সোনালি চুল

সোনালি চুল

বাড়ির পাশেই কবরখানা থাকলে ব্যাপারটা কীরকম হয় তা আর পাঁচজনের পক্ষে অনুমান করা সহজ নয়। নিতু সেদিক দিয়ে ভারি ভাগ্যবান। জ্ঞান হওয়া থেকেই ও জেঠুর জানালায় বসলেই সারি সারি কবর দেখতে পায়। অনেক কবরই পুরোনো হয়ে ধসে পড়েছে, আবার বেশ কিছু কবরের চেহারা বেশ শক্তপোক্তই আছে। সকালের আলোয় অথবা পড়ন্ত রোদে কবরখানার দিকে চেয়ে বসে থাকলে দিব্যি সময় কেটে যায় ওর। শেষ কবে এই গোরস্থানে কাউকে গোর দেওয়া হয়েছে সেটা নিতুর জানার কথা নয়। জেঠু বলে, সে তো খুব কম দিনের কথা না। বছর পঁচিশ তো হবেই। সেই শুনে নিতু হাল ছেড়ে দিয়েছে। ওর দশ বছরের জীবনে ও শুধু সারি সারি কবরই দেখে গেল। সবুজ ঘাস আর খান আষ্টেক গাছের ছায়ায় সাদা কিংবা ছাই ছাই রঙের কবরগুলোর এক অদ্ভুত চেহারা। দুপুর বেলা নিতু ঘুমোবার অছিলায় জেঠুর ঘরে এসে নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকে কবরগুলোর দিকে। এভাবেই তাকিয়ে থাকতে থাকতে একদিন ও সেই দৃশ্যটা দেখে ফেলেছিল।

নিতু তাকিয়েছিল একটা গাছের ছায়ায় আত্মভোলাভাবে শুয়ে থাকা একটা পুরোনো, ভাঙা কবরের দিকে। কবরটার গায়ে মোটা-মোটা, কালো কালো ফাটল। জেঠু বলে, নিতু, খবরদার ওইসব কবরে গিয়ে বসিস না, সাপখোপ থাকতে পারে। জেঠু যে খুব একটা ভুল বলেছিল তাও না। কারণ একদিন দুপুরে বৃষ্টির পর নিতু হাঁটতে গিয়েছিল কবরখানায়। আচমকা দেখল একটা কালো, মোটা সাপ ঘাসের ভেতর থেকে উঠে সুড়সুড় করে ঢুকে গেল কবরের গর্তে। সে-কবরটা যে কোনটা নিতুর মনে নেই, শুধু মনে আছে সাপটাকে দেখে কীরকম একটা ঠাণ্ডা বাতাস খেলে গিয়েছিল ওর শিরদাঁড়া দিয়ে। তারপর থেকে কোনো কবরের ওপর বসতে গেলে নিতু জায়গাটা আগে দেখে-টেখে নেয়, দরকার হলে এক মুঠো ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে একটু-আধটু মুছে-টুছেও নেয়। তো যাই হোক, ওরকম একটা পুরোনো কবরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখল সাদা মতো কী একটা পড়ে আছে সেটার ওপরে। প্রথমে ভেবেছিল ওটা হয়তো কারও ফেলে যাওয়া রুমাল। তারপর হঠাৎই দাদুর কথা মনে আসাতে ভাবল হয়তো বা কোনো সাপের ছাড়ানো খোলস। এটা মনে হতেই একটা রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়ল ওর শরীরে। সাপের খোলসের কথা তো এতদিন বইতেই পড়ে এসেছে। এবার সাক্ষাৎ দেখা হবে। ও আরও মনোযোগ দিয়ে চেয়ে রইল বস্তুটির দিকে। এবং হঠাৎই দেখল সেটা নড়ছে। আরেক ধাক্কা বিস্ময় এবার। নড়াচড়া করলে আর সাপের খোলস বা রুমাল হয় কী করে। তা হলে ওটা কী? নিতু আরও খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে জমে পাথর হয়ে গেল। সাদা হালকা জিনিসটা একটা মানুষের পাঞ্জা! কবজি থেকে আঙুলের। ডগা অবধি। আঙুলগুলোকে পা হিসেবে ব্যবহার করে টুকটুক করে চলে মিলিয়ে গেল কবরের ফাটলে! দিনদুপুরে এরকম ঘটনা দেখে প্রথমে বরফ হয়ে গেল নিতু, তারপর শরীরে তাপ ফিরে পেতে ‘মা!’ বলে এক বিকট চিৎকার দিয়ে ও দৌড়ে গেল বাড়ির ওধারে মা-র ঘরে! গিয়ে মাকে ঘুমন্ত দেখে এক লাফে মা-র পাশে শুয়ে ও চোখ বন্ধ করে হাঁপাতে লাগল।

.

নিতু শুয়ে রইল বহুক্ষণ, কিন্তু ঘুম জিনিসটা কিছুতেই এল না। ও ভেবে পেল না বাড়ির কাকে একথা আদৌ বলা যেতে পারে। বিশ্বাস তো কেউই করবে না, উলটে দুপুরে জেঠুর ঘরে বসে কবর দেখাটাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এসবই ভাবছিল নিতু মটকা মেরে পড়ে, আর সেই সঙ্গে একটা মৃদু কাঁপুনি অনুভব করছিল জেঠুর কাছে শোনা ড্রাকুলার কাহিনির জায়গা-জায়গা মনে পড়ে। এর আগেও নিতু বহুবার ভয় পেয়েছে—অঙ্ক স্যারের ডাস্টারপেটা, মা-র হাতে উত্তম-মধ্যম, পাগলা ষাঁড়ের তেড়ে আসা, একদিন ছাদে কালবৈশাখীর ঝড় দেখে, আরেকদিন রাতে ছাতের সিঁড়িতে পা হড়কে পড়ে—কিন্তু সেসব ভয় এর থেকে একেবারে আলাদা। কোনো ভয়ই যেন ঠিক এরকম নয়। সব চেয়ে খারাপ হল যে, এতখানি ভয় পাওয়ার পরও ভয়টা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। কীরকম ঘুরে ঘুরে আসছে। কাউকে এটা বলতে না পারলে এ ভয় যাওয়ার নয়। কিন্তু বলবেটা কাকে? শুনবেই বা কে? আর বিশ্বাসই বা কে করবে?

বিকেলের শেষ দিকে, যখন রোদ পড়ে আসছে, নিতু ছাদের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু সিঁড়িতে পা দিতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। ভুল করে যদি ছাদ থেকেও চোখ চলে যায় কবরের দিকে? প্রথমে নিতু ভাবল, গেলই বা ওদিকে? তাতে কী হয়? তারপরেই ভাবল, যদি ওই কাটা হাতটা ফের—নিতু সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা লাগাল বাড়ির নীচে গোরুর গোয়ালে। জগরু নিশ্চয়ই এতক্ষণে গোরু দুইয়ে হাত-পা ছেড়ে বিড়ি ধরিয়ে খাঁটিয়ায় বসে গেছে। ওকে না হয় মন খুলে ব্যাপারটা বললে হয়। কিন্তু এরপরেও একটা দুশ্চিন্তা ভর করল নিতুকে। ভাবল, জগরুটা তো গবেট। কোনো কথা পুরো শোনার আগেই হাঁ হাঁ করে ওঠে। তারপর কী যে বকবক করে! নিতু ঠিক করল, না! ওকে বলবে না।

কিন্তু গোয়ালের মুখটায় পাতা খাঁটিয়ায় জগরুকে নয়, বাবার ড্রাইভার অবনীদাকে খুঁজে পেল নিতু। অবনীদা সবে কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে এসে মনের সুখে একটা পাসিং শো সিগারেট ধরিয়েছে। নিতু গুটি গুটি অবনীদার পাশে গিয়ে বসে বলল, আমার বেশ ভয় করছে, অবনীদা।

অবনীদা হঠাৎ করে বুঝে উঠতে পারেনি নিতু কী বলছে। তাই জিজ্ঞেস করল, কী বললে নিতু? নিতু আমতা আমতা করে সেই কথাটাই বলল। অবনীদা এবার ভুরু কুঁচকে, একটু গম্ভীর চালে বলল, কেন, পরীক্ষায় ডিগবাজি খেয়েছ? নিতু জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ধ্যাৎ!

-তা হলে?

—আজ দুপুরে একটা কাটা হাত দেখেছি কবরে।

অবনীদা প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলল, কাটা হাত! কার হাত?

-সে আমি কী জানি! তুমি গিয়ে দেখে এসো।

অবনীদা ধুর! বলে ফের সিগারেটে টান দিল। নিতু বেশ অভিমান করে চুপ করে রইল। তখন গাল ভরতি ধোঁয়া বেশ কয়েকটা রিং করে হাওয়ায় ছেড়ে অবনীদা বলল, বেশ, আমি গিয়ে দেখে আসছি। কিন্তু কোন কবরটা?

নিতু বলল, সে তুমি খুঁজে পাবে না। আমি সঙ্গে যাচ্ছি চলো।

সারাটা দুপুর ভয় পাওয়ার পরেও কী এক অদম্য কৌতূহল ওকে পেয়ে বসেছে। যে দৃশ্যটা থেকে ওর এত ভয়, সেই দৃশ্যটাই কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখার জন্য মন আনচান করছে ওর এখন।

অবনীদা বলল, এই বললে ভয় করছে। এখন বলছ সেখানেই যাবে? তারপর গলাটা বেশ কড়া করে ধমকের সুরে বলল, গাঁজা তো খায় পরসাদী জমাদার। আর উলটোপালটা ব্যাপার দেখছ তুমি।

নিতু কোনো কথা না বলে অবনীদার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করল।

বিকেলের শেষ, নরম রোদ তখন গাছের ডালপালাতেই আটকে গেছে। আর ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু ঝরে পড়েছে ভাঙা কবরগুলোয় তাতে জায়গাটাও বেশ মনোরম লাগছিল। নিতু একটা লাইন ধরে গুনতে গুনতে হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘অবনীদা! এইটা!

কিন্তু অবনীদা কই? ইতিউতি চেয়ে হঠাৎ নিতু দেখল অবনীদা হাঁটু মুড়ে কী একটা দেখছে। ও ফের হেঁটে গেল অবনীদার কাছে। আর কাছাকাছি হতেই ওর চোখে পড়ল এক পুরোনো কবরের মস্ত ফাটল। ও গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী দেখছ, অবনীদা? অবনীদা মাথা সেই নীচে মাটির দিকে ঝুঁকিয়ে রেখে বলল, একপাটি জুতো।

—একপাটি জুতো! কেন, তোমার চটি তো তোমার পায়েই আছে?

—আমার না। এটা মেমসাহেবের জুতো।

–মেমসাহেবের জুতো?

অবনীদা এবার মাথা তুলে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, এইমাত্র জুতোটা পাথরের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ল নীচে।

বলেই একটা গাছের ভাঙা ডাল নিয়ে গর্তটায় খোঁচাতে লাগল অবনীদা। নিতু বলল, খোঁচাচ্ছ। শেষে সাপ বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু অবনীদা ওর কথায় কান না দিয়ে খুঁচিয়ে চলল। কিন্তু জুতোর বদলে কিছুক্ষণ পর অবনীদা যেটা টেনে বার করল সেটা এক গোছা সোনালি চুল।

-বাপরে! এ তো মেমসাহেবের চুল! এত তাজা চুল কোত্থেকে এল?

নিতুর ভেতরে ভেতরে কে যেন বলল, যার হাত দেখেছ দুপুরে এই চুলও তার। নিতুর শরীরে হঠাৎ শীত শীত ভাব হল। ও অবনীদাকে ফেলেই বাড়ির দিকে ছুট লাগাল। দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে যখন ও দোতলায় তখন রোদের প্রায় সবটাই চাপা পড়েছে। জজবাড়ির দেওয়ালে, আর অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে মোটামুটি।

দোতলায় বাবার সেরেস্তা থেকে কাজ সেরে নামছিলেন বাবার অ্যাসিস্ট্যান্ট সৌরীন কাকা। নিতুকে ওভাবে দুদ্দাড় করে উঠতে দেখে বললেন, কীরে! তোর আবার এত তাড়া কীসের? কোথায় ছুটলি? নিতুর কিন্তু এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ফুরসত নেই। ওকে এক্ষুনি জেঠুর ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে হবে সোনালি চুল দিয়ে অবনীদা কী করছে। অন্ধকার নেমে গেল বলে, এই সুযোগে না দেখলে পুরো ব্যাপারটা আরও গোলমেলে হয়ে যাবে। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে সৌরীন কাকার উদ্দেশে ও শুধু দুটো শব্দ ছুড়ে দিল—খিদে পেয়েছে।

কিন্তু জেঠুর জানালা থেকে নিতু যে দৃশ্য দেখল তাতে ওর বুক হিম হয়ে গেল। হঠাৎ করে গলাটা যেন বন্ধ হয়ে আসল, কে যেন টিপে ধরছে। একটু-আধটু চেঁচাবে তারও উপায় নেই। ও মরে যাওয়া আলোয়, বলতে গেলে সদ্য নামা অন্ধকারে, জানলার দিকে মাথা রেখে দেখল দূরের একটা কবরের পাশে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে অবনীদা!

চোখে প্রচুর জলের ঝাপটা, দু-গ্লাস গরম দুধ আর হাত-পা রগড়ানির পর অবনীদা শুধু বলতে পারল যে কবরের গর্তে একরাশ সোনালি চুল পাওয়ার পর সে আরেকটু খুঁচিয়ে দেখতে গিয়েছিল আর কী আছে সেখানে। সে-সময় হঠাৎ একটা শ্বাসকষ্ট শুরু হল এবং অবনীদার মনে হল যে, পাশে ফেলে রাখা চুলটাই যেন কে গলায় জড়িয়ে দিচ্ছে আষ্টেপৃষ্ঠে। কিন্তু দোহাই মা দুর্গার, অবনীদা কিন্তু ঘুণাক্ষরে নিতুর নাম করেনি। তা হলে জেঠুর হাতে আর রক্ষা থাকত না!

রাত্রেও শোওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে দুপুরের সেই হাত আর বিকেলের সেই সোনালি চুল চোখের সামনে ভাসল। তারপর কখন এক সময় ভারী ঘুমে ঢলে পড়ল নিতু। আর তারপর একসময় অতল নিদ্রায় কোন এক পর্যায়ে এক অদ্ভুত স্বপ্ন ভর করল ওর দুই চোখে। ও দেখল এক পরমাশ্চর্য সুন্দরী মেয়ে, যেমনটি ও বিলিতি ছবির বইয়েই দেখেছে, একলা বসে কাঁদছে বাড়ির পাশের ওই কবরখানার একটা পাথরে বসে। নিতু পা টিপে টিপে ওর পাশে গিয়ে ইংরেজিতে বলল, তুমি কাঁদছ কেন? কে-ই বা তুমি?

সেই মেয়ে-কতই বা বয়স হবে? উনিশ-কুড়ি? বাঁহাত দিয়ে ওর চোখ মুছে ভাঙা গলায় বলল, তুমি কেন আমার নাম জিজ্ঞেস করছ? তুমি কি আমায় চিনবে?

নিতু বলল, নাম ছাড়া কাউকে কি চেনার চেষ্টাও করা যায়? মেয়েটি এবার বলল, আমার নাম লিণ্ডা। লিণ্ডা ফাটাডো। তাতে কিছু সুবিধে হল?

নামটা শুনেই একটা বিদ্যুৎ খেলে গেছে নিতুর মনে। নামটা তো কতবার শুনেছে দিদির কাছে। সেই যে মেয়েটা দারুণ বাস্কেটবল আর টেবিল টেনিস খেলত, দুর্ধর্ষ নাচত বিলিতি গানের তালে তালে, আর একদিন ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে গড়ের মাঠে ট্রাম থেকে পড়ে কাটা গিয়েছিল যার হাত। সমস্ত কাগজে এই ঘটনা ছেপে বেরিয়েছিল। দিদিদের ইশকুলের প্রাক্তন ছাত্রী ছিল লিণ্ডা। যেদিন লিণ্ডা মারা গিয়েছিল হাসপাতালে সেদিন ছুটি হয়ে গিয়েছিল দিদিদের স্কুলে। ওর আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা সভায় মাদার কেভিন ওর নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য গোল্ডেন হেয়ার্ড বিউটি’! সোনালি চুলের সুন্দরী।

হঠাৎ নিতু বলে উঠল, লিণ্ডা আমি তো তোমায় চিনি! তুমি লোরেটোর মেয়ে না? তুমি ভালো টেবল টেনিস খেলতে না? তুমি ট্রাম থেকে পড়ে গিয়েছিলে?

লিণ্ডা বলল, না।

চমকে উঠে নিতু বলল, সে কী! আমি তো তাই শুনেছি।

লিণ্ডা শান্ত গলায় বলল, সব্বাই তাই শুনেছে। কিন্তু সেটা ঠিক না।

—ঠিকটা তা হলে কী?

—আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

—ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল?

—আমার প্রিয় বান্ধবী আইলিন।

-তোমার প্রিয় বান্ধবী তোমাকে–

হ্যাঁ। ভারতের মহিলা বাস্কেটবল টিমে একটাই জায়গা ছিল। সেখানে ও যাবে নয় আমি। আইলিন জানত যে, আমি থাকতে ও ওই জায়গাটা পাবে না। তাই আমাকে বলেছিল, তুই টেবিল টেনিসে কিংবা ক্যাবারে ডান্সেও নাম করতে পারিস। আমার কিন্তু এই একটাই খেলা। এই জায়গা আমি তোকে নিতে দেব না, দেখিস। আমি তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারিনি, কারণ ও একটা চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিকেলে ট্রেনিং সেরে ফেরার আগে ট্রেনার রামনাথ দুবে স্যারকে বললাম ইণ্ডিয়ান টিমের জন্য আমার নাম না পাঠাতে। কিন্তু স্যারকে এটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে, আইলিন যেন একথা না জানে। কিন্তু স্যার আমার প্রস্তাবে মুগ্ধ হয়ে আইলিনকে ফলাও করে সব বলেছিলেন। আর তাতেই গরিব ঘরের মেয়েটির আত্মসম্মানে লেগেছিল। যেদিন টিম অ্যানাউন্সমেন্টে জানা গেল ভারত দলে ও আছে, আমি নেই ও আমাকে টেন্টের গেটের পাশে দাঁড় করিয়ে বলল, তুই এই অপমানটা আমাকে না করলেও পারতিস। আমি তোকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম। তুই সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করে আমাকে অন্যভাবে হেয় করলি। আমি তোকে দেখে নেব। ওর এই কঠিন কথাগুলো শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম এবং ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করে ওকে বোঝাব আমি ওকে ভালোবেসেই যা কিছু করার করেছি।

নিতু আর কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারল না, উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলে উঠল, কিন্তু ও তাই বলে তোমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল? লিণ্ডা হাসল। বলল, ঠিক সেজন্য নয়। ও আমাকে দ্বিতীয় বারের মতোও ভুল বুঝেছিল। নিতু জিজ্ঞেস করল, কীরকম? লিণ্ডা খুব বিষণ্ণ মুখে বলল, ওকে না বুঝে আহত করার জন্য আমি যে কী ভীষণ লজ্জিত তা বোঝাবার জন্য আমি পরের দিন সন্ধ্যায় ওর বাড়িতে গেলাম আর ওকে আদর করে বুকে টেনে ওর হাতে একটা উপহারের বাক্স তুলে দিলাম। ও কিন্তু আমাকে দেখেই যারপরনাই চমকে গিয়েছিল। ওর মুখ দিয়ে একটা কথাও সরল না, ও শুধু হাঁ করে আমায় দেখে যাচ্ছিল।

এবার অবাক হওয়ার পালা নিতুর। ও জিজ্ঞেস করল, তোমায় ও হাঁ করে দেখছিল কেন? লিণ্ডা চোখ থেকে দু-ফোঁটা জল মুছতে মুছতে বলল, কারণ আমি আমার সমস্ত সোনালি চুল কেটে উপহারের বাক্সে তুলে দিয়েছিলাম ওকে। আমার প্রিয়তম জিনিস দিয়ে প্রিয়তম বন্ধুর দুঃখ ঘোচাতে চেয়েছিলাম।

নিতু বলল, তাতে কী হল?

লিণ্ডা বলল, তাতে ও আরেকবার রেগে গেল। বলল, জানিস লিণ্ডা, তুই খেলার মাঠের লড়াইটা ঘরে টেনে আনছিস। আমি তোকে মাঠে হারাতে চাই, তুই কিন্তু আমাকে মাঠের বাইরে আক্রমণ করছিস। আমি কিছু না বলে চলে এলাম। তখনও ও জানত না আমার সুন্দর চুলটাই গোছানো আছে উপহারের বাক্সে। পরের দিন সকালে ট্রেনিং-এ গিয়ে দেখি আইলিন আসেনি, খবর পাঠিয়েছে শরীরের কারণে ভারত দল থেকে নাম উঠিয়ে নিচ্ছে। দুবে স্যার এসে আমায় বললেন, সেক্ষেত্রে তোমাকেই দলে নিতে হচ্ছে লিণ্ডা। আমি ভাঙা মন নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ট্রামে উঠলাম, কিন্তু খালি ট্রামেও ভেতরে না গিয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম ফুটবোর্ডে। একবার ভাবলাম আইলিনকে দেখে আসি, পরমুহূর্তে ভাবলাম যদি ফের ও ভুল বোঝে। কিন্তু নিজের মনের সঙ্গে অনেক ঝগড়া করে শেষে চলেই গেলাম ওকে দেখতে। কিন্তু হায় কেন যে গিয়েছিলাম ওকে দেখতে!

উদবিগ্ন স্বরে নিতু বলল, কেন, ও কি ফের তোমাকে অপমান করল?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিণ্ডা বলল, না। সে উপায়ই ওর ছিল না, ও আমার সোনালি চুলে গলায় ফাঁস বেঁধে মরে পড়েছিল বাথরুমে।

নিতুর ছছাট্ট মগজে যে একটা মস্ত বাজ পড়ল। ও কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বলল, কিন্তু তুমি যে বললে আইলিনই তোমাকে ধাক্কা দিয়েছিল।

লিণ্ডা বলল, ঠিক। আর কেউ জানে না সেটা। কিন্তু আমি জানি। ভারত দলের হয়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে খেলে আসার পর সেদিন সকালে প্র্যাক্টিসে গিয়ে খুব মন খারাপ করছিল। সবাই দেখলাম কীরকম গোমড়া গোমড়া। সবারই ধারণা আমি দেশের হয়ে আমার সেরা খেলা উজাড় করে দিতে পারিনি। কিন্তু কেউ জানেনি আমার সমস্যা। সারাক্ষণ খেলার সময় আমার মনে হয়েছে আমার পায়ে পায়ে এক অদৃশ্য খেলোয়াড় ছুটছে। শুধু বিপক্ষের খেলোয়াড় নয়, আমাকে বল নিয়ে দৌড়োতে হচ্ছে ওকে কাটিয়ে কাটিয়েও। ফলে সারাক্ষণ ভুলভ্রান্তি করছি। আমি চুপ করে সমস্ত সমালোচনা শুনলাম, তারপর মুখ বুজে উঠে এলাম আইলিনের বাড়ি যাব বলে। কিন্তু …।

নিতু অধৈর্ষ হয়ে বলল, কিন্তু? লিণ্ডা বলল, কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ট্রামের মধ্যেই। আমি সেদিনও সকালের হাওয়া খাব বলে দাঁড়িয়েছিলাম ফুটবোর্ডে। হঠাৎ অনুভব করলাম আমার কাঁধে একরাশ সোনালি চুল ভর করছে। ঠিক সেই রকম চুল যা কিছুদিন আগে অবধি আমার মাথা থেকে ঢলে পড়ত। আমি চুলটা কার দেখার জন্য মাথা ঘুরিয়ে মানুষটির দিকে চাইলাম। আর আইলিনকে দেখলাম। আমার চুলটাকেই উইগ করে পরে আছে মেয়েটা আর আমার দিকে চেয়ে মিটি মিটি হাসছে। আমার মাথা টাল খেতে লাগল। সমস্ত মাঠটা চোখের সামনে পাক খেতে লাগল। আইলিন শুনলাম বলছে, আমি তোকে মাঠে হারাব বলেছিলাম। দেখলি তো কথা রেখেছি। তোকে খেলতে দিইনি। আমি বললাম, কিন্তু এখন আমায় বাঁচতে তো দিবি। আমার পাশ থেকে সরে যা, প্লিজ! ও হেসে বলল, নিশ্চয়ই। তারপর আমার হাতটা ধরে এক ঝটকায় আমাকে সঙ্গে নিয়ে নীচে নামল। তারপর সব।

অন্ধকার।

নিতু শিউরে উঠে বলল, তারপর?

লিণ্ডা বলল, মরে যাওয়ার পর একটাই আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল আমার। আমার সোনালি চুল। যে চুল নাকি আইলিনের সঙ্গে ওর কফিনে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম না কোন কবরখানায় কোন পাথরের নীচে আইলিন শুয়ে আছে। আমার এই তুখোড় ডান হাতটা কেবলই খুঁজে বেড়ায় ওই চুল। আইলিনের পাশ থেকে তুলে এনে আমার মাথায় রাখব বলে।

নিতু জিজ্ঞেস করল, তোমার ডান হাত?

-কেন, কাল দুপুরে যে-হাত দেখলে তুমি!

নিতু তোতলামি করতে করতে বলল, ওই যে কাটা হাতটা নিজের থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কবরে, ওটা তোমার হাত?

লিণ্ডা হাসল। নিতু এবার ওর ডান হাতটার দিকে তাকিয়েই ভয়ে চিৎকার করে উঠল, মাগো। দেখল সুন্দরী ফরসা ধবধবে মেয়েটির ডান হাতের কবজির কাছ থেকে কিছু নেই। দেখল লিণ্ডা তখনও হেসে চলেছে নীরবে, ওর সোনালি চুল খুটো খুটো করে কাটা। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আজ তোমার কাছে আসার আমার একটাই উদ্দেশ্য। তোমাদের ড্রাইভারের ঘরে আমার চুলটা আছে। ওটা বার করে এনে দাও আমাকে প্লিজ।

হঠাৎ ভীষণ সহানুভূতি আর ব্যথা অনুভব করল নিতু লিণ্ডার জন্য। বলল, কিন্তু তোমায় কোথায় পাব? এখানেই? তারপর নিজের চারপাশে তাকিয়ে নিতু দেখল ও অন্ধকারে, বিছানায় শুয়ে। কোথায় লিণ্ডা? কোথায় কে!

কিন্তু ঘুম ভেঙে গিয়েছে নিতুর। আর চোখের পাতায় ভর করে আছে লিণ্ডার করুণ দুটি চোখ। সোনালি চুলের আশায় কাতর প্রার্থীর মতো চেয়ে আছে। কী মনে করে নিতু হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে পা টিপে টিপে নেমে এল একতলায় অবনীদার ঘরের সামনে। তারপর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখল নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে অবনীদা। তার পাশে একটা ছোট্ট, ভাঙা টেবিলে শোয়ানো আছে একরাশ অদ্ভুত সুন্দর সোনালি চুল। নিতু চুলের গোছাটা তুলে নিঃশব্দে বাড়ির গেট খুলে বেরিয়ে গেল পাশের কবরখানার দিকে। যে কবরের দিকে রাতেরবেলায় চোখ মেলে চাইতেও বুক ঢিপ ঢিপ করত নিতুর আজ সেই কবরের দিকে এই শেষরাতে কী এক অদ্ভুত শক্তি যেন ওকে অবলীলায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। নিতু যেন স্বপ্নের ভেতর হেঁটে যাচ্ছে একটা স্বপ্নের মানুষের দিকে।

চারপাশে অন্ধকার, কিন্তু নিতু কীরকম পরিষ্কার দেখছে সব কিছু। কে যেন ওকে ভেতরে ভেতরে বলেও দিচ্ছে এদিকে এসো, ওদিকে চলো…তারপর একসময়, এখানে থামো।

নিতু থেমে পড়ার পর খেয়াল করল যে, যে-কবরে এসে দাঁড়িয়েছে ও সেটিই দুপুরে জেঠুর জানালা দিয়ে দু-চোখে গিলছিল। ও হাঁটু মুড়ে বসে হাতের চুলের দলাটা পাথরের ফাটলের পাশে রাখল। তারপর হাত দিয়ে ধুলো মুছে পড়তে শুরু করল পাথরের ওপর খোদাই করা নামটা। দেখল লেখা আছে একটি নারীর নাম। আইলিন হোয়াইট।

এই কি তা হলে লিণ্ডার সেই প্রতিদ্বন্দ্বী? কথাটা মনে হতেই নিতু ফের নামের নীচটা ঘষতে লাগল। দেখল মাত্র উনিশ বছরে মৃত্যু হয়েছে মেয়েটির।

এখানেই কি লিণ্ডা চেয়েছিল ওর চুল রাখা হোক? ভাবার সঙ্গে সঙ্গে নিতু ফের তাকাল পাশে ফেলে রাখা সোনালি চুলের দিকে। আর দেখল একটা ফর্সা, সুন্দর হাত—কবজি থেকে ছিন্ন-সোনালি চুলটাকে আঁকড়ে ধরে গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাচ্ছে ঘাসের পথ ধরে।

উষাকালের নরম আলোয় এরকম একটা দৃশ্য দেখে এতটুকু ভয় পেল না নিতু। ও গভীর মনোযোগে দৃশ্যটা দেখতে দেখতে ভুলে গেল কেন বসে আছে এখানে। যখন হাত আর চুল মিলিয়ে গেছে গাছে আর ঘাসের আড়ালে তখনও ও ওই দিকে চেয়ে রইল।

আর তখন পুব আকাশে সূর্যোদয় হল। পরসাদী গোয়ালার রামগান শুরু হল। নিতুর মনে পড়ল এক্ষুনি জেঠু উঠবে, বাবা উঠবে, মা উঠবে। আর দেখবে নিতু ঘরে নেই। বাপরে! বলে নিতু বাড়ির দিকে ছুট লাগাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *