৬
পরদিনই রাজা ত্রিস্তান কে ফিরিয়ে আনলেন দুর্গে। ত্রিস্তান আগের মতোই রাজা- রানীর শয়ন ঘরের পাশে জায়গা পেল। রাজার মন এখন মেঘমুক্ত আকাশের মতো সন্দেহহীন, ঈর্ষাহীন। ত্রিস্তান আর সোনালির মধ্যে আবার নিয়মিত গোপনে দেখা হতে লাগলো। আবার ওদের ভালোবাসা উদ্দাম হয়ে উঠলো।
এবার রাজার মনে পড়লো সেই চারজন নাইট আর গণৎকারের কথা। ওদের শাস্তি দেবার জন্যে রাজা পাঁচজনকেই ডেকে পাঠালেন। সামনে আসতেই রাজা বললেন, এই পাজী গণৎকারটাকে ফাঁসি দেবো আর তোমাদের-
নাইটরা বললো, মহারাজ, আপনি আমাদের যতই ঘৃণা করুন, তবু আমরা বলবো, ত্রিস্তান রানীকে ভালোবাসে, ওদের গোপনে মিলন হয়। এতে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।
গণৎকার বললো, রাজা আমাকে ফাঁসি দিন ক্ষতি নেই। কিন্তু, তবুও শেষ পর্যন্ত বলে যাবো, আমার গণনা কখনো মিথ্যা হয় না। আমার কথা মতো গিয়ে আপনি ওদের দেখতে পেয়েছিলেন কি না? আমি আবার বলছি, এখনও ওদের মিলন হয়।
রাজা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মুখ নিচু করলেন। ভাবলেন, আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু আমার প্রজাদের মুখ বন্ধ করি কি করে?
গণৎকার আবার বললো, ফাঁসি দেবার আগে, মহারাজ, আমাকে আর একবার সুযোগ দিন! এবার হাতে হাতে ধরিয়ে দেবো।
মেঘগর্জনের স্বরে রাজা বললেন, যদি না পারো?
—তবে আমি নিজের হাতে ফাঁসির দড়ি গলায় পরবো। মহারাজ, আমার গণনা মিথ্যা হয় না।
এই কুৎসিত গণৎকারটার কণ্ঠ স্বরে এমন একটা দৃঢ়তা ছিল, রাজা অবহেলা করতে পারলেন না।
তিনি বললেন, কি ব্যবস্থা তুমি করতে চাও?
—মহারাজ, আপনি ত্রিস্তানকে আজই ভোর রাত্রে কোনো দূর দেশে পাঠান কয়েকদিনের জন্য, কিন্তু একটা কাজের ভার দিয়ে। আদেশটা দেবেন আপনি রাত্তির বেলা। তারপর যা করার আমি করবো। হঠাৎ বাইরে যাবার কথা শুনলে, ত্রিস্তান সবার আগে এককবার রানীর সঙ্গে দেখা না করে পারবে না!
সেই রাত্রে রাজা শুতে যাবার আগে প্রতিদিনের মতো ত্রিস্তান এলো রাজার সামনে বীণা বাজাতে। রাজা বললেন, আজ আর গান ভালো লাগছে না। তা ছাড়া, ত্রিস্তান, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। তোমাকে একটা গোপন চিঠি নিয়ে যেতে হবে রাজা আর্থারের কাছে। তুমি ওখান থেকে উত্তর নিয়ে আসবে।
ত্রিস্তান বললো, আমি কালই রওনা হবো।
—কাল নয়, আজই ভোর রাত্রে। খুব জরুরি চিঠি ত্রিস্তান, তোমাকে ছাড়া আর কারুর হাতে দিতে পারি না! এখন বরং খানিকটা ঘুমিয়ে নাও।
ত্রিস্তান শুতে গেল। রাজা গেলেন নিজের ঘরে অথচ ত্রিস্তানের বুকে একটা অসম্ভব ইচ্ছে ঝাপটা মারছে। সাত দিন অন্তত বাইরে থাকতে হবে, যাবার আগে একবার রানীর সঙ্গে দেখা হবে না? একবার না দেখলে সারাটা পথ যে ত্রিস্তানের বুক খাঁ-খাঁ করবে। রোদ্দুর তাকে বেশি জ্বালা দেবে, শীত তাকে বেশি কষ্ট দেবে-পথ মনে হবে অনন্ত, যদি একবার যাবার আগে রানীর সঙ্গে দেখা না হয়!
রাজার চোখে ঘুম নেই, সারারাত তিনি জেগে। গণৎকারের পরিকল্পণা মতো গভীর রাত্রে রাজা একবার উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। জাগ্ৰত ত্রিস্তান তা লক্ষ্য করে ভাবলো, এই তো সুযোগ। নিমেষের জন্য একবার রানীর সঙ্গে দেখা করে আসা যায়। হঠাৎ ত্রিস্তান দেখলো, একটা বেঁটে মতো কুৎসিত লোক অন্ধকারের মধ্যে তার আর রাজার ঘরের মধ্যে যে বারান্দা সেখানে কি যেন ছড়াচ্ছে! এ সেই গণৎকার, সারা বারান্দায় ময়দা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ত্রিস্তান বা রানী যে কেউ একজন ঘর থেকে বেরুলেই পায়ের ছাপ পড়ে যাবে। আর সেই পায়ের ছাপ বলে দেবে কে কোন দিকে গেছে।
ত্রিস্তান অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে সব লক্ষ্য করলো। মনে মনে হাসলো ঐ বামনটা ভেবেছে ঐ দিয়ে তাকে ধরবে? অন্য যে- কেউ হলে সে রাত্রে আর দেখা করার সাহস পেতো না। কিন্তু ত্রিস্তানের কথা আলাদা। সে আলাদা ধাতু। বিপদের গন্ধ পেয়েই যেন ত্রিস্তানের ইচ্ছে আরও উদ্দাম হয়ে উঠলো। গণৎকার চলে যেতেই ত্রিস্তান নিজের ঘরের চৌকাঠের কাছে এসে এক লাফ দিয়ে বারান্দা পেরিয়ে চলে গেল রানীর ঘরে। কোনো পায়ের ছাপ পড়লো না। তারপর ত্রিস্তান গিয়ে ঘুমন্ত রানীর ম্যুখ চুম্বন করে তাকে জাগালো।
কিন্তু সেদিন সকালবেলা হরিণ শিকারে গিয়ে ত্রিস্তানের পায়ের গোড়ালির খনিকটা কেটে গিয়েছিল। এখন লাফাবার সময়ই সেই ক্ষত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়লো বারান্দায়। ত্রিস্তান টের পায়নি। ওদিকে রাজা গিয়ে মিলিত হলেন সেই চারজন অপেক্ষমাণ নাইটের সঙ্গে, একটু পরেই গণকঠাকুর কাজ সেরে এলো। তারপর মাটিতে খড়ির দাগ কেটে শুনতে শুনতে হঠাৎ উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলো, এইবার, এইবার এসেছে, চলুন, এখনই গিয়ে ধরতে হবে!
উন্মুক্ত তরবারি হাতে নাইট চারজন ছুটে এলো রাজার সঙ্গে সঙ্গে। ওদের আসার শব্দ পেয়েই ত্রিস্তান একলাপে ফিরে গেছে নিজের ঘরে। আবার ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়লো বারান্দায়। ত্রিস্তান জানে কোনো পায়ের ছাপ পড়েনি। সে মনে মনে হেসে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো।
রাজা এসে দেখলেন রক্তের দাগ। নাইট চারজন ঝাঁপিয়ে পড়ে চেপে ধরণো নিরস্ত্র ত্রিস্তান কে। তারপর বললো, এই দেখুন মহারাজ, ওর পায়ের কাটা ঘা, ওখান থেকে রক্তে পড়েছে। ময়দার ওপর দু’সারি রক্তের দাগ-তার মানে একবার এসেছে একবার গেছে। কি সাহস, আপনি একটু বেরিয়েছেন তার মধ্যেই। আর ঐ যে ও- ঘরে আপনার রানী পড়ে আছেন ঘুমের ভান করে, মনে হয় যেন সতী-সাধ্বী কিন্তু ওঁর পাপও সমান সমান।
রাজা ঘৃণায় মুখ নিচু করলেন। ত্রিস্তান শুধু বললো, না, রানীর কোনো দোষ নেই।
রাজা গভীর বিষাদের স্বরে বললেন, ত্রিস্তান, আর আমার সন্দেহ রইলো না। আমি তোমায় বিশ্বাস করেছিলুম, সেই বিশ্বাসের এই মূল্য দিলে তুমি? তুমি আমার প্রিয় ভগিনী শ্বেতপুষ্পার ছেলে কিন্তু তোমার মুখ দেখতেও আজ আমার ঘৃণা হচ্ছে। কাল সকাল বেলাতেই তোমাকে মরতে হবে।
ত্রিস্তান কাতরভাবে বলে উঠলো, মহারাজ দয়া করুন! দয়া-
—তোমার দয়ার কথা বলতে লজ্জা হয় না ত্রিস্তান?
—আমার জন্য দয়া নয়। আমি কি মরতে ভয় করি? তাহলে কি এই চারটে কাপুরুষকে আমার গায়ে হাত ছোঁয়াতে দিতাম? আমার জন্য দয়া নয়, রানীকে দয়া করুন। ওঁর কোনো পাপ নেই। এরা যে আমার নাম জড়িয়ে রানীকে অপবাদ দিতে চায়-আমি এদের প্রত্যেকের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে রাজী আছি। কিন্তু রানীর নামে এক কলঙ্ক বাইরে ছড়াবেন না।
রাজা দু’হাতে মুখ ঢেকে বললেন, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমি তাকাতে পারছি না এই অকৃতজ্ঞ পশুটার মুখের দিকে! ওঃ! কে কোথায় আছো, বেঁধে রাখো ওকে!
ত্রিস্তানকে হাত-পা বেঁধে রেখে ওরা চলে গেল। রানীরও নরম শরীর বাঁধলো শক্ত দড়ি দিয়ে। কাল সকালে ওদের দুজনেরই শাস্তি হবে।
দরা পড়েও ত্রিস্তান বেশি ভয় পায়নি। কারণ, আপনারা তো জানেন, সেকালে নিয়ম ছিল কোনো নাইটের নামে কেউ কোনো অভিযোগ আনলে, দুজনে রাজার সামনে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করে সেটা মিটিয়ে নিত। যুদ্ধে যে হারে সে-ই দোষী। ত্রিস্তান জানতো, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস হবে-এমন লোক সে রাজ্যে একজনও নেই। কিন্তু হায়, সে জানতো না পরের দিন বিনা বিচারেই তার মৃত্যুদণ্ড হবে। যদি জানতো, তবে কি সে ঐ কাপুরুষ চারজন নাইটের হাতে ধরা দিত? নিরস্ত অবস্থাতেও সে ওদের হত্যা করতে পারতো। হায় ত্রিস্তান! হায় সোনালি! দুজনে পড়ে রইলো দু’ঘরে হাত পা বাঁধা।