সোনালী দুঃখ – ১

আমি একজন সামান্য কবি। হে প্রভুগণ, আপনারা গুণী মানী লোক, আপনারা কত পড়েছেন, কত শুনেছেন, আপনারা রসের বিচার করতে জানেন। আমি আপনাদের সভায় এসেছি, যদি অনুমতি পাই, আমি আপনাদের আজ দুজন নারী-পুরুষের ভালোবাসার গান শোনাবো। ভালোবাসার জন্যই মানুষ পৃথিবীতে জন্মায়, কিন্তু এই যে দুজন— এদের মতো এমন তীব্র-মধুর ভাবে আর কেউ বোধহয় কখনও ভালোবাসেনি। আপনারা মহৎ, আপনারা উদার, আপনারা জানেন ভালোবাসা হচ্ছে আগুনের মতো, যাতে কোনো পাপ স্পর্শ করে না। আপনারা অন্তর দিয়ে বুঝতে পারবেন, এই দুই হতভাগ্য প্রেমিক- প্রেমিকা প্রেমের শক্তিতে কি করে পাপ-পুণ্য ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আহা, ওদের গান শুনলে যে-মানুষ পাহাড়ের মতো কঠোর ব্রহ্মচারী তারও বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে ঝরনা। অপ্রেমিকও প্রেমিক হয়। সুখভোগ আমোদ-আহ্লাদে ডুবে আছে যে মানুষ, এই গান শুনে সেও এক মুহূর্ত থমকে যায়, তার মনে পড়ে- জীবনে কি যেন বাকি রয়ে গেল, বুকের মধ্যটা উদাস উদাস হয়ে যায়। এই গান শোনার পর, যখন আপনারা কেউ একা থাকবেন, আপনাদের মনে হবে- এই পৃথিবীতে যে জন্মালুম, জীবনটা ঠিক মতো বাঁচা হলো তো? নাকি এক জীবন মনের ভুলেই কেটে গেল! ভালোবাসাহীন জীবনই তো ভুল জীবন! আমি এই গান গ্রামে-গ্রামে হাটে-বাজারে, নদীর ধারে গেয়ে বেড়াই। আজ আপনাদের সভায় এসেছি। অনুমতি করুন।

রাজকুমারের নাম দুঃখ, রাজকন্যার নাম সোনালি। কোথায়, কত দূরে ওরা ছিল, তবু দেখা হয়ে গেল। পৃথিবীতে এদের চেয়ে সুন্দর, এদের চেয়ে নিষ্পাপ নারী-পুরুষ কি আর জন্মেছে? ওদের মতো সুখী কেউ নেই, ওদের মতো দুঃখীও কেউ নেই। ভালোবাসা মানেই তো দুঃখ, তবু মানুষ ভালোবাসতে চায়। জীবনে ভালোবাসাই একমাত্র দুঃখ, যেখানে মানুষ ইচ্ছে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ওরা বড় বেশি দুঃখ পেয়েছে ভালোবেসে। অমন সোনার মতন শরীর, তবু মনের মধ্যে ছিন্নভিন্ন পোশাকে রোদ-বৃষ্টির নিচে দুজনে দুজনকে আলিঙ্গন করে যখন ঘুমিয়েছে- সে দৃশ্য ভাবলে বুক ফেটে যায়। প্রভু, আমাকে এক মিনিট ক্ষমা করুন। ওদের কথা বলার আগে আমি একটু চুপ করে বসে থাকি। ওদের কথা বলতে গেলেই আমার গলার কাছে কান্না ঠেলে আসে। প্রতিটি নিশ্বাস দীর্ঘশ্বাস হয়ে যায়। ওঃ! ওরা এক সঙ্গে পান করেছিল ভালোবাসা ও মৃত্যু। ওদের কাছে মৃত্যু আর ভালোবাসা এক।

যেদিন ওরা ঠোঁটের কাছে তুলে এনেছিল সেই ভয়ঙ্কর সুরার পাত্র, সেদিন যদি ওরা জানতো যে ওদের ভালোবাসা ওদের মৃত্যু পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে- তাহলে কি ওরা ভয় পেত? ঠোঁটের কাছে এনেও সরিয়ে দিত? কি জানি। ভালোবাসায় মানুষ বরাবর একই ভুল করে। প্রেমিকরা কখনও অভিজ্ঞ হয় না। অভিজ্ঞ লোকেরা প্রেমিক হতে পারে না। রাজকন্যাকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে তবু কেন রাজকুমার ফিরে আসতে লাগলো বারবার?

কিন্তু তার আগে বলি রাজকুমারের জন্মবৃত্তান্ত। ওর দুঃখিনী মায়ের কথা, যে মা নিজের সন্তানের নাম রেখেছিল, দুঃখ।

সে অনেক, অনেকদিনের আগের কথা। অনেক দূর দেশের কথা। রূপকথা নয়, আপনার-আমার জীবনের মতই সত্যি ঘটনা। হিমালয় পেরুলে তাতার বেদুইনদের দেশ, তারপর মরুভূমি। মরুভূমিও পার হলে নীল ভূমধ্যসাগর। ভূমধ্যসাগরের ওপারের স্থলভাগকে বলে ইউরোপ। সেখানকার সব মানুষই ফর্সা। আমাদের থেকে অন্যরকম চেহারা। কিন্তু চেহারা অন্যরকম হলে কি হয়, মানুষের স্বভাব পৃথিবীর সব দেশেই একরকম। হুজুর, যুবক-যুবতীর ভালোবাসা, মায়ের কান্না, আর শত্রুর ক্রোধ— সব দেশেই এক। ঐ ইউরোপের একটা ছোট্ট রাজ্যের নাম কর্নওয়াল। সেখানকার রাজার নাম মার্ক। ভারী ধর্মপ্রাণ, ন্যায়পরায়ণ রাজা, প্রজারা সকলেই তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর রাজ্যে কোনো অভাব নেই, অশান্তি নেই। যুদ্ধ করার বদলে রাজা বেশি ভালোবাসেন গান-বাজনা। হঠাৎ একদিন ওঁর রাজ্য আক্রমণ করলো বাইরের এক দস্যু-রাজা। সীমান্ত পেরিয়ে শত্রু-সৈন্য গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিতে লাগলো। রাজা মার্ক প্রাণপণে লড়াই করতে লাগলেন নিজের রাজ্য রক্ষার জন্য- কিন্তু দুর্দান্ত বেপরোয়া নিষ্ঠুর দস্যুদের সঙ্গে সহজে এঁটে উঠলেন না। দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চলতে লাগলো।

রাজা মার্কের দেশের একদিকে সমুদ্র। সেই সমুদ্রের ওপারে যে রাজ্য, তার নাম লিওনেস। সেই লিওনেসের রাজা রিভালেন রাজা মার্কের খুব বন্ধু। তিনি বন্ধুর বিপদের কথা শুনেই নিজের সৈন্য-সামন্ত নিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে ছুটে এলেন সাহায্য করতে। রাজা মার্কের সঙ্গে যদিও রিভালেনের বন্ধুত্ব, কিন্তু দুজনের চরিত্র সম্পূর্ণ দু’রকম। রিভালেনের দীর্ঘ, সুঠাম চেহারা- দুঃসাহসী স্বভাব, যুদ্ধ করাই তাঁর একমাত্র শখ। রাজা মার্ককে তিনি বললেন, তুমি এবার একটু বিশ্রাম করো, আমি যুদ্ধটা সেরে আসি! তারপরই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধে। যুদ্ধক্ষেত্রে কি অতুলনীয় বিক্রম রিভালেনের, তাঁর নির্ভীক মুখ, স্বচ্ছন্দ গতি আর ঐ রকম সুন্দর চেহারা দেখে মনে হয়, যেন স্বয়ং দেবসেনাপতি যুদ্ধে নেমেছেন। এ যুদ্ধ জয় করতে তাঁর বেশিদিন লাগলো না। দস্যুর দলকে তিনি সীমান্ত পার করে দিয়ে এলেন।

রাজা মার্কের দেশের লোক রাজা রিভালেনকেও হৃদয়ে আসন দিল। সারা রাজ্যে শুরু হলো উৎসব। সকলেরই মুখে রিভালেনের নাম। এমন সুপুরুষ, এতবড় বীর কেউ কখনো দেখেনি। নিজের বন্ধুর জন্য কে অতখানি করে?

রাজা মার্কের চোখে কৃতজ্ঞতার অশ্রু। তিনি রিভালেনের হাত চেপে ধরে বললেন, বন্ধু তুমি যা করেছো আমার জন্য, জন্ম-জন্মান্তরের আত্মিয়ের জন্যও লোকে আজকাল তা করে না। তোমাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই।

রাজা রিভালেন যুদ্ধে যেমন পারঙ্গম, কথাবার্তায় তেমন নয়। তিনি লাজুক হেসে বললেন, তুমি একটু বাড়িয়ে বলছো! বন্ধুকে তো সাহায্য করবেই!

মার্ক বললেন, বিপদের সময়েই কে আসল বন্ধু, তা চেনা যায়। আমার বিপদের দিনেই জানতে পারলুম, বন্ধু হিসেবে তুমি কত মহৎ!

রিভালেন বললেন, আমি কি শুধুই তোমার জন্য যুদ্ধ কেরছি? বিপন্ন বন্ধুকে সাহায্য করা প্রত্যেক ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। যদি তোমাকে সাহায্য করার জন্য আমি এগিয়ে না আসতুম, তবে ক্ষত্রিয় হিসেবে নিজের কাছে আমার সম্মান কোথায় থাকতো? তোমাকে বাঁচাতে এসে, সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজের আত্মসম্মান আর অহঙ্কারকেও বাঁচিয়েছি।

রাজা মার্ক বললেন, এ শুধু বীরেরই যোগ্য কথা। কিন্তু তোমাকে এখন আমি ছাড়ছি না। তোমাকে আমি এমন বাঁধনে বাঁধতে চাই যেখান থেকে মুক্তি পাবার সাধ্য তোমার মতো বীরেরও নেই

—সে কোন বাঁধ, বন্ধু? জিগ্যোস করলেন রিভালেন।

—সুন্দরীর ভুজবন্ধন! তুমি আমার বোন শ্বেতপুষ্পাকে বিয়ে কর। তাকে একবার দেখো, সে তোমার অযোগ্য হবে না।

হঠাৎ লজ্জায় মাথা নিচু করলেন তরুণ রাজা রিভালেন। শ্বেতপুষ্পাকে বুঝি তিনি আগেই দেখেছিলেন। যুদ্ধযাত্রার দিন সকালে রাজপ্রাসাদের জানলায় দাঁড়ানো রাজকুমারীকে তিনি দেখেছিলেন এক পলক। রাজকুমারীর শ্বেতপুষ্পাও বুঝি তাঁর দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। তখনই রিভালেনের বুকে রক্ত চমকে উঠেছিল। এমন সুন্দরও কেউ হয় পৃথিবীতে? শ্বেতপুষ্পা সত্যিই যেন একটা সাদা ফুল, কিন্তু কি ফুল তার নাম জানেন না রাজা, আগে কখনো এ ফুল দেখেননি। কি জানি, যুদ্ধক্ষেত্রে শ্বেতপুষ্পার মুখ মনে করেই রাজার শরীরে অতখানি বীরত্ব ও তেজ এসেছিল কি না!

শুভ তিথিতে রাজার সঙ্গে বিয়ে হলো শ্বেতপুষ্পার। টিন্টাজেল দুর্গে সে বিবাহের সমারোহের বর্ণনা দেবো এমন শক্তি আমার নেই। প্রভু, আমি সামান্য কবি, আমি তো আর বিবাহ-সভায় উপস্থিত ছিলুম না। তবে কল্পনা করতে পারি, তরুণ রাজা রিভারেনের পাশে শ্বেতপুষ্পাকে মানিয়েছিল ঠিক স্বর্গের দেব-দেবীর মতো।

সমস্ত কর্নওয়াল রাজ্যে আনন্দের স্রোত বয়ে যায়। যুদ্ধ জেতার আনন্দ, সেই সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে। টিন্টাজেল দুর্গের সোনার পালঙ্কে শুয়ে রিভালেন নবপরিণীতার সঙ্গে ডুবে রইলেন এক মধুর স্বপ্নেন রণক্লান্ত যোদ্ধা এখন বিশ্রাম করছেন।

কিন্তু আপনারা সবাই জানেন, বিশ্বসংসারে সুখ বড় চঞ্চলা। কোনো নারীর অঞ্চলেই সুখ দীর্ঘকাল বাঁধা থাকে না। হঠাৎ দুঃসংবাদ এলো, রিভালেনের রাজ্য আক্রমণ করেছে পরম পরাক্রান্ত জমিদার, ডিউক মর্গান। রাজার অনুপস্থিতির সুযোগে, অর্ধেক রাজত্ব সে জয় করে নিয়েছে।

একথা শুনেই জেগে উঠলেন সুপ্ত সিংহ। রিভালেন তখনই জাহাজ সাজিয়ে যাত্রা করলেন নিজের দেশের দিকে। সঙ্গে নিয়ে চললেন নতুন রানী শ্বেতপুষ্পাকে। উপকূলের কাছেই তাঁর যে দুর্গ, সেখানে এসে উঠলেন প্রথমে। তারপর ডাকলেন তাঁর বিশ্বাসী অনুচর রোহল্টকে। রোহল্টের সততা এবং প্রভুভক্তি এমন বিখ্যাত ছিল যে সকলেই তাঁকে ডাকতো, সত্যবাহন রোহল্ট। রাজা রোহল্টকে বললেন, রোহল্ট, তোমাকে আমি রেখে গেলাম রানীকে পাহারা দিতে। রানী শ্বেতপুষ্পা নিজের দেশ ছেড়ে এসেছেন নতুন দেশে, তুমি কখনও এঁর পাশ ছেড়ে যাবে না। আমি শয়তানটাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে ফিরে আসছি।

রাজা তারপর রানী শ্বেতপুষ্পার কপালে চুম্বন দিয়ে বললেন, আমার ভিনদেশী ফুল, তুমি নিশ্চিন্তে থাকো এখানে, কোনো ভয় নেই তোমার, আমি এক সপ্তাহের মধ্যেই ছুঁটো মর্গানটাকে বন্দী করে নিয়ে আসছি তোমার পায়ের কাছে। মাত্র এক সপ্তাহ, তুমি একটু কষ্ট করে একা থাকো।

যাবার সময় রাজা জেনে গেলেন না যে রানী তখন গর্ভবতী!

তারপর একদিন যায়, দু’দিন যায়, রাজার আর কোনো খবর নেই। সাতদিনও কেটে গেল। রাজা এলেন না। রানী শ্বেতপুষ্পা সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন জানলায়। রানী খান না, ঘুমোতে যান না। রানী ঠায় দাঁড়িয়ে জানলায়, শেষকালে একদিন ভগ্নদূতের মুখে খবর এলো, রাজা রিভালেন মারা গেছেন গুপ্তঘাতকের চুরিতে, তাঁর সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। বাকি সৈন্যরা সবাই জড়ো হয়ে শুধু রক্ষা করছে এই উপকূলের দুর্গ।

রিভালেনের মৃত্যুর খবর শুনে দুর্গে কান্নার রোল পড়ে গেল। কাঁদলেন না শুধু রানী। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে খবরটা শুনলেন। তারপর একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে এতদিন পর এই প্রথম স্নান করে একটু জল মুখে দিয়ে শুতে গেলেন। তার পরদিনও রানী চোখ শুকনো, কোনো কান্না নেই। কেউ কেউ আড়ালে বললেন, উঃ, রানী কি নিষ্ঠুর! এক ফোঁটা চোখের জল পর্যন্ত ফেললে না, স্বামীর মরণের খবর শুনে একটু হা-হুতাশ নেই! অন্তত লোক দেখানোও তো খানিকটা করতে হয়।

একমাত্র সত্যবাহন রোহল্ট আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন। নিভৃতে এসে রানীর পায়ের কাছে বসে বললেন রোহল্ট, মা, একি মরণপণ তোমার? এক ফোঁটা চোখের জল ফেলো, তাই দেখে আমরা বাঁচি! কেন তুমি নিজেকেও মারতে চাইছো? দুঃখের বোঝা বাড়াবার চেয়ে হালকা করার চেষ্টা করাই তো উচিত সবার। যে জন্মায় তাকে তো একদিন মরতেই হবে! বরং কারুর মরার খবর শুনলে, যে বেঁচে আছে তার আরও বেশি করে বাঁচার চেষ্টা করা দরকার।

রানী শ্বেতপুষ্পা ম্লান হেসে বললেন, তোমার ভয় নেই, তোমার ভয় নেই রোহল্ট, আমি এত সহজে মরবো না।

রানীর মুখ এমন পাষাণের মতো শান্ত যে দেখলে বুখ কেঁপে ওঠে। কিছুদিনের মধ্যেই রানী শ্বেতপুষ্পা একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। সেই পুত্রকে দু’হাতে তুলে ধরে রানী বললেন, বাছা, তোর প্রতীক্ষাতেই আমি বেঁচে ছিলাম, আজ তোর দেখা পেলাম। তোর মতো এমন সুন্দর সন্তান বুঝি পৃথিবীতে আর কোনো নারী জন্ম দেয়নি। কিন্তু বড় দুঃখের দিনে তুই এসেছিস। বড় দুঃখের মধ্যে আমি এসেছি এদেশে। বড় দুঃখে আমার কেটেছে এ-কটা দিন। ওরে, বড় দুঃখের মুহূর্তে তোর জন্ম। আরও কত দুঃখ তোর সামনে আছে কি জানি! এত দুঃখ তুই ললাটে নিয়ে এসেছিস, তাই তোর নাম রাখলাম আমি ‘ত্রিস্তান’, অর্থাৎ দুঃখের সন্তান। দুঃখের সন্তান, তুই আর এক দুঃখ।

এই কথা বলে রানী শিশুর কপালে চুম্বন করে রোহল্টের হাতে তুলে দিলেন। বললেন, রোহল্ট, তুমি এই শিশুকে রক্ষা করো। তোমার প্রভুকে তুমি ভালোবাসতে, সেইরকম ভালোবাসা দিয়েই এই শিশুকে তুমি বাঁচিয়ে রেখো। নাও! তার সঙ্গে সঙ্গেই রানী লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। রোহল্ট রানীকে তুলতে গিয়ে দেখলো রানীর দেহে প্রাণ নেই। শিশুকে রোহল্টের হাতে তুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই রানী প্রাণত্যাগ করেছেন। শুধু এই মুহূর্তটির জন্যই বেঁচে ছিলেন।

কিন্তু তখন শোক করারও সময় নেই। দুর্গের বাইরে শত্রু। এতদিন প্রতিরোধ করে রাখার পরও দুর্গকে আর রক্ষা করা গেল না। শত্রুসেনা দুর্গের প্রাচীর ডিঙিয়ে ঢুকতে শুরু করেছে। রোহল্ট সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। স্বীকার করে নিলেন ডিউক মর্গানের অধীনতা। কিন্তু মর্গান কি এই শিশুটিকে বাঁচতে দেবে? শত্রুর কেউ শেষ রাখে না। রোহল্ট তখন সেই শিশুকে রেখে এলেন নিজের স্ত্রীর কাছে, চারিদিকে রটিয়ে দিলেন তাঁর স্ত্রী একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছেন।

ক্রমে সাত বছর বয়েস হলো শিশুর। রোহল্ট তখন তার জন্য একজন আলাদা গুরু ঠিক করলেন। সেই গুরু হলেন সর্ববিদ্যা পারঙ্গম গরভেনাল। গরভেনাল অবাক হয়ে গেলেন বালক ত্রিস্তানকে দেখে। এই বালকের যে সর্বশরীরে রাজলক্ষণ, অথচ এ রোহন্টের পুত্র! হুজুর, আপনারা জানেন, সিংহের শাবক সিংহই হয়। কোকিলের ছানা কাকের বাসায় বেড়ে ওঠে, কিন্তু তা বলে সে কাক হয়ে যায় না, বড় হয়ে কোকিলই হয়। ঝরনার পাশ থেকে তুলে এনে গোলাপের চারা ছাইগাদায় পুঁতলে তাতে গোলাপ ফুলই ফুটবে। ত্রিস্তানের স্বভাবে ফুটে উঠতে লাগল রাজকীয় সমস্ত গুণ। বর্শা চালনা, তলোয়ার খেলা, ধনুক বাণ ছোঁড়া, ঘোড়ায় চড়ে লাফিয়ে নদী পার হওয়া—এসব সে শিখে নিল অতি সহজেই। সেই সঙ্গে গুরু গরভেনাল তাকে আরও শেখালেন-পৃথিবীর সমস্ত মিথ্যা ও নীচতাকে ঘৃণা করা, এবং প্রাণ দিয়েও শপথ রক্ষা করা। শুধু যুদ্ধ নয়, ত্রিস্তান আরো শিখলো-বেহালা বাজানো, গান, ছবি আঁকা। পনেরো বছরের কিশোর ত্রিস্তার যখন সাদা ঘোড়ায় চড়ে পথ দিয়ে যেত, তখন পথচারীরা থেমে দাঁড়িয়ে দেখতো তার যাওয়া, বলাবলিকরতো, কি ভাগ্য রোহন্টের এমন সন্তানের পিতা হয়েছে! এরকম সুঠাম, সুকুমার, সর্বগুণের আধার সেই সন্তানের নাম সে ‘দুঃখ রেখেছে কেন? সত্যবাহন রোহল্ট কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য পরলোকগত প্রভু রিভালেন এবং রানী শ্বেতপুষ্পার কথা ভোলেননি। ত্রিস্তানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস পড়তো তাঁর। ত্রিস্তানকে তিনি বাইরে নিজের পুত্রের মতো স্নেহ করলেও মনে মনে ভক্তি করতেন প্রভুপুত্র হিসেবে।

হঠাৎ একদিন রোহল্ট চোখে সর্বনাশ দেখলেন। ত্রিস্তান নেই। ত্রিস্তান চুরি হয়ে গেল। নরওয়ে থেকে একটি বাণিজ্য-জাহাজ এসেছিল। ত্রিস্তান সমুদ্রের পাড়ে একা একা দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে চেয়ে ছিল সেই জাহাজের দিকে। এই জাহাজ কত দেশ ঘুরে ঘুরে এসেছে! দেখেছে কত জনপদ, কত রকম মানুষ! ত্রিস্তানের ইচ্ছে হয়, সেও কেদিন এরকম একটা জাহাজে চড়ে দূরদেশে চলে যাবে। সমুদ্রের যেখানে শেষ হয়ে গেছে, তার ওপারে কোন দেশ আছে সে গিয়ে দেখবে। জাহাজের নাবিকেরা এসে ত্রিস্তানের সঙ্গে ভাব করে। ত্রিস্তানকে দেখে লোভে তাদের চোখ চক্‌চক্ করে ওঠে। এমন সুন্দর, সুঠাম কিশোরকে যদি তারা ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করতে পারে, কত স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায় তাহলে! তারা ত্রিস্তানকে বললো, এসো না, আমাদের জাহাজের ওপরে উঠবে? উঠে ঘুরে ঘুরে গোটা জাহাজটা দেখে যাও না। বণিকরা ত্রিস্তানকে কথায় কথায় ভুলিয়ে একবার সেই জাহাজে তুলেই জাহাজ ছেড়ে দিল। অনেকক্ষণ ত্রিস্তান বুঝতে পারেনি, যখন সে বুঝতে পারলো- তখনই সে ক্রুদ্ধ নেকড়ের মতো লড়াই করে চেষ্টা করলো সমুদ্রে লাফিয়ে পড়বার। কিন্তু অতজনের সঙ্গে সে একা পারবে কেন বলুন? তা ছাড়া তার সঙ্গে কোনো অস্ত্র ছিল না। ত্রিস্তান ওদের হাতে বন্দী হয়ে রইলো।

কিন্তু আপনারা জানেন, সমুদ্র কখনও পাপের বোঝা বয় না। ওরকম পাপের জাহাজ সমুদ্রে নিরাপদে যেতেই পারে না। আকাশ কালো করে ঝড় উঠলো, বিশাল ঢেউয়ের ঠাক্কায় দিক হারিয়ে সে জাহাজ কোন দিকে ভেসে চললো কে জানে! ক্রমাগত আটদিন ঝড়। তারপর, জাহাজের নাবিকেরা ঝড় ও কুয়াশার মধ্যেই দেখতে পেল সামনেই একটা খাড়া পাহাড়, জাহাজ সেদিকেই তীরবেগে এগিয়ে চলছে। সেখানে গিয়ে ধাক্কা দিলেই জাহাজসুদ্ধ সকলের মৃত্যু। দুঃখে অনুতাপে তারা তখনই হাঁটু গেড়ে বসে সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘হে সমুদ্র, আমরা এরকম পাপ আর কখনো করবো না। এই নিরপরাধ কিশোরকে আমরা এখনি মুক্তি দিচ্ছি।’ এ কথা বলেই তারা একটা ছোট্টো নৌকা নামিয়ে কিছু খাবার-দাবার দিয়ে ত্রিস্তানকে সেখানে বসিয়ে দিল। সেই সঙ্গে খুলে দিল হাত-পায়ের বাঁধন। কি জানি সমুদ্র ওদের প্রার্থনা শুনেছিল কিনা, কিন্তু হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি কমে গিয়ে কুয়াশা কেটে গেল। আস্তে আস্তে ভেসে চললো ত্রিস্তানের নৌকো। ঠেকলো এসে সমুদ্রের পাড়ে।

সামনেই খাড়া পাহাড়। আর কোনো পথ নেই। অতি কষ্টে, প্রাণ হাতে নিয়ে, ত্রিস্তান বেয়ে উঠলো খাড়া পাহাড়ের প্রাচীর। উঠে দেখলো সামনে এক বিস্তৃত বনভূমি, নিচে সমুদ্র। আর কোথাও কিছু নেই। তখন ত্রিস্তানের একবার তার বাবা, গুরু গরভেনাল, আরও সকলের কথা মনে পড়লো। মনে পড়লো নিজের দেশ লিওনেসের কথা। আর এখন সে কোথায় এসে পড়লো? দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো সে হঠাৎ। জনশূন্য সমুদ্রতীরে একা বালক বসে বসে কাঁদতে লাগলো। আপনারা ভেবে দেখুন সেই অসহায় দৃশ্য।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দূরে মানুষের শব্দ পেয়ে তিস্তান চোখ মুছলো। কয়েকজন অশ্বারোহী একটা হরিণকে তাড়া করে আসছে। বাণবিদ্ধ হরিণটা এসে লুটিয়ে পড়লো ত্রিস্তানের কাছেই। অশ্বারোহীরা নেমে এলো। ত্রিস্তান একটা গাছের আড়ালে লুকিয়েছে— শিকারীরা ওকে দেখতেই পায়নি। ওদের মধ্যে একজন তলোয়ার খুলে এক কোপে হরিণটার মাথা কেটে ফেলতে গেল। তাই দেখে ত্রিস্তান চেঁচিয়ে উঠলো, ওকি, ওকি, অমন সুন্দর হরিণের চামড়াটা নষ্ট করছেন?

অশ্বারোহীরা চমকে উঠলো। তারা এসে জিগ্যোস করলো, তুমি কে? কি তোমার নাম?

ত্রিস্তান জবাব দিল, আমার নাম ত্রিস্তান, লোকে আমাকে দুঃখ বলে ডাকে। আমি বলছিলুম, আপনারা হরিণটার গলা কেটে ফেলছিলেন, এতে যে চামড়াটা নষ্ট হয়ে যায়।

—তুমি অন্যরকম ভাবে চামড়াটা ছাড়াতে জানো নাকি?

—আজ্ঞ হ্যাঁ। যদি অনুমতি করেন, আমিই চামড়া ছাড়িয়ে দিতে পারি।

একটা ছুরি চেয়ে নিয়ে নিপুণ হাতে ত্রিস্তান হরিণটাকে চিরতে লাগলো। একটু পরেই মনে হলো, ওখানে যেন দুটো হরিণ আছে। একটা হরিণের খোসা, আর একটা ছালহীন মাংসময় হরিণ। তারপর ত্রিস্তান হরিণের মাংসগুলোও পৃথকভাবে কাটতে লাগলো।

অশ্বারোহীরা জিগ্যোস করলো, তুমি কোন দেশ থেকে এসেছো? তোমার বাবা কে? এ রকম চমৎকার ভাবে হরিণ ছাড়াতে তো এ দেশের কেউ জানে না।

ত্রিস্তান এখন বুঝেছে, সব জায়গায় সব কথা বলা উচিত নয়। সে বললো, আমার দেশের নাম লিওনেস, আমার বাবা একজন ব্যবসায়ী। আমি বাবার সঙ্গে জাহাজে করে ভারতবর্ষের পথে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ আমাদের জাহাজ ঝড়ের মুখে পড়ে। জাহাজ ভেঙে ভাসতে ভাসতে আমি এসেছি এখানে। জানি না, অন্য আর কেউ বেঁচে আছি কিনা।

অশ্বারোহীরা দুর্ঘটনার কথা শুনে দুঃখিত হলো। ত্রিস্তানের মধুর ব্যবহার দেখে বললো, বাঃ! লিওনেসের ব্যবসায়ীর ছেলেরাও এমন অভিজাতের মতো হয়? তুমি আমাদের রাজার কাছে যাবে? আমাদের রাজা মার্ক তোমাকে দেখলে খুব খুশী হবেন। তুমি তাঁর কাছে আশ্রয়ও পেতে পারো।

ত্রিস্তান রাজা মার্ক সম্বন্ধে কিছুই জানে না। সে আগ্রহের সঙ্গেই রাজার কাছে যেতে চাইলো। অশ্বারোহীরা ওকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চললো।

বন পেরিয়ে জনপদ। দূর থেকে দেখা যায় বিশাল দুর্গ টিন্টাজেল। সেই দুর্গের দেওয়াল বেয়ে উঠেছে আঙুরলতা। সাদা আর নীল পাথরের চৌকো চৌকো দেওয়াল, দূর থেকে দেখায় পাশা খেলার ছকের মতো। লোকে বলে, পুরাকালের দৈত্যরা এই দুর্গ বানিয়েছে–নইলে মানুষের কি সাধ্য, এতবড় দুর্গ বানানো। টিন্টাজেল দুর্গ দেখে ত্রিস্তান অভিভূত হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো, আমি কি এ দুর্গের মধ্যে কোনোদিন ঢুকতে পারবো? তখনও সে জানে না, এই দুর্গের মধ্যেই তার ভাগ্য তাকে নিয়ে কি নিষ্ঠুর খেলা খেলবে।

রাজা মার্ক বন্ধু-সামন্তদের সঙ্গে বসেছিলেন, অশ্বারোহীরা ত্রিস্তানকে তাঁর সামনে নিয়ে এলো। তারপর সবিস্তারে বলতে লাগলো কি করে ত্রিস্তানকে দেখেই চমকে উঠলেন, এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। রাজা মার্ক ত্রিস্তানের জন্মকথা কিছুই জানেন না। তিনি জানেন তাঁর বোন শ্বেতপুষ্পা আর তাঁর বন্ধু রিভালেন মারা গেছেন নিঃসন্তান অবস্থায়। তবু ত্রিস্তানকে দেখে তাঁর মনে হতে লাগলো, এ মুখ বহুদিনের চেনা। ওকে দেখেই মনের মধ্যে কেমন মায়া আর ভালোবাসা জেগে উঠলো। রাজা মার্ক ওর দিকে তাকিয়ে তন্ন তন্ন করে ভাবতে লাগলেন, কেন এই মুখ দেখেই তাঁর হৃদয় দুলে উঠলো! কিছুই ভেবে পেলেন না। কিন্তু, আপনারা জানেন, রক্ত রক্তকে চেনে। রাজার রক্ত ত্রিস্তানের রক্তকে চিনেছিল। রাজা ত্রিস্তানকে ডেকে নিয়ে পাশে বসালেন। বললেন, তুমি এখানেই থাকো।

সেই দিন সন্ধেবেলা গান-বাজনার মজলিস। রাজ্যের শ্রেষ্ঠ গায়ক বীণা বাজিয়ে গান ধরেছেন। ত্রিস্তান রাজার পাশে বসে। গান চলেছে, এক প্রণয়ী যুগলের ব্যর্থ প্রেমের করুণ গান, হঠাৎ ত্রিস্তান গায়ককে বলে উঠলো, গুণী, এই গানটি এত মধুর, তার চেয়েও মধুর আপনার গলা, কিন্তু মাঝের একটু অংশ বাদ দিলেন কেন? সে অংশটা যে সবচেয়ে সুন্দর!

গায়ক নিজের গান শেষ করে বললেন, আমি মাঝের অংশটা জানি না। তুমি জানো নাকি? লিওনেসের ব্যবসায়ীরাও কি তাদের ছেলেদের এ সব উচ্চাঙ্গের গান শেখায়? তুমি সেই অংশটা গেয়ে দেখাতে পারবে?

ত্রিস্তান বিনীতভাবে বীণা যন্ত্রটা তুলে নিয়ে গান ধরলো। সেই সুরে মূর্ছনা বাতাসের স্তরে স্তরে ঘুরতে লাগলো। যেন বাতাসই হয়ে গেল সুর। সেই ভাষায় সুর ছাড়া আর কিছুই নেই। পুরুষের কৈশোরের কণ্ঠস্বর নারীর চেয়েও অনেক মিষ্টি অনেক সুরেলা হয়। ত্রিস্তানের সেই মিষ্টি রিণরিণে গলার সুরে সভাগৃহ যেন কাঁপতে লাগলো।

গান যখন শেষ হলো, তারও অনেকক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত সভাস্থল নিস্তব্ধ। রাজা উঠে এসে ত্রিস্তানকে আলিঙ্গন করে বললেন, ধন্য সেই গুরু, যে তোমাকে গান শিখিয়েছে। তোমাকে দেখা মাত্রই আমার মনে আনন্দও হচ্ছে, দুঃখও হচ্ছে। কেন জানি না, বৎস, তোমার গান আমাকে অনেক দুঃখ ভুলিয়ে দিল। এ রকম শুদ্ধ সঙ্গীত মানুষের মনও শুদ্ধ করে। ত্রিস্তান, তুমি আমার কাছে থাকো। তুমি আর কোথাও যেও না। আমার হৃদয় বারবার তোমাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে।

অভিভূত হয়ে ত্রিস্তান বললো, মহারাজ যদি দয়া করেন, আমি থাকবো আপনার ভৃত্য হয়ে। আমি হব আপনার শিকারের সঙ্গী, আপনার বীণাবাদক।

সেখানেই থেকে গেল ত্রিস্তান। তিন বছর কেটে গেল। রাজা মার্কের কোনো ছেলে ছিল না। ত্রিস্তানের প্রতি এত টান জন্মালো যে এক মুহূর্তের জন্য তিনি ওকে কাছ ছাড়া করেন না। রাজকার্যের সময়ও তিনি ত্রিস্তানকে ডাকেন পরামর্শ দিতে। রাজার মন খারাপ হলে ত্রিস্তান বীণা বাজিয়ে শোনায়, রাত্রে রাজা যখন শুতে যান, ত্রিস্তান শুয়ে থাকে তাঁর পাশের ঘরে। দেশের সব লোকও ভালোবাসে ত্রিস্তানকে।

প্রভুগণ, আপনারা জানেন, সৎ কবি কখনও কাব্য-গাথা অনাবশ্যক দীর্ঘ করে না। বাজে কবিরাই কাহিনীকে অকারণে ফেনিয়ে তোলে। রাজা মার্ক ত্রিস্তানকে কত রকম ভাবে স্নেহ দেখাতেন সে কথার আর বর্ণনা করে লাভ নেই। আমাদের মূল বিষয় ত্রিস্তানের বুক- পোড়ানো ভালোবাসা। সে কথায় আমরা এখনো আসিনি। তার আগে তার পূর্বকথা সংক্ষেপেই সেরে নিতে চাই।

প্রভুভক্ত সত্যবাহন রোহল্ট ত্রিস্তানকে হারিয়ে এক মুহূর্ত শান্তিতে ছিলেন না। তিনি নিজেই ছদ্মবেশে ত্রিস্তানকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। অনেক দেশ ঘুরে, বহুদিন পর রাজা মার্কের দেশ কর্নওয়ালে এসে ত্রিস্তানকে দেখা পেলেন। ত্রিস্তানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে রোহল্ট বললেন, ‘দুঃখ, তুমিই আমার একমাত্র সুখ ছিলে। ত্রিস্তান, তুমি আমার সন্তান নও, তুমি রাজপুত্র। এবার এসো, নিজের রাজ্য জয় করে নাও!’

রোহল্ট রাজা মার্ককে দেখালেন রানী শ্বেতপুষ্পার অভিজ্ঞান। বললেন, ত্রিস্তান অজ্ঞাত কুশলীন নয়, রাজারই আত্মীয়, তাঁর প্রিয় বোনের সন্তান। এখন ত্রিস্তান বড় হয়েছে। এখন ত্রিস্তানের উচিত, বাহুবলে নিজরাজ্য উদ্ধার করা এবং পিতৃহত্যার শোধ নেওয়া।

রাজা মার্ক একথা শুনে আনন্দে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। তখনই তিনি দেশে ফেরার জন্য ত্রিস্তানকে সব রকম সাহায্য দিলেন- অস্ত্রশস্ত্র সৈন্যসামন্ত। লিওনেসে ফিরে এসে ত্রিস্তান গোরতর যুদ্ধে মেতে উঠলো। পিতৃহন্তা মর্গানের সঙ্গে সম্মুখ দ্বন্দ্বযুদ্ধে তাকে পরাজিত করে খুন করলো। এবং সেই রক্তে তর্পণ করলো পিতার। নিজের রাজ্য জয় করে ত্রিস্তান এবার হল রাজা।

কিন্তু রাজা হলেও ত্রিস্তানের সুখ নেই। রাজা হওয়া বড় আঁটসাট ব্যাপার। সব সময় ব্যস্ত আর দায়িত্বপূর্ণ থাকতে হয়। ত্রিস্তানের ভালো লাগে না। তার বয়স তখন একুশ। এতকাল সে স্বাধীনভাবে যেখানে- সেখানে, বনে-পাহাড়ে ঘুরেছে, একা একা বীণা বাজিয়ে গান করেছে, এখন মাথায় ভারী রাজমুকুট পরে দায়িত্বপূর্ণ কাজ করতে তার অস্বস্তি লাগে। রাজসভায় যখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা হয়, তখন হঠাৎ তার ইচ্ছে হয় উঠে গিয়ে নিরালায় প্রাসাদের অলিন্দে চুপ করে বসে থাকতে।

ছেলেবেলা থেকে এ রাজ্যে যাদের সে ভালোবেসেছে, যাদের সঙ্গে সমানভাবে মিশেছে— আজ তারা দূর থেকে তাকে শ্রদ্ধা করে। কেউ সহজভাবে কথা বলে না। নাঃ, রাজা সেজে থাকা তার পছন্দ হয় না! তার বারবার মনে পড়ে রাজা মার্কের কথা, তাঁর অফুরন্ত স্নেহ ভালোবাসার কথা। কেমন স্বাধীনভাবে সেখানে বীণা বাজিয়ে ঘুরে রেড়াতো। সেই জীবনই ছিল তার ভালো। তাই ত্রিস্তান তাঁর রাজ্যের সমস্ত সম্ভ্রান্ত লোক আর জমিদারদের একদিন ডাকলো। ডেকে বললোঃ

বন্ধুগণ, ঈশ্বর এবং আপনারা আমাকে সাহায্য করেছেন, তাই আমি পিতৃহন্তাকে নিহত করে প্রতিশোধ নিয়েছি। আমি আমার পিতার আত্মাকে তৃপ্তি দিয়েছি। কিন্তু এছাড়াও আমার দুজন পিতৃতুল্য আত্মীয় আছেন। সত্যবাহন রোহল্ট ও কর্নওয়ালের রাজা মার্ক। এঁরাও আমার পিতা, একজন আমাকে বাল্যকালে প্রতিপালন করেছেন, একজন কৈশোরে। এদের কাছে আমার ঋণ আছে। আমি সেই ঋণ থেকেও মুক্ত হতে চাই।

একজন স্বাধীন মানুষের দু’রকম সম্পত্তি থাকে। নিজের শরীর আর তার জমি। এই দুই সম্পত্তি আমি উৎসর্গ করতে চাই আমার দুই পিতাকে। সুতরাং, আমার এ রাজ্য আমি রোহল্টকে দিলাম। পিতা, তুমি সর্বসমক্ষে আমার এ রাজ্য গ্রহণ করে আমাকে ঋণমুক্ত করো।

আর আমার এ শরীর আমি দেবো রাজা মার্ককে। আমি এদেশ ছেড়ে চলে যাবো- যদিও যেতে খুব কষ্ট হবে আমার-তবুও আমি কর্নওয়ালে গিয়ে রাজা মার্কের সেবা করতে চাই। আপনারা কেউ কি এতে আপত্তি করবেন? আপনারা অনুমতি দিন, আমি রাজপদের গুরুভার থেকে মুক্ত হই।

এরকম অসাধারণ মহানুভবতার কথা ত্রিস্তানের মুখে শুনে প্রথমে সকলেই কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। তারপর একসঙ্গে আন্তরিকভাবে জয়ধ্বনি দিতে লাগলেন ত্রিস্তানের নামে! এ ছেলেটার মানুষের শরীর কিন্তু অন্তঃকরণটা দেবতার মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *