সোনার হরিণ নেই – ২১

একুশ

রাত দশটা। বানারজুলির অনেক রাত। অন্ধকার ঘরে শুয়ে বাপী এ-পাশ ও-পাশ করছে। রাজ্যের ক্লান্তি আর অবসাদ নিয়ে ঘরে ফিরেছিল। ঊর্মিলাকে বলে দিয়েছিল তাকে যেন রাতে খাওয়ার জন্য ডাকা না হয়। ঘরে গিয়েই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। তাই ইচ্ছে ছিল। ঘুমের ট্যাবলেট একটা খেয়েছে। একঘুমে সকাল হলে হয়তো দেখবে এই দুঃস্বপ্নের রাতটাই মিথ্যে। ঊর্মিলা বাধা দেয়নি বা জোর করেনি। সে-শক্তিও ছিল না। তার চোখেও আতঙ্ক। ঘরে গিয়ে হয়তো মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদবে। ওরা কেঁদে হাল্কা হতে পারে। বাপী পারে না।

কিন্তু ঘুম চোখের ত্রিসীমানায় নেই। চোখ বুজলেই সামনে বিভীষিকা। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো এক মেয়ের বুকের ওপরে শঙ্খচূড়ের ফণা। ওটা সরে যাবার পরে যা দেখেছে সে আরো ভয়ঙ্কর। বিষে বিষে ফর্সা অঙ্গ গাঢ় নীল কালিতে ছোপানো। চোখ বুজলেই সামনে সেই ত্রাস। অন্ধকার অসহ্য। উঠে আলো জ্বেলে দিয়েছে।

আলো দেখেই একটু আগে গায়ত্রী রাই এসেছিল। ঘরের দরজা দুটো খোলাই ছিল। মাথার ওপর বনবন পাখা ঘুরছে। কিন্তু জানলা দরজা বন্ধ করলে বাপী বুঝি দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। কেউ আসছে টের পেয়েই চোখ বুজে ফেলেছে। তা সত্ত্বেও আঁচ করেছে কে এলো। বাপী চোখ মেলে তাকায়নি। কেন তাকাবে? চোখে জল নেই। বুকে মুখ গোঁজার মতোও কেউ নেই।

গায়ত্রী রাই আধ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে ওকে দেখেছিল হয়তো। তারপর ঘরের আলো নিভিয়ে নিঃশব্দে দরজা দুটো ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেছে।

মেয়ের মুখে যা শোনার শুনেছে। যা বোঝার বুঝেছে। ঊর্মিলার কাছেই বরং অনেক কিছু দুর্বোধ্য এখনো। কিন্তু তার মা সব শোনা মাত্র বুঝবে। বাপীকে রেশমা ভরাডুবি থেকে একেবারে নিরাপদ ডাঙায় তুলে দিয়ে শুধু নিজের ওপর চরম শোধ নিয়ে গেল।

….দুলারিকে নাকি রেশমা এই দুপুরেই হেসে হেসে বলেছিল, ও অনেক দোষ করেছে, ওর গুনাহর শেষ নেই। তাহলেও বাপীভাই কখনো ওর দোষ ধরবে না, ওকে মাপ করে দেবেই। কারণ সব দোষ আর সব পাপের যুগ্যি প্রায়শ্চিত্ত ও করবে। তখন আর বাপীভাইয়ের কক্ষনো ওর ওপর রাগ থাকতে পারে না। বাপীভাইয়ের মতো এমন মুরুববী আর হয় নাকি। এই মুরুব্বী মাফ করে দিলে যত দোষ আর যত পাপই করুক নরকের বদলে সরাসরি হয়তো বেহেস্তে গিয়েই হাজির হবে।

এই পাজী মেয়েকে হাড়ে হাড়ে চেনে দুলারি। ওর থেকে ভালো আর কেউ চেনে না। সব শোনার পরে শেষ মুহূর্তে সুমতি হয়েছে বুঝেও হাড়পিত্তি জ্বলছে দুলারির! কিন্তু ওকে চিনতে যে এত বাকি সে কি তখনো বুঝেছিল!

….হারমা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে তার বাপ ধামন ওঝাকে ধরে নিয়ে আসতে দুলারির সেই কঠিন দু’চোখ আবার বাপীর মুখের ওপর উঠে এসেছিল।—কি হবে?

বাপী মাথা নেড়েছে। কিছু হবে না। যা হবার হয়ে গেছে।

দুলারি ডেকেছিল, এসো। তুমিও এসো মেমদিদি।

জঙ্গলের পথ ধরে দুলারি আগে আগে নিজের ঘরের দিকে এগিয়েছে। পিছনে বাপী আর ঊর্মিলা। বাপীর মনে হচ্ছিল কেউ তার গলায় একটা অদৃশ্য দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে চলেছে। না গিয়ে উপায় নেই, তাই চলেছে। ঊর্মিলা তার একটা হাত চেপে ধরে ছিল। ও তখনো বিমূঢ়, ভয়ার্ত।

…দুলারি ঊর্মিলাকে সুদ্ধ ডাকল কেন? ওর সামনেই চরম কিছুর ফয়সালা করে নিতে চায়? কোনো অভিযোগের বোঝা চাপিয়ে ওকে কিছু বুঝিয়ে দিতে চায়? যে আগুন দুলারির চোখে দেখেছে, সেই আগুনে এবার বাপীর মুখ ঝলসে দিতে চায়?

ঘরে ঢুকে দুলারি ছেলে দুটোকে বাইরে বার করে দিয়েছে। তারপর ঊর্মিলাকে বলেছে, বোসো।

ওরা দাঁড়িয়েই ছিল।

আঁচলে বাঁধা একটা পুঁটলির মতো কোমর থেকে টেনে বার করল দুলারি। গিঁট খুলে মোটা সুতোয় জড়ানো কাগজের পুঁটলিটা বাড়িয়ে দিল বাপীর দিকে।— এটা তোমার কাছে রাখো এখন।

বাপীর মুখে কথা সরলো এতক্ষণে।—কি এতে?

—আমার জানার কথা নয়। ওর ডেরা থেকে ঘরে ফিরে খুলে দেখছিলাম। দু’হাজার টাকা।

বাপী আরো হতভম্ব।—এ কিসের টাকা?

—তোমাকে যমের মুখে ঠেলে দেবার জন্য এই টাকা চালিহা ওকে ঘুষ দিয়েছিল।

বিস্ময়ে হতবাক দু’জনেই। ঊর্মিলার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়নি। সে চৌকিতে বসে পড়েছিল।

দুলারি আবার বলেছে, এটা রেশমা তোমার হাতে দিতে বলেছিল। মেমসায়েবকে সব বলে তার আপত্তি না হলে এ-টাকা তুমি হারমাকে দিয়ে দেবে। রেশমা তাই বলে গেছে।

.

বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠল বাপীর। নিজের ঘরের অন্ধকার শয্যায় উঠে বসল।…একটি একটি করে দুলারি এরপর যা বলে গেছে ঊর্মিলাও শুনেছে। আংকল চালিহা একটা নোংরা ষড়যন্ত্রের জালে আটকে বাপীর বিরুদ্ধে তার মা—কে বিষিয়ে দিতে চেয়েছিল—ঊর্মিলা শুধু এটুকুই বুঝেছে। এর বাইরে আর বেশি কিছু ওর কাছে স্পষ্ট নয় এখনো। কিন্তু ওর মা সব শোনামাত্র রণজিৎ চালিহার উদ্দেশ্য আরো ঢের বেশি বুঝবে বাপীর তাতে একটুও সন্দেহ নেই। গায়ত্রী রাই হয়তো এর পর ওকে আরো বেশি কাছে টেনে নেবে, আর চালিহার সঙ্গেও চূড়ান্ত বোঝাপড়া কিছু করবে। কিন্তু সব শোনার পর থেকে হাড়-পাঁজরগুলো আরো বেশি দুমড়ে মুচড়ে ভাঙছে বাপীর। ভেঙেই চলেছে।

….শেষ মুহূর্তে রণজিৎ চালিহার বদলে পাহাড়ে এবার বাপী তরফদার যাবে সেটা গায়ত্রী রাই বা ঊর্মিলা জানত না, আবু বা দুলারি জানত না, বাপী নিজেও জানত না। জানত শুধু চালিহা আর রেশমা। ম্যানেজারের হঠাৎ এমন দরাজ ভালো মানুষ হবার কারণটা রেশমা আগে বোঝেনি। তার নিজের লোভটাই আসল ভেবেছিল। কিন্তু পরে বুঝেছে। নিজের লোভ ছেড়ে এখন বাপীভাইকে লোভের ফাঁদে ফেলতে চায়। ফাঁকমতো অর্জুনকে দিয়ে কদিন সকালে ওকে ডেকে পাঠিয়েছে। ক্লাবের ডাটাবাবুর কাছে বোতলের বাক্সটা চালান দেওয়ার জন্য বা কাছাকাছির মধ্যে কোনো খদ্দেরের জিম্মায় নেশার প্যাকেট পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য রেশমাকে পঁচিশ-তিরিশ টাকা করেও বখশিস দিয়েছে। এ-ভাবে কাঁচা টাকা হাতে পেলে রেশমা ছাড়ার মেয়ে নয়, দিব্বি নিয়েছেও। কিন্তু গোড়া থেকেই তার মতলব সম্পর্কে রেশমা হুঁশিয়ার ছিল। বাপীভাইয়ের বুকে সে কোন্ কলঙ্কের ছুরি বসাতে চায় সেটা বোঝার পর তাজ্জব বনেছে। আবার মজাও পেয়েছে।

রেশমার সঙ্গে খাতির বাড়ার পর টোপ ফেলেছে রণজিৎ চালিহা। প্রথমে কেবল বাপী তরফদারের প্রশংসা। সে আছে বলেই রাতারাতি রেশমার এত আয়পয়। নইলে ও যে এত গুণের মেয়ে সেটা আগে কে বুঝেছিল? মালকানও বোঝে নি, ম্যানেজার নিজেও না। তারপর বলেছে, শুধু এই একজনের যদি মন বুঝে চলিস আর তাকে খুশি রাখতে পারিস, তাহলে আর দেখতে হবে না। কালেদিনে এর দশগুণ বরাত ফিরে যাবে।

মতলব বোঝা গেছে। কাঁচা টাকা হাতে আসছে, রেশমা পরামর্শটা একেবারে বরবাদ করে দিতে পারে না। চালিহার সামনে খুশি যেমন দুর্ভাবনাও তেমনি।…খোদ ম্যানেজার সাহেব যখন বলছে তখন আর ভাবনা কি। তার সাধ্যমতো চেষ্টা করবে। কিন্তু ওই তরফদার সাহেবের মেজাজের হদিসও যে পায় না কখনো, মন বুঝবে কি করে? কাছে গেলে দশ হাত দূর দিয়ে চলে যায়। আর এমন করে তাকায় যে ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করে। আগে কত সহজে মেলা-মেশা করত ওদের সঙ্গে, এত বড় মুরুব্বী হয়ে বসার পর অন্য রকম হয়ে গেছে।

চালিহা সাহস যুগিয়েছে। হেসে হেসে বলেছে, তুই একটা আস্ত বোকা। ওটা বাইরের চাল। কোথা থেকে কোথায় টেনে তুলল দেখেও মন বুঝতে অসুবিধে! যা বললাম শোন, চেষ্টা-চরিত্র করে লেগে থাক ওর সঙ্গে, হিল্লে হয়ে যাবে।

এই লেগে থাকার তাগিদটাই দিনে দিনে বেড়েছে। বখশিসের অঙ্কও। রেশমার টাকার লোভ দেখেই মুখোস খুলে শেষে মতলব ফাঁস করেছে। ওই বাপী তরফদারের মুখ লালসার আগুনে পুড়িয়ে দিতে হবে। একটা রাতের জন্যও যদি রেশমা তা পারে, চালিহা ওকে নগদ দু’হাজার টাকা দেবে। আর তার পরেও বরাত ফেরানোর জন্য ওই বাপী তরফদারের মুখ চেয়ে থাকতে হবে না কোনোদিন। ওর রানীর হালে থাকার ব্যবস্থা চালিহাই করে দেবে।

ওই শয়তানের মতলব এবার আবু সাহেব আর দুলারির কাছে ফাঁস করে দেবার কথা ভেবেছিল রেশমা। বাপীভাইয়ের মুখ কার কাছে পোড়াতে চায় রেশমা তাও জানে। মালকানের কাছে। কিন্তু যেমন বেপরোয়া তেমনি নিজের ওপর বিশ্বাস ওর। ও জানে বাপীভাইয়ের কক্ষনো কোনো ক্ষতি হবে না বা হতে পারে না। মজা কতটা গড়ায় দেখা যাক না। ফাঁকতালে নগদ আরো কিছু হাতে এলেই বা মন্দ কি, সানন্দে রাজি হয়ে দু’ হাজার টাকার বদলে দু’শ টাকা আগাম চেয়েছে। খুব দরকার। চালিহা তক্ষুনি দিয়ে দিয়েছে। আর বলেছে, এটা আগাম ফাউ। বাপী তরফদার ঘায়েল হলে ফের দু’হাজারই দেবে।

খোশ মেজাজে কড়কড়ে দু’শ টাকা নিয়ে ঘরে ফিরেছে। `ম্যানেজার শেষ পর্যন্ত ওর কি করবে? কোন্ মতলবে দু’শ টাকা ওকে দিয়েছে সে তো আর কারো কাছে ফাঁস করতে পারবে না। বোকা বনে নিজেই জ্বলবে। তার আগে আরো কিছু টাকা ট্যাকে গোঁজার মওকা পাবে রেশমা। চালিহা যা চায় সেটা কল্পনা করতে গিয়ে অনেক সময় যে কান-মাথা গরম হয়েছে, শেষদিন হেসে হেসে দুলারির কাছে রেশমা তাও স্বীকার করেছে। ও-চিন্তা মাথা থেকে ঝেঁটিয়ে তাড়িয়েছে।

বাপীভাইকে রসাতলে পাঠানোর প্ল্যান রেডি চালিহার। কাজ নিয়ে রেশমা পাহাড়ের বাংলোয় যাবে। দিনকতক বাদে তার বদলে বাপী তরফদার সেখানে টাকা নিয়ে যাবে। ওদের মেমসায়েবই তাকে যাতে পাঠায় সে-ব্যবস্থা চালিহাই করবে। ওকে জালে ফেলার মতো অমন মোক্ষম জায়গা আর নেই। সেখানে ঝগড়ু আছে, তাকে মদে ঠেসে রাখতে হবে। কিন্তু পরে যদি সে-ও আঁচ করতে পারে ব্যাপারটা, খুব ভালো হয়। রেশমা যেমন চালাক মেয়ে, একটু মাথা খাটালে সে-ব্যবস্থাও ও নিশ্চয় করে আসতে পারবে।

ওই আপনা-খাকী মেয়ের মাথায় তখনো কেবল মজাই নাচছে। এক কথায় রাজি। খরচার নাম করে আরো দু’শ টাকা আগাম ফাউ নিয়েছে। পাহাড়ে যখন নিজের নাগালের মধ্যেই পাবে বাপীভাইকে, তখন আর আবু সাহেব বা দুলারিকে বলা কেন—তার কাছেই ম্যানেজারের সব মতলব ফাঁস করে দেবে। বাপীভাইকে ও কি চোখে দেখে নিজে তো জানে—তার এক ফোঁটা ক্ষতিও কক্ষনো হতেই পারে না। সব বলে চালিহার দেওয়া চারশ টাকা বাপীভাইকে দেখাবে আর মালকানের সামনে এসেও সব কবুল করতে রাজি হবে।

পাহাড়ের বাংলোয় গিয়ে বাপীভাইয়ের অপেক্ষায় দিন গুনছে। রেশমা হেসে হেসে দুলারির কাছে স্বীকার করেছে, পাহাড়ে যাবার পর চালিহার মত লোকের চিন্তাটা আবারও মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে, আর ভাবতে মজা লাগলেও জোর করেই সেটা ঝেঁটিয়ে দূর করেছে। কিন্তু বাপীভাই আসতেই ও যেন আর এক মজার খোরাক পেয়েছে। দোষ বাপীভাইয়েরই। আগেও টের পেয়েছে, ওকে বিশ্বাস করে না। জঙ্গলে ওকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। ডাকলেও সাড়া দেয় না। এবারে ও আরো ভালো করে বুঝেছে, বাপীভাই আসলে ওকে ভয় পায়। এবারে পাহাড়ে আসতে রেশমার মনে হয়েছে, সেই ভয় যেন বাপীভাইয়ের কাঁধে ভূতের মতো চেপে বসেছে। কেবল কাজের কথা ছাড়া ওর সঙ্গে কথা বলে না, ওর দিকে তাকায় না, নিজের ঘরে বসে খায়। ফাঁক পেলে জঙ্গলে পালিয়ে যায়।

ক’দিন ধরে রেশমার মাথায় কেবল মজা গিসগিস করছে। বাপীভাইকে যা বলার পরে বলবে। যাবার আগে বলবে। তার আগে পর্যন্ত এইভাবেই চলুক। রেশমা নিজের মনে ছিল, আর চালিহার মতলবের কথা ফাঁস করলে বাপীভাইয়ের মুখখানা দেখতে কেমন হবে ভেবে ডবল মজা পাচ্ছিল।

ওখানকার কাজ শেষ বুঝে রেশমা সেদিন আড়াল থেকে নজর রাখছিল। পাহাড়ের ধারে জঙ্গলে এসে তাকে ধরেছে। কিন্তু পথের ওপর এমন বিমনা হয়ে বসেছিল বাপীভাই যে একটু পিছনে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে তাকে দেখে কিছুক্ষণ চোখ ফেরাতে পারেনি। শয়তান যে রেশমার দিকেই গুটি গুটি এগোচ্ছে রেশমা ভাবেইনি। ভাববে কি করে। ও তো এসেছে চালিহার মতলবের কথা ফাঁস করে দেবার জন্য!

কিন্তু ওর অজান্তে শয়তান ভর করেছে বলেই হয়তো খোদাতালাও নারাজ। নইলে বনমায়ার সেই পাগলা বুনো হাতি জঙ্গল ফুঁড়ে যমের মতো এসে হাজির হবে কেন। ওটাকে তেড়ে আসতে দেখেই রক্ত জল। ভয় পেয়ে বাপীভাই জঙ্গলের দিকে ছুটতে যাচ্ছিল। ও ধরে ফেলে পাহাড়ের দিকে টেনে নিয়ে না গেলে হয়েই গেছল। তাও প্রাণে বাঁচবে কি না কে জানে। তক্ষুনি মনে হয়েছে বাপীভাইয়ের মতো এত আপনার জন আর নেই, তাকে যেমন করে হোক বাঁচাতে হবে—হবেই। না পারলে নিজের জীবনও রাখবে না। আর বাপীভাইয়ের সেই মুখ দেখে মনে হয়েছিল, নিজের বুকটা দু’খানা করে খুলে তাকে তার মধ্যে পুরে নিয়ে পালানো সম্ভব হলে তাই করত। তাকে আগলে নিয়ে ফাঁড়া কাটিয়েছে শেষ পর্যন্ত। ফাড়া সত্যি কেটেছে কিনা বাপীভাই তখনো জানে না। আর ঠিক তক্ষুনি বোধ হয় শয়তানের দখলে চলে গেছে রেশমা। ফাঁড়া কেটেছে, খানিকক্ষণ পর্যন্ত বাপীভাইকে সেটা বুঝতে দেয়নি। তাকে আঁকড়ে রেখে আর এক পাথর থেকে অন্য পাথরে সরেছে।

…শয়তান রেশমাকেই ফাঁদে ফেলেছে। আসমানের চাঁদের লোভ দেখিয়েছে। সেই চাঁদ যেন হঠাৎ ওর হাতের মুঠোয়। না, চালিহার মতলব হাসিলের কথা আর তার মাথায়ও ছিল না। চালিহা জানবে না। দুনিয়ার কেউ কোনদিন জানবে না।

বাংলোয় ফেরার মধ্যে রেশমার সবটাই শয়তানের দখলে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। বাপীভাই ভয়ে ঘরে সেঁধিয়ে আছে। সেই ভয়ের খোল ছিঁড়ে-খুঁড়েই দেবে রেশমা আজ। ঝগড়ুকে মদে ডুবিয়ে দিয়ে এসে দেখে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। ক্ষিপ্ত হয়েই সে বন্ধ দরজায় ঘা দিয়েছিল।

দরজা খুলতে নির্লজ্জ বেহায়ার মতো আসমানের চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়েছিল রেশমা।

বাপীভাই সেই হাত দুমড়ে ভেঙে দিয়েছে।

রেশমার মাথায় দাউ দাউ আগুন জ্বলেছে তার পর থেকে। শয়তান সেই আগুন নিভতে দেয়নি। ওকে উল্টে পাগল করে তুলেছে। চরম প্রতিশোধ না নিতে পারা পর্যন্ত মাথার আগুন নিভবে না।

ভালো করে ফর্সা হবার আগে বেরিয়ে পড়েছে। ডেরায় তোরঙ্গটা রেখে সোজা চালিহার কাছে চলে গেছে। বলেছে, দু’হাজার টাকা দাও এবার।

চালিহা আনন্দে লাফিয়ে উঠেছে। কিন্তু রেশমার মুখ দেখে আবার খটকাও লেগেছে।—তোর এরকম মূর্তি কেন? বাপী তরফদার ফাঁদে পা দিয়েছে তো?

রেশমা বলেছে, না! কিন্তু না দিলেও তুমি এত বোকা কেন? এক ঝটকায় গায়ের জামা সরিয়ে পাহাড়ের সেই কাটা-ছেঁড়ার দাগ দেখিয়েছে।—এগুলো দেখেও তোমার শত্রু কিভাবে আমাকে শেষ করেছে বললে মালকান্ অবিশ্বাস করবে? তাছাড়া জিগ্যেস করলে ঝগড়ুও বলবে, ভোর হবার আগে আমি হেঁটে পালিয়ে এসেছি।

চালিহার ফর্সা মুখেও শয়তান হাসছে।—মালকানকে তুই নিজে গিয়ে বলবি?

—বলব। তার আগে তোমার কাছে নালিশ করেছি তাও বলব।

—কবে বলবি?

ও পাহাড় থেকে ফিরুক, তারপর বলব।

রেশমার মুখে সেই আগুন দেখে চালিহা বিশ্বাস করেছে। আর সেই প্রথম নিজের দুচোখেও গলগল করে লোভ ঠিকরেছে। ওর মাথাটা আদর করে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলেছে, তোর থেকে বেশি আপনার আর আমার কেউ না। নগদ টাকা হাতে নেই এখন, রাতে আসিস দিয়ে দেব।

রাতে এসেছে। আসবে না কেন, শয়তানের হাতে চলে গেলে আর কার পরোয়া? রাতে ডাকার অর্থ জেনেও এসেছে। এরপর আর কিছুই যায় আসে না। চালিহা ওকে দারুণ খাতির করেছে। কড়কড়ে টাকা ওর হাতে গুঁজে দিয়েছে। রেশমা মদ ঘৃণা করে, কিন্তু চালিহা আদর করে সেই মদও ওকে খাওয়াতে পেরেছে। তারপর নরকে ডুবেছে। নিজেকে ধ্বংস করতেই চায়। নিজেকে, সেই সঙ্গে আর একজনকে।

কিন্তু পরদিন সকালে সেই বাংলোয় বাপীভাইকে দেখে রেশমার বুকের তলায় হঠাৎ প্রচণ্ড মোচড় পড়েছে। প্রাণপণে তখন সেই শয়তানকেই আঁকড়ে ধরেছে সে। নিজেকে দ্বিগুণ হিংস্র করে তুলতে চেয়েছে।

বাপীভাই চলে যাবার পর চালিহা ওকে মালকানের কাছে ঠেলে পাঠাতে চেয়েছে। কিন্তু রেশমা আবার যেন পঙ্গু হয়ে পড়েছে। শয়তান তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করেও বাঘিনীটাকে আর বুকের মধ্যে ধরে রাখতে পারছে না। তবু অক্লান্ত চেষ্টা করছে। চালিহাকে বলেছে, আজ না, মালকানের কাছে কাল যাবে।

চালিহার সবুর সয় না।—কাল কেন? আজ নয় কেন?

রেশমা বলেছে, আজ রাতেও তোমার কাছে থাকব। তাড়া দিও না। আমার মন মেজাজ এখনো ভালো না।

চালিহা লোভের টোপ গিলেছে, আর তাগিদ দিতেও সাহস করেনি।

পরদিন সকাল থেকে রেশমা আরো গুম। শয়তানও ওর সঙ্গে শয়তানি করেছে। ওকে ছেড়ে চলেই গেছে। ভিতরের সেই বাঘিনীও উধাও। এদিকে চালিহারও তাগিদ বেড়েছে। ওকে মালকানের কাছে পাঠানোর জন্য ব্যস্ত।

ভেবেচিন্তে রেশমা একটা মতলব এঁটেছে। তাকেই ঢিট করার মতলব। চালিহাকে বলেছে, সকালে নয়, দুপুরে যাবে মালকানের কাছে। তখন তাকে নিরিবিলিতে পাবে। আর পরামর্শ দিয়েছে, তুমি সায়েব, পাহাড়ের বাংলোয় চলে যাও। আমি যা-ই বলি, ঝগড়ুকে মেমসায়েব জিজ্ঞাসাবাদ করবেই। আমার ব্যাপারে খোঁজ-খবর করার নাম করে তুমি আগেভাগে গিয়ে তার মগজে যা ঢোকাবার ঢুকিয়ে দিয়ে এসো। তারপর রাতে এসে মালকানকে যা বলার বোলো।

রেশমা জানে এই লোকের কোনো নোংরা কথা ঝগড়ু বিশ্বাস করবে না। তার নজরে বাপীভাইয়ের পাহাড়ের মতো উঁচু মাথা। রেশমার মতলব হাসিল হলে চালিহা উল্টে আরো বেশি নিজের কলে পড়বে।

দুপুরে রেশমা নিজের ডেরায় ফিরেছে। হারমা ঘরের সামনে বসে আছে দেখে বিরক্ত হতে গিয়েও ফিকফিক করে হেসেছে। কাছে এসে ওর ঝাঁকড়া চুল মুঠো করে ধরে মাথাটা ঝাঁকিয়েছে আর আদুরে গলায় বলেছে, আমার ওপর তোরা সব্বাই খুব রেগে গেছিস জানি। কিন্তু আজ থেকেই বুঝবি আমি কতো ভালো মেয়ে।

এ-কথা হারমাই পরে বলেছে দুলারিকে। দু’দিন ধরে রক্ত সত্যি টগবগ করে ফুটছিল হারমার। রেশমাকে নাগালের মধ্যে পেলে খুনই করে ফেলবে ঠিক করেছিল। কিন্তু তার কথা শুনে আর অত হাসি দেখে হারমা হকচকিয়ে গেছল। রাগও জল।

রেশমা তক্ষুনি হারমাকে ঠেলে পাঠিয়েছে দুলারিকে ডেকে আনার জন্য। এক্ষুনি আসতে হবে, খুব দরকার।

দুরাত ওই শয়তানের বাংলোয় কাটিয়েছে জানার পর দুলারি আর তার মুখ দেখবে ভাবেনি। কিন্তু ডাকছে শুনে না এসে পারেনি। ওই মুখপুড়ি যে কতখানি ওর, জানে বলেই ডেকেছে। তাছাড়া অনেক জানার আছে, অনেক বোঝার আছে। না এলে জানবে কি করে, বুঝবে কি করে?

এসেছে। দুলারিকে জড়িয়ে ধরে সে কি আদরের ঘটা ওর। আর সে কি হাসি! যেন দুনিয়া জয় করে ঘরে ফিরল। খুশি ধরে না। তেমনি হাসিমুখে ওর আদ্যোপান্ত সব বলল। শুনতে শুনতে দুলারি স্তব্ধ। কিন্তু ওর ভ্রূক্ষেপ নেই। শয়তান ওকে ছেড়ে গেছে। ভিতরের বাঘিনী পালিয়েছে। আর ওর কাকে ভয়? এবারে ওই ম্যানেজারকে জব্দ করার পালা। মোক্ষম জব্দই করবে। এমন জব্দ করবে যে দুলারি আবু সায়েব এমন কি বাপীভাইয়েরও ওর ওপর আর একটুও রাগ থাকবে না।

ও কি করবে বা কি মতলব এঁটেছে বার বার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও বলল না। হেসেছে আর মাথা নেড়েছে। সেটি হচ্ছে না। আগে থেকে জানা-জানি হলে সর্বনাশ। সব ভেস্তে যাবে। এত কাণ্ডর পর মেয়েটার মাথাই খারাপ হয়ে গেল কিনা দুলারি ভেবে পায়নি।…ওই চালিহাকে খুন-টুন করে বসে শেষে সব কবুল করার ফন্দি আঁটছে না তো? ও না পারে কি?

মোট কথা মেয়েটার অত হাসি দুলারির ভালো লাগেনি। তার ওপর দু’হাজার টাকার পুঁটলিটা তার হাতে দিয়ে কি করতে হবে বলতে আরো খটকা লেগেছে। কিন্তু ভাবার সময় পায়নি খুব। রেশমা আবার ঠেলে তুলে দিয়েছে ওকে। বলেছে, হারমার সঙ্গে ওর দরকারি কথা আছে, পরে দেখা হবে।

দুলারির দুশ্চিন্তা বেড়েছে আরো। ওই হারমার সঙ্গে জোট বেঁধে কিছু একটা করে বসার মতলবে আছে নাকি?

দুলারি চলে যেতে রেশমা বেরিয়ে এলো। হারমাকে বলল, তুই আর বসে আছিস কেন, ঘরে যা। আমার দরকারি কাজ আছে, এক্ষুনি বেরুবো।

হারমা গোঁজ হয়ে বসে থেকে জবাব দিয়েছে, আমার আর ঘর কোথায়। এ-কথা শুনে রেশমা নাকি হাসতে লাগল আর ওকে দেখতে লাগল। তার পর কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা আজ থেকে আমার এই ঘরই তোর ঘর। আবার ঘরে ঢুকে দুটো টাকা এনে ওর হাতে দিল—সমস্ত দিন খাওয়া হয়নি মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যা খেয়ে আয়—

হারমা তাও নড়ে না।

—অবাধ্য হলে রাগ করব বলে দিচ্ছি, যা চটপট খেয়ে আয়।

হারমা চলে গেল। কিন্তু আসলে কোথাও না গিয়ে একটু ঘুরে রেশমার ডেরার পিছনে এলো আবার। নিজের এত ভাগ্য বিশ্বাস করতে পারছিল না। রেশমা কোথায় বেরুবে, কি তার দরকারি কাজ না দেখে থাকে কি করে। তাছাড়া ওর সেই হাসিমুখ দেখেই ক্ষুধাতৃষ্ণা গেছে।

একটু বাদে রেশমা বেরুলো। কিন্তু হারমা ভেবে পেল না কোথায় চলল ও। রাস্তার দিকে নয়, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যে-দিকে চলেছে সে-দিকে তো সাপ-ঘর! ভয়ে ভয়ে হারমা অনেকটা ফারাক রেখে গাছের আড়ালে আড়ালে চলছে। দেখে ফেললে কি মূর্তি ধরবে সেই ভয় আছে।

বেশ দূরে একটা গাছের ওধারেই দাঁড়িয়ে গেল হারমা। সামনে আর গাছ নেই, আর এগোলে দেখে ফেলবে। বাঁশের বেড়া সরিয়ে রেশমা দাওয়ার দিকে এগলো। তারপর সামনের বড় সাপ-ঘরটার দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল।

এই ঘরে হঠাৎ কি দরকার পড়তে পারে রেশমার, হারমা ভেবেই পাচ্ছে না। পাহাড়ের বাংলো থেকে সাপের বিষ বার করা শিখে এসেছে, এ অনেকদিন আগে রেশমাই ওকে বলেছিল। সেই বিষ বার করতে গেল? বিষের নাকি অনেক দাম। কিন্তু বিষ দিয়ে রেশমা কি করবে? চুরি করে বিক্রি করবে? না কি কাউকে সাবড়ে দেবার মতলব!

ঝুপড়ির মুখ একটু একটু ফাঁক করে খুব বিষাক্ত সাপ টেনে বার করা জল—ভাত ব্যাপার। ভয়ের কিছু নেই। হারমা নিজেও পারে। অথচ কি একটা ভয় হারমার বুকের ওপর চেপে বসেছিল। রেশমা এত দেরি করছে কেন? তিন-পো ঘণ্টা পার হতে চলল—বেরিয়ে আসছে না কেন?

আর পারা গেল না। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল। পা টিপে দাওয়ায় উঠল। আস্তে আস্তে দরজাও ঠেলল। তারপর মেঝেতে ওই দৃশ্য দেখে একটা আর্তনাদ করে বাইরে ছুটল।

.

টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখল বাপী। রাত এগারোটা বেজে দশ। ঘুম এই রাতে আর আসবে মনে হয় না।…দু’হাজার টাকার সেই পুঁটলিটা ফেরার সময় বাপী ঊর্মিলার হাতে দিয়েছে। তার মাকে দিতে বলেছে। আর যা শুনেছে সব তাকে বলতে বলেছে। রণজিৎ চালিহাকে রেশমা মোক্ষম জব্দ করে গেল বটে। পাহাড় থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে অঘটনের খবর তার কানে গেছেই। তারপর সাহস করে সে আর পাশের বাংলোয় এসে গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে দেখা করেনি নিশ্চয়। কথার খেলাপ করে যে মেয়ে এ-ভাবে নিজের জীবন দিয়েছে, তার আগে হাটে হাঁড়ি কতটা ভেঙে দিয়ে গেছে কে জানে? দু’রাত পর পর ওই মেয়ে তার বাংলোয় কাটিয়েছে এও আর গোপন থাকবে না। আত্মঘাতিনী হবার ফলে ম্যানেজারের বাংলোয় রাত কাটানো নিয়েই সকলের বিকৃত জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। বাংলো থেকে নড়ার সাহস এই রাতে অন্তত চালিহার হবে না।

কিন্তু বাপী কি করবে এখন? টর্চটা হাতে করে রেশমার ডেরায় চলে যাবে? ওকে সেখানেই শুইয়ে রাখা হয়েছে এখন। আবু বসে পাহারা দিচ্ছে। সংস্কারবশে হারমার বাপ ধামন ওঝা সাপেকাটা মরাকে চব্বিশ ঘণ্টার আগে মাটি চাপা দিতে নিষেধ করে গেছে। যে মুখ চোখের সামনে থেকে সরানোই যাচ্ছে না, চুপচাপ বেরিয়ে গিয়ে বাপী আবুর সঙ্গে তার কাছে গিয়েই বসে থাকবে?

—বাপী সাব! বাপী সাব! বাপী সাব!

আচমকা চিৎকারে অন্ধকার রাতের স্তব্ধতা খান-খান হয়ে গেল। সুইচটা টিপে একলাফে বিছানা থেকে নেমে বারান্দার দরজা খুলে বাপী বেরিয়ে এলো। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কে। বারান্দার আলো জ্বালল।

রণজিৎ চালিহার কম্বাইন্ড হ্যান্ড অর্জুন। ভয়ার্ত মুখ। দু’চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। বেদম হাঁপাচ্ছে।

তার কথা শুনে বাপী কাঠ কয়েক মুহূর্ত। অর্জুন ঘুমোচ্ছিল। একটু আগে তার সায়েবকে সাপে কেটেছে। চিৎকার চেঁচামেচি করে কয়েকজন লোক জুটিয়ে সে সাইকেল নিয়ে এখানে খবর দিতে ছুটে এসেছে। মেমসায়েব তাকে জলদি গাড়ি বার করে বাংলোর সামনে দাঁড়াতে বলেছেন। তিনিও যাবেন

দু’মিনিটের মধ্যে গাড়ি নিয়ে বাপী পাশের বাংলোয় এলো। বারান্দায় গায়ত্রী রাই আর বিবর্ণ মুখে ঊর্মিলা দাঁড়িয়ে। গায়ত্রী রাই একাই নেমে এলো। ঊর্মিলার নড়াচড়ারও শক্তি নেই যেন। অর্জুন সাইকেল নিয়ে আগেই ছুটে বেরিয়ে গেছে।

রণজিৎ চালিহার শোবার ঘরে আট-দশজন লোক। প্রতিবেশী হবে। কিন্তু বাপী সব থেকে অবাক সেখানে হারমাকে দেখে। তার মুখে রক্ত। হাতে একটা ছোরা। সে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। দু’মিনিটের মধ্যেই মুখ ধুয়ে ফিরে এলো।

চালিহা বিছানায় পড়ে আছে। অত ফর্সা মুখ কালচে, বিবর্ণ। সেটা ভয়ে কি বিষে বাপী ঠাওর করতে পারল না। জ্ঞান আছে কি নেই তাও বোঝা যাচ্ছে না। সম্বিৎ ফিরতে হাত তুলে বাপী নাড়ী দেখল। পালস্ অস্বাভাবিক দ্রুত। হাঁটুর নিচে পায়ের পিছনে মাংসালো জায়গায় সাপে কেটেছে। হারমা কাছাকাছিই ছিল নাকি। অর্জুনের চেঁচামেচি শুনে ভিতরে ঢুকেছে। তারপর প্রাথমিক যা করার সে-ই করেছে। হাঁটুর ঠিক নিচে শক্ত বাঁধন দিয়েছে। আর হাঁটুর ছ’আঙুল ওপরে আর একটা। তার সঙ্গে ওই ছোরাটা ছিল। সেটা দিয়ে সাপে কাটা জায়গা আরো বেশি করে কেটে দিয়ে রক্ত বার করে দিয়েছে। একবারে বিষকালা রক্ত বেরিয়েছে গলগল করে। তারপর মুখ লাগিয়ে ও অনেকটা রক্ত টেনে এনেছে—বিষ কতটা বার করতে পেরেছে জানে না।

হারমা বিড়বিড় করে বলল, সায়েব ভয়ে ভিরমি খেয়েছে—আর ভয় নেই, বেঁচে যাবে।

চা-বাগানের হাসপাতালে খবর দেওয়া হয়েছিল। তাদের গাড়ি এলো, রণজিৎ চালিহাকে তুলে নিয়ে গেল।

তখন পর্যন্ত বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি বাপীর।…সাপের জায়গা, বাংলোয় সাপ ঢোকাটা আশ্চর্য কিছু না। কিন্তু ঢুকতে পারে না বড়। কারণ সব জানলাতেই পাতলা তারের জাল লাগানো থাকে। বাপী তিনটে জানলা চেয়ে চেয়ে দেখল। পায়ের দিকের জানলার জাল বেশ খানিকটা ছেঁড়া আর দুমড়নো। মাথায় রক্ত ওঠার দাখিল বাপীর। ঘরে তখন কেবল গায়ত্রী রাই আর সে। অর্জুন তার সায়েবের সঙ্গে হাসপাতালে। কাছে ডেকে বাপী গায়ত্রী রাইকে ছেঁড়া জালটা দেখালো। চাপা গলায় বলল, জাল কেটে কেউ ঢুকিয়ে না দিলে এ-ঘরে সাপ ঢুকতে পারে না।

গায়ত্রী রাই একটি কথাও বলল না। সমস্ত মুখ অদ্ভুত সাদা। তার হার্টের কথা চিন্তা করেই বাপী হাত ধরে বাংলো থেকে নামিয়ে গাড়িতে তুলল। সব কটা আলো জ্বালাই থাকল। বাপী বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।

গায়ত্রী রাই গাড়িতেও নির্বাক।

হেড লাইটের আলোয় বাপী দেখল, পঁচিশ-তিরিশ গজ দূরে একটা লোক শ্লথ পায়ে হেঁটে চলেছে। হারমা। লাইট দেখে সেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

তার সামনে এসে বাপী গাড়ি থামালো। হেড লাইট নেভালো। গায়ত্রী রাইকে বলল, একটু বসুন, আসছি।

নেমে এসে হারমাকে গাড়ি থেকে আট-দশ হাত দূরে গিয়ে ধরল। তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে চেয়ে রইল খানিক। হারমার ভাবলেশশূন্য মুখে শুধু রাজ্যের ক্লান্তি। চেয়ে আছে সে-ও।

—তুমি এত রাতে এদিকে এসেছিলে কেন?

হারমা নিরুত্তর।

—কি করছিলে?

নিরুত্তর।

বাপীর গলার স্বর কঠিন এবার।—আমাকে বিশ্বাস করে যা জিগ্যেস করছি জবাব দাও!

বিড়বিড় করে বলল, এদিকে এসেছিলাম।

—এত রাত্তিরে কেন এসেছিলে? তোমার সঙ্গে ওই ছোরা ছিল কেন? ঘোলাটে চোখে হারমা চেয়ে রইল খানিক।—দুশমনকে খতম করব বলে এসেছিলাম। ওই ছোরা দিয়ে খোদা তাকে বাঁচিয়ে দিল।

আর দু’চার কথায় ব্যাপারটা বুঝে নিল বাপী। রাতে সুযোগ না পেলে ভোরে বাংলোয় ডুকে সায়েবকে শেষ করার সংকল্প নিয়ে এসেছিল। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বাংলোয় ঢুকে দেখে আল্লা তাকে আগেই শাস্তি দিয়েছে। তক্ষুনি আল্লার ওপর ভয়ঙ্কর রাগ হয়ে গেল ওর—আল্লা রেশমাকে নিয়েছে। তাই খোদা এবারে যাকে মারতে গেল হারমা তাকে বাঁচিয়ে দিল। হঠাৎ বিষম রাগে ওই কালো দেহের ছাতি ফুলে উঠল, বলল, আমি ভুল করলাম, আবার বদলা নেব।

বাপী দেখছে ওকে। এবারে ঠাণ্ডা গলায় বলল, খোদা ওই সায়েবকে শাস্তি দেয়নি, জানলার জাল কেটে কেউ তার ঘরে সাপ ছেড়ে দিয়ে গেছে। তুমি? বিমূঢ় মুখে মাথা নাড়ল লোকটা। সে নয়। পরের মুহূর্তে কিছু মনে হতে চমকে উঠল যেন। সামলে নিয়ে আবার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।

—তুমি দেখেছ কাউকে?

মাথা নাড়ল, দেখেনি

—ভালো করে ভেবে দেখো। দেখেছ? কে এমন কাজ করতে পারে বলে তোমার মনে হয়?

হঠাৎ গলার স্বর গমগম করে উঠল ওর।—কিছু মনে হয় না। আমি জানি না। আমি কাউকে দেখিনি। হনহন করে হেঁটে চলল।

গাড়িতে ফিরে আসতে গায়ত্রী রাই জিজ্ঞাসা করল, লোকটা কে?

—হারমা। এক ওঝার ছেলে। রেশমাকে খুব ভালোবাসত।

—তাহলে ওরই কাজ?

বাপী জবাব দিল, না—মিস্টার চালিহাকে ও-ই বাঁচিয়ে দিল ভেবে এখন পস্তাচ্ছে।

বাকি রাতটুকু দু’চোখের পাতা আর এক করা গেল না। খুব ভোরে বাপী গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। গা-জুড়নো ঝিরঝিরে ঠাণ্ডা বাতাস। পাশে বসন্তের রং—ছোপানো বানারজুলির জঙ্গল। বনমায়া নেই। রেশমা নেই। এই বাতাস আর এই বসন্ত বিদ্রূপে ঠাসা এখন।

সাপে কাটা রোগী হামেশাই আসে এখানকার হাসপাতালে। তাই চিকিৎসার ব্যবস্থাও ভালো। রণজিৎ চালিহাকে কেবিনে রাখা হয়েছে। এত সকালে বাপী তাকে দেখতে আসেনি। খবর নিতে এসেছে। মেট্রনের কাছ থেকে খবর পেল ভালো আছে। তবে জ্বর খুব। এমনি ছোরা দিয়ে ক্ষত জায়গা কেটে দেওয়ার দরুন অ্যান্টিটিটেনাস দিতে হয়েছে। প্রাণের ভয় নেই আর, কিন্তু প্রচণ্ড রকমের নার্ভাস শকের দরুন পেশেন্ট খুবই কাহিল। যে লোকটা ক্ষত জায়গা কেটে বিষরক্ত বার করে দিয়েছে আর জায়গামতো দু-দুটো বাঁধন দিয়েছে তার খুব প্রশংসা করেছে ডাক্তাররা।

গাড়িতে ফিরে এলো। এক জায়গায় এসে জঙ্গলের ধারের রাস্তায় গাড়ি থামালো আবার। এখান থেকে জঙ্গলের পথে আবুর ঘর দূরে নয় খুব।

দুলারি দাওয়ায় দাঁড়িয়ে। দূর থেকে বাপীকে দেখল। চোখে একবারও পলক পড়ল না। নিশ্চল পাথর-মূর্তি।

বাপী ওর কাছে দাওয়ার সামনে দাঁড়ালো। এ-ও সমস্ত রাত ঘুমোয়নি বোঝা যায়। এই চোখে গতকালের মতো আগুন ঠিকরোচ্ছে না এখন। পাথর-মূর্তির মতো শুধু অপলক। অনেকটা হারমার মতো ভাবলেশশূন্য।

সাদামাটা সুরে বাপী জিগ্যেস করল, আবু রাতে ঘরে ফেরেনি তো?

মাথা নাড়ল। ফেরেনি।

জানা কথাই। গতকাল বিকেল থেকে রেশমার ডেরায় আছে। মাটি না দেওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। বাপী দুলারির কাছেই এসেছে। কিছু বলতে নয়, শুধু দেখতে। দেখছেও। অনেক কাল আগের সেই দুলারিকে মনে পড়ছে। যখন রেশমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সাপ খেলা দেখাতো, গাল ফুলিয়ে সাপের বাঁশি বাজাতো, হাঁটু মুড়ে বসে সামনের ফণা-তোলা সাপের মতোই সামনে পিছনে কোমর বুক মাথা দোলাতো আর বার বার মাটিতে হাত পেতে দিয়ে ছোবল পড়ার আগেই পলকে সে হাত টেনে নিয়ে সাপকে উত্তেজিত করত। বাপী তখন রেশমার থেকে সেই দুলারিকেই ঢের সাংঘাতিক মেয়ে ভাবত।

এতকাল বাদে আজ আবার সেই দুলারিকেই দেখছে বাপী। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে শুধু দেখাটা বিসদৃশ। বলল, এ-দিকের ব্যাপার তো শুনেছ?

দুলারি চেয়েই আছে। এখনো জিজ্ঞেস করল না কি ব্যাপার বা কি শুনবে।

—কাল রাত এগারোটা নাগাদ রণজিৎ চালিহাকে খুব বিষাক্ত সাপে কেটেছে।…ওর চাকর এসে খবর দিতে আমি আর তোমাদের মেমসায়েব তক্ষুনি গেছলাম। চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলছে বাপী। জানলার জাল কেটে কেউ ঘরে সাপ ছেড়ে দিয়ে গেছে। খুব বরাত ভালো লোকটার…ওই হারমার জন্যেই বড় বাঁচা বেঁচে গেল।

যা দেখার এবারে নির্ভুল দেখল বাপী। ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে সোজা হয়ে দাঁড়াল দুলারি। মুহূর্তের মধ্যে চোখে সেই আগুন নেমে এলো। এই শেষের খবরটাই যেন সর্বাঙ্গ ঝলসে দিয়ে গেল ওর—হারমার জন্য বেঁচে গেল! হারমার জন্য! ও কি করেছে?

বাপী বলল কি করেছে।

—হারমা! হারমা এই কাজ করল! হারমা ওই শয়তানকে বাঁচিয়ে দিল! বাপীর নির্লিপ্ত মুখ। গলার স্বরও ঠাণ্ডা।—তুমি তাহলে জানতে চালিহা সাহেবকে সাপে কাটবে?

সেই ছেলেবেলা হলে এই চাউনি দেখেই বাপী হয়তো ভয়ে তিন পা সরে যেত।

—হ্যাঁ, জানতাম। তুমিও বুঝেছ বলেই এত সকালে এখানে ছুটে এসেছ, তাও তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছে। তোমার বন্ধুও শোনামাত্র বুঝবে। কিন্তু আমায় কে কি করবে? কে ছেড়েছে বলার জন্য ওই সাপ ফিরে আসবে, না তার গায়ে আমার হাতের দাগ থাকবে? ওই হারমাকে আমি দেখে নেব, বুঝলে? আর রেশমাকে যে শেষ করেছে, এবার প্রাণে বাঁচলেও সেই শয়তানকে আমি আর বেশিদিন এই বানারজুলির বাতাস টানতে দেব ভেবেছ?

এবারে চাপা ধমকের সুরে বাপী বলল, এখন মাথা খারাপ করবার সময় নয়—যা বলি শুনে রাখো। কটা দিন এখন মুখ সেলাই করে থাকবে। হারমাকে একটি কথাও বলবে না, আবু যা বোঝার বুঝুক, নিজে থেকে তুমি কিছু বলবে না। নিশ্চিন্ত থাকো, যাকে সরাতে চাও এবারে সে নিজেই সরবে—বানারজুলির বাতাস বেশিদিন তাকে নিতে হবে না।

.

পরের পাঁচ-ছ’দিনের মধ্যে বাপী আর একবারও হাসপাতালে যায়নি। গায়ত্ৰী রাই রোজ একবার করে গেছে। কিন্তু তিন মিনিটও থাকেনি। দেখেই চলে এসেছে। সেদিন ঊর্মিলা সঙ্গে ছিল। সে এসে বাপীকে খবর দিল, আংকল তার কথা শোনার জন্য মাকে বার বার বলছিল। পরে মায়ের মুখে শুনেছে, রোজই বলে তার নাকি অনেক কথা বলার আছে। সেদিন মা তাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, তারও অনেক কথা শোনা হয়ে গেছে—কিন্তু আপাতত তার কারো কোনো কথা শোনার ইচ্ছে নেই। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই আংকল যেন এখন আসাম চলে যায়। পরের কথা পরে।

শুনে আংকলের মুখ আমসি একেবারে।

বাপী হাসপাতালে তার কেবিনে এলো আরো দু-দিন বাদে। বিকেলে। পরের দিন সকালে সে নিজের বাংলোয় আসছে শুনেছে।

বেড-এর মাথার দিকে পিঠে ঠেস দিয়ে বসেছিল, ওকে দেখেই রণজিৎ চালিহা অন্যদিকে মুখ ফেরালো। অনেক দিন বাদে সেই ওপরওয়ালার গাম্ভীর্য আর বিরক্তি টেনে আনার চেষ্টা। কিন্তু মুখ দেখে বাপীর মনে হল এই কদিনে লোকটার দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে।

চেয়ারটা টেনে নিয়ে বাপী পাশে বসল।—কাল বাংলোয় ফিরছেন শুনলাম?

চালিহা তার দিকে ফিরল। ক্রূর সন্দিগ্ধ চাউনি।—তোমার কি ধারণা হাসপাতালেই থেকে যাব?

—না। তারপর আপনি আসাম যাচ্ছেন কবে?

পিঁজরায় পোরা হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল রণজিৎ চালিহা।—সে খোঁজে তোমার কি দরকার? আমার ঘরের জানলার জাল কেটে সাপ ঢোকানো হয়েছে…এ খবরটা জানা আছে?

—আছে।

—কে করেছে এ কাজ? এত সাহস কার?

—জানি না।

—কিন্তু আমি জানব! আমি তার টুটি টিপে ধরব—বুঝলে?

—চেষ্টা করে দেখুন। আমার আপত্তি নেই।

সন্দিগ্ধ দুই চোখ মুখের ওপর থমকে রইল একটু।—তুমি আপত্তি করার কে?

—আপনার সঙ্গে ফয়সালা এরপর আমার হবে ভেবেছিলাম। আপনি এ চেষ্টায় এগিয়ে এলে তার আর দরকার হবে না। রেশমা কেন নেই কারো জানতে বাকি নেই। আপনি যাদের খুঁজছেন তারা এখনো আপনার ঘরে ফেরার অপেক্ষায় আছে। আমি বাধা না দিলে তাদের সুবিধে।

রাগে কাঁপছে লোকটা। কিন্তু বাপী জানে আসলে ত্রাসে কাঁপছে। জালে-পড়া জানোয়ারের ত্রাসে রাগের ঝাপটাই বড় হয়ে ওঠে।—তুমি তাহলে আমাকে ভয় দেখাতে এসেছ, কেমন?

—শুনুন! এবারে ঠাণ্ডা কঠিন গলায় বাপী বলে গেল, মিসেস রাইয়ের অনেক ধৈর্য…মাত্রা ছাড়িয়ে ড্রিঙ্ক করে বৃষ্টির পাহাড়ী রাস্তায় তাঁর স্বামীর জিপ—অ্যাকসিডেন্ট করাটা আর তার আগে আপনার সেই জিপ থেকে নেমে যাওয়াটা তিনি খুব সাদা চোখে দেখেননি। তবু এত ধৈর্য যে আপনাকে তিনি এ পর্যন্ত বরদাস্ত করে এসেছেন। তাঁর কাছে এতদিন থেকে আমিও কিছু ধৈর্য শিখেছি। নইলে এবারে যে ষড়যন্ত্রে আপনি নেমেছিলেন, তার জবাব আমারই দেবার কথা। কিন্তু কাল আপনার ঘরে ফেরার পর থেকে আমারও ধৈর্যের মেয়াদ আর তিন দিন। হাতে গুনে তিনটি দিন। সেই তিনদিনের জন্য আপনার জীবনের দায়িত্ব আমি নিলাম। কিন্তু তারপর আপনাকে আর এই বানারজুলিতে দেখা গেলে আমার আর কোনো দায়িত্ব থাকবে না।

চালিহার সমস্ত মুখ এখন পাংশু বিবর্ণ

বাপী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো।

বাংলোর বারান্দায় মা-মেয়ে বসে। গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে বাপী নামল। বারান্দায় উঠে সামনের চেয়ার টেনে বসল। গায়ত্রী রাই জিগ্যেস করল, পাঁচটার আগেই আপিস ছেড়ে হুট করে কোথায় চলে গেছলে?

—হাসপাতালে। চালিহার কাছে।

আজ আর মিস্টার বা সাহেব জুড়ল না, ওই কানে তাও ধরা পড়ল মনে হল। তার দিকে চেয়ে একটু অপেক্ষা করল।—কেন? কি কথা হল?

বাপী শান্তমুখে জানালো কেন, বা কি কথা হল। কিছুই গোপন করল না।

ঊর্মিলার চোখে-মুখে চাপা উত্তেজনা। কিন্তু গায়ত্রী রাই বিরক্ত হঠাৎ।—কেন তুমি আগবাড়িয়ে এ-সব বলতে গেলে? সে আসাম চলে গেলে পরে ব্যবস্থা আমিই করতাম। এখন গোঁ ধরে যদি না যায়?

বাপী তেমনি নির্লিপ্ত, নিরুদ্বিগ্ন। ঠাণ্ডা স্পষ্ট জবাব দিল, না যদি যায়, আপনি আমার নামে কুকুর পুষবেন।

গায়ত্রী রাই চেয়ে রইল। তার মেয়েও নতুন মুখ দেখছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *