সৌন্দর্যের উপলব্ধি
যে সমস্ত বস্তুতে আমরা আনন্দ পাই না হয় সেগুলি আমাদের মনে এমন বোঝা হয়ে থাকে যে যে কোনো মূল্যে আমরা তাদের থেকে উদ্ধার পেতে চাই; অথবা তারা প্রয়োজনীয়, আর সেই কারণে সাময়িক ও আংশিক ভাবে আমাদের সঙ্গে যুক্ত, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তারা বোঝা হয়ে ওঠে; অথবা তারা ভবঘুরেদের মতো, আমাদের স্বীকৃতির প্রান্তে মুহূর্তের জন্য ঘোরাফেরা করে, তারপর চলে যায়। কোনো বস্তু কেবল তখনই সম্পূর্ণভাবে আমাদের আপন হয় যখন তা আমাদের কাছে আনন্দের সামগ্রী হয়ে ওঠে।
এই জগতের বৃহত্তর অংশ আমাদের কাছে যেন কিছু মাত্র নয়। কিন্তু আমরা তাকে এইভাবে থাকতে দিতে পারি না, কারণ এইভাবে সে আমাদের নিজেদের সত্তাকে খর্ব করে। সমগ্র বিশ্ব আমাদের দেওয়া আছে, আর আমাদের সমস্ত শক্তির চরম অর্থ এই বিশ্বাসের মধ্যে রয়েছে যে এদের সাহায্যেই আমাদের পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার নিতে হবে।
কিন্তু আমাদের চেতনা বিস্তারের এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আমাদের সৌন্দর্যের অনুভূতির ভূমিকা কী? সে কি সেখানে তীব্র আলো ও ছায়ার মধ্যে সত্যকে বিভক্ত করতে, আর সুন্দর ও অসুন্দরের আপোষহীন পার্থক্যের মধ্যে তাকে আমাদের সামনে আনবার জন্য রয়েছে? যদি তাই হতো, তা হলে আমাদের স্বীকার করা উচিত হতো যে এই সৌন্দর্যচেতনা আমাদের বিশ্বে এক বিরোধ সৃষ্টি করছে, আর প্রত্যেক বস্তুর সঙ্গে অন্য সমস্ত বস্তুর যোগাযোগের রাজপথে এক বাধার দেওয়াল তুলে দিচ্ছে।
কিন্তু তা সত্য হতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের উপলব্ধি অসম্পূর্ণ থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত জানা ও অজানা, প্রীতিকর ও অপ্রীতিকর বস্তুর মধ্যে বিভাজন অবশ্য থাকে। কিন্তু কিছু দার্শনিকের অনুশাসন সত্ত্বেও মানুষ তার জানার জগতে কোনো বিধি বহির্ভূত সীমা ও চরম সীমা স্বীকার করে না। ইতিপূর্বে যে এলাকা তার মানচিত্রে অনাবিষ্কৃত বা আবিষ্কারের অযোগ্য বলে চিহ্নিত ছিল প্রতিদিন তার বিজ্ঞান সেই এলাকায় জোর ক’রে প্রবেশ করছে। একই ভাবে আমাদের সৌন্দর্যবোধও সর্বদা তার সমস্ত সাফল্যকে জোর ক’রে এগিয়ে নেওয়ার কাজে যুক্ত আছে। সত্য সর্বত্র রয়েছে, সেইজন্য সবকিছুই আমাদের জ্ঞানের বিষয়। সুন্দর সর্বব্যাপী, তাই সবই আমাদের আনন্দ দিতে পারে।
মানুষ তার ইতিহাসের শুরুর দিনগুলিতে জীবনের সবকিছুকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপে নিয়েছিল। প্রাণ ও নিষ্প্রাণের মধ্যে এক সুস্পষ্ট পার্থক্য সৃষ্টি ক’রে তার জীবনবিজ্ঞান আরম্ভ হয়েছিল। এই বিজ্ঞান যতই এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ততই চেতন ও অচেতনের বিভেদের সীমারেখা ক্রমশ অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে উঠছে। আমাদের বুঝতে পারার শুরুতে বৈসাদৃশ্যের এই সুস্পষ্ট রেখাগুলি আমাদের সাহায্য করে, কিন্তু আমাদের উপলব্ধি যত পরিষ্কার হয়ে যায় তত তারা ক্রমশ মিলিয়ে যায়।
উপনিষদ বলেছেন সমস্ত কিছুই অসীম আনন্দের থেকে জাত ও জীবিত। সৃষ্টির এই তত্ত্ব উপলব্ধি করতে হলে আমাদের এক বিভাজন দিয়ে শুরু করতে হবে— এই বিভাজন সুন্দর ও অসুন্দরের। তখন প্রারম্ভিক আলস্য থেকে আমাদের সচেতনতাকে প্রবল আঘাতে জাগানোর জন্য সুন্দরের চেতনাকে আমাদের কাছে আসতে হয় আর বৈসাদৃশ্যের প্রয়োজনে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। এই কারণে সুন্দরের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় হয় তার বহু বর্ণের পোশাকে যা শুধু তার ডোরা ও পালক নিয়ে নয়, তার বিকৃত রূপ নিয়েও আমাদের প্রভাবিত করে। কিন্তু আমাদের পরিচয় যত পরিণত হয় তত সমস্ত আপেক্ষিক বৈসাদৃশ্য ছন্দের নিয়ন্ত্রণে মিলিয়ে যায়। প্রথমে আমরা পারিপার্শ্বিক থেকে সুন্দরকে পৃথক করি, অন্য সব কিছুর থেকে তাকে আলাদা ক’রে ধরি, কিন্তু শেষে আমরা সব কিছুর সঙ্গে তার সামঞ্জস্য উপলব্ধি করি। তখন তীক্ষ্ণস্বরে আমাদের উত্তেজিত করার আর কোনো প্রয়োজন সুন্দরের সঙ্গীতের থাকে না; সে তখন উগ্রতা ত্যাগ করে, আর এই সত্য দিয়ে আমাদের চিত্ত আকর্ষণ করে যে নম্রতাই জগতের উত্তরাধিকার।
আমাদের ক্রমোন্নতির কোনো স্তরে, আমাদের ইতিাহসের কোনো পর্যায়ে, আমরা সুন্দরের জন্য এক বিশেষ রীতি তৈরি করার চেষ্টা করি, আর তাকে এক সংকীর্ণ বৃত্তের মধ্যে এনে অল্প অল্প ক’রে ছোট ক’রে ফেলি যাতে সে কয়েকজন বাছাই করা ব্যক্তির গর্বের বিষয় হয়ে ওঠে। তখন সে ব্রতী ব্যক্তিদের মধ্যে কৃত্রিম আচরণ ও অতিরঞ্জন প্রবণতার জন্ম দেয়, যেমন ভারতীয় সভ্যতার অবক্ষয়ের যুগে ব্রাহ্মণদের মধ্যে দিয়েছিল, তখন পরম সত্যের উপলব্ধি হ্রাস পেয়েছিল ও অন্ধবিশ্বাস অবাধে মাথা তুলেছিল।
সৌন্দর্যতত্ত্বের ইতিহাসে এক বন্ধনমুক্তির যুগও আসে যখন ছোট বড় সকল বস্তুর মধ্যে সুন্দরকে চিনে নেওয়া সহজ হয়ে যায়, আর আমরা তাকে অসাধারণ বস্তুর চমৎকারিত্বের থেকে সাধারণ বস্তুর অনাড়ম্বর সামঞ্জস্যের মধ্যে আরো বেশী ক’রে দেখি। এতটাই দেখি যে, যা নিশ্চিতভাবে আমাদের আনন্দ দেয় ও যাকে প্রচলিত রীতির অনুমোদন রাজমুকুট পরিয়ে দেয়, তাকে যখন আমরা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করি তখন সুন্দরকে প্রকাশ করতে গিয়ে আমাদের নানা স্তরের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তখন বিরোধিতা করার জন্য আমরা সাধারণ বস্তুর সাধারণত্বকে অতিরঞ্জিত করতে প্রলুব্ধ হয়ে থাকি, ফলে তাদের আক্রমণাত্মক ভাবে অসাধারণ ক’রে তুলি। আবার সামঞ্জস্য স্থাপন করার জন্য আমরা নানা অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করি যা সকল প্রতিক্রিয়ারই বৈশিষ্ট্য। ইতিমধ্যে বর্তমান যুগে আমরা এই নান্দনিক প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ দেখছি, এতে প্রমাণ হয় যে মানুষ অবশেষে জেনেছে একমাত্র প্রত্যক্ষের সঙ্কীর্ণতা তার নান্দনিক সচেতনতার ক্ষেত্রে অসুন্দর ও সুন্দরের সুস্পষ্ট ভাগ করছে। যখন সকল বস্তুকে ব্যক্তিস্বার্থ ও ইন্দ্রিয় লালসার অহরহ দাবি থেকে আলাদা ক’রে দেখার ক্ষমতা তার থাকে, একমাত্র তখন সে সর্বত্র বিরাজমান সুন্দরকে দেখার সত্য দৃষ্টি লাভ করে। তখনই কেবল সে দেখতে পায় যা আমাদের কাছে অপ্রীতিকর তা অপরিহার্য রূপে অসুন্দর নয়, বরং সত্যের মধ্যে তার সৌন্দর্য রয়েছে।
যখন আমরা বলি সুন্দর সর্বত্রই বিরাজিত তখন এমন বুঝাই না যে আমাদের ভাষা থেকে কুশ্রী শব্দটি মুছে যাওয়া উচিত, ঠিক যেমন ক’রে এ কথা বলা অবাস্তব যে অসত্য বলে কোনো বস্তু নেই। অসত্য অবশ্যই আছে, বিশ্ব নিয়মের মধ্যে নয়, কিন্তু রয়েছে নেতিবাচক উপাদান রূপে আমাদের উপলব্ধি করার ক্ষমতায়। একই ভাবে আমাদের জীবনে ও শিল্পে সৌন্দর্যের বিকৃত প্রকাশের মধ্যে কুশ্রী রয়েছে। সত্যের অসম্পূর্ণ উপলব্ধি থেকে এসে কুশ্রী রয়েছে। আমাদের জীবনে ও সমস্ত কিছুর মধ্যে সত্যের যে বিধান আছে, আমরা কিছুদূর পর্যন্ত আমাদের জীবনকে তার বিরোধী করতে পারি আর সেইভাবে সুসামঞ্জস্যের যে চিরন্তন বিধি সর্বত্র আছে তার প্রতিকূলে গিয়ে আমরা কুশ্রীকে জাগিয়ে তুলতে পারি।
সত্যের অনুভূতির মধ্যে দিয়ে আমরা সৃষ্টির রীতি উপলব্ধি করি, আর সৌন্দর্য অনুভূতির মধ্যে দিয়ে বিশ্বের অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্য উপলব্ধি করি। যখন আমরা প্রকৃতির বিধান চিনতে পারি তখন প্রাকৃতিক শক্তির উপরে আধিপত্য বিস্তার ক’রে শক্তিমান হয়ে উঠি; যখন আমাদের নৈতিক প্রকৃতির রীতি চিনতে পারি তখন আমাদের সত্তার উপরে আধিপত্য লাভ করি ও স্বাধীন হয়ে যাই। এইভাবে যত আমরা প্রাকৃতিক জগতের সামঞ্জস্য উপলব্ধি করি তত আমাদের জীবন সৃষ্টির আনন্দ ভাগ ক’রে নেয়, আর শিল্পে আমাদের সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি তত বেশী উদার হয়ে ওঠে। আমাদের আত্মিক সামঞ্জস্য সম্বন্ধে আমরা যত সচেতন হয়ে উঠি, তত জগতের পরম আনন্দময় ভাব সম্বন্ধে আমাদের ধারণা বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে, আর আমাদের জীবনে মঙ্গল ও প্রেমের মধ্যে দিয়ে সুন্দরের অভিব্যক্তি অসীমের দিকে এগিয়ে যায়। আমাদের অস্তিত্বের চরম লক্ষ্য হলো, সদা সর্বদা আমাদের জানতে হবে যে, “সুন্দরই সত্য, সত্যই সুন্দর”; সমগ্র বিশ্বকে আমাদের প্রেমের মধ্যে উপলব্ধি করতে হবে, কারণ প্রেমই তার জন্ম দেয়, তার পুষ্টিসাধন করে ও আপন হৃদয়ে তাকে ফিরিয়ে নেয়। আমাদের যে হৃদয় সব কিছুর অন্তরতম কেন্দ্রে দাঁড়ানোর শক্তি দেয় তার পরিপূর্ণ বন্ধন মুক্তি থাকা দরকার, আর সেই নিঃস্বার্থ আনন্দের পরিপূর্ণ স্বাদ পাওয়া দরকার যা একমাত্র ব্রহ্মেই রয়েছে।
শিল্পের শুদ্ধতম রূপ সঙ্গীত, আর সেই কারণে একক ও সরল বিন্যাস ও ভাব থাকায় এর মধ্যে সুন্দরের অভিব্যক্তি সব থেকে বেশী স্পষ্ট, ও বাইরের কোনো কিছুর দ্বারা বিন্দুমাত্র ভারাক্রান্ত নয়। আমাদের এমন অনুভব হয় যে সৃষ্টির সীমিত বিন্যাসে সঙ্গীত নিজেই অসীমের নীরব ও সুস্পষ্ট প্রতীয়মান প্রকাশ। সন্ধ্যার আকাশ, নিরলস ভাবে নক্ষত্র সমাবেশের পুনরাবৃত্তি করতে থাকে, মনে হয় যেন একটি শিশু নিজের প্রথম উচ্চারণের রহস্যে বিস্মিত হয়ে, একই শব্দ বার-বার আধো আধো ভাবে বলছে, ও অফুরন্ত আনন্দে তা শুনছে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের বর্ষণমুখর রাতে যখন তৃণক্ষেত্রে অন্ধকার গাঢ় হয়, ও তন্দ্রাচ্ছন্ন পৃথিবীর স্তব্ধতার উপর টুপটাপ ক’রে ঝরে পড়া বৃষ্টি পর্দার পর পর্দা টেনে দেয় তখন টুপটাপ বৃষ্টির এই একটানা সুরে মনে হয় এ যেন শব্দেরই অন্ধকার। অস্পষ্ট ও ঘন গাছের সারির বিষণ্ণতা, ঊষর প্রান্তরে ইতস্তত ছড়ানো কাঁটা ঝোপ যেন সাঁতারুদের ভাসমান মাথার অবিন্যস্ত ভেজা চুল, ভেজা ঘাস আর ভেজা মাটির গন্ধ, গ্রামের কুটিরগুলি ঘিরে জড়ো হওয়া দিশাহীন পুঞ্জীভূত অন্ধকারকে ছাড়িয়ে মাথা উঁচু ক’রে ওঠা মন্দিরের চূড়া— এ সমস্তই মনে হয় যেন রাত্রির অন্তস্তল থেকে উৎসারিত নানা সুর, অবিশ্রান্ত বৃষ্টির একই রকম শব্দের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে ও নিজস্বতা হারিয়ে আকাশ ভরিয়ে দিচ্ছে।
এইজন্য যাঁরা দ্রষ্টা, সেই প্রকৃত কবিরা বিশ্বকে সঙ্গীতের পরিভাষায় প্রকাশ করতে চান।
নীল আকাশের চিত্রপটে প্রতি মুহূর্তে যে রূপ উন্মোচিত হচ্ছে, রেখা ও রঙের যে নিরবচ্ছিন্ন মিশ্রণ হয়ে চলেছে তাকে প্রকাশ করতে তাঁরা চিত্রের প্রতীক অল্পই ব্যবহার করেন।
তাঁদের নিজস্ব যুক্তি আছে। যিনি ছবি আঁকেন তাঁর চিত্রপট, তুলি ও রঙের বাক্স অবশ্যই থাকা প্রয়োজন। তাঁর তুলির প্রথম ছোঁয়া ছবির পূর্ণ ধারণার থেকে বহু দূরে থাকে। আর তারপর যখন কাজটি সম্পূর্ণ হয়ে যায় ও চিত্রকর চলে যান, তখন প্রভুহীন ছবিটি একাকী দাঁড়িয়ে থাকে, সৃজনশীল হাতের ভালবাসার নিরন্তর স্পর্শ ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
কিন্তু গায়কের নিজের মধ্যেই সব কিছু থাকে। স্বরগুলি তার জীবন থেকেই উৎসারিত হয়। সেগুলি বাইরে থেকে সংগৃহীত উপকরণ নয়। তার ভাব ও তার অভিব্যক্তি ভাই ও বোনের মতো; প্রায়ই তারা যমজ হয়ে জন্মায়। সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে হৃদয় নিজেকে সরাসরি প্রকাশ করে; কোনো বিজাতীয় উপাদানের প্রতিবন্ধকতা তাকে ভোগ করতে হয় না।
সেই কারণে অন্য যে কোনো শিল্পের মতো সঙ্গীতকে যদিও তার সম্পূর্ণতার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তবুও প্রতি পদক্ষেপেই সে পূর্ণতার সৌন্দর্য বিতরণ করে। অভিব্যক্তির উপকরণ রূপে এমনকি শব্দও বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তাদের অর্থ চিন্তা দিয়ে প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু সঙ্গীতকে কখনোই কোনো সুষ্পষ্ট অর্থের উপর নির্ভর করতে হয় না; কোনো শব্দ কখনো যা প্রকাশ করতে পারে না সে তাই প্রকাশ করে।
তা ছাড়া, গান ও গায়ক অবিচ্ছিন্ন। যখন গায়ক চলে যান, তাঁর সঙ্গে তাঁর গানেরও অবসান হয়; প্রভুর জীবন ও আনন্দের সঙ্গে তা চিরকাল এক হয়ে থাকে।
এই পার্থিব-সঙ্গীত এক মুহূর্তের জন্যও তার গায়কের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। বাহ্য কোনো উপাদানে তাকে রচনা করা হয় না। এ তারই আনন্দ নিজেই অনন্ত রূপ নেয়। এ সেই মহান হৃদয় রোমাঞ্চিত হয়ে আকাশে তার শিহরণ পাঠিয়ে দেয়।
এই সঙ্গীতের প্রতিটি স্বরের মধ্যে রয়েছে সম্পূর্ণতা, যা অপূর্ণতার মধ্যে পূর্ণতাকে প্রকাশ করে। এর কোনো সুরই সর্বশেষ নয়, যদিও প্রতিটি সুরে অনন্তের প্রতিফলন হচ্ছে।
এই মহান সুর-সামঞ্জস্যের প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করতে যদি আমরা অসমর্থ হয়ে থাকি, তাতে কি এসে যায়? তারের সঙ্গে মিলিত হয়ে যে হাত তৎক্ষণাৎ সব ক’টি স্বর বার ক’রে আনে এ কি সেই হাতের স্পর্শের মতো নয়? এ হলো সুন্দরের ভাষা, স্নেহের স্পর্শ, জগতের অন্তস্তল থেকে উৎসারিত হয়ে যা সোজাসুজি আমাদের হৃদয়ে পৌঁছে যায়।
গতরাত্রে, নিস্তব্ধতায় পরিব্যাপ্ত অন্ধকারে, আমি একা দাঁড়িয়েছিলাম আর চিরন্তন সুরের গায়কের কণ্ঠ শুনেছিলাম। যখন আমি নিদ্রিত হলাম তখন এই শেষ ভাবনা নিয়ে চোখ বন্ধ করলাম যে, যখন আমি তন্দ্রায় অচেতন থাকবো এমনকি তখনো আমার ঘুমন্ত শরীরের নিস্তব্ধ পরিসরে নক্ষত্রদের সঙ্গে পা মিলিয়ে জীবনের নৃত্য চলতে থাকবে। হৃদয় স্পন্দিত হবে, ধমনীতে রক্ত সঞ্চালিত হবে আর আমার শরীরের লক্ষ লক্ষ জীবন্ত পরমাণু ওস্তাদের স্পর্শে বীণার তারে রোমাঞ্চ জাগানো সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আন্দোলিত হবে।