সোনার হরিণ নেই – ৩৪

চৌত্রিশ

যত দোস্তিই থাক, মালিকের সম্মান আবুর কাছে কম নয়। তার হুট করে এসে হাজির হওয়াটা পছন্দ হবে কিনা সেই সংশয়ও আছে। হাসি মুখে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। জিও।

আবুর পরনে ধবধবে সাদা চোস্ত, গায়ে জালি গেঞ্জির ওপর রঙিন ফুলকাটা সাদা পাঞ্জাবি, তার ওপর গাঢ় খয়েরি রঙের চকচকে মেরজাই। হঠাৎ মনে হবে ইতিহাসের পাতা থেকে কোনো নবাবজাদা উঠে এসেছে। ওকে দেখে বাপী কত খুশি মুখ দেখে বোঝা যাবে না। বানারজুলি টানছিল। আবু রব্বানী নিজেই তার চোখে অনেকখানি বানারজুলি। তবু ওকে আরো একটু বিব্রত করার কৌতুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘটা করে দেখে নিয়ে চোখে চোখ রাখল।

আবুর ফাঁপরে-পড়া মুখ! বলে উঠল, ঘাট হয়েছে জনাব, মালের সঙ্গে চালান হয়ে এসে গেছি, কালই আবার ট্রাকে চেপে ফেরত চলে যাব।

বাপীর হাবভাব দেখে আর আবুর কথা শুনে অসিত চ্যাটার্জি আর জিও মজা পাচ্ছে। বাপীর ঠোঁটে হাসি একটু এসেই গেল। এগিয়ে এসে দু’হাত আবুর দুই কাঁধে তুলে দিল। তারপর সামান্য চাপ দিয়ে আবার তাকে সোফায় বসিয়ে দিল। সামনের সোফায় নিজেও বসল। —কখন এসেছ?

দেড় ঘণ্টা হয়ে গেল। তোমার ট্রাক গুদোমে এসে দাঁড়াতেই জিত্‌ সাহেব সব ছেড়ে আগে আমাকে খালাস করে সোজা তোমার এখানে এনে তুলল। তুমি নেই দেখে গাঁটের পয়সা খরচা করে অনেক খাওয়ালে।

আবুকে জিতের একটু খাতির করারই কথা। একে মুরুব্বী মানুষ এখন, তার ওপর ওর সুপারিশের জোরেই সুদিনের মুখ দেখছে।

হাসিমুখে বাপী অসিত চ্যাটার্জির দিকে ফিরল।——অসিতদা কতক্ষণ?

—অনেকক্ষণ। সময়ে এসে গেছিলাম তাই আমিও চপ কাটলেট রসগোল্লা সন্দেশ থেকে বাদ পড়িনি—তুমি শুধু ফসকালে

বাপী মনে মনে জিতের বুদ্ধির তারিফ করল। দু একদিন দেখে এই লোককেও খাতিরের পাত্র ধরে নিয়েছে। আবুর দিকে ফিরল। ঠোঁটের হাসি চোখে ঠিকরলো। অসিতদার সঙ্গে গল্প তো করছিলে দেখলাম—কি, বুঝতে পেরেছ?

আবু খুশিতে ডগমগ।—আমি কি এত বোকা বাপীভাই, তুমি ওঁর বিবিসাহেবার ছেলেবেলার বন্ধু শুনেই ধরে ফেলেছি। এতক্ষণ তো বহিনজির ছেলেবেলার গল্পই বলছিলাম জামাই সাহেবকে—একবার তুমি যে তাকে পেল্লায় ময়াল সাপের গেরাস থেকে ছিনিয়ে এনেছিলে তাও জামাইসাহেব আমার কাছ থেকে এই প্রথম শুনলেন। ওঁকে দেখে আমাদের সেই ফুটফুটে ছোট্ট বহিনজি এখন কেমনটি হয়েছেন খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

আবু পদস্থ হয়েছে বটে। আগের দিনে পড়ে থাকলে মেমসায়েবের মেয়েকে বহিনজি না বলে মিসি সায়েবটায়েব কিছু বলত। বাপী সাদা মুখ করে সায় দিল, দেখে এসো—অসিতদাকে বলো।

হৃষ্টমুখে আবু জবাব দিল, বলতে হবে না, আমি অলরেডি ইনভাইট!

বাপী হেসে ফেলল, আবার ইংরেজি কেন!

অসিত চ্যাটার্জি আর জিও হাসছে। আবু মাথা চুলকে বলল, গড়বড় হয়ে গেল বুঝি—কি করব, তোমাদের কলকাতার বাতাসের দোষ, জিভে সুড়সুড় করে ইংরেজি বেরিয়ে আসে।

চাকরিতে বহাল হবার পর জিত্ মালহোত্রা এই প্রথম বোধ হয় মালিকের হালকা মেজাজের হদিস পেল। সকলকে ছেড়ে বাপীর পলকা গম্ভীর মনোযোগটা হঠাৎ জিতের দিকে।—মিস্টার চ্যাটার্জি মানে অসিতদার সঙ্গে তোমার কত দিনের আলাপ?

যে-রকম চেয়ে আছে আর যে ভাবে বলল, যেন গলদ কিছু ধরা পড়েছে। অপ্রতিভ জিত্ জবাব দিল, আগে কয়েকবার এখানে দেখেছি…আলাপ আজই। বাপী আরো গম্ভীর।—তুমি তো বুদ্ধির ঢেঁকি দেখি, মিস্টার চ্যাটার্জি একজন আর-এ, চার্টারড অ্যাকাউন্টেন্টের সগোত্র, আর এক মস্ত তেল কোম্পানির চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট—এ খবর রাখো?

কি বলতে চায় কেউই বুঝছে না। আবু দোস্তকে দেখছে। অসিত চ্যাটার্জির বদনের সলজ্জ আভায় সোনালি চশমা চিকচিক করছে। ফ্যাসাদ শুধু বেচারা জিতের। খবর রাখে না যখন মাথা নাড়া ছাড়া আর উপায় কি

বাপীর পালিশ করা মুখ।—তিন মাস ধরে খাতাপত্রের হাল কি করে রেখেছ তুমিই জানো। সব ঠিকঠাক করে দেবার ব্যাপারে সাহায্য করার মতো এমন আর একজন কলকাতা শহর চষে পাবে?

আবুর চোখে কৌতুক। অসিত চ্যাটার্জির ফর্সা মুখ খুশিতে টসটসে। এতক্ষণে মনিবের ইশারার হদিস পেয়ে জিতের অমায়িক বদন। পারলে এক্ষুনি গুণী মানুষটির তোয়াজ তোষামোদ শুরু করে দেয়। হালকা মেজাজে বাপী অসিত চ্যাটার্জিকে সতর্ক করল।—জিত্ এরপর তোমাকে ছেঁকে ধরবে অসিতদা, ওর তোয়াজে ভুলো না, হাত দিয়ে ওর জল গলে না—সাহায্য চাইলেই পঁচিশ পারসেন্ট চড়িয়ে ফী হাঁকবে।

বাড়তি রোজগারের লোভ আছেই। চড়িয়ে ফী হাঁকলে শেষ পর্যন্ত সেটা কার ঘাড়ে গিয়ে পড়বে ভেবে না পেলেও অসিত চ্যাটার্জির চোখে জিতের কদর বেড়ে গেল। ফলে অন্তরঙ্গ হাসি মুখ তার দিকে ফিরল।—ফী-এর জন্য কি আছে, দরকার হলেই বলবেন। আপিসের দশটা-পাঁচটা ছাড়া অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস।

চতুর জিতের দুকুল বজায় রাখার চেষ্টা। সপ্রতিভ মুখে সে মাথা নাড়ল, থ্যাংক্‌স।

আবুর আসাটা বাপী একটা বড় উপলক্ষ করে তুলল। রাতের খাওয়া-দাওয়ার আগে আজও অসিত চ্যাটার্জিকে ছাড়ল না। বলাই তার রোশন বাবুর্চির তৎপরতায় আয়োজনে কার্পণ্য নেই। খাওয়ার আনন্দের মধ্যে বাপী বলল, এক জিনিসের অভাবে তোমার সবটাই নিরামিষ লাগছে বোধ হয় অসিতদা, কিন্তু আজ তুমি কথার খেলাপ করলে না দেখে মিলু নিশ্চয় খুশি হবে।

অভাব কোন্ জিনিসটার বুঝতে আবু বা জিতেরও অসুবিধে হল না। লজ্জা পেয়ে অসিত চ্যাটার্জি বলল, কি যে বলো, আমি কি রোজই ওসব খাই নাকি— সঙ্গে সঙ্গে আবুর আফসোস।—জামাই সাহেবের চলে জানলে আমি তো গোটা কয়েক বাছাই মাল নিয়ে আসতে পারতাম!

সোনালি চশমার ওধারে দু’চোখ উৎসুক।—ওদিকে ভালো ভালো জিনিস পাওয়া যায় বুঝি?

বাপী জবাব দিল, নেপাল ভুটানের ও-সব জিনিস এদিকে তো দেখতেই পাও না তোমরা। আবুর দিকে ফিরল, হবে’খন, অসিতদা তো পালিয়ে যাচ্ছে না—। খাওয়ার পর্ব শেষ হতে জিকে বলল, দু’জনেই তো সাউথে যাবে, একটা ট্যাকসি ধরে অসিতদাকে নামিয়ে দিয়ে যাও।

তারা চলে যেতে আবু সোফায় বসে মৌজ করে একটা বিড়ি ধরাবার ফাঁকে দোস্ত-এর মুখখানা দেখে নিচ্ছে। চোখাচোখি হতে বাপীর ঠোঁটে হাসি ছড়ালো। ঊর্মিলা দূরে চলে গেছে। কাছের মানুষ বলতে এখন শুধু এই একজন।

ভণিতা ছেড়ে আবুও সোজাসুজি চড়াও হল। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, শুধু জামাই-আদর নয়, বেশ একটা টোপও ফেললে মনে হল?

বাপী হাসছে।—কেন, খাতা-পত্র ঠিক রাখার দরকার নেই?

আবু মাথা নাড়ল।——আগের মতো তোমার ভেতর-বার এক লাগছে না বাপীভাই।—ভদ্রলোক সত্যি অত গুণের মানুষ নাকি?

ছদ্ম গাম্ভীর্যে বাপী সায় দিল, হ্যাঁ, তার অনেক গুণ।

আবু তবু অপেক্ষা করল একটু। তারপর একটা বড় নিঃশ্বাসের সঙ্গে বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আগের দিন আর নেই, নইলে তোমাকে ধরে ধরে গোটাকয়েক ঝাঁকানি দিলে ভিতরে যা আছে গলগল করে বেরিয়ে আসত। যাক, তার বিবিসাহেবের খবর কি?

—ভালোই। এয়ার অফিসে ভালো চাকরি করছে।

—তোমার সঙ্গে দেখা-টেখা হয়?

—ক্বচিৎ কখনো। আপাতত তার হাজব্যান্ডের সঙ্গেই বেশি খাতির।

আবু টান হয়ে বসল।—আপাতত?

বাপীর মগজে সূক্ষ্ম কিছু বুনুনির কাজ চলেছে। আবু রব্বানী হঠাৎ এভাবে চলে আসাটাও সামনে পা ফেলে এগোনোর মতো লাগছে। নিরীহ মুখে মাথা নেড়ে সায় দিল।

আবুরও ধৈর্য বাড়ছে। জিগ্যেস করল, এদের বিয়ে হয়েছে কদ্দিন?

—বছর আড়াই প্রায়

কৌতূহলে একটা চোখ আগের মতোই ছোট হয়ে এলো।—বাচ্চা কাচ্চা? এই সাদাসাপটা প্রশ্নের তাৎপর্য বেআব্রু গোছের ঠেকল বাপীর কানে। মাথা নাড়ল। নেই। আবুর জিভ আরো বেসামাল হবার আগে প্রসঙ্গ বাতিল। তোমার খবর কি বলো, হুট করে চলে এলে, দুলারি ছাড়ল?

রসের ঝাঁপি বন্ধ হয়ে গেল আবুও বুঝল। দোস্ত-এর পেট থেকে আপাতত আর কোনো কথা টেনে বার করা যাবে না। জবাব দিল, তোমার কাছে আসছি শুনে পারলে নিজেও ছুটে আসে।…আর, ছাড়াছাড়ির কি আছে, যে বোঝা কাঁধে চাপিয়েছ মাসের মধ্যে আট-দশ দিন বাইরেই কাটাতে হয়। কিন্তু তুমি কথা রাখলে যা-হোক—

কি কথা?

—আসার সময় কত রকম বুঝিয়ে এসেছিলে—হাওয়াই জাহাজে এক-দেড় ঘণ্টার পথ, দরকার হলে ফি হপ্তায় একবার করে চলে যাবে—তিন মাসেও একবার তোমার ফুরসৎ হল না?

বাপী বলল, দরকার হলে যেতাম। বেশ তো সামলাচ্ছ।

জবাবে গড়গড় করে আবু অনেক কথা বলে গেল। এবার থেকে দরকার যাতে হয় ফিরে গিয়েই সেই ব্যবস্থা করছে। তিন মাসের মধ্যে একবারও আসার নাম নেই দেখে দুলারিও সাত-পাঁচ ভেবেছে। ও জানে কলকাতা হুরী-পরীর দেশ—কেউ গেলে তাকে ভুলিয়ে রাখে। দোস্ত কোনো জ্যান্ত পরীর খপ্পরে পড়েছে কিনা সেই চিন্তাও করেছে। আবার আবুর আসার ব্যাপারেও খুঁত-খুঁত করেছে। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ গিয়ে হাজির হলে বাপীভাই নারাজ হবে কিনা চিন্তা। আবু বলেছে, নারাজ হয় হবে, কিন্তু দোস্তকে না দেখে আর সে থাকতে পারছে না?

বাপীর ভালো লাগছে। ঠিক এ-সময় ওকেই সব থেকে বেশি দরকার ছিল। কিন্তু মনে যা আছে এক্ষুনি ফাঁস করার তাড়া নেই। দিন-কতক ওকে ধরে রাখতে হবে। ওখানকার ব্যবসার খবর শুনল! লেখাপড়ায় দিগ্‌গজ বলে এখন একটু আফসোস আবুর। সে কারণে রণজিৎ চালিহার মতো একটু হম্বি-তম্বির চালে চলতে হয়। অসুবিধে খুব হচ্ছে না। কেবল বাপীভাই পাশে না থাকলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে, এই যা। বাপী পাহাড়ের বাংলোর বুড়ো ঝগড়ু, বাদশা ড্রাইভার আর কোয়েলার খবরও নিয়েছে। এর মধ্যে পাহাড়ের বাংলো থেকে ঝগড়ু একদিন নাচতে নাচতে নেমে এসেছিল। সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপার থেকে মেমসায়েবের মেয়ের চিঠি পেয়েছে। সেই চিঠি ওদের দেখাতে এসেছিল। তার ঊর্মি লিখেছে, ওদের কোনো চিন্তা নেই, নতুন মালিক সকলকে ভালো রাখবে। মালিকের পাত্তা নেই দেখে ওরা একটু ভাবনায় পড়েছিল।

কেন ওরা টাকা-কড়ি ঠিক মতো পাচ্ছে না?

—তা পাচ্ছে, কিন্তু বিয়ে-সাদি করে মালিকের কলকাতাতেই থেকে যাওয়ার মতলব কিনা সে-চিন্তা তো হতেই পারে।

বানারজুলির কথাপ্রসঙ্গে আবু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ধামন ওঝার ছেলে সেই হারমাকে মনে আছে তো তোমার?

—থাকবে না কেন, রেশমার হারমা…

—হারমার রেশমা বলো, বেঁচে থাকতে রেশমা ওকে পাত্তাই দেয়নি।

—হারমার কি হয়েছে?

—মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে। তুমি থাকতেই তো দিন-রাত রেশমার ঘর আগলে পড়ে থাকত, কেউ মুখ দেখতে পেত না। এখন আবার দিন ছেড়ে রাতেও বাইরে টো-টো করে বেড়ায়। ওর এখন মাথায় ঢুকেছে, চালিহা সাহেবের জন্য রেশমা সাপের ছোবল খেয়ে মরেনি—ও জান দিয়েছে তোমার জন্যে। কেউ বিশ্বাস করে না, দুলারিও ওকে ডেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু ওর ওই এক কথা—

বাপী সচকিত একটু।—সে কি? আমার ওপর খুব রাগ নাকি ওর?

—রাগ না…দুঃখু। বলে, তোমাদের উঁচু-মাথা বাপী সাহেব কেবল দিল্‌ কাড়তেই জানে, দিলের কদর জানে না।

.

রাতটা এরপর অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে কাটল বাপীর। আধ-ঘুমে মাথার মধ্যে একটা হিজিবিজি ব্যাপার চলতে থাকল। পাহাড়ী জঙ্গল…বুনো হাতি…. রেশমা পাহাড়ের বাংলো…নেশায় বুঁদ ঝগড়ু… রেশমা। বাপী… রেশমা…রণজিৎ চালিহা টাকা মদ—রেশমা। হারমা—রেশমা—হারমা—-রেশমা—

সকালে উঠে বাপী নিজের ওপরে বিরক্ত। কি দোষ করেছে? কোন দুর্বলতার প্রশ্রয় দিয়েছে? এত দিন পরেও এ-রকম টান পড়ে কেন? হারমা যা ভাবে ভাবুক। যা বলে বলুক। তাতে ওর মগজে দাগ পড়ে কেন?

সকালটা আবুর সঙ্গে গল্প-গুজবের পর কলকাতার ব্যবসার আলোচনায় কেটে গেল। সব দেখেশুনে আবু দোস্ত-এর তারিফ করল, তুমি যাতে হাত দাও তাই সোনা দেখি বাপীভাই!

প্রশস্তির জবাবে আঙুল তুলে বাপী জিকে দেখিয়ে দিল। বলল, জিত্ সঙ্গে থাকলে তার আর মার নেই, ওরও কেরামতি কম নয়। সঙ্গে সঙ্গে ছদ্ম আশঙ্কা। মাইনে বাড়ানোর চাপ দিলো বলে।

আবু অখুশি নয়। জিকে জোটানোর বাহাদুরি সবটাই তার। চিঠিতে দোস্ত এই লোকের প্রশংসা আগেও করেছে। তার ভাগ্য শিগগীরই আরো কিছু ফিরবে ধরে নিয়ে ভারিক্কি স্বরে মন্তব্য করল, চাপ দিলে আমি চোখ বুজে স্যাংশন করে দেব। বলে ফেলে সভয়ে বাপীর দিকে তাকালো।—স্যাংশনই তো বলে—না কি?

জিত্‌ হাসছে আর টেবিলের কাগজপত্র গুছিয়ে রাখছে। গায়ত্রী রাইয়ের কাছে মাসকয়েকের চাকরির কালে এই আবু রব্বানী তাকেও সেলাম ঠুকত। যার অনুগ্রহে লোকটার আজ এই কপাল, তার দাক্ষিণ্য থেকে সে-ও বঞ্চিত হবে না, তিন মাসে সেই বিশ্বাস আরো বেড়েছে।

আলতো করে বাপী বলল, জিত্ তোমার। অন্য স্যাংশনের আশায় অনেক দিন ধৈর্য করে বসে আছে—

মালিকের মনে কি আছে জিত্ নিজেও ধরতে পারল না। ঠাট্টার ব্যাপার কিছু কিনা না বুঝে আরো উৎসুক। দুজনারই কৌতূহল জিইয়ে রেখে বাপী জিগ্যেস করল, ডাটাবাবুর ক্লাবের সঙ্গে তোমার লাল জলের কারবার কেমন চলছে এখন?

—ফার্স্টো কেলাস। ক্লাব তো আছেই, প্রাইভেট প্র্যাকটিসও আগের থেকে বেড়েছে—রইস খদ্দেররা এসে অর্ডার পেশ করে যায়। কেন বলো তো?

—জিকে তুমি কলকাতার বাজার সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলে দিয়েছিলে? আবু মাথা চুলকে সায় দিল। বলল, আমার মনে হয়েছিল ওই জলের কারবার এখানে ভালো চলতে পারে।

—বানারজুলি থেকেও ঢের ভালো চলতে পারে। জিত্ খোঁজখবর নিয়ে জেনেছে কলকাতার মতো বাজার আর হয় না। আমি গা করছি না বলে ওর মেজাজ খারাপ।

আবু জিতের মুখখানা দেখে নিল। এ ব্যাপারে তার আগ্রহ সত্যি কম মনে হল না। দোস্ত ঠাট্টা করছে না বা বাড়িয়ে বলছে, না বুঝে তাকেই জিগ্যেস করল, তুমি তাহলে গা করছ না কেন?

বাপী প্রায় নিরাসক্ত।—এসে গেছ যখন নিজেই বুঝেশুনে নাও। ভালো বুঝলে শুরু করা যাবে।

দোস্তকে কাগজপত্রে মন দিতে দেখে আবু একটু বাদে বসার হলঘরে চলে এলো। দোস্ত দিনকতক থেকে যেতে বলেছে। সে সানন্দে রাজি। তাই ঘরে একটা চিঠি পাঠাতে হবে। দুলারি লিখতে পড়তে জানে না সে-জন্য আবুর এই প্রথম আপসোস একটু। নইলে দোস্ত-এর খবরাখবর দিয়ে বেশ রসিয়ে একখানা চিঠি লেখা যেত। কিন্তু পড়াতে হবে বড় ছেলেটাকে দিয়ে। সে ব্যাটা এখনই লায়েক হয়ে উঠেছে। ছোট সাইকেলে চেপে বানারহাটের স্কুলে যায়। চিঠিতে বেচাল কথা থাকলে ফিরে গিয়ে দুলারির মুখঝামটা খেতে হবে।

মনিবের হুকুমে জিত্ ড্রাইভারসুদ্ধু একটা ভালো প্রাইভেট গাড়ির সন্ধানে বেরুলো। তিন দিন সকাল-সন্ধ্যা ভাড়া খাটবে। আবুর জন্য দরকার। টাকা যা লাগে লাগবে। মালিককে বাদ দিলে ব্যবসায় আবু রব্বানীর মর্যাদা এখন সকলের ওপরে। সঙ্গে গাড়ি থাকলে এখানকার পার্টির কাছে সেই মর্যাদা বজায় থাকবে। কলকাতার ঠাট আলাদা। পার্টির সঙ্গে আলাপ পরিচয় করানোর জন্য মালিক নিজে তার জেনারেল ম্যানেজারকে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় কি করে। সে কাজটা জিত্ মালহোত্রা করলে বরং কোম্পানীর চটক বাড়বে। আর, এই কাজের ফাঁকে আবুর ইচ্ছেমতো কলকাতা দেখাও হবে।

মালিকের দরাজ মনের খবর জিত্ ভালোই রাখে। আজ আরো খুশি কারণ, আবু সাহেবের জন্য গাড়ি ঠিক করতে বলে মনিব তাকেও চটপট ড্রাইভিং শিখে নিতে বলেছে। বানারজুলির মোটরগাড়ি এখন আবু সাহেবের জিম্মায়। ওর ড্রাইভিং শেখা হলে জিপটা কলকাতায় নিয়ে আসবে হয়তো

বড় হোটেলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে পছন্দসই প্রাইভেট গাড়ি জোটানো শক্ত নয়। জিত্ একেবারে গাড়িতে চেপেই ফিরল। গাড়ি কি জন্যে আর কার জন্যে শুনে আবু হাঁ। বলল, তোমার কাণ্ড দেখে আমি ঘাবড়ে যাচ্ছি বাপী ভাই।

হাসি চেপে বাপী বলল, তুমি কম লোক? ঘাবড়াবার কি আছে—

.

বিকেলে ওদের ফেরার অপেক্ষায় বসেছিল। আসলে ভাবছিল কিছু। মগজে একটা ছক তৈরী হচ্ছিল। আর থেকে থেকে কুমকুমের মুখ সামনে এগিয়ে আসছিল। রেশমার মতো করে না হোক ‘ অবস্থা-বিপাকে এই কুমকুমও সর্বনাশের দড়ির ওপর কম হেসে খেলে নেচে বেড়ায়নি।

কলিং বেল বাজতে বলাই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। আবু বা জিত্‌ নয়। মণিদা। তার কথা বাপীর এর মধ্যে মনে পড়ে নি। মণিদার শুকনো ক্লান্ত মুখ। দায়ে ঠেকে আসার অস্বস্তিও অস্পষ্ট নয়।

বোসো মণিদা। বাচ্চু এলো না?

—আমি ইয়ে বাড়ি থেকে আসছি না, পরে একদিন আনব’খন।

গদী আঁটা সোফায় বসে ফ্ল্যাটের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। এই মানুষকে দেখে বাপীর আজ আর রাগ হচ্ছে না। বরং মায়া হচ্ছে। এই একটিমাত্র মানুষের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক। অসময়ে দু’হাত বাড়িয়ে আশ্রয় দিয়েছিল। শুধু খেতে ভালোবাসতো, নইলে বরাবর সাদাসিধে চাল-চলনের মানুষ ছিল। স্ত্রীর প্রতি অন্ধ আনুগত্যের ফলে আজ এই হাল।

বলাইকে হুকুম করে আগে তার ভালো জলখাবারের ব্যবস্থা করল। তারপর সোজা কাজের কথা। বাচ্চুর অ্যানুয়েল পরীক্ষা কবে?

—দু’আড়াই মাসের মধ্যেই বোধ হয় …

বাপী ভাবল একটু। তারপর বলল, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে এই সপ্তাহের মধ্যেই আমি ওর জন্যে একজন ভালো মাস্টার ঠিক করে পাঠাচ্ছি।…কিন্তু আমার মতে তারপর ছেলেটাকে এখানে আর রাখা ঠিক হবে না, অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। ওর মা…বিশেষ করে সন্তু চৌধুরীর কাছ থেকে ওকে তফাতে সরানো দরকার।

মণিদার অসহায় পাংশু মুখ।

বাপী জিজ্ঞাসা করল, বাইরের খুব ভালো কোন ইনস্টিটিউশনে রেখে ওকে পড়ানো যায়? খরচ যা-ই লাগুক তোমাকে ভাবতে হবে না—ওর গার্জেন হিসেবে আমার নাম থাকবে।

মণিদার চোখে-মুখে সংকটের দরিয়া পার হবার আশা। নরেন্দ্রপুর আর দেওঘরের বিদ্যাপীঠের কথা বলল। সামর্থ্য থাকলে ছেলেকে নিজেই ওরকম কোনো জায়গায় পাঠাতো। ছেলেটার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে নিজেই স্বীকার করল। যন্ত্রণাও চাপা থাকল না আর। তুই যদি ছেলেটার ভার নিস আমি আর ওদের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই রাখব না। এত ঠকেছি…আর সহ্য হচ্ছে না।

বাপীর জিজ্ঞাসা করার লোভ, গৌরী বউদির যে নালিশ শুনে ওকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলা হয়েছিল সেটা এখন আর মণিদা বিশ্বাস করে কি না। লোভ সামলালো। বলল, এই দুটো মাস কাউকে আর কিছু বলার দরকার নেই— যা করার তুমি চুপচাপ করে যাও।

উঠে ভিতরের ঘরে গিয়ে দু-তিন মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো। দশখানা একশ টাকার নোট মণিদার পকেটে গুঁজে দিয়ে বলল—এই হাজারটা টাকা তোমার কাছে রাখো এখন। তোমাকে কিন্তু-কিন্তু করতে হবে না, এও বাচ্চুর জন্যে। মুখোমুখি বসল আবার। এবারে তোমার কাজের কথা, বলো কাজ করবে তো?

দু’চোখ ছলছল মণিদার। ভিতর থেকে আরো কিছু যন্ত্রণা ঠেলে বেরুলো। বলল, কাস্টমসের পাকা চাকরি গেছে…কেউ আর বিশ্বাস করতে চায় না।

যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষটার ভেতর দেখতে পাচ্ছে বাপী। তবু এ ব্যাপারে স্পষ্ট কথাই বলল।—কোম্পানীর লোক দরকার, তুমি কোম্পানীর কাজ করবে, সেখানে বাপী বলে কেউ নেই এটুকু মনে রাখলেই আমার দিক থেকে আর কোনো অসুবিধে হবে না।

জিতের সঙ্গে আবু ঘরে ঢুকল। বাপী ওদের সঙ্গে মণিদার পরিচয় করিয়ে দিল। তার কোম্পানীতে যোগ দেবার কথাও জানালো। মণিদাকে বলল, যতদিন না এদিকে সুবিধে মতো অফিস ঘর মেলে তাকে রোজ উল্টোডাঙার গোডাউনে হাজিরা দিতে হবে। জিত্ চেষ্টা করছে, অফিস-ঘর পেতে দেরি হবে না। কাজ আপাতত মাল চালানের খাতাপত্র ঠিক রাখা আর পার্টির কাছে চিঠি লেখা বা তাদের চিঠির জবাব দেওয়া। জিই সব দেখিয়ে শুনিয়ে আর বুঝিয়ে দেবে। বানারজুলি থেকে আবু রব্বানী তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠাবে।

একটু বাদে মণিদা আর জিত্ চলে গেল। বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবু বলল, আমাকে বাঁশ দিয়ে ঠেলে আর কত ওপরে তুলবে—একটু আগে তোমার হোমরাচোমরা পার্টিদের খাতিরের চোটে হাঁপ ধরে গেছল, এসেই আবার এই—

বাপী হাসছে—দেখাশুনা হল সব?

—এখনো সব নয় শুনছি, জিত্ শাসিয়ে রেখেছে কাল রবিবার, পরশু মাঝারি আর ছোট পার্টির সঙ্গে মোলাকাত হবে।

—জলের ব্যবসার খোঁজ নিয়েছ?

—নিশ্চয়। জিত্ ঠিকই বলেছে, টুইংকিল টুইংকিল ইস্টার—ঘাবড়ে যেও না, বাইরে বেরিয়ে একটাও ইংরেজি বলিনি।

চায়ের পর্বের পরেও দোস্ত গা ছেড়ে বসে আছে দেখে আবু উসখুস করতে লাগল। শেষে বলেই ফেলল, ইয়ে—কোথাও বেরুবে-টেরুবে না?

—কোথায়?

আবুর মুখে দুষ্টু হাসি।—কোথায় আমি তার কি জানি। ভাবলাম আমার জন্য তুমি অপেক্ষা করছ—এলেই বেরুবে।

ওর ইচ্ছে বাপী খুব ভালো করেই বুঝছে। অসিত চ্যাটার্জির আপ্যায়নে সাড়া দেবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওর চোখে সেই দশ বছরের মেয়েই লেগে আছে। এখন চৌদ্দটা বছর জুড়বার তাগিদ।

বাপী উঠল। বলল, চলো—

ভাদ্র-শেষের ছোট বেলা। আলো-ঝলমল রাস্তা। দোস্ত্ এখন ভারী চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে দেখেও আবু মজা পাচ্ছে। জামাই সাহেবের সামনে টোপ ফেলার ব্যাপারটা মনের তলায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দোস্তের মতলব এখনো আঁচ করতে পারেনি।

সামনে চোখ রেখে বাপী জিজ্ঞাসা করল, বানারহাট স্কুলের মাস্টারমশাইদের মনে আছে তোমার?

হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন আবু ভেবে পেল না।—যারা মারধর করত তাদের মনে আছে। কেন বলো তো?

—আমাদের ড্রইং করাতো ললিত ভড়— তাকে মনে আছে?

—পেটুক ভড়! তাকে খুব মনে আছে। ব্ল্যাক বোর্ডে খড়ি দিয়ে এঁকে এঁকে কত রকমের খানা খাইয়েছে!

—এখানেও ফুটপাথে খড়ি দিয়ে এঁকে রাস্তার মানুষকে অনেক খানা খাইয়েছে—সকলে পাগল ভাবত।

—আ-হা…তার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে বুঝি?

হয়েছিল। খেতে না পেয়ে আধমরা হয়ে গেছল। শেষের দু’মাস একটু শান্তি পেয়ে গেছে। কিছুদিন আগে মারা গেল।

আবু চুপ খানিকক্ষণ। তারপরে বলে উঠল, যাচ্ছি এক জায়গায় আনন্দ করতে, দিলে মনটা খারাপ করে—

বাপী শুধু হাসল একটু।

দোরগোড়ায় তার গাড়ি থামার আগেই কুমকুম ভিতর থেকে দেখেছে। তাড়াতাড়ি বারান্দায় বেরিয়ে এলো। সঙ্গে অচেনা লোক দেখে থমকালো একটু।

বাপী হাসিমুখে বলল, কটা দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। ভালো আছ তো?

কুমকুম মাথা নাড়ল। বাপীদার সঙ্গে এসেছে তাই দু’হাত জুড়ে অচেনা সঙ্গের লোকটাকে নমস্কার জানিয়ে তাদের ভিতরের ঘরে বসালো। আবু হঠাৎ ঘাবড়ে গেছে কেমন। সামনে যাকে দেখছে সে বেশ সুশ্রী বটে, কিন্তু জঙ্গলের বড় সাহেবের দশ বছরের যে ফুটফুটে মেয়েটাকে মনে আছে, পরের চৌদ্দ বছরে তার চেহারা এই দাঁড়াতে পারে কল্পনায় আসে না।

নিরীহ মুখে দোস্ত তার দিকে তাকাতে আরো খটকা লাগল। জিগ্যেস করল, বহিনজি তো…?

—তুমি কোন বহিনজির কথা ভাবছ? একটু আগে যে মাস্টারমশায়ের কথা বললাম তার মেয়ে কুমকুম।

আবু হতচকিত কয়েক মুহূর্ত। কিন্তু বোকা নয়, চট করে সামলে নিল। দরাজ হেসে বলল, উনিও বহিনজিই তো হলেন তাহলে। কুমুর দিকে ফিরল, মাস্টারজির হাতে আমিও বছর কতক ঠেঙানি খেয়েছি।

কুমু হাসিমুখেই নরম প্রতিবাদ করল, বাবা ভয় দেখাতেন, মারতেন না কাউকে।

বাপী সাদা মুখে কাজের কথায় চলে এলো। আবুর পরিচয় দিল। বলল, ও-ই সর্বেসর্বা এখন, তোমার যা কিছু বোঝাপড়া সব এরপর ওর সঙ্গে আর জিতের সঙ্গে—আমাকে আর বিশেষ পাচ্ছ না।…আমাকে যতটা বিশ্বাস করো একেও ততটাই বিশ্বাস করতে পারো।

কুমুর মুখে কথা নেই, চুপচাপ চেয়ে রইল।

দোস্তের মাথায় কি যে আছে আবু ভেবে পাচ্ছে না। তাই আগবাড়িয়ে সেও কিছু বলছে না।

বাপী জিজ্ঞাসা করল, টাকা কেমন আছে?

—আছে…।

পার্স থেকে এক গোছা টাকা বার করে তার দিকে বাড়িয়ে দিল।—এই পাঁচশ টাকা রাখো তোমার কাছে।

কুমকুম ইতস্তত করতে আবার বলল, আবুর সামনে লজ্জা করার কিছু নেই, ও আমার থেকে কড়া মুরুব্বী, এখন থেকে যা পাবে সব তোমার পাওনা থেকে কড়াক্রান্তি কেটে নেবে। ধরো।

কুমকুম হাত বাড়িয়ে টাকা নিল। সম্মান বাঁচিয়ে সাহায্য করা হল আবু এইটুকুই ধরে নিল।

দশ মিনিটের মধ্যে আবার গাড়িতে পাশাপাশি দুজনে। আবু বলল, অ্যাস্ মানে গাধা আবার ডংকি মানেও গাধা——আমি কোন্‌টা?

বাপী হাসছে।—কি হল?

প্রথম দিন তুমি আমার ঘরে রেশমার বদলে দুলারিকে দেখে হাঁ হয়ে গেছলে…তার বদলা নিলে মনে হচ্ছে।…তোমার সব ইন্টারেস্ট এখন তাহলে এই বহিনজি?

সব না, কিছুটা।

আবুর খুশি ধরে না।—এও দেখতে শুনতে তো ভালোই। ঠাণ্ডা মেয়ে হলেও বেশ বুদ্ধি ধরে মনে হল—ঠিক না?

—ঠিক। কিন্তু তুমি তো চিনতেই পারলে না।

—আমি আগে দেখলাম কোথায় যে চিনব!

—দেখেছ। ভেবে দেখো…।

আবু বিমুঢ় খানিক। এরকম ভুল তার হবার কথা নয়।—কোথায় দেখেছি?

—বানারজুলিতে। আমি তখন ডাটাবাবুর ক্লাবের সেই কোণের ঘরে থাকতাম। চা-বাগানের এক অফিসারের বন্ধু মেয়েছেলে নিয়ে এসেছিল বলে আমাকে কোণের ঘরটা ছেড়ে দিতে হয়েছিল—সেজন্যে তুমি ডাটাবাবুর ওপর খেপে গেছলে, আর সেই মোটা কালো লোকটাকে দেখে বলেছিলে, এই চেহারা নিয়ে বউয়ের সঙ্গে রঙ্গরস করার জন্যে কোণের ঘর চাই—মনে পড়ছে?

মনে পড়ছে বটে। কিন্তু তার ফলে আবু চারগুণ অবাক।—এই বহিনজি সে নাকি! সেই লোকটার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?

সামনে চোখ রেখে বাপী নির্লিপ্ত মুখে গাড়ি চালাচ্ছে। জবাব দিল, শুধু সেই লোক কেন, তারপর অরো কত লোকের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে।

আবু আধাআধি ঘুরে বসেছে দোস্তের দিকে। জল-ভাত কথাগুলোও ঠিক-ঠিক মাথায় ঢুকছে না। এখানে একে কোথায় পেলে?

—রাতের রাস্তায়! কারো জন্যে অপেক্ষা করছিল।

এও হেঁয়ালির মতো লাগল।—রাতের রাস্তায়…কার জন্যে অপেক্ষা করছিল?

—পকেটে পয়সা আছে এমন যে কোনো রসিক পুরুষের জন্য। হাতে কিছু পেলে তবে বস্তিঘরের রুগ্ন বাপের জন্য খাবার আসবে।

আবুর মুখে কথা নেই আর। স্তম্ভিতের মতো বসে রইল। তার দিকে না তাকিয়ে বাপী মোলায়েম করে বলল, তুমি যে ইন্টারেস্টের কথা ভাবছিলে ঠিক সে ইন্টারেস্ট যে নয় আমার এখন বুঝতে পারছ?

ধাক্কাখানা এমনি যে আবু তার পরেও নির্বাক। একটু বাদে একই সুরে বাপী আবার মন্তব্য করল, তবু মেয়েটাকে আমি খারাপ ভাবি না।

.

রবিবারের বিকেল পর্যন্ত বাপীর ফ্ল্যাট ছেড়ে নড়ার নাম নেই। আড্ডা দিয়ে আর গড়িমসি করে কাটিয়ে দিল। অথচ সকাল থেকেই আবু আশা করছে এই ছুটির দিনে দোস্ত ওকে প্রত্যাশার জায়গাটিতে নিয়ে যাবে। শেষে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। বলল, বেরুবে না কি সমস্ত দিনটা ঘরেই কাটিয়ে দেবে?

বাপী সাদামাটা মুখ করে চেয়ে রইল একটু। ঠোটের ফাঁকে হাসির আঁচড় পড়ল কি পড়ল না। গা মোড়ামুড়ি দিয়ে উঠে বলল, চলো—

কিন্তু এবারও আবুর অপ্রস্তুত হবার কপাল। অভ্যর্থনায় যারা এগিয়ে এলো তাদের একজন সুদীপ নন্দী আর একজন মনোরমা নন্দী। আবু দেখেই চিনেছে। তারা চিনতে পারল না। খাতিরের ছেলের সঙ্গে এসেছে তাই খাতির করেই বসালো। তার আগে আবুর আদাবের ঘটা দেখে মা-ছেলে দুজনেই অবাক একটু। হাসিমুখে বাপী বলল, মাসিমার কথা না হয় ছেড়ে দিলাম, দীপুদা তুমিও ওকে চিনতে পারলে না?

সুদীপ বলল, চেনা-চেনা লাগছে কিন্তু ঠিক….

—বানারজুলির জঙ্গলের সেই অপদেবতা আবু রব্বানী। পাথর ছুঁড়ে কত বুনো মুরগি আর খরগোশ মেরে খাইয়েছে, মনে নেই?

বলা মাত্র ছেলে ছেড়ে মায়েরও মনে পড়েছে। মনোরামা দেবী বলে উঠলেন, ওকে তো জঙ্গলের বীটম্যান করা হয়েছিল….।

বাপীর সরব হাসি। সেই লোক আর নেই মাসিমা। আবু এখন আমাদের কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার, দু’গণ্ডা বি-এ, এম-এ পাশ ওর আন্ডারে চাকরি করছে—নিজের বাড়ি নিজের গাড়ি।

লজ্জা পেয়ে আবু বলল, ছাড়ো তো, মাসিমা আর দীপুদার কাছে আমিও তোমার মতো একটা ঘরের ছেলে—

বাপীর মজা লাগছে। মওকা বুঝে সেয়ানা আবুও নিজেকে ঘরের ছেলে করে ফেলল। বানারজুলির সেই দাপটের কালে মহিলাকে মেমসায়েব আর দীপুদাকে ছোট সাহেব না বললে গর্দান যাবার ভয় ছিল।

বাইরে অন্তত মা ছেলে দুজনেরই হাসি-মুখ আর খুশি-মুখ। কিন্তু আসলে ভেবে পাচ্ছে না, একটা বুনো জংলি ছেলেরও ভাগ্য এমন ছপ্পর ফুঁড়ে ফেরে কি করে। টাকার ঘরে রূপের বাসা। সেই জংলি ছেলেরও রূপ ফিরে গেছে বটে।

আদর-আপ্যায়নে কার্পণ্য নেই। বাপী মোটে আসে না বলে মনোরমা দেবী বার কয়েক অনুযোগ করলেন। শিগগীরই আবার আসবে কথা দিয়ে ঘণ্টাখানেক বাদে আবুকে নিয়ে বাপী উঠল। ছেলের পিছনে মা-ও নিচের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। এক ধাপ নেমে বাপী ঘুরে দাঁড়াল।—মিষ্টির খবর কি মাসিমা, অনেক দিন দেখি না…

মহিলার অপ্রসন্ন মুখ। গলা খাটো করে জবাব দিলেন, কে জানে মাথায় কি ঢুকেছে, এখানেও বেশি আসে-টাসে না।

গাড়ি তাঁদের চোখের আড়াল হতে আবু ঝাঁঝালো চোখে দোস্তের দিকে ফিরল। বাপী বলল, আর পাঁচ-সাত মিনিট মুখ বুজে অপেক্ষা করো, নিয়ে যাচ্ছি

আবু ধৈর্য ধরে বসে রইল বটে, কিন্তু তার ভিতরে অনেক প্রশ্ন কিলবিল করছে এখন। বড় রাস্তা ছেড়ে কয়েকটা ছোট রাস্তা ঘুরে গাড়িটা মিনিট সাতেকের মধ্যেই থামল এক জায়গায়। আঙুল তুলে বাপী বলল, ঠিক চারটে বাড়ির পরে ওই বাড়িটা—নেমে যাও।

আবু আকাশ থেকে পড়ল।—আর তুমি?

—আমি না। একটা ট্যাক্সি ধরে ফিরে এসো, তাহলে আর রাস্তা ভুল হবে না।

—তাহলে আমারও গিয়ে কাজ নেই। ফেরো!

বাপী গম্ভীর।—দেখো তোমাকে আমি বোকা ভাবি না। তোমার একা যাওয়া দরকার, একাই যাবে। নামো।

আবছা অন্ধকারে দোস্তের মুখ ভালো দেখা যাচ্ছে না। দরজা খুলে আবু নামল। সামনের বাঁক ঘুরে বাপী তখনি গাড়িসুদ্ধু চোখের আড়ালে।

বড় রাস্তায় পড়ে নিজের মনেই হাসছে।

.

রাত নটার পরে আবু ফিরল। গোল গোল দু’চোখ বাপীর মুখের ওপর তুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

হাসি চেপে বাপী জিগ্যেস করল, হল?

আবু মাথা নাড়ল। মুখেও জবাব দিল, হল।

কিন্তু রাতের খাওয়া সারা হবার আগে দোস্তের আর কোনো কিছুতে উৎসাহ দেখা গেল না। আবু সঙ্গ দেবার জন্য বসল শুধু। পর পর দু জায়গায় খাওয়া হয়েছে, খিদে নেই। সে দোস্তের খাওয়া দেখছে অর্থাৎ ভালো করে মুখখানা দেখছে।

খাওয়ার পর রাতের আড্ডা বাপীর শোবার ঘরে বসেই হয়। আবুর গুরু-গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে এবারে বাপী হেসে ফেলল।—কেমন দেখলে?

—এত ভালো ভাবিনি, তোমার জন্যে বুকের ভেতর টনটন করছিল।

বাপী হাসছে।—আর অসিত চ্যাটার্জির জন্যে?

—খুব আদর যত্ন করেছে, তবু তাকে ধরে আছাড় মারতে ইচ্ছে করেছিল।

আলতো করে বাপী মন্তব্য করল, সে সুযোগ পাবে’খন।

আবু রব্বানী নড়েচড়ে বসল। বাপী জিগ্যেস করল, মিষ্টি তোমাকে দেখে খুশি হল?

—খুব।

—কি বলল?

—বানারজুলির পুরনো কথা, বনমায়ার কথা—আমার সে-সময়ের সাহসের কথা শোনালো জামাই সাহেবকে। পরিবার আর ছেলেপুলের কথা জিগ্যেস করল, এখানে মেমসায়েবের মেয়ে ঊর্মিলা আর তার বরের সঙ্গে আলাপের খবরও বলল—কেবল তোমাকে মোটে চেনেই না বোঝা গেল।

বাপী হেসে ফেলল।—বোঝা গেল?

—খুব। এই জন্যেই তো তোমাকে নিয়ে মিষ্টি বহিনজির ভিতরেও কিছু গড়বড় ব্যাপার আছে টের পেলাম।

বাপীর বাইরে নিরীহ মুখ। ভিতরে হাসছে। ঊর্মিলাও এই গোছের কিছু বলে গেছল। ওই মিষ্টিকে দেখে সব চুকে-বুকে গেছে বলে তারও মনে হয়নি। বাপী প্রস্তুত হচ্ছে। রণে বা প্রণয়ে নীতির বালাই থাকতে নেই।

আবুর একটা চোখ এবারে ছোট একটু। জেরায় জেরবার করার ইচ্ছে। মিষ্টি বহিনজির মেমসায়েব মা এখন তাহলে তোমার মাসিমা?

হাবা মুখ করে বাপী মাথা নেড়ে সায় দিল।

—ওই মা আর ছেলের কাছে তোমার এখন খুব খাতির কদর?

আবারও মাথা নাড়ল।—খুব।

—আসার সময় মেমসায়েব মেয়ের সম্পর্কে অমন কথা বলল কেন— তেমন বনছে না?

—জামাইয়ের সঙ্গে বনছে না।

এটা শোবার ঘর ভুলে আবু বিড়ি ধরালো একটা।—বনছে না কেন?

—জামাই মদ খায়, রেস খেলে, জুয়ার নেশায় বউয়ের টাকা চুরি করে, ঝগড়া করে।

—সত্যি?

বাপী মাথা নাড়ল। সত্যি।

মেমসায়েবের তাহলে কি ইচ্ছে?

বাপী নির্লিপ্ত জবাব দিল, তার আর তার ছেলের ধারণা কাগজ-কলমের বিয়ে, ছিঁড়ে ফেললেই ফুরিয়ে যায়—অমন লোকের সঙ্গে ঘর করার কোন মানে হয় না।

আবু লাফিয়ে উঠল।—বিসমিল্লা। তুমি তাহলে গুলি মেরে দিচ্ছ না কেন? ঠেস দেবার মতো করে বাপী ফিরে বলল, দুলারির বেলায় তুমি অন্ধ ছট্টু মিঞাকে গুলি মেরে দিতে পেরেছিলে?

আবু লজ্জা পেল।—লোকটা মরার জন্য ধুঁকছিল তাই মায়া পড়ে গেছল। তোমারও কি এই মরদের ওপর মায়া পড়েছে?

—আমার না। তোমার বহিনজির পড়েছে। তার বিশ্বাস, জামাই সাহেব যতোই নেশা করুক জুয়া খেলুক টাকা সরাক বা ঝগড়া করুক—লোকটার ভালবাসায় কোনো ভেজাল নেই—তোমার জামাই সাহেবের এটাই নাকি আসল পুঁজি—এই পুঁজির জোর মিথ্যে হলে কাউকে কিছু বলতে হত না, তোমার বহিনজি নিজেই তাকে ছেঁটে দিত।

ব্যাপারখানা তবু মাথায় ভালো ঢুকছে না আবুর। জিজ্ঞাসা করল, তাহলে? —তাহলে ওই লোকের ভালোবাসার সবটাই যে ভেজাল আর তোমার বহিনজির বিশ্বাস সবটাই যে ভুল এটুকু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারলেই ফুরিয়ে যায়।

—কি করে? আবু স্পষ্ট করে ধরতে ছুঁতে পারছে না বলে দ্বিগুণ উন্মুখ। সোনা মুখ করে বাপী জবাব দিল, সেটা খুব আর কঠিন কি।…তুমি জিকে একটু তালিম দিয়ে যাও, বেচারা অসিত চ্যাটার্জিকে যেন ভালো করে খাতির-যত্ন করে, রেসের নেশায় বউয়ের আলমারি থেকে টাকা সরাতে হবে এ কি কথা! আর ভদ্রলোক রংদার মানুষ, ভালো জিনিস খুব পছন্দ—মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে কুমকুমকে নিয়ে বোতলের ব্যবসা তো তোমরা শুরুই করে দিচ্ছ—ও জিনিসেরও অভাব হবার কথা নয়…

আবু লাফিয়ে উঠল। কুমকুমকে নিয়ে বোতলের ব্যবসা!

—সেদিন গিয়ে বলে এলাম কি? অমন বিশ্বস্ত আর ভালো মেয়ে কোথায় পাবে।…তাছাড়া মেয়েটার অভিজ্ঞতারও শেষ নেই।

নিরীহ মুখের দুই ঠোঁটে হাসিটুকু আরো স্পষ্ট হয়ে ঝুলছে। আবুর গোলগোল চোখ তার মুখের ওপর চড়াও হয়েই আছে। আর দুর্বোধ্য কিছু নেই। অস্পষ্ট নেই।

গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কাছে এসে আধখানা ঝুঁকে সেলাম ঠুকল একটা। বলল, ঠিক আছে, এর পরের সব ভার তুমি এই বান্দার ওপর ছেড়ে দিতে পারো।

পরের দুটো দিন আবু জিকে নিয়ে ব্যস্ত। তার পরের দিন বানারজুলি ফেরার তাড়া। বাপীকে বলল, জিত্ সাহেব আর কুমকুম বহিনকে তিন-চার দিনের জন্য নিয়ে যাচ্ছি। আমি তো খুব ঘন ঘন আসতে পারব না, ওদেরও দরকার মতো একটু ছোটাছুটি করতে হবে। নিয়ে যাই, দেখে-শুনে বুঝে আসুক। কুমকুম বহিন তোমার বাংলোয় কোয়েলার কাছে থাকবে’খন, আর জিত্ সাহেবের তো বউ ছেলে সেখানেই।…তোমার অসুবিধে হবে?

পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে! বাপী মাথা নাড়ল। অসুবিধে হবে না।

নিরাসক্ত মুখ আবুরও।—তুমি ঠিকই বলেছিলে বাপীভাই, কুমু বহিন ভারী ভালো মেয়ে। নতুন করে এখন কি ব্যবসায় নামছি শুনেও একটু ঘাবড়ালো না। বলল, বাপীদার ব্যবস্থার ওপর আর কোন কথা নেই।…ওর বাবা নাকি চোখ বোজার খানিক আগেও বলে গেছে আমাদের স্বর্গ-নরক বলে কিছু নেই…দরকার হলে ওই বাপীর জন্য যদি প্রাণ দিতে পারিস তাহলে সব স্বর্গ।

আবু হাসছে অল্প অল্প। বাপী নির্লিপ্ত! ভেতরটা খরখরে হয়ে উঠছে। কিন্তু বাপী তা হতে দেবে না। পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *