সোনার হরিণ নেই – ৩

তিন

শীতের রাত বাড়ছে। পথে লোক চলাচল নেই বললেই চলে। বাপী ঠায় দাঁড়িয়ে গায়ে শার্টের ওপর শুধু একটা আলোয়ান। কাঁপুনি ধরার কথা। কিন্তু ভিতর থেকে একটা উষ্ণ তাপের ওঠা-নামা চলেছে তখনো। একেবারে বুকের পাতাল থেকে। বাইরের ঠাণ্ডা চামড়ায় বিধলেও টের পাচ্ছে না। বাইরের জানালা দিয়ে দু চোখের এক-একটা উষ্ণ ঝাপটায় জ্যোতিষীর সামনে বসা শেষ লোকটাকে তুলে দিতে চাইছে।

জ্যোতিষীর অপেক্ষায় বাইরে তখন একমাত্র বাপী তরফদার ছাড়া আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই। হাতের কবজিতে পুরনো আমলের ঘড়ি বাঁধা আছে একটা। সেটা চলছে। রাত দশটা বেজে দশ।

ভবিতব্য জানার আশ মিটিয়ে শেষ লোকটা উঠল। বাপী তরফদারের স্নায়ুগুলো টান-টান আবার। লোকটা বেরিয়ে আসতে সে ঢোকার জন্য প্রস্তুত। দেখতে না পেলেও নিজের চোখ-মুখের খরখরে ভাবটা অনুমান করতে পারছে। ভিতরে ঢোকার আগে সেটা মোলায়েম করে নেবার তাগিদ।

ঘর ফাঁকা হবার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিষী ভদ্রলোক নিজের ভাগ্য যাচাইয়ে মনোনিবেশ করেছে। সামনের এক-হাত প্রমাণ কাঠের বাক্সটা খুলে ভিতর থেকে এক মুঠো নোট বার করে ওটার ওপর রাখতে যাচ্ছিল। মুখ তুলে তাকাল এবং সঙ্গে সঙ্গে নোটগুলো আবার কাঠের বাকসের ভিতরে চালান করল। একই সঙ্গে পাশের গোল পকেট ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল?

বাপী তরফদার মাথা নাড়ল। ছিল না। আর কিছু বলার আগে ভদ্রলোকও মাথা নাড়ল।—অনেক রাত হয়ে গেছে, আজ আর হবে না।

প্ল্যানমাফিক বাপী তরফদার সবিনয়ে বলল, আমি শুধু একজনের ঠিকানা জেনে নেবার জন্য অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করছি…মিসেস মনোরমা নন্দী, আজ তাঁর এখানে আসার কথা ছিল…আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল, জানা থাকলে ঠিকানাটা দয়া করে যদি বলেন….

ভদ্রলোকের গোল দুচোখ তার মুখের ওপর আটকে থাকল খানিক। তারপর আপাদ-মস্তক ওঠা-নামা করল।—তাঁদের এখানে আসার কথা ছিল আপনি জানলেন কি করে?

সন্দেহ এড়ানোর জন্যেই শুধু মনোরমা নন্দীর নামটা করেছিল। মালবিকা বা মিষ্টির নাম করে নি। তবু ভদ্রলোকের চাউনি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে সেটা অনুভব করা গেল। আমতা-আমতা করে জবাব দিল, বিকেলে ফোনে কথা হয়েছিল…তখন বলেছিলেন—

—ফোন নম্বর জানা আছে, বাড়ির ঠিকানা জানা নেই?

বাপী তরফদার মাথা নাড়ল। জানা নেই।

মুখের ওপর সন্দিগ্ধ চাউনিটা কঠিন হয়ে উঠতে লাগল।—কি মতলব?

—আজ্ঞে…..?

—আমি দু ঘণ্টা আগেও তোমাকে ওই জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। ভদ্রমহিলার ঠিকানা চাই কেন? কি মতলব?

ভিতরের উত্তেজনার ফলে এ-রকম বিপাকে পড়ার কোন সম্ভাবনা অন্তত মাথায় আসে নি। এখন ছুটে পালাতে চাইলেও চেঁচামেচি করে লোক ডাকবে কিনা কে জানে। এই তিনতলা বাড়ীর একতলায় বসে জ্যোতিষী করে। ডাকলে ভিতর থেকে কতজন ছুটে আসবে ঠিক নেই। কোণঠাসা হয়ে জবাবদিহি করল, ভদ্রমহিলাকে হঠাৎ এখানে দেখে তাঁর স্বামীর কাছে একটা চাকরির তদ্বিরের জন্য ঠিকানা খোঁজ করছিলাম…অনেক কাল আগে উত্তরবঙ্গে থাকতে ওঁরা আমাকে চিনতেন….

আরো রূঢ় স্বরে জ্যোতিষী জিজ্ঞাসা করল, ওঁর স্বামীর নাম কি?

—সন্দীপ নন্দী…উত্তরবঙ্গে বানারজুলি রিজার্ভ ফরেস্টের রেঞ্জ অফিসার ছিলেন এক সময়…বড় দুঃসময় চলছে তাই একটু চেষ্টা করার ইচ্ছা ছিল—

এবারে বিশ্বাসযোগ্য হল বোধ হয়। শীতের রাতের এই বেশবাস বিশ্বাসের অনুকূল। ভদ্রলোকের ঠোটের ফাঁকে হাসির আভাস দেখা গেল। ভাঁওতাবাজী ধরে ফেলার মতই পাকা জ্যোতিষী। বলল, কোন মহিলার ঠিকানা জানার জন্য এভাবে আর কখনো কোথাও ঢুকে পড়ো না—ওঁর স্বামী কলকাতায় থাকেন না। যাও।

বেরিয়ে এল। এর পরেও উত্তেজনার উপশম হল না একটুও। মনে মনে জ্যোতিষীর মুন্ডুপাত করতে করতে ঘরের দিকে পা বাড়াল। ওই মেয়েকে আবারও দেখার তাড়না ভিতরে একটা যন্ত্রণার মত ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকল। সেই যন্ত্রণার তাপ বুকের পাঁজর থেকে মাথার দিকে উঠছে। জ্যোতিষীর জানলা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখেছে মিষ্টিকে, আর বাইরে বেরুনোর পর সামনে দাঁড়িয়েও দেখেছে। এই দেখার বিশ্লেষণে ফাঁক ছিল না বড়। আগের সঙ্গে মেলে না। মাথায় লম্বা হয়েছে বেশ। স্বাস্থ্যও লোভনীয় রকমের নিটোল ছাঁদ নিয়েছে। ফোলা গাল ভেঙে অন্য ধাঁচের পরিণত আকার নিয়েছে। গায়ের রঙে তাজা তামাটে প্রলেপ পড়েছে। সব মিলিয়ে মিষ্টিকে তীক্ষ্ণ মনে হয় এখন। রূপ নয়, এর থেকে ঢের রূপসী কলকাতায় এ ক’মাসে সে অনেক দেখেছে। সন্ধ্যার দিকে যে কোন অভিজাত বার-রেস্তারাঁর সামনে দাঁড়ালে দু-চারটি অন্তত রূপসী মেয়ে চোখে পড়েই। বড় গোছের যে-কোন সোস্যাল ফাংশান ভাঙলেও চোখে পড়ে। ভিতরের সুপ্ত বাসনা অনেক সময়েই তাকে ওসব জায়গায় টেনে নিয়ে যায়। পকেটে পয়সার টান। হিসেবী মন বাজে খরচের ঝোঁকে বিক্ষিপ্ত হয় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক-একদিন শুধু বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে। এই গোপন অশালীন দেখার খবর একমাত্র সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। সে-তুলনায় এই রূপ এমন কিছু নয়। কিন্তু এই রূপের মধ্যে এমন কিছু আছে যা পুরুষের বিশ্লেষণের বস্তু, আবিষ্কারের বস্তু। এই বিশ্লেষণ অথবা আবিষ্কার দীর্ঘকালের জমাট-বাঁধা লোভ আর যন্ত্রণার ফল কিনা জানে না। জানতে চায়ও না। অপ্রত্যাশিতভাবে যার দেখা পেল আজ, তার সমস্ত খুঁটিনাটি দু চোখের তারায় আগলে নিয়ে পথ চলেছে।

মগজে সাদাটে গাড়ির নম্বরটা ঘুরপাক খাচ্ছে।

রাত প্রায় এগারোটা। টালি-এলাকায় শীতের নিঝুম রাত। রাস্তার ধারে লাইটপোস্টের ঝিমুনো আলোয় ভিতরে ঢোকার সরু গলি-পথ দেখা যাচ্ছে। বাপী তরফদার নিঃশব্দে ভিতরে সেঁধিয়ে গেল। অন্ধকার সত্ত্বেও আন্দাজে ঠিক নিজের খুপরির দরজা ঠেলে অন্দরে ঢুকে যেতে পারবে। কিন্তু ভেতরটাও খুব অন্ধকার নয়। ওপর থেকে খানিকটা জ্যোৎস্না এক ধারের টালি বেয়ে উঠোনে লুটোপুটি খাচ্ছে।

কোন দিকে না তাকিয়েই বাপী তরফদার তার খুপরি ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। তার পরেই বিষম চমক। পাশের ঘরের দরজা দুটো খোলা। দরজার ওধারে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে রতন বনিকের ঘুমকাতুরে বউ কমলা। মুখ—চোখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তাহলেও সাদা চাদর জড়ানো ওই মূর্তি ভুল হবার নয়।

চোখের পলকে বাপী তরফদার নিজের খুপরির দরজা ঠেলে ভিতরে চলে এলো। ক্যাঁচ করে শব্দ হল একটু। আবার বন্ধ করার সময়েও সেই শব্দ। জোরে না হলেও ওই শব্দ রাতের এই নিঝুম স্তব্ধতা ভেঙে দেওয়ার মতো বিরক্তিকর। দরজা বন্ধ করে ঘরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে রইল বাপী। এতক্ষণে শীতটা ছেঁকে ধরেছে তাকে। একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি পা বেয়ে বুকের হাড়ের দিকে এগোচ্ছে। মিনিট খানেক বাদে পাশের ঘরের দরজা বন্ধ করার আর হুড়কো লাগানোর মৃদু শব্দ কানে এলো।

এবারে ঠাণ্ডার ভাবটা কমতির দিকে। অবসন্ন শরীরটা দেয়াল-ঘেঁষা দড়ির খাটিয়ার কাছে টেনে নিয়ে এলো। বসল। গায়ের আলোয়ান খুলে পায়ের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর জামাসুদ্ধই কম্বলের নিচে ঢুকে গেল।

বিকেল থেকে এই রাত পর্যন্ত আজ অনেক মাইল হাঁটা হয়েছে। স্নায়ুর ওপর প্রচণ্ড ধকল গেছে। রাতে কিছু খেয়ে নেবার কথা মনেও পড়ে নি। কম্বলের তলায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল দু চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে।

বাপী তরফদার জানে এই সন্ধেটা আর এই রাতটা অনেকগুলো বছরের অনেকগুলো সন্ধ্যা থেকে আর রাত থেকে এত তফাৎ হয়ে গেছে যে খানিকক্ষণের মধ্যেই অবসন্ন স্নায়ুগুলো আবার টান-টান হয়ে উঠবে। কিন্তু মনে-প্রাণে এখন সে ঘুমের অতলে ডুবে যেতে চায়। মড়ার মতো নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়তে চায়।

দরজার পরিচিত শব্দটা কানে এলো যখন, অন্য দিনের মতোই বাপী তরফদারের আপাদমস্তক কম্বলের নিচে। কিন্তু আজ সে রাত থাকতে উঠে মুখহাত ধুয়ে আবার শয্যায় আশ্রয় নিয়েছে।

—বড়বাবু ঘুমিয়ে না জেগে?

কম্বলের তলা থেকে গলার স্বরটা ভারী-ভারী ঠেকল কানে। কম্বল বুকের নিচে নামিয়ে বাপী সোজা কমলার মুখের দিকে তাকালো। ঘুম-ভাঙা ফোলাফোলা মুখ আঁচলের ঘোমটায় কান মাথা গলা বেড়িয়ে আধখানা ঢাকা। ভিতরেও আজ পাতলা ব্লাউস নয়, একটা গরম জামা পরেছে। তার ওপর দিয়ে আঁট করে শাড়ি জড়ানোর ফলে শরীরটাও ফোলা ফোলা লাগছে।

বাপী আস্তে আস্তে উঠে বসল। নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞসা করল, ঠাণ্ডা লাগালে কি করে?

অনেকটা সেই রকমই নির্লিপ্ত ঢংয়ে কমলা ফিরে জিজ্ঞাসা করল, ঠাণ্ডা লেগেছে তুমি বুঝলে কি করে?

—গলার আওয়াজ শুনে, তাছাড়া ঢাকাঢুকি দিয়ে এসেছ—

তার চোখের ওপর কমলার দু চোখ আকারে বড় হতে থাকল। তারপর রাগত সুরে বলল, দেখো, সাতসকালে গোপাল ঠাকুরের রঙ্গও ভাল লাগে না বলে দিলাম…ঢাকাঢুকি না দিয়ে কবে তোমার সামনে এসেছি?

সকালের ঠাণ্ডা সত্ত্বেও ঝাঁ করে দু কান গরম হয়ে উঠল বাপী তরফদারের। তাড়াতাড়ি ওকে বিদায় করার জন্যেই চায়ের গেলাসের দিকে হাত বাড়ালো।

—মুখ ধোয়া হয়েছে?

—হয়েছে।

সত্যি-মিথ্যে যাচাইয়ের চোখে একবার দেখে নিল।—কখন হল?

—কারো ওঠার আগেই হয়েছে, দাও।

গেলাস আর নুন-মাখানো গরম রুটি দুটো সামনে এগিয়ে দিয়ে ঠেসের সুরে কমলা বলে উঠল, দরজায় আওয়াজ শুনেও তাহলে কম্বলের তলায় ঢুকে ছিলে কেন?

বাপী তরফদার জবাব দিল না বা তার দিকে তাকালো না। রাতের নির্জলা উপোসের পর গরম চা আর নুন-ছড়ানো গরম রুটি অমৃতের মতো লাগছে। সকালে চায়ের সঙ্গে রুটি হলে সে চিনি-গুড়ের থেকে নুন পছন্দ করে।

কমলা এস্তে ঘর ছেড়ে চলে গেল। কারণ না বুঝলেও বাপী তরফদার স্বস্তি বোধ করল একটু। কিন্তু দু মিনিটের মধ্যেই দ্বিগুণ বিরক্ত। শাড়ির আঁচলে নিজের চায়ের গরম গেলাস ধরে আবার এ-ঘরে হাজির। চোখের কোণে কৌতুকের ছোঁয়ায় শ্যামবর্ণ মুখ সরস দেখাচ্ছে।

দু চুমুক তল করে বলল, বুড়োটা ঘুমোচ্ছে এখনো, ঠাণ্ডার চোটে উঠে পড়ে আজ এক ঘণ্টা আগে চা বানিয়েছি। তুমি চায়ের পিত্যেশে বসে আছ জানলে আরো আগেই করে দিতে পারতাম। বলতে বলতে একটা হাত পিছন দিকে নিয়ে দরজার একটা পাট বন্ধ করে দিল। তারপর সেদিকের দেয়ালে আড়াল নিয়ে ফিক করে হাসল একটু–তোমার ঘরে এসে গল্প করতে করতে চা খেতে দেখলে কার চোখে আবার কাঁটা বেঁধে ঠিক কি।

কাল রাতে নিজের ঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকাটা ভুলতে পারেনি। আজ এই দিনমানেও ওকে দেখে অস্বস্তি। চাপা বিরক্তির সুরে বাপী বলল, আমার ঘরে এসে চা খাওয়ার দরকারটা কি!

চায়ের গেলাস মুখে তুলেছিল। সেটা ঠোঁটে ঠেকিয়ে রেখেই হাসি আড়াল করল। —গোপাল ঠাকুরের মনে এক মুখে এক—হুঃ। বড় বড় তিন চার ঢোঁক চা গিলে নিল। তারপর টেনে টেনে বলল, বড়বাবুর কি সাঁঝের টাইমে কোনো ডিউটি-টিউটি জুটেছে নাকি?

—না। নিজের গেলাস খাটিয়ার সামনে মেঝেতে নামিয়ে রাখল।

—তবে কাল রাতে ফিরতে এত দেরি হল?

এবার সত্যি সত্যি ধমকে উঠল বাপী তরফদার। —দেরি হল তো হল—কেন দেরি হল সে জবাবদিহি তোমার কাছে করতে হবে?

গেলাসের চা শেষ করে মুখখানা আর একবার ভালো করে দেখে নেওয়া দরকার বোধ করল কমলা। ঝাঁজালো ব্যঙ্গ ঝরল তার গলাতেও।— সাধে বড়বাবু বলি! নুন রুটি দিয়ে দিন শুরু তবু মেজাজ কতো! রাত-দুকুর পর্যন্ত হাট-করা খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ঠাণ্ডা লাগালাম, সকালে তাই নিয়ে উঠে চা করে খাওয়ালাম—লজ্জাও করে না মুখ নেড়ে কথা বলতে!

বলতে বলতে এক-পাট খোলা দরজা ভুলে যেভাবে কাছে এগিয়ে এলো, মুহূর্তে দিশেহারা অবস্থা বাপী তরফদারের। কিন্তু না, টুপ করে উপুড় হয়ে তার খাওয়া গেলাসটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে দু চোখে এক ঝলক মেকি আগুন ছড়িয়ে প্রস্থান করল।

বাপী তরফদার পঙ্গুর মতো বসে রইল। তারপর আত্মস্থ হল।…হ্যাঁ, মুখ নেড়ে কথা বলতে লজ্জা করে। আগেও করেছে, এখনো করে। তাই কথা বেশি বলে না, বলতে চায় না। কিন্তু এখন অন্যায় থেকে বেশি করে ভয়। ভয় কমলাকে। তার থেকে ঢের বেশি নিজেকে।

…বানারজুলিতে সোমত্ত বয়সের দু-ঘর সাপুড়ে মেয়ে ছিল। ননদ-ভাজ সম্পর্ক। একজনের মরদ দিন-রাত নেশা করে পড়ে থাকত। আর একজনের মরদের দুটো চোখই বসন্তের গুটিতে খেয়ে দিয়েছে। সেই ননদ-ভাজ একসঙ্গে দু’তিনটে ঝাঁপিতে সাপ পুরে নিয়ে গ্রামে শহরে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়াতো। গাল ফুলিয়ে পেটমোটা সাপুড়ের বাঁশি বাজিয়ে যেত ঘাগরা-পরা মেয়ে দুটো। কিছু পয়সা মেলার মতো ভিড় দেখলেই সাপের ঝাঁপি খুলে বসত তারা। হরেক রকমের সাপ বের করত। বাঁশি বাজাতো আর সাপের খেলা দেখাতো। কিন্তু অবাক চোখে বাপী ওই মেয়ে দুটোকেই বেশি দেখতো। হাঁটু গেড়ে বা হাঁটু মুড়ে বসে বসে ফণা তোলা সাপের মতোই সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে কোমর-বুক-মাথা দোলাতো তারা। ওই করে সাপকে উত্তেজিত করতে চাইত। শুধু তাই নয়, সাপের ছোবল খাবার জন্য অঙ্গ যেন চিড়-চিড় করত তাদের। ফণা-তোলা সাপের সামনে ভুঁয়ের ওপর হাত পেতে দিত। ছোবল পড়ার আগেই চোখের পলকে হাত সরিয়ে নিত, মাটির উপর ছোবল পড়ত। এই করে যতবার ওরা সাপকে ঠকাতে পারতো ততো ওদেরও উত্তেজনা বাড়ত। কিন্তু ক্রুদ্ধ সাপের ছোবল একবার না একবার হাতের উল্টো পিঠে বা আঙুলের মাথায় পড়তই। সঙ্গে সঙ্গে দরদর করে রক্ত বেরুতো। ওরা তখন থলে থেকে কি পাতা বার করে দাঁতে চিবিয়ে সে-পাতা ক্ষতর ওপর লাগিয়ে দিত। ছোবল খাবার পরে উত্তেজনার শেষ।

…কমলাও অনেকটা সেই সাপুড়ে মেয়ে দুটোর মতোই। সাপকে দখলে রেখে উত্তেজনা বাড়িয়ে ছোবল খাওয়ার লোভ। কিন্তু সাপুড়ে মেয়েদের সাপের মতো নিজেকে নির্বিষ ভাবে না বাপী তরফদার। তাই কমলার থেকেও নিজেকে বেশি ভয়।

কিন্তু গত সন্ধ্যা থেকে তার ভিতরে ভিতরে সাপের মতোই এক বিষ-বাষ্প কুণ্ডলি পাকাচ্ছে, গজরাচ্ছে, ফুঁসে উঠে ছোবল বসাতে চাইছে। এই অকরুণ অব্যর্থ সন্ধানী লক্ষ আর এক মেয়ে। নাম মিষ্টি। মালবিকা…।

বানারজুলির সবজান্তা আবু রব্বানী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, ষোল-সতের বছর বয়সে মিষ্টির চেহারাখানা যা হবে, কোনো না কোনো বড়লোকের ছেলের চোখ পড়বেই ওর ওপর—বিয়ে করে ওকে ঘরে এনে পুরবে, তারপর লুটেপুটে শেষ করবে—বি.এ., এম.এ., পাস করার ফুরসৎ মিলবে কোত্থেকে?

হিসেবে ভুল হবার নয় বাপী তরফদারের। নিজের বয়েস চৌদ্দ আর আটে বাইশ। মাস দেড়-দুই বেশি হতে পারে। ওই মেয়ের দশ আর আটে আঠের। সেই চৌদ্দ আর সেই দশ থেকে আটটি বছর সামনে পা ফেলেছে তারা। কিন্তু বাপীর একটা সত্তা চৌদ্দর সেই অবুঝ দুরন্ত রক্তাক্ত গণ্ডীর মধ্যে আটকে আছে এখনো। আর এই মেয়ের সবটাই সেই দশের গণ্ডী টপকে ভরভরতি আঠেরোয় পা ফেলে জাঁকিয়ে বসেছে। অতীতের ছিটে-ফোঁটাও তার গায়ে লেগে নেই। আবু রব্বানীর ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হয়নি। ভরাট সময়ে যে রূপ রব্বানীর কল্পনায় ছিল সেটা এ-চেহারার সঙ্গে আদৌ মিলবে না এ বাপী হলফ করে বলতে পারে। তার থেকে ঢের ভালো কি ঢের খারাপ জানে না। মোট কথা মেলেনি, মিলবে না। কোনো বড়লোকের ছেলের চোখ পড়েছে কিনা জানে না, কিন্তু কেউ ঘরে এনে পুরতে পারেনি এখন পর্যন্ত। সাদা সিঁথিই তার প্রমাণ। বাপী তরফদার আরো হিসেব করেছে। এম. এ. পড়ার বয়স এখনো হয়নি, কিন্তু এযাবৎ ফেলটেল যদি না করে থাকে তো এতদিনে বি.এ., পড়া শুরু করা উচিত।

একটা অসহিষ্ণু তাড়নায় বেলা এগারোটার মধ্যে স্নান-টান সেরে বেরিয়ে পড়ল। শুধু মোটর গাড়ির নম্বরটা সম্বল। শহর কলকাতার শত সহস্র গাড়ির মধ্যে সেই নম্বরের সাদাটে গাড়িটাকে খুঁজে বার করার চিন্তাও হাস্যকর পাগলামি। কিন্তু আট বছর পরের এই হঠাৎ-দেখাটা হঠাৎই শেষ একেবারে, এরকম চিন্তা বাপী বরদাস্ত করতেও রাজী নয়।

এক জায়গায় বেশ করে খেয়ে নিল। অনেক দিন বাদে নিজেকে সুস্থ আর তাজা রাখার তাগিদ। খেয়েদেয়ে মাথা ঠাণ্ডা করে একটা বড় কিছুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর প্রস্তুতি। আজ আর পা দুটো কোনো আপিসপাড়ার দিকে এগোতে রাজি নয়। গত সন্ধ্যার পথ ধরে হাঁটা শুরু করল। জ্যোতিষীর একতলা ঘরের বাইরের দরজা বন্ধ। খোলা থাকলেও সেখানে ওই বাঞ্ছিত মুখ আজও চোখে পড়বে এমন আশা বাতুলে করে।

জ্যোতিষীর ঘর ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল বাপী তরফদার। অপ্রত্যাশিত হদিস মিলবে এরকম আশা করছে না বটে, কিন্তু রাস্তার দুদিকের একটা বাড়িও তার শ্যেন দৃষ্টি থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তাটা ফুরিয়ে গেল একসময়। বেঁকে গিয়ে ট্রাম লাইনের বড় রাস্তায় এসে মিশেছে। সামনে ব্রীজ। একটা রাস্তা গেছে তার তলা দিয়ে। আর একটা রাস্তা ট্রাম লাইন পেরিয়ে লেক-এর দিকে।

গলা দিয়ে অস্ফুট একটা গালাগাল বেরিয়ে এলো। বড় রাস্তার বাস স্টপের ‘ কাছে চুপচাপ খানিক দাঁড়িয়ে রইল বাপী তরফদার। মাঝখানের ট্রাম লাইন ধরে ট্রাম আসছে যাচ্ছে। এক-একটা করে মানুষ বোঝাই বাস এসে দাঁড়াচ্ছে আবার চলে যাচ্ছে। মোটর ছুটেছে অবিরাম। সাদাটে রঙের গাড়ি দেখলে দু চোখ সেটার গায়ে আটকাচ্ছে। সব-কিছুই দেখছে বটে, কিন্তু আসলে সে ভেবে চলেছে।

হঠাৎই মাথায় এলো কিছু। চেষ্টার নাম পুরুষকার। দেখা যাক। সামনে যে বাস পেল তাতেই উঠে পড়ল। সব বাসই ডালহৌসি যায় এ-সময়। গাড়ির নম্বর থেকে বাড়ির হদিশ মেলা সম্ভব কিনা বন্ধু নিশীথ সেন সেটা বলতে পারে। নিশীথের বাবা মধ্য কলকাতার মাঝারি নাম-ডাকের কবিরাজ। নিজের আয়ুর্বেদ ফার্মেসি আছে। তাঁর ঝরঝরে গাড়ি আছে একটা। সেই গাড়িরও নম্বর আছে।

কলকাতায় বাপীর মোটামুটি দরদী বন্ধু বলতে ওই একজনই—নিশীথ সেন। ছেলেবেলা থেকে একসঙ্গে স্কুলে পড়েছে, একসঙ্গে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। বানারহাটে নিশীথ তার দাদুর কাছে থেকে স্কুলে পড়াশুনা করত। জলপাইগুড়ি থেকে আই-এসসি পরীক্ষার পর ছাড়াছাড়ি। নিশীথ আই-এসসির পর কলকাতায় বি-এ পাস করেছে। ছেলেকে মেডিক্যাল কলেজে পড়ানোর ইচ্ছে ছিল বাপের। কিন্তু আই-এসসি’র ফল দুই দাঁড়ির নিচের দিকে ঠেকতে সেটা সম্ভব হয় নি। বি—এ পাস করার সঙ্গে সঙ্গে ও একটা যুদ্ধের আপিসের চাকরিতে ঢুকে পড়েছিল। এখনো সে চাকরিতে টিকে আছে, কিন্তু মাথার ওপর ছাঁটাইয়ের খড়্গা ঝুলছে। দুদিন আগে হোক পরে হোক ওটা নেমে আসবেই। তা বলে বাপীর মতো বেকার হবে না সে। বি-এ পড়ার সময় থেকে বাপের কাছে কবিরাজি চিকিৎসার তালিম নিচ্ছে। বাবার সঙ্গে বসে নানারকম কবিরাজি ওষুধ তৈরির কাজে হাত পাকাচ্ছে। রোজ সন্ধ্যার পরে আয়ুর্বেদ ফার্মেসিতে বাবার পাশের কাঠের চেয়ার দখল করে গম্ভীর মুখে ছোট কবিরাজ হয়ে বসতে দেখা যায় তাকে। ছুটির দিনে সকাল—বিকেল দু বেলাই বসে সেখানে। বাপের অনুপস্থিতিতে সে এখন দিব্বি ঠেকা দিতে শিখেছে। চাকরিটা নেহাৎ আছে বলেই ছাড়তে পারছে না। চাকরি গেলে আয়ুর্বেদের দুই-একটা দিশী টাইটেল জুড়ে পাকাপোক্ত কবিরাজ হয়ে বসবে।

নিশীথ সেন আপিসেই আসেনি আজ। আবার একটা গালাগাল বেরিয়ে এলো বাপীর ভিতর থেকে। এটা ছেলেবেলার অভ্যাস। অনেক রকমের কুৎসিত গালাগালও নিঃশব্দে ঠেলে বেরিয়ে আসে।

আবার কলেজ স্ট্রীটের বাস ধরল। কপালে আজ কিছু পয়সা গচ্চা লেখা আছে।

কলেজ স্ট্রীট ছাড়িয়ে আরো একটু উত্তরে এগোলে নিশীথের বাড়ি। বাড়ির কাছেই ওদের আয়ুর্বেদ ফার্মেসি। আগে সেখানে হানা দিল। দরজা বন্ধ, কিন্তু বাইরে তালা ঝুলছে না। অর্থাৎ ভিতরে কেউ আছে। বাপ আর ছেলে ভিন্ন আর কেউ এ দপ্তর খোলে না। এই বেলা দেড়টায় বাপের এখানে দরজা বন্ধ করে বসে থাকার সম্ভাবনা কম।

বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কা দিল। সাড়া না পেয়ে দরজার গায়ে জোরে দু’চারটে চড়চাপড় বসালো। ভিতর থেকে দরজা খোলা হল।

কাঁচা ঘুম-ভাঙা মুখখানা বিরস দেখালো নিশীথের। হাই তুলে বলল, তুই মরতে এখানে এসে জুটলি—

—আপিস কামাই করে এখানে ঘুমুচ্ছিস?

—বাড়িতে থাকলেই বাবা কোনো পাচন বা সালসা বানাবার কাজে বসিয়ে দিত, এখানেও তুই দিলি ঘুমের বারোটা বাজিয়ে। বোস, খাবি কিছু?

এই বেঁটেখাটো ছেলেটার বুকের তলায় একটু নরম জায়গা আছে। এমনিতে বাস্তববুদ্ধি প্রখর। কিন্তু বেকার বন্ধুর প্রতি সদয়। চাকরির প্রথম কটা দিন ওর বাড়িতেই ছিল বাপী তরফদার। কিন্তু বন্ধুর প্রীতি বেশি, কি অনুকম্পা —জানে না।

বিরক্ত মুখ করে জবাব দিল, তুই ভাবিস আমি খালি খেতেই আসি তোর কাছে। এখন অন্য দরকারে এসেছি মন দিয়ে শোন, তোদের তো একটা গাড়ি আছে?

হঠাৎ গাড়ির খোঁজ কেন ভেবে না পেয়ে নিশীথ সেন শুরু থেকেই সতর্ক।—আছে একটা, কিন্তু তার ওপর বাবা ছাড়া আর কারো দখল নেই।

—আরে বাবা আমি তোদের গাড়ি চাইছি না; কোনো গাড়ির নম্বর যদি তোকে দিই তুই তার মালিকের ঠিকানা বার করে দিতে পারিস?

নিশীথ সেন অপ্রস্তুত একটু। —সে আবার কি—!

—আমার খুব দরকার। কাল হঠাৎ ভদ্রলোকের গাড়িটা দেখলাম, চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল, নম্বরটা মনে আছে, বাড়ির ঠিকানা বার করতে পারলে একটা চাকরি-বাকরি হতে পারে—

নিশীথ সেন জ্যোতিষী নয়, তাছাড়া পরিস্থিতিও সন্দিগ্ধ হবার মতো নয়। একটু ভেবে জিজ্ঞাসা করল, ভদ্রলোকের কোন্ আপিস বা কি চাকরি জানিস না?

জেরা পছন্দ নয়।—সে জানলে আর তোর কাছে আসব কেন, বড় চাকরিই করে নিশ্চয়, এককালে খুব চেনাজানা ছিল, ধরতে পারলে একটা সুরাহা হতে পারে।

—ভদ্রলোকের নাম কি? ফোন-গাইড দেখেছিস?

ভদ্রলোক বাপী তরফদারের চিন্তার মধ্যেও নেই বলেই তল্লাসীর এই প্রাথমিক রাস্তাটা মনে পড়ে নি। —সন্দীপ নন্দী…ফোন-গাইড আছে এখানে?

জবাব না দিয়ে নিশীথ সেন ঢাউস টেলিফোন গাইডটা টেনে নিল। সাগ্রহে খোঁজাখুঁজি চলল খানিকক্ষণ। দুজন সন্দীপ নন্দীর নাম পাওয়া গেল, কিন্তু বাড়ির ঠিকানা দক্ষিণ কলকাতার নয়। তাছাড়া তাদের একজন ডাক্তার আর একজন অ্যাডভোকেট। নন্দী এস-এর মধ্যে একগাদা নম্বর। ফোন-গাইড বন্ধ করে নিশীথ জিজ্ঞাসা করল, গাড়ির নম্বর ঠিক মনে আছে?

বাপী তরফদার গড়গড় করে নম্বর বলে দিতে সে একটু ভেবে মন্তব্য করল, মোটর ভেহিলিস্-এ গেলে বাড়ির ঠিকানা বার করা যায়, অনেক দূর—

—সেটা কি? সেটা কোথায়?

—তোদের ও-দিকেই। সেখানে কলকাতার সমস্ত গাড়ির ঠিকানাপত্তর থাকে। কাল একবার খোঁজ করে দেখ না —

—কাল নয়, আজই। বাপী তরফদার সাগ্রহে উঠে দাঁড়াল।—আমার দ্বারা হবে না, চল আমি তোকে বাস ভাড়া দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, আবার পৌঁছেও দেব—

তাগিদ বোঝাবার জন্যেই এরকম করে বলা।

মোটর ভেহিকিলস্-এর অপরিচিত চত্বরে পা ফেলতেই জনা-তিনেক হা-ঘরে মূর্তি হেঁকে ধরল। কি চাই? নতুন লাইসেন্স না রিন্যুয়াল? লার্নার্স লাইসেন্স? ট্র্যান্সফার?

এখানে একলা এলে বাপী তরফদার কোনো কিছুর হদিস পেত কিনা সন্দেহ। কিন্তু নিশীথ সেন-এর জানা আছে। দালালদের মধ্য থেকে সব থেকে দুঃস্থ মার্কা লোকটাকে বেছে নিল সে। তারপর বক্তব্য জানালো। গাড়ির নম্বর থেকে বাড়ির ঠিকানা বার করে দিতে হবে।

এরকম ফরমাস পেতে অভ্যস্ত নয় এরা। দুরূহ দায়িত্ব নেবার মতো মুখ করে দালাল পাঁচ টাকা দর হাঁকল। বাপী তরফদার তক্ষুনি পাঁচ টাকাই বার করতে রাজি। কিন্তু নিশীথ সেন আট আনা থেকে শুরু করে এক টাকায় রফা করে ফেলল।

দশ মিনিটেই মধ্যে কাজ হাসিল। কিন্তু ঠিকানা হাতে নিয়ে নিশীথ সেন হাঁ… না সন্দীপ না নন্দী। সেই নম্বরের গাড়ির মালিকের নাম অনিমেষ ঘোষ!

বিব্রত মুখে বাপী তরফদার তার হাত থেকে কাগজটা নিল। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা দেখে আশান্বিত একটু। সেই জ্যোতিষীর ডেরার রাস্তায় বাড়ির নম্বর। একটা টাকা দিয়ে দালাল বিদায় করে বন্ধুকে বলল, কোনো আত্মীয়ের গাড়ি হবে হয়তো ওটা—

নিশীথ সেন প্রস্তাব করল, এতটাই যখন করা গেল ওটুকু আর বাকি থাকে কেন—চল্, ওই ঠিকানাতেই খোঁজ কর দেখি তোর চেনা লোকের হদিস মেলে কিনা।

—না, না, আজ আর ভালো লাগছে না। বাপী তরফদার ব্যস্ত হয়ে উঠল।— মেজাজ খিঁচড়ে গেছে, নাম মিলছে না, চলতি গাড়িতে কাকে দেখতে কাকে দেখলাম কে জানে। ইয়ে, আমি এ-দিকে একটু কাজ সেরে যেতাম…তোকে পৌঁছে দিতে হবে?

তাকে অব্যাহতি দিয়ে নিশীথ সেন নিজের বাস ধরল। তারপর…। তারপর অপচয় করার মতো হাতে আর এক মুহূর্তও সময় নেই বাপী তরফদারের।

…সেই রাস্তা।

মিথ্যেই অনেকটা আগে থেকে রাস্তার ডান দিকের বাড়িগুলোর দিকে চোখ রেখে দ্রুত হেঁটে চলেছে বাপী তরফদার। রাস্তার বাঁয়ের বাড়িগুলোর জোড় নম্বর। তার বে-জোড় নম্বর চাই। নিজের ওপরেই বিরক্ত। বোকার মতো বেশি হাঁটছে। ওই নম্বরের বাড়ি রাস্তার শেষ মাথায় হবে। বাসে চেপে এসে শেষ দিক থেকে খুঁজতে খুঁজতে এলে সময়ের সাশ্রয় হত। শীতের বেলা পড়ে আসছে, তার হাঁটার গতি বাড়ছে।

কম করে দেড় মাইল লম্বা এই রাস্তা। জ্যোতিষীর বাড়ি সিকি মাইলের মধ্যে। লোকটা বিকেলেই দপ্তর খুলে বসেছে, আর আশ্চর্য, খদ্দেরও জুটেছে! জানলা দিয়ে একটা অসহিষ্ণু দৃষ্টি ছুঁড়ে বাপী তরফদার হনহন করে এগিয়ে চলল।

বাড়ির নম্বর যতো বাড়ছে, উত্তেজনাও বাড়ছে ততো। একটা বাড়ির সামনে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে গেল শেষে।…নম্বর মিলেছে। সামনে কোলাপসিবল গেট লাগানো শূন্য গ্যারাজ। তার কোণের দিকে দেয়ালের গায়ে বাড়ির নম্বর-প্লেট। ছোটর ওপর ছিমছাম বাড়ি।

বুকের ভিতরটা ধপ-ধপ করছে বাপী তরফদারের। …ওই গাড়িটা হয়তো এই বাড়িরই, কিন্তু মিষ্টি মালবিকা নন্দী নামে কোনো মেয়ে কি সত্যিই এখানে থাকে? পনের বিশ গজ এগিয়ে গিয়ে রাস্তা টপকে উল্টো দিকের ফুটপাথ-এ এসে দাঁড়াল। দোতলার বারান্দাটা ফাঁকা। তার ও-ধারে পর পর তিনটে ঘরে লোক চলাচলের আভাস পাচ্ছে। কিন্তু স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

নির্নিমেষে ওই দোতলার দিকেই চেয়ে আছে বাপী তরফদার। হঠাৎ তন্ময়তায় ছেদ পড়ল কেন জানে না। উল্টো দিকের বাড়িটার একতলায় বাঁধানো দাওয়ায় তারই বয়সী জনা-তিনেক ছেলে বসে সিগারেট টানছে। তারা ওকে দেখেই হাসাহাসি করছে বোধ হয়। আবার ঘন ঘন সামনের বাড়িটার দোতলার দিকে তাকাচ্ছে।…এদিকের একটা বাড়ির দোতলায় রেলিংএর সামনে সোনালি ফ্রেমের চশমা-পরা ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের একজন সুশ্রী লোক দাঁড়িয়ে। তারও দৃষ্টি ওই বাড়িটার দোতলার বারান্দার দিকে। বাপী তরফদারের হঠাৎ কেমন মনে হল সিগারেট-মুখে ওই ছেলেগুলো বা দোতলার ওই লোকটাও তারই মতো কারো দেখা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। বাপী তরফদারের আশা বাড়ছে।

হঠাৎ নিঃশ্বাস রুদ্ধ হবার দাখিল তার। ঘর থেকে ওই দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে একজন। খোলা চুল ফোলা-ফোলা মুখ। মনোরমা নন্দী! মিষ্টির মা।

সন্তর্পণে বড় নিঃশ্বাস ফেলল বাপী তরফদার। একটা প্রকাণ্ড অনিশ্চয়তার অবসান। অনিমেষ ঘোষ যে-ই হোক, মিষ্টি এ বাড়িতেই থাকে।

ভুরু কুঁচকে মহিলা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচের দাওয়ার ছেলে তিনটিকে দেখলেন একবার। সামনের বাড়ির দোতলার সোনালি ফ্রেমের চশমা-পরা লোকটাকেও দেখলেন। তারপর বাপীর দিকে চোখ গেল তাঁর। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তিনি বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকলেন আবার।

বাপী তরফদারের মনে হল শেষের বিরক্তিটুকু এক বাড়তি উপদ্রব দেখার দরুন। অর্থাৎ তাকে দেখেই।

এর তিন-চার মিনিটের মধ্যে দাওয়ার ছেলে কটা সচকিত। তিনজনেরই ঘাড় রাস্তার উল্টো দিকে ফিরেছে। …হ্যাঁ, ও-দিক থেকে সাদাটে গাড়ি আসছে একটা। সঙ্গে সঙ্গে তারও ধমনীর রক্তে দাপাদাপি

গাড়িটা এই সাতাশি বাড়ির গায়ে এসে দাঁড়িয়ে গেল। বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। তবু সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই সাদাটে গাড়ি। এঞ্জিনের সামনে সেই নম্বরের প্লেট।

গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে হর্নও বেজেছে। মনোরমা নন্দী আবার দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ভিতর থেকে একটা অল্পবয়সী চাকর ছুটে এসে গ্যারাজের তালাবন্ধ কোলাপসিবল গেট খুলতে গেল।

বাপী তরফদারের একাগ্র দু চোখ গাড়িটার গায়ে আটকে আছে। পিছনের দরজা খুলে প্রথমে মিষ্টি নামল। বুকের সঙ্গে একপাঁজা বই ধরা। পরনে হালকা সবুজ শাড়ি, সবুজ ব্লাউস। নেমে দাঁড়াল একটু। পিছনে আর একজন প্যান্ট-কোট পরা বৃদ্ধ লোক নামছেন। তাঁর জন্য কয়েক পলকের প্রতীক্ষার ছলে দাঁড়িয়ে তিন দিকে তিন ঝলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মিষ্টি নন্দী : প্রথমে দাওয়ার ছেলে তিনটের দিকে— তাদের কারো মুখে সিগারেট নেই এখন। তারপর সামনের বাড়ির দোতলার সোনালি ফ্রেমের চশমা-আঁটা সুশ্রী গম্ভীর মূর্তির দিকে।

তারপর বাপী তরফদারের দিকে। তাকে দেখাটা নতুন পতঙ্গ দেখার মতো। পলকা ঝটকায় ঘুরে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *