৪
তারপর রানী বিরজাকে আলাদা ডেকে বললেন, বিরজা, তোর ওপরেই ভার দিলুম ওকে দেখাশোনা করার। তুই ছেলেবেলা থেকে ওর সঙ্গে আছিস। তোকে ছাড়া ও বাঁচবে না। আর এই নে এই কলসীটা। এটা খুব গোপনে রাখবি। খুব সাবধান। এতে আছে মন্ত্রপূত আরক। বিয়ের দিন এই আরক তুই রাজা মার্ক আর সোনালিকে দিবি। দুজন নারী পুরুষ যদি পাশাপাশি বসে এই আরক খায়, তবে তারা সারাজীবন পরস্পরকে ভালোবাসবে। ওদের বালোবাসা আর মৃত্যু এক সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। দুজনের প্রত্যেক মুহূর্ত, প্রত্যেক নিশ্বাস মিলে যাবে এক ভালোবাসায়, এক মৃত্যুতে। দেখিস, খুব সাবধান। সাবধানে লুকিয়ে রাখিস কলসীটা।
আয়ার্ল্যান্ডের লোক চোখের জলে বিদায় দিল ওদের। জাহাজ সমুদ্রে ভাসলো। অকূল সমুদ্র, এ জাহাজ চলেছে কোন অচেনা দেশে, এ কথা ভেবে রাজকুমারী বিরজার সঙ্গে বসে কাঁদেন। ত্রিস্তানকে তিনি দু’ চোখে দেখতে পারেন না। ত্রিস্তান কাছে এলে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেন্। এই লোকটা তার জীবনে এলো কোন শনিগ্রহ হয়ে। এ খুন করলো মোরহল্টকে, বাবা মায়ের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে এনে এখন তুলে দেবে কোন অচেনা লোকের হাতে। অথচ, এই লোককেই তিনি দু’ দু’বার বাঁচিয়েছে। সমুদ্র, তুমি এ পাপ সহ্য করছো? ঝড় তুলে বরং তুমি আমায় ডুবিয়ে মারো! এ অপমান আমার আর সহ্য হয় না!
একদিন সমুদ্রে একটুও হাওয়া নেই। পাল তোলা জাহাজ হাওয়া ছাড়া চলে না। জাহাজের সব সৈন্যরা কাছাকাছি একটা দ্বীপে নেমে গেল বনভোজন করতে। রাজকুমারী কিছুতেই যাবেন না। সৈন্যরা তখন অনেক অনুনয় করে বিরজাকে টেনে নিয়ে গেল। ত্রিস্তান একা রইলো সোনালিকে পাহারা দিতে।
ত্রিস্তান কাছে এসে বললো, রাজকুমারী, আমার ওপর রাগ করো না।
সোনালি বললেন, তুমি দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। নইলে আমি জলে ঝাঁপ দেবো!
ত্রিস্তান দূরে সরে গেল। দাঁড়িয়ে রইলো একা।
ত্রিস্তান একা জাহাজের রেলিং-এ ভর দিয়ে ভাবে, রাজকুমারী কেন তাকে ভুল বুঝলো? সে যা কিছু করেছে, সবই তো কর্তব্যের জন্য। রাজার কাছে শপথ রক্ষার জন্য! কিন্তু তার নিজের মনও ঠিক মানতে চায় না। বাইরে উদাসভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার বুক টনটন করে ওঠে। বারবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় রাজকুমারীর দিকে। তার বড় ইচ্ছে করে, রাজকুমারী সোনালির পাশে গিয়ে বসতে, তার সুন্দর মুখ থেকে দু’একটা কথা শুনতে। যত সামান্য কথাই হোক না।
ঐ যে ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটা বাহুতে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে, ছড়িয়ে পড়ছে একমাথা সোনার রেশমের মতো চুল-ওর ঐ শরীরে কি মায়া লুকানো আছে-যা তাকে টানছে বারবার। অন্য কোনো কাজে তার আর মন নেই-এই নির্জন জাহাজে ত্রিস্তানের সমস্ত মনপ্রাণ ঐ মেয়েটির দিকে। অথচ ওর কাছে যেতে পারছে না।
ত্রিস্তান এতদিন কোনো মেয়ের সংস্পর্শে আসেনি। মেয়েদের কথা কখনও তার তেমন করে মনেই পড়েনি। সোনালিই একমাত্র মেয়ে অসুস্থ অবস্থায় ত্রিস্তান যার স্পর্শ পেয়েছে। ত্রিস্তান সারা শরীর দিয়ে অনুভব করতে লাগলো সেই স্পর্শ। এরকম অনুভব তার জীবনে আগে কখনও হয়নি। একা দাঁড়িয়ে ত্রিস্তান ছট্ফট্ করতে লাগলো। অতবড় বীরপুরুষ সে, কিন্তু রাজকুমারীর কাছে যেতে আজ তার ভয় হচ্ছে। জোর করে কাছে গেলে কি যেন একটা ভেঙে যাবে। কি যেন একটা সে সারা জীবনের মতো হারাবে। মেয়েদের সম্পর্কে তার তেমন কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। তবু কেমন করে যেন জেনে গেছে- জোর করে মেয়েদের কাছ থেকে কিছুই আদায় করা যায় না।
প্রভুগণ, আপনারা বুঝতে পারছেন ত্রিস্তানের অবস্থা? এতদিন তার শরীর বৃদ্ধি পেলেও সে ছিল বালক। বালক স্বভাবের লোকেরাই যুদ্ধবিগ্রহ বেশি ভালোবাসে। এতদিনে, আজ ত্রিস্তান পূর্ণবয়স্ক হয়ে উঠলো। সে বুঝতে পারলো, সে কোনো যুদ্ধেই জেতেনি। জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সে এখনও পায়নি।
খানিকক্ষণ পর রাজকুমারী চেঁচিয়ে উঠলেন, ওঃ, আমার তেষ্টা পেয়েছে। কেউ আমাকে একটা শরবত বা সুরা দিতে পারে না! কেউ নেই এখানে?
জাহাজে আর কেউ নেই, ত্রিস্তান ছুটে এসে বললো, আমি দিচ্ছি! বিষম ব্যস্ত হয়ে খোঁজাখুঁজি করতে ত্রিস্তান কিছুই পায় না। হঠাৎ চোখে পড়লো বিরজার সেই লুকোনো কলসী। কি চমৎকার টলটলে আঙুরের মদ তার মধ্যে। একটা বড় গেলাসে ঢেলে রাজকুমারীকে দিল। সোনালি প্রথমে ইতস্তত করতে লাগলেন। এই অকৃতজ্ঞ, বিবেকহীন লোকটার হাত থেকে নিয়ে তিনি পান করবেন? না। সোনালি মুখ ফিরিয়ে রইলো।
ত্রিস্তান অনুনয় করে বললো, রাজকুমারী, আমায় ক্ষমা করো। আমি সামান্য ভৃত্য, আমার হাত থেকে পান করতেও তোমার ঘৃণা?
তৃষ্ণায় রাজকুমারীর বুক ছটফট করছে। ত্রিস্তানের দিকে না তাকিয়ে অবহেলাভরে গ্লাসটা নিলেন। এক চুমুকে অনেকটা খেয়ে গেলাসটা ফিরিয়ে দিতেই ত্রিস্তান নিজে বাকিটুকু খেয়ে ফেললো। তারপর দুজনে সম্পূর্ণভাবে তাকালো দুজনের দিকে।
তারা কি পান করলো। এ তো সুরা নয়, এ যে তীব্র কামনা আর আনন্দ, এ যে অন্তহনি আকর্ষণ আর ছটফটানি! এ যে মৃত্যু।
সখী বিরজা ফিরে এসে দেখে, নিঃশ্ব দুটি পাথরের মূর্তির মতো ওরা পরস্পরের দিকে চেয়ে বসে আছে। যেন জোর করে ওদের কেউ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে তার নজর পড়লো সেই শূন্য কলসীর দিকে। হায় হায় করে উঠলো বিরজা। একি, এর আগে কেন আমার মরণ হলো না! এ আমি কি পাপ করলুম! সখী সোনালি, হতভাগ্য ত্রিস্তান, এ তোমরা কি কাজ করেছো! বিশ্বাসঘাতকতা! এ যে সর্বনেশে ভালোবাসা, এ যে মৃত্যু!
জাহাজ আবার চললো, কিন্তু ত্রিস্তান এখন অন্য মানুষ। ত্রিস্তানের মনে হলো, তার রক্তের মধ্যে যেন শিকড় ফুটিয়েছে একটা ফুলগাছ, তার তীব্র গন্ধ-ফুল ফুটে উঠেছে তার শরীরে। এক মুহূর্ত তার স্বস্তি নেই, বারবার ছুটে যেতে ইচ্ছে আর একটা ফুলগাছের কাছে। যে ফুলগাছ রয়েছে সোনালির শরীরে। ত্রিস্তান আর্তকণ্ঠে গুমরে উঠলো, ঠিকই বলেছিল সেই চারজন নাইট। আমি বিশ্বাসঘাতক। রাজা মার্ক তুমি অসহায় অবস্থায় আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলে, আজ আমি তোমার বিশ্বাসঘাতক! রাজা, সোনালি তো তোমারই, আমি তোমার অনুচর মাত্র। সোনালি তোমারই, আমি তোমার পুত্রতুল্য। সোনালি তোমার, সে আমাকে ভালোবাসবে কেন?
কিন্তু কোথায় গেল সোনালির ঘৃণা! তার সমস্ত রক্তে ত্রিস্তানের নাম! এ নাম যেন একটা নতুন সুর। সমুদ্র এই নাম বলে, বাতাস এই নাম বলে, সোনালির রক্ত এই নাম বলে। দুঃখ, দুঃখ, দুঃখ তুমি ত্রিস্তান, তুমিই আমার সুখ।
বিরজা দূর থেকে ওদের দুজনকে লক্ষ করে অনুতাপে দগ্ধ হতে লাগলো।
দু’দিন ত্রিস্তান বসে রইল নিজের ঘরে। তৃতীয় দিন আর পারলো না, এগিয়ে এলো সোনালির দিকে। সোনালি মাটিতে বসে ছিলেন, ত্রিস্তানকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এসো ত্রিস্তান, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? তুমি কেন আমাকে একা ফেলে রেখে কষ্ট দিচ্ছো?
—না, না, তুমি রানী, তুমি অমন করে আমাকে ডেকো না! তুমি আমার প্রভুপত্নী, আমি তোমাদের অনুচর মাত্র।
—আমি আর কিছুই জানি না ত্রিস্তান, তুমিই আমার প্রভু, আমি তোমার দাসী। ওঃ মুমূর্ষু বীণাবাদক হয়ে যেদিন এসেছিলে, সেদিন তোমার ক্ষতস্থানে কেন আমি ওষুধের বদলে বিষ দিইনি! ড্রাগনকে মারার পর যখন ঝোপের মধ্যে পড়েছিলে—কেন আমি তুলে এনেছিলাম! এখন যে আমার উপায় নেই! আমি যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি।
—কিসের যন্ত্রণা তোমার রানী?
—জানি না। জানি না। আকাশ আমায় যন্ত্রণা দিচ্ছে। সমুদ্র আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। আমার শরীর, আমার জীবন আমাকে যন্ত্রণায় পুড়িয়ে মারছে।
সোনালি কাছে এগিয়ে ত্রিস্তানের দুই কাঁধে হাত রাখলেন। তাঁর শরীর, তাঁর চোখ, ওষ্ঠ থরথর করে কাঁপছে। ত্রিস্তান আবার জিগ্যেস করলো মৃদু স্বরে, কি তোমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে, রানী?
—তুমি! তুমি! আমার ভালোবাসা! তুমি আমাকে বাঁচাও!
ত্রিস্তান সোনালির ওষ্ঠে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো। দুজনে গভীরভাবে তাকালো দুজনের দিকে। তারপর পূর্ণ আলিঙ্গন করে দুজনে ডুবিয়ে দিল দুজনের ওষ্ঠাধর।
বিরজা হাত বাড়িয়ে ছুটে এসে বললো, থামো, থামো, এখনও থামো। এ কোন সর্বনাশের পথে চলেছো, আর যে ফিরতে পারবে না। এ ভালোবাসা যে তোমাকে দুঃখ দিয়ে মারবে! ত্রিস্তান এখনও সরে যাও, অনেক দুঃখ সইতে হবে তোমায়।
ত্রিস্তান ম্লান হেসে বললো, দুঃখ আমার ভয় নেই! আমার নাম দুঃখ, আমার জন্ম দুঃখের দিনে, দুঃখকে আমার ভয় নেই।
—কিন্তু এ দুঃখ যে তোমাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাবে।
—তবে আসুক মৃত্যু!
একথা বলে ত্রিস্তান সোনালিকে আবার চুম্বন করলো। তারপর মাটিতে বসে পড়ে সোনালির পায়ে চুমু খেলো। সোনালি দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে, ত্রিস্তানের করতলে তাঁর চম্পক বর্ণ মুখখানি ঢাকলেন। ত্রিস্তানের শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে বললেন, আমি জানতাম, তুমি আমার নিয়তি! পাশেই সোনালির বিছানা। সেদিকে তাকিয়ে ত্রিস্তান সোনালিকে বললো, এসো! সোনালি নিজেই হাত ধরে ত্রিস্তানকে নিয়ে এলেন বিছানায়। তারপর দৃঢ়ভাবে ত্রিস্তানকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমরা দুজনে দুজনের জন্য মরবো। এসো আমরা আজ সেই মৃত্যুকে ভোগ করি।