সোনালী দুঃখ – ১০

১০

সেই রাত্রেই রাজা মার্ক সমস্ত সভাসদ এবং অভিজাত রাজপুরুষদের ডেকে পাঠালেন। ঘুম চোখে সবাই উঠে আসতেই রাজা বললেন, আপনারা শুনুন ত্রিস্তান কি লিখেছে। মুন্সী, পড়ে শোনাও তো চিঠিটা।

সভাসদরা মাঝরাত্রে এই কাণ্ড দেখে অবাক। প্রৌঢ় রাজার একি নব যুবকের মতো উৎসাহ। আসলে এক ধরনের মানুষ থাকে, যাদের হৃদয়ে ভালোবাসা যেমন তীব্র, ঘৃণাও তেমনি তীব্র। রাজা মার্কের হৃদয়ে ভালোবাসাই বেশি, কিন্তু কিছুদিনের জন্য সেটা চাপা পড়ে গিয়ে তীব্র ঘৃণা জেগে উঠেছিল। আবার ভালোবাসা ফিরে এসেছে। ত্রিস্তান আর সোনালি, দুজনের জন্যই ভালোবাসা।

মুন্সী রাজার হুকুমে চিঠি পড়তে আরম্ভ করলো :

মহারাজ, আপনাকে আমার প্রণাম। সভাসদদের আমার অভিবাদন। আমি ত্রিস্তান। মনে পড়ে মহারাজ, আমি সেই ত্রিস্তান যে জীবন তুচ্ছ করে আয়ার্ল্যান্ডে গিয়েছিল। মহারাজ, ওদের ড্রাগনকে আমিই হত্যা করেছি। ওদেশের রাজা তো আমার সঙ্গেই বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন রাজকন্যাকে। কিন্তু আমি আপনার নাম করে গিয়েছিলাম বলে, সেই রাজকন্যাকে আপনার হাতে তুলে দিয়েছি। কিন্তু আপনি নীচ লোকদের কথায় কান দিয়ে আমাদের সন্দেহ করতে শুরু করলেন। নীচ, কুন্ত্রণাদাতারা আপনার মনে ঈর্ষা ঢুকিয়ে দিল, সেই ঈর্ষা থেকে জন্মালো ক্রোধ। ক্রোধের বশে আপনি বিনা বিচারে আমাদের পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। তখন ঈশ্বর আমাদের সহায় হলেন। ঈশ্বরের অনুগ্রহেই আমি উঁচু পাহাড় থেকে লাফ দিয়েও মরিনি। তারপর থেকে আমি আর কি দোষের কাজ করেছি? আপনি রানীকে সঁপে দিলেন কুষ্ঠরোগীদের হাতে, আমি তাদের হাত থেকে রানীকে উদ্ধার করেছি। আমি নাইট, বিপন্না রানীকে আপনার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে পারিনি, কারণ আপনার ঘোষণা ছিল জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় আমাকে বন্দী করা। কিন্তু, এখন আমি অনুরোধ করছি, রানী আপনার ধর্মপত্নী, তাঁকে আপনি গ্রহণ করুন। রানীর বিরুদ্ধে যদি কেউ কুৎসা রটাতে চায়, তবে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমি দ্বন্দ্বযুদ্ধে রাজী আছি। যার সত্যিকারের সৎসাহস আছে, সে-ই যেন প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে রানীর বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ জানায়, আড়ালে নয়। যদি এমন কেউ থাকে আপনি তাদের নাম আমাকে জানান, আমি তাদের সঙ্গে দেখা করে হিসেব মিটিয়ে ফেলবো।

আমাকে আপনি পুনরায় গ্রহণ করবেন কিনা সেটা আপনার ইচ্ছে। আমি না হয় এ দেশ ছেড়ে চলে যাবো। কিন্তু মহারাজ, আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনি রানীকে পূর্ব-সম্মানে ফিরিয়ে নিন। যদি না নিতে চান, আমি রানীকে আবার আয়ার্ল্যান্ডে ফিরিয়ে দিতে আসবো। ওদেশের রাজকুমারী, ওদেশেরই রানী হয়ে থাকবেন। ইতি,

প্ৰণত ত্রিস্তান

এই চিঠি শুনে একজন সভাসদেরও প্রতিবাদ করতে সাহস হলো না। মনে পড়লো ত্রিস্তানের দুর্ধর্ষ মুখ, ঝকঝকে তলোয়ার। সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো, মহারাজ, রানীকে ফিরিয়ে আনুন। রানীর কলঙ্কের কোনো প্রমাণ নেই। রানী হলো রাজ্যের লক্ষ্মী, রানী না থাকলে কি রাজ্যে লক্ষ্মীশ্রী আসে? মহারাজ রানীকে ফিলিয়ে আনুন, কিন্তু-

—কিন্তু কি? মহারাজ গর্জে উঠলেন।

সভাসদরা নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করে খনিকক্ষণ পরামর্শ করলো। তারপর বললো, মহারাজ, ত্রিস্তানকে আর ফিরিয়ে না আনাই ভালো। ও যখন অন্য দেশে চলে যেতে চায়, তবে তাই যাক। ও ফিরে এলে আবার হয়তো নানা কথা উঠতে পারে।

মহারাজ বললেন, আপনারা আবার ভেবে দেখুন, রানীর নামে আপনাদের কোনো অভিযোগ আছে কিনা। কেউ ত্রিস্তানের সঙ্গে লড়াই করতে রাজী আছেন?

সকলেই বললো, না মহারাজ, রানীর নামে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।

রাজা তৎক্ষণাৎ মুন্সীকে বললেন, মুন্সী শিগগির চিঠি লেখো। লেখো, আমি রানীকে ফিরিয়ে নিতে চাই। এ রাজ্যের রানী হয়ে সে গাছতলায় শুয়ে আছে। শিগগির চিঠি লিখে, বনের সীমান্তে বাজেপোড়া ওক গাছটায় ঝুলিয়ে রেখে এসো।

একটু থেমে আবার রাজা যোগ করে দিলেন, আর হ্যাঁ, চিঠির শেষে আমার আশীর্বাদ জানিও। ওদের দুজনকেই।

শহর ছাড়িয়ে যেখান থেকে বন শুরু হয়েছে, তার আগে একটা খোলা মাঠ। ঠিক হলো, বনের সীমান্তে সেই মাঠে এসে ত্রিস্তান সোনালিকে রাজার হাতে সঁপে দিয়ে যাবে।

নির্দিষ্ট দিনে ত্রিস্তান সোনালিকে বললো, সখী, আজ বিদায়। আর হয়তো কোনোদিন দেখা হবে না। কিন্তু আমার জন্যে তুমি যে কষ্ট সহ্য করেছো, তা ভেবে আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবার কষ্ট সহ্য করবো। তবে, আমি যত দূর দেশেই থাকি, মাঝে মাঝে লোক পাঠিয়ে তোমার ঠিক খবর নেবো। তোমার কোনো বিপদের কথা শুনলে আবার ছুটে আসবো আমি।

সোনালি কাঁদতে কাঁদতে ত্রিস্তানের বুকে মুখ গুঁজে বললেন, দুঃখ আমার, তুমি আমার জন্য আর কত দুঃখ সইবে? ত্রিস্তান, আমার এই সবুজ পাথরের আংটিটা তুমি নাও। যদি তোমার কাছ থেকে কোনো লোক এসে আংটি দেখায়, আমি তার সব কথা বিশ্বাস করবো। সে যদি তোমার সঙ্গে দেখা করতে বলে আমায়, রাজপুরীর হাজারটা দেওয়ালও আমায় আটকাতে পারবে না। আমি এই পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়েও তোমার সঙ্গে দেখা করবো!

ত্রিস্তান কোনো কথা বলতে পারলো না। সোনালির মুখখানি উঁচু করে তুলে সে চুম্বন করলো। বহুক্ষণ, যেন সে চুম্বন আর শেষ হবে না। তারপর সেইরকম আলিঙ্গনে আবদ্ধ অবস্থাতেই ওরা নীরবে বসে রইলো কিছুক্ষণ।

একটু পরে বাইরে শুনতে পাওয়া গেল ঋষি অগরুর গলার আওয়াজ। ঋষির হাতে কতগুলো দামী সিল্কের পোশাক, মুক্তোর গয়না। লজ্জিত মুখে ঋষি বললেন, রানী, আমার কাছে কয়েক টুকরো সোনা ছিল। আমি সন্ন্যাসী মানুষ, আমার তো ওসব কোনা কাজে লাগে না, তাই ওগুলো বদলে তোমার জন্যে কয়েকটা পোশাক নিয়ে এসেছি। তুমি রাজরানী, এই ছিন্নকন্থা পরে কি করে যাবে রাজ-সন্নিধানে তাই যথাসম্ভব….মানে… জানি না অবশ্য, তোমার পছন্দ হবে কি না। মেয়েদের পোশাক পছন্দ করার অভ্যাস তো আমার নেই!

কৃতজ্ঞতায় রানীর চোখে জল এসে গেল। তিনি ছুটে এসে ঋষির পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন।

একদিকে রাজা পাত্রমিত্রদের নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন সেই প্রান্তরে। হাজার হাজার লোকও ছুটে এসেছে খবর পেয়ে। জমিদার দিনাসও রাজার ওপর রাগ ভুলে আবার এসে হাজির হয়েছেন। প্রতীক্ষায় সবাই উদ্‌গ্রীব। কতদিন পর আবার ত্রিস্তান আর সোনালিকে দেখবে। কি ভাবে, কোন রূপে তারা দেখা দেবে, সেই নিয়ে সকলের কৌতূহল।

হঠাৎ বন থেকে বেরিয়ে এলো ত্রিস্তান আর সোনালি। রানী সুসজ্জিত, ত্রিস্তানের পরনে শতছিন্ন ময়লা পোশাক। ঘোড়ার পিঠে রানীকে বসিয়ে দীন ভৃত্যের মতন ত্রিস্তান পায়ে হেঁটে আসছে।

ত্রিস্তান রানীর কানে কানে বললো, সোনালি, আর হয়তো তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় পাবো না। আমার শেষ অনুরোধ, কখনো যদি তোমাকে কোনো খবর পাঠাই, তুমি একটা উত্তর দিও।

সোনালি বললেন, ত্রিস্তান কেন বলছো ও কথা। তুমি যদি আবার কোনোদিন আমাকে ডাক পাঠাও, পৃথিবীর কোনো শক্তি, রাজবাড়ির হাজারটা দেওয়ালও আমাকে আটকে রাখতে পারবে না! তুমি তো জানো এ কথা।

—সোনালি, তোমাকে আর আমি ডাকবো না। আর কোনোদিন তোমাকে আমি রাজপ্রাসাদ থেকে বাইরে আনবো না।

—ও কথা বলো না, ত্রিস্তান। আমাদের নিয়তি এক সুতোয় বাঁধা। জানি না সে কোনদিকে যাবে।

ততক্ষণে ওরা রাজার দলের খুব কাছে এসে গেছে। রানী ফিফিস্ করে বললেন, ত্রিস্তান আমার আর একটা অনুরোধ আছে। তুমি আজই এ দেশ ছেড়ে চলে যেও না। অন্তত এক মাস লুকিয়ে থেকো এই জঙ্গলে। জানি না, রাজা আমাকে কি চোখে দেখবেন। যদি তিনি এই ছলে ধরে নিয়ে আবার আমাকে শাস্তি দিতে চান। তখন তুমি ছাড়া আর আমাকে অপমান থেকে কে উদ্ধার করবে? যদি সে রকম কিছু হয়, আমি লোক পাঠাবো ঋষির আশ্রমে। আমার শেষ খবর শুনে তবে তুমি যেও।

—সোনালি, আমার শরীরে শেষ রক্তবিন্দু থাকতে তোমাকে কেউ অপমান করতে পারবে না। তোমার খবর না পেয়ে আমি নড়বো না। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো।

—চিন্তা আমার কোনোদিন ঘুচবে না, ত্রিস্তান। জানি না ভাগ্য আমায় কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে। কেনই বা আমি তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি? আমরা ভুল করছি না তো? চলো, এখনও আমরা আবার জঙ্গলে ফিরে যাই!

ত্রিস্তান ম্লান হেসে বললো, না, আর তা হয় না!

আর কথা বলার সময় নেই। ত্রিস্তান রাজার কাছে নতজানু হয়ে প্রণাম করলো। তারপর জমিদার দিনাসকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ধীরস্বরে বললো, মহারাজ এই আপনার রানীকে গ্রহণ করুন। গ্রহণ করে এঁকে ফিরিয়ে দিন রানীর সমস্ত সম্মান। যদি রানীর বিরুদ্ধে কারুর কোনো অভিযোগ থাকে, আমি তা মুখে বা তরবারির সাহায্যে উত্তর দিতে প্রস্তুত।

কেউ কোনো কথা বললো না। দিনাসই এগিয়ে এসে সোনালির হাত ধরে বললেন, এসো, তুমি আবার আমাদের রানী হও! এই বলে সোনালির হাত ধরে এসে সঁপে দিলেন রাজার হাতে। রাজা মার্ক রানীর কপালে একটি চুম্বন আঁকলেন। জয়ধ্বনি দিলো প্রজারা। রক্ষীরা বহুমূল্য পরিচ্ছদ এনে রাখলো রানীর সামনে। সোনালি নিজের পরনের পোশাকের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন সেই ঋষির কথা। চকিতে একবার দেখলেন ত্রিস্তানকে। বললেন, থাক।

তখন দিনাস বললেন, মহারাজ, ত্রিস্তানকেও ফিরিয়ে নিন। ত্রিস্তানের মতো বীর আপনার রাজ্যের গর্ব। ত্রিস্তানের সব উপকারের কথা আপনি ভুলে গেলেন?

রাজা চাইলেন সভাসদদের দিকে। সকলেরই মুখে ‘না’ লেখা আছে।

অনেকেই প্রকাশ্যে বললো, মহারাজ, আবার সর্বনাশ ঘরে ডেকে আনবেন না। আমরা ওর নামে কোনো অভিযোগ করছি না। কিন্তু ওর এখন দূরে থাকাই ভালো। কিছুদিন পরে না হয় ডাকবেন ইচ্ছে হলে!

ত্রিস্তান গম্ভীর গলায় বললো, না, আমি এ রাজ্যে আর থাকবো না। মহারাজ, আপনি আমাকে গ্রহণ করলেও আমি আর থাকতে রাজী নই। আমি চলে যাবো।-এই বলে, ত্রিস্তান স্থির চোখ মেলে তাকালো সোনালির দিকে। এত জনতার সামনে, লজ্জায় সোনালি চোখ নামিয়ে নিলেন।

রাজা আর্দ্র গলায় বললেন, ত্রিস্তান, চলেই যখন যাবে, যাও। কিন্তু এরকম হতদরিদ্রের মতো ছিন্নভিন্ন পোশাকে তুমি এ রাজ্য ছেড়ে যেতে পারবে না। আমার ভাণ্ডার থেকে তুমি যে কোনো পরিচ্ছদ বেছে নিয়ে যাও!

ত্রিস্তান অদ্ভুত ধরনের হাসি হেসে বললো, মহারাজ, আপনার কাছ থেকে আমি পোশাক নেবো? না থাক। আমার এই ভালো।

এরপর ত্রিস্তান কোনো দিকে না থাকিয়ে ঘোড়ায় উঠে বসলো। আর একটিও কথা না বলে বিদ্যুৎ বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে মিলিয়ে গেল বনের মধ্যে। যতদূর ত্রিস্তানকে দেখা গেল, সবাই নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। শুধু রানী সোনালি শেষ মুহূর্তে ভেঙে পড়ার ভয়ে সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *