সোনালী দুঃখ – ১৫

১৫

ত্রিস্তান আবার ফিরে চলেছে ব্রিটানিতে। ধীর মন্থন তার পদক্ষেপ। যেন সে জানে না, কেন সে আবার ফিরে যাচ্ছে কাহারডিনের রাজ্যে, রুপালির রাজ্যে। যেন সে জানে না, কেনই বা সে গিয়েছিল সোনালির কাছে।

বন পেরুলেই দুর্গ। বনের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় একটি সুদর্শন তরুণ অশ্বারোহীর সঙ্গে দেখা হলো তার। যুবকটির বয়স আঠারো-উনিশ। সশস্ত্র। যুবকটি বললো, সেও ব্রিটানিতে যাচ্ছে। বীর ত্রিস্তানের খোঁজ করতে।

ত্রিস্তান মৃদু হেসে জিগ্যেস করলো, বালক, ত্রিস্তানকে তোমার কি দরকার

—তার সঙ্গে আমার বিশেষ প্রয়োজন!

ত্রিস্তান বললো, তুমি আমাকেই সে প্রয়োজনের কথা বলতে পারো। আমিই ত্রিস্তান।

যুবকটি সন্দেহের চোখে তাকালো। এমন ছিন্নভিন্ন পরিচ্ছদ, অদ্ভুত চেহারা, এই নাকি বিখ্যাত ত্রিস্তান? সে বললো, যাও, তা কখনো হয়। ত্রিস্তান তো অভিজাত রাজপুরুষ!

ত্রিস্তান বললো, আমার কেন এ চেহারা সে অনেক গল্প। কিন্তু আমিই যে ত্রিস্তান—তাতে সন্দেহ নেই। আমার মাথা এখনো সম্পূর্ণ খারাপ হয়নি। বলো, কি তোমার প্রয়োজন?

যুবকটি কর্কশ কণ্ঠে তখন বললো, যদি তুমি ত্রিস্তান হও, তবে যুদ্ধের জন্য তৈরি হও! তোমার সঙ্গে আমার হিসেব মেটাতে হবে!

—কিসের হিসেব?

—আমার বাবার নাম মর্গান। তিনি লিওনেস রাজ্য জয় করেছিলেন। তারপর লিওনেসের ত্রিস্তান তাঁকে খুন করে। আমি এসেছি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে।

ত্রিস্তান হেসে বললো, প্রতিশোধ? এই আমি হাত তুলছি, আমায় মারো।

মর্গানের ছেলে ঘৃণায় মুখ কুঁচকে বললে, আমরা ক্ষত্রিয়, বিনা যুদ্ধে কারুকে হত্যা করি না। এসো যুদ্ধ করো।

ত্রিস্তান বিরক্তির সঙ্গে বললো, না, না, না, আমি আর যুদ্ধ করতে চাই না! ঢের যুদ্ধ করেছি। ঢের মানুষ মেরেছি। আর না, এবার আমি নিজে মরতে চাই। তোমার বাবাকে আমি মেরেছিলাম-আমার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে। তুমি এসেছো আমাকে মেরে তোমার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবে! আবার, আমার যদি কোনো সন্তান থাকে-সে যাবে তোমাকে মারতে। এই কি চলবে চিরকাল? এই পরপর প্রতিশোধ? কোনোদিন থামবে না? তোমাকে আমি বলিছ, আমার কোনো সন্তান নেই। তুমি আমাকে মেরে রেখে যাও। এখানেই শেষ হোক-এই প্রতিশোধের পালাবদলের!

যুবক বললো, তুমি কেন আমাকে অপমান করছো? বিনা যুদ্ধে আমি মারবো না! তোমার অস্ত্র নেই, এই নাও তলোয়ার। তৈরি হও!

ত্রিস্তান ম্লান হেসে বললো, ঐখানেই তো তোমার বিপদ। যুদ্ধে আমার মরণ নেই। যুদ্ধে আমি হারতে জানি না বিশ্বাস করো, আমি অহংকার করছি না, আমি আজ পর্যন্ত কোনো যুদ্ধে হারিনি, সেই আমার দোষ! তুমি আমাকে এমনি মারো!

যুবকটি ক্রুদ্ধভাবে একটি তলোয়ার তুলে দিল ত্রিস্তানের হাতে। নিজে আর একটি তলোয়ার নিয়ে দূরে সরে তৈরি হয়ে দাঁড়ালো। ত্রিস্তান তলোয়ার হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কি যেন এক গুরুভাব উদাসীনতা ভর করেছে তাকে। যুবকটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। এ যেন তারই বালক বয়সের প্রতিমূর্তি। একে মেরে কি হবে!

যুবকটি উত্তেজিত হয়ে বারবার লড়াইয়ের জন্য ত্রিস্তানকে আহ্বান করতে লাগলো। তারপর আর থাকতে না পেরে নিজের তলোয়ারটা ছুঁড়ে মারলো ত্রিস্তানের দিকে। তলোয়ারটা গভীরভাবে বিদ্ধ হয়ে গেল ত্রিস্তানের দক্ষিণ বাহুতে। বিদ্ধ হয়ে সেখানেই ঝুলে রইলো। তখন চোখ জ্বলে উঠলো ত্রিস্তানের। তীব্র স্বরে বললো, এই বুঝি এখানকার যুদ্ধের নিয়ম? এসো খোকা, তোমার যুদ্ধের সাধ মিটিয়ে দিচ্ছি।

বাহু থেকে নিজেই টান মেরে বার করে আনলো তলোয়ারটা। আবার সেটা ছুঁড়ে দিল ছেলেটির দিকে। রক্তে ত্রিস্তানের হাত ভেসে যাচ্ছে। বাঁ হাতে তলোয়ার ধরে ত্রিস্তান এগিয়ে গেল ছেলেটির কাছে।

অল্প একটুক্ষণ যুদ্ধ চললো। তার মধ্যেই ত্রিস্তান নিরস্ত করলো যুবকটিকে। ক্রোধে যন্ত্রণায় সে তাকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র তুললো। কিন্তু মারতে গিয়েও মারলো না, ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে। তারপর বললো, না থাক্। বালক, তোমার বয়স কম-তোমার সামনে দীর্ঘ জীবন পড়ে আছে উপভোগের, আনন্দের। আমার আর মরলেই বা কি ক্ষতি! ত্রিস্তান নিজের তলোয়ারও দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। যুবকটি চেঁচিয়ে উঠলো, না, আমাকে অপমান করে যেও না। আমাকে মেরে রেখে যাও!

ত্রিস্তান বললো, নাঃ! আমি আর অস্ত্র হাতে নেবো না। আমি পিছন ফিরে চলে যাচ্ছি। তুমি ইচ্ছে হলে পিছন থেকে আমাকে খুন করতে পারো!

এই বলে ত্রিস্তান আবার হাঁটতে আরম্ভ করলো। তখন যুবকটি অনুতপ্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো, ত্রিস্তান, আমি আগেই একটা মহা অন্যায় করেছি! আমার তলোয়ারে বিষ মাখানো ছিল! মৃত্যু তোমার হবেই!

ত্রিস্তান একটু থমকে দাঁড়ালো। তারপর অদ্ভুতভাবে হেসে পিছনে তাকিয়ে বললো, মৃত্যু আর কি এমন বেশি কথা! মৃত্যু এখন আমার প্রাপ্য।

ত্রিস্তান যখন দুর্গে এসে পৌঁছুলো-তার সর্বাঙ্গ বিষে জরজর। কাহারডিন এবং সকলেই ত্রিস্তানের জন্য বিষম উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন। কোথায় ত্রিস্তানের ফিরে আসার জন্য উৎসব করবে, তার বদলে হাহাকার পড়ে গেল। ত্রিস্তানের চিকিৎসার জন্য প্রাণপণে আয়োজন করতে লাগলো। রাজকুমারী রুপালি এসে সেবা করার জন্য বসলেন স্বামীর পাশে। রুপালি স্বামী সম্ভোগের সুখ পাননি, স্বামীকে সেবা করার সুখটুকু অন্তত পেতে চাইলেন। কি অদ্ভুত ধরনের স্বামী তাঁর। এমন রূপবান, গুণবান স্বামী পেয়েও তিনি সবচেয়ে দুর্ভাগিনী। রুপালি কিছুই জানেন না সোনালির কথা।

সব চিকিৎসা ব্যর্থ হলো। এক একজন কবিরাজ, বৈদ্য এসে এক একরকম চিকিৎসা করেন। কত জড়ি-বুটি, শিকড়, মন্ত্র—কিছুই কাজে লাগলো না। ক্রমশ বিষ ছড়িয়ে যেতে লাগলো ত্রিস্তানের সমস্ত শরীরে। বিছানার সঙ্গে একেবারে লেগে রইলো ত্রিস্তানের কঙ্কালসার দেহ। শরীরের সমস্ত হাড়গুলো গোনা যায়। এই নিয়ে তিনবার নিশ্চিত মৃত্যু এলো তার কাছে। লোকে বলে, মৃত্যু কখনো তৃতীয়বার ফিরে যায় না।

শরীর দুর্বল হবার সঙ্গে সঙ্গে তার মনও দুর্বল হতে লাগলো। বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে সে ভাবে- সোনালির সঙ্গে আর একবার দেখা না করে সে মরবে কি করে? এ জীবন যে সোনালির সঙ্গে বাঁধা। সে যতই ঘৃণা করুক, অপমান করুক- সোনালিকে না জানিয়ে এ জীবন সে ছেড়ে যেতে পারে না।

একদিন রাজকুমার কাহারডিন এসে ত্রিস্তানের শয্যার পাশে বসে অশ্রুতপাত করছেন, তখন ত্রিস্তান বললো, তার সঙ্গে একটা গোপন কথা আছে। এবং সে চোখের ইশারায় রুপালিকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে অনুরোধ করলো।

নারীর কৌতূহল। ত্রিস্তানের এই অবস্থাতেও কি তার গোপন কথা। রুপালি তখন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে গোপনে ওদের কথা শুনতে লাগলেন।

ত্রিস্তান কাহারডিনকে বললো, বন্ধু তুমি জানো আমার এ রোগ আর সারবে না। আমার এ বিষের চিকিৎসা রানী সোনালি ছাড়া আর কেউ জানে না। এ বিষ ছাড়াও আমার শরীরে এক এক রকম বিষ আছে, সোনালিকে না দেখলে সে বিষের জ্বালা যাবে না। তুমি একবার সোনালির কাছে আমাকে নিয়ে চল!

—অসম্ভব ত্রিস্তান! তোমার শরীরের এই অবস্থায়, তোমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না। অসম্ভব!

—তবে তুমি সোনালিকে আমার কাছে এনে দাও।

—তুমি পাগল হয়েছো ত্রিস্তান? সোনালির সঙ্গে আমি দেখা করবো কি করে? আর দেখা করলেও তিনি আমার কথা শুনে আসবেন কেন?

ত্রিস্তান তখন সেই সবুজ পাথরের আংটিটা বার করে দিল কাহারডিনকে। বললো, তুমি বণিকের ছদ্মবেশে কোনোরকমে রাজসভায় গিয়ে যদি রানীকে এই আংটি দেখাও, সে চিনতে পারবে। তা হলে, তোমার কথায় নিশ্চিত আসবে সে। হ্যাঁ, আসবেই। সে বলেছিল, আমার ডাক শুনলে রাজবাড়ির হাজারটা দেওয়াল ভেঙেও সে বেরিয়ে আসবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে আটকাতে পারবে না। তুমি যাও, বন্ধু! আজই যাও!

কাহারডিন নিরুপায় হয়ে শেষ পর্যন্ত যেতে রাজী হলো। ত্রিস্তান তাঁকে আবার ডেকে বললো, যদি অনুকূল বাতাস পাও, তোমার যেতে আসতে অন্তত পনেরো দিন লাগবে। ততদিন আমি বাঁচবো কিনা জানি না। আমার শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। কিন্তু সোনালিকে একবার দেখবার জন্য আমাকে বাঁচতেই হবে। তুমি আমাকে এই দুর্গের চূড়ায় সবচেয়ে উঁচু ঘরে শুইয়ে দাও! সেখান থেকে আমি সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকবো। প্রতীক্ষায় থাকবো তোমার জাহাজের। আর শোনো, যখন তুমি ফিরে আসবে-তোমার জাহাজে উড়বে রাজপতাকা। আর, জাহাজে দু’রঙের পাল নিয়ে যাও। যদি সোনালি আসে, সাদা পাল উড়িয়ে দিও। যদি সে না আসে-উড়িয়ে দিও কালো পাল। সে আসবেই। মনে রেখো- সাদা পাল আর কালো পাল। দূর থেকে তোমার জাহাজের সাদা পাল দেখতে পেলে আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাবো। আমি কতবার মরতে চেয়েছি। এখন আমার বাঁচতে ইচ্ছে হয়। খুব বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছে। শুধু সোনালির জন্য। সোনালিকে ছেড়ে আমি মরতে পারি না। কাহারডিন, ভাই আমাকে বাঁচাও! আমি মরতে চাই না! আমি কাঙালের মতন বেঁচে থাকতে চাই! আমি আরও বেঁচে থাকতে চাই সোনালির জন্য! তুমি আজই যাও।

কাহারডিন সেই দিনই যাত্রা করলো। আর পাশের ঘর থেকে সব শুনলেন রাজকুমারী রুপালি। এই সেই রহস্য? তাঁর স্বামী অন্য নারীকে ভালোবাসে সারা জীবন! তাকে না দেখলে বাঁচবে না! আমি কেউ নই? আমি, আমি-রাজকুমারী অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন। কেঁদে কেঁদে তাঁর শরীর অবশ হয়ে গেল। তাঁর সমস্ত দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী সেই সর্বনাশিনী। ত্রিস্তান সেই রাক্ষসীর জন্যই সারা জীবন তাঁকে অপমান করলো?

কান্না শেষ হবার পর রুপালির শরীর জ্বলতে লাগলো ক্রোধে। তিনি ছটফট করে ঘুরতে লাগলেন সারা দুর্গে। কোথাও তিনি এক মুহূর্ত দাঁড়াতে পারেন না, বসতে পারেন না। বাতাসের স্পর্শেও যেন তাঁর গায়ে ছ্যাঁকা লাগছে। স্বামীর অবহেলায় এতদিন তিনি ছিলেন বিষণ্ন, আজ স্বামীর মুখে অন্য নারীর নাম শুনে এক মুহূর্তে তাঁর সারা শরীর অস্থির।

দুর্গের এ কোণ থেকে ও কোণ ঘুরছেন রুপালি। এক সময় তাঁর চোখ পড়লো, দুর্গের দরজার কাছে দাঁড়ানো শৃঙ্খলিত রিওলের দিকে। ত্রিস্তান ওর জীবন ভিক্ষা দেবার পর, রাজকুমার কাহারডিন দুর্গের সিংহদ্বারে ওকে শিকলে হাত বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। রিওলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুপালি ভাবলেন, এর চেয়ে তাঁর যদি ঐ পশুর মতো কুৎসিত রিওলেরও সঙ্গে বিয়ে হতো, তাও বোধহয় ছিল ভালো। তবু তো ও একটা পুরুষ। এবং ও রুপালিকেই পাবার জন্য যুদ্ধে নেমেছিল। আর, বীর ত্রিস্তান, যে তাঁর উদ্ধারকারী, সে তাঁকে একবার ছুঁয়েও দেখলো না! রুপালি একা একা কাঁদতে লাগলেন।

রুপালি ত্রিস্তানকে সত্যিই ভালোবাসতেন অন্তর দিয়ে। পূজারিণী যেমন মন্দিরের দেবতাকে ভালোবাসে। যদিও তাঁর ভালোবাসা এক দিনের জন্যও চরিতার্থ হয়নি। আজ যেন সেই দেবতার মূর্তির মধ্যে খড় কাদা-মাটি দেখতে পেলেন। মৃত্যুকালেও স্বামী চেয়ে আছেন অন্য নারীর পথের আশায়! পাশে নিজের বিবাহিতা স্ত্রী অথচ গ্রাহ্য নেই। রুপালি ভাবলেন, তিনি দারুণ প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু কি সেই প্রতিশোধ?

মেয়েদের রাগ আর মেয়েদের ভালোবাসা- কোন্‌টা বেশি প্রবল তা বলা মুশকিল। কোমল, রূপশ্রীময়ী রুপালি এত অপমান সত্ত্বেও ত্রিস্তানকে স্বার্থহীনভাবে ভালোবাসতেন। আর এখন প্রতিশোধের চিন্তায় জ্বলতে লাগলেন।

এদিকে ত্রিস্তান জানলার সামনে বসে থাকে দিনরাত। দিনের পর দিন যায়, ক্রমে পনেরো দিন পার হয়ে গেল। জাহাজের দেখা নেই। ত্রিস্তানের আর বসে থাকারও ক্ষমতা নেই। বিছানায় মরার মতো পড়ে থাকে। সেখান থেকে সমুদ্র ভালো দেখা যায় না। বারবার রুপালিকে ডেকে বলে, দেখো তো, রাজকুমারের জাহাজ আসছে কিনা! তবে কি সে আসবে।

একদিন দূরে সত্যিই দেখা গেল জাহাজ। উপরে পতপত করছে পতাকা। ত্রিস্তানের তখন চোখে দেখারও সাধ্য নেই। চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। বালিশ থেকে মাথা তুলতে পারে না। জানলার কাছ থেকে সরে এসে রুপালি বললেন, জাহাজ আসছে, রাজকুমারের জাহাজ। ত্রিস্তান, তোমার জন্য দাদা ওষুধ আনছেন, নিয়ে আসছেন এক মায়াবিনীকে!

জাহাজ? ত্রিস্তান অসহায় চোখে তাকালেন রাজকুমারীর দিকে। তারপর করুণভাবে ভিক্ষে চাওয়ার মতো বললো, রাজকুমারী, দয়া করে বলো সে জাহাজে কি রঙের পাল? সাদা নিশ্চয়ই!

রাজকুমারীর ঠোঁট থরথর করে কাঁপতে লাগলো, তিনি কথা বলতে পারলেন না। ত্রিস্তান নিদারুণ অনুনয়ের স্বরে বললো, রুপালি একবার দেখো, কি রঙের পাল? আমার দেখার সাধ্য নেই যে।

জানলার ধারে সরে গিয়ে রাজকুমারী একবার তাকালেন সেই সাদা পালের জাহাজের দিকে। তারপর ক্ষিপ্তের মতো তীব্রকণ্ঠে বললেন, কালো, কালো! ভয়ঙ্কর, কুৎসিত, বীভৎস রঙের কালো!

—কালো? না না, তা হয় না, রুপালি তুমি আর একবার দেখো!

—আমি বলিছ কালো! ঝড়ের মেঘের মতো কালো! সর্বনাশের মতো কালো পাল তুলে আসছে জাহাজ!

—রুপালি, তোমার দয়ার প্রাণ। তুমি সত্যি কথা বলো। আমি চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমি অন্ধ হয়ে গেছি! কিন্তু আমি বাঁচতে চাই। যদি তুমি মিথ্যে কথা বলো, আর এক মুহূর্তও আমার বাঁচার সামর্থ্য নেই। তুমি বিধবা হবে। আর একবার দেখে বলো, জাহাজ কোন রঙের পাল উড়িয়ে আসছে?

রুপালি কঠিন মুখে বললেন, কালো!

—কালো? হঠাৎ ত্রিস্তানের চোখ ঘূর্ণিত হতে লাগলো। বুকের খাঁচাটা প্রবলভাবে ওঠানামা করতে লাগলো নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টায়।

তা দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন রুপালি, না, না, না, আমি দেখেছি, সাদা! মেঘ কেটে গেছে, আমি এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সাদা রঙের পাল। জাহাজ এসে বন্দরে লেগেছে!

ত্রিস্তান ক্ষীণভাবে বললো, তাহলে সোনালি এসেছে?

—হ্যাঁ, সে এসেছে। আমি নিজে তাকে নিয়ে আসছি। রুপালি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু কত দূরে যাবেন। যদি এর মধ্যেই ত্রিস্তান মরে যায়-একা ঘরে, অসহায়? দরজার পাশে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, রুপালি আবার এসে ঘরে ঢুকলেন।

শব্দ শুনে ত্রিস্তান বললো, কে? সোনালি?

ধরা গলায় রুপালি বললেন, হ্যাঁ, ত্রিস্তান আমি এসেছি।

–সোনালি! আমি চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

রুপালি আবার বললেন, ভয় নেই ত্রিস্তান, আমি এসেছি।

—সোনালি, তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না আমি। তুমি আমার বুকের কাছে এসো। তুমি মুছে নাও আমার শরীরের বিষ। সোনালি, আমার বড় বাঁচতে ইচ্ছে করে। এসো!

রুপালি এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ত্রিস্তানের বুকে। এই প্রথম তাঁর স্বামীস্পর্শ ।

কিন্তু মুহূর্তে মৃগীরোগীর মতো, এক ঝঙ্কায় তাকে দূরে ঠেলে দিল ত্রিস্তান! হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, চোর! পাপিষ্ঠা! এ সোনালি নয়! সোনালির স্পর্শ আমি চিনি। তাঁর স্পর্শ আমার সারা শরীরে লেগে আছে। আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তার একটি আঙুলের স্পর্শে আমি চিনতে পারবো।

একটু দম নিয়ে ত্রিস্তান আবার বললো, রুপালি, কেন আমায় কষ্ট দিচ্ছ? তোমার প্রতি আমি অন্যায় করেছি, কিন্তু জীবনের শেষ সময়টুকুতে আমায় তুমি দয়া করে শান্তি দাও! তুমি সত্যি করে বলো, সোনালি এসেছে কিনা!

মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন রুপালি। সেখান থেকে ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, এগিয়ে গেলেন জানলার পাশে। সেখান থেকে শান্ত স্বরে বললেন, ত্রিস্তান, সে আসবে না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমার দাদার জাহাজে শোকের চিহ্ন। শুধু কালো রং। কালো পতাকা, কালো পাল।

—কালো! ত্রিস্তান জোরে নিঃশ্বাস ফেললো একবার। তারপর যেন মন্ত্রবলে শক্তি পেয়ে উঠে বসলো বিছানার ওজর সোজা হয়ে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে তিনবার ডাকলো-সোনালি-সোনালি-সোনালি। সেই ডাক যেন ছিন্নভিন্ন করে দিল বাতাস। সেই করুণ ডাক যেন কালো মেঘ ফুঁড়ে চলে গেল স্বর্গের দিকে। ত্রিস্তান প্রাণপণে চেষ্টা করলো পাখির মতো শিস দিয়ে উঠতে। গলা ভেঙে গেল, পারলো না। ধপ্ করে ত্রিস্তান পড়ে গেল বিছানায়।

রাজকুমারের জাহাজ যখন লাগলো-তখন সমস্ত দুর্গে কান্নার রোল। জাহাজ থেকে প্রায় ঝাঁপিয়ে নেমে এলো এক নারী। তার রুক্ষ সোনালি চুল, উদ্‌ভ্রান্ত চোখ, ছুটে চললো দুর্গের দিকে। পথের লোকেরা অবাক হয়ে বলাবলি করতে লাগলো, কে এই দেবী-মূর্তির চেহারায় উন্মাদিনী নারী? সেই নারী তখন যাকে সামনে পাচ্ছে, জিজ্ঞেস করছে, ত্রিস্তান কোথায়? ত্রিস্তান কোথায়? এই রকম প্রশ্ন করতে করতে উঠে এলো দুৰ্গেল উচ্চতম ঘরে। সেখানে ত্রিস্তানের বুকের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে রুপালি। রানী সোনালি সেখানে এসে শান্তভাবে বললেন, বোন, তুমি একটু সরে যাও। আমাকে একবার কাঁদতে দাও। বিশ্বাস করো, ওর চেয়ে আপনজন-আপনার এ বিশ্বসংসারে কেউ ছিল না!

সোনালি উঠে এলেন ত্রিস্তানের খাটে। ত্রিস্তানকে নিবিড় ভাবে আলিঙ্গন করে ওর মরা ওষ্ঠে চুম্বন করতে করতে বললেন, ত্রিস্তান, আমি রাজবাড়ির দেওয়াল ভেঙে বেরিয়ে এসেছি। আমিও তোমার সঙ্গে যাবো সেই দেশে। আমি একা থাকবো না!

সেই ভাবেই সোনালির মৃত্যু হলো। ত্রিস্তানকে আলিঙ্গন করে।

রাজা মার্কের কানে যখন ওদের দুজনেরই মৃত্যু-সংবাদ পৌঁছুলো, তিনি নিজে এসে দুটি বহুমূল্য শবাধারে ওদের দুজনের দেহ সাজিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন নিজের দেশে। তারপর একটি নির্জন গির্জার দু’পাশে ওদের দুজনকে কবর দিলেন। সেই দিন থেকে তিনি সত্যিকারের বৃদ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর মাথার সব চুল সাদা হয়ে গেল। রাজা মার্কের এতদিনেও সন্তান হয়নি, ত্রিস্তানকে হারিয়ে তিনি সম্পূর্ণ নিঃসন্তান হলেন।

কয়েক মাস বাদে ত্রিস্তানের কবর থেকে একটি অদ্ভুত লতানে গাছ বেরিয়ে আসে। তীব্র গন্ধময় তার ফুল। সেই গাছটা গির্জার ছাদ পেরিয়ে ঝুঁকে পড়ে ওপাশের সোনালির কবরে। তিন তিনবার কবরের রক্ষকরা সেই গাছ কেটে দিল। তিনবারই আবার গজিয়ে উঠলো সেই গাছ। রক্ষকরা তখন গিয়ে সেই অলৌকিক ঘটনা রাজাকে জানাতে, রাজা নিজে এসে সেই গাছ দেখলেন। তারপর ওদের নিষেধ করলেন আর সেই গাছ কাটতে। তখন ক্রমশ সেই গাছটা দিনে দিনে লক্লক্ করে বেড়ে উঠে গির্জার ছাদ পেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়লো সোনালির কবরে। সেখানে ওর ফুল ফুঠে উঠলো অজস্র।

প্রভুগণ, যুগ যুগ ধরে কবিরা এই গান শুনিয়েছে! ত্রিস্তান আর সোনালির ভালোবাসা আর দুঃখের গান। আমি সামান্য কবি- একদা পূর্ববঙ্গবাসী, অধুনা ভ্রাম্যমাণ—গঙ্গোপাধ্যায় বংশীয় সুনীল আমার নাম। যদিও ব্রাহ্মণকুলে জন্ম, কিন্তু জ্ঞানের অভিমানের বদলে ভালোবাসার শক্তিতেই আমার বেশি বিশ্বাস! তাই ভালোবাসার এই অমর গাথা আমি শোনাতে চেয়েছি। আমার বাকশক্তি সীমিত, আমার ভাষাজ্ঞান সীমিত, আমি জানি না শব্দের ঝংকার, জানি না বর্ণনার ছটা! আপনারা গুণীজন, আপনারা বহুদর্শী, রসজ্ঞ সহৃদয়-আপনাদের সভায় ভরসা করে এ গান শোনালাম। এ গান শুনলে, যে দুর্বল সে আবার শক্তি ফিরে পায়। ভালোবাসায় যত অবিশ্বাস এসেছে, সে আবার ভালোবাসায় বেঁচে ওঠে। যার জীবনে কখনো ভালোবাসা জাগেনি, এ গান শুনলে সেই পাথরের বুক ভেদ করে বেরিয়ে আসে ঝরনা। এই ভালোবাসার গান শুনলে মানুষ মরতে ভয় পায় না। ভালোবাসা ছাড়া জীবন হয় না, যেমন দুঃখ ছাড়া ভালোবাসা হয় না! ভালোবাসার জাত নেই, গোত্র নেই, ধর্ম নেই।

ত্রিস্তান আর সোনালি যদি আবার জন্মায়, জানি ওরা পরস্পরকে আবার ঠিক এই রকম ভালোবাসতে চাইবে-এক জীবনের শত সহস্র দুঃখের কথা জেনেও। কি জানি, হয়তো ওরা আবার জন্মেছে, সব বিপদ তুচ্ছ করেও আবার ভালোবেসেছে! আপনারা ওদের আশীর্বাদ করুন।

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *