সোনালি-রূপালি

সোনালি-রূপালি

চিরদিন আমি এইরকম মোটাসোটা গিন্নিবান্নি ছিলাম না। ইয়ে-কী-বলে আমাকে বিয়ে করবার আগে আয়তলোচনা তন্বী তরুণী ছিলাম। আর এই যে আমার ইঁদুরের ল্যাজের মতন বিনুনিটা পাকিয়ে বড়ি খোঁপা করে রেখেছি, এ তখন ছিল কুণ্ডলিনী সর্পিণীর মতন, মিশকালো, চকচকে, মসৃণ। কিন্তু আমার সে শ্যামশ্রী সত্ত্বেও তখন আমার জীবনে কাব্য ঘনিয়ে ওঠেনি। স্পষ্ট মনে আছে আমার দিনের পর দিন বৃথা কেটে যেত; রামধনুকের রঙ আর কিছুতেই লাগত না। আমি খেতুম না ভালো করে, বসতুম না আরাম করে, গলা ছেড়ে কথা বলতুম না, পাছে আয়েসী হয়ে গিয়ে লোমহর্ষণের দর্শন না পাই। মিছিমিছি সে সকল আত্মদাহ, আমার ঘটনাহীন যৌবনের দুর্লভ দিনগুলো টলটলে নদীর জলের মতন স্বচ্ছন্দে গড়িয়ে চলল, শেষে হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি যৌবনের খাতার শেষ পাতা উলটে ফেলেছি।

সেদিন বিষম রেগেছিলুম; এই যে মনে মনে এত কাব্যরচনা করলুম, এত অসম্ভব ঘটনাবলী কল্পনায় সৃষ্টি করলুম, একি সব মিছিমিছি নাকি? যে অপরূপ আমাকে চিরদিন হাতছানি দিয়ে ডেকে-ডেকে আড়ালে লুকোয়, শেষ অবধি সে কি সত্যি-সত্যি আমাকে এড়িয়ে যাবে নাকি? বিষম রাগ হল। ইয়েকে খুব বকলুম, বললুম, “তুমি ভারী ইয়ে; তোমার মুখখানাতে দিন-রাত্তির একগাল হাসি লেগে আছে; তোমার মাথার মাঝখানকার চুল পাতলা হয়ে গেছে; তুমি মোটা হয়েছ; রাত্তিরে নাক ডাকাও; তুমি আমাকে কখনো মক্ষিরাণী বলে ডাকো না; আমার জীবনটাই বৃথা!”

সে অবাক হয়ে আমার দিকে একবার চেয়ে আবার মন দিয়ে দাড়ি কামাতে লাগল।

হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে আমার এই হেলা-ফেলায় নষ্ট-করা জীবন কানায়-কানায় রসে-রহস্যে ভরে উঠল।

আমরা অনেকদিনের পুরনো একটা বাড়িতে উঠে এলুম। সবাই সকালবেলা বাড়ি বদল করে, কিন্তু আমরা এলুম সন্ধ্যের আগে; সূর্য তখনো ডুবে যায়নি কিন্তু তার স্তিমিত আলো লালচে হয়ে এসেছে। সেই লালচে রোদ লেগেছে বাড়ির বাইরের ছাই রঙের দেয়ালে, বাড়ির চারপাশের বাগানের বিশাল-বিশাল আমগাছের বাতাবীলেবু-গাছের ঘনসবুজ ডালপালাতে, যাতে এক ঝাঁক পাখিই বাসা বেঁধেছে। সেই যে শুনেছিলুম মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নৈঃসঙ্গের কথা, যা কোনো কিছুতে দূর করতে পারে না, আমার প্রাণের সেই নিদারুণ নিঃসঙ্গতা এক নিমেষে যেন একটু কমে গেল।

প্রাচীন বাড়িটার কাঠের সিঁড়িতে গালচে দেওয়া নেই, কিন্তু গালচে পাতার দাগ আছে, ঝকঝকে পেতলের শিক দিয়ে আঁটা লাল পুরু গালচের দাগ ধাপে-ধাপে রয়েছে। একতলাটা সংস্কার করে আধুনিক বানিয়েছে, কিন্তু ঐ গালচে-বিহীন কাঠের সিঁড়ির উপরে দোতলাটা কোন বিগত যুগের। আমরা আসতে যারা দুদিনের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছে, আমরা চলে গেলে তারা কানায়-কানায় সব জুড়ে বসবে। বলতে সময় লাগল, কিন্তু বাড়িতে পা দেবার মুহূর্তেই এত কথা আমার মনের মধ্যে বিদ্যুতের মতো খেলে গিয়েছিল।

পুরোনো জিনিসের জাদু আছে এই বাড়িতে। একতলার সমস্ত আসবাব নতুন, কিন্তু দোতলাটাকে ধুয়ে-মুছে নিলে পরও সে তার পুরোনো ভাঙা সজ্জা নিয়ে দিনরাত আমাকে ইঙ্গিত করত। সত্যিকারের কিছু হয়তো ছিল না। নালন্দার ভাঙা বিদ্যালয়ে, বুদ্ধগয়ার জনহীন মন্দির দেখেও আমার এই রকম কেমন যেন চেনা-চেনা লেগেছিল, মনে হয়েছিল এদের সঙ্গে আমার একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে; একটু ভাবলেই হয়তো বিষম প্রয়োজনীয় কত কথা মনে পড়ে যাবে; কিন্তু হায়রে আমার মায়ের দেওয়া এ জন্মের মন, সেই বিশাল ইঙ্গিত তাকে এড়িয়ে গেল। আর এখানেও দোতলার সারি-সারি ভাঙা জানলাগুলো আমগাছ আর বাতাবিলেবুগাছের দিকে অপলকনেত্রে চেয়ে রইল, কী একটা তাদের প্রকাশ করা উচিত ছিল সে আর বলা হল না।

ছোটবেলায় হয়তো আমি মন্ত্রপড়া একটা কিছু ভুল করে খেয়ে ফেলেছিলুম আর তার আমেজ এখনো আছে আমার চোখে আর রক্তের মধ্যে। মনে হত জীবনের অর্ধেকের বেশি কেটে গেল, তবু যেন সব থেকে যা প্রধান, যার কাছে দাঁড়ালে আর সব কিছু ছোট হয়ে যায়, সেটাই হল না। মনে হত যৌবনে কেন সারারাত্রি প্রত্যাশা করে থাকতুম সকালবেলা আমাকে কী আশ্চর্য জিনিস এনে দেবে। আর সারাদিন অধীরভাবে প্রতীক্ষা করে থাকতুম রাত্রি আমাকে অলৌকিকের খোঁজ দেবে? কেন গাছপালা আলো-অন্ধকার, চাঁদের কিরণ আর সূর্যরশ্মি সবাই রহস্য মেখে এসে আমাকে নেমন্তন্ন করত?

একদিন দুপুরে এই সব হতাশার কথা ভাবছিলুম। রান্নাঘর ধুয়ে চাকররা চলে গেছে, কোথায় বেশ ছায়া-ছায়া জায়গা দেখে বিড়ি খেতে। ছেলেরা গেছে স্কুলে, ইয়ে গেছে আপিসে। আমি একলা। সকালের সূর্য সরে গেছে, বারান্ডায় সারি-সারি সাজানো জলপাই আর কাঁচালঙ্কার আচারের বোতলে আর রোদ লাগছে না। সেগুলোকে সরিয়ে দিলুম। শুকনো কাপড়গুলো তুলে ফেললাম। কুকুরটাকে ছেড়ে দিলুম। তারপর দোতলায় গেলুম, যেখানে উত্তরের ঘরে ভাঙা ড্রেসিং-টেবিলের উপর পুরোনো মাসিকপত্রিকা গাদা করে রেখেছিলুম, প্রমথবাবুর এক পরমাশ্চর্য জুড়ির গল্প খুঁজবার জন্য।

অযত্নে রাখা পুরোনো মাসিকপত্রিকার মধ্যেও আছে পুরোনো জিনিসের জাদু। যা এক সময়ে অতি আধুনিক ও প্রয়োজনীয় ছিল, এখন যাতে অনাদরের ধুলো জমছে, এমন সব কিছুতেই আছে। নিস্তব্ধ দুপুরে আমি সেই ধুলোর মন্ত্রে ডুবে গিয়েছিলাম, হঠাৎ সতর্ক হয়ে চোখ তুলে তাকে দেখতে পেলুম। তখুনি আমার চিন্তাশক্তি, আমার সম্ভব-অসম্ভব বিচার করবার শক্তি দূর হয়ে গেল, তাই আমি ভয় পেলুম না, শুধু বিস্মিত হয়ে অনিমেষ নয়নে তার দিকে চেয়ে রইলুম। সে দরজার কাছে, ঘরের ভিতর মুখ করে ঈষৎ বঙ্কিম ভঙ্গীতে দাঁড়িয়েছিল। আমার দুই কৃতার্থ চক্ষু তার সেই শান্ত লাবণ্য গ্রহণ করল। আমি প্রসন্ন হয়ে তার ফিকে হয়ে যাওয়া আলতাপরা, পদ্মফুলের মতন পা দুখানি থেকে তার কালোপাড় দিশি শাড়ি, সাদা জামা, অনতিদীর্ঘ কোঁকড়া খোলা চুল, তার নিখুঁত সুন্দর বিবর্ণ মুখখানি, বুকের কাছে জড়ো করা কেবলমাত্র দুগাছি কঙ্কণ-শোভিত হাত দুখানি, সমস্ত বারবার চেয়ে দেখলুম। দেখলুম তার একহাতে একটি নীলসবুজ মিনে করা ছোট পেতলের বাক্স, আর অন্য হাতে সবুজ পাথরের দীর্ঘ একছড়া মালা। অপূর্ব সুন্দর। বর্ষায় ঘন বনানীর সবুজ অন্তরালের মতন; সেই বনানীর ছায়া-লাগা বর্ষার নিটোল ধারার মতন, বনানীর অন্তরালে ঘন বনের ছায়া-পড়া স্বচ্ছ সবুজ দীঘির মতন। চোখ-জুড়োনো সবুজ পাথরের এক ছড়া মালা দেখলুম, আর তার বড়-বড় পুঁতির সঙ্গে পুঁতির আঘাত লাগার একটুখানি নিক্কণ কানে শুনলুম।

সে আমাকে দেখেনি। তার দুই চোখ ঘরের ভিতর নিবিষ্ট ছিল। তার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও ঘরের মধ্যে তাকিয়ে দেখলুম। শূন্য ঘরের মধ্যে চেয়ে দেখলুম কোথায় তার আগ্রহভরা চোখের লক্ষ্যস্থল, শূন্য ঘর থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার তার দিকে চাইলুম; দেখলুম যে রং-ওঠা পাল্লাভাঙা দরজাটা রয়েছে সে নেই। তখনই আমার সর্বাঙ্গ কন্টকিত হয়ে উঠল, আমার বিগতযৌবন মধ্যবিত্ত জীবনে অপরূপের রঙ লাগল। আমি প্রমথবাবুর সেই পরমাশ্চর্য জুড়ির কথা ভুলে গিয়ে অন্যমনস্কভাবে নিচে নেমে এলুম আর চোখ বুজলেই দেখতে পেলুম তার চম্পক আঙুলে দুলছে এক ছড়া ঘন সবুজ মালা।

কাউকে কিছু বলতে বাধছিল; আমার স্বাভাবিক মুখরতা ভুলে গিয়েছিলুম, এ সব কথা গোপন করেছিলুম। এর মধ্যে অনেকদিন অনেক কাজে উপরে গেছি, প্রতীক্ষা করে থেকেছি, আর তাকে দেখিনি। ক্রমে তার ছায়া মনের মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে এল, মনে সন্দেহ হতে লাগল, সত্যি বোধহয় তাকে দেখিনি, স্বপ্ন দেখেছি। এমন সময় যখন মন থেকে তার বিন্দুমাত্র চিন্তাও লোপ পেয়েছে, তখন তাকে আবার দেখলুম। সেই নির্জন নিস্তব্ধ দুপুরে, হেমন্তকালে, বাইরে যখন ঝোড়ো হাওয়ায় শুকনো পাতার মাতামাতি।

পুরোনো কাগজওয়ালাটা বহুদিন আসেনি, তাই আমি একমাসের জমানো খবরের কাগজের রাশি উপরে নিয়ে গেছি। সেগুলোকে ভাঙা ড্রেসিং টেবিলের তলায় নামিয়ে রেখে, সোজা হয়ে দাঁড়াতেই তাকে দেখলাম, এত কাছে যে হাত বাড়ালেই তাকে ছুঁতে পারি। যতবার দেখেছি, সহসা গোটা মানুষটাকেই দেখেছি, তাকে যেতে আসতে দেখিনি, ক্রমশ তাকে রূপ নিতে দেখিনি, আমি তাকে দেখেছি পরিপূর্ণভাবে। আশ্চর্য হয়ে দেখলুম তার সেই আলতা-ওঠা রাঙা পা দুখানি, কালোপাড় দিশি শাড়ি, তার খোলা কোঁকড়া খাটো চুলগুলি, তার পাংশু সুন্দর মুখ, বুকের কাছে জড়ো-করা তার নয়নাভিরাম হাত দুখানি, তার হাতের মিনে করা বাক্স— আজ ভালো করে দেখলুম তাতে লাল চোখওয়ালা নীলসবুজ চিনে ড্রাগন চিত্র করা— আর তার বড়-বড় সবুজ পাথরের সুদীর্ঘ মালা, শ্যাওলা-জমা সবুজ পুকুরের স্থির জলের উপর ঘন সবুজ বাঁশপাতার ছায়ার মতন, উইলোগাছের আলম্বিত পাতার ছড়ার ছায়ার মতন।

অনিমেষলোচনে দেখলুম তার মুখের সেই ব্যাকুল অতৃপ্তির ব্যথা, কালিমাচ্ছন্ন চোখের তারা দুটি একদিকে নিবদ্ধ। তার দৃষ্টিপথ ধরে আজ দেখলুম সেই বহুদিনের শূন্য ঘরে দামী নীল গালচে পাতা, তার উপর অযত্নে ছড়ানো রাশি-রাশি ছবি, নিপুণ হাতে আঁকা সব তৈলচিত্র। আর দেখলুম জানলার কাছে ইজেলে যে অসম্পূর্ণ ছবিখানা ঘর আলো করে রয়েছে তাতে সেই পরিচিত বিবর্ণ সুন্দর মুখ, সেই কালোপাড় দিশী শাড়ি, খোলা চুল। আর সবুজ পাথরের মালা। চিত্রকরকেও দেখলাম, কিন্তু অস্পষ্ট, কারণ আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, অনভ্যস্ত আবেগে হাত-পা কাঁপছিল। আমি সেই ভাঙা ড্রেসিংটেবিলটাকে অবলম্বন করে, চিন্তাস্রোত রোধ করে আশ্চর্য হয়ে দেখছিলুম চিত্রকরের দীর্ঘ দেহ, অস্পষ্ট বসনভূষণ, গৌর মুখশ্রী, চাপা ঠোঁট, বাঁকা ভ্রূ, চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সবই দেখলুম, কিন্তু অস্পষ্ট, যত না দেখলুম তার চেয়ে বেশি অনুমান করে নিলুম। মনে হল তার যৌবন শেষ হয়ে গেছে কিন্তু প্রৌঢ়ত্ব শুরু হয়নি, আর তার চোখে-মুখে অদ্ভুত অনাসক্তি।

আমার চতুরিন্দ্রিয় লুপ্ত হয়ে ছিল, কেবলমাত্র দৃষ্টিশক্তি বেঁচে ছিল। লুব্ধ চোখে যা দেখছিলুম, মুগ্ধ চেতনা তাই নীরবে গ্রহণ করছিল, নির্বিচারে, নিঃসন্দেহে।

চিত্রকর তুলি হাতে অপেক্ষা করছিল, আর সে গিয়ে নীরবে আলোর দিকে মুখ করে তার সামনে দাঁড়াল। তাকে দরজা থেকে ঘরের ভিতর অবধি হেঁটে যেতে দেখলুম না; এক মুহূর্ত আমার কাছে ছিল, এত কাছে যে তার চুলের মৃদু মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিলুম, তার স্পন্দমান হাতের মালার মৃদু শব্দ কানে আসছিল; পর মুহূর্তেই তাকে ঘরের ভিতরে ইজেলের সামনে দেখলুম। কোনো কথার আদানপ্রদান হল না, তার তৃষিত চোখের দৃষ্টি চিত্রকরের মুখের উপর গভীর প্রত্যাশায় নিবদ্ধ ছিল আর চিত্রকরের দৃষ্টি উদাসীন ও নির্লিপ্ত। আমি যেন সেখানে নেই, তাদের কাছে আমি যেন অদৃশ্য, আমার এই বাস্তব শরীর, এই চঞ্চল চেতনা, এই কৌতূহলী দৃষ্টি যেন সৃষ্টিই হয়নি। দেখলুম সে নিপুণ হাতে তুলির রেখার উপর রেখা টেনে যাচ্ছে আশ্চর্য নিশ্চয়তার সঙ্গে, তার কর্মরত হাতের উপর আনত চোখের দৃষ্টি, আর অন্যজনের মুগ্ধচোখ তার মুখ থেকে ক্ষণেকের জন্য ভ্রষ্ট হচ্ছে না। সমস্ত ঘরটি জুড়ে গভীর নীরবতা বিরাজ করছে।

কতক্ষণ এই রকম ছিলুম জানি না, হঠাৎ চকিত হয়ে দেখলুম বেলা পড়ে গেছে, গাছের ছায়াগুলি লম্বা হয়ে আসছে। জানলার বাইরে এক মুহূর্তের জন্য চেয়েছি আর সেই মুহূর্তেই ঘরের সেই অপূর্ব সম্ভারও কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। অনুভব করলুম আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি, একভাবে ড্রেসিংটেবিল ধরে দাঁড়িয়ে থেকে-থেকে হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে আর দুই চোখ বিষম ক্লান্তিতে বুজে আসছে।

সমস্ত শীতকাল কেটে গেল তার চিরন্তন শিহরন নিয়ে। আমি তাদের কথা কাউকে বলতে পারলুম না। এক দিকে আমার জীবন যেমন চিরকাল ভরা ছিল, আমার সংসার, আমার স্বামী, আমার ছেলেমেয়ে, আমার বন্ধুবান্ধব, আমার একশো রকমের ছোটখাটো কর্তব্য দিয়ে তেমনই রইল। কিন্তু আর যে দিকটা আজন্ম শূন্য ছিল অনির্বচনীয়ের প্রত্যাশায়, যে প্রত্যাশা ইদানীং প্রায় নৈরাশ্যে দাঁড়িয়েছিল সেখানে গোপনে গুঞ্জরণ শুরু হল, পত্রপুষ্পে ভরে উঠল। মনে হল এতদিনের যে দুঃখ আমার, আমার জীবনে অপরূপের আলো লাগল না— তাই সব ব্যর্থ হয়ে গেল, সে কিছু নয়। মনে হল আকাশ-বাতাসকে মুক্ত করে পৃথিবীর চারপাশের দিগ্বলয় খসে পড়েছে। মনে হল— সে যে কথায় প্রকাশ করা যায় না, কী করে বোঝাব কী আমার মনে হল।

তারপর শেষবার তাকে দেখলাম ফাল্গুন মাসের আরম্ভের দিকে। তখন আমের বোলের আর বাতাবিফুলের গন্ধে বাতাস মধুর হয়েছে, পাতায়-পাতায় বসন্তকালের হাওয়া লেগেছে, আর আমাদের ব্যবহার-না-করা দোতলার চুণ-বালি, দরজার রঙ শুকনো হাওয়াতে খসে-খসে পড়ছে। সন্ধ্যাবেলা মনে হল দোতলায় কেউ আলো জ্বেলেছে। আস্তে-আস্তে গেলুম, মনে হতে লাগল আমার বুকের ভিতর কে লোহার হাতুড়ী পিটছে। দরজার কাছে গিয়ে মন্ত্রাহতের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালুম, দেখলুম সে আমাদের ভাঙা ড্রেসিংটেবিলে ঠেস দিয়ে, এক হাতে মাটির প্রদীপ উঁচু করে ঘরের মধ্যে বিষণ্ণভাবে চেয়ে রয়েছে। অন্য হাতে সবুজ পাথরের মালা; প্রদীপালোকে তার স্নিগ্ধ রং আমার চোখকে মুগ্ধ করল।

শূন্য ঘরে নীল গালচে পাতা, শূন্য ইজেল। অযত্নে ছড়ানো ছবিগুলি কে যেন যত্নে সংগ্রহ করে দেয়ালের দিকে মুখ করিয়ে সারি-সারি দাঁড় করিয়ে রেখেছে, সমস্ত ঘরে অব্যবহারের ছাপ।

আমি সমব্যথী হয়ে তার দিকে চেয়েছিলুম, সহসা সে আমার দিকে তাকাল। এবার সে আমাকে দেখতে পেল, আমি আর অদৃশ্য রইলুম না, আমি চকিত আনন্দের সঙ্গে বুঝলুম সে আমাকে দেখতে পেয়েছে। মালাসুদ্ধ হাতখানা সে একটুখানি আমার দিকে এগিয়ে দিল, তার চোখের গভীর নৈরাশ্য আমার অসহ্য বোধ হল। তার চোখের দৃষ্টি যেন আমার চোখের মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজতে লাগল, আমি অব্যক্ত স্নেহে দুই হাত প্রসারিত করে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলুম। মনে হল হিমশীতল জলে আমি আবক্ষ অবগাহন করছি, আমার চোখে-মুখে, মনের ভিতর সেই হিমশীতল ছোঁয়া লাগল, আর সে যেন আমার বাহুপাশের মধ্যে বাতাসে বিলীন হয়ে গেল কিন্তু বিদায়কালে স্পষ্ট অনুভব করলাম সবুজ মালাখানি আমার হাতে তুলে দিল। তার সবুজ পাথরের শীতল কঠিন স্পর্শ আমার হাতে লাগল। আমি জীবনে এই প্রথম ও শেষবারের মতন মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেলুম।

ওরা তখন খেলার মাঠ থেকে, আফিস থেকে, বন্ধুদের বাড়ি থেকে সব ফিরে এসেছে। আমায় দেখতে না পেয়ে, উপরে এসে ধরাধরি করে আমাকে নামিয়ে নিয়েছে, মাথায় জলের ঝাপটা দিয়েছে, হাওয়া করেছে, আমার চেতনা ফিরে এসেছে। আমি সমস্ত প্রশ্ন থেকে নিজেকে রক্ষা করবার জন্য বালিশে মুখ লুকিয়ে ক্লান্তির ভান করে রইলুম।

অনেক রাত্রে ইয়ে বললে, ‘আজ তোমার জন্য একটা সুন্দর জিনিস এনেছি, আর আজই তুমি আমাদের এমন ভয় দেখালে!’

আমি নীরব রইলুম।

সে আবার বললে, ‘দেখো, কোর্টের কাছে হলটাতে আজ অনেক পুরোনো জিনিস নিলেম হচ্ছিল, তোমার জন্য এই মালাটা কিনলুম। সঙ্গে একটা ড্রাগন-আঁকা মিনে-করা বাক্স ছিল কলেক্টার সাহেবের মেম অনেক দামে ডেকে নিল।’

বিস্ময়ে বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে দেখলুম, তার হাত থেকে ঝুলছে এক ছড়া বড়-বড় পুঁতির সবুজ পাথরের মালা, বাতাবিলেবুর গাছের মাঝে বর্ষাধারার মতন স্নিগ্ধ-শ্যামকান্তিময়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *