সোনার হরিণ নেই – ৩২

বত্রিশ

টানা চব্বিশ দিনের ট্রাম বয়কটের ফ্যসলা শেষ পর্যন্ত হল। এক পয়সার যুদ্ধ শেষ। সরকারের তরফ থেকে এক পয়সা ভাড়া বৃদ্ধি স্থগিতের নির্দেশ ঘোষণার ফলে আপাতত গণদাবির জয়। বাপীর ধারণা পুঁজিপতিরা এ জয় খুব স্বস্তির চোখে দেখছে না। কারণ এর পিছনে নিরীহ মানুষগুলোর সঙ্ঘবদ্ধ বিপ্লবের চেহারাটা উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে। চোখ চালিয়ে নিজের ভিতরটা দেখতে চেষ্টা করেছে বাপী। সেও তো ছোটখাটো এক পুঁজিপতিই হয়ে বসেছে। তবু সাধারণের এই জয় ভার ভালো লাগছে। গা-ঝাড়া দিয়ে বাপী আত্মপ্রসাদ বাতিল করল।

এবারে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। আবু রব্বানীকে একপ্রেস টেলিগ্রাম করে মালের ট্রাক পাঠাতে বলেছে। ফাঁক পেলে নিজেরও একবার ঘুরে আসার ইচ্ছে। পুরো এক মাসও হয়নি কলকাতা এসেছে কিন্তু মনে হচ্ছে কত দিন হয়ে গেল শিকড় ছাড়া হয়ে আছে।

ঊর্মিলাদের যাওয়া কি কারণে এক সপ্তাহের জন্য পিছিয়েছিল। সেই যাত্রারও সময় এগিয়ে এসেছে। ফ্ল্যাটে আসার পর একদিন মাত্র ওর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছিল। শিগগীরই যাবে কথা দিয়েছিল। হঠাৎ ললিত ভড়কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার দরুন সময় পেয়ে ওঠেনি। সে মেয়ে হয়তো রাগে ফুঁসছে। রাতে ওর নাগালের মধ্যে টেলিফোন নেই। বিজয়ের আপিস থেকে দিনে করতে পারে। এর মধ্যে ক’বার করে তাই করেছে কে জানে। দিনের বেলায় ঘরে আর কতক্ষণ থাকে বাপী, ফোন ধরে কে।

ঊর্মিলার ওখানেই যাবে ঠিক করে প্যান্ট আর শার্ট বদলাবার জন্য সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটে ফিরেছিল। একটু বাদে দরজার ওধারে কলিং বেল বেজে উঠল। বাপী অবাক একটু।…কে হতে পারে। একটু আগে জিত্ মালহোত্রাকে ছেড়ে এসেছে—সে নয়। একমাত্র মিষ্টি চেনে এই ফ্ল্যাট। সে এসেছে ভাবা যায় না। তার কাছ থেকে ঠিকানা আর ফ্ল্যাটের হদিস নিয়ে দিপুদা আসতে পারে অবশ্য।

দ্বিতীয় দফা বেল বাজল। বাপী এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল।

অসিত চ্যাটার্জি। ফর্সা মুখে খুশি উপচে উঠল। সঙ্গে অন্তরঙ্গ অনুযোগ কি ব্যাপার বলো তো তোমার! কদিনের মধ্যে নো-পাত্তা! আপিস থেকে রোজ কবার করে টেলিফোন করছি কেউ ধরেই না! আপিস-ফেরতা দু-দিন এসে ফিরে গেলাম—তুমি নেই, দরজায় তালা।

লোকটাকে দেখামাত্র একটা বিজাতীয় আক্রোশ ভেতর থেকে ঠেলে উঠতে লাগল। তার সঙ্গে যুঝতে হলে মুখে দরাজ হাসি টেনে আনতেই হয়। এসো অসিতদা এসো। আমিও কদিন ধরে তোমার কথাই ভাবছিলাম। একদম সময় পাইনি। এক হাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বসার জায়গায় নিয়ে এলো।—আমার ফ্ল্যাটের হদিস আর টেলিফোনের নম্বর তোমাকে কে দিল?

সোফায় আরাম করে বসে জবাব দিল, বাঃ মিলু এসেছিল না!

সাদা কথায় কদিন আগে যার স্ত্রী এসে গেছে এখানে, তার স্বামী কেন জানবে না। কিন্তু এত সাদা বাপী ভাবতে পারছে না। ঠিকানা বা ফোন নম্বর পেলে এই লোক এখানে এসে হানা দেবে অথবা যোগাযোগ করবে জানা কথাই। তবু দিয়েছে। দিয়ে মিষ্টি বোঝাতে চেয়েছে, যে যাই ভাবুক ওদের পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়ার কোনো অভাব নেই। ফাঁকিও নেই।

মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারদিকে একবার চোখ চালিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে ভিতরের দিকটাও একবার দেখে নিল। তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে মন্তব্য করল, নাঃ, টাকা না থাকলে সুখ নেই—চমৎকার ফ্ল্যাট তোমার। তারপরেই অন্তরঙ্গ অথচ কড়া অনুযোগ। আমি আসি আর যাই করি তোমার ওপর কিন্তু দারুণ রেগে আছি।

সঙ্গে সঙ্গে বাপীরও আকাশ থেকে আছাড় খাওয়া মুখ।—কি অপরাধ করলাম?

—বাড়ির দোরে সেদিন মিলুকে নামিয়ে দিলে, একবারটি ভিতরে এলে না বা দেখা করলে না!

মগজে বক্র চিন্তার কারিকুরি চলেছে। মুখের হাসিতে খুঁত নেই।—মিস্…মানে মিলু গিয়েই তোমার কাছে নালিশ ঠুকল বুঝি?

খুশি থাকলে লোকটা প্যাচ-ট্যাচের ধার ধারে না বাপী আগেও লক্ষ্য করেছে। এখনো নিজের দোষ ঢাকার চেষ্টা করল না, ইয়ে মেজাজটা সেদিন আমার খুব ভালো ছিল না, আর দিনটাও কেমন ছিল তোমার মনে আছে তো? হাঙ্গামা, গুলি-গোলা—অথচ রাত পর্যন্ত ওর বাড়ি ফেরার নাম নেই। তুমি বলো, চিন্তা হয় না?

বাপী ঘটা করে মাথা নাড়ল। চিন্তা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।

—আমি ভাবলাম ওই মওকায় ঠিক কেউ না কেউ ওকে নিজের বাড়ি টেনে নিয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি ভাই, মিলুর আপিসের খাতিরের লোকগুলোকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না—বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাতির করার জন্য বা লিফট দেবার জন্যে সর্বদা হাঁ করে আছে। আর মিলুরও একটা গুণ স্বীকার করতেই হবে, আমি রেগে যাই জেনেও মিথ্যে বলে না—জিগ্যেস করলে কোথায় ছিল বা কোথায় গেছিল সত্যি কথাই বলে দেয়। রাত সাড়ে আটটায় বাড়ির দোরে গাড়ি থামতে ভাবলাম তাদের কেউ হবে—আমার তখনকার মেজাজ বুঝতেই পারছ। সেই মেজাজের মুখে যখন শুনলাম তুমি ওর আপিসে এসে ধরে নিয়ে গেছ আর তুমিই বাড়ী পৌঁছে দিয়ে গেলে তখন আমিই আবার উল্টে হাঁ। দোরগোড়ায় এসেও পালিয়ে যেতে দিল বলে তখন মিলুকেই বকলাম।

এমন বিশ্বাস আর এই হৃদ্যতার কথা শুনে ভিতরটা আরো হিংস্র হয়ে উঠছে বাপীর। এই ঘরে বসে বাপী সেদিন যে খোঁচাটা দিয়েছিল, এ তারই জবাব মিষ্টিই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে লোকের রোগের খোঁচা দিয়েছিলে সে তোমাকে কত পছন্দ করে আর কত বিশ্বাস করে নিজের চোখেই দেখো।

মুখের মেকি হাসি গলায় নামল। বলল, অত রাতে তোমার খপ্পরে পড়লে সহজে ছাড়া পেতাম! হাতে সময় নিয়ে যাব’খন একদিন।…কিন্তু জানান না দিয়ে আজ প্রথম দিন এলে, ঘরে তো সেসব কিছুই মজুত নেই—

মাখন-মার্কা হৃষ্টবদনে লজ্জা-লজ্জা হাসি।—না হে, তোমার এখানে এসে আর ওসব চলবে না…কখ। দিতে হয়েছে।

—কি ব্যাপার? ভিতরে একপ্রস্থ হোঁচট খেলেও বিস্ময়টুকু নির্ভেজাল।

চোখের মিটিমিটি হাসিতে সোনালি ফ্রেমের চশমাটাও বেশি ঝিকমিক করছে এক কথায় পাঁচ কথা বলার অভ্যেস রয়েসয়ে জবাব দিল, মিলুর মাথা ইদানীং আগের থেকে ঠাণ্ডা দেখছি, কথায় কথায় আগের মতো অত রেগে ওঠে না…নিজের দাদা আর মায়ের ওপরেই বরং এখন বেশি রাগ। তারাই আমার মাথাটা বিগড়ে দিচ্ছে বুঝছে বোধ হয়। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব বা মাখামাখিতে আপত্তি নেই—আপত্তি শুধু ড্রিংক করার ব্যাপারে। খুব ইচ্ছে হলে বাড়িতে বসে একটু-আধটু ড্রিংক করতে পারি—কিন্তু তোমার এখানে এসে নয়।

বাপীর ঠোঁটে হাসি। মগজ তৎপর আবার। এতক্ষণের হিংস্র থাবাটার এক ঘা বসিয়ে দেবার সুযোগ আপনা থেকে উপস্থিত। মিষ্টি সেদিন কিছু জোরের সঙ্গে বড়াই করে গেছিল। এই লোকের ভালবাসার জোর। তাতে ভেজাল নেই বলেই তার একটু-আধটু বিকৃতি বরদাস্ত করতেও অসুবিধে হবে না বলেছিল। মিষ্টির সেই সব কথা একটা যন্ত্রণার মতো দাগ কেটে আছে। বাপী বিশ্বাস করেনি, কারণ এই জোরের দিকটা সে চেনে। নিজেকে দিয়ে চিনেছে, অনেক দেখে চিনেছে।

ঊর্মিলার ওখানে যাওয়ার চিন্তা আজও বাতিল। জোরের যাচাই কিছুটা এই রাতেই হতে পারে। মিষ্টিকে কথা দিয়েছে তার এখানে এসে ড্রিংক করবে না। লোকটাকে কথা রাখার মতো সবল ভাবতেও রাজি নয় বাপী। অন্তরঙ্গ সুরে বলল, চায় না যখন একেবারে ছেড়েই দাও না, ও আর এমন কি জিনিস।…কিন্তু আমার এখানে এসে ড্রিংক ছাড়া আর কিছুতেই নিষেধ নেইতো?

— আর কি? —

—কাজের চাপে হাঁসফাঁস দশা গেছে কটা দিন, সবে আজই একটু হাল্কা হতে পেরেছি তাই তোমাকে পেয়ে দারুণ ভাল লাগছে…শিগগীর ছাড়া পাচ্ছ না। কিন্তু আমার বেজায় খিদে পেয়ে গেছে, আগে কোথাও গিয়ে বেশ মেজাজে ডিনার সেরে আসা যাক চলো।

অসিত চ্যাটার্জির তক্ষুনি ঘাড় কাত. এসবে আপত্তি করার মতো বেরসিক নয়।

আধ ঘণ্টার মধ্যে বাপীর গাড়ি পার্ক স্ট্রীটের এক জমজমাট রেস্তরাঁর পাশে এসে দাঁড়াল। বাইরে আলোর বহর দেখে এটাই সব থেকে অভিজাত মনে হল। এত গাড়ি দাঁড়িয়ে যে পার্ক করার জায়গা মেলা ভার। রাস্তার উল্টো দিকে জায়গা খুঁজে বার করতে হল।

ঢোকার পথে পাগড়ি আঁটা তকমা-পরা দারোয়ান সেলাম ঠুকে দরজা খুলে দিল। ভিতরে পা দিয়ে বাপীরই চোখে ঘোর লাগার দাখিল। পায়ের নিচে পুরু গালচে বিছানো। অন্ধকার-ছোঁয়া খুব মৃদু আর নরম লালচে আলোয় মানুষ দেখা যায়, দশ হাত দূরের মুখ ভালো দেখা যায় না। বাইরে থেকে এলে বা অনভ্যস্ত চোখে এ আলোয় চোখ বসতে সময় লাগে। মদিরাচ্ছন্ন বাতাস, ডিশে কাঁটা বা চামচ ঠোকার টুন-টান শব্দ, সোডার ফসফস মুখ খোলা, মেয়ে-পুরুষ বহু গলার গুনগুন রব, মিহি মোটা হাসি—ভোগবতীর আমেজ ঠাসা আসর।

এখানে ক্যাবিনের বালাই নেই। রসিক-রসিকারা আড়াল কেউ চায় না। দূরে দূরে দু’জন চারজন বা ছ’জনের তকতকে টেবিল চেয়ার। টেবিলে ধপধপে সাদা ঢাকনা। নিচে সিট নেই, দোতলার ব্যালকনিতে ঠাঁই মিলল। দোতলার পরিবেশও একই রকম জমজমাট।

বেয়ারা ফুড চার্ট আর ড্রিংক চার্ট রেখে গেল। ড্রিংক চাৰ্টটা ঠেলে সরিয়ে বাপী ফুড চার্টটা টেনে নিয়ে বলল, এখানকার ফুড খুব ভালো, সেদিন এক পার্টিকে নিয়ে এসেছিলাম—তারা অবশ্য বলে এখানকার ড্রিংকের কোনো তুলনা নেই…তা আমি তো এসবের মর্ম বুঝি না, আমার ফুডই ভালো লাগল।

চারিত্রিক নীতির প্রশ্ন যেখানে, বাপী পারতপক্ষে মিথ্যে বলে না। কিন্তু চাণক্যনীতির মুখে বাছ-বিচার নেই। তখন অম্লানবদন। গম্ভীর। ফুড বাছাই চলছে। আড়চোখে এক-একবার সামনের মুখখানাও লক্ষ্য করছে। অসিত চ্যাটার্জির দু চোখ ব্যালকনির সব কটা টেবিলে ঘুরছে। কি মেয়ে কি পুরুষ, কারো গেলাস এখানে সুরাশূন্য নয়।

একটু বাদে নোটবই আর পেন্সিল হাতে অর্ডার নেবার জন্য স্টুয়ার্ড এগিয়ে এলো। বাপী জাঁকালো ডিনারের অর্ডার দিল। লেখা শেষ করে অফিসার থমকে তাকালো। অবাকই একটু।—নো ড্রিংক?

—নো ড্রিংক।

সে চলে গেল। লালচে ঝিমুনো আলোয় অসিত চ্যাটার্জির ফর্সা মুখ নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে এখন। তবু একটু হাসি টেনে বলল, এখানে এসে ড্রিংক-এর অর্ডার না দেওয়া ওরা বোধ হয় আর দেখেনি।

—তা আর কি করা যাবে, কথা যখন দিয়েছ…।

—কথা দিয়েছি বলতে, গঙ্গাজলে গলা ডুবিয়ে তো আর প্রতিজ্ঞা কিছু করিনি।—এদের খাবার আনতে সময় লাগবে, তেষ্টাও পেয়ে গেছে।

বোকা-বোকা মুখে বাপী জলের গেলসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল।

—ধেৎ, জল কে খাবে, এখানে এসে নিরেমিষ গেলার কোনো অর্থ হয় না, তোমার অভ্যেস নেই তাই বুঝলে না—তুমি ভাই যা হোক একটা-দুটো দিতে বলো, গলা না ভেজালে কিছু নামবে না।

—একটা দুটো মানে…

ড্রিংক?

এত তেষ্টা যে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না অসিত চ্যাটার্জির। মাথা নাড়ল।

বাপী টেবিলে আঙুল ঠুকে বয়কে ডাকল। ছাপানো ড্রিংক চাৰ্টটা কাছে টেনে নিয়ে কোন জিনিসটার সব থেকে বেশি দাম দেখে নিল। তারপর সেই নামের ওপর আঙুল রেখে কার্ড সামনে ঠেলে দিল।—এ জিনিস চলবে?

ঝুঁকে নাম দেখেই অসিত চ্যাটার্জির দু-চোখ চকচক করে উঠল।—অনেক দাম যে…

এক পেগের অর্ডার নিয়ে বয় চলে গেল। বাপীর কোমল-গম্ভীর দু’চোখ সামনের লোকের মুখের ওপর স্থির একটু।—আমার কাছে তুমি এর থেকে ঢের দামী মানুষ, সকলে তোমাকে বোঝে না কেন আমি ভেবে পাই না।

সোনালি চশমা আঁটা মাখন-মূর্তি গলেই যাচ্ছে।—হিংসে, স্রেফ হিংসে ভাই, কিন্তু আমিও অসিত চাটুজ্জ্যে, কারো তোয়াক্কা রাখি না।

হুইস্কির গেলাসে সোডা ঢেলে দিয়ে বয় চলে যেতে বাপী বলল, শাশুড়ী জামাইকে আর সম্বন্ধী ভগ্নীপতিকে ভালো চোখে দেখবে না বরদাস্ত করবে না— এ কেমন কথা বুঝি না।

দুটোেক গলা দিয়ে নামার সঙ্গে সঙ্গে অসিত চ্যাটার্জির ভিন্ন মূর্তি। ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, হিমালয়ের মতো মাথা উঁচু লোক ভাবে যে নিজেদের। বরদাস্ত করবে কি করে? তাদের মেয়ে বোনকে রেস জুয়া আর মদের নেশায় একেবারে সর্বস্বান্ত করে ফেললাম না।

তাপ বাড়ার ফলে এবারের চুমুকে গ্লাসের অর্ধেকের বেশি শেষ! নিরীহ বিস্ময়ে বাপী চেয়ে রইল একটু।—মদ তো তোমাকে খুব একটা বেশি খেতে দেখি না…রেস আর জুয়া সত্যি বেশি খেলো নাকি?

—ক্ষেপেছ! ওরা যাই ভাবুক অত টাকা কোথায় আমার! মৌসুমের সময় মাঠে এক-আধদিন যাইনে এমন নয়, আর জুয়াও একটু-আধটু খেলি সত্যি কথাই—কিন্তু সে সব তোমার কাছে নস্যি—তবু তাই বলে ওদের অত মাথা—ব্যথা কেন! ওদের কাছে কখনো হাত পাততে গেছি!

গেলাস খালি। বাপীর হুকুমে বেয়ারা দ্বিতীয় দফা গেলাস সাজিয়ে দিয়ে গেল। ডিশ থেকে একটা দুটো চিনেবাদাম তুলে বাপী দাঁতে কাটছে, আর অনেকটা আপন মনেই হাসছে। নতুন গেলাসে নতুন চুমুক বসিয়ে মাখন-মুখ উৎসুক।— হাসছ যে?

—না, ভাবছিলাম…

—কি?

—আমাদের চিন্তাটিন্তাগুলো দিনে দিনে কেমন ছোট হয়ে গেল, মানে ন্যারো হয়ে গেল সেই কথা। …নইলে এই ঘোড়দৌড় আমাদের সেই কতকালের রাজরাজড়ার খেলা, যার যত বড় দিল তার-এ খেলায় ততো বেশি টান।…জুয়াতে হেরে যুধিষ্ঠির হেন মানুষ সভার মধ্যে নিজের স্ত্রীকে বে-ইজ্জত পর্যন্ত করালেন তাতে দোষ হল না, আর আমরা দশ-বিশ টাকায় একটু আনন্দ পেতে চাইলেই মস্ত দোষ।…আর সুরা জিনিসটাই বা কি? আসল—দেব-দেবতা থেকে শুরু করে মহাযোগী ঋষি পর্যন্ত এ জিনিস ছাড়া কার চলত?

কথা নয়, সমস্ত মন ঢেলে কথকতা শুনছে অসিত চ্যাটার্জি। তারপর গলায় সবটুকু আকুতি ঢেলে বলল, বাপী আমাদের বাড়িতে একবারটি এসে মিলুকে ঠিক এমনি করে বলে বোঝাও, ওই মা আর দাদাটি সত্যি মাথাটা ওর মাঝে মাঝে বিগড়ে দিচ্ছে!

রসালো ডিনার শেষ হবার ফাঁকে মোট চারদফা গেলাস শেষ। এরপর আর একবার ওয়ান ফর দি রোড-এও বাপী আপত্তি করল না। পঞ্চম গেলাস শেষ হতে ঘড়িতে সাড়ে দশটা। বিল মিটিয়ে বাপী চটপট উঠে পড়ল। আর বাড়লে লোকটাকে হয়তো সিঁড়ি দিয়ে নামানো দায় হবে।

হাত ধরে নিচে নামালো। রাস্তায় এসে ট্যাক্সির খোঁজ। রাস্তার ওধারে দু’তিনটে ট্যাক্সি দাঁড়িয়েই আছে। তাকে ধরে পার হতে হতে বাপী বলল, আমাকে তুমি কিন্তু মুশকিলে ফেললে অসিতদা, মিলুকে কথা দিয়েও কথা রাখলে না—ও আমাকেই এরপর যাচ্ছেতাই বলবে—

আর তিন হাতের মধ্যে ট্যাক্সি। তার আগেই লোকটা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গলায় হুমকি।—কি? তোমাকে যাচ্ছেতাই বলবে? মিলু ছেড়ে মিলুর বাপ এসে কিছু বলুক দেখি তোমাকে—মুখ একেবারে ভোঁতা করে দেব না? আমার নাম অসিত চাটুজ্জে!

…টাকা মন্দ খরচ হল না আজকে। বাপীর পরিতুষ্ট মুখ। খরচের কড়ায় গণ্ডায় সার্থক। ফ্ল্যাটে এসেও নিজের মনে হেসেছে আর অসিত চ্যাটার্জি ঘরে ফেরার পর মিষ্টির মুখখানা কেমন হতে পারে কল্পনা করতে চেষ্টা করেছে। তার জোরের মানুষের জোর বোঝা গেছে। মিষ্টি বুঝতে চায় না, কারণ এই জোরের কল্পনাটুকুই ওর কাছে শেষ সম্বল। জোর গলায় বলেছিল, এতে ভেজাল থাকলে ও নিজেই ছেঁটে দিত বা দেবে।…দেখা যাক।

পরদিনও সকাল থেকে একটা প্রচণ্ড লোভের রাশ টেনে ধরে আছে। এয়ার অফিসে গিয়ে মিষ্টির মুখখানা একবার দেখার লোভ। আজ ও গিয়ে দাঁড়ালে সেই মুখের প্রতিক্রিয়া কেমন হয় দেখার বাসনা।

নিজেকে আগলাবার জন্যেই সকালের কাজের পর দুপুরের লাঞ্চ সেরেই ঊর্মিলার ওখানে চলে গেছে। আর মাত্র দুটো দিন আছে ওরা, ওই মেয়ে ক্ষেপেই আছে। বিকেলে আবার কোন ফ্যাসাদে আটকে যায় কে জানে। মাস্টারমশায়ের শরীর সকালে বেশ খারাপ দেখে এসেছে। প্রতিদিন থেকে প্রতিদিন খারাপ মনে হচ্ছে। তাঁর সময় দ্রুত ঘনিয়ে আসছে বোঝা যায়। সকালে ভদ্রলোক ওকে বলেছে পারলে বিকেলে আবার আসিস বাবা, তোকে দেখলেই প্রাণটা ঠাণ্ডা হয়। বাপী আসবে আশ্বাস দিয়ে এসেছে।

বিজয় আপিসের কার সঙ্গে দেখা করার জন্যে নিচে নেমেছে। এখন আর ওর আপিস নেই। বেশ লম্বা একপ্রস্থ বকা-ঝকা রাগারাগির পর ঊর্মিলা একটু ঠাণ্ডা মাথায় বাপীকে ভালো করে লক্ষ্য করল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, দিনে না হয় তুমি কাজ নিয়ে ব্যস্ত…রাতে কি নিয়ে ব্যস্ত?

—রাতে ব্যস্ত তোমাকে কে বলল?

—কাল রাত সাড়ে দশটায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিজয়কে এদিকের এক সাহেবের ফ্ল্যাট থেকে তোমাকে ফোন করার জন্য পাঠিয়েছিলাম। ফোন বেজে গেছে, কেউ ধরে নি।

আগে যে প্রসঙ্গ বাপী এড়িয়ে গেছে, আজ হঠাৎ তার বিপরীত ঝোঁক কেন, জানে না। ঠোঁটের হাসিতে কৌতুক মিশল একটু। জবাব দিল, কাল রাতে হোটেলে একজনকে এনটারটেন করতে হল।

যেভাবে বলল, ঊর্মিলার চাউনি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠবে জানা কথাই।—একজন? মহিলা না ভদ্রলোক?

—ভদ্রলোক। তবে যা ভাবছ তার সঙ্গে তাঁর যোগ আছে।

ঊর্মিলা উৎসুক।—কি যোগ?

—মহিলার হাজব্যান্ড।

ঊর্মিলা ডবল উৎসুক।—মিষ্টির হাসব্যান্ড! রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত তাঁকে একলা এনটারটেন করলে?

বাপী হাসছে মিটিমিটি। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, আর একদিনও হোটেলে করেছিলাম—

বড় বড় চোখ করে ঊর্মিলা আগে একদফা পর্যবেক্ষণ করে নিল। তারপর জোর দিয়ে বলল, তোমার মতিগতি একটুও ভালো দেখছি না—ভদ্রলোককে পথে বসাবার মতলব নাকি?

—ভদ্রলোকের যা চরিত্র নিজেই অনেকখানি পথে বসে আছে।

ঊর্মিলার চাউনি এখনো বিস্ফারিত তেমনি। মিষ্টির সঙ্গে তোমার দেখা হয়? বাপী নির্লিপ্ত। না হবার কি আছে।

ঊর্মিলা ব্যগ্রমুখে ঝাঁঝিয়ে উঠল, আর আমাকে একটিবার দেখালে না! আমার এত ইচ্ছে ছিল…

কথার মাঝে থমকালো। কৌতূহলের ওপর দুশ্চিন্তার ছায়া পড়তে লাগল। গলার স্বরেও চাপা আবেগ মিশল একটু।—বাপী, তোমাকে আমি বোধ হয় তোমার থেকেও ভালো চিনি…তুমি কক্ষনো কোনো ছোট কাজ করতে পারো না, করবেও না। মাঝখান থেকে আরো দুঃখু পাওয়ার রাস্তা করছ না তো?

শেষের কথায় বাপী কানও পাতল না। এতক্ষণের দাবিয়ে রাখা সেই লোভটাই আবার মাথায় চেপে বসল। মিষ্টির সামনে আজই একটিবার গিয়ে দাঁড়ানোর দুর্বার লোভ। সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যানও ঠিক। গম্ভীর।—তুমি আর দয়া করে আমার ওপর মাস্টারি করতে বোসো না—যাকে পেয়েছ তাকেই সামলে-সুমলে রাখো। দুদিন বাদে আমেরিকা দেখতে তো যাচ্ছ—ভালো করে কলকাতা দেখা হয়েছে?

তক্ষুনি রেগে ওঠার সুযোগ পেল ঊর্মিলা।—খুব দেখা হয়েছে, সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত একজন আপিস ঠ্যাঙাচ্ছে—আর একজনের কলকাতায় এসেও পাত্তা নেই—জিগ্যেস করতে লজ্জাও করে না!

বাপী তক্ষুনি উঠে দাঁড়াল।—লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম, রেডি হয়ে নাও। আমি ততক্ষণে নিচে নেমে বিজয়ের বুকে একটু দাগা দিয়ে আসি—

.

ঊর্মিলার খুশি আর ধরে না। হড়বড় করে এটা সেটা গল্প করে চলেছে। সেই খুশির ফাঁকে গাড়ির স্পিড কত চড়ানো হয়েছে খেয়াল নেই। বাপীর ঘড়ির দিকে চোখ আছে। বেড়ানোর নামে বেরুনো বেড়াতে একটু হবেই। আর বিকেল চারটের মধ্যে সেই এয়ার অফিসের দরজায় গাড়ি ভিড়ানোরও তাগিদ।

ঠিক সময় ধরেই পৌঁছুলো। নিজে গাড়ি থেকে নেমে ঊর্মিলাকে বলল, নামো—

এয়ার অফিসের সাইনবোর্ড দেখে ঊর্মিলা অবাক!—এখানে কোথায়?

—ভয় নেই, আজই টিকিট কেটে তোমাকে নিয়ে কোথাও হাওয়া হয়ে যাচ্ছি না। এসো—

ওকে নিয়ে দোতলায় উঠল। কয়েক পা এগোলেই সেই ঘর। অপেক্ষা করতে হল না, ঘরে দ্বিতীয় কেউ নেই। দরজা ঠেলে বাপীই প্রথম ভিতরে ঢুকল, তারপর ওটা রেখে বাইরের দিকে চেয়ে ডাকল, এসো—

কলম রেখে মিষ্টি সোজা হয়ে বসেছে। এই লোককে দেখামাত্র মুখে তাপ ছড়াচ্ছিল। তারপরেই অবাক। ঊর্মিলাও ভিতরে পা দিয়ে বিমূঢ়।

বাপী গম্ভীর। এটা যে অফিস তার জন্য ভ্রূক্ষেপ নেই। ঊর্মিলাকে বলল, দেখো—

ঊর্মিলা বড় বড় চোখ করে সামনে চেয়ে দেখল খানিক। মিষ্টিও।

মিষ্টি। চাপা উচ্ছ্বাসে প্রায় নিজের অগোচরে ঊর্মিলার গলা দিয়ে নামটা বেরিয়ে এলো। তারপর টেবিলের কাছে এগিয়ে একমুখ হেসে বলল, আমাদের ফ্রে কি দুষ্টু দেখো, আমি মিষ্টি দেখতে চেয়েছিলাম বলে আগে থেকে কিচ্ছু না জানিয়ে হুট্ করে এনে হাজির করল! ঘুরে বাপীর দিকে তাকালো।—আমি তো মিষ্টি দেখলাম কিন্তু আমি কে ওঁকে বললে না?

গায়ত্রী রাইয়ের মেয়ে, তার বুদ্ধি নেই কে বলবে। জায়গা বুঝে আমার না বলে আমাদের ফ্রেন্ড বলল। বাপীর একেবারে সাদামাটা মুখ। জবাব দিল, বলার দরকার নেই, বুঝেছে। সব থেকে দূরের চেয়ারটায় বসল সে।

ঊর্মিলা আবার টেবিলের দিকে ফিরল।—কে বলো তো?

ঊর্মিলা। সৌজন্যবোধে মিষ্টির ঠোঁটের ফাঁকে সামান্য হাসি। তার এই ব্যক্তিত্ব যতটা সজাগ ততোটা সহজ নয়।—বসুন।

ইচ্ছে করেই তুমি’র জবাবে ‘তুমি’ বলল না।

—বসুন! মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে পড়ে অকৃত্রিম খুশির সুরে ঊর্মিলা বলল, আমি ভাই আস্ত একখানা জংলি মেয়ে, আপনি-টাপনি শিকেয় তুলে রেখে দাও। আঙুল তুলে বাপীকে দেখালো।—ওই জবরদস্ত ফ্রেন্ড-এর ওপরেও প্রথম দিনই তুমি চালিয়ে কেমন ঘায়েল করেছিলাম জিগ্যেস করো।

স্বতোৎসারিত খুশির উষ্ণ স্পর্শ একটু আছেই। চেষ্টা করলেও এরকম মেয়েকে ঠাণ্ডা ব্যবধানে সরিয়ে রাখা সহজ নয়। মিষ্টি তবু ওদিকের লোকের দিকে একবারও না তাকিয়ে ঈষৎ তেরছা সুরে বলল, মালিকের মেয়ের কাছে ঘায়েল হতে পারা তো ভাগ্যের ব্যাপার।

ঊর্মিলার চোখ তক্ষুনি বড় বড় আবার।—ভাগ্য আমার? তুমি তাহলে ফ্রেন্ডকে কেমন চেনো? মেয়ে ছেড়ে উল্টে খোদ মালিকই কেমন ঘায়েল হয়ে গেল জানো না তো। ভুরু কুঁচকে ঘাড় বেঁকিয়ে বাপীর দিকে তাকালো। বলে দেব?

বাপী ছোট হাই তুলল একটা—তোমার জিভ আর কে টেনে ধরে রাখতে পারছে।

আবার একটা খুশির ঝাঁকুনি দিয়ে ঊর্মিলা সামনে তাকালো।—কটা বছরের মধ্যে মাকেই ও যেভাবে ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল, হিংসেয় আমার গা জ্বলে যেত—আমি বলতাম মায়ের বয়েস আর দশটা বছর কম হলে আর ওর দশটা বছর বেশি হলে ঠিক একটা গড়বড় হয়ে যেত!

অফিস আর ব্যক্তিত্ব ভুলে মিষ্টিও এবারে একটু হেসেই ফেলল।—চা বলি?

ঊর্মিলা বাপীর দিকে ফিরল।—খাবে?

চেয়ারের কাঁধে মাথা রেখে বাপী ঘরের ছাদ দেখছে।—আমার অনুমতি দরকার?

—ছাই দরকার। মিষ্টির মুখোমুখি। —বলো।

বেল টিপে হুকুম করতে বেয়ারা দু’ মিনিটের মধ্যে ট্রে-তে পট আর তিনটে পেয়ালা রেখে গেল। সেই ফাঁকে ঊর্মিলা টেবিলে দু-হাত রেখে আর একটু ঝুঁকে মিষ্টিকে দেখছে। সঙ্গে সঙ্গে খুশির মন্তব্য।—সত্যি মিষ্টি। গম্ভীর থাকলে মিষ্টি, হাসলে মিষ্টি, কথা কইলে মিষ্টি—এত মিষ্টি আমি ভাবিনি!

পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে মিষ্টি একবার তার দিকে তাকিয়ে আলতো করে জিজ্ঞাসা করলো, নিজের মুখ আয়নায় দেখো-টেখো না?

—আমার সঙ্গে তোমার তুলনা! আমি হলাম গিয়ে একটা জংলি মাকাল ফল…লেখাপড়ায় কাঁচকলা—আর তুমি? এক-একবার কাগজে তোমার রেজাল্ট বেরোয় আর ওই বাবুর তখন—

কি হচ্ছে! সোজা হয়ে বসে একটা পেয়ালা টেনে নিতে নিতে বাপী বলল, পরস্ত্রীর কাছে এইসব গল্প করার জন্য তোমাকে এখানে আনা হয়েছে নাকি?

এই প্রথম মিষ্টি সোজা তাকালো তার দিকে। চেষ্টা সত্ত্বেও ভিতরের আঁচ গোপন থাকল না খুব। গলা না চড়িয়ে বলল, পরস্ত্রী যে সে-জ্ঞান ওর থেকে তোমার আর একটু বেশি থাকলে আমার সুবিধে হয়।

চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বাপী দেওয়ালের ক্যালেন্ডার দেখছে। নিস্পৃহ গোছের জবাবও দিল। —মনে রাখতে চেষ্টা করব।

গত রাতে একজন মাতাল হয়ে ঘরে ফেরার কারণে এই উষ্মা আর এই মুখই দেখবে আশা করেছিল। কিন্তু ঊর্মিলা একটু ঘাবড়ে দিয়ে বলল, আমি এলাম বলে…?

তার দিকে চেয়ে মিষ্টি তক্ষুনি হাসল—তুমি এলে বলে ও-কথা বলব কেন? তোমাকে সত্যি খুব ভালো লেগেছে।

ঊর্মিলা সঙ্গে সঙ্গে উৎফুল্ল। বলো কি।

—হ্যাঁ ঠোঁটের ফাঁকে তার পরেও হাসি ঝুলছে।—তোমাকে দেখার পর ভাবছি এক-একটা লোক কত বোকা হয়। খুব মন দিয়ে তারা ট্র্যাজিক হিরো হতে চেষ্টা করে।

এবারে মোলায়েম খোঁচাটা বাপীর ঠিকই লাগল। নাগালের জনকে ছেড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরের দূরের জনকে নিয়ে বিভোর হয়ে থাকার খোঁচা। কিন্তু সময় বুঝে ঊর্মিলাও চোখ কপালে তুলতে জানে। একটু চেয়ে থেকে তরল গলায়ই বলে উঠল, মুখ্যুসুখ্যু মানুষ অত বুঝিনে ভাই…ফ্রেন্ডের ওপর তুমি খুব রেগে আছ এটুকু শুধু বুঝছি। তুমি কেন, ও আমাকে কম জ্বালিয়েছে। তবু তো তোমাকে আমার থেকে বেশি কেয়ার করে—তুমি আর তোমার বর ওর খোঁজখবর রেখো একটু, নইলে আরো অধঃপাতে যাবে।

মিষ্টি নিজেকে ব্যক্তিত্বের সংযমে বেঁধেছে আবার। সামান্য মাথা নেড়ে স্পষ্ট অথচ মোলায়েম সুরে বলল, আমাদের অত সময় হবে না ভাই—এতকাল তোমরা খোঁজ-খবর রেখেছ, তোমরাই রেখো।

—আমরা! দুদিন বাদে আমরা তো আমেরিকায়! জানোই না বুঝি? বোকার মতো ফেঁসে গেলাম বলে, নইলে এই লোকের ভার কেউ কাউকে দেয়! তরল উচ্ছ্বাসে জিব এবারে আরো আলগা। কি অন্যায় দেখো, ছেলেদের বেলায় তিন—চারটে বউ নিয়ে ঘর করলেও দোষ নেই, আমাদের বেলায় একের বেশি হল তো মহাভারত অশুদ্ধ।

রসের কথায় ঊর্মিলা এমনিতেই ঠোঁট কাটা মেয়ে। কিন্তু এখন যেন ইচ্ছে করেই আরো বেপরোয়া। ও-পাশ থেকে বাপী আলতো করে বলল মহাভারতে তোমাদের একসঙ্গে পাঁচজনের ঘর করার নজির আছে, এত যখন টান বিজয়কে বলে দেখতে পারো…যদি রাজি হয়ে যায়। …

ঊর্মিলা ভ্রুকুটি করে তাকালো তার দিকে।—দেব ধরে থাপ্পড়। তারপরেই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল।—আজ চলি ভাই, অনেক হামলা করে গেলাম—তোমার মনে থাকবে নিশ্চয়।

সৌজন্যবোধে মিষ্টিও উঠে দাঁড়াল। মুখের ওপর চোখ রেখে হাসছে অল্প অল্প। সামান্য মাথাও নাড়ল।

—থ্যাংক ইউ। বাপীকে ডাকল, এসো—

ঊর্মিলা আগে আগে দরজার দিকে এগলো। পিছনে বাপী। ঊর্মিলা দরজা ঠেলে বেরুতেই বাপী ঘুরে দাঁড়াল।

টেবিলের ও-ধারে মিষ্টি দাঁড়িয়ে তখনো। ঠোঁটের হাসি মিলিয়েছে। বাপী চেয়ে আছে। মিষ্টিও। এতক্ষণের উষ্ণ তাপ সেই পলকের মধ্যেই মুখের দিকে ঠেলে উঠেছে।

পলকা গাম্ভীর্যে বাপী বলল, চলি তাহলে?

মিষ্টি জবাব দিল না, চেয়েই আছে।

বাপী দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো।

.

বাপী গাড়ি চালাচ্ছে। সামনের দিকে গম্ভীর মনোযোগ। পাশে ঊর্মিলা। আড়ে আড়ে দেখছে তাকে। একটু বাদে আধাআধি ঘুরেই বসল। ভুরুতে পলকা ভ্ৰূকুটি। আটঘাট বেঁধে প্রস্তুত হবার মতো করে বলল, তাহলে কি দাঁড়াল?

বাপী নির্লিপ্ত জবাব দিল, কি আর, তোমার দেখার ইচ্ছে ছিল, দেখা হল।

ঊর্মিলারও গম্ভীর হবার চেষ্টা। সামান্য মাথা নাড়ল।—হ্যাঁ দারুণ দেখা হল। প্রথমে মিষ্টি দেখলাম। তারপর মিষ্টির চোখ দিয়ে তোমাকে দেখলাম। শেষে তোমার চোখ দিয়ে মিষ্টিকে দেখলাম। এত দেখার ধাক্কায় এখন আমি খাবি খাচ্ছি, আর ভাবছি এ-সময়ে মায়ের বেঁচে থাকার খুব দরকার ছিল।

মায়ের কথায় বাপী একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখে নিল তাকে।—এ সময়ে মানে?

—মানে বুঝতে তোমার অসুবিধে হচ্ছে? মা ছাড়া কেঁ আর তোমাকে চুলের ঝুঁটি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে বানারজুলির মাটিতে পা দুটো পুঁতে রাখতে পারত?

বিবেকের কাঁটা ফোটাতে চায় ভেবে বাপীর ভিতরটা উষ্ণ হয়ে উঠল। তবু নিস্পৃহ সুরেই জিগ্যেস করল, তোমার খুব ভাবনা হচ্ছে?

—খুব। সম্ভব হলে বিজয়কে বলে যাওয়া ক্যানসেল করতাম।…এক্ষুনি কি ভাবছিলাম জানো?

ভিড়ের রাস্তা। বাপী মুখ ফেরালো না। কান খাড়া

—ভাবছিলাম…এই মিষ্টি-হারা হয়ে বানারজুলিতে ফিরে সেই রাতে ক্ষেপে গিয়ে আমাকে যে তুমি একেবারে শেষ করে দাও নি সেটা নেহাত মায়ের পুণ্যির জোর। মিষ্টি তোমার চোখে কত মিষ্টি সেটা আজ বোঝা গেল। কিন্তু আমার মায়ের মতো অত পুণ্যির জোর তার স্বামী বেচারার আছে?

ধরা পড়ে বাপীরও মুখোশ খুলছে। ঠোটের ফাঁকে ক্রূর হাসির ঝিলিক।—নেই মনে হল?

—খুব। থাকলে মিষ্টি আরো ঢের সহজে তোমাকে বরদাস্ত করতে পারত। নয়তো ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারত। তার বদলে শ্যাম আর কুল দুই নিয়ে বেচারী কেবল জ্বলছে মনে হল।

বিশ্লেষণ শুনে কান জুড়লো। মা গায়ত্রী রাই তোমার মেয়ের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। ভিতরে পরিতুষ্ট আরো। মেয়েটা ভালবাসতে জানে বলেই ভালবাসার অনেক চেহারাও অনায়াসে মনে দাগ কাটে। তবু গায়ত্রী রাইয়ের মেয়েকে আর বাড়তে দেওয়া নিরাপদ ভাবছে না। তাই সামনে মনোযোগ। গম্ভীর। বাজে বোকো না।

—বাজে বকা হল? ঊর্মিলার গলা চড়ল একটু।—ওর বরকে তুমি একলা হোটেলে নিয়ে গিয়ে এনটারটেন করো কোন মতলবে—উদারতা দেখাও, না বুকে ছুরি বসাও?

সামনে ট্র্যাফিকের লাল আলো জ্বলে উঠেছে বাপীর সেদিকে খেয়াল নেই। একটা ক্রুদ্ধ ডাক শুনে আচমকা ব্রেক কষে গাড়ি থামালো। অদূরের পুলিশটা চেঁচিয়ে উঠেছে আর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির নম্বর নেবার জন্য নোটবইটাও হাতে উঠেছে। তাড়াতাড়ি গাড়িটা ব্যাক করে বাপী সাদা দাগের এধারে নিয়ে এলো। রুষ্ট পুলিশের দিকে চেয়ে এমন করে হাসল যেন লজ্জায় তারই মাথা কাটা যাচ্ছে। আশপাশের গাড়ি থেকেও অনেকে দেখছে।

ছদ্মরাগে ঊর্মিলার দিকে ফিরে বাপী চোখ পাকালো।—তুমি মুখ বন্ধ করবে, না এর পর লোক চাপা দেব?

কিন্তু মুখের কথা শেষ হবার আগেই চোখ দুটো হঠাৎ প্রচণ্ড রকমের ধাক্কা খেল একটা। ঊর্মিলার ও-পাশ ঘেঁষে রং-চটা একটা ছোট অস্টিন গাড়ি দাঁড়িয়ে। ভার চালকের বিস্ফারিত দুই চোখ এই গাড়ির দিকে। তার পাশে যে বসে সেই মহিলারও। স্থান-কাল ভুলে দু’জনেই তারা ঝুঁকে বাপীকে দেখছে, ক্রিম রঙের ঝকঝকে বিলিতি গাড়ি দেখছে, আর ঊর্মিলাকে দেখছে।

অস্টিনের চালকের আসনে বসে মণিদার পাশের বাড়ির কনট্রাকটর সন্তু চৌধুরী। তার পাশে মণিদার বউ গৌরী বউদি

…সন্তু চৌধুরীর স্টিয়ারিং-ধরা ডান হাতের পুষ্ট কব্জিতে সেই মস্ত সোনার ঘড়ি। দু’হাতের আঙুলে সেই রকম ঝকঝকে সাদা আর নীল পাথরের আংটি পরনে ট্রাউজার গায়ে সিল্কের শার্ট। শার্টে হীরের বোতাম। ফর্সা রং বটে, মুখশ্রী আগেও সুন্দর ছিল না। ছটা বছর বয়েস বাড়ার দরুন কিনা জানে না, দেখামাত্র এই সাজসজ্জায় মানুষটাকে বাপীর আগের থেকেও খারাপ লাগল।

আগে লাল আলো খেয়াল না করে পুলিশের ধমক খেয়েছে। এখন আবার সবুজ আলোয় থেমে আছে দেখে পুলিশ হাঁক দিল। পিছনের দাঁড়ানো গাড়িগুলো হর্ন দিচ্ছে, পাশের অস্টিনও ততক্ষণে বিশ গজ এগিয়ে গেছে। রাস্তাটা পেরিয়ে বাপী গাড়ির স্পিড চড়াতে গিয়েও ব্রেকে পা রাখল। সামনের অস্টিন ফুটপাথের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গৌরী বউদি নামছে।

নিজের গাড়ি বাপী হাত দশেক পিছনে দাঁড় করালো। সামনের অস্টিন ওর জন্যেই দাঁড়িয়ে গেছে বুঝতে অসুবিধে হল না। গৌরী বউদি শুধু নয়, সন্তু চৌধুরীও নেমেছে। স্টার্ট বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে ইশারায় ঊর্মিলাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে বাপীও হাসি-হাসি মুখে নেমে এলো।

গৌরী বউদির পরনের হাল্কা নীল দামী শাড়ি। গায়ের শামলা রঙের সঙ্গে মানায় না এমন কটকটে শাড়ি বা ব্লাউস আগেও পরত না। তবে প্রসাধনের পরিপাট্য আগের থেকে কিছু বেড়েছে মনে হল। তা সত্ত্বেও বয়েসের দাগ স্পষ্ট। কাছে আসার ফাঁকে বাপী হিসেব করে নিয়েছে।…সেদিন আঠাশ ছিল, এখন চৌত্রিশ। আঠাশের ধারালো কথাবার্তা আর তার থেকেও বেশি ধারালো মেজাজের ফাঁকে যে রসের দাক্ষিণ্য উঁকিঝুঁকি দিত, এখন তাতেও টান ধরেছে মনে হয়।

বিস্ময়ের ধাক্কায় সন্তু চৌধুরীর বরং আগের থেকেও দিল-খোলা হাসি মুখ। কাছে আসতে এক হাত কাঁধের ওপর তুলে দিয়ে বলল, আমরা তাহলে ভুল দেখি নি ব্রাদার—অ্যাঁ?

বাপীও হাসিমুখে মাথা নাড়ল। ভুল দেখে নি। তোয়াজের সুরে বলল, সন্তুদা আবার কবে ভুল দেখেছে।

এই সন্তু চৌধুরীই একদিন ওর চেহারাখানা ‘ডিসেপটিভ’ বলেছিল বাপী ভোলে নি। ভদ্রলোক আবার হাসল এক দফা।—তোমার বউদি তো দেখেও বিশ্বাস করতে পারে নি, তাই গাড়ি থামিয়ে নামলাম। কথার ফাঁকে আপাদ-মস্তক চোখ বুলিয়ে নিল একবার।—বিশ্বাস করা শক্তই অবশ্য…সেই তুমি পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে এই তুমি! কি ব্যাপার বলো দেখি ভায়া, চাকরিতে তো এত বরাত ফেরে না—ব্যবসা?

বাপী তেমনি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিল।

সন্তু চৌধুরী ওর ঝকঝকে বিলিতি গাড়িটা আর একবার দেখে নিল। একই সঙ্গে ঊর্মিলাকেও। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যবসা? কলকাতাতেই?

জবাবে কোটের ভিতরের পকেট থেকে মোটা ব্যাগটা বাপীর হাতে উঠে এলো। আইভরি ফিনিশড কার্ড বার করে তার হাতে দিল। ফ্ল্যাট নেবার পর এ কার্ড নতুন করা হয়েছে। ব্যবসার নাম মালিকের নাম বাড়ির ঠিকানা ফোন নম্বর সবই এতে ফলাও করে ছাপা আছে।

কার্ডটা উল্টে-পাল্টে দেখে সন্তু চৌধুরী সেটা গৌরী বউদির দিকে এগিয়ে দিল। হাতে নিয়ে গৌরী বউদিও চোখ বোলালো। বাপীর এখন অন্তত ‘ডিসেপটিভ মুখ তাতে নিজেরও সন্দেহ নেই। বুকের তলায় খুশির ঢেউ, বাইরে, লজ্জা-লজ্জা মুখ

তরল স্বীকৃতির সুরে সন্তু চৌধুরী বলল, তোমার সঙ্গে সেই পাঞ্জায় হারার পরেই আমার মনে হয়েছিল তুমি কালেদিনে কিছু একটা হবে—নাও ইউ আর রিয়েলি সামবডি! এ গ্রান্ড সারপ্রাইজ ব্রাদার—

গৌরী বউদিকে একবার দেখে নিয়ে সন্তু চৌধুরী আবার বাপীর দিকে তাকালো। খুব মজাদার কিছু মনে পড়েছে যেন।—তোমার বউদির সঙ্গে একটাও কথা বলছ না কি ব্যাপার! চওড়া কপালের তুলনায় ছোট ছোট দুই চোখে কৌতুক উপচে উঠল। জবাবের অপেক্ষা না রেখে তরল উচ্ছ্বাসে নিজেই মুখর আবার।—আমি ভায়া সব-কিছু স্পোর্টিংলি নিয়ে থাকি, বুঝলে? সেদিক থেকে আমি এভার গ্রীন অ্যান্ড এভার ইয়ং। হুট করে তুমি ঘর-ছাড়া হতে আমি তোমার হয়েই এক হাত লড়েছিলাম কিনা জিগ্যেস করে দেখো!

বেশ গলা ছেড়ে হেসে উঠল সন্তু চৌধুরী। বাপীর হাসি-ছোঁয়া নিরীহ দু’চোখ এখন গৌরী বউদির মুখের ওপর। চকিত ধড়ফড়ানিটুকু দৃষ্টি এড়ালো না। তার ঘরছাড়া হবার ব্যাপারটাকে এই লোকের কাছে গৌরী বউদি যে নিজের কদর বাড়ানোর মতো করেই বিস্তার করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাগ দূর থাক বাপীর মজাই লাগছে।

সামলে নিয়ে বিরক্তির ভ্রুকুটি জোরালো করে তুলল গৌরী বউদি। ঝাঁঝালো গলায় বলল, মেয়েমানুষের সঙ্গে কি ইয়ারকি হচ্ছে। ছ’বছর আগের সেই মেজাজেই বাপীর দিকে ফিরল।— মস্ত মানুষ হয়েছ দেখতে পাচ্ছি, গরিব দাদার বাড়ির রাস্তা আর মনে নেই নিশ্চয়ই?

বাপী অম্লানবদনে জবাব দিল, নিশ্চয় আছে। হুকুম হলেই যেতে পারি।

গৌরী বউদি অপলক চেয়ে রইল একটু। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমার হুকুম করার দিন গেছে, ইচ্ছে হলে যেও একদিন…বাচ্চু এখনো তার বাপীকাকাকে ভোলে নি।

সাদা কথা ক’টা প্রাঞ্জল ঠেকল। গৌরী বউদির রাগ বিরাগ বা ঠেসঠিসারার সঙ্গে গলার এই সুর মেলে না। কিন্তু বাচ্চুর নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরটা নির্দয় হয়ে উঠতে চাইল।…বছর সাতেক বয়েস ছিল তখন ছেলেটার, এখন বছর তের হবে। এই বয়সে বাপী অনেক জানত অনেক বুঝত, অনেক কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতো। আবু তখন বলত, মেয়ে-পুরুষের ভালবাসাবাসির ব্যাপারে মানুষে জানোয়ারে কোনো তফাৎ নেই। এই গৌরী বউদি আর মণিদা বানারজুলি বেড়াতে আসার ফলে বাপীর চোখের সামনে রহস্যের শেষ পর্দাটুকুও ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার হয়ে গেছিল।…আজ নিজের ছেলে মায়ের এই অভিসার কি-চোখে দেখছে? কি ভাবছে?

গৌরী বউদির দৃষ্টি আবার পিছনের গাড়ি অর্থাৎ ঊর্মিলার দিকে। সন্তু চৌধুরীও ঘনঘন ওদিকেই তাকাচ্ছিল। চাপা আগ্রহ নিয়ে ভদ্রলোক এবারে বাপীর দিকে ফিরল।—মেয়েটি কে…বাঙালী মনে হচ্ছে না তো?

— বাঙালী নয়।

—তোমার বউ?

বাপী চট করে গৌরী বউদির গম্ভীর মুখখানা দেখে নিল একবার। ঠোঁটের ফাঁকে সরস হাসি, সন্তু চৌধুরীর দিকে ফিরে জবাব দিল, আমার নয়, অন্য এক ভদ্রলোকের বউ।

গৌরী বউদি তাড়াতাড়ি নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। নিরাপদ ব্যবধান বুঝে সন্তু চৌধুরী চাপা আনন্দে গলা খাটো করে বলল, কংগ্রাচুলেশনস! তোমাকে দেখে খুব আনন্দ হল ব্রাদার…ফাঁক পেলে তোমার বাড়ি যাব’খন একদিন।

ভুল বোঝার ইন্ধন নিজেই যুগিয়েছে। ওই হাসি মুখের ভোল পাল্টে দেবার জন্য হাত দুটো নিশপিশ করে উঠল এখন। ওদিক থেকে গৌরী বউদির নীরব ঝাঁঝালো তাড়া খেয়ে ব্যস্ত পায়ে সন্তু চৌধুরী তার গাড়ির দিকে এগোল।

নিজের জায়গায় ফিরে গাড়িতে স্টার্ট দিতেই ঊর্মিলা ধমকে উঠল, মেয়েছেলে দেখলেই অমন আটকে যাও কেন—বসে আছি তো বসেই আছি।

সামনের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। বাপী ধীরে সুস্থে চালাচ্ছে।

ঊর্মিলা আবার জিজ্ঞাসা করল, তোমাকে দেখে ভদ্রলোক আর মহিলা দু’জনেই খুব অবাক মনে হল…কে?

সামনে চোখ রেখে বাপী এবার গম্ভীর মুখে জবাব দিল, মহিলা আমার জ্যাঠতুতো দাদার বউ। ভদ্রলোক তাঁর প্রেমিক

ঊর্মিলার চাউনি উৎসুক। ঠিক বিশ্বাস হল না। তরল সুরেই আবার জিগ্যেস করল, তোমার আর মিষ্টির মতো?

বাপী ভিতরে ভিতরে ধাক্কা খেল একপ্রস্থ। গৌরী বউদির সঙ্গে সন্তু চৌধুরীর সম্পর্কটা কোন দিন নোঙরামির ঊর্ধ্বে মনে হয়নি বাপীর। তাই জবাবও অকরুণ।——বিজয় আর ফুটফুটে একটা ছেলেকে ফেলে তোমার অন্য কোনো লোকের ঘর করার মতো।

ঊর্মিলা বুঝল। সঙ্গে সঙ্গে নাক মুখ কুঁচকে বলে উঠল, কি বিচ্ছিরি! একটু বাদেই উৎসুক আবার।—এই জন্যেই তোমার ওপর মহিলাকে একটুও খুশি মনে হল না।——কিন্তু ওঁরা আমাকে অমন ঘন ঘন দেখছিলেন কেন—আর শেষে ভদ্রলোক কি বলছিলেন তোমাকে?

বাপী শেষেরটুকুর জবাব দিল। বলল, আমিও অন্যের বউয়ের সঙ্গে আনন্দ করে বেড়াচ্ছি ধরে নিয়ে ভদ্রলোক আমাকে কংগ্রাচুলেট করছিলেন।

ঊর্মিলা বাপীর কাঁধে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে নিজে সোজা হয়ে বসল।

বাপী বিমনা। মিষ্টির অফিস থেকে যে মেজাজ নিয়ে বেরিয়েছিল তার সুর কেটে গেছে। ছ’টা বছর জুড়ে মণিদার ছেলে বাচ্চুর মুখখানা ভাবতে চেষ্টা। করল। পারা গেল না। সাত বছরের সেই দুষ্টু কচি মুখখানা চোখে ভাসছে।

বুকের তলায় অবাঞ্ছিত মোচড় পড়ছে একটা।…মিষ্টির কোলেও আজ যদি একটা বাচ্চা থাকত বাপী কি করত? অসহিষ্ণু আক্রোশে চিন্তাটা মগজ থেকে ছিঁড়ে সরাতে চেষ্টা করল। পারল না। ভিতরের কেউ বরাবর যা করে তাই করছে। ওকে বিচারের মুখে এনে দাঁড় করাচ্ছে। জিগ্যেস করছে, সন্তু চৌধুরীর সঙ্গে তফাৎ কোথায়? তফাৎ কতটুকু?

ওই অদৃশ্য বিচারকের মুণ্ডুপাত করতে চেয়ে বাপী মনে মনেই ঝাঁঝালো জবাব দিল, তফাৎ ঢের, তফাৎ অনেক—মিলন আর ব্যভিচারে যত তফাৎ—ততো।

কিন্তু ক্ষোভে আর আক্রোশে ওই একজনকে কেন্দ্র করে নিজের ভিতরটাও সময় সময় কত ব্যভিচারী হয়ে ওঠে বাপী জানে। বিবেকের এই দ্বন্দ্ব থেকেও নিজেকে খালাস করার তাড়না। জীবনের শুরু থেকে সমস্ত সত্তা দিয়ে যার ওপর দখল নিয়ে বসে আছে তারই হাতে মার খাচ্ছে মনে হলে বাসনার আগুন শিরায় শিরায় জ্বলে ওঠে সত্যি কথাই। সর্বস্ব গ্রাস করেই তখন তাকে আবার সেই দখলের অন্তপুরে টেনে এনে বসাতে চায়। ব্যভিচার শেষ কথা নয়। এক দরজায় ঘা খেলে ব্যভিচার সতের দরজায় হানা দিয়ে বেড়ায়। মিষ্টি আর অসিত চ্যাটার্জির সম্পর্কটাকেও মিলন ভাবতে রাজি নয় বাপী তরফদার। তার চোখে এও ব্যভিচার। তাই এত দাহ, এত যন্ত্রণা। যাকে পেয়েছে, চোখ কান বুজে মিষ্টি তাকেই দোসর ভাবতে চাইছে।

…যদি সত্যি হয়, বাপীর যদি ভুল হয়ে থাকে, আর কারো বিচারের দরকার হবে না। বাপীর নিজের বিবেকই তাকে বেতের ঘায়ে দূরে সরিয়ে নেবে।

.

বিদেশে পাড়ি দেবার খানিক আগে ঊর্মিলা আবার না বুঝে এই বিবেকের ওপরেই আঁচড় কেটে বসল। বাপী এয়ারপোর্টে এসেছে ওদের তুলে দিতে। অকারণ ব্যস্ততায় বিজয় মেহেরা এদিক-ওদিক টহল দিচ্ছে। ঊর্মিলা একটা সোফায় চুপচাপ বসে। অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। মন খারাপ! বাপীকেও সামনে বসিয়ে রেখেছে।

মন বাপীরও ভালো না। গায়ত্রী রাইয়ের এই মেয়ে কত কাছের। আজ এত দূর চলে যাচ্ছে বলে সেটা আরো বেশি অনুভব করছে। তবু নিজে হালকা হবার আর ওকে হালকা করার জন্যে টিপ্পনীর সুরে বলল, অত মন খারাপের কি হল, গিয়ে তো দুদিন বাদেই ভুলে যাবে।

ঊর্মিলা সোজা হয়ে বসল একটু। চোখে পলক পড়ছে না। বলল, বাপী, তোমাকে ফেলে আমার সত্যি যেতে ইচ্ছে করছে না।

বাপী ঘাড় ফিরিয়ে বিজয়কে খুঁজল। অদূরে দাঁড়িয়ে সে মালের ওজন দেখছে। বাপী এদিক ফিরল আবার।—ডাকব?

—ডাকো, বয়েই গেল। আমি কেন বলছি তুমি বেশ ভালোই জানো। তার থেকে এখানকার পাট তুলে নিয়ে বানারজুলি চলে যাও না বাপু, আমি নিশ্চিন্ত হই—

বাপী হাসছে মিটি-মিটি।—গেলাম। তারপর?

—তারপর আবার কি? সেখানে আবু রব্বানী আছে, সে তোমাকে পাহাড়ের মত উঁচু-মাথা প্রাণের বন্ধু ভাবে—যতদিন না দেখাশুনার জন্য লোক ঘরে আসছে, সে দেখবে। ধমকে উঠল, হাসছ কেন?

—হাসছি না। ভাবছি।…বিজয়কে বাতিল করে তোমাকেই যদি আটকে ফেলতাম, তুমি কি করতে?

—তোমার মাথা করতাম।

—যে আসবে সে-ও তাই করবে না কি করে বুঝলে?

—কেন করবে? যে আসবে তারও যে একজন বিজয় থাকবে তার কি মানে?

—কিন্তু যার কাছে আসবে তার কেউ আছে জানলে?

রাগত সুরে ঊর্মিলা বলে উঠল, কে আছে? কোথায় আছে? সব চুকেবুকে গেছে যখন, ঘটা করে জানানোর দরকারটা কি?

বাপীও গম্ভীর এবার।—সব চুকেবুকে গেছে যখন তোমারই বা আমাকে নিয়ে এত দুর্ভাবনার কারণটা কি?…তুমি নিজেই বলো আমি কক্ষনো কোনো ছোট কাজ করতে পারি না—সে-বিশ্বাস এখন আর নেই তাহলে?

ঊর্মিলার মুখে আর কথা যোগালো না। চেয়ে আছে। চোখ দুটো বেশি চিকচিক করছে। এবারে তাকে একটু আশ্বাস দেবার মতো করে বাপী বলল, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, চুকেবুকে যদি গিয়ে থাকে, তাহলে সব ফুরিয়েই গেল। গেছে কিনা তাতে আমার যেমন সন্দেহ, তোমারও তেমনি। এর মধ্যে ছোট কাজ, বড় কাজ কিছু নেই, সুযোগ পেলে এর ফয়সালা আমি করব, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর এই ইচ্ছেটাকে তুমি সাদা চোখে দেখতে পারছ না বলেই অশান্তি ভোগ করছ। সব গুলি মেরে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাতাস সাঁতরে চলে যাও।

বাপী আবার হাসছে বটে, কিন্তু খুব কাছের একজন অনেক দূরে চলে যাচ্ছে এটুকু অনুভব না করে পারছে না। মাইকে যাত্রীদের সিকিউরিটির দিকে এগোতে বলা হল। ওদিক থেকে বিজয় মেহেরা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো।

আরো আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ওদের এরোপ্লেন আকাশে উড়তে দেখা গেল। অন্ধকারে এরোপ্লেন ঠিক দেখা গেল না। সগর্জনে একটা বড় আলো দেখতে দেখতে ছোট হয়ে গেল, তারপর আর দেখা গেল না।

.

ঘড়িতে রাত পৌনে দশটা। ফাঁকা রাস্তায় বাপী তীব্র বেগে গাড়ি চালিয়ে আসছে। গাড়ি. সার্কুলার রোডে পড়তেই মাস্টারমশাইয়ের কথা মনে হল। ঊর্মিলার ওখানে ছোটাছুটিতে আর কাজের ঝক্কিতে দু’দিনের মধ্যে একটা খবরও নেওয়া হয়নি। তার আগেও ভাল কিছু দেখেনি। ভদ্রলোক এখন নিশ্চিন্তে খুব নিশ্চিত কোন দিকে পা বাড়িয়েছেন সেটুকু আরো স্পষ্ট।

এত রাতে উনি জেগে নেই হয়তো। কুমুর জেগে থাকা সম্ভব। বাড়ির কাছের একটা লাইব্রেরিতে নাম লিখিয়েছে। ছোকরা চাকরটাকে দিয়ে বই আনায়। বাবা বিছানার পাশে বসে রাত জেগে বই পড়ে। বাপী যখনই যায়, লাইব্রেরির ছাপ—মারা একটা না একটা বই চোখে পড়ে। ছোকরা চাকরটা একদিন বই বদলে এনে তার সামনেই হেসে হেসে বুড়োবাবুকে অর্থাৎ মাস্টারমশাইকে বলছিল, লাইব্রেরীর লোক নাকি ঠাট্টা করেছে, তার দিদিমণি এই রেটে পড়লে শিগগীরই লাইব্রেরি ফাঁকা হয়ে যাবে। কুমকুম লজ্জা পেয়েছে। মাস্টারমশাই মেয়ের রাত জেগে বই পড়ার কথা বলেছিলেন। বাপীর মনে হয়েছে, সময়ে ঘুমে এরই মধ্যে এই মেয়ের অভ্যস্ত হওয়ার কথা নয়।

যাবে কি যাবে না, দ্বিধা। আবার তক্ষুনি তা নাকচ করার ঝোঁক। গাড়ির স্পিড আরো চড়ল।

যা আশা করেছিল, তাই। দুটো ঘরেই আলো জ্বলছে। নিঃশব্দে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলো। ঘরের দরজা বন্ধ। মাস্টারমশায়ের ঘরের দরজায় কয়েকটা মৃদু টোকা দিতে কুমকুম দরজা খুলে দিল।

—বাপীদা…এত রাতে?

বাপী তক্ষুনি লক্ষ্য করল। বিস্ময়ের আঁচড়ে মেকি কিছু ধরা পড়ল না। ভেতর কারো কত তাড়াতাড়ি বদলায় বাপীর ধারণা নেই। এই মেয়ের কাছে অন্তত এটুকু রাত বেশি রাত হল কি করে!

—আলো জ্বলছে দেখে নামলাম।… কেমন?

—একরকমই। ঘুমোচ্ছে। এসো…

ওর সঙ্গে নিঃশব্দে বাপী শয্যার কাছে এলো। বুক পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। দাড়ি সত্ত্বেও মাস্টারমশায়ের মুখ দুদিন আগের থেকে বেশি ফোলা মনে হল বাপীর। চাদর টেনে দেখতে গেলে ঘুম ভাঙার সম্ভাবনা। সে চেষ্টা না করে পাশের ঘরে এলো। ছোকরা চাকরটা মেঝেতে মাদুর পেতে শোবার তোড়জোড় করছিল। বাপীকে দেখে তাড়াতাড়ি মাদুর গুটিয়ে নিয়ে চলে গেল।

কুমকুম ব্যস্ত হয়ে বলল, বোসো বাপীদা, এক পেয়ালা চা করে আনি?

—এত রাতে আর চা না। চেয়ার টেনে বসল।—এর মধ্যে ডাক্তার দেখে গেছে? মুখ তো আরো ফোলা মনে হল।

—আমারও মনে হয়েছে। বাপী লক্ষ্য করছে, দুশ্চিন্তা সত্ত্বেও ভেঙে পড়ার মেয়ে নয়। বলল, সকালে ডাক্তারকে ফোন করেছিলাম, শুনেও তিনি তো এই ওষুধই চালিয়ে যেতে বললেন…। ঠোঁটের ফাঁকে হাসির মতো দেখা গেল একটু বলল, দু’দিন আসনি, বাবা নিজেকে ছেড়ে তোমার জন্যে বেশি ব্যস্ত।…এদিকে অন্য কাজে এসেছিলে বুঝি?

—একজনকে এয়ারপোর্টে তুলে দিয়ে ফিরছিলাম, ভাবলাম দেখে যাই—

বাপী চিন্তা না করেই দু’জনের বদলে একজনকে বলেছে। তার ফলে এমন একটা প্রশ্ন শুনবে কল্পনার মধ্যে ছিল না। কুমকুমের চাউনি হঠাৎ উৎসুক একটু। বলে ফেলল, বউদি কোথাও গেলেন?

শোনামাত্র বাপীর ভিতরে নাড়াচাড়া পড়ল একপ্রস্থ। প্রথমেই রাস্তায় দাঁড়ানো মেয়ের অন্তরঙ্গ ছলাকলা কিছু কিনা বোঝার চেষ্টা। সে-রকম আদৌ মনে হল না। তবু পাশ কাটিয়ে জবাব দিল, না, অন্য কেউ। সোজা চেয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ তোমার এ-কথা মনে হল?

আমতা আমতা করে কুমকুম বলল, শুনলে তুমি রাগ করবে না তো বাপীদা? বাপীর সন্দিগ্ধ চাউনি ওর মুখের ওপরে আরো স্থির একটু।—আমি রাগ করব এমন কি কথা তুমি বলতে পারো?

গলার স্বরে হঠাৎ উষ্ণ আমেজ কেন কুমকুম তাই বুঝে উঠল না। বিমর্ষ অথচ ঠাণ্ডা সুরে বলল, তা না…আমি কেমন মেয়ে জানি, তবু বাবা তোমার কাছে কতখানি, নিজের চোখে দেখছি বলে রোজই খুব আশা হয়, বউদিও হয়তো তোমার সঙ্গে এসে বাবাকে একবারটি দেখে যাবেন। এখন বুঝছি আমার জন্যেই ঘেন্নায় আসছেন না…

এই মুখ দেখে আর এই কথা শুনে বাপীই বিমূঢ় হঠাৎ। তারপরেই চকিতে মনে পড়ল কিছু। এবারে গলার স্বরও নরম।—বউদি বলে কেউ কোথাও আছে তুমি ধরে নিলে কি করে?

সঙ্গে সঙ্গে কুমকুমও হকচকিয়ে গেল।—সেদিন যে তোমার গাড়িতে তোমার পাশে…বউদি নয়?

হ্যাঁ, বাপীরও সেই সন্ধ্যার কথাটাই মনে পড়েছিল। তার পাশে সেই একজনকে দেখে কুমকুম যা ভেবে বসে আছে, তা-ও ভাবতে ভালো লাগছে। এমন কি মেয়েটার এই ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখখানাও এখন ভালো লাগছে! ঠোঁটের হাসি চোখে জমা হচ্ছে। খুব হাল্কা করে জবাব দিল, এখন পর্যন্ত নয়।

এর পরেও মেয়েটার বিমূঢ় মুখে বিস্ময়ের আঁচড় পড়ছে দেখল। কেন পড়ছে তা-ও আঁচ করতে পারে।…সেই সন্ধ্যায় গাড়িতে তার পাশে বসার আগেই মিষ্টি শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিয়েছিল। বাপীকে সজাগ রাখার আর তফাতে রাখার সংকল্প বোঝানোর জন্যেই শাড়ির আঁচল মাথার ওপর দিয়ে বুকের আর একদিকে টেনে এনেছিল।…কুমকুমের এ-রকম ভুল হতেই পারে।

বাপী উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে প্রসঙ্গও বাতিল।—আর রাত করব না, তুমি যাও।…টাকা আছে তো হাতে?

মেয়েটার কমনীয় মুখে কৃতজ্ঞতা উপচে উঠল। বলল, অনেক আছে!

—ঠিক আছে।…ডাক্তারকে কাল আমিই না হয় ফোন করে দেব’খন একবার, এসে দেখে যাক। পারি তো একেবারে ধরেই নিয়ে আসব—

কুমু এমন চেয়ে রইল যে, বাপী তার পরেও থমকে দাঁড়াল। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আরো কিছু ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে।—বাপীদা আর কত করবে তুমি

আমাদের জন্য—আর কত করবে?

এই ব্যাপারটাই বাপীর চোখে বা কানে সয় না।…আশ্চর্য, সেই মুহূর্তে রেশমাকে মনে পড়ল। সেই সাপধরা মেয়েটার কিছু ধারালো স্ফুলিঙ্গ হঠাৎ এর মধ্যেও আশা করছে কেন, জানে না। ঝাপটা মারা গোছের গলার স্বর।—বাজে বোকো না, তোমার জন্যে কিছু করা হলে তখন ঋণ শোধের কথা ভেবো, বাপীদা কাউকে দয়া করে কিছু করে না, তখন মনে রাখতে চেষ্টা কোরো।

কুমকুম থতোমতো খেয়ে চেয়ে আছে। অবাকও।

.

নির্জন রাস্তায় গাড়ির স্পিডের কাঁটা পঞ্চাশের দাগ ছুঁয়েছে।…সব চুকেবুকে গেছে ভাবে না বলেই ঊর্মিলার দুশ্চিন্তা। ভালবাসার চেহারা ওই মেয়ে চেনে। মিষ্টির ওখান থেকে বেরিয়ে টিপ্পনী কেটেছিল, শ্যাম আর কুল দুই নিয়ে বেচারী কেবল জ্বলছে মনে হল। বাপী তাই বিশ্বাস করেছে, করে জোর পেয়েছে। আজও প্লেনে ওঠার আগে ঊর্মিলা হার মেনে ওর গোঁ বাড়িয়ে দিয়ে গেছে। তারপর কুমকুমের কথা শুনেও কান দুটো লোভাতুর হয়ে উঠেছিল! শিকারে বেরিয়ে সেই সন্ধ্যায় কুমকুম গাড়িতে বাপীর পাশে যাকে দেখেছিল, তাকে তার বউ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি। বউদি নয় শুনে অবাক হয়েছে। আর বাপীর জবাব শুনেও মেয়েটা হকচকিয়ে গেছে। বাপী বলেছে, এখন পর্যন্ত নয়।

…মাথায় ঘোমটা তোলা কারো বউ এখন পর্যন্ত তার বউ নয় শুনলে অবাক হবারই কথা।

রণে আর প্রণয়ে নীতির বালাই রাখতে নেই। শয়তানকেও কাছে ডাকতে বাধা নেই। ও-কথার পর কুমকুমের মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎই শয়তানের কিছু ইশারা মনের পাতাল ফুঁড়ে সামনে ধেয়ে আসতে চেয়েছে। তাই কুমকুমের পরের উচ্ছ্বাসটুকু বাপী বরদাস্ত করতে চায়নি। বরং সর্বনাশের দড়ির ওপর হেসে খেলে নেচে বেড়াতে পারে এমন মেয়ে রেশমাকে মনে পড়েছে।

কেন মনে পড়েছে বাপী এখন আর সেটা তলিয়ে দেখতে রাজি নয়। ভাবতে রাজি নয়। তাহলে নিজেরই কোনো ভয়াবহ চেহারা ধরা পড়ার আশঙ্কা। ইচ্ছেটাকে বাপী চার চাকার তলায় গুঁড়িয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *