সোনার হরিণ নেই – ৩৮

আটত্রিশ

চাকরির মোহ মিষ্টিরও আর নেই খুব। উপার্জনের সঙ্গে প্রয়োজনের কিছুমাত্র যোগ না থাকলে সেটা শখের চাকরি। তখন দশটা পাঁচটার কড়াকড়ি খুব সুখের মনে হয় না। মিষ্টি তবু তর্ক করতে ছাড়েনি। বলেছে, ঘরে বসে থেকে করব কি, খাবদাব ঘুমুবো আর মুটিয়ে যাব?

ওর মুটিয়ে যাবার নামে বাপীর কপট আতঙ্ক।—সর্বনাশ! সেটা বরদাস্ত হবে না। যা আছ তার থেকে এক চুল মোটা হতে দেখলে খাওয়া আর ঘুম আর্ধেক করে দেব আর হরদম ওঠ-বোস করাবো। এতদিনে আমার হাতের একটা পাকা আন্দাজ হয়ে গেছে—রোজ রাতে আর ছুটির দিনের দুপুরে খুব কড়া করে মাপ নিয়ে ছাড়ব।

মিষ্টির অবাকই লাগে। এরকম বে-আবরু রসের কথা ওই মুখেই দিবিব মানায়। হাসি চেপে বলেছে, তোমার অত কষ্ট করার দরকার কি, আমি চাকরিটা করে গেলেই তো হয়

বাপী গম্ভীর। তা হয় না। অসিত চ্যাটার্জি আমার কান বিষিয়ে রেখেছে। ওখানে নাকি গণ্ডায় গণ্ডায় লোক তোমার রূপে গুণে মজে আছে। সব ছেড়েছুড়ে আমাকে তাহলে তোমার অফিস পাহারা দিতে হয়।

সন্তর্পণে একটা মুক্তির নিশ্বাস ফেলেছে মিষ্টি। দুজনের মধ্যে দুস্তর তফাৎ কত, অনুভব করা যায়। মুখের কথা ছেড়ে আগের লোকের চাউনিতে অবিশ্বাসের ছায়া দেখলেও বরদাস্ত করতে পারত না, ঝলসে উঠত। আর এই একজনের তাই নিয়ে সাদাসাপটা ঠাট্টাও নির্ভেজাল রসের বস্তু হয়ে ওঠে।

মিষ্টির মা বাবা দাদারও এখন বাপীর সর্ব কথায় সায়। বিশেষ করে মায়ের। জামাই-গর্বে মহিলা ডগমগ। মেয়ের নিজের আলাদা নতুন গাড়ি হয়েছে, তার জন্য ড্রাইভার রাখা হয়েছে। সোনাদানার ছড়াছড়ি। ছেলের বউয়ের আর তাঁর নিজের গায়েও এক-গাদা নতুন গয়না উঠেছে। মেয়ে কোনো আপত্তিতে কান দেয়নি। মেয়ের একলার হাতখরচের জন্য এখানকার ব্যাঙ্কে যে টাকা জমা পড়েছে তা-ও চোখ ঠিকরে পড়ার মতো। জীবন-ভোর বড় চাকরি করেও মেয়ের বাপ অত টাকা জমাতে পারেনি। জামাইয়ের পরামর্শ মতো সেই টাকা মনোরমা নন্দী আর মালবিকা নন্দীর নামে রাখা হয়েছে—ঠিকানাও সেই বাড়ির। বাপীর সঙ্গে এই টাকার কেউ কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাবে না। ইনকাম ট্যাক্স এড়ানোর এই ফন্দি মিষ্টির খুব পছন্দ নয়। কিন্তু দাদা এমন কি বাবাও বলে, বেশি টাকা যাদের, এভাবে কিছু টাকা সরিয়ে রাখতেই হয়।

মায়ের উদ্ভাসিত মুখ দেখে মিষ্টি তাকে আরো কিছু দেখানোর লোভ সামলাতে পারেনি। গাড়ি পাঠালেই মা চলে আসে। মেয়ের ঐশ্বর্যের আভাস পেলেও তার পরিমাণ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। মায়ের সঙ্গে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার পর আনন্দে আত্মহারা মা-কে মিষ্টি নিজের এখানে নিয়ে এলো। খাওয়া দাওয়ার পর আরো কত সোনা আর মণিমুক্তো ঘরে পড়ে আছে মা-কে দেখালো। উত্তর বাংলার নানা ব্যাঙ্কে জমা টাকার পাশবইগুলো দেখেও মায়ের দম-বন্ধ হওয়ার দাখিল। মিষ্টি আনন্দ পেয়েছে বই কি। যে জামাইয়ের আজ এত গুণকীর্তন, এই মায়ের হাতে তার ছেলেবেলার হেনস্থা মেয়ে ভোলেনি। মানুষটার পিঠের ওই দাগগুলোর ওপর মিষ্টি যখন হাত বা ঠোঁট বুলিয়ে আদর করে, তখন সেই সব নির্যাতন অবজ্ঞা আর অবহেলা সব থেকে বেশি মনে পড়ে।

কিন্তু এত ঐশ্বর্য বলেই মিষ্টি নিজেও স্বস্তি বোধ করে না খুব। একটা উৎকণ্ঠা মনের তলায় থিতিয়েই আছে। ভুটান পাহাড়ের বাংলোয় নিজের চোখে কিছু দেখে এসেছে। কিছু বুঝেও এসেছে। তারপর ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে এই জমা টাকার স্তুপ দেখে কেবলই মনে হয়েছে এত বড় ব্যবসার তলায় তলায় কিছু বে-আইনী ব্যাপারের স্রোতও বইছে। বাপীর দিকে চেয়ে কোনরকম উদ্বেগের ছিটেফোঁটাও যে দেখে না—সেটা অবাক হবার মতো কিছু নয়। তার মতো বেপরোয়া দুঃসাহসী কজন হয়।

মুখে কিছু না বলে মিষ্টি দেখে যাচ্ছে। বুঝতে চেষ্টা করছে। নিজের চোখ আর বুদ্ধির ওপর আস্থা আছে। বাড়ির নিচের তলায় অফিস। বাপীর কথামতো খাওয়া-দাওয়ার পর দু’তিন ঘণ্টার জন্য এসে বসে। জিত্ থাকলে তার কাছ থেকে কাজকর্ম বোঝা সহজ হয়। আর শুধু এই লোক থাকলে খানিক বাদে ফষ্টিনষ্টি শুরু হয়ে যায়। এক-একদিন কাজের অছিলায় বাপী গম্ভীর মুখে জিকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। মিষ্টি মনে মনে অপ্রস্তুত হয়। জিত্ চলে গেলে রাগ দেখায়।— তোমার যে যে দিনে বাইরে কাজ থাকবে সেই সব দিনে আমি এখানকার কাজ দেখতে বা বুঝতে নামব।

বাপীর ঠোঁটে জবাব মজুত।—আমার যা হবার হয়েছে, বউ ছেলে আছে, বেচারা জিতের মাথাটা আর খাবে কেন।

—জিত্ কি বোকা নাকি, তোমার চালাকি বুঝতে পারে না ভাবো?

—না পারার কি আছে। তোমাকে কি করে ঘরে এনেছি ও সেটা খুব ভালোই জানে।

তবু এই ক-মাসে মিষ্টি যতটুকু দেখেছে বা বুঝেছে, এখানকার ব্যবসায় বেআইনী কিছু আছে মনে হয়নি। বাপীর সঙ্গে উল্টোডাঙার বিশাল গোডাউনও দেখে এসেছে। সেখানে ভাসুর অর্থাৎ মণিদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ভদ্রলোকের দুর্ভাগ্যের কথা মিষ্টির শোনা ছিল। মাসখানেক আগের ছুটিতে বাচ্চু এসেছিল। তখন শুনেছে। শোনার পর ছেলেটার জন্য ভারী মায়া হয়েছিল। ওই ছেলেও খুব আর ছোটটি নেই এখন। সবই বোঝার কথা। যাই হোক, গোডাউন দেখেও সন্দিগ্ধ হবার মতো কিছু চোখে পড়েনি।

প্রথম ধাক্কা খেয়েছে মাস চার-পাঁচ বাদে বাপীর সঙ্গে টুরে এসে। পর পর দুবার মিষ্টি যেচে সঙ্গ নিয়েছে। তার স্পষ্ট কথা, খুব আনন্দ করে চাকরি ছাড়িয়েছ, এখন একলা বসে আমার দিন কাটে কি করে?

বাপী সানন্দে নিয়ে এসেছে। ভালো হোটেল যেখানে আছে সেখানে আর অসুবিধে কি। মিষ্টি সেই প্রথম টের পেয়েছে এ-সব দিকের ব্যবসার সবটাই সাদা রাস্তায় চলছে না। ফার্মের নামে অনেক টাকা চেকে আসতে দেখেছে। সেই সঙ্গে থোকে থোকে কাঁচা টাকাও। কাঁচা টাকার বেশির ভাগই ব্যাঙ্কে জমা পড়ছে না। যা-ও পড়ছে তা-ও ফার্মের নামে নয়, দুজনের নানা নামের অ্যাকাউন্টে। ঘরের সিন্দুকে অত কাঁচা টাকার আমদানিও এই থেকেই বোঝা গেল। প্রথমবারের সন্দেহ দ্বিতীয়বারে সঙ্গে এসে আরো মাথায় গেঁথে গেল। এবারে মধ্যপ্রদেশের কয়েক জায়গায় টুরে আসা হয়েছিল। ফেরার সময় গা শিরশির করার মতো সঙ্গে পাঁজা পাঁজা নোট।

এবারে ফিরে এসে মিষ্টি আর চুপ করে থাকতে পারল না। উদ্বেগ বুঝতে না দিয়ে ঘুরিয়ে প্রসঙ্গটা তুলল। জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের সেই ভুটান পাহাড়ের বাংলোর পিছনের অত জায়গায় সবটা জুড়ে শুধু নেশারই নানারকম গাছগাছড়ার চাষ হচ্ছে দেখেছিলাম, সব ওষুধে লাগে?

বাপী হেসে জবাব দিল, ওষুধে যতটা লাগে নেশায় তার থেকে বেশি লাগে।

—তোমার লাইসেন্স আছে?

—লাইসেন্স না থাকলে এত জায়গায় ব্যবসা চালাচ্ছি।

—না, মানে নেশার জন্য ও-সব বিক্রি করার লাইসেন্সও আছে? বাপী হাসতে লাগল।

—হঠাৎ তোমার মাথায় এসব চিন্তা কেন?

—বলোই না?

—আমি হোলসেলারদের দিয়ে খালাস। যা করার তারা করে। কোটার বাইরে তারা যা নেয় তার হিসেব মুখে মুখে—আমার রেকর্ড সাফ।

মিষ্টির পছন্দ হল না। বলল, কোটার বেশি জিনিস দেওয়াও তো অন্যায়, বিশেষ করে কেন বেশি নিচ্ছে তা যখন তুমি জানো।

এই গোছের ন্যায়-নীতির আলোচনা ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু বাপীর একটুও খারাপ লাগছে না। মিষ্টির ভেতরটা এখনো ছেলেবেলার মতোই পরিষ্কার। বলল, লোকে নেশা করবেই, তাই এ অন্যায় তুমি না করলে আর একজন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে করবে। হেসে খোঁচাও দিল আর ন্যায়-অন্যায় যা-ই বলো সব করেছি তোমার জন্য—পিছনে টাকার জোর ছিল না বলে বানারজুলির বড়সাহেবের বাংলোয় ঢুকতে পর্যন্ত পেতাম না—লোকে নেশা আর কতটুকু করে, তোমার জন্য আমার টাকা রোজগারের নেশা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মিষ্টি মুখে আর কিছু বলল না, কিন্তু ভিতরে একটা দুশ্চিন্তা থিতিয়েই থাকল। বলতে ইচ্ছে করছিল, আমার জন্যেই যদি হয় তো এ নেশায় আর কাজ কি! আমার নাগাল তো পেয়েছ, এখন সাদা রাস্তায় চলো। বলতে পারল না। এত বছর ধরে এত জায়গায় যা ছড়িয়ে বসেছে, হুট করে তা গুটিয়ে ফেলতে বললে কান তো দেবেই না, উল্টে হেসে উড়িয়ে দেবে। বিরক্তও হতে পারে। এর পর বাপী টুরে বেরুলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত মিষ্টির একটা চাপা অস্বস্তির মধ্যে কাটে। এত কাঁচা টাকা নিয়ে অনায়াসে ঘোরাফেরা করে, মিষ্টির সে-জন্যেও দুশ্চিন্তা।

ইচ্ছে থাকলেও এখন আর সঙ্গে যাওয়া হয় না। নরেন্দ্রপুর থেকে বাচ্চুকে ছাড়িয়ে এনে আবার কলকাতার স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। মুখে না বললেও বাচ্চুর এখানে থাকার ইচ্ছেটা মিষ্টি টের পেত। কলকাতায় এলে কাকীমার কাছছাড়া হতে চায় না। এই থেকেই বুঝেছে। আর এই ছেলেটার ওপর তার কাকার স্নেহ মায়া মমতাও লক্ষ্য করেছে। এত বড় বাড়িতে মিষ্টিরও একা ভালো লাগে না। সে-ই তাগিদ দিয়ে বাচ্চুকে আনিয়েছে। ছেলেটার ওপর আগেই মায়া পড়েছিল। এখন আরো বেড়েছে।

সামনের বারে স্কুল ফাইন্যাল দেবে। কিন্তু মিষ্টি মাস্টার রাখতে দেয়নি। বাপীকে বলেছে, এটুকু দায়িত্ব তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও।

বাপী আরো নিশ্চিন্ত।

সময় সময় তবু মিষ্টির কেমন নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিমনা দু-চোখ নিজের দেহে ওঠা-নামা করে। যেমন ছিল তেমনি আছে। আগের মতই কাঁচা, তাজা। তবু খুশি হতে পারছে না তেমন। বছর ঘুরতে চলল, দেহের নিভৃতে কোনো সাড়া নেই, ঘোষণা নেই। সব থেকে বেশি কাম্য কি এখন, মুখ ফুটে বাপীকে বলতে না পারলেও নিজে জানে। কোল-জোড়া হয়ে থাকার মতো কাউকে চাই। আগের জীবনে আর ছেলেপুলে না হওয়াটা ইচ্ছাকৃত ভাবত। একবারের তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে সেই সম্ভাবনাও ভয়ের চোখে দেখত। সেই দোসরের ওপর ভরসা আদৌ ছিল না, তাই নিরাপদ বিধি-ব্যবস্থার দায় নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু এখন কি? এই এক বছর ধরে তো কোনো বাধারই বালাই নেই। ভাবতে গেলে নিজের মুখ লাল হয় মিষ্টির। দুর্বার স্রোতে ভেসে যাওয়ার এমন পরিপূর্ণ আনন্দ আগে জানা ছিল না। নিজের শরীর স্বাস্থ্য অত ভাল না হলে ধকল পোহানোও খুব সহজ হত না। এই ভোগ-বিস্মৃতির একটাই পরিণাম। কিন্তু এত দিনেও শরীরে তার কোনো লক্ষণ বা ইশারা নেই কেন?

মিষ্টির দুশ্চিন্তার ছায়াটা ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে। সেই অভিজ্ঞ ডাক্তারের কথা মনে পড়েছে। বলেছিল, অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তখনকার সেই ভাঙা স্বাস্থ্যই সব থেকে বড় ক্ষতি ধরে নিয়েছিল মিষ্টি। সেই ক্ষতি মানে কি তাহলে এই! এত পাওয়ার বিনিময়েও তার কিছু দেবার থাকবে না?

নিজের হেপাজতে গাড়ি, হাতে অঢেল টাকা, মিষ্টি দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে বসে থাকল না। মা-কে শুধু বলল। তারপর সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে মায়ের মারফৎ অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তার কাছে গেল। সঙ্গে কেবল মা। আর কেউ কিছু জানে না।

মা সব বলার পর কেসটা বড় ডাক্তারের কিছু কিছু মনে পড়েছে। ‘দু’ সপ্তাহে বারকয়েক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সে মা-কে জানিয়েছে, এত দিনেও হয়নি যখন, আর হবে বলে মনে হয় না। হবেই না এমন কথা ভদ্রলোক খুব জোর দিয়ে না বললেও মিষ্টি যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। মা ডাক্তারের কথা মানতে রাজি নয়। কলকাতা শহরে বড় ডাক্তার ওই একজনই নয়। মায়ের তাগিদে সমস্ত কেস সহ আরো দুজন বিশেষজ্ঞকে দেখানো হয়েছে। তাদেরও ঊনিশ-বিশ একই কথা। তবে আশ্বাস দিল, বিজ্ঞান থেমে নেই, এ ধরনের কেস নিয়েও বিদেশে ঢালাও গবেষণা চলছে। কোনো আশা নেই, এ-কথা জোর দিয়ে বলা চলে না।

আগের জামাইয়ের ওপর জ্বলন্ত আক্রোশে মনোরমা নন্দী দুর্ভাবনার ব্যাপারটা ছেলেকে না বলে পারেনি। ছেলে আবার কথায় কথায় সেটা বাপীকেই বলে ফেলেছে। এই ভগ্নীপতি তার সব থেকে অন্তরঙ্গজন এখন। মা-কে নিজে তাগিদ দিয়ে দাদুর সাতাশি নম্বরের বাড়ি দীপেন নন্দীর একলার নামে লেখাপড়া করিয়েছে। শুধু তার জন্যেই ভগ্নীপতি ঘরে দামী বিলিতি বোতল মজুত রাখে। নিজে এরোপ্লেনের টিকিট কেটে সপরিবারে তাকে বানারজুলিতে বেড়াতে পাঠিয়েছে—সেখানে নিজের বাংলোয় নি-খরচায় রাজার হালে রয়েছে। সেখানেও বেড়ানোর জন্য একটা গাড়ি চব্বিশ ঘণ্টা তার দখলে। এমন দরাজ ভগ্নীপতির কাছে গোপন করার কি আছে। তার ওপর তরল পদার্থ পেটে পড়তে মনের খেদ আপনি প্রকাশ পেয়েছে।

বলেছে, বোনটার মন খুব খারাপ। তিন-তিনজন স্পেশালিস্ট দেখানো হয়েছে, তারা এই-এই বলছে—ওই অসিত রাসকেলটাকে হাতের নাগালে পেলে দীপুদা নিজেই তার মাথাটা ছাতু করে দেয়, ইত্যাদি।

বাপী আদৌ আকাশ থেকে পড়েনি। প্রথম বারের সেই অঘটনের পর দীপুদার মুখ থেকে বড় ডাক্তারের মন্তব্য শুনে বাপীর মনে এই সংশয় ছিল। মিষ্টিকে ঘরে আনার তিন মাসের মধ্যেও কোনো লক্ষণ না দেখে ছেলেপুলে যে আর হবে না, ধরেই নিয়েছে। কিন্তু সে-জন্য তার এতটুকু মাথাব্যথা নেই বা অসিত চ্যাটার্জির মাথাও ছাতু করার ইচ্ছে নেই। সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে মিষ্টিকে চেয়েছিল। পেয়েছে. সেই অঘটন না ঘটলে বা তার পরেও একটা বা দুটো ছেলেপুলে থাকলে বাপীর চাওয়া আর পাওয়া দুই-ই বরবাদ হয়ে যেত।

বলে ফেলার পর দীপুদার অন্য সুর।—মা নিষেধ করেছিল, কিন্তু আমার মনে হয়েছে তোমার জেনে রাখাই ভালো। আমার মুখ থেকে শুনেছ মিষ্টিকে বোলো না যেন—দুদিন আগে হোক পরে হোক ও নিজে তো বলবেই তোমাকে।

বাপী বলেনি।

মিষ্টির থেকে থেকে বাপীর ওপরেই রাগ হয় এখন। এত বড় ব্যবসার কোনো কিছু চোখ এড়ায় না। বানারজুলি থেকে সময়ে আবু রব্বানীর চিঠি না এলে এখান থেকে টেলিগ্রাম যায়। সব কে-কেমন আছ জানাও। ঊর্মিলার চিঠি পেলে মিষ্টিকে তাগিদ দিয়ে জবাব লেখায়। জিতের আবার ছেলেপুলে হবে, তার বউ অ্যানিমিয়ায় ভুগছে। কিন্তু জিতের থেকেও চিন্তাভাবনা বেশি তার মালিকের। থোক থোক টাকা দিচ্ছে, খবর নিচ্ছে। বাচ্চুর দিকেও কড়া দৃষ্টি, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা। একমাত্র মিষ্টির সঙ্গেই যেন শুধু ভোগ-দখলের সম্পর্ক ষোল আনা ছেড়ে আঠের আনা।

খুব সুবিচার করছে না ঠাণ্ডা মাথায় মিষ্টি নিজেই বোঝে। এই সম্পর্কে ভোগদখলের থেকে সমর্পণ ঢের বেশি। আসলে রাগ হয় অন্য কারণে। নিজের দুশ্চিন্তা সম্পর্কে এই লোককে সেধে সজাগ করতেও সংকোচ। কিন্তু এত যার বুদ্ধি-বিবেচনা আর সবেতে এমন প্রখর দৃষ্টি, এতদিনে এ-ব্যাপারেও তো তার নিজে থেকেই সচেতন হওয়ার কথা। হলে মিষ্টির পক্ষেও সংকোচ ঝেড়ে সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়ানো সহজ হত। ও এখনো একেবারে হাল ছেড়ে বসে নেই! এরকম কেস নিয়ে বিদেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে শুনছে। দরকার হলে তাদেরও বাইরে চলে যাওয়া তো জলভাত ব্যাপার। কিন্তু এ-ব্যাপারে ওই মানুষের এতটুকু হুঁশ নেই দেখেই মিষ্টির কখনো রাগ, কখনো অভিমান।

এই মানসিক অবস্থার মধ্যে হঠাৎ বড় রকমের ধাক্কা খেল একটা। দিন কয়েক আগে মিষ্টির কাছে ঊর্মিলার চিঠি এসেছে। তার শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছে না লিখেছে। খুব অস্পষ্ট একটু ইঙ্গিতও আছে চিঠিতে যা পড়ে শুধু মেয়েরাই সন্দিগ্ধ হতে পারে। মিষ্টি সেটা ধরিয়ে দিতে খুশি মুখে বাপী পারলে তক্ষুনি তাকে পাল্টা চিঠি লিখতে বসিয়ে দেয়। তাগিদ সত্ত্বেও তিন দিনের মধ্যে লেখা হয়ে ওঠেনি। বিকেলে বাইরের ঘরে বসে বাচ্চু কাকুর কাছে তাদের স্কুলের খেলার গল্প ফেঁদে বসেছে। মিষ্টিও শুনছিল। আর এক-ফাঁকে উঠে গিয়ে চট করে চিঠিটা লিখে ফেলবে কিনা ভাবছিল। ওদিকে মনে পড়লেই বকুনি খেতে হবে।

কলিং বেল বেজে উঠল।

দরজা দুটো ভেজানো ছিল। বাপী সাড়া দিল, কাম ইন!

দরজা ঠেলে ঘরে পা ফেলল সন্তু চৌধুরী। পরনে দামী ট্রাউজারের ওপর সিল্কের শার্ট, কব্জিতে সোনার ব্যান্ডের ঘড়ি, দু-হাতের আঙুলে জেল্লা ঠিকরনো আংটি। লম্বা ফর্সা বলিষ্ঠ অপরিচিত মানুষকে খবর না দিয়ে সরাসরি দোতলায় উঠে আসতে দেখে মিষ্টি বাপীর দিকে তাকালো। প্রসন্ন মনে হল না তাকে।

সন্তু চৌধুরীর পিছনে আরো কেউ আছে কিনা বাপী ঝুঁকে দেখে নিল। তারপর নীরস স্বরে বলল, সন্তুদা যে…

ঘুরে বাচ্চুকে বলল, ভিতরে যা।

ছেলেটার দিকে চোখ পড়তেই মিষ্টি বুঝে নিল কে হতে পারে। বাচ্চু উঠে চলে গেল। কি করবে ভেবে না পেয়ে মিষ্টিও উঠে দাঁড়াল।

বাচ্চুকে এখানে দেখেই সন্তু চৌধুরীর ফর্সামুখ রাগে লাল। ওকে ভিতরে চলে যেতে বলা হল তাও কানে গেছে। সপ্রতিভ গাম্ভীর্যে এগিয়ে এলো। মিষ্টির মুখের ওপর কপালে সিঁথিতে সিন্দুর আরো ঘরোয়া বেশবাস দেখে কে হতে পারে আঁচ করেছে। আর বাপীর মনে হল সেদিনের হা-ঘরে ছেলের এই বরাত দেখে ও লোকটার বুক চড়চড় করছে। চোখ তুলে আলতো করে একবার তাকাতে মিষ্টি বুঝে নিল, ভব্যতার দায় কিছু নেই, সে-ও ভিতরে যেতে পারে।

ঘরের দিকে পা বাড়াতে পিছন থেকে বেশ অবাক সুরের প্রশ্ন কানে এলো, সঙ্গে সঙ্গে সরস জবাবও।

—তোমার মিসেস নাকি?

—একেবারে নির্ভেজাল।

মিষ্টি আড়ালে চলে গেল বটে, কিন্তু দূরে নয়। যে এলো তার থেকে ঘরের লোকের হাবভাব দেখে ওর বেশি দুশ্চিন্তা

বাপী বলল, বোসো, হঠাৎ কি মনে করে?…

—হঠাৎ নয়, বিলেত থেকে ফিরে তোমার অনেক খোঁজ করেছিলাম। ফ্ল্যাট ছেড়ে বাড়ি করেছ কি করে জানব। ফোন গাইডেও তোমার নিজের নাম নেই। দিন কয়েক আগে খবরের কাগজে হঠাৎ হার্ব-ডিলার রাই অ্যান্ড তরফদারের বিজ্ঞাপনে টেলিফোন নম্বর দেখে তোমার বউদি অনেকটা আন্দাজেই ফোন করেছিল। তোমার অফিস থেকে খবর পেল তুমি এ-বাড়িরই দোতলায় থাকো। খুব ঠাণ্ডা গলায় বাপী জিজ্ঞাসা করল, আমাকে এত খোঁজাখুঁজির কারণ কি? চাপা ঝাঁঝে সন্তু চৌধুরী জবাব দিল, বাচ্চু তোমার ঘাড়ে পড়ে আছে সেই সন্দেহ আমাদের হয়েছিল। দু বছরের ওপর নিজের ছেলের একটা খবর পর্যন্ত না পেলে মায়ের মন কেমন হয় সেটা ওই রাসকেল বুঝতে না পারুক, তোমার বোঝার কথা।

…কার কথা বলছ, মণিদার?

সন্তু চৌধুরী জবাব দিল না। ঝাঁঝালো মুখ

বাপী আরো শান্ত।—যা বললে, দ্বিতীয়বার উচ্চারণ কোরো না, ওই ভদ্রলোক আমার দাদা।

সন্তু চৌধুরীর ছোট চোখজোড়া খাপ্পা হয়ে উঠল।

একই সুরে বাপী আবার বলল, বাচ্চুকে কেউ আমার ঘাড়ে চাপায়নি, আমিই ওকে নিয়েছি।

রূঢ় স্বরে সন্তু চৌধুরী বলল, এখন আমরা যদি ওকে নিয়ে যেতে চাই?

—আমরা বলতে তুমি আর কে?

সন্তু চৌধুরী থমকালো একপ্রস্থ। মুখ আরো লাল।—ওর মা যদি নিতে চায়?

—ওর মা বলে কেউ আছে আমি ভাবি না। আর কিছু দিন গেলে বাচ্চুও ভাববে না।

দু চোখ ধক ধক করছে সন্তু চৌধুরীর। সেদিনের সেই করুণাপ্রার্থীর মত স্পর্ধা ভাবতে পারে না। চেঁচিয়ে উঠল, ধরাকে সরা দেখছ এখন তাহলে, মস্ত একজন হয়ে গেছ, কেমন? নিতে চাইলে তুমি ঠেকাতে পারবে?

—চেষ্টা করে দেখ। গলা চড়িও না, ছেলেটা শুনতে পাবে।

—চড়ালে তুমি কি করবে?

—গলাধাক্কা খাবে।

সন্তু চৌধুরী ছিটকে উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছাকাছি গিয়েও আবার ফিরল। দুচোখে গলগল করে তপ্ত বিষ ঝরছে।—অপমান মনে থাকবে, নিজের চরিত্র ভুলে এখন এতবড় সাধু হয়ে উঠেছ জানা ছিল না।

বাপী আস্তে আস্তে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মুখে একটি কথাও বলল না। আরো কিছু জানানোর জন্যে ধীরে সামনে এগলো।

মুহূর্তে বিপদ বুঝে সন্তু চৌধুরী এক ঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

ওদিক থেকে মিষ্টি ছুটে এসে বাপীকে টেনে ফেরালো। দু কাঁধ ধরে জোর করে তাকে সোফায় বসিয়ে দিতে দিতে বলে উঠল, এ কি কাণ্ড—অ্যাঁ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি—বোসো বলছি। সত্যি তুমি ভদ্রলোককে মারতে যাচ্ছিলে?

—ও ভদ্রলোক নয়।

—খুব হয়েছে। ঠাণ্ডা হয়ে বোসো এখন

—বাচ্চু কি করছে?

—ওর ঘরে কাঠ হয়ে বসে আছে।

বাপী বলল, ঠিক আছে, তুমি ওর কাছে যাও।

সোফায় হাত রেখে মিষ্টি দাঁড়িয়ে রইল একটু। পুরুষের এত সংযত অথচ এমন ভয়-ধরানো মূর্তি আর দেখেছে? এদিক-ওদিক দেখে নিল। তারপর চট করে দু-হাতে বাপীর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়েই দ্রুত ভিতরে চলে গেল।

.

দুদিন বাদে বিকেলের দিকে মিষ্টি নিউ মার্কেট থেকে ফিরল। যখন বেরোয় বাপী বাড়ি ছিল না। মিষ্টি ফেরার আগে ফিরেছে। বাইরের ঘরে বসেছিল। বলাই তাকে বলেছে দিদিমণি গাড়ি নিয়ে মার্কেটে গেছে। কিন্তু ফিরল খালি হাতে বাপী খেয়াল করল না। ও কাছে আসতে খুশি মুখে বলল, জিতের এবারও ছেলেই হয়েছে—মেয়ের ইচ্ছে ছিল খুব।

কিছু না বলে মিষ্টি চুপচাপ ঘরে চলে যাচ্ছিল। বাপীর তখুনি আবার মনে পড়ল কি। ডাকল, শোনো! ঊর্মিলার চিঠির জবাব দেওয়া হয়েছিল তো?

মিষ্টি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। থমথমে মুখ। চোখে চোখ।—না।

—কেন? সঙ্গে সঙ্গে বিরক্ত।

—আমার সময় হয়নি, হবেও না। তুমি নিজে লেখো।

চলে গেল।

বাপী ভেবাচাকা খেয়ে গেল প্রথমে। কি হতে পারে ভেরে নিল। ওর নিজের মনে চাপা দুঃখ থাকতেই পারে, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তা বলে এমন থমথমে মুখ দেখবে বা এমন কথা শুনবে ভাবা যায় না। বাপীর মনে মিষ্টির জায়গা ঈর্ষার অনেক ওপরে। অন্যের আনন্দে খুশি না হতে পারাটা ঈর্ষা ছাড়া আর কি? বাপীরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আশা করল, একটু ঠাণ্ডা হবার পর নিজেই লজ্জা পাবে। ঠাণ্ডা করার উদ্দেশ্যে উঠে সে-ও হাসিমুখেই ঘরে এলো।

মিষ্টি চুপচাপ খাটে বসে আছে। তেমনি থমথমে মুখ

—কি ব্যাপার?

জবাবে মিষ্টি অপলক চেয়ে রইল।

বাপীর খটকা লাগল একটু। মনে হল, দু চোখে তার ভেতর দেখছে।

এই মূর্তি কেন?

এবারে জবাব দিল। ফিরে জিজ্ঞাসা করল, বলব? তোমার আমার মধ্যে লুকোচুরির কিছু থাকতে পারে না, তবু বললে ঠাণ্ডা মাথায় বরদাস্ত করতে পারবে?

যে গোপনীয় ব্যাপারটা এত দিন ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল সেটাই কবুল করবে ধরে নিয়ে হাসি চেপে বাপীরও নিজের মুখখানা সীরিয়াস করে তোলার চেষ্টা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে বসার কুশনটা টেনে নিয়ে ওর দুই হাঁটুতে প্রায় হাঁটু ঠেকিয়ে মুখোমুখি বসল।—পারব। মিষ্টির সবই আমার কাছে মিষ্টি। বলে ফেলো।

উঠে সামনের দরজা দুটো ভেজিয়ে দিয়ে মিষ্টি আবার জায়গায় ফিরে এলো।——তোমার গৌরী বউদির সেই ভদ্রলোক একটু আগে আমার ওপর দিয়ে তার সেদিনের অপমানের শোধ নিল। সেই মহিলাও পাশে ছিল।

বাপীর সত্তাসুদ্ধ আচমকা ঝাঁকুনি খেল একপ্রস্থ। তপ্ত রক্তকণার ছোটাছুটি। জায়গায় ফিরে স্থির হতে সময় লাগল।—কি অপমান করেছে?

মিষ্টির দু চোখ তার চোখে বিঁধে আছে।—মার্কেটে মুখোমুখি দেখা হয়ে যেতে খুব খুশির বিনয়ে তোমার বউদির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। সম্মান দেখিয়ে আমার সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বলল। তুমি কত বড় একজন হয়েছ দুবার করে শোনালো। তারপর আমাকে কংগ্র্যাচুলেট করে বলল, এমন মস্ত মানুষের ঘরে আমাকে আশা করেনি, অন্য একজনকে দেখবে ভেবেছিল।

—কেন? বাপীর দুই চোয়াল শক্ত।

—গাড়িতে আর একজনের অবাঙালী সুন্দরী বউকে পাশে বসিয়ে তোমাকে আনন্দে হাওয়া খেয়ে বেড়াতে দেখেছে। শুধু সে নয়, তোমার বউদিও দেখেছে। গাড়িতে সেই মেয়েকে বসিয়ে রেখে তুমি নাকি নেমে এসে তাদের সঙ্গে কথাও বলেছ। তুমি তাদের বলেছ, নিজের বউ নয়, অন্যের বউ। তাই আমার বদলে তাকে এখানে দেখবে আশা করেছিল।

বাপীর তখুনি মনে পড়ল। অল্প অল্প মাথা নেড়ে বলল, একদিন দেখেছে — ঠিকই দেখেছে।—তাহলে একথা শুনেই তোমার সব বিশ্বাস ধ্বসে গেছে?

মিষ্টি চেয়ে আছে। নিরুত্তর।

—সেই আর একজনের সুন্দরী বউকে তুমিও দেখেছ। তার নাম ঊর্মিলা। গাড়িতে পাশে সে ছিল। সেই একই দিনের কথা—তোমার অফিস থেকে তাকে নিয়ে ফেরার পথে পার্ক স্ট্রীটের রাস্তায় তাদের সঙ্গে দেখা।

মিষ্টি অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা সুরে বলল, সেদিনের কথা জানতাম না, তবে আমারও উর্মিলা বলেই মনে হয়েছিল।

—তাহলে? সে আর কি অপমান করেছে তোমাকে?

মিষ্টি চেয়ে রইল একটু।—শুনলে তোমার মাথা খুব ঠাণ্ডা থাকবে মনে হয় না।

—আমার মাথা সম্পর্কে তোমারও খুব ধারণা নেই। বলো।

—প্রথমবার কলকাতায় এসে তুমি কয়েকমাস বাচ্চুর বাবা-মায়ের আশ্রয়ে ছিলে নিজেই বলেছিলে। আজ শুনলাম বয়সে অত বড় বউদির দিকে তোমার চোখ গেছল বলেই সেখান থেকে তোমাকে তাড়ানো হয়েছিল। সত্যি কিনা তোমার বউদিকেই জিজ্ঞাসা করতে বলল। আমি জিজ্ঞেস করিনি। তোমার বউদি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল।

এ-ই শুনবে বাপী জানত। কুশন ঠেলে ঘরের মধ্যে একবার পায়চারি করে আবার মিষ্টির সামনে এসে দাঁড়াল।—আমার ভিতরের জানোয়ারকে তুমি ছেলেবেলায় দেখেছ। পরেও তার চোখ অনেকবার অনেক দিকে গেছে। কিন্তু বাপী তরফদার তোমাকে ছাড়া আর কাউকে চায়নি বলে চাবুক খেয়ে ওটাকে চোখ ফেরাতে হয়েছে। বাচ্চুর মা কোথায় কোন্ বাড়িতে থাকে জানে কিনা ওকে জিগ্যেস করে এসো!

আগের কথায় ধাক্কা খেয়েছিল। এবারে মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি প্রমাদ গুনল।—জেনে কি হবে, তুমি সেখানে যাবে?

—না গেলে সন্তু চৌধুরী যা বলেছে তার কতটা সত্যি তুমি জানবে কি করে?

উঠে দু-হাত ধরে মিষ্টি তাকে বিছানায় বসাতে চেষ্টা করল। আর কিচ্ছু জেনে কাজ নেই—অপমানে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছল।

তখনকার মতো বাপী ঠাণ্ডা হল বটে, কিন্তু তার পর থেকে সমস্তক্ষণ গুম হয়ে থাকল। সন্ধ্যা পর্যন্ত এ-ঘর ও-ঘর করল। মিষ্টিকে সামনে দেখলে দাঁড়াচ্ছে। দেখছে। আবার অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। একটু বাদে একটা বই খুলে বসল। কি বই মিষ্টি জানে। আরো দুই-একদিন এ-বইটার পাতা ওল্টাতে দেখা গেছে। নেপোলিয়ন হিল-এর থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ। রিচ অর্থাৎ বড়লোক হওয়ার রাস্তা দেখানো হয়েছে ভেবে কৌতূহলী হয়ে মিষ্টিও বইটা উল্টেপাল্টে দেখেছিল। আগাগোড়া মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার দেখে পড়ার উৎসাহ হয়নি।

রাতে চুপচাপ।

মিষ্টির এতক্ষণের চাপা অস্বস্তি এবারে বুকে চেপে বসল।—যেমন মা-ই হোক, ছেলের জন্য কাতর হওয়া স্বাভাবিক। বাচ্চুর মা-ও অনেক কষ্টে ছেলের হদিস পেয়েছে। সেই সঙ্গে ওই ছেলের এখন একমাত্র আশ্রয় কে বা কারা তাও জেনেছে। তবু ছেলের মুখ চেয়েও মহিলা ওই লোকটার অমন কুৎসিত কথাগুলোর প্রতিবাদ করল না কেন? সত্যের ছিটেফোঁটাও না থাকলে ওভাবে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারল কি করে?

এর জবাব পরদিন পেল। স্কুল থেকে ফিরে জলখাবার খেয়ে বাচ্চু তার ঘরে গেছে, মিষ্টি ডাইনিং টেবিলে বসে। বাপী নিচের অফিস ঘরে। উঠে এলে একসঙ্গে চা খাবে।

সময় ধরেই উঠে এলো। একলা নয়, তার পিছনে আরো একজন। —মিষ্টি, গৌরী বউদি, তোমার কাছে এসেছেন।

মিষ্টি নির্বাক কয়েক মুহূর্ত। সহজাত সৌজন্যে উঠে দাঁড়ানোর কথা। পারা গেল না। অস্ফুট স্বরে বলল, বসুন।

বসল। বেশ সহজ সুরে বলল, বেশি বসার সময় নেই ভাই। বাপীর দিকে ফিরল। চোখে একটু হাসির আভাস।—বউয়ের নাম মিষ্টি তুমি রেখেছ না ও-ই \\নাম?

৬৪৩

বাপীও হাল্কা জবাব দিল, আমার কোনো কেরামতি নেই।

গৌরী বউদি মুখে আর নামের সঙ্গে চেহারার মিলের প্রশংসা করল না। তাড়ার মধ্যে কিছু দরকারী কাজ সেরে যাওয়ার মতো করে বলল, তোমার কাছেই একবার এলাম ভাই…

মহিলার রীতি জানা নেই মিষ্টির। গ্লানি বা পরিতাপ-কাতর মুখ দেখছে না।—কাল যা শুনে এসেছি তা সত্যি নয় জানাতে? গলার স্বর সংযত হলেও সদয় নয় খুব।

গৌরী বউদি তক্ষুনি জবাব দিল, হ্যাঁ। সব মিথ্যে।

—কিন্তু কাল তো একটি কথাও বললেন না?

গৌরী বউদি চুপচাপ চেয়ে রইল একটু। জবাব দিল, কেন বললাম না, না বুঝে থাকলে বাপীকে জিগ্যেস কোরো।

প্রায় আধ মিনিট কারো মুখে আর কথা নেই। গৌরী বউদি চেয়ার ছেড়ে উঠল। বাপীকে বলল, তোমার বউভাগ্য ভালো, এর থেকে ঢের বেশি রাগ দেখব ভেবেছিলাম। চলি—

বাপী পলকে ভেবে নিল কি। গলা চড়িয়ে ডাকল, বাচ্চু!

বাচ্চু এলো। তারপরেই আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কে এসেছে জানত না গৌরী বউদি ওর আপাদমস্তক দেখে নিল একবার। সহজ সুরেই জিজ্ঞাসা করল, কি রে কেমন আছিস?

গলা দিয়ে স্বর বেরুলো না ছেলেটার। সামান্য মাথা নাড়ল। ভালো আছে। গৌরী বউদি চুপচাপ দেখল আর একটু। বলল, সব সময় কাকা কাকিমার কথা শুনে চলবি।…

দরজার দিকে পা বাড়ালো। বাপী এগিয়ে এলো।

নীচে গৌরী বউদির ট্যাক্সি অপেক্ষা করছিল। তাকে তুলে দিয়ে বাপী দু—মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো। বাচ্চু ঘরে চলে গেছে। বলাই তক্ষুনি চায়ের পট আর পেয়ালা সাজানো ট্রে রেখে গেল।

বাপী চেয়ার টেনে মিষ্টির মুখোমুখি বসল। চা ঢেলে মিষ্টি একটা পেয়ালা তার দিকে এগিয়ে দিল।

বাপী বলল, গৌরী বউদিকে এক পেয়ালা চা খেয়ে যেতে বললে পারতে। নিজের পেয়ালা মুখের দিকে তুলতে গিয়ে মিষ্টি থমকে তাকালো। চেয়েই রইল একটু। বলল, কি জানি, আমি জানতাম বাচ্চুকে তুমি ওই মায়ের ছায়াও মাড়াতে দিতে চাও না, তাছাড়া সেদিন আর একটা লোককে তুমি গলাধাক্কা দিতে গেছলে দেখে আজ আরো এই ভুলটা হয়ে গেল।

প্রচ্ছন্ন শ্লেষটুকু বাপী চুপচাপ হজম করে গেল। ভিতরে একটু অসহিষ্ণুতার তাপ ছড়িয়ে আছে। কেন, নিজেও জানে না। মনের অনুভূতিগুলো সর্বদা যুক্তির পথে চলে না। তাই কেউ বুঝতেও পারে না। যেমন এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে সমস্ত অতীত মুছে দিয়ে এই গৌরী বউদিকে যদি মণিদার কাছে আর তাদের ছেলের কাছে ফিরিয়ে এনে দিতে পারত—দিত। তা হবার নয় বলেই ক্ষোভ হয়ত। কিন্তু মিষ্টি এই ক্ষোভের কি অর্থ খুঁজে পাবে?

একটু বাদে মিষ্টিই আলতো করে জিজ্ঞাসা করল, অপবাদ দিয়ে তোমাকে তোমার দাদার বাড়ি থেকে তাড়ানোর কথাটাও মিথ্যে তাহলে?

পেয়ালা সামনে রেখে বাপী সোজা হয়ে বসল। সোজা তাকালো। দুজনের মধ্যে কোনো গোপনতা থাকবে না বলেছিল। এই গোপনতার সবটুকু ছিঁড়েখুঁড়ে দিলে কি হয় দেখার তাড়না। জবাব দিল, খুব সত্যি।

মিষ্টি থতমত খেল। অপবাদ সত্যি হলেও এই মুখ দেখবে ভাবেনি। আরো শোনার প্রতীক্ষায় চেয়ে রইল।

চোখে চোখ রেখে ঠাণ্ডা গলায় বাপী বলল, কাল আমার ভেতরের যে জানোয়ারটার কথা তোমাকে বলেছিলাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও গৌরী বউদি সেটাকে ঠিক দেখেছিল। দেখে প্রশ্রয় দিতে চেয়েছিল। তার আগে জানোয়ারের টুটি টিপে ধরে বাপী তরফদার ছিটকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল বলেই ও-বাড়িতে আর ঠাঁই হয়নি।

নিখাদ সত্যের আলোয় এসে দাঁড়ানোর ফল দেখল বাপী। মিষ্টির চোখে প্রথমে অবিশ্বাস, তারপর সমস্ত মুখ লাল। পাহাড়ের বাংলোয় রেশমার কথা শুনে বুক ভরে গেছল, আজকের অনুভূতিটা তার বিপরীত ধাক্কার মতো। চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে চুপচাপ উঠে চলে গেল।

কিন্তু বাপীর হাল্কা লাগছে। এই সত্যের স্বাদটুকু বিচিত্র লাগছে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *