কাউন্সিল এক মুহূর্তে নির্দেশ দিয়ে তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ফেরত পাঠাত স্বদেশে। কোনও আদালতে তার বিচার হত না। এ ব্যাপারে প্রায় স্বৈরাচারী ক্ষমতা ভোগ করত কলকাতার কাউন্সিল। ১৭৫৭ সালে কলকাতার শ্বেতাঙ্গদের সম্পত্তি বিক্রির ওপর পাঁচ শতাংশ কর বসানো হলে ক্যাপ্টেন ডুরান্ড মেয়র কোর্টের নির্দেশ ছাড়া তা দিতে অস্বীকার করেন। তাঁর এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয় কাউন্সিল ও পরিচালক সমিতি। ডুরান্ড প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হলেও তাঁকে রেয়াত করা হয়নি। তিনি লাইসেন্সহীন হওয়ায়, সেই অযোগ্যতার দোহাই দিয়ে তাঁকে স্বদেশে ফেরত পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয় কাউন্সিল। জনৈক সিভিলিয়ন, প্লেইসটিড (Plaistead) ছুটি নিয়ে ইংল্যান্ড যাওয়ার পর তাঁকে আর ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি তার বদমেজাজ ও অবাঞ্ছিত আচরণের কারণে।৯খ এসব নিয়ে হৈ হৈ করারও স্বাধীনতা ছিল না সংবাদপত্রের।৯গ কোম্পানির আমলে ইংরেজদেরও সরকারের বিরূপ সমালোচনা করার স্বাধীনতা ছিল না। অন্যথা হলে কোম্পানি দ্বিধা করত না দ্বীপান্তরে পাঠাতে। আঠারো শতকে জেমস অগাস্টাস হিকি এবং উনিশ শতকে জেমস সিল্‌ক বাকিংহামের কপালে জুটেছিল এমনই শাস্তি।৯ঘ

ফলে এদেশে কোম্পানির কর্মচারী নয়, এমন সায়েবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল খুব ধীর গতিতে। ১৮১৫ সালে নথিভুক্ত করা হয়েছিল ১৫০১ জনের নাম। তেরো বছর পরে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ২১১৬।১০ ১৮১৪ থেকে ১৮৩১-এর মধ্যে পরিচালক সমিতি মাত্র ১২৫৩ জনের আর্জি মঞ্জুর করে। তাদের মধ্যে ১৯২ জন মিশনারি, ১০৬ জন নীলকর, ৭৮ জন আইনজীবী এবং ২৫০ জন সওদাগর সংস্থার এজেন্টের অংশীদার। বাকিরা ছাড়পত্র পায় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে। আর কিছু সংখ্যক ছিল কারিগর, বাজনাদার, দর্জি, দক্ষ শ্রমিক এবং গৃহভৃত্য।১১ পিটার মার্শাল মনে করেন, পরিচালক সমিতির নীতি প্রথম দিকে সীমিত সাফল্য পেয়েছিল। আঠারো শতকে বিভিন্ন শ্রেণির ইউরোপীয়র নির্বিচার দেশান্তর ঘটেছিল বাংলায়।১২ তথাপি ১৮১৩ সালে ভারতে এবং কুড়ি বছর পরে চিনে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য অধিকার কেড়ে নেওয়ার পরও পরিচালক সমিতির মনোভাব মচকায়নি, ঋজু ছিল ১৮৫৮-তে কোম্পানির শাসনের অবসান পর্যন্ত।

প্রাসঙ্গিকভাবে একটা প্রশ্ন উঠে আসে। বেশি সংখ্যক ইংরেজ বা অন্য ইউরোপীয় সায়েবের ভারতে আসায় কোম্পানির আপত্তির কী কারণ ছিল? যতদিন পর্যন্ত কোম্পানির বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত ছিল, ভারতে উপনিবেশ গড়ে তোলার ভাবনা কোম্পানির মনে আসেনি। প্রথম দিকে কোম্পানির ধারণা ছিল, আমেরিকার মতো ভারতে উপনিবেশ গড়ে তোলা বা শ্বেতাঙ্গ শাসন কায়েম করা সম্ভব নয়। দুটো কারণে। প্রথম, ইংরেজরা আসার আগেই এদেশে মোগল শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। আমেরিকায় তেমনটা ছিল না। এডমন্ড বার্ক লিখেছিলেন, ভারতীয়রা আমেরিকার আদিবাসীদের মতো অসভ্য নয়। তারা সুপ্রাচীনকাল থেকে সভ্য ও মহান ঐতিহ্যের ধারক।১৩ দ্বিতীয়, আঠারো শতকের প্রথম দিকে কোম্পানির যেসব প্রতিনিধি কলকাতায় এসেছিল, তারা বিব্রত ছিল বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে, উপনিবেশায়নের স্বপ্ন দেখা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখনও তেমন অনুকূল পরিস্থিতি গড়ে ওঠেনি। আঠারো শতকের শেষ দশকে, ১৭৯৩ সালে কোম্পানির মুখপাত্র (বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি) হেনরি ডুনডাস কমন্স সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে সতর্ক করেছিলেন বেপরোয়া উপনিবেশায়নের উদ্যোগে।১৪ আরও পরে, ১৮২৩ সালে যখন ভারতে একমাত্র শিখরা ছাড়া সমস্ত দেশীয় শক্তি কোম্পানির হাতে পর্যুদস্ত, Lt. R. G. Wallace তাঁর ‘Fifteen Years in India’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন, ‘The Government shows a decided dislike to colonization’.১৫ ডেভিড আরনল্ড মনে করেন, আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতে উপনিবেশ গড়ে তোলার প্রশ্নটা দেখা দেয় কোম্পানির অধিকৃত এলাকার সীমানা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে। কোম্পানির মনোভাব কিন্তু একেবারে নেতিবাচক ছিল। তারা মনে করত, ভারতে বেসরকারি সায়েবের প্রবেশে ঢালাও অনুমতি কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং রাজনৈতিক ও সামারিক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক।১৬

পলাশির পর থেকেই পরিচালক সমিতি এদেশে শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন ও সেইসঙ্গে সতর্ক হয়ে ওঠে। তাই তারা ঘোষণা করে, ভারতে কোম্পানির এলাকায় সায়েবরা জমির মালিক হতে পারবে না। নীতিটা লর্ড বেন্টিঙ্কের পছন্দ হয়নি। ১৮২৯ সালে তিনি এই নিষেধাজ্ঞা নাকচ করে দেন। তাঁর এই ধৃষ্টতার জন্য বেন্টিঙ্ক তিরস্কৃত হন পরিচালক সভার দ্বারা। তারা বেজায় ক্ষুব্ধ হয়ে এমনকী গভর্নর জেনারেলের পদ থেকে তাঁকে হটিয়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিল।১৭

একটা দুশ্চিন্তা কোম্পানির কর্মকর্তাদের তাড়া করে বেড়াত। ইউরোপ থেকে যেসব সায়েব ভারতে ভাগ্যের খোঁজে আসত, তাদের নিয়ে আশঙ্কা ছিল যে, তারা বৈরীভাবাপন্ন দেশীয় শক্তির শিবিরে আশ্রয় নিতে পারে। আশঙ্কা মিথ্যে ছিল না। এদেশে আসা সায়েবরা রুজির তাগিদে ভাড়াটে সেনা হিসেবে যোগ দিত দেশীয় শাসকদের বাহিনীতে। এর অনেক দৃষ্টান্ত আছে। পথ দেখিয়েছিল পর্তুগিজরা। ১৫৩০ সালে তারা বাংলায় আসে গৌড় রাজার ভাড়াটে সেনা হিসেবে। ১৭৯৩ সালে হেনরি ডুনডাস কমন্স সভায় বলেন, মারাঠা ও টিপুর কথাটা খেয়াল রাখতে হবে। ইউরোপীয় সেনা নিয়োগ করে তাদের বাহিনীকে শক্তিশালী করতে দেওয়া উচিত কাজ হবে না। সম্ভবত এজন্যই অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির অন্যতম শর্ত হিসেবে নিজেদের বাহিনীতে ইউরোপীয় সেনা নিয়োগের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় দেশীয় রাজাদের কাছ থেকে।১৭ক এইভাবে কোম্পানি শুধু ইংরেজ নয়, ইউরোপের যেকোনও দেশের সায়েবের ভারতে আসার পথে বাধা তৈরি করার চেষ্টা করেছিল তাদের শাসনের গোটা পর্বে।

বাংলায় শাসন ক্ষমতা দখল করার পর কোম্পানির শাসক শ্রেণি সচেতন হয়ে ওঠে জাতীয় সম্মান নিয়ে। ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে শাসক-শাসিতের বিভাজন রেখা। শাসক সম্প্রদায়ের চরিত্রে যাতে নিচু শ্রেণির সায়েবদের উপস্থিতিতে দাগ না লাগে, সেজন্য কোম্পানি তাদের এদেশে আসার পথ বন্ধ করতে উদ্যোগী হয় নানাভাবে। ১৭৯২ সালে পরিচালক সমিতির অন্যতম সদস্য চার্লস গ্রান্ট অভিবাসন নীতির কড়াকড়ি শিথিল না করার জন্য পরিচালক সমিতিকে চাপ দেন। তাঁর ধারণা ছিল, নিচুস্তরের ইউরোপীয়রা নেটিভদের সঙ্গে কোম্পানির শাসক-শাসিতের সম্পর্কের চেহারাটা নষ্ট করে দেবে। নেটিভরা শুধু শাসক জাতির প্রতি সমীহ হারাবে, তা নয়, তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে।১৮ তিনি আরও বলেন, ‘অসংখ্য অভাবী অলস ইংরেজ ওই দেশের (ভারতের) সুখ্যাতির কথা শুনে অভিনব সুখের খোঁজে হাজির হবে সেখানে। আর অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটেনের জনসংখ্যা হ্রাস পাবে ভীষণভাবে। সে দেশটা ভরে যাবে নিচু শ্রেণির উচ্ছৃঙ্খল শ্বেতাঙ্গে। তারাই নেটিভদের ছাড়িয়ে যাবে সংখ্যায়। ফলে তারা হেনস্তা করবে তাদের, কোণঠাসা করবে, উত্তেজিত করে তুলবে। এর পরিণতি ষড়যন্ত্র এবং অভ্যুত্থান। তারা আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে শক্তি সঞ্চয় করে।’১৯

১৮১৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ফ্রি ট্রেডের স্বার্থে লাইসেন্স ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার জন্য যখন আলোচনা হয়, জন শোর (গভর্নর জেনারেল, ১৭৯৩-৯৮) হুঁশিয়ারি দেন, ইউরোপীয়রা ব্যাপক সংখ্যায় ভারতে গিয়ে সায়েবদের চরিত্রের মান নষ্ট করে দেবে। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক কারণ, সে দেশে সরকারের মূল্যায়ন করে সেখানকার মানুষ। তারা সংখ্যায় ইউরোপীয়দের থেকে কম করে দু’হাজার গুণ বেশি।২০ বেশি সংখ্যক নিচু শ্রেণির সায়েব-মেমের অবস্থান সেই ভারসাম্য উলটে দিতে পারে যা কোম্পানি উপনিবেশের নেটিভদের সঙ্গে আচরণে বজায় রাখতে চায়। কারণ, উপনিবেশের ওপর কোম্পানির কর্তৃত্বের শেকড় তখনও গভীরে প্রবেশ করেনি। উল্লেখ করা যেতে পারে, বিলেতের নিচুতলার সায়েবদের অভব্য আচরণ নিয়ে যে আশঙ্কা বারবার প্রকাশ করা হয়েছিল, তা মোটেই মিথ্যে ছিল না। আশঙ্কা করা হত, নিচুতলার অশিক্ষিত সায়েবরা ব্রিটিশ জাতির চরিত্রে কালি লেপে দেবে মদ খেয়ে মাতলামি করে, বেয়াদপি করে। সেজন্য ঘন ঘন শাস্তি ভোগ করবে। মদের নেশায় তাদের দণ্ডনীয় অপরাধ কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে দুশ্চিন্তায় রেখেছিল দীর্ঘদিন ধরে।২১ এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে অন্য অধ্যায়ে।

১৭৯২ সালে চার্লস গ্রান্ট যখন তাঁর বক্তব্য পেশ করেন, তার মাত্র আট বছর আগে আমেরিকায় দেশান্তরিত ইংরেজরাই পিতৃভূমির বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল। সম্ভবত, সেই জাতীয় বিপর্যয়ের প্রভাব পড়েছিল চার্লস গ্রান্টের ভাবনায়। ১৭৯০-এ চার্লস গ্রান্ট থেকে শুরু করে ১৮৩০-এর দশকে এলেনবরোর সময় পর্যন্ত সেই বিপর্যয়ের স্মৃতি এবং ভারতে তেমনই আশঙ্কা তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল কোম্পানিকে। তাই তারা ইউরোপের সায়েবদের ভারতে আসার পথ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।২২ এমনকী, কোম্পানির কর্মচারী নয়, এমন কোনও সায়েব কলকাতা থেকে বিলেতে ফিরে যাওয়ার পর যদি আবার সেই শহরে যেতে চেয়ে আর্জি পেশ করত, সতর্ক হয়ে যেত পরিচালক সমিতি। তার লাইসেন্স নবীকরণ করার আগে তাকে বলা হত, ভারতে থাকাকালীন তার আচরণ কেমন ছিল, সে সম্পর্কে কলকাতার কর্তৃপক্ষের শংসাপত্র দাখিল করতে হবে। সেটা ইতিবাচক হলে তবেই মিলত ভারতে আসার ছাড়পত্র।২৩

কোনও নির্দিষ্ট কাজ ছাড়া ভারতে আসা লাইসেন্সহীন সায়েবদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আইন পাশ হয়। আইন চালু হওয়ার পর দেখা গেল, জাহাজে করে ভারতে আসা লাইসেন্সধারী সায়েবদের তালিকা একেবারে গোঁজামিলে ভর্তি।২৪ বেশির ভাগ যাত্রীর লাইসেন্সের নথিপত্র জাল। ১৮১৭ সালে এমন একটা ঘটনা তার সাক্ষী। ওই বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট ওপরমহলে জানায় যে, ‘এলিজাবেথ’ জাহাজে তিনজন মেমসায়েব নিউ সাউথ ওয়েলসের পোর্ট জ্যাকসন থেকে কলকাতায় এসেছে। তিনজনেই জেলখাটা আসামি। দু’জনের মেয়াদ তখনও অসম্পূর্ণ। তৃতীয়জন যে নথিপত্র দাখিল করেছে তা রীতিমতো সন্দেহজনক। কারণ, পরিচয়পত্রে যে মহিলার চেহারার বর্ণনা দেওয়া রয়েছে, তার চুল কালো। কিন্তু এই তৃতীয় মহিলার চুল বাদামি। প্রথম দুই মহিলার নাম এলিজাবেথ ফিনলে এবং আমেলিয়া বার্কার। তৃতীয় জন, অ্যান হেলিং। ‘এলিজাবেথ’ জাহাজের ক্যাপটেনের বক্তব্য, ১৮১৬-র ১৩ নভেম্বর তিনি যখন পোর্ট জ্যাকসন থেকে জাহাজ ছাড়েন, তখন ওই তিন মেমসায়েবকে জাহাজে তোলেননি। তিনদিন পরে গভীর সমুদ্রে তাদের হদিশ পাওয়া যায়। ওই তিনজন ৮৯তম রেজিমেন্টের সার্জেন্ট গুইরি-র (Guire) সাহায্যে জাহাজে চড়েছিল।২৫

আসলে কলকাতায় সেসময় শুধুমাত্র বিলেতের নিচুতলার মানুষজনই আসত না কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে। অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকেও অনেক সায়েব-মেম কলকাতায় আসত কিছু করে খেতে। তারা বেশিরভাগ ছিল দাগি আসামি অথবা জাহাজ থেকে পলাতক নাবিক। এলিজাবেথ ফিনলে তার জবানবন্দিতে বলেছিল, একজন আসামি হিসেবে তাকে সাত বছরের জন্য দ্বীপান্তর দেওয়া হয় বোটানি বে-তে। সে দাবি করে, তার মেয়াদ শেষ হয়েছে এবং সেই প্রমাণপত্রও আছে তার কাছে। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর জাহাজে পাড়ি দেওয়ার মতো টাকা-পয়সা তার ছিল না। সেজন্য পুরুষের পোশাকে ছদ্মবেশে ‘এলিজাবেথ’ জাহাজে চড়ে বসে। একমাস জাহাজে থাকলেও তাকে কেউ চিনতে পারেনি। এই অবস্থায় তার কাছে বাংলায় আসার ছাড়পত্র থাকা সম্ভব নয়। আমেলিয়া বার্কারের বক্তব্যও একই। তৃতীয় জন, অ্যান হেলিং একটা ঘড়ি চুরির দায়ে সাত বছরের জন্য দ্বীপান্তরিত হয়। কোম্পানি কিন্তু তাদের সাফাই মেনে নিতে পারেনি। নির্দেশ দেয়, তিনজনকেই নিউ সাউথ ওয়েলস্‌-এ ফেরত পাঠানো হোক।২৬

১৮৩৩-এর আগে যেসব সায়েব কলকাতা বা ভারতের অন্যত্র আস্তানা গড়ে তুলেছিল ছাড়পত্র ছাড়াই, তাদের দ্বীপান্তরে পাঠানো হত। এই শাস্তি জুটত বিশেষ করে জাহাজ থেকে পালানো নাবিকদের কপালে। এইসব নাবিকরা ভারতের কোনও এক বন্দরে জাহাজ থেকে পালিয়ে শহরে এসে ভৃত্য, কেরানি কিংবা দোকানের কর্মচারী হয়ে পেট চালাত। কেউ কেউ বেছে নিত ভবঘুরের জীবন, কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ত। ১৭৯০-এর জুলাই মাসে কোম্পানি অন্তত দু’ডজন নাবিককে নির্বাসন দিয়েছিল যারা জাহাজ ছেড়ে পালায়।২৭

যেসব সেনা স্বেচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ভারতে থাকার জন্য অনুমতি চাইত, তাদের আর্জিও খারিজ করে দেওয়া হত। অথচ তখন কলকাতায় সায়েব সমাজে গৃহভৃত্য, কোচম্যান প্রভৃতি কাজে গোরাদের চাহিদা ছিল ব্যাপক। কোনও প্রতিষ্ঠানের মালিক বছরে কুড়ি পাউন্ডের বেতনে এরকম একজন প্রাক্তন সৈনিককে নিয়োগ করতে চাইলেও অনুমতি দেওয়া হত না। ১৮২৩ সালে পরিচালক সমিতি কলকাতার কর্মকর্তাদের জানায়, কোম্পানির চাকরিতে যারা বহাল নেই, তাদের ভারতে থাকার আর্জি যেন মঞ্জুর করা না হয়। অথর্ব সৈনিককেও অবশ্যই ফেরত পাঠাতে হবে বিলেতে।২৮

কলকাতার কাউন্সিল লাইসেন্সবিহীন নিচুতলার সায়েবদের শহরে বাস করা নিয়ে একটু নরম মনোভাব দেখালেও পরিচালক সমিতির চিন্তা-ভাবনাকে সমর্থন করেছিল শহরের ছোটখাটো শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীরা। তারা বিলেতের কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে এক আর্জিতে জানায়, কলকাতায় ব্রিটিশ প্রজাদের অবাধে আশ্রয় গ্রহণ এবং আস্তানা তৈরি করে বাস করা শহরের শান্তিশৃঙ্খলার পক্ষে বিপজ্জনক। নেটিভদের সম্পত্তি এবং প্রথা সুরক্ষিত থাকবে না। প্রাচ্যের ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়বে। তবে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক পরিচালকদের আশ্বস্ত করে বলেন, ক্ষুদ্র ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক আভিজাত্য’ এদেশে ‘বর্বর অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ’ পাবে না।২৯ ভারতীয়রাও চাইত না বেশি সংখ্যক বাউন্ডুলে সায়েব কলকাতায় আসুক। রামমোহন রায় বিধিনিষেধের পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষিত উঁচুতলার সায়েবরা এদেশের মানুষকে নিচু শ্রেণির সায়েবদের মতো অযথা অপমান করে না।৩০ সুতরাং কোম্পানির নীতি, কলকাতায় বসবাসকারী পুরনো সায়েব এবং ভারতীয়দের ঘোরতর আপত্তির ফলে কলকাতায় সায়েবদের সংখ্যা আঠারো শতকের শেষদিকে হাজারের বেশি হয়নি। পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে এই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছিল মাত্র ৭৫৩৪ জন।৩১

উনিশ শতকেও কোম্পানির মনোভাব আগের মতোই অটল ছিল। ১৮০৭-এর ৪ ফেব্রুয়ারি পরিচালক সমিতি কলকাতার কাউন্সিলকে সতর্ক করে লেখে, তাদের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কোম্পানির লাইসেন্স ছাড়াই অনেক ব্রিটিশ প্রজা প্রেসিডেন্সিতে বাস করছে। কোম্পানির নজর এড়িয়ে তারা কোম্পানির এবং বিদেশি জাহাজে পাড়ি দিয়েছিল ভারতে।৩২ সেইসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয়, ইতিপূর্বে ১৭৮৭-র ৩১ জুলাই তারা নির্দেশ দিয়েছিল, কলকাতায় পৌঁছনো মাত্র প্রত্যেকটি জাহাজের ক্যাপ্টেন কর্তৃপক্ষের কাছে যেন জাহাজের যাত্রী ও নাবিকদের তালিকা দাখিল করে, যাতে লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যেতে পারে। বিদেশি জাহাজেই সাধারণত লুকিয়ে-চুরিয়ে সায়েবরা লাইসেন্স ছাড়া কলকাতায় আসত। বিলেত থেকে কড়া নির্দেশ আসে, ওই ধরনের ব্যক্তিকে যেন গ্রেপ্তার করে যত দ্রুত সম্ভব বিলেতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।৩৩ এর আগে ১৭৯১-এর ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার পুলিশ সুপার তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছিলেন, কলকাতায় অনেক বেকার ইউরোপীয় সায়েব আছে যাদের কোনও চালচুলো নেই। পরিচালক সমিতি সে কথা জানতে পেরে কলকাতার কাউন্সিলকে নির্দেশ দিয়েছিল, সেরকম ইউরোপীয়, বিশেষ করে কোনও ফরাসি যেন কলকাতায় না থাকে।

কলকাতার কর্মকর্তারা বিলেতের নির্দেশ মোটের ওপর মেনে চলার চেষ্টা করেছিল। ১৮১১-র ১৬ আগস্ট সরকারের সচিব কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেটকে এক চিঠিতে জানান, কিছু ইংরেজ সম্প্রতি কলকাতায় এলেও তারা ইংল্যান্ড ত্যাগ করেছিল অনেক আগে। সেজন্য কিন্তু তাদের বিবেচনা করা হবে না। তারা আইন ভেঙে এসেছে। তাদের এদেশ ছাড়তেই হবে।৩৪ মজার কথা হল, পরিচালক সমিতি লাইসেন্সবিহীন সায়েবদের ফেরত পাঠানোর হুকুম দিয়েই খালাস হয়ে যেত। তাদের ফেরত নেওয়ার কোনও উপায় বাতলে দিত না। ১৮০৯ সালে থোমাস জোন্স (Thomas Jones) নামে জনৈক বুটজুতোর কারিগর ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যান পেনাঙে। সেখানে তেমন সুবিধে করতে না পেরে পরের বছর চলে আসেন কলকাতায়। কসাইতলা স্ট্রিটে এক জুতোর দোকানে কাজ পান। তাঁর কাছে পরিচালক সমিতির লাইসেন্স ছিল না। আয়ারল্যান্ড থেকে কলকাতায় এসেছিলেন রিচার্ড থমসন, একজন ক্যাবিনেট নির্মাতা। এসেছিলেন মেহগনি কাঠ কিনতে। তাঁর কাছে লাইসেন্স ছিল না। পরিচালক সমিতি জানায়, এরকম যারা লাইসেন্স ছাড়া কলকাতায় বাস করছে তাদের এই মুহূর্তে ফেরত পাঠাবার নির্দেশ দিচ্ছে না। কিন্তু ‘আমরা নিশ্চিতভাবে চাই যে, এই চিঠি পাওয়ার পরই যেন সেইসব লোকের পেশাগত চরিত্র, ভারতে পৌঁছনোর দিন এবং অন্যান্য তথ্যাদি উল্লেখ করে একটা তালিকা প্রস্তুত করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিলেতে।’৩৫

কলকাতার কাউন্সিল কলকাতাবাসী সায়েবদের প্রতি একটা অন্তর্লীন সহানুভূতি লালন করত কয়েকটা কারণে। কলকাতার সায়েবদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন ধরনের পেশার মানুষের প্রয়োজন ছিল। সব কাজ এদেশের মানুষ দিয়ে হত না। হেয়ারড্রেসার, ছুতোর মিস্ত্রি, ঘড়ি নির্মাতা, গাইয়ে, অভিনেতা প্রভৃতির কলকাতায় আসার পক্ষে একটা নিরেট যুক্তি ছিল। কলকাতার উঁচুতলার সায়েবদের ভদ্র জীবনযাপনের জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য। কিন্তু পরিচালক সমিতি তার কর্মচারীদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখার তাগিদে এই প্রয়োজনকে আমল দিত না।৩৬ ১৭৯০ সালে এক থিয়েটার কোম্পানির বিশেষ প্রতিভাবান অভিনেতা, লো লিউস (Loe Lewis) ভারতে আসার জন্য আর্জি পেশ করেন পরিচালক সমিতির কাছে। কিন্তু তারা এক হাস্যকর যুক্তিতে তাঁর আর্জি খারিজ করে দেয়। থিয়েটার কোম্পানিতে অনেক সুন্দরী মেমসায়েব আছে। কোম্পানির জুনিয়র কর্মচারীদের মধ্যে তাদের নিয়ে রেষারেষি হতে পারে। তখন শহরে মেমসায়েবের বড় অভাব। সুতরাং তাদের নিয়ে কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি ঘটা অস্বাভাবিক নয়।৩৭

কিছু সায়েব যারা কলকাতায় আর্থিক দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারা স্বদেশে ফিরে যেতে চাইত না। তাদের দুশ্চিন্তা ছিল, দেশে ফিরে তারা কী করবে। সেখানে জীবিকা অর্জনের অনিশ্চয়তা ছিল তাদের ফিরে যাওয়ার পথে বড় বাধা। অনাথ ছেলেমেয়েদের জীবন এই শহরে সুরক্ষিত। ১৭৯০-এ Free School স্থাপিত হয়েছিল তাদের লেখাপড়া শেখার জন্য। বিধবারা পেনশন পেত। এসব ছেড়ে স্বদেশে ফিরে গেলে তাদের কাছে তা বিদেশ মনে হবে। কলকাতার কর্তৃপক্ষ এ ধরনের অজুহাত দেখাতে পারে, একথা ভেবেই সম্ভবত পরিচালকরা কলকাতার কাউন্সিলকে ১৭৯৩-এর ১১ ডিসেম্বর এক চিঠিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, লাইসেন্সহীন ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ভারতে গুছিয়ে বসার আগেই যেন তাদের বিলেতে ফেরত পাঠানো হয়। তাদের ব্যাবসা জমিয়ে তোলার সুযোগ দেওয়া চলবে না।৩৮ পরিচালক সমিতি কলকাতার কাউন্সিলকে এরকম ঘন ঘন নির্দেশ দিতে থাকলে ১৮১৪ সালে তারা বিলেতকে জানায়, তাদের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করতে গেলে সমস্যা দেখা দেবে। বেশ কিছু সায়েব কলকাতায় কিছু করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাদের জোর করে স্বদেশে ফেরত পাঠালে তারা এবং তাদের পরিবার আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।৩৯

কাউন্সিলের এই যুক্তি ও ভাবপ্রবণতাকে বিলেতের কর্মকর্তারা বিবেচনা করেননি। ১৮৩৩ পর্যন্ত বিধি-নিষেধ অনড় দিল। বস্তুত, অনেক ইংরেজ প্রতিকূল অবস্থার শিকার হয়ে, একান্তভাবে প্রয়োজনের তাগিদে লাইসেন্স পাওয়ার অপেক্ষায় না থেকে কলকাতায় আসত অনেক সমস্যার ঝুঁকি নিয়ে। বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে কলকাতার জনৈক W. Limond সায়েবের ১৮১৪-র ৯ মে তারিখে লেখা একটা চিঠি পড়লে। তিনি সরকারের মুখ্য সচিবকে লিখেছিলেন, ‘একটা অদ্ভুত এবং হতাশাজনক পরিস্থিতিতে আমি ব্রিটেন ত্যাগ করেছিলাম। পরিচালক সমিতির সম্মতির জন্য অপেক্ষা করতে পারিনি। তা ছাড়া, এরকম অনুমোদন যে অপরিহার্য, তা আমার জানা ছিল না। এই ত্রুটি দূর করার জন্য আমি দেশে আমার বন্ধুদের জানিয়েছি, তারা যেন প্রয়োজনীয় নথিপত্র জোগাড় করার চেষ্টা করে। আমার আশা, তারা সফল হবে।’৪০

বিলেতের কর্তৃপক্ষের মাথাব্যথা ছিল অজ্ঞাতকুলশীলদের নিয়ে যারা বিনা লাইসেন্সে কলকাতায় পাড়ি দিত। যারা বিলেতের সুপরিচিত সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক তাদের নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না। কর্তৃপক্ষ তাদের লাইসেন্স দিয়ে দিত দরাজ হাতে। কিন্তু সতর্ক হতে হত অন্যান্যদের ক্ষেত্রে, যাদের বিলেতে ওপরতলার সঙ্গে যোগাযোগ থাকত না। তাদের বাধ্য করা হত ভারতে বাস করছে এমন একজন উঁচুদরের ব্যক্তিকে জামিনদার হিসেবে পেশ করতে। সেইসঙ্গে আর্জিতে উল্লেখ করতে হত বাংলায় কোথায় থাকবে, কী পেশা গ্রহণ করবে— স্বাধীন ব্যবসায়ী, না স্বাধীন নাবিক ইত্যাদি তথ্য।৪১ এত কড়াকড়ি করা সত্ত্বেও কলকাতা শহরে অবাঞ্ছিত নিচুশ্রেণির গরিব সায়েবদের উপস্থিতি নজরে পড়ত যথেষ্ট সংখ্যায়। ১৮৩৩-এ লাইসেন্স ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত লয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকল বেসরকারি সায়েবদের কলকাতায় আসা। পরবর্তী কুড়ি বছরের মধ্যে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল অন্তত পাঁচ গুণ।৪২ কারণ, উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে প্রচুর বিলিতি শ্রমিক আমদানি করতে হয়েছিল রেল ও টেলিগ্রাফের কাজের জন্য। ১৮৫৮ সালে দেখা যায়, সারা ভারতে বেসরকারি কাজে নিযুক্ত সায়েবের সংখ্যা প্রায় বাইশ হাজার।৪৩ ১৮৪০-র দশক থেকে নিচুতলার সায়েবদের বিপুল স্রোত ভাসিয়ে দেয় ভারতে কোম্পানির অধীনস্থ এলাকাকে। তার প্রভাব পড়ে কলকাতায়। ১৮৬৬ সালে কলকাতায় সায়েবের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১১,২২৪।৪৪

এর পেছনে কারণ ছিল। উনিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের মধ্যে ইংল্যান্ডে দেখা দেয় তীব্র অনটন। ১৮৪৫-এ আয়ারল্যান্ডে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তার চাপ এসে পড়ে ইংল্যান্ডে। ১৮৪৮ সালে Leicester Square-এর জনসভায় এক বক্তা দাবি করেন, লন্ডন শহরে আড়াই লক্ষ কারিগর ও মিস্ত্রির মধ্যে প্রায় আশি হাজার কর্মহীন। অন্তত পঞ্চাশ হাজার মানুষ জানে না, তাদের পরের দিনের খাবার জুটবে কোথা থেকে। বিলেতের এই বিশাল অভাবী জনসংখ্যার একটা অংশ স্বাভাবিকভাবেই ভারতে তথা কলকাতায় আসার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিল।৪৫

অনেক সায়েব কোম্পানির অনুমতি না নিয়ে কলকাতায় আসার পর আর্জি পেশ করত লাইসেন্স পাওয়ার জন্য। কর্তৃপক্ষ কারওর আর্জি বিবেচনা করত, কারওর আর্জি খারিজ করে দিত। যে সমস্ত অপরাধী গোপনে কলকাতাগামী জাহাজে চড়ে এই শহরে আসত, কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিত। আবার কোনও ক্ষেত্রে দেখানো হত শিথিল মনোভাব। ১৮১০ সালে উইলিয়ম কেলি (William Kelley) নামে একজন আইরিশ কয়েদি গোপনে কোম্পানির জাহাজে চড়ে ফ্রান্স থেকে চলে আসে কলকাতায়। কোম্পানি তার আর্জি বিবেচনা করে তাকে লাইসেন্স দিয়েছিল।৪৬ উঁচু মহলের সায়েবের সঙ্গে তার জানাশোনা ছিল কিনা, সে তথ্য অমিল। ১৮১৩ সালের সনদ আইনে ভারতে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটলে বিলেতের সায়েবরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে এদেশে ব্যাবসা-বাণিজ্য করে ভাগ্য ফেরাবার আশায়। কেউ সফল হত, কেউ হতাশ হয়ে আবার স্বদেশে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিত। ফিরে যাওয়ার পেছনে শুধু মন্দ ভাগ্যই দায়ী ছিল না, অনেকের পকেটে কোম্পানির লাইসেন্স থাকত না। T. W. Pilcher কলকাতায় এসেছিলেন ১৮২১ সালে। বিলেতের কাছ থেকে সবুজ সংকেত না পেলেও তাঁর সঙ্গে ছিল পামার, অ্যান্ডারসনের মতো কলকাতায় সুপরিচিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত সায়েবদের নামে পরিচয়পত্র। কলকাতায় এসে চোদ্দটা মাস কেটে গেলেও তিনি তেমন কিছু করে উঠতে পারেননি। তবু কলকাতায় কয়েকটা দিন থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু Pilcher-কে হুকুম দেওয়া হয়, ১৮২১-এর ১৫ অক্টোবরের মধ্যে কলকাতা ছাড়তে হবে। তা না হলে কর্তৃপক্ষ তাকে স্বদেশে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে।৪৭

কোম্পানিকে সমস্যায় ফেলত কলকাতায় আসা বেসরকারি জাহাজের ক্যাপ্টেনরা। তারা অনেক সময় তাদের জাহাজে আনা জেল খাটা আসামিদের মধ্যে দু’-একজনকে কলকাতায় ফেলে রেখে চলে যেত। অনেক সময় তাদের মধ্যে মহিলাও থাকত। বলাবাহুল্য, তাদের কাছে না থাকত লাইসেন্স, না বিদেশের এই শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই। এমনই ঘটনা ঘটিয়েছিল ১৮০১ সালে ‘Minerva’ জাহাজের ক্যাপ্টেন সালকেড (Captain Salkeld) এবং ‘Tames’ জাহাজের ক্যাপ্টেন এইলব্যাক (Eilback)। প্রথম জাহাজে ছিল পোর্ট জ্যাকসন থেকে আনা এমন বাষট্টি জন আসামি। তাদের মধ্যে ছিল দু’জন মহিলা। ক্যাপ্টেন তাদের কলকাতায় ফেলে রেখে যাওয়ার মতলব করছে বুঝতে পেরে তারা পুলিশের সাহায্য চায় স্বদেশে ফেরার জন্য।৪৮ তবে জাহাজের ক্যাপ্টেনরা সবচেয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টি করত বিলেত থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা নাবিকদের এই শহরে ছেড়ে দিয়ে।

নবাগত সায়েব, যারা কলকাতায় ব্যাবসা করতে আসত, কলকাতায় বসবাসকারী পুরনো সায়েবদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা ছিল একটা মস্ত সুবিধের ব্যাপার। তাদের কাছে হয়তো কলকাতায় ব্যাবসা বা চাকরি করার জন্য পরিচালক সমিতির ছাড়পত্র থাকত। তা সত্ত্বেও শহরে থাকাকালীন কোনওরকম মোটা দাগের অসভ্য আচরণ করলে হুকুম হত শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার। এমন হলে তখন সামাল দিত কলকাতায় তাদের পরিচিত উঁচুদরের প্রভাবশালী কোনও সায়েব। তিনি শহরের অসামরিক কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে সংকটে তারণ হয়ে উঠতেন। এটা ঘটনা যে, ব্যক্তিগত ব্যাবসা-বাণিজ্য করে ভাগ্য ফেরাবার লক্ষ্য নিয়ে যারা এ শহরে আসত লাইসেন্স ছাড়াই, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়ে মাথা ঘামাত না যতক্ষণ তারা সুবোধ হয়ে নিজেদের কাজকর্ম করে যেত।৪৯

কলকাতায় কতজন বেসরকারি সায়েব কোম্পানির লাইসেন্সধারী, আর কতজন লাইসেন্সবিহীন হয়ে বাস করছে তার সঠিক হিসেব পাওয়া ছিল কঠিন। কলকাতার চিফ ম্যাজিস্ট্রেট ১৮২২-এর ২০ এপ্রিল এক চিঠিতে সরকারকে জানান যে, তিনি কলকাতায় বসবাসকারী সায়েবদের একটা তালিকা তৈরি করেছেন। তালিকা তৈরি করতে গিয়ে জোগাড় করেছেন যতদূর সম্ভব তাদের নাম-ধাম, পেশা সম্পর্কিত তথ্য। ১৮২১ সালে তিনি একটা রেজিস্টার তৈরি করেছিলেন। তাতে কলকাতায় বসবাসকারী লাইসেন্সধারী এবং লাইসেন্সবিহীন সায়েবদের ঠিকানার উল্লেখ ছিল। তথাপি তিনি নিজেই কবুল করেছেন, নিচুতলার অনেক সায়েবের হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়। তাঁর দেওয়া তালিকায় ৫৯৯ জনের নাম-ধাম ও পেশা সম্পর্কে তথ্য ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ১৬৭ জনের লাইসেন্স ছিল, বাকি ৪৩২ জন শহরে বাস করছিল পরিচালক সমিতির অনুমতি ছাড়াই।৫০

ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃপক্ষকে জানান, শহরে যারা লাইসেন্স নিয়ে বাস করছে, তারা সরকারের কোনও বিশেষ দপ্তরে রিপোর্ট না করা পর্যন্ত লাইসেন্সবিহীনদের শনাক্ত করা সম্ভব নয়। কিন্তু এ ব্যাপারে উপযুক্ত আইনের অভাবে সরকারের পক্ষে সমস্ত বেসরকারি ইংরেজকে ওইভাবে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করার জন্য বাধ্য করা সম্ভব ছিল না।৫১ সরকারের পক্ষে এমন নির্দেশ দেওয়া ছিল অসুবিধেজনক। কারণ কলকাতায় এমন অনেক সম্ভ্রান্ত ইংরেজ বাস করত যাদের আদৌ কোনও লাইসেন্স ছিল না। তেমন নির্দেশ দিলে সেসব সায়েব অসম্মানিত বোধ করতে পারত। তারা অনেকে এজেন্সি হাউসের সঙ্গে যুক্ত, কেউ ব্যাবসা-বাণিজ্যে খুবই সফল, কেউ অন্য কোনও ভদ্র পেশায় যুক্ত থেকে অনেক বছর ধরে শহরে বাস করছে। ঘর-দোর তৈরি করেছে। তারা কলকাতার শ্বেতাঙ্গ সমাজের প্রয়োজনীয় সদস্য। কর্তৃপক্ষ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানায়, যারা এই শহরে লাইসেন্সহীন হয়ে ভাগ্যের খোঁজে এসে বেকার হয়ে আছে, তাদের সঙ্গে এইসব সম্ভ্রান্ত মানুষকে এক করে দেখা উচিত হবে না। সমস্ত লাইসেন্সবিহীনদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে অবিচার করা হবে তাদের প্রতি। কলকাতা কাউন্সিল পরিচালক সমিতিকে জানায়, আইন অনুসারে ১৮১৪-র ১০ এপ্রিলের পরে যারা তাদের অনুমতি না নিয়ে এসেছে, তারা যথেষ্ট কারণ দেখাতে না পারলে গভর্নর জেনারেল নিশ্চিতভাবে তাদের লাইসেন্স দেওয়ার কথা বিবেচনা করবেন না। তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হবে। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আইন ভেঙে সরকারকে বিব্রত করলেও এমন অনেকে আছে যারা যথেষ্ট অভাবের মধ্যে পড়েও সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্ত। একেবারে নির্দোষ।৫২

ম্যাজিস্ট্রেট পরামর্শ দেন, যারা এদেশে একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে এসেছে তাদের বলা হোক তারা যেন শহরে তাদের থাকার বিশদ তথ্য পেশ করে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স সংগ্রহ করে। তিনি আশা করেন, এমন পদক্ষেপ নিলে যারা অনেকদিন ধরে শহরে বাস করছে, তারা নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে এগিয়ে আসবে তথ্য পেশ করে লাইসেন্স সংগ্রহ করতে।৫৩

কিন্তু লাইসেন্সবিহীন সায়েবদের প্রতি কলকাতার কর্মকর্তাদের কোমল মনোভাব বিলেতের পরিচালকদের বেপছন্দ ছিল। তারা কলকাতা কাউন্সিলের হাবভাব আঁচ করতে পেরেই সম্ভবত ১৮১৯-এর ১২ মে একটা চিঠি পাঠায় কড়া নির্দেশ দিয়ে।৫৪ সেই চিঠি থেকে জানা যায়, ১৮১৩-র পর বিলেত থেকে বেসরকারি ইংরেজদের ভারতে আসার এমন জোয়ার দেখা দিয়েছিল যে, সে জোয়ারে ভেসে যায় ভারতে আসার কোম্পানির নিয়ম-কানুন। কোম্পানির লাইসেন্সের তোয়াক্কা না করেই চলে এসেছিল অনেক ইংরেজ। তারা কেউ সরকারের কাজ নিয়ে আসেনি। কলকাতায় এসে তারা লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে। বিলেতের কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিল ১৮১৩-র সনদ আইন সমস্ত ইংরেজদের জন্য যে ঢালাও সুবিধে করে দিয়েছে, তার সুযোগ নিতে সকলে ছুটেছে কলকাতায়। তাদের দুশ্চিন্তা ছিল এই কারণে যে, যেসব অবাঞ্ছিত ইংরেজের পেশ করা আর্জি ইতিপূর্বে বাতিল হয়ে গিয়েছিল তাদের বদ উদ্দেশ্য এবং দাগি চরিত্রের জন্য, তারাও চলে গেছে কলকাতায়। পরিচালক সমিতি স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ওইসব ইংরেজরা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। শুধু জরিমানা নয়, তাদের গ্রেপ্তার করে বিলেতের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা দরকার।

কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এতসব হম্বিতম্বি করে চিঠির শেষে লিখেছে, ‘We are induced to abstain at present from directing the immediate return to country of those persons who are residing within your jurisdiction without our licence…”৫৫ শুধু তাই নয়, কলকাতার কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিয়েছে, তারা কর্তৃত্ব প্রয়োগ যেন মুলতুবি রাখে। কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট শহরে বসবাসকারী লাইসেন্সবিহীন সায়েবদের তথ্য সংগ্রহ করে একটা তালিকা তৈরি করলেই চলবে। পরিচালক সমিতির মনোভাবের এ হেন পরিবর্তন প্রহেলিকা মনে হয়। সম্ভবত, তারা বিলেতের জনমতের চাপে নত হতে বাধ্য হয়েছিল।

সূত্রনির্দেশ

১. Sarmistha De, Marginal Europeans in Colonial India: 1860-1920, Kolkata, (2008) p.6

২. The Calcutta Review, May-August, 1844, p. 295

৩. P. J. Marshall, East Indian Fortunes, London (1976), p. 13

৪. Harald Fischer—Tine, Low and Licentious Europeans—Race, class, and ‘white subalternity’ in colonial India, New Delhi (2009), p. 45

৫. P. J. Marshall, প্রাগুক্ত, p. 12

৬. S. S. O’Malley, প্রাগুক্ত, p. 229

৬ক. Thomas Williamson, The East India Vade-Mecum, vol. I, London (1810), pp. 5-6.

৭. P. J. Marshall, প্রাগুক্ত, p. 21

৮. তদেব, p. 15

৯. Sarmistha De, প্রাগুক্ত, p. 28

৯ক. Thomas Williamson, প্রাগুক্ত, p. 3, 4

৯খ. W. H. Carey, The Good Old Days of Honorable John Company, Calcutta (1980), pp. 33-34

৯গ. R. G. Wallace, Memoirs of India, London, (1824) p. 404

৯ঘ. Abhijit Dutta, European Social Life in 19th Century Calcutta, Calcutta (1994), p. 61

১০. Sarmistha De, প্রাগুক্ত, p. 25

১১. David Arnold, ‘White colonization and Labour in Nineteenth Century India. The Journal of Imperial and Commonwealth History, January 1983, vol. XI, No. 2, p. 135

১২. Harald Fischer—Tine, প্রাগুক্ত, p. 45

১৩. Robert Travers, Ideology and Empire is Eighteenth Century India: The British in Bengal, New York (2007) p.7

১৪. J. Long, Calcutta in the Olden Times, Calcutta (1979) p. 70

১৫. P. T. Nair (ed.), Calcutta in the 19th Century, Calcutta (1989) p. 309

১৬. David Arnold, প্রাগুক্ত, p. 135

১৭. তদেব

১৭ক. তদেব, p. 137

১৮. Harald Fisher—Tine, প্রাগুক্ত, p. 46

১৯. তদেব

২০. তদেব, p. 47

২১. Harald Fisher—Tine, ‘Britain’s Other Civilizing mission: Class Prejudice, European ‘loaferism’ and the work house—System in colonial India. The Indian Economic and social History Review, 2005, vol. 42, p. 300)

২২. David Arnold, প্রাগুক্ত, p. 137

২৩. Letters from Court of Directions, 20 June, 1804, (W. S. Seton Karr, Selections from Calcutta Gazettes, vol. VI, Calcutta (1987) p. 124

২৪. Sarmistha De, প্রাগুক্ত, p. 28

২৫. Judicial (criminal) Proceedings, 21 February, 1817, No. 1. [এরপর থেকে Jud. (cr.)]

২৬. তদেব

২৭. David Arnold, প্রাগুক্ত, p. 136

২৮. তদেব

২৯. Harald Fischer—Tine, প্রাগুক্ত, p. 48

৩০. তদেব

৩১. P. J. Marshall, The White Town of Calcutta under the Rule of East India Company. (Modern Asian Studies, vol. 34, part I, February 2000, p. 309

৩২. Jud. (cr.), 18 December, 1813, No. 6

৩৩. তদেব

৩৪. Jud (cr.), 20 August, 1811, No. 4

৩৫. তদেব, 31 August, 1821, No. 7

৩৬. The Rev. J. Long, (Mahadevprasad Saha ed.) Selections from Unpublished Records, of Government. Calcutta (1937), No. 309

৩৭. Sarmistha De, প্রাগুক্ত, p. 28

৩৮. W. S. Seton Karr, Selections from Calcutta Gazettes, vol. 111, Calcutta (1987, pp. 68-69

৩৯. General Letters to the Court of Directors, (Judicial), 20 May, 1814

৪০. Jud (cr.) 20 May, 1814, No. 23

৪১. W. S. Seton Karr, প্রাগুক্ত, p. 70

৪২. Harald Fischer-Tine, p. 49

৪৩. David Arnold, প্রাগুক্ত, p. 136

৪৪. P. J. Marshall, The White Town of Calcutta…, p. 309

৪৫. Sarmistha De, প্রাগুক্ত, p. 43

৪৬. Jud. (cr.), 21 February, 1817, No. 21

৪৭. তদেব, 17 August, 1821, No. 10

৪৮. Jud. (cr.) 9 September, 1801, No. 1

৪৯. Abhijit Dutta, European Social Life in 19th Century Calcutta, Calcutta (1994), p. 4

৫০. Jud. (cr.), 19 December, 1822, No. 16

৫১. তদেব

৫২. General Letters to the Court of Directors (Judicial), 20 May, 1814

৫৩. Jud. (cr.) 19 December, 1822, No. 16

৫৪. Jud. (cr.), 31 August, 1821. No. 7

৫৫. তদেব

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *