সৌন্দর্য

৫৩-সংখ্যক প্রস্তাবে বড়দাদা সৌন্দর্য সম্বন্ধে যে প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছেন তাহার রীতিমতো উত্তর দেওয়া দুঃসাধ্য। সে সম্বন্ধে দু-একটা কথা যাহা বলিবার আছে বলি।

“নিজে না মাতিলে অন্যকে মাতানো যায় না” এ কথাটা অতি অল্প জায়গায় খাটে। অধিকাংশ স্থলেই যে মাতাইবে তাহাকে মাতিলে চলিবে না। “মাতা” বলিতে বুঝায় প্রবৃত্তির তরঙ্গে বুদ্ধির হাল ছাড়িয়া দেওয়া। নিজের উপরে নিজের প্রভুত্ব চলিয়া যাওয়া। বাগ্মী, যিনি বক্তৃতা করিয়া দেশ মাতাইতে চান, তাঁহার এমনি ঠিক থাকা আবশ্যক যে, “মাতা’ না মাতা তাঁহার সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন হয়। বাষ্পকে অধিকারায়ত্ত করিয়া যেমন কল চলে তেমনি নিজের মনোবৃত্তিকে সম্পূর্ণ দখলে রাখিয়া তবে দশজনের মনোবৃত্তি নিজের অভিপ্রায়মতো উদ্রেক করা যাইতে পারে। তবে এই কথা বলা যায় বটে যাহার হৃদয় নাই সে [অন্যের] হৃদয় বিচলিত করিতে পারে না– কিন্তু প্রবৃত্তির প্রাবল্যবশত নিজের উপর যাহার অধিকার নাই সেই আপনি যতই চঞ্চল হৌক অন্যকে … অতএব “নিজে না মাতিলে অন্যকে মাতানো যায় না” এ কথা [ঠিক] নহে।

সে যাহাই হৌক, নিজের মনের ভাব অন্যের মনে উদ্রেক করিতে হইলে প্রথমেই নিজের মনের ভাব থাকা আবশ্যক এ কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সৌন্দর্য তো মনের ভাব নহে– সুতরাং এক হৃদয়বৃত্তি অন্য হৃদয়ে যে সমবেদনার নিয়মে সঞ্চারিত হয় সে নিয়ম এখানে খাটে না।

আমার তো মনে হয় সৌন্দর্য স্বভাবতই অপ্রমত্ত কারণ পৃথিবীতে সৌন্দর্যই পরিপূর্ণতার আদর্শ। পরিপূর্ণতার সহিত মত্ততা শোভা পায় না। সৌন্দর্যের আপনার মধ্যে আপনার একটি সামঞ্জস্য আছে– সে নিজের মধ্যে নিজেই সম্পূর্ণ– সে আর সকল হইতে আপনাকে সংযত করিয়া রাখে। এইজন্যই আর সকল এমন প্রবলবেগে তাহার প্রতি আকৃষ্ট হয়। সৌন্দর্যের মধ্যে দৈন্য নাই, এইজন্যই, আমাদের ভিক্ষুক হৃদয় তাহার দ্বারে অতিথি হইয়া উপস্থিত হয়। সৌন্দর্যের মধ্যে এই ঐশ্বর্য এই পরিপূর্ণতা আছে বলিয়া সৌন্দর্যেই ক্ষুদ্রতার মধ্যে মহত্ত্ব, সীমার মধ্যে অসীমতা প্রকাশ পায়। পূর্ণতাকে আপন আয়ত্তের মধ্যে পাইয়া হৃদয় আনন্দে অভিভূত হয়। এই-সকল কারণেই পৃথিবী সৌন্দর্য [পূর্ণতা] অনুভব করিবার এক প্রধান উপায়।

যে রমণী আত্মসৌন্দর্য সম্বন্ধে সর্বদাই সচেতন, অর্থাৎ সৌন্দর্যের হাত হইতে নিজের হাতে কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং হাবভাব ও টীকাভাষ্য দ্বারা সৌন্দর্যকে বিক্ষিপ্ত করিয়া তোলে সে সৌন্দর্যের স্থায়ী এবং গভীর প্রভাব নষ্ট করিয়া ফেলে– কারণ তাহার সৌন্দর্যের মধ্যে উদ্দেশ্য সুতরাং দৈন্যের চিহ্ন দেখা যায়। তাহাতে উপস্থিতমতো মনে করিয়া সুখ জন্মে যে এমন সৌন্দর্য আমার দ্বারে আসিয়া হাজির হইয়াছে আমার প্রশংসার অপেক্ষা রাখিতেছে। কিন্তু এই আত্মাভিমানের সুখ স্থায়ী হইতে পারে না, কারণ অবহেলার ভাব যে পরিমাণে বাড়িতে থাকে অহংকারের ভাব সেই পরিমাণে কমিতে থাকে। রাজা যদি একদিন রাজার ভাবে আমার গৃহে পদার্পণ করেন তবে আমার যথাসর্বস্ব অতিথিসৎকারে ব্যয় করিয়া চরিতার্থতা লাভ করি– কিন্তু যদি অভাব জানাইয়া স্থায়ী অতিথিরূপে আমার গৃহে জমি জুড়িয়া বসেন তবে তাঁহার বরাদ্দ ক্রমেই কমিয়া আসিতে থাকে। মানুষ যে “তেলা মাথায় তেল ঢালে” তাহার কারণ এই যে ক্ষমতা এবং সৌন্দর্যের মধ্যে মানুষ ঈশ্বরের ভাব দেখিতে পাইয়া অভিভূত হয় স্বতই তাহার নিকটে আপনাকে বিসর্জন দিতে প্রবৃত্তি হয়– নতুবা আমার জন্য একটা লোক কাঁদে না কেন, আর নেপোলিয়নের জন্য হাজার লোক মরে কেন? এই সীমাবদ্ধ মর্ত্যভূমিতে থাকিয়াও অসীমের প্রতি আমাদের এমনি স্বাভাবিক আকর্ষণ। ক্ষমতার মধ্যে চেষ্টার চিহ্ন অপেক্ষাকৃত অল্প কিন্তু তবু আছে কারণ, তাহা ক্রিয়াসাপেক্ষ– কিন্তু সৌন্দর্য নিষ্ক্রিয়, সুতরাং তাহাতে চেষ্টার নামগন্ধ নাই। এইজন্য সৌন্দর্য অধিক পরিপূর্ণ; এইজন্য তাহা ক্ষমতা অপেক্ষা অধিক ক্ষমতাশালী। এইজন্য বৈষ্ণবেরা কৃষ্ণকে মথুরাপতিভাবে দেখিয়া সুখ পায় না, তাঁহাকে বৃন্দাবনবিহারীভাবে দেখিতে চায়। কারণ স্বাধীন আত্মার উপরে ক্ষমতা অপেক্ষা সৌন্দর্যের প্রভাব অধিক। পাঠকের মন অনেক সময় ঙতক্ষতধভড়ন কষড়ঢ়-এর শয়তানের স্বপক্ষতা অবলম্বন করে; তাহার কারণ শুদ্ধ ক্ষমতার উপরে স্বভাবতই মানবাত্মার বিদ্রোহভাব উপস্থিত হয়, কিন্তু ঈশ্বরকে সৌন্দর্যরূপভাবে দেখিলে তবেই শয়তানের বিদ্রোহকে যথার্থ শয়তানী বলিয়া মনে হয়।

উপরে যাহা যাহা বলিলাম তাহা যদি সত্য হয় তবে ইহা নিশ্চয় সৌন্দর্য মাতে না বলিয়াই মাতাইতে পারে।

পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক, ১৯| ১২| ১৮৮৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *