সোনার হরিণ নেই – ৯

নয়

হাসি আর থামেই না। হাসির দমকে জঙ্গলের গাছপালাকে সুদ্ধু তাক লাগিয়ে দিচ্ছে আবু রব্বানী। অদুরের নতুন চারা বেড-এ যে তিন-চারটে লোক কাজ করছে তারাও মাঝে মাঝে এদিকে ঘাড় ফেরাচ্ছে। আবু রব্বানী জঙ্গলের অনেকগুলো খেটে খাওয়া লোকের মুরুব্বি এখন। দস্তুরমতো কড়া মানুষ আর দাপটের মানুষ। সেই লোকের এত ফূর্তি আর এমন হাসি ওদের কাছেও নতুন কিছু

একটু সামলে আবু বলল, তুমি বাপীভাই সেই আট বছর আগে থেকে ধরে নিয়ে বসে আছ আমি রেশমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি! এত চৌকস হয়েও তুমি ভাবলে কিনা রেশমার জন্য আমার কলজে পুড়ছে। রোসো, ঘরে ফিরি আগে, দুলারি শুনলেও হেসে গড়াবে।

বোকা বনলেও বাপী হাসছে। নিজের এমন বিতিকিচ্ছিরি ভুলটা স্বীকার করতে আপত্তি নেই। ওর এত হাসি আর এত আনন্দ দেখে স্বস্তিও বোধ করছে। বাইরে যত হোমরাচোমরা হয়ে উঠুক ভিতরের মানুষটা খুব বদলায়নি।

নিজের ঘর-বাড়িতে অমন একখানা ঝাপটা খেয়ে তিক্ত মেজাজে বাপী আবার জঙ্গলে ঢুকেছিল। বাড়তি ঘর তুলে সাজিয়েগুছিয়ে ওই নেপালিনী যে—রকম জাঁকিয়ে বসেছে, তাতে নিজের ডেরায় ঠাঁই মেলার আশায় জলাঞ্জলি। ভরসা আবু রব্বানী।

জিগ্যেস করতে আঙুলের নিশানায় একটা লোক বলে দিল, ওদিকে নয়া চারা বেড হচ্ছে, আবু রব্বানী সেদিকে আছে—

নিশানা ধরে এগোতে এগোতে বাপীর মনে হল জঙ্গলটার কিছু উন্নতি হয়েছে। বড় বড় গাছগুলোর সাদা রং মাখানো গুঁড়ির ওপর কালো কালো নম্বরগুলো বেশ চকচকে লাগছে। পড়ন্ত বেলাতে এদিকে সেদিকে দুই-একটা করে লোক কাজ করছে। রাবারের নল দিয়ে কেউ গাছে জল দিচ্ছে, কেউ আগাছা পরিষ্কার করছে। কাগজে-কলমে কাজের লোক আগেও ছিল, কিন্তু বেশির ভাগ সময় তাদের খুঁজেপেতে বার করতে হত। বাপীর মনে হল জঙ্গলটা কিছু যত্নের ছোঁয়া পেয়েছে।

পিছন ফিরে থাকলেও দূর থেকে আবুকে চিনতে অসুবিধে হল না। পরনে খাকি ফুল প্যান্ট। গায়ে চক্রাদার মোটা আঁট গেঞ্জি। চওড়া কাঁধ, আগের থেকেও কিছু লম্বা লাগছে ওকে। কালো সুপুষ্ট দুই বাহু। এক হাতের কব্জিতে ঘড়ি অন্য হাতে ছোট মোটা ছড়ি। ছড়ি দেখে ওর হাতের সেই লম্বা শক্ত পোক্ত লাঠিটার কথা মনে পড়ে গেল, যার একদিকে ইস্পাতের ঝকঝকে ধারালো ফালা গোঁজা আর তার ওপরে লোহার ক্যাপ। ওই লাঠি আবুর চোখের মণি ছিল একদিন। মস্ত মানুষ হয়ে এখন কি সেটা বাতিল করেছে? দেখলে মনে হবে জঙ্গলের কোনো ছোটোখাটো অফিসার লোক দিয়ে কাজ করাচ্ছে।

—হেঁজিপেঁজি ব্যাপার নয়, এ চন্দ্রার বেড ইয়াদ রেখো সাঙাতরা—বড় সাহেবের স্পেশাল অর্ডারের জিনিস। চারা গজালেই সাপে ছুবলোনো বেজির উৎপাত হবে—খুব হুঁশিয়ার, নষ্ট হলে কারো কাঁধে মাথা থাকবে না।

পিছন থেকে আলতো করে বাপী বলল, কাঁধের ওপর নিজের মাথাটা তো খুব টান দেখছি—এদিকে ফেরাও।

ঝটকা মেরে ঘুরে দাঁড়াল। আর তার পরেই খুশিতে আনন্দে দুই চক্ষু বিস্ফারিত একেবারে। ঠিক দেখছে কিনা সেই সন্দেহ।

—বাপী তুই! মা-মানে বাপীভাই তুমি!

দেমাক না বেড়ে থাকলে এই উচ্ছ্বাসই প্রত্যাশিত। বাপী হাসছে।—আবার তুমি কেন!…

লাঠিসুদ্ধু দু হাত বুকের সঙ্গে জাপটে ধরল ওকে। সঙ্গের লোক কটা হাঁ মেরে গেছে দেখে ছেড়ে দিল। কপট গাম্ভীর্যে ইশারায় ওদের কাজে মন দিতে হুকুম করল। তারপর আবার বে-সামাল খুশির উচ্ছ্বাস।—আরে বাপরে বাপ, এখন তুমি কত বড় কত বিদ্বান মানুষ—আর এখানে থাকলে তো কবেই আমার মুরুব্বি হয়ে বসতে—আনন্দে মুখ ফসকে ওরকম বেরিয়ে গেছল—এবার থেকে বাপীভাই-ই বলব। কিন্তু তুমি আজ কোত্থেকে? তোমাকে কত খুঁজেছি, তোমাদের কলেজের ঠিকানায় চিঠি লিখেছি—চার-পাঁচ মাস আগে তোমার খোঁজে জলপাইগুড়িও চলে গেছলাম। শুনলাম প্রায় দেড় বছর আগে গ্র্যাজুয়েট হয়ে তুমি নিপাত্তা—

কাঁধ জড়িয়ে ধরে পনের-বিশ গজ সরে এসে ওকে নিয়ে বসল এক জায়গায়।—পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে একটা চিঠি নেই, একটা খবর নেই—ভাবলাম, বানারজুলির এই জংলিটাকে ভুলেই গেছ। কবে এলে? আজই?

হাসি মুখে মাথা নেড়ে বাপী বলল, এসেই পর পর দুটো রাম-ধাক্কা

—সে আবার কি, কোথায়?

—প্রথমটা তোমার বাড়িতে।

—গেছলে বুঝি? তা ধাক্কা কেন, দুলারিকে দেখে?

বাপী হাসতে লাগল। লজ্জা লজ্জা মুখ করে আবু বলল, ওকে যখন ঘরে আনি তোমার কি কোনো পাত্তা ছিল যে খবর দেব!

—সেজন্যে নয়, আমি বরাবর জানতাম রেশমাকে নিজের ঘরে এনে তোলার জন্য তুমি হাঁ করে আছ।

আবু রব্বানীর এবারে আকাশ থেকে পড়া মুখ।—রেশমাকে! এ আবার তোমার মাথায় গজালো কি করে?

অবাক বাপীও কম নয়। কারণ তখনো ধারণা বিশেষ কোনো ঘটনার ফলেই রেশমার বদলে দুলারি তার ঘরে। কিন্তু আবুর মুখ দেখে আর কথা শুনে মনে হচ্ছে তাও না। কি মনে পড়তে বাপী বলল, বাবা মারা যাবার পর বানারজুলি ছাড়ার আগে তোমার বিয়েটা কবে হবে, জিগ্যেস করতে বিরক্ত মুখ করে তুমি বলেছিলে, শালার মরদ ঘরে থাকতে তার বিবিকে বিয়ে করা অত সোজা!…সে তবে কার কথা বলেছিলে?

—কেন, সেই ছটু মিঞার কথা। তুমি কি ভেবে বসেছিলে রেশমার মরদ কাঁদনা?

বাপী বোকার মতো মাথা নাড়ল। এতদিন সেই ধারণাই বদ্ধমূল ছিল বটে। তাই শুনে আবুর সেই হাসি।—এমন হাসি যে আশপাশের ওই লোকগুলোও সচকিত। তারপর বলল, তোমার দোষ নেই, বলতে গেলে তো ছেলেমানুষই ছিলে তখন। তাছাড়া আধ-মরা মরদের সেবাযত্ন করলেও আমার ভিতরের মতলবখানা দুলারি টের পেয়ে গেছল। তাই কড়া ভাব দেখাতো আর ছুবলোতে আসত। রেশমা আঁচ পেয়েছিল দুলারির কাছ থেকে—ননদ-ভাজে ভারি ভাব তো—তাই রেশমা আমার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করত। এই সব দেখেই তুমি উল্টোপাল্টা ভেবে বসে আছ।

চওড়া বুক চিতিয়ে আর এক দফা হাসল।—আরে আমি হলাম গিয়ে জঙ্গলের সেই অপদেবতা আবু রব্বানী—আমার যুগ্যি বিবি তামাম বানারজুলিতে দুলারি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি! ছটু মিঞা মারা যাবার তিন দিনের মধ্যে দুপুরের নিরিবিলিতে ছোঁক ছোঁক করে যখন গিয়ে হাজির হলাম, দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল, তারপর বলল, কালকেউটের ঝুপড়িটা এনে খুলে দেব? দুদিন বাদে আবার গিয়ে হাজির হতে বলল, একটা চেলা কাঠ ঠিক করি আগে, তারপর এসো।

বাপী উৎসুক।—তারপর?

—আমিও সেই ছেলে। পরদিন দুটো লোকের মাথায় দেড়-দেড় তিন মণ চেলা কাঠ এনে ওর উঠোনে ফেললাম আর গ্যাঁট হয়ে ওদের দাওয়ায় বসলাম। আবুর প্রাণখোলা হাসি।—দুলারির তখনকার মুখখানা যদি দেখতে!

আবুর এখন সবদিক থেকে সুদিন আর সুখের দিন চলছে বোঝা গেল। বাপী পর পর দুটো রাম-ধাক্কা খাওয়ার কথা বলেছিল মনে পড়তে জিজ্ঞেস করল, একটা ধাক্কা তো দুলারি, আর একটা কি?

—তোমাকে না পেয়ে নিজের ঘরে গেছলাম। সেখান থেকে নেপালী মহিলার তাড়া খেয়ে বেরুতে হয়েছে।

—এই রে! তোমার ঘরবাড়ি তো বেদখল। চার-পাঁচ মাস আগেও যদি একটা খবর পেতাম তাহলে ছাড়ি? তোমার খোঁজে জলপাইগুড়ি পর্যন্ত গেছলাম—

বাপী শংকিত।—বেচে দিয়েছ নাকি?

আবু এটুকুতেই আহত।—আমি যেমন লোকই হই, তোমার সঙ্গে বেইমানি করব বাপী ভাই? আমাকে জিম্মাদার করে গেছ আর আমিই খেয়ে নেব?

বাপীর তাড়াতাড়ি সামাল দেবার চেষ্টা।—খেয়ে নেবার কথা বলিনি, সুবিধে পেলে বেচে দেবার কথা তো আমি লিখেই দিয়ে গেছলাম তোমাকে।…তাহলে কি ভাড়া দিয়েছ?

—ভাড়াই বলতে পারো, তবে তার মধ্যেও প্যাচ-ঘোঁচ আছে। মওকা পেয়ে আমি তোমার ভালোই করতে গেছলাম, বাড়ির চেহারাখানা কেমন হয়েছে ভালো করে দেখেছ?

বাপী মাথা নাড়ল। দেখেছে।

—গেল মাসে আবার ইলেকট্রিক লাইটও আনা হয়েছে। ও তল্লাটে এখন কেবল তোমার বাড়িতেই বিজলির আলো জ্বলে—অনেক খরচা করে চা—বাগানের কোয়ারটারস থেকে লাইন টানা হয়েছে—তা কে তাড়া করল, নেপালী মেমসাহেব…মানে গায়ত্রী রাই নিশ্চয়?

—নাম কি করে জানব, যার বয়েস বেশি।

—হ্যাঁ, গায়ত্রী রাই। তার মেয়ে ঊর্মিলা রাই। মেয়েকে দেখেছ?

—হুঁ।

একটা চোখ সামান্য ছোট করে আবু হাসল একটু।—বেশ খাসা, না!

আগের দিনের মতো চটুল প্রসঙ্গ বাপীর ভালো লাগল না। তার বুকের তলার ক্ষত আবু জানে না। তাছাড়া স্বাস্থ্য ভালো আর রং ফর্সা হলে বয়েসকালের সব নেপালী মেয়েরাই মোটামুটি সুশ্রী। যে তপ্ত নিঃশ্বাস মুচড়ে বেরিয়ে আসছে সেটা গোপন করার তাগিদ।…ওই মেয়েকে খাসা বলছে, মিষ্টিকে দেখলে কি বলত?

হাল্কা সুরেই জবাব দিল, মায়ের তাড়া খেয়ে আর অত দেখা হয় নি।

আবুর এতেও হাসি।—দেখতে গেলে আরও বেশি তাড়া খেতে—মাটি জাঁদরেল মেয়েমানুষ। সব বলব’খন–তা তোমার সঙ্গে তার কি কথা হয়েছে?

এ প্রসঙ্গও সংক্ষেপে সারল বাপী। তারপর বলল, এখানে থেকে যাব বলেই এসেছিলাম, যা হোক কিছু করে চালিয়ে নিতাম—তাও হবার নয় দেখছি।

আবু প্রায় আগের মতোই তিরিক্ষি।—আমি থাকতে তোমার এখানে থাকার জায়গার অভাব হবে? চলে যেতে হবে? তুমি কিছু ভেবো না, সব আমার ওপর ছেড়ে দাও। এই আবু রব্বানী এখন খোদার দয়ায় অনেক কিছু পারে—বুঝলে?

বোঝা যায় কি যায় না এমন একটু শ্লেষ মাখিয়ে বাপী বলল, এখানে পা দিয়েই শুনেছি তুমি এখন একজন মস্ত লোক এখানকার—

—কোন শালা—। বেফাঁস শব্দটা মুখ দিয়ে বার করেই জিভ কাটল আবু রব্বানী—তুমি এখন অনেক পাশটাশ করা ভদ্রলোক মনে থাকে না, আমি শালা সেই জংলিই আছি—

বাপী বলল, জংলিই ভালো, মনে রাখার দরকার নেই।

আবুর হৃষ্ট মুখ।—আসলে কি জানো বাপীভাই, দাপটে না চললে সকলে ঘাড়ে পা দিতে চায়, তা বলে তুমি মস্ত লোক বলবে?

—আচ্ছা বলব না। কিন্তু আমাকে থাকতে দেবে কোথায়, নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে তুলবে?

নিরীহ মুখে আবু ফিরে জিজ্ঞাসা করল, তুললে অসুবিধে হবে?

—তা হয় না—

আবু হেসে উঠল।—আমি মস্ত লোক হয়েছি, না তুমি ভদ্দর লোক হয়ে গেছ বোঝো তাহলে। কিছু ভেবো না, তোমাকে আমি জঙ্গলের ঘরে রাখব না। উঠে দাঁড়াল।—কিন্তু আমার ঘরে গিয়ে কিছু মুখে দিতে আপত্তি নেই তো?

বাপীও উঠে পড়ল। মনের অবস্থা আবুর বোঝার কথা নয়। জঙ্গলের ঘরে কেন, একেবারে গহন জঙ্গলে সেঁধিয়ে যাবার মতোই ভিতরের তাড়না। একা থাকতে চায়। নিরিবিলিতে থাকতে চায় দিন-কতক। গুলি-বিদ্ধ বাঘও হিংস্র আক্রোশে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, তারপর ক্ষত শুকোনোর তাড়নায় নিরিবিলি আড়াল খোঁজে। সামনে দিয়ে তখন হরিণ নেচে গেলেও মুখ ফিরিয়ে থাকে।

—চলো। খিদের চোটে অন্ধকার দেখছি।

যত খুশিই হোক, আবুর কাজে গাফিলতি নেই। নতুন চারা-বেডটার দিকে এগিয়ে গেল। একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে লোক ক’টাকে বলল, রাতে এরপর দুজন করে পাহারা দিতে হবে মনে থাকে যেন, নইলে বেজিতে শেষ করে দেবে।

যেতে যেতে বাপী বলল, বড়সাহেবের স্পেশাল অর্ডারের চন্দ্রা না কিসের বেড বললে ওটা জঙ্গলে ফুলের চাষ-টাষও হচ্ছে নাকি আজকাল?

আবু মিটি মিটি হাসতে লাগল। দুদিন সবুর করো, সব জানবে। চন্দ্ৰা কোনো বাহারী ফুল নয়, ওর আর এক নাম সর্পগন্ধা—অ্যালোপাথি কবরেজি হোমিওপ্যাথি এই তিনেতেই এর দারুণ কদর। এছাড়া হাতুড়েরাও পাগলদাওয়াই বানাবার জন্যে এর ফুল ফল পাতা শেকড়বাকড় সব কেনে।

সর্বগন্ধা নাম বাপীরও জানা। কিন্তু বীটম্যান আবুর এত-সব জানার কারণ কি, আর ওর মুখেই বা এরকম হাসি কেন? জিজ্ঞেস করল, বড়সাহেবের হুকুমে জঙ্গলে ওষুধের গাছ-গাছড়াও চাষ হচ্ছে এখন?

—হচ্ছে না, আমি হওয়াচ্ছি। আর একটু কায়দা করে বড়সাহেবের হুকুমটা আদায়টা করে নিতে হচ্ছে। খুশিতে টইটুম্বুর মুখ আবুর।—বললাম তো, কটা দিন সবুর করো, সব জানবে সব শুনবে। তুমি এখানেই থেকে যাবে শুনে আমার বুকের ছাতি ডবল হয়ে গেছে—তুমি যা-হোক কিছু করে চালিয়ে নেবার কথা বলছিলে—এখানে পয়সার ছড়াছড়ি, বুঝলে দোস্ত—শুধু মাথা খাটিয়ে তুলে নিতে জানলেই হয়

আবু রব্বানী মাথা খাটাচ্ছে আর পয়সাও তুলছে এটুকু বোঝা গেল। সেটা যে চাকরির পয়সা নয়, বাড়তি কিছু, তাও স্পষ্ট।

আরো একটু এগিয়ে বাপী দাঁড়িয়ে গেল।—বাক্স-বিছানা এদিকে রেখে এসেছি, নিয়ে নিলে হত।

—কোথায় রেখেছ?

বাপী ইচ্ছে করেই লছমনের নাম করল না। হেসে বলল, বনমায়ার জিম্মায়।

—বনমায়া! আমাদের বনমায়া?

সায় দিয়ে বাপী বলল, এখানে এসেই তো সবার আগে ওর সঙ্গে দেখা করলাম।

—তোমাকে চিনল?

—খুব। শুঁড় উঁচিয়ে আগের মতো সেলাম বাজালো, শুঁড় পেঁচিয়ে আদর করল।

শুনে আবুও খুশি। বলল, এক ভীমবাহাদুর ছাড়া বনমায়ার কদর এখানে কেউ বুঝলই না। ভেবে নিল কি একটু।—বাক্স-বিছানা ওখানেই থাক এখন….আপাতত ওদিকেই তোমার থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। লছমন দেখে রেখেছে তো?

সায় পেয়ে ঘরের দিকেই চলল আবার। আবু বলল, ভীমবাহাদুর নেই, বনমায়ার মেজাজেরও ঠিক নেই; তবে ফি বছর মরদের সঙ্গে পালানোটা ঠিক আছে!

—বনমায়াকে ছেড়ে ভীমবাহাদুর পালালো কেন?

শুনল কেন। না পালালে ভীমবাহাদুরকে জেলে পচতে হত। এখনো ওর নামে হুলিয়া বহাল আছে। ভালবাসার মেয়েকে ঘরে আনার আধা-আধি টাকার যোগাড় হয়ে গেছল। সেই টাকা জমানোর নেশায় ভীমবাহাদুর ভালো খেত না পর্যন্ত। চা-বাগানের এক উঠতি বয়সের দাপটের বাবু ওই পাহাড়ী মেয়েকে ছলাকলায় ভুলিয়ে নিজের বাংলোয় নিয়ে এসেছিল। তারপর যা, তাই। মেয়েটা বাবুর গায়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল বলে সে তাকে চাবুক দিয়ে মেরেছে পর্যন্ত। আর দরজায় পাহারা মোতায়েন রেখেছে।

মাঝরাতে ভীমবাহাদুর বাংলোয় ঢুকে তার বুকে ছুরি বসিয়েছে। আধ ঘুমন্ত পাহারা-অলা ওর সেই মূর্তি দেখে পালিয়ে গেল। বাবুটি তখন নেশা করে ঘুমোচ্ছিল। সে ঘুম আর তার ভাঙেনি। সেই রাতেই ভীমবাহাদুর তার ভালবাসার মেয়েকে নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে।

বাপী মুখ বুজে চলেছে। কিন্তু ভিতরে নাড়াচাড়া পড়ল একপ্রস্থ। দক্ষিণ কলকাতার কোনো এলাকার সাতাশি নম্বর বাড়ির উল্টো দিকের দোতলা বারান্দার সোনালি চশমা রাঙামুখো একজনের কলজে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দেবার সুযোগ পেলে তার নিজের হাত একটুও কাঁপত কি? নাকি রাতের অন্ধকারে খুপরি ঘরে ঢুকে রতন বনিক তার বউ কমলা বনিকের আর বাপী নামে এক বেইমানের বুকে ওমনি ছুরি বসিয়ে গেলে খুব অন্যায় হত?

কথায় কথায় আরো কিছু খবর জানালো আবু রব্বানী।…ওর বাবা কালু তিন বছর আগে মারা গেছে। শেষের দিকে ছেলের ওপরেও তার অভিমান, যেন ওকে হটিয়ে ছেলে তার জায়গাটা জুড়ে বসেছে। অথচ শেষ সময় পর্যন্ত আবু তাকে নেশার জিনিস যুগিয়ে এসেছে—শহর থেকে সেরা জিনিস এনেও খাইয়েছে। আর গেল বছর রেশমার মরদ কাঁদনা মাটি নিয়েছে। ওর আর পেট বলে কিছু ছিল না, হেজে পচে গেছল। ও মরে বেঁচেছে, রেশমারও নিষ্কৃতি।

বাপী জিগ্যেস করল, রেশমা একাই সাপ খেলা দেখাচ্ছে এখন?

—ছোঃ! তার থেকে ঢের ঝাঁঝের খেলা দেখাচ্ছে। আবু হাসতে লাগল, রেশমা আর সে রেশমা নেই, বুঝলে? এখন বুকের পাটা কত, বিষাক্ত সাপগুলোর খপাখপ টুটি টিপে ধরা দেখলে তোমার তাক লেগে যাবে।

বাপী ভেবে নিল সাপ ধরে রেশমা এখন অন্য সাপুড়েদের কাছে বেচে দেয়। আবুর কথায় আর হাব-ভাবে কিছু রসের ছোঁয়া থাকলেও বাপী আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চলতে লাগল। রস চুলোয় যাক।

আবু হঠাৎ উৎসুক চোখে ঘাড় বেঁকিয়ে ওকে দেখে নিল।—আগে তোমার কথা শুনি বাপীভাই, অ্যাদ্দিন ছিলে কোথায়?

—কলকাতায়।

—চাকরির চেষ্টায়?

—মাস কয়েক যুদ্ধের আপিসে টেম্পোরারি চাকরি করেছি। —তারপর বেকার বসে ছিলে?

বাপী মাথা নাড়ল। তাই। এ নিয়েও কথা বাড়াতে চায় না। কিন্তু আবু খুশিতে ডগমগ।—খোদার খেল দেখো, তার মরজি না হলে টান পড়ে না—এখানে কাজই উল্টে তোমার জন্যে হাঁ করে আছে! আমি কতদিন তোমার কথা ভেবেছি, দুলারিকেও বলেছি, এ-সময় বাপীভাই এখানে থাকলে জমত ভালো—নেপালী মেমসাহেবকে ওই বাড়িটা দেবার সময় তোমার কথা তো খুব হত—

আবু রব্বানী এ ক’বছরে আরো কত চতুর হয়েছে বাপীর ধারণা নেই। বাড়িটা হাতছাড়া হয়েছে বলে এমন আশার কথা শোনাচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। বাপী ভিতরে উৎসুক একটু, বাইরে প্রায় নির্লিপ্ত।—কি কাজ, চাকরি-টাকরি?

—চাকরি করলে চাকরি, নয়তো চুক্তিতে রফা হলে চুক্তি—ধৈর্য ধরে সব দেখে-শুনে যা তুমি ভালো বুঝবে। বললাম না পয়সার ছড়াছড়ি এখানে। মাথা খাটাও, দিল লাগাও আর কড়ি তোলো। তোমার মতো ভদ্দরলোকের চামড়া গায়ে থাকলে আর বিদ্যের জোর থাকলে এই আবু রব্বানীকে আজ দেখতে হত! নেপালী মেমসাহেবের ওই প্যাচামুখো লাটসাহেবকেই লাট খাইয়ে দিতাম না! এও দুর্বোধ্য। তবে নেপালী মেমসাহেব যে ওর স্বার্থের কোনো বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে, এটুকু স্পষ্ট।

আবু আর একবার ঘাড় ফেরালো, তারপর বলল, তুমি একটু বদলে গেছ বাপীভাই…

—কেন?

—আগে আমার সব ব্যাপারে তোমার কত আগ্রহ ছিল, উৎসাহ ছিল—প্রায় ছ’বছর বাদে দেখা, আর তুমি যেন আমার কাছ থেকে ছ’হাত দূরে দূরে হাঁটছ।

আবু চালাক বলেই একটু ঘুরিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করল। নইলে সাদাসাপটা বলে বলত, আগে তো আমার চেলাটি ছিলে, আমাকে গুরু ঠাওরাতে। এখন সে—রকম দেখছি না। বাপী হাসল একটু, জবাব দিল, আধ-হাত দূর দিয়েও তো হাঁটছি না!

হঠাৎ আগের মতোই সন্ধানী চাউনি আবুর। কথার ধরনও তেমনি চাঁছাছোলা—সাহেব বাংলোর তোমার সেই মহারাণীর মেয়ের খবর কি, আর দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে?

আবুর সঙ্গে দেখা হলে এ-কথা উঠবে জানত। আর যতটা সম্ভব নির্লিপ্ত মুখে এ-প্রসঙ্গ ধামা-চাপা দেবার চেষ্টাই করবে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে আবুকে আগের মতো সেই কাছের মানুষ মনে হতে বুকের তলায় মোচড় পড়ল। জবাব না দিয়ে একবার তাকালো শুধু।

আবু লক্ষ্য করছে। উৎসুকও।—দেখা হয়েছে তাহলে! কেমন এখন? বহুত খুবসুরৎ?

—ভালোই।

খপ করে শিকার ধরে তোলার মতো চকচক করছে আবুর দু চোখ।—কত দিন আগে দেখা হয়েছে?

বাপী কি হঠাৎ জোর গলায় ওকে ধমক লাগাবে একটা? পারা গেল না। বিড়-বিড় করে বলল, বেশি দিন নয়।

যন্ত্রণার আঁচ আবু কতটা পেল সে-ই জানে। সব ঝেড়ে ফেলার মতো করে বলল, গুলী মেরে দাও বাপীভাই, আমি তো সেই কবেই বলে রেখেছিলাম ও—মেয়ে বেশি দিন বাপ মায়ের সিন্দুকে বসে থাকবে না। যেতে দাও—নিজের দুটো পায়ের ওপর শক্ত করে দাঁড়ালে অমন কত হুরী-পুরী এসে গড়াগড়ি খাবে!

বাপী সন্তর্পণে বড় নিঃশ্বাস ফেলল একটা। আবু ধরে নিয়েছে মিষ্টি অন্যের হেপাজতে চলেই গেছে আর সেই মনস্তাপেই কলকাতা ছেড়ে ও আজ বানারজুলিতে। একেবারে সত্যি না হলেও কত আর ভুল…।

ঘরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আবুর আর এক মূর্তি। ঘরে ঢুকল না তো একখানা দুরন্ত খুশির ঢেউ আছড়ে পড়ল যেন। হাতের লাঠি একদিকে ছুঁড়ে ফেলল। সাড়ে তিন বছরের ছেলেটা ছুটে এসে, তার সাধ্যমতো একটা লাফ দিয়ে দু-হাতে বাপের কোমর জড়িয়ে ধরে ঝুলতে লাগল। ওদিকে দুলারির কোলের আঁট—ন’মাসের ছেলেটাও দু-হাত তুলে বাপের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ব্যগ্র। হাত বাড়িয়ে আবু আগে ওকে নিয়ে লোফালুফি খেলল খানিক। ছেলেটার ভয়-ডর নেই, খিক-খিক হাসি। তারপর একটু দূর থেকেই ওটাকে মায়ের কোলে ছুঁড়ে দিয়ে আবু বড়টার সঙ্গে ছোটাছুটি আর মেকি মারামারি ঘুষোঘুষি শুরু করে দিল। বাপীকে বলল, কালে দিনে এ দুটো আমার থেকেও কড়া অ্যালসেসিয়ান হয়ে উঠবে দেখে নিও

ছেলেটাকে উসকে দেবার জন্য আবু একটু জোরেই ঘা বসাচ্ছে এক একবার আর ওটা দ্বিগুণ গোঁ-ভরে বাপের ওপর চড়াও হচ্ছে। দুলারির তামাটে মুখ প্রসন্ন, কিন্তু ধমকেই উঠল, আঃ থামবে। বাপীভাই যে কাণ্ড দেখে হাঁ হয়ে গেল!

মায়ের ধমকেই ছেলের দৌরাত্ম্য থামল। কি মনে পড়তে আবুর হাসিমুখ বিপরীত গাম্ভীর্যে ঘোরালো করে তোলার চেষ্টা। গলায় কপট শ্লেষ মিশিয়ে বলল, রেশমার বদলে তোমাকে আমার ঘরে দেখে বাপীভাই তার থেকে ঢের বেশি হাঁ হয়েছে—বুঝলে? আমি রেশমার জন্য পাগলা হয়ে গেছলাম দেখে গেছে আর আজ ঘরে এসে দেখে বিবি বদল।

দুলারি হাসছে না ঠিক, তামাটে মুখে হাসির আভা ছড়াচ্ছে। বলল, বাপীভাইয়ের তখন চোখ কানা ছিল বোধ হয়।

আবু হা-হা শব্দে হেসে উঠল। হাসছে বাপীও। আর মনে মনে সায় দিচ্ছে, কানা যে ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আবু বলল, দুজনেরই খিদে পেয়ে গেছে, কি আছে জলদি দাও—বাপীভাইকে নিয়ে এরপর আবার নেপালী মেমসাহেবের কাছে যেতে হবে।

সুপটু গৃহিণীর মতো পাঁচ মিনিটের মধ্যে একরাশ জলখাবার নিয়ে দুলারি হাজির। বাপী আসবে ধরেই নিয়েছিল বোধ হয়। খুশি মুখে আবু টিপ্পনী কাটল, এত সব আজ তোমার খাতিরে, আমার অত জোটে না।

দুলারিরও সমান জবাব।—বেইমানি কথা শুনলে জিভে গরম ছেঁকা লাগাব। আবু সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকালো।—আমার জিভে ছেঁকা লাগালে আখেরে কে পস্তাবে?

সাপুড়ে মেয়ের তামাটে মুখে শরমের রং। কটাক্ষের চাবুক হেনে চটপট সরে গেল। আবু হাসতে লাগল।

বাপী সুখের ঘর দেখছে।

.

জলখাবারের পাট শেষ হতে আবু আয়েস করে বিড়ি ধরালো একটা। বাপীকে বলল, সিগারেটও আছে—চলে?

বাপী মাথা নাড়ল, চলে না। নিজের বাড়ির খবর জানার তাগিদ। জিগ্যেস করল, নেপালী মেমসাহেবের কাছে যাবে এখন?

—যাব’খন। হাসল।—ওই ঠাকরোনটির কাছে যেতে হলে এমনিতেই বেশ করে দম নিয়ে যেতে হয়—তার ওপর আজ বাড়ির মালিককে দেখে ক্ষেপেই আছে কিনা কে জানে।

—কেন?

—কেন আর, নতুন ঘর তুলে তোমার বাড়ির ও-রকম ভোল পাল্টাতে এককাঁড়ি টাকা খরচ হয়েছে—আমাকে হিসেব দেবে বলছিল।…লাইট-ফাইট জল-কলসুদ্ধু কম করে পাঁচ হাজার হবে—সে বাজার কি আছে!

বাপীর দু’কান খাড়া। বাড়ির দায় ওর ওপরেই ছেড়ে দিয়ে গেছল। ভাড়া আর বিক্রীর দুটো পরোয়ানা ওকেই লিখে দিয়েছিল। বেচে যে দেয় নি সেটা আবু আগেই বলেছে। আবার ভাড়া নিয়েও কি প্যাচ-ঘোঁচের ব্যাপার আছে বলছিল। কি শর্তে নেপালী মেমসাহেব ওই বাড়ির পিছনে অত টাকা ঢেলেছে আবু এখন পর্যন্ত সেটাই বলে নি।

সে বাড়ির মালিক শুনে মহিলা থমকেছিল বেশ, বাপীর মনে আছে। জিজ্ঞেস করল, তা আমাকে দেখে ক্ষেপবে কেন?

হাতের বিড়িটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলল আবু রব্বানী।—মেমসাহেব জানে বাড়ির মালিক বে-পাত্তা! কোন দিন ফিরবে কি ফিরবে না তারও ঠিক নেই। আর জানে, আমি বাড়ির জিম্মাদার, আমি সব্বে-সর্বা—তাই নিশ্চিন্ত মনে ঘর তুলেছে আর বাড়ি সাজিয়েছে—আমার সঙ্গে এখন পর্যন্ত সইসাবুদটা পর্যন্ত হয়নি, এর মধ্যে খোদ মালিক হাজির দেখলে কি আহ্লাদে আটখানা হবে?

বাপী ভিতরে ভিতরে স্বস্তি বোধ করল একটু। বাড়ির ব্যাপারে এত সব তোমার পারমিশন নিয়ে করা হয়েছে?

—হুঁঃ, সেই মেয়ে! পারমিশন-টারমিশনের ধার ধারে না, তাঁর মর্জি-মাফিক কাজ—ম্যানেজারকে দিয়ে তোমার বাড়ির খোল-নলচে পাল্টানোর পর চুক্তির কথা তুলেছে—আমি মওকা পেয়ে চুপ মেরে ছিলাম—

—নেপালী মেমসাহেবের আবার ম্যানেজারও আছে নাকি?

—নেই আবার—হেঁজিপেঁজি মেয়েমানুষ নাকি! সে শালাই তো তার প্যাচামুখো লাটসায়েব।

জঙ্গল ভেঙে ঘরে ফেরার পথে আবু বলেছিল বটে, বিদ্যেবুদ্ধির জোর থাকলে নেপালী মেমসাহেবের কোন্ প্যাচামুখো লাটসায়েবকে লাট খাইয়ে দিত।

বাড়ি আর চুক্তির ব্যাপারটা বাপী আর একটু বিশদ করে শুনে নিল। গায়ত্রী রাই পাশের জমিসুদ্ধু বাড়িটা কিনে নিতে চেয়েছিল। যুদ্ধের পর জায়গা-জমির দাম এ—দিকেও হু-হু করে বাড়ছে দেখে আবু রাজি হয় নি। তাছাড়া দোস্তের পৈতৃক ভিটের ওপর তারও কম মায়া নয়। গরজের দায়ে গায়ত্রী রাই চড়া দামের লোভ দেখিয়ে চাপাচাপি করছিল। মিনমিন করে আবু তখন একটা মিথ্যে কথাই বলেছে। ও বাড়ির জিম্মাদার ইচ্ছে করলে ভাড়া দিতে পারে, বেচতে-টেচতে পারে না।

গায়ত্রী রাইয়ের দাপটের ম্যানেজারের নাম রণজিৎ চালিহা। আসামের মানুষ। ধরাকে সরা ভাবে। বাড়ির মালিক পাঁচ বছর যাবৎ নিখোঁজ, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে ওটা জবরদখলের মতলব দিয়েছিল মেমসায়েবকে। বলেছিল, সব নিজের ভেবে তুমি যা-খুশি করে নাও, কেউ দাবি ফলাতে এলে আমি আছি। কিন্তু গায়ত্রী রাই যত জাঁদরেল মেয়েমানুষই হোক, অমন কাঁচা ঠকবাজি পছন্দ করে না। তাছাড়া বেগতিক দেখে মেমসায়েবের কাছে আবু বাপীর মরা বাপকে এই জঙ্গলের অফিসার বানিয়ে দিয়েছিল। বলেছে, এখানকার সরকারী ছোট অফিসার ছিলেন ভদ্রলোক—আর মস্ত ধার্মিক মানুষ ছিলেন, সক্কলে তাঁকে ভক্তিশ্রদ্ধা করত। তাঁর ছেলের সঙ্গে এ-রকম করাটা ঠিক হবে না, তাছাড়া বাড়ির দলিলপত্র মালিকের কাছে আছে—নিখোঁজ হলেও সে সব তো আর হাতছাড়া হয় নি।

গায়ত্রী রাই হাঁ-না কিছুই বলেনি। কারো উপদেশ বরদাস্ত করার মেয়ে নয়। আবুকে ধমকে যে ওঠেনি তাতেই বোঝা গেছে বড়দরের অন্যায় কিছু করবে না। বাড়ির ভোল বদলানোর পর আবুর ডাক পড়েছে; গায়ত্রী রাই জানিয়েছে সব ঠিক-ঠাক করে নিতে পাঁচ হাজার টাকার মতো খরচ পড়েছে। হিসেব তার ম্যানেজারের কাছে আছে। এ-টাকাটা ভাড়ার টাকা থেকে কাটান যাবে—সব শোধ হলে তবে মাসের ভাড়া হাতে আসবে।

এই মওকা ছাড়ার পাত্র কি আবু রব্বানী? ভিজে বেড়ালের মতো মুখ করে ভাড়ার ফয়সলায় নেমেছে। শুধু বসতবাড়ি তো নয়, বাড়তি ঘরখানা তোলা হয়েছে ব্যবসার কাজে লাগানোর জন্য। তাছাড়া যুদ্ধের সময় থেকে এই বানারজুলিতেও সেলামীর ভূত নেমেছে——ইজেরাদার ঠিকেদারদের কল্যাণে এখন একখানা ঘর পেতে হলে আগে নজরানা গুনে দিতে হয়। আবুর বরাত ভালো ম্যানেজার তখন ট্যুরে। গায়ত্রী রাইয়ের পায়ের কাছে বসে অনেক কথা নিবেদনের সুযোগ পেয়ে গেছল। যেমন বাড়ির মালিক বাপী তরফদার তার প্রাণের দোস্ত—আর তার বাপের দয়াতে ওর এখানকার জঙ্গলের চাকরি, সেই দোস্ত ফিরে এসে যদি ওকে বেইমান ভাবে তাহলে খোদার বজ্র ওর মাথায় নেমে আসবে। তাই বাড়ির ব্যাপারে আবুর মুখ না চেয়ে হকের ফয়সালাই করতে হবে।—কারণ পাঁচ হাজার ভাড়া থেকে কাটানো গেলে এখন যা হয়েছে তার সবটাই তো বাড়ির মালিকের। তাই পাঁচ হাজার থেকে প্রথমেই হাজার টাকা সেলামী বাবদ কাটান যাবে। আর একশ টাকার নিচে এই দিনে এরকম বাড়ির ভাড়া তো হতেই পারে না।

কলে পড়লে নেপালী মেমসাহেবের দরাজ হাত। এ নিয়ে খুব একটা ঝকাঝকি করেনি। সেও আবু রব্বানীকে সেয়ানা জানে কিন্তু বেইমান ভাবে না। ভাববেই বা কেন, আবু তাকে বলেছে, সেলামী বাদ দিয়ে বাকি চার হাজার টাকা থেকে একশ টাকা করে কাটান দেবার চুক্তি সে-ই করবে—তত-দিনে বাড়ির মালিকের দেখা নিশ্চয় মিলবে, আর না যদি মেলে তো মেমসায়েব যেন তার পরের টাকা বানারহাটের সরকারী দপ্তরে বাড়ির মালিকের নামে চেকে জমা করে দেন। ও তো আর হাত পেতে একটি পয়সাও নিচ্ছে না।

হাজার টাকা সেলামী আর একশ টাকা ভাড়া শুনে ম্যানেজার রণজিৎ চালিহা নাকি আবুকে ধরে এই মারে তো সেই মারে। কিন্তু গায়ত্রী রাইয়ের জবান খসলে পাকা ব্যাপার। তার কথামতো কাগজপত্র তৈরি। কিন্তু হচ্ছে হবে করে এই চার মাসেও সইবাবুদের ফুরসৎ মেলেনি। ম্যানেজার মাসের অর্ধেক সময় বাইরে বাইরে ঘোরে, নেপালী মেমসায়েবও হুট হুট করে তার পাহাড়ের বাড়িতে চলে যায়। আর দুজনেই যখন এখানে তখন এত কাজের চাপ আর এত রকমের প্ল্যান—প্রোগ্রাম হিসেব-নিকেশ যে এই সামান্য ব্যাপারটা হয়তো মনেই থাকে না।

এবারে তিন নম্বর বিড়িটা আবু বাইরে ছুঁড়ে ফেলে হিসেব দাখিল করল, খরচের মোট পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে হাজার টাকা সেলামী বাদ দিলে থাকল চার হাজার। তার থেকে গত চার মাসের চারশ টাকা ভাড়া আর তার আগের চার মাসে পঞ্চাশ টাকা করে ধরে মোট ছ’শ টাকা তোমার শোধ হয়েই গেছে। হেসে উঠল, হাঁ হয়ে গেলে যে—মওকা পেয়ে আবু রব্বানী দোস্তের ভালো করেছে কি খারাপ করেছে?

বাড়ির ব্যাপারে বাপী অন্যরকম ভাবছিল বলে নিজেরই খারাপ লাগছে। বলল, এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে—

আবু এতেই খুশি। দুনিয়ার অনেকখানি হাতের মুঠোয় এমন সুরে বলে উঠল, ভালোর এখনো ঢের বাকি, সবে এলে, এখন তোমার আমার দু মাথা এক হলে কি যে হবে দেখো!

ওকে পেয়ে আবুর মাথায় কিছু মতলব গজিয়েছে আগেই সেটা বোঝা গেছে। ঘরে আসার পথে ওর মুখে ফুর্তি উপচে পড়ছিল, কলকাতায় বাপী বেকার বসেছিল শুনে বলেছিল, খোদার মর্জি না হলে টান পড়বে না—এখানে কাজই উল্টে তার জন্যে হাঁ করে আছে। দুলারিকেও নাকি কত সময় বলেছে, এ-সময় বাপীভাই এখানে থাকলে জমত ভালো।…আর বলছিল, পয়সার ছড়াছড়ি এখন এখানে—মাথা খাটাও, দিল্ লাগাও আর কড়ি তোলো। ওকে পেয়ে আবুর মাথা খাটানো দিল্ লাগানোর জোর আর কড়ি তোলার আশা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু এদিকটা বাপীর কাছে দুর্বোধ্য এখনো

আবু রব্বানীর জিভের লাগাম আরো ঢিলে এরপর। খুশি-ঝরা দুচোখ বাপীর মুখের ওপর। দেখছে কিছু। তরল গলায় বলল, তোমার মুখখানা এখন আগের থেকে ঢের মিষ্টি লাগছে বাপীভাই—দেখলেই মনে হয় ভেতর-বার সাফ— নেপালী মেমসাহেবের ঠিক পছন্দ হয়ে যাবে।

শোনার পর কান খাড়া, বাপী হাল্কা সুরে ইন্ধন যোগালো, কেন—মেয়ের জন্য পাত্রটাত্র খুঁজছে!

রসের কথায় আবু আর চাঁচাছোলা মানুষ নয় আগের মতো। হেসে উঠে জবাব দিল, মেয়ের জন্য কেন, নিজের জন্যেই খুঁজছে—ঠাকরোন বিধবা জানো তো?

নেপালিনীদের কী দেখে সধবা বিধবা বোঝা যেতে পারে বাপীর ধারণা নেই। পাত্র খোঁজার রহস্যটা আবু আর একটু বিস্তার করল। নিজের কাজের জন্যেই খুব একজন বিশ্বাসী আর লেখাপড়া জানা চৌকস লোক খুঁজছে নাকি গায়ত্রী রাই। ম্যানেজারের অনুপস্থিতিতে চা-বাগান থেকে দুবার দুটো ভদ্রলোক ছেলেকে এনে কাজে বহাল করেছিল। দুজনেই তারা চা-বাগানের কেরানী। চা-বাগানের কর্তাব্যক্তিরা গায়ত্রী রাইকে চোখে বড় দেখে না কিন্তু মানে-গনে খুব। দরকার শুনে তারাই দুবার দুজনকে লম্বা ছুটি দিয়ে আর বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে মহিলার যাচাইয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু একজনও টিকে যেতে পারে নি। গায়ত্রী রাই দুজনকেই ছেঁটে দিয়ে চা-বাগানে ফেরত পাঠিয়েছে। আবুর মতে ওই দুজনের একজন অন্তত বেশ শিক্ষিত আর চালাক-চতুর, আবু ধরে নিয়েছিল সেই লোকটা টিকেই যাবে। রসের ছোঁয়া পেলে আবুর এক চোখ এখনো একটু ছোট হয়ে যায়! মুচকি হেসে বলল, আমার ধারণা ওই লোকটার ঘাড়ে ঠাকরোনের খাঁড়া নেমেছে অন্য কারণে, নইলে কাজকর্ম ভালই করছিল, আর পরে ম্যানেজারও তাকে ভালো চোখেই দেখছিল।

মুখ দেখে বোঝা না গেলেও রস-টস কানে নেবার মন নয় বাপীর। সাদাসিধে ভাবেই জিগ্যেস করল, আমার মুখ দেখে আর ভেতর-বার সাফ ভেবে তোমার নেপালী মেমসাহেব এখন আমাকে সে জায়গায় নিয়ে নেবে ভাবছ?

—নিশ্চয় নেবে। আবুর গলার জোর বাড়ল।—একে তোমার বাড়ির সে ভাড়াটে, তার ওপর ওই বাড়ির ব্যাপারেই তোমার সম্পর্কে আমি একরাশ গুণ গেয়ে রেখেছি না! যেমন লোকই হই, ঠাকরোন আমাকে দারুণ বিশ্বাস করে— লেখাপড়া জানা একজন ভালো অথচ চালাক-চতুর মানুষ তার খুব দরকার এ কথা নিজে আমাকে বলেছে। চাকরি না পোষায় চুক্তিতে কাজ করতে পারো, তবে আটঘাট সব বুঝে নিয়ে মেমসাহেবের গলায় দাঁত বসাতে হলে চাকরিতে লেগে যাওয়াই ভালো। হেসে উঠল, ভেবো না, দাঁত বসানোর মওকা আমিই করে দেব—

বাপীর চোখে বা মুখে উৎসাহের চিহ্ন নেই। ওর মিষ্টি মুখের ছলনার ওপর আবু কিছুটা নির্ভর করছে মনে হতে খারাপই লাগল। বলল, আমার ভেতরবার সাফ ভেবে নেপালী মেমসাহেবের পছন্দ হলে তোমার কি লাভ—ভাঁওতাবাজীর ব্যাপার কিছু?

এবারে নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল আবু রব্বানী। মেজাজী পুরুষ! দেখো বাপীভাই, আমি লোক যেমনই হই আর যা-ই করি নিজেকে খোদার গোলাম ভাবি। তুমি লেখাপড়া জানা ভদ্রলোকের ছেলে, আমার দোস্ত—তোমাকে নোংরামির মধ্যে যেতে বলব কেন, আর তুমিই বা তা বরদাস্ত করবে কেন? তোমাকে মেমসায়েবের সঙ্গে জুড়ে দিতে চাই কেরামতি দেখিয়ে একদিন ওই চালিয়াৎ ম্যানেজারকে ঢিট করার জন্য, আর আমাদের ন্যায্য পাওনা-গণ্ডা ঠিক—ঠিক পাইয়ে দেবার জন্য। এরই নাম দাঁত বসানো, নইলে তো ওই আধবয়সী মেয়েমানুষের বদলে তার মেয়েকেই দেখিয়ে দিতাম!

উষ্মার মুখেই হেসে ফেলল আবার। —খবরদার, মেয়ের দিকে তাকিয়েছ কি কেস গড়বড়—এ ব্যাপারে মা-টি যাকে বলে বাঘিনী। মেয়ের পিছনে ছোঁকছাক করতে দেখেই চা-বাগানের সেই চৌকস লোকটিকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়েছিল।

ঘরে বাতাসের অভাব, না বুকে? দুনিয়ায় কি এমন জায়গা নেই যেখানে মেয়ে নেই? বাপী বিড়বিড় করে বলল, মেয়ের কথায় কাজ নেই, মায়ের কথা বলো। গায়ত্রী রাইয়ের মেজাজ বা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বাপীর মিনিট কয়েকের পরিচয়। একটা উটকো মানুষ অন্দরে ঢুকে পড়েছে ভেবে তার ঝাঁঝ দেখে আর ঝাপটা খেয়ে চলে এসেছিল। ওটুকু দিয়ে মহিলার বিচার সম্ভব নয়। তবু বাপীর মনে হয়েছিল তার রমণীসুলভ কোমলতার দিকটায় কিছু ঘাটতি আছে।

কিন্তু আবুর প্রগল্ভ বিস্তারের সার থেকে ওই রমণীর যে ছবিটা পেল তেমনটি হাজার গণ্ডা মেয়েছেলের মধ্যে একজনকেও দেখা যাবে কিনা সন্দেহ

…বানারজুলির এই জঙ্গল ভারত সীমার মধ্যে। কিন্তু জঙ্গলের পরিধি ভুটান পর্যন্ত জুড়ে আছে। ভুটান স্বাধীন। এখান থেকে মাত্র সাত মাইল দূরে সেই স্বাধীন ভুটানের বাসিন্দা গায়ত্রী রাই।

সেখানে একটা ছোট্ট পাহাড়ের মাথায় তার নিজস্ব বাড়ি। বাড়িটা করেছিল তার স্বামী বীরেশ্বর রাই। হিমালয়ের নিচের দিকে অমন ছোট ছোট অজস্র পাহাড় আছে। যারা অবস্থাপন্ন তারা নামমাত্র টাকায় সেই সব পাহাড় ইজারা নিয়ে তার ওপর ঘরবাড়ি তোলে। বীরেশ্বর রাই টাকার মুখ দেখার পরেই পাহাড়ের ওই বাড়ি করেছিল, কিন্তু সেই বাড়ির চেহারা এখন যা দাঁড়িয়েছে তার বারো আনা গায়ত্রী রাইয়ের কৃতিত্ব। সে-এলাকার অমন বাড়ি এখন খুব বেশি নেই। পাহাড়ের সেই বাড়িতে আবু বার কয়েক গেছে। গায়ত্রী রাইয়ের হুকুমে তার কাজ নিয়েই যেতে হয়েছে। গায়ত্রী রাইয়ের নিজের ভ্যান আছে একটা। স্বামীর আমলে জিপ ছিল। সেই জিপ বেচে দেওয়া হয়েছে। এখন ভ্যানেই যাতায়াত চলে।

আবুর যাতায়াত ভ্যানেই। ভ্যানে পাহাড়ের তলা থেকে উঠে একেবারে পাহাড়ের ডগায় বাংলোর কম্পাউন্ডে পৌঁছে যেতে পারে। তলা থেকে লাল কাঁকরের রাস্তা পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে ওপরে উঠে গেছে। গায়ত্রী রাইয়ের স্বামীর আমলে রাস্তাটা ভাল ছিল না। সেই রাস্তার সংস্কারও গায়ত্রী রাই করিয়েছে আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খোলা দিকে অর্থাৎ পাহাড়ের দেয়ালের উল্টো দিকে তারের বেড়া লাগিয়েছে।

কারণ তিন বছর আগে কিছুটা স্বামীর দোষে আর কিছুটা বা ওই রাস্তার দোষে গায়ত্রী রাইয়ের কপাল ভেঙেছিল। আবু রব্বানীর অবশ্য ধারণ। সেই থেকে নেপালী মেমসাহেবের কপাল খুলে গেছে।

গায়ত্রী রাইয়ের ওই পাহাড়ের ঘরবাড়ি দেখার জন্য একজন লোক আর একটা মালী আছে। আর সেখানে তার পেশার কাজে সাত-আটজন নানা জাতের পাহাড়ী লোক বহাল আছে। এদের সকলের মাথার ওপর যে তার নাম ঝগডু। দেশ বিহারে। কিন্তু সেই ছেলেবেলা থেকে এদিকের জঙ্গলে আর পাহাড়ে বাস। তার বউ বুনো হাতির পায়ের তলায় চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে মরেছে। দু-দুটো জোয়ান ছেলের একটাকে সাপে কেটেছে আর একটাকে ভালুকে মেরেছে। কিন্তু আবু সে-জন্যে লোকটার বড় রকমের শোক-পরিতাপ কিছু দেখে নি। কেবল সাপের গলা টিপে বিষ নিঙড়ে বার করার সময় তার চোখ দুটো সাপের থেকেও বেশি জ্বলতে দেখে, আর ভালুক শিকারের গন্ধ পেলে এই বয়সেও যে অস্ত্র সামনে পায় হাতে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসে। এই বয়সে বলতে লোকটার বয়স এখন সত্তরের কাছাকাছি। এখনো পাথরে কোঁদা মজবুত শরীর। বীরেশ্বর রাইয়ের ব্যবসার শুরু থেকে তার সঙ্গে আছে। এখন তো মেমসায়েব না থাকলে ও-ই পাহাড়ের বাড়ির সর্বেসর্বা।

বয়েসের অনেক ফারাক সত্ত্বেও এই ঝগড়ুর সঙ্গে আবুর গলায় গলায় ভাব এখন। ভাব দু-তিন কারণে। স্বয়ং কর্ত্রীর যে বিশ্বাসের পাত্র ঝগড়ুর কাছে তার কদর বেশি। তা ইদানীং তো কর্ত্রীর অনেক রকমের জরুরী কাজে আবুর ডাক পড়ে। সে হেড বীটম্যান হবার পর মেমসাহেবের আয়-পয় আরও বেড়েছে। দ্বিতীয় কারণ আবুকে সত্যিকারের মরদ ভাবে ঝগড়ু। পাহাড় থেকে নেমে এ—পর্যন্ত তিনটে ভালুক শিকার করেছে ওরা। আবুর বন্দুক আছে এখন, কিন্তু বন্দুক দিয়ে শিকার করাটা কি এমন মরদের কাজ। দুজনে মাথা খাটিয়ে জাঁদরেল ভালুককে নাজেহাল করে হাতের অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করতে পারলে তবে তো কথা। তাই করেছে। আর সে-সময় আবুর সাহস আর বুদ্ধি বিবেচনা দেখে ঝগড়ুর তাক লেগে গেছে।

গলায় গলায় ভাবের তৃতীয় কারণ—কারণ। অর্থাৎ শরাব। ভুটানে এই জিনিসটি অঢেল। বাজারে অনেক রকমের সস্তার মাল মেলে। আবার দামী বিলিতি জিনিসও এন্তার পাচার হয়ে আসে। দামী হলেও অন্য জায়গার তুলনায় ঢের সস্তা। কিন্তু গরীব মানুষ ঝগড়ুকে কম পয়সার দিশী মালই গিলতে হয়। অথচ সে বিলিতি বা দামী শরাবের ভক্ত। গন্ধ পেলে জিভে জল গড়ায়। ভাল জিনিসের স্বাদ জেনেছিল মনিব অর্থাৎ বীরেশ্বর রাই বেঁচে থাকতে। তখন দিশী জিনিসের দিকে ফিরেও তাকাত না ঝগড়ু। মনিবটি একদিকে যেমন দিলদরিয়া মানুষ ছিল, অন্যদিকে তেমনি শরাব-রসিক ছিল। কত রকমের দামী মাল ঘরে মজুত রাখা হত তখন। সাহেব দরাজ হাতে তার ভক্তকে প্রসাদ দিত—সিকি বোতল আধ-বোতল যা অবশিষ্ট থাকত ঝগড়ুর ভোগে আসত। ঝগড়ুর সেই সব সুখের দিন গেছে। ভাল জিনিস আর মেলেই না। কর্ত্রী ঘরে থাকলে এখন কত লুকিয়েচুরিয়ে আর মেহনত করে তাকে একটু-আধটু দিশী মাল খেতে হয়। টের পেলে এত পুরনো খাতিরের লোককেও ওই মনিবানি খাতির করবে না। যা-ই হোক, মেমসায়েবের ফরমাশ মত আবু পাহাড়ে গেলে বেশি দামের ভাল মালই ঝগড়ুকে খাওয়ায়। এরই ফলে দোস্তি জমজমাট। সেই দিলখুস নেশার সময় ঝগড়ুর মুখ থেকে এই পরিবারের নাড়িনক্ষত্র জেনেছে আবু রব্বানী।

ওষুধের বনজ কাঁচা মাল সরবরাহের ব্যবসা ফেঁপে উঠেছিল বীরেশ্বর রাইয়ের। অ্যালোপ্যাথী, কবিরাজি / আর হোমিওপ্যাথী ওষুধের কারখানায় যেসব শিকড়—বাকড় লতাপাতা বীজ ফলমূল গাছগাছালির বিশেষ চাহিদা। আশপাশের হেকিম ওঝা হাতুড়ে বদ্যিরাও এ-সবের খদ্দের। ভেষজগুণের দামী আর দুষ্প্রাপ্য মাল সংগ্রহের দিকে বেশি ঝোঁক ছিল বীরেশ্বর রাইয়ের। এ ব্যাপারে দারুণ পরিশ্রমী ছিল নাকি মানুষটা। নিজে পড়াশুনা করত, ওষুধের গাছগাছড়া লতাপাতা চেনে এমন লোকদের খুঁজে বার করত, তাদের নিয়ে পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। এই করে ওষুধের গাছ যোগাড় করা আর চাষ করার একটা দলই তৈরী করে ফেলেছিল। তারা এখনো আছে, নতুন লোককেও শেখাচ্ছে। পাহাড় আর জঙ্গলের মানুষেরা বেশির ভাগই ভীষণ গরিব। পয়সার মুখ দেখলে তাদের উৎসাহের অভাব হয় না, জঙ্গলের বাঘ-ভালুকেরও পরোয়া করে না। ওষুধের গাছ, লতাপাতা, বীজ, দানা চেনার ব্যাপারে সব থেকে চৌকস হয়ে উঠেছিল ওই ঝগড়ু। মনিব এ-জন্যে ওকে সব থেকে বেশি ভালবাসত। বয়েস হয়েছে, এখন আর যোগাড়ের কাজে বেরোয় না। পাহাড়ের বাংলোর পিছন দিকে কিছু দামী ওষুধ গাছের চাষের বাগান আছে, সেটা দেখাশুনা করে আর অন্য লোকদের তালিম দেয়।

বীরেশ্বর রাইয়ের এই সব বনজ কাঁচা মালের পসরা ভুটান সিকিম ছেড়ে আসাম আর উত্তর বাংলার দিকেও ছড়িয়ে গেছল। ও-সব দিকে তখনও কবিরাজি চিকিৎসার প্রাধান্য। অশিক্ষিত বা গরিব-মধ্যবিত্ত মানুষেরা আগে হেকিম বা কবিরাজের কাছে ছুটত। ফলে ছোট-বড় কবিরাজি ওষুধ তৈরির কারখানাও গজিয়ে উঠছিল। তা ছাড়া ছোট-বড় কবিরাজেরা নিজেরা তো ওষুধ তৈরি করেই। এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের জন্য দফায় দফায় লম্বা টুরে বেরুতো বীরেশ্বর রাই। ফলে সুনাম আর তার কাঁচা মালের কদর দুই-ই বেড়েছে।

এই ব্যবসা সামনে রেখে কাঁচা টাকা রোজগারের আর একটা দিকও হাতের মুঠোয় এসে গেছল বীরেশ্বর রাইয়ের। পাহাড়ী বনজঙ্গলে ওষুধের গাছ-গাছালি ছাড়া নেশার জিনিসও কত রকমের গজায় তার ঠিক নেই। আফিম গাঁজা ভাঙ তো আছেই, আরও অনেক রকমের ছোট-বড় নেশার জিনিসের হদিস মেলে। এ-ব্যাপারেও যেটুকু জ্ঞানগম্যি থাকা দরকার বীরেশ্বর রাইয়ের সেটুকু ছিল। এ ব্যবসা সে বাইরে চালাত না। এই সব নেশার জিনিস ভুটানের রাজধানী থিম্পু আর পারোর মত দুই একটা বড় শহরে চালান দিত। তাইতেই অনেক টাকা ঘরে আসত।

ব্যবসা ফেঁপে উঠতে বীরেশ্বর রাই একা আর পেরে উঠছিল না। রণজিৎ চালিহা তখন চা-বাগানে চাকরি করে। তার বন্ধু আর এক গেলাসের ইয়ার। চালাক-চতুর চৌকস মানুষ। টগবগ করে অসমীয়া বাংলা হিন্দী ভুটানি নেপালী আর ইংরেজীতে কথা বলতে পারে। রণজিৎ চালিহার ওপর আগে থাকতেই চোখ ছিল বীরেশ্বর রাইয়ের। আসামের মানুষ, তাকে পেলে আসামের বাজারটা ভাল মত কব্জায় আসতে পারে। তাছাড়া অতগুলো ভাষা জানা একটা চৌকস লোককে হাতে পেলে সব-দিক থেকেই সুবিধে। হাতে পাওয়া ব্যবস্থা ওপরঅলাই করে দিলে। হঠাৎ কি গোলযোগে চা-বাগানের চাকরি নিয়ে টানাটানি রণজিৎ চালিহার। সেই মওকায় বে-ইজ্জত হবার আগেই বীরেশ্বর রাই আরও কিছু বেশি মাইনের টোপ ফেলে ব্যবসায় টেনে নিল। সেই থেকে সে ম্যানেজার।

বন্ধু আর এক গেলাসের ইয়ার হলেও ব্যবসার কাজকর্ম আর টাকা-পয়সা লেনদেনের ব্যাপারে কড়া মানুষ ছিল বীরেশ্বর রাই। সব-দিকে তার চোখ ছিল। রাতে গেলাস নিয়ে বসলে বা মেয়ে-বউ নিয়ে তার সঙ্গে কোন ফুর্তির সফরে .. বেরুলে তখন বন্ধু। অন্য দিকে ম্যানেজার রণজিৎ চালিহাও চতুর কম নয়। মনিব-বন্ধুর মুখের দিকে চেয়ে মন বুঝতো আর চটপট সেই মতো কাজ সেরে ফেলত। ফলে ঝগড়ু দুই বন্ধুর মধ্যে ঝগড়া ভুল-বোঝাবুঝি কখনও হতে দেখে নি। একসঙ্গে চার বছর কাজ করেছে তারা, ততদিনে ব্যবসা আরও চাঙা হয়ে উঠেছে। মালিক তার ওপর খুশি ছিল, আর ফুর্তিবাজ কাজের মানুষটার ওপর মালকানও অখুশি ছিল না। মালিক বেঁচে থাকতে ম্যানেজার কত মাইনে আর উপরি পেল বা এখন কত মাইনে পায় ঝগড়ু বা আবুর কোন ধারণা নেই। মাইনে এখন আরও বেশি পায় নিশ্চয়, কিন্তু আবুর ধারণা, ইদানীং তার বাড়তি রোজগার মাইনের থেকে বেশি ছাড়া কম নয়। যতই হোক মাইনের টাকায় এত মদ খাওয়া ফুর্তি করা বা এমন চালের ওপর থাকা সম্ভব নয়। আবুর আরও ধারণা, তার বাড়তি রোজগারের ব্যাপারটা গায়ত্রী রাইও জানে কিন্তু কিছু বলে না। বলবে কি করে, ব্যবসায় অনেকখানি তো বলতে গেলে এখনও তারই হাতে।

যতখানি সম্ভব গায়ত্রী রাই নিজেই ব্যবসার হাল ধরেছে আর ধরে আছে। বীরেশ্বর রাই মারা গেছে তিন বছর আগে। আচমকা অঘটন, আচমকা মৃত্যু। পাহাড়ের বাংলোয় ওঠার পথে বেসামাল জিপ নিচে পড়ে যায়। জিপ চালানোর ব্যাপারে মানুষটা বেপরোয়া হলেও পাকা হাত। তখনও বর্ষা শুরু হয়ে যায় নি। বর্ষাকালে পাহাড়ের বাংলোয় থাকাই যায় না। প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়। রাস্তা খারাপ হয়ে যায়। ধ্বস নামে। রাস্তা বন্ধও হয়ে যায়। প্রতি বছর বর্ষা নামার আগে সপরিবারে পাহাড় থেকে নেমে আসতে হয়। ওই সময়টা কাছাকাছির কোন শহরে বা চা—বাগানের বাংলো ভাড়া করে থাকে তারা। বর্ষা শুরু না হলেও সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল, আর পাহাড়ী রাস্তাও বেশ খারাপ হয়ে গেছল। তাছাড়া তখনকার সেই রাস্তাও এখনকার মত ছিল না। সেই অঘটনের ফলেই এককাড়ি টাকা খরচ করে এখানকার এই রাস্তা বানিয়েছে গায়ত্রী রাই। যা-ই হোক, বৃষ্টিতে রাস্তা খারাপ থাকলেও বীরেশ্বর রাইয়ের মতো অমন পাকা হাতে এই গোছের অ্যাকসিডেন্ট হবার কথা নয়। আসলে একটা মস্ত কাজ হবার ফলে মনের আনন্দে এন্তার মদ গিলে দুই বন্ধু বাড়ি আসছিল। পোস্ট মরটেম রিপোর্ট থেকে সেটা বোঝা গেছে। রণজিৎ চালিহারও সেই রাতে পাহাড়ের বাংলোতেই খাওয়া আর থাকার কথা। কিন্তু কিছু টুকিটাকি কাজ সারার জন্য সে আগেই নেমে গেছল। কাজ শেষ করে ঘণ্টা দু ঘণ্টার মধ্যে ফিরবে। এক কথায় আয়ুর জোর ছিল লোকটার। নইলে একসঙ্গে দুজনেই শেষ হয়ে যেত।

সেই থেকে মদ দু চোখের বিষ গায়ত্রী রাইয়ের। তার কাজের লোকদের কারও মদ খাওয়া বরদাস্ত করে না। একমাত্র রণজিৎ চালিহাকেই কিছু বলে না। স্বামী বেঁচে থাকতে ব্যবসার হিসাবপত্র রাখা আর পার্টির কাছে চিঠিপত্র লেখার কাজ গায়ত্রী রাই করত। কিন্তু সে মারা যাবার দু মাসের মধ্যে মহিলা এমন শান্ত হাতে ব্যবসার হাল ধরবে কেউ ভাবে নি। প্রখর বুদ্ধিমতী তো বটেই, এই তিন বছরে ব্যবসা ডবল ফাঁপিয়ে তোলার ব্যাপারে কম সাহস দেখায় নি। অবশ্য এই সাহসও রণজিৎ চালিহাই যুগিয়েছে। একটু বেপরোয়া হতে পারলে কত সহজে আরও কত বেশি টাকা রোজগার করা যায় সে-পথ সে-ই গোড়ায় দেখিয়েছে। না, টাকার গন্ধ পেলে মহিলা পেছু পা হবার মেয়ে নয়। ভুটান সিকিম উত্তরবাংলা আর আসামের নানা জায়গায় বনজ ওষুধের কাঁচা মাল মজুতের পাকাপোক্ত ঘাঁটি করা হয়েছে। সেই সব জায়গায় কাজ চালানোর জন্য লেখাপড়া জানা স্থানীয় এজেন্ট বাছাই করে বহাল করা হয়েছে। তাদের ব্রোকাররা জায়গায় জায়গায় গিয়ে অর্ডার বুক করে। কমিশন পায়। এই নির্ভরযোগ্য চালিহা তার ডান হাত— সে সঙ্গে থাকত। এ-রকম ঘাঁটি করার ফলে কারবারের মাল এখন ওদিককার বড় বড় অনেক শহরেই পৌঁছে যাচ্ছে।

এদিকে নেশার কারবারটি আগের থেকে চারগুণ জমজমাট। গায়ত্রী রাইয়ের কাছে নেশা করাটা চক্ষুশূল, কিন্তু নেশার জিনিস বিক্রী করে ঘরে টাকা তুলতে আপত্তি নেই। ভুটানের থিম্পু বা পারো ছেড়ে বর্ডারের কাছাকাছি বড় শহর ফুটশোলিঙ, পর্যন্ত নেশার মাল পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর সে-সব জায়গা থেকে এখানে আসছে ভাল ভাল মদ! বানারজুলি আর আশপাশের অনেক চা-বাগানের সাহেব-সুবোরা এই মদের এখন বড় খদ্দের। হবে না কেন, ও-সব জিনিসের এখানে অনেক দাম—আর আনাও সহজ ব্যাপার নয়। সুবিধের দামে হাতের কাছে মজুত পেলে তাঁরা ঝুকবে না কেন? সুবিধের দামে দিয়েও রাইয়ের মোটা লাভ থাকে।

ব্যবসার আরও একটা বড় শাখা বিস্তার করেছে গায়ত্রী রাই। সাপের ব্যবসা। এ—দেশ থেকে বহু সাপ বিদেশের নানা জায়গায় চালান যায়। আমেরিকা ইংল্যান্ড পশ্চিম জার্মানি হল্যান্ড জাপান সকলেরই সাপের চাহিদা। বিষাক্ত সাপ তো বটেই, নির্বিষ সাপও চাই তাদের। এখানে এত খবর কে রাখত? সাপুড়ে আর বেদেবেদেনীদের কাছে দালালদের আনোগোনা বাড়তে ব্যাপারটা বোঝা গেছে। তারা তো খবর রাখেই। এই বানারজুলি থেকে শুরু করে বিশাল তরাইয়ের জঙ্গলের সর্বত্র বিষধর আর নির্বিষ সাপ কিলবিল করছে। সাপের কি শেষ আছে এ-সব দিকে! গায়ত্রী রাইয়ের এই ব্যবসা শুরু করার পিছনে আসল কৃতিত্ব আবু রব্বানীর। এদিককার জঙ্গলের সে হেড বীটম্যান। দালালরা তার কাছে আসত, তার পকেটে টাকা গুঁজে দিয়ে অনুরোধ করত লোক লাগিয়ে জ্যান্ত সাপ ধরে দাও। এমনি সাপ হলে কম পয়সা, বিষাক্ত সাপ হলে বেশি। যে ধরে দেবে তাদেরও এক-একটা সাপের জন্য আট আনা থেকে দেড়-দু টাকা পর্যন্ত দিত তারা। পাইথন পেলে দশ-পনের টাকা দিতেও রাজি। তাজ্জব ব্যাপার।

কিন্তু সরকারী চাকুরে আবু দালালদের খুশি করে কি করে? তারা এলে তখন সাপের খোঁজ। সে তো আর সাপ মজুত করে রাখতে পারে না বা আগে থাকতে লোক লাগিয়ে গাঁটের পয়সা খরচ করে সাপ কিনে রাখতে পারে না। কথায় কথায় একদিন দালালদের চাহিদার ব্যাপারটা সে গায়ত্রী রাইকে বলেছিল। মেমসাহেবের একটা মজা আছে, নিজে কথা বেশি বলে না কিন্তু সকলের সব কথা শোনে। শোনার পর ম্যানেজারকে ডেকে বলল কি ব্যাপার খবর নিতে। এ-সব ব্যাপারে রণজিৎ চালিহা তৎপর খুব বলতেই হবে। আট-দশ দিনের মধ্যে সমস্ত খবর তার ঠোটের ডগায়। শতকরা পঁচানব্বই ভাগ সাপ বিদেশে যাচ্ছে। বাকি পাঁচ ভাগ দেশের গবেষণার কাছে লাগছে। বাইরে সাপ চালানের প্রতিষ্ঠান আছে। এ-দেশে। দালালদের হাত ঘুরে সেই সাপ প্রতিষ্ঠানে পৌঁছয় দালালরা তো লাভ করেই, খোদ কারবারীরাও তার ওপর মোটা লাভ করে সাপ বিদেশে চালান দেয়। প্রতিষ্ঠান বড় দালালদের কাছ থেকে কোন্ জাতের সাপ কি দরে কেনে শুনে মেমসাহেব পর্যন্ত হাঁ একেবারে। বিষাক্ত সাপের দাম ছয় থেকে বিশ টাকা পর্যন্ত ওঠে। তার মধ্যে একটা শঙ্খচূড়ের দাম একশ থেকে তিনশ সাড়ে তিনশ পর্যন্ত হয়। যত বড় হবে ততো দাম চড়বে। আর নির্বিষ সাপের মধ্যে পাইথনের দামও একশ থেকে আড়াইশ-তিনশো হতে পারে।

ব্যস, আবুর হুকুম হয়ে গেল বেদে সাপুড়ে বা জঙ্গলের লোকের কাছ থেকে একটা সাপও যেন দালালরা না পায়। সাপের খোঁজে এলে তাদের গায়ত্রী রাই অথবা ম্যানেজারের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। আর সকলকে জানিয়ে দিতে হবে জ্যান্ত সাপ ধরে আনলে দালালদের থেকে অনেক ভাল দামে তারা সেগুলো কিনে নেবে। বিয়ের আগে দুলারিরা যে ডেরায় থাকত সেটা এখন নানা জাতের আর নানা রকমের সাপের গুদাম। মাস গেলে দুলারি এখন কুড়ি টাকা করে ডেরার ভাড়া পায়। আর আরও পঞ্চাশ টাকা পায় এই ব্যবসা দেখাশুনা করার জন্য। দেখাশুনা বলতে সাপ ধরার লোকদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করা আর দালালদের সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেলে মালকান বা ম্যানেজারের নির্দেশমত তাদের হাতে সাপ জিম্মা করে দেওয়া। দুলারির নামে এই দেখাশুনার ব্যাপারটা সব আবুই করে। দু-দুটো বাচ্চা নিয়ে তার অত সময় কোথায়। দুলারি এখন পাকা সংসারী হয়ে গেছে।

সাপের বিষও যে সোনার দরে বিকোয় তাই বা কে জানত? কিন্তু গায়ত্ৰী রাই ঠিক জেনেছে। সাপের বিষের চাহিদা অবশ্য সামান্যই সে-সময়। কিন্তু যেটুকু আছে তাতেও কম লাভ নয়। বাছাই করা কিছু বিষাক্ত সাপ গায়ত্রী রাইয়ের পাহাড়ের বাংলোয় চলে যায়। সেখানে একটা সাপের ঘরই করে দেওয়া হয়েছে। ওদিকটার ভার ঝগড়ুর। ওর হাতে টিপুনির চাপে সাপগুলো গলগল করে বিষ ঢেলে দেয়। সাপের বিষ পেতে হলে খদ্দেরদের সেই পাহাড়ের বাংলোয় যেতে হয়।

গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে ম্যানেজার রণজিৎ চাহিলার অবনিবনা কেউ কখনও দেখে নি। বরং এই একজনের সঙ্গেই শুধু মেমসাহেব হাসিমুখে কথাবার্তা বলে, আর বেশির ভাগ ব্যাপারে তার সঙ্গেই পরামর্শ-টরামর্শ করে। কিন্তু একবার মেমসাহেবের সঙ্গে তার মনকষাকষি একটু হয়েছিল সে-খবর শুধু ঝগড়ু রাখে। আবুকে এই গোপন কথাও সে-ই বলেছে। সাহেব মারা যাবার বছরখানেকের মধ্যে রণজিৎ চালিহা নাকি গোটা ব্যবসাটা তিনজন পার্টনারের নামে চালাবার প্রস্তাব দিয়েছিল। একজন গায়ত্রী রাই, একজন তার মেয়ে উর্মিলা রাই আর একজন সে নিজে। সাদা কথা, তিন ভাগের এক ভাগ মালিক হতে চেয়েছিল। মেয়ের সঙ্গে গলায় গলায় ভাব ঝগড়ুর। এ খবর সে-ই চুপি চুপি ফাঁস করেছে। তার কাছে। মেয়ে তখন নাবালিকা। মেমসাহেব সে-প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। ম্যানেজারের তখন নাকি মেজাজ বিগড়েছিল। মেমসাহেব কোন্ কায়দায় তাকে ঠাণ্ডা করেছে, ঝগড়ু জানে না। তবে মাইনে যে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর ঝগড়ু লক্ষ্য করেছে, তারপর থেকে বাড়িতে লোকটার আদর-আপ্যায়নও বেড়েছে।

রণজিৎ চালিহার বউ ছেলে মেয়ে আছে। আগে বছরের বেশির ভাগ সময় তারা আসামেই থাকত, মাস-কতকের জন্য বানারজুলিতে আসত। গত দু বছরের মধ্যে আর আসেই নি তারা। ফলে দেড়-দু মাস অন্তর ম্যানেজারের আসামে টুর প্রোগ্রাম পড়ে। অবশ্য ব্যবসার বাজারও সেখানে ভালই জমে উঠেছে। আগে মেমসাহেবের কাছে লোকটার খাতির কদর দেখে আবুরা ভাবত লটঘটের ব্যাপার কিছু আছে। অমন কড়া মালকান এই লোকের কাছে শুধু নরম নয়, হাসি-খুশিও। প্রেমের আবার বয়েস বলে কিছু আছে নাকি? মেমসাহেব পাহাড়ের বাংলোয় থাকলে ম্যানেজার সেখানে মাঝেসাজে গিয়ে উপস্থিত হয়, খানাপিনা করে, রাতে থাকেও। ওদিকে ম্যানেজারের বউ ছেলে মেয়ে এ-দিক মাড়ায় না। কিন্তু দু-দুটো বছর একভাবে কেটে গেল, নানা কারণে আবুর আর এখন সে-রকম কিছু মনে হয় না। তাছাড়া সে-রকম হলে ঝগড়ু নেশার মুখে ঠিক বলে দিত। ম্যানেজার লোকটাকে ঝগড়ু খুব একটা পছন্দ করে না। পছন্দ কোন কর্মচারীই করে না। লোকটার এমন হাবভাব যেন সে-ই সব-কিছুর হর্তাকর্তা বিধাতা। নিজে কত দিকে কত ভাবে টাকা কামাচ্ছে ঠিক নেই, অন্যকে হকের পয়সা দেবার বেলায় বকাঝকি করে মালিককে খুশি করার চেষ্টা। নেশার মুখে ঝগড়ু বরং বলেছে, তেমন দরকার পড়লে মালকান গাল বাড়িয়ে ব্যাঙের লাথি খেতে পারে, আবার দুশমন ঢিট করতেও জানে। দরকার

হলে যত লায়েকই হোক ওই ম্যানেজারকেও টাইট দিতে ছাড়বে না। কেন বলতে পারবে না, আবু এখন তার মেমসাহেবের এই চরিত্রটাই বেশি বিশ্বাস করে।

আবুর সঙ্গে মেমসাহেবের যোগাযোগ দু বছরেরও বেশি। আর বছর খানেকের ওপর হল ও তার একজন বিশ্বস্ত লোক। বর্ষায় তো পাহাড় থেকে নেমে আসতেই হয়, আবার কড়া শীতেও নেমে আসতে হয়। এই জন্য মেমসাহেব পাকাপোক্ত ডেরার খোঁজে ছিল। ইদানীং বানারজুলির দিকে কাজ বেশি, আবার এখানে থাকলে যোগাযোগের সুবিধেও বেশি। আট মাস আগে আবু বাপীর বাসাটা তার জিম্মায় ছেড়েছে। দুলারিও এই পরামর্শই দিয়েছিল। মেমসাহেবের নেকনজরে পড়ার আরও কারণ আছে। ও কাজের লোক কেমন তা তো দেখেছেই। তার ওপর ও এ-জঙ্গলের হেড বীটম্যান হবার দরুন সুবিধেও কম পাচ্ছে না। যেমন, জঙ্গলে আজ বাপী স্বচক্ষে যে চন্দ্রা বা সর্পগন্ধার বেড দেখে এলো, সেটা ওখানে হচ্ছে কার জন্য? হচ্ছে কি করে? হচ্ছে ওই মেমসাহেবের জন্যে, খরচ একরকম নেই-ই বলতে গেলে। আর হচ্ছে আবুর দৌলতে। মাথা চুলকে বড়সাহেবের কাছে আর্জি পেশ করল, কিছু ভাল ওষুধ-গাছের বীজ তার হাতে এসেছে, জঙ্গলের মধ্যে একটু জায়গা নিয়ে চাষ করতে দিলে অনেক গরীব লোকের উপকার হয়। নি-খরচায় লোকের উপকার করে নাম কিনতে পারলে বড়সাহেবই বা আপত্তি করবে কেন? জঙ্গলে তো আর জায়গার টানাটানি নেই। তাছাড়া আবুর কল্যাণে জঙ্গলের কম জিনিস কি তার বউয়ের হেঁসেলে বা ভাঁড়ারে যায় যে আর্জি নাকচ হবে?

গল্পে গল্পে কখন সন্ধ্যা পার বা কখন দুলারি ঘরে হারিকেন রেখে গেছে দুজনের কেউই তেমন খেয়াল করে নি। এই সমাচার আরও কতক্ষণ চলত কে জানে। বাধা পড়ল।

আবু এ-দিন ফিরে ছিল, ঘরে যে ঢুকল, তাকে দেখে বাপীই প্রথমে সচকিত। দুলারি নয়।

রেশমা।

অন্দরে একজন বাইরের লোক দেখে ভিতরে ঢুকে ও থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। কয়েক মুহূর্ত, তারপরেই মুখে বিস্ময় ভাঙল।—বাপীভাই মনে হচ্ছে—অ্যাঁ?

আবু ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। তারপর কিছু একটা রসিকতা করতে গিয়েও বাপীর মুখের দিকে চেয়ে থেমে গেল। মজা দেখছে।

কারণ বাপীর মুখে কথা নেই। চেয়েই আছে। সেই রেশমাই বটে, অথচ অনেক তফাৎ।…বছর দুই বড় হবে বাপীর থেকে, বছর চব্বিশ-পঁচিশ হবে বয়েস এখন। কিন্তু এত দিনেও মেয়েটার বয়েস বাড়ে নি; শুদু চেকনাই বেড়েছে। আগের থেকে অনেক তাজা আর পুষ্ট লাগছে। পরনের খাটো ঘাগরা আগের মত মলিন নয়। গায়ের আঁট জামাটাও চকচকে। মাথার সেই উস্কো-খুস্কো চুল মিশকালো এখন—পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। সুমা-টুৰ্না কিছু লাগানোর দরুন চোখ দুটো গভীর টানা দেখাচ্ছে।

বাপীর এই গোছের দেখার জালে পড়লে রেশমা আগে খিলখিল করে হেসে উঠত। এখনও হাসছে বটে, কিন্তু এখনই যেন সত্যিকারের সাপের খেলা দেখানো মেয়ের হাসি।

পরের মুহূর্তে মেয়ে গম্ভীর। একটু এগিয়ে এসে আবুর মুখোমুখি দাঁড়াল। দু হাত দু দিকের কোমরে উঠে এলো। চোখে ভ্রুকুটি।

কপট যন্ত্রণায় আবুর মুখ কুঁচকে গেল।—অমন করে চোখ দিয়ে বিঁধিস না মাইরি, বাপীভাই এসেই আমার ঘরে তোর বদলে দুলারি কেন জিগ্যেস করে বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।

খেদ শেষ হবার আগে দুলারিও ঘরে। আবু এখন কোন্ দিক সামলাবে। মেকি ত্রাসে পিছিয়ে বসল একটু।—মুখ ফসকে বলে ফেলেছি, বাপীভাই বাঁচাও!

রেশমা ফিরে দেখল দুলারিও মুখ টিপে হাসছে। তাকে নিয়ে রসের কথা কিছু হয়েছে বুঝেও তেমন কৌতূহল দেখাল না। আবুর দিকে ফিরে শাসনের সুরে বলল, এই জন্যেই তোমার পাত্তা নেই—বুকে বসানোর জন্য মালকান ওদিকে ছুরি হাতে অপেক্ষা করছে—যাও। ম্যানেজারও আছে—

—শালারা খেলে দেখছি। রস ভুলে আবু তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।— বাপীভাই চলো, অনেক দেরি হয়ে গেছে।

বাপীর দু চোখ তখনও রেশমার মুখের ওপর। রেশমা কটাক্ষে এ-দিকে তাকালো একবার। ঠোঁটে হাসি ঝিলিক দিল।—আবু সাহেব তুমি একলাই যাও, বাপীভাই এখন আমাকে দেখতে ব্যস্ত।

পিছন থেকে দুলারি একটা থাপ্পড় বসালো তার পিঠে। আত্মস্থ বাপী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। আবুকে বলল, চলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *