সোয়েটারের উল

সোয়েটারের উল

আজ সকালে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল অরূপ। সোমাদ্রি মুগ্ধ হয়ে চারিদিক দেখছিল। আজকালকার দিনে এমন বাড়ির ভেতর দেখতে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। জায়গাটা কোন্নগরের গঙ্গার ধারে। বিশাল এক রাজবাড়ি। সেই বাড়িরই এক উত্তরাধিকারী অরূপ রায়চৌধুরী। সোমাদ্রির কলেজের বন্ধু। দুজনেরই ফিজিক্স অনার্স। সেকেন্ড ইয়ার। গত পরশুদিনই কলেজে ছুটি পড়েছে। আগেই প্ল্যান ছিল এবার অরূপদের বাড়ির মদনমোহনের উৎসব দেখতে যাবে সোমাদ্রি। অরূপের কাছে অনেক গল্প শুনেছে এই উৎসবের। প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো অষ্টধাতুর মদনমোহন ও রাধা এই রায়চৌধুরী বাড়ির কুলদেবতা। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিনে এই উৎসব হয়। বাড়ির সামনে জিটি রোডের ওপর মেলা বসে। সব মিলিয়ে এক হই হই কাণ্ড চলে তিনদিন ধরে।

এখন আর আগের মতো সেই শানদার ব্যাপারটা নেই বুঝলি, আমার ছোটবেলাতেও যেটুকু দেখেছি এখন তাও প্রায় নেই।

সোমাদ্রি বলল, হুম, সেটাই তো হওয়ার কথা। ঐতিহ্য চিরকালই ক্ষয়িষ্ণু

জিটি রোডের ওপরেই বিশাল উঁচু পাঁচিলে ঘেরা প্রধান ফটক। তারপর লম্বা লন। লন শেষে পেল্লায় বাড়ি। সংস্কারের অভাবে জীর্ণ। বাড়ির সামনে বড় উঠোন, একটি শুকনো ফোয়ারা আর গঙ্গার ঠিক ধারে একটি নাচদালান। তার থেকে একটু তফাতে মদনমোহনের মন্দির। চমৎকার বিগ্রহ যুগল।

এই সবই গতকাল বিকেলে এই বাড়িতে আসামাত্র দেখা হয়ে গিয়েছিল সোমাদ্রির। আজ বাদে কাল উৎসব। তারপরের দিন বিকেলের দিকে আবার কলকাতায় নিজের মেসে ফিরে যাবে ও।

আসলে শরিকি সমস্যায় আর কিছুই তেমন করা হয়ে ওঠে না। তাও যতদিন দাদু জীবিত আছে এইসব হচ্ছে, এরপরে যে কী হবে কেউ জানে না। উৎসব বন্ধই হয়ে যাবে হয়তো।

অরূপের কথার উত্তরে সোমাদ্রি বলল, চল তোর দাদুর সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দে।

হ্যাঁ চল, এবার সময় হয়েছে। দাদু এখন নাটমন্দিরে রয়েছে। ওখানেই যাওয়া যাক।

 দুজনে মন্দিরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। মন্দিরে যাওয়ার আগে দুটো বিশাল আমগাছ রয়েছে। তারই একটার নীচে একটি ছেলে আর মেয়েকে দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখল সোমাদ্রি। দুজনেরই বেশ হাসি হাসি মুখ। কিন্তু সোমাদ্রি আর অরূপের সঙ্গে চোখাচুখি হতেই ওই দুজন কেমন একটু আড়ষ্ট হয়ে উঠল।

কী রে, এখানে কী করছিস তোরা? মেয়েটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল অরূপ।

মেয়েটি একটু থতমত খেয়েই কোনওমতে বলল, ন-ন-না কিছু না দাদা, এই ইয়ে পুজোর কথা বলছিলাম তপুর সঙ্গে।

ওহ। এই সোমাদ্রি, এ হল আমার বোন আদৃতা। আমার ছোটকাকার মেয়ে। আমরা সকলে ওকে আদুরি নামে ডাকি। ওরা এই বাড়িতেই থাকে।

আর ও? বলে সুন্দর দেখতে ছেলেটির দিকে আঙুল তুলল সোমাদ্রি।

ও তপু, আমাদের ঠাকুরমশাইয়ের ছেলে। এই মাস দুয়েক হল এখানে এসেছে। তার আগে গ্রামে দেশের বাড়িতে থাকত। মাধ্যমিক পাশ করে এখন এখানে চলে এসেছে। কলেজে পড়ে, আর ওর বাবার সঙ্গে মদনমোহনের সেবা করে আর কি। বেশ ক্যাজুয়ালি বলল অরূপ।

তপুর মুখের দিকে তাকাল সোমাদ্রি। লাজুক মুখ আরও যেন সংকুচিত হয়ে উঠেছে। আদৃতা বরং নিজেকে সামলে নিয়েছে। তবু নিজেকে মনেপ্রাণে যতটা আড়াল করতে চাইছে ততটা পারছে না। কীসের আড়াল? মনে একটু খটকা লাগল সোমাদ্রির।

অরূপের দাদু অবিনাশ রায়ের সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগছিল। প্রায় আশি বছর বয়েস। কিন্তু এখনও টানটান ছিপছিপে চেহারা। ব্যাকব্রাশ করা কাঁধ পর্যন্ত সাদা চুল। সাদা গোঁফটিও দিব্যি মানানসই। সাদা আদ্দির পাঞ্জাবির ওপর সাদা দামি শাল আর ধুতি। কণ্ঠস্বর বয়েসের কারণে কিছুটা ভাঙা।

পুরনো কাঠের ইজি চেয়ারে আয়েশ করে বসে বেশ রাজকীয় স্টাইলেই তিনি সোমাদ্রিকে এই বাড়ির ইতিহাস বলছিলেন। প্রায় দুশো বছরের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে এই বাড়ির সঙ্গে। বেশ লাগছিল শুনতে।

মানুষের আসল পরিচয় তার বংশে। প্রত্যকের উচিত তার নিজের বংশের সম্মান,ঐতিহ্যকে বজায় রাখা। পশুদের কোনও পারিবারিক সম্মান রক্ষার দায় নেই, কিন্তু মানুষের রয়েছে। এইসব ডায়ালগগুলো শুনতে শুনতে সোমাদ্রি বুঝতে পারছিল এই বয়েসেও ভদ্রলোক তার পরিবার, ঠাঁটবাটের ঐতিহ্যের প্রতি মারাত্মক সচেতন।

আদুরি কোথায় রে? জিজ্ঞাসা করলেন দাদু।

অরূপ উত্তর দিল, এই তো এইমাত্র দেখলাম বাইরে তপুর সঙ্গে কথা বলছিল। ডাকব?

তপুর সঙ্গে? কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কিছুটা শক্ত হয়ে উঠলেন তিনি। এই সামান্য পরিবর্তনটুকু সোমাদ্রির নজর এড়াল না।

ডাকব দাদু?

তপুকে ডাক। এখুনি।

হ্যাঁ দাদু ডাকছি। উঠে গেল অরূপ। সোমাদ্রি মুখোমুখি বসে রইল অবিনাশবাবুর। অবিনাশ এই কয়েকমুহূর্তেই যেন ভূলে গেছেন এতক্ষণ তিনি গল্প করছিলেন। চোখমুখে সাংঘাতিক একটা বিরক্তি ফুটে উঠেছে। একা হয়ে উঠেছেন উনি। সোমাদ্রি চুপচাপ বসে ভাবতে চেষ্টা করল ওঁর আচমকা এই বিরক্তির কারণটা কী?

একটু পরেই অরূপ ফিরল, ওর পিছনে তপু। জড়োসড়ো ভাব। তপুর দিকে খুব তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকালেন অবিনাশ। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ঠাকুরের অঙ্গরাগ কতদূর?

প্রায় হয়ে এসেছে। বাবা বললেন আজ সন্ধের মধ্যেই…

কেন? সন্ধ্যের মধ্যে কেন? আজ দুপুরের মধ্যে কেন শেষ হবে না? তুমি কি তোমার বাবাকে সাহায্য করছ না?

আজ্ঞে করছি। বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বলল তপু।

আমার ধারণা করছ না। নিজের কাজটা মন দিয়ে করো। এখানে তোমাকে কেন রাখা হয়েছে আশা করি জানো।

তপু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। খারাপ লাগছিল সোমাদ্রির। প্রায় ওরই বয়েসি ছেলেটা সকলের সামনে এইভাবে অপমানিত হচ্ছে দেখে। অবিনাশবাবু ইচ্ছে করেই সকলের সামনে ওকে অপমান করবেন বলেই যেন ডেকে এনেছেন। ওর রাগটা কীসের?

যাও, দাঁড়িয়ে না থেকে বাবাকে সাহায্য করো। বেশ ধমক দিয়েই বললেন অবিনাশ।

মাথা নিচু করেই ঘর থেকে চলে গেল তপু। কিছুক্ষণ সকলেই চুপ। অবিনাশবাবু আর সহজ হতে পারলেন না। অরূপ বলল, দাদু আমরা তাহলে এখন উঠি। সোমাদ্রিকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাই।

হ্যাঁ, এসো। আর কিছু বললেন না উনি।

পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখার পর অরূপ বলল, চল এবার তোকে আমাদের বাড়ির ছাদটা দেখাই।

দোতলায় টানা বারান্দা আর একপাশে সারসার ঘর। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে অবিনাশবাবুর ঘর। তারপর ছাদে ওঠার সিঁড়ি। সে এক সাংঘতিক সিঁড়ি। কাঠের এবং ভয়ংকর খাড়া। এই বাড়িতে এমন সিঁড়ি ভাবাই যায় না।

এ কী রে অরূপ, এত উঁচু সিঁড়ি কাঠের!

আর বলিস না ভাই। এই সিঁড়ি আমার জন্মের অনেক আগে থেকে। কেন যে এমন জানি না। ছোটবেলায় আমাদের এই সিঁড়ি বেয়ে ছাদে যাওয়া বারণ ছিল।

সেটাই স্বাভাবিক। সিঁড়ির দুই ধারের সরু কাঠের রেলিং ধরে খুব ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করল সোমাদ্রি। সামনে অরূপ। কম করে কুড়িটা ধাপ। আর প্রতিটা ধাপের মধ্যে দূরত্ব স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই বেশি। ওপরে ওঠার পর অবশ্য মন জুড়িয়ে গেল। কী চওড়া ছাদ! অনেক দূর পর্যন্ত চোখ যায়। ছাদের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত বেশ কয়েকবার পাক খাওয়ার পর সোমাদ্রি অরূপকে জিজ্ঞাসাই করে ফেলল, তোর দাদু হঠাৎ ওই তপুর ওপর এমন চোটপাট করল কেন রে?

আমিও ঠিক বুঝলাম না। দাদু কিন্তু এমনি খুবই ভালো মনের। কাউকে অকারণে বকাঝকা করেন না। বরং তপুকে বেশ স্নেহ করেন।

আর আদুরিকে?

ওব্বাবা, আদুরি হল এই পরিবারে যতজন ছোট সদস্য রয়েছে তাদের মধ্যে দাদুর কাছে সবথেকে আদরের।

হুঁ। চল এবার নামি।

আগামীকাল সকাল থেকেই অনুষ্ঠান শুরু। তার আগে গত পনেরোদিন ধরে রাধামাধবের অঙ্গরাগ চলে। মানে ঠাকুরকে রং করা, সাজানো ইত্যাদি। এই সময়ে প্রতিবছর বিগ্রহ দর্শন বন্ধ থাকে। অঙ্গরাগের কাজটি করেন ঠাকুরমশাই নৃপেনবাবু, তপুর বাবা। দুপুরে ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। রোগাসোগা মানুষটি বেশ শান্তশিষ্ট। ছেলে পড়াশোনায় ভালো, তাই কলকাতার কলেজে ভর্তি করেছেন। কর্তা অবিনাশবাবু এখানে থাকা খাওয়া ফ্রি করে দিয়েছেন ছেলের।

ছেলের জন্য বাবার গর্বের শেষ নেই সেটাও কথায় কথায় বুঝতে পারল সোমাদ্রি।

এই বাড়ির বিশাল পরিবার। বিকেলের মধ্যেই আত্মীয়স্বজনরা এসে পড়ল। হৈ হৈ ব্যাপার। প্রায় সকলের সঙ্গেই পরিচয় হল সোমাদ্রির। বেশ ভালো লাগল। এই পরিবারের কাছে রাধামাধবের উৎসব একটা বিশাল ব্যাপার। এবং সকলেই অবিনাশবাবুকে খুবই শ্রদ্ধার নজরে দেখেন। সন্ধেবেলার দিকে ঠাকুরের সাজসজ্জা শেষ হল। মন্দিরের দরজা খোলা হল নাম সংকীর্তনের মধ্য দিয়ে। খুব সুন্দর সাজিয়েছেন ঠাকুরমশাই আর তার ছেলে তপু মিলে। যখন গানবাজনা হচ্ছিল সোমাদ্রি খেয়াল করল, তপু আর আদুরির মধ্যে বেশ কয়েকবার চোখাচুখি হল। কিছু একটা ব্যাপার ঘটছে ডেফিনিট। কী সেটা?

মেলার লোকজন সব এসে গেছে। কাল ভোরবেলা থেকে অনুষ্ঠান শুরু। ঠাকুরের অভিষেক, বিশেষ পুজো, ভোগরাগ। বিকেলে মেলা বসবে। এলাহি ব্যপার।

রাতের খাওয়াদাওয়া নটার মধ্যেই শেষ। অরূপ আর সোমাদ্রি দুজনে মিলে অরূপের ঘরে বসে গল্প করছিল। হঠাৎই তীক্ষ্ন চিৎকার এবং ভারি কিছু একটা হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাওয়ার শব্দ। কীসের শব্দ বুঝে ওঠার আগেই ওরা ঘর ছেড়ে দৌড় দিল বাইরে। আওয়াজটা দোতলার বারান্দার দিক থেকে এসেছে। ওই পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই বাড়ির অনেকের প্রবল আর্তনাদে ভরে উঠল চারদিক। কয়েকলাফে সোমাদ্রি আর অরূপ সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বারান্দার কোণ পর্যন্ত পৌঁছতেই চোখের সামনে যা দেখল তা দেখে হাত-পা হিম হয়ে গেল ওদের।

কাঠের সিঁড়ির নীচে বেঁকে দুমড়ে পড়ে রয়েছে আদুরি। মাথা ফেটে চৌচির। চোখ খোলা। ঘাড় এমনভাবে বেঁকে রয়েছে, দেখলেই বোঝা যায় শরীরে আর প্রাণ নেই। আদুরির সামনে তপু দাঁড়িয়ে বলির পাঁঠার মতো থরথর করে কাঁপছে। দেখে বোঝাই যাচ্ছে সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে আদুরি। আর তার পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন অবিনাশবাবু।

অরূপ আর সোমাদ্রিকে দেখে হাউমাউ করে উঠল তপু, বিশ্বাস করুন দাদা, আমি কিছু করিনি…কিছু করিনি…।

সোমাদ্রি সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তপুকে চুপ করতে বলল। কয়েক মিনিটের মধ্যে গোটা বাড়ির লোক জড়ো হয়ে গেল সিঁড়ির সামনে। উৎসবের আনন্দ এক মুহূর্তে আর্তনাদ আর কান্নায় পরিণত।

অ্যাম্বুলেন্স এল। আদুরিকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। যদিও সকলেই বুঝে গেছিল আদুরি আর নেই। পুলিশ এল আরও পরে। সিঁড়ির সামনেটা ফাঁকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোমাদ্রি টর্চ জ্বালিয়ে সিঁড়িটা আঁতিপাতি করে দেখছিল। কী যেন একটা পেয়ে সবার অলক্ষ্যে নিজের পকেটে ভরে ফেলল সেটাকে। পুলিশ সকলকে রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে গেল। যা বোঝা গেল আদুরি রাত্রে ছাদে গেছিল, অন্ধকারে নামার সময় সিঁড়িতে ভুল স্টেপ ফেলায় ওপর থেকে সটান নীচে পড়েছে।

এদিকে অবিনাশবাবুর অবস্থা আশঙ্কাজনক। ডাক্তার এসে বললেন সেরিব্রাল অ্যাটাক। এখুনি হসপিটালাইজ করতে হবে। আবার তাঁকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হল স্থানীয় নার্সিংহোমে। বাড়ির লোকেরা যখন অচৈতন্য অবিনাশবাবুকে ধরাধরি করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছে, তখন সোমাদ্রি একবার ঝুঁকে অবিনাশবাবুকে দেখল। তারপর সরে এল।

স্টেশনে বসেছিল সোমাদ্রি আর অরূপ। সোমাদ্রি ফিরে যাবে। অরূপ এখন কিছুদিন এই বাড়িতেই থাকবে। বাড়ির যা অবস্থা তাতে এখন কলকাতায় ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই নেই।

গতকালের আনন্দ উৎসব বদলে গেছিল শোকের পরিবেশে। কোনওমতে শুধু ঠাকুরের পুজোটুকু হয়েছে, আর কিছুই হয়নি। আদুরির শেষকৃত্য, অবিনাশবাবুর ডিপ কোমায় চলে যাওয়া…এইসব কিছু যেন এক লহমায় বদলে দিল বাড়ির সুন্দর পরিবেশটাকে। অমন সুন্দর বোনকে এইভাবে হারিয়ে অরূপের মানসিক অবস্থাও খুব খারাপ। তবু বন্ধুকে আজ ছাড়তে এসেছে স্টেশনে। দুজনে প্ল্যাটফর্মে বসে রয়েছে চুপচাপ। হঠাৎ অরূপ বলে উঠল, ওই শালা তপুটাই কিছু করেছে জানিস। ওটাকে ধরে বেদম মার দিলে সত্যি কথাটা বলবে।

তুই শিয়োর, ওই কিছু করেছে?

সোমাদ্রির প্রশ্নে অরূপ বলল, আমার বাড়ির লোকেরাও শিয়োর। কারণ আদুরির পাশে সেদিন ওকেই সর্বপ্রথম দেখা গেছে। অত দ্রুত ও ওখানে পৌঁছাল কী করে বল? ওর এগেন্সটে পুলিশকে এনকোয়ারি করতে বলা হবে ঠিক করেছি আমরা।

অরূপের মুখের দিকে তাকাল সোমাদ্রি। তারপর নিচু গলায় বলল, তপু কিছু করেনি। পুলিশি বিষয়ে জড়াস না, তাহলে তোর পরিবারেরই সুনাম নষ্ট হবে। আদুরিকে খুন করেছে অন্য একজন। তোদের পরিবারেরই একজন।

কী বলছিস তুই!

ঠিকই বলছি। অবশ্য ইচ্ছাকৃত খুন নয়, ইনফ্যাক্ট তিনি আদুরিকেও খুন করতে চাননি, চেয়েছিলেন অন্য একজনকে আহত করতে, কিন্তু সেমসাইড হয়ে গেছে।

এসব কী বলছিস সোমাদ্রি! কে করল এইসব?

আমি এইসব তোকে কিছুই বলতাম না, কিন্তু তোরা যখন ঠিক করছিস তপুর বিরুদ্ধে স্টেপ নিবি তখন আমার মনে হয় তোকে সত্যিটা বলা দরকার নইলে ওই বেচারা ফেঁসে যাবে। বলে লম্বা শ্বাস টেনে সোমাদ্রি বলল, এই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটিয়েছে তোর দাদু, অবিনাশবাবু।

কী! এসব কী বলছিস তুই! দাদু কেন করবেন? তুই জানিস দাদু আদুরিকে কী ভালোবাসত।

জানি, আর সেই স্নেহের কারণেই তিনি এমন কাণ্ডটা ঘটিয়ে ফেললেন।

তোর কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না সোমাদ্রি।

শোন তাহলে। তুই বুঝেছিস কি না জানি না, তবে প্রথম দিন আমি আর তুই মিলে তপু আর আদুরিকে আমগাছের নীচে গল্প করতে দেখেছিলাম আর সেই কথা তোর দাদু জানার পর কেমন রিয়্যাক্ট করেছিলেন মনে আছে? আসলে আমার ধারণা আদুরি আর তপুর মধ্যে একটা রিলেশন তৈরি হচ্ছিল। এই বয়েস শুধু ভালোবাসা ছাড়া আর বাকি কিছু বোঝে না। ব্যাপারটা তোর দাদু আন্দাজ করতে পারেন, একদিকে আদরের নাতনীর কাঁচা বয়েসের ভুল আবার পরিবারের এতিহ্য সম্মান। আমার ধারণা উনি বেশ কয়েকবার ভেবেছিলেন কিংবা আদুরিকে তপুর সঙ্গে মিশতে বারণও করেছেন, কিন্তু আদুরি শোনেনি। তোদের পরিবারের সকলে একমাত্র পারিবারিক এই অনুষ্ঠানেই একসঙ্গে জড়ো হন। আর এর মধ্যে যদি তপু আর আদুরির এই ঘনিষ্ঠতা সকলের মধ্যে জানাজানি হয় সেটা অবিনাশবাবুর পক্ষে খুবই অসম্মানের ব্যপার হবে ভেবেছিলেন তাই তিনি ভাবছিলেন কীভাবে তপুকে এখান থেকে সরানো যায়। একবার এই বাড়ি থেকে সরিয়ে ফেলতে পারলে আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড হয়ে যাবে ব্যাপারটা। উপযুক্ত ছুতোর অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।

গতকাল রাত্রে অবিনাশবাবু নিজের ঘরে বসেছিলেন। আমার ধারণা তিনি তখন বারান্দা দিয়ে তপুকে ছাদের দিকে যেতে দেখেন। তখনই তাঁর মাথায় বুদ্ধি এসে যায়। সিঁড়ির একেবারে ওপরের ধাপে পায়ের কাছে রেলিঙের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত যদি কোনও শক্ত কিন্তু সরু দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া যায়, তাহলে অন্ধকারে নামার সময় ওই দড়িতে পা জড়িয়ে তপু নীচে পড়বেই এবং ভালোমতো জখম হবে। তখন ওকে চিকিৎসার ছলে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। ভাবামাত্র কাজ শুরু করে দিলেন অবিনাশবাবু। কিন্তু অত দ্রুত সরু দড়ি পাবেন কোথায়? গায়ে ছিল নস্যি রঙের সোয়েটার। ওই সোয়েটারেরই উল ছিঁড়ে নিলেন, তারপর চুপিচুপি সিঁড়িতে উঠে কাজ সেরে আবার নিজের ঘরে বসে অপেক্ষা করতে থাকলেন তপুর চিৎকারের।

হ্যাঁ শুনলেনও চিৎকার। কিন্তু সেটা তপুর নয়, আদুরির। আসলে আমার ধারণা আদুরি আর তপু রোজই রাতে একটু দেখা সাক্ষাৎ করে গল্প করত। কিন্তু কাল বাড়ি ভর্তি লোক থাকায় ওরা নীচে দেখা করার সাহস নেয়নি। কিন্তু মনের টান, একটু দেখা না করলে মন খারাপ করবে, তাই ঠিক করেছিল রাতে সবার খাওয়া দাওয়ার পর দুজনে ছাদে দেখা করবে। কথামতো আদুরি আগেই ছাদে চলে গেছিল, সেটা অবিনাশবাবুর নজরে পড়েনি, তিনি শুধু তপুকে যেতে দেখেছিলেন, আর সেটাই কাল হল। আদুরি কাল আগে নামতে গেছিল আর…। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল সোমাদ্রি।

অরূপ হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে সোমাদ্রির দিকে।

অবিনাশবাবু ভেবেছিলেন তপুকে নিয়ে সকলে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়বে তখন এক ফাঁকে রেলিঙে বাঁধা সোয়াটারের ছেঁড়া উলটা তিনি খুলে নেবেন, কিন্তু সেই সুযোগও তিনি আর পাননি, নিজের পাতা ফাঁদে যে তাঁর এমন সর্বনাশ হবে ভাবতেও পারেননি। তাই তাঁর আঘাতটাও এসেছে অমন সাংঘাতিক। বলে ব্যাগের চেন খুলে একটা ছোট কাগজে মোড়া দুটো কোঁচকানো উলের খণ্ড অরূপের হাতে দিয়ে বলল এই নে, পরশু রাতে তোদের সিঁড়ির রেলিং থেকে এটা পেয়েছিলাম। তোর দাদু যে রঙের সোয়েটারটা পরেছিলেন তার সঙ্গে মিলিয়ে নিস। আর ছাদে যাওয়ার ব্যাপারটা আমি গতকাল তপুর সঙ্গে কথা বলেই জেনেছি।

অরূপ কিছু বলতে পারছিল না। ওর চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়ছিল। বন্ধুর হাতটা ধরল সোমাদ্রি। আমার আর কিছু বলার নেই। তবে তুই বলতে পারিস আমি কেন সত্যিটা জেনেও তোকে আগে কিছুই বলিনি। আসলে এই অপরাধে যাঁর শাস্তি হওয়ার কথা ছিল তিনি নিজেই এখন হাসপাতালে শেষ অবস্থায় শুয়ে রয়েছেন। মৃত্যুপথযাত্রীর প্রতি আর কীই বা দোষ দেব। কিন্তু তোরা যখন তপুকে দায়ী করছিস দেখলাম, তখন আর চুপ থাকতে পারলাম না।

প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকছে। বন্ধুর হাতটা নিজের মুঠিতে আলতো করে একবার ধরে আবার ছেড়ে দিয়ে সোমাদ্রি ট্রেনে উঠে বসল। অরূপ তখনও প্ল্যাটফর্মে পাথরের মতো বসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *