ছয়
মিষ্টি হাসছে, বাপী তরফদারও।
মিষ্টি বলল, সেই দস্যি তুমি আজও আমার পিছনে লেগে আছ কি করে বুঝব। আর আমি চিনবই বা কি করে, মাঝের আটটা বছর কি কম নাকি!
বাপী বলল, আমি তো গণৎকারের ওখানে তোমাকে দেখেই চিনেছিলাম। মিষ্টি যেমন খুশি তেমনি অবাক।—কি করে চিনলে বলো তো! দশ বছরে যা ছিলাম, এই আঠেরো বছরেও কি তেমনি আছি নাকি আমি!…তখন তো ফ্ৰক পরতাম।
বাপী হাসছে। কিন্তু সত্যি কথাটা বলছে না।…বানারজুলির দশ বছরে সেই ফ্রক—পরা মিষ্টি আর কলকাতার এই আঠেরো বছরের শাড়ি-পরা আর কলেজেপড়া মিষ্টি এক নয়। একরকমও নয়। বানারজুলির ফ্রক-পরা মিষ্টির একমাথা ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল, লালচে ফোলা-ফোলা গাল, বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর বিস্ময়মাখা দুটো কালো চোখ। ধরে চিবুতে ইচ্ছে করত, দুটো ফর্সা কচি কচি হাত আর আঙুল, গায়ে মিষ্টি—মিষ্টি গন্ধ। আটটা বছর জুড়লে সেই মিষ্টি এই মিষ্টি হয়, এ বাপী কল্পনাও করতে পারত না। মাথায় বড় খোঁপা। ফর্সা রঙে মেটে ছোপ ধরেছে। ফোলা গাল আর মুখের আদুরে ভাব গিয়ে অন্য ছাঁদ নিয়েছে। চোখের গোল ভাবটা পর্যন্ত এখন আয়ত-গভীর, তাতে বুদ্ধির ছোপ, কৌতুকেরও।…বেশি লম্বাও নয়, বেঁটেও নয়, মোটাও নয় আবার রোগাও নয়—পা থেকে মাথা পর্যন্ত ও যেন এখন কারো বেশ হিসেবের তৈরি। হিসেবের বাইরে যেটুকু সেটুকু আরো বেশি লোভনীয় বলেই শাড়ির আড়ালে বেশ করে আগলে রাখার চেষ্টা। তবু সর্ব অঙ্গে তার উঁকি ঝুঁকির কামাই নেই।…না, এই মিষ্টি পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে বাপী হয়তো দাঁড়িয়ে যেত, দেখত। কিন্তু চিনতে পারত না। জ্যোতিষীর ঘরে ওর মাকে দেখে পলকে চিনেছিল। মাকে চেনার ফলে মেয়েকে চিনেছে।
কিন্তু এখন আর বুকের তলায় এতদিনের সেই ভীষণ যন্ত্রণাটা নেই। সেই ভয়ংকর আক্রোশও নেই। গোপন সুড়ঙ্গপথের সেই জানোয়ারটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। অনেক—অনেক যুদ্ধ অনেক ক্লান্তির পরে ও যেন তার লক্ষ্যে এসে পৌঁছেছে। আর তার কোনো খেদ নেই, কোনো ক্ষোভ নেই। এই মিষ্টি এখন তার মিষ্টি-মিষ্টি হাতখানা যদি মাথা রাখে, যদি একটু হাত বুলিয়ে দেয়, পরম শান্তিতে বাপী তাহলে এখন ঘুমিয়েও পড়তে পারে।
রাগ বা ক্ষোভ না থাকুক, একটু অভিমানের কথা বলতে ইচ্ছে করছে তবু। বলল, এই আট বছরে আমি তোমাকে একটা দিনের জন্যেও ভুলিনি, কিন্তু তুমি দিব্যি ভুলে গেছলে—
মিষ্টির ঠোঁটে দুষ্টু দুষ্টু হাসি, আবার চোখের কোণে প্রতিবাদের হাল্কা কোপও একটু। জবাব দিল, এমনিতে ভুলে গেছলাম বটে, কিন্তু একেবারে ভোলার উপায় ছিল? বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বুঝতে পারতাম, তখন হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যেত।…মিষ্টি খাব মিষ্টি খাব করে জ্বালিয়ে মারতে আর হাতের নাগালে পেলে কি কাণ্ড করতে। শেষে সেই একদিন…যাঃ। আমি বলব না—
বাপীর কান জুড়িয়ে যাচ্ছে। ভিতর জুড়িয়ে যাচ্ছে। সেই তাজা রক্তের স্বাদও মুখে আর লেগে নেই। বাপী হাসছে।—সেই একদিন বাবার হাতে শাস্তিখানা কেমন খেলাম তাও তো নিজের চোখেই দেখেছিলে।
মনে পড়তে গা শিউরে উঠল মিষ্টির। বাপীর তাও ভারী মিষ্টি লাগল।
—সে কথা আর বোলো না। আবু যখন তোমাকে ধরে নিয়ে এলো তখনো সবার আগে ছুটে গিয়ে তোমার মাথাটা মনের সাধে মাটিতে ঠুকে দিতে ইচ্ছে করছিল আমার। তারপর তোমার বাবার সেই পাগলের মতো মার দেখে আর তোমার নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরুতে দেখে সারা গা ঘুলোচ্ছিল, আর এত রাগ হচ্ছিল তোমার বাবার ওপর যে ইচ্ছে করছিল, বেঁটে মোটা লাঠিটা কেড়ে নিয়ে তাকেই ঘাকতক বসিয়ে দিই।
….আশ্চর্য! সত্যি একটা মোটা লাঠির খোঁচা লাগছে গায়ে।
চমক ভেঙে বিষম ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসল বাপী তরফদার। না, বাপী স্বপ্ন দেখছিল না। জেগেই ছিল। বসেই ছিল। এখানে বসেই একটা খুব লোভনীয় বাস্তবের খুব কাছাকাছি পৌঁছে লাঠির খোঁচায় আচমকা এখানেই ফিরে এলো আবার। রাতের অন্ধকার ঘুটঘুটি এই পার্কে। বকুলতলার এই বেঞ্চিতে…।
…সেই থেকে বাপী তরফদার জেগেই আছে। বসেই আছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে মনে আছে। ছেলেমেয়েরা এসেছে, খেলাধুলো করছে, ছোটাছুটি হুটোপুটি করছে—মনে আছে। দিনের আলোয় টান ধরতে পার্কটা আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়েছে, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে আসতে একেবারে খালি হয়ে গেছে, তাও খেয়াল করেছিল। তারপর এমনি বসে থেকে এমনি চোখ তাকিয়ে কতক্ষণ কিভাবে কেটে গেল তাই শুধু খেয়াল নেই। সমস্ত সত্তাসুদ্ধ কতক্ষণ উধাও হয়েছিল এখনো ঠাওর করতে পারছে না।
লাঠির খোঁচা পুলিশের। এখন সে পিছনে কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।
লোকটা ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করল, সঙ্গে সঙ্গে বড় শ্বাস টানল একটা। মদটদ খেয়ে ঝিম মেরে বসে আছে কিনা বোঝার চেষ্টা। মাথার ওপর বকুল গাছটার জন্য এখানটায় এক চাপ অন্ধকার। লোকটা মাঝবয়সী বাঙালী। কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করল, এত রাতে এখানে বসে কি হচ্ছে?
বাপী বেঞ্চি ছেড়ে উঠল। সমস্ত দিন পেটে কিছু না পড়ায় মাথাটা ঘুরছে। যে বরাত, সন্দেহ হলে হয়তো টেনে নিয়ে গিয়ে লক্-আপে ঠেলে দেবে। ক্লান্ত সুরে বলল, মনটা ভালো ছিল না সিপাই সাহেব…বসে ছিলাম।
মাতাল-টাতাল নয়, মুখ দেখে চোর-ছেঁচড়ও মনে হল না। তবু পা থেকে মাথা পর্যন্ত আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল। বলল, রাত বারোটায় মন ভালো করার জায়গা নয় এটা, অন্য পুলিশের খপ্পরে পড়লে আর কিছু না হোক হাতের ওই ঘড়ি খুলে দিতে হত। পা চালিয়ে চটপট ঘরে চলে যান —
পার্কের গেট পেরিয়ে কব্জির পুরনো ঘড়িতে সময় দেখল বাপী। বারোটা নয়, এগারোটা বেজে কয়েক মিনিট। ঘর এখান থেকে অনেক দূর, কম করে আধ ঘণ্টা লাগবে। শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলল। একটা দোকানপাট খোলা নেই যে কিছু কিনে মুখে দেবে। ইচ্ছে করছে না, আবার শরীরও চলছে না।
…বিমনা হবার মতো রসদ পার্কে বকুলতলার বেঞ্চিতে বসেই সংগ্রহ করেছিল। হোক কল্পনা, কিন্তু তারই মধ্যে মিষ্টিকে খুব কাছে পেয়েছিল। খুব কাছ থেকে দেখেছিল। আর এক আশ্চর্য শান্তিতে বাপীর ভিতর-বার ডুবে গেছল। সেই শান্তির ছোঁয়ায় সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিল কি না কে জানে! নইলে এত রাত হয়ে গেল কি করে…! এখনো সেই তৃপ্তির স্বাদটুকু ভিতরে লেগে আছে।
মনটা সজাগ হয়ে উঠছে আবার। বেশ জোরও পাচ্ছে।…পার্কে বসে নিজের মন থেকে যে ছবি আঁকছিল সেটা এমন কিছু আজগুবী নয়। সত্যি হতে পারে না এমন কিছু নয়। বরং এর বিপরীত চিন্তাটাই বাপীর মাথায় একটা আশ্বাসের মতো এঁটে বসতে লাগল। আটটা বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে আবার কোনো নিভৃতে মুখোমুখি হতে পারলে বাপী যা ভাবছিল তাই হবে। মিষ্টির চোখে ওইরকমই বিস্ময় ঝরবে। তারপর মিষ্টি ওইরকম করেই হাসবে, আর ওই গোছের কথাই কিছু বলবে।
নিজের অজান্তে পা আরো দ্রুত চলছে বাপীর। দুপুরে ওই পার্কটায় বসে প্রথম যা মনে হয়েছিল, ঘুরেফিরে এখন তাই আবার মাথায় আসছে।…সাতাশি নম্বরের ওই বাড়িটার দোতলায় দাঁড়িয়ে মিষ্টি ঠাণ্ডামুখে আজ ওর নিগ্রহ দেখেছে। ওর ওপর পাড়ার ছেলেগুলোর হামলা দেখেছে। মিষ্টির চোখে সেটা অপরিচিতের নিগ্রহ। অপরিচিতের ওপর হামলা। কিন্তু এ-ই শেষ নয়। শেষ হতে পারে না। চৌদ্দ বছরের একটা ছেলের ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত মুখ যদি শেষ কথা না হয়ে থাকে, আজকের এই অপমান আর নিগ্রহও শেষ কথা নয়। বাপী তা হতে দেবে না।
সামনে পিছনে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চলেছে সেই থেকে। রাতের নির্জনে রাস্তা পাহারা দেওয়াটা ওদের যেন ডিউটি। পাড়া জানান দিতে দিতে খানিক সঙ্গ নেয়। ভয় পেলে তেড়েও আসে। ভয়শূন্য নির্লিপ্ততা দেখলে চেঁচানি থামে। তারপর আবার সামনের রাস্তার কুকুরের পালা। মিষ্টিদের সাতাশি নম্বরের বাড়ির সামনের সেই ছেলেগুলোকে আবার মনে পড়ে গেল বাপীর। আর সোনালী ফ্রেমের চশমা-পরা ফুটফুটে ফর্সা সেই ছেলেটাকে—পাড়ার ছেলেদের অসিতদা। তাদেরও কাউকে পাহারায় মোতায়েন রাখেনি কেউ। তারা নিজে থেকেই পাহারা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা খুশির ছবি চোখে ভাসল বাপীর।…এরপর মিষ্টির সঙ্গেই যদি ওরা ওকে ওই সাতাশি নম্বরের বাড়িতে ঢুকে যেতে দেখে তো কি করবে? কুণ্ডলি পাকিয়ে বসবে আর বার করা জিভ দিয়ে লালা ঝরবে?
পা দুটো থেমে গেল। পৌঁছে গেছে। ঘড়িতে রাত প্রায় বারোটাই এখন। টালি এলাকার বাইরেটা নিঝুম। ভিতরেও। তবু এত রাতে কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে ঠিক নেই। কিন্তু সেটা সমস্যা নয়। লোকগুলো এমনিতে সরল। রতন বনিক ওদের যা বুঝিয়েছে তাই বুঝেছে। বিপুলবাবুকে ওরাও লেখাপড়া-জানা নির্বিবাদী ভালোমানুষ জানে। সমস্যা অন্য। সমস্যা বাপী নিজে। সেই কারণে বিষণ্ণ। আবার সেই কারণে নিজের ওপর অসহিষ্ণু।
…সমস্যা ওর ভিতরের সেই জানোয়ারটা। ওটা খোলস থেকে বেরিয়ে পড়লে নিজের ওপর বাপীর আর এতটুকু দখল থাকে না। মেয়েরা দেখা মাত্র সেই মাংসলোলুপ জানোয়ারটাকে চেনে।…গৌরী বউদি দেখেছিল। দেখেই চিনেছিল। প্রশ্রয় দিতে চেয়েছিল। জানোয়ারটা আবার খোলসে ঢুকে গেছল বলেই মণিদার সেই আরামের ঘর ছেড়ে আজ ও এইখানে।…আজ আবার তেমনি দিনেদুপুরেই ওটা আচমকা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। খুব কাছে এসে ঝুঁকে ছেঁড়া জামার ভিতর দিয়ে পিঠে আঘাতের দাগ আছে কিনা দেখতে গেছল রতন বনিকের বউ কমলা বনিক। জানোয়ারটা তখন দুটো চোখের ভেতর দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে ওর ওপরেও ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিল। কমলা ওটাকে দেখেছে। চিনেছে। বিষম হকচকিয়ে গিয়ে কয়েক পা পিছনে সরে গেছে।
হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে গৌরী বউদিও খানিক পিছনে সরে গেছল। তারপর চোখের সামনে কাঁচা তাজা পুরুষ দেখেছিল। বয়েস ভুলে, সব ভুলে, পতঙ্গ পোড়ানোর নেশায় পেয়েছিল তাকে।
কমলা বনিক কি করবে?
পুলিশ তাড়া না করলে রাতটা ওই পার্কেই কাটিয়ে দিত।
পায়ে পায়ে উঠোনে চলে এলো। নিশ্চিন্ত একটু। কেউ জেগে নেই। কমলার ঘরের দরজা বন্ধ। যত সন্তর্পণে খুপরি ঘরের দরজা খুলুক, ক্যাচ করে শব্দ একটু হবেই। কিন্তু দরজা ঠেলতেই বাপী হাঁ একেবারে।
খাটিয়ার কাছে ছোট্ট একটা হারিকেন ডীম করা। ওটার সামনে ঝাঁপিতে কিছু চাপা দেওয়া। দেখেই বুঝল, ওটার নীচে বাপীর রাতের খাবার। এদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝের ওপর হাত পা ছড়িয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে রতন বনিক।
বাপী নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল খানিক।…
সমস্ত দিন লোকটার মেহনতের মধ্যে কাটে। আপিসের কাজ কিছু আছেই, তার ওপর ভাগ্য গোনার ধকলে জিভের কামাই নেই। সন্ধ্যার পর এই খুপরি ঘরে বসে মৌজ করে একটু নেশা করে। ইচ্ছে করেই বাপী সে সময় ঘরে আর থাকেই না। নেশা বেশ জমে উঠলে রতন নিজের ঘরে যায়, খেয়েদেয়ে রাত সাড়ে আটটা ন’টার মধ্যে অঘোরে ঘুম
…আজ বউয়ের হুকুমে ওর এই বাড়িতে ধকল সম্ভবত।
কাঁধ ধরে জোরে নাড়া দেবার পর রতনের ঘুম ভাঙল। লণ্ঠনটা এত ডীম্ করা যে ভালো করে মুখ দেখা যায় না। তবু বাপীর মনে হল, ও এখানে এভাবে পড়ে ঘুমুচ্ছিল কেন নিজেই চট করে ঠাওর করে উঠতে পারছে না। বাপী বলল, ঘরে গিয়ে ঘুমোও গে যাও
বিপুলবাবুর গলা শুনে মাথা পরিষ্কার হচ্ছে। শিথিল শরীরটা মেঝে থেকে টেনে তুলল। ঝুঁকে ছোট লণ্ঠনটা উসকে দিল। তারপর চোখ বড় করে বিপুলবাবুর মুখখানা দেখল। জিজ্ঞেস করল, রাত কত এখন?
—অনেক। বাপী বিব্রত বলেই ভিতরে ভিতরে বিরক্ত। এরকম কষ্ট করার কি দরকার ছিল, শুয়ে পড়োগে যাও।
রতনের দু চোখ ঘুমে বোঝাই। বলল, ওই আপনার খাবার ঢাকা দেওয়া আছে, খেয়ে নিন —
কথা না বাড়িয়ে ও বাইরে গিয়ে দরজা দুটো টেনে দিল। ঘুরে বাপী নির্দয় চোখে ঝাঁপিটার দিকে তাকালো। কারণ ওটার নিচে যা আছে তাই এখন সব থেকে বেশি দরকার ওর। ওটা দেখার পর পেটের তাগিদ এমনি যে গোগ্রাসে এখন গিলতে না বসে উপায় নেই।
খেতে বসল। সামগ্রী বিশেষ কিছু নয়। কিন্তু থালায় সাজিয়ে রাখার মধ্যে যত্নের ছোঁয়া আছে।…এটুকুর মধ্যেই কমলার সঙ্গে গৌরী বউদির একটা বড় তফাৎ। তবু এই রাতটা না কাটলে, বাপী কাল কি করবে? কাল কেমন করে মুখ দেখাবে? তার খাবার সাজিয়ে রাখা দেখে তলায় তলায় ভরসাও পাচ্ছে একটু।… সেই কটা স্তব্ধ হিংস্র মুহূর্তের মধ্যে কমলা সত্যি কতটা ভিতর দেখেছিল ওর? কতটুকু বুঝেছিল?…গৌরী বউদির মত অতটা নাও হতে পারে। কমলা হয়তো বা চণ্ডাল রাগ ভেবেই অমন হকচকিয়ে গেছল। আর তারপর সামলে নিয়ে নিজের জোর ফলিয়েছিল। বলেছিল, আমার ঘর থেকে আমাকে চলে যেতে বলার তুমি কে?…বাপী নিজেই চলে যাবার জন্য পা বাড়াতে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে বলেছিল, কই যাও?…মজা করে জিজ্ঞেস করেছিল, এক কাপ চা এনে দেবে কিনা। তারপর মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য ওকে চানে যেতে বলে ধীরেসুস্থে রান্না চড়াতে চলে গেছল। না খেয়ে ওকে বেরিয়ে যেতে দেখে আকুতি নিয়েই পিছন থেকে ডেকে ফেরাতে চেষ্টা করেছিল।
খেতে খেতে নিজের দিক টেনেই ভাবছিল বাপী। কিন্তু ভিতরের অস্বস্তিটা থিতিয়েই থাকল।
সমস্ত দিনের এত ধকলের পর খাটিয়ায় গা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু ঘুম চট করে চোখের ধারেকাছে ঘেঁষবে না জানে।
…নিশীথ বলেছিল, তুই একটা রামবোকা। একটা মাত্র মেয়ে, তাও কালো—কোলো নয়, বেশ ফর্সা, স্বাস্থ্য ভালো। কোথায় জামাই হয়ে জাঁকিয়ে বসবি, বাড়ি—ঘরের মালিক হবি, শ্বশুর ওদিকে নিজের দায়ে তোর পাকা চাকরি আর প্রমোশনের জন্য ওপরওয়ালার কাছে হত্যা দেবে—তা না, নিজের গোঁয়ে চাকরিটাই খুইয়ে বসলি। কি লাভ হল?
রতন বনিকের এই খুপরি ঘরে এসে ওঠার পরদিন, অর্থাৎ চাকরিতে জবাব হয়ে যাবার তিন দিনের মধ্যে বাপী বন্ধুর কাছে ছুটে এসেছিল। কিন্তু কিছু বলার আগেই নিশীথের ওই কথা।
সঙ্গে সঙ্গে ভিতরটা ওরই ওপর উগ্র হয়ে উঠেছিল বাপীর। তুইও তাহলে সব জেনেশুনেই এই চাকরি নেবার জন্য আমাকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলি।
পাল্টা ঝাঁঝ দেখে নিশীথ ওকে বুঝিয়েছিল, সে সময় ও সত্যি কিছু জানত না। পরে রামকাকা ওকে বলেছিল। তাও চাকরি হবার অনেক পরে, আর বড়বাবু মন্মথ সোমের ছেলে পছন্দ হবার পরে। বন্ধুকে একটু খুশি করার জন্যেও হতে পারে, নিশীথ আরো বলেছিল, তোর গায়ের রং ফর্সা না হলেও মুখের মধ্যে তো বেশ একটু মিঠে ভাব আছে—রামকাকার মুখে শুনেছি, শুধু বড়বাবুর নয়, তার মেয়েরও তোকে ভারী পছন্দ হয়েছিল…আমি কোথায় আশায় দিন গুনছিলাম, এর মধ্যে কাল রামকাকার কথা শুনে বুঝলাম সব চিত্তির। তুই বড়বাবুর আশায় ছাই দিয়েছিস, আর বড়বাবুও তোকে আপিস থেকে ছেঁটে দিয়েছে।…আমারই ভুল হয়েছে, ঘাড়ে চেপে থেকে তোকে রাজি করানো উচিত ছিল।
নিশীথের দোষ নেই বুঝে বাপীর রাগ পড়ে এসেছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, তুই হলে কি করতিস?
—আমি? ওষুধের বড়ির মতো গলায় ফেলে টুক করে গিলে বসে থাকতাম। আরে বাবা, আমার কথা আলাদা, আমার যদি তেমন কোনো মেয়ে চোখে পড়ে বা মনে ধরে, তাতেই বা কি? কবিরাজের ছেলে হবু কোবরেজের সঙ্গে কোনো আধুনিক মেয়ে প্রেমে পড়ে এমন কথা নাটক-নভেলেও কখন পড়েছিস?
…বাপী হেসে ফেলেছিল। নিশীথ আবার বলেছিল, তোর মাথারই ঠিক নেই, নইলে কোন রূপসী আর বিদুষী তোর জন্যে মালা গাঁথছে যে এমন মওকা হেলায় হারালি!
খাটিয়ায় শুয়ে নিশীথের কথাগুলো মনে পড়েছিল। মিষ্টির সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা সেদিন কোনো কল্পনার মধ্যেও ছিল না। যত অবাস্তবই হোক, তবুও ওই কথা শোনার পর মনে হয়েছিল, কোথাও কেউ একজন ওর জন্যে অপেক্ষা করছে, করবে। করতে বাধ্য!…ব্রুকলিনের বড়বাবু মন্মথ সোমের প্রস্তাব শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল কেন? এই কলকাতায় শিকড় গেঁথে বসতে পারাটাই তো তখন একমাত্র কাম্য ছিল, প্রাণপণে চাকরিটা রক্ষা করতেই তো চেয়েছিল, তবু অমল দিশেহারা দশা কেন সেদিন?
…বাপী ভাবছে কেন। মিষ্টির সঙ্গে অচিরে দেখা হওয়াটা সেদিনও কোনো কল্পনার মধ্যে ছিল না। নিশীথ যা বলেছিল সেই অসম্ভব ব্যাপারটা সত্তার মধ্যে ছিল।…কোথাও কেউ একজন ওর জন্যে অপেক্ষা করছে, করবে। করতে বাধ্য।
…কল্পনার বাইরে ব্যাপারটা ঘটেছে। সেই একজনের দেখা পেয়েছে। বাপীকে চিনতে পারেনি। কিন্তু পারলে কি হত? কি হবে? নিশীথ তবু কবিরাজের ছেলে হবু কবরেজ? বাপী কে? বাপী কি? এখন পেট ঠাণ্ডা, মাথা ঠাণ্ডা। ফলে করকরে বাস্তবটাও বেশি স্পষ্ট। এখন আর জোর দিয়ে ভাবা যাচ্ছে না কেউ একজন ওর জন্যে অপেক্ষা করছে, করবে বা করতে বাধ্য। আধুনিক মেয়ের হবু কবরেজের প্রেমে পড়ার থেকেও এ বেশি হাস্যকর অবাস্তব।
স্নায়ু তেতে উঠছে আবার। যত অবাস্তবই হোক সেটা নস্যাৎ করার চেষ্টা।…হিসেবের বাইরে কত কি ঘটে, কত কি হয়। বানারজুলির বিশালকায়া বনমায়ার চেহারাখানা সামনে এগিয়ে এলো। বুনো হস্তির ডাকে ভয়ে কুঁকড়ে না গিয়ে ওই বজ্জাত সকলের সব হিসেব বানচাল করে শিকল ছিঁড়ে ফি বছর তার সঙ্গেই পালায় কেন? জাতের ভয় আর সমাজের ভয় শিকেয় তুলে ভীমবাহাদুর আর তার ভালবাসার কালো মেয়ে কাছাকাছি আসে কেমন করে? আবু রব্বানী কি এতদিন রেশমাকে নিজের ঘরে এনে তুলতে পেরেছে? এ-ও তো কোনো হিসেবের মধ্যে পড়ে না।
…অন্ধকারে বড় করে চোখ তাকিয়ে আরো কিছু দেখছে বাপী। বানারজুলি বাংলোর বড়সাহেবের সেই মেয়ে মিষ্টি আর সাতাশি নম্বর বাড়ির এই মিষ্টিকে পাশাপাশি দেখছে। কিছু ভেঙে আর অনেকটা জুড়ে সেই মিষ্টি থেকে এই মিষ্টি। বাপীও তাই। কিন্তু বাপী আর কত বদলেছে? আট বছর আগের সব কিছু তো একেবারে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে : তাহলে সেই মিষ্টি বা কতটা বদলাতে পারে? কতটা বদলানো সম্ভব?
পার্কে নিজের কল্পনার ছবিগুলো সামনে এগিয়ে আসছে আবার। বাস্তব অবাস্তব সম্ভব অসম্ভবের দরিয়া পারের ছবি।…মাথায় বড় খোঁপা। আগের ফুটফুটে ফর্সা রঙে এখন মেটে ছোপ। ফোলা গাল আর আদুরে ভাব গিয়ে এই মুখের অন্য ছাঁদ। চোখের সেই গোল ভাব এখন আয়ত গভীর। তাতে বুদ্ধির ছাপ, কৌতুকেরও। …মিষ্টি। পার্কে দেখা মিষ্টির সেই হাসি। সেই সব কথা। মন জুড়নো হাসি, প্রাণ জুড়নো কথা।
মিষ্টি। আমি বড় ক্লান্ত। তোমার একখানা হাত আমার মাথায় রাখো। আমি ঘুমিয়ে পড়ি!
বাপী ঘুমিয়েই পড়ল।
কলতলার কলরব জমে ওঠার আগে বাপী মুখ-হাত ধোয়া সেরে আসে। নইলে মেয়েদের জটলার মধ্যে গিয়ে পড়তে হয়। কিন্তু অনেক দিন বাদে আজই . ঘুম ভাঙতে দেরি। মাথাটাও অন্যদিনের মতো ভার-ভার নয়। উল্টে ঝরঝরে লাগছে। ওদিকে কলতলা জমজমাট।
কলসির জল গড়িয়ে মুখ ধোয়ার কাজটুকু জানলা দিয়ে সারল। তারপর আবার শুয়ে চায়ের অপেক্ষা। এই সকালেও কমলার মুখোমুখি হওয়ার চিন্তা অস্বস্তিকর। সেটুকু চাপা দেবার জন্যই বাপী বেশি গম্ভীর। তার কেন যেন ধারণা, চা দিতে এসে কমলা আজ মুখে কোনো কথা বলবে না। শুধু চেয়ে দেখবে একটু। তারপর চায়ের গেলাস বাড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ চলে যাবে। হাসা বা কথা বলার সুযোগ দিতেও চায় না বলে বাপী এমন গম্ভীর।…কিন্তু চা দিতে আজ দেরিই হচ্ছে।
ক্যাঁচ করে দরজা ঠেলার সেই পরিচিত শব্দ। পরের মুহূর্তে বাপী বিমূঢ়। এক হাতে ডিশের ওপর ওর চায়ের গেলাস আর অন্য হাতে নিজের গেলাস নিয়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকছে রতন বনিক। আর সেই কটা মুহূর্তের মধ্যে বাপীর মনে হল, কমলার মুখে রোজ সকালের বড়বাবু ডাকটা বড় মিষ্টি লাগত।
রতন বলল, জেগে আছেন দেখছি—নিন। হাসছে।—পিওনের বউ হলে কি হবে, দেমাক খুব। বলে, আমাকে অপমান করলে আমি যাব কেন, তুমি যাও। ডিশে বিস্কুটসহ গেলাসটা হাতে নিল বাপী। কমলা এলো না, স্বস্তি। রাগই যদি হয়ে থাকে তাহলে আরো স্বস্তি;কিন্তু এখানে অপমান শব্দটা খুব প্রাঞ্জল নয়। হাসতে চেষ্টা করে বলল, অপমান কি করলাম…।
—মেয়েছেলের কথা ছাড়েন। আপনার জন্যে রান্না হচ্ছে জেনেও আর পিছন থেকে ডাকাডাকি করা সত্ত্বেও আপনি নাকি না খেয়ে চলে গেলেন—সেই অপমান। আর বলে কি, আপনার খাবার-টাবার এবার থেকে আমাকেং দিয়ে যেতে হবে, ও পারবে না।
বাপী বলল, কিছু দরকার নেই, কাউকে দিয়ে যেতে হবে না।
রতন এবার মাথা নাড়ল—সে হবে না। বউ বলছিল, রাতে ছেড়ে দিনেও নাকি সব দিন আপনার খাওয়া হয় না। অতিথি না খেয়ে থাকলে গেরস্তের অকল্যাণ হয় এ সম্বন্ধে বউয়ের সঙ্গে আমি একমত। দিনে আপনিও কাজের ধান্ধায় ঘোরেন, আমিও সকাল সকাল আপিসে চলে যাই—যে ক-দিন না বউয়ের রাগ পড়ে, আপনার রাতের খাবার আমিই দিয়ে যাব। ফের আপনি রাতে উপোস দিচ্ছেন জানলে বউটা সত্যি ক্ষেপে যাবে…যত দেমাকই দেখাক ওর ভেতরটা ভালো, বুঝলেন বিপুলবাবু।
বাপী একটুও খুশি হতে পারছে না। বলল, তোমার বউয়ের কি ধারণা আমি পয়সার অভাবে উপোস দিচ্ছি?
রতন জিভ কাটল।—তা কেন, ছি-ছি-ছি, বউও জানে নিজের খেয়ালে থাকেন, তাই সময়ে খাওয়া হয় না—এই জন্যেই তো আরো বেশি মায়া। আপনার যদি সম্মানে লাগে না-হয় মাসের শেষে ধরে দেবেন কিছু—খাওয়াটা তো হবে।
আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বুঝে বাপী চুপ। রতন বনিক এবারে একটু নিরীক্ষণ করে দেখল ওকে।—আপনার কপালের রঙ এখন অবশ্য আরো একটু কালো হয়েছে…তা ভাল হবার আগে অনেক সময় অমন হয়। আপনার দিন ফিরতে আর খুব বেশি সময় লাগবে না, দেখে নেবেন।
হাত বাড়িয়ে ডিশ আর গেলাস নিয়ে রতন চলে গেল। বাপী বিমনা একটু। এরকম আশার কথা রতন অনেক বলেছে। বাপী কানে তোলেনি। কখনো বা হেসেছে। আজও ওর কথা বেদবাক্য ভাবছে না। শুধু রতনের এই বিশ্বাসের জোরটুকুই ভিতর থেকে যেন আঁকড়ে ধরতে চাইছে।
মাথার মধ্যে সময়ের একটা হিসেব ঘুর-পাক খাচ্ছিল বাপীর। স্নান সেরে জামাকাপড় বদলে সেই সময় ধরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। ট্রাম বা বাস ধরার দরকার নেই, হাতে সময় যথেষ্ট। হাঁটার ব্যাপারে পা দুটো বাধ্যও খুব। ট্রাম-বাসের ভিড়ে হাঁপ ধরে।
…সাতাশি নম্বরের সেই বাড়ির রাস্তা সকলের জন্য খোলা। শুধু বাপীর জন্য নয়। কিন্তু খোলা থাকলেও বাপী আজ ও-পথ মাড়াতো না। পাড়ার ওই ছেলেগুলোর হামলা করার কোনো দরকার ছিল না। ওদের চোখের সাধ মেটানোর ভাগীদার নয় বাপী। পরের ভাবনা তাকে এমনিতেই ভাবতে হত। ভাবা হয়েছে।
সাতাশি নম্বর বাড়ির সাদাটে গাড়ি রাস্তার বাঁক নিয়ে বড় রাস্তায় এসে পড়ে। তারপর ডাইনে যায় কি বাঁয়ে, উত্তরে কি দক্ষিণে সেটুকুই আজ দেখা দরকার। আজ আর এর বেশি কিছু নয়।
সাদা গাড়ির নম্বরসুদ্ধু জানা। তাই বড় রাস্তার মুখোমুখি দাঁড়ানোরও দরকার নেই। সেখান থেকে কম করে একশ গজ দূরে একটা গাড়িবারান্দার নিচে এসে দাঁড়াল। সময় ধরে এসেছে, খুব অপেক্ষা করতে হবে না জানে। আট-দশ মিনিটের মধ্যে সেই সাদা গাড়ি বড় রাস্তার মুখে। ভাগ্য কি দুর্ভাগ্য বাপী জানে না। হর্ন বাজিয়ে গাড়িটা বাঁয়ে অর্থাৎ বাপী যেদিকে দাঁড়িয়ে সেইদিকে ঘুরল। তারপর একশ গজ গড়াতে আর কতটুকু?
মিষ্টি গাড়ির বাঁ দিকে। আপনা থেকেই বাপীর পা দুটো ফুটপাথ ঘেঁষা রাস্তার দিকে এগিয়ে এসেছে। কয়েক পলকের মুখোমুখি, চোখাচোখি। মিষ্টি চিনেছে। চিনেছে বলতে বে-পাড়ার যে ছেলেটাকে বাড়ির সামনে কদিন হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে আর গতকাল দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাড়ার ছেলেগুলোর হাতে যার দুর্ভোগ দেখছে—তাকে চিনেছে। আজ এইখানে দাঁড়িয়ে থাকার অর্থটাও ওর কাছে যেন খুব স্পষ্ট। সেই কটা মুহূর্তের মধ্যে বাপীর মনে হয়েছে, মিষ্টি ওকে দেখেছে আর দেখার সঙ্গে সঙ্গে যেন তাকাতেও অরুচি।
গাড়িটা এগিয়ে গেল। বাপীর চোখে আগুন। বুকের তলায় সেই অসহিষ্ণু দাপাদাপি। কাল ওর পাড়ার ছেলেরা যে অপমান করেছিল, আজ এই বিতৃষ্ণা অবজ্ঞার চাউনি ছুঁড়ে ও যেন তার দ্বিগুণ অপমান করে গেল।
গাড়িটা কোন্ দিকে কোন্ রাস্তা ধরে যায় আজ শুধু একটু জানতে বুঝতেই এসেছিল। কিন্তু ওপরঅলার ইচ্ছে অন্য রকম। বাপী শ্যেনদৃষ্টিতে ওই চলন্ত গাড়িটার দিকেই চেয়ে ছিল। সামনেই বড় রাস্তার চার-মুখে দাঁড়িয়ে গেল ওটা। ট্র্যাফিকের লাল আলো জ্বলে উঠেছে। সবুজ হলে আবার চলবে।
সত্যি কেমন বরাত আজ বাপীর কে জানে। পরের যা প্ল্যান সেটা এই মুহূর্তে এভাবে হাতের মুঠোয় পাবে ভাবেনি। গাড়িবারান্দার ও-মাথায় একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। আট-দশ গজের মধ্যে। বাপী ছুটে গিয়ে উঠে পড়ল। বাঙালী ড্রাইভার ঘাড় ফেরাতে আঙুল তুলে সামনেটা দেখিয়ে দিল।
বাঁ দিকে পাঞ্জাবীর বুক পকেটের ওপর হাত রেখে চাপ দিল একটু। ধপ-ধপ কতটা করছে দেখার জন্যে নয়। খুচরো পয়সা নিচের পকেটে থাকে, আর টাকা পাঞ্জাবির ভিতরের পকেটে। কলকাতার ট্রাম-বাসে চড়তে হলে সব জামার ভিতরে একটা করে পকেট দরকার সেটা নিশীথ ওকে গোড়াতেই বলে দিয়েছিল। যে কটি টাকা খরচ মাসে, ব্যাঙ্ক থেকে একবারেই তুলে ফেলে। খরচ না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সে-টাকা ওর জামার সঙ্গেই ঘোরে। তবু সাবধানের মার নেই। আজ জামা আর পাজামা বদলেছে। আনতে ভুলেছে কিনা একবার ওপর দিয়ে স্পর্শ করে বুঝে নিল।
সাদা গাড়ির দুটো গাড়ি পিছনে ওর ট্যাক্সি। কলকাতার ট্যাক্সিতে বাপী এই প্রথম। এর আগে বারকয়েক নিশীথের বাবার পুরনো গাড়িতে চাপা হয়েছে।… হলদে আলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই সবুজ আলো। এ-দিকের গাড়ির সারি চলল।
খুব গম্ভীর গলায় ড্রাইভারকে বলল, ওই সাদা গাড়িটার পিছনে চলুন তো…। গাড়ির নম্বরও বলে দিল।—গাড়ির ওই মেয়েটি যে কলেজে পড়ে, আমার আগে সেখানে একবার যাওয়া দরকার, কলেজের নামটা মনে পড়ছে না…।
সাদা গাড়ির পিছনের কাচ দিয়ে ওই মেয়ের শুধু মাথা আর গলা দেখা যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের উৎকণ্ঠার পর বাপী নিশ্চিন্ত একটু।—মিষ্টিদের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করতে গিয়ে জ্যোতিষীর হাতে নাকাল হওয়াটা ভোলেনি। ড্রাইভার ঘাড়ও ফেরালো না। সাদা গাড়ির পিছনে চলল।
হাজরায় সাদা গাড়ি ডাইনে বাঁক নিল। বাপীর ট্যাক্সিও। তারপর বেশ খানিকটা সোজা গিয়ে তারপর কোথা দিয়ে কোথায় চলল ঠাওর করা গেল না। এদিকের সব রাস্তাই বাপীর অচেনা। আরো খানিক বাদে সচকিত। এবারে চেনা লাগছে জায়গাটা। গাড়ি আর পিছনে ট্যাক্সি পার্ক সার্কাসের ময়দানের দিকে চলেছে। মণিদার বাড়ি থেকে মাইল দেড় দুই হাঁটা পথ। ওই ময়দানে বাপী অনেকবার এসেছে। …ট্যাক্সি এখন ছেড়ে দিলেও চলে। বাপী বুঝে নিয়েছে ওই মেয়ের কোন কলেজ। মেয়েদের একটাই নামডাকের কলেজ এখানে।
সামনের সাদা গাড়ি বড় ফটকের সামনে থাকল। মস্ত কাঠের গেটের এক পাট খোলা। বাপী পঁচিশ-তিরিশ গজ পিছনে ট্যাক্সিটা দাঁড় করালো। সাদা গাড়ি থেকে নেমে মিষ্টিকে ভিতরে ঢুকে যেতে দেখল। গাড়িটা ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল।
বাপী ট্যাক্সি থেকে নামল। মিটার দেখে ভাড়া মেটানোর সময় ট্যাক্সিঅলা শুধু মুখের দিকে তাকালো একবার। সে হয়তো আশা করেছিল তাকে অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ট্যাক্সিতে উঠে বাপী বলেছিল, মেয়েটি যে কলেজে পড়ে আগে একবার সেখানে যাওয়া দরকার। মুখে কিছু বলল না ট্যাক্সিঅলা, কিন্তু একবার চোখ তাকিয়ে যেন বলে গেল তোমার মতো সোয়ার আমার অনেক দেখা আছে।
পায়ে পায়ে ফটকের দিকে এগলো। গাড়িতে বাসে পায়ে হেঁটে দলে দলে মেয়ে আসছে আর ঢুকে যাচ্ছে। কলেজের চারদিক ঘেরা উঁচু পাঁচিল। এক-পাট খোলা ফটকের ভিতর দিয়ে সামনের বিশাল হলদে দালান দেখা যাচ্ছে। দুদিকে বাগান।
…না, এখন নয়। আরো ঘণ্টা কয়েক বাদে। বাপীর আর তাড়া কিছু নেই। ফিরে চলল। ময়দানে ঘোরাঘুরি করে কাটাল খানিক। তারপর আবার রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা হেঁটে একটা বড় রেস্তরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে গেল। নিশীথের সঙ্গে ছোট রেস্তরাঁয় খেয়েছে। কিন্তু এইদিন অন্য সব দিনের থেকে তফাৎ কিছু হবেই। ঢুকে পড়ল। মুখ-হাত ধোবার জায়গায় বড় আয়না। নিজেকে দেখে নিল। পা-জামার বদলে পরনে ধুতি থাকলে ভাল হত। তবু পাটভাঙা পাজামা-পাঞ্জাবিতে খারাপ দেখাচ্ছে না। এ ব্যাপারে গৌরী বউদি ওকে একটু শৌখিন করে দিয়েছিল।
বেশ করে খেয়ে নিল। অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল। হোক। সব থেকে বড় ফয়সলাই হয়তো আজ হয়ে যাবে। ছোট কিছু ভালো লাগছে না।
বাপী কিছু চিন্তা করছে না। কিচ্ছু ভাবছে না। সব ভাবনা-চিন্তা পরে। এলোমেলো ঘোরাঘুরি করে সময় কাটাতে লাগল। দুটো যেন আর বাজবেই না।
বাজল একসময়। বাপী তখন কলেজ-ফটকের কাছাকাছি। দারোয়ান বসে আছে একজন। এখান থেকেই বাধা পড়বে কিনা কে জানে। না, কিছু বলল না। বাপী সোজা কলেজের দালানের দিকে চলল। দু-দিকের বাগানে দুটো-চারটে করে মেয়ে বসে।
হলঘরের সামনের কাঠের বেঞ্চিতে জনাতিনেক বেয়ারা বসে। ওদের মধ্যে বুড়ো মতো অবাঙালী লোকটাকে ডাকল। সে উঠে এলো।
—মালবিকা নন্দীকে চেনো? থার্ড ইয়ারে পড়ে।
পুরনো বেয়ারা, পুরনো ছাত্রীদের অনেককেই চেনে।—মালবিকা নন্দী কোন ডিপার্ট, হিস্টরি?
বাপী মাথা নাড়ল।
—কি দোরকার আপনার?
—খুব দরকার—একটু যদি খবর দাও…
আঙুল তুলে সে একটা ঘর দেখিয়ে দিল।—ওই আপিস ঘরে গিয়ে বোসেন—শিলিপ ভেজিয়ে দেন—
বাপী বলল, তুমি একটু সাহায্য করো না ভাই, আমি বাইরে থেকে এসেছি, কিছুই জানি না, একটা খবর দেওয়া খুব দরকার।
বিনয়ে তুষ্ট প্রায় সকলেই। আধবুড়ো বেয়ারা ওকে সঙ্গে করে আপিস ঘরে নিয়ে এলো। কেরানীবাবুকে নিজেই কি বলে একটুকরো সাদা কাগজ ওর হাতে দিল।—আপনার নাম লিখে দেন, আওর ঠিকানা।
পেন্সিলও সে-ই এগিয়ে দিল।
বাপী প্রথমে লিখল, মালবিকা নন্দী। তলায় লিখল, বাপী তরফদার। বানারজুলি ফরেস্ট।
বেয়ারা স্লিপ নিয়ে চলে গেল। বাপী আবার বাইরের বারান্দায়।
ছটা-সাতটা মিনিট নয় যেন একটা যুগ। বেয়ারা ফিরে এসে জানালো, পাঞ্চ মিনিটের মধ্যে কেলাস শেষ হোবে—ওপেক্ষা করুন, আসছেন।
অনেকক্ষণের একটা রুদ্ধশ্বাস মুক্তি পেয়ে বাঁচল। বাপী পায়ে পায়ে বারান্দা ছেড়ে নিচে নেমে এলো। তারপর ফটকটার দিকে কয়েক পা এগিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
…মিষ্টি তাহলে আসছে!