সোনার হরিণ নেই – ২২

বাইশ

বাপীর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণ করে তিনরাতের মধ্যে রণজিৎ চালিহা বেত-খাওয়া কুকুরের মতো বানারজুলি থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বাপী যা বলে এসেছিল তারপর আর তার গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে দেখা করারও মুখ ছিল না বা সাহস ছিল না। পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবার খবরটা কানে আসতে গায়ত্রী রাই মুখে একটি কথাও বলেনি বা কোনো মন্তব্য করেনি। রাতে খাবার টেবিলে বসে কেবল টিপে-টিপে হেসেছে আর বাপীকে লক্ষ্য করেছে। দুষ্টু দামাল ছেলের কাণ্ড দেখা প্রসন্ন কমনীয় মিষ্টি-মিষ্টি হাসি।

তাই দেখে ঊর্মিলার হঠাৎ হি-হি হাসি। হাসির চোটে বিষম খেয়ে নাকের জলে চোখের জলে একাকার। গায়ত্রী রাই ওকে ধমকে থামাতে চেষ্টা করে শেষে নিজেই আবার হেসে ফেলল।—এত হাসির কি হল তোর?

জবাবে চোখেমুখে জল দেবার জন্য ঊর্মিলা বাথরুমের দিকে ছুটেছে। পরে একলা পেয়ে বাপীকে বলেছে, মা তোমাকে যেভাবে দেখছিল আর হাসছিল, তাইতে আমার সেই কথা মনে আসছিল।

—কি কথা?

চপল খুশিতে ঊর্মিলার রক্তবর্ণ মুখ তখনো।—তোমার বয়েস আর দশটা বছর বেশি হলে আর মায়ের দশ বছর কম হলে কি হত!

বাপী ওকে সতর্ক করার একটা বড় সুযোগ ফসকালো। বলতে পারত, বয়েসের ফারাক যে-দুজনের একটুও আপত্তিকর নয়, মা যদি তাদের মধ্যে কিছু ঘটাতে চায়, তাহলে কি হবে?

বলা গেল না। ওর মায়ের কোন উদ্দেশ্য পণ্ড করার জন্য এমন একটা ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে বসেছিল রণজিৎ চালিহা, এই মেয়ের মাথায় সেটা ঢোকেইনি। জানলে এই হাসিমুখ আমসি হয়ে যেত।

চালিহা উধাও হবার তিন-চার দিনের মধ্যে তার আসামের ঠিকানায় গায়ত্রী রাইয়ের সই-করা রেজিষ্ট্রি চিঠি গেছে। টাইপ করা সেই চিঠির কপি বাপী দেখেছে। অল্প কথায় ঠাণ্ডা বিদায়। রাই অ্যান্ড রাই-এর সমস্ত দায়িত্বভার থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হল। এই সংস্থার সঙ্গে আর তার কোনরকম সংস্রব থাকল না।

মহিলার পাকা কাজ। কাগজে কলমে চিফ একজিকিউটিভ এখন বাপী তরফদার—ভুটান সিকিম নেপাল বিহার মধ্যপ্রদেশ আর উত্তর বাংলার ছোট বড় সমস্ত ক্লায়েন্টের কাছে মহিলার স্বাক্ষরে রেজিষ্ট্রি ডাকে সেই ঘোষণাও তড়িঘড়ি পৌঁছে গেছে। আসামের মার্কেট হাতছাড়া হল বলে একটুও খেদ নেই তার। বিহার আর মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে এবার ওয়েস্ট বেঙ্গলের মার্কেটও যাচাই করে আসার পরামর্শ দিয়েছে বাপীকে। সব কটা প্রভিন্স-এর জন্য তার অধীনে দেখে শুনে একজন করে রিজিয়ন্যাল ম্যানেজার নেবার কথা বলেছে। ওকে সকলের ওপরে রেখে ব্যবসাটা এবার ঢেলে সাজাবার ইচ্ছে তার।

কিন্তু গায়ত্রী রাইয়ের মাথায় আরো কি আছে বাপীর কল্পনার মধ্যেও ছিল না। জানা গেল আরো আট-ন মাস বাদে। যে লোভে শুরু থেকে রণজিৎ চালিহার এত দিনের এত ছলা কলা কৌশল, না চাইতে বাপীর বরাতে ভাগ্যের সেই শিকেও ছিঁড়ল।

রাই অ্যান্ড রাইয়ের সমস্ত ব্যবসার চার আনার অংশীদার বাপী তরফদার।

ওকে নিয়েই মহিলা শিলিগুড়ির অ্যাটর্নি অফিসে হাজির একদিন। তখন পর্যন্ত বাপীর ধারণা নেই কি হতে যাচ্ছে। তাই বাধা দিয়ে বলেছিল, এই শরীরে এতটা পথ গাড়িতে যাওয়ার দরকার কি আপনার—কি করতে হবে আমাকে বলুন না?

অবাধ্য হলে এখনো আগের মতই মেজাজ দেখাতে চেষ্টা করে গায়ত্রী রাই। জবাব না দিয়ে গটগট করে গাড়িতে গিয়ে উঠেছে। অ্যাটর্নির সঙ্গে কথাবার্তার সময় ওকে ডাকা হল না দেখে ধরে নিয়েছে ব্যক্তিগত ব্যাপার কিছু। তার দিন—কতক বাদে গায়ত্রী রাই বাংলোর আপিস ঘরে এসে চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসল। সহজ সাদামাটা মুখ। হাতে অ্যাটর্নির তৈরি একটা খসড়া। বাপীর দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল, পড়ে দেখো তো—

সাধারণ কিছু ধরে নিয়েই বাপী চোখ বোলাতে শুরু করেছিল। তারপর চক্ষু স্থির। হকচকিয়ে গিয়ে খসড়াটা ফেলে তার দিকে তাকালো। মহিলার সাদা মুখ কমনীয় কৌতুকে ভরাট।

এ কি কাণ্ড! এ আপনি কি করছেন!

—কেন, তোমার আপত্তি আছে? হাসি-ছোঁয়া স্নেহ ঝরছে দু’চোখে। কিন্তু খুশির বদলে শুকনো মুখ দেখে অবাক একটু।

বাপী বলল, তা না, মানে কত ভাবে কত তো দিচ্ছেন—এক্ষুনি এর দরকার কি!

মুখের দিকে চুপচাপ খানিক চেয়ে থেকে মহিলা ওর অস্বস্তিটুকু লক্ষ্য করল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমার প্রাপ্য থেকে একটুও বেশি দেওয়া হয়নি বা হচ্ছে না। শরীরের যা হাল, আমার দিক থেকে কোনো কাজ ফেলে রাখার ইচ্ছে নেই।

বাপীর গলা শুকিয়ে কাঠ। চুপচাপ খসড়াটা তার দিকে ঠেলে দিল শুধু।

—ওটা অ্যাপ্রুভ করে পাঠালে দলিল হবে, আমি দেখেছি—ঠিকই আছে, তবু তুমি একবার দেখে নিতে পারো।

—আমি আর কি দেখব। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল, ডলি দেখেছে?

—ওর অত সময় আছে না ধৈর্য আছে? আমার মুখে শুনেছে। সব দিক সামলে যে ভাবে এখন তুমি ব্যবসার হাল ধরে আছ, ওর মতে চার-আনার থেকে বেশিই দেওয়া উচিত। ঠোটের ফাঁকে আবার একটু হাসির রেখা স্পষ্ট হতে দেখা গেল।—আমি আরও ঢের বেশি দেবার জন্য তৈরি হয়েই আছি, কিন্তু নেবার জন্য তৈরি হতে পারছ না কেন? চোখ-কান বুজে এভাবেই বা দিন কাটাচ্ছ কেন?

বাপীর কপাল ঘেমে উঠেছে। খসড়াটা হাতে করে মহিলা উঠে দাঁড়াতে প্রায় অনুনয়ের সুরে বলে উঠল, দলিল করার জন্য এক্ষুনি ওটা না পাঠালে ভালো হয়। এরকম বাধা আদৌ প্রত্যাশিত নয়। গায়ত্রী রাইয়ের দু-চোখ ওর মুখের ওপর স্থির খানিক।—কেন?

বাপী চুপ। কি বলবে? কি বলতে পারে?

কমনীয় মুখে কিছু সংশয়ের আঁচড় পড়তে থাকল। গলার স্বরও নীরস একটু।—মনে যা আছে খোলাখুলি বলো। দলিল করার জন্য এক্ষুনি এটা না পাঠালে ভালো হয় কেন?

দায়ে পড়ে বাপী সত্যি জবাবই দিতে চেষ্টা করল। বলল, আপনি যা ভেবে রেখেছেন শেষ পর্যন্ত তা যদি না হয়, আপনারই খারাপ লাগবে। আপনি আমাকে অনেক দিয়েছেন, দিচ্ছেনও—পার্টনার ইচ্ছে করলে পরেও করে নিতে পারবেন।

গায়ত্রী রাই ভিতর দেখছে ওর।—আমি যা ভেবে রেখেছি তার সঙ্গে তোমাকে চার-আনার পার্টনার করার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এ-কথা কেন, আমার মেয়েকে তোমার পছন্দ নয়?

বাপী আরো ফাঁপরে পড়ল। তাড়াতাড়ি জবাব দিল, ডলির মতো মেয়ে আমি কমই দেখেছি। কিন্তু বলার পরই মনে হল, এবারেও ভুল বুঝল মহিলা।

অনুচ্চ গলার স্বর প্রায় কঠিন।— আমার মেয়ের যদি শেষ পর্যন্ত তোমাকে বাতিল করার মতো দুর্বুদ্ধি হয়, তাহলে তোমাকে আমার চার আনা ছেড়ে আট—আনার পার্টনার করে নেবার কথা ভাবতে হবে। ডলি আপত্তি করেছে বা তোমার সঙ্গে কোনো কথা হয়েছে?

সত্যি অসহায় মূর্তি বাপীর। মাথা নাড়ল। ডলি আপত্তি করেনি বা কোনো কথা হয়নি।

এত চৌকস ছেলে এ ব্যাপারে সত্যি এত ভীরু কিনা দেখছে মহিলা। এবারে গলার স্বর সদয় একটু।—আমি যতদূর বুঝেছি ডলি তোমাকে পছন্দ করে। কিন্তু তুমি প্রায় দুটো বছর এভাবে কাটিয়ে দিলে কেন, আমি কি চাই বুঝতে তোমার বাকি ছিল?

দলিলের খসড়া হাতে চলে গেল। তার পরেও বাপী অনেকক্ষণ স্থাণুর মতো বসে।

ঊর্মিলার ইদানীংকালের বেপরোয়া মেলামেশা তার মা লক্ষ্য করেনি এমন হতে পারে না। ঝর্ণা পাথরের ওপর আছড়ে পড়ে, কিন্তু নদীর দিকে গতি তার। সেই আছাড়ি-বিছাড়ির মতো বাপীর ওপর মেয়ের অমন সহজ আর নিঃসংকোচ হামলা দেখেই তার পছন্দ সম্পর্কে মায়ের এমন ধারণা। রাগ হলে বা ঝগড়া বাধলে মেয়ে তার সামনেই বাপীর কাঁধ ধরে বা দু-হাতে মাথার চুলের মুঠো ধরে ঝাঁকায়। গায়ত্রী রাই মেয়েকে বকা-ঝকা করে আর মেয়ে পাল্টা মুখঝামটা দেয়, বেশ করব, আমার সঙ্গে লাগতে আসে কেন!

ঊর্মিলা এখন গাড়ি চালানোটা মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছে। অনায়াসে মায়ের অনুমতি আদায় করার ফলে বাপীই শিক্ষাগুরু। তার ওপর দিয়ে তখন আরো বেশি ধকল গেছে। শেখানোর সময় ঊর্মিলার হাতে স্টিয়ারিং, ব্রেক আর ক্লাচ স্বভাবতই বাপীর দখলে। ফলে স্টিয়ারিং-এর ওপর দখল আনতে হলে মেয়ের বাপীর গায়ের সঙ্গে লেপটে বসা ছাড়া উপায় কি? একটা পা, হাঁটু থেকে কোমরের একদিক, বুকের পাশের খানিকটা আর কাঁধের একদিকে বাপীর সঙ্গে এঁটে থাকবেই—কিন্তু মেয়ের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। শেখার উত্তেজনায় সমস্ত মন স্টিয়ারিংয়ের দিকে। প্রথম দিনের মহড়ার পরেই উল্টে বাপীর মাথা ঝিমঝিম করেছিল। ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলেছে, আমার দ্বারা হবে না—বিয়ের পরে নিজের লোককে ধরে শিখো।

অসুবিধেটা না বোঝার কথা নয় ঊর্মিলার। ওর শেখার তাড়া, কারণ বিজয় মেহেরা লিখেছে গাড়ি চালানো শিখে সে একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়িও কিনে ফেলেছে। অতএব ঊর্মিলাও তাকে অবাক করে দেবেই—ছেলে ফিরে এসে দেখবে ড্রাইভিং-এ ওরও পাকা হাত। বাপীর আপত্তির হেতু বুঝে হাসি চেপে চোখ পাকিয়েছে।—ধরেছি যখন না শিখে ছাড়ব না—তোমার বদলে তাহলে ওই আধবুড়ো বাদশাই মজা লুটবে।

পরদিন সকালে মায়ের সামনেই আবার হিড়হিড় করে গাড়িতে টেনে তুলেছে ওকে। তারপর তার চোখের আড়ালে গিয়ে ধমকেছে, মায়ের যখন আপত্তি হয়নি, তোমার অত সতীপনা কিসের মশাই? যার কাছে ড্রাইভিং শিখব, তার সঙ্গে জড়াজড়ি একটু হবেই মা জানে না? সঙ্গে সঙ্গে হাসি।—তুমি আমার ফ্রেন্ড আর আমি তোমার ফ্রেন্ড—ওই তকতকে নীল আকাশখানার মতো পরিষ্কার সম্পর্ক—শেখা হয়ে গেলে গুরুদক্ষিণা হিসেবে অনায়াসে একখানা চুমুও খেয়ে ফেলতে পারি।

এরপর বাপীর আর অব্যাহতি কোথায়। কিছুদিন বাদে মেয়ের হাত কিছুটা রপ্ত হতে বাপীই একটু সরে বসতে পেরে বেঁচেছে। কিন্তু এক সহজ বিশ্বাসে মেয়েটার এই বেপরোয়া মেলামেশা সত্যি যে আশ্চর্যরকম পরিষ্কার, তা অনুভব না করে পারেনি।

এভাবে আর খুব বেশি দিন কাটবে না জানত। জেনেও অসহায়। অনেক দিন থেকে মা আর মেয়ের বিপরীত প্রত্যাশা আর তাগিদ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ভাবসাব মেলামেশা দেখে গায়ত্রী রাই আশা করছে মেয়ের মনের জগৎ থেকে সেই অবাঞ্ছিত পাঞ্জাবী ছেলেটা মুছে গেছে। সে জায়গায় এই ছেলে জুড়ে বসেছে। কিন্তু আশাই করছিল শুধু, নিশ্চিত হতে পারছিল না। শরীর মোটে ভালো যাচ্ছে না। মুখ ফুটে স্বীকার না করলেও দিনকে দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে গেলে সব দিক থেকে নিশ্চিন্ত। কিন্তু দিন একে একে কেটেই যাচ্ছে, ওদের দুজনারই হাতে যেন অঢেল সময়। কারো তাড়া নেই দেখেই মহিলা মাঝে মাঝে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল, বাপী তাও টের পেত। অন্যদিকে মাকে সামলাবার বা বোঝাবার সব দায় ফ্রেন্ড-এর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে ঊর্মিলাও দিন গুনছে। কিন্তু মনের মানুষের ফেরার সময় এগিয়ে আসছে অথচ ফ্রেন্ড-এর তেমন মাথাব্যথা নেই। বিয়ের ব্যাপারে মায়ের দিক থেকেও স্পষ্ট কিছু তাগিদ নেই দেখেও ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি। যে ছেলে কাছে নেই, সে একেবারেই দূরে সরে গেছে ধরে নিয়ে নিশ্চিন্ত কিনা কে জানে! তাহলে তো চিত্তির। ঘুরেফিরে তাই বাপীর ওপরেই ক্ষোভ ঊর্মিলার। এতগুলো দিন কেটে গেল, এখনো কেন মাকে বোঝাতে পারল না—মায়ের মন ফেরাতে পারল না। এত পারে আর এটুকু পারে না? এদিকে তো মায়ের চোখের মণিটি হয়ে বসে আছে একেবারে!

বাইরের দিক থেকে দেখলে প্রতিটি দিন বাপীর অনুকূলে গড়িয়ে চলেছে সেটা মিথ্যে নয়। না চাইতে গায়ত্রী রাই তার দু-হাত ভরে দিচ্ছে। সম্মান আর প্রতিপত্তি বেড়েই চলেছে। চিফ একজিকিউটিভ হিসাবে মাসের মাইনে দ্বিগুণ। তবু ও-টাকা টাকাই নয়। যাতে হাত দেয় তাই সোনা, তাই টাকা। টাকাই এখন বাপীর পিছনে ধাওয়া করে চলেছে। মাইনের টাকা, কমিশনের টাকা, পার্টনারশিপের ভাগের টাকা। গায়ত্রী রাইয়ের চোখের মণি হয়ে ভাগ্যের বিপুল জোয়ারেই ভাসছে বটে বাপী তরফদার।

এরই মধ্যে যে আশঙ্কা দুঃস্বপ্নের মতো বাপীর বুকে চেপে বসে আছে ঊর্মিলা তার খবর রাখে না। পরের কটা মাসের মধ্যে গায়ত্রী রাই আর একটা কথাও বলেনি। কিন্তু মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় তার প্রতিটি দিন কিছু প্রতীক্ষার মধ্য দিয়ে কাটছে। ওর ওপর নির্ভর করে কখনো ঠকতে হয়নি বলেই এখনো স্থির বিশ্বাসে মহিলা সেই নির্ভরতার মর্যাদা দিয়ে চলেছে।

কিন্তু প্রতীক্ষারও শেষ আছেই।

এক সন্ধ্যায় ঊর্মিলা তার ঘরে হাজির। গনগনে মুখে সিঁদুরে মেঘ। এক ঝাপটায় বাপীর হাতের বই পাঁচহাত দূর মাটিতে ছিটকে পড়ল।

—সব তোমার জন্য বুঝলে? তুমি যতো নষ্টের গোড়া!

এরকম হামলা বা এই গোছের সম্ভাষণ নতুন কিছু নয়। শোয়া থেকে উঠে বসল।—কি ব্যাপার?

রাগের ফাটলে নাচার হাসির জেল্লা।—অমন চালাক মা বোকার মতো কি আশায় এতদিন ধরে এমন ভালোমানুষটি হয়ে ঠাণ্ডা মেরে আছে তুমি জানো?

বাপীর ভিতর নাড়াচাড়া পড়ল একপ্রস্থ—তুমি কি জেনেছ তাই বলো।

জবাব না দিয়ে ঊর্মিলা আবার জিগ্যেস করল, চিকিৎসার জন্য মাকে তুমি বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছ?

—হ্যাঁ, একজন স্পেশালিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম, তাঁর মতে নিয়ে যেতে পারলে ভালই হয়।…কেন?

—একটু আগে মা সেই কথা বলতে আমি তক্ষুনি সায় দিলাম। তার উত্তরে মা কি বলল জানো? বলল, আমার বিয়ের পরে যাবে। তারপরেই জিগ্যেস করল, তোদের বিয়েটা হচ্ছে কবে আগে আমাকে সোজাসুজি বল্।

বাপীর বুক দুরুদুরু। তারপর?

—আমি হাঁ। কার সঙ্গে বিয়ে? শুনে মা রেগেই গেল। পরে বুঝলাম তার ধারণা আমার প্রেমে তুমি হাবুডুবু খাচ্ছ একেবারে। ধমকে বলল, এমন ভালো একটা ছেলে, সেই কবে থেকে তোর মুখ চেয়ে বসে আছে আর তুই কেবল ধিঙ্গিপনা করে বেড়াচ্ছিস। ছেলেটাকে তোরও এত পছন্দ যখন মিছিমিছি দেরি করিস কেন—আমার শরীরের হাল দেখছিস না? বোঝো কাণ্ড, মা কিনা শেষে এই ভেবে বসে আছে! তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারি মায়ের এ ধারণা হল কি করে?

বাপীরও ওর মতো সহজ হবার চেষ্টা। উনি যাকে এত কাছে টেনে নিয়েছেন, তাকে তুমি এমন অমানুষ ভাবো তিনি জানবেন কি করে?

—ধ্যেৎ! তুমি একটা যাচ্ছেতাই। তুমি আমার ফ্রেন্ড। সেই হিসেবে তোমাকে আমি দারুণ ভালবাসি। মা সেটাই দেখেছে কিন্তু বোঝেনি।

—তুমি আজ বুঝিয়ে দিলে না কেন?

—হুঁঃ, ধড়ফড়ানির চোটে পালিয়ে বাঁচলাম। সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ চড়ল।— আমি বোঝাতে যাব কেন—দু’ বছর ধরে তুমি কি করলে? নাকি মায়ের মন বুঝে তলায় তলায় তাতেই সায় দেবার ইচ্ছে?

এবারে বাপী নির্লিপ্ত। গম্ভীরও।— নিজেকে নিয়ে বিভোর হয়ে না থাকলে মায়ের মন আমার থেকে তুমি ঢের আগেই বুঝতে পারতে।

ঊর্মিলার চোখে-মুখে সংশয়ের ছায়া।—তার মানে মা কি ভাবছে তুমি আগেই জানতে?

—তোমার মা ভাবাভাবির মধ্যে নেই। দু’ বছর ধরে তিনি নিজে যা চেয়েছেন তাই তোমাকে বলেছেন।

সোজা চেয়ে থেকে ঊর্মিলা সেই একই প্রশ্ন করল, তুমি তাহলে জানতে মা এই চায়?

—শুধু আমি কেন, অনেকে জানত। এত বড় একটা বিভ্রাটের পরেও তুমিই শুধু কিচ্ছু তলিয়ে দেখলে না বা ভাবলে না।

ঊর্মিলা এবারে বিমূঢ় খানিক। উতলাও।—কোন্ বিভ্রাটের পরেও আমি কিছু তলিয়ে দেখলাম না, ভাবলাম না? মা কি চায় সেটা তুমি ছাড়া আর কে জানত?

—রণজিৎ চালিহা জানত। রেশমা জানত। আবু রব্বানী জানত। তার বউ দুলারি জানত। তোমার মা এই চান জেনেই রণজিৎ চালিহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তোমার মায়ের কাছে তাই আমার এ-মুখ বরাবরকার মতো পুড়িয়ে দেবার জন্য টাকা ঢেলে রেশমাকে সে অমন কুৎসিত ষড়যন্ত্রের মধ্যে টেনে নামাতে চেয়েছিল। এখন বুঝতে পারছ?

ঊর্মিলা হতভম্ব। চোখে পলক পড়ছে না।—কিন্তু সকলে তো জানে আংকল ইজ্জত খেয়েছে বলে রেশমা অমন ভয়ংকর প্রায়শ্চিত্ত করে তাকে আক্কেল দিয়ে গেল!

ঠাণ্ডা মুখে বাপী জবাব দিল, অত সহজে ইজ্জত খোয়াবার মতো ঠুনকো মেয়ে নয় রেশমা। আমার ওপর আক্রোশে তার মাথার ঠিক ছিল না। সেই আক্রোশে চালিহার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তোমার মায়ের কাছে সেও আমার মুখ পুড়িয়েই দিতে চেয়েছিল। পরে অনুশোচনায় জ্বলেপুড়ে ঠাণ্ডা মাথায় ওই কাজ করেছে।

এক বছর পরে হলেও চোখের সামনে থেকে একটা হেঁয়ালির পর্দা সরেছে ঊর্মিলার। অস্ফুট বিস্ময়।—ওঃ! সেই জন্যেই সেই দিন নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে দুলারি তোমাকে ওই সব কথা বলেছিল!

বাপী নিরুত্তরে অন্যদিকে চেয়ে রইল।

পরের মুহূর্তে ঊর্মিলা আবার অসহিষ্ণু।—কিন্তু আমাকে তুমি কিচ্ছু বুঝতে দাওনি কেন? মায়ের মতলব জেনেও এতদিন তুমি চুপ করে ছিলে কেন?

—তাতে অশান্তি বাড়ত, মায়ের শরীর খারাপ হতো।

পায়ের নিচে থেকে নতুন করে আবার যেন মাটি সরছে ঊর্মিলার। অবুঝ ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল, অশান্তি কমবে? মায়ের শরীর ভালো হবে? সব জেনে-বুঝেও কেন তুমি এতদিন ধরে তাকে এমন একটা অসম্ভব ইচ্ছে আঁকড়ে ধরে থাকতে দিলে?

নিরুপায় বলেই সঙ্গে সঙ্গে বাপীও তেতেই উঠল।—তোমার কি ধারণা? কেন দিলাম?

মেয়েটা থতমত খেল একপ্রস্থ। অবিশ্বাসের এক আচমকা যন্ত্রণা ভিতর থেকে ঠেলে উঠেছিল ঠিকই। ধমক খেয়ে ঠাণ্ডা। কিছু হাল্কাও। কিন্তু গোঁ ছাড়ার মেয়ে নয়। সমান মেজাজে জবাব দিল, আমার ধারণা তুমি একটা ভীতুর ডিম—তুমি একটা ওয়ার্থলেস। বিপদ জেনেও উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছ, এদিকে তোমার ওপর নির্ভর করে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি।

নিস্পৃহ মুখে বাপী বলল, তোমার মা-ও এখন ঠিক এই কারণে আমার ওপর বিরক্ত, দু’বছর ধরে তিনিও আমার ওপর নির্ভর করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছেন। এজন্য অনুযোগও করেছেন—

ফ্রেন্ডকে অবিশ্বাস করে না, করতে চায় না। কিন্তু ফের একথা শোনার পর চোখে সংশয়ের ছায়া দুলছেই একটু। মায়ের জন্যেই এ-ছেলের বেশি দরদ, বেশি দুর্ভাবনা।

—মা কি বলেছে?

—বলেছেন ব্যবসার চার-আনার অংশ ছেড়ে তিনি আরো ঢের বেশি দেবার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছেন—আমি নেবার জন্য তৈরি হতে পারছি না কেন, সব জেনেও কেন চোখ-কান বুজে এভাবে দিন কাটাচ্ছি।

ঊর্মিলা চেয়ে আছে। এই লোকেরও ভিতর বোঝার দায় এখন। তাই নিজেকে সংযমে বাঁধাঁর চেষ্টা।—এতটা শোনার পরেও মাকে তুমি কিছু বললে না? কিছু আভাস দিলে না?

—দিয়েছিলাম। সেই জন্যেই পার্টনার হতে আপত্তি করেছিলাম। তাইতে তিনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, তাঁর মেয়ের যদি শেষ পর্যন্ত আমাকে বাতিল করার মতো দুর্বুদ্ধি হয়, তাহলে চার আনা ছেড়ে আট-আনার পার্টনার করে নেবার কথা ভাবতে হবে।

চেষ্টা করেও গলার স্বর খুব সংযত রাখা গেল না এবার।—আট-আনা ছেড়ে ষোলো-আনাই দিক না, কে তাকে ধরে রেখেছে?

বাপীর জবাবও এবারে প্রায় নির্মমগোছের ঠাণ্ডা।—তাও দিতে পারেন। শরীরের হাল তো ভালো নয়, তবে তাঁর ষোলো-আনাটা তোমাকে বাদ দিয়ে নয়। ঊর্মিলার ঝকঝকে দু-চোখ বাপীর মুখের ওপর নড়ে-চড়ে স্থির আবার। গলার স্বরে তপ্ত ব্যঙ্গ।—তাহলে?

—তাহলে ঘরে গিয়ে এবারে মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবোগে যাও। তোমার মা আমার কাছে কতখানি সেটা তোমার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে বলেই আমার সমস্যাটা দেখছ না—লোভের কলে পা দিলাম কিনা ভাবছ। তোমার মা হয়তো বেইমান নেমকহারাম ভাববেন আমাকে, তবু বরাবরকার মতো আমি এখান থেকে চলে গেলে তোমার সুবিধে হবে? নিশ্চিন্ত হতে পারবে?

ঊর্মিলা হকচকিয়ে গেল। গালে যেন ঠাস্ করে চড় পড়ল একটা। আর একই সঙ্গে ওকে যেন একটা দম-বন্ধ করা শূন্যতার গহ্বরে ঠেলে দেওয়া হল। …ও নেই, বাপী নেই—মা একা। এ-চিত্র আর ভাবাই যায় না। ফলে চিরাচরিত রাগত মুখ।—আমি তোমাকে তাই বলেছি?

—বলেছ। সব কথা মুখে বলার দরকার হয় না।—সমস্যা দুজনেরই এক এটুকু জেনে মাথা এখনই সব থেকে ঠাণ্ডা রাখা দরকার। বুঝলে?

পরের দিন-কতকের মধ্যে ঊর্মিলা মুখে আর কিছু বলল না বটে, কিন্তু মাথা যে খুব ঠাণ্ডা নেই, তাও স্পষ্ট। এতটা জানা আর বোঝার পরে ঘাবড়েছে বেশ। নিজের মা-টি কত শক্ত মেয়ে বিলক্ষণ জানে। কিন্তু বাপীকে তার থেকেও জোরালো ছেলে ধরে নিয়ে নিশ্চিন্ত ছিল। এখন ভয় মা-ই না উল্টে এই ছেলেকে ঘায়েল করে। তার মতি-গতি বদলে দেয়। দিলেও ওর নাগাল কেউ পাবে না বটে, কিন্তু এমন সংকটের মধ্যে কে পড়তে চায়। এই ছেলের প্রতি মায়ের এতটুকু টান দেখলে ভিতরে ভিতরে তেতে ওঠে এখন।

ওর মনের অবস্থাটা বাপী আঁচ করতে পারে।

কিন্তু বন্ধুকে আগের মতো মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেই চায় ঊর্মিলা। ভিতরে ভিতরে বিশ্বাস যে ভেঙেছে তাও নয়। তবু এরই মধ্যে সব সংশয় আর অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠার মতোই কিছু চোখে পড়ল ঊর্মিলার।

নাকের ডগায় চশমা এঁটে মা কি-সব দরকারী কাগজপত্র দেখছিল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বাপী তখনো খবরের কাগজ পড়ছিল। হঠাৎ এক জায়গায় বাপীর দু’চোখ আটকে গেল। ঊর্মিলা তারপর সেই আর একবারের মতোই স্থান-কাল ভুলে কাগজের খবরের ওপর ঝুঁকে পড়তে দেখল তাকে। চোখ দিয়ে পড়ছে না, মন দিয়ে স্নায়ু দিয়ে সত্তা দিয়ে পড়ার মতো কিছু খবর যেন কাগজে আছে।

ঊর্মিলা লক্ষ্য করছে। সেই একবার কলকাতায় প্লেগের খবর পড়ে যে-রকম বিবর্ণ মুখ দেখেছিল সে-রকম নয়। কিন্তু আত্মহারা মনোযোগটুকু সেই গোছের। খবরের কাগজ খুলেই এই ছেলে প্রথমে কলকাতার খবর খোঁজে, ঊর্মিলা তাও খেয়াল করেছে। ওর এখনো বদ্ধ ধারণা, ছেলেবেলার সঙ্গিনী এক মেয়ে তার মন জুড়ে আছে যার নাম মিষ্টি। সেবারে তো বলেই বসেছিল, কলকাতার প্লেগের খবর পড়ে মূর্ছা যেতে বসেছিলে কার ভাবনায় মশাই? আজও এই মুখ আর এই একাগ্র উন্মুখ মনোযোগ দেখেই ধরে নিল, সেই এক মেয়েকে মনে পড়ার মতো কাগজে খবর আছে কিছু।

নিঃশব্দে উঠে পিছনে এসে দাঁড়াল। ঠিক কোন্ খবরটার ওপর চোখ আটকে আছে ঠাওর করা গেল না। কিন্তু কোন্ জায়গাটা পড়ছে মোটামুটি আন্দাজ করা গেল।

একটু বাদে কাগজ রেখে বাপী আপিস ঘরে চলে এলো। নিজের তখনকার চেহারা আয়নায় দেখেনি। কিন্তু ঊর্মিলা দেখেছে।

দশ মিনিটের মধ্যে নবাব-নন্দিনীর মতো দু’হাত পিছনে করে ঊর্মিলা হাজির। গম্ভীর বটে, কিন্তু মুখ থেকে মেঘের পরদা সরে গেছে।

কলকাতার মিষ্টি নামে কোনো মেয়ে দু’বছর আগে বি-এ পাশ করেছিল? হকচকিয়ে গিয়ে বাপী ওর দিকে চেয়ে রইল।

ঊর্মিলা জবাব যেন পেয়েই গেছে। আবার প্রশ্ন।—এবার তাহলে তার এম—এ পাশ করার কথা?

বাপী বোকার মতোই জিজ্ঞাসা করল, তুমি জানলে কি করে?

—তোমার মুখ দেখে। পিছনের হাত সামনে এলো। হাতে ভাঁজ করা খবরের কাগজ। ওটা সামনে ধরল। কলকাতা য়ুনিভার্সিটির এম-এ পরীক্ষার ফল বেরুনোর খবরটার চার পাশে লাল দাগ। বলল, মুখে রক্ত তুলে এমন দিশেহারা

হয়ে পড়ার মতো আর কোনো খবর এ-জায়গায় দেখলাম না। তাই মনে হল, এটাই তোমার কাছে দুনিয়ার সেরা খবর।

ঊর্মিলা হাসছে। আগের মতো তাজা হাসি।

বাপী দেখছে। এই মেয়ে এখন নিজের আর ওর সমস্যাটা এক জেনে নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *