সোনার হরিণ নেই – ৮

আট

রাতের অন্ধকার ফুঁড়ে ট্রেন ছুটেছে। কামরার বেশির ভাগ লোক ঘুমোচ্ছে। জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ বসেই ঝিমুচ্ছে। বাপীর কারো দিকে চোখ নেই। দু’ চোখ জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে। ভিতরে আরো বেশি দমবন্ধ-করা অন্ধকার।

মা বলে কি কেউ কোথাও আছে? নিজেরই বিষে ভিতর-বার কালি হয়ে গেলেও যার কাছে ছুটে যাওয়া যায়, যার বুকে মুখ গোঁজা যায়, মুখ লুকনো যায়? বুকের জমাট-বাঁধা কান্নার স্তূপ যার স্পর্শে গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যায়? বাপী জানে না। মা কাকে বলে জানে না। কিন্তু মায়ের মতো করে কেউ ডাকছে ওকে। বানারজুলি ডাকছে। বানারজুলির জঙ্গল হাতছানি দিচ্ছে। এত বড় পৃথিবীতে শুধু সেখানে একটু আশ্রয়। সেখানে একটু মুখ লুকানোর জায়গা।

বাপী তরফদার সেইখানে চলেছে।

সেই রাতের পর আরো দুটো রাত রতন বনিকের খুপরি ঘরে বিনিদ্র কেটেছে। নাইট ডিউটি দিয়ে রতন বনিক সকাল সাতটার মধ্যে খুশি মেজাজে ঘরে ফিরেছিল। সপ্তাহে একদিনের নাইট ডিউটিটা ওর চক্ষুশূল। বাকি ছ’টা দিন নিশ্চিন্ত। কমলা নয়, ও-ই চায়ের গেলাস হাতে করে ঘরে ঢুকেছে। জিগ্যেস করেছে, রাতে খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হয়েছিল তো?

নিঃশংক, নিশ্চিন্ত মানুষ। কথাগুলো তাই বিবেকের পিঠে চাবুক হয়ে নেমে এসেছিল। তার থেকে যদি বাপীর মুখের দিকে চেয়ে এই সাদাসিধে ভালোমানুষটার চাউনি ঘোরালো হয়ে উঠত, তাহলেও কিছু সান্ত্বনা থাকত। মুখের দিকে না চেয়ে বাপী বিড়বিড় করে জবাব দিয়েছে, রাতে খাব না বলেই তো রেখেছিলাম—

…সকাল দশটার মধ্যে রাস্তায় নেমে এসেছিল। কিন্তু যাবে কোথায়? দুর্ভর দিন কাটবে কেমন করে? সঙ্গোপনের পশুটা প্রাণভয়ে গুহা ছেড়ে উধাও। তখন তার অস্তিত্বই নেই।

কমলা বনিক কোনদিন তার শিকার ছিল না। সেই রাতেও না। দেহ যারই হোক, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে শেকল-ছেঁড়া ক্ষিপ্ত আহত জানোয়ার অপটু উল্লাসে যাকে নিয়ে বিস্মৃতির অতলে ডুবেছিল, সে আর কেউ। আর একজন। তারপর চেতনার কশাঘাতে জেগে ওঠা সেই রূঢ় বাস্তব। বাপী তরফদারের যন্ত্রণা সম্বল।

বিকেলের দিকে কে যেন লেকে টেনে এনেছে তাকে। আগের দিনের সেইখানে এসে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতর ওপর হিংস্র নখের আঁচড় পড়েছে। ফিকি দিয়ে রক্ত ছুটেছে। মাথায় আগুন জ্বলেছে।

বাপী তরফদার এরই মধ্যে সচকিত। একটা অস্বস্তির ছায়া পড়ছে।… জানোয়ারটা ওঁত পেতে ছিল কোথায়। সুযোগ আর সময়ের প্রতীক্ষায় ছিল। গুটি গুটি এবারে তার আশ্রয়ের দিকে এগোচ্ছে। বিবেকের কশাঘাতে বাপী তরফদার ওটাকে ধরাশায়ী করতে চেয়েছে, নির্মূল করতে চেয়েছে। কিন্তু ওই শয়তান তার সময় জানে। সুযোগ জানে। পায়ে করে তাকে থেঁতলে থেঁতলে বাপী তরফদার হনহন করে লেক থেকে বেরিয়ে এসেছে। তবু তার পায়ের শব্দ বাড়ছেই, বাড়ছেই। যত বাড়ছে, নিজের ওপর বাপীর ততো দখল কমছে

…রাত সাড়ে আটটায় কে তাকে ঘরে টেনে এনেছে। হাতের ধাক্কায় নড়বড়ে দরজা দুটো আর্তনাদ করে উঠেছে। এখন ওর কাছে পাশের ঘরের ওই একজন ক্ষমার পাত্রী নয়, দয়ার পাত্রী নয়। কোনো মেয়েই নয়। আগের রাতের তিমির তৃষ্ণার অনুভূতি হাড়ে-পাঁজরে যন্ত্রণার বাষ্প ছড়াচ্ছে।

….ছোট লণ্ঠন হাতে ঢুকেছিল রতন বনিক। খোশ মেজাজ। টেনে টেনে বলেছিল, ক’দিনের মধ্যে আজই একটু তাড়াতাড়ি ফিরলেন দেখছি

সকালে যে মানুষটার কথায় বিবেকের চাবুক পড়েছিল পিঠে, এখন তাকে ঠেলে সরানোর তাগিদ।—খেয়ে এসেছি। খাবার আনার দরকার নেই।

—কেন? আমার বউটার ওপর আপনি রেগেই গেলেন নাকি? অসহিষ্ণু ঝাঁঝে বাপী বলেছে, কি বাজে বকছ!

—ঠিক আছে, আপনার যেমন সুবিধে।

লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ দুলছিল রতন বনিক। মুখের খুশি কাঁচা—পাকা দাড়ি বেয়ে ছুঁয়ে পড়ছিল। মাছের মতো চোখ। চার হাত দূর থেকেও চেনা গন্ধ বাপীর নাকে আসছিল। মাত্রার ঠিক ছিল না। বোঝা যায়। কিন্তু ওর ঢলো—ঢলো কথা শুনে বিরক্তির বদলে বাপীর দু’কান সজাগ।

বউটার মতিগতি আজ বদলেছে বিপুলবাবু—বুঝলেন। বোতল নিয়ে আজ আর এ-ঘরে আসতে হল না, ঘরে বসেই খেতে দিলে। আর তোয়াজ করে সেই সঙ্গে এটা-সেটা ভেজে খাওয়ালে। ফুর্তির চোটে একটা গোটা বোতল সাবড়ে দিলাম দেখেও রাগ করল না। শব্দ করে রতন বিশাল হাই তুলল একটা।— আপনার খাওয়ার পাট নেই যখন, যাই শুয়ে পড়িগে—

দুলতে দুলতে চলে গেল। লণ্ঠনটা রেখে যেতেও ভুলেছে।

দুর্বার লোভের দু’ চোখ কতখানি চকচক করে উঠেছিল, বাপী খবর রাখে না। কিন্তু অনুমান করতে পারে। রতনের কথাগুলো শেষ হতে না হতে বুঝেছিল, এই

রাতেও কমলা আসবে।

…এসেছিল।

তার পরের রাতেও।

একই আধারে ওই অবুঝ লুব্ধ জানোয়ার আর মানুষ পাশাপাশি বাস করে কেমন করে। নগ্ন উল্লাসে জানোয়ারটা যখন নখ-দাঁত বার করে, মানুষটার তখন অস্তিত্ব নেই। আবার লজ্জায় ক্ষোভে নিদারুণ ধিক্কারে মানুষ যখন যন্ত্রণার মাটিতে ঘষে ঘষে নিজেকেই রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে, ওই শয়তান তখন নিখোঁজ বাপী তরফদার এমন দুটো দুর্বার সত্তা আর কত বইতে পারে?

রাতে ঘুম হয়নি। সকালের মধ্যে মনস্থির। ভালো করে ভোর হবার আগে সকলের অগোচরে এখান থেকে নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়ার দুর্বল ইচ্ছেটা বাতিল করেছে। অন্য সব বাসিন্দাদের মনে খটকা লাগতে পারে, সংশয়ের আঁচড় পড়তে পারে। রতন বনিকের সেটা প্ৰাপ্য নয়।

আজও সকালে রতনই চা-রুটি নিয়ে হাজির। বাপী ওইটুকু ঘরেই পায়চারি করছিল। আসা মাত্র বলল, আমি আজ চলে যাচ্ছি রতন।

শুনে রতন বনিক একেবারে হাঁ। যাবার কথা বিপুলবাবু মাঝেসাঝে বলে বটে, কিন্তু কাজকর্মের সুরাহা হবার আগে সত্যি যাবে ভাবেনি। তাই ধাক্কাই খেল।— আজই যাবেন!…আমাদের ওপর রাগ করেছেন?

সামান্য কথায়ও বুকের তলায় মোচড় পড়ে। বাপী মাথা নাড়ল। বলল, তোমাদের ঋণের কথা ভুলব না, তোমার মতো ভালোমানুষও আমি কম দেখেছি রতন।

রতন বনিক নিশ্চিন্ত, খুশিও।—কি যে বলেন, আপনি ছিলেন, আমাদের কত ভাগ্যি।…আজই যাবেন কেন, কাজটাজের কিছু খবর পেয়েছেন?

—দেশে যাব, সেখানে একটু তদ্বির-তদারক করতে পারলে চা-বাগানের কাজ কিছু পেয়ে যেতে পারি। বাপী ভেবে বলেনি, কিছু বলা দরকার তাই বলেছে। আসলে বাপী কোথায় যাবে সে ফয়সালাও নিজের সঙ্গে তখন পর্যন্ত হয়নি। এখান থেকে নড়বে এটুকুই স্থির।

রতন বনিক চেয়ে রইল একটু। বলল, কাজ পেতে পারেন না—পেয়ে যাবেন। ক’দিন আগে যা দেখেছিলাম, তার থেকে আপনার কপালের রং অনেকটা ভালো হয়ে গেছে। আমর কথা মিলিয়ে নেবেন, দিন ফিরলে ভুলবেন না যেন। বউটাকে বলি, ভালো কিছু রাঁধুক আজ, আমি না-হয় এ-বেলা হাফ-ডে ছুটি নিয়ে ও-বেলা আপিস যাব।

বাপী ব্যস্ত হয়ে উঠল, না-না, তার কিছু দরকার নেই, আমি ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে বেরিয়ে পড়ব, সকালের দিকে গাড়ি। মুখে হাসি টানার চেষ্টা, খাওয়ার জন্য ব্যস্ত কেন, কম খেলাম নাকি এ পর্যন্ত!

—তাহলে ভালো করে একটু জলটল খেয়ে নিন, আমি চট্ করে দোকান থেকে ঘুরে আসছি।

দু’ঘণ্টার আগেই বাপী বেরিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত। চলে যাচ্ছে শুনে এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকে দেখা করে গেল। রতন তাদের বলেই ফেলেছে, চা-বাগানের মস্ত একটা কাজের খবর পেয়ে বিপুলবাবু চলে যাচ্ছেন। রতন ট্যাক্সি ডাকতে গেল। খুপরি ঘরে বাপী একা নিস্পন্দের মতো দাঁড়িয়ে। ও-ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার কি বলে আসবে, আমি চলে যাচ্ছি?

কমলা নিজেই এলো। দরজা দুটো খোলা। আজ এক পাটও বন্ধ করল না। বাইরে থেকে সরাসরি চোখে না পড়ে সেই ভাবে দেওয়ালের দিক ঘেঁষে দাঁড়াল।

কিন্তু কমলার এই মুখ দেখবে বাপীর কল্পনারও মধ্যেও ছিল না। গত তিন রাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে লোলুপ সান্নিধ্যের উদ্‌ভ্রান্ত মুহূর্তেও তার মুখ দেখতে পায়নি। নিঃশব্দে এসেছে। নিঃশব্দে চলে গেছে। একটি কথাও বলেনি। আজ ওকে দেখে বাপীরই বিস্ময়। কমলার এমন ঢলঢলে প্রশান্ত কমনীয় শামলা মুখ আর কি কখনো দেখেছে? সংকোচের লেশ নেই, অনুতাপের চিহ্ন নেই, বিবেকের তাড়নার এতটুকু ছায়ামাত্র নেই। মুখের দিকে চেয়ে রইল একটু, বলল, তুমি চলে যাবে জানতাম, আজই যাবে ভাবিনি…ভালই হল।

বাপীর খুব ইচ্ছে জিগ্যেস করে, কেন ভালো হল। মুখে কথা সরল না। নির্বাক দু’ চোখ ওর মুখের ওপর।

কমলাও দেখছে। বলল, এর পর তুমি কেবল আমাকে ঘেন্নাই করবে জানি। কিন্তু আমি হয়তো তোমাকে পুজো করেই যাব, আর ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব

যেন তোমাকে ভালো রাখে।

ভিতরে ভিতরে বাপী হঠাৎ বড় রকমের নাড়াচাড়া খেল একটা।…ওর জন্যে, ওর ভালোর জন্যে দু’ চোখে এত মায়া বাপী আর কার দেখেছে? মনে পড়ছে কার দেখেছে। বানারজুলির পিসিমার দেখেছে। আর সেই মুহূর্তে সত্তার নাড়িতে টান পড়েছে একটা। পিসিমা নেই। বানারজুলি আছে. মা কাকে বলে বাপী জানে না। মায়ের মতো করে বানারজুলি তাকে ডাকছে। অনেক ডেকেছে। বাপী শোনেনি। এখন আবার ডাকছে।

বাপী চলেছে।

.

জলপাইগুড়িতে এবারে আর দু’ ঘণ্টাও ভালো লাগল না। যাঁর টানে এসেছিল তিনি নেই। ড্রইং-মাস্টার ললিত ভড়। তাঁর ঘরে সেই মরচে-ধরা তালা ঝুলছে এখনো। চারদিক আগাছায় ভরে গেছে, দু’ঘরের পিছনেরটা পড়ো-পড়ো। বুকের তলায় কারো জন্য এখনো যে একটু দরদের জায়গা আছে বাপী জানত না। এখন টের পাচ্ছে। ভিতরটা টনটন করছে। সপরিবারে একটা মানুষ একেবারে হারিয়েই গেল।

জলপাইগুড়ি থেকে বানারহাট পর্যন্ত টানা বাস ছিল। সেখানে এসে শুনল আরো একটু সুব্যবস্থা হয়েছে। বানারহাট থেকে বাস সার্ভিস চালু হয়েছে বানারজুলির চা-বাগানের কল পর্যন্ত।

আসতে আসতে বাপী ভাবছিল, তার ঘরদোরেরই বা কি অবস্থা কে জানে। ভেঙে পড়ার কথা অবশ্য নয়। আবু রব্বানী থাকলে বে-দখল হবার সম্ভাবনাও কম। কিন্তু যে মেজাজের মানুষ ও, এখনো বীটম্যানের কাজ নিয়ে পড়ে আছে কিনা কে জানে। থাকলেও বাড়ি খালি পড়ে আছে কি ভাড়াটে বসানো হয়েছে জানে না। বাবা মারা যাবার পরে চলে আসার সময় আবুকে বাড়িটা বেচে দিতেই বলে এসেছিল। আবু রাজি না হওয়াতে ভাড়াটে দেখতে বলেছিল। দেড়ঘরের কাঠের বাড়ির পাঁচ-সাত টাকা যা ভাড়া—জোটে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে বাপী নিজে একটা চিঠি লিখেও খবর নেয়নি। এর মধ্যে কত কাণ্ড। যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয়েছে। দেশ দু-খণ্ড হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে। এই তোড়ে তার দেড়ঘরের বসতবাড়ির অদৃষ্ট চোখে না দেখা পর্যন্ত ভরসা করার কিছু নেই।

চা-কলের সামনে বাস এসে দাঁড়ানোর আগেই বাপী ভাবনাচিন্তা ভুলে গেল। সেই বানারজুলি। আকাশের গা ঘেঁষা সেই পাহাড়ের সারি। তার গায়ে থাক-থাক পেঁজা তুলোর মতো সাদাটে মেঘ।…ওই বানারজুলির জঙ্গল। দিনটা ঠিক মেঘলা নয় আজ। কিন্তু জঙ্গলের দিকটা মেঘলা দিনের মতোই লাগছে।

…ওই মাথা-উঁচু শাল শিশু অর্জুন জারুল দেবদারু ইউক্যালিপটাস গাছগুলো যেন সেই আগের মতো বাপী নামে এক দুরন্ত ছেলের পা ফেলার অপেক্ষায় ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। বাসের মাথা থেকে টিনের সুটকেস আর বাঁধা বিছানা নামানো হতেই বাপীর ছোটার তাড়া। কিন্তু বাক্সবিছানা নিজে বয়ে নিয়ে যাবার মতো এখন আর অত হাল্কা নয়। জিনিস তো কিছু বেড়েইছে।

পয়সা কবুল করে একটা লোক জোটানো গেল। তারপর জুতোর তলা দিয়েও পায়ে সেই পরিচিত পথের স্পর্শ। এদিকের চা-বাগনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সেই পুরনো দৃশ্য চোখে পড়ল। নানা বয়সের নানা রংয়ের মেয়েরা আড়াই-পাতি তুলছে আর কোমরের সঙ্গে বাঁধা বেতের ঝুড়িতে ফেলছে। বাপী একটু না দাঁড়িয়ে পারল না। হঠাৎ দেখলে মনে হবে কিছুই বদলায়নি, জীবনের স্রোত সেই একভাবেই চলছে।

বদলেছে শুধু বাপী নিজে। আগের মতো ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ওরা আর সেরকম করে হাসবে না, রঙ্গকৌতুক উছলে উঠবে না। ওরা মতলব দেখবে, লোভের ছোবল ভাববে। অথচ সেই চৌদ্দ-পনের বছর বয়সে যেমন ছিল সেই মুহূর্তে অন্তত সেটুকু লোভেরও ছিটেফোঁটা নেই।

চা-বাগানের সাহেববাংলো কটা পার হবার সঙ্গে সঙ্গে বাপীর উৎসুক দু চোখ আর একদিকে ছুটল। রাস্তার ঢালের ওধারে শালগুঁড়ির দিকে। তারপর সেই ছেলেবেলার মতোই ছুটে যেতে ইচ্ছে করল।

বনমায়ার একটা পা শালগুঁড়ির সঙ্গে শেকলে বাঁধা। সামনে ডালপালা ছড়ানো। বনমায়ার খাবার তাড়া খুব নেই। বেছে একটা দুটো তুলে মুখে দিচ্ছে। সঙ্গের লোকটাকে দাঁড়াতে বলে বাপী নেমে গেল। শালের ছায়ায় বছর আঠারো—উনিশের একটা ছেলে মাটিতে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।

বাপী আট-দশ হাতের মধ্যে এসে দাঁড়াল। এবারে হাতিটা দেখল ওকে। পেল্লায় শরীরের ক্ষুদে চোখ দুটো স্থির খানিক। তারপরেই বিশাল দেহে আনন্দে তরঙ্গ তুলে শুঁড়ে উঁচিয়ে মস্ত সেলাম। গলা দিয়ে আনন্দের টানা ঘড়ঘড় শব্দে গাছতলায় ছোকরার ঘুম ভেঙে গেল।

বাপীর গলার কাছে আনন্দের ডেলা আটকেছে একটা। আর চোখের দু কোণ শিরশির করছে। এগিয়ে যেতে বনমায়া ওকে শুঁড়ে দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে সোহাগ জানালো। যেন বলতে চায়, এতদিন কোথায় ছিলে, কত খুঁজেছি তোমাকে। ছেড়ে দিতে বাপী ওর শুঁড়ে হাত বুলিয়ে আদর করল খানিকক্ষণ। বলল, ছ বছর বাদে দেখেও তুই আমাকে ঠিক চিনে ফেললি! কি করে চিনলি? একবার চিনে রাখলে তোরা আর ভুলিস না?

গাছতলার ছেলেটা মুখ উঁচিয়ে এই আদরের মাখামাখি দেখছিল। ভূমিশয্যা ছেড়ে অবাক মুখে উঠে এলো। বাপী দেখেনি। বনমায়ার নাকেমুখে এবার ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনে ঘুরে তাকালো। মনে হল, এই ছেলেটাকে বনমায়া তেমন পছন্দ করে না।

বাপীর পরনে পরিষ্কার পাজামা-পাঞ্জাবি। এই এখন সর্বদার পোশাক। কিন্তু বনমায়ার হাবভাব দেখে হোক বা যে কারণেই হোক ছেলেটা হয়তো বিশেষ কেউ ভেবে বসল ওকে। ফিরে তাকাতে সসম্ভ্রমে সেলাম ঠুকল।

—তুমি কে?

—জী লছমন…

—ওর মাহুত ভীমবাহাদুর কোথায়?

লছমন সবিনয়ে জানালো, ভীম বাহাদুর চার বছর আগে এ-জায়গা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এখন ও-ই বনমায়ার মাহুত।

বাপী তক্ষুনি বুঝে নিলে এই পালানোর সঙ্গে ওর সেই ভালবাসার মেয়ের কিছু যোগ আছে। কিন্তু চাকরি ছেড়ে বনমায়াকে ছেড়ে একেবারে পালানোর দরকার হল কেন বোঝা গেল না। যতদূর মনে পড়ে, আবুর মুখে শুনেছিল ভীমবাহাদুর পণের টাকা জমাচ্ছে। যে মেয়েকে চায় তাকে পেতে হলে তার বাপকে পণের টাকা গুনে দিতে হরে।

কথার ফাঁকে বাপী বনমায়ার শুঁড়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। বনমায়ার হঠাৎ ফোঁস-ফোঁসানি তাইতে থেমেছে ছেলেটা তাও লক্ষ্য করল। একটু আগ্রহ নিয়ে বলল, আপনাকে হুজুর এই গোঁয়ার হাতিটা খুব ভালবাসে দেখছি।

এক প্রেমিকের সঙ্গে পালানো ছাড়া বনমায়া গোঁয়ার এমন অপবাদ বাপীর কানে এই প্রথম। জিজ্ঞেস করল, কেন, তোমাকে ভালবাসে না?

লছমনের মুখখানা বিষ একটু। মাথা নেড়ে জানালো, ভালবাসে না। তারপর ওর কথা থেকে সমস্যা বোঝা গেল। ভীমবাহাদুর চলে যাবার পর চার বছরে একে একে পাঁচজন মাহুত বনমায়ার কাজে লেগেছে। ও ছ নম্বর। গোড়ায় তিন—তিনটে মাহুতকে এই জিদ্দী হাতি কাছেই ঘেঁষতে দেয়নি। কাছে গেলে তেড়ে এসেছে। টানা দুটো বছর ওকে দিয়ে জঙ্গলের কাজ হয়নি। পরের দুটো মাহুতও খুব সুবিধে করতে পারেনি। এখন অবশ্য আগের তুলনায় অনেক ঠাণ্ডা, কিন্তু এখনো রাগে ফোঁস ফোঁস করে, আর মাঝে মাঝে ক্ষেপে যায়! ক’দিন বেশ ঠাণ্ডা ছিল, আজ আবার মতিগতি সুবিধের নয়।

বাপীর ধারণা, ওকে দেখে বনমায়ার ভীমবাহাদুরকে আজ বেশি মনে পড়ছে। তাই রাগ। জিজ্ঞেস কর, ও ফি বছর একবার করে পালাতো—এখনো পালায়? লছমনের হাসি-হাসি মুখ। জবাব দিল, সে-বেলায় ঠিক আছে। কোনো বছর বাদ যায় না। আবার ফিরেও আসে। পালালে সাহেবরা এখন আর রাগটাগ করে না, জানে ফিরে আসবে। কেবল যতদিন না আসে আমার হয়রানি। আমি কাজ নেবার তিন সপ্তাহের মধ্যেই পালিয়েছিল।

বাপী ভেবে পেল না, এই মেজাজ যখন, বনমায়া পালিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে কেন? হয়তো ভীমবাহাদুরের টানে আসে। ভাবে ফিরে এসে ওকে দেখতে পাবে। হয়তো বা সভ্যভব্য হাতি জংলি দোসরের সঙ্গ খুব বেশিদিন বরদাস্ত করতে পারে না। আবুর একটা কথা মনে পড়তে বনমায়াকে আর একবার ভালো করে দেখে নিল।…সেবার ফিরে আসার পর বনমায়াকে একটা বড়সড় আদরের চাপড় মেরে আবু বলেছিল, তিন বছর ধরে পালিয়ে গিয়ে রস করে আসছিস—বাচ্চা-কাচ্চা হবার নাম নেই কেন? তোর মরদটাকে ধরে এনে ডাক্তার দেখা।

বাচ্চা আজও হয়নি বোধ হয়। হলে দেখতেই পেত। লছমনকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি আবু রব্বানীকে চেনো?

সঙ্গে সঙ্গে ও ঘাড় হেলিয়ে জানালো, খুব চেনে। আঙুল তুলে জঙ্গলের দূরের দিকটা দেখিয়ে দিল। ওই জঙ্গলে থাকে।

আবু এখানেই আছে জেনে বাপী নিশ্চিন্ত একটু। তারপরেই মনে হল সঙ্গের মাল নিয়ে সোজা নিজের ডেরায় গিয়ে কি লাভ। খালি আছে কিনা ঠিক নেই, আর খালি যদি থাকেও, ও আসবে বলে কি কেউ ঘরদোর খুলে বসে আছে? আবুর সঙ্গেই আগে দেখা হওয়া দরকার।

লছমন এতক্ষণে ভরসা করে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে হুজুর?

বাপী হেসেই জবাব দিল, আমি তোমাদের হুজুর-টুজুর কেউ নই। এখানেই জন্মেছি এখানেই বড় হয়েছি। পাঁচ-ছটা বছর এখানে ছিলাম না—

কোনো ভদ্রলোক এভাবে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে সদালাপ করে না হয়তো। খুশি—মুখ দেখল। সেই সঙ্গে হঠাৎ কিছু প্রত্যাশাও যেন।—আমার একটু উপকার করবেন বাবু?

বাপী অবাক!—আমি আবার তোমার কি উপকার করতে পারি?

গলায় আব্দারের জোর ঢেলে লছমন বলল, আপনি একটু চেষ্টা করলেই পারবেন বাবু—ওই জেদী হাতি আপনাকে কত ভালবাসে স্বচক্ষে দেখলাম। এক ভীমবাহাদুরকে এ-রকম ভালবাসত শুনেছি। আপনি একটু চেষ্টা করলে ও আমাকেও ঠিক পছন্দ করবে—ওরা যাকে ভালবাসে তাদের কথা শোনে, বোঝে ওকে দিয়ে এখনো জঙ্গলের কাজ ভালো করে করাতে পারি না, না পারলে সাহেবরা বা ঠিকাদার খুশি থাকে না। এরকম হলে আগের মাহুতদের মতো আমারও কাজ যাবে—

এমন উপকারের বায়না বাপী আর শোনেনি। হড়হড় করে এতগুলো কথা বলার পর ছেলেটার কালো মুখ প্রত্যাশায় জ্বলজ্বল করছে। বাপীর হাসি পাচ্ছে। বানারজুলিতে পা দিয়েই একটা কাজের মতো কাজ পেল বটে।

—আবু রব্বানীকে বলোনি কেন, ওকেও তো বনমায়া ভালবাসে।

এবারে লছমনের মুখ দেখে মনে হল প্রায় অসম্ভব প্রস্তাব কিছু। বলল, সে তো এখন মস্ত লোক বাবু, অনেককে টপকে জঙ্গলের হেড বীটম্যান হয়েছে, বন্দুক নিয়ে ঘোরে, বড়সাহেব তাকে পছন্দ করে—তার কাছেই তো যেতে সাহস হয় না। কখনো দেখা হয়ে গেলে বনমায়াকে একটু আদর করে, আর আমাকে বলে, ভালো সেবা-যত্ন করে ওকে বশ কর, নইলে তোরও সময় ঘনালো বলে। না বাবু, তাকে দিয়ে হবে না, আপনি চেষ্টা করলেই হবে—আপনাকে ও আবুর থেকেও বেশি ভালবাসে স্বচক্ষে দেখলাম।

…আবু রব্বানী তাহলে এখন হেড বীটম্যান আর মস্ত লোক। একটা বন্দুক বাগাতে পারেনি বলে নিজের বাপকে অকর্মণ্য ভাবত, তাও মনে আছে। কি ভেবে নিয়ে রাস্তার বাক্সবিছানা মাথায় লোকটাকে ডাকল। অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। লছমনকে বলল, আমার এই জিনিসগুলো তোমার জিম্মায় রাখো, আমি একটু ঘুরে আসছি। আবু রব্বানীর ওখানেই যাব—

সভয়ে লছমন বাবু থেকে আবার হুজুরে উঠে এলো তক্ষুনি।—আমার কথা যেন কিছু বলবেন না হুজুর!

বাপী হেসেই আশ্বাস দিল, তোমার কিছু ভয় নেই, বনমায়া যাতে তোমাকে পছন্দ করে আমি নিজেই সে-চেষ্টা করব। বনমায়ার শুঁড় চাপড়ে দিল, লছমনকে ভোগাচ্ছিস কেন, অ্যাঁ?

লোকটার পয়সা মিটিয়ে আবার রাস্তায় উঠে এলো। যত এগোচ্ছে চোয়াল দুটো এঁটে বসছে। ধমনীতে রক্তের স্রোত বদলাচ্ছে। আর খানিক এগোলেই সেই বাংলো। বানারজুলি জঙ্গলের বড় সাহেবের বাংলো।

এলো। রাস্তা ছেড়ে সেই ধারের গাছটার সামনে দাঁড়াল। যে গাছের নিচু ডালে বসে মিষ্টিকে নানা কৌশলে ওই বাংলো থেকে টেনে আনত। বাইরের কাঠের বারান্দায় মাঝবয়সী একজন আয়া গোছের কেউ বসে।

আট সাড়ে আট বছর আগে ওই বারান্দায় এই শরীরটা বাবার চাবুকে লুটোপুটি খেয়েছিল। গায়ের চামড়া ফেটে ফেটে যাচ্ছিল। ঠোঁট ফেটে কেটে মুখ রক্তে ভরে গেছল।…ওই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মিষ্টি দেখছিল। আর এই সেদিন বিকেলে লেকের ধারে ভিতরটা যখন তার থেকেও বেশি ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছিল…মিষ্টি দেখছিল।

কিন্তু আশ্চর্য! বাপীর চোয়াল দুটো আরো এঁটে বসছে, একটা ক্ষমাশূন্য অভিলাষ ভিতরে দাপাদাপি করছে, অথচ প্রতিশোধের সেই সাদা আগুন এই মুহূর্তে ঠিক তেমন করে জ্বলছে না।…কেন? নিজে ভ্রষ্ট হবার ফল? অপরাধ—চেতনা?

বাপী সামনের ওই বাংলোর দিকে চেয়ে আছে বটে, কিন্তু দেখছে নিজেকে। আরো কিছু দেখার আছে যেন, বোঝার আছে। সব প্রত্যাশার বুকে ছুরি বসানো আচমকা অপমানের আঘাতে আর আত্মঘাতী ক্রোধে আর নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে প্রবৃত্তির ক্রূর উল্লাসে সেই আরো-কিছু-দেখা বা বোঝার ব্যাপারটা দূরে সরে গেছল। বাপীর ভেতর-বার এই মুহূর্তে আবার অদ্ভুত ঠাণ্ডা। এখানে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বনের হাতি বনমায়া সেই ঠাণ্ডা প্রলেপ বুলিয়ে দিয়েছে।

…পুরনো দিনের অন্তরঙ্গ সঙ্গীকে বনের পশুও ভোলে না। মানুষ ভোলে?…মিষ্টি কি একেবারে ভুলতে পেরেছিল? স্লিপ পাঠানোর তিন-চার মিনিটের মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসেছিল, তার দু’চোখে বিস্ময় আর আগ্রহের বন্যা দেখেছিল—সে কি মিথ্যে।…সেই সন্ধ্যায় চলে যাবার আগে ওর জুলুমে পড়ে অমন করে মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি কি দেখছিল? শুধু দেখছিল, না নিজের সঙ্গে যুঝছিল? তারপর ভব্যভাবে বাপীকে অকরুণ কিছু বুঝিয়ে দেবার জন্যে একই সঙ্গে ওই সোনালী চশমাকেও লেকে ডেকেছিল বটে। আট বছরের ফারাকে কেউ যদি তার মন কেড়েই থাকে, ছেলেবেলার সাথীকে দেখামাত্র তাকে নাকচ করে দেবে এমন আশা বাতুলে করে। ঠাণ্ডাভাবে এটুকুই হয়তো বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল। পাড়ার ভক্তের দল এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে সে-আঘাত চারগুণ হয়ে বাপীর বুকের ভিতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়েছিল সত্যি কথাই। কিন্তু মিষ্টি যে মূর্তিতে ওদের ধাওয়া করে তাকে আগলেছিল আর সেই মন কাড়া সোনালি চশমার ওপর যে-রকম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল—সেই সত্যটা কি কম কিছু?

…পুরনো লোভ পুরনো আশা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে আবার। ওই মাখমের দলা সোনার চশমা মিষ্টির জীবনের দোসর হতে পারে না। মিষ্টি বাপীর জগৎ থেকে একেবারে মুছে যাবে এমন হতে পারে না। দুনিয়া যত বড়ই হোক, আবার যোগাযোগ হবে, আবার কিছু ঘটবে। ঘটতে বাধ্য। যা ঘটেছে সেটা এখনো শেষ নয়, শেষ কথা নয়।

কিন্তু এই উদ্দীপনার পিছনে বিষাদের ছায়া দুলছে। সত্তার দুর্বার জোরের অনেকখানি কলকাতার সেই টালি এলাকায় খুইয়ে এসেছে। দোষ কমলা বনিকের কি নিজের সেটা কোনো সান্ত্বনা নয়।

অসহিষ্ণু তাড়নায় চিন্তাটা বাতিল করার চেষ্টা বাপীর। এখান থেকেই জঙ্গলে ঢুকত মিষ্টিকে নিয়ে। বাপী নেমে এলো। জঙ্গল তেমনি আছে, শুধু অনেকদিন না দেখার ফলেই হয়তো ঘন লাগছে একটু।

…সব যেন সেদিনের কথা, সেদিনের ব্যাপার। এদিকটায় ওরা রঙিন প্রজাপতি আর কাঠবেড়ালি আর খরগোশের পিছনে ছোটাছুটি করত। বাপী তরফদার দেখছে, দাঁড়াচ্ছে, আবার চলছে।…ওই সেই ছোট গাছটা। বাপী এই ছোট ডালটায় পা ঝুলিয়ে বসেছিল, দু হাতে দুটো হাত ধরে মিষ্টিকে প্রথমে পায়ের ওপর তুলেছিল, তারপর বুকে জাপটে ধরে পাশে বসিয়ে দিয়েছিল। নামার সময় তেমনি বুকে করে নামিয়েছিল—দশ-বারো গজ ওমনি টেনে নিয়ে তবে ছেড়েছিল।

পা দুটো আড়ষ্ট আবার এক জায়গায়। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।…সামনে সেই শিশুগাছ যার মোটা গুঁড়িতে পাকে পাকে জড়িয়ে ছিল সাদা-কালো ছোপের বিশাল ময়াল সাপ, চ্যাপ্টা মুখটা সামনে টান হয়ে মিষ্টির দিকে। ওটার সোঁ-সোঁ নিঃশ্বাসে মিষ্টির সর্বঅঙ্গ অবশ, নড়াচড়ারও ক্ষমতা ছিল না। ওকে দুচোখে আটকে নিয়ে সাপটা আস্তে আস্তে গাছের গুঁড়ি থেকে নিজের শরীরের প্যাঁচ খুলছিল।…বাপীর আচমকা প্রচণ্ড ধাক্কায় মিষ্টির চার-পাঁচ হাত দূরে ছিটকে পড়েছিল। তারপর পাগলের মতোই ছুটেছিল দুজনে।

বাপীর কপালে ঘাম। সংকট যেন সদ্য কেটেছে।…পুরস্কারও পেয়েছিল। মেয়েকে জঙ্গলে টেনে আনার অপরাধে মেমসাহেব সকলের চোখের সামনে বাপীর কান টেনে ছিঁড়তে চেয়েছে, আর গালাগাল করে ঘাড় ধরে বাংলো থেকে নামিয়ে দিয়েছে।

সেই বাপী আজ এই মুহূর্তেও ভাবছে যে-মেয়েকে ধরা-বাঁধা মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে এনেছে, তার ওপর সব দখল কার? শুধু তার ছাড়া আর কার হতে পারে?

পা দুটো আরো এক জায়গায় থেমে গেল। সেখানে সেই শেষ কিছু ঘটেছিল। যার ফলে মুখের গা-ঘুলনো রক্তের স্বাদ জীবনে ভুলবে কিনা জানে না। স্থান—কাল ভাল-মন্দ ভুলে, পরিণামের হিসেব ভুলে উন্মাদ লোভে আর আক্রোশে সেই মেয়েকে এখানে এনে ফেলেছিল আর তার সর্বাঙ্গর নরম মাংস খুবলে নেবার উল্লাসে মেতেছিল। বাপী তরফদারের মুখের রেখা কঠিন। কপালে ভ্রুকুটি। শিরায় শিরায় উষ্ণ তাপ। টালি এলাকার খুপরিঘরে আত্মবিলোপের দাহ বুকে লেগে আছে। কিন্তু এখানকার সেই স্মৃতির কোনো দাহ নেই। অনুতাপ নেই। বরং সেই দখল অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ায় পরিতাপ। ওই একজনের ওপর তার সত্তার অধিকার। কোথা দিয়ে কেমন করে সেই অধিকার এসেছে, চৌদ্দ বছরের বাপী জানত না, আজকের বাপী তরফদারও জানে না। সেই অধিকার নাকচের যন্ত্রণা সেদিনও যেমন, আজও তেমনি।

আবু রব্বানীর ডেরার সামনে এসে বাপীর ধোঁকা লাগল বেশ। খুব ভালো জানা না থাকলে চেনা যেত না এমনি ভোল পাল্টেছে। দুখানা ঘরের পাশে এখন আরো একটা ঘর। সামনে পিছনের অনেকটা জায়গা পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। চারদিকের সবটা জুড়ে শক্তপোক্ত বাঁশের বেড়া। সামনে বাঁশের মজবুত গেট। এদিকে পাহাড়ী ফুলের বাগান।

বনমায়ার ছোকরা মাহুত লছমন সসম্ভ্রমে বলেছিল, আবু রব্বানী মস্ত মানুষ একজন। এখন তার ভেতর কেমন কে জানে। গেট খুলে পায়ে পায়ে ঘরের দিকে এগলো। ঘর থেকে মোটাসোটা তিন-সাড়ে তিন বছরের কালো-কোলো ন্যাঙটা ছেলে ছুটে বেরিয়ে এলো। ওকে দেখে থমকে দাঁড়াল, তারপর হাঁ করে চেয়ে রইল।

ছেলেটা নয়, ভেবাচাকা খেয়ে গেল বাপীই বেশি। শুধু বিয়ে নয়, আবুর এর মধ্যে ছেলেও হয়ে গেছে! এরপর যে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো তাকে দেখে বাপী সত্যি হাঁ। ছটু মিঞার বউ দুলারি। তার কোলে আর একটা আট-ন’মাসের বাচ্চা। কিন্তু দুলারি কেন? রেশমা নয় কেন?

বাড়ির আঙিনায় ঢুকে একটা লোককে সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দুলারি ছেলে কোলে নিয়েই গম্ভীর মুখে আরো খানিকটা এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কাকে চাই বা কি চাই? করা হল না। তামাটে মুখে বিস্ময়ের আঁচড় পড়তে লাগল।

—বাপীভাই না?

অবাক চোখে দুলারির দিকে চেয়ে বাপী মাথা নাড়ল। আগে ওকে কখনো বাপীভাই বলে ডেকেছে মনে পড়ে না। তামাটে রঙে এখন আর অতটা কালচে ভাব নেই। ঢ্যাঙা শরীর এখনো প্রায় আগের মতোই আঁটোসাঁটো। মাথার চুল এলোমেলো, লালচে নয় আগের মতো। বেশ সুবিন্যস্ত আর তেল-চকচকে। মুখের সেই রুক্ষভাব আর নেই, চাউনিও তেমন ধার-ধার নয়।

তবে স্বভাব-গম্ভীর মেয়ের আপ্যায়নে উচ্ছ্বাস বেশি ধরা পড়ে না। এত বছর বাদে ওকে দেখে অখুশি নয় এটুকুই বোঝা গেল।

—বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, দাওয়ায় উঠে এসো। কত বড়টি হয়ে গেছ, অনেক লম্বাও হয়েছ—আমি হঠাৎ চিনতেই পারিনি। কবে এলে?

—আজই। বাপী খানিকটা এগিয়ে এলো বটে, কিন্তু মাটি ছেড়ে দাওয়ায় উঠল না। কোলের বাচ্চাটা আঙুল চুষছে আর কুতকুত করে তাকাচ্ছে। বড়টাও দুলারির গা ঘেঁষে ড্যাবডেবে চোখে ওকে নিরীক্ষণ করছে। জিজ্ঞেস করল, আবু কোথায়?

—খানিক আগে তো তোমার ঘরের দিকেই যাচ্ছে বলে গেল, তুমি ও দিক থেকে আসছ না?

—না। ব্যাপারটা এখনো বোঝার চেষ্টা বাপীর।—ছটু মিঞার খবর কি? সামনের আকাশের দিকে একবার একটু মুখ উঁচিয়ে নির্লিপ্ত গলায় দুলারি জবাব দিল, তার খবর তো ওখানে, সেই যেবারে তুমি শেষ এলে সে-বছরই চলে গেল—

বাপী ভাবল, আর কেউ নেই বলে আবু রেশমার সঙ্গে ওকেও ঘরে এনে রেখেছে। তবু কেন যেন বোকার মতোই জিজ্ঞাসা করল, এরা কার ছেলে?

এত অবাক হতে দেখেই হয়তো তামাটে মুখে হাসি ফুটল একটু—যার কাছে এসেছ তার, আবার কার?

—রেশমা কোথায়?

জবাব দেবার আগে দুলারি এবারে ওকে ভালো করে দেখে নিল একটু। তারও অবাক লাগছে বোধ হয়। সাপ নাচাতো যে মেয়ে সে বাঁকা তাকাতে জানে, বাঁকা কথাও বলতে পারে।—এতকাল বাদে এসেই রেশমার খোঁজ কেন—সে তার ঘরেই হবে।

বাপী এখনো কি শুনছে কি বুঝছে ঠিক নেই।…রেশমা তার ঘরে আর দুলারি আবুর ঘরে! হঠাৎই রহস্যের পর্দাটা উঠে গেল। কিন্তু সে-ও তো বিস্ময়ে হাবুডুবু খাবার মতোই ব্যাপার!

বিড়ম্বনার ধকল সামনে বলল, আচ্ছা এখন যাই, আবুকে ধরতে পারি কিনা দেখি। পরে আবার আসব—

তড়িঘড়ি পা চালিয়ে একেবারে আঙিনার বাইরে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নিজের ঘরের পথ ধরেও মাথায় এই বিস্ময়টুকুই ঘুরপাক খাচ্ছে। সাপ খেলানোর ব্যাপারে দুলারি রেশমার থেকেও ঢের বেশি চৌকস ছিল বটে। হতেই পারে, ঘরের লোকের কাছ থেকে সরাসরি শিখেছে। রুক্ষ মুখে পেটমোটা বাঁশি লাগিয়ে গাল ফুলিয়ে হেলেদুলে সাপের ফণার সঙ্গে তালে তালে ঝোঁক মিলিয়ে সাপ খেলানোর দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুলারি এ কি খেলা দেখালো!

আরো একটু ধাক্কা বাকি ছিল বাপীর।

নিজের বাড়ির সামনে এসেও হাঁ। এরও ভোল বদলে গেছে। ছোট-বড় দুখানা ঘরের পাশের খালি জমিতে লাগোয়া আর একটা বড় ঘর গজিয়েছে। কাঠের বাড়িতে আগে রঙের বালাই ছিল না, এখন ওটার সর্বাঙ্গে রঙের জেল্লা। হালে সংস্কারও করা হয়েছে সন্দেহ নেই। তকতকে ছোট্ট বাংলোর মতো দেখাচ্ছে। সামনের চিলতে বারান্দায় বেতের চেয়ার বেতের টেবিল। ধপধপে সাদা টেবিল-ক্লথ।

আবু রব্বানী সত্যি কি-রকম মস্ত মানুষ হয়েছে বাপী ভেবে পেল না। সামনের দরজা খোলা দেখে ভাবল আবু ভিতরেই আছে।

পায়ে পায়ে উঠে এলো। তারপর খোলা দরজার ভিতরের দিকে এক পা ফেলে মুখ বাড়াতেই বিষম চমক।

—হু ইজ্ ইট! হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?

মহিলা কণ্ঠের ঝাপটা খেয়ে দু’ পা পিছনে ছিটকে এলো বাপী। সঙ্গে সঙ্গে উগ্রমূর্তি মহিলাটিও বাইরে। বাঙালীর মতোই শাড়ি পরা, কিন্তু এক নজরেই বোঝা যায় বাঙালী নয়। নেপালী। চল্লিশ-বিয়াল্লিশের মধ্যে বয়েস। ফর্সা মুখে লালিত্য কম। এই মুহূর্তে অন্তত উগ্রমূর্তি, রুষ্ট চাউনি। তার পিছনে বছর উনিশের একটি মেয়ে। কমনীয় মুখ, হৃষ্টপুষ্ট সুডৌল চেহারা। পরনে রঙিন ঘাগরা, গায়ে লম্বাটে সাদা ব্লাউস।

বাপীর অমন বিমূঢ় মুখখানা দেখেও মহিলা সদয় নয়। তেমনি রুক্ষ স্বরে আবার জিজ্ঞাসা করল, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?

বাপীর গলা দিয়ে শুধু বেরুলো, আবু রব্বানী…

ওর আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে নেপালী মহিলা এবারও একটু কড়া গলায় কিন্তু পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, আবু রব্বানীর খোঁজে এসে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন কেন? কি দরকার তাকে?

পিছনের সুদর্শনাটি মহিলার মেয়েই হবে হয়তো। দুর্দশা দেখছে। বাপী নিজেকে অথৈ জল থেকে টেনে তুলল এবার। মোলায়েম করেই বলল, দরকার কিছু না…। এতকাল আমি জানতাম এটা আমারই বাড়ী…বছর কয়েক ছিলুম না এখানে, দরজা খোলা দেখে ভিতরে আবু আছে ভেবে ঢুকতে যাচ্ছিলাম।

এমন জবাব আশা করেনি বোঝা গেল। মহিলার গোল চোখ আর একটু গোল হতে দেখা গেল। মেয়ের চাউনিও বদলেছে।

এর পরেও মচকাবার পাত্রী নয় মহিলা। গলার ঝাঁঝ একটু কমল শুধু। কি নাম আপনার?

—বাপী তরফদার।

ভুরু কুঁচকে কিছু স্মরণ করার চেষ্টা। স্মরণ হল কিনা বোঝা গেল না। তারপর সাফ কথা—আবু রব্বানী খানিক আগে এসেছিল, চলে গেছে। আপনার কিছু জানার বা বোঝার থাকে তো তার সঙ্গে দেখা করুন।

কথা শেষ হবার আগেই ঘরে চলে গেল। বাপী এবারে কয়েক পলক মেয়েটার মুখোমুখি। ভিতর থেকে আবার একটা তাড়া খাওয়ার সম্ভাবনা মনে আসতেই বাপী তাড়াতাড়ি নেমে এলো।

বিশ-বাইশ গজ দূরে এসে সন্তর্পণে ফিরে তাকালো একবার। মেয়েটা দাঁড়িয়েই আছে আর তাকিয়েই আছে। যার ঘর-বাড়ি তারই এমন হেনস্থার প্রহসনটা বেজায় উপভোগ্য যেন।

অগত্যা সামনের সোজা রাস্তা ধরে বাপীর দ্রুত প্রস্থান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *