সোনার হরিণ নেই – ২৮

আটাশ

মনিব আজ আসছে জিত্‌ মালহোত্রা জানে। কিন্তু বাপী তাকে এয়ারপোর্টে আসতে বলেনি। সন্ধ্যার পর হোটেলে দেখা করতে লিখেছে। মনের তলায় কিছু হিসেব ছিল তাই এ-রকম নির্দেশ। তা না হলে ঘড়ির কাঁটা ধরে জিত্ মালহোত্রা এরোড্রোমে হাজির থাকতই।

বিশাল লাউঞ্জের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে গেল। হিসেব গরমিল হয়েছে। এয়ার অফিসের সেই ইনফরমেশান কাউন্টারে আর একটি অবাঙালী মেয়ে দাঁড়িয়ে।

—ছ’মাস আগে বিজয় মেহেরাকে নিয়ে যাবার জন্য যখন কলকাতায় এসেছিল, এই লাউঞ্জের এদিকে আসেই নি। যে-সঙ্কল্প নিয়ে আসা, তার বাইরে মাথায় আর কিছু ছিলও না। আর পরের ভোরে বিজয়কে বগলদাবা করে আবার যখন প্লেনে উঠেছে তখন আর কারো সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না। আজ কলকাতার মাটিতে পা দেবার আগে থেকে স্নায়ুগুলো সব নির্লিপ্ত সহজতার কৃত্রিম তারে বাঁধা ছিল। কিন্তু ঝকঝকে ইনফরমেশন কাউন্টারের ওধারে একজনের বদলে আর একজনকে দেখে হিসেব বরবাদ হলে যেমন হয়, মুহূর্তের মধ্যে ভেতরটা তেমনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠল।

….দাঁড়িয়ে যে আছে তাকেই জিগ্যেস করবে? খোঁজ নেবে? দু’পা এগিয়েও থামল। দিল্লির সেই ইন্টারভিউর কথা মনে পড়ল। সেই চাকরি পেয়ে থাকলে তার এখনকার ঠিকানা কলকাতা না দিল্লি? সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার এক রাস্তায় সেই সাতাশি নম্বর বাড়িতে গিয়ে হাজির হবার তাড়না। বাপীর এক হাতে মস্ত সুটকেস, অন্য হাতে বড় শৌখিন ট্র্যাভেল এটাচি। লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে এসে ট্যাক্সি ধরল।

ছুটন্ত গাড়িতে বসে একটু বাদেই নিঃশব্দে এক বিপরীত কাজ করল। ছেলেবেলা থেকে চেনা নিজের ভিতরের সেই অবুঝ অসহিষ্ণু বাপী নামে ছেলেটাকে সামনে দাঁড় করিয়ে প্রবীণ শাসনের চোখে দেখল খানিক। তারপর ঠাস ঠাস করে দু’গালে চড় কষালো গোটাকতক। অমন নির্বোধ তাড়নার মধ্যে ফেলে দেওয়ার শাস্তি। ধৈর্যের হিমঘরে বাস এখন। অনন্তকাল ধরেই যদি সেখানে থাকতে হয়—অত ছটফটানি কিসের?

—হয়তো আজই কোনো কারণে আসেনি। দেখা হয়নি ভালো হয়েছে। মন বিক্ষিপ্ত হতই। কৃত্রিম মুখোশের আড়াল নিতে হত। ব্যবসার তাগিদে আসাটা বড় করে তুলতে হত। নিজের কানেই সেটা কৈফিয়তের মতো শোনাতো। দু’দশ দিন বা দুই এক মাসে কাজে-কর্মে কিছুটা স্থিতি হবার পরে দেখা হলে সব দিক থেকে সুবিধে। কাজের আসনে আত্মস্থ পুরুষের আর এক রূপ। সেটাই সব থেকে সহজ আর নির্ভরযোগ্য মুখোশ

—চাকরি নিয়ে দিল্লিতেই যদি চলে গিয়ে থাকে তাও অবাঞ্ছিত নয়। বাপী চাইলে দিল্লী আর কতদূর? এক ঘণ্টার জায়গায় দু’ঘণ্টা। আসল ফারাক অসিত চ্যাটার্জির সঙ্গে। আরো বড় ফারাকের সূচনা হতে পারে এটা। মিষ্টি তার আওতার মধ্যে বসে নেই এ আরো বেশি কাম্য। সেই রকম দাঁড়িয়েছে কিনা জানার লোভ বাপীর। দক্ষিণ কলকাতার সাতাশি নম্বরের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেই জানা যেতে পারে। গেলে খাতির কদর আগের থেকেও বেশি হবে হয়তো। তার বর্তমান মর্যাদার খবর সুদীপ নন্দী আর তার মা-ই খুঁচিয়ে বার করবে। তাদের টাকা যথা পিরীত তথা।

নাঃ, বাপীর তাড়া নেই। সময়ে সব হবে। সব বোঝা যাবে। সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের সামিল। স্নায়ু নিজের বশে এখন। আপাতত সে হোটেলে যাচ্ছে। আর কোথাও না। পাশের বড় অ্যাটাচি কেসটা বোঝাই টাকা। নিজের রোজগারের টাকা ছোঁবার দরকার হয়নি। সে-সব উত্তরবাংলার নানা ব্যাঙ্কে আর লকারে যেমন ছড়ানো ছিল তেমনি আছে। এই অ্যাটাচিতে গায়ত্রী রাইয়ের সিন্দুক থেকে পাওয়া নিজের ভাগের টাকা। দু’ লক্ষর ওপরে আছে। সবটাই নিয়ে এসেছে। এত টাকা এ ভাবে আনতে বুকে কাঁপুনি ধরার কথা। কিন্তু বাপীর এ ব্যাপারে এক ফোঁটা উদ্বেগ নেই। যেমন নির্বিকার তেমনি স্বাভাবিক। এমন কি গায়ত্রী রাইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী সোনা আর তার থেকেও দামী যা-কিছু হাতে এসেছে সে-সবও ওই পেল্লায় সিন্দুকের তলায় ফেলে এসেছে। অবশ্য কুডুলের ঘায়েও অমন সিন্দুক ভাঙা সহজ নয়। আর কোয়েলা আছে। তার মালকান নেই, কিন্তু তার কাছ থেকে নগদ যা পেয়েছে তাতে বাপীরও কেনা হয়ে আছে। না পেলেও বিশ্বাস খোয়ানোটা ইজ্জত খোয়ানোর সামিল ওর কাছে। ওদের এই ধাত বাপী চেনে। আর বাদশা ড্রাইভার আছে। প্রভুভক্ত সজাগ কুকুরের মতোই ওরা বাংলো পাহারা দেবে। তাছাড়া সিন্দুকে কিছু থাকতে পারে এমন ধারণাও কারো নেই। সোনা তবু সোনাই। ছায়া-ভয় পিছনে ধাওয়া করে। বাপীর করে না।

তা হলেও এত কাঁচা টাকা সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি কোনো কাজের কথা নয়। তাই ঊর্মিলার ওখানে যাওয়ার ইচ্ছেও আজকের মতো বাতিল। কাল এখানকার ব্যাঙ্কের কাজ সেরে অন্য চিন্তা।

আগের সেই দামী হোটেলে মালহোত্রাকে ঘর বুক করে রাখতে বলা হয়েছিল। সে আগে থাকতে এসে বসে আছে। সপ্রতিভ অভ্যর্থনায় এগিয়ে এলো।

এই লোকের একটা গুণ বাপী বানারজুলির ক’দিনের মধ্যেই লক্ষ্য করেছে। কাজের ব্যাপারে চতুর, চটপটে। গায়ত্রী রাইয়ের কাছেও ছ’মাস ছিল। কাজ সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে। কিন্তু কি করল না করল প্রশংসার লোভে আগবাড়িয়ে সেটা জাহির করতে আসে না। হাল্কা চা-পর্বের পরে মালিককে বিশ্রামের অবকাশ দিয়ে পার্টিশনের ও ধারে চুপচাপ বসে আছে।

বেশভূষা বদলে বাপী গদির নরম বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকল খানিকক্ষণ। গতবারে এই হোটেলের প্রথম দিনটা বার বার মনে আসছে। শেষের দিনটাও। বাপীর ওটাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা। প্রত্যাশার আতসবাজী রঙে রঙে ঝলসে উঠেছিল। ছাই হয়ে মেনেছে। ছাই ঝেঁটিয়ে দুটো দিনকেই বিদায় করল বাপী। নিশ্চল নিস্পন্দ পড়ে থেকে মাথাটাকে খানিকক্ষণের জন্য শূন্য করে দেওয়ার চেষ্টা। ভালো-মন্দ সমস্ত রকমের চিন্তা বাতিল। কোনো বই-এ পড়া এই কসরত কিছুটা রপ্ত হয়েছে। পরে বেশ ঝরঝরে লাগে।

—জিত্!

—সার! জিত্ মালহোত্রা তক্ষুনি পার্টিশনের ও-ধার থেকে এগিয়ে এলো।

—একটা চেয়ার এনে বোসো। তারপর খবর কি বলো!

খবর মোটামুটি যেমন আশা করা গেছল তাই। নিজের পোর্টফোলিও ব্যাগ থেকে জিত্ আর্ট পেপারে ছাপা একটা প্যামফ্লেট তার হাতে দিল। বাপী শুয়ে শুয়েই উল্টে-পাল্টে দেখল সেটা। তার খসড়া মতোই এখানে ছাপা হয়েছে গ্রুপে ভাগ করা ফার্মের যাবতীয় ভেষজ মালের ক্যাটালগ। সমস্ত উত্তরবাংলা নেপাল ভুটান মধ্যপ্রদেশ আর বিহারের শাখা-প্রশাখার হদিস। সে-সব এলাকায় সরবরাহের বিনীত ফিরিস্তি। ট্রেনের অনিশ্চয়তার ওপর নির্ভর না করে নিজেদের যানবাহনে সময়ে সর্বত্র মাল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। কলকাতার এ-মাথা ও মাথা পর্যন্ত এই প্যামফ্লেট ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বনজ ওষুধের পুরনো ব্যবসার প্রচার এ-যাবৎ তেমনি পুরনো ধাঁচের ছোট গণ্ডীর মধ্যে আটকে ছিল। পাঁজির পাতায় বা ক্বচিৎ কখনো খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখা যেত। এ-সব জায়গায়ও পাতা-জোড়া প্রচারের সংকল্প বাপীর মাথায় আছে। তার আগে এইগোছের চটকদার প্রচার এ-লাইনে কমই দেখা গেছে। ফার্মের চকচকে ক্যালেন্ডার আর ফ্যাশানের ডায়েরি তাদের নজর কেড়েছিল। আর্ট পেপারে ছাপা প্যামফ্লেট ছড়ানোর ফলে কলকাতার বাজারে রাই অ্যান্ড তরফদারের আসন্ন পদার্পণের ঘোষণা আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। জিতের খবর, মালিক আসছে জেনে অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন শুধু বানারজুলি থেকে মাল চালান আর স্যাম্পল্ আসার অপেক্ষা।

—সে-সব তুমি সামনের সপ্তাহের মধ্যে পেয়ে যাবে। গোডাউন ঠিক করেছ?

জিত্‌ সায় দিয়ে জানালো, দুটো গোডাউন দেখে রাখা আর ল্যান্ডলর্ডের সঙ্গে কথা বলে সময় নেওয়া হয়েছে। এখন মালিকের যেটা পছন্দ। এ-ছাড়া চৌরঙ্গীর কাছাকাছি এলাকায় আর পার্ক স্ট্রীটের দিকে কিছু ফারনিশড্ ফ্ল্যাটও দেখা হয়েছে। ‘ভাড়া অনেক। পছন্দ হলে পেতে কোনো অসুবিধে হবে না।

ফ্ল্যাট খোঁজার কথাও বাপী তাকে লিখেছিল। বলল, কাল-পরশুর মধ্যে সব ঠিক করে ফেলব। ভাবল একটু। কাল সকালে—না কাল শনিবার, বারোটার মধ্যে ব্যাঙ্কের কাজ সারতে হবে। দুপুরের দিকে তাকে আসতে বলে দিল। ভবানীপুরের দিকের কোনো মেসে একটা ঘরভাড়া নিয়ে আছে ও। মনে পড়তে হঠাৎ কৌতূহল একটু।—তোমার মেস ঠিক কোন্ জায়গায় বলো তো?

জিত্‌ হদিস দিতে মনে হল টালি এলাকার কাছাকাছিই হবে।—ব্রুকলিন পিওন রতন বণিক কপাল যাচাই করে প্রথম থেকে অন্ধ বিশ্বাসে তার রাজার ভাগ্য ঘোষণা করেছিল। আর চলে আসার দিনও বলেছিল, কপালের রং আগের থেকে ভালো হয়েছে, আর বলেছিল আমার কথা মিলিয়ে নেবেন, দিন ফিরলে ভুলবেন না যেন।

দিন ফিরেছে। বাপী ভোলেনি। সেই কৃতজ্ঞতায় ওরও কপাল ফেরানো, দিন ফেরানোর ইচ্ছে। আগের বারে এসেও এমনি তাগিদ অনুভব করেছিল। এবারও হেঁটেই দিতে হল।…ভুলবে তো নাই কোনদিন। প্রবৃত্তির শেকলের দাগ এখনো আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে, ভুলবে কেমন করে। পরে দেখা যাবে। পরে যা হয় হবে।

—আচ্ছা আজ এসো।

একটু ইতস্তত করে জিত্ উঠে দাঁড়ালো। মনিবের দিকে আর একবার তাকিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ালো।

তক্ষুনি নিজের চোখ যাচাইয়ের ঝোঁক বাপীর। ডাকল, শোনো—

ফিরল।

—বোসো। কিছু বলবে? আরো কিছু যে বলতে চেয়েছিল মালিক বুঝল কি করে ভেবে পেল না। দ্বিধা কাটিয়ে জিত্ জানালো আবু সাহেব অন্য মালের ব্যাপারেও কিছু খোঁজখবর নিতে বলে দিয়েছিল। তাও নেওয়া হয়েছে—

বাপী তক্ষুনি বুঝে নিল অন্য মালটা কি। ভুটান সিকিম বা নেপালের মদ। ট্রাক যখন আসবেই, লাভ বুঝলে এ-দিকটাও চালু রাখতে অসুবিধে নেই। এই ব্যবসা এখন পুরোপুরি আবুর এখতিয়ারে। লাভের আধাআধি বখরার শর্তে বাপী শুধু পুঁজি অর্থাৎ টাকা যুগিয়ে খালাস। এ-ছাড়া আর কোনো দায়দায়িত্ব বা সংস্রব নেই।

নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, বাজার কেমন?

শুনল, বাজার খুব ভালো। বানারজুলির থেকে ঢের ভালো। যতগুলো লিকারশপের মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে, দামের আঁচ পেয়ে সকলেই এক কথায় রাজি। জিনিস কেবল তাদের ঘরে পৌঁছে দিতে হবে।

এ-কাজেও লোকটার এমন তৎপরতা দেখে বাপী ভিতরে ভিতরে থমকালো একটু। জিগ্যেস করল, তুমি ড্রিংক করো?

—না, সার।

—শিওর—নো?

এবারে একটু জোরের সঙ্গে জবাব দিল, আপনি একটু খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, মিসেস গায়ত্রী রাইয়ের কাছে আমার সম্পর্কে চালিহা সাহেবের সেটাই বড় সার্টিফিকেট ছিল।

বাপী আর জেরা করল না। এত বলার দরকার ছিল না, সত্যি না হলে মুখ দেখে বুঝতে পারত। বলল, ঠিক আছে, এ সম্পর্কে পরে ভাবব, আবুকে চিঠিপত্রে কিছু লেখার দরকার নেই।

মালহোত্রা চলে গেল। যতটা আশা করেছিল লোকটা তার থেকেও ভালো উৎরোবে মনে হল বাপীর। আকাঙ্ক্ষা বড় বলেই দ্বিতীয় দফা চাকরি ছেড়ে এই ঘাটে নৌকো বেঁধেছে। নিজের দায়েই সেটা অক্ষত রাখতে চাইবে।

আরো অনেকক্ষণ শুয়েই কাটিয়ে দিল। বাইরের অন্ধকার ঘরে সেঁধিয়েছে উঠে আলো জ্বালল। নোটবই খুলে একটা টেলিফোন নম্বর বার করে ঘরের রিসিভার তুলে কানেকশন দিতে বলল।

একটু বাদে ও-প্রান্ত থেকে চেনা গলা ভেসে এলো।

—ছোট কোবরেজ মশাই?

—বলছি—আপনি?

এধারে বাপীর গলা আরো গুরুগম্ভীর।—প্রেয়সীর খবর কি—ঘরে ডেকে গান-টান শোনাচ্ছে আজকাল, না এখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনতে হচ্ছে?

কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্তের পর ও-দিক থেকে নিশীথ সেনের গলা আছড়ে পড়ল।—বাপী তুই! আচ্ছা চমকে দিয়েছিলি মাইরি। তারপরেই খাটো গলা।— ও-সব কথা আর মুখেও আনিস না ভাই, আমি ফেঁসে গেছি, এই গলায় যে ঝোলার সে ঝুলে পড়েছে—

বাপী যেন ধাক্কাই খেল একটু।—কে ঝুলল, তোর বাবার পছন্দের সেই টাকাঅলা মুদির পুঁটলি?

—আর বলিস না ভাই। লজ্জায় তোকে একটা খবরও দিতে পারিনি।—ভদ্রলোক মানে বউয়ের বাবা হঠাৎ শক্ত অসুখে পড়ে যেতে নিজের বাবাটি একেবারে মাথায় চেপে বসল। কি আর করব, দুগ্‌গা বলে ঝাঁপিয়েই পড়লাম। ভদ্রলোকের ছেলে তো নেই, তিনটেই মেয়ে—অসুস্থ শ্বশুরের সঙ্গে সকালের দিকে এখন দোকানেও বসতে হচ্ছে। যাকগে, হুট-হুট করে কখন আসিস কখন যাস জানতেই পারি না—তোর খবর কি?

—ভালো।

নিশীথের গলার স্বর উৎসুক একটু।—এখানে তোদের রিজিয়ন্যাল অফিস হচ্ছে এবার?

—ঠিক নেই। ছাড়ি, খুব ব্যস্ত এখন।

—শোন, সেই হোটেলেই উঠেছিস নাকি? কবে দেখা হবে?

—আমি তোকে ফোন করব’খন, এখন বেজায় তাড়া, ছাড়ি

রিসিভার নামিয়ে আবার বিছানায় চিৎপাত। ফোন করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত এখানকার ম্যানেজারের চেয়ারে নিশীথ সেনকে বসানো স্থির ছিল। ওদের সামনের বাড়ির সেই বি. এ. পাশ করা মিষ্টি গান করা আধুনিকা সুশ্রী মেয়েই যদি নাকসিঁটকে কবিরাজের ছেলেকে বাতিল করে দিত, বাপী এমন অকরুণ হত না। ফোনে এই শোনার পর নিশীথ সেনের অস্তিত্বসুদ্ধ বাতিল।

কলকাতার বাতাস ঠিক এই সময়ে কতটা উত্তপ্ত বাপীর ধারণা ছিল না। পরদিনই টের পেল। দিন বারো আগে ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর হঠাৎ মৃত্যুর খবর কাগজে দেখেছিল। ছ’ সপ্তাহ যাবৎ শ্রীনগরে আটক ছিলেন। সেখানেই অঘটন। পশ্চিম বাংলার মানুষ এই মৃত্যুকে সাদা চোখে দেখেনি। অসন্তোষের আগুন তখন থেকেই ধিকি ধিকি জ্বলছে। দিল্লিতে বসে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু আটক অবস্থায় এই সংগ্রামী নেতার জীবনান্তের কারণে তাঁর বেদনাবোধের কথা বলেছেন। কিন্তু এই মৃত্যু নিয়ে হাজার হাজার বাঙালীর তদন্তের দাবি সম্পর্কে তিনি নিরুত্তর। অসন্তোষ বাড়ছে। সাধারণ মানুষ ক্রোধে গজরাচ্ছে। ঠিক এই সময়, অর্থাৎ বাপী আসার পরদিনই সমস্ত কলকাতা দপ করে জ্বলে উঠল আর এক উপলক্ষে। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের এক পয়সা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এখানকার সরকারের তাতে অনুমোদন ছিল। ফলে ক’দিন যাবৎ একটা প্রতিরোধের আন্দোলন শুরু হয়েছিল। স্নায়ু এমনি তপ্ত সকলের যে অতি নিরীহ যাত্রীও এক পয়সা বেশি দিতে নারাজ।

কলকাতায় আসার তাড়ায় আগের দু’দিনের কাগজ উল্টে দেখারও সময় হয়নি বাপীর। গতরাতে রেডিওর খবরও শোনার মেজাজ ছিল না। সকালের কাগজ খুলে দেখে, কলকাতায় সেদিন ওই এক পয়সা ট্রামভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় বামপন্থীদের স্বার্থের কথা বলে পাল্টা কটাক্ষ হেনেছেন। জনসাধারণের কাছেই এই হরতাল বানচাল করার আবেদন পেশ করেছেন।

কলকাতার এই বাতাস বাপী চেনে না। ক্ষ্যাপা কলকাতার এই চেহারা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ কোনো ধারণা ছিল না। শুধু একদিন নয়, পর পর আরো ক’টা দিন হোটেল-বন্দী হয়ে থাকল। চারদিকে আগুন জ্বলে উঠেছে, রক্ত ঝরছে। ট্রাম পুড়ছে, সরকারী বাস পুড়ছে। নগর জীবন স্তব্ধ, অচল। হরতালের পরদিনই বিধান রায় য়ুরোপ চলে গেছেন। তাঁর সেখানে চোখের অপারেশন। এই অনুপস্থিতিতে হাল যাঁরা ধরেছেন, জনমতের দিকে না চেয়ে অবস্থা আয়ত্তে আনার তাগিদে তাঁরা পুলিশের পৌরুষের ওপর নির্ভর করেছেন। এই ভুলের মাশুল বেড়েই চলল। এক পয়সার যুদ্ধের সমস্ত নেতার সঙ্গে হাজারের ওপর বিক্ষুব্ধ মানুষ জেলে। কিন্তু মানুষ ক্ষেপলে জেলই বা কত বড়? ফলে লাঠি টিয়ারগ্যাস গুলি—খুন-জখমের তাণ্ডব।

বাপী আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করে আবুকে মালের ট্রাক ছাড়তে নিষেধ করেছে। এই বিপাকে গোডাউনই ঠিক করা হয়নি, মাল এনে করবে কি। ব্যাঙ্কের কাজ অবশ্য সেরে রাখতে পেরেছে। চৌরঙ্গী এলাকার কয়েকটা ব্যাঙ্কে নগদ টাকার কাঁড়ি জমা করে দিয়েছে। জিত্‌ মালহোত্রা হেঁটে হলেও একবার করে আসে। তার তৎপরতায় এর মধ্যেই ভালো একটা ফ্ল্যাটও বুক করা গেছে। চৌরঙ্গীর কাছাকাছি অভিজাত এলাকা। এখন পর্যন্ত বাঙালীর বাস কম। মস্ত ম্যানশানের রাস্তামুখো তিনতলার ফ্ল্যাট। লিফট আছে। একতলায় গ্যারাজ। সামনে প্রকাণ্ড ফারনিশড হল। ও-ধারে দুটো বড় বেডরুম। পরিপাটী ব্যবস্থার কিচেন আর ঝকঝকে বাথরুম।

মাস কয়েকের মোটা ভাড়ার আগাম দাবি মিটিয়ে বাপী চোখকান বুজে চুক্তিপত্রে সই করে দিয়েছে। গণ্ডগোলের দিন না হলে চার-পাঁচ দিনের মধ্যে উঠে আসা যেত। বাপীর তাড়ায় ফ্ল্যাটের মালিক আশ্বাস দিয়েছে, মাসের মাঝামাঝি সময়ে যে করে হোক হোয়াইটওয়াশ আর ঝাড়ামোছা সেরে ফ্ল্যাট তার বাসযোগ্য করে দেবে।

ঊর্মিলার সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি। বিজয়ের সঙ্গে ফোনে দু’দিন কথা হয়েছে। ওর অফিসে এসে ঊর্মিলাও গতকাল ফোনে কথা বলেছে। তাদের ওখানে চলে আসার জোর তাগিদ ওর। এই গণ্ডগোলের মধ্যে হোটেলে বসে কি করছে? তাদের ওখানে চলে আসছে না কেন? ফ্যাকটরি কোয়ার্টার্স এলাকার মধ্যে ঢুকে যেতে পারলে নিশ্চিন্ত। দু’খানা ঘরের একটা খালি পড়ে আছে জেনেও ফ্রেন্ড হোটেলেই উঠতে গেল কেন?

সম্ভব হলে বাপী আজ যাবে ঠিক করেছে। আর কিছু না হোক, ওদের গাড়িটা এখনি দরকার। নিজের দখলে একটা গাড়ি থাকতে এতটা পঙ্গু মনে হত না। ট্যাক্সি পাওয়াও দুর্ঘট এখন। বেলা থাকতে যাবে ঠিক করেছিল। বিকেলের দিকেই গণ্ডগোলটা বেশি হচ্ছে। সকালে গিয়ে লাভ নেই। বিজয় মেহেরাকে অফিস থেকে টেনে বার করা যাবে না। সব ঠাণ্ডা থাকলে চলেই আসবে। বাপীর রাতে কোথাও থাকার ইচ্ছে নেই।

আড়াইটে নাগাদ বেরুনোর জন্য তৈরি হয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। এখান থেকে সামনের ময়দান আর চৌরঙ্গী এলাকার খানিকটা দেখা যায়। এই ক’টা দিনের মধ্যে অস্থির কলকাতা সম্পর্কে বাপীর কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই জানালায় দাঁড়িয়েই দিনের হাওয়া টের পায়। ট্রাম চলাচল সেই শুরু থেকেই বন্ধ। শান্তি-শৃঙ্খলায় ঘা পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে বাস ট্যাক্সি এমন কি রিকশও রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায়।

ভারী পর্দাটা ঠেলে সরানোর সঙ্গে সঙ্গে বাপীর গলা দিয়ে একটা বিরক্তির শব্দ বেরিয়ে এলো। যাওয়ার বারোটা বেজে গেল। কোথাও ঘটছে কিছু। নিচের ফুটপাতে আর সামনের ময়দান ভেঙে কাতারে কাতারে মানুষ চলছে। লোকগুলো কিছু তাড়া খেয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরার জন্য ব্যস্ত। বাস চলছে এখনো, কিন্তু তার ছাদে পর্যন্ত মানুষ।

ঘরের দরজা বন্ধ করে বাপী নেমেই এলো তবু। হোটেলের বাইরের সামনের গাড়ি-বারান্দার নিচে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষের পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরার মিছিল দেখতে লাগল। ঘটনা কি তাও কানে এলো। ডালহৌসি স্কোয়ারে এক পয়সার বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ বেপরোয়া লাঠি চালিয়েছে। কত লোককে শুইয়ে দিয়েছে ঠিক নেই। কারো কারো অবস্থা আশঙ্কাজনক।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে মানুষগুলোর মুখ দেখছে বাপী। কোথায় কোন মুহূর্তে আবার আগুন জ্বলে সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরার তাড়া তাদের। কিন্তু তার মধ্যেও চোখে-মুখে জমাট-বাঁধা ক্রোধ। হয়তো বা ঘৃণাও। সামিল হবার সাহস হয়তো নেই। কিন্তু ক্ষমতার মত্ত আঘাত তাদেরও বুকে বাজছে।

ভিতরে কোথায় মোচড় পড়ছে বাপীরও। এই মানুষগুলোর থেকে, আর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়ে যার শাসনের আঘাতে মাটিতে মুখথুবড়ে পড়ছে তাদের থেকে ও যেন বিচ্ছিন্ন; এই বিচ্ছেদের একটা অচেনা যন্ত্রণা ওকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। একটা পয়সা—শুধু একটা পয়সার জন্য এমন ঝড় এমন তাণ্ডব? তা কক্ষনো হতে পারে না। এই একটা পয়সা হয়তো অনেক বঞ্চনা অনেক অবিচারের প্রতীক তাই যদি হয়, যত ঐশ্বর্যই থাকুক বাপীর অন্তরাত্মা এদের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

—কি ব্যাপার? এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখছ?

হাত ধরে একটা বড় রকমের ঝাঁকুনি দিল ঊর্মিলা। ফুটপাতের ধারে ক্রিম রঙের চকচকে একটা মরিস মাইনর গাড়ির দরজা বন্ধ করে বিজয় মেহেরাও এদিকে আসছে।

ঊর্মিলা অত মানুষকে পথ চলতে দেখে সভয়ে আবার জিগ্যেস করল, গণ্ডগোলের ব্যাপার নাকি কিছু?

—হ্যাঁ, ডালহৌসিতে জোর লাঠি-চার্জ হচ্ছে শুনলাম। তোমাদের কাছে যাব বলে তৈরি হয়ে আজও আটকে গেছি…এর মধ্যে আবার তোমরা এসে হাজির হলে।

কথায় সময় নষ্ট না করে ঊর্মিলা তাকে গাড়িতে ঠেলে নিয়ে সামনের সীটে তুলল। পরে নিজেও তার পাশে বসে পড়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে বিজয়কে তাড়া দিল, হাঁ করে দেখছ কি— জলদি চালাও!

সামনে তিনজন সহজভাবে বসার মতো বড় নয় গাড়িটা। ওদের দু’জনকে সামনে বসতে দেখেই বিজয় হয়তো থমকে ছিল একটু। তাড়াতাড়ি ঘুরে এসে নিজের আসনে বসে গাড়ি ছোটাল। ঊর্মিলা বলে উঠল, আর ভালো লাগে না বাপু, রোজ এই এক কাণ্ড লেগে আছে—হাড়পিত্তি জ্বলে গেল।

গাড়ির স্পিড আরো বাড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে বিজয় বলল, হাড়পিত্তি আমারও জ্বলে যাচ্ছে, তুমি দুজনের মাঝখানে বসলে আধাআধি ভাগ পেতাম।

ছদ্ম কোপে ঊর্মিলা বলল, দেব ধরে গাঁট্টা।

বাপী হাসল মনে মনে। যখন যার যেমন জগৎ। বিজয়কে বলল, বেশি হাড়পিত্তি জ্বললে গাড়ি থামাও, আমি পিছনে গিয়ে বসছি।

ঊর্মিলাও এবার হেসেই সায় দিল, তাহলে দুজনেই পিছনে যাই চলো। এই যাঃ! জিব কাটল।—ভেবেছিলাম হাসব না, কম করে ঘণ্টাখানেক তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব।

বিজয় ফোড়ন কাটল, আমার সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টাই করছে তাই অরুচি ধরে গেছে।

জবাবে ঊর্মিলা বাপীর পিছন দিয়ে হাত বাড়িয়ে বিজয়ের চুলের গোছা টেনে ধরল।

পথে আর কোয়ার্টার্সে পৌঁছনোর পরেও বাপী অনেকবার ওদের ঝগড়া দেখল। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতে রাজি নয়। যেমন, ঊর্মিলা বাপীকে বলল, আমার খপ্পরে পড়েছ, এখন সাতদিনের মধ্যে তোমাকে ছাড়ছি না।

বাপী বাধা দেবার আগে বিজয় বলল, বাইরে যাবার মুখে আমি এখন অত ছুটি পাচ্ছি কোথায়?

—তোমাকে ছুটি নিতে কে বলেছে? সঙ্গে সঙ্গে ঊর্মিলার জবাব।

—দেখলে, দেখলে? বাপীকেই সালিশ মানল বিজয়। তারপর গলা চড়িয়ে বলল, তোমার তেমন তাড়া থাকে তো আজই চলে যেতে পারো—আমিই না হয় পৌঁছে দিয়ে আসব।

ওদের গাড়িটা বাপীর সত্যি খুব পছন্দ হয়েছে। দেখতে যেমন, চলেও জলের মতো। বাপীর মুখে প্রশংসা শুনে ঊর্মিলা চা খেতে খেতে বিজয়কে বলল, এত যখন পছন্দ হয়েছে, গাড়িটা এমনি দিয়ে দাও না ওকে, তবু মনে থাকবে—

কথা শেষ হবার আগেই গম্ভীর ঝাঁঝের সুরে বিজয় বলল, যে দরে কিনেছি তার থেকে দেড় হাজার টাকা বেশি লাগবে।

এই ঝগড়ার তলায় তলায় যা সেইটুকু আস্বাদের বস্তু। বাপীর ভাবতে ভালো লাগছে, গায়ত্রী রাইও কোথাও থেকে ওদের এই খুনসুটি দেখছে আর মুখ টিপে হাসছে।

ঊর্মিলার রাগারাগিতে কান না দিয়ে পরদিন চা-পর্বের পরেই বাপী চলে এলো। বিকেলের মধ্যেই আবার ফিরবে কথা দিল। গাড়িটা তার এক্ষুনি চাই। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে এনে কিছু বোঝার আগেই বিজয়ের পকেটে গুঁজে দিয়েছে। দুজনের কারো আপত্তি কানে তোলেনি। বিজয়কে বলেছে, তুমি, কেনা বেচা সইসাবুদের ব্যাপার করো বসে বসে, আমি গাড়ি নিয়ে আজই চললাম।

ঊর্মিলা এই রাতেও ছাড়েনি ওকে। খাবার টেবিলে ঊর্মিলার মুখেই টগবগ করে বেশি কথা ফুটছিল। হঠাৎ থেমে গিয়ে আড়ে আড়ে বাপীকে দেখতে লাগল।

—কি হল?

—একটা কথা মনে পড়ল। গোটা ব্যবসাটাই এখন তোমার। যা আছে তাই নিয়ে বানারজুলিতে বসেই রাজার হালে কাটিয়ে দিতে পারতে। হঠাৎ‍ কলকাতায় জাঁকিয়ে বসার ইচ্ছে কেন?

বাপী হাল্কা সুরেই ফিরে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি ধারণা?

—আমার ধারণা, এখনো তোমার মাথায় মতলব কিছু আছে।…এবারে এসে দেখা হয়েছে?

বাপী ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হঠাৎ। গেলবারে বানারজুলিতে এসে জেরার মধ্যে ফেলে ঊর্মিলা মিষ্টির বিয়ের খবর শুনেছে। তখন বেশ দুঃখও হয়েছিল ওর।

—কি বাজে বকছ!

—বাজে বকছি? তুমি শুধু আরো বেশি রোজগারের নেশায় এখানে জাঁকিয়ে বসছ?

আলতো করে বিজয় বলল, বসলেই বা। যে মতলবই থাক, আমি তো তোমাকে নিয়ে এ-মাসের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছি! তোমার নাগাল পাচ্ছে কোথায়?

রাগতে গিয়েও ঊর্মিলা থমকালো। ঠোঁটের ফাঁকে দুষ্টু-দুষ্টু হাসি। ওর দিকে চেয়েই জবাব দিল, প্রেমে ঘা পড়লে কেউ কেউ কোন্ মূর্তি ধরতে পারে জানলে তুমি হার্টফেল করতে। বাপীর দিকে ফিরে চোখ পাকালো, বলে দেব?

পরক্ষণে সামলে নিল। একটা যন্ত্রণার আঁচড় পড়েছে বুঝতে সময় লাগল না। বলল, থাক বাপু ঘাট হয়েছে, এই কানে হাত দিচ্ছি, আর বলব না।…আসলে তোমাকে আমি একটু একটু ভয়ও করি, তাই তোমার জন্যে ভাবনা বুঝলে? বোঝেনি কিছুই শুধু বিজয়। তবু সে-ই চেঁচিয়ে উঠল, আমি কিন্তু এবার হার্টফেল করছি!

ওরা যাবার আগে ঘন ঘন আসবে কথা দিয়ে পরদিন বিকেলে ঝকঝকে মরিস মাইনর গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সকালে বিজয়ের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক মহড়া দিয়েছে। হাত অভ্যস্ত এখন। এমন একটা গাড়ি নিজস্ব হবার ফলে মেজাজ খুশি। খানিকটা পথ এগোতে সেই খুশিতে হঠাৎই কিছু সঙ্কল্পের ফল ধরল।

দক্ষিণের পথ ধরে ফিরতে লাগল। মিনিট পঁচিশের মধ্যে সেই পরিচিত রাস্তায়। সাতাশি নম্বর বাড়িটা লক্ষ্য। ঘড়ি দেখল। ছ’টা বাজে। সুদীপ নন্দী অনেক আগেই কোর্ট থেকে ফিরেছে নিশ্চয়। আশা করছে তাকে বাড়িতে পাবে। তার মা-কেও পাবে। আজই যেন তাদের সঙ্গে দেখা করার ঠিক দিন। ঠিক সময়।

খানিক দূর থেকে গাড়ির স্পিড কমালো। বিকেলের আলোয় টান ধরেছে। তাহলেও তেমন অস্পষ্ট নয় এখন পর্যন্ত। বাপীর আশা দীপুদাকে বা তার মা—কে বা দুজনকেই দোতলার বারান্দায় দেখবে।…ও দেখবে না, তারা ওকে এই গাড়ি থেকে নামতে দেখবে।

নেই।

খানিক আগে আপনা থেকেই ব্রেকে চাপ পড়তে গাড়িটা প্রায় থেমে গেল। প্যান্ট কোর্ট পরা যে মানুষটা ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনো দিকে না তাকিয়ে হনহন করে সামনে এগিয়ে চলল, ব্রেকে চাপ পড়েছে তাকে দেখে।

….ফর্সা মুখ। সোনালী চশমা। আরো অনেক দূর থেকে দেখলেও ভুল হবার নয়। অসিত চ্যাটার্জি। যার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মিষ্টি এখন মালবিকা চ্যাটার্জি। বাপী গাড়িটা থামিয়েই দিল। লোকটা যে মুখ করে ওই সাতাশি নম্বর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো আর যে-ভাবে দু’পায়ে মাটি দাপিয়ে চলেছে তাই থেকে মেজাজ আঁচ করা যায়। জামাই-অভ্যর্থনা নিয়ে যে বেরোয়নি সেটুকু স্পষ্ট।

দু’মিনিটের মধ্যে সামনের বাঁক ধরে চোখের আড়াল হতে বাপীর গাড়িও নড়ল। কিন্তু সাতাশি নম্বর বাড়ির দোরে আর থামল না বা সেদিকে তাকালোও না। সোজা বেরিয়ে এসে সে-ও বাঁক নিল। এই হঠাৎ-দর্শনে মগজের প্ল্যানও বাঁক ঘুরেছে।

গাড়িটা যে-ভাবে একেবারে পাশ ঘেঁষে ঘ্যাঁচ করে থামল, লোকটা চমকে দাঁড়িয়ে গেল। রাগ উপচে ওঠার আগেই বিস্ময়ের ধাক্কা। বাপী হাসছে অল্প অল্প। পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল, খুব অচেনা মনে না হলে উঠে পড়ো!

.

চকচকে গাড়িটা এক নজরে দেখে নিয়ে অসিত চ্যাটার্জি খোলা দরজায় এক হাত রেখে ঝুঁকল একটু। সোনালি ফ্রেমে আঁটা কাঁচের ওধারে চোখ দুটো চিকচিক করে উঠল। বাপীর মুখ হাতড়ে অপ্রীতিকর কোনো ব্যাপারের হদিস পাচ্ছে যেন। গলার স্বরেও তেমনি আঁচ-লাগা বিস্ময়। তুমি এখানে তাহলে?

বাপী সত্যি অবাক।—তাহলে মানে?

চোখের তাপ মুখে ছড়াচ্ছে।—বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে? কবে আসা হয়েছে?

বাপী মিথ্যে কথা সচরাচর বলে না। কিন্তু জবাব যা দেবে তা আরো কারো কানে ওঠার সম্ভাবনা। কলকাতায় এসেছে আজ হাতে গুণে ন’দিন। অম্লান বদনে বলে ফেলল, তা মাস দেড়েকের ওপর হবে। কিন্তু ব্যাপার কি…তোমরা সব আছ কেমন?

দেড় মাসের ওপর এসেছে শুনে হোক বা সাদা বিস্ময়ে খবর জিজ্ঞাসা করার দরুন হোক, লোকটা থমকালো একটু। কিন্তু চাউনি সন্দিগ্ধ তার পরেও। এতদিন এসেছ, মিলুর সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি?

মিলু শুনে কানের পর্দা আজও চিড়চিড় করে ওঠল। কিন্তু মিলু ছেড়ে মিষ্টি শুনলে আরো অসহ্য মনে হত। ভেবাচাকা খাওয়া নিরীহ মুখ বাপীর। দেখা হলে তোমার না জানার কথা নাকি। আসার দিনে ইনফরমেশান কাউন্টারে তাকে না দেখে আমি তো ধরে নিয়েছি দিল্লির সেই চাকরি পেয়ে সেখানে চলে গেছে।

কি কারণে ওকে দেখামাত্র লোকটার এমন সন্দিগ্ধ আচরণ বাপী ঠাওর করতে পারছে না। এই জবাবের পর খানিকটা ঠাণ্ডা। তবু আরো কিছু সংশয়ের অবকাশ আছে যেন। আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে আছ, এখানকার এরাও জানে না?

—এরা কারা?

—মিলুর দাদা আর মা?

এবারের জবাবে স্পষ্ট বিরক্তি।—কি বাজে বকছ, তাদের নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর সময় হয়নি, কাজের চাপে নাওয়া-খাওয়ারও ফুরসৎ মেলে না। রাস্তার মাঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তোমার অত জেরা শোনারও ধৈর্য নেই আমার, উঠবে তো ওঠো, নয়তো সরো।

দাবড়ানি খেয়ে ধাতে ফিরল। বাপীর মনে হল, সেই সঙ্গে একটা আশঙ্কাও দূরে সরল। তাড়াতাড়ি পাশের আসনে বসে দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে দিল।

বাপী এনজিন বন্ধ করেনি। সামনের দ্বিতীয় বাঁক ঘুরে বড় রাস্তায় পড়তে—গাড়ির ভিতরটা এক নজর দেখে নিয়ে অসিত চ্যাটার্জি জিগ্যেস করল, বিলিতি

গাড়ি নিজে চালাচ্ছ…কিনলে নাকি?

জবাবে মাথা নেড়ে সায় দিল।

এমন ভাগ্যও ঈর্ষার বস্তু।—তুমি তাহলে কলকাতাতেই থাকছ এখন …ব্যবসার নতুন কিছু চার্জ নিয়েছ নাকি?

—চার্জ আর কার থেকে নেব…সমস্ত ব্যবসাটাই আমার এখন। এখানে নতুন সেন্টার খুলেছি। তুমি এখন আর কোথাও যাবে, না আমার ওখানে বসবে একটু?

—তোমার ওখানে মানে সেই হোটেলে?

—আপাতত তাই। ফ্ল্যাটও পেয়েছি একটা, শিগগীরই উঠে যাব।

—কোথায়?

বলল।

—এসব জায়গার ফ্ল্যাটের তো অনেক ভাড়া!

—খুব না, মাসে আটশ। সুবিধে হলে কিনে ফেলার ইচ্ছেও আছে।

বলার উদ্দেশ্য সফল। এমন পর্যায়ের মানুষকে হিংসে আর কত করবে। হৃদ্যতা বরং কাম্য। চোখে লোভ, ঠোটে হাসি।—সেবারের মতো ভালো জিনিস ঘরে আছে?

বাপী গাড়ি চালাচ্ছে তাই সামনে চোখ। হেসেই জবাব দিল, তুমি হলে গিয়ে আমার হীরো, চাইলে এসে যেতে কতক্ষণ।…আচ্ছা অসিতদা, আমাকে দেখেই তোমার মেজাজখানা অমন খিঁচড়ে গেল কেন?

লজ্জা পেল।—মন-মেজাজ সত্যি একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে আছে। তুমি কিছু মনে কোরো না ভাই, এরা দিনকে দিন মাথায় চেপে বসছে।

—এরা বলতে?

—আর কে, মিলুর দাদা আর মা।

জেনেও অবাক হওয়ার ভান করল বাপী।—তুমি এখন ওঁদের ওখান থেকে নাকি?

—হ্যাঁ। আজ এক হাত হয়ে গেল।

এক হাত হয়ে গেল বলে ওকে দেখে অমন তিরিক্ষি আর সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিল কেন, বাপী ফিরে আর তা জিগ্যেস করল না। তার তাড়া নেই। হোটেলে নিয়ে গিয়ে ফেলার পর খোলস থেকে ভিতরের মানুষটাকে টেনে বার করতে সময় লাগবে না। বলল, গুলি মেরে দাও, তোমার মাথায় চেপে বসতে চাইলে আবার জন্মাতে হবে। কাজ-কর্ম কেমন চলছে বলো।

ফর্সা মুখে খুশির ঢল নামল। যত টাকাই করুক ছেলেটা সত্যিকারের সমঝদার বটে। চাকরিতেও লোককে বলার মতো মোটামুটি পদস্থ এখন। এক নামী তেল কোম্পানীর চীফ অ্যাকাউন্টেন্ট হয়ে বসেছে। বিলিতি কোম্পানী। মালিকানার বেশির ভাগ এখনো সাহেবদেরই হাতে। সুপারিশের জোর ছিল না, তিন-তিনটে ইন্টারভিউর বেড়া টপকে নিজের বিদ্যেবুদ্ধির জোরে কাজটা পেয়েছে। ফর্সা মুখ আত্মতুষ্টিতে অমায়িক আরো।—সাহেবদের ইন্টারভিউ বোর্ডে এই চেহারাও কিছু কাজ করেছে অবশ্য, তাহলেও ও-দেশের চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট থেকে আমাদের রেজিস্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট যে কম কিছু নয় এটা তাদের বুঝতে হয়েছে।

বাপীর চোখেমুখে প্রশংসার বন্যা। গাড়ি চালানোর ফাঁকে দুই-একবার না তাকিয়ে পারল না। বলল, তুমি ঢের বড় হবে অসিতদা, আমি খুব ভালো করেই জানতাম। এসব ব্যাপারে আমার একটা সিক্সথ সেন্স আছে।..মাইনে এখন তাহলে অনেক পাও?

খুশিতে বিগলিত হতে গিয়েও থমকালো। হাজার টাকার মত পাচ্ছে আপাতত। চাকরির বাজার যা, সাধারণ দশজনের চোখে অনেকই বটে। কিন্তু এই লোক ফ্ল্যাট ভাড়াই দেয় মাসে আটশ টাকা। তার এই গাড়ি আর এত বড় ব্যবসার মালিক। জবাব দিল, মন্দ নয়, উন্নতিও আছে…তা হলেও তোমার কাছে আর অনেক কি!

—ছাড়ো তো। ক-অক্ষর গো-মাংস অনেক আলু-পটোলের কারবারীও ঢের টাকা রোজগার করে, তা বলে তারা অসিতদা হয় না। বাবার টাকায় বিলেতে গিয়ে পার্টিগুণে ব্যারিস্টার হয়ে আসা থেকে তো ঢের ভালো।

এমন জায়গায় সুড়সুড়ি পড়ল যে অসিতদাটি আধাআধি তার দিকে ঘুরে না বসে পারল না। শুধু কান আর বুক দিয়ে নয়, দুটো চোখ দিয়েও স্বাদ নেবার মতো কথা। ফর্সা মুখে হাসি ছুঁয়ে পড়ছে।

হোটেলে এসে বাপী এবারও আস্ত বিলিতি বোতল আনালো একটা। সঙ্গে জিভ টসটস করার মতো বাছাই খাবার! মাখন গলা আব্দারের সুরে অসিতদা বলল, আজ কিন্তু তোমাকে আমার সঙ্গে একটু খেতে হবে।

—খাব যখন তোমার কাছেই হাতেখড়ি দেব, আজ না—মহাগুরু নিপাত দশার এক বছর না কাটলে ওসব হাত দেবার উপায় নেই।

—থাক তাহলে, থাক। অসিতদার গলায় অন্তরঙ্গ সহানুভূতি।—মহাগুরু মানে তোমার বাবা-মায়ের কেউ?

—না, আমার ভাগ্যের ইষ্টদেবী। মনে মনে বলল, মা গায়ত্রী রাই দোষ নিও না। ওই ইষ্টদেবীটিকে স্মরণ করার সময় আগে বা পরে মা জুড়ে দিতে বাপীর বেশ লাগে।

পানাহার দ্রুততালে জমে উঠলে লাগল। ঘরের সবুজ আলো জ্বেলে বাপী সাদা আলো নিভিয়ে দিল। যে সময়ের যে পরিবেশ। অসিতদা এই বিবেচনাটুকুরও তারিফ করল। দ্বিতীয় গেলাসও আধা-আধি শেষ হতে সময় লাগল না। একটু বাড়তি মর্যাদা দেবার সুরে বাপী বলল, তুমি তো তাহলে দিব্বি ভালো আছ এখন অসিতদা—

কাবাবে কামড় দিয়ে হেসেই তাকালো। চোখের তারা সবে বড় হতে শুরু করেছে।—কেন বল তো?

—নিজে এমন একখানা চাকরি করছ, মি—মা-মানে তোমার মিলুও ভালো কাজ করছে, তোমার আর ভাবনা কি!

মিষ্টি বলতে গিয়েও শুধরে মিলু বলল। ওই মুখে এই নাম হামলার মতো শোনাবে। গেলাসে একটা বড় চুমুক দিয়ে তরলানন্দে অসিতদা বলল, মিলুরও একটা প্রমোশন হয়েছে জানো তো?

বাপী ভিতরে ভিতরে থমকালো একটু।—না তো…কি প্রমোশন?

—জুনিয়ার এক্সিকিউটিভ হয়েছে। এখন এয়ারপোর্টে নেই, সেন্ট্রাল এভিনিউর আপিসে বসছে।

—গেলবারের সেই ইন্টারভিউতে ভালো করেছিল বুঝি?

—সেটা তো দিল্লির চাকরি। এখানেও চেষ্টাচরিত্র করছিল—হয়ে গেল। আবার এক চুমুক তল করে লালচে মুখে রসিকতার সুরে বলল, মেয়েদের চেহারাপত্রের জোর থাকলে সুবিধে যেচে আসে ভাই…তুমি স্বীকার করো কি করো না?

বাপী তৃতীয় দফা তার গেলাস ভরে দিতে দিতে অম্লানবদনে মাথা নেড়ে সায় দিল। ফলে ওই ফর্সা মুখের লাগাম আরো একটু ঢিলে।—আমি এ-কথা বললে মিলু আবার রেগে যায়, ওর ধারণা কাজ দেখাতে পারলেই উন্নতি হয়। আমার ভাই সাফসুফ কথা, কাজের আদ্ধেক তো যে অফিসারগুলো ছোঁকছোঁক করে ঘিরে থাকে তাদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। কিন্তু বলতে গেলেই ফোঁস! তা হলে ও মেজাজ বিগড়োলে, আমি ছেড়ে কথা কই না।

শেষের ঝাঁঝালো অভিব্যক্তিটুকু থেকেই বোঝা গেল ওই কারণে অসিতদার মেজাজ বিলক্ষণ বিগড়োয়। এ-প্রসঙ্গ বাতিল করে খুশি গলায় বাপী বলল, যাক এমন যুগল উন্নতির খবর আমি কিছুই জানতাম না—কংগ্র্যাচুলেশনস!

রং-ধরা আবেগে অসিতদা অনুযোগ করল, তুমিই তো আমাদের ছেঁটে দিয়েছ, এতদিন হল কলকাতায় আছ একটা খবর পর্যন্ত দাওনি।

সময় বুঝে হালকা ঠাট্টার সুরে বাপী ঠেস দিয়ে বলল, আজ আমাকে দেখেই রাস্তায় তোমার যে মূর্তি দেখলাম, সেধে খবর দিতে গেলে ডাণ্ডা নিয়ে তেড়ে আসতে বোধ হয়।

—আরে না না। অন্তরঙ্গ দোসরের সংশয় মোচনের চেষ্টা। মিলুর ওই মা আর দাদার সামনে গিয়ে পড়লেই মাথায় আগুন জ্বলে আমার। সঙ্গে সঙ্গে অসিতদার বিরস বদন, ধরা গলা।—তারা আমার লাইফ হেল্ করে দেবার চেষ্টায় আছে ভাই, আর মিলুর কানে অনবরত বিষ ঢোকাচ্ছে।

বাপীর কান জুড়োচ্ছে।—খুব দুঃখের কথা। কিন্তু তা বলে রাস্তায় আমাকে দেখে তোমার অত রাগ কেন?

—তুমি আপনার জন, তোমাকে সব বলব ভাই—কিচ্ছু লুকোবো না।— ওখানে তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল, ওরা যা চায় তুমি হাতে আছ বলেই চায়—

মেকি দাপটে কথার মাঝেই বাপী গলা চড়ালো।—আমি কোনো দিন কারো হাতে নেই—এই বান্দাকে চিনতে তাদের ঢের দেরি।

—জানি ভাই জানি। ভুলের জন্য তুমি এখন আমার গালে একটা চড় কষালেও রাগ করব না—তোমাকে সব বলব।

চতুর্থ গেলাস জঠরস্থ হতে গলগল করে অনেক দুঃখ আর অনেক রাগের কথা বলে গেল লোকটা। —মিলুর সঙ্গে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে খিটিরমিটির লেগেই আছে আজকাল। দোষের মধ্যে সে নেশা-টেশা করে আর একটু রেস বা জুয়াটুয়া খেলে। এ অভ্যেস বিয়ের আগে থেকেই ছিল, আর মিলু তা যে একেবারে জানত না তাও নয়। কিন্তু মা আর দাদা সর্ব্বোক্ষণ কান বিষোলে কাঁহাতক মাথা ঠিক থাকে? নইলে সব দোষ-গুণ মেনে নিয়েই ও কি তার কাছে আসেনি?—পাড়ার দামাল ছেলেরাও অসিতদার কথায় কেমন ওঠে-বসে, তার প্রতাপ কত মিলু সে—সব নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখত। সেই লোক যখন ফাঁক পেলে রাস্তায় লেকে বা কলেজে ওর ওপর চড়াও হত তখনো পছন্দ করত বলেই ছেঁটে দিত না। আর ওর আই-এ পড়ার সময় সেই লোকই যখন চিঠি লিখল তাকে বিয়ে

৫১৮

না করলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না, ও-মেয়ে তখন নিজে পার্কে ডেকে নিয়ে বলেছিল, আত্মহত্যা করতে হবে না, ভালো করে পড়াশুনা করো।—তারপর দুবাড়িরই অত বাধা সত্ত্বেও মিলু কি তার জীবনে আসেনি? এখন অত বিগড়ে যাচ্ছে কেন?

সব ওই মা-টির দোষ। ছেলে হবার সময় জামাই নাকি অভাবে আর অনাদরে তার মেয়েকে মেরেই ফেলার মতলবে ছিল। আরে বাবা, নিজের বউকে মেরে ফেলে তার কি লাভ? মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ী অপমান করে বাড়িতে ঠাঁই দেয়নি তাও জামাইয়ের দোষ। আর একটু নেশা-টেশা করে বলে যেন মেয়ে-খুনের আসামী সে। কিন্তু তাদের মেয়ে যে আপিসের পাঁচজন পুরুষ-বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দেয়, মাঝেমধ্যে রাত করে বাড়ি ফেরে, তা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই গোটা মহাভারতখানাই অশুদ্ধ হয়ে গেল একেবারে!

….মওকা বুঝে ব্যারিস্টার দাদাটিও সর্বদাই মায়ের কানে মন্ত্র জপছে। এমন অমানুষ জামাই আর হয় না। আসলে দাদুর কাছ থেকে পাওয়া মায়ের নামের অমন বাড়িখানা একলা গেলার মতলব তার। সর্বদাই মায়ের কানে ভাঙানি দিচ্ছে, বোনের নামে বাড়ির আদ্ধেক লিখে দিলে সেটা শেষ পর্যন্ত জামাইয়ের খপ্পরে গিয়ে পড়বে—বাড়িটাই তখন বেচে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। এমন সেয়ানা যে ঠিক জানে ডিভোর্সের ব্যাপারে বোন কান দেবে না—তাই মাকে বোঝায় এ বিয়ে ভেঙে দিয়ে বোনের নামে আদ্ধেক লিখে দিলে তার কোনো আপত্তি নেই।

—আজকের সমস্ত দিনটাই বড় খারাপ গেছে ভাই। পঞ্চম গেলাসে অসিতদার ধরা গলা।

কেন খারাপ গেছে তাও গলগল করে বলে গেল।…গত সন্ধ্যায় আপিস থেকে ফিরে মিলুকে বাড়িতে না দেখে বড় একলা লাগছিল। আর রাগও একটু হয়েছিল। তাই আড্ডায় চলে গেছল।

হাতে টাকা-কড়ি তেমন ছিল না। একেবারে শূন্য পকেটে জুয়ার আসরে গিয়ে বসে কি করে। ওদের আলমারির দুটো চাবি, একটা তার কাছে থাকে, অন্যটা মিলুর কাছে। সেই আলমারি খুলে মিলুর টাকার খাম থেকে মাত্র পঁচাত্তরটি টাকা তুলে নিয়ে সে বেরিয়ে গেছিল। আর রাতে বাড়ি ফিরতেও দেরি হয়ে গেছিল একটু।

ব্যস তাই নিয়ে সকালে যাচ্ছেতাই করল মিলু। এমন লোকের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়াই উচিত এ-কথা পর্যন্ত বলল। ফলে এই শর্মারও ভয়ানক রাগ হয়ে গেল। পাল্টা ঠেস দিয়ে সে-ও চারদিকের এই গণ্ডগোলের দিনে রাত পর্যন্ত ঘরে না ফেরার কৈফিয়ৎ চাইল। ব্যস, তারপরেই কথা বন্ধ। মিলুর এটাই এখন বড় দোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঝগড়ার সময় ঝগড়া করলেই ফুরিয়ে যায়। না, তার বদলে কথা বন্ধ করে বসে থাকে। স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে চায় সে অনেক সুশালীন মেয়ে, ঝগড়া করতে রুচিতে বাধে। তার ফলে অসিতদা যদি আরো বেশি রেগে যায় আর বকাঝকা করে, সেটা কি খুব দোষের? সে কি কম লেখাপড়া-জানা ভদ্রলোক?

আজ আপিসে গিয়ে অসিত চ্যাটার্জির মাথা ঠাণ্ডা হয়েছিল। খানিক আগে ছুটি নিয়ে মিলুর আপিসে চলে এসেছিল। আগেও এ-রকম আপোস করেছে। দুজনে একসঙ্গে সকাল-সকাল বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু আজ ওর আপিসে গিয়ে শুনল মিলু আসেইনি মোটে। ভাবল বাড়িতে পাবে। বাড়িতেও নেই। তাহলে আর বাপেরবাড়ি ছাড়া কোথায়? রাগ ধামাচাপা দিয়ে ওকে নিয়ে যাবার জন্য শ্বশুরবাড়িতে গেল। সেখানে তেলের কড়ার মাছ ছাড়ার মতো তপতপে গলায় শাশুড়ী জানালো, মেয়ে খানিক আগে অমানুষ জামাইয়ের ওখানেই চলে গেছে।

…শাশুড়ী আর সম্বন্ধী এমন ব্যবহার করল যেন হাড়িকাঠে গলা দিয়ে আছে সে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলটিমেটামই দিল তারা। বুঝেশুনে না চললে তাদের মেয়ে বা বোনও আর বেশিদিন বরদাস্ত করবে না। অসিতদাও তখন পাল্টা জবাবে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে, ছেলে সে-ও খুব সহজ নয়—বুঝেশুনে চলার দায় তাদের মেয়ে বা বোনেরও আছে। ব্যস, তাই শুনে শাশুড়ী আরও খাপ্পা…ওই খিঁচড়নো মেজাজ নিয়ে বেরিয়ে এসেই বাপীর সঙ্গে তার দেখা। তাই তক্ষুনি সন্দেহ হল নাগালের মধ্যে একজন আছে বলেই শাশুড়ী আর শ্যালকের কথায় কথায় আজকাল এমন শাসানি—আর মিষ্টিরও তুচ্ছ কারণে এত মেজাজ।

—এ রকম সন্দেহ হতে পারে কিনা তুমিই বলো ভাই। অনুশোচনায় গলা বুজে আসার দাখিল অসিত চ্যাটার্জির। —তুমি এতদিন ধরে কলকাতায় আছ আর এদের মতো স্বার্থপর লোক তা মোটে জানেই না ভাবব কি করে? ওই মা আর দাদাটির মতো প্যাঁচালো লোক নই আমি, তোমাকে দেখামাত্র সন্দেহ আমার হয়েছিল খোলাখুলি স্বীকার করেছি—ভুল স্বীকার করারও হিম্মত চাই, এরপর তোমার মনে আর কোনো দাগ থাকতে পারে, না রাগ থাকতে পারে তুমিই বলো—পারে?

মুখখানা সীরিয়াস করে বেশ ঘটা করে মাথা নাড়ল বাপী। পারে না। তারপর মুখেও বলল, সব শোনার পর এখন বরং তোমার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে—যে সে লোক তো নও যে এভাবে হেনস্থা করবে ওরা।

সহানুভূতির আঁচ পেয়ে আহত পুরুষকার মাথা তুলল।—তুমি হলে গিয়ে একটা সমঝদার দিলের মানুষ, তুমি বুঝবে না কেন। মদ-গেলা ফর্সা তেলতেলে মুখ রাগে লাল আরো।—ওদেরও বুঝতে হবে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে এই শর্মাই বুঝিয়ে ছাড়বে। আমাকে হেনস্থা করে কেউ পার পাবে ভেবেছে—সেই মেজাজ দেখলে ওদের মেয়েসুদ্ধ ভয়ে কাঁপবে—আমি কারো ধার ধারি, না, কারো পরোয়া করি?

নিরীহ মুখে বাপী বিক্রমের কথা শুনল, মাথা নেড়ে সায়ও দিল। কিন্তু আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা হচ্ছে বুঝলে জঙ্গলের পশু যেমন করে, এই প্রতাপও অনেকটা সেই গোছের লাগল বাপীর।

পঞ্চম দফা গেলাস খালি হতে বাপীই বলল, আর না, আমার ড্রাইভার নেই, তোমাকে একলা যেতে হবে।

আর দরকারও নেই। আশ মিটিয়ে খাওয়া হয়েছে। দাঁড়াতে গিয়ে এখনই দু—পায়ের ওপর তেমন ভর থাকছে না। আতিথ্যে পরিতুষ্ট অসিতদা এখন যেমন অন্তরঙ্গ তেমনি দরাজ। টেনে টেনে বলল, নিজের গাড়ি আছে, কি আর এমন রাত, তুমিও চলো না আমার সঙ্গে—মিলুও খুশি হবে নিশ্চয়, হাজার হোক ছেলেবেলার বন্ধু তো তোমরা।

এবারে লোকটাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘরে থেকে বার করে দিতে ইচ্ছে করল বাপীর। মাথা নেড়ে মোলায়েম সুরেই বলল, আজ না, আর একদিন হবে— বাড়িতে টেলিফোন আছে?

—না ভাই, আপিস থেকে শিগগিরই পাবার কথা আছে। আপিসে আমার টেবিলেই ফোন, সেই নম্বরটা রাখো। দুলে দুলে টেবিলের সামনে গিয়ে পকেট থেকে কলম বার করে খসখস করে ফোন নম্বর লিখে দিয়ে বলল, তোমার নম্বরটাও আমাকে দাও।

এতক্ষণ বাদে আর যেন এক মুহূর্তও বরদাস্ত করা যাচ্ছে না লোকটাকে। হাল্কা তাড়ার সুরে বলল, কাল-পরশুর মধ্যেই ফ্ল্যাটে চলে যাচ্ছি হয়তো, এখানকার নম্বর নিয়ে কি হবে। পরে বাড়ির নম্বর নিও’খন।

লিফটে নিচে নামালো। বাইরে এসে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিল।

একটু আগে অল্পস্বল্প বৃষ্টি হয়ে গেছে মনে হয়। ফুটপাথ আর রাস্তা ভেজা। ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। বাপী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। হাওয়াটা ভালো লাগছে।

হাওয়াটা না আর কিছু?…জীবনের এই বাঁকে একটা অনুকূল পটভূমি তার অগোচরে আপনা থেকেই প্রস্তুতির পথে কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *