সোনালি রুপোলি শিকি
রাজকোষ ভ’রে জমেছে মোহর আর আশরফি। সোনার ঝকমকে মুদ্ৰা। রুপোর চকচকে শিকি। হাতে নিলে ঝকঝক চকচক ক’রে ওঠে, বেজে ওঠে জলতরঙ্গের মতো। এক মুঠো মুদ্রা হাতে নিলে মনে হয় মুঠোতে জমেছে আকাশের জ্যোতির্ময় তারাগণ। সোনালি মুদ্রায় রুপোলি মুদ্রায়, সোনালি শিকিতে রুপোলি শিকিতে ঐশ্বর্যশালী হয় রাজকোষ। যে- রাজকোষে যতো বেশি মুদ্রা, সে-রাজকোষ ততো বেশি ধনাঢ্য। ভাষার রাজকোষ ভ’রে থাকে শব্দে। সোনালি শিকির মতো শব্দ, রুপোলি আধুলির মতো শব্দ, ঝলমল করে চকচক করে। যে-ভাষার ভাণ্ডারে যত বেশি শব্দ সে-ভাষা ততো বেশি ধনী। শব্দগুলো সোনালি রুপোলি শিকির মতো। ধাতুতে তৈরি নয়, ধ্বনিতে তৈরি। তবু ধাতুর মতোই টেকসই। এক সময় সোনা ক্ষ’য়ে যায়, মলিন হয়ে ওঠে রুপো। ঘষা পয়সায় পরিণত হয় রাজমুদ্রা। শব্দগুলোও তেমনি।
যেনো কোনো রাজা শব্দের শিকি আধুলি — মোহর আর আশরাফি বানিয়ে ছেড়েছে জনগণের মধ্যে। টাকা দিয়ে মানুষ জিনিশ কেনে। শব্দ দিয়ে কেনে একে অন্যকে, একে অন্যের মনোভাবকে। আমরা মনের কথা প্রকাশ করি আমি শব্দে। তোমার মনের কথা তুমি জানিয়ে দাও শব্দে। যতো শব্দ থাকে ততোই সুবিধা হয় ভাষা ব্যবহারকারীদের। মুদ্রা যেমন এক সময় মলিন হয়ে যায়, পরিণত হয় ঘষা পয়সায়, শব্দও তেমন অনেকটা। এক সময় যে-শব্দ চলে কোনো ভাষায়, কয়েক বছরে সে-শব্দের কোনো কোনোটি মলিন হয়ে পড়ে। মানুষেরা তখন সেটি কম ব্যবহার করে। এক সময় সেটি চ’লে যায় ব্যবহারের বাইরে, পরিণত হয় ঘষা শব্দে। তখন তৈরি হয় নতুন শব্দ। চকচক করলেই কোনো কিছু সোনা হয় না, কিন্তু চকচকে জিনিশ পছন্দ করে মানুষেরা। পছন্দ করে চকচকে শব্দও। যুগে যুগে ভাষার শব্দও বদলাতে থাকে। অনেক শব্দ হারিয়ে যায়, জন্মে নতুন শব্দ, নতুনতর শব্দ। ধনশালী হয়ে ওঠে ভাষা। ভাষা শব্দের সোনালি রুপোলি শিকির রাজকোষ।
একএকটি শব্দ প্রকাশ করে একটি বা একাধিক অর্থ বা ভাব বা ধারণা। কেউ কেউ পেয়ালার সাথেও তুলনা করে শব্দের। পেয়ালায় আছে এক পেয়ালা দুধ। দুধটুকু শুষে নিলে বা ফেলে দিলে পেয়ালাটি শূন্য। শব্দ- পেয়ালায় তেমনি ভরা থাকে ভাব বা অর্থ। ‘চাঁদ’ শব্দের পেয়ালাটিকে ঢেলে দিলে গড়িয়ে পড়ে আকাশের উজ্জ্বল উপগ্রহের ভাব। ‘ভালোবাসি’ শব্দের পেয়ালাটিতে টলমল করে আমাদের হৃদয়মনের আবেগের দুগ্ধ। ভাবে ভ’রে আছে শব্দের পেয়ালা।
বাঙলা ভাষায় আছে অজস্র শব্দ। কতো শব্দ আছে, তা কারো জানা নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ’রে জমেছে শব্দের শিকি আধুলি বাঙলা ভাষার ভাণ্ডারে। তাতে ধনী হয়ে উঠেছে বাঙলা ভাষা। বহু শব্দের শিকি জমেছিলো বাঙলা ভাষার শুরুর কালে। যতোই দিন যেতে থাকে জমতে থাকে নতুননতুন শব্দ। হারিয়ে যেতে থাকে শব্দ। জমতে থাকে আরো নতুন শব্দ। আছে ‘তুমি’র মতো ছোট্ট মিষ্টি শব্দ। ছিলো ‘আলিএঁ’র মতো শব্দ; ছিলো ‘ফাডডিঅ’র মতো শব্দ। আছে ‘জমি’, ‘চাষ’, ‘আগুন’, ‘পাখি’, ‘নদী’র মতো চেনা শব্দ। ছিলো ‘সহ্মা’, ‘কোঁয়রী’, ‘শিশে’, ‘রেহা’র মতো কিছুটা চেনা কিছুটা অচেনা শব্দ। আছে ‘চাঁদ’, ‘তারা’, ‘বই’,’স্বপ্ন’, ‘আকাশ’, ‘জ্যোৎস্না’র মতো শব্দ। ছিলো ‘অপত্রপা’, ‘অব্ৰুবাণ’, ‘সৈংহিকেয়’, ‘প্রাডিব্বাক,’ ‘উৎকলিকাকুল’, ‘আস্যদেশ’, ‘কোকিলকলালাপবাচাল’, ‘সুন্দরীমুখমনোহরান্দোলিতোৎফুল্লারাজীব’-এর মতো শব্দ। বহু আছে কিছু নেই। বহু থাকবে কিছু থাকবে না। বাঙলা ভাষার ভাণ্ডার ভরা থাকবে শব্দে।
বাঙলা ভাষার শব্দগুলো কি শুধুই বাঙলার? বাঙলা ভাষা কি ধনী শুধুই নিজের ধনে? পৃথিবীতে কখনো কি কেউ শুধু নিজের ধনে ধনী হয়েছে? না, হয় নি কখনোও, ধনীদের ধনভাণ্ডারের একটি অংশ নিজেদের, অন্য অংশটি পরের। তারা ব্যবসা ক’রে বাড়ায় নিজের ধন, আর সাথেসাথে হরণ করে অনেকটা পরের ধন। ভাষার বেলাও তাই। বাঙলা ভাষার শব্দের একটি বড়ো অংশ নিজের, বাঙলার। আরেকটি অপরের, অন্য ভাষার। বাঙলা ভাষার ভাণ্ডার ভ’রে আছে নিজের ধনে ও পরের ধনে। তাই বাঙলায় পাই দু-রকম শব্দ; বাঙলা শব্দ ও বিদেশি শব্দ বা ভিন্ন ভাষার শব্দ। বিদেশি বা ভিন্ন ভাষার শব্দগুলো হরণ ক’রে আনে নি বাঙলা ভাষা। গ্রহণ করেছে। আর অনেক সময় তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।