সোনার হরিণ নেই – ২৬

ছাব্বিশ

ঊর্মিলা আবার দুপুরে আর রাতে অন্য দুজনের সঙ্গে খাবার টেবিলে এসে বসছে। সকাল বিকালের চায়ের টেবিলেও আসছে। একটা বড় রকমের অশান্তির মোকাবিলার সংকল্পে কঠিন হাতে বাৎসল্যের রাশ টেনে ধরে বসেছিল গায়ত্রী রাই। কিন্তু হঠাৎ কোনো জাদুমন্ত্রে মেয়ের সুমতি ফিরে এলো কিনা ঠাওর করতে পারছে না। তার আচরণ কৃত্রিম হলে মায়ের চোখে ধরা পড়তই। স্নায়ুর সব টানা—পোড়েন একেবারে ঠাণ্ডা, ভোরের জুঁইফুলের মতো কাঁচা আর তাজা মুখ। মেয়ের রাগ-বিরাগের চিহ্ন নেই। আবার মুখে কথাও নেই। বড়সড় কিছু কৌতুকের ব্যাপার ঘটে গেছে যেন। সেটা চোখে ঝিকমিক করে, ঠোঁটের ফাঁকে হাসির আঁচড় কাটে। গায়ত্রী রাই তখন ইচ্ছে করেই অন্য দিকে মুখ ফেরায়। কারণ মাকে ফাঁকি দিতে পারলে ওই ছেলের মুখখানাই যে মেয়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়, সেটা বুঝতে পারে।

বাপী সবই লক্ষ্য করে। মেয়ের থেকেও উল্টে ওরই আচরণ মহিলার কাছে বেশি দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে তাও আঁচ করতে পারে। সর্বদাই গম্ভীর। সেটা কৃত্রিম নয়। একটা অসহিষ্ণুতার বাষ্প চারিদিক থেকে ওকে ছেঁকে ধরেছে। মেয়ে উঠে গেলে প্রত্যাশিত সুখবর শোনার আশায় গায়ত্রী রাই ওর দিকে ফেরে। কাজের অছিলায় বাপী তক্ষুনি উঠে চলে যায়। কদিন ধরে কাজের ভূত মাথায় চেপেছে। কেবল কাজ আর কাজ।

চায়ের টেবিলে সেদিন জানান দিল, এখনই সে একবার পাহাড়ে যাচ্ছে।

গায়ত্রী রাই সাদা মনে জিজ্ঞেস করল, কেন?

—আপনি সবেতে মাথা দেন কেন, নিজে কি করে ভালো থাকবেন সে চেষ্টা করুন না।

ছেলের ধমক খেয়ে মা যেমন হাসি চেপে বেচারি মুখ করে চেয়ে থাকে, গায়ত্রী রাইয়ের চাউনিও অনেকটা সেই রকম হয়?

গম্ভীর মুখেই বাপী বলল, ক্লাবে মাল টান পড়েছে তাই যাওয়া দরকার।

একটু চুপ করে থেকে গায়ত্রী হঠাৎ বলল, এ কাজ বন্ধ করে দিলে কি

—কোন কাজ, লিকার সাপ্লাই?

—হ্যাঁ।

বাপী গম্ভীর।কি আর হবে, মোটা লোকসান হবে। আপনি মালিক, হুকুম করলেই বন্ধ হবে।

হালকা প্রতিবাদের সুরে গায়ত্রী রাই বলল, সাপ আর সাপের বিষ চালানোর কারবার বন্ধ করার সময় তুমি মালিকের হুকুমের অপেক্ষায় ছিলে? না সেই লোকসান গায়ে লেগে আছে?

রেশমার অঘটনের পরের বছর থেকেই ব্যবসার ওদিকটা বাপী জোর করে তুলে দিয়েছিল। সাপ ধরার মৌসুমে যারা আসে তারা বেজার হয়েছিল। সব থেকে বেশি বেজার হয়েছিল পাহাড়ের বাংলোর ঝগড়ু। সাপের গলা টিপে বিষ বার করা বন্ধ হলে তার আর কাজের আনন্দ কি? আবুর তত্ত্বাবধানে এই ব্যবসা জাঁকিয়ে উঠছিল তাই আপত্তি তারও ছিল। বাপী কারো কথায় কান দেয়নি। গায়ত্রী রাইকে বলেছিল, আপনার সব লোকসান উশুল হয়ে যাবে, যে কাজে লেগে আছি তার এখনো ঢের স্কোপ।

কথার খেলাপ হয়নি, এদিকের ব্যবসা এত বেড়েছে যে ওদিকের লোকসান চোখেও পড়েনি। কিন্তু কোন তাড়না বা যন্ত্রণার ফলে বাপী ওই মারাত্মক কারবার একেবারে তুলে দিয়েছে তা আজও ব্যক্ত করার নয়। একটু গুম হয়ে থেকে বাপী গম্ভীর শ্লেষের সুরে বলল, তাহলে শুদু মদ কেন, নেশার আর যা কিছু নিয়ে আছি আমরা সে সবও বন্ধ করে দিন। নেশা নেশাই।

ভেবেছিল জব্দ হবে। কিন্তু জবাবে যা শুনল, মেজাজ সুস্থির থাকলে বাপীর মন নরম হবার কথা। শ্লেষ গায়ে না মেখে মহিলা হাসল একটু।—এ চিন্তাও মাঝে মাঝে মনে আসে।…যত দিন নিজের রক্তের জোর ছিল, ভয়-ভাবনা কিছু ছিল না। সব দায় নিজের ভাবতাম। এখন তোমাদের এর মধ্যে জড়াতে অস্বস্তি হয়। অনেক হয়েছে, ও সবও এখন বন্ধ করে দিলে আমার আপত্তি হবে না। গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসল।—তোমার রাগের কি হল, এক্ষুণি তোমাকে কিছু করতে বলছি না। মনে হল তাই ভেবে দেখতে বলেছি। আজ পাহাড়ে যাচ্ছ যাও—

টেবিলের এ পাশ থেকে আলতো করে ঊর্মিলা বলল, আমিও যেতে পারি— চাপা গর্জনের সুরে বাপী তক্ষুণি বলল, না!

এই মেজাজ দেখে গায়ত্রী রাই সত্যি হকচকিয়ে গেল। আরো অবাক, যে মেয়ে কারো হম্বি-তম্বির ধার ধারে না, সেও চুপ। কিছু একটা ব্যাপার চলেছে দুজনের মধ্যে তাও বোঝা যাচ্ছে। একটু সময় নিয়ে গায়ত্রী রাই মোলায়েম করেই জিজ্ঞাসা করল, তুমি আজ ফিরছ না?

—বিকেলে ফিরব।

—তাহলে ও যেতে চাচ্ছে যাক না, রাগের কি আছে।

তেমনি চাপা ঝাঁঝে বাপী জবাব দিল, রাগ হয় স্বার্থপরতা দেখলে বুঝলেন?

আপনি নিজে ছাড়া আপনাকে দেখার আর কেউ কোথাও নেই, এ এখন থেকেই খুব ভালো করে জেনে রাখুন।

গায়ত্রী রাই হাঁ করে কয়েক পলক চেয়ে রইল তার দিকে। রাগের হেতু বোঝা গেছে। তার জন্যেই বাড়িতে কারো থাকার দরকার। আর সে খেয়াল না থাকার মানেই স্বার্থ। চোখের দু কোণ শিরশির করে উঠল। মেয়ের দিকে ফিরল। আগে হলে মেয়ে তেল-তেল বলে চেঁচিয়ে উঠে জব্দ করতে চেষ্টা করত। পুরুষের যে রাগ আর শাসন মেয়েরা চেষ্টা করলেও অশ্রদ্ধা করতে পারে না, নিজের মেয়েরও এখন সেই মুখ।

বাপী উঠে এলো। মহিলার নীরব প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারে বলেই ভেতরটা আরো তিক্তবিরক্ত। নিজের ঘরে এসে বেশ-বাস বদলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ভিতরের অসহিষ্ণুতা গাড়ীর বেগের সঙ্গে মিশছে। খানিকক্ষণের মধ্যে গাড়ি ভুটানের রাস্তায় ছুটল। আর তক্ষুনি রেশমার মুখখানা চোখে ভাসল। রেশমার হাসি-কৌতুক, ছলা-কলা…নিজের সত্তা-দগ্ধানো বন্য আক্রোশ। ও কি কোথাও থেকে বাপীকে দেখছে এখন?

রেশমার সঙ্গে সঙ্গে আর এক মেয়ের কথা মনে আসে কেন জানে না। অথচ স্বভাব-চরিত্রে দিন-রাতের তফাৎ দুজনের। মাস্টারমশাই ললিত ভড়ের মেয়ে কুমকুম।…এখানে এসে দেখা করার কথা ছিল। বাপী ওকে এই ভুটান এলাকায় রেখে রেশমা যা করত সেই কাজে লাগাবে ঠিক করেছিল। আট-দশদিন ছেড়ে দু সপ্তাহ গড়াতে চলল। আর আসবে মনে হয় না। এরপর এলে সোজা বিদায় করে দিতে অসুবিধে হবে না।

সন্ধ্যার একটু আগে ডাটাবাবুকে মাল বুঝিয়ে দিয়ে আবার গাড়িতে বসতেই আবু রব্বানী সামনে এসে দাঁড়াল।—কি ব্যাপার বাপীভাই, মিসিসায়েব যে আজ আমাকে খুব নাকাল করে দিয়ে গেল—তোমাদের মন-বোঝাবুঝি হয়ে গেছে নাকি?

নাকাল হয়েছে বলল বটে কিন্তু মুখে খুশি উপচে পড়ছে। বাপীর স্নায়ু তেতেই আছে। তবু ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

—ক্লাবের সামনে আগেও দু-তিন দিন তাকে দেখেছি তখন একটা কথা বলা দূরে থাক, চোখে আগুন ঠিকরতো—আজ খানিক আগে আমাকে দেখে হেসে কাছে এলো, বলল, তোমার ডিউটি এখনো চলছে, আমাকে ভেবাচাকা খেয়ে যেতে দেখে আরো মজা পেয়ে বলল, আর ডিউটির দরকার আছে কিনা তোমার দোস্তকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।…তুমি তো কিছুই বলোনি আমাকে, সত্যি আর দরকার নেই?

বাপী মাথা নাড়ল, দরকার নেই। তারপর স্টার্ট দিয়ে চোখের পলকে গাড়ি হাঁকিয়ে দিল।

পরের সাতটা দিন বাপী বাইরের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত যে আপিসে বসারও ফুরসৎ নেই। কাজ-কাজ করে হঠাৎ এত ক্ষেপে গেল কেন ছেলেটা গায়ত্রী রাই বুঝছে না। দুদিনের জন্য এর মধ্যে টুরে চলে গেল একবার। কোথায় কি এমন জরুরি কাজ কিছুই বলে গেল না। ফিরে আসার পরেও কিছু জিগ্যেস করার উপায় নেই। ডাক্তার সম্পূর্ণ বিশ্রামের হুকুম জারি করেছে। ফলে ব্যবসা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে যাওয়াটাও এই ছেলের বিবেচনায় দোষের এখন। এছাড়া আরো দুদিন সকালে বেরিয়ে রাতে ফিরেছে। অত ভোরে তাকে ডাকেনি। কোয়েলা বা মালিকে বলে গেছে ফিরতে রাত হবে, ওর জন্য যেন অপেক্ষা করা না হয়। মাথায় কিছু চাপলে তার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সুস্থির থাকতে পারে না এ বরাবরই লক্ষ্য করেছে। তবু এ-সময়ে কাজের ঝোঁক ভালো লাগছে না। তা বলে দুশ্চিন্তা কিছু নেই। মেয়েকে এত ঠাণ্ডা আর এমন নরম কখনো দেখেনি। সর্বদা কাজে কাজে থাকে, নিজের হাতে ওষুধপত্র দেয়। দুপুরে একটু ঘুমনো অভ্যেস হয়ে গেছে, তখনো ঘরেই বসে থাকে। ওকে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকতে বললে পলকা ঝাঁঝে জবাব দেয়, দরকার নেই বাপু, তোমার সেবায় পান থেকে চুন খসলে মাথা কাটতে আসবে।

গায়ত্রী রাইয়ের দু কান জুড়িয়ে যায়। মনের মতো ফয়সলা যে কিছু হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। মেয়ে কিছু বোনা বা একটা বইটই নিয়ে সামনে বসে থাকে। গায়ত্রী রাই থেকে-থেকে মুখখানা দেখে তার। ভাগ্য দেখে।

সেদিনও সকালে বেরিয়ে বাপী ফিরল প্রায় রাত আটটার পর। সামনের বাংলোর গেটের কাছে অন্ধকারে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থামালো। একজন নয়, সেখানে দাঁড়িয়ে তিনজন। মালি, আধবুড়ো ড্রাইভার বাদশা, আর আবু রব্বানী। জোরালো আলোয় বারান্দায় কোয়েলাকেও দেখল। কার গাড়ি বোঝামাত্র সে ভিতরে ছুটল।

গাড়ি থামিয়ে বাপী নিস্পন্দের মতো বসে রইল। চট করে নামতেও পারল না। সবার আগে আবু ছুটে এলো। চাপা উত্তেজনায় তার দু চোখ কপালে— সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে গেছে বাপীভাই, সকাল আটটায় চা-টা খাওয়ার পর মিসিসায়েব কখন বাংলো ছেড়ে বেরিয়েছে কেউ দেখেনি, এখন পর্যন্ত তার পাত্তা নেই!

বাপী বসেই আছে। পাথরের মতো নিষ্প্রাণ ঠাণ্ডা। উদ্বিগ্ন মুখে পরের সমাচার জানালো আবু। বেলা এগারোটা নাগাদ ওর কাছে খবর গেছে মিসিসাহেবকে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর থেকে বাদশা ড্রাইভারকে নিয়ে আবু তামাম বানারজুলি চষেছে। পাহাড়ের বাংলোয়ও গেছল। সেখানেও নেই। অ্যাকাউন্টেন্টকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে দিয়ে মেমসায়েব বাপীভাইয়ের খোঁজে এদিকের প্রায় সব কটা ঘাঁটিতে ফোন করিয়েছে। বিকেল থেকে মেমসায়েব খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, দাঁড়ানো থেকে পড়ে যাচ্ছিল, কোয়েলা ধরে ফেলতে রক্ষা। এখনো খুব ছট্‌পট করছে। কোয়েলা ডাক্তার ডাকার কথা বলতে এমন ধমক খেয়েছে যে ভরসা করে আর কেউ কিছু বলতেও পারছে না। মুখ বুজে তার কষ্ট দেখতে হচ্ছে। সক্কলে সেই থেকে বাপীভাইয়ের ফেরার অপেক্ষায় দম বন্ধ করে বসে আছে।

গায়ত্রী রাইয়ের বেশি রকম অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা কানে আসতে বাপীর সম্বিৎ ফিরল। ত্রস্তে গাড়ীর দরজা খুলে বাংলোর দিকে এগলো।

ঘরে সবুজ আলো জ্বলছে। গায়ত্রী রাই বিছানার পাশে ইজিচেয়ারে শুয়ে। সবুজ আলোর জন্য কিনা বলা যায় না, রক্তশূন্য মুখ নীলবর্ণ। সমস্ত দেহেও সাড়া নেই যেন। চাউনিতে অব্যক্ত যন্ত্রণা। যন্ত্রণা প্রতিটি শ্বাসেও।

তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বাপী তার পাশে মেঝেতেই বসে পড়ল। পালস দেখার জন্য একটা হাত ধরতেই এক ঝটকায় হাতটা টেনে নিল গায়ত্রী রাই। মুহূর্তের মধ্যে ঋজু সোজা কঠিন। চোখে সাদা আগুনের হল্কা।—আর কি দেখবে? আর কি দেখার আছে?

বাপী নিরুত্তর। থমথমে মুখ। চোখে চোখ

সব থেকে কাছের জনকে নাগালের মধ্যে পেয়ে এতক্ষণের জমা যন্ত্রণার সমস্ত আক্রোশ তারই ওপর ভেঙে পড়ল।—সমস্ত দিন কোথায় এত কাজ দেখাচ্ছিলে? কোথায় যাও না যাও বলে যেতেও মানে লাগে তোমার আজ—কাল——কেমন? ও আমার চোখে ধুলো দিতে পেরেছে তোমার জন্য—শুধু তোমার জন্য বুঝলে? ওকে বিশ্বাস করে এত নিশ্চিন্ত মনে তুমি কাজে ডুবে ছিলে কি করে? তোমার অপদার্থতার জন্য আমারও ভুল হয়েছে—

রাগে দুঃখে উত্তেজনায় কাঁপছে। সমস্ত মুখ আরো বিবর্ণ। বাপী আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে এগলো।

—স্টপ! গায়ত্রী রাই পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল।

বাপী ঘুরে দাঁড়াল।

—কোথায় যাচ্ছ?

—ঘরে। বাপীর অনুচ্চ গলার স্বরও কঠিন একটু।—আমাকে কাছে দেখলে নিজের এতটুকু ক্ষতি যদি আপনি করেন, তাহলে কোথায় যেতে পারি এরপর তাও ভারতে হবে।

গায়ত্রী রাইয়ের দু চোখে এখনো সাদা আগুন। আবারও ফেটে পড়ার মুখে সামলে নিল। সে শক্তিও আর নেই বোধ হয়। চেয়ারের গায়ে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল।

বাইরে এসে বাপী চাপা গলায় আবুকে বলল, বাদশাকে ডেকে গাড়ি নিয়ে চলে যাও, যেখান থেকে পারো চা-বাগানের ডাক্তারকে ধরে নিয়ে এসো।

ভিতরে শুধু কোয়েলা দাঁড়িয়ে। রাগে আর কান্নায় তার কালো মুখ ফেটে পড়ছে। বাপী আবার এসে ইজিচেয়ারের পাশে মেঝেতে বসল। এবারে হাত টেনে নিতে গায়ত্রী রাই বাধা দিল না। দু চোখ বোজা তেমনি।

পালস-এর গতি বাপীর ভালো ঠেকল না। বাপী এবার হাঁটুর ওপর বসে নিঃসঙ্কোচে নিজের একটা হাত তার বুকের ওপর রেখে একটু চাপ দিল। এবারে গায়ত্রী রাই আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো।

বুকের ধপধপ শব্দ হাতেও স্পষ্ট টের পাচ্ছে বাপী। হাত সরিয়ে নিল। মহিলা অপলক চেয়ে আছে তার দিকে। বাপীর মনে হল, হাতটা ওখানে থাকুক তাই যেন চাইছিল। একটা উদ্‌গত অনুভূতি চেপে বাপী কোয়েলার দিকে তাকালো।— দুপুরে কিছু খাওয়া হয় নি তো?

কোয়েলা মাথা নাড়ল। হয় নি।

—এক গেলাস গরম দুধ নিয়ে এসো।

সঙ্গে কয়েক চামচ ব্র্যান্ডি মেশালে ভালো হত বোধ হয়, কিন্তু ও জিনিসটা খাওয়ানো যাবে না জানে, তাই শুধু দুধই আনতে বলল। দুপুরের পরে একবার দুধ এনে কোয়েলা প্রচণ্ড ধমক খেয়েছে, দ্বিধান্বিত মুখে তাই কর্ত্রীর দিকে তাকালো। বাপীরও চাপা ধমক।—ওদিকে দেখছ কি, আমি তোমাকে দুধ আনতে বলেছি!

কোয়েল ত্রস্তে চলে গেল। এই ধমক খেয়ে রাগের বদলে স্বস্তি বরং।

পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে উষ্ণ দুধের গেলাস নিয়ে ফিরে এলো। হাত বাড়িয়ে বাপী ডিস থেকে গেলাসটা তুলে নিয়ে আবার দুই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসল। অন্য হাতটা মহিলার ঘাড়ের তলা দিয়ে গলিয়ে দিয়ে খানিকটা তুলে দুধের গেলাস মুখে ধরল।

একটুও আপত্তি না করে গায়ত্রী রাই দুধ খাচ্ছে, দু চোখ বাপীর মুখের ওপর। দুধের গেলাস কোয়েলাকে ফেরত দিয়ে বাপী জলের গেলাস নিল। দু ঢোক জল খাইয়ে সেই গেলাসও কোয়েলাকে দিয়ে বাপী পকেট থেকে রুমাল বার করে আলতো করে তার মুখ মুছিয়ে দিল।

গায়ত্রী রাইয়ের অপলক দু’চোখ তখনো বাপীর মুখের ওপর। তাই দেখে বুকের তলায় অদ্ভুত মোচড় পড়ছে বাপীর। চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। দু চোখ ভরে দেখতে ইচ্ছে করে। এই দেখার তৃষ্ণা কোন যুগ ধরে বুকের ভেতরেই কোথাও লুকিয়েছিল। সহজ হবার তাড়নায় আবার তাকে শুইয়ে দিয়ে বাপী হাসতে চেষ্টা করল। বলল, অত ভাবছেন কেন, যা হবার তাই হয়, দেখছেন না আমি কোথা থেকে উড়ে এসে কোন জায়গাটা জুড়ে বসেছি।

গায়ত্রী রাই কি জীবনে কখনো কেঁদেছে? বাপী জানে না। এখনো যেভাবে চেয়ে রইল কাঁদতে পারলে হয়তো হাল্কা হত। বাপী আবার বলল, মাথা ঠাণ্ডা রাখুন, মেয়ের খবর ঠিকই পাবেন…আর ভালো খবরই পাবেন

কানে যেতে আস্তে আস্তে নিজে থেকেই সোজা হয়ে বসল এবার। চাউনি বদলে গেল। সবুজ আলোয় নীলাভ তীক্ষ্ণ কঠিন মুখ। খবর পাব…! ভালো খবর পাব? তুমি এই সান্ত্বনা দিচ্ছ আমাকে? ও যা চায় তাই হতে দেবে তুমি? তাই যদি হয় নিষ্ঠুর বেইমান মেয়েকে আমি কোনদিন ক্ষমা করব ভেবেছ?

উত্তেজনা দেখে বাপী আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু কিছু করতে হল না বা বলতে হল না। আবু ডাক্তারকে সঙ্গে করে ঘরে ঢুকেছে। বিরক্তি চাপতে না পেরে গায়ত্রী রাই হাল ছেড়ে চেয়ারের গায়ে মাথা রাখল আবার।

আবু বুদ্ধিমান। মেয়ের সম্পর্কে ডাক্তারকে বলেই এনেছে নিশ্চয়। কারণ হঠাৎ এরকম হল কেন ডাক্তার একবারও জিজ্ঞাসা করল না। চুপচাপ পরীক্ষা শুরু করে দিল।

বাইরে এসে বাপীকে জানালো হার্টের অবস্থা আগের থেকেও বেশ খারাপ। আগামীকালের মধ্যে আর এক দফা বুকের যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দিল। শিলিগুড়ির বড় হার্ট-স্পেশালিস্টকে আবার নিয়ে আসার পরামর্শও দিল। এই রাতটার জন্য শুধু কড়া ঘুমের ওষুধ

টানা ঘুমে রাত কেটে গেল। খুব ভোরে চোখ তাকিয়ে গায়ত্রী রাই দেখে পাশের ইজিচেয়ারে বাপী শুয়ে। আস্তে আস্তে বসল। বাপীও সজাগ তক্ষুনি

—সমস্ত রাত তুমি এভাবেই কাটালে নাকি?

—খুব ভালো কাটালাম। এখন কেমন লাগছে?

জবাব না দিয়ে গায়ত্রী রাই চুপচাপ চেয়ে রইল একটু। ব্যথাটা নিজের মেয়ের থেকে এই ছেলের জন্য বেশি কিনা জানে না। বলল, ঘরে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও।

আড়মোড়া ভেঙে বাপী উঠে দাঁড়াল।—নাঃ, আমার এখন অনেক কাজ। কোয়েলা—!

সঙ্গে সঙ্গে কোয়েলা হাজির। বাপী হুকুম করল, আমার জন্য শুধু এক পেয়ালা চা আর ওঁর জন্য দুধ—খুব তাড়াতাড়ি।

কোয়েলা চলে গেলে বাপী এদিকে ফিরল।—আমি চট করে মুখ-হাত ধুয়ে আসছি, আপনিও যান। থাক, কোয়েলা আসুক।…চা খেয়ে আমি তিন-চার ঘণ্টার জন্য একবার বেরুবো, আপনাকে ততক্ষণ সব ভাবনা-চিন্তা ছেড়ে ঠাণ্ডা হয়ে থাকতে হবে।

এই ছেলেকে খুব সহজ আর নিশ্চিন্তই দেখছে গায়ত্রী রাই। আশায় উদ্‌গ্রীব হঠাৎ।—ওর খোঁজে যাবে? পাবে?

সকালের শিথিল স্নায়ুগুলোতে টান পড়ল আবার। গম্ভীর শাসনের সুরে বলল, খোঁজে গেলে না পাবার কোনো কারণ নেই। যাব কিনা সেটা আপনি কতটা সুস্থ থাকেন তার ওপর নির্ভর করছে। এখন আমি শিলিগুড়ি থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে আসতে যাচ্ছি। আপনাকে আমি আবার বলছি, আমাকে বিশ্বাস করুন, করে একটু নিশ্চিন্ত থাকতে চেষ্টা করুন।

বেরিয়ে এলো।

শিলিগুড়ির বড় ডাক্তারকে অনেক টাকা কবুল করে বাপী একটা রাত বানারজুলিতে ধরে রাখল। যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁর ছুটি। রিপোর্ট সব হাতে পেয়ে তিনিও তেমন কিছু আশ্বাস দিয়ে যেতে পারলেন না। হার্টের আরো ভাল্ব খারাপ হয়েছে। হঠাৎ কিছু ঘটেও যেতে পারে, আবার খুব সাবধানে থাকলে কিছুকাল চলেও যেতে পারে। চিকিৎসার সমস্ত ফিরিস্তি চা-বাগানের ডাক্তারকে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি।

গায়ত্রী রাইয়ের মনের জোরের খবর বাপীর, থেকে আর কে ভালো রাখে। কিন্তু এখন যে জোরটা দেখছে সে যেন প্রাণের দায়ে।…ও বলেছে, মেয়ের খোঁজে যাবে কিনা সেটা তার সুস্থ থাকার ওপর নির্ভর করছে। তাই সুস্থ থাকার প্রাণপণ চেষ্টা। বলেছে বিশ্বাস করতে, বিশ্বাস করে নিশ্চিন্ত থাকতে। দুর্যোগের আকাশে রামধনু দেখার মতো এই বিশ্বাসটুকুই আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা। এই ছেলে কখনো তাকে মিথ্যে ভোলাবে না।

একান্ত চেষ্টার ফলে সত্যি কাজ হল। চারদিনের মধ্যে অনেকটা সুস্থ। পালস আর ব্লাডপ্রেসার স্বাভাবিক। বাপী যতক্ষণ সামনে থাকে, মহিলা ভাব দেখায় যেন কিছুই হয় নি। দিন-রাতের তিন ভাগ সময় বাপী কাছেই থাকে। কত ভালো আছে বোঝানোর তাগিদে এজন্যেও আগের মতো চোখ রাঙানোর চেষ্টা।—কাজ কর্ম শিকেয় তুলে দিন-রাত এখানে পড়ে থাকলে চলবে?

কিন্তু ধৈর্যের শেষ আছে। সেদিন কাছে ডেকে বাপীর মুখ নিজের ঠাণ্ডা দু’ চোখের আওতায় বেঁধে নিয়ে বলল, বিশ্বাস করে তুমি আমাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছিলে, আমি চেষ্টা করেছি।…আজ ছ’দিন হয়ে গেল, আর কত যন্ত্রণার মধ্যে আমাকে রাখতে চাও?

বাপী চুপচাপ চেয়ে রইল খানিক। পাপপুণ্য মানে না—এই যন্ত্রণা দেখার নামই বোধ হয় পাপ। মুহূর্তে মন স্থির করে নিল। ভাগ্যের পাশায় একদিন যে দান পড়েছিল আজ সেটা যদি একেবারে উল্টে যায় তো যাক।

কোয়েলা!

বাপীর ডাক শুনে কোয়েলা তক্ষুণি দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। —ডলির ঘর থেকে তার বড় সুটকেসটা নিয়ে এসো।

গায়ত্রী রাই অবাক।—ওর সুটকেস কেন?

—বলছি।

কোয়েলা সুটকেস এনে দিতে বাপী সেটা বিছানায় গায়ত্রী রাইয়ের সামনে রাখল। পকেট থেকে একটা চাবি বার করে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল খুলুন—

—এ চাবি তুমি কোথায় পেলে?

—ডলির কাছ থেকে চেয়ে এনেছি। খুলুন ওটা

মেয়ে কিছু লিখে রেখে গেছে ধরে নিয়ে স্তব্ধ মুখে গায়ত্রী সুটকেসটা খুলল। তারপর বাপীর দিকে তাকালো।

—ওপরের জামাকাপড়গুলো সরিয়ে কটা চিঠি পান দেখুন।

বিমূঢ় মুখে গায়ত্রী রাই মেয়ের জামাকাপড়গুলো বিছানায় নামিয়ে আরো হতভম্ব সুটকেসের নীচে একগাদা খাম। কম করে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশটা হবে; সবগুলোতে লন্ডনের ছাপ।

নিজের অগোচরে গায়ত্রী রাই সেগুলো সব হাতে তুলে নিয়েছে। প্রায় দুর্বোধ্য বিস্ময়ে খামগুলো দেখছে।—এ সব বি. ব্যাপার?

—বিলেত থেকে লেখা বিজয়ের চিঠি। ডলিও এর থেকে কম চিঠি লেখেনি। আড়াই বছর ধরে দুজনে দু’জনকে চিঠি লিখে দিন গুনছিল…

গায়ত্রী রাইয়ের ফ্যাকাশে মুখ কঠিন হয়ে উঠছে।—তুমি এটা জানতে?

—ও-চিঠি আপনার চোখে বা হাতে না পড়ে সে-ব্যবস্থা আমাকেই করে দিতে হয়েছিল।

রাগ নয়, একটা অবিশ্বাস যেন যন্ত্রণার মতো ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে!—তুমি তাহলে আমার মেয়েকে কখনো ভালবাসনি….কখনো চাওনি?

—ভালো যখন বেসেছি তখন কোনো লোভ ছিল না। শেষে কোন অক্রোশে আপনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওকে পেতেও চেয়েছিলাম জানলে আপনিও আমাকে ঘৃণা করতেন। আমার চরিত্রের সেই কদর্য দিকটা ডলি দেখেছে।…কিন্তু এই বন্ধুর ওপর তার এত বিশ্বাস যে শেষে ও-ই আমাকে রক্ষা করেছে। রক্ষা আপনাকেও করেছে।…আত্মহত্যার জন্য ও তৈরি হয়ে বসেছিল।

গায়ত্রী রাই নির্বাক, স্তব্ধ

খুব শান্তমুখে বাপী আবার বলল, ডলি যাকে বেছে নিয়েছে সে একটা ছেলের মতো ছেলে এও আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, ড্রিংক একটু-আধটু করে, কিন্তু নিজের আক্রোশে আপনাকে ওর ওপর আরো বিরূপ করে তোলার জন্য আমি সেই কথা তুলেছিলাম, ড্রিংক করে অমানুষ হবার ছেলে সে নয়, আমি ড্রিংক না করলেও আমার থেকে অন্তত ঢের ভালো।

গায়ত্রী রাই শুনছে, সামনে যে বসে আছে তাকে দেখছে, হিসেব জানে, এখনো কিছু হিসেব মিলতে বাকি যেন। চাউনিও সন্দিগ্ধ একটু।—ডলি কোথায় এখন…কলকাতায়?

—শিলিগুড়িতে।

—শিলিগুড়িতে কোথায়?

—একটা হোটেলে।…বিজয় মেহেরার কাছে।

গলার স্বর অভিমানে অকরুণ কিনা বলা যায় না।———তাদের বিয়ে হয়ে গেছে তাহলে? না হবে বলে আগে থাকতেই একসঙ্গে আছে?

বাপী জানে নিজেরই চরম সংকটের মুহূর্ত এটা। তবু শান্ত। তবু ঠাণ্ডা — বিয়ে হয়ে গেছে। দু’দিন টুরে থাকার নাম করে কলকাতায় গিয়ে বিজয়কে এরোপ্লেনে নিয়ে এসে শিলিগুড়িতে রেখেছিলাম, টাকা খরচ করে পিছনের তারিখ দিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসে নোটিস দেওয়া হয়েছিল।…ছ’দিন আগের সেই সকালে ডলিকে আমিই নিজের গাড়িতে করে শিলিগুড়ি নিয়ে গেছি। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছি।

প্রথমে নিজের দুটো কানের ওপর অবিশ্বাস গায়ত্রী রাইয়ের, কিন্তু এই মুখ দেখেই বুঝছে অবিশ্বাস করারও কিছু নেই আর। সমস্ত সংযম ছিঁড়ে খুঁড়ে গলা দিয়ে আর্ত স্বর বেরিয়ে এলো। — তুমি! তুমি ওকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছ? এত…এত উপকার করেছ তুমি আমার? আবেগ সামলে নিতে বাপীরও সময় লাগল একটু। উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে।—উপকার সত্যি করেছি। এত ভালো কাজ জীবনে আর করেছি কিনা জানি না। এরপর আপনি যেমন খুশি শাস্তি দেবেন, তাও আমি আশীর্বাদ ধরে নেব।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। সোজা নিজের বাংলোয়। নিজের ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। অনেক দিনের টান-ধরা স্নায়ুগুলো সব একসঙ্গে শিথিল হয়েছে। অবসাদ সম্বল।

বাপী ঘুমিয়েই পড়ল।

.

কারো ডাক শুনে চোখ মেলে তাকিয়েছে। কোয়েলা। ঘরে আলো জ্বলছে। বাপী তাড়াতাড়ি উঠে বসে ঘড়ি দেখল। রাত ন’টা বাজে। কোয়েলা জানালো মালকান খেতে ডাকছে।

এই রাতেই আবার ওই একজনের সামনে বসে খাওয়ার দায় থেকে অব্যাহতি পেলে বেঁচে যেত। তার রোষ যদি মাথায় বজ্র হয়ে নেমে আসত, এর থেকে মুখ বুজে তাও সহ্য করা সহজ হত।

এত্তেলা পাবার পরেও বসে থাকতে দেখে কোয়েলা আবার জানান দিল, সে দুবার এসে ফিরে গেছে, সাহেব ঘুমুচ্ছে দেখে ডাকেনি—মালকান এবার ডেকে দিতে হুকুম করেছে।

—তুমি যাও, আসছি।

চোখে মুখে জল দিয়ে পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই এলো। কোয়েলা বলল, খাবার মালকানের ঘরে দেওয়া হয়েছে।

পায়ে পায়ে বাপী শোবার ঘরে ঢুকল। গায়ত্রী রাই পিছনে উঁচু বালিশে ঠেস দিয়ে বিছানায় বসে। বিষম সাদা মুখ। গালের পাশে চামড়ার নিচে একটা নীল শিরা উঁচিয়ে আছে। বাপী ঘরে ঢুকতে একটুও না নড়ে তার দিকে তাকালো। বাপীও।

সামনের ছোট টেবিলে একজনের খাবার দেওয়া হয়েছে।

—অসময়ে ঘুমুচ্ছিলে…শরীর খারাপ?

বাপী মাথা নাড়ল। শরীর ঠিক আছে। তবু গত পাঁচ-ছ’দিন যাবৎ স্নায়ুর ওপর দিয়ে কতটা ধকল গেছে মহিলা নিঃশব্দে আঁচ করে নিল বোধ হয়।—খেয়ে নাও।

এই মুখ সদয়ও নয়, নির্দয়ও নয়। গলার স্বরও নরম নয় বা কঠিন নয়। বাপী টেবিলের খাবারের দিকে তাকালো একবার, তারপর দাঁড়িয়েই রইল। একলা খেতে বসার দ্বিধা স্পষ্ট।

গায়ত্রী রাইয়ের চাউনি আরো ঠাণ্ডা। কথাও—আমি তোমার হুকুম এখনো মেনে চলেছি, ঘড়ি ধরে সময়মতো খেয়ে নিয়েছি। বোসো!

বাপীর চোখের কোণদুটো হঠাৎ শিরশির করে উঠল কেন জানে না। শাস্তির জন্য প্রস্তুত? কিন্তু সুচনা যা দেখছে সমস্ত সংযম খুইয়ে নিজেই ভেঙে না পড়ে! ছোট টেবিলের সামনে বসল। চুপচাপ খাওয়া শেষ করল।

গায়ত্রী রাইয়ের দু’চোখ তার মুখের ওপর স্থির সেই থেকে। এবারে জিজ্ঞাসা করল, তারা কলকাতায় চলে না গিয়ে শিলিগুড়িতে বসে আছে কেন?

বাপীর জবাবেও আর রাখা-ঢাকার চেষ্টা নেই। আপনি একবার ডাকবেন সেই আশায়।…নইলে বিজয়ের ছুটি নেই, ওর ফেরার তাড়া খুব।

গলা চড়াল না। কিন্তু কঠিন।—ডলির এত আশা করার কথা নয়।…এ-রকম আশাও তাহলে তুমিই দিয়েছ?

বাপী নিরুত্তর। এই অনুযোগের সবটাই প্রাপ্য নয়। খানিকটা হয়তো তার মেয়ের ঘাড়ে চাপানো যেত। শিলিগুড়ি থেকে বড় ডাক্তার আনার সময় ঊর্মিলা খবর জেনেছে। একবারটি এসে মা-কে দেখার জন্য তখন ঝোলাঝুলি করেছিল। সেই অবস্থায় মহিলার মানসিক প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবেই বাপী রাজি হয়নি। পরে অবস্থা বুঝে দুজনকেই নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে এসেছিল।

জবাবের অপেক্ষায় গায়ত্রী রাই চুপচাপ আবার খানিক চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে মাথাটা বালিশের ওপর রাখল। দু’ চোখ বোজা এখন। পাঁচ গজের মধ্যে বসেও বাপী শ্বাস-প্রশ্বাস ঠাওর করতে পারছে না। একটু বাদে তেমনি ঠাণ্ডা কটা কথা কানে এলো।—ঠিক আছে। কাল সকালের দিকে নিয়ে এসো। আর টাকা নিয়ে যেও। বিকেলের প্লেনে ওদের কলকাতার টিকিট বুক করে এসো।

বাপী তাই করেছে। বিকেলের প্লেনে দুটো কলকাতার টিকিটও কেটেছে। নির্দেশ অমান্য করার জোর আর নেই। টিকিটের কথা ঊর্মিলাকে বলেনি। আশা হাওয়া যদি হঠাৎ বদলায়। যাওয়া যদি ওদের না হয়। তাছাড়া, বিদায় করার জন্য একেবারে তৈরি হয়ে মেয়ে-জামাইকে ডেকে পাঠানো হয়েছে, এ বলেই বা কি করে।

মা যেতে বলেছে শুনে ঊর্মিলা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ফ্রেন্ডের মুখখানা ভালো করে দেখার পর হাওয়া মোটে সুবিধের মনে হয়নি। যে-ঝড়টা গেছে, শুকনো হাসির তলায় বাপীর সেটা চাপা দেবার চেষ্টা। খুঁটিয়ে কিছু জিগ্যেস করারও ফুরসৎ পেল না ঊর্মিলা। এসেই আধ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হওয়ার তাড়া লাগিয়েছে। তাছাড়া বিজয়ের সামনে খোলাখুলি জিগ্যেস করাও মুশকিল। এ-ছেলে মায়ের কতটুকু আর জানে। এমনিতেই ঘাবড়ে আছে। মা ডেকেছে শুনেও বাপীকে বলছিল, গিয়ে আবার ফ্যাসাদে পড়ব না তো, শুধু ডলিকে নিয়েই যাও না।

স্বাভাবিক ভ্রুকুটিতে তার ভয় বরবাদ করতে চেয়েছে ঊর্মিলা।—আ-হা, কি বীরপুরুষ! বলল বটে, কিন্তু নিজের ভিতরেই চাপা অস্বস্তি।

বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ বাপী ওদের নিয়ে বানারজুলির বাংলোয় পৌঁছল। গায়ত্রী রাই নিজের শয্যাতেই বসে আছে। দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় ওই বিছানায় উঁচু বালিশে ঠেস দিয়ে কাটে। শ্বাসকষ্টের রোগীর এ ভাবে বসতে সুবিধে। কিন্তু ইদানীং শ্বাসকষ্ট বেশি কি কম মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই।

মেয়ে জামাই ঘরে পা দেবার পর থেকে বাপী নির্বাক দ্রষ্টা, নীরব শ্রোতা। সামনে কয়েকটা চেয়ার পাতা। বাইরের অতিথি আসছে জেনে বাড়ির অসুস্থ কর্তা যেমন ঘরে চেয়ার পেতে রাখতে বলে, গায়ত্রী রাইয়ের অভ্যর্থনার আয়োজন ও সেই গোছের।

ঘরে পা দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়েই নিঃশব্দে আঁতকে উঠল ঊর্মিলা। বিজয় মেহেরা না পারুক, ক’দিনের মধ্যে তফাৎটা মেয়ে বুঝতে পারছে। মোমের মতো সাদা মুখ মায়ের। মুখে না হোক, দুই চোখেও যদি একটু উষ্ণ তাপের স্পর্শ পেত ঊর্মিলা, হয়তো ছুটে গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরত, কাঁদত।

কিন্তু ঐ বিষম সাদা মুখ তেমনি একটা নিষেধের গণ্ডীর মধ্যে আগলে রেখেছে নিজেকে। মেয়েকে একবার দেখল শুধু। তারপর জামাইয়ের দিকে তাকালো। ঊর্মিলা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।

ব্যক্তিত্বের এরকম অভিব্যক্তি হয়তো বিজয় মেহেরার কল্পনার মধ্যে ছিল না। প্রণামের উদ্দেশ্যে তাড়াতাড়ি পা ছোঁবার জন্য এগিয়ে এলো। কিন্তু দুটো পা-ই পাতলা চাদরের তলায়।

—থাক। আঙুলে তুলে গায়ত্রী রাই চেয়ার দেখালো—বোসো।

বিজয় মেহেরা বসে বাঁচল।

কিন্তু তার পরেও ওই দু’ চোখ মুখের ওপর অনড়। কথায় অনুযোগের লেশমাত্র নেই। কি আছে সেটা বাপী অনুভব করতে পারছে। ঊর্মিলাও পারছে।

—ক’দিন তোমরা আমার জন্য শিলিগুড়ির হোটেলে কাটালে শুনলাম। আমি জানতাম না, বাপী কাল রাতে বলল।…ছুটি-ছাটা না থাকায় তোমার অসুবিধের কথা ভেবে ওর খুব চিন্তা, তাই না বলে পারল না।

ফাঁপরে পড়া ভাবটা কাটিয়ে উঠে বিজয় মেহেরার সহজ হবার চেষ্টা। সায় দিয়ে বলল, নতুন জয়েন করেছি, তার ওপর কাজের এত চাপ…ছুটি বলে কিছু নেই এখন।

গায়ত্রী রাইয়ের সামান্য মাথা নাড়ার অর্থ, সমস্যাটা বুঝেছে। বলল, আর দেরি কোরো না, খাওয়া-দাওয়া সেরে বিকেলের প্লেনেই চলে যাও। বাপীর দিকে তাকালো।—ওদের প্লেনের টিকিট কাটা হয়েছে তো?

বাপী হাঁ-না কিছুই বলল না। ঊর্মিলার মুখ আরো ফ্যাকাশে। কিন্তু মেহেরা ছেলেটা সরলই। শাশুড়ির উদারতা দেখে তারও একটু উদার হবার ইচ্ছে। বলল, আপনার শরীর খুব খারাপ শুনলাম, ডলি না হয় এখন আপনার কাছেই থাক না— ঠাণ্ডা দু চোখ আবার তার মুখের ওপর—তোমার নিয়ে যেতে কোনো অসুবিধে আছে?

—না, না—আমি ভালো কোয়ার্টার্সই পেয়েছি…

—তাহলে নিয়ে যাও।…আমার চোখে ধুলো দিয়ে ডলি এখান থেকে চলে যাবার পর একে-একে ছটা দিন চলে গেছে। ওকে সাপে কেটেছে কি কোথাও কোন অঘটন ঘটেছে বা কি হয়েছে ছ-ছটা দিনের মধ্যে আমাকে কেউ কিছু বলেনি। তখন আমার শরীরের কথা কেউ ভাবেনি। যাক, তুমি নিশ্চিন্ত মনে ওকে নিয়ে চলে যাও। বাপী আছে…তার কর্তব্যজ্ঞান খুব

বাপী বারান্দায় চলে এলো। একটু বাদে ঊর্মিলাও এসে চুপচাপ সামনে বসল। অপরাধের একই বোঝা দুজনের বুকে চেপে আছে। নিজেদের মধ্যে ফয়সলা যখন হয়েই গেছল, সব ভয়-ভাবনা ছেঁটে দিয়ে একসঙ্গে দুজনে যদি এই একজনের কাছেই এসে ভেঙে পড়ত, কি হতে পারে না বা কি হবেই হবে খোলাখুলি সেই ঘোষণাই করত—তাহলে কি হত? রাগ করত, আঘাত পেত কিন্তু এই বিয়েই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে দিতে হত। আজ মনে হচ্ছে, ওরা তার দাপটই দেখেছে শুধু ভেতরটা দেখেনি।

দুপুরে খাওয়ার টেবিলেও একটা স্তব্ধতা থিতিয়ে থাকল। নতুন জামাইয়ের খাতিরেও বাপীর সহজ হবার চেষ্টা বিড়ম্বনা। গায়ত্রী রাই নিজের ঘরে। তার সময়ে খাওয়া সময়ে বিশ্রামের আজও ব্যতিক্রম ঘটল না। এদিকে তার নির্দেশেই কোয়েলার পরিপাটি ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি নেই। বিশেষ আয়োজনের ফলে লাঞ্চে বসতে অন্য দিনের তুলনায় দেরি হয়েছে।

খাওয়ার পরে বাপী বার দুই মহিলার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঊর্মিলাও।…শুয়ে আছে। সাড়া নেই। চোখ বোজা। এ বিশ্রামের অর্থ এত স্পষ্ট যে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতেও দ্বিধা।

মেয়ে জামাইয়ের যাবার সময় হবার খানিক আগে গায়ত্রী রাই উঁচু বালিশে ঠেস দিয়ে বসেছে আবার।

ওরা ঘরে এলো। পিছনে বাপী। সকলকে ছেড়ে গায়ত্রী রাই জামাইয়ের দিকে তাকালো।——যাচ্ছ?

বিজয় জানান দিল,—এখনো আধ ঘণ্টা মতো সময় আছে।

এয়ার অফিস পথ কম নয়…হাতে সময় নিয়ে রওনা হওয়াই ভালো। বাপীকে জিজ্ঞাসা করল, ওদের বাগডোগরা ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে, বাদশাকে বলে রেখেছ?

বাপী মাথা নাড়ল। বলা হয়েছে।

জামাইয়ের দিকেই ফিরল আবার।—তোমার সঙ্গে যেতে পারে এরকম একটু বড় ব্যাগট্যাগ কিছু নেই?

হেতু না বুঝেই সে তাড়াতাড়ি জবাব দিল, এয়ার ব্যাগ আছে—

—নিয়ে এসো।

—অত কিছুই না। আরো ঢের পাবে।

এবারেও কিছু না বুঝেই বিজয় হন্তদন্ত হয়ে পাশের ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে এলো।

গায়ত্রী রাই বালিশের তলা থেকে শক্ত সুতোয় বাঁধা বড় একটা খামে মোড়া প্যাকেট তার দিকে বাড়িয়ে দিল।—এটা সাবধানে ওর মধ্যে রাখো, আর ব্যাগ নিজের সঙ্গে রেখো।

ঊর্মিলা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিজয় ভেবে পেল না কি ব্যাপার। কি আছে এতে?

—আগে রাখো ঠিক করে।

বিমূঢ় মুখে তামিল করল। প্যাকেট ব্যাগে ঢোকালো।

গায়ত্রী রাই বলল, চল্লিশ হাজার টাকা আছে ওখানে।…যে তাড়াহুড়োর ব্যাপার করলে, কিছুই করা গেল না। তোমাদের যা পছন্দ ওই থেকে করে নিও।

বিজয় মেহেরা আঁতকেই উঠল।—অত টাকা কি হবে!

এবারে ঊর্মিলা ভেঙে পড়ল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মা, তুমি আমাদের টাকা দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছ।

এই প্রথম পরিপূর্ণ দু চোখ মেয়ের মুখের ওপর এঁটে বসতে লাগল। বাপীর মনে হল শুধু দেখবেই। জবাব দেবে না।

জবাব দিল। বলল, এখানে আমার কাছে পড়ে থাকার জন্য এমন দুড়দাড় করে বিয়েটা সেরে ফেলেছিস?

—না না। তুমি তাড়িয়েই দিচ্ছ! আমি ঠিক জানি তুমি আমাকে আর কক্ষনো ডাকবে না।

চেয়ে আছে। একটু পরে খুব স্বাভাবিক অনুশাসনের সুর। ছেলেটার সামনে কি পাগলামি করিস? চোখ মোছ! আমার শরীরের হাল দেখছিস না…আমি না পারলেও সময়মতো বাপী ঠিক ডাকবে। তখন দেরি না করে বিজয়কে নিয়ে চলে আসিস।

ঊর্মিলা তবু কাঁদছে। মা কি যে বলল, এই বিচ্ছেদের আবেগে তা মাথা পর্যন্ত পৌঁছুলো না বোধ হয়। বিজয় মেহেরারও না।

এক আর্ত ত্রাসে বাপীই শুধু নিস্পন্দ হঠাৎ।

সময় হয়েছে। বাপীর গাড়ি নিয়ে বাদশা প্রস্তুত। মায়ের পা ছুঁয়ে ওরা বেরিয়ে এলো। গাড়িতে উঠল। বাপী পাশে দাঁড়িয়ে। ঊর্মিলা চেয়ে আছে তার দিকে। আশা করছে এই রওনা হবার মুহূর্তে ফ্রেন্ড কিছু বলবে। আর কিছু না হোক, মায়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে বলবে। শিগগীরই আবার দেখা হবার কথা বলবে।

বাদশাও ঘাড় ফিরিয়ে হুকুমের প্রতীক্ষায় আছে। বাপী হুকুম করল, — চলো!

সামনের বাঁকের মুখে গাড়িটা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত ঊর্মিলা জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে এদিকে চেয়ে রইল। বাপীও। কিন্তু সে ওকে দেখছে না। গাড়িটাও না। মাথার মধ্যে চিনচিন করে জ্বলছে কিছু। কতগুলো কথার কাটা-ছেঁড়া চলেছে। গায়ত্রী রাই শেষে মেয়েকে যা বলেছে সেই কটা কথা। মেয়েকে বলেনি, ওকে শুনিয়েছে, ওকেই কিছু বোঝাতে চেয়েছে। বুকের ভেতরটা আচমকা দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যন্ত্রণাটা মগজের দিকে ধাওয়া করেছে। এখন সেটা চোখ বেয়ে নেমে আসতে চাইছে।

বাপী বাংলোয় উঠে এলো। সেখান থেকে আবার ঘরে। কোয়েলা তার মালকানের শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে। কিছু বলতে হল না। এই মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

দু’চোখ আরো বেশি করকর করছে বাপীর। চেয়ে আছে।

চেয়ে আছে গায়ত্রী রাইও। ভাবলেশশূন্য, নির্লিপ্ত।—বলবে কিছু?

—হ্যাঁ। আপনার মেয়ের শাস্তি দেখলাম। আমার কি শাস্তি?

জবাব দেবার তাড়া কিছু নেই যেন। একটু সময় নিয়ে ফিরে প্রশ্ন করল, মেয়ের কি শাস্তি দেখলে?

—ক্ষমার শাস্তি। আমি আপনার ক্ষমা চাই না।

মুখখানা যেন আরো একটু ভালো করে দেখে নেওয়ার কারণ ঘটল। অভিব্যক্তির রকমফের নেই, গলার স্বরে নির্লিপ্ত কৌতুকের ছোঁয়া লাগল একটু।—তুমি তো আমার গার্জেন এখন…এ-সবের অনেক ওপরে উঠে গেছ। পরের কথাগুলো ধার-ধার।—তাছাড়া এসব কথা ওঠে কেন, নিজের মুখেই তো বলেছ, যা করেছ জীবনে কারো এত উপকার খুব কম করেছ।

—হ্যাঁ, বলেছি। তাই করেছি। কিন্তু তার বদলে আপনি কি করেছেন? কি বলতে চায় গায়ত্রী রাই ঠাওর করে উঠতে পারল না। দেখছে।—আমি কি করেছি?

—আপনি মেয়েকে বলেছেন, সময়মতো বাপী ঠিক ডাকবে। সময়মতো বলতে কোন্ সময়? কিসের সময়? আর বলেছেন, তখন দেরি না করে চলে আসতে। তখন বলতে কখন?

দু’ চোখ রাগে জ্বলছে বাপীর। কিন্তু গত রাতের পর থেকে এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম গায়ত্রী রাইয়ের মুখের নির্লিপ্ত কঠিন পরদাটা সরেছে একটু একটু করে। কোমল প্রলেপ পড়ছে। পাতলা সাদা ঠোঁটের ফাঁকে রং ধরেছে। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের হাওয়াও লঘু করে দিতে চাইল। পলকা মোলায়েম সুরে বলল, আমার ডাক আসতে আর বেশি দেরি নেই, তোমার বুঝতে খুব অসুবিধে হচ্ছে?

আগে হলে বাপী এই কমনীয় মাধুৰ্যটুকু দু চোখ ভরে দেখত। কিন্তু এখন, বিশেষ করে এই কথা শোনার পর দ্বিগুণ ক্ষিপ্ত। বলে উঠল, ডাক আসুক না আসুক, আমাকে আক্কেল দেবার জন্য আপনি যে তৈরী হচ্ছেন সেটা বুঝতে একটুও অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু আমাকে অনেক চিনলেও আরো একটু চিনতে বাকি আপনার। নিজে সেধে ডাক শুনতে এগোলে তার আগে আমি আপনাকে নিজের মরা মুখ দেখিয়ে ছাড়ব। বানারজুলির জঙ্গলে তার সুযোগের অভাব কিছু নেই—

—বাপী!

বাতাস-চেরা তীক্ষ্ম চিৎকার শুনে ওদিক থেকে কোয়েলা ছুটে এলো। বাপীর ফুটন্ত মগজে হঠাৎ যেন বিপরীত হিমশীতল তরঙ্গ বয়ে গেল একটা। শয্যার দিকে একবার থমকে তাকিয়ে ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো।

.

এরপর থেকে বাপীর বাইরেটা অনেক ধীর অনেক শান্ত। নিভৃতে নিঃশব্দে এক ধরনের শক্তি সংগ্রহের চেষ্টা। যে শক্তি জীবনের অমোঘ বরাদ্দও বরবাদ করে দিতে পারে। সেই অদৃশ্য শক্তিটা ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে পেতে চায়। পাশের বাংলোর ওই রমণীর প্রাণসত্তায় সেটা আরোপ করে দিতে চায়।

পাশের বাংলোয় নয়। এখন ওই বাংলোতেই রাত কাটে তারও। পাশের ঘরে অর্থাৎ ঊর্মিলার ঘরে নিজের শোবার জায়গা করে নিয়েছে। এজন্যে কারো অনুমতির দরকার হয়নি। মাঝের দরজা খোলা। নিজের শয্যায় বসেই দেখতে বা লক্ষ্য রাখতে সুবিধে হয়। গায়ত্রী রাইয়ের ঘরে সবুজ আলো জ্বলে।

সেই ঘটনার পর থেকে তারও আচরণ বদলেছে। কোনো কিছুতে নিজের জোর খাটায় না। এক অবুঝ গোঁয়ার ছেলের হাতে নিজের সব দায় সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত। যা বলে, শোনে। যা করতে বলে, করে। তবু শরীর সারার নাম নেই দেখে বেচারী-মুখ করে বাপীর দিকে চেয়ে থাকে।

ঊর্মিলার যাবার সাত-আট দিনের মধ্যে পৌঁছানোর সংবাদ এসেছে বাপীর কাছে। ঊর্মিলার তখনো মন খারাপ, তখনো অভিমান। ছোট চিঠিতে মায়ের খবর জানতে চেয়েছে। নিজেদের কথা বিশেষ লেখেনি।

আর দশ দিন পরের চিঠি অবশ্য বড়। লিখেছে, কলকাতা একটুও ভালো লাগছে না। আর একজনের কেবল কাজ তার কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে ফুরসৎ নেই। আর লিখছে, মা-কে যে এত ভালবাসে আগে জানত না। এখন বুঝছে। সব সময় মায়ের কাছে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে। মা রাগ করুক আর যাই করুক, আর বেশিদিন মাকে না দেখে ও এভাবে থাকতে পারবে না। বিজয়কে রেখে একলাই দিনকতকের জন্য চলে আসবে।

বাপী এ চিঠিও তার মাকে পড়ে শোনালো।

—না। স্বর না চড়লেও সুর কঠিন।

বাপী জিজ্ঞাসা করল, কি না?

—লিখে দাও একলা আসতে হবে না। আমি ভালো আছি, আমার জন্য কোনো চিন্তা নেই।

এই শুনেও বাপীর রাগ।—আমি লিখে দিচ্ছি, আপনি একটুও ভালো নেই, যত তাড়াতাড়ি পারে চলে আসুক।

আসলে বাপীর বুকের তলায় সেই এক ত্রাস থিতিয়েই আছে। সেটা কতটা অহেতুক জানে না। একটা হিম-ছবি থেকে থেকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যে সময়ে তার মেয়েকে বাপীর ডাকতে হবে, সেই সময়ের ডাক শুনে দেরি না করে যখন মেয়েকে চলে আসতে হবে, সেই সময়ের। সম্ভাবনার এই ছবিটাই ছিঁড়েখুঁড়ে উপড়ে নির্মূল করে দিতে চায়। কিন্তু খুব ধীরে, প্রায় অগোচরের অমোঘ গতিতে এটা যেন এগিয়ে আসছে।

তাই আতঙ্কিত যেমন, আক্রোশও তেমনি

মফঃস্বলে বেরুনো ছেড়েই দিয়েছে। সব কাজ ফোনে বা চিঠিতে এখানকার জন্য একে একে আরো দুজন বাছাই করা সহকারী বহাল করেছে। তারা অনুগত, বাপী তরফদারকেই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা জানে তারা! তাছাড়া মাইনে আরো বাড়িয়ে আবু রব্বানীর ঘাড়েও অনেক বাড়তি দায় চাপিয়েছে। বাপীর কাজ বলতে বাংলোর আপিস ঘরে। খুব দরকার পড়লে বানারজুলির গোডাউনে অথবা পাহাড়ের বাংলোয় যেতে হয়। তাও কাজ শেষ হওয়া মাত্র ঝড়ের গতিতে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে আসে।

ঘরে এসে দাঁড়ালেই গায়ত্রী রাই খুব সহজ আর স্বাভাবিক মুখ করে তাকায় তার দিকে। বোঝাতে চায় ভালো আছে। কিন্তু ভালো যে কেমন আছে এক নজর তাকিয়েই বাপী সেটা বুঝতে পারে। অন্তত বিশ্বাস করে যে বুঝতে পারে। আরো রেগে যায়। যেন লুকোচুরি খেলা হচ্ছে ওর সঙ্গে।

সেদিনও বাইরে থেকে ফিরে মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে বলল, এখানকার ডাক্তারদের বিদ্যা-বুদ্ধি বোঝা গেছে। আর না, বাইরে যাবার জন্য তৈরি হোন।

মুখের দিকে চেয়ে মেজাজ আঁচ করেও গায়ত্রী রাই বলল, পাগলামি কোরো না। —আমি পাগলামি করছি? আর মুখ বুজে কষ্ট সহ্য করে আপনি খুব বুদ্ধির কাজ করছেন? তাহলে আমাকে আর কি দরকার, যেদিকে দু চোখ যায় চলে যাই? গায়ত্রী রাইয়ের সাদা-সাপটা জবাব, ভয় দেখাচ্ছ কি, পারলে যাও। চেয়ে আছে, সামাল দেবার জন্যেই আবার বলল, হার্টের এই অবস্থায় আকাশে ওড়া সম্ভব কিনা ডাক্তারকে জিগ্যেস করেছ?

বাপী তক্ষুণি চলে এলো। ফোনে শিলিগুড়ির ডাক্তারকে ধরল। ইদানীং প্রতি সপ্তাহে তাকে বানারজুলি এসে রোগিণী দেখে যেতে হচ্ছে। তার সঙ্গে কথা বলে রিসিভার আছড়ে বাপী মুখ কালো করে ঘরে ফিরে এলো।

গায়ত্রী রাই সাদা ভাবেই জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তার যেতে বলল?

চোখের ধার ওই ফ্যাকাশে সাদা মুখে বিঁধিয়ে দিতে চাইল বাপী।—না। খুশী?

শিলিগুড়ি থেকে দুজন অভিজ্ঞ নার্স নিয়ে এসেছে এরপর। পালা করে রাতদিনের ডিউটি তাদের। দরকার একেবারে ছিল না এমন নয়। বড় ডাক্তারের ব্যবস্থামতো মাঝে মাঝে অক্সিজেন চলছে এখন। অক্সিজেন দেওয়া মানেই ভয়ের কিছু নয় জানে। তবু এ জিনিসটাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না বাপী। গা শিরশির করে। সেই হিমেল ছবিটা, সামনে এগিয়ে আসতে চায়। কিন্তু অক্সিজেন দিলে রোগীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সহজ হয়, আরাম হয়। অসুবিধে হচ্ছে মনে হলে গায়ত্রী রাই নিজেই ওটা চেয়ে নেয়। দরকার ফুরোলে ছেড়েও দেয়। কিন্তু দরকারের মেয়াদ যে খুব একটু একটু করে বাড়ছে তাও বাপীর হিসেব এড়ায় না। তাই কারণে অকারণে অসহিষ্ণুতা। একজন ছেড়ে দুজন নার্স আসতে দেখে গায়ত্রী রাই বলল, এক কাজ করো, জঙ্গলের একটা হাতি-বাঁধা শেকল এনে আমাকে বাঁধো, তারপর নিশ্চিন্তে একটু কাজে-কর্মে মন দাও।

সঙ্গে সঙ্গে বাপীর মনে হয়েছে, বনের হাতি বনমায়াকে শেকলে বেঁধে রাখা যায়নি, সে খোলস ফেলে পালিয়েছে। ফলে এই ঠাট্টাতেও রাগ।—তাহলে ছেড়ে দিই এদের?

নার্সদের সামনে গায়ত্রী রাই না পারে হাসতে, না পারে বকতে।

দিনে রাতে ঘণ্টা কতক কাজ দেখাশুনা করতেই হয় বাপীকে। মহিলা ইদানীং সেই ফাঁকে কিছু লেখা-পড়া করে চলেছে টের পেল। তার মাথার কাছের টেবিলে কিছু সাদা কাগজ আর কলম দেখে বাপীর সন্দেহ হয়েছিল। আড়ালে নার্সদের জিজ্ঞাসা করে জানল। কোয়েলাও বলল। চার-পাঁচ দিন বাদে টেবিলে আর কাগজ কলম দেখা গেল না। বাপীর থমথমে মুখ।—আপনার উইল-টুইল করা সারা তাহলে? সাক্ষী-সাবুদ ডাকতে হবে?

কোয়েলা ঘরে। সামনে একজন নার্স বসে। গায়ত্রী রাইয়ের বিপাকে-পড়া মুখ।—উইল আবার কি? ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা লিখে রাখলাম তা ছাড়া—

অসহিষ্ণু ঝাঁঝে বাপী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, আপনার ইচ্ছে—অনিচ্ছেয় দুনিয়া চলছে ভাবেন? যা লিখেছেন ছিঁড়ে ফেলতে কতক্ষণ লাগে?

গায়ত্রী রাই গম্ভীর। ধমকের সুরে বলল, এবার ডাক্তার এলে আগে নিজের মাথাটা দেখিয়ে নিও।

ছায়া আগে চলে। বাপীর চিন্তায় সেটা অনেক আগে চলে। মন আগে থাকতে কিছু বলে দেয়। তেমনি অনাগত কিছুর সঙ্গে সারাক্ষণ যুঝছে এখন। সেটা নাকচ করে দেওয়ার আক্রোশ। অথচ আর কারো উতলা মুখ দেখলে রেগে যায়। অকারণে কোয়েলা ধমক খায়, নার্সদের বেশি যত্ন-আত্তিও সব সময় পছন্দ নয়, ঘণ্টাখানেকের জন্য সেদিন কি কাজে বেরিয়েছিল, ফিরে এসে দেখে আবু রব্বানী আর দুলারি এসেছে। মেমসাহেবকে দেখতে।

বাপী নীরস মন্তব্য করে বসল, ঘটা করে দেখতে আসার মতো কি হয়েছে—তোমাদের মেমসায়েবের তাতে খুব কিছু হয়েছে ভাবার সুবিধে।

আবু অপ্রস্তুত। দুলারিও। সাদামাটা গাম্ভীর্যে গায়ত্রী রাই আগের বারের মতোই মন্তব্য করল, বাপী ঠিকই বলেছে, ওকে বরং ভালো করে দেখে যাও।

একে একে কটা মাস কাটল। এই অনাগত দিনের পদক্ষেপ এখন আরো স্পষ্ট। দিনে রাতে অনেকবার করে অক্সিজেন দরকার হয়। এক এক দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে। শিলিগুড়ির বড় ডাক্তারের একজন সহকারীকে বানারজুলিতে নিজের ছোট বাংলোয় এনে বসিয়ে রেখেছে বাপী। তার ক্ষিপ্ততা আরো বেড়েছে, এক অদৃশ্য বিধানের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করছে। সাহস করে ঊর্মিলাকে আসতে বলবে কিনা জিজ্ঞাসাও করতে পারে না। ও এসে ভেঙে পড়লে বাপী তার সমস্ত জোর খোয়াবে।

মাঘের গোড়া এটা। হাড়-কাঁপানো শীত। বানারজুলির জঙ্গলে শুকনো কঠিন রিক্ততার ছাপ। তার কঠোর বৈরাগ্যের তপস্বিনী মূর্তির সঙ্গে শয্যায় শয়ান ওই শান্ত রমণীর নিষ্প্রভ মুখের কোথায় যেন মিল। এতটুকু চাঞ্চল্য নেই ক্ষোভ নেই। রোগীর অবস্থা হঠাৎই সংকটের দিকে মোড় নিল। এমন হবে ডাক্তার পর্যন্ত বুঝতে পারেনি। কিন্তু বাপী যেন স্পষ্ট জানত এই গোছের কিছু হবে।

রাত্রি। অক্সিজেন চলছে। ডাক্তার পাশে দাঁড়িয়ে। ঘন ঘন ইনজেকশন দিচ্ছে। ঘরে দুজন নার্স, কোয়েলা…। বাপীর ঘোরালো চোখ একে একে সকলের ওপর ঘুরছে।

গায়ত্রী রাই চোখ মেলে তাকালো। আশ্চর্য পরিষ্কার চাউনি

বাপী কাছে এসে দাঁড়াল। গায়ত্রী রাই কিছু বলল না। শুধু চেয়ে রইল।

বাপী বলল, টেলিগ্রাম করা হয়েছে। কাল সকালের মধ্যেই ওরা এসে পড়বে।

গায়ত্রী রাই আবার চোখ বুজল। যেন এটুকুই শুনতে চেয়েছিল।

বাপী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আপিস ঘরে এসে চুপচাপ বসে রইল।

রাত বাড়ছে। দেওয়াল ঘড়ি টুং টুং শব্দে সময় জানান দিচ্ছে। ওটুকু শব্দেও বাপী বিষম চমকে উঠেছে। ঘড়িটা আছড়ে ভাঙতে চাইছে।

তিনটে বাজল।

বাপী সোজা হয়ে দরজার দিকে তাকালো। কোয়েলা ছুটে এসেছে। — সাহেব! শিগগীর—শিগগীর!

আবার ছুটে চলে গেল।

বাপী উঠল। পায়ে পায়ে এঘরে এসে দাঁড়াল। সবুজ আলোর জায়গায় জোরালো বড় আলো জ্বলছে এখন। অক্সিজেনের নল সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নার্স দুজনের ছলছল চোখ। ডাক্তার নির্বাক দাঁড়িয়ে। কোয়েলা মুখে শাড়ি গুঁজে দিয়ে কাঁদছে।

বাপী শয্যা ঘেঁষে দাঁড়াল। বুকে হাত রাখল। আর কোনো সংশয় নেই। শান্ত। স্তব্ধ।

এখনো একটা চেষ্টা বাকি আছে বাপীর, যা অনেক— অনেক দিন গলা পর্যন্ত এসেও ফিরে ফিরে গেছে। এই শেষ একবার সেই চেষ্টা করবে?…এই বাতাস এই স্তব্ধতা খানখান করে দিয়ে গলা ফাটিয়ে একবার মা বলে ডেকে দেখবে? তাহলে কানে যাবে? তাহলে ফিরবে? চোখ মেলে তাকাবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *