সোনালী দুঃখ – ৫

সমুদ্র পাড়ে রাজা মার্ক এসেছেন রানীকে অভ্যর্থনা জানাতে। পাশে নগরসুদ্ধু লোক। ত্রিস্তান রাজকন্যার হাত ধরে জাহাজ থেকে নামলো। তারপর সেই হাত সঁপে দিল রাজার হাতে। রাজা মার্ক বললেন, ধন্য সেই দোয়েল পাখি, যে আমাকে তোমার সোনালি চুল এনে দিয়েছিল। সেই চুল দেখে আমি তোমার সৌন্দর্য কল্পনা করেছিলুম। কিন্তু আমার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গেছো তুমি। আর ত্রিস্তান, তুমিও ধন্য। ধন্য তোমার সাহস আর বীরত্ব।

নগরবাসীরা জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলো। মহাসমারোহে রাজকুমারীকে নিয়ে আসা হলো টিন্টাজেল দুর্গে।

আঠারো দিনের দিন রাজা সোনালিকে বিয়ে করলেন! সে কি আনন্দ, সে কি উৎসব, সে কি প্রাচুর্য! শুধু তিনজনের মনে আনন্দ নেই। ত্রিস্তান আর সোনালি ছাড়াও আনন্দ নেই বিরজার মনে। ভয়ে তার বুক দুরুদুরু করছে। আজ ফুলশয্যার সময় রাজা যখন দেখবেন, তাঁর নতুন রানী কুমারী নয়, তাঁর কুমারীত্ব নষ্ট হয়ে গেছে, তখন কে বাঁচাবে রাজার ক্রোধ থেকে? রাজা তো সবাইকে মেরে ফেলবেন সেই মুহূর্তে! বিরজা সোনালির সঙ্গে এক পরামর্শ করলো। ফুলশয্যার রাত্রে সব উৎসবের শেষে যখন রাজার ঘরে আলো নিবে যাবে, তখন সোনালি একবার বেরিয়ে আসবেন ঘর থেকে- কোনো এক ছুতোয়, তারপর বিরজা নিজেই ঢুকবেন সোনালির পোশাক পরে। অন্ধকারে বিরজার সঙ্গে সোনালির তফাত বোঝা যাবে না।

ঠিকই সেই রকমই হলো। হুজুর, আপনারা ভেবে দেখুন, বিরজার আত্মত্যাগের মহত্ত্ব। নিজের সখীর সম্মান রাখার জন্য, বিরজা সেদিন নিজের কুমারীত্ব বিসর্জন দিল রাজার কাছে।

তারপর থেকে রাজকুমারী সোনালি হলেন রানী সোনালি। রাজ্যের সবাই তাঁকে ভালোবাসে। রাজা মার্ক তাঁকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। রাজা কত মণিমুক্তা, কত অলংকার দিলেন তাঁকে। নানান দেশ থেকে এলো দুষ্প্রাপ্য আভরণ। কিন্তু রানীর মনে শুধু এক চিন্তা কখন ত্রিস্তান কাছে আসবে। অলংকার, বস্ত্র, সুগন্ধি কিছুর প্রতিই তাঁর ভালোবাসা নেই, সব ভালোবাসা শুধু ত্রিস্তানের জন্য। দেখা হয় দুজনে গোপনে। ত্রিস্তান আগের মতোই শোয় রাজার পাশের ঘরে। মাঝরাত্রে ঘুমন্ত রাজার পাশ থেকে সোনালি আসে ত্রিস্তানের কাছে। দুজনে তখন বিশ্বসংসার ভুলে যায়। ভুলে যায় পাপ-পুণ্য, ভুলে যায় জীবন-মৃত্যুর কথা। দোষ কিংবা গুণ-আপনারা যাই বলুন, ভালোবাসা এই রকমই, সে আর সব কিছুকে আড়াল করে দেয়।

কিন্তু সব সময়েই দুজনের ভয়-কে কখন দেখে ফেলে। ভয় অথচ দুজনে না মিলিত হয়েও পারে না। ওদের মৃত্যুভয় নেই, ওদের শুধু আর দেখা-না হবার ভয়! মরবে জেনেও চুম্বকের পাহাড়ের গায়ে জাহাজ যেমন ধাক্কা মারে, ওরা সেই রকম ছুটে আসে দুজনে। আর সখী বিরজা সব সময় ওদের পাহারা দেয়। একমাত্র সে জানে ওদের গোপন মিলনের খবর।

কিন্তু ভালোবাসা কি গোপন থাকে? এই উন্মাদ, দুর্দান্ত ভালোবাসা যে মারী গুটিকার মতো সারা শরীরে ফুটে বেরোয়। ভালোবাসা যেন এক বিশাল বাজ পাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওদের ওপর। ওদের দেহ এই ভালোবাসার আক্রমণে ছিন্নভিন্ন। ভালোবাসা আলোর মতো শরীর ফুঁড়ে বেরোয়। ওদের শরীরে সেই ভালোবাসার দীপ। গোপন প্রেম, সে তো প্রেমিক-প্রেমিকার প্রতি কথাবার্তা, হাঁটা- বলা থেকেই ফুটে বেরোয়। তীব্র সুরার মতো ভালোবাসা মিশেছে ওদের শোণিতে, ওদের নেশাগ্রস্তের মতো দেখাবে না? কেউ ওদের আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় দেখে ফেলেনি, তবু লোকে ওদের সন্দেহ করতে লাগলো। যেন ওদের দুজনেরই শরীরে গোপন প্রেমের গন্ধ।

অন্তত সেই চারজন হিংসুটে নাইট। তারা তীব্র ঈর্ষা আর ক্রোধে জ্বলতে লাগলো। একদিন রাজাকে বলেই ফেললো, মহারাজ আপনি ত্রিস্তানকে বড় বেশি বিশ্বাস করেছেন। ও আপনার সর্বনাশ করবে। এখনো ওকে সরান! ও কী রানীকে জয় করে আনলো শুধু শুধু? লোকে যে এই নিয়ে নানা কথা বলছে। মহারাজ, ওকে বিশ্বাস করবেন না। আমরা জানি, ও রানীর প্রতি কুদৃষ্টি দিয়েছে।

শুনে রাজা ক্রোধে চিৎকার করে উঠলেন-ভীরু, কাপুরুষের দল! ত্রিস্তানকে বিশ্বাস করবো না তো কাকে বিশ্বাস করবো? যেদিন দানব মোরহল্ট এসে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছিল-সেদিন তোমাদের ম্যুখ কোথায় ছিল! সেদিন কে বাঁচিয়েছিল এ দেশের সম্মান? তোমরা তাকে হিংসা করো? কি শুনেছো, কি দেখছো তোমরা ত্রিস্তানের অবিশ্বাসের কাজ?

—কিছুই না। আপনি চোখ খুললে, কান খুললে তা দেখতে পাবেন, শুনতে পাবেন। সময় থাকতে সাবধান হোন মহারাজ!

রাজা তাদের দূর থেকে তাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু কথাটা রয়ে গেল তাঁর মনের মধ্যে। সব সময় খচখচ্ করতে লাগলো। বিষের ক্রিয়া শুরু হয়ে গেল রাজার মধ্যে। ঈর্ষা জিনিসটা এমন-তা যে কি অবলম্বন করে কখন বেড়ে ওঠে কেউ জানে না। ত্রিস্তানকে সন্দেহ করতে রাজার নিজেরই মন ছি ছি করে ওঠে। আর ঐ ফুলের মতো পবিত্র রানী, তাকে কখনও সন্দেহ করা যায়? তবু রাজার মন ঘুরে-ফিরে ও- কথাই ভাবে। তাঁর মনের মধ্যে কাঁটা গেঁথে গেল। রাজা গোপনে নজর রাখতে লাগলেন ওদের দুজনের ওপর। বিরজা কিন্তু রাজার মনের অবস্থা টের পেয়ে ওদের সাবধান করে দিল

রাজা একদিন ত্রিস্তানকে ডাকলেন। মুখ নিচু করে গম্ভীরভাবে বললেন, ত্রিস্তান, তুমি রাজবাড়ি ছেড়ে চলে যাও। আমি কোনো কারণ দেখাতে পারবো না। তোমাকে বিদায় দিতে বুক ফেটে যায়। কিন্তু নিন্দুকরা তোমার সম্বন্ধে খারাপ কথা বলছে। সে এমন কথা, যা আমি মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারবো না। আমি জানি সে কথা মিথ্যে। তবু, আমার মনে সে কথা গেঁথে যাচ্ছে। তুমি যাও। আমার মন শান্ত হলে আবার তোমাকে ডাকবো। তুমি যাও! ত্রিস্তান, আমায় ক্ষমা করো। তুমি এখনো আমার প্রাণের মতো প্ৰিয়।

ত্রিস্তান একটি কথাও না বলে বেরিয়ে এলো। কিন্তু কতদূর যাবে? চুম্বকের পাহাড়ের সঙ্গে যে সে বাঁধা! শহর ছেড়ে একটু বাইরে সে গুরু গরভেনালের সঙ্গে একটা ছোট্ট বাড়ি ভাড়া করে রইলো। কয়েকদিন পরই পড়লো অসুখে। গুরু গরভেনাল অনেক সেবা করলেন। কিন্তু এ অসুখ সারবে কিসে! শায়িত ত্রিস্তানের আত্মা বারবার উড়ে গিয়ে আঘাত করতে লাগলো দুর্গের দরজায়।

ওদিকে রানীর অসুখ। কিন্তু এ অসুখ আরও মারাত্মক। রানীকে বাইরে অসুখী থাকলে চলে না, মুখে হাসি ফোটাতে হয়। প্রতিদিন শুতে হয় রাজার সঙ্গে এক শয্যায়। তিনি স্বপ্ন দেখেন, তিনি ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছেন ত্রিস্তানের কাছে। প্রহরীরা তার ডানা কেটে দির। সমস্ত রাজপুরীতে রানীর রক্ত। সে রক্ত চোখে দেখা যায় না।

প্রেমিক-প্রেমিকা দুজন হয়তো মরেই যেতো। কিন্তু সখী বিরজা উপায় বার করলো। সে খুঁজতে খুঁজতে এলো ত্রিস্তানের বাড়িতে। এবং গোপন মিলনের পথ বলে দিল।

দুর্গের পিছন দিকে বাগানের শেষ প্রান্তে নানা রঙের ফুলগাছ আর আঙুর লতার ঝোপ। একটা লম্বা পাইন গাছ সেখানে দাঁড়িয়ে। তার নিচ দিয়ে ঝরনা চলে এসেছে। সেই ঝরনাটা বয়ে এসেছে একেবারে রাজপুরীর মধ্যে, রানীর স্নানের ঘরে। ত্রিস্তান রাত্রিবেলা লুকিয়ে সেই ফুলগাছের ঝোপে দাঁড়িয়ে ঝরনার জলে একটা গোপাল ফুল ফেলে দেবে। ফুলটা ভাসতে ভাসতে রানীর স্নানের ঘরে গেলে, রানী বুঝতে পারবেন ত্রিস্তানের সঙ্কেত। তখন তিনিও চুপিচুপি বেরিয়ে আসবেন বাগানে পাইন গাছের নিচে।

প্রত্যেক সন্ধেবেলা ত্রিস্তান গিয়ে সেই ঝোপে লুকিয়ে ঝরনার জলে গোলাপ ফুল ফেলে দেয়। রাজা তখন রাজকার্যে ব্যস্ত। রানী সোনালি গোপনে এসে মিলিত হন। রানীর আসার সময় প্রতি মুহূর্তে ভয়, প্রতি মুহূর্তে সতর্কতা। তারপর একবার ত্রিস্তানের আলিঙ্গনের মধ্যে এলে আর কোনো ভয় থাকে না। সেই আলিঙ্গনের মধ্যেই যে সমস্ত বিশ্ব।

একদিন রাত্রে সোনালি বললেন, ত্রিস্তান, আমরা কোথায় বসে আছি? আমি গল্প শুনেছি এই দুর্গটা পরীরা তৈরি করেছে। বছরে দু’বার এই দুর্গটা অদৃশ্য হয়ে যায। আজ সেই অদৃশ্য হবার দিন। আজ দুর্গ নেই, প্রহরী নেই, রাজা নেই, নেই কোনো সতর্ক চোখ। আমরা বসে আছি এক মায়া কাননে, এই গাছ এই ফুলের গন্ধ, এই জ্যোৎস্না-সবাই আমাদের বন্ধু। আজ আমরা এখানে সারারাত থাকবো।

ঠিক তখনই দুর্গের ফটকে ন’টার ঘণ্টা বাজলো।

ত্রিস্তান বললো, না সোনালি, এ সেই মায়া কানন নয়, এ দুর্গ অদৃশ্য হয়ে যায়নি। তবে, একদিন আমরা এক অপরূপ দেশে যাবো, যেখান থেকে কেউ ফেরে না। সেখানে আছে এক সাদা পাথরের দুর্গ, তার এক হাজারটা জানলার প্রত্যেকটিতে আলো জ্বলে, প্রত্যেক ঘরে সুর ভেসে বেড়ায়, সেখানে সূর্য ওঠে না কিন্তু আলোর অভাবে কেউ অনুতাপ করে না। সেই চিরসুখের দেশে একদিন আমরা দুজনে চলে যাবো, চিরকাল থাকবো এক সঙ্গে। এখন এক নিষ্ঠুর, বাস্তব দুর্গে তুমি ফিরে যাও।

সোনালি ফিরে পেয়েছেন তাঁর আনন্দ। রাজা মার্কের মন থেকে মুছে গেছে সন্দেহের কুয়াশা। কিন্তু সেই হিংসুকরা নিবৃত্ত হয়নি। রানীকে দেখে তখনও তাদের সন্দেহ হয়। এখনও কেন রানীর সর্ব অঙ্গে সুখের শিহরণ? অথচ কিছুই ধরতে পারছে না!

তখন তারা একজন গণৎকারের কাছে গেল। এই গণৎকারটি মাটিতে খড়ির দাগ কেটে অনেক কিছু বলতে পারে। লোকটি দেখতে যেমন কুৎসিত, তেমনি লোভী। সব শুনে সেই লোকটা আনন্দে নেচে উঠলো। সে কুৎসিত বলেই কোনো সুন্দর জিনিস সহ্য করতে পারে না। ত্রিস্তান আর সোনালির প্রেমের কথা শুনে সে খলখল করে হেসে উঠলো। ওর নিজেরই গরজ হলো ওদের নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দেবার। সে খড়ির দাগ কেটে বললো, আপনারা আজই তো ওদের ধরতে পারবেন!

সকলে মিলে এলো রাজার কাছে। বললো, মহারাজ, এবার হাতে হাতে প্রমাণ দিয়ে দিচ্ছি, ত্রিস্তান কতখানি অবিশ্বাসী! আপনি আজই ঘোষণা করে দিন, সাতদিনের জন্য আপনি শিকারে যাচ্ছেন। সেই মতো সৈন্যসামন্ত, শিকারের সরঞ্জাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। তারপর একা গোপনে ফিরে এসে, আপনি লুকিয়ে উঠে বসে থাকুন বাগানের উঁচু পাইন গাছে। দেখবেন, সেখানে ওদের কাণ্ডকারখানা!

শুনে রাজার ঘৃণা হলো ওদের কথায়। কিন্তু উড়িয়ে দিতেও পারলেন না। প্রেমের ঈর্ষা এমনই আশ্চর্য বস্তু, যে তা পরম মহৎ লোকেরও হৃদয় কুরে খেতে পারে! রাজা মুখে বললেন, তোমরা দূর হয়ে যাও, কুকুরের দল! কিন্তু সেদিন সন্ধ্যাবেলা, গোপনে রাজা উঠে বসে রইলেন পাইন গাছে।

সেই রাতে জ্যোৎস্নায় চারিদিক সাদা হয়ে গেছে। দিনের আলোর মতো ফট্‌ফট্ করছে জ্যোৎস্না। ত্রিস্তান পাঁচিল ডিঙিয়ে লাফ দিয়ে এলো ঝোপের মধ্যে। তারপর নিচু হয়ে ঝরনার জলে গোলাপ ফুল ফেলে দিলো। কিন্তু ফুলটা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ঝরনার জলে দেখলো মানুষের ছায়া, ছায়ার মাথায় রাজমুকুট। ত্রিস্তানভয়ে কেঁপে উঠলো। বুঝতে পারলো, গাছের ওপর বসা কার ছায়া পড়েছে জলে। কিন্তু ততক্ষণে ফুল ভেসে গেছে। সোনালিকে যে আর ফেবারার উপায় নেই! ঈশ্বর ওদের রক্ষা করুন!

আর ত্রিস্তানের পালাবারও উপায় নেই! কারণ রানী তো আসবেনই। দূর থেকে দেখা গেল রানী আসছেন। ত্রিস্তান পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। একটুও সাড়া-শব্দ করলো না, হাত তুলে ইশারা করলো না। রানী ভাবলেন, আজ কি হলো ত্রিস্তানের, সে তো আমার দিকে ছুটে আসছে না। তবে কি ওর শরীর অসুস্থ? অথবা কোনো শত্রুকে দেখতে পেয়েছে? রানী একটু দূরে থমকে দাঁড়ালেন। তাকিয়ে রইলেন ত্রিস্তানের দিকে। তবু ত্রিস্তানের শরীর নিস্পন্দ। এবার রানী জিগ্যোস করলেন, কে ওখানে? কোনা সাড়া এলো না! এবার স্পষ্ট সন্দেহ করে, রানী সোনালি অনুচ্চ স্বরে বললেন, তুমি যদি ত্রিস্তান হও, তবে তুমি কোন সাহসে এতো রাত্তিতে আমাকে ডেকোছো? তুমি অনেকবার আমাকে ডেকোছো, আমি আসিনি। কিন্তু, তুমিই আমাকে জয় করে এনে এ রাজ্যের রানী করে সুখী করেছো। তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা আছে। বলো, তুমি কি বলতে চাও আজ?

রানীর কথা শুনে ত্রিস্তান মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালো। একটু আগেই সে শুনেছে গাছের ওপর খুব মৃদু একটা শব্দ। অর্থাৎ রাজা ধনুকে বাণ পরিয়েছেন। যে কোনো মুহূর্তে বাণ এসে বুকে বিঁধতে পারে। কিন্তু ভয় পেল না সে। করুণ গলায় ত্রিস্তান বললো, রানী, আপনি একবার আমার হয়ে রাজাকে অনুরোধ করুন। আপনাকে এই জন্যই বারবার খবর পাঠিয়েছি, আপনি আসেননি। কিন্তু, আপনি আমাকে দয়া করুন। রাজা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন আমি জানি না কেন! কিন্তু রাজাকে ছেড়ে থাকতে আমার মন কাঁদে। রানী, আপনার দয়ার প্রাণ, আপনি আমার হয়ে রাজাকে একটু বুঝিয়ে বলুন। আমার কি দোষ?

কান্নায় তখন সোনালির শরীর কাঁপছে। তবু তিনি সখেদ গলার বললেন, ত্রিস্তান, এ কি দুর্বুদ্ধি তোমার! এই কি প্রার্থনা জানাবার সময়! আমি জানি তুমি নির্দোষ! কিন্তু রাজা তোমাকে সন্দহ করেন- সে যে কি সন্দেহ আমি মুখ ফুটে বলতে পারব না! রাজা হয়তো আমাকেও সন্দেহ করেন। ঈশ্বর সাক্ষী আছেন, কুমারী অবস্থায় যার বাহুতে আমি প্রথম ধরা দিয়েছি, তাকে ছাড়া আর কারুকে আমি ভালোবাসি না! তোমার জন্যে রাজার কাছে দয়া ভিক্ষা করলে যে রাজা আমাকে আরও সন্দেহ করবেন! বিশেষত, এত রাত্রে আমি তোমার কাছে এসেছি, তিনি জানতে পারলে, আমাকে পুড়িয়ে তিনি আমার ছাই বাতাসে উড়িয়ে দেবেন।

ত্রিস্তান যেন আরও ভেঙে পড়ে বললো, রাজা, তুমি কেন আমায় সন্দেহ করলে? আমার অপরাধের কি প্রামণ পেয়েছো তুমি?

রানী বললেন, না ত্রিস্তান, রাজা মার্ক উদার, তিনি নিজে থেকে এমন নিচ সন্দেহ করতেই পারেন না। দুষ্ট লোকেরা রাজার মন বিষিয়ে দিয়েছে। রাজা তো এমন ছিলেন না! কিন্তু আমি আর থাকতে পারছি না, আমি যাই। ত্রিস্তান তোমার দুর্ভাগ্য, মিথ্যে সন্দেহে রাজা তোমার মতো বন্ধুকে ত্যাগ করলেন। রাজারও দুর্ভাগ্য!

—তবে তাই হোক, আমি এ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবো। রানী, আপনি শুধু রাজাকে বলুন, যেন আমি সসম্মানে চলে যেতে পারি। যাবার আগে রাজা যেন আমাকে তাঁর আশীর্বাদ দিয়ে বিদায় করেন। নইলে দেশ-বিদেশে যে আমার নামে কলঙ্ক রটে যাবে।

—না ত্রিস্তান, আমি কোনো অনুরোধই করতে পারবো না তোমার হয়ে। যদি রাজার কাছে তোমার নাম উচ্চারণ করলেই তিনি রেগে ওঠেন? এ দেশে আমি একা, রাজা ছাড়া আর কারুকে আমি নির্ভর করতে পারি না। তিনি নির্দয় হলেও আমাকে তা সহ্য করতে হবে। তুমি যাও ত্রিস্তান, একাই চলে যাও এ রাজ্য ছেড়ে গোপনে রাজা তোমাকে ক্ষমা না করলেও ঈশ্বর তোমাকে সাহায্য করবেন।

এই কথা বলে রানী ফিরে গেলেন! ত্রিস্তান আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো, তাকিয়ে দেখলো, দূরে রানীর ঘরের জানলায় আলো জ্বলে উঠেছে। তখন ত্রিস্তান সরবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আপন মনেই বললো, আমি তোমার জন্যে বারবার জীবন বিপন্ন করেছি, আর তুমি তার এই প্রতিদিন দিলে? আচ্ছা, আমি এ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি!

ত্রিস্তান চলে যেতে, রাজা গাছ থেকে নেমে এলেন। মৃদু হাস্য করে বললেন, কি সৌভাগ্য যে আজ এখানে এসেছিলাম। সব ভুল ভেঙে গেল। না ত্রিস্তান, তোমার অন্য দেশে যাওয়া হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *